কথা রাখা

কথা রাখা

ওরা পাঁচ বন্ধু। সুমন, আখতার, কাবুল, প্রিয়তোষ আর বিনায়ক। সকলেই খড়গপুর আই আই টি-র ছাত্র। ওরা এসেছে নানান জায়গা থেকে। সুমন বর্ধমানের ছেলে, আখতার হুগলির, কাবুলের বাড়ি পাটনায়, প্রিয়তোষের বাড়ি আগরতলায় আর বিনায়কের বাড়ি হল বীরভূম জেলায়।

আই.আই.টি.-তে ওদের এখন দ্বিতীয় বছর। পাঁচজনের মধ্যে খুব ভাব, অনেকে ওদের পঞ্চপাণ্ডব বলে ঠাট্টা করে। ওরা অবিশ্যি এসব ঠাট্টা বিদ্রূপ গায়ে মাখে না। তবে ওদের পাঁচজনেরই শক্ত সমর্থ চেহারা, সাত-আটজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার ক্ষমতা ওরা রাখে, তাই ওদের বেশি ঘাঁটাতে সাহস করে না অন্য ছাত্ররা। দু-এক বার হাতাহাতি হয়েও গেছে কয়েক জনের সঙ্গে। তারা ওদের ওজন ঠিকমতো বুঝতে পারেনি, গায়ে পড়ে লাগতে এসেছিল, তারপর বেদম পিটুনি খেয়ে শিক্ষা হয়েছে। সেই ঘটনা জানাজানি হবার পর অন্যরা সাবধান হয়ে গেছে।

লেখাপড়ায় কিন্তু ওরা পাঁচজনই ভালো, নইলে আই আই টি-তে পড়বার সুযোগই বা পাবে কেন! সবচেয়ে মজার কথা, ওদের পাঁচজনের চিন্তাভাবনায় অমিলই বেশি, কিন্তু মনের মিল দারুণ।

ওরা নিজেদের মধ্যে একটা নিয়ম চালু করেছিল। বছরে একদিন ওরা একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করবে, আর কেউ থাকবে না সেখানে। দিনটা ওরাই ঠিক করবে। সে খাওয়া হবে ছোটোখাটো একটা ভোজ। ক্যাম্পাসের বাইরে কোনো রেস্তোরাঁ বা হোটেলে ওরা মিলিত হবে বছরে মাত্র একদিন, তাই হস্টেলের তত্ত্বাবধায়ককের অনুমতি পেতে অসুবিধে হয়নি।

এমন করে কয়েকটা বছর কেটে গেল। ওরা সবাই পাশ করে বেরুলো। তারপর কর্মসূত্রে ছড়িয়ে পড়ল নানান জায়গায়। সুমন চাকরি পেল ব্যাঙ্গালোরে, আখতার পুনায়, কাবুল দিল্লিতে, প্রিয়তোষ কলকাতায় আর বিনায়ক দুর্গাপুরে। সবাই ইঞ্জিনিয়ার। আখতার যোগ দিল মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে। পুনায় প্রথম পোস্টিং (তখনও ‘পুনে’ নাম হয়নি)।

ছাড়াছাড়ি হবার আগে ওরা পাঁচজন হাতে হাত রেখে শপথ করেছিল যেখানেই থাকুক না কেন, বছরের নির্দিষ্ট একটা দিনে যেমন করেই হোক ওরা খড়গপুরে আসবে, একটা হোটেলে উঠবে। সেখানে রাত্রে একজনের ঘরে বসবে ভোজের আসর।

এটারও একটা নিয়ম হল। প্রথম বার ভার নেবে সুমন। সে সবাইকে দিনক্ষণ জানিয়ে চিঠি দেবে। এমনভাবে দিনটা ফেলা হবে যাতে সকলের সুবিধে হয়। যেমন আগে পিছে ছুটি পড়েছে, এমন একটা দিন, নইলে পর পর দু-দিন ছুটি এমন দিন। যত কাজই থাকুক না কেন তাদের আসতেই হবে, এর নড়চড় হবে না। হোটেলে সবার হয়ে সুমন ঘর ভাড়া নেবে আর তার ঘরেই বসবে আসর। অবিশ্যি সবাই সমানভাবে বহন করবে খরচ।

দ্বিতীয় বছর এ ভার পড়বে আখতারের ওপর। তারপর কাবুল, প্রিয়তোষ আর বিনায়কের পালা। ঘুরে ফিরে প্রত্যেককেই দায়িত্ব নিতে হবে।

ওটা আসলে ওদের পুনর্মিলন। ওই দিনটিতে ওরা খানা-পিনা আর গল্পগুজবে উচ্ছল হয়ে উঠবে। বছরে এক বার এই মিলনের জন্য উৎসুক হয়ে থাকে ওরা।

পাঁচ বছর কেটে গেছে। ওদের বয়স বেড়েছে, কিন্তু মনের মিল ঠিক একই আছে। এই পাঁচ বছরে ওদের এই নিয়মের এক বারও ব্যতিক্রম হয়নি। তা ছাড়া টেলিফোনে যোগাযোগ তো আছেই। ওদের মধ্যে সুমন, কাবুল আর প্রিয়তোষ বিয়ে করেছে। আখতার আর বিনায়ক দু-জনেই এখনও অকৃতদার।

এ বছর আবার সুমনের পালা, এই নিয়ে দ্বিতীয় বার। ও দিনক্ষণ জানিয়ে সবাইকে চিঠি দিয়েছে। এই ভোজসভায় কিন্তু ওরা পাঁচজন ছাড়া আর কারও উপস্থিত থাকার নিয়ম নেই, এমনকী ওদের বউদেরও নয়। এটা এক অলিখিত চুক্তি।

কাবুল, প্রিয়তোষ আর বিনায়ক একই জায়গায় আছে, একমাত্র আখতারের স্থান পরিবর্তন হয়েছে, ও এখন আছে কাশ্মীরে।

সেটা ছিল ইং, ১৯৬৫ সাল। সেপ্টেম্বর মাস। ওখানে চলছে সামরিক শাসন।

হঠাৎই দু-দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেল, উপলক্ষ্য কাশ্মীর। আখতার ছাড়া বাকি চার জন নির্দিষ্ট দিনে এসে পড়ল খড়গপুরে। ওই হোটেলে এতদিনে ওরা খুব পরিচিত হয়ে গেছে।

শনিবার সন্ধ্যায় ওরা এসেছে। রবিবার রাত্রে ওদের ভোজের আসর। সোমবার ছুটি, সেদিনই ওরা হোটেল ছাড়বে। সুমন আর কাবুল কলকাতা হয়ে বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে যাবে। প্রিয়তোষ কলকাতাতেই থাকে আর বিনায়ক হাওড়া থেকে ট্রেন ধরবে। সমস্যা আখতারকে নিয়ে, ও জানিয়েছে এখন যুদ্ধের মধ্যে ছুটি পাবার সম্ভাবনা নেই, তবুও চেষ্টা করবে যাতে রবিবার এসে সোমবারই ফিরে যেতে পারে।

এক বছর পরে বন্ধুদের দেখা। শনিবার রাতটা গল্পগুজব করে কেটে গেল। আই আই টি-তে থাকার সময় পুরোনো সব ঘটনার কথা মনে করে ওরা হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। আখতার ভূতে বিশ্বাস করে না, সেই আখতারকে ওরা একবার ভূতের ভয় দেখিয়েছিল। ভীষণ ভয় পেয়েছিল আখতার, সেই ঘটনা মনে করে খুব হাসছিল ওরা।

যুদ্ধের কথাও হচ্ছিল। হঠাৎ ওরা শুনল বেতারে যুদ্ধের খবরে বলছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের মধ্যস্থতায় দু-পক্ষই অস্ত্র সংবরণ করতে রাজি হয়েছে।

ওরা চারবন্ধু ‘হুররে’ বলে লাফিয়ে উঠল, কেই-বা যুদ্ধ চায়। আখতারও হয়তো এবার আসতে পারবে।

শনিবারের রাত আর রবিবারের দিন কেটে গেল।

রবিবারের সন্ধ্যায় সুমনের ঘরে ওরা আসর জমিয়ে বসেছে। পাঁচজনের জন্য স্পেশাল ডিনারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে, সঙ্গে আছে দামি পানীয়। আজ ওরা সারারাত ফুর্তি করবে। যুদ্ধ বিরতিকে সম্মান জানাবে সকলে।

রাত সাড়ে-আটটায় ওদের ডিনার সার্ভ করার কথা, কিন্তু আখতারের দেখা নেই। ও নিশ্চয়ই ছুটি পায়নি। না পাওয়াই স্বাভাবিক। বেতারে গত রাত্রে যুদ্ধ বিরতির কথা ঘোষণা করেছে, তাই বোধ হয় ও ছুটির দরখাস্ত করার সময় পায়নি। ওদের মন খারাপ হয়ে গেল। এই প্রথম ওদের পাঁচজনের একজন পুনর্মিলন সভায় নেই।

ঠিক তখুনি দরজার কলিং বেলটা বাজল। সুমন উঠে দরজা খুলল আর সঙ্গেসঙ্গে আনন্দে লাফিয়ে উঠল আখতার দাঁড়িয়ে আছে। ওর গায়ে সামরিক পোশাক, ও এখন লে কর্নেল। ওকে যুদ্ধে অংশ নিতে হয় না, কিন্তু রণাঙ্গনেই এখন ওর কাজ। সেনাবাহিনীর চলাচলের জন্য সড়ক সেতু বা ব্রিজ তৈরি থেকে শুরু করে নানারকম কনস্ট্রাকশনের কাজের দায়িত্ব ওর ওপর। গোলাগুলির মধ্যেও অনেক সময় প্রাণ হাতে নিয়ে ওই সব কাজ দেখাশোনা করতে হয় ওকে।

আখতারের মুখেও ফুটে উঠল এক টুকরো হাসি, তারপর ও এগিয়ে গেল। ওর সব বন্ধুরা উঠে দাঁড়িয়েছিল। ও সকলকে আদাব জানালো, তারপর ওর জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসল।

শুরু হল যুদ্ধের আলোচনা। ওকে সবাই যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করছিল। আখতার কিন্তু কথা খুব কম বলছে, মাথা নেড়ে কিংবা হ্যাঁ হু, করে জবাব দিচ্ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব ক্লান্ত, মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ঠান্ডা আর ঢুলু ঢুলু।

সুমনই বলল, ‘ওকে বিরক্ত করার দরকার নেই, ও যে আসতে পেরেছে এটাই আমাদের সৌভাগ্যের।’

ইতিমধ্যে হোটেলের বয়রা ট্রলি করে খাবার এনে একটা বড়ো টেবিলে সাজিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেক বছরই ওরা তাই করে আর জানে খাবার সময় ওরা একলা থাকতে চায়, কারও থাকার দরকার নেই।

সবাই খাওয়া শুরু করল। আখতার কিন্তু কাঁটা-চামচ নিয়ে খাবার দাবার নাড়াচাড়াই করল বেশি, খেল সামান্যই, বলল, খিদে নেই, ওর শরীর ভালো নয়। পর পর কয়েকটা রাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি।

ওকে কেউ পীড়াপীড়ি করল না। ওকে কেমন যেন অসহায় মনে হচ্ছিল, ওদের মায়াই হচ্ছিল ওর জন্য। যুদ্ধের সময় বেচারার হয়তো খুব পরিশ্রম হয়েছে, ঘুম তো দূরের কথা, খাওয়া-দাওয়ারও বোধ হয় সময় পেত না।

ওদের খাওয়া শেষ হতেই আখাতার উঠে পড়ল, বলল, ও শুয়ে পড়বে, ওর শরীর আর বইছে না। তা ছাড়া কাল খুব ভোরেই ওকে বেরিয়ে পড়তে হবে।

ওরা চার বন্ধু ওকে ঘর পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ওর এখন একটা লম্বা ঘুম দরকার। আখতার শুয়ে পড়ার পর ওরা খাবার টেবিলে এসে বসল। হোটেলের বয়রা এসে চটজলদি সব পরিষ্কার করে দিয়ে গেল।

এত তাড়াতাড়ি ওরা শুতে চায় না কিন্তু আসর আগের মতো জমল না। আখতারের পাণ্ডুর ক্লান্ত মুখ বার বার ভেসে উঠছিল ওদের চোখের সামনে। ওদের মধ্যে আখতারই বেশি হাসিখুশি ছিল।

আরও এক ঘণ্টা কেটে গেল। বেতারে খবর শুরু হল, সেটাই আজ রাতের শেষ খবর। ওরা অন্যমনস্কভাবে শুনছিল। ঘোষক আরেক বার যুদ্ধ বিরতির খবর জানিয়ে বলল, ‘গভীর দুঃখের সঙ্গে জানানো হচ্ছে, যুদ্ধ বিরতির মাত্র এক ঘণ্টা আগে শত্রু পক্ষের গোলার আঘাতে এখানকার মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের কর্নেল আখতার হোসেনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি ছিলেন এক সৎ এবং নির্ভীক অফিসার। যুদ্ধের গোলা বর্ষণের মধ্যেও দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন অটুট। তাঁর মরদেহ তাঁর দেশের বাড়িতে উপযুক্ত সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হবে।’

চার বন্ধুদের মুখে কথা নেই। তারা যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। এ কী শুনলো তারা। তবে যে এসেছিল সে কে!

কথাটা ভাবতেই ওদের সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল।

সুমনই ওদের নিয়ে আখতারের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে ঘরের দরজাটা খুলল ওরা।

ঘরে আলো জ্বলছে, কিন্তু শয্যা খালি। ওরা ঘরে ঢুকল, কেউ নেই, বাথরুমেও না।

সুমনের চিঠি আখতার ঠিক সময়েই পেয়েছিল, কিন্তু ও আসতে পারেনি। তাই প্রতিশ্রুতি রাখার জন্য ওর আত্মা এসেছিল, কথার খেলাপ করার মতো মানুষ ছিল না আখতার। এটাই মনে হল ওদের।

কিন্তু আরও চমক অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য। আখতারের শয্যা খালি, কিন্তু বিছানা থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে। দীর্ঘ পরিশ্রমে ক্লান্ত কেউ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার সময় তার যেমন বড়ো বড়ো নিশ্বাস পড়ে তেমন একটা শব্দ ভেসে আসছে বিছানা থেকে। যেন এক বিদেহী আত্মা পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে।

চার বন্ধু হাঁটু গেড়ে বসল খাটের পাশে, তারপর প্রার্থনা করতে লাগল বন্ধুর আত্মার সদগতির জন্য। ওদের চার জনের চোখের কোল বেয়ে নেমেছে অশ্রুর ধারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *