আসামী হাজির – উপন্যাস – বিমল মিত্র
‘আসামী হাজির’ প্রসঙ্গে – যজ্ঞেশ্বর রায়
১৯৭১-এর নভেম্বর থেকে “আসামী হাজির” সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। সেই থেকে শুরু করে ১৯৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত আগাগোড়া আমি ছিলাম উপন্যাসখানির নিয়মিত পাঠক। পড়তে পড়তে এই দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি যে কত অনায়াসে বিমল মিত্রের কলমে একটি Positive good man জীবন্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য এ-ধরনের চরিত্র-চিত্ৰণ তার হাতে এই প্রথম নয়। তাঁর প্রথম উপন্যাস –সাহেব বিবি গোলাম-এ, যে বই থেকে তার খ্যাতির জয়যাত্রা শুরু, তার ভূতনাথ চরিত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি উপন্যাসে নানা নামে নানা বেশে এই সক্রিয় ভাল মানুষটির আনাগোনা আমরা দেখেছি। আসলে প্রতিবাদের এই বলিষ্ঠ কণ্ঠ লেখকের মধ্যে সর্বদাই মুখর। হতাশা, গ্লানি অন্যায়কে তিনি নির্দয় ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেন, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন আমাদের সমাজ-জীবনে রাষ্ট্রে কত দুর্নীতি দুরাচার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে; কিন্তু শুধু ওই দিকটা দেখিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হন না তিনি। আলোর দিকেও তার চোখ আছে। সবাই যখন অন্ধকারের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করছে তিনি তখন দু’হাত প্রসারিত করে ধরেছেন আলোর উদ্দেশে। পরম নৈরাশ্যের মধ্যে এমন করে তিনি বিশ্বাসের প্রদীপটি তুলে ধরেন যে, তাকে সেই মুহূর্তেই মনে হয়, তিনি মানুষের একজন চিরকালের অকৃত্রিম বন্ধু। জনতার কাছ থেকে জনপ্রিয়তার শিরোপা তাই তো তিনি এমন অনায়াসে অর্জন করেছেন।
আজ যখন অন্যান্য সাহিত্যরথিগণ অন্ধকারকেই আমাদের অনিবার্য নিয়তি বলে বলছেন তখন বিমল মিত্রের এই আলোর দিকে, বিশ্বাসের দিকে প্রসারিত অতন্দ্র দৃষ্টিকে আমরা ক্রমশই আরো প্রখর হয়ে উঠতে দেখছি; দেখছি যে –’ভাল মানুষ’ চরিত্রগুলো এতদিন অসহায় বিভ্রান্ত মানুষগুলোর পাশে পাশে প্রদীপ হাতে নিয়ে তাদের আলো দেখিয়ে চলত সেই সীমিত ও খণ্ডিত চরিত্রগুলো ক্রমশঃ অখণ্ড ও সম্পূর্ণ হতে চেয়ে তার উপন্যাসে নায়কের ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। যেমন –রাজাবদল-এর গৌর পণ্ডিত মশাই, –শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন-এর লোকনাথ এবং আলোচ্য উপন্যাসের সদানন্দ।
Positive good man-কে নায়ক করে উপন্যাস লেখা, দস্তয়েফস্কি বলেছেন, সব চেয়ে কঠিন কাজ। এ কাজে যিনি সফল হন তিনি শ্রেষ্ঠ শিল্পী। শিল্পীর এই শ্রেষ্ঠত্ব বোঝা সহজ নয়। –On the Modern Element in Literature’ গ্রন্থে Mathew Arnold বলেছেনঃ
And everywhere there is connexion, everywhere there is illustration : no single event, no single literature, is adequately comprehended except in relation to other events, to other literature.
ম্যাথু আরনল্ড-এর এই উক্তির তাৎপর্য আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি “আসামী হাজির” পড়তে পড়তে। আমার কেবল মনে হয়েছে Positive good man সম্পর্কে আগে থেকে পাঠকের যদি যৎকিঞ্চিৎ ধারণা তৈরি না থাকে তো “আসামী হাজির”-এর নায়ককে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। একটা নেলা-ক্ষেপা বোকা-পাগলা মানুষের অধিক বড় জোর একজন ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ বলে মনে হবে তাকে। এই এলোমেলো চরিত্রটির যে। একটা “grotesque beauty”–একটা রহস্যময় খেয়ালী সৌন্দর্য আছে, তা না বোঝাই থেকে যাবে। সদানন্দের চেয়ে উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্ররাই তখন মনে ছাপ ফেলবে বেশী করে; এমন দুরূহ শিল্পকৃতিত্বের কিছুই পাঠক বুঝতে পারবেন না।
Positive good man-কে সম্যক আয়ত্ব করতে অনেক লেখকই পারেন নি। Positive good man বলতে সব আগে আমাদের মনে পড়বে চৈতন্যদেব অথবা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে। ইওরোপের খৃশ্চিয়ান জগৎ একবাক্যে স্মরণ করবেন যীশুকে। কিন্তু এই মহামানবদের আদলে চরিত্র আঁকতে চাইলে তা হয়ে যাবে মহামানব নিয়ে উপন্যাস, তা আর তখন রস-সাহিত্য হবে না। দস্তয়েফস্কি বলেন, রসসাহিত্যের কাজ সাধারণ মানুষের। মধ্যে থেকে সাধারণ নয় এমন একটি মানুষকে উপস্থিত করা। সে হবে শিশুর মতন সরল, পবিত্র এবং স্বভাবতই সৎ অথচ সে থাকবে (যেহেতু মহামানব নয়) –Screened with human weakness. পাঠক তার সম্পর্কে যত জানবেন ততই তার আত্মীয় হয়ে উঠবেন এবং ততই অনুভব করবেন যে এ মানুষটি তার নিজের জাতের নয়, এ মানুষটির ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না, এ যেন কেমন বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ, একলা। একে বন্ধু, সমাজ, বাপ-মা এমন কি শেষপর্যন্ত তার স্ত্রী ও ত্যাগ করে চলে যায়, কারো সঙ্গেই সে সহ-অবস্থান করতে পারে, সমঝোতায় আসতে পারে না। আপোস বলে যে একটা কথা আছে, তা যেন তার অভিধানে থাকতে নেই।
কিন্তু এহেন জটিল চরিত্র প্রথমেই কোন লেখক কল্পনা করেন নি। প্রথমে তাদের কল্পনায় Positive good man হিসেবে একটি সরল বিশ্বাসের অটল মানুষই ধরা পড়েছিল। পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে তার সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ ষোড়শ শতকে। লেখক একজন স্পেনিস। একাধারে কবি নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক সারভাঁতে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি “ডন কুইক্সট”-এর জন্যে অমর হয়ে আছেন। দস্তয়েফস্কি লিখেছেন—”of all the good characters in christ an literature, Don Quixote stands as the most finished of all. But he is good solely because he is ludicrous at the same time comical.” Comical হওয়াতে চরিত্রটির ওজন কমে গেছে অতিমাত্রায়। তার সততা সারল্য ও নিষ্ঠা পাঠকের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। তথাকথিত হিরোইজমের প্রতি শ্লেষ হিসেবেই চরিত্রটিকে পাঠক ভালবেসেছে কিন্তু তার Positive goodness চোখে পড়ে নি কারো। Tom Jones-এর ভাগ্যেও জুটেছে সেই ক্লাউনেরই জনপ্রিয়তা। নাম চরিত্রের ওই উপন্যাসটি লেখেন হেনরি ফিলডিং। ১৭৪০-এর কাছাকাছি প্রকাশিত এই বইটিতে একটি সরল মানুষের সহজ বিশ্বাসের ক্রিয়াকলাপকে নিয়ে এমন ব্যঙ্গ কৌতুক করা হয়েছে যে এই ভঁড়ামির তলায় একটি বিশুদ্ধ সৎ চরিত্র সমূলে চাপা পড়ে গিয়েছে। অন্যপক্ষে ডিকেনসের ‘পিকউইক’ অনবদ্য চরিত্র হলেও ডন কুইক্সটের তুলনায় অনেক দুর্বল। তবু মোটামুটি ভাবে এ সব চরিত্র পাঠকের মন কেড়েছে কেবল তাদের চারিত্রিক বিশুদ্ধতার জন্যে। সৎ ও সরল মানুষকে সবাই ভালবাসে। সবাই যাকে উপহাস করে কিংবা হুগোর “লে মিজেরাবল”-এর নায়ক জাঁ ভালজার মতন যে কেবল ভাগ্যদোষে অত্যাচারই কুড়োয়, কারো কাছে এটুকু স্নেহ-মমতা পায় না, স্বভাবতই সেই অনন্যোপায় মানুষটির জন্যে পাঠকের মন করুণায় ভরে ওঠে। সেকালের হিউমারের গোপন লক্ষ্যটিও ছিল তাই “…to aroise compassion.” অর্থাৎ পাঠকের মনে করুণা উদ্রেক করা।
কিন্তু অসহায়ের প্রতি এই করুণাকে বড় ভয়ের চোখে দেখেছেন দস্তয়েফস্কি। বলেছেন, নায়কের প্রতি পাঠকের করুণার উদ্রেক হলে তার অন্তর্নিহিত সত্য স্বরূপ করুণার নিচে চাপা পড়ে যায়। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পাঠক তথা সমস্ত আয়োজনটাই তাঁর পণ্ড হয়ে যায় তখন।তাই হুগোর ‘horrible beauty’ হয়েট-এর ‘terrible beauty’র চেয়ে ‘grotesque beauty’-র মধ্যেই দস্তয়েফস্কি দেখলেন “avenue to spiritual reality in art.”
Positive good man-এর প্রসঙ্গে আর্টে রিয়ালিজমের প্রশ্ন যখন এল তখনই এর good man চরিত্রে জটিলতা দেখা দিল। চরিত্র থেকে বাদ চলে গেল নির্বুদ্ধিতা ও ভঁড়ামির। অংশটা, যুক্ত হল মনুষ্যোচিতদুর্বলতা আর উৎকেন্দ্রিকতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই জটিল Positive good man চরিত্রটির সফল চিত্র যিনি আমাদের প্রথম উপহার দিলেন তার নাম দস্তয়েফস্কি। চরিত্রটি ইডিয়ট’-এর প্রিন্স মিসকিন। সেই থেকে এই পজিটিভ চরিত্রে হাত দিয়েছেন অনেকেই, সফলও হয়েছেন কোন কোন লেখক, অবশ্য ততদিনে সাহিত্যও তার কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তন করেছে। যুদ্ধ আর এটম বোমার আঘাতে মানুষের বিশ্বাস গেছে চূর্ণবিচূর্ণ ইয়ে, নিরবলম্ব মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে একটা চাপিয়ে দেওয়া অনিচ্ছার বোঝা, বেঁচে। থাকা হয়ে উঠেছে এক হাস্যকর অবাস্তব ব্যায়াম। এই চিন্তার প্রতিফলক-সাহিত্যে জীবন নেতিবাদের অন্ধকারে তার নিজস্ব চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। তবু তারই মধ্যে মাঝে মাঝে ক্ষণপ্রভার মতন দু’একটি পজিটিভ চরিত্র আমাদের চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়। তেমনই একটি চরিত্র ১৯৫৯ সালের রচিত ইয়োনেসকোর নাটক ‘রাইনোসেরাস’ (গণ্ডার) এর নায়ক বেরেজের। বন্ধু, সমাজ, শেষ পর্যন্ত স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছে তবু আত্মসমর্পণ করে নি বেরেজের। অবমানুষ হবার বিরুদ্ধে শেষ অবধি সে একলা লড়াই করে গেছে। একা লড়াইতে ফাঁকি থাকে না। তাই পজিটিভ চরিত্রে কঁকির অবকাশ নেই। আর realism-এ ফকির সুযোগই বা কোথায়!
পজিটিভ চরিত্র নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনার আগে এই realism কী ব্যাপার তা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। পাঠক নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, “রাজাবদল”-এর গৌর পণ্ডিত মশায়, “শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন”-এর লোকনাথ এবং “আসামী হাজির”-এর সদানন্দ বিভিন্ন কোণ থেকে আমাদের মনে যে ছাপ ফেলেছে, সে আসলে একটি মানুষেরই ছাপ, সে মানুষ ‘a positive good man’! এই যে সাধারণ মানুষ থেকে বেছে অন্য একটি সাধারণ মানুষ খুঁজে বের করা যে সর্বপ্রকারে সাধারণ হয়েও উৎকেন্দ্রিকতাবশত অ-সাধারণ, দস্তয়েফস্কি বলেছেন এটাই আর্টে realism in a higher sense অর্থাৎ “to find the man in a man.”
বিখ্যাত সমালোচক কনসট্যানটিন মাচুল্ স্কি realism-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন,…the new reality created by the artist of genius, real, because, it reveals the very essence of existence.
এখানে বলা দরকার realistic আর realism-এ পার্থক্য আছে। Realistic লেখা হচ্ছে। বাস্তবের ফটোগ্রাফিক অনুকৃতি (কার্বন কপি)। Reality in art অন্য ব্যাপার। এখানে লেখক সংসারে সমাজে নিত্য ঘটা ঘটনার বিবৃতি মাত্র দেন না, তিনি অনুরূপ ঘটনা নির্মাণও করেন। সে ঘটনার ভাষ্যের ভিতর দিয়ে একটি চরিত্র ক্রমাগত বিশিষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। অবশেষে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক বাস্তবতায় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু উত্তীর্ণ হওয়ার কথা যত সহজে বলা হল ব্যাপারটা তত সহজ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কথাশিল্পের সমস্ত সম্ভাব্য দিকগুলো। বিশেষ করে ভাবতে হবে কী ভাবে বলব। যে ভাবে বললে–idea ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে বাস্তব ও যুক্তিসঙ্গত হয়ে ওঠে, কাহিনীর শেষে নায়কের গা থেকে ঘটনার নামাবলী খসে গিয়ে নিঃসঙ্গ সেই নিরাবরণ মানুষটি পাঠকের মনের দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে থাকে তাকেই বলি সার্থক রচনা। কিন্তু সে বড় সহজ কাজ নয়। ত য় তার War and peace শেষ করে ডায়েরীতে লিখেছিলেন–I cannot call my composition a tale, because, I do not know how to make my characters act only for the sake of proving or clarifying any one idea or series of ideas.
তল্স্তয় যা পারেন নি বলে বলেছেন এক্ষেত্রে ‘আসামী হাজির’-এর লেখক কিন্তু তা পেরেছেন। তিনি তাঁর প্রতিটি ঘটনাকে একটি মুল ঘটনার মধ্যে কেন্দ্রীভূত করেছেন এবং একটি প্রত্যয়কে প্রমাণ অথবা প্রাঞ্জল করার জন্যে সব চরিত্র ও ঘটনা সেদিকে সক্রিয় করে তুলেছেন। ঘটনাগুলো বহু শাখা-প্রশাখায় প্রসারিত হতে হতে চতুর্দিক থেকে এগিয়ে এসে শেষে উদ্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুতে লয় পেয়েছে। এইভাবেই নিজস্ব প্যাটার্ন ও টেকচারের টানাপড়েনে ‘আসামী হাজির’-এর লেখক তার ফিশনাল য়ুনিভার্স অর্থাৎ কাহিনীর বিশাল জগৎ গড়ে তুলেছে। এই বাবদে তিনি বালজাক, ডিকেনস, গোগোল, দস্তয়েফস্কির সঙ্গে তুলনীয়। বিশেষ করে grotesque beauty প্রসঙ্গে দস্তয়েফস্কি তো অবশ্যই। পজিটিভ গুড ম্যান-এর চরিত্র থেকে যখন ব্যঙ্গাত্মক অংশটা বাদ দেওয়া হল, যোগ করা হল উৎকেন্দ্রিকতা, তখনই ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনার শূন্যস্থান পূর্ণ করল অনৈসর্গিক উপস্থাপনা। যেমন ‘শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন’-এ নায়ক লোকনাথ ঈশ্বরের সঙ্গে তর্ক করছে। যেমন ‘আসামী হাজির’-এ সদানন্দ তার দ্বিতীয় সত্তাকে অর্থাৎ হাজারি বেলিফকে খুন করেছে। এইসব অনৈসর্গিক ঘটনার সন্নিবেশ দেখেই সেকালের দস্তয়েফস্কিকে এবং একালের বিমল মিত্রকে অনেক সমালোচক অতিরঞ্জনের দোষে অভিযুক্ত করেছেন; কিন্তু এ দোষ যে দোষ নয় বরং বিশেষ এক ধরনের গুণ দস্তয়েফস্কিই তার জবাব বেঁচে থাকতে দিয়ে গেছেন। যাদের তা মনে নেই কিংবা যাঁরা তা জানেন না তাদের অবগতির জন্যে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তিনি বলেছেন, “All art consist in a certain portion of exaggeration provided…one does not exceed certain bounds.”
এই bounds, এই সীমরেখা নির্দেশ করা বড় কঠিন; তবে সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে কিন্তু বোঝা যায় লেখকের বিশেষ আধ্যাত্মিক বাস্তবতার লক্ষ্য অনুধাবন করলে। যদি দেখা যায়। তিনি তাঁর সেই উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছেন তখন অতিরঞ্জন আর অতিরঞ্জন থাকে না।
পাঠক ও সমালোচকদের স্মরণার্থে বলছি, অতিরঞ্জনের প্রয়োজন হয় তখনই যখন পরিবর্তনশীল উপরিভাগের অব্যবহিত নিচেকার অপেক্ষাকৃত স্থির ও স্থিতিশীল মানবিকভ্ অস্তিস্তকে দেখানো আবশ্যক হয়ে ওঠে–কেবল অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম কিংবা ধূসর জিনিসকে দৃষ্টিগোচরে আনতে হলে তাকে বর্ধিতায়তন করাই দরকার। ডিকেনস্ বলেছেন-What is exaggeration to one class of mind and perception is plain truth to another. দস্তয়েফস্কি–The important thing is not in the object, but in the eye; if you have an eye, the object will be found; if you don’t have an eye, if you are blind–you won’t find anything in any object.
বিষয়ের এই অন্তর্নিহিত গুণটি দেখবার চোখ যাঁর আছে তিনিই realism-এর শিল্পী। তার হাত দিয়েই যুগে যুগে মূর্ত হয়ে উঠবে Positive good man. বিমল মিত্র নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছেন সত্য দর্শনের সেই দুরাসদ দৃষ্টি তার আছে।
শিল্পীর এই দুরাসদ দৃষ্টিগোচর Positive good man প্রসঙ্গে Mochulskey বলেছেন : In the “world of darkness” comes a man not of this world…He is not an active fighter contending in the struggle with evil forces, not a tragic hero challenging fate to combat, he does not judge and does not accuse, but his very appearance provokes a tragic conflict. One personality is set in opposition to the entire world.
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি ‘আসামী হাজির’-এব নায়ক সদানন্দর দিকে তাকাই তো সদানন্দর তিনটে ডাইমেনশানই (স্তর) একসঙ্গে আমাদের চোখে পড়বে। তিনজন সদানন্দকে আমরা একটি অবয়বে বিধৃত দেখতে পাব। চোখ মেললেই যেটা চোখে পড়বে সে তার সাধারণ চেহারা। আর পাঁচজন সমবয়সীর মতন স্বাভাবিক আচার-আচরণ। লেখাপড়া করে, স্কুলে যায়। প্রাকৃতিক নিয়মে সকলের মতন তারও বয়েস বাড়ে। কিন্তু এই ওপরের স্তরের নিচে সদানন্দ কিন্তু আসলে অন্য রকম। তার প্রশ্ন সাধারণের প্রশ্ন নয়, তার দেখার চোখও নয় সাধারণের চোখের মতন। সদানন্দর চোখে আরও কিছু, এমন কিছু ধরা পড়ে যা আর কারও চোখে পড়ে না। চোখে পড়লেও যার তাৎপর্য আর কেউ বোঝে না। শেষ স্তরের সদানন্দর এই যে অবহিতি-বোধ, এবং ভ্রষ্টত্ব সম্বন্ধে প্রখর সচেতনতা, এর থেকেই ঘটতে থাকে তার অহং-এর উত্তরণ। সদানন্দর এই তিনটি স্তর কিন্তু পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নয়, এই ত্রিস্তর মিলিয়েই সদানন্দ সম্পূর্ণ একটি মানুষ। কী করে জানলাম? বিমল মিত্র সদানন্দ সম্পর্কে কি একটা দার্শনিক বক্তৃতা দিয়েছেন? না। তবে? হ্যাঁ, এইখানেই বিমল মিত্রের শিল্প-বৈদগ্ধ্য। তিনি বক্তৃতা দেন না, তিনি Maupassant-র ভাষায় –To produce the effect he seeks, that is, the feeling of simple reality, and I to bring out the lesson he would draw from it, that is, the revelation of what contemporary man really is to him, he will have to employ facts of constant and unimpeachable veracity…the achievement of such a goal consists, then, in giving the complete illution of reality following the ordinary logic of facts, and not in transcribing slavishly in the pell-mell of their occurance. (Preface to “Pierre et Jean”) অর্থাৎ বিমল মিত্র দৈনন্দিন জীবনের নিত্য-ঘটা সাদামাটা ঘটনার মধ্য দিয়ে তার চরিত্রকে উপস্থিত করেন কিন্তু সে সাদামাটা ঘটনাও আসলে মোপাশ্যাঁর ভাষায় ওই উপরিউক্ত বাস্তবেরই অধ্যাস এবং আদৌ বিশৃংখল কতকগুলি ব্যাপার মাত্র নয়। বিমল মিত্রের উদ্ভাবিত ঘটনা বা সিচুয়েশান বস্তুত ঘটনা নয়, ইলাসট্রেশান অর্থাৎ উদাহরণ। এবং তারও সব সময় থাকে তিনটে স্তর-প্রতিক্রিয়া, তাৎপর্য এবং প্রভাব।
উদাহরণ স্বরূপ কপিল পায়রাপোড়ার ঘটনাটাই উল্লেখ করা যাক। পাঁচ বছরের সদানন্দ কৈলাস গোমস্তার সঙ্গে হাটে গেছে। সেখানে কপিল বেলুন বেচছিল। সদানন্দ বেলুন চাইলে, সে দাম নিলে না, এমনিতেই একটা বেলুন দিয়ে দিল তাকে। কিন্তু কৈলাস গোমস্তা হিসেবের খাতায় চার পয়সা খরচ লিখে সেই পয়সা চারটে নিজে রাখলে। দুদিন বাদে সেই বেলুনটা চুপসে গেলে সদানন্দ বায়না ধরলে তার আর একটা বেলুন চাই। একমাত্র বংশধরের আবদারের কাছে কঞ্জুস জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর মনে কৃপণর ছিটেফোঁটাও থাকে না। তখুনি চাকর পাঠানো হল রেলবাজারে। চাকর দু’পয়সা দিয়ে একটা বেলুন কিনে নিয়ে এল। বেলুনের দাম দু’পয়সা শুনেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন নরনারায়ণ চৌধুরী, আর একবার হিসেবের খাতাটা মিলিয়ে দেখলেন–হ্যাঁ, কপিল দু’পয়সা বেলুনের দাম চারপয়সা নিয়েছে তার নাতির কাছ থেকে। কপিল ঠগ, কপিল জোচ্চোর! হুকুম হল কপিলকে ধরে নিয়ে আসবার। বিনে পয়সার বেলুনের দাম হিসেবের খাতায় চার পয়সা লিখে যে চুরি করেছিল সেই কৈলাস গোমস্তাই ছুটল তাকে গ্রেপ্তার করে আনতে।
তারপর? কপিল পায়রাপোড়ার আর্তনাদ শুনে সদানন্দ ছুটে গিয়েছিল কিন্তু তার কথায় তার প্রতিবাদে কেউই কান দিলে না, শুনতে চাইলে না কেউ অপরিণত বালকের কথা, টেনে বের করে নিয়ে এল তাকে ঘর থেকে। কপিল পায়রাপোড়া শুধু মারই খেলে না, তার তিন বিঘের সামান্য জমিটুকুও গেল। জমিদারের নির্দয় ক্রোধ তাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ছাড়লে। একপাল ছেলেপুলে নিয়ে অসহায় মানুষটা অনন্যোপায় হয়ে শেষমেশ গলায় দড়ি দিয়ে মরল। সে দৃশ্য দু’দিন পরেই সবাই ভুলে গেল। এসব নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা এমনই গা-সওয়া হয়ে গেছে মানুষের যে, এসব ঘটনা কেউই আর মনে রাখলো না।
কিন্তু সদানন্দ বলে, “দেখ প্রকাশ মামা, আজকাল সবাই তার কথা ভুলে গেছে। …….ওই বারোয়ারীতলায় যখন সে আত্মঘাতী হল সবাই তা দেখেছে, দেখে শিউরে উঠেছে, কিন্তু আজকে কারো সে কথা মনে নেই……..”
শুনে প্রকাশ মামা হো হো করে হেসে উঠেছে, বলেছে, “তুই তো দেখছি একটা আস্ত পাগল। অত কথা মনে রাখতে গেলে মানুষের চলে! তুই তো আমায় অবাক করলি সদা।”
সদা বলে, “কিন্তু মামা আমি কেন কিছুই ভুলতে পারি নে? আমার কেন সব মনে পড়ে যায়?”
না–সদানন্দর শুধু মনেই পড়ে না, তার তীব্র বোধের কাছে, তীক্ষ্ণ অবহিতির কাছে চৌধুরীবংশের পাপের ইতিহাস সন্ধ্যার ধূসর ছায়ার মধ্যে পুকুরের জল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। তারা তাকে চৌধুরীবংশের পাপের ইতিহাস শোনায়।
কপিল পায়রাপোড়ার এই প্রাসঙ্গিক কথার মধ্যে আমার উপরিউক্ত তিনটি স্তর পর পর এইভাবে সাজানো–(১) চারটে পয়সাও চুরি করতে ছাড়ে না এমনই হীন এই জমিদার সেরেস্তার মানুষ (২) কত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে জমিদারের ক্রোধ চরম হয়ে ওঠে (৩) তার ফলে একটি শিশুর সামনে এই জগৎ ও জীবনের ওপরকার পলেসতারাটা কী ভাবে ভেঙে যায়, কী ভাবে ভেতরের বীভৎস চেহারাটা বেরিয়ে আসে। বিমল মিত্র কোন ঘটনা অকারণে তো বলেননি না অধিকন্তু তিনটে ডায়মেনশন না থাকলে তার অবতারণাও করেন না। তার লক্ষ্য সব সময় সেই ঘটনার দিকে যার মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয় বাঙালী মানসের যন্ত্রণা, তার নৈতিক সংকট। অন্ধকারটা যত তীব্র হয়ে ওঠে আলোর জন্যে আকূতি ততই ঐকান্তিক হয়। অতএব তার উদ্ভাবিত ঘটনার মধ্যে একটা আলোর আভাসও শেষ-মেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সদানন্দর এলেবেলে মনোভাব ও ছন্নছাড়া আচার আচরণকে চিরাচরিত পথে সুস্থ করে। তোলার জন্যে প্রকাশ মামা একদিকে তার বিয়ের জন্যে সদানন্দর বাপ-মাকে সুপারিশ করে আর একদিকে তাকে লায়েক করে তোলার জন্যে যাত্রা, কবিগান, ঢপ শোনাতে নিয়ে যায়, নিয়ে যায় বাজারে-মেয়ে মানুষের বাড়িতে। যার হাতে একদিন আট দশ লাখ টাকার। সম্পত্তি আসবে তাকে সেই টাকার সুখভোগ করতে হবে তো! আর তখন তার হাতেও কোন্ দু’এক লাখ টাকা না আসবে! পৃথিবীর সব দালালরাই এই রকম এক এক জন প্রকাশ। মামা।
সদানন্দর অন্তরদৃষ্টি প্রকাশ মামাকে চিনতে ভুল করে না,–প্রকাশ মামাও একজন মানুষ। সদানন্দ ভাবে, কেউ প্রকাশ মামাকে মানুষ ছাড়া জানোয়ার বলবে না। মানুষের মতন দুটো হাত, পা, চোখ, কান। মানুষেরই মতন মুখের ভাষা। সংসারে ওরকম লোককে সবাই মানুষ বলেই জানে। অথচ প্রকাশ মামা কি সত্যিই মানুষ!
সত্যিকারের মানুষ তার দাদু নরনারায়ণ চৌধুরীও না। এবং তার বাপও না। নরনারায়ণ চৌধুরী পনেরো টাকা মাইনের নায়েব ছিলেন কালীগঞ্জের জমিদার হর্ষনাথ চক্রবর্তীর। হর্ষনাথ চক্রবর্তীর শেষ জীবনে চৈতন্যোদয় হয়েছিল, তিনি সজ্ঞানে গঙ্গাজলে দেহত্যাগ। করলেন এবং নরনারায়ণের সৌভাগ্য কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর ওয়ারিশানদেরও মৃত্যু ঘটল। রইল শুধু হর্ষনাথের বিধবা, কালীগঞ্জের বউ। সেই বিধবার সর্বস্ব তিলে তিলে গ্রাস করে নায়েব নরনারায়ণ চৌধুরী হলেন কালীগঞ্জ আর নবাবগঞ্জ–এই দুই বিশাল ভূমির একচ্ছত্র জমিদার। শেষ বয়েসে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন নরনারায়ণ চৌধুরী, তবু টাকার সিন্দুকটা–চুনী পান্না হীরে জহরতে বোঝাই সিন্দুকটা আগলে বসেছিলেন তিনি। এবার তিনি একমাত্র বংশধর নাতি শ্রীমান সদানন্দকে বিয়ে দিয়ে তার ঘাড়ে এই বিশাল জমিদারী আর এই মস্ত সিন্দুকটা সঁপে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত; কিন্তু এদিকে যে পাপের বীজটি বিশাল এক মহীরূহ হয়ে উঠেছে তিনি তা গ্রাহ্যই করতে চান নি। কিন্তু সদানন্দ ছাড়লে না। সে যখন জানলে দশ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে কালীগঞ্জের বউ দাদুর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়েছে, সে দাদুকে চেপে ধরলে,তোমার সিন্দুক বোঝাই টাকা, কেন তুমি তবে বিধবা বুড়ো মানুষটাকে ঘোরাচ্ছ, টাকাটা দিয়ে দাও।
দাদুর যুক্তি–দাও বললেই দেওয়া যায়? আমি কি দেব না বলেছি, দেব, ঠিক দিয়ে দেব। তুই বিয়ে করে আয়…
যার কাছে হিসেবই ধর্ম হিসেবই মোক্ষ, যার কাছে স্বর্গ বলতেও টাকা সে কখনো সহজে টাকা ছাড়ে! অথচ সেই টাকাই মুঠো মুঠো খাওয়াতে হল পুলিসের দারোগাকে। একটা খুন চাপা দিতে আরও পাঁচটা খুন করতে হল। কেননা অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক স্বার্থ ক্রমাগত মানুষকে এক নিদারুণ ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে নিজের ওপর কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলছে মানুষ। যত সে অসহায় বোধ করছে ততই সে পাপীর গোষ্ঠী বাড়াচ্ছে, সেই দলের পুষ্টিবিধান করছে। একদিকে এভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বলবান হচ্ছে আর একদিকে অসহায় মানুষ তারই শিকার হয়ে হয় আত্মবিসর্জন দিচ্ছে নয় তো তাদের দালাল হয়ে দল ভারী করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে positive good man ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, সরে যচ্ছে negation-এর দিকে, বৈরাগ্যের দিকে। শুভ রাত্রির মধুর ক্ষণটিতেই তাই একটি নিষ্পাপ নববধূর জীবনে নেমে এল অন্ধকার।
শোষণভিত্তিক সমাজে যে শোষণ করে না সে শোষিত হয়। আর যে এই শোষণকে পাপ বলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ও শোষিতের জন্যে দুঃখ পায়, সমাজ তাকে কায়দা করে মুঠোয় পুরতে চায়, না পারলে তাকে সেখানে তিষ্ঠতে দেয় না। আসলে তার বিবেকই তাকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ঘটেও ছিল তাই। নরনারায়ণ চৌধুরী সদানন্দকে আয়ত্তে আনতে পেরেছেন ভেবে খুশী হয়েছিলেন। সে নববধূর ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিয়েছে। এতএব আর চিন্তা কী! এখন থেকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে বংশপরম্পরা তিনি অমর হয়ে থাকবেন, অনন্তকাল ধরে নিজের রক্তের ধারার মধ্যে অখণ্ড পরমায়ু লাভ করবেন। কিন্তু তিনি জানলেন না তাদেরই পাপের প্রতিবাদ ও প্রায়শ্চিত্ত করতে ফুলশয্যার পালঙ্ক থেকে নেমে সকলের অগোচরে আকাশের নিচে কন্টক শয্যা পাততে বেরিয়ে গেছে সে। কিন্তু পাপের বিরুদ্ধে জেহাদ জানিয়ে একটা মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেই তো তার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কাজ থেমে যায় না। থেমে যেতে দিতেও চান না নরনারায়ণ চৌধুরীর। যোগ্যপুত্র হরনারায়ণ চৌধুরী। তাই তিনি নিজেই পরিত্যক্তা পুত্রবধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদন। করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন। এখানে লেখকের সংযম ও শিল্প-নৈপুণ্য দেখে বিস্মিত হতে হয়। সুপরিচিত এবং সম্পর্কযুক্ত শব্দের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহ্য যুক্তির পথ ধরে তিনি অনায়াসে এক নিদারুণ সংকট উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছেন।
সত্যকে দেখার স্লং সেই সত্যের সামাজিক ও ব্যক্তিগত বাস্তব রূপ তুলে ধরার ক্ষমতা শ্রেষ্ঠ শিল্পীর লক্ষণ সন্দেহ নেই কিন্তু সংকটের সত্যকে টুকরো টুকরো করে দেখলে সংকটের পূর্ণ চেহারা যেমন দেখা যায় না, তেমনি, Positive good man, যাকে কেন্দ্র করে সংকট প্রকট হয়ে ওঠে তাকেও সম্পূর্ণ করে পাওয়া যায় না। লেখকের শ্রেষ্ঠত্বের আর এক প্রমাণ এই তাত্ত্বিক সত্য তাঁর শুধু জ্ঞাতই নয়, এর স্বরূপও তাঁর অনায়াস-আয়ত্ত। তাই তো তিনি সদানন্দর মাধ্যমে স্তরে স্তরে বিন্যস্ত সামাজিক সংকটের জটিল রূপটি। সামগ্রিক ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। আর সামাজিক সংকট সামগ্রিক ভাবে ফুটে ওঠার দরুন সদানন্দ চরিত্রও স্বচ্ছন্দে স্বতঃই পূর্ণবিকশিত হয়ে উঠতে পেরেছে।
এই যে যুগপৎ চিত্র ও চরিত্র আঁকা, এ এক দুর্লভ গুণ। লেখক আমাদের সামনে যুগসংকট তুলে ধরতে চান; কিন্তু কী ভাবে? যুগসংকটকে আমরা নিজেরাই কি দেখতে চাই যে কেউ দেখালেই দেখব? দৈনন্দিন জীবনে এত অসংখ্য অন্যায় আমরা দেখছি আর ভুগছি যে আমাদের বোধশক্তিটাই ভোঁতা হয়ে গেছে, চোখে পড়ে গেছে চালশে। এখন আর কোন অসঙ্গতিই আমাদের চোখে পড়ে না, কোন মর্মান্তিক ঘটনাই আর দাগ কাটে আমাদের মনে। অতএব লেখককে আনতে হয়েছে এমন একজন মানুষকে যে এই সমাজ-সংসারে একেবারেই আগন্তুক। আগন্তুকের চোখে সবই ধরা পড়ে। অথচ আগন্তুক যেহেতু এই সমাজ-সংসারের সুখ-দুঃখের শরিক নয় তাই সে সব কিছু দেখবে খোলা চোখে সাদা মনে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে। তাই তার সেই দেখায় কোথাও গাম্ভীর্য বা গুরুত্ব নেই। থাকলেও Positive good man যেহেতু রাজনীতি বোঝে না, তার চোখের দেখা দুরূহ ব্যাপারগুলোও তখন আর গুরুভার হয় না। কৌতুকে-শ্লেষে মিলে মিশে এক উপাদেয় রসবস্তু হয়ে ওঠে, যার নাম দেওয়া যায় grotesque beauty. পাঠক লক্ষ্য করবেন, এই শ্লেষ ও কৌতুক মেশানো রচনার grotesque beauty শুধু নায়ক সদানন্দর মধ্যে নয়, গ্রন্থের সর্বত্র সমস্ত চরিত্র ও ঘটনার মধ্যেই সূক্ষ্মভাবে বিরাজমান।
তবে কি শুধু কৌতুকে বিদ্রুপে আমাদের এই যুগসংকটের অন্ধকারটাকেই প্রকট করার জন্যে positive good man-এর মাধ্যম ব্যবহার? না। তমসো মা জ্যোতির্গময়য়া-উপনিষদের এই প্রার্থনাই লেখকের শিল্প-প্রেরণা। positive good man-এই আলোরই প্রদীপ। যুগ সংকটেই এদের আবির্ভাব ঘটে। এরা এলেই সংকটের সামগ্রিক চেহারাটা আমাদের সামনে প্রকট হয়, আমরা শিউরে উঠি, আমরা আলোতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রার্থনায় নতজানু হই। আর সেই তো আমাদের পরিত্রাণ।
শ্বশুরের লালসাকে ধিক্কার দিয়ে, তার মর্যাদার মুখোশটাকে খুলে জনতার সামনে দু’পায়ে থেঁতলে দিয়ে নয়নতারা তার স্বামীর ভিটে জন্মের মতন ছেড়ে এসেছিল বটে কিন্তু সেই থেকে তাকে হতে হয়েছিল পরস্পরবিরোধী দুই প্রবণতার শিকার। অসুস্থ সদানন্দকে রাস্তা থেকে বাড়িতে কুড়িয়ে এনে নয়নতারা তাকে প্রাণপাত সেবা করে এবং তজ্জনিত লাঞ্ছনা। সয়ে তাকে সুস্থ করে তোলে অথচ সে নিজে তখন নিখিলেশের স্ত্রী। নিখিলেশ ততদিনে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, তাকে অফিসে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে। নিখিলেশ তাকে তার অসহায় অবস্থা থেকে রক্ষা করেছে। সে তাই নিখিলেশকে ভালবাসে। কিন্তু সদানন্দকে?…
সদানন্দ নয়নতারাকে অপ্রত্যাশিত ভাবে বিপুল অর্থ দিয়েছিল বটে কিন্তু সে কি নয়নতারা তাকে রোগে সেবা করেছিল বলে? কিম্বা সে কি নয়নতারাকে সে বিনা দোষে ত্যাগ করেছিল বলে? নাকি…
ফাউস্টকে বাজী রেখেছিলেন ঈশ্বর। শয়তান বলেছিল, এই পৃথিবীকে আমি বাড়ি গাড়ি নারী সম্পদ আর খেতাব খয়রাৎ দিয়ে দখল করে ফেলেছি, ব্যভিচার যুদ্ধ আর মহামারী ছড়িয়ে মানুষদের এমন কোণঠাসা করে রেখেছি যে, সবাই আমাকে ষোড়শোপচারে পূজো করছে। অতএব এই দুনিয়াদারী আমার। ঈশ্বর বললেন, তুমি যদি ওই পবিত্র-প্রাণ ফাউস্টের আত্মাকেও আয়ত্ব করতে পারো, নিভিয়ে দিতে পারো তার বুক থেকে প্রেমের দীপশিখা তবেই স্বীকার করব এই পৃথিবী তোমার। শয়তান ফাউস্টের আত্মা কিনে নিয়েছিল, তাঁকে ভোগ সুখ ও জগতের যাবতীয় বিলাস-ব্যসনের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ফাউসট তাঁর প্রাণের সেই প্রেমের দীপশিখাটি কিছুতেই নিভতে দেন নি। শেষ পর্যন্ত তাই ফাউস্টেরই জয় হল। শয়তান আর পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি হতে পারল না।
ফাউস্টের সেই পবিত্র প্রেমের শিখাটিই বুঝি দু’চোখের দৃষ্টি-প্রদীপে ধরে পৃথিবীর অন্ধকার পায়ে পায়ে পার হয়ে সদানন্দও তার লক্ষ্যস্থলের দিকে হেঁটে চলছিল। আর ওদিকে তখন কলকাতার অভিজাত পল্লী থিয়েটার রোডের এক সুরম্য সৌধে পড়ে-পাওয়া বিপুল অর্থে কেনা সুখের কুষ্ঠব্যাধিতে ভুগছিল নয়নতারা।
দিব্য প্রেমের পবিত্র আলোটি নিয়ে আজ থেকে এক হাজার নয়শ তিয়াত্তর বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন প্রথম Positive good man. তিনিও ওই সদানন্দর মতই পৃথিবীর পথে পথে সেদিন হেঁটে চলেছিলেন। তিনিও মানুষের কল্যাণই চেয়েছিলেন। মানুষের কল্যাণের জন্যে তিনি তাঁর সারা জীবনের তপস্যার ফল মানুষকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। সে-তপস্যার ফল মানুষের কী কী কল্যাণ করেছে সদানন্দর মতন তিনিও তা দেখতে বেরিয়েছিলেন তখন। হাঁটতে হাঁটতে একদিন তিনি সেদিনের থিয়েটার রোডের এক সুরম্য সৌধে গিয়ে উপস্থিত হলেন। রাজকীয় উৎসবে সেখানে তখন ফরিশীয় পুরোহিতরা সকলে উপস্থিত–দীয়তাং ভূজ্যতাংএর রব উঠছে চারদিকে। হঠাৎ তারই মধ্যে এক ছন্নছাড়া ছিন্নবাস মানুষের উপস্থিতি যেন সব কিছু হঠাৎ তছনছ করে দিলে। কেউ তাঁকে সহ্য করতে পারলে না, কেউ তাঁকে স্বীকার করতেও চাইলে না–এমন কি নয়নতারাও না। কেবল সমবেত পাপের হিংস্র ক্রোধ মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ছুটে এল তাঁর দিকে–তাকে রক্তাক্ত করে ছাড়ল। নিহত মানুষটির সেই রক্তে স্নান করে তখন পবিত্র হল নয়নতারা। নয়নতারার সুখের কুষ্ঠব্যাধি মিথ্যের খোলসের মতন সেই মুহূর্তেই খুলে পড়ল তার শরীর থেকে। প্রেমে জ্যোতিষ্মতী হয়ে উঠল সে। পাপের পাথর চাপা সত্য তখন মুক্তি পেল কণ্ঠে নয়নতারা নির্দ্বিধায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করল—’ইনি আমার স্বামী’।
কিন্তু একালের যীশু তখনও চিৎকার করে বলে চলেছে—’আমি তোমাদের মতন হতে পারি নি, তোমরা আমার সেই অক্ষমতার বিচার কর, তোমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে না পারার অপরাধের বিচার কর। আমি আসামী, আমি হাজির হয়েছি।’
অনুরূপ আর এক কণ্ঠস্বর শুনি আমরা ইয়োনেসকোর “গণ্ডার” নাটকের নায়কের মুখে—”I’m the last man left, and I’m staying that way until the end, I’m not capitulating.”
***
বিমল মিত্র তাঁর এই উপন্যাসে যে বিশাল জগৎ সৃষ্টি করেছেন তার প্রতিটি ঘটনা এবং প্রতিটি চরিত্র এমনই বিশ্বাসযোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী যে আমরা আমাদের অজ্ঞাতসারেই এই জগতের সামিল হয়ে যাই কিংবা কখন যেন, কেমন করে যেন, এ জগৎ আমাদেরই জগৎ হয়ে ওঠে। সব কিছুর মধ্যে এখানে আমরা আমাদের নিজেদেরই দেখতে পাই, আমরা অবহিত হয়ে উঠি। আর এমন করে যিনি আমাদের আত্ম-অবহিত করে তোলেন, নিঃসন্দেহে তিনি আমাদেরই লেখক, আমাদের প্রিয় লেখক।
যজ্ঞেশ্বর রায়
৯ এপ্রিল ১৯৭৩
Leave a Reply