৩.১ পর-চিতেন (দ্বিতীয় খণ্ড)

দ্বিতীয় খণ্ড

পর-চিতেন

মনে আছে এর পর থেকেই সদানন্দর জীবনে সব কিছুই যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। এর পর থেকেই শুরু হলো তার সংঘর্ষ। নিজের সঙ্গে নিজের সংঘর্ষ আবার নিজের সঙ্গে পরের। আসলে এর পর থেকে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গেই সদানন্দর সংঘর্ষ বেধে গেল।

যারা সাধারণ মানুষ তারা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। কিন্তু যারা পারিপার্শ্বিককে অস্বীকার করে চলতে চায় তাদেরই হয় যত বিপদ। তারা নিজেকেও ক্ষমা করে না পারিপার্শ্বিককেও না। পারিপার্শ্বিক যখন তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে আসে তখন সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে গিয়ে কখনও ধ্বংস হয়ে যায় আবার কখনও কখনও ইতিহাসের পাতায় একটা স্থায়ী দাগ রেখে যায়। কিন্তু তা-ই বা পারে কজন? বেশির ভাগই তো পারিপার্শ্বিকের চাপে নিঃশেষ হয়ে হয়ে কোথায় মিলিয়ে যায় কেউ জানতে পারে না। ইতিহাসের পাতায় এত জায়গা থাকে না যে ঐতিহাসিক তাদের নিয়ে দু’চার লাইন লিখবে। তাদের জায়গা থাকে একমাত্র উপন্যাসের পাতায়। একমাত্র ঔপন্যাসিকই বুঝি তাদের জন্যে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে।

তা সংসারে এক ফোঁটা চোখের জলের দামই কি কম!

সেদিনের সেই মাঝরাত থেকেই নয়নতারার এই কথাটা মনে হলো। মনে হলো চোখের জল সে আর ফেলবে না। সংসারে চোখের জলের যত দামই থাক, যে তার মর্যাদা দেয় না তার জন্যে সেও নিজের চোখের জল অপব্যয় করবে না।

কতক্ষণ যে সে অজ্ঞান হয়ে ছিল তা তার খেয়াল ছিল না। বোধহয় সমস্ত রাতটাই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। সমস্ত রাতের মধ্যে একবারও কিছু মনে হয়নি তার। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলে সকাল হয়েছে। পাশের খোলা জানালা দিয়ে এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে ঘরে। আগের রাতটার সেই ঘটনাও আস্তে আস্তে তার মনে পড়তে লাগলো। মনে পড়তে লাগলো কেমন করে তার চোখের সামনেই মানুষটা দোয়াতদানি দিয়ে নিজের কপালে ঠাঁই ঠাঁই করে মেরেছিল। কেমন করে সমস্ত শরীরটা তার রক্তে একেবারে ভেসে গিয়েছিল। তারপরে আর কিছুই তার মনে ছিল না।

এতক্ষণে মনে পড়লো বাবার কথা। বাবা যদি এই সময় একবার আসত তো আর এখানে থাকতো না সে। বাবার সঙ্গেই চলে যেত কেষ্টনগরে!

কিন্তু কেষ্টনগরে গিয়েই বা কী হবে? সেখানে গেলেই কি সে সুখে থাকবে?

আবার মনে হলো তাহলে কি সে হেরে যাবে? তার শাশুড়ীকে যে সে কথা দিয়েছিল সে বেহুলার মত তার স্বামীকে ফিরিয়ে আনবে? তা তো কই সে পারলে না?

হঠাৎ শাশুড়ি ঘরে ঢুকলো। বললে–ভালো আছো বউমা?

নয়নতারার মনে হলো যেন তার নিজের মা আবার সশরীরে তার কাছে ফিরে এসেছে।

শাশুড়ি বললে–এই ওষুধটা খেয়ে নাও বউমা। আমি যে কী ভাবনায় পড়েছিলাম তোমার জন্যে।

তারপর একটু থেমে বললে–তোমার গায়ে কোনও ব্যথা হয়নি তো?

ওষুধটা খেয়ে নিয়ে নয়নতারা বললে–আমি যে আপনার কথা রাখতে পারলুম না মা, উনি যে আমার কথা কিছুতেই শুনলেন না। আপনি আমাকে যা বলেছিলেন আমি তা সব কিছুই তো তেমনি করেই করলুম, সব কিছুই তেমনি করেই বললুম! এখন আমি কি করবো?

শাশুড়ি বললে–এখন ওসব কথা ভেবো না বউমা, তোমার এখন শরীর খারাপ, তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো।

নয়নতারা জিজ্ঞেস করলে–উনি এখন কেমন আছেন?

–কার কথা বলছো? খোকা? খোকা ভালো আছে।

–রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে? জ্বরটর হয়নি তো?

শাশুড়ি বললে—না–

নয়নতারা বললে–আমি ভাবতেই পারিনি মা যে উনি অমন করে নিজের মাথায় সমস্ত শাস্তিটা তুলে নেবেন। আমি ওটা কল্পনাই করতে পারিনি। পারলে টেবিল থেকে দোয়াতদানিটা আগেই সরিয়ে রাখতুম।

শাশুড়ি বললে–না বউমা, তোমার তো দোষ নেই, তুমি মেয়েমানুষ হয়ে যা করবার তা করেছ। তুমি আমার কথা রেখেছ পুরোপুরি। দোষ যদি কিছু হয়ে থাকে তো সে আমার। আজ যা কিছু হয়েছে সবটার জন্যে আমিই দায়ী।

নয়নতারা বললে–আপনার কেন দোষ হতে যাবে মা, দোষ আমার কপালের। আপনি যা কিছু করেছেন সব তো আমার ভালোর জন্যেই। আমার কপালে সুখ নেই তা আপনি কী করবেন?

তারপর একটু থেমে বললে–উনি এখন কোথায়?

শাশুড়ি কী যেন একটু ভেবে নিল। বললে–এই তো ওপরের ঘরেই রয়েছে।

–ভালো আছেন তো?

–হ্যাঁ, এখন ভালো আছে একটু। ডাক্তারবাবু এসে মাথায় ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিয়ে গেছে, এই তো এখন খোকার ঘর থেকেই আসছি। এখন আর মাথায় কোনও যন্ত্রণা নেই। একটু আগেই এক গেলাস দুধ খাইয়ে এসেছি।

নয়নতারা জিজ্ঞেস করলে–আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করেছেন?

শাশুড়ি বললে–হ্যাঁ, এই এখখুনিই তো জিজ্ঞেস করছিল তোমার কথা।

–কী জিজ্ঞেস করছিলেন?

–জিজ্ঞেস করছিল তোমার শরীর কেমন আছে।

–আপনি কী বললেন?

শাশুড়ি বললে–আমি বললাম তুমি এখন একটু ভালো আছ।

নয়নতারা বললে–আমি আপনার কথা রাখতে পারলুম না মা, আপনার সাধ মেটাতে পারলুম না, আমি হেরে গেলুম। আপনি কেন আমাকে এবাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিলেন? অন্য কোনও মেয়ে হলে হয়ত আপনার সব সাধ মেটাতে পারতো। আমি আপনার কিছুই উপকার করতে পারলুম না মা–

বলে নয়নতারা ঝর-ঝর করে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললে। শাশুড়ি নিজের আঁচল দিয়ে নয়নতারার চোখ দুটো মুছে দিতে দিতে বললে–কেঁদো বউমা, তুমি কী করবে বলো, তোমার কোনও দোষ নেই–তুমি চুপ করো। তোমার মত বউ পেয়েও যে সুখী হলো না তার কপালে অনেক কষ্ট লেখা আছে–

নয়নতারা বললে–আমি এখন একবার ওঁর কাছে যাবো মা?

–কার কাছে। খোকার কাছে? কেন?

নয়নতারা বললে–আমি একবার গিয়ে ওঁকে জিজ্ঞেস করবো কেন উনি এমন করলেন, নিজের ঘাড়ে সমস্ত শাস্তি তুলে নিয়ে উনি কাকে শাস্তি দিতে চাইলেন? যে আসল অন্যায় করেছে তাকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা যদি ওঁর না থাকে তো এমন ভীরুর মত কাজ কেন করলেন? আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করবো এর নাম কি পৌরুষ? এর নাম কি বীরত্ব?

বলতে বলতে নয়নতারা উঠে বসলো। বললে–আমি এখুনি একবার ওঁর কাছে যাবো মা, আপনি আমাকে বাধা দেবেন না।

–না বউমা, এখন তোমার খোকার কাছে গিয়ে দরকার নেই। তারও শরীর খারাপ, তোমারও শরীরে জোর নেই, এখন হয়ত রাগের মাথায় তোমাকে কী বলে বসবে তখন তুমিও হয়ত আর সহ্য করতে পারবে না, তখন উল্টো বিপত্তি হবে—

নয়নতারা বললে–-না মা, আমি যাবোই। আমি মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলে কি আমাকে এত অগ্রাহ্য করবেন? আমিও তো একজন মানুষ। উনি যা বলবেন তাই-ই আমাকে মুখ বুঁজে সহ্য করতে হবে?

–কিন্তু বউমা, তুমি তো ওর কথা সব শুনেছ। ওর রাগ তো তোমার ওপরে নয়, ওর যত রাগ আমাদের ওপর, ওর বাবার ওপর, ওর কর্তাবাবুর ওপর–তুমি গিয়ে বললেও কোনও ফল হবে না–

–কিন্তু সব অপরাধেরই তো ক্ষমা আছে মা!

শাশুড়ি বললে–ক্ষমাই যদি থাকবে তাহলে অমন করে কেউ আত্মঘাতী হতে চেষ্টা করে? তুমি নিজেই তো দেখলে। ওই দোয়াতদানিটার বদলে যদি ওখানে ছোরা-ছুরি কিছু থাকতো তাহলে কী সব্বোনাশ হতো বলে দিকিনি? আমার ভাবতেও বুক কেঁপে উঠছে–

নয়নতারা বললে–তবু আমাকে একবার যেতে দিন না মা। আমাকে উনি যত ইচ্ছে অপমান করুন তাতে আমার কিছু এসে যাবে না। কিন্তু আমি হেরে গেলাম এ আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি কেন হেরে যাবো? আমি আমার নিজের স্বামীকে বশ করতে পারবো না। এ যে আমারই লজ্জা! আমি লোককে মুখ দেখাবো কী করে? আমার নিজেরই তো নিজের মুখ দেখতে লজ্জা হচ্ছে।

শাশুড়ি বললে–তুমি অত উত্তেজিত হয়ো না বউমা। তোমার দুর্বল শরীরে অত উত্তেজনা ভালো নয়। তুমি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো, আমি এখন যাই, আমি পরে আবার আসবো। তোমাদের ব্যাপারে আমারও শরীর ভালো যাচ্ছে না। আর শরীরেরই বা দোষ কী বলো! আমি একলা মানুষ কোন্ দিকে দেখবো

নয়নতারাকে শুইয়ে দিয়ে প্রীতি বাইরে এল। তারপর নিজের ঘরে আসতেই দেখলে চৌধুরী মশাই ঘরের মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন। গৃহিণীকে দেখেই সামনে এগিয়ে এলেন।

বললেন–কী হলো? বউমা কী বলছে?

গৃহিণী বললে–আমায় জিজ্ঞেস করছিল খোকার কথা। জিজ্ঞেস করছিল খোকা কেমন আছে।

–বউমা জানে না বুঝি যে খোকা বাড়িতে নেই?

গৃহিণী বললেন–আমি বলেছি খোকা বাড়িতেই আছে, ওপরের ঘরে শুয়ে আছে। খোকার সঙ্গে একবার দেখা করবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছিল বড্ড।

–সে কী? এত কাণ্ডের পরেও?

প্রীতি বললে–হ্যাঁ, অনেক কথা বলছিল বউমা। বড় সম্মানে ঘা লেগেছে। বলছিল এত বড় অপমান সে সহ্য করবে না। বড্ড লজ্জা হয়েছে বউমার। বলছিল আর একবার চেষ্টা করে দেখবে।

চৌধুরী মশাই বললেন–কিন্তু যখন জানতে পারবে যে খোকা বাড়িতে নেই, তখন? তখন যদি ওপরের ঘরে যায় কোনও দিন?

প্রীতি বললে–সে যখন জানতে পারবে তখন জানবে। আমি আর সে নিয়ে বেশি ভাবতে পারছি না। আমার আর এখন মাথার ঠিক নেই।

–কিন্তু খোকা যদি আর ফিরে না আসে?

–যদি ফিরে না আসে তখন অন্য বুদ্ধি বার করবো। যদি বলতুম খোকা নেই তখন যদি আবার কান্নাকাটি করতো! তখন আমি সামলাতুম কী করে? তুমি তো বলেই খালাস। সামলাবার বেলায় তো সেই আমিই। এখন যদি কিছু গণ্ডগোল হতো তো তোমরা তো আমারই দোষ দিতে। আমি যা করেছি সব দিক ভেবে-চিন্তেই করেছি।

চৌধুরী মশাই বললেন–তাহলে সকলকে বলে দিও যেন কেউ আবার বউমাকে উল্টো কথা না বলে দেয়। প্রকাশকেই যা ভয়। সে সব সময় যা বকবক করে, হয়ত তখন বউমার কাছে সব ফাঁস করে দেবে। তা প্রকাশ কোথায়?

প্রীতি বললে–কোথায় আবার যাবে? তাকে পাঠিয়েছি খোকার খোঁজে–সে তো সেই সকাল বেলাই বেরিয়েছে, মুখে জল পর্যন্ত দেয়নি। তার জন্যেই তো বসে আছি–

চৌধুরী মশাই সব শুনে যেন একটু নিশ্চিন্ত হলেন। মাঝরাত থেকেই তিনি একবার ঘর একবার-বার করছেন। ভেতরে বাইরে তাঁর অশান্তি। ছেলের বিয়ে দেবার আগে পর্যন্ত তেমন কোনও ঝঞ্ঝাট ছিল না। মন দিয়ে সব কাজকর্ম দেখতে পারতেন। আদায়-পত্র নিয়েই তাঁর সময় কাটতো। কিন্তু এ কী বিপদ ঘাড়ে চাপলো তাঁর। এমনি করে আর কিছুদিন চললেই তো হয়েছে। জমিদারি করা একেবারে লাটে উঠে যাবে তাঁর। এত কষ্টের পয়সা সব সাত ভূতে লুটে-পুটে খাবে।

তিনি আর দাঁড়ালেন না সেখানে। বললেন–আমি আসি, আমার এখানে বসে থাকলে চলবে না,–ওদিকে আমার অনেক কাজ পড়ে আছে–

বলে তিনি বার বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

.

বহুদিন আগে কালীগঞ্জের জমিদারের কাছে নায়েবী করবার সময় কর্তাবাবু প্রথম শিখেছিলেন কাকে বলে পরচা, কাকে বলে খতিয়ান, কাকে বলে জমাবন্দী, কাকে বলে ওঠবন্দী, কাকে বলে খাতক, মহাজন, তমসুক, আর কাকে বলে নজরানা।

সাধ ছিল একদিন তিনিও নতুন এক জমিদারির মালিক হবেন। আর যেমন করে চক্রবর্তী মশাই পরের উপার্জিত ধনের ভোগ-দখল করছেন, তেমনি তিনিও করবেন। তিনিও প্রজার দখল দেবেন, প্রজা উচ্ছেদ করবেন, মহাজন হয়ে প্রজাদের টাকা দাদন দেবেন, খাজনা আদায়ের সময় নজরানা নেবেন।

তা সে সবই তাঁর হয়েছিল। বলতে গেলে হর্ষনাথ চক্রবর্তীর চেয়েও বেশি হয়েছিল। যখন কর্তাবাবুর ছেলে হয়েছিল তখন তাকেও নিজের শেখা বিদ্যের তালিম দিয়েছিলেন। ছেলেও সব কিছু মন দিয়ে শিখে নিয়েছিল। কিন্তু মানুষের ত আশার শেষ থাকে না। মনে হয় ছেলে না-হয় শিখলো। কিন্তু নাতি? তা নাতিও না-হয় শিখলো, সব সম্পত্তির আয়ও বাড়লো। কিন্তু নাতির নাতি? নাতির নাতির নাতি? আর শুধু তাও নয়, যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ এ থাকবে তো!

কর্তাবাবুর পরে চৌধুরী মশাইয়েরও ছিল ওই একই চিন্তা। কীসের জন্যে এত পরিশ্রম, কীসের জন্যে এত অর্থ-উপার্জন? ছেলে যদি সংসারী না হয়, ছেলের যদি বংশরক্ষা না হয়–তাহলে কী হবে?

তা সেদিনও আবার রাত হলো।

কোটি-কোটি বছর ধরে পৃথিবীতে কত কোটি-কোটি বার রাত হয়েছে। কিন্তু সেদিন রাত না হলে কার কী এমন লোকসান হতো!

চৌধুরী মশাই সেদিনও ওপরের ঘরে শুতে যাচ্ছিলেন। যাবার আগে বললেন–আমি যাই, আজকে একটু সকাল সকাল ওপরের ঘরে শুতে যাবো

কদিন ধরেই চৌধুরী মশাই ওপরে শুচ্ছেন। তবু সেদিন যেন তাঁর একটু বেশি তাড়া ছিল। কদিন ধরেই চৌধুরী মশাইএর মনে হচ্ছিল বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে, আর নয়।

প্রীতি বললে–আর কতদিন এমনি করে কষ্ট করবে?

চৌধুরী মশাই বললেন তুমি তো কেবল আমার শরীরের কষ্টের কথাই ভাবছো, আর কত টাকা যে নষ্ট হয়ে গেল তা তো কেউ ভাবছো না একবারও! টাকা নষ্ট হওয়াও যা, রক্ত নষ্ট হওয়াও তাই। রক্ত নষ্ট হলে তবু একদিন রক্ত হয়, ঘি-দুধ খেলে রক্ত বাড়ে, কিন্তু টাকা গেলে কি আর তা ফিরে আসে? জলের মত আমার টাকাগুলো খরচ হয়ে যাচ্ছে অথচ আমি কিছু করতে পারছি না–

প্রীতি বললে–তা বলে মানুষকে তো মেরে ফেলা যায় না–

চৌধুরী মশাই রেগে গেলেন। বললেন–কেন? কেন মেরে ফেলা যাবে না? যে-মানুষ ভুগে ভুগে কষ্ট পাচ্ছে তাকে যদি গলা টিপে মারি অন্যায়টা কীসের শুনি?

প্রীতি বললে–তুমি বলছো কি? জলজ্যান্ত মানুষকে তুমি গলা টিপে মারবে?

–কেন মারবো না? তাতে রুগীও বাঁচবে, আমার টাকাও বাঁচবে।

–কিন্তু হাজার হোক নিজের বাবা তো তোমার! তাকে মারতে তোমার মনে লাগবে না?

চৌধুরী মশাই বললেন–কেন লাগবে? আগে হলে তবু লাগতো, কিন্তু এখন কেন লাগবে? এখন আমি পাথর হয়ে গিয়েছি। এখন মায়া-দয়া বলতে আর কিছু নেই আমার। কর্তাবাবুই তো একদিন আমাকে দয়া-মায়া করতে বারণ করেছিলেন। মায়া-দয়া করলে কি আর আমার এ জমি-জমা রাখতে পারবো মনে করেছ?

বলতে বলতে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আবার ফিরে দাঁড়ালেন। বললেন–বউমা কোথায়?

প্রীতি বললে–কোথায় আবার থাকবে? নিজের ঘরে–

–তা প্রকাশ কোথায়? প্রকাশ এখনও ফেরেনি?

–ফিরলে তো তুমি দেখতেই পেতে।

চৌধুরী মশাই কথাটা শুনে যেন নিজের মনেই বলতে লাগলেন–আমি যে কোন্ দিকটা দেখি তা বুঝতে পারছি না। একটা মানুষ কত দিক সামলাবো বলে দিকিনি। একটা ছেলে ছিল তাও অমানুষ হয়ে গেল। তার দ্বারা কোনও কাজ হবার জো নেই। সে কোথায় গিয়ে রইল তারও কোনও ঠিক-ঠিকানা পেলুম না। হয় আমি পাগল হয়ে যাবো নয়তো আত্মহত্যা করবো।

কথাগুলো বলে চৌধুরী মশাই বাইরে চলে গেলেন। কিন্তু প্রীতির অনেকক্ষণ ধরে কোনও ঘুম এলো না। আস্তে আস্তে অন্য রাতের মত সেরাতেও চারদিকে সব শান্ত হয়ে এলো। অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দোতলার ঘরের দিকে কান পেতে রইলো প্রীতি। যদি কিছু শব্দ আসে, যদি কোনও কান্না কানে আসে! কারো চাপা-গলার আর্তনাদ! কথাটা ভাবতেই প্রীতির মনে হলো তার গলাও যেন কেউ টিপে ধরেছে। গলা টিপে ধরলে কী রকম যন্ত্রণা হয় সেটাও কল্পনা করতে চাইলে প্রীতি। কিন্তু যদি কেউ টের পায়! আর মারতেই যদি হয় তো ডাক্তারি ওষুধ খাইয়েই তো মারা ভালো। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলেই হয়। তা হলে সে-ঘুম আর কোনও দিন ভাঙবে না। নিঃশব্দে আরামে মারা যাবে। খুন করার দায় থেকেই মানুষ অব্যাহতি পাবে।

হঠাৎ যেন বাইরে খট করে একটা শব্দ হলো।

প্রীতি কানটাকে খাড়া করে রইল। মানুষকে গলা টিপে মারলে কি ওই রকম খট করে শব্দ হয়? কিন্তু কেন? কেন মানুষকে খুন করবার দরকার হবে বুঝতে পারলে না সে! এই জন্যেই তো খোকা এমন হয়েছে।

কিন্তু প্রীতি জানতে পারলে না যে এ বাড়ির আর একটা ঘরে তখন আর একজনও জেগে রয়েছে।

নয়নতারা প্রতি দিনের মত সেদিনও চোখ বুজে শুয়ে ছিল। কিন্তু আর থাকতে পারলে না। চারিদিকে যখন সব নিঝুম হয়ে এল তখন বোঝা গেল কোথাও আর কেউ জেগে নেই। এই-ই তার সুযোগ। এইবার সে দরজা খুলে ওপরে যাবে। এবার সোজা গিয়ে তার ঘরের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দেবে।

হয়ত দরজা খুলবে না মানুষটা। কিম্বা হয়ত দরজা খোলাই আছে। অসুস্থ মানুষের ঘরের দরজা তো খোলাই থাকে সাধারণত।

নয়নতারা শুধু গিয়ে তাকে একবার জিজ্ঞেস করবে–এ তুমি কী করলে? তুমি নিজের ওপরে কেন এমন শাস্তি নিলে বলো? কার জন্যে?

মানুষটা হয়ত মাঝরাত্রে হঠাৎ তাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। হয়ত কোনও কথার উত্তর দিতে পারবে না।

–তুমি কি আমাকে শাস্তি দেবার জন্যে নিজের ওপর এই শাস্তি তুলে নিলে?

মানুষটা হয়ত তার কথার কোনও জবাব দেবে না। কিন্তু এবার আর ছাড়বে না নয়নতারা। এবার তার কাছ থেকে জবাব সে আদায় করবেই–

ভেতর বাড়ি পেরিয়ে বার বাড়ি। এতদিন বিয়ে হয়েছে নয়নতারার কিন্তু কখনও এমন করে বার বাড়িতে আসেনি। বার বাড়ি যাবার মুখেই দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। দোতলার ঘরে যেতে গেলে এই সিঁড়ি দিয়েই উঠতে হয়।

নয়নতারা টিপি টিপি পায়ে দেয়াল ধরে ধরে ওপরে উঠতে লাগলো।

কোথায় কোন্ ঘরে মানুষটা শুয়ে আছে তাও জানা নেই। শাশুড়ি শুধু এইটুকু বলেছে যে সে দোতলার ঘরে আছে। কিন্তু দোতলায় কটা ঘর? কর্তাবাবুর ঘর তো দোতলায়। হয়ত পাশাপাশি দুটো ঘর। একজন ঠাকুর্দা আর একজন নাতি। দুজনেই অসুস্থ। তাই দু’জনেই ওপরে থাকে।

বড় ভয় করতে লাগলো নয়নতারার। একে শীতে সমস্ত শরীরটা কাঁপছে, তার ওপর ভয়, যদি কেউ দেখে ফেলে! যদি কেউ সন্দেহ করে। যদি কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে তো সে তাকে কী জবাব দেবে।

বাগানের দিক থেকে একটা প্যাঁচা হঠাৎ ডেকে উঠেছে। ডাকটা শুনেই নয়নতারা সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে থমকে দাঁড়ালো। সিঁড়ির দু’পাশে দেয়াল। দু’পাশের দেয়ালে হাত দিয়ে দিয়ে সাবধানে ওপরে উঠছিল নয়নতারা।

একবার মনে হলো দরকার নেই। মনে হলো যেমন চুপি চুপি সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে আবার তেমনি করে সে ফিরে যাবে। এই কাঙালপনা তার আর ভালো লাগলো না। যে তার মুখ দেখতে চায় না, জোর করে তাকে তার নিজের মুখ দেখানোএর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে! বিয়ে করেছে বলে কি এতই ছোট হয়ে গেছে সে? এতই তাচ্ছিল্য করবার মত মানুষ নয়নতারা!

নয়নতারা ফিরেই আসছিল। কিন্তু আবার উঠতে লাগল। না, হেরে যাবার জন্যে সে এ বাড়ির বউ হয়ে আসেনি। কেন হারতে যাবে সে? বাবা তো তাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই শিখিয়েছে বরাবর। এখানে এই শ্বশুরবাড়িতেও সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

আবার সে ওপরে উঠতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়ির যেখানে শেষ ধাপ সেখানেই একটা বারান্দা মতন। তার পাশেই একটা ঘরের মত মনে হলো। ঘরের ভেতরে মনে হলো টিম-টিম করে একটা হারিকেন জ্বলছে।

এটা কার ঘর? এই ঘরের মধ্যেই শুয়ে আছে নাকি সে?

নয়নতারার আবার যেন কেমন সঙ্কোচ হতে লাগলো। যদি তাকে দেখে আবার মানুষটা রেগে ওঠে! আবার সমস্ত শাস্তি নিজের মাথায় তুলে নেয়! আবার যদি সে অজ্ঞান-অচৈতন্য হয়ে পড়ে। তখন তা সব জানাজানি হয়ে যাবে।

রাত তখন অনেক। সমস্ত নবাবগঞ্জ ঘুমোচ্ছে। এতটুকু সাড়াশব্দ নেই কারো।

দরজাটা বন্ধ। নয়নতারা বারান্দা দিয়ে পাশের জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ালো। জানালার আধখানা পাল্লা খোলা।

সেই খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলে।

হঠাৎ অস্পষ্ট আলোয় মনে হলো ঘরের মধ্যে কে যেন নড়ে বেড়াচ্ছে। এ কার ঘর? এই কি কর্তাবাবুর ঘর নাকি?

হঠাৎ নজরে পড়লো তার শ্বশুর!

ভালো করে দেখলে চেনা যায় তার শ্বশুরকে। চৌধুরী মশাই এত রাত্রে ঘরের মধ্যে নড়ে বেড়াচ্ছেন কেন? এত রাত্তিরে চৌধুরী মশাই জেগে ঘরের মধ্যে কী করছেন?

বুকটা থর-থর করে কাঁপছে নয়নতারার। কিন্তু তবু চোখ দুটো বন্ধ করে থাকতে পারলে না।

দেখলে চৌধুরী মশাই আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আর তার একটু দূরে মেঝের ওপর শুয়ে আছে একজন বুড়ো মানুষ। ঘুমন্ত বুড়ো মানুষটার সারা শরীর চাদর দিয়ে ঢাকা।

হয়ত উনিই কর্তাবাবু। কর্তাবাবুর নামই সে বরাবর শুনে এসেছে। দেখেনি সে কখনও। একবার শুধু দেখেছিল। সেও ঠিক দেখা নয়। নতুন বউ হয়ে যখন এসেছিল সে তখন শুধু ওপরে উঠে একবার ঘোমটায় মুখ ঢেকে প্রণাম করেছিল কর্তবাবুকে। আর তারপর এই আজ।

নয়নতারার চোখ দুটো হঠাৎ বড় কৌতূহলী হয়ে উঠলো।

নয়নতারা দেখলে চৌধুরী মশাই কর্তাবাবুর মুখের সামনে নিচু হয়ে বসলেন। কী যেন তিনি দেখতে লাগলেন কর্তাবাবুর মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে। তারপর দুটো হাত কর্তাবাবুর গলার কাছে তুলে নিয়ে এক মুহূর্ত বুঝি দ্বিধা করতে লাগলেন।

নয়নতারা একটা অজ্ঞাত বিপদ কল্পনা করে নিয়ে ভয়ে আর্তনাদ করতে যাচ্ছিল। না না না, তোমরা খুনী, তোমরা সবাই খুনী! তুমি ঠিক বলেছিলে তুমি ঠিকই করেছিলে গো এ বংশের রক্তের মধ্যে পাপের জীবাণু মেশানো আছে! এরা কপিল পায়রাপোড়াকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে আত্মঘাতী করিয়েছিল, এরা মাণিক ঘোষের ভাতের থালা পা দিয়ে ঠেলে ফেলে টিনের চাল খুলে নিয়েছিল, এরা ফটিক প্রামাণিককে রাস্তায় পাগল করিয়ে ছেড়েছিল। এদের তুমি ক্ষমা কোর না গো, এদের শাস্তি তুমি মাথায় তুলে নিয়েছ ঠিকই করেছ।

নয়নতারা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো–না-না-না—

কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোবার আগেই পেছন থেকে ডাক এলো—বউমা–

সঙ্গে সঙ্গে নয়নতারা যেন বাস্তবে ফিরে এসেছে।

দেখলে পেছনে শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

শাশুড়ী বললে–এসো বউমা, এসো, এদিকে এসো–

বলে সিঁড়ি দিয়ে আগে-আগে নিচে নামতে লাগলো। নয়নতারাও শাশুড়ির পেছন-পেছন নিচেয় এল। তারপর একেবারে নয়নতারাকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে শাশুড়ি বললে–তুমি এত রাত্তিরে ওপরে গিয়েছিলে কী করতে?

নয়নতারা হতবাক হয়ে তখনও চুপ করে আছে। চোখের সামনে যেন তখনও দৃশ্যটা ভাসছে। তখনও যেন চৌধুরী মশাই কর্তাবাবুর গলার কাছে দুটো হাত উঁচু করে আছে

–কই বউমা, কথা বলছো না যে? ওপরে কী করতে গিয়েছিলে, বলো!

নয়নতারা বললে–আপনি যে বলেছিলেন উনি ওপরের ঘরে আছেন। তাই দেখা করতে গিয়েছিলুম।

–তা বলে এই রাত্তির বেলা যেতে হয়? তোমার কি আক্কেল বলে কিছু থাকতে নেই? তুমি আমাকে যাবার আগে জিজ্ঞেস করলে না কেন? আমি কি তোমাকে যেতে বারণ করতুম? তুমি যে হঠাৎ ওপরে গেলে, তা ওপরে কখনও গিয়েছ তুমি?

নয়নতারা বললে–কিন্তু আমি যে আর থাকতে পারছিলুম না মা, আমি যে ছটফট করছিলুম ওঁর সঙ্গে একবার দেখা করবার জন্যে।

শাশুড়ি বললে–না, আর কখনও এমন কাজ কোর না, তুমি এ বাড়ির নতুন বউ, আমাকে না বলে তুমি আর কোথাও যেও না। বুঝলে?

তারপর একটু থেমে বললে–তুমি জানলায় উঁকি দিয়ে কী দেখছিলে?

নয়নতারা কী বলবে বুঝতে পারলে না!

–বলো কী দেখছিলে?

নয়নতারা শাশুড়ির চোখের দিকে চেয়ে ভয় পেয়ে গেল।

বললে–আমি কিছু দেখিনি–

–দেখিনি মানে? আমি যে দেখলুম তুমি জানলায় উঁকি দিচ্ছ? এ কী রকম স্বভাব তোমার, পরের ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখা? বলো কী দেখেছ?

নয়নতারা বললে–আমি ওঁকে খুঁজছিলুম–

ওঁকে মানে? খোকাকে? খোকার সঙ্গে যদি দেখা করবার এত ইচ্ছে তোমার তো আমাকে বললে না কেন? আমিই তোমাকে সঙ্গে করে খোকার ঘরে নিয়ে যেতুম। এ-স্বভাব তো তোমার ভালো নয় বউমা–

হয়ত এই প্রসঙ্গে আরো অনেক কথা বলতো শাশুড়ি। কিন্তু বাইরে যেন কার পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।

–কই, কোথায় গেলে তুমি?

শাশুড়ি হঠাৎ কথা থামিয়ে বললে–তুমি বোস আমি আসছি—

বলে বাইরে চলে গেল।

আর নয়নতারা সেই নিজের ঘরের বিছানার ওপর বসে বসেই ভাবতে লাগলো এ কী রকম বাড়ি! এ কী রকম বাড়িতে বিয়ে হয়েছে তার! এ কী রকম শাশুড়ি, এ কী রকম শ্বশুর, এ কী রকম সংসার! তাহলে তার স্বামী যা বলেছিল কিছুই তো মিথ্যে নয়? কালীগঞ্জের বউকে তাহলে এখানেই খুন করা হয়েছে! তাহলে কি সেই কালীগঞ্জের বউ এর অভিশাপই শেষ পর্যন্ত ফললো?

বাইরের একটা শব্দে হঠাৎ নয়নতারা চমকে উঠলো। মনে হলো দীনুর গলা। দীনু বাইরে থেকে বলছে–ছোট মশাই, একবার শিগগির আসুন, কর্তাবাবু যেন কেমন করছেন—

.

জীবনের যদি কোনও একটা মানে থাকে তো সে-মানেটা হলো এই যে জীবন কখনও থেমে থাকে না, সে চলে। চলতে চলতে কখনও সে অচলায়তনে গিয়ে শেষ হয় আবার কখনও অনন্তে গিয়ে পরিপূর্ণতা পায়। এই পরিপূর্ণতা পাওয়াটাই হলো আসল পাওয়া। একদিন সদানন্দও এমনি করে চলতে আরম্ভ করেছিল। সেই চৌধুরী বংশে জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল তার চলা। সব মানুষই তো এমনি করে চলা শুরু করে। কিন্তু তারই মধ্যে হঠাৎ এক-একজনেরই বা কেন মাঝপথেই অচলায়তন এসে পথ আটকে দাঁড়ায়? সদানন্দেরও এমনি যাত্রাপথের মাঝখানে একদিন বাধা এসে দাঁড়ালো। সে এক এমন বাধা যে তার মনে হলো সামনে চলবার আর বুঝি পথ নেই।

কিন্তু না, মানুষ তো পালিয়ে রেহাই পায় না। পালিয়ে যাওয়া মানেই তো থেমে যাওয়া। থামবার জন্যে তো সে জন্মায়নি। থেমে গিয়েছিল কর্তাবাবু, থেমে গিয়েছিল চৌধুরী মশাই। যদি সদানন্দ নয়নতারার সঙ্গে মানিয়ে-গুনিয়ে আপোস করে ঘরসংসার করতো তাহলেই সে হয়ত থেমে যেত। চৌধুরী মশাই-এর মতই সে চণ্ডীমণ্ডপে বসে সেরেস্তার খাতা-পত্র দেখতো। তার জমিজমার অঙ্ক বাড়তো আর বংশপরম্পরায় বিষয়-সম্পত্তি ভোগদখল করতো।

কিন্তু তা হলো না।

নবাবগঞ্জের লোকের তখন পরের বাড়ির ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। কোথা থেকে কে যেন খবর এনে দিলে যে যুদ্ধ বেধেছে। বারোয়ারিতলায় নিতাই হালদারের দোকানের সামনের মাচায় সেদিনও তেমনি তাসের আড্ডা বসেছে।

কেদার দাস তাস খেলতে খেলতে জিজ্ঞেস করলে কার সঙ্গে কার যুদ্ধ বেধেছে রে?

পাশেই ছিল পরমেশ মৌলিক। বললে–খেলার সময় বাজে কথা বলবিনে কেদার, খবরদার, আগে তাস দে–

যুদ্ধের কথা আর আলোচনা হলো না। যে যুদ্ধতে সারা পৃথিবীর ভূগোল-ইতিহাস রাজনীতি অর্থনীতি সব কিছু ওলোট-পালোট হয়ে গেল তা নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামালো না। নবাবগঞ্জ যেমন চলছিল তেমনিই চলতে লাগলো। পূজোর সময় যাত্রা, কবিগান, পাঁচালী চলতে লাগলো আর বাকি বারোমাস ক্ষেত-খামারের কাজ।

সেদিনও রাত্রের দিকে কবিগান চলছে বারোয়ারিতলায়। বেশ ভিড় হয়েছে চারদিকে। কবিয়াল গান গাইছে:

চৈত্র মাসে চালতে মিঠে
মিটে ডাহুকের রাও।
গাছের তলায় ছায়া মিঠে
মিঠে দখিন বাও।।
খয়ের মিঠে পানে রে ভাই
পান মিঠে চুনে।
বয়েস কালে কামিনী মিঠে
ঘৃত মিঠে নুনে।

সারাদিনে খাটাখাটুনি করে সবাই আসর জাঁকিয়ে গান শুনতে বসেছে। বেশ মজা লাগছে। পৃথিবীর কোথায় কোন্ কোণে যুদ্ধ বেধেছে, মারামারি লাঠালাঠি চলেছে, কোথায় ইংলন্ড, কোথায় জার্মানী আর কোথায় বা জাপান তা জানবার দরকার নেই আমাদের। যুদ্ধ বাধলেও যা, আর না বাধলেও তাই। আমাদের পক্ষে সবই সমান। আমাদের খেটে খাওয়ার কপাল। আমাদের যখন বরাবর খেটেই খেতে হবে তখন ও-সব রাজারাজড়ার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী! তার চেয়ে এই যাত্রা কবিগান পাঁচালি নিয়েই মেতে থাকি। আর আছে তাস। তাস খেলতে খেলতেই রাতগুলো কাবার করে দিই–

হঠাৎ আসরের এক কোণ থেকে অনুরোধ এলো–একটু রসের গান হোক এবার আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম–

তা রসের গানই শুরু হলো একটার পর একটা।

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
কারো মুখে যদি শুনিতাম।
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও-বিষ ভখিতাম।।

সঙ্গে সঙ্গে সারা আসরময় হুল্লোড় পড়ে গেল। রীতিমত তারিফের হুল্লোড়। এই গানটা অনেকবার শুনেছে নবাবগঞ্জের লোক। তবু এ-গান যেন পুরোন হতে নেই নবাবগঞ্জের লোকদের কাছে। কবিয়ালের দল এলেই বায়না ধরে–ওই গানটা গাও হে, আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম–

ভিড়ের ভেতরে এক কোণে বসে একটা লোক একমনে গানটা শুনছিল। আর ভাবছিল রাধার কথা। ছোট বেলায় সেই রানাঘাটের রাধার বাড়িতেই গানটা প্রথম শুনেছিল সে।

হঠাৎ পাশ থেকে একজন বলে উঠলো–আরে সদা না? সদা তুই? তুই অ্যাদ্দিন পরে কোত্থেকে এলি?

সদানন্দ এতক্ষণ নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল। কেউ জানতে পারেনি তার কথা। চুপি চুপি এতকাল পরে এসে পৌঁছেছিল নবাবগঞ্জে।

পাশেই বসে ছিল কেদার। সেও দেখলে। সেও চিনতে পেরেছে। আরে তুই? তুই কোত্থেকে এলি?

শুধু কেদার নয়, কেদার, গোবর্ধন, নিতাই হালদার, গোপাল ষাট সবাই একবারে হই হই করে উঠেছে। চৌধুরীবাড়িতে এতদিন এত কাণ্ড হয়ে গেল আর যাকে নিয়ে কাণ্ড সে-ই এতদিন পরে সশরীরে এখানে এসে হাজির!

–কোথায় ছিলি তুই এতদিন?

সকলেরই ওই এক প্রশ্ন। এ কী চেহারা হয়েছে সদার! এই ক’বছরে একেবারে ভোল পালটে ফেলেছে সদা। মুখে অল্প-অল্প খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। গায়ে ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে ছেঁড়া চটি।

সদানন্দ হাসতে লাগলো।

কেদার বললে–হাসছিস যে?

সদানন্দ বললে–ওই গানটা শুনে। ওই গানটা শুনলেই আমার অন্য কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয় লোকটা ভূলে গাইছে। ‘শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত’ কথাটা ঠিক নয়, ওটা হবে ‘টাকার পীরিত গরল মিশ্রিত’।

বলে আবার হাসতে লাগলো।

নিতাই বললে–তোর বাবার সঙ্গে দেখা করেছিস?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, বাবা বাড়িতে ঢুকতে দিলে না। বাড়ি থেকে বার করে দিলে—

বলে আবার হাসতে লাগলো।

পরমেশ মৌলিকও শুনছিল পাশে বসে। সেও অবাক হয়ে গেল। বললে–তোমাকে ঢুকতেই দিলেন না চৌধুরী মশাই?

পরমেশ মৌলিকের চাকরি চলে গিয়েছিল। শুধু পরমেশ মৌলিক নয়, সকলের চাকরিই চলে গিয়েছিল। কৈলাস গোমস্তা, দীনু কেউই নেই আর তখন চৌধুরী বাড়িতে। কৈলাস, দীনু, পরমেশ মৌলিক সবাই তখন চাকরি করছে বেহারি পালের আড়তে।

সত্যিই এ কবছরে নবাবগঞ্জের ভেতরে যে এত পরিবর্তন হয়ে গেছে তা সদানন্দ জানতো না। যখন নবাবগঞ্জে এসে সে পৌঁছেছিল তখন কেউই জানতে পারেনি। বহুবছর পরে আসা। বলতে গেলে এক যুগ। এই এক যুগে যে কত কী ঘটে গেছে তা যেন ভাবাও যায় না। সমস্ত পৃথিবীটাই সদানন্দের দেখা হয়ে গিয়েছিল। জীবনের প্রদক্ষিণ-পথে কেন যে আবার সে তার জন্মভূমিতে ফিরে এল তা সে-ই জানতো। ভেবেছিল সে এসে দেখবে তার রক্তারক্তির ফলে কোথায় কী প্রতিক্রিয়া হলো! যে কর্তাবাবু তাঁর বংশরক্ষে করবার জন্যে এত আয়োজন করেছিলেন তার শেষটাও দেখবার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু শুধু কর্তাবাবুর শেষটাই নয়, ফিরে এসে অনেক কিছুই শেষ দেখতে পেলে সদানন্দ। দেখলে যে বাড়িতে একদিন সে জন্মেছে সে বাড়ি তখন ঠিক সেই কালীগঞ্জের জমিদারের বাড়ির মতই ভূতের বাড়ি হয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে সদানন্দ বারবাড়ির উঠোনে ঢুকলো। সেই উঠোন যেখানে বিধু কয়ালের ছেলে ধান-চাল-সরষে আর পাটের ওজন নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ডান দিকে চণ্ডীমণ্ডপ। তার পাশেই বংশী ঢালীর ঘর। সব ফাঁকা। জায়গাটার চারদিকে আগাছা ঝোপঝাড় জন্মে একেবারে যাতায়াতের রাস্তা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরে ভেতর বাড়ি। ভেতরবাড়িতে ঢুকতে কেমন ভয় করতে লাগলো সদানন্দর। মনে হলো কে যেন পেছন থেকে ডাকলে– খোকা–

সদানন্দ শিউরে উঠেছে। কে?

ঠিক যেন মা’র গলার মতন। সদানন্দও ডাকলে–মা–

সদানন্দর গলার আওয়াজ পেয়ে একদল চামচিকে কড়িকাঠ থেকে ফর ফর করে বাইরে উড়ে গেল। অনেকদিন ঝাট পড়েনি বারান্দায়। অনেকদিন যেন কারোর পায়ের স্পর্শও পড়েনি বাড়িতে। যেন সব বিশৃঙ্খলা চারদিকে। কিন্তু ভেতরবাড়ির দরজার সামনেই বাধা পড়লো। দরজার মাথায় তালা ঝুলছে। আর সামনে যাওয়া গেল না। সদানন্দ এবার চলে আসছিল। পাশে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। কেন মনে হলো যেন ওপরে দোতলায়ও সে গিয়ে দেখবে। এ সমস্ত বাড়িরই তো উত্তরাধিকারী সে। সে নরনারায়ণ চৌধুরীর পৌত্র, হরনারায়ণ চৌধুরীর একমাত্র সন্তান। তার এ বাড়ির সর্বত্র যাবার অধিকার আছে।

আধখানা উঠেই মনে হলো যেন ওপরের ঘর থেকে একটা অস্পষ্ট আলোর ক্ষীণ রেখা আসছে। তাহলে ওপরে নিশ্চয়ই কেউ আছে। তার পায়ের বোধহয় আওয়াজ হয়েছিল সামান্য। সেই সামান্য আওয়াজেই কে যেন ভেতরে সচেতন হয়ে উঠেছে।

–কে?

শুনেই বোঝা গেল চৌধুরী মশাই-এর গলা। সমস্ত নিস্তব্ধতার মধ্যে একজন সজীব মানুষের চলা-ফেরা তাঁকে বিচলিত করে তুলেছে। কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে চৌধুরী মশাই আবার বললেন–কে? কে ওখানে?

সদানন্দ স্পষ্ট গলায় বললে—আমি–

চৌধুরী মশায় উত্তরটা শুনে বোধ হয় খুশী হলেন না। বললেন–আমি কে? নাম নেই–?

সদানন্দ বললে–আমি সদানন্দ–

সঙ্গে সঙ্গে চৌধুরীবাড়ির মাথায় যেন বাজ পড়লো। সদানন্দর মুখের সামনে দরজাটা হাট করে খুলে গেল এক মুহূর্তে। আর সদানন্দ দেখতে পেলে সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা।

খানিকক্ষণ দু’জনের মুখেই কোনও কথা নেই। যেন দু’জনেই দুজনের সামনে ভূত দেখেছে। একদিন এই সদানন্দকে ঘিরে যে-লোকটার ভাবনা-চিন্তা-আনন্দ আর শান্তির শেষ ছিল না সেই তাকেই সামনে দেখে তিনি কী যে করবেন ভেবে পেলেন না। একদিন নিজের মাথায় আঘাত করে এ বাড়ির কপালেও এক চরম আঘাত দিয়েছিল এই সদানন্দ। এই চৌধুরী মশাই-এর আজ সব গেছে। এই সদানন্দের জন্যে চৌধুরী মশাই সমস্ত গ্রামের লোকের কাছে চরম কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়েছিলেন। এর জন্যেই তাঁর সর্বস্ব গেছে, তাঁর মান-মর্যাদা বংশ সমস্ত ধুলোয় মিশেছে। এই এর জন্যেই তিনি আজ অভিশাপগ্রস্তের মত দিন কাটাচ্ছেন। আর তিনি যখন সর্বনাশের শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছেন ঠিক তখনই কিনা আবার এ এসে হাজির হয়েছে।

–কেন এসেছ? কেন এসেছ বলো?

সদানন্দ কোনও উত্তর দিলে না। শুধু হাসলো একবার ঠোঁটের ফাঁকে।

–আবার হাসছো? তোমার লজ্জা করে না? কেন এলে আবার আমার বাড়িতে?

সদানন্দ তবু কোনও উত্তর দিলে না। যেমন হাসছিল তেমনিই হাসতে লাগলো।

–হাসছো কেন? কথার জবাব দাও?

সদানন্দ এবার স্পষ্ট করে হাসতে লাগলো। যেন চৌধুরী মশাই-এর সর্বনাশ দেখে সে খুশী হয়েছে। যেন বলতে চাইছে–আমি তো আগেই সাবধান করে দিয়েছিলুম। বলেছিলুম কালীগঞ্জের বউ-এর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে। তখন তো আপনারা আমার কথা শোনেননি। তখন তো আপনারা জোর করে আমাকে আমার ঘরে পুরে সুন্দরী বউকে সামনে লেলিয়ে দিয়ে দরজায় শেকল দিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তো ভেবেছিলেন মেয়েমানুষের সুন্দর মুখ দেখে আমি ভুলে যাবো। ভেবেছিলেন দশ হাজার টাকার খেসারত আর আপনাদের দিতে হবে না। কিন্তু কোথায় গেল সেই দশ হাজার টাকার ধাপ্পা? এখন যে তার গুণোগার দিতে হচ্ছে দশ লাখ টাকার সেলামী গুনে দিয়ে! কিন্তু এই দশ লাখ টাকার সেলামী গুণে দিয়েও কি কালীগঞ্জের বউ-এর রক্তের ঋণ শোধ করতে পারবেন? এখনও যে অনেক গুণোগার বাকি আছে।

–বলো, কেন এসেছ তুমি? বলো, কথার জবাব দাও! কথা বলছো না কেন? সদানন্দ জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। তবু তার মনের কথাগুলো বুঝি চোখের ভাষায় স্পষ্ট হয়ে উঠলো। তার চোখ দুটো বললে–কেন এসেছি? এসেছি মানুষ কেমন করে রক্তের ঋণ শোধ করে তাই দেখতে! কপিল পায়রাপোড়া, মাণিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিকের রক্ত, কালীগঞ্জের বউ-এর রক্ত কি মিথ্যে হবে?

চৌধুরী মশাই আর থাকতে পারলেন না। বললেন–কথার জবাব দেবে না তো বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও আমার সামনে থেকে, যাও বেরিয়ে–

সদানন্দ আর দাঁড়ালো না। সদানন্দ বেরিয়ে আসবার আগেই চৌধুরী মশাই-এর দরজাটা তার মুখের ওপরেই দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে আসতেই হঠাৎ যেন আবার সেই ডাক–খোকা–

সদানন্দ এক মুহূর্তের জন্যে একটু থমকে দাঁড়ালো। একবার চারিদিকে চাইলে। কই, কোথাও তো কেউ নেই, তবে কে তাকে ডাকলে?

–খোকা! তুই এসেছিস?

এবার সদানন্দ বড় ভয় পেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি বারান্দা পেরিয়ে সদরের দিকে পা বাড়াবার চেষ্টা করলে। হঠাৎ একটা কালো ছায়ার মত কে যেন পায়ের কাছে এসে তাকে শুঁকতে লাগলো।

–কে? কে? কে?

না, কেউ নয়। মিছিমিছি ভয় পেয়েছিল সদানন্দ। ছায়াটা একটা কুকুর। তাদেরই আশ্রিত কুকুর। বাড়ি পাহারা দিচ্ছে উঠোনে বসে। অথচ অবলা জীবটা জানে না যে পাহারা দেবার মত কিছু নেই আর এবাড়িতে। এতদিন পাহারা দিয়েই কি তুই কিছু আটকাতে পেরেছিস! সর্বনাশ যখন আসে তখন হাজার পাহারা দিলেও আসে, পাহারা না দিলেও তা আসে। পাইক বরকন্দাজ-লাঠিয়ালবন্দুক রাইফেল দিয়েও তা রোধ করা যায় না। কারণ আর কেউ না জানুক সদানন্দ ভালো করেই জানতো–তুমি হাজার চেষ্টা করলেও জীবনের মত মৃত্যুকেও ঠেকানো যায় না। পৃথিবীতে একমাত্র মৃত্যুরই মৃত্যু নেই। এ-পৃথিবীতে একমাত্র মৃত্যুই অবিনশ্বর।

সেখান থেকে দৌড়তে দৌড়তে সে সোজা এসে দাঁড়ালো বারোয়ারিতলায়। সেখানে তখন অসংখ্য মানুষের ভিড়। লণ্ঠন জ্বালিয়ে কবিয়ালের আসর বসেছে। কবিয়াল তখন সেই চেনা গানটাই রসিয়ে রসিয়ে গাইছে।

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
কারো মুখে যদি শুনিতাম ॥
কূলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও-বিষ ভখিতাম ॥

সদানন্দ সেখানে গিয়ে নিঃশব্দে ভিড়ের মধ্যে বসে পড়লো।

.

সে বহুদিনের কথা। সে কথা সদানন্দের জানা না থাকলেও গ্রামের আর কারো জানতে বাকি ছিল না। ওই বেহারি পালের বউ সকলের আগে জেনেছিল। আর তারপর গ্রামের আবাল বৃদ্ধবনিতা কারো শুনতে বাকি ছিল না।

সদানন্দ চলে যাবার পর থেকেই রহস্যটা যেন আস্তে আস্তে আরো ঘনিয়ে আসছিল।

কর্তাবাবুর মৃত্যুর পর অবশ্য কেউ বুঝতে পারেনি। মৃত্যু না মৃত্যু! বহুদিন ধরে যে মানুষটা ভুগছিল তার মৃত্যুতে কে আর কী সন্দেহ করবে! যেমন ঘটা করে জমিদার বাড়িতে শ্রাদ্ধ হয় তেমনি করেই তাঁর শ্রাদ্ধ হলো। লোকজন খেলেও প্রচুর। একেবারে পেট পুরেই খেলে সবাই। কিছু কিছু লোক ছাঁদা বেঁধেও বাড়িতে নিয়ে গেল। দক্ষিণা পেলে ব্রাহ্মণরা। কাপড়ও পেলে বাড়ির লোকজনেরা। যারা পাতা পেতে খাবে না তারা ছাঁদা বেঁধে নিয়ে গেল। মোটকথা নবাবগঞ্জের গ্রামবাসীরা কদিন ধরে খুব একচোট আনন্দ করে নিলে।

শুধু একজনের কথা কারো মনে পড়লো না। সে বাড়ির ছেলে সদানন্দ।

বেহারি পাল একবার জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল–সদানন্দর কোনও খবর পেলেন নাকি চৌধুরী মশাই!

চৌধুরী মশাই কথাটা শুনে ক্ষেপে গেলেন। তবু মনের রাগ মনে চেপে রেখেই বললেন সে-ছেলের খোঁজখবর পেলেই বা কী লাভ? সে থাকলেও যা, না থাকলেও তাই—

বেহারি পাল বলতে গেল–কিন্তু হাজার হোক আপনার নিজের ছেলেই তো সে! সে যত অন্যায়ই করুক, আপনি কি বাপ হয়ে তাকে ছেড়ে থাকতে পারবেন? অন্তত আপনি না হোক, তার গর্ভধারিণীও কি ভুলতে পারবেন তাকে?

কিন্তু এসব প্রসঙ্গ বেশি আলোচনা করতে চাইতেন না চৌধুরী মশাই। চৌধুরী মশাই যেন তারপর থেকে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। যেন আরো খিটখিটে আরো গম্ভীর। কর্তাবাবুর দোতলার ঘরটা তখন খালিই পড়ে থাকতো। তিনি সেখানেই নিজের থাকবার বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলেন।

চণ্ডীমণ্ডপে কেউ এসে চৌধুরী মশাই-এর কথা জিজ্ঞেস করলেই সেরেস্তাদার বলতো–তিনি তো আর নিচেয় নামেন না, ওপরে আছে–

কিন্তু সামান্য একটা আর্জি পেশ করবার জন্যে অনেকেই ওপরে যেতে চাইতো না। চৌধুরী মশাইও অনেক বাজে ঝামেলা থেকে বেঁচে যেতেন। কিন্তু যখন সন্ধ্যে হয়ে আসতো তখন কেমন যেন একটা আতঙ্কে বুকটা শিরশির করে উঠতো। রাত্রে ভয়ে ভয়ে অনেক সময় যেন দম আটকে যাবার মত অবস্থা হতো। কে যেন গলা টিপে ধরতো তাঁর। ধড়মড় করে তিনি উঠে আলোটা জ্বালতেন। এক গেলাস জল খেতেন। তারপর আবার শোবার চেষ্টা করতেন।

পাশে শুয়ে এক-একদিন গৃহিণীর ঘুম ভেঙে যেত। বলতো–কী হলো? ঘুম আসছে না তোমার?

চৌধুরী মশাই বলতেন–না, জলতেষ্টা পেয়েছিল—

তারপর আবার জিজ্ঞেস করতেন–বউমা কোথায়?

গৃহিণী বলতো–কেন? বউমার কথা জিজ্ঞেস করছো কেন? বউমা তার নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছে–

রাত্রে ওই পর্যন্তই।

কিন্তু সকাল বেলা বাড়ির আবার অন্য এক চেহারা। বাড়ির লোক বলতে তো মাত্র দু’জন। কর্তা আর গিন্নী। আর এ ছাড়া আছে আর একজন। পরের বাড়ির মেয়ে। তখন কর্তাবাবুও আর নেই, সদানন্দও নেই। সংখ্যায় দু’জন কমে গেছে। কিন্তু দু-তিনজন প্রাণীকে কেন্দ্র করে যে নাটক ঘটে চলেছে তা বুঝি পৃথিবীর কোনও সংসারেই আগে কখনও ঘটেনি।

নয়নতারা তখন স্নান করে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে ভিজে চুল শুকোচ্ছে।

হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে শাশুড়ি দৌড়ে এল কুয়োতলায়। বললে–বউমা তুমি কি কালা? কানে কালা হয়েছ নাকি তুমি?

নয়নতারা বললে––কেন মা? কি হয়েছে?

–তুমি আবার বলছো কী হয়েছে। আমি যে এদিকে তোমাকে ডেকে ডেকে গলা ফাটিয়ে ফেলছি তা তো তোমার কানে যায় না বাছা। না তুমি ভাবছো শাশুড়ি ডেকে ডেকে মরুক গে, আগে চুল তো শুকোই।

নয়নতারা সঙ্কোচে জড়োসড়ো হয়ে বললে–কিন্তু আমি তো শুনতে পাইনি মা–

শাশুড়ি বললে–তা শুনতে পাবে কেন? শুনলে যে গেরস্তের সংসারের সাশ্রয় হবে। সংসার পুড়ে যাক ঝুড়ে যাক তাতে তোমার কী? তোমাকে তো আর গতরে খেটে পয়সা উপায় করতে হয় না? যাকে পয়সা উপায় করতে হয় সে বুঝবে। বলি উনুনে যে দুধ পুড়ে যাচ্ছে সেই দুধপোড়া গন্ধও তো মানুষের নাকে আসে! তোমাকে দিয়ে কি বাছা আমার সংসারের কোনও কাজটাই হবে না বউমা, শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াবার জন্যেই তোমাকে বউ করে বাড়িতে এনেছি? তবু বুঝতুম যদি নিজের স্বামীকে বাড়িতে আটকে রাখতে পারতে–

বলতে বলতে শাশুড়ি যেমন এসেছিল তেমনি আবার গরগর করে রান্নাবাড়ির দিকে চলে গেল।

নয়নতারাও শাশুড়ির পেছন পেছন রান্নাবাড়ির ভেতরে এসে দাঁড়ালো। দেখলে এক কড়া দুধ উনুনে জ্বাল দেওয়া হচ্ছিল, কারোর নজর ছিল না সেদিকে। সবাই সংসারের যে যার কাজে ব্যস্ত। তারই মধ্যে সমস্ত দুধটা কখন পুড়ে একেবারে চাঁছি হয়ে গেছে। এতখানি লোকসানের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সে যে কী করবে বুঝতে পারছিল না। গৌরী পিসীর মুখেও তখন কথা নেই। বিষ্টুর মাও দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে বোবা হয়ে গেছে। সবাই মিলে তখন রান্নায় হাত লাগিয়েছে। এই অবস্থায় নয়নতারার যেন নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল।

হঠাৎ শাশুড়ির কথায় যেন তার চমক ভাঙলো। শাশুড়ি বললে–তুমি আবার ঠুঁটো জগন্নাথের মতন ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলে কেন শুনি? তোমার ঘর আছে, তুমি ঘরে যাও না, ঘরে গিয়ে পটের বিবি সেজে শুয়ে থাকো না গিয়ে, খাবার হলে তোমাকে ডাকবোখন, দয়া করে তখন খেয়ে নিয়ে আমার হেঁসেল মুক্ত করে দিও, যাও–

নয়নতারা সেইখানে দাঁড়িয়ে শাশুড়ির সমস্ত কথাগুলো শুনলো। তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে বিছানার বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো।

শুয়ে পড়ে কখন যে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তার খেয়াল ছিল না। শাশুড়ির ডাকাডাকিতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যেতেই নয়নতারা শুনতে পেলে শাশুড়ি বলছে–এত ঘুম তোমার কোত্থেকে আসে বৌমা? আর তাও বলি, আমি তোমাকে ঘরে গিয়ে শুতে বললুম বলে তুমিও অমনি শুয়ে পড়লে? বলি আক্কেল জিনিসটাও কি মাথা থেকে বিদেয় করে দিয়েছ তুমি? বুড়ি শাশুড়ি মরে মরে তোমাকে ভাত বেঁধে এনে তোমার মুখে তুলে দেবে। আর তুমি দয়া করে গিলবে, এই কি তুমি চাও? তা তাই যদি চাও তো তাও দিতে পারি, তোমার মুখের কাছে ভাতের থালা এনে তোমাকে খাইয়ে দিতে পারি। তাই-ই দেব!

নয়নতারা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে রইল। বললে–আমায় মাফ করবেন মা, আমি বুঝতে পারিনি–কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম–

শাশুড়ি বলে উঠলো–তা তো ঘুমিয়ে পড়বেই বউমা, বাড়িতে এতগুলো দাসীবাদী আছে, তুমি ঘুমোবে না তো কে ঘুমোবে! ভগবান তোমাকে ঘুমোবার কপাল দিয়েছে, তুমি তো ঘুমোবেই। আমার খেটে মরার কপাল তাই আমি চিরটাকাল কেবল খেটেই মরবো–

তারপর আর কথা না বাড়িয়ে নয়নতারা গিয়ে খেতে বসতো। খেতে খেতে অনেক কষ্টে চোখের জলটাকে আটকে রাখতো। নইলে শাশুড়ি দেখতে পেলেই আবার নতুন করে সে-জন্যে গঞ্জনা দেবে। বাবা-মার কাছে বড় আদরে মানুষ হয়েছিল নয়নতারা। জীবনে গঞ্জনাটাকে তাই বরাবর সব চেয়ে ভয় করে এসেছে সে। আর এখন সেই গঞ্জনাই কিনা তাকে দিনের পর দিন শুনে যেতে হচ্ছে!

অথচ কী করেছে সে? কী অপরাধটা সে করেছে যে তাকে এত গঞ্জনা সহ্য করতে হবে?

গৌরী পিসীও যেন অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল তখন। যে গৌরী পিসী বিয়ের পর তাকে অত আদর করতো, তারই বা ব্যবহার অমন হয়ে গেল কেন কে জানে?

বেহারি পালের বউ চুপি চুপি চুপি এক-একদিন এসে হাজির হতো।

বলতো–তোমার শাশুড়ি কোথায় বউমা?

নয়নতারা বলতো–বোধ হয় ঘুমোচ্ছেন, ডেকে দেব?

বেহারি পালের বউকে বড় ভালো লাগতো নয়নতারার। কিন্তু শাশুড়ির ভয়ে দিদিমা বেশি আসতেও পারতো না। যখন দুপুরবেলা সবাই একটু ঘুমিয়ে পড়তো তখন টিপি টিপি পায়ে নয়নতারার ঘরে এসে বসতো।

বলতো–কেমন আছো বউমা?

প্রথম প্রথম বেহারি পালের বউকে দেখলেও ভয় পেয়ে যেত নয়নতারা। মনে হতো যদি দিদিমা শাশুড়িকে বলে দেয়! তাই শুয়ে থাকলে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে বসতো।

বেহারি পালের বউ বলতো–উঠলে কেন বউমা, তুমি শুয়ে থাকো না, আমি দেখলুম এ বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে কিনা তাই তোমার কাছে এলুম। তা সকালবেলা শাশুড়ি তোমাকে অত বকছিল কেন বউমা, তুমি কী করেছিলে কী?

প্রথম প্রথম নয়নতারা নিজের দুঃখের কথা কিছু বলতো না। কিন্তু পাশের বাড়ির কথা কত দিন আর চাপা থাকে? বেহারি পালের বউ বলতো–তোমার শাশুড়ি তোমাকে খেতে টেতে দেয়?

নয়নতারা বলতো–দেয়–

বেহারি পালের বউ সবই জানতো। তার কাছে কিছু লুকোন চলতো না। বলতো তুমি মিছে কথা বলছো, বউমা, আমি সব দেখেছি, তোমার খাওয়াই হয়নি আজকে–

নয়নতারা অবাক হয়ে যেত বেহারি পালের বউ-এর মুখের দিকে চেয়ে। তারপর আর কিছু করতে না পেরে তার কোলে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলতো।

কাঁদতে কাঁদতে বলতো–আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করে না দিদিমা–কিছু ভালো লাগে না। ওরা একটু দূরে সরে গেলেই আমি ভাতগুলো জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিই, কুকুরে এসে সব খেয়ে যায়।

বেহারি পালের বউ বলতো–খাবে কী বউমা, ক্ষিধে হবে কেন? তোমাকে কী খেতে দেয় তোমার শাশুড়ি তা তো আমার দেখতে বাকি নেই, ওই ডাল আর ভাত কেউ খেতে পারে?

তারপর আঁচলের ভেতর থেকে দিদিমা কতদিন খাবার বার করতো। কোনও দিন মাছ ভাজা, কোনও দিন পোস্তর বড়া। এমনি সব কত কী খাবার! বাড়িতে যা রান্না হতো সব বেছে বেছে আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে এনে নয়নতারাকে খাওয়াতো।

বেহারি পালের বউ-এর কাছে নয়নতারা নিজের মনটা উজাড় করে ঢেলে দিত। বলতো–এ রকম কেন হলো দিদিমা? আপনি তো গোড়া থেকেই সব দেখে আসছেন, আমি কী এমন দোষ করেছি যে আমাকে শাশুড়ি মোটে দেখতে পারেন না–

দিদিমা বলতো–তোমার শাশুড়ি কি মানুষটা ভালো যে তোমাকে দেখতে পারবে বউমা?

নয়নতারা বলতো–কিন্তু আগে তো এমন ছিলেন না। আগে আমাকে কত আদর করতেন, তা তো আপনার দেখেছেন–

–ছাই আদর করতো, ছাই! ও এক নম্বরের বদমাইশ মেয়েমানুষ! আমি তোমার শাশুড়িকে চিনি না বলতে চাও?

–কিন্তু আমি তো শাশুড়িকে বরাবর ভক্তি শ্রদ্ধা করে এসেছি দিদিমা! আমি তো আমার দিক থেকে কোনও দোষ করিনি। আমার নিজের মা নেই, তাই বরাবর শাশুড়িকেই আমি আমার মা বলে মনে করেছি। আমার কি দোষ আপনিই বলুন?

বেহারি পালের বউ বলতো দোষ তোমার নয় তো কার বউমা? দোষ তো সব তোমারই

–আমার দোষ? কেন?

–তা তোমাকে কেন শাশুড়ি আদর-যত্ন করবে? তুমি শ্বশুর-শাশুড়ির কোনও উপকারে এসেছ? তুমি তোমার সোয়ামীকে ঘরে আটকে রাখতে পেরেছ? সোয়ামী না থাকলে মেয়েমানুষের আবার খাতির-যত্ন কী? কথায় বলে সোয়ামী নেই যার সে ঘরের বার। সোয়ামী-পুত কিছুই নেই তোমার, কে তোমাকে ভালোবাসবে বউমা? তুমি কি তোমার শাশুড়ির কোলে একটা নাতি তুলে দিতে পেরেছ?

নিজের অক্ষমতায় নিজের অসার্থকতায় নয়নতারা আরো ভেঙে পড়তো। বলতো আপনি তো সব জানেন দিদিমা, আপনি জেনেশুনে তবু এই কথা কেন বলছেন?

এসব কথা বেশিক্ষণ হতো না। বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ হলেই বেহারি পালের বউ তাড়াতাড়ি উঠে যেত। যাবার আগে বলতো–আমি আসি বউমা, পরে আবার এক সময়ে আসবোখন, তোমার শাশুড়ি মাগী দেখতে পেলে আবার অনর্থ বাধাবে—যাই–

কিন্তু বাইরে গিয়ে শাশুড়ির কাছে বেহারি পালের বউ আবার অন্য মানুষ। শাশুড়ি বলতো-এসো এসো মাসিমা, কী রাঁধলে আজকে?

এটা-ওটা কথা হবার পর বেহারি পালের বউ জিজ্ঞেস করতো তোমার বউমা কোথায় বউ, বউমাকে যে দেখছিনে?

শাশুড়ি বলতো–বউমা আর কোথায় থাকবে, নিজের ঘরেই ঘুমোচ্ছে, ঘুম ছাড়া তো বউমার আর কোনও কাজ নেই–

এমনি করেই চলছিল নয়নতারার জীবন। যেদিন প্রথম বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিল তখন একরকম, আবার যখন সদানন্দ বাড়ি থেকে চলে গেল তখন একেবারে অন্যরকম। কর্তাবাবু মারা যাবার পর থেকেই যেন একেবারে এ বাড়ির জীবনযাত্রা অন্য দিকে মোড় ফিরলো।

সেদিন হঠাৎ শাশুড়ি বললে–বউমা, আজ রাত্তিরে ঘরের দরজায় খিল দিয়ে শুয়ো না, দরজা খুলে শুয়ো–বুঝলে?

কথাটা ঠিক বুঝতে পারলে না নয়নতারা। বললে–দরজা খুলে শোব?

শাশুড়ি গম্ভীর মুখে বললে—হ্যাঁ–

নয়নতারা তবু বুঝতে পারলে না। জিজ্ঞেস করলে–কেন মা? দরজা খুলে যোব কেন?

শাশুড়ী বললে–যা বলছি তাই কোর, তর্ক কোর না—

কিন্তু আপনিই তো আগে আমাকে রোজ দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে শুতে বলতেন?

শাশুড়ি তেমনি সুরেই বললে–আগে যা বলতুম বলতুম, আজ তুমি দরজা খুলে শোবে।

তবু কেমন যেন খটকা লাগলো নয়নতারার মনে। হঠাৎ শাশুড়ি তাকে দরজা খুলে শুতে বলছে কেন?

বললে–আপনি বুঝি আজ রাত্তিরে আমার ঘরে শোবেন?

শাশুড়ি এতক্ষণে রেগে গেল। বললে–তুমি তো দেখছি খুব বেয়াদব মেয়ে বউমা। আমি তোমার ঘরে শুই না-শুই তাতে তোমার কী? আমি যা বলছি তাই করবে–যাও এখন–

এসব কথা বেহারি পাল জানে। বেহারি পালের বউও জানে। আর শুধু বেহারি পালের বউই নয়, ওই নিতাই হালদার, কেদার গোবর্ধন যারা বারোয়ারিতলায় নিতাই হালদারের দোকানের সামনের মাচায় বসে তাস খেলে তারাও জানে। যেসব মেয়েরা নদীতে চান করতে যায় আর এবাড়ির ও-বাড়ির গল্প করে তারাও জানে। এককালে নবাবগঞ্জের চৌধুরীবাড়ির নতুন বউ নয়নতারাকে নিয়ে কত হইচই বেধে গিয়েছিল কত কানাঘুষো চলেছিল। কালের খরস্রোতে সে-সব প্রসঙ্গ প্রায় ভেসে গিয়েছে এখন। কিন্তু এতদিন পরে সেই সদানন্দকে দেখে আবার যেন সব মনে পড়তে লাগলো তাদের।

গান তখনও পুরোদমে চলেছে :

আর নারীরে করিনে প্রত্যয়।
নারীর নাইকো কিছু ধর্মময় ॥
নারীর মিলতে যেমন ভুলতে তেমন,
দুই দিকে তৎপর।
মজিয়ে পরে চায় না ফিরে
আপনি হয় অন্তর।

বেহারি পালও গান শুনছিল। বলতে গেলে বেহারি পালই বেশি চাঁদা দিয়েছিল গানের জন্যে। নবাবগঞ্জের মাথা এখন বেহারি পাল। অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরে গৃহিণীকে ডাকলে, ওগো শুনছো–

বেহারি পালের বউ-এর তখন ঘুমে চোখ ঢুলছে। গান শুনে এসে শুতে পারলে বাঁচে। বললে–কী?

–কাকে এনেছি দেখ। চৌধুরী মশাই-এর ছেলে সদানন্দ।

বউ-এর যেন বিশ্বাস হলো না। বললে–বলছো কী? আমাদের সদানন্দ? এতদিন কোথায় ছিল সে?

বেহারি পাল বললে– চৌধুরী মশাই-এর কাছে গিয়েছিল, ছেলেকে নাকি চৌধুরী মশাই বাড়িতে ঢুকতেই দেয়নি, তাড়িয়ে দিয়েছে দূর করে। তাই আর কোথায় যাবে, তাকে আমাদের বাড়িতে ডেকে এনেছি–

বেহারি পালের বাড়িতে ঘর-দোরের অভাব নেই আর আগেকার মতন। এখন যুদ্ধের কল্যাণে ব্যবসাও আরো ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। আরো টাকাপয়সা হয়েছে। বেহারি পালের বউ বাইরে বেরিয়ে এল। বলল-কই কোথায় সদানন্দ, দেখি–

সদানন্দর মুখে সেই খোঁচা-খোঁচা দাড়িগোঁফ। ময়লা পাঞ্জাবি, ছেঁড়া চটি কিন্তু হাসি মুখ।

বেহারি পালের বউ বললে–এতদিন কোথায় ছিলে বাবা তুমি? সে-ই তুমি এলে, আর কিছু দিন আগে আসতে পারলে না, তাহলে আর নয়নতারার এমন করে সর্বনাশ হতো না—আহা–

সদানন্দ কিন্তু নির্বিকার। সে তখন হাসছে।

বেহারি পালের মনে পড়তে লাগলো সেই ঘটনাটা। নয়নতারাই পরে বলেছিল। শাশুড়ি যেমন বলেছিল তেমনি করে দরজা খুলে রেখেই শুয়েছিল নয়নতারা। তারপর হয়ত একটু তন্দ্রাও এসেছিল। জানালা দিয়ে আকাশের জ্যোৎস্না এসে পড়েছিল বিছানার ওপর।

হঠাৎ যেন একটা কীসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘুমটা ভাঙতেই দেখলে কে যেন একেবারে বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কে? কে?

নয়নতারা যেন স্পষ্ট দেখতে পেল মানুষটাকে। চিনতে পারলে। এক মুহূর্তে নয়নতারা নিজের কাপড়টা সামলে নিয়ে উঠে বসেছে। না, স্বপ্ন তো নয়, সত্যিই তো সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মানুষটাকে–

নয়নতারা আর থাকতে পারলে না। চিৎকার করে উঠলো–মা–মা–মা–

নয়নতারার সমস্ত শরীরটা তখন ঘামে ভিজে উঠেছে। তার চিৎকারে ঘরটা আবার ফাঁকা। মনে আছে অনেক রাত্রে শাশুড়ি এসে তার পাশে শুয়ে পড়েছিল। তার পরে কখন সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর কিছুই খেয়াল ছিল না তার। কিন্তু যে মানুষটা তার ঘরে এসেছিল সে তখন উধাও। নয়নতারা বিছানা ছেড়ে উঠলো। তারপর ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে চারদিক দেখলে। কেউ কোথাও নেই। তাহলে কে তার ঘরে ঢুকেছিল?

সমস্ত বাড়িটা অন্ধকার। তাড়াতাড়ি শাশুড়ির ঘরের সামনে এসে আবার ডাকতে লাগলো–মা, মা–দরজাটা একটু খুলুন–

কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

কিন্তু শাশুড়িকে না ডেকে অন্য কী উপায়ই বা আছে তার? অথচ রাত্রে ডাকলে হয়ত শাশুড়ি রাগ করবে।

নয়নতারা আবার ডাকলে–মা, ওমা–

এতেও যখন সাড়া পাওয়া গেল না তখন দরজায় ধাক্কা দিতে হলো। হয়ত মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সারাদিনের ঝঞ্ঝাটের পর ঘুমে অচৈতন্য হয়ে আছে।

–মা, মা, ওমা এবার সাড়া পাওয়া গেল। দরজার খিল খুলে শাশুড়ি বাইরে বেরিয়ে এল। বললে– কে? বউমা? কী হলো?

নয়নতারা বললে–আমার খুব ভয় পাচ্ছে—

শাশুড়ি ব্যাপার শুনে রেগে উঠলো–সবই কি তোমার ঢং বউমা? তোমার ভয় পাচ্ছে। তো আমি কি করবো? তোমার ভয় পাচ্ছে তো এ-কথাটা বলবার জন্যে এই ভর-দুপুর রাতে আমার ঘুম না ভাঙালে তোমার চলতো না? কাল সকালে বললে তোমার মহাভারত এমন কী অশুদ্ধ হয়ে যেত শুনি?

নয়নতারা বললে–আমার খুব ভয় করছিল মা, মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার ঘরে ঢুকেছে–

–তুমি আর ঢং কোর না বউমা, তোমার ঘরে কে ঢুকতে যাবে শুনি? কার এত দায় পড়েছে যে এত রাত্তিরে না ঘুমিয়ে তোমার ঘরে ঢুকতে যাবে?

নয়নতারা বললে–চোর-ডাকাত কত কী থাকতে পারে তো! আপনি আমাকে দরজা খুলে রেখে শুতে বলেছিলেন তাই বলছি। আপনি তো আমার পাশেই শুয়েছিলেন, কখন উঠে গেলেন আমি টের পাইনি—

শাশুড়ি বললে–তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমি চলে এসেছি। আমার যে আবার নিজের বিছানা ছাড়া অন্য কারো বিছানায় ঘুম আসতে চায় না। আর চোর-ডাকাতের কথা বলছো, তা চোর-ডাকাতের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তোমার ঘরে তারা ঢুকতে যাচ্ছে! তোমার সোনা-দানা সব তো আমার সিন্দুকের মধ্যে! তোমার ঘরে ঢুকে ডাকাতরা কী নেবে শুনি?

–কিন্তু মা, আমি কাল থেকে রাত্তিরে দরজায় খিল দিয়ে শোব।

শাশুড়ি বললে–কালকের কথা কালকে হবে। ও-সব কথা রাতদুপুরে বলে কী হবে? তার চেয়ে আমাকে এখন একটু ঘুমোতে দাও–। তুমি তো সারাদিন ঘুমিয়েই কাটাও, আমি সারাদিন গতরে খেটে রাততিরটুকু যে একটু ঘুমোব তোমার জ্বালায় কি তারও যো নেই–

বলে আর সেখানে দাঁড়ালো না শাশুড়ি। নয়নতারার মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঘুমোতে গেল।

নয়নতারা সেখানে সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী করবে বুঝতে পারলে না। ঘরে গিয়ে সে ঘুমোবে কেমন করে? ভাবলে হারিকেনটা জ্বালিয়ে রাখলে হয়। কিন্তু এ বাড়িতে এতদিন এসেছে, হারিকেন কোথায় থাকে তাও তো সে জানে না।

আস্তে আস্তে সে আবার নিজের ঘরে গেল। নিজের ঘরের খোলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। চারিদিকে কেউ কোথাও নেই। বড় ভয় করতে লাগলো তার। কিন্তু এমন করে সমস্ত রাত একা-একলা সে জেগে থাকবে কী করে? না-ঘুমিয়ে কত দিন কাটাবে? দূরে বারোয়ারিতলায় বোধ হয় যাত্রার রিহার্সাল চলছে। কিছু কিছু গানবাজনার অস্পষ্ট সুর কানে ভেসে আসছে। এখন একজন কারো সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো লাগতো। দিদিমা যদি আসতো এ-সময় তো খুব ভালো হতো। ওই একটা লোক। ওই একটা লোকের কাছেই তবু মনের কথা খুলে বলা যায়। আর এখানকার অন্য সবাই-ই যেন তার পর!

অথচ আগে শাশুড়ি কত আদর করতো তাকে। এ বাড়িতে এসে পর্যন্ত ওই শাশুড়ির কাছেই তখন যা-কিছু মনের কথা খুলে বলতে পারতো। যখন সেবার বাবা এসে তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তখন তো সে ওই শাশুড়ির মুখের দিকে চেয়েই বাবার সঙ্গে যেতে রাজি হয়নি। কিন্তু এখন? এখন আর বাবা আসছে না কেন? এখন বাবাও কি তাকে ভুলে গেল?

হয়ত এমনিই হয়। হয়ত সব মেয়ের জীবনেই এমনি হয়। বিয়ে হয়ে যাবার পর সব বাবা-মাই হয়ত এমনি করে মেয়েকে ভুলে যায়। বলতে গেলে হয়ত কেবল মা’ই মেয়েকে মনে রাখে। সত্যি তার কপালটাই খারাপ! নইলে সেই মা-ই বা কেন চলে যাবে? মা যদি এখন বেঁচে থাকতো তো সে নিজেই মার কাছে চলে যেত। মা’কে গিয়ে বলতো–মা, এবার থেকে আমি আর শ্বশুরবাড়ি যাবো না, আমি এখন থেকে তোমার কাছেই থাকবো। তুমি আমায় থাকতে দেবে না?

মা হয়ত তবু সান্ত্বনা দিত তাকে। আদর করতো তাকে। মা হয়ত বলতো–তুই কিছু ভাবিসনি মা, ওরকম কত ছেলে বাড়ি থেকে রাগ করে চলে যায়, তারপর দেখেছি একদিন আবার ফিরে আসে। ও কিছু না, তুই কিছুদিন কষ্ট করে থাক, দেখবি সদানন্দ আবার একদিন তোর কাছে ফিরে আসবে

কিন্তু হঠাৎ চোখ দুটো ঘুমে ঢুলে আসতে লাগলো। কিন্তু দরজা খুলে রাখলে ঘুম আসবে কী করে?

নয়নতারা আর থাকতে পারলে না। তাড়াতাড়ি ঘরের দরজায় খিল তুলে দিয়ে বিছানার ওপর গিয়ে গা এলিয়ে দিলে। দিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলে। ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে, কিন্তু তবু ঘুম আসছে না। বিছানার ওপর একবার এপাশ একবার ওপাশ করতে লাগলো। কিন্তু তবু কিছুতেই ঘুম এলো না। কেবল মনে হতে লাগলো তার ঘরের দরজা বন্ধ রয়েছে, যদি শাশুড়ী জানতে পারে! যদি বকে শাশুড়ি!

না, আর নয়, নয়নতারা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজার খিলটা খুলে দিয়ে যেন নিশ্চিন্ত হলো। না হোক ঘুম, ঘুম না হলে অবশ্য তার শরীর খারাপ হবে ঠিকই, কিন্তু তাকে নিয়ে তো সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হবে না। তাকে কেন্দ্র করে সংসারে অশান্তি হবে এটাকেই নয়নতারার সব চেয়ে বেশি ভয়।

হঠাৎ শাশুড়ির কথায় ঘুম ভেঙে গেল নয়নতারার।

–বউমা, বলি তুমি নিজে গিয়ে চা খাবে, না তোমার মুখের কাছে এনে চায়ের বাটি ধরবো? তুমি যদি বলো তো তাও আনতে পারি। আনবো?

শাশুড়ির কথায় লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেল নয়নতারা। কখন যে চোখ দুটো জুড়ে ঘুম এসে গিয়েছিল তা তার খেয়াল ছিল না। চারদিকে রোদ উঠে গেছে। জানালা দিয়ে রোদ এসে ঘরের ভেতরটা একেবারে ভাসিয়ে দিয়েছে। এত দেরি পর্যন্ত তো কখনও ঘুমোয়নি সে! এ কী করে হলো! এ কেন হলো!

বাইরে এসে দাঁড়াতেই তার আগের রাত্রের সব ঘটনাগুলো মনে পড়তে লাগলো। দিনের আলোয় ঘটনাকে যেন স্বপ্ন বলে মনে হতে লাগলো। তবে কি স্বপ্ন দেখেছিল নাকি সে? তার ঘরে যে ঢুকেছিল সেও কি স্বপ্নের মানুষ? সেই ভয় পেয়ে শাশুড়ির ঘরের সামনে এসে ডাকা! সেই শাশুড়ির বকুনি! সবই স্বপ্ন নাকি তাহলে? নয়নতারা অনেকবার করে ঘটনাগুলোকে মনে করবার চেষ্টা করলে। স্বপ্নই যদি হবে তো সে এতক্ষণ ঘুমোল কী করে? শেষরাত্রের দিকে ঘুম এসেছিল বলেই তো এত বেলা পর্যন্ত সে ঘুমিয়েছে। বিছানায় যাবার সঙ্গে সঙ্গে যদি ঘুম আসতো তো সে কি এত বেলা করে ঘুম থেকে উঠতো!

সবাই যখন রান্না নিয়ে ব্যস্ত তখন নয়নতারাও রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। সবাই কাজ করছে। এ সময়ে সে যদি তার নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকে তাহলেও দোষ হবে তার। আবার শুধু যদি চুপচাপ দাঁড়িয়েও থাকে তাহলেও দোষ হবে।

শাশুড়ি হঠাৎ বলে উঠলো–তুমি আবার যাবার-আসবার পথের ওপর রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছো কেন শুনি? নিজের কাজও করবে না, কাউকে কাজও করতে দেবে না। হয় এখান থেকে সরে যাও না-হয় নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো, খাবার সময় তোমাকে ডেকে পাঠাবোখন। এখন সরো দিকিনি এখান থেকে, পথ ছাড়ো–

নয়নতারা কী করত বলা যায় না, কিন্তু তার আগেই চৌধুরী মশাই হঠাৎ ভেতরবাড়িতে এসে হাজির। তিনি কথা বলতে বলতে ঢুকছিলেন–ওরে গৌরী, কোথায় গেলি? চণ্ডীমণ্ডপে যে চা দিতে হবে, সব ভুলে গেলি নাকি?

নয়নতারা শ্বশুরকে দেখে মাথার ঘোমটাটা আর একটু মুখের ওপর টেনে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। কিন্তু আবার সেই ঘর! তার নিজের ঘর। সেই ঘর আর বাইরের বারান্দা–এইটুকুই তার পরিক্রমার পরিধি। এইটুকুর মধ্যেই তাকে বন্দী হয়ে থাকতে হবে। এই বন্দিত্ব থেকে কি তার মুক্তি নেই।

.

সারা দেশ ঘুরে সদানন্দর তখন একটা বিশেষ উপলব্ধি হয়েছে। এই উপলব্ধি হয়েছে যে সমস্ত পৃথিবীটাই আসলে নবাবগঞ্জ। এই নবাবগঞ্জটাই যেন বড় আকার নিয়ে সমস্ত পৃথিবীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে এই নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশটাই যেন ডালপালা ছড়িয়ে সারা পৃথিবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কর্তাবাবুর মত পৃথিবীতে হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ কর্তাবাবু ছড়িয়ে রয়েছে, এই চৌধুরী মশাই-এর মত হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ চৌধুরী মশাইও এই পৃথিবীতে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু তারাই যেন ভেতরে ঢুকে সব কিছু তিলে তিলে ধ্বংশ করে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

এই চৌধুরীবাড়িও তেমনি করে তিলে তিলে নিঃশেষ হতে চলেছিল তখন। যেদিন সদানন্দর বিয়ে হলো সেইদিন বুঝি তা প্রথম প্রকাশ পেলে। তারও আগে থেকে হয়ত শুরু হয়েছিল, কিন্তু তখন কেউ তা টের পায়নি। ছাইচাপা আগুনের মত তা ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছিল। কিন্তু প্রথম ধোঁয়া দেখা গেল বোধহয় সেই সদানন্দর বিয়েকে উপলক্ষ করে। তার পর থেকেই যা শুরু হলো তা সদানন্দ নবাবগঞ্জের লোকের কাছে শুনেছে।

প্রকাশমামা নাকি তখনও হঠাৎ এক-একদিন নবাবগঞ্জে এসে উদয় হতো। রেলবাজারের স্টেশন থেকে নেমে সাইকেল-রিকশা চড়ে এসে হাজির হতো।

নিতাই হালদারের দোকানে যারা বসে থাকত তারা জিজ্ঞেস করতো–কী গো শালাবাবু, সদার কোনও খোঁজখবর পেলেন?

প্রকাশমামা রিশার ওপর বসেই চিৎকার করে বলতো–আমার ভাই কথা বলবার এখন সময় নেই, পরে কথা হবে–

প্রকাশমামা বরাবরই ব্যস্তবাগীশ লোক। কোনও দিনই তার গল্প করবার সময় ছিল না। সদানন্দর বিয়ে দেওয়ার সময় তার তো নাইবার-খাবার সময়ই ছিল না। সেটা যদি বা মিটলো, তারপর সদানন্দকে পুলিসে ধরা। আর তারপর বাড়ি ছেড়ে সদানন্দর পালিয়ে যাওয়া। এক-একবার একটা কাণ্ড হয়েছে আর প্রকাশমামা লাল হয়ে উঠেছে। ক্রমে-ক্রমে তার জামা-কাপড়ের বাহার বেড়েছে। ভাগলপুরের বাড়িতে বউকে মনি-অর্ডার করে টাকা পাঠিয়েছে, আর রাণাঘাটের রাধার ঘরে গিয়ে বাবুয়ানির মেজাজ উড়িয়েছে। প্রকাশমামা রাধার ঘরে গেলে সেদিন উৎসব লেগে যেত। রাধার রান্নাঘর থেকে মাছ-মুরগী আর ইলিশ মাছের ভুরভুরে গন্ধ সমস্ত পাড়াটা মাত করে দিত। গন্ধ বেরোলেই পাড়ার মেয়েরা বুঝতে রাধার বাবু এসেছে–

সেদিন অনেক দিন পরে আবার ঘর থেকে মাংস রান্নার গন্ধ বেরোল।

এমনিতে রাধা ডালভাত-আলুভাতে খেয়েই দিন কাটিয়ে দেয়। কিন্তু প্রকাশমামার তাতে রুচি হয় না। বলে–ও কি খাওয়া! তার থেকে উপোস করে থাকা ভালো।

প্রকাশমামা খাবে তো কালিয়া-পোলাও খাবে আর তা যদি না পায় তো খাবেই না। যখনই রাধার বাড়িতে আসতো তখন একেবারে বাজার থেকে মুরগী কিম্বা পাঁঠার মাংস আলু পেঁয়াজ সব কিছু নিয়ে ঢুকতো।

সেদিনও বাড়ি ঢোকবার মুখেই প্রকাশমামা ডাকলে-রাধা, এই রাধা–

চেনা গলার ডাক পেয়েই রাধা ধড়মড় কর উঠে বসলো। তারপর পড়ি-কি-মরি করে উঠোনে এসে সদরের হুড়কো খুলে দিলে। প্রকাশমামা বললে–মাংস এনেছি, এক হাঁড়ি ভাত চড়িয়ে দে আর মাংসয় বেশ গরগরে ঝাল দিবি–ঝাল না হলে মুখে মাল একেবারে আলুলি ঠেকে–

বলে মাংসর থলিটা রাধার হাতে দিয়ে পা দুটো ধুয়ে নিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকলো। তারপর জামার পকেট থেকে বোতলটা বার করে রেখে গায়ের জামাটা খুলে ফেলল। তারপর আলনা থেকে রাধার একটা শাড়ি লুঙ্গির মতন করে পরে নিয়ে রাধার বিছানায় বাবু হয়ে বসলো।

একেবারে কায়েমী বন্দোবস্ত প্রকাশমামার। এইটেই তার বরাবরের নিয়ম। যে দু’এক দিন রাধার বাড়ি থাকবে ততদিন রাধার বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও নড়বে না। ওই তক্তপোষের ওপর বসে সিগারেট টানতে টানতে মদ গিলবে আর কেবল চিৎপাত হয়ে ঘুমোবে।

রাধা রান্নাঘরে উনুনে আগুন দিয়ে দিয়েছে তখন। তারই ফাঁকে একবার এল। বললে– তা এতদিন পরে আমাকে বুঝি মনে পড়লো গা?

প্রকাশমামা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললে–আসতে যে পেরেছি এই তোর ভাগ্যি। বাড়িতে যে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়েছে…

–কেলেঙ্কারি? আবার কি কেলেঙ্কারি কাণ্ড হলো?

প্রকাশমামা বললে–আমার সেই ভাগ্নেকে দেখেছিস তো? বেটা একেবারে আস্ত অপোগণ্ড। অত লাগসই মেয়ে দেখে বিয়ে দিলুম, তা বউ-এর সঙ্গে মোটে শোবে না–

–শোবে না মানে?

–শোবে না মানে শোবে না! কত রকমের বেকুব লোকই যে আছে সংসারে তাই ভাবি। বাপের অত টাকা। ঠাকুর্দা মারা যাবার পর তো সব তার বাবাই পেয়েছে। ঠাকুর্দার এক ছেলে। আবার আমার ভাগ্নেটাও ছিল বাপের এক ছেলে। তবু বলে বউ-এর সঙ্গে শোবে না

–কেন? বউ কি নষ্ট নাকি?

–আরে দূর, আমি নিজে দেখে সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছি, এখন সে-সব পুরোন কাসুন্দি থাক, ভাগ্নেটা আর এক কাণ্ড করে বসেছে। হঠাৎ বাড়ি থেকে পালিয়েছে–

রাধা চমকে উঠলো। বললো–পালিয়েছে মানে? তোমার ভাগ্নে তো আমার এখেনে এসেছিল!

–তোর এখেনে? তোর এখেনে আমার ভাগ্নে এসেছিল? কবে? কদ্দিন আগে?

প্রকাশমামা খবরটা শুনে একেবারে তক্তোপোষের ওপর লাফিয়ে উঠে বসেছে। বললে–তুই এতক্ষণে তো কিছু বলিসনি আমাকে? তা হঠাৎ তোর এখেনে আসতে গেল কেন?

রাধা বললে–সে কি নিজে এসেছে? তোমার ভাগ্নেকে তো আমি চিনি, সে কি আমার কাছে আসবার ছেলে? আমি বাজার করে রাস্তা দিয়ে আসছি দেখি তোমার ভাগ্নে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। মনে হলো ডাক্তারখানা থেকে বেরোচ্ছে

–তারপর?

রাধা বললে–আমি চিনতে পেরে ওকে জিজ্ঞেস করলাম মাথায় কী হয়েছে?

–তা কী বললে সে?

রাধা বললে–সে কথার জবাব দিলে না তোমার ভাগ্নে। জামা কাপড়ের চেহারা দেখে বুঝলুম একটা কিছু হয়েছে। তা জোর করে তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলুম। বুঝলুম ক’দিন খায়নি কিছু। কাছে একটা পয়সাও নেই, তার দুর্দশার একশেষ। তোমার খবর জিজ্ঞেস করলুম, কিছুই বললে না সে।

–তারপর কোথায় গেল সে তাই বল্ না। আমি তো তাকে খুঁজতেই বেরিয়েছি।

রাধা বললে–কোথায় গেল তা কি সে আমায় বলে গেছে? আমার এ-ঘরে ঢুকতেই চায়নি প্রথমে। আমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলেনি। এমন ভাব দেখালে যেন আমাকে সে চেনেই না। কিন্তু আমি ছাড়িনি তবু। বাড়িতে এনে খাওয়ালুম দাওয়ালুম। বললুম এখেনে আরাম করে শোও। তা শুলো। আমি এই তক্তপোষটা ছেড়ে দিলুম তার শোবার জন্যে, আর আমি গিয়ে পাশের বাড়িতে শুলুম। কিন্তু ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরের দরজা খোলা। কোথাও নেই সে। আমাকে না বলে কয়ে মাঝরাত্তিরেই চলে গেছে

–তারপর?

রাধা বললে–তারপর আর কী! তারপর আর জানি না–

খবরটা শুনেই প্রকাশমামা সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে এসেছে নবাবগঞ্জে। এইরকম একবার কোথাও গিয়েছে আর নবাবগঞ্জে ফিরে এসেছে। চেষ্টার কসুর করেনি কিছু প্রকাশমামা। দিদি বলতো কী রে, খবর পেলি কিছু?

যেমন-যেমন খবর পেত প্রকাশমামা তেমনি-তেমনি এসে দিদির কাছে খবর দিয়ে যেত। আর টাকা নিয়ে যেত। রাধার কাছে খবরটা পেয়েই সোজা দিদির কাছে চলে এসেছিল।

দিদি বলতো–তাহলে বেঁচে আছে তো সে?

প্রকাশমামা বলতো–বেঁচে থাকবে না কোথায় যাবে শুনি? দেখবে আমি তাকে ঠিক খুঁজে বার করবো। ওদিকে রেলবাজারে পুলিসকে লাগিয়েছি, রাণাঘাটের পুলিসকে লাগিয়েছি। সকলকে টাকা খাইয়েছি কি মিছিমিছি? তা রাণাঘাটে একবার যখন তাকে দেখা গেছে তখন নিশ্চয়ই কলকাতায় গেছে সে–। এবার গিয়ে কলকাতার পুলিসকে গিয়ে টাকা খাইয়ে আসবো–

দিদি বলতো–তা কলকাতায় যাবে কী করে সে? তার কাছে কি টাকা আছে? টাকা পয়সা তার কাছে তো কিছুই নেই, ঘর থেকে এক কাপড়েই তো বেরিয়ে গেছে। একটা গামছা পর্যন্ত নিয়ে যায়নি সঙ্গে করে। রেলে উঠবে কী করে? টিকিটচেকাররা ধরবে না?

প্রকাশমামা বলতো–টিকিট? টিকিট কেউ কেনে ভেবেছ আজকাল? আমার মতন যারা বোকা-সোকা মানুষ তারাই কেবল টিকিট কেটে মরে। যুদ্ধের সময় এখন কে-ই বা টিকিট কাটছে আর কেই-ই বা টিকিট চাইছে! তা দাও, আরো শ পাঁচেক টাকা দাও দিকিনি, এবার কলকাতার পুলিসকে গিয়ে ধরতে হবে–

শুধু টাকাই বরাবর নিয়ে গেছে প্রকাশমামা, কিন্তু কাজের কাজ তখনও পর্যন্ত কিছুই হয়নি। সদানন্দও আর বাড়ি ফিরে আসেনি।

তা এবার প্রকাশমামা শ’ পাঁচেক টাকা পকেটে পুরে আবার কলকাতায় গিয়ে হাজির হলো। কলকাতা মানেই প্রকাশমামার কাছে স্বর্গ। টাকা থাকলে কলকাতা সকলের কাছেই স্বর্গ। তবে বিশেষ করে প্রকাশমামার কাছে ট্যাঁকে যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ কাকে ভয় করবো বলো? কেন ভয় করতে যাবো কাউকে? আমি কি তোমার চেয়ে কোনও অংশে ছোট হে?

প্রকাশমামা যখন রাধার বাড়িতে যায় তখনও যেমন বুক ফুলিয়ে ঢোকে এখানেও তেমনি। এই মাসির বাড়িতে। মাসি এখন বুড়ি হয়ে গেছে বটে, কিন্তু মাসি যখন বুড়ি ছিল, তখন থেকে প্রকাশমামা এ বাড়ির বাঁধা গাহেক। যখনই দিদির কাছে টাকা পেয়েছে তখনই সারা বাঙলাদেশের সব জায়গায় গিয়ে ফুর্তি উড়িয়েছে। প্রথমে ভাগলপুর থেকেই শুরু হয়েছিল ঘোড়দৌড়। তারপর যেখানেই এতটুকু ফুর্তির ছিটেফোঁটা গন্ধ পেয়েছে সেখানে গিয়েই ফুর্তির ঘোড়দৗর উড়িয়েছে প্রকাশমামা।

কলকাতায় তখন ব্ল্যাক-আউট চলছে। কালীঘাটের বাজারের পাশের গলিগুলোতে তখন তেমন আর জৌলুস নেই। বাড়িউলী মাসির খদ্ধের তখন আরও কমে গিয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার। রাস্তার আলোগুলোর মুখ ঢাকা। কারোর মুখ যে ভালো করে দেখবে তার উপায় নেই। কদিন আগেই বোমা পড়ার সময় কলকাতা একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়ছিল। মাসির বড় দুর্ভাবনা হতো। খরচ-পত্তোর চলবে কী করে!

গলি দিয়ে কেউ তেমন লোক গেলে সবাই ছেঁকে ধরে।

মেয়েরা বলে–কোথায় যাচ্ছে গো? ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?

লোকটা বলে–আমি আসছি, আমার কাজ আছে ওদিকে–

বোঝা গেল লোকটা একজন এ-পাড়ার কাঁচা খদ্দের। তখন আর ছাড়ন-ছোড়ন নেই। কেউ হাত ধরে টানে, কেউ জামা ধরে, কেউ বা কোঁচার খুট। লোকটাও আসবে না, মেয়েরাও ছাড়রে না। সেই অন্ধকার ফালি-গলির মধ্যে তখন টানাটানি পড়ে গেল। সন্ধ্যে থেকে কারো বউনি হয়নি তখনও। অনেকের কেরোসিন তেল কেনবার পয়সা পর্যন্ত জোটেনি। আর সেই সময় যদিই বা একটা খদ্দেরের মুখ দেখা গেল তো সে-ও কিনা হাতছাড়া হয়ে যাবে!

লোকটা বললে–-ছাড়ো ছাড়ো, ওগো ছাড়ো আমাকে–

মেয়েদের মধ্যে একজন বেশ ডাকাবুকো। সে বললে–কেন বাপু, ছাড়বো কেন তোমাকে? আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? আমাদের ঘরে বসলে কি তুমি এঁটো হয়ে যাবে?

লোকটা বললে–আমার দলের লোক আছে ক্ষুদির বাড়িতে, আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি–আমাকে ছাড়–একি, কাপড় ছাড়ো, আমাকে ন্যাংটো করে দেবে নাকি?

কথাটা শুনে একজন লোকটার কোঁচার খুঁটটা আরো জোরে টেনে ধরলে। বললে– তা ক্ষুদির চেয়ে কি আমরা খারাপ দেখতে? আমরা কি সুখ দিতে পারি না?

লোকটা আর পারলে না। জোর করে কোঁচাটা এঁটে ধরে বললে–আমার কাছে টাকা নেই, মাইরি বলছি টাকা নেই, টাকা-ফাঁকা সব ওদের কাছে আছে–আমাকে মিছিমিছি ধরছো তোমরা–

এ-সব যুক্তি মেয়েদের অনেক শোনা আছে। ঢোকবার ইচ্ছে না থাকলে এ-সব ধাপ্পা সকলেই দেয়। এসব কথা এ-পাড়ার মেয়েরা বিশ্বাস করে না।

বলে-দেখি, টাকা আছে কি না, পকেট দেখি—

বলে সবাই মিলে লোকটার জামার পকেট হাতড়াতে লাগলো–

লোকটা তখনও চেঁচাচ্ছে–বলছি আমার কাছে টাকা নেই, তবু শুনছে না, এ কি গেরো

একজন বলে উঠলো–তা টাকা না থাকুক, আট আনা পয়সাও নেই?

–না, আট না পয়সাও নেই—

–তাহলে চার আনা?

কিন্তু কারোর মুখের কথায় অত বিশ্বাস কী? ততক্ষণে জামার পকেট, কাপড়ের ট্যাঁক, সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ফেলেছে সবাই। কোথাও টাকাকড়ি কিছু নেই।

এবার লোকটাকে সবাই হতাশ হয়ে ছেড়েই দিচ্ছিল। ইঁদুরই যদি ধরতে না পারলো তো তেমন বেড়াল পুষে লাভ কী?

লোকটা চলেই যাচ্ছিল। এতক্ষণে যেন লোকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলো। সে যেদিকে যাচ্ছিল সেই দিকেই চলতে আরম্ভ করলো।

হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন মেয়ের খেয়াল হলো। বললে–ওরে, কাছাটা দেখলি নে? কাছাটার মধ্যে যদি টাকা থাকে!

ততক্ষণে লোকটা একটু এগিয়ে গিয়েছে। একজন মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সামনে গিয়ে পথ আটকে ধরেছে। বললে–দেখি, তোমার কাছা দেখি–

পেছন-পেছন আরো সবাই বলা-নেই কওয়া নেই লোকটার কাছাটা টেনে খুলে দিয়েছে।

লোকটা চিৎকার করে উঠেছে–আরে করো কী, কাছা টানতে হবে না, আমি নিজেই দেখাচ্ছি–

কিন্তু এ-লাইনের মেয়েরা এত সহজে মুখের কথায় বিশ্বাস করে না। তারা কাছাটা খুলতেই দেখল কাছার মুড়োতে টাকা বাঁধা রয়েছে।

–এই তো টাকা রয়েছে! এতক্ষণ চালাকি হচ্ছিল?

লোকটা খপ করে টাকাটা ধরে ফেলেছে। কিছুতেই দেবে না টাকা। বললে–এ আমার টাকা নয় গো, এ পরের টাকা, ছাড়ো–ছাড়ো–

বলে মেয়েদের হাত ছাড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করলে।

মেয়েরা তখন পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে–ও মাসি, মাসি, এই দেখ পালিয়ে যাচ্ছে–

মাসি চিৎকার শুনে বাইরে এসে দাঁড়ালো–কী লা, কী হয়েছে ওখানে? কে পালাচ্ছে?

মেয়েরা বলে উঠলো-এই দেখ না মাসি, টাকা নেই বলে পালাচ্ছিল, এদিকে কাছায় টাকা লুকিয়ে রেখেছে

মাসি সামনে গিয়ে লোকটাকে ভালো করে দেখলে। তারপর মেয়েদের বললে–আরে, তোরা ওর কাছা ছাড়, কাছা ধরেছিস কেন? তুমি এসো বাবা, আমার মেয়েদের কথায় কিছু মনে কোর না, এসো, তোমার টাকা কেউ কেড়ে নেবে না, তোমার কোনও ভয় নেই, এসো এসো–

অনেক দিন পরে একটা খদ্দের এসেছে, মাসি তাকে সহজে হাতছাড়া করতে চাইলে না। আদর করে লোকটার হাত ধরে ডাকতে লাগলো। বললে–কিছু ভয় নেই বাবা তোমার, আমার সঙ্গে এসো–

লোকটা বললে–আমি ক্ষুদির বাড়ি যাচ্ছি, ওখানে আমার দলের লোকরা আছে–

–তা দলের লোকরা থাকলেই বা। ওরা ক্ষুদির বাড়িতে আছে থাকুক, তুমি আমার বাড়িতে থাকো। ক্ষুদির চেয়েও ভালো ভালো মেয়ে আছে আমার কাছে। তুমি আগে দেখই না, দেখতে দোষ কী বাছা? পছন্দ না-হয় ক্ষুদির কাছেই যেও। আর যদি পছন্দ হয় তো এখেনেই রাতটা থাকো। কাল সকালে আবার তোমার দলবলের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে–

কিন্তু এদিকে যখন এমনি টানাহ্যাঁচড়া চলেছে ওদিকে গলির মোড়ে তখন প্রকাশমামা ঢুকছে। অন্ধকার আশ-পাশ দেখে দেখে পা টিপে টিপে চলেছে। ট্রেনটা দেরি করে আসাতেই এই দুর্ঘটনা। নইলে, বিকেল বিকেল এলে এমন হতো না।

সামনে দিয়েই একটা লোক মাথা মুড়ি দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কেমন সন্দেহ হলো প্রকাশমামার। সদানন্দ না! তাকে দেখে মাথায় মুড়ি দিয়েছে!

পেছন থেকে ডাকলে–এই সদা, সদা-সদা না?

ডাক শুনে লোকটা আরো জোরে পা চালিয়ে দিলে।

প্রকাশমামার সন্দেহটা আরো দৃঢ় হলো–এই সদা, সদা, আমি তোর প্রকাশমামা রে, সদা—

লোকটা তখন আরো জোরে অদৃশ্য হয়ে যেতে চাইছে। এবার প্রকাশমামা দৌড়তে লাগলো। তাকে দেখে বোধহয় পালাচ্ছে। লুকিয়ে লুকিয়ে এখানে এসেছিল। ভাবতে পারেনি যে মামা আবার তার পিছু ধাওয়া করবে!

লোকটাও যত জোরে যায় প্রকাশমামাও তত আরো জোরে যেতে লাগলো। শেষে দৌড়ে গিয়ে লোকটার চাদরটা চেপে ধরে ফেললে।

–কী রে, পালাচ্ছিস যে? এত ডাকছি তোকে মোটে শুনতে পাচ্ছিস না?

কিন্তু মুখটা কাছ দেখেই কেমন চটকা ভাঙলো। সদা নয়। অন্য লোক। এ-পাড়ায় এসেছিল বলে মাথায় চাদর মুড়ি দিয়ে বেরোচ্ছে। খানিক দূরে গিয়ে চাদর খুলে গায়ে জড়িয়ে নেবে।

ততক্ষণে চাদরটা ছেড়ে দিয়েছে প্রকাশমামা। বললে–কিছু মনে করবেন না দাদা, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলুম আমার ভাগ্নে সদা–

বলে আর কথা বাড়ালে না প্রকাশমামা। ছি! ছি! লোকটা ভদ্রলোক বলে কিছু বললে না। অন্য ধরনের লোক হলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়ে যেত! সত্যিই তো সদা কেন এখানে আসতে যাবে? সে তো ভালো ছেলে। এমন সন্দেহ হলোই বা কেন তার? বোধহয় নেশাটার মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেছে। ছিঃ–

তারপর মাসির বাড়ির সামনে আসতেই দেখে অবাক কাণ্ড!

এতক্ষণে মাসিও দেখতে পেয়েছে তাকে। মেয়েরাও দেখে ফেলেছে।

–ওমা, ভালো মানুষের ছেলে যে? তুমি কখন এলে বাবা? কী ভাগ্যি আমার, তবু মাসিকে মনে পড়লো এ্যাদ্দিন বাদে–

যে-লোকটা এতক্ষণ কাছা নিয়ে সামলাতে পারছিল না, সে এই সুযোগে ছাড়া পেয়ে বাঁচল। কাছা আঁটতে আটতে সে তার নিজের পথে চলে গেল। এতদিন পরে পুরোন খদ্দের এসে গেছে আর উটকো খদ্দেদের দরকার নেই। মাসির একগাল হাসি বেরোল ভালো মানুষের ছেলেকে দেখে।

বললে–এসো বাবা, এসো, তা খাওয়া-দাওয়া তো কিছু হয়নি তোমার? একেবারে ট্রেন থেকে নেমেই আসছো তো?

প্রকাশমামা গোড়াতেই পকেট থেকে পাঁচখানা দশ টাকার নোট বার করে ফেলে দিলে।

বললে–এই নাও, মাংস-ডিম-মাছ যা আনবার আনাও, মালও আনাও–তোমার কাছে একটা কাজের জন্যে এসেছি–

মাসি তখন টাকা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেটা আঁচলে বেঁধে ফেলেছে। খবর পেয়ে গিরিধারীও এসে গেছে। বাড়ির মেয়েরাও প্রকাশমামাকে দেখে কিলবিল করে উঠেছে। আর ভাবনা নেই। এবার হোটেল থেকে মাংস-ডিম-মাছ সব এসে যাবে। ব্ল্যাক-আউটের বাজারে খদ্দেরপাতি কিছু নেই। আজ অনেকদিন পরে কিছু ভালোমন্দ পেটে পড়বে তবু।

বললে–কী খাবে তুমি বলো বাবা–

প্রকাশমামা বললেও দিশি-ফিশি নয়, আজ বিলিতি খাবো। তুমিও তো বিলিতি খেতে ভালোবাসো।

মাসি বললে–না বাবা, আজকে আমার একাদশী, আজকে আমার বিলিতি খেতে নেই, আমি দিশিই খাবো। তা আমার কথা ছেড়ে দাও। তুমি পরোটা না ভাত কী খাবে?

প্রকাশমামা বললে–ভাত-ফাত নয়, পরোটা। পরোটা আর পাঁঠার মাংস।

গিরিধারীকে সেই রকম অর্ডার দেওয়া হলো। বাড়ির অন্য মেয়েরাও পেসাদ পাবে। সুতরাং বেশি করেই আনতে হবে। মাসি হিসেব করে টাকা দিয়ে দিলে গিরিধারীকে।

প্রকাশমামা মাসিকে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে–তোমাকে একটা কাজ করতে হবে মাসি–

–কী কাজ?

–তোমার সেই বাতাসী! বাতাসী আছে?

–কেন, বাতাসীর ঘরে বসবে নাকি তুমি?

প্রকাশামামা বললে,–আরে তা কেন, সেই বড়বাবুর জন্যে বলছি। বড়বাবু আসে তো?

মাসি বললে–না বাবু, বড়বাবু এখন বাতাসীকে পাকাবাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। এখানে বড় গোলমাল হচ্ছিল।

–কিন্তু বড়বাবুকে দিয়ে আমার যে একটা কাজ করাতে হবে!

–কী কাজ?

–আমার ভাগ্নেকে চেনো তো? সেই সেবার নিয়ে এসেছিলুম তোমার কাছে! সেই ভাগ্নেটা আমার হঠাৎ বাড়ি থেকে পালিয়েছে। বুঝলে? এদিকে নতুন বউ বাড়িতে রয়েছে, ওদিকে সেও পালিয়েছে। এখন তোমার বড়বাবু যদি একটু সাহায্য করে তা তাকে উদ্ধার করা যায়। ওরা তো ডিটেকটিভ পুলিস, বুঝলে না, ওদের অসাধ্যি কিছু নেই। তা আমি টাকা যা খরচ লাগে সব দেবো–

মাসি গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলে কত টাকা ছাড়বে?

প্রকাশমামা বললে–বড়বাবু যত চাইবে। টাকার জন্যে কিছু আটকাবে না।

ততক্ষণে গিরিধারী হোটেল থেকে পরোটা-মাংস-ডিম সব এনে হাজির করেছে।

মাসি বললে–ঠিক আছে, তুমি এখন খেয়ে-দেয়ে নাও, আজ রাত্তিরে তো আর কিছু হবে না, কাল সকালে যা হয় সব ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু আমার বখরা যেন ঠিক থাকে বাবা। দেখো–

প্রকাশমামা বললে–সে-সব নিয়ে তুমি ভেবো না—

.

সেদিনও রাত্রে নয়নতারা ঘুমোচ্ছিল। ক’দিন ক’রাত না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কখন অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। হঠাৎ মনে হলো কে যেন তার গায়ে হাত দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে নয়নতারা চীৎকার করে উঠেছে–কে? কে?

সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকা দিতেই হাতটা তার গা থেকে সরিয়ে নিয়েছে।

নয়নতারা সামনের দিকে চোখ মেলে দেখতেই মানুষটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু মানুষটাকে চিনতে দেরি হলো না নয়নতারার। রাত কত কে জানে! নয়নতারা উঠে বসলো। কিন্তু অন্যদিনের মত চেঁচিয়ে উঠলো না। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠলো। ততক্ষণে সমস্ত ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝে নিয়েছে সে। তারপর নিজের শাড়িটা গুছিয়ে নিয়ে নিজের গায়ে জড়িয়ে নিলে। মাথায় ঘোমটা টেনে দিলে। আজ এর একটা বিহিত না করলে চলবে না। রোজ রোজ এ আর সহ্য করা উচিত নয়।

বেহারি পালের বউ-এর সকাল-সকাল ঘুম আসে না। প্রথম রাতটা আড়ামোড়া খায়। কিছুতেই আর ঘুম আসতে চায় না। তারপর মাঝরাত থেকে একটু একটু হাই ওঠে।

সেদিন সবে ঘুম আসছিল এমন সময় হঠাৎ বাইরে থেকে কে যেন ডাকলে–দিদিমা, ও দিদিমা–

মিহি মেয়েলি গলা।

বেহারি পালের বউ-এর কেমন সন্দেহ হলো। এ যেন চেনা-চেনা গলা মনে হচ্ছে!

তাড়তাড়ি দরজাটা খুলে বাইরে আসতেই দেখে আগাগোড়া চাদরে ঢেকে কে যেন ঘোমটা দিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

–কে? বউমা?

নয়নতারা সামনে এল এবার। বললে–হ্যাঁ দিদিমা, আমি–

–একি? বউমা? তুমি এত রাত্তিরে?

নয়নতারা তখন হাঁপাচ্ছে। বেহারি পালের বউএর মনে হলো যেন নয়নতারা অনেক দূর থেকে দৌড়তে দৌড়তে তাদের বাড়িতে এসেছে।

নয়নতারা বললে–দিদিমা…

কিন্তু বলতে গিয়েও মনের কথাটা পুরো বলতে পারলে না। হাঁপাতে লাগলো।

দিদিমা বললে–কী হলো বউমা এত রাত্তিরে? তুমি এত হাঁপাচ্ছো কেন? তোমার শাশুড়ি কোথায়?

নয়নতারার মুখে তখনও কোনও কথা বেরোচ্ছে না। বেহারি পালের বউ সব দেখেশুনে বললে–তুমি ঘরের ভেতরে এসো বউমা। তুমি বড় হাঁফাচ্ছ। এসো এসো–

বলে নয়নতারাকে নিজের ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বিছানার ওপর বসালে। তারপর হারিকেন জ্বেলে ভালো করে নয়নতারার মুখটা দেখলে। খুব ভয় পেলে মানুষের যেমন হয়, নয়নতারারও ঠিক তেমনি চেহারা হয়েছে তখন। জিজ্ঞেস করলে–এবারে বলো তো বউমা, কী হয়েছে তোমার? বাড়ি থেকে চলে এলে কেন? কেউ কিছু বলেছে?

নয়নতারা তবু কিছু বললে–না।

–শাশুড়ি জানে যে তুমি এখনে চলে এসেছ?

তবু নয়নতারার মুখে কোনও জবাব নেই। যেন একটা অজ্ঞাত ভয়ে নয়নতারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

–কী হলো? তোমার মুখে কোনও কথা নেই কেন?

এতক্ষণে নয়নতারার মুখে যেন একটু কথা বেরোল। বললে–আপনি যেন কাউকে বলবেন না দিদিমা যে আমি এখানে এসেছিলুম। কেউ যেন এ-কথা জানতে না পারে।

দিদিমা বললে–কিন্তু কাল সকালবেলা? কাল সকালে যদি তুমি এখানে থাকো তাহলে তো সবাই-ই জানতে পারবে, আমাকে আর কিছু বলতে হবে না তখন।

নয়নতারা বললে–কাল সকাল হবার আগেই আমি এখান থেকে চলে যাবো দিদিমা। আজ এই রাতটুকুই শুধু আপনার এখানে আমাকে একটু থাকতে দিন–

দিদিমা বললে–তা তো থাকতে দিচ্ছি, এখানে তোমাকে থাকতে দিতে তো আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তোমার শাশুড়ি? তোমার শাশুড়ি তো লোক ভালো নয় বউমা। শাশুড়ি জানতে পারলে আর রক্ষে রাখবে ভেবেছ?

নয়নতারা বললে–আমার শাশুড়ি জানতে পারবে না দিদিমা। ভোর হবার আগেই আমি চলে যাবো। শুধু রাতটুকু আপনার এখেনে থাকতে দিন আমাকে

–কিন্তু কেন বলো তো বউমা? তোমার কি একলা ঘরে শুতে ভয় করে?

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ বড্ড ভয় করে।

–তা সে কথাটা শাশুড়িকে বললেই পারো। তাহলে তোমার শাশুড়ি তোমার পাশে শুতো।

নয়নতারা বললে–শাশুড়িকে সেকথা বলতে আমার ভয় করে দিদিমা।

দিদিমা বললে–তা বটে, যার ছেলেই ওরকম বাপ-মার কাছে থাকতে পারলে না তো তার বউই বা থাকবে কী করে?

তারপর একটু থেমে বললে–তা হ্যাঁ বউমা, একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করি– বলো তো সদা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল কেন? তোমার সঙ্গে কি তার কিছু ঝগড়া হয়েছিল?

নয়নতারা বললে–দিদিমা, আপনি তো সব জানেন তাহলে আর জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমার দিক থেকে আমি বলতে পারি সবই আমার কপালের দোষ। কপাল ছাড়া আর কাকে দোষ দেব বলুন?

দিদিমা বললে–গাঁয়ের লোক নানা রকম কথা বলছে কি না। ছাই ভস্ম মাথা-মুণ্ডু নানারকম কথা কানে আসছে। তোমার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলে সে তো তোমার নামেই দোষ দিচ্ছে–

–আমার নামে! আমার নামে দোষ দিচ্ছেন আমার শাশুড়ি?

দিদিমা বললে–তা থাক গে, সে-সব কথা এখন থাক। ওসব তোমার এখন শুনে কাজ নেই–তুমি কি মনে করেছ তোমার শাশুড়ির কথা আমি বিশ্বাস করি? ও হলো গিয়ে ঝাড়-মিথ্যেবাদী। আমি তোমার বাবার কথাও বলি, কিছু মনে কোর না, তোমার বাবা কি আর পাত্র পেলেন না, এই চৌধুরীবাড়িতে তোমার মতন মেয়ের বিয়ে দিতে হয়? তোমার মত এমন যার রূপ তার কি পাত্তোরের অভাব?

তারপর নিজেই আবার সে-প্রসঙ্গ বদলে বললে–যাক গে, সেকথা এখন বলে লাভ নেই বউমা, এখন কী হয়েছিল তোমার তাই বলো, তোমার ক্ষিধে পেয়েছে? কিছু খাবে?

নয়নতারা বললে–না দিদিমা, এত রাত্তিরে কেউ খায়!

দিদিমা বললে–তাহলে? তাহলে তোমার জন্যে আমি কী করব তাই বলো?

নয়নতারা বললে–আমার জন্যে আপনার ঘুম হলো না। তাই ভেবেই আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি কী করবো বলুন তো দিদিমা! রাত্তির হলেই আমার ও বাড়িতে বড্ড ভয় হয়। রাত হলেই ভয়ে আমার বুক দূর-দূর করে ওঠে

–কেন? রাত্তিরে অত কীসের ভয়?

নয়নতারা বললে–আচ্ছা দিদিমা, রাত্তিরে যদি রোজ আপনার কাছে এসে শুই তো আপনার আপত্তি আছে?

দিদিমা বললে–ওমা, সে কী কথা! তুমি ওদের বাড়ির বউ হয়ে আমাদের বাড়ি শুলে লোকেই বা কী বলবে আর তোমার শাশুড়িই বা তা করতে দেবে কেন? মিছিমিছি ভাববে আমি বুঝি তোমার কানে ভাঙচি দিয়েছি

বাইরে পশ্চিমপাড়ার দিক থেকে মুরগী ডেকে উঠতেই নয়নতারা জানালার বাইরের আকাশটার দিকে চেয়ে দেখলে। বললে–ভোর হয়ে এলো বুঝি দিদিমা! আকাশটার দিকে চেয়ে দেখুন তো?

দিদিমাও জানালার কাছে সরে গিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে বললে–সকাল এখনও হয়নি, এইবার হবো-হবো–

নয়নতারা এতক্ষণ বিছার ওপর গা এলিয়ে দিয়েছিল। এবার উঠে বসলো। বললে– এবার তাহলে যাই দিদিমা, এখন চলে না গেলে সবাই আবার জেনে ফেলবে–

দিদিমা বললে–চলো তোমাকে আমি এগিয়ে দিয়ে আসি, অন্ধকারের মধ্যে তুমি একলা যেতে পারবে না–

নয়নতারা তখন ভালো করে মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়েছে। যাবার জন্যে একেবারে তৈরি।

বাইরে বারান্দায় পা বাড়িয়েই বললে–আসি দিদিমা—

কিন্তু চেয়ে দেখলে দিদিমাও তার পেছনে পেছনে আসছে। বললে–আপনি আবার আসছেন কেন দিদিমা, আমি ঠিক যেতে পারবো।

যদি তোমাদের সদর দরজা বন্ধ থাকে? অন্ধকার রাস্তায় তুমি একলা যাবে?

কিন্তু বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে নয়নতারা বড় ভয় পেয়ে গেল। আসবার সময় ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছিল। তখনও কোনও দিকে কিছু ভাবেনি। এখন ফেরবার সময় যেন গা ছমছম করতে লাগলো তার। হঠাৎ মনে পড়ে গেল এই সদরে ঢোকবার মুখে ডানদিকে চণ্ডীমণ্ডপের কাছেই কোথাও কালীগঞ্জের বউকে খুন করা হয়েছিল। কথাটা মনে পড়তেই পা দুটো যেন আরো ভারি ঠেকলো। পেছনে ফিরে চেয়ে বললে–দিদিমা আপনি যান, আমি এসে গেছি, দরজা খোলা আছে।

দিদিমা বললে–তুমি আগে ভেতরে ঢোকো বউমা, আমি দেখি তবে যাবো—

দিদিমা দাঁড়িয়ে দেখলে নয়নতারা বারবাড়ির উঠোনে ঢুকলো। তারপর আর দেখা গেল না। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল বউমার চেহারাটা।

নয়নতারা আসবার সময় বারবাড়ির দরজাটা খুলে চলে এসেছিল। দরজাটা তখনও তেমনি খোলাই রয়েছে। ভেতরবাড়িতে ঢুকে আস্তে আস্তে দরজায় আবার খিল লাগিয়ে দিলে। এতটুকুও শব্দ হলো না। তারপর পা টিপে টিপে আবার তার নিজের ঘরের দিকে চলতে লাগলো। কিন্তু এমন করে আর ক’দিন চলবে? এমনি করে প্রত্যেক রাত্রে কি দিদিমার বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাতে হবে নাকি তাকে?

কিন্তু নিজের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই যেন ভূত দেখে নয়নতারা চমকে উঠলো। মনে হলো তার ঘরের দরজা আগলে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

–কোথায় গিয়েছিল বউমা?

শাশুড়ির গলার শব্দটা নয়নতারার বুকে গিয়ে শেলের মত বিঁধলো।

–বলো কোথায় গিয়েছিলে?

নয়নতারা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। শাশুড়ির মুখের দিকে চাইতেও যেন তার ভয় করছিল। নয়নতারা কল্পনাও করতে পারেনি যে তার অনুপস্থিতিটা শাশুড়ির চোখে ধরা পড়বে। অথচ জানবার তো কথাও নয় কারো। যাবার সময় সে তো কোনও শব্দও করেনি। নিঃশব্দেই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

–কই কথা বলছো না যে? দরজা হাট করে খুলে রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি, বলো? না বললে তোমায় ঘরে ঢুকতে দেব না। বলো?

নয়নতারা কী বলবে বুঝতে পারলে না। সে যেন বোবা হয়ে গেছে তখন।

–চুপ করে আছো যে, কথার জবাব দাও!

–কুয়োতলায় গিয়েছিলুম।

–কুয়োতলায় গিয়েছিলে? মিছে কথা বলতে তোমার লজ্জা হলো না? ছিঃ, এবাড়ির বউ হয়ে তোমার এই মতি? তুমি ভেবেছ আমি কিছু দেখিনি? আমি নিজের চোখে দেখলুম তুমি সদর দিয়ে ঢুকে বার বাড়ি হয়ে ভেতরে এলে আর বলছে কিনা তুমি কুয়োতলায় গিয়েছিলে?

নয়নতারা চুপ করে রইল।

কিন্তু শাশুড়ি ছাড়লে না। বললে–কী হলো? ভেবেছ চুপ করে থাকলেই সাতখুন মাফ হয়ে যাবে? ভেবেছ বোবার শত্রু নেই, না? কিন্তু এও তোমাকে বলে রাখি বউমা, এ বাড়ির বউ হয়ে এরকম উড়ুউড়ু স্বভাব আমি সহ্য করবো না। যদি এ বাড়ির নিয়মকানুন মেনে চলতে পারো তো ভালো আর তা যদি না মেনে চলতে পারো তো তার ফল খারাপ হবে–এই তোমায় বলে রাখছি–

নয়নতারা তখনও চুপ করে ছিল।

শাশুড়ি বললে–আমার কথা কানে ঢুকলো, না ঢুকলো না? ঢুকলো?

নয়নতারা ঘাড় নাড়লো। বললে—হ্যাঁ—

শাশুড়ি বললে–আর একটা কথা, তুমি যেখানে রাত কাটিয়ে এলে তাদের বলে দিও, আমাদের বাড়ির শাশুড়ি-বউতে যা কিছু হয় তা নিয়ে যদি অন্য কেউ মাথা ঘামায় তো তাদেরও আমি ছেড়ে কথা বলবো না। আমি সকলের হাঁড়ির খবর জানি। নতুন দু’টো পয়সার মুখ দেখেছে বলে যেন কেউ চৌধুরীদের সঙ্গে টেক্কা না দিতে আসে বুঝলে?–এখন যাও–

এতক্ষণ যা-কিছু হচ্ছিল সবই বেহারি পালের গিন্নীর কানে গেল। শোবার ঘর ছেড়ে বেহারি পালের বউ একেবারে বাগানের পাঁচিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কান পেতে ছিল।

কথাবার্তার শব্দে বেহারি পাল নিজেও এসে গিন্নীর পাশে দাঁড়ালো।

জিজ্ঞেস করলে–কে এসেছিল গো?

–ওদের বউ।

বেহারি পাল বললে–তা তো শুনেছি, আমি আমার ঘরে শুয়ে শুয়ে সব শুনেছি। তা ওদের বউ এত রাত্তিরে বাড়ি থেকে চলে এসেছিল কেন? শাশুড়ি-বউতে ঝগড়া হয়েছে নিশ্চয়ই!

গিন্নী বললে–সে-সব তো কিছু ভাঙলে না। ভয়ও তো আছে। যা গুণের শাশুড়ি–

বেহারি পাল বললে–ছেলে কি আর সাধে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে—

গিন্নী বললে–আহা, বউমার জন্যে বড় কষ্ট হয়, একেবারে কচি বয়স তো। নিজের মা’টা ছিল, তাও পট করে মারা গেল! একেই বলে কপাল!

বেহারি পাল বললে–কোনও পথ না পেয়ে বুঝি তোমার কাছে ছুটে এসেছে?

গিন্নী বললে–ওই শোন না, সেই জন্যেই তো শাশুড়ী মাগী খোঁটা দিচ্ছে। বলিহারি শাশুড়ির নজর। মাঝ রাতিরেও মাগীর চোখে ঘুম নেই, বউএর পেছনে লেগেছে

বেহারি পাল বললে–চলে এসো, তুমি চলে এসো, ওদের শাশুড়ি বউতে ঝগড়া, তাতে আমাদের কী? আমাদের নিজেদের ঝঞ্ঝাট কে সামলায় তার ঠিক নেই, আমরা ওদের নিয়ে ভেবে মরছি! ওদের ছেলে ওদের বউ, ওরাই সামলাক–

কিন্তু গিন্নী বললে–তা আমি কি ওদের বাড়ির কথা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি, আমি ভাবছি বউটার কথা, বউটা তো পরের বাড়ির মেয়ে, তার কেন মাঝখান থেকে এত ভোগান্তি!

বেহারি পাল বললে–তা দোষ তো ছেলেটার। ছেলেটাই বা বিয়ে করতে গেল কেন? যদি জানতোই যে তার বাপ-মা-ঠাকুর্দা এমন তো তা জেনে শুনেও কেউ বিয়ে করে?

গিন্নী বললে–তুমি ছেলেটারই দোষ দেখছো। ছেলেটা কী করবে? ছেলের বাপ-ঠাকুর্দা যদি অমন করে মিথ্যে স্তোক না দিত তো সে কি বিয়ে করতো? সে তো বিয়ের দিন গায়েহলুদের সময়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তাকে তো জোর করে বেঁধে ধরে এনে বিয়ে করতে পাঠালে, তুমি তো সব দেখেছ–

খোলা আকাশের তলায় বাগানের ঝোপজঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। আকাশ তখনও ভালো করে ফর্সা হয়নি। বেহারি পালেরও অনেক কাজ। পরের বাড়ির কেচ্ছা শুনলে তার পেট ভরবে না। তাদেরও সংসার আছে, সংসারের দায়-দায়িত্ব আছে। সব বাড়ির যা-যা আছে তাদেরও তো সবই আছে। বরং অনেক বেশি মাত্রাতেই আছে।

বললে–এসো, এসো চলে এসো তুমি। ভোর হয়ে আসছে

ও-বাড়ি থেকে তখন আর কোন আওয়াজই আসছে না। গিন্নীও আর দাঁড়ালে না। আস্তে আস্তে ঘরের দিকে চলে এলো।

বেহারি পাল বললেও নিয়ে আর ভেবো না তুমি।

গিন্নী বললে–আমি কি ভাবতুম! বউটা যদি রাততিরে আমাদের বাড়ি না আসতো আমিই কি ও নিয়ে মাথা ঘামাতুম মনে করেছ?

বেহারি পাল বললে–তা ভেবে আর তুমি কী-ই বা করবে? আমিও কিছু করতে পারবো না, তুমিও কিছু করতে পারবে না। শেষকালে মাঝখান থেকে আমাদের ওপর ওরা যত ঝাল ঝাড়বে।

গিন্নী বললে–তা যাক, আমরা কিছু নাই বা করতে পারলুম, মাথার ওপর ভগবান বলে তো একজন আছে। ভগবান তো সবই দেখছে। তার চোখ তো কেউ এড়াতে পারবে না–

আর ওদিকে চৌধুরী মশাই তখন জেগেই ছিলেন। গৃহিণী ঘরে আসতেই বললেন– কী হলো? বউমা এলো?

গৃহিণী বললে–হ্যাঁ এসেছে–

–তা কী বললে? বেহারি পালের বাড়িতে কেন গিয়েছিল এত রাত্তিরে তা কিছু বললে না?

প্রীতি বললে–বলবে আবার কী? আবার বলছে কি না কুয়োতলায় গিয়েছিল! ভেবেছে আমি কিছু টের পাইনি!

চৌধুরী মশাই বললেন–তা হলে তো দেখছি বউমা সোজা মেয়ে নয়।

প্রীতি বললে–তা আমিও কি সোজা মেয়ে? আমিও দেখাতে পারি কে কত সোজা আর কে কত ব্যাঁকা—

.

নবাবগঞ্জে যখন এই আধিপত্য আর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে, কলকাতা শহরে তখন আর এক ষড়যন্ত্রের জাল পাততে শুরু করছে প্রকাশমামা। কলকাতায় তখন যুদ্ধের আমল। যুদ্ধের আমল মানে লুঠের আমল। সে এমন এক আমল যখন আয় আর ব্যয়ের কোনও হিসেব নেই। জীবন আছে মৃত্যুও আছে তখন, কিন্তু জীবন-মৃত্যুর কোনও মূল্যায়ন নেই। অথচ এককালে যেমন এই শহর থেকে লোকে পালাতে ব্যস্ত ছিল তেমনি আবার এই শহরে তখন ফিরে আসতে পারার জন্যেও হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। বিহার-আসাম উড়িষ্যা-ঢাকা-চট্টগ্রাম থেমে ট্রেনে করে লোক আসছে তো আসছেই। সকলেরই এক কথা-কলকাতায় চলো। আসলে কলকাতা তখন সাউথ-ইষ্ট-এশিয়ার মিলিটারি হেডকোয়াটার্স। যুদ্ধের সব মাল সাপ্লাই হচ্ছে এই কলকাতা থেকে। টাকা কামাতে চাও এখানে এসো, আর টাকা ওড়াতে চাও তো তাও এখানেই এসো। ফুর্তি লুটতে চাও আর ফতুরই হতে চাও তো এখানেই তোমাকে আসতে হবে। এমন দরাজ শহর দুনিয়াতে আর কোথাও পাবে না। বাঁচি যদি তো কলকাতায় গিয়ে বাঁচবো, আর যদি মরি তো কলকাতাতে গিয়েই মরবো।

প্রকাশমামার দৌড় সাধারণত ভাগলপুর আর রাণাঘাট পর্যন্ত। দেশে কালে-ভদ্রে কখনও গেছে, কিন্তু টাকা সেখানে নিয়ম করে পাঠিয়েছে বরাবর। ফুর্তিই করুক আর যা-ই করুক সমস্ত মনটা পড়ে থাকে তার ভাগলপুরে। জমিজমা তেমন নেই যে সেই চাষবাসের ওপর নির্ভর করে সংসার চলবে। বরাবর গলগ্রহ। ছোটবেলায় গলগ্রহ ছিল পিসেমশাইএর। বড়লোক পিসোমশাইএর বাড়িটাই ছিল বলতে গেলে তার নিজের বাড়ি। নিজের বাপ-মা মারা গিয়েছিল ছোট বয়েসে। সেই তখন থেকেই একসঙ্গে মানুষ হয়েছিল প্রীতি আর প্রকাশ।

যেন দুই ভাই বোন।

কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায় নিজে হাত-টান মানুষ। টাকা হাত দিয়ে বেশি গলতো না। তাই প্রকাশের তেমন পছন্দ হতো না পিসেমশাইকে।

একদিন প্রকাশ জিজ্ঞেস করেছিল–এত টাকা তোমার কে খাবে পিসেমশাই? তুমি মরে গেলে কার জন্যে টাকা রেখে যাবে?

পিসেমশাই বলতো–কেন, আমার যখন নাতি হবে সে খাবে–

পিসেমশাই-এর বিষয় বুদ্ধি দেখে প্রকাশ তখনই অবাক হয়ে গিয়েছিল। কবে পিসেমশাই-এর মেয়ের বিয়ে হবে, কবে আবার সেই মেয়ের ছেলে হবে তখনকার কথা ভেবে বুড়ো টাকা জমাচ্ছে। এরই নাম যাকে বলে দূরদৃষ্টি!

ও-সব দূরদৃষ্টি ফুরদৃষ্টির ধার ধারতো না প্রকাশ রায়। তার মত ছিল দিয়তাং ভূজ্যতাং। অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষ দু’দিনের জন্যে মাত্র আসে। সে-দুটো দিন কেটে গেলে সবাইকেই একদিন চোখ উল্টে চিৎপটাং হতে হবে। সুতরাং ফুর্তিই সকলের জীবনের একমাত্র সারবস্তু হওয়া উচিত। এই জীবনদর্শন নিয়ে প্রকাশ রায় পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিল আর এই জীবন-দর্শনে আস্থা রেখে সে জীবন-সমুদ্রে পাড়ি দিচ্ছিল। এর পর পিসেমশাই একদিন তার বিয়ে দিয়ে দিলে। পিসেমশাই ভেবেছিল বিয়ে দিয়ে দিলেই প্রকাশের দায়িত্বজ্ঞান ভূমিষ্ঠ হবে আর তখন টাকা উপার্জনের দিকে সে মনোযোগ দেবে। অর্থাৎ টাকার ওপর তার মায়া বসবে।

পিসেমশাইএর দূরদৃষ্টি এই প্রথমবারই বুঝি মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয়েছিল। টাকার ওপর মায়া তো প্রকাশের বসেই নি, উল্টে টাকা ওড়াবার প্রবৃত্তিটাই ক্রমে ক্রমে প্রবল হয়ে উঠেছিল।

আসলে টাকাকে যারা অশ্রদ্ধা করে টাকাও বুঝি তাদের অশ্রদ্ধা করে। টাকার মূল্য যে বোঝে না টাকাও বুঝি তার মূল্য দেয় না। টাকার জগতের এমনই নীতি যে ভালোবাসার মানুষকে সে বুকে করে রাখে।

কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের বসতবাড়ির লাগোয়া একটা জায়গায় তিনি প্রকাশের জন্যে একটা ছোট বাড়ি করে দিলেন। বললেন–তুই তোর ঘর-সংসার ওইখানে পাত্, আমার ঘাড়ে আর কদ্দিন থাকবি?

কিন্তু ঘর-সংসার পাতবো বললেই পাতা যায় না। তার জন্যে রেস্ত লাগে। প্রকাশ রায়ের সেই জিনিসটিরই বড় অভাব ছিল বরাবর। এমন সময় প্রীতির বিয়ে হলো নবাবগঞ্জে। প্রকাশ বউ-ছেলে-মেয়ে ছেড়ে সেই যে দিদির কাছে গিয়ে রইল, সেখান থেকে আর এলো না। দিদিও ছাড়লে না তাকে। বললে–আর কিছুদিন থেকে যা তুই, তারপর একদিন গেলেই হবে। তোর তো সেখানে কোনও রাজকার্য নেই–

তখন থেকে প্রকাশ দিদির ফাই-ফরমাস খাটে আর সেই ফাই-ফরমাসের সুবাদে একবার রেলবাজার, একবার রাণাঘাট আর একবার কলকাতা করে বেড়ায়। কাজ কি দিদির কম!

এতগুলো জায়গার মধ্যে কলকাতার ওপরেই ছিল প্রকাশ রায়ের বেশি টান। যে কাজটা রেলবাজারেই সমাধা হয়ে যায় তার জন্যে প্রকাশ রায়ের কলকাতায় না গেলে চলে না। এই কলকাতায় কত রূপই না দেখেছে প্রকাশ। দিনের কলকাতা, সন্ধ্যের কলকাতা, রাত্রের কলকাতা ছাড়াও ঝগড়ার কলকাতা, মারামারির কলকাতা, ফুর্তির কলকাতা, টাকার কলকাতা আর সঙ্গে সঙ্গে প্রমোদের কলকাতা, বস্তির কলকাতা, অভাবের কলকাতা, দারিদ্র্যের কলকাতা, সমস্তই সে দেখেছে। তাই কলকাতা দেখতে তার আর বাকি নেই কিছু। তবু ফুরসৎ পেলেই প্রকাশ রায় কলকাতায় চলে আসে। দুতিন দিন এখানে কাটায়, তারপর আবার টাকার খ্যাঁচ পড়লেই নবাবগঞ্জে ফিরে যায়।

এবার প্রকাশ রায় এসেছিল একটা গভীর উদ্দেশ্য নিয়ে।

মাসি বলেছিল–বড়বাবুকে বলে যা করবার আমি করে দেব, তোমায় কিছু ভাবতে হবে না বাবা। সে দায় আমার ওপর ছেড়ে দাও তুমি–

প্রথম দু’দিন গায়ের ঘাম মারতেই কেটে গেল প্রকাশ রায়ের। কেবল পেট ভরে দু’বেলা পরোটা-মাংস খেতে লাগলো আর নেশার ঘোরে পড়ে-পড়ে ঘুমোতে লাগলো।

একদিন জিজ্ঞেস করলে–-কই মাসি, কিছু হলো?

মাসি বললে–অত তাড়া কীসের, এ কি তাড়াহুড়োর কাজ যে হুট বলতে করে দেব! বাতাসীকে বলেছি, বাতাসী আবার ফুরসৎ মত বড়বাবুকে বলবে

প্রকাশ বললে—এ-কথা বলতে ফুরসতের আবার কী দরকার? এ বলতে তো একমিনিটও লাগে না–

মাসি বললে–কী যে বলো তুমি তার ঠিক নেই। যে কাজের যা নিয়ম। বড়বাবুর মেজাজ কি সব দিন সমান থাকে, মেজাজ বুঝে তো কথা বলতে হবে। বড়বাবুর মাথায় হাজারটা ঝঞ্ঝাট। সে-সব ঝঞ্ঝাট ভুলতে বাতাসীর বাড়িতে আসে, আর এখানেও যদি ঝঞ্ঝাটের কথা ওঠে তো মানুষের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাবে না? তাহলে মাগ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার কী দোষ করলো?

প্রকাশ রায় বললে–তা বটে—

মাসি বললে–বড়বাবুর কথা না হয় ছেড়েই দিলুম, এই তোমার কথাই ধরো না বাবা, তোমারও তো বাড়িতে মাগ-ছেলে-মেয়ে আছে, তবু তুমি মাসির বাড়িতে কেন আসো বলো? ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট ভোলবার জন্যেই তো। নইলে মিছিমিছি টাকা নষ্ট করতে কে চায় বলো? কিছু ফায়দা পাও বলেই তো মাসির বাড়িতে আসো। তোমাদের মতো ভালোমানুষের ছেলেদের পায়ের ধুলো পড়ে বলেই তো আমার মেয়েরা দুটো পেটে খেতে পায়। নইলে তোমাদের বাড়িতে কি পরোটা-মাংসের অভাব, না তোমাদের বাড়িতে খাওয়া জোটে না? তা তো নয়।

মাসি মিষ্টি কথা বলতে যেমন, আবার পকেট কাটতেও তেমনি।

প্রকাশ বললে–ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বোঝ মাসি তাই করো, আমি এই শুয়ে রইলুম–

কিন্তু সত্যি-সত্যি শুয়ে প্রকাশ থাকে না। খেয়ে উঠেই বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে কাঁহা কাঁহা চলে যায় তার ঠিক নেই। বড়বাজারের দুধওয়ালা ধর্মশালা থেকে শুরু করে দক্ষিণেশ্বরের কালিবাড়ি পর্যন্ত কোথাও ঘুরতে বাকি থাকে না তার। ভালো করে নজর দিয়ে দেখে সকলকে। সকলের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলোয়। যাবে আর সে কোথায়? এই শহরেই কোথাও কোনও কোণে সদা আছে নিশ্চয়ই। যেখানে যে-আস্তানাতেই থাকুক রাস্তায় কি একবারের জন্যও বেরোবে না?

তারপর আছে কলকাতার বাজারগুলো। যে-যেখানে থাকুক, বাজারে একবার আসতেই হবে। সদা কি আর বাজার করতে আসবে? তা নয়। তবু অনেকগুলো লোককে একসঙ্গে বাজারেই পাওয়া যায়। সন্ধ্যেবেলা আর বেরোতে পারে না প্রকাশ। তখন ব্ল্যাক-আউট। তখন অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যে মিলিটারি-লরির ধাক্কা লাগলেই সঙ্গে সঙ্গে খতম। তখন এই মাসির বাড়িই ভালো। তখন এ-পাড়া আবার জম-জমাট। আগে যেমন ফাঁকা ছিল এখন আবার তেমনি জম-জমাট। তখন বস্তির বাড়িতে বাড়িতে মদের সঙ্গে ফুলুরি-পেঁয়াজির চাট জমে ওঠে। কোনও কোনও বাড়িতে আবার গান-বাজনার ঠাট্টা। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে যখন ট্যাঙ্ক বারুদ-বোমার ঘায়ে কোটি-কোটি লোকের জীবনান্ত অবস্থা তখন এ-প্রান্তে যৌবন নিয়ে ছেঁড়াছেঁড়ি কাণ্ড চলে।

কিন্তু সেদিন একটা অঘটন ঘটে গেল। হাওড়া স্টেশনের প্লাটফরমে গিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল প্রকাশ রায়। বিকেল হবো-হবো। মিলিটারিস্পেশাল এসেছে। খুব ভিড় চারদিকে। প্রকাশ সকলের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো। সদা যদি মিলিটারিতে নাম লিখিয়ে থাকে। সদার পক্ষে কিছুই বিচিত্র নয়।

–হটো, হটো, হট যাও–

কোথা থেকে মানুষের একটা ঢেউ এসে প্রকাশকে একেবারে অনেক দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। যখন চমক ভাঙলো দেখলে কে একজন হোমরা-চোমরা মানুষ যাচ্ছে, তার জন্যেই এত সতর্কতা। যুদ্ধের সময় মানুষকে আর মানুষ বলেও মনে করে না কেউ। যেন সবাই গরু ভেড়ার সামিল।

হঠাৎ পায়ে কী একটা ঠেকতেই প্রকাশ চেয়ে দেখলে। মানিব্যাগের মতন ঠিক। জিনিসটা কুড়িয়ে তুলে নিতেই চারিদিকে চেয়ে দেখলে। কেউ দেখে ফেলেনি তো! তারপর সেটা পকেটে পুরে ফেলে একেবারে সোজা প্লাটফরমের বাইরে। কিন্তু সেখানে গিয়েও স্বস্তি পেলে না। ভেতরে কী আছে কে জানে? সেখান থেকে একেবারে মাসির বাড়িতে চলে এসেছে। সেখানে নিজের ঘরখানাতে ঢুকেই দেখলে একটা মেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে।

বললে–তুই এখন যা বাপু এখেন থেকে, আমার কাজ আছে–

মেয়েটা চলে যেতেই প্রকাশ দরজা বন্ধ করে দিলে। একেবারে খিল বন্ধ। শালীদের কাউকে বিশ্বাস নেই।

মানি-ব্যাগটা খুলতেই হাত কাঁপতে লাগলো ঠক্ ঠক্ করে। হে মা কালী, হে মা জগদম্বা, তোমাকে আমি জোড়া-পাঁঠা বলি দিয়ে পূজো দেব মা। ভেতরে যেন টাকা থাকে মা।

হঠাৎ বাইরে থেকে মাসির গলা শোনা গেল–ওগো ছেলে, ও ভালোমানুষের ছেলে, বলি ভর সন্ধ্যেবেলায় দরজায় খিল দিলে কেন গা? আমার মেয়ে আছে নাকি ঘরে?

ব্যাগটার মধ্যে কিছু নেই। একেবারে ফাঁকা ব্যাগ। প্রকাশ রায়ের কপালটাই ফুটো। যেমন তার ফুটো কপাল, তেমনি ফুটো ব্যাগ!

প্রকাশ রায় তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলে।

মাসি বললে–ওমা, তাই বলি! আমি ভাবলুম কাকে ঘরে ঢুকিয়ে তুমি বুঝি খিল দিয়েছ! খবর আছে। আমি বাতাসীর বাড়ি গিয়েছিলুম

–তাই নাকি? তা কী খবর? বড়বাবু রাজি হয়েছে?

মাসি বললে–তা তো হয়েছে। কিন্তু বড়বাবু বলেছে তোমার ভাগ্নের ছবি চায়। ছবি না হলে খুঁজে বার করবে কী করে?

প্রকাশ বললে–ছবি তো নেই আমার কাছে। কিন্তু চেহারা বলে দিতে পারি। লম্বা গড়ন, ফরসা গায়ের রং, টিকোলো নাক, চুলগুলো সব সময় উস্কোখুস্কো থাকে। বেশ ভাবুক-ভাবুক চেহারা।

মাসি সব শুনলো। বললে–ও-সব বললে তো চিনতে পারবে না, একটা ছবি হলে তাড়াতাড়ি ধরা যাবে, নইলে পুলিসের লোক, বুঝতেই পারছো তো, গা করবে না মোটে–

তারপর একটু থেমে বললে–আর টাকা! টাকার কথাটাও বলি। মোটা টাকা লাগবে কিন্তু

প্রকাশ বললে–আমি তো বলিইছি টাকা দেব। তা কত টাকা লাগবে মোট?

মাসি বললে–আগাম দিতে হবে কিছু তারপর বাকিটা তোমার ভাগ্নেকে পাওয়া গেলে তখন দিলেই চলবে–

প্রকাশ বললে–একশো টাকা এখন দিতে পারি আগাম। তাতে চলবে?

–একশো টাকা মাত্তোর?

মাসির প্রথমে অনিচ্ছে ছিল। তারপর বললে–তা দাও, এখন একশো টাকাই দাও, বাকি ন’শো কিন্তু হাতে হাতে শোধ করতে হবে।

–ন’শো! প্রকাশ রায় টাকার অঙ্কটা শুনে যেন চমকে উঠলো।

বললে–মোট এক হাজার? যুদ্ধের বাজার বলে দাম বাড়লো নাকি? একটু কমসম করে হয় না?

মাসি বললে–তুমি যে কী বলো বাবা তার ঠিক নেই! জিনিস-পত্তোরের দাম চারদিকে কী রকম আগুন হয়েছে তুমি দেখতে পাচ্ছো না? আগে আমার এই বাড়িতেই চার-আনা আট-আনার লোক বসিয়েছি, এখন পারি?

প্রকাশ বললে–আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। গরজ যখন আমার তখন আর টানাহ্যাঁচড়া করবো না, যা চাইছো তাই-ই দেব, আমার কাজ উদ্ধার হলেই হলো–

মাসি বললে–আর টাকাটা বড়বাবু তো নিজে নেবে না। বড়বাবু তেমন লোকই নয়। অমন মানুষ হয় না, তা জানো? নেহাৎ ভালোবাসার মেয়েমানুষ আবদার ধরেছে তাই রাজি হয়েছে। কিন্তু দলের লোকেরা তো আর ধম্ম করতে পুলিসের চাকরিতে ঢোকেনি, তারা ত নেবে! টাকাটা তাদের জন্যে

প্রকাশ রায় বললে–ঠিক আছে, এখন তো একশো টাকা রইলো তোমার কাছে, ওটা তুমি বাতাসীকে দিয়ে দিও–আমি আগে আমার ভাগ্নের ফটোটা নিয়ে আসি

মাসি ততক্ষণে একশো টাকার নোটটা কপালে ঠেকিয়ে আঁচলে বেঁধে ফেলেছে। তখন তার কাজ হয়ে গেছে। আর দেরি না করে বাইরে চলে গেল।

ভেতর থেকে প্রকাশ বললে–তাহলে কালকে সকালের ট্রেনেই আমি চলে যাচ্ছি মাসি, আমার হিসেবটা বুঝিয়ে দিও—

.

নবাবগঞ্জে সেদিনও আবার অনেক রাত হয়েছে। আবার সব নিরিবিলি, আবার সব নিঝুম। এই সব রাত্রেই বুঝি মানুষের সব কলঙ্ক সব পাপ সাপের মত গর্ত থেকে বাইরে মুখ বাড়ায়। বাড়িয়ে শিকারের লোভে বুকে হেঁটে পরিক্রমা শুরু করে। পরিক্রমা করে কলকাতা থেকে। নবাবগঞ্জ সর্বত্র।

–দিদিমা, দিদিমা, ও দিদিমা, আমাকে বাঁচাও…ও দিদি…

বেহারি পালের বউ-এর ঘুম বড় পতলা। একটু শব্দ হলেই ঘুম ভেঙে যায়। আওয়াজটা কানে আসতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো। তারপর সমস্ত জিনিসটা আন্দাজ করে নিলে। ওই তো, ঠিক যেন ও বাড়ির বউমার গলার মত!

বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে গেল।–বললে–ওগো, শুনছো—ওগো—

বেহারি পাল মশাই উঠলো। বললে–কী হলো?

গিন্নি বললে–জানো, হঠাৎ চৌধুরীদের নতুন বউ আমাকে দিদিমা বলে যেন ডাকলে আমি স্পষ্ট শুনতে পেলুম। নতুন বউ যেন বললে–দিদিমা আমাকে বাঁচাও। তা আমি একবার ওবাড়িতে যাই, বুঝলে? আমার বড় ভয় হচ্ছে, মনে হচ্ছে নিশ্চয় কিছু বিপদ হয়েছে

–সে কী? এই এত রাতিরে তুমি ওদের বাড়িতে যাবে কি গো! ওরা যদি কিছু বলে তখন? সেদিন কত কী কথা শোনালে শুনতে পেলে না? ওদের শাশুড়ি-বউ-এর ঝগড়াতে তোমার থাকবার দরকার কী? অপমান করলে তখন তো গায়ে লাগবে–

কিন্তু গিন্নী বললে, না গো, বউটার বড় কষ্ট, আবার হয়ত কিছু কষ্ট দিচ্ছে ওরা, আমি যাই, বলা যায় না, শাশুড়ী যা গুণের মানুষ, মারধোরও করতে পারে।

বলে আর দাঁড়ালে না। কাপড়টা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে একেবারে সদর মাড়িয়ে চৌধুরী বাড়ির বার বাড়ির উঠোনে গিয়ে পড়লো।

হঠাৎ আবার সেই ডাক–ও দিদিমা আমাকে বাঁচাও–ও দিদিমা…

বার বাড়ির উঠোন পেরিয়ে ভেতর বাড়ির দরজায় গিয়ে জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো।

–ও বউ, বউ, দরজা খোল। বউমা অত চেঁচাচ্ছে কেন? কী হয়েছে বউমার?

জোরে জোরে ধাক্কা দিতে দিতে বেহারি পালের বউ আবার বলতে লাগলো–ও বউ, বউ, আমি তোমার মাসিমা, দরজাটা খোল–

হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। অন্ধকারে চৌধুরী-গিন্নীর চেহারাটা অস্পষ্ট ছায়ার মত দাঁড়িয়ে।

–কে?

বেহারি পালের বউ বলে উঠলো–আমি বউ আমি। বউমা অত চেঁচিয়ে উঠলো কেন গা? কী হয়েছে বউমার? আমাকে ডাকলে কেন?

প্রীতি বললে–আমার বউমার কী-হলো না-হলো তা নিয়ে তোমার তো দেখছি খুব মাথা ব্যথা মাসিমা!

মাসিমা বললে–তা মাথা ব্যথা হবে না বউ? মেয়েটা অমন করে চেঁচিয়ে উঠলো, ভাবলুম গিয়ে দেখে আসি কী হলো! মানুষের বিপদে-আপদে কি চুপ করে থাকতে পারা যায়?

প্রীতি বললে–আমার বউ-এর বিপদ-আপদের জন্যে তোমার বুঝি খুব ভাবনা? তা এতই যদি ভাবনা তো আমার বউকে কাল নিজের বাড়িতে আটকে রাখলেই পারতে? আবার সোহাগ করে আসতে দিলে কেন? তোমার বাড়িতেই খেতে শুতে থাকতো?

মাসিমা স্তম্ভিত হয়ে গেল বউ-এর কথা শুনে।

বললে–তুমি কী বলছো বউ? আমি বউমাকে আমার বাড়িতে আটকে রাখবো?

প্রীতি বললে–তা আমি কি অন্যায় বলেছি মাসিমা? কাল রাতিরে বউমা তোমার বাড়িতে যায়নি বলতে চাও? নিজের শাশুড়ি থাকতে তার কোন্ দায় পড়েছিল তোমার বাড়িতে যাবার শুনি? আজকে পরের বাড়ির দিদিমার ওপরে বউমার এত টানই বা হলো কেন? তবু যদি নিজের দিদিমা হতে তো তাও বুঝতাম

বেহারি পালের বউ বললে–আমার আসাই ঘাট হয়েছে বউ, কর্তা ঠিকই বলেছিল, এখন বুঝছি না-এলেই বুঝি ভালো হতো।

প্রীতি বললে–সেকথাটা আগে বুঝলে আমাকেও এত কথা বলতে হতো না আর তোমাকেও এত কথা শুনতে হতো না মাসিমা–

বেহারি পালের বউ বললে–ঠিক আছে বউ, আমি আসি

বলে আবার যেমন এসেছিল তেমনি চলেই যাচ্ছিল, কিন্তু পেছন থেকে প্রীতি আবার ডাকলে।

বললে–একটা কথা শুনে যাও মাসিমা, পরের বাড়ির গেরস্তালি ব্যাপারে নাক গলাতে চেষ্টা করা, এটা ভাল কাজ নয়। আমার বউমা খেতে পেলে কি পেলে না, আমার বউমা রাতিরে একলা ঘরে শুতে ভয় পেলো কি পেলো না, সেটা দেখার কাজ আমার, পরের কাজ নয়–

বেহারি পালের বউ বললে–কিন্তু আমি তো তোমাদের পর মনে করি না বউ। পর মনে করলেই পর হয়। এতদিনে তুমিও আমাকে পর মনে করোনি, আমিও তাই। তা আজ যদি আমি পর হয়ে গিয়ে থাকি তো সে আমার কপাল বউ, সে আমার কপাল–

বলে বেহারি পালের বউ আর সেখানে দাঁড়লো না। সোজা নিজের বাড়িতে চলে এল।

বেহারি পাল সদরেই দাঁড়িয়ে ছিল। বললে–কী হলো? খুব কথা শোনালে তো? আমি তোমাকে বললুম যেও না তুমি সেই গেলে!

বেহারি পালের বউ সেকথার কোনও উত্তর না দিয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লে। বেহারি পালও পেছনে-পেছনে এসে দাঁড়ালো ঘরের ভেতরে।

বললে–দেখ, যখন মানুষের সময় খারাপ হয় তখন এমনিই হয়। তখন আর কারোর সঙ্গে মানুষ ভালো ব্যবহার করতে পারে না, তখন কাউকেই আর সহ্য হয় না–

বউ বললে–তা আমি কি ওদের টাকায় ভাগ বসাতে গেচি, না আমার সঙ্গে ওদের সেই সম্পর্ক! পাশাপাশি বাস করলে বিপদে-আপদে মানুষ মানুষের বাড়ি যায় না?

বেহারি পাল বললে–সে কথা তো সবাই জানে। কিন্তু ওরা কি সেই ধরনের লোক? দেখনি আমার একটু পয়সা হয়ছে বলে কর্তামশাই আমাকে কী-চোখে দেখতো? যখন অবস্থা ভালো ছিল না আমার তখন একরকম ব্যবহার পেইছি, তারপর আবার যখন আমার অবস্থা ভালো হলো তখন অন্য রকম। তখন থেকে তো কর্তামশাই আমাকে মানুষ বলেই মনে করতেন না। অসুখের সময় কতদিন দেখা করতে গিয়েছি, যেন আমি গরু না ভেড়া, মানুষ না পাথর! নিজে না খেয়ে না পরে, লোকজনকে সুদে টাকা দিয়ে জমি-জমা করেছি, সে সব তো কানে গেছে কর্তামশাইএর।

বউকে এসব পুরোন কথা শোনোনো বৃথা। কারণ এসব নবাবগঞ্জের সবাই জানে। এত লোক বেহারি পালের দোকানে সওদা করতে আসতো, কিন্তু কর্তামশাইএর বাড়ি থেকে কখনও এক পয়সার সওদা করতেও কেউ আসেনি।

কৈলাস গোমস্তাকে একদিন রাস্তায় বেহারি পাল জিজ্ঞেস করেছিল–আচ্ছা কৈলাস, আমার দোকান তো তোমাদের কর্তামশাইএর বাড়ির পাশেই, কই তোমরা তো কোনও দিন আমার দোকান থেকে একটা আধলার জিনিসও সওদা করো না? আমার মাল কি খারাপ, না আমি ওজনে কম দিই, নাকি বাজার দরের বেশি দাম নিই—

কৈলাস বলেছিল–আজ্ঞে, তা নয়, আমি হলুম গিয়ে হুকুমের চাকর, আমি কী করবো বলুন? আমার ওপর যেমন হুকুম হবে আমি তেমনি তামিল করবো–

বেহারি পাল বলতো–তোমার কোনও দোষ নেই কৈলাস, তোমাকে আমি বলছি না। আমি তোমার কর্তাবাবুর কথাই বলছি। নিতাই হালদারের দোকানের ওপরও আমার কোনও রাগ নেই। আর আমার দোকান থেকে না কিনলে যে আমি উপোস করবো তাও নয়, কথাটা আমার মনে হয়েছে বলেই তোমায় জিজ্ঞেস করছি–

তা বেহারি পাল তখন থেকেই জানতো যে কারোর অবস্থা ভালো হোক, কারোর টাকা হোক এটা কর্তাবাবুর কাছে ভালো লাগতো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *