মানুষ সম্পত্তি যখন করে তখন পুরুষানুক্রেমে ভোগ-দখল করবে, এই আশা নিয়েই করে। কবেকার কোন্ আলীবর্দী খাঁ বা মীরজাফর খাঁর আমলের বংশ কোথা দিয়ে কেমন করে কত যুগ-পরিক্রমা করে হাজার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছিল। তাদের মধ্যে কে কোথায় ছিটকে ছড়িয়ে পড়েছিল কেউ তা জানতো না। ঘটনাচক্রে হঠাৎ দেখলেও হয়ত তারা পরস্পরকে চিনতে পারতো না। কিন্তু সেই বৃহৎ মহীরুহের একটা ছোট শাখা একদিন নদীয়া জেলার একটা অখ্যাত গ্রামে কেমন করে আবার ইতিহাসের সমুদ্রে বুদ্বুদের সৃষ্টি করতে পেরেছিল, তাও চৌধুরী মশাই-এর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কোথায় তা নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল।
কিন্তু প্রশ্ন তা নয়। প্রশ্নটা হলো সরকারী সেরেস্তার খাতায় এ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে কার নাম লেখা হবে? কে সেই আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারী? কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়েরও কোনও পুত্র-সন্তান নেই। কন্যা-সন্তান ছিল একটা, তাও মারা গেছে। এবার জামাই হরনারায়ণ চৌধুরীও গেল। রইল শুধু সদানন্দ। সদানন্দ চৌধুরী। কিন্তু কোথায় সে? কে বলে দেবে তার সন্ধান? সে তো কবে থেকেই নিরুদ্দেশ! কিন্তু যদি বেঁচে থাকে সে? তাহলে তো সে একলাই এই দুই জমিদারের সম্পত্তির অধিকারী। সে যদি এখন হঠাৎ এসে তার পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে বসে তখন কোথায় থাকবে প্রকাশ? প্রকাশ রায়?
প্রকাশ রায় আর দেরি করলে না। শুভস্য শীঘ্রং, কিন্তু অশুভস্য শুধু কালহরণং!
বউ ছেলে-মেয়েকে সে আগেই জামাইবাবুর বাড়িতে উঠিয়ে এনেছিল।
অশ্বিনী ভট্টাচার্যির চোখের সামনেই সে সমস্ত কিছুর মালিক সেজে বসলো। সুলতানপুরের লোক সবাই রাতারাতি ভক্ত হয়ে পড়লো প্রকাশ রায়ের। কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায় ঠিক যেমন করে বৈঠকখানা ঘরে পায়ের ওপর পা তুলে আরাম-দরবার বসানে, প্রকাশ রায়ও ঠিক তেমনি পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে আরাম-দরবার বসাতে লাগলো। ব্যাঙ্কের টাকা কড়ি যা কিছু তাতে হাত দেওয়া গেল না। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বললে–টাকা তো আপনাকে দিতে পারবো না, আপনিই যে হরনারায়ণ চৌধুরীর আইনসম্মত উত্তরাধিকারী তার প্রমাণ চাই
প্রকাশ বললে–প্রমাণ আর কী দেব বলুন, প্রমাণ গাঁয়ের লোক। তারাই প্রমাণ দেবে, তারাই বলবে চৌধুরী মশাই-এর কেউ নেই, তিনি আমার জামাইবাবু, আমি তার সমস্ত গচ্ছিত টাকাকড়ির আইনত ওয়ারিশন–
ব্যঙ্কের ম্যানেজার বললে–তা বললে তো ব্যাঙ্ক শুনবে না, আপনি কোর্ট থেকে সাকসেশান সার্টিফিকেট নিয়ে আসুন। তারা যদি আপনাকেই ওয়ারিশন বলে তো হরনারায়ণ চৌধুরীর সব টাকা কড়ি আপনিই পাবেন–
বড় মুশকিলে পড়লো প্রকাশ রায়। এত বছরের এত সাধ যখন শেষ পর্যন্ত মিটলোই তখন সব কি এমন করে বানচাল হয়ে যাবে নাকি? একেবারে ঘাটে এসে তরী ডুববে?
ততদিনে তোষামুদের দল জুটে গেছে প্রকাশ রায়ের। অশ্বিনী ভট্টাচার্যের আর সে রাগ নেই। এখন সে অন্য মানুষ। সকাল হতে-না-হতে তারা এসে প্রকাশ রায়ের বৈঠকখানায় জোটে। ঢুকেই প্রকাশ রায়কে প্রণাম করে। জিজ্ঞেস করে রাত্রে রায় মশাই-এর ঘুম হয়েছে কি না। সবাই-ই প্রকাশ রায়-এর শুভাকাঙ্ক্ষী তখন। সবাই-ই বলে–শরীরটার দিকে একটু নজর দেবেন রায় মশাই, আপনার শরীর ভালো থাকলে তবে আমরা ভালো থাকবো
প্রকাশ রায় বলে–কিছু ভেবো না হে তোমরা, আমি তোমাদের সকলের ভালো করবো–
তারপর কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের গড়গড়ার নলটা মুখে দিয়ে ধোঁয়া টানতে টানতে বলে–আরে জামাইবাবুই যে সব কেস খারাপ করে দিয়ে গেল। জামাইবাবু যদি সব জমি জমা বেচে না দিত তো দেখতে আমি তোমাদের সকলের খাজনা মকুব করে দিতুম।
ভীম বিশ্বাস জিজ্ঞেস করে–তা জমি-জমা সব বেচে দিতে গেলেন তিনি কার জন্যে? ছেলে নেই মেয়ে নেই বউ নেই, অত টাকা ব্যাঙ্কে রেখে গেলেন কার জন্যে? অত টাকার সুদ কে খাবে?
অশ্বিনী ভট্টাচার্য বলে–আপনার জন্যেই সব রেখে গেলেন রায় মশাই। আপনিই তো সারাজীবন ভগ্নিপতির সেবা করেছেন। এ সেই সেবার দাম–
–আরে রামঃ, আমি ওই টাকা ছোঁব? পরের টাকা ছুঁতে আমার বয়ে গেছে না। যার টাকা সে ফিরে এলেই তাকে ব্যাঙ্কের পাসবই ফেলে দেব। বলবো–তোর টাকা তুই নে বাবা, আমাকে এই ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি দে–
ভীম বিশ্বাস বলে–তা এতদিন হয়ে গেল, আপনার ভাগ্নে কি আর ফিরবে রায় মশাই, ফিরলে এতদিন কবেই ফিরতো।
প্রকাশ বলে–না ফিরলে আর আমি কী করতে পারি বলো, আমি তো আর তাকে খুঁজতে কসুর করিনি। সারা দুনিয়া খুঁজে বেড়িয়েছি। আমি যথাসাধ্যি করেছি আমার ভাগ্নের ভালোর জন্যে। ছোটবেলা থেকে তাকে আগলে আগলে মানুষ করেছি যাতে বদ ছেলেদের সঙ্গে মিশে বিগড়ে না যায়–
ভীম বিশ্বাস বললে–তা হলে মনে করে নিন ও-টাকা ভগবান আপনাকেই দিয়েছেন। ভগবান তো আপনাকে চেনেন, ভগবানের চোখে তো আপনি কোনও পাপ করেননি–
–পাপ?
পাপের নাম শুনেই প্রকাশ রায় ভয়ে লাফিয়ে ওঠে। বলে–ওরে বাবা রে, পাপ আবার করিনি? কত পাপ জীবনে করেছি কে জানে? মানুষ হয়ে জন্মানোই তো পাপ গো! দেখ, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে আজান্তে কত পিঁপড়ে মাড়িয়ে ফেলছি, পুকুরের মাছ খাচ্ছি, মাংস খাচ্ছি, কত মশা-মাছি মারছি, ওটা পাপ নয়?
–না না, ও পাপের কথা বলছিনে, ও-পাপ কে না করে রায় মশাই? যাঁরা মহাপুরুষ তারাও ওরকম কত পাপ করেছেন।
প্রকাশ বলে–তবে হ্যাঁ, তোমরা যদি মদ খাওয়াকে পাপ বলো তো মদ কখনও চোখেই দেখিনি, তো খাওয়া! মদের গন্ধ কখনও কখনও রাস্তায়-ঘাটে নাকে গেছে বটে, সে মিথ্যে কথা বলব না। আর মেয়েমানুষ? তা মেয়েমানুষ মাত্রকেই আমি মা বলে ডাকি, সে তো তোমরা নিজেরাই জানো
সবাই স্বীকার করে রায় মশাই-এর মত দেবতুল্য মানুষ ভাগলপুরে আর নেই।
প্রকাশ বললে–কিন্তু আমি একলা ভালো হলে হবে কি? সারা পৃথিবীর লোক যে সব খারাপ হয়ে গেল, সেইটেই যে আমার দুঃখ গো
অশ্বিনী ভট্টাচর্যি বলে–ও-নিয়ে আর আপনি ভাববেন না রায় মশাই, ও ভাবতে গেলে মাঝখান থেকে আপনারই শরীর খারাপ হয়ে যাবে। এই যে আপনি আপনার ভাগ্নের কথা ভাবছেন, এ কেউ ভাবে? অন্য লোক হলে এতদিনে ভগ্নিপতির সম্পত্তি খেয়ে ফেলতো। আপনি বলেই তাই এখনও ভাগ্নের আসার পথ চেয়ে বসে আছেন–
ভীম বিশ্বাস বলে–আপনার ভাগ্নের তো বিয়েও হয়েছিল?
–আর আমিই তো বিয়ে দিয়েছিলুম তার। বেশ সদ্বংশ থেকে রূপসী মেয়ে দেখে ভাগ্নেবউ করেছিলুম। কিন্তু এই যে বললুম, বেটা ছড় খেয়ে গেল
–ছড় খেয়ে গেল মানে?
–ছড় খেয়ে গেল মানে চরিত্র নষ্ট করে ফেললে। মানুষের আসল জিনিস হলো চরিত্র! সেইটেই যদি নষ্ট হলে তো থাকলোটা কী? নিজের বউকে ফেলে রেখে কি না কলকাতায় চলে গেল। আগে একবার পুলিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ওই ভাগ্নেকেই জেলে পুরেছিল, তা জানো?
–কেন?
–আবার কেন? ওই চরিত্র। চরিত্রটি যার নষ্ট হয়েছে তার তো ইহকালও নেই পরকালও নেই। আমি তো তাই জামাইবাবুকে বলতুম যে আপনার সব ভালো জামাইবাবু, শুধু আপনার ছেলেটি হয়েছে বেয়াড়া–
–তা তারপর কী হলো?
–তারপর সেই আমি! আমিই কলকাতায় গিয়ে পুলিসের কর্তাকে হাতে-পায়ে ধরে তবে আবার তাকে ছাড়িয়ে আনি। ওই ভাগ্নের জন্যে কি আমি কম করেছি হে? তা অত যে করলুম, সব আমার দিদির জন্যে। আমি যে ভাগলপুরে এসে আমার পিসেমশাইকে দেখবো, কি বউ-ছেলে-মেয়ে দেখবো তার তো উপায় ছিল না তখন। এখানে আসতে চাইলেই দিদি কান্নাকটি করতো। বলতো–তুই চলে যাসনি প্রকাশ, তুই চলে গেলে আমার সদা গোল্লায় যাবে–তা যে গোল্লায় যাবে প্রতিজ্ঞা করে, তাকে কি ভগবানই বাঁচাতে পারে গো?
যারা রায় মশাই-এর বৈঠকখানায় আসে তারা আখেরের ভরসায় আসে। প্রকাশ রায় তা জানে। জানে বলেই সকলকে আশা দেয়। এমন ভরসা দেয় যাতে তারা রোজই আসে। আর ঠিক পিসেমশাইকে যেমন ভয়-ভক্তি করতো রায় মশাইকেও তারা ঠিক তেমনি ভয় ভক্তি করে। নবাবগঞ্জে দিদির শ্বশুর কর্তাবাবুর খাতির দেখেছে, সুলতানপুরে পিসেমশাই এরও খাতির দেখেছে। এতকাল পর নিজে লোকের কাছে সেই খাতির পেয়ে প্রকাশের খুব ভালো লাগতো।
অশ্বিনী ভট্টাচার্য জিজ্ঞেস করতো–তা ভাগ্নে-বউ-এর শেষকালে কী হলো রায় মশাই?
প্রকাশ বলতে–কী আবার হবে, যে-গাইগরু বিয়োবেও না দুধও দেবে না তাকে ঘরে বসে খড়-ভূষি খাওয়াবে এমন আহাম্মক কেউ আছে?
কথাটা শুনে ভীম বিশ্বাসও অবাক হতো, অশ্বিনী ভট্টাচার্যিও অবাক হতো। বৈঠকখানা ঘরে যে-যে থাকতো, তারা সবাই-ই অবাক হয়ে যেত। জিজ্ঞেস করতো–তা সে বউ এখন কোথায়? খবরটবর কেউ রাখে না?
–কে আবার সেই অলক্ষুণে বউ-এর খবর রাখতে যাবে বলো তো? সেই বউ আসার পর থেকেই তো দিদি-জামাইবাবুর এই হাল হলো। নইলে নবাবগঞ্জের অত লাখ টাকার জমিদারি সাধ করে কেউ জলের দামে বেচে দেয়?
ভীম বিশ্বাস জিজ্ঞেস করতো তা কত দামে বিক্রি হলো সেই জমিদারি?
প্রকাশ বলতো–লাখ তিনেক টাকা।
তিন লাখ! তিন লাখ টাকা হলো জলের দর! টাকার অঙ্কটা শুনে উপস্থিত শ্রোতারা সবাই চমকে উঠতো। নবাবগঞ্জের জমিদারি যদি তিন লাখ টাকা হয়, তাহলে সুলতানপুরের জমি-জমা কম করেও পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে নিশ্চয়ই। উপস্থিত শ্রোতারা একসঙ্গে হাজার টাকাই কখনও চোখে দেখেনি, আর এ তো লাখ লাখ টাকা। তার ওপর আছে সুদ। মাসে মাসে সে-টাকার সুদও তো জমছে। সেই সুদও তো পাবে রায় মশাই।
ভীম বিশ্বাস আর থাকতে পারতো না। জিজ্ঞেস করে ফেলতো–অত টাকার সুদ কত হবে রায় মশাই?
প্রকাশ রায় তাচ্ছিল্যের সুরে বলতো–কত আর হবে, হাজার আষ্টেকের কম হবে।
–মাসে মাসে?
–হ্যাঁ, মাসে মাসে।
সর্বনাশ! সবাই সুদের অঙ্ক শুনে আবার আকাশ থেকে পড়তো। মাসে আট হাজার করে সুদ! আসলে হাত পড়বে না, সুদটাও সব খরচ হবে না। সুদের থেকেও আবার কিছু কিছু মোটা অংশ মাসে মাসে আসলে গিয়ে জমা পড়বে। তারপর সেই টাকা পাহাড় হয়ে হয়ে ব্যাঙ্কের সিন্দুক ছাপিয়ে শেষকালে উপচে পড়বে। এর নামই বলে কপাল! কার টাকা কে ভোগ করে দেখ! নরনারায়ণ চৌধুরী প্রজা ঠেঙিয়ে টাকা জমিয়ে গেল, সেই টাকার সঙ্গে আবার যোগ হলো বেয়াই-এর টাকা। আবার একটা ছেলে ছিল ছেলের বউও ছিল, তারাও কে কোথায় চলে গেল, সকলের সব টাকা কিনা এসে রায় মশাই-এর কপালে নাচলো!
–বুঝলেন রায় মশাই, আর জন্মে আপনি অনেক পুণ্যি করেছিলেন তাই এ-জন্মে এতগুলো টাকার মালিক হলেন। ধন্য আপনি রায় মশাই–আপনিই ধন্য—
বলে ভীম বিশ্বাস প্রকাশ রায়ের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকাতে।
প্রকাশ রায় পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলতো–পায়ের ধুলো নিচ্ছ নাও, কিন্তু আমার তো কোনও বাহাদুরি নেই হে এতে। তবে আমি শুধু চরিত্রটি ঠিক রেখেছি এই যা আমার কেরামতি। মদও খাইনি মেয়েমানুষও করিনি, আর কখনও মিছে কথাও বলিনি–মদ মেয়েমানুষ না করা আর মিছে না বলা, যদি ভালো কাজ হয় তো ভালো কাজ করেছি–
বলে আত্মতৃপ্তিতে মুখ দিয়ে গল্ গল্ করে তামাকের ধোঁয়া বার করতো।
কিন্তু সব মুশকিল করে দিলে ওই ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। সাকসেশন সার্টিফিকেট নিতে গেলেই তো কোর্টে যেতে হবে। তখন? তখন যদি বেরিয়ে পড়ে হরনারায়ণ চৌধুরীর এক ছেলে বেঁচে আছে! আর সে যদি মারা গিয়েও থাকে তো তার একটা বিয়ে হয়েছিল সে বউ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। নতুন আইনে ছেলে না থাকলে ছেলের বউই হবে শ্বশুরের সম্পত্তির ওয়ারিশন!
.
তা শেষকালে প্রকাশ উকিলের বাড়িতেও গেল। সব কিছু শুনলে উকিল। শুনে তারপর বললে–আপনার ভাগ্নে যদি বেঁচে থাকে তা হলে সব সম্পত্তি সেই ভাগ্নেই পাবে–
–ধরুন বেঁচে নেই। সন্নিসী হয়ে গেছে।
–ভাগ্নেকে যদি না পাওয়া যায় তা হলে সমস্ত ভাগ্নে বউ পাবে। এই রকম নতুন আইন হয়েছে এখন। তা তার কাছে গিয়ে একটা কাগজ লিখিয়ে নিয়ে আসুন না!
–কী লিখিয়ে আনবো?
–শুধু লিখিয়ে আনলে চলবে না। ভাগ্নেবউকে একটু ভুজুং-ভাজুং দিয়ে একবার ভাগলপুরের কোর্টে নিয়ে আসুন, তারপর যা করবার আমি করবো। আপনার ভাগ্নে বউ কোথায়?
প্রকাশ রায় বললে–তা তো জানি না–বোধ হয় তার বাপের বাড়িতেই আছে।
–তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন আপনাদের?
প্রকাশ বললে–সম্পর্ক খুব ভালো নয়। শেষের দিকে জামাইবাবুর সঙ্গে ছেলের বউ এর খুব ঝগড়া হয়ে যায়। সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়েছিল। ছেলের বউ রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল, তারপর আর আসেনি
উকিল বললে–ডিভোর্স হয়ে গেছে কিনা কিছু খবর রাখেন? বিবাহ-বিচ্ছেদ? এখন আবার এই নতুন আইনটা হয়েছে কিনা। যদি ডিভোর্স হয়ে থাকে তাহলে আপনি বেঁচে গেলেন
প্রকাশ রায় বললে–আজ্ঞে তা তো কিছু খবর রাখিনি।
–তাহলে এবার খবরটা রাখুন। এতগুলো টাকার ব্যাপার, ইয়ার্কি নাকি! টাকার ওয়ারিশন হতে গেলে খোঁজখবর করতে হবে আপনাকেই। খুঁজে দেখুন আপনার ভাগ্নে বউ আবার বিয়ে-টিয়ে করেছে কি না। আর ভাগ্নেও তো এখনও বেঁচে থাকতে পারে, তাকে খুঁজে বার করুন আগে, তা হলে সবই সুরাহা হয়ে যাবে। যদি বিবাগী হয়ে গিয়ে থাকে তো তাকে ধরে নিয়ে আসুন, তখন যা করবার আমি করে দেব’খন–
–কী করবেন তাকে দিয়ে?
–সে কোর্টে দাঁড়িয়ে বলবে যে সে টাকা চায় না। সেটা বলাতে পারবেন তাকে দিয়ে?
প্রকাশ বললে–খুব বলাতে পারবো। টাকার ওপরে তার কোনও লোভ-টোভ নেই কোনও কালে। ছোটবেলা থেকেই সে টাকা চায় না। অদ্ভুত ছেলে সে মশাই। বিয়ে করতেই চাইতো না তার আবার টাকা! আমরা তো তাকে জোর করে ধরে-করে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলুম–
উকিল বললে–তা হলে তা ল্যাঠা চুকেই গেল। কিন্তু তাকে যদি না পান তো আপনার ভাগ্নেবউকে তা হলে ভুজুং দিয়ে রাজি করাতে হবে–
প্রকাশ বললে–ওই একটা মুশকিল! ভাগ্নেবউ একলা হলে আমি কিছু ভয় পেতুম, যেমন করে লোক তাকে পটিয়ে ফেলতে পারতুম। কিন্তু তার পেছনে যে আবার একটা লোক আছে–
–লোক মানে?
–লোক মানে সে একটা বকাটে ছোকরা। তার নাম নিখিলেশ না কি।
–সে তার কে–
–কে আবার? কেউই না। বাবার ছাত্র। মেয়ের বিয়ের সময় কেনাকাটা-টাটা করা। সে-ই সব করতো আর কি। সেই তো একদিন জামাইবাবুর কাছে এসেছিল বউ-এর গয়না গাঁটি ফেরত চেয়ে নিতে। বুঝুন মশাই, বউ রাগ করে শ্বশুর-শাশুড়ীকে গালাগালি দিয়ে তেজ করে বাপের বাড়ি চলে গেল, এমন কি সিঁথির সিঁদুর মুছে হাতের শাঁখা পর্যন্ত ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে চলে গেল, তারপর আবার কোন্ লজ্জায় গয়না চেয়ে পাঠায়?
–কত টাকার গয়না?
প্রকাশ বললে–তা বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির গয়না মিলিয়ে প্রায় একশো ভরি হবে।
উকিল সব শুনে বললে–যাক গে ও-সব কথা। তার ব্যাপার শুনে মনে হচ্ছে সে বউ কি আর সম্পত্তির লোভ ছাড়বে! আপনি বরং ভাগ্নের খোঁজ করুন, টাকা-পয়সা সম্পত্তির ওপর যখন তার লোভ নেই বলছেন, তখন মনে হচ্ছে আপনাকে বিশেষ বেগ পেতে হবে না–আমি আপনাকে সব ব্যবস্থা করে দেব–
–তা হলে তাই যাই—
বলে উকিলের কাছ থেকে বাড়ি এসে সেইদিনই প্রকাশ রায় নবাবগঞ্জের পথে রওনা দিলে। কোথায় ভাগলপুর, আর কোথায় নবাবগঞ্জ। যদি নবাবগঞ্জে না পাওয়া যায় তখন আবার যেতে হবে কলকাতায়। আর কলকাতা ছাড়া গতি কী? বাঙালীর তো ওই একটাই জায়গা। যাবে আর সে কোথায়? পাপ করতে গেলেও সেই কলকাতা, পুণ্য করতে গেলেও তাই। ১৯৪৭ সালের পর থেকে যেন কলকাতার আকর্ষণ আরো বেড়েছে। একবার যদি জামাইবাবুর টাকাগুলো হাতাতে পারা যায় তো শেষ পর্যন্ত সুলতানপুরের বাড়িটা বেচে দিয়ে একবারে কলকাতায় চলে যাবে সে। এতদিন সে কালীঘাটের মানদা মাসির বাড়িতে গিয়ে উঠেছে, এবার থেকে উঠবে গিয়ে নিজের বাড়িতে। নিজে একটা মস্ত বাড়ি করবে কলকাতায়। একেবারে বড়-লোকদের পাড়ায়। আর কিনবে একখানা গাড়ি। সুদ থেকেই তো মাসে আট হাজার টাকা করে পকেটে আসবে। তখন কত খরচ করবে করো না, কত পরোটা আর ডিমের ডালনা খাবে খাও না। তবে এবার আর ধেনো নয় বাবা। ধেনো খেয়ে খেয়ে পেটের নাড়ি-ভুড়িতে মরচে ধরে গেছে। এবার বিলিতি। একেবারে খাস বিলিতি মাল ছাড়া আর কিছু ছোঁবে না সে।
ভাবতে ভাবতে প্রকাশ রায় ভাগলপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলো।
.
১৯৪৭ সালের পর সেই দশ বছর কেটে গেছে আর সঙ্গে সঙ্গে যেন পৃথিবীর মানচিত্র বদলেছে, পৃথিবীর মানুষের মনের মানচিত্রও যেন আগাগোড়া বদলে গেছে। অনেক নীল রঙ লাল হয়ে গেছে, অনেক লাল রং আবার নীল। লালের সঙ্গে নীলের বিরোধে মানুষে মানুষে ব্যবধানের পাঁচিল আরো উঁচু হয়ে একজনের সঙ্গে আর একজনের সম্পর্কের মধ্যে আড়াল সৃষ্টি করেছে। বন্ধুত্বের চেয়ে শত্রুতার শক্তিতে মানুষ মানুষের কাছেই আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। তাই বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষাশেষি এসে প্রকাশ রায় একদিন টাকার লোভে পৃথিবী পরিক্রমা করতে শুরু করলো। যে-টাকাকে সদানন্দ অত সহজে প্রত্যাখ্যান করতে পারলো, যে-টাকাকে প্রত্যাখান করে সে দাতব্য-ধর্মশালায় নিজের আশ্রয় খুঁজে নিলে সেই টাকার জন্যেই প্রকাশ রায় একদিন এক জেলা থেকে আর এক জেলায় হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগলো। কোথায় সদানন্দ, সদানন্দ কোথায়? সদানন্দকে খুঁজে বার করতে না পারলে যেন সব সাধ, সব বাসনা, সব ভবিষ্যৎ রসাতলে চলে যাবে।
বেহারি পালমশাই বললে–কই না তো, সদানন্দ তো আর আসেনি এখানে–
সদানন্দকে খুঁজে বেড়াবার পেছনে প্রকাশ রায়ের এই আগ্রহের কারণটা কিন্তু কারো কাছে আর চাপা থাকলো না। বরোয়ারিতলার দোকানের মাচায় বসে যারা আড্ডা দেয় তারাও বললে–এখন কেন তাকে খুঁজছেন শালাবাবু? যখন সদা নিজে থেকেই ছোটমশাই এর কাছে গিয়েছিল তখন তো আপনারা কেউই কিছু বলেননি? এখন বুঝি টাকার জন্যে সদাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন?
প্রকাশ বললে–আরে না ভাই তা নয়। তার নিজের বাপের মৃত্যুর খবরটা তাকে দিতে হবে না? তার টাকার ওপর আমার কোনও লোভ নেই।
–এদিকে প্রাণকেষ্ট সা’ মশাই-এর খবর শুনেছ শালাবাবু?
–কী খবর?
বেহারি পাল মশাই বললে–সা’ মশাই হার্ট-ফেল করে মারা গেছেন হে। তোমার ভগ্নিপতির বাড়ি কেনার পরদিনই এই কাণ্ড হলো। ওবাড়ি যে-ই কিনতো তারই ওই কাণ্ড হতো। আমি তখন কিনতে চেয়েছিলুম তা ছোটমশাই আমাকে বেচেননি, পাছে আমার ভালো হয়। এখন ভাবি ভালোই হয়েছে–আমি ও বাড়ি কিনলে আমারও তো ওই হতো–
অনেকদিন পরে আবার নবাবগঞ্জে আসা। এককালে কত বছর প্রকাশ রায় এই নবাবগঞ্জে কাটিয়ে গেছে। এই নবাবগঞ্জের ধুলোর সঙ্গে তার জীবন জড়িয়ে গিয়েছিল। কখনও কেউ ভাবতেও পারেনি তখন যে একদিন সেই নবাবগঞ্জেরই এই দশা হবে। কল্পনাও করতে পারেনি যে এমন করে চৌধুরী বংশ এত তাড়াতাড়ি ধুলোয় মিশিয়ে যাবে। প্রকাশ রায় সেই পুরোনো বাড়িটার দিকে চেয়ে দেখলে ভালো করে। সমস্ত বাড়িটাতে কালের দাগ যেন দাগী হয়ে গেছে যেন দাগী হয়ে গেছে সেটা।
প্রকাশ রায় উঠলো। বললে–উঠি পাল মশাই, আবার অনেক দূর যেতে হবে–
–কোথায় যাবে এখন?
–কোথায় আর যাবোয় দেখি সদাকে কোথায় পাওয়া যায়। যার সম্পত্তি তার হাতে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই। জামাইবাবুর লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি, এখন সে যদি না আসে তো গভর্মেন্টই তো সব বাজেয়াপ্ত করে নেবে
বেহারি পাল বললে–কেন? তা কেন? তুমিই সব পাবে! তুমি ছাড়া আর তো কেউ নেই চৌধুরী মশাই-এর–
–না পাল মশাই, টাকার ওপরে আমার অত লোভ নেই। টাকার লোভ যদিও বা আগে ছিল, এখন আর তাও নেই। টাকা থাকার পরিণাম তো চোখের সামনেই দেখলুম। অত টাকা থাকায় লাভটা কী হলো বলুন? শেষকালে তো মুত্যুর সময়ে এক গণ্ডুষ জলও পেলেন না জামাইবাবু–
কথা শেষ করে প্রকাশ রায় উঠলো৷ কিন্তু ফয়সালা হলো না কিছুই। এখান থেকে কোথায় যাবে তাই-ই ভাবতে লাগলো যেতে যেতে। কলকাতা ছাড়া সে আর কোথায়ই বা যাবে ভাগ্নেকে খুঁজতে! আর কলকাতা কি নবাবগঞ্জ যে সেখানে গেলেই সদানন্দকে খুঁজে বার করা যাবে? তা ছাড়া কলকাতাও তো আর এখন সে কলকাতা নেই। সে কলকাতা নাকি আরো জমজমাট হয়েছে। উদ্বাস্তুদের ভিড়ে নাকি কলকাতার রাস্তায় হাঁটাও দায় হয়েছে। ট্রামে বাসে আর দাঁড়াবার জায়গাও নাকি পাওয়া যায় না। আশে-পাশের সব জায়গায় নাকি তাদের ঝুপড়ি দোকান-ঘর উঠেছে।
হঠাৎ মানদা মাসির কথাটা মনে পড়ে গেল। মাসি বেঁচে আছে কি না তাই-ই বা কে জানে। আর সেই পুলিসের বড়বাবু। সেই বাতাসীর বাবু। তাকে তো সে সদার একটা ছবিও দিয়ে এসেছিল সেবার।
রেল বাজার থেকে প্রকাশ রায় আবার কলকাতার ট্রেনে চেপে বসলো।
.
নৈহাটির একটা বাড়ীর একটা ঘরে সদানন্দ তখন চোখ মেলে চাইলে। প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো দৃষ্টিটা। তারপর আস্তে আস্তে পাশ ফিরে শুলো।
মাথার বালিশটা মাথা থেকে সরে গিয়েছিল। নয়নতারা সেটা আবার মাথার নিচে ঠিক করিয়ে বসিয়ে দিলে। মাথায় নয়নতারার হাতের স্পর্শ লাগতেই সদানন্দের কেমন যেন চৈতন্য ফিরে এল।
মাথার ওপর চোখ দুটো যেন কাকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো। সামনে নয়নতারাকে দেখে একদৃষ্টে সেই দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর আবার চোখ বুজলো।
নয়নতারার মনে হলো মানুষটা বোধহয় আবার ঘুমিয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে সে বাইরে চলে এল। সকালবেলা নিখিলেশ ভাত খেয়ে অফিসে গেছে। তারপর গিরি বালাকে রোগীর কাছে বসিয়ে নিজের কাপড় কাচা, চান করা সব কিছু তাড়াতাড়ি সেরে নিয়ে কোনও রকমে ভাত মুখে গুঁজে দিয়ে আবার রোগীর কাছে এসে গিরিবালাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। গিরিবালাও তো মানুষ। বুড়ো মানুষ, একলা সে-ই বা কত পারবে? রান্না করতে করতেই তাকে হয়ত ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে ডাক্তারের বাড়ি ছুটতে হয়। আবার সেখানে থেকে এসেই ঘর ঝাঁট দেওয়া। কটা দিক সে দেখবে! সব চেয়ে বেশী মুসকিল হয়েছে নিখিলেশকে নিয়ে। আজকাল লাস্ট ট্রেনের আগে বাড়িই আসে না সে। জিজ্ঞেস করলে বলে–অফিসে কাজ পড়েছে–
অথচ আগেও তো নিখিলেশ অফিসে গিয়েছে। তখন যত কাজই থাকুক ঠিক ছুটির সময়ে নয়নতারার অফিসে এসে হাজির হতো। একদিনের জন্যেও তার এক মিনিট দেরি হয়নি। নয়নতারা বুঝতে পারে ও-মানুষটা যে এ বাড়িতে শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছে, ও-মানুষটার জন্যে যে এতগুলো টাকা খরচ হচ্ছে, নয়নতারার অফিস কামাই হচ্ছে, এটা নিখিলেশের পছন্দ নয়। কিন্তু পুরুষ মানুষ এত অবুঝ কেন? এইটুকু বোঝে না কেউ যে, আজ না হয় ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখা উচিত নয়, কিন্তু এককালে তো ওর সঙ্গে তার অগ্নি সাক্ষী রেখে বিয়ে হয়েছিল। একটু ভদ্রতা, একটু সহানুভূতি দেখানোও কি অন্যায়। বাড়িতে কুকুর-বেড়াল পুষলেও তো মানুষ তাকে দুটো খেতে দেয়, অসুখ-বিসুখে তার সেবা করে। আর এতো তাও নয়, এ তো জলজ্যান্ত একটা মানুষ! এর জন্যে এমন করে রাগ করতে আছে!
শুকনো কাপড়গুলো ঘরের আলনায় রেখে দিয়ে আবার নয়নতারা এ-ঘরে এল। আসতেই অবাক হয়ে গেল। দেখলে মানুষটা চোখ মেলে জেগে রয়েছে। নয়নতারা ঘরে ঢুকতেই তার দিকে চেয়ে দেখলে।
আস্তে আস্তে তার কাছে এসে দাঁড়ালো নয়নতারা। মানুষটার দৃষ্টিও তাকে অনুসরণ করে তার মুখের ওপর পড়ে সেটা স্থির হয়ে রইল।
নয়নতারা মুখ নিচু করে জিজ্ঞেস করলে–কী দেখছো?
বোঝা গেল, কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে মানুষটার। নয়নতারা আবার জিজ্ঞেস করলে–কী দেখছো তুমি অমন করে?
মানুষটা তবু তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
–বলো কী দেখছো? আমার কথার জবাব দাও—
তবু কিছু কথা বলে না লোকটা। আশ্চর্য, অসুখ বুঝি এমনই জিনিস! সেই এতখানি দশাসই মানুষটা, যে তাকে দেখলেই অদৃশ্য হয়ে যেতে চাইতো, যে-লোকটা একদিন পরের অপরাধের দায়ে নিজের ওপর আঘাত করে মাথাটা রক্তাক্ত করে তুলেছিল, আজ অসুখে পড়ে সেই লোকটাই কেমন নির্জীব হয়ে শুয়ে পড়ে আছে। আর নয়নতারার সেবা তাকে মাসের পর মাস নিঃশব্দে মুখ বুঁজে গ্রহণ করতে হচ্ছে। সে জানতেও পারেনি যে তার দায় নয়নতারার ওপর ছেড়ে দিয়ে এতদিন নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছে সে। এরই নাম বুঝি অসুখ। এই জন্যেই বুঝি অসুখকে মানুষ এত ভয় করে। এই অসুখের কথা ভেবেই বুঝি মানুষ সংসার করে, ঘর বাঁধে, সন্তান কামনা করে।
–কী হলো, কী দেখছো বলো?
মানুষটার ফ্যাকাশে ঠোঁট দুটো একটু নড়ে উঠলো। দু’চোখে অগাধ কৌতূহল উগ্র হয়ে উঠলো।
–তুমি কে?
নয়নতারা আরো নিচু হলো এবার। মানুষটার মুখের কাছকাছি মুখ নামিয়ে আনলো। বললে–আমি নয়নতারা–
হঠাৎ যেন মানুষটার সর্বাঙ্গে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঠোঁটের একটা পাশ থর থর করে কেঁপে উঠলো।
–আমাকে চিনতে পেরেছ? নয়নতারাকে মনে পড়ে তোমার? আমি সেই নবাবগঞ্জের নয়নতারা! যাকে ফেলে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে! মনে পড়েছে?
মানুষটা তখনও একদৃষ্টে নয়নতারার দিকে চেয়ে আছে।
নয়নতারা জোরে জোরে বলতে লাগলো-–এ আমার বাড়ি। তুমি ট্রেনে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। তাই আমি তোমাকে সেখান থেকে আমার বাড়িতে এনে তুলেছি, বুঝলে? তোমার খুব শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই তোমার জ্ঞান ছিল না। ডাক্তারবাবু বলেছেন তোমার কোনও ভয় নেই, তুমি শিগগির সেরে উঠবে। অমন করে চেয়ে চেয়ে কী দেখছো? অনেকদিন ধরে তুমি অসুখে ভুগছ কিনা, তাই তোমার শরীর খুব দুর্বল হয়ে গেছে–কিছু ভেবো না–আমি তোমাকে ঠিক সারিয়ে তুলবো–
এতগুলো কথা মানুষটার কানে গেল কি না নয়নতারা বুঝতে পারলে না। নয়নতারার দিকে মানুষটা তখনও ফ্যা ফ্যা করে শুধু চেয়েই দেখতে লাগলো।
নয়নতারা বুঝতে পারলে না মানুষটা তার কথা শুনতে পাচ্ছে কি পাচ্ছে না। মুখে চোখে তেমন কোনও আভাসও পাওয়া গেল না।
একটু থেমে নয়নতারা আবার বললে–আমার কথা তুমি বুঝতে পারছো?
সদানন্দ মাথা নাড়তে চেষ্টা করলে।
নয়নতারা বললে–আমাকে চিনতে পেরেছ তুমি? বলো, চিনতে পেরেছ?
সদানন্দ আবার মাথা নাড়লে। কী যেন বলতে চেষ্টা করতে গেল। কিন্তু কিছু বলতে পারলে না।
নয়নতারা বললে–কিছু বলবে? তুমি কিছু বলবে আমাকে?
সদানন্দ অনেক চেষ্টা করে বললে–আমি…এখানে…কোথায়?
নয়নতারা বললে–এটা আমার বাড়ি, আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি, তোমার খুব অসুখ হয়েছিল কিনা তাই…
–আমার অসুখ হয়েছিল?
–হ্যাঁ, তুমি ক’মাস ধরে আমার বাড়িতেই রয়েছ। তুমি ট্রেনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে, তাই তোমাকে দেখতে পেয়ে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি। এখন তুমি ভালো হয়ে গেছ, আর কোনও ভয় নেই।
কথাটা শুনে সদানন্দ যেন উসখুস করতে লাগলো। এপাশ-ওপাশ চারদিকে দেখতে লাগলো। যেন চিনতে চেষ্টা করতে লাগলো চারিদিকের পরিবেশ। চারিদিকের পরিবেশ দেখে তার যেন কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। যেন তার ভালো লাগলো না এই শুয়ে থাকাটা। যেন উঠে বসতে চেষ্টা করতে গেল।
–ও কী করছে? উঠছো কেন? উঠছো কেন? শুয়ে থাকো।
নয়নতারা সদানন্দকে ধরে শুইয়ে রাখবার চেষ্টা করলে। দুর্বল শরীর সদানন্দর, পাখির পলকা শরীরের মত।
নয়নতারা আবার বলে উঠলো–কেন উঠতে চেষ্টা করছে, উঠো না, পড়ে যাবে–
নয়নতারার কথায় সদানন্দ হতাশ হয়ে আবার নির্জীব হয়ে শুয়ে পড়লো। অসহায় হয়ে শুধু নয়নতারা মুখের দিকে চেয়ে রইল। যেন বলতে চাইলে আমাকে ছেড়ে দাও তুমি, আমাকে মুক্তি দাও–
সেই আরো একবার যেমন করে কথাগুলো বলেছিল তেমনি করেই যেন কথাগুলো বলতে চাইলে সদানন্দ। নয়নতারা বুঝলো। কিন্তু-না-বোঝার ভান করে সদানন্দকে বলতে লাগলো–তুমি আগে ভালো হও, তারপরে চলে যেও, আমি তোমাকে এখানে আটকে রাখবো না, তুমি থাকতে চাইলেও আমি তোমাকে এখানে থাকতে দেবো না–
সদানন্দ এবারে আবার কথা বললে। বললে–তুমি কেন..আমাকে এখানে আনলে?
নয়নতারা বললে–এখানে না আনলে তুমি কি বাঁচতে? তোমার যে খুব শরীর খারাপ হয়েছিল। তুমি যে গাড়ীতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে–
এর জবাবে সদানন্দ কিছু বললে না। নিজের হাত দুটো শুধু নিজের মাথায় ঘষতে লাগলো।
নয়নতারা জিজ্ঞেস করলে–তোমার মাথা ব্যথা করছে? আমি টিপে দেব?
কোনও জবাব না পেয়ে নয়নতারা নিজে থেকেই সদানন্দর কপালটা আস্তে আস্তে টিপতে গেল। কিন্তু সদানন্দ হাত দিয়ে নয়নতারার হাতটা সরিয়ে দিলে।
নয়নতারা বললে–এখনও দেখছি তোমার রাগ গেল না আমার ওপর! এখনও তুমি সে সব কথা ভুলতে পারোনি দেখছি! মাথা টিপে দিলে তোমার কী ক্ষতি হয়?
সদানন্দ স্পষ্ট গলায় বললে—না–
নয়নতারা বললে–না কেন? আমাকে এখনও ঘেন্না করো? আমি হাত দিলে কি তোমার গায়ে কাঁটা ফোটে?
সদানন্দ এ-কথার কোনও জবাব দিতে পারলে না। নয়নতারার হাতে আত্মসমর্পণ করে যেন সে তৃপ্তি পেল। নয়নতারা একমনে তার মাথা টিপে দিতে লাগলো, আর সদানন্দ নির্জীবের মত শুয়ে রইল চোখ বুজিয়ে। নয়নতারার মনে হলো মানুষটা যেন এতদিনের অসুস্থতার পর তার সেবায় একটু আরাম পাচ্ছে। দুপুরবেলা চারিদিকে সব চুপচাপ। দূরে স্টেশনে বুঝি কোনও ট্রেনের হুইসল্ বেজে উঠলো। কোথাকার ট্রেন কে জানে! হয়ত ওই ট্রেনটাই তার আগেকার শ্বশুরবাড়ি রেলবাজারে যাবে। কিম্বা হয়ত ট্রেনটা রেলবাজার থেকেই আসছে। কে জানে! রেলবাজার! নামটা মনে পড়তেই মনটা অনেক দিনের পুরোন দিনগুলোর মধ্যে তলিয়ে গেল। আশ্চর্য! এমন যে হবে তা কি সে কল্পনা করতে পেরেছিল? তার জীবন তো এতদিন অন্য খাতে বইছিল। অফিস করছিল, মাসকাবারি মাইনে ঘরে আনছিল। নিখিলেশের সঙ্গে নিজের জীবনটা জড়িয়ে ফেলে সে তো একেবারে অন্য মানুষই হয়ে গিয়েছিল। তাহলে আবার তার পুরনো জীবনের ফেলে আসা মানুষটকে এমনভাবে কেন সে বাড়িতে এনে তুললো? ভগবান তার এ কী করলে? এখন একে নিয়ে সে কী করবে?
শাশুড়ী অনেক দিন বলেছে–দেখো বউমা, আমার খোকাকে তুমি যা ভাবছো ও তা নয়, ওর মত মায়া-দয়ার শরীর হয় না, সকলের জন্যে ওর মায়া, সকলের দুঃখে ও দুঃখ পায়, কেউ ওর পর নয়, সবাই ওর কাছে আপন–
আরো বলতো–শুধু অন্য সকলের থেকে একটু আলাদা, এই যা। পাড়ার আর দশজন ছেলেদের থেকে আলাদা। দেখছো না সবাই রারোয়ারিতলায় যাত্রা-থিয়েটার-কবিগান নিয়ে মেতে আছে, ও সেদিকে নেই, কোথায় মাঠে-ঘাটে-ক্ষেতে-খামারে এক-একলা ঘুরে বেড়ায়। ছোটবেলায় প্রহ্লাদ চরিত্র যাত্রাগান হচ্ছে বার বাড়িতে, আমার কাছে বসে ও গান শুনছে, শুনতে শুনতে ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমার তো তখন থেকেই ভয় হতো ও ছেলে বড় হলে সন্নিসী না হয়ে যায় না–
তখন সদানন্দকে নয়নতারা অতটা ভালো করে চেনেনি। মনে হয়েছিল সে বলে–তা ছোটবেলা থেকেই যদি আপনার ছেলের সেই রকম মতিগতি তো সে ছেলের বিয়ে দিলেন কেন? তেমন ছেলের তো বিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি আপনার–
কিন্তু শাশুড়ীর সামনে সেদিন নয়নতারা মুখ ফুটে এ-কথা বলতে পারেনি। শুধু মনে মনে শ্বশুর-শাশুড়ীর ওপরই রাগ হয়েছিল তার। শাশুড়ী যত তার ছেলের গুণগান করতে তত তার রাগ হয়ে যেত শ্বশুর-শাশুড়ীর ওপর।
নয়নতারার মুখটা গম্ভীর হতে দেখলেই শাশুড়ী ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠত। বলতো–এখন বউমা তুমি খোকাকে ওই রকম দেখছো বটে, কিন্ত ওর আর একটু বয়েস হোক, তোমার কোলে একটা খোকা আসুক, তখন দেখবে তোমার ঘর থেকে ও আর নড়তে চাইবে না, পুরুষমানুষের তো স্বভাবই এই, তোমার শ্বশুরকেও তো দেখেছি বউমা, সবাই-ই ওই রকম–
কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো ততই যেন মানুষটার স্বভাব আরো তীক্ষ্ম, আরো কঠোর হয়ে উঠতে লাগলো। তখন মানুষটার দিকে চেয়ে দেখতেও তার ভয় করতো।
আর আশ্চর্য সেই শাশুড়ী। সেই শাশুড়ীই যে আবার একদিন ওই রকম হয়ে যাবে তাও যেন কল্পনার বাইরে। রাত্রে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুতে দেবে না। এ কি আবদার শাশুড়ীর! বেশ হয়েছে। ভালো হয়েছে। অমন বংশ যে নির্বংশ হয়ে গেছে খুব ভালো হয়েছে, নয়নতারা শুনে খুব খুশী হয়েছে। নিখিলেশ নিজে গয়নাগুলো চাইতে নবাবগঞ্জে গিয়ে সব শুনে এসেছে। সে বাড়ি নাকি এখন ভূতের বাড়ি হয়ে গেছে। হবে না! তার অভিশাপ কি মিথ্যে হবে নাকি!
হঠাৎ বাইরের সদর দরজায় কড়া নড়ে উঠলো।
গিরিবালার এতক্ষণে সবে খাওয়া শেষ হয়েছে। রান্নাঘরের এঁটো কাঁটা পরিষ্কার করে চৌবাচ্চায় হাত ধুচ্ছিল। এমন অসময়ে আবার কে এল তার বাড়িতে! নিখিলেশ অফিস কামাই করে বাড়ি চলে এল নাকি?
নয়নতারার কাছে এসে গিরিবালা বললে–দিদিমণি, আপনার সঙ্গে কে দেখা করতে এসেছে দেখ–
গিরিবালার পেছনে কে বুঝি দাঁড়িয়ে ছিল।
–আরে নয়নদি! তোমার অসুখ বলে ছুটি নিয়েছ, আর তুমি তো দিব্যি বসে আছো, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম–
–ওমা তুই!
হুড়মুড় করে উঠে পড়লো নয়নতারা। নইলে মালা একেবারে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়তো হয়ত। নয়নতারা তাড়াতাড়ি তাকে তার নিজের শোবার ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালো। কিন্তু সেইটুকুর মধ্যে মালা যা দেখবার তা দেখে নিয়েছে।
ঘরের ভেতরে বসে মালা বললে–ও কে নয়নদি? ও-ঘরে? কারোর অসুখ নাকি?
নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, কিন্তু তুই হঠাৎ কী মনে করে?
মালা বললে–কী আবার মনে করে? এতদিন অফিসে যাচ্ছ না, আমরা সবাই ভেবে অস্থির। তুমি ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়েছ, আর আমি ভাববো না? তোমাকে একবার দেখতেও আসবো না?
–কিন্তু আজকে অফিস নেই তোর?
–ও মা, বুঝি জানো না, আজকে যে আমাদের ডিপার্টমেন্টের থিয়েটার হচ্ছে। তাই আজকে হাফ-হলিডে হয়ে গেল। সন্ধ্যেবেলা প্লে, সকাল-সকাল বাড়িতে গিয়ে খেয়ে দেয়ে সবাই সেজেগুজে থিয়েটার দেখতে যাবে, আমি বললুম আমি থিয়েটার দেখবো না, আমি বরং নৈহাটিতে গিয়ে নয়নদিকে দেখে আসি–
–তুই এসেছিস ভালো করেছিস, এখন তোর জন্যে কী খাবার আনাই বল্?
–কী যে বলো তুমি নয়নদি, আমি তো এইমাত্র অফিসের ক্যানটিন থেকে খেয়ে এলুম। খাওয়ার কথা থাক, তুমি তোমার কথা বলো, তোমার তো অসুখ-বিসুখ কিছু দেখতে পাচ্ছি না, তাহলে অফিসে যাচ্ছ না কেন? কী হয়েছে তোমার? এদিকে আমি কিনা অত দূর থেকে দৌড়তে দৌড়তে তোমাকে দেখতে এলুম–
নয়নতারা বললে–আমার নিজের অসুখ ঠিক নয়, আমার বাড়িতে অসুখ ভাই, এ এমন অসুখ, কিছুতেই সারছে না, এতদিনে এবার মনে হচ্ছে যেন একটু সেরে উঠেছে–
মালা বললে–কার অসুখ, নয়নদি, উনি কে?
নয়নতারা বললে–উনি আমাদের এক আত্মীয়–ওঁর অসুখের জন্যেই তো আমার অফিস কামাই, ওঁকে বাড়িতে একলা কার হাতে ফেলে অফিসে যাই বল?
–তোমার বাপের বাড়ির কেউ বুঝি?
নয়নতারা বললেন, আমার শ্বশুরবাড়ির লোক–
–তোমার দেওর বুঝি?
–না দেওর নয়—
–তবে?
মালার বড় কৌতূহল। নয়নতারা সে-প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বললে–ওঁর কথা থাক, তুই অফিসের সব খবরটবর বল, কেতকীর খবর কী? নতুন কিছু গয়না গড়ালো আর?
বলে নয়নতারা আর মালা দুজনেই হেসে উঠলো। কেতকী হাজরার গয়নার শখের কথা অফিসময় সবাই জানে। টাকা হাতে পেলেই কেবল গয়না গড়াবে কেতকী।
–আর একটা খবর তোমাকে দিই নয়নদি, আমাদের ডেস্প্যাচ সেকশানের অরুণাদি, অরুণাদিকে চিনতে পারছো তো?
–কে? অরুণা বোস?
–না, অরুণা পাল, চল্লিশ বছর বয়েস হয়ে গেছে, মনে নেই? ডেসপ্যাচ সেকশানের হেড-অ্যাসিসটেন্ট?
–হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি, তা তার কী হয়েছে?
–সেই অরুণাদি বিয়ে করছে!
নয়নতারা চমকে উঠলো।
বললে–ও মা, সে কী রে? সে তো বুড়ি হয়েছে, চুল পেকে গেছে যে তার।
মালা বললে–তা সে যেমন বুড়ি, তেমনি বুড়ো বরও তার জুটেছে। কার সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে জানো?
–কার সঙ্গে?
–আমাদের বাজেট সেকশানের বড়বাবুর সঙ্গে–
নয়নতারা আরো অবাক হয়ে গেল। বাজেট সেকশানের বড়বাবু আর-ডি-চ্যাটার্জি, রসিকদাস চট্টোপাধ্যায়। আগে একটা বিয়ে হয়েছিল বড়বাবুর, কিন্তু সে বউ বিয়ের পরেই মারা গিয়েছিল, তারপর আর বিয়ে করেনি ভদ্রলোক।
নয়নতারা বললে–-সে তো বুড়ো থুত্থুড়ো রে, তার সঙ্গে অরুণাদির বিয়ে? সে তো রিটায়ার করবে শিগগির, তাকে কী দেখে পছন্দ হলো অরুণাদি’র? টাকা?
মালা বললে–তা ছাড়া আর কী বলবো বলো! রিটায়ার করে অনেক পেনসন পাবে তো, পেনসন কমিউট করে কয়েক হাজার টাকা পাবে, সেই টাকার লোভ–আর অরুণাদিরও তো আর কেউ নেই, শেষকালে বুড়ো বর রিটায়ার করে বাড়িতে বসে রান্না করে দেবে, আর অরুণাদি অফিস করবে, ঠাকুর-চাকরের খরচটা বেঁচে যাবে–
নয়নতারা বললে–তাহলে শুধু টাকা! টাকার জন্যেই এই বয়েসে বিয়ে করতে গেল অরুণাদি? কিন্তু এতদিনই যদি বিয়ে না করে থাকতে পেরে থাকে তো আর বাকি জীবনটা থাকতে পারলে না?
মালা বললে–আরো কত মজার খবর আছে অফিসের, তোমায় কী বলবো নয়নদি। তুমি ছিলে না, তোমাকে এই সব খবর দেবার জন্যেই তো আরো এলাম।
গিরিবালা ততক্ষণে চা করে নিয়ে ঘরে এসেছে। সঙ্গে আবার মিষ্টি।
–ও মা, এসব আবার আনলে কেন নয়নদি! এরকম করলে কিন্তু আর আমি আসবো তোমার কাছে, এই আমি উঠলুম।
বলে মালা উঠে দাঁড়ালো। নয়নতারা বললে–উঠছিস কেন, আমিও তো চা খাবো রে, আমারও তো চা খাওয়ার সময় হয়েছে, এই নে, খা–
মালা বসলো। তারপর চা খেতে খেতে বললে–এবার যাবো নয়নদি, তা তুমি তো বললে না কার অসুখ, ও ঘরে কে রয়েছে তা তো বললে না–
পাশের ঘরে শুয়ে সদানন্দর কানে এতক্ষণ সব কথাগুলো ভেসে আসছিল। সবে সেদিন সে একটু সুস্থ হয়েছে। নয়নতারা তাকে গরম জলে স্নান করিয়ে দিয়েছে। নয়নতারার গলাও শুনতে পাচ্ছিল সে, আর একজন মেয়ের গলাও শুনতে পাচ্ছিল। তার মনে হলো সে যেন সব বুঝতে পারছে। তার অবর্তমানে নয়নতারা নবাবগঞ্জ ছেড়ে কেন কেষ্টনগরে না গিয়ে এখানে এই নৈহাটিতে এসেছে তাও যেন বুঝতে পারছে।
কদিন থেকেই অল্প-অল্প একটা ধারণা হচ্ছিল তার। কিন্তু আজকে যেন আরো স্পষ্ট হলো জিনিসটা–
হঠাৎ মালা জিজ্ঞেস করলে-কবে তুমি অফিসে যাবে, নয়নদি? তোমার জন্যে যে আমরা সবাই হাঁ করে বসে আছি–
নয়নতারা বললে–আমি কী করে যাই তুই বল, এই রুগীকে তাহলে কে দেখবে?
–তা ওঁর নিজের লোক কেউ নেই? ওঁর বিয়ে হয়নি? স্ত্রী ছেলে মেয়ে তাঁরা কোথায়?
–তারা নেই
মালা বললে–ও মা, কেউ নেই? তা তুমিই বা এত ঝক্কি ঘাড়ে নিতে গেলে কেন?
নয়নতারা বললে–সবাই তো তাই-ই বলে।
মালা বললে–তা বলবেই তো। তোমাদের তো ঝাড়া হাত পা। আপনি আর কোপনি! তুমি এসব পরের ঝঞ্ঝাট ঘাড়ে নিতে গেলে কেন নয়নদি–তোমাকে দেখে তো তাই অফিস-সুদ্ধু মেয়ে সবাই আমরা হিংসে করতুম।
সদানন্দর কেমন খারাপ লাগলো কথাগুলো শুনতে। তবে কি সে এবাড়িতে অবাঞ্ছিত। নয়নতারা তো আবার বিয়ে করেছে। বিয়ে করে সুখেই আছে। চাকরি করছে অফিসে। অফিসে যায়নি বলে অফিসের বন্ধুরা তার বাড়িতে পর্যন্ত খোঁজ নিতে এসেছে। এই অবস্থায় কেন সে এখানে আসতে গেল? কেন নয়নতারা তাকে বাড়িতে এনে তুললে? আর তুললোই যদি তাহলে সে জেনেশুনে কেন এখানে থাকবে? সে এখান থেকে চলে গেলেই তো আবার ওদের সংসারে শান্তি ফিরে আসে।
চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো সদানন্দ। এই ঘর, দেয়ালের গায়ে ঠেসান দেওয়া একটা আলমারি। তাতে কয়েকটা পুতুল। ঘরের মধ্যে দু’চারটে চেয়ার। আর একদিকে দেয়ালের তাকে ওষুধের শিশি জড়ো করা। কত ওষুধ খেয়েছে সে! তার অসুখের জন্যে কত টাকা খরচ হয়ে গেছে এদের!
–নিখিলেশবাবু কেমন আছেন রে!
–ওঁর কথা আর বলিসনি তুই, আমার ওপর ভীষণ রেগে গেছে জানিস?
–কেন?
–ওই যে আমি অফিসে যাচ্ছি না। অফিসে যাচ্ছি না বলে আমার মাইনে কাটা যাচ্ছে। সেই জন্যে রাগ। টাকার লোকসান হচ্ছে বলে ওঁর যত রাগ। এ ক’দিন আমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলছে না ভাই।
–তা নিখিলেশবাবুর দোষ কী নয়নদি, যে-কোনও স্বামীই তাই করতো। এতগুলো টাকা লোকসান কি মুখের কথা! সে-টাকায় কতগুলো শাড়ি হয়ে যেত বলো তো?
নয়নতারা বললে–দূর, একজনের জীবনের চেয়ে কি শাড়িই বড় হলো নাকি?
–তা তো বুঝলুম, কিন্তু উনি তো তোমার নিজের কেউ নন। নিজের স্বামী হলে অবশ্য অন্য কথা ছিল, কিন্তু উনি তো পর, মানে নিজের ছেলে-মেয়ে-স্বামী-ছাড়া মেয়েমানুষের কাছে আর সবাই-ই তো পর, বলো?
সদানন্দ আর থাকতে পারলে না। হ্যাঁ, সে তো পরই বটে। হাজারবার পর। এখন নয়নতারার কাছে সে আর নিজের লোক নয়। নিখিলেশবাবুকে বিয়ে করার পর থেকে সদানন্দ নয়নতারার চিরকালের মত পর হয়ে গেছে। সত্যিই তো, ওই মহিলা তো অন্যায় কথা কিছুই বলেনি। আজকের মানুষের কাছে পাড়া-প্রতিবেশী-আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধব বাবা-মা-শ্বশুর-শাশুড়ী সবাই-ই পর বই-কি। নিজের বলতে তো শুধু নিজের স্বামী, নিজের ছেলে-মেয়ে এই সব। এ ছাড়া তো আর কেউ নিজের নয়। তাহলে কেন সে এখানে থাকবে! সে এখানে থাকবে কেন? সে এখানে আছে বলেই তো নয়নতারা অফিসে যেতে পারছে না। তার জন্যেই নয়নতারার অফিসে মাইনে কাটা যাচ্ছে! যে-কোনও স্বামীই তো এতে স্ত্রীর ওপর রাগ করবে।
–জানিস, এই ওঁর জন্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল।
–তাই নাকি? কত টাকা খরচ হলো সবসুদ্ধ?
–তা অনেক।
–নিখিলেশবাবুকে তো ভালো বলতে হবে নয়নদি। আমার কর্তা হলে তো রুগীকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতেন।
নয়নতারা–কিন্তু ওঁকে তো খরচের কথা কিছু বলিনি। উনি কিছুই জানেন না। উনি মনে করেছেন বড় জোর শ’খানেক কি শ’দেড়েক টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু ভাই আজকাল ওষুধের কী গলাকাটা দাম হয়েছে! এক-একটা ইনজেকশানের অ্যামপিউলের দামই পঁচিশ টাকা তিরিশ টাকা করে। এক-একটা সামান্য ভিটামিনের বড়ি, তাও এক টাকা পাঁচ সিকে করে। তারপর ডাক্তারবাবু যতবার এসেছে ততবার আটটাকা করে ভিজিট দিতে হয়েছে– খরচ কী কম হলো? যে কটা টাকা আমার জমেছিল সব ওঁর অসুখেই চলে গেল–
–তা সবসুদ্ধ কত খরচ হলো?
নয়নতারা বললে–তুই যেন কাউকে বলসিনি ভাই, উনি শুনলে ক্ষেপে যাবেন। উনি জানে শ’খানেক শ’দেড়েক, কিন্তু আমার নিজের কাছে ছিল তিনশো টাকা, সেটা সব খরচ হয়ে গেল। তারপর আর টাকা নেই। তখন কী করি! শেষকালে ভাই আমার গলার হারটা স্যাকরার দোকানে বাঁধা দিয়ে চারশো টাকা নিয়ে এসেছি
মালা চমকে উঠেছে। বললে–সে কী? ওমা, কী চমৎকার ডিজাইনের হারটা গড়িয়েছিলে তুমি, সেটা পরলে তোমায় খুব মানাতো, তুমি কিনা সেইটে বাঁধা দিলে?
–চুপ কর ভাই, অত চেঁচাসনি, শেষকালে আমার ঝি আবার শুনতে পাবে। কথাটা এখনও কেউ জানে না, কাউকে বলিনি। দেখিস ভাই, অফিসে যেন কারো কানে না যায়–
সদানন্দ ঘরের বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে। দরজা দিয়ে বাইরে উঠোনের একটা ফালি দেখা যায়। সেখানে কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না। বোধ হয় পাশের ঘরে ছাড়া কেউ কোথাও নেই। না, এখানে আর এক মুহূর্ত তার থাকা উচিত নয়। আস্তে আস্তে সদানন্দ উঠতে চেষ্টা করলে। মাথা যেন ঘুরতে লাগলো তার। অনেক কষ্টে তক্তপোশের ওপর উঠে বসতে গিয়েই ঘেমে নেয়ে গেল। তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সমস্ত শরীর ব্যথায় টনটন করে উঠলো।
কিন্তু সে-সব ভাবলে চলবে না। পরের সংসারে বিপর্যয় অধিকার নেই তার। সত্যিই নয়নতারা আজ তার কাছে পর। সদানন্দর নিজেরই লজ্জা করতে লাগলো। প্রথমে একটা হাত দিয়ে কোনও রকমে দেয়ালটা ধরলে সে। তারপর দেয়াল ধরে ধরে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। কেউ কোথাও নেই। চারদিকে বেলা পড়ে এসেছে। মনে হলো সন্ধ্যে হবো হবো। সামনের উঠোনটা ফাঁকা। আর একটু পরে অন্ধকার হয়ে গেলে কিছুই দেখা যাবে না। সদানন্দ বারান্দায় দেয়াল ধরে ধরে বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে উঠোনে নামবার চেষ্টা করলে। উঠোনের ডান দিকেই দরজা। দরজাটা খুলে বাইরে বেরোলেই রাস্তা! একবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারলে আর কোনও ভাবনা নেই। অনেকদিন নয়নতারাকে সে ভুগিয়েছে। অনেক কষ্ট তাকে দিয়েছে, অনেক টাকা তার খরচ হয়ে গেছে তার জন্যে। এবার তাকে মুক্তি দেবে সে। সত্যিই তো, সে যাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি তার কাছ থেকে সেবা নেবার অধিকারও তার নেই। জীবন যাকে প্রবঞ্চনা করেছে, জীবনের কাছে তার আকাঙ্খা করবার কি কিছু থাকে! অথচ সেই জীবনকে সুন্দর করবার আকাঙ্খা নিয়েই তো সে একদিন গৃহত্যাগ করেছিল। সেদিন তো সে ভেবেছিল নিজের সকলকে পরিত্যাগ করলেই বাইরের সবাই তার নিজের হবে। সবাইকে আপন করবার ইচ্ছেতেই সে তো পথে বেরিয়ে পড়েছিল। এই কি সেই তার সকলকে নিজের করবার নমুনা! সবাইকে তো সে কেবল কষ্টই দিয়েছে, সকলেরই কাছে সে তো কেবল বোঝা হয়েই রয়েছে। একদিন সকলের বোঝা হবার ভয়ে সমরজিৎবাবু বাড়ি থেকেও সে এমনি করে নিঃশব্দে সরে এসেছিল। তারপর সেই পাঁড়েজী। ধর্মশালার পাঁড়েজীর কাছে সে বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়। তা মুখে সে যা-ই বলুক না কেন! নিজের সংসার ছারখার করেছে বলে পরের সংসার ছারখার করবার অধিকার তাকে কে দিলে? না, এখান থেকে যদি সে কোনও রকমে কলকাতায় পৌঁছোতে পারে তাহলে পাঁড়েজীর কাছেও আর গিয়ে দাঁড়াবে না। পাঁড়েজীকে গিয়ে বলবে না যে আমাকে আশ্রয় দাও। পৃথিবীর কাউকে সে বলবে না–তুমি আমার আশ্রয়স্থল! আর যদি কোথাও থাকতেই হয় তো আশ্রয়ের প্রতিদানে কিছু কাজ করে দেবে সে।
কিন্তু কী কাজই বা করতে পারে সে! তার কাছ থেকে লোকে কী-ই বা চাইবে? টাকা? টাকা তার কোথায়? অথচ আজ যদি এই বাড়ি থেকে চলে যাবার সময় কিছু টাকা সে দিয়ে যেতে পারতো, যদি বালিশের তলায় নয়নতারার সোনার হার বাঁধা রাখার চারশো টাকাও রেখে যেতে পারতো, তাহলেও সে নয়নতারার সংসারের কিছু সাশ্রয় করেছে বলে গর্ব বোধ করতে পারতো। কিন্তু তা নয়, সমরজিৎবাবুর বাড়িতে যেমন, পাঁড়েজীর ধর্মশালায় যেমন, এখানেও ঠিক তেমনি সে গলগ্রহ। অথচ গলগ্রহই যদি সে হবে তাহলে নবাবগঞ্জ কী দোষ করেছিল! নবাবগঞ্জে তার পৈতৃক অর্থের ভারবাহী হয়ে জীবন কাটানোটা কেন তার কাছে অত অসহ্য মনে হয়েছিল!
মালা বললে–আজ তাহলে আসি নয়নদি, কলকাতায় ফিরতে আবার রাত হয়ে যাবে, তিনি আবার আমার দেরি দেখে ভাববেন, নার্ভাস মানুষ তো
–কিন্তু আর একদিন আসিস ভাই, অনেকদিন পরে দেখা হলো, বেশ ভালো লাগলো—
মালা এবার সত্যিই উঠে দাঁড়ালো। বললে–তুমি অফিসে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের অফিসের আড্ডাটি জমছে না নয়নদি–
নয়নতারা বললে–এইবার মনে হচ্ছে যেতে পারবো, এখন ও-ঘরে উনি একটু ভালোর দিকে যাচ্ছেন, আজ তো আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন–
মালা কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বাইরে দুম করে কী একটা শব্দ হলো। কিছু একটা ভারি জিনিস যেন কাছেই কোথাও পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নয়নতারা সচকিত হয়ে উঠলো। কী পড়লো! কোথায় পড়লো।
নয়নতারা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই দেখলে–সর্বনাশ!
সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো-গিরিবালা, ও গিরিবালা–কোথায় তুমি–
শব্দটা গিরিবালার কানেও গিয়েছিল। সে তখন রান্নাঘর পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। দিদিমণি ডাকবার আগেই সে শব্দ শুনে উঠোনে বেরিয়ে এসেছে।
–ওমা এ কী?
মালাও দেখলে সদর দরজার ভেতরের দিকে উঠোনের ওপর একজন পুরুষ মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এই মানুষটাই তো একটু আগে ঘরের মধ্যে শুয়ে ছিল। বাইরে কী করে এল?
কিন্তু নয়নতারার তখন আর জ্ঞান নেই। তাড়াতাড়ি মানুষটার মুখের কাছে মুখ নিচু করে দেখতে চাইলে সে বেঁচে আছে না অজ্ঞান হয়ে গেছে!
গিরিবালাকে বললে–গিরিবালা, শিগগির এক ঘটি জল নিয়ে এসো, এ কী সর্বনাশ হলো!
গিরিবালা ঘটি করে জল নিয়ে এসেছে তখনি। সদানন্দর মাথায় চোখমুখে জল দিতে দিতে নয়নতারা বললে–তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে বলো দিকিনি গিরিবালা, মানুষটা যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে, তুমি একবার দেখতেও পাওনি? এখন কী হবে? আর সদর দরজাটাই বা অমন হাট করে খোলা কেন?
গিরিবালা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। বললে–আমি তো দরজা খুলিনি দিদিমণি, এখন তো দেখছি খোলা রয়েছে–
নয়নতারা রেগে গেল। বললে–তুমি খুলবে না তো কে আবার দরজা খুলে রাখতে যাবে? আর রুগী মানুষ বিছানা থেকে উঠে এতখানি হেঁটে এসেছে, তুমি একবার দেখতেও পেলে না? অনেকদিন পরে মালা এসেছে, আমি তার সঙ্গে একটু ও-ঘরে গল্প করছি, আর এরই মধ্যেই এই কাণ্ড! আমি তো কোনও দিন ওঁকে একলা ছেড়ে উঠি না, আজ একটু ও-ঘরে গেছি, আর তুমি ওঁর পাশে একটু বসতে পারলে না? আমি যে কাজটা দেখবো না সেই কাজটাতেই কি গাফিলতি! আমি একলা ক’দিক দেখবো বলো তো? রান্নাঘরটা পরে ধুলে কী এমন ক্ষতি হতো শুনি?
গিরিবালা এর উত্তরে কী বলবে! মালাও যেন কেমন বিব্রত বোধ করতে লাগলো। সে এসেছিল একটু গল্প করতে। কিন্তু তার এই আসার ফলে যে সে নয়নদির সংসারে এত বড় একটা দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠবে তা সে কল্পণাও করতে পারেনি।
মালা বললে–কী হবে নয়নদি, আমার জন্যেই তো এই রকম হলো–
নয়নতারা বললে–তোর কী দোষ, গিরিবালাই তো যত কাণ্ড বাধালে! কেন, এখন রান্নাঘর না ধুলে চলতো না–
গিরিবালা বললে–সন্ধ্যে হয়ে গেল, তাই ভাবলুম–
–তুমি থামো, তোমাকে আর কথা বলতে হবে না–এখন তুমি ওদিকটা ধরো, আমি মাথার দিকটা ধরছি, ধরো, কোনও রকমে ঘরে নিয়ে চলো–
গিরিবালা নিচু হয়ে সদানন্দর নিচের দিকটা ধরলে। নয়নতারা সামনের দিকটা। সদানন্দর হাত দুটো দিয়ে নিজের গলাটা জড়িয়ে নিলে। তারপর গিরিবালাকে বললে–খুব সাবধান, সাবধানে তোল–
মালার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল। সেও হাত লাগালে। সদানন্দর শরীরের মাঝখানটা ধরে একটু সাহায্য করবার চেষ্টা করলে।
ঠিক সেই সময়ে তিনজনেই অবাক হয়ে দেখলে খোলা সদর দরজার সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে নিখিলেশ।
আর নিখিলেশ নিজেও অবাক। অফিস থেকে বাড়ি আসার আগে প্রতিদিন সে যা কল্পনা করে আজকে একটু আগে বাড়ি আসার সময় সেই দৃশ্য দেখবে বলেই সে কল্পনা করেছিল। ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে দেখবে রোগীর সামনে বসে নয়নতারা মাথায় আইসব্যাগ দিচ্ছে মাথা টিপে দিচ্ছে। কিম্বা থার্মোমিটারে রোগীর জ্বর পরীক্ষা করছে। নয়তো রোগীর সামনে চেয়ারে বসে বসে একদৃষ্টে তাকে পাহারা দিচ্ছে। এইরকম একটা-না-একটা রোজই তাকে দেখতে হয়।
কিন্তু এ অন্যরকম। নিখিলেশ দেখলে সদানন্দর দুটো হাত নয়নতারার গলায় জড়ানো, আর নয়নতারা তাকে জড়িয়ে ধরে পাঁজাকোলা করে তোলবার চেষ্টা করছে। আর তার সামনে গিরিবালা, আর তার মাঝখানে আর একজন। নয়নতারার অফিসের বন্ধু। তাকেও চিনতে পারলে নিখিলেশ। এই মেয়েটাই অনেকবার গান শুনিয়ে গেছে তাদের।
ঠিক এই ঘটনার মধ্যে বাড়িতে ঢুকে পড়ে একজন অল্প-পরিচিত মহিলার সামনে নিখিলেশ যেন বিব্রত বোধ করলে।
নয়নতারা নিখিলেশকে দেখতে পেয়েই বলে উঠলো–ও, তুমি এসে গেছ? ভালোই হয়েছে, একটু এদিকটা ধরো তো গো–
নিখিলেশের সমস্ত মন যেন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠলো। কিন্তু এই অবস্থায় কোন রাগ প্রকাশ করা শোভা পায় না। তার শিক্ষা-দীক্ষায়-ভদ্রতায় বাধে। অথচ মানুষের ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে! নিখিলেশ জামার হাত দুটো গুটিয়ে নয়নতারাকে সাহায্য করতে এগোচ্ছিল।
কিন্তু সদানন্দ ঠিক সেই সেই সময়েই তার চোখ দুটো খুললো। বললে–আমাকে ধরতে হবে না, আমি নিজেই উঠতে পারবো–
বলে অনেক কষ্টে সকলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলে। তারপর আস্তে আস্তে সেখানেই উঠে দাঁড়ালো।
নয়নতারা সদানন্দর আত্মনির্ভরতার চেষ্টার ওপর আর ভরসা করতে পারলে না। সে সঙ্গে সঙ্গে তাকে দুই হাতে ধরে ফেলেছে। পাছে সে পড়ে যায়। তারপর বললে–চলো, ঘরের দিকে চলো–
চারদিকে তখন বেশ সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ঝাপসা আলোয় সমস্ত কিছু অস্পষ্ট। নয়নতারা সদানন্দকে দুই হাত ধরে ধরে তাকে বারান্দায় ওঠালো। তারপরে ঘরের ভেতের নিয়ে গিয়ে তাকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিলে।
আর উঠোনে দাঁড়িয়ে মালা, নিখিলেশ, গিরিবালা সেই দৃশ্য দেখতে লাগলো।
.
তারপর পৃথিবীর আর সব বাড়ির মত এ বাড়িতেও রাত নেমে এলো। রাত নেমে এলো নৈহাটিতে। রাত নেমে এল নবাবগঞ্জে। রাত নেমে এল বউবাজারের সমরজিৎবাবুর বাড়িতে আর নেমে এল বড় বাজারের দাতব্য ধর্মশালায়। এ রাত পৃথিবীতে আগেও অনেকবার নেমে এসেছে, কিন্তু নৈহাটির এই বোসপাড়ার বাড়িতে বুঝি আগে কখনও এমন করে রাত নেমে আসেনি।
ক্লান্তিতে, দুর্বলতায়, অবসাদে সদানন্দ অনেকক্ষণ তার নিজের বিছানার ওপর আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ছিল। কিন্তু খানিক পরেই কাদের কথাবার্তার শব্দে তার আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। পাশে ঘর থেকেই কথাগুলো আসছিল। মনে হলো পাশের ঘরে স্বামী-স্ত্রীতে তখন তুমুল ঝগড়া বেধে গেছে।
নিখিলেশের গলারই তেজটা বেশি। সে বলছে–কেন, আমি কি তোমার জন্যে কিছুই করিনি? সেদিনের কথা মনে করে দেখ তো, যেদিন তুমি শ্বশুরবাড়ি থেকে কাঁদতে কাঁদতে কেষ্টনগরে এলে, মাথার সিঁদুর মুছে ফেলে বাবার কাছে এসে দাঁড়ালে, সেদিন কোথায় ছিল এই সদানন্দবাবু? সেদিন তো তার কোনও পাত্তা ছিল না। তোমার বুড়ো শ্বশুর যখন রাত্তিরে শোবার ঘরে ঢুকে তোমার সতীত্ব নষ্ট করতে চেয়েছিল তখনই বা কোথায় ছিল এই সদানন্দ? আমি সেদিন তোমাকে যদি না বাঁচাতুম তো কে তোমাকে বাঁচাত শুনি? আমি যে সারাদিন অফিসে গাধার খাটুনির পর রাত জেগে তোমাকে পড়িয়েছি তোমাকে হায়ার সেকেণ্ডারি পাস করিয়েছি, তারপরে কত লোককে খোশামোদ করে কত লোকের পায়ে তেল দিয়ে তোমাকে গভর্ণমেন্ট সারভিস করে দিয়েছি, সে-সব তুমি একেবারে ভুলে গেলে?
নয়নতারা গলা শোনা গেল এবার। সে বললে–ওগো, তুমি চুপ করো এবার, ও-ঘর থেকে ও যদি শুনতে পায় তো সর্বনাশ হবে–
নিখিলেশ এবার আরো গলা চড়িয়ে দিলে। বললে–হোক, সর্বনাশ হোক, আমি কাউকে ভয় করি নাকি? আমি তো জ্ঞানত কোনও অন্যায় করিনি যে কাউকে আমি ভয় করতে যাবো–
নয়নতারা বললে–কিন্তু তুমি মদ খাওনি? তুমি মদ খাওয়া ধরলে কেন আগে তাই বলো? কার ওপর রাগ করে তুমি ওই বিষটা খেতে গেলে?
–খেয়েছি বেশ করেছি। আমার ভালো-মন্দ দেখবার যখন কেউ নেই, তখন আমি মদ খাবো না তো কী করবো? আমি তো রোজ মদ খাই–
–সে কী? তুমি রোজ খাও?
–হ্যাঁ খাই, রোজ খাই, আজকেও খেয়েছি। কিন্তু কেন খাবো না বলতে পারো?
–কিন্তু ও-সব ছাইপাঁশ খেলে কি তুমি বাঁচবে? ওগুলো খাওয়া কি ভালো? ও খেলে তো শুনেছি শরীর খারাপ হয়, পক্ষাঘাত হয়, আরো কত কী হয়–
–তা আমার পক্ষাঘাত হলে কার কী? পক্ষাঘাত হলে আমার হবে, তাতে অন্য কারো তো কিছু ক্ষতি হবে না।
নয়নতারা বললে–ওকথা বলো না গো, ওকথা বললে আমার মনে বড় কষ্ট হয়, তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো। লোকের বাবা থাকে, মা থাকে, মাসি-খুড়ি-জেঠি ভাই-বোন কত কী থাকে, আমার কি সে-সব কেউ আছে? তুমি অমন রাগ করলে আমি কী নিয়ে থাকবো বলো, কার মুখের দিকে চেয়ে কোন্ ভরসায় আমি থাকবো বলো?
–কেন, তোমার তো সব আছে। তোমার তো কোনও ভাবনা নেই–
–সে কী, তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে?
–কেন, ও-ঘরে তোমার সদানন্দবাবু আছে—
নয়নতারা চমকে উঠলো। যেন কোনও অমঙ্গলের কথা তার কানে গেছে। বললে–ছিঃ, তুমি কি বলো তো, তোমার মুখে কি কোনও কথা আটকায় না!
–কেন আটকাবে? আমি তোমাকে যে দশভরি সোনার হার করিয়ে দিয়েছিলুম, সে হার তুমি সদানন্দবাবুর রোগ সারাবার জন্যে চারশো টাকায় বাঁধা রাখোনি?
ওদিক থেকে নয়নতারার আর কোন জবাব শোনা গেল না।
নিখিলেশ বললে–কী হলো, কথার জবার দিচ্ছ না যে? বলো, জবাব দাও–আমি কি সাধ করে মদ খাই? সদানন্দবাবুর জন্যে তোমার লুকিয়ে হার বাঁধা দেওয়াতে দোষ হলো না, আর আমার মদ খাওয়াতেই বুঝি যত দোষ হলো, না?
সদানন্দ বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান পেতে সব শুনছিল। ও-ঘর থেকে থেকে স্পষ্ট তার কানে আসছিল কথাগুলো। কিন্তু নিখিলেশের কথার জবাবে নয়নতারার কোনও গলার আওয়াজ আর পাওয়া গেল না–
কিন্তু সদানন্দ যে ঘরের ভেতরে শুয়ে শুয়ে কী করবে তা সে বুঝতে পারলে না। কথাগুলো যত তার কানে আসছিল ততই তার নিজের ওপরেই ধিক্কার জন্মাচ্ছিল। চারদিকে গভীর নিশুতি। শুধু মাঝে মাঝে দূরের রেল স্টেশনের ইয়ার্ড থেকে ট্রেনের হুইস-এর শব্দ আসছে। নৈহাটি। এত জায়গা থাকতে সে কিনা এই নৈহাটিতে এসে আশ্রয় পেলে! কলকাতা যাতায়াতের পথে কতবার সে এখান দিয়ে ট্রেনে করে গেছে। কিন্তু তখনও কি একবারও ভেবেছে যে, একদিন সেই নৈহাটিতেই তাকে নামতে হবে, কিংবা এই নৈহাটিতেই নয়নতারা তার সংসার পাতবে, এই নৈহাটিতেই সে অসুস্থ হয়ে পড়বে আর নয়নতারা এমন করে তাকে তার নিজের বাড়িতে তুলে এনে তার নিজেরই জীবনে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে।
বিছানার মাথায় দিকে একটা অল্প-পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। সদানন্দর মনে হলো সেখান থেকেই শুয়ে শুয়ে সে চিৎকার করে ওদের ডাকে। চিৎকার করে ওদের ডেকে বলে– ওগো, তোমাদের সংসারে এসে আমি অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছি, এবার আমাকে তোমরা তোমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও, আমাকে তোমরা তোমাদের বাড়ি থেকে চলে যেতে বলো, তাতে আমি বাঁচি আর না বাঁচি তোমরা অন্তত এই অশান্তি আর অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে বাঁচো–
সদানন্দ সেই বিছানার ওপর শুয়ে শুয়েই অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করতে লাগলো। এই কয়েক ঘণ্টা আগেই তো এবাড়ি থেকে সে চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল, কিন্তু কেন সে তখন ধরা পড়ে গেল! দরজার খিলটা খুলে সে তো নিঃশব্দেই চলে যেতে চেয়েছিল। এমনভাবে চলে যেতে চেয়েছিল যাতে কেউ টের না পায়। কিন্তু কেন সে চলে যেতে পারলে না? কেন ধরা পড়ে গেল সকলের চোখে? কেন অমন করে তার মাথাটা ঘুরে গেল?
পাশের ঘরে হঠাৎ আবার নিখিলেশবাবুর গলা শোনা গেল–না না না, কিছুতেই–
নয়নতারা বোধ হয় তখন কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে গলাটা বোধ হয় তার তখন ভারি হয়ে গেছে। ভারি গলাতেই সে বলে উঠলো–ওগো তোমার দুটি পায়ে পড়ি, এমন করে আর চেঁচিও না তুমি–
নিখিলেশ বললে–কেন চেঁচাবো না? আমার নিজের বাড়িতে আমি যা ইচ্ছে তাই করবো, আমি চেঁচাবো, গান গাইবো, হাসবো, কাঁদবো, তাতে কার কী বলবার আছে?
নয়নতারা বললে–তুমি এত রেগে যাচ্ছে কেন? আগে তো তোমার এত রাগ ছিল না–
নিখিলেশ বললে–তুমি আজকে আমার রাগটাই দেখলে, কিন্তু একবারও তো তুমি তোমার নিজের দোষটা দেখলে না–
–আমি তো বলছি দোষ করেছি, এবার হলো তো? এবার তোমার রাগ থামাও–
–তুমি দোষ স্বীকার করলেই বুঝি তোমার সাতখুন মাপ হয়ে গেল? তাহলে তো মানুষ খুন করে দোষ স্বীকার করলেই সবাই রেহাই পেয়ে যেত!
নয়নতারা বললে–ওগো, ও সব তর্ক এখন থাক। ওই নিয়ে আমি এই রাত তিনটের সময় তর্ক করতে চাই না তোমার সঙ্গে–
–তা কেন করবে? তাতে যে তোমার নিজের মুখেই কালি লাগবে! কিন্তু এখন কী হলো? এখন তো তোমার অফিসের বন্ধুরাও জেনে গেল। আমি না হয় মুখ বন্ধ করে রইলুম, কিন্তু তোমার বন্ধুদের মুখ চাপা দেবে কী করে? তারা তো জেনে গেল তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কোথায় নেমে এসেছে–আর তার জন্যে কে দায়ী?
নয়নতারা বললে–দেখ, ওদের কথা তুমি বোল না, ওদের মন তোমার মত অত নীচ নয়–
–তার মানে?
–হ্যাঁ, তার মানে আমি যা বলেছি ঠিকই বলেছি। তোমার নিজের মনটা যেমন তুমি অন্য লোককেও সেইরকম মনে করো। একটা অসহায় অসুস্থ মানুষকে বাড়িতে এনে সেবা করেছি বলে তুমি আমাকে এমন যা-তা কথা শোনাবে!
নিখিলেশ বললে–কেন শোনাবো না? তোমার অফিসের বন্ধুদের জিজ্ঞেস কোর তো তারা কেউ নিজের স্বামী থাকতে বাইরের একটা উটকো মানুষের জন্যে লুকিয়ে লুকিয়ে সোনার হার বাঁধা দেয় কিনা–
নয়নতারা এবার ক্ষেপে উঠলো যেন। বললে–তুমি ওকে উটকো লোক বললে? সব জেনেশুনেও তোমার মুখে ওই কথা বেরোল? একটু ভদ্র ভাষা বলতেও তুমি শেখোনি?
–তুমি আমাকে ভদ্রতা শিখাতে এসো না। তাহলে একদিন যে তোমার সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করেছিল তার কাছে গিয়েই শুলে পারো, আমার কাছে এলে কেন? আমি কি তোমায় ডেকেছিলুম?
–তাহলে বেশ, তাই যদি তুমি চাও তাই-ই যাচ্ছি—
–হ্যাঁ যাও, আর জীবনে তাহলে আমার ঘরে কখনও এসো না
নয়নতারা বলে উঠলো–তাহলে এও বলে রাখছি, আমিও আমার হার বাধা দিয়েছি বেশ করেছি–
নিখিলেশও বলে উঠলো–তাহলে আমিও বলছি, আমিও মদ খেয়েছি বেশ করেছি। এখন দেখছি সেদিন তোমায় বিপদ থেকে উদ্ধার করবার জন্যে তোমাকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল হয়েছিল–
–তাই যদি ভাবো তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও না। এখন তো সে-পথও খোলা আছে। তাতে তুমিও বাঁচো আমিও বাঁচি–
–তা তো এখন বলবেই, এখন তোমার চাকরি হয়ে গেছে কিনা, এখন আর আমার পরোয়া করবে কেন? তোমার পাকা চাকরি, মোটা মাইনে পাচ্ছো, পেনসন পাবে রিটায়ার করলে, এখন আর আমার কথা মনে থাকবে কেন? মেয়েমানুষ জাতটাই এইরকম নেমকহারাম–আগে জানলে…
–চুপ করো, স্কাউন্ড্রেল কোথাকার, তোমার মুখ দেখতেও আমার ঘেন্না হয়।
নিখিলেশ রাগের মাথায় আরো কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সামনে যেন ভূত দেখে দুজনেই চমকে উঠেছে। সদানন্দ তাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। একেবারে সশরীরে।
একটা মুহূর্ত শুধু নিজেকে সামলে নিতে নয়নতারার সময় লাগলো। কিন্তু তারপর একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেছে সে। বললে–এ কি, তুমি?
সদানন্দ দরজার দুটো চৌকাট ধরে কোনও রকমে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
বললে–হ্যাঁ আমি–
–কিন্তু তুমি তো ঘুমোচ্ছিলে! আমি তো তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এ-ঘরে এসেছি। তুমি আবার জাগলে কখন?
সদানন্দ বললে–আমি এতক্ষণ জেগেই ছিলুম। কিন্তু আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলুম না। আমি একটা কথা বলতে এসেছি শুধু–
নয়নতারা তখন পাগলের মতন অবস্থা। বললে–তা কথা বলার যদি দরকার ছিল তো আমাকে তুমি ডাকলেই পারতে। তুমি নিজে আসতে গেলে কী বলে? তোমার যে শরীর খারাপ! তুমি যদি অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে কী সব্বোনাশ হতো বলে দিকিনি। এখুনি চলো চলো তোমাকে শুইয়ে রেখে আসি–
বলে নয়নতারা সদানন্দর হাতটা ধরতে গেল।
সদানন্দ বললে–না, থাক–তার দরকার হবে না—
নয়নতারা সদানন্দর কথায় কান না দিয়ে সদানন্দকে ধরলে। কিন্তু সদানন্দ নয়নতারার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিখিলেশের দিকে চেয়ে বললে–নিখিলেশবাবু, আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি–
ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর তখনো হয়ত কাটেনি নিখিলেশের। এক মুহূর্ত কোনও জবাব দিতে পারলে না সে।
সদানন্দ আবার বললে–জানি আপনি আমায় ক্ষমা করবেন না, তবু আপনার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া কর্তব্য মনে করেই আমি ক্ষমা চাইছি–আমায় ক্ষমা করবেন তো?
নয়নতারা একবার সদানন্দর মুখের দিকে তাকাল, তারপর আর একবার নিখিলেশের মুখের দিকে। কিন্তু নিখিলেশ তখন অপরাধীর মতন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নয়নতারা সদানন্দর দিকে চেয়ে বললে–চলো, চলো যা বলবার আছে তুমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলবে চলো–
সদানন্দ সে কথায় কান না দিয়ে নিখিলেশের দিকে চেয়ে বললে–আপনি ক্ষমা না করলে আমি এখান থেকে চলে যেতে পারবো না নিখিলেশবাবু। বলুন আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন!
এতক্ষণে নিখিলেশের মুখ দিয়ে কথা বেরোতে পারলো। বললে–আপনি কী দোষ করেছেন যে আপনাকে ক্ষমা করতে যাবো?
–কী দোষ করেছি? তার চেয়ে জিজ্ঞেস করুন কী দোষ করিনি? নয়নতারা যে আজকে আপনার সঙ্গে এই খারাপ ব্যবহার করছে এ আমারই দোষ, নয়নতারা যে আপনাকে লুকিয়ে আমার চিকিৎসার জন্যে হার বাঁধা দিয়েছে সেও আমারই দোষ। এই আজ যে আমার জন্যে আপনাদের সংসারে এই অশান্তি হচ্ছে এও আমারই দোষ। আমি সব টের পেয়েছি নিখিলেশবাবু। কিন্তু কী করবো বলুন? সব দোষ ঘটে গেছে আমার অজ্ঞাতে। বিশ্বাস করুন, আমি সকলের ভালো করতেই চেয়েছিলুম। আমি যে একদিন নয়নতারাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলুম তাও নয়নতারার ভালোর জন্যেই, বিশ্বাস করুন, সে সব-কিছুই নয়নতারারই ভালোর জন্যে–
নিখিলেশ গম্ভীর গলায় বললে–অত ভালো করার চেষ্টা সেদিন না করলেই হয়তো ভালো করতেন সদানন্দবাবু, তা হলে আর আমাদের কপালে এই দুর্দশা হতো না–
–দুর্দশা!
নিখিলেশ বললে–হ্যাঁ, দুর্দশা না তো কী? নয়নতারার শ্বশুর যেদিন ওর সতীত্ব নাশ করতে ওর শোবার ঘরে ঢুকেছিল, তখন কোথায় ছিল আপনার এই ভালো করবার চেষ্টা? যেদিন কেষ্টনগরে নয়নতারার বাবা মেয়ের এই অবস্থা দেখে স্ট্রোক হয়ে হঠাৎ মারা গেলেন, তখনই বা কোথায় ছিল আপনার এই ভালো করবার চেষ্টা?
নয়নতারা নিখিলেশের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললে–ওগো তুমি কীসব যা-তা বলছো? দেখছো রুগী মানুষ, সবে অসুখ থেকে উঠেছে এখনও ভালো করে সারেনি–
নিখিলেশ নয়নতারাকে ধমক দিয়ে উঠলো! বললে–তুমি থামো, একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন লোক, যে নিজের স্ত্রীকে অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না, যে নিজের স্ত্রীকে ওই রকম বদমায়েশ শ্বশুর-শাশুড়ীর হাতে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় তার হয়ে তুমি ওকালতি করতে এসো না।
সদানন্দ বললে–না নিখিলেশবাবু, আপনি ভুল করছেন, আমি নয়নতারাকে কারো হাতে ফেলে রেখে পালাইনি, বরং চরম অপমানের হাত থেকেই নয়নতারাকে বাঁচিয়েছি–
–এই বুঝি আপনার নয়নতারাকে বাঁচাবার নমুনা?
–বাঁচানো আপনি কাকে বলেন? যারা বাইরে মানুষের চেহারা নিয়ে ঘোরাফেরা করে, আর ভেতরে পশুর মতন প্রকৃতি তাদের স্বরূপ চিনতে সুযোগ দেওয়া কি বাঁচানো নয়?
নিখিলেশ বললে–নিজের বাবা-মা’র সম্বন্ধে যদি এই-আপনার ধারণা তা হলে নয়নতারার মত মেয়েকে বউ করে কেন নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন?
সদানন্দ বললে–আপনি সব কথা জানেন না, তাই অমন কথা বলছেন। আমি তাদের চিনতে পেরেছিলাম বলেই বিয়ের দিন আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলুম, হিন্দু বাঙালীদের বিয়েতে যে-নিয়ম মানা হয় আমার বিয়েতে তাও মানা হয়নি, নয়নতারার হয়ত মনে আছে নিয়মমত আমার গায়ে-হলুদও হয়নি।
নয়নতারা নিখিলেশের সামনে গিয়ে আবার মিনতি করতে লাগলো। বললে–ওগো, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে কেন তুমি আর পুরোন কাসুন্দি ঘাঁটছো?
তারপর সদানন্দর সামনে গিয়েও বলতে লাগলো–তুমি সবে একটু সেরে উঠেছ, এখন মাথা গরম কোর না, ওঁর কথা শুনো না তুমি। তুমি তোমার ঘরে চলো–
সদানন্দ বললে–কিন্তু আর যদি কখনও তোমার সঙ্গে দেখা না হয় তাহলে আমার কথাগুলো কবে বলবো? কবে আর এমন সুযোগ পাবো? কবে আমি আবার নিখিলেশবাবুর কাছে ক্ষমা চাইবো?
নিখিলেশ বলে উঠলো–আপনি নয়নতারার যা করেছেন তা তো করছেই, কিন্তু আমার যা ক্ষতি করেছেন, তার জন্যে আপনার ক্ষমা চাইবার অধিকার নেই–
নয়নতারা নিখিলেশকে ধমক দিলে। বললে–তুমি আবার ওই রকম করে কথা বলছো? রুগী মানুষের সঙ্গে কী রকম করে কথা বলতে হয় তাও তুমি জানো না? কাল সকালবেলাও তো ওকথাগুলো বলতে পারতে?
সদানন্দ বললে–না, কাল সকাল পর্যন্ত আমি আর থাকতে পারবো না, যা বলবার যা শোনবার তা আজকের মধ্যেই বলতে আর শুনতে হবে–
নিখিলেশ বললে–কাল সকাল পর্যন্ত আপনাকে আমি আর থাকতে দেবও না, আপনি এ বাড়ি ছেড়ে আজকে এখনি চলে যান–
–কি বলছ তুমি?
নয়নতারা নিখিলেশের একেবারে মুখের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ালো। আবার বললে– তুমি যা-তা বলছো কেন? এই শরীরে উনি কোথায় যাবেন?
নিখিলেশ বলে উঠলো–সে যেখানে ওঁর খুশী সেখানে চলে যান, আমাদের বাড়িতে ওঁকে আর থাকতে হবে না, এখানে আমি আর থাকতে দেব না ওঁকে–
নয়নতারা বেঁকে দাঁড়ালো। বললে–না, উনি এখানে থাকবেন।
নিখিলেশ নয়নতারার কথায় প্রথমে একটু হতবাক হয়ে গেল। এমনভাবে নয়নতারা তার কথার প্রতিবাদ করবে তা সে ভাবতে পারেনি। কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্যে তারপরেই সে বলে উঠলো–না, তুমি থাকতে বললেও আমি ওঁকে থাকতে দেব না।
নয়নতারা বললে–তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি? তুমি নিজেই বুঝতে পারছে না তুমি কি বলছ। এত রাত্তিরে কেউ বাড়ির বাইরে যায়? আর উনি যাবেনই বা কোথায়?
নিখিলেশ বললে–কোথায় যাবেন তা আমার জানবার দরকার কী?
নয়নতারাও এবার একটু কঠোর হয়ে উঠলো। বললে–না, উনি যাবেন না–
–হ্যাঁ যাবেন।
নয়নতারা বললে–না, আমি বলছি উনি যাবেন না। উনি যেতে চাইলেও এই অবস্থায় আমি ওঁকে চলে যেতে দেব না।
সদানন্দ এবার এতক্ষণে কথা বললেন, আমি এখানে আর থাকতে চাই না, নিখিলেশবাবু আমাকে জোর করে ধরে রাখলেও না। আর আমি সজ্ঞান অবস্থায় থাকলে এখানে আসতুমও না। কিন্তু যাবার আগে আপনার কথার জবাব না দিয়ে যাবো না, নইলে এখান থেকে চলে গিয়েও আমার মনে শান্তি থাকবে না। আপনি একটু আগে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি কেন নয়নতারাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করিনি, আপনি তো তা-ই জিজ্ঞেস করছিলেন?
নয়নতারা সদানন্দর সামনে এসে বললে–না, তোমাকে সে-সব কথা বলতে হবে না। আমি সব জানি–
সদানন্দ বললে–তুমি জানো কি না তা আমি জানি না। পৃথিবীর কোন মানুষই তা জানুক তাও আমি চাই না, আমি নিজেও কাউকে তা জানাতে চাই না।
নিখিলেশ বললে–সেইটেই তো স্বাভাবিক, নিজের পাপ কি কেউই নিজের মুখে প্রকাশ করে? সবাই তো তা চেপেই রাখতে চায়–
সদানন্দ কথা বলছিল আর ক্লান্তিতে হাঁফাচ্ছিল। বললে–আপনি ঠিকই বলছেন, কিন্তু এ-ক্ষেত্রে আলাদা, নয়নতারার সঙ্গে আমার সম্পর্কের ব্যাপারটা ঠিক সে-ধরনের পাপ নয়। পাপটা আমার পূর্বপুরুষের।
নিখিলেশ বুঝতে পারলে না কথাটা। জিজ্ঞেস করলে–তা পূর্বপুরুষের পাপ সম্বন্ধে আপনি যদি এতই সচেতন তাহলে সেই পাপী পূর্বপুরুষকেই তো আপনি ত্যাগ করতে পারতেন–আপনি পূর্বপুরুষের পাপের জন্যে যখন বাড়ি ত্যাগ করলেন তখন একলা না গিয়ে আপনার স্ত্রীকেও তো সঙ্গে নিতে পারতেন–ওই রকম শ্বশুর-শাশুড়ীর হেফাজতে নয়নতারাকে ফেলে রেখে নিজে কেন আপনি নিরুদ্দেশ হয়ে চলে গেলেন?
নয়নতারা লক্ষ্য করলে ক্লান্তিতে দুর্বলতায় সদানন্দর দম আটকে আসছে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে।
নিখিলেশের দিকে চেয়ে বলে উঠলো–তুমি কী বলো তো? এখন এই রাত্তির বেলা এই সব কথা না বললে কি তোমার চলতো না? দেখছো মানুষটার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে–
সদানন্দ নয়নতারার কথায় কান না দিয়ে নিখিলেশের দিকে চেয়ে বললে–কেন চলে গেলুম জানেন? শুনতে চান?
নয়নতারা সদানন্দকে লক্ষ্য করে বললে–সে সব কথা ওকে বলতে হবে না–আবার তোমার জ্বর বাড়বে, আবার তুমি অসুখে পড়বে, সকালবেলা ডাক্তারবাবু এলে তখন আমাকেই বকাবকি শুরু করবেন, চলো তুমি তোমার ঘরে শোবে চলো–আমি তোমাকে শুইয়ে রেখে আসি–
নিখিলেশ বললে–কেন তুমি ওকে বলতে বাধা দিচ্ছ? যা বলতে চান উনি তা বলতে দাও না–
নয়নতারা বললে–উনি যা বলবেন তা আমি ভালো করেই জানি, আর বলতে হবে না–
নিখিলেশ বললে–কিন্তু তুমি জানলে কী হবে? আমি তো শুনি নি, আমাকে শুনতে দাও না–
নয়নতারা বলে উঠলো–না, তোমাকে শুনতে হবে না। তোমার সে-সব শুনে কী লাভ? আর তুমি শুনলেও তো তা বুঝতে পারবে না। তুমি যদি বুঝতে পারতে তাহলে আমার সঙ্গে আর এই রকম ব্যবহার করতে না–
–কেন, আমি তোমার সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করেছি?
–তুমি আবার বলছো কী রকম ব্যবহার করেছ? বলতে তোমার লজ্জা করছে না?
নিখিলেশ বললে–কী রকম ব্যবহার করেছি বলো?
–বলবো সকলের সামনে?
–নিশ্চয়ই বলবে। আমি এমন কিছু করি না যার জন্যে আমাকে লজ্জা পেতে হবে।
–তা হলে কেন তুমি মদ খাও, বলো?
–মদ?
নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, মদ। তুমি নিজে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রোজ বাড়ি ফের আর অন্য লোককে দোষ দিচ্ছ বউকে ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে। তোমার লজ্জা করে না কথা বলতে! মদ খেয়ে বাড়ীতে আসাটা বুঝি দোষের নয়? আর বউকে বাড়িতে ফেলে চলে যাওয়াটাই বুঝি দোষের?
নিখিলেশ ধমকে উঠলো। বললে–তুমি থামো!
নয়নতারা গর্জে উঠলো। বললে–কেন থামবো? যখন কথাটা উঠেছে তখন ভালো করেই কথাটা উঠুক। কথাটা চিরকালের মত পরিষ্কার হয়ে যাক। আমি কত কষ্ট করে টাকা জমাতুম ভবিষ্যতের জন্যে, আর তুমি সেই টাকা কিনা মদ খেয়ে নষ্ট করে দেবে?
নিখিলেশ এবার উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বললো–বাজে কথা বোল না, তুমি ভালো করেই জানো কেন আমি মদ খাওয়া ধরেছি–তুমি যদি নিজের হার বাঁধা না দিতে তো আমি কি কোনও দিন মদ খেতুম? এর আগে কি কোনও দিন মদ খেয়েছি? আগে তো প্রত্যেক দিন অফিস থেকে তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফিরেছি–তখন তুমি কোনও দিন আমাকে মদ খেতে দেখেছিলে?
নয়নতারা বললে–তা আমার হার কি আমি নিজের জন্যে বাঁধা রেখেছি? বাড়িতে কারো অসুখ হলে মানুষ কী করে? টাকা ধার করে না?
–কিন্তু আমাকে তুমি সে কথা কিছু জানিয়েছিলে? আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?
নয়নতারা বললে–কেন তোমাকে জানাতে যাবো? তোমাকে জানালে কি তুমি রাজি হতে? টাকা খরচ হবে বলে তুমিই তো এঁকে হাসপাতালে পাঠাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করেছিলে। কেন, এঁর জন্যে টাকা খরচ হলে তোমার এত রাগ হয় কেন? ইনি কি এখানে থাকতে এসেছেন মনে করো?
নিখিলেশ রেগে গেল এবার। বললে–আবার বাজে কথা বলছো তুমি? আমি কখনও কি বলেছি যে সদানন্দবাবু এখানে থাকতে এসেছেন?
নয়নতারা বললে–কিন্তু তুমি তো তাই-ই মনে করেছিলে।
নিখিলেশ বললে–তোমার নিজের মনের মধ্যেই এই পাপ রয়েছে তাই তুমি অমন কথা বলতে পারলে!
–পাপ? আমার মনের মধ্যে পাপ আছে না তোমার মনের মধ্যে পাপ! যেদিন থেকে ওঁকে এ বাড়িতে এনে তুলেছি সেই দিন থেকেই তো তুমি ওঁকে সহ্য করতে পারছ না–আমি কিছু বুঝতে পারি না মনে করছো?
–আমি কী সে কথা কোনও দিন তোমাকে বলেছি?
নয়নতারা বললে–মুখে বলবে কেন? মুখে কী কেউ তা বলে? কাজ দিয়ে তা প্রমাণ করেছ!
–কাজ? আমার কাজে কোথায় প্রমাণ পেলে যে আমি ওঁকে সহ্য করতে পারছি?
নয়নতারা এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বললে–তাহলে ওঁকে খাওয়াবার জন্যে ওষুধের নাম করে বিষ কিনে এনেছিলে কেন?
বিষ?
–হ্যাঁ, বিষ!
নিখিলেশের মুখ দিয়ে খানিকক্ষণের জন্যে কোনও কথা বেরোল না। তারপর ঢোঁক গিলে বললে–কে বললে?
–প্রমাণ চাও?
কিন্তু নিখিলেশ সে-সম্বন্ধে প্রমাণ চায় কী চায় না সে কথা শোনবার আগেই নয়নতারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর এক মুহূর্তের মধ্যে পাশের ঘর থেকে একটা কী নিয়ে আবার ফিরে এল। ওষুধের শিশি নিখিলেশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে–এটা তুমি কিনে আনোনি?
নিখিলেশ তখন বিমূঢ় হতবাক!
–কী, কথা বলছো না যে? আমার কথার জবাব দাও? এটা তুমি কী জন্যে কিনে নিয়ে এসেছিলে, বলো?
নিখিলেশ তখনও চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। তার মুখ দিয়ে তখন একটা কথাও বেরোচ্ছে না।
–কী হলো? তুমিই তো এতক্ষণ প্রমাণ চাইছিলে, আমি এখন প্রমাণ দেখিয়ে দিলুম। এবার জবাব দাও–
একটু থেমে নয়নতারা আবার বলতে লাগলো–তা ভাগ্যিস এটা আমি এঁকে খাওয়াই নি, খাওয়ালে কী সর্বনাশ হতো বলো তো? এটা আমি এতদিন ফেলে দিই নি, রেখে দিয়েছিলুম একদিন আমার নিজের কাজে লাগবে বলে। কী সর্বনেশে লোক বলো তো তুমি? যদি না দেখেশুনে এটা আমি এঁকে খাইয়ে দিতুম? ভাগ্যিস আমি ডাক্তারবাবুকে এটা দেখালুম! ডাক্তারবাবুই তো দেখে বললে–এটা বিষ! বললে–এটা কোত্থেকে এল? কে আনলে? আমি ডাক্তারবাবুর কথার কোনও জবার দিতে পারলুম মা, মনে মনে তোমার মতি-গতি দেখে আমি শুধু শিউরে উঠলুম, ভাবলুম মানুষ এত নীচও হতে পারে। একটা কুকুর বেড়ালকে বিষ খাইয়ে মারতেও মানুষ দু’বার ভাবে। আর তুমি এত নীচ যে একটা নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে মারতে তোমার এতটুকু সঙ্কোচও হলো না–বিষের শিশিটা কিনতে গিয়ে তোমার হাত একবার কাঁপলোও না, তুমি কিনা এসে আমাকে এক কাপ জলের সঙ্গে এই ওষুধটা এঁকে খাইয়ে দিতে বললে?
সমস্ত আবহাওয়াটা তখন থমথম করছে। এতক্ষণে যে কোথা দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে। তা কেউই টের পায় নি। সদানন্দ নয়নতারার কাছে গিয়ে ওষুধের শিশিটা নিতে গেল। বললে–ওটা আমাকে দাও–
নয়নতারা হাতটা সরিয়ে নিলে। বললে–না, তুমি ওটা নিয়ে কী করবে?
সদানন্দ বললে–আমার দরকার আছে–
নয়নতারা বললে–না, দরকার আমারই আছে। আমি এটা রেখে দেব। আমার কাছেই থাক। যখন সব মানুষকে চিনে গেলুম তখন হয়ত আমারই একদিন এটা দরকার হতে পারে, সেদিনের জন্যে আমি এটা যত্ন করে রেখে দেব–
–দিদিমণি–
হঠাৎ গিরিবালার গলার আওয়াজে সবাই চমকে উঠেছে। নয়নতারা ঘরের দরজার দিকে চেয়ে দেখলে গিরিবালা দাঁড়িয়ে।
–কী গো, কিছু বলবে?
–ডাক্তারবাবু এসেছেন—
ডাক্তারবাবুর নাম শুনে নয়নতারা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে উঠলো। অবাকও কম হলো না। এত রাত্রে ডাক্তারবাবু কেন? ডাক্তারবাবুকে তো এ সময়ে আসতে খবর দেওয়া হয় নি! তিনি হঠাৎ কেন আসতে গেলেন? তার তো সকাল বেলা আসার কথা, যেমন রোজ একবার করে আসেন।
কিন্তু ভালো করে বাইরের দিকে চেয়ে দেখতেই নয়নতারার ভুল ভাঙলো। এ কী, সকাল হয়ে গেছে যে! তাড়াতাড়ি বাইরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলে, ডাক্তারবাবু হাত ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
নয়নতারাকে দেখেই ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলে–কী হলো, আমার পেসেন্ট আজকে কেমন আছে?
.
বউবাজারে সমরজিৎবাবুর বাড়িতে তখন আর এক নাটকের অভিনয় হয়ে চলেছে। বাইরে থেকে সমস্ত বাড়িটা তো বেশ শান্ত। কোথাও কিছু ব্যতিক্রম নেই। দিনের বেলায় কলকাতা শহরের চলমান সভ্যতার পালিশ গায়ে মেখে বেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এককালে বড়লোকের সম্পত্তি বলে সুনাম ছিল বাড়িটার। সে-সুনাম বুঝি তখন আরো বেড়েছে। কারণ আগেকার মালিক ছিলেন গৃহস্থ মানুষ, কারো সাতে-পাঁচে তিনি থাকতেন না। কলকাতা শহরের রাজনীতি সমাজনীতির স্রোতে গা-ও ভাসাতেন না। দেশ স্বাধীন হবার পর কে কত সুবিধে করে নিচ্ছে, কার কতখানি অসুবিধে হচ্ছে তা নিয়েও তিনি কখনও মাথা ঘামাতেন না। তাঁর মত ছিল, সকলেই সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকুক, কারুর যেন কোনও অভিযোগ না থাকে, কেউ যেন কাউকে শোষণ না করে। আর যাদের টাকা আছে তারা যেন তাদের বাড়তি টাকা কিছু দাতব্য করে। যাদের আছে আর যাদের নেই তাদের লড়ালড়িতে যেন দেশে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়। এক কথায়, তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আওতায় মানুষ হওয়া একজন নিরীহ শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোক।
শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোকেরাই বোধ হয় এ যুগে সব চেয়ে কৃপার পাত্র। সত্যি বলতে কি, তাদের একূলও নেই ওকূলও নেই। তাদের সততাই তাদের সব চেয়ে বড় শত্রু। তাদের সততাকে লোকে নির্বুদ্ধিতা বলে ধরে নেয়। যেহেতু তারা শান্তি প্রিয় তাই তারা কোনও বাদ-প্রতিবাদে যেতে চায় না।
জীবনে সমরজিৎবাবু একবারই দৃঢ় হয়েছিলেন। আর সেইবারেই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল। শান্তিপ্রিয় হওয়ার খেসারৎ তিনি ভালো করেই দিয়ে গেলেন। তাতে নিজের জীবনই যে শুধু তিনি বলি দিলেন তাই নয়, নিজের সহধর্মিণীর জীবনও চিরকালের মত বরবাদ করে দিয়ে গেলেন।
এ-বাড়ীর গিন্নী ছিলেন তিনিই। কিন্তু সমরজিৎবাবুর মৃত্যুর পর থেকে তাঁর আর কোনও কর্তব্য রইল না। এ বাড়ির গিন্নী হয়ে বসলো–মানদা মাসি।
প্রথম প্রথম সমরজিৎবাবুর স্ত্রী কিছু বলতে চাইতেন, কিন্তু মানদা মাসি থামিয়ে দিত। বলতো–তুমি চুপ করো না দিদি, তুমি বুড়ো মানুষ, পূজো-আচ্ছা নিয়ে থাকলেই পারো। তোমাকে সব ব্যাপারে মাথা ঘামাতে কে বলেছে?
সমরজিৎবাবু মারা যাবার পর থেকেই যেন এ বাড়ির সব হালচাল একেবারে রাতারাতি বদলে গেল।
বাড়ির গিন্নী সব দেখেশুনে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেলেন। এককালে কত সুখ ছিল কত প্রতিপত্তি ছিল। সেসব স্মৃতি যেন তখনও চোখের ওপরেই ভাসতো।
একমাত্র মহেশই বলতে গেলে গিন্নীমার খোঁজখবর নিত তবু। দোতলায় একেবারে কোণের ঘরটায় তাকে ঠেলে দিয়েছে নতুন বউমা।
মহেশ এলে চুপি চুপি ডাকে—মা—
গিন্নীমা বলেন–কে?
–আমি মহেশ মা। আপনার খাওয়া হয়েছে?
গিন্নিমা জিজ্ঞেস করেন–বাড়িতে কারো শব্দ পাচ্ছিনে কেন রে? নতুন বউমা কোথায়? মহেশ বলে বড়বাবু নতুন বউদিকে নিয়ে বায়োস্কোপ দেখতে গেছে–
–ও—
এর বেশি আর কিছু বলেন না তিনি। এর বেশি বলবার প্রবৃত্তিও কখনও হয় না তার। আগে হলে অন্তত একবার রান্নাঘরের দিকে যেতেন। কর্তা কী খাবেন না-খাবেন তার তদারকও করতেন একটু। ঘর থেকে দশবার বেরোতেন, তারপরে কর্তা গঙ্গাস্নান সেরে আসবার পর থেকে কাছে কাছে থাকতেন।
কিন্তু আসল মানুষ চলে গেলে বোধ হয় বাড়ির চেহারাটাই এমনি বদলে যায়। এ বাড়ির চেহারাটাই তাই বোধ হয় আমূল বদলে গেছে।
–বউমা কী করছে?
–বউদির ঘরের দরজা বন্ধ। সকাল থেকেই খুলছে না।
–খায় নি?
মহেশ বললে–না।
গিন্নীমা বললে–একবার দরজা ঠেললিনে কেন?
মহেশ বলে–ওরে বাবা, তা হলেই হয়েছে। বউদির চেহারা দেখলেই আমার ভয় পায়, আমি ও-চেহারা আর দেখতে পারিনে–
গিন্নীমা বলেন–তা তুই-ই বা এ বাড়িতে আর আছিস কেন? তোর বুঝি এত হেনস্থা ভাল লাগে?
–আমি?
মহেশ বলে–আমি চলে গেলে তখন শ্মশান জাগবে কে? শ্মশান জাগতেই তো বসে আছি! আপনি মরবেন, বৌদি মরবেন, তখন ফেলবে কে? তখন তো মড়া ফেলতে এই মহেশেরই ডাক পড়বে?
এ-সব পুরোনো কথা। এ-সব কথা শুনলে গিন্নিমার দুঃখও হয় না, ভাবান্তরও হয়না। আগে হতো। আগে চোখের জল মুছতেন আঁচলে। মনে মনে নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দিতেন। এই অগাধ সম্পত্তি, এই ঐশ্বর্য আর এই প্রাচুর্যের ধ্বংস কামনা করতেন। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকতে পারতেন না। নিচে থেকে মানদা মাসির গলার শব্দে তার সমস্ত দুশ্চিন্তার জাল ছিঁড়ে ছিঁড়ে একাকার হয়ে যেত।
কিন্তু এবাড়িতে আসার পর থেকে সেই মানদা মাসিরই সুখ হয়েছে সব চেয়ে বেশি। মানদা মাসি ছোটবেলা থেকেই বড় কষ্টে মানুষ হয়েছে। কোথায় ছিল তার মা আর কোথায়ই বা ছিল তার বাবা, তার কোনও দিন হদিস মেলে নি। লোকের আত্মীয়স্বজন থাকে, তারাই সাধারণত ছোটবেলায় সকলকে মানুষ করে। তারপর একটু খুঁটে খেতে শিখলেই তারা সরে দাঁড়ায়। তখন সবাই স্রোতের শ্যাওলার মত রাস্তায়-ঘাটে ভেসে ভেসে বেড়ায়। কলকাতার সমস্ত মানদা মাসিদের অতীত জীবনের ইতিহাস এই রকমই। তখন মানদা মাসি কালীঘাটের মন্দিরের সামনে ভিক্ষে করে বেড়াতো। একটা ছেঁড়া ময়লা ফ্রক পরে যাত্রীদের পেছন-পেছন আঠার মতন লেগে থাকতো। গলায় কান্নার সুর মিশিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতো। মন্দিরের সদর দরজা থেকে শুরু করে একবারে ট্রাম রাস্তার মোড় পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে যেতো, আর গ্রামোফোনের ফাটা রেকর্ডের মত একটা কথাই বার বার আবৃত্তি করতো–একটা পয়সা দাও বাবা, একটা পয়সা দাও বাবা–একটা পয়সা…
তখন বলতে গেলে ওইটেই সারাদিনের বুলি হয়ে গিয়েছিল মানদা মাসির। ঘুমোতে ঘুমোতে যদি কোনও দিন মাঝরাত্তিরে তার ঘুম ভেঙ্গে যেত তাহলেও ওই কথাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে আসতো–একটা পয়সা দাও বাবা–একটা পয়সা দাও বাবা…
তারপর একদিন ফ্রক ছেড়ে গায়ে শাড়ি উঠলো। আর তারপরে যা হয় তাই হলো। তখন আর ঘুরে ঘুরে পয়সা চাইতে হতো না। তখন বরং খাতির বেড়ে গেল মানদার। কালীঘাটের ধর্মশালা আর পাণ্ডাদের যাত্রীনিবাসে পূণ্যার্থীরা ডেকে ডেকে আদর করে মানদাকে পয়সা দিতে লাগলো। একখানা শাড়ি থেকে দুখানা শাড়ি হলো তার তখন।
তখন আর রাস্তায় ঘুরতে হলো মা মানদাকে। মন্দিরের পাণ্ডাদের বস্তিতে খোলার ঘর ভাড়া নেওয়ার প্রয়োজন যাকে বলে একেবারে অনিবার্য হয়ে উঠলো। তখন মানদার দিনেও খদ্দের, রাত্তিরেও খদ্দের। এমন কি, এক একদিন সকাল দশটার সময়ও তার দরজায় খদ্দেরের ভিড় লেগে যেত।
সে এক স্বর্ণযুগ গেছে মানদা মাসির জীবনে!
কিন্তু সে আর কতদিন! বলতে গেলে ক’টা তো বছর মাত্র। কিন্তু সেই কটা বছরের মধ্যেই একবোরে আস্ত একটা বাড়ির মালিক হয়ে বসলো মানদা মাসি। একেবারে বাড়িউলি!
সেই অবস্থাই চলছিল এতদিন। সুখে-দুঃখে অনেক বছর কেটে গিয়েছিল। কখনও টাকা কিছু জমতো, আবার হয়ত একদিন সব টাকা ফতুরও হয়ে যেত। যেত বেশির ভাগ ঘুষ দিতে গিয়ে। এ ব্যবসায় ওই একটা দোষ। টাকা এলেও তাকে বেশি দিন ধরে রাখা যায় না। চোলাই মদের কারবার সঙ্গে থাকে বলে যথাস্থানে ঘুষ দিতে হয়। সেই ঘুষের চাপ মাঝে মাঝে এত তীব্র হয়ে ওঠে যে তখন ইচ্ছে করে কারবার গুটিয়ে নিই।
তা ভাগ্য ভালো ছিল মানদা মাসির। ঠিক সেই সময়েই এল বাতাসী, আর এল বড়বাবু।
তখন থেকেই মানদার প্রধান কাজ হলো বাতাসীকে খুশী করা। কী করে বাবুকে খুশী করে তাকে বশ করতে হয় মানদা মাসি সে-সব বিদ্যে শিখিয়ে দিত বাতাসীকে।
বাতাসীর একটা গুণ ছিল যে মাসির কথাগুলো মন দিয়ে শুনতো।
মানদা মাসি বলতো–একটা কথা বলে রাখি বাছা–মন দিয়ে শোন, মন-পেরান দিয়ে বাবুর খাতির করবি বুঝলি, বাবু যদি মদ খেয়ে বমি করে দেয় তা তাতেও ঘেন্না করিস নি যেন। হাত পেতে সেই বমি তুলে নিবি, তবু মুখে রাগ দেখাতে পারবি না। সেই কথায় আছে না–মাটির বেড়ালই হোক, আর কাঠের বেড়ালই হোক ইঁদুর ধরতে পারলেই হলো–
আরো কত কথা শেখাতো বাতাসীকে। বলতো–পোড়া পেটের জন্যেই তো ভাত রে বাতাসী, নইলে ভাতের বয়ে গেছে পেট খুঁজতে
বাতাসী বলতো–কিন্তু মাতাল হলে যে বড়বাবুর আর জ্ঞান থাকে না মাসি–
মানদা মাসি বলতো–তা না থাকুক, ভাতারে কি ভাত দেয় মা! ভাত দেয় গতরে গতর যতদিন আছে তদ্দিন কামিয়ে নাও–তোমার গতর যখন থাকবে না তখন কেউ তোমায় দেখবে না—
তা বাতাসীর ভাগ্য ভালো ছিল বলতে হবে। তবে গতরের জোর কি ভাগ্যের জোর কে জানে, বড়বাবুর বাবু মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাতাসী একেবারে বউ হয়ে গিয়ে বড়বাবুর বাড়িতে গিয়ে উঠলো। বাতাসী বললে–মাসি, তুমিও আমার সঙ্গে চলো–
মাসির কারবারেও তখন বেশ মন্দা চলেছে। সেই যে কলকাতায় বোমা পড়লো, তারপর শহর থেকে লোকজন পালাতে আরম্ভ করলো, তখন থেকেই মন্দা হয়েছিল। তারপর যেদিন হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা হলো তখন আর তার কারবার চলে না। এক-একদিন মেয়েদের হাঁড়ি চড়ে না পর্যন্ত। খদ্দের দূরের কথা, দরজা সামনে দিয়ে একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত রাস্তা মাড়ায় না। অতদিনের বনেদী পাড়া, এককালে কত জাঁকজমক ছিল পাড়ার, কত ইজ্জৎ ছিল। তখন কারবারের এমন বাড়বাড়ন্ত ছিল যে খদ্দেরে ভিড়ে মেয়েদের নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত ছিল না। সেই পাড়ারই তখন একেবারে মড়াখেগো দশা। এক-একদিন বউনিই হয় না, এমন আকাল।
সুতরাং বাতাসীর কথায় মানদা মাসির অবস্থাটা প্রায় সেই রকম হলো–পাগলা ভাত খাবি, না আঁচাবো কোথায়?
মানদা মাসি বললে–যেতে তো আমি তৈরি, কিন্তু তোকে একটা কাজ করতে হবে মা, পারবি?
–কী কাজ বলো না।
–বড়বাবু তো এখন বাপের সম্পত্তির মালিক হলো, আমাকে এখন কিছু টাকা পাইয়ে দিতে পারিস? আমি এমনি নোব না, ধার হিসেবে নেব, সুদ চাইলে সুদও দিতে পারি। তা বলবি তুই?
বাতাসী বললে–তোমার তো অনেক টাকা মাসি, তুমি আবার টাকা কী করবে?
–ওমা, তুই আমার টাকা কই দেখলি? আমার টাকা কোথায়? টাকা থাকলে আজ আমি এই বুড়ো বয়েসে তোর খোসামোদ করি? টাকা থাহলে আমি আজ এর-ওর দোরে হন্যে হয়ে বেড়াই?
–তা তোমার বাড়িতে ভালো ভালো মেয়ে রাখলেই পারো। ভালো মেয়ে রাখলেই বড়লোক খদ্দের আসবে।
দূর পাগলী মেয়ে, ভালো মেয়ে যে রাখবো তাতেও তো টাকা লাগবে। ভালো মেয়ে কি এমনি অকাশ থেকে উড়ে আসে! তার জন্যে দালাল লাগাতে হয়। সে এ-সব বাজে দালালের কম্ম নয়। এর জন্যে বড় বড় সব দালাল লাগে, তাদের খাইও যে তেমনি। যে পূজোর যে-নৈবিদ্যি তা তো তুই জানিস নে। এ কারবারে অনেক ল্যাঠা। ভালো দালাল না রাখলে ভালো মেয়ে তারা যোগাবে কে? বাড়িটাও তেমনি একটা ভালো পাড়ায় নিয়ে যেতে হবে। ভালো মানুষের ছেলেরা কি আর আমার এই টিনের চালের বাড়িতে আসতে চায়? তা মতলোব আমি সব দিতে পারি, কিন্তু শুধু পিঠে খেলেই তো চলবে না, পিঠের ফোঁড় গুনবে কে?
কথাগুলো বুঝেছিল বাতাসী। বড়বাবুর কাছে যখন বাবার মৃত্যুর খবরটা এল তখনই বাক্স-প্যাটরা বেঁধে নিলে বাতাসী। মানদা মাসিও নিজের বাড়ির জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে এল।
বড়বাবু মানদা মাসিকে দেখে জিজ্ঞেস করলে–তুমি? তুমি আবার কোথা যাবে?
বাতাসী বললে–মাসি আমার সঙ্গে যাবে—
বড়বাবু জিজ্ঞেস করলে–কেন?
বাতাসী বললে–না গেলে আমার দেখাশোনা করবে কে সেখানে?
বড়বাবু বললে–তোমাকে দেখবার কি লোকের অভাব আছে সেখানে? লোক না থাকে লোক রাখবো। মাসির অনেক কাজ, মাসির নিজের কাজকারবার কে দেখবে?
মাসি এতক্ষণে কথা বললে–কারবারের কথা আর বোল না বাবা, কারবার আমার ডকে উঠেছে–
–কেন?
–খদ্দের কোথায়? খদ্দেরই তো লক্ষ্মী আমার। এমন হাল হয়েছে কলকাতার, এ একেবারে লক্ষ্মীছাড়া কাণ্ড! মেয়েরা আমার সব উপোস করতে বসেছে।
–কেন? কেন?
–সে-সব বাবা তোমাকে পরে বলবো, এখন তো তোমার অত শোনবার সময় নেই। এখন তোমার নিজেরই কত ভাবনা, তার ওপরে আমার ভাবনা দিয়ে আর তোমার মাথা ভারি করতে চাই না–
তা সেই-ই হলো সূত্রপাত। সেইদিন থেকেই মানদা মাসি বড়বাবুর পেছেনে লেগে পড়ে ছিল। শ্রাদ্ধ-শান্তি যেদিন চুকে গেল সেই দিন থেকেই মানদা মাসি বাতাসীকে বলতে কী রে, বড়বাবুকে তুই বলেছিস?
বাতাসীর তখন সুখের শেষ নেই। এত বড় সংসারের গিন্নী। চাকরবাকর, ঝি রাঁধুনী, এক গ্লাস জল পর্যন্ত নিজের হাতে গড়িয়ে খাবার দায় নেই। ঘুম থেকে ওঠবার আগেই মুখের কাছে চা এসে হাজির হয়। আর শোবার আগে যতক্ষণ না বড়বাবু বাড়ি ফেরে ততক্ষণ মানদা মাসি তার পা টিপে দেয়। এমন বিনা-পয়সার পা টেপবার লোক ক’টা বাড়ির বউ পেয়েছে?
মানদা মাসি বাতাসীর পা টিপে দেয় আর গল্প করে।
পা টিপতে টিপতে বলে–কী রে, আমার কথা বড়বাবুকে কিছু বলেছিলি?
বাতাসী চোখ বুঁজে বুঁজেই বলে–তোমার কথা আমি আর কী বলবো মাসি, তুমি নিজেই তো বলেছিলে।
মাসি বলে–আমি তো বলেই ছিলুম, কিন্তু তোকে তো সে-সব একবার মনে করিয়ে দিতে হয়! কাজের লোকের কী সব সময়ে সব কথা মনে থাকে?
বাতাসী বলে–তা আমারই কী কাজ নেই ভাবছো? আমারই কী সব কথা মনে থাকে?
মাসি বলে–তোর আবার কীসের কাজ রে? তোর কাজ করবার কত লোক রয়েছে, তুই একবার হুকুম কর না কোন কাজটা তোর করে দিতে হবে? যদি কেউ না করে তো আমি তাকে ঝাঁটা মেরে বাড়ি থেকে বিদায় করে দেব না–
বাতাসী বলে–তা এতই যদি তোমার ঝাঁটার জোর তো ওই মাগীটাকে বাড়ি থেকে বার করে দাও দিকিনি, দেখি তোমার কত ক্ষমতা?
–কোন মাগীটাকে? ওই বুড়ীকে?
–না, ওই ছুঁড়িকে।
মাসী বলে–ছুঁড়ির যে দেখাই পাইনে রে, ছুঁড়ি যে ঘর থেকেই বেরোয় না–
–তা কী এমন নন্দিনী যে ঘর থেকে একবার বেরুবেই না! বাড়ির ঝি-চাকর-ঠাকুর সবাই তো নবাব নন্দিনীকে নিয়েই অস্থির, আমাকে আর কে দেখছে বলো না, আমার কথা আর কে ভাবছে?
মাসি বলে–তা বড়বাবুকে সে কথা বললেই পারিস—
বাতাসী বলে–বড়বাবু আমার কথা শুনছে!
মাসি বলে–ওমা, তুই বলিস কী? বড়বাবু তোর জন্যে এত করে, তুই রাস্তায় পড়ে ছিলিস, বড়বাবু তোকে সেখান থেকে নিজের বাড়িতে এনে তুললে, সেই তুই-ই কিনা বড়বাবুর নামে এই বদনাম দিস?
তারপরে একটু থেমে বলে ঠিক আছে, আমি আজকে ওই মহেশ বেটাকে বলছি, ওই মহেশ বেটাই যত নষ্টের গোড়া। ওই মহেশটাই তো ছুঁড়ির ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসে। ওকে তুই ছাড়াতে পারিস না?
বাতাসী বলে–ও এতদিনের লোক, ওকে কী করে ছাড়াই বলো দিকিনি–
মাসি বলে–ঠিক আছে, তুই না ছাড়াতে পারিস, আমি ছাড়াবো। আমি এখুনি গিয়ে ছাড়িয়ে দিচ্ছি—
বলে সত্যি-সত্যিই মাসি উঠলো। উঠে বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো এই মহেশ, মহেশ–
মানদা মাসির চিৎকারে সমস্ত বাড়িটা তখন গমগম করে উঠলো। দোতলা থেকে একতলা পর্যন্ত সমস্ত আবহাওয়া যেন বিষিয়ে উঠলো মানদা মাসির চেঁচামেচিতে।
–কই, মহেশ কোথায়, মহেশ—
বাড়িতে আর কজনই বা লোক। দোতলার এক কোণের দিকে বাড়ি গিন্নী চুপ করে বসে ছিল। কথাটা তার কানেও গেল। কানে যেতেই মনটা বিষিয়ে উঠলো এক মুহূর্তে। কর্তা চলে গেছেন, তিনি চলে গিয়ে বেঁচেছেন। কিন্তু তাকে এ কোন্ নরকের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেলেন তিনি। তিনি হয়ত বুঝতেই পেরেছিলেন যে একদিন এমন হবে। তাই হয়ত খোকাকে সব সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর। গিন্নীর সামনে দেওয়ালের গায়ে সমরজিৎবাবুর একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি টাঙানো ছিল। সেই দিকে চেয়েই তিনি মনে মনে কী বলতে লাগলেন তা কেউ জানতে পারলে না।
–ঠাকুর, মহেশ কোথায় গেল?
ঠাকুর নিচের রান্নাঘরে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। বললে–আমি তো দেখি নি মাসিমা–
–তুমি যদি দেখতেই না পাবে বাছা তো মাইনে নিচ্ছ কেন বসে বসে? বসন্ত কোথায় গেল? বসন্ত?
–সে বাজারে গেছে।
বাজারে গেছে! বাজারে যাবার আর সময় পেলে না হারামজাদা। যখন-তখন বাজারে যাওয়া তার আমি দেখাচ্ছি! কে তাকে বাজারে পাঠালে এখন? কে?
যেদিন থেকে মাসি আর নতুন বউমা এসেছে সেই দিন থেকেই এ বাড়ির আদি বাসিন্দাদের কারো মনে সুখ নেই। আগে ঠাকুর-চাকর কাজ করেছে, তখন কোনও ঝামেলা ছিল না কারো। তারা এ বাড়ির একজন হয়েই কাজ করে নিশ্চিন্ত হয়েছে। কারোর গালাগালি খাবার দুর্ভোগ সইতে হয়নি কখনও।
ঠাকুর বললে–আজ্ঞে, মহেশ তাকে বাজারে পাঠিয়েছে—
–আমি মহেশকে দেখাচ্ছি–দেখাচ্ছি তার মজাটা—
কিন্তু সদর দরজার সামনে মহেশ তখন একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ভদ্রলোক গ্রাম থেকে এসেছে। কলকাতায় বিশেষ কাউকেই চেনে না। অনেক কষ্টে ঠিকানা খুঁজে এই বউবাজারের গলির মধ্যে এসেছে।
মহেশ জিজ্ঞেস করলে–তা মানদা মাসি আপনার কে?
ভদ্রলোক বললে–কে আবার, কেউই না। আমি কালীঘাটে তার বাড়িতে গিয়ে শুনলুম মাসি এখন এখানে, তাই দেখা করতে এলুম। তুমি এবাড়ির কে?
–আমি এ বাড়িতে চাকরি করি। আপনি কে? আপনার নাম কী?
ভদ্রলোক বললে–আমাকে মাসি চেনে, তুমি চিনতে পারবে না, আমি আসছি নবাবগগঞ্জ থেকে
–নবাবগঞ্জ? নদীয়া জেলার নবাবগঞ্জ? আমি তো সেখানে গিয়েছি। রেলবাজারে নেমে যেতে হয়।
–তুমি সেখানে গিয়েছ? কী করতে? তোমার দেশ নাকি?
মহেশ বললে–আমি গিয়েছিলুম সদানন্দবাবুর বাড়ির খোঁজখবর নিতে–
সদানন্দবাবু? সদা? সে-ই তো আমার ভাগ্নে গো! আরে আমি তো তার খোঁজেই কলকাতায় এসেছি। সে কোথায়? আমার কাছে কিছু লুকিও না ভাই, আমি তার মামা, আমি হন্যে হয়ে তাকে খুঁজছি আর সে কি না তোমাদের এখানে রয়েছে। তাজ্জব কাণ্ড তো! আমার নাম প্রকাশ। প্রকাশচন্দ্র রায়। আমার নাম বললেই চিনতে পারবে সে। তাকে একবার ডেকে দাও তো–ডেকে দাও–
মহেশ বললে–কিন্তু তিনি তো এখানে নেই
–নেই? কোথায় গেল?
মহেশ একবার ভাবলে লোকটাকে দাদাবাবুর ঠিকানা দেবে কিনা। ভালো করে চেয়ে দেখলে ভদ্রলোকের চেহারার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলে কিন্তু আমি তো নবাবগঞ্জ গিয়ে শুনে এসেছি দাদাবাবুর মা মারা গেছে, বাবা ছিল, তা তিনিও চলে গেছেন ভাগলপুরে। আমি যখন গিয়েছিলুম তখন তো নবাবগঞ্জে কেউ ছিল না–
প্রকাশ বললে–সদার বাবা তো ভাগলপুরে ছিলেন। কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন, সেই তার বাপ মারা যাওয়ার খবরটাই তাকে দিতে এসেছি–
–কিন্তু দাদাবাবুর তো বিয়েও হয়েছিল শুনে এসেছি।
প্রকাশ বললে–বাঃ তুমি তো বেশ চালাক-চতুর লোক হে, তুমি তো তা হলে সব জানো দেখছি।
–তা জানবো না, দাদাবাবু তো সব বলেছে আমাদের।
প্রকাশ বললে–বেশ বেশ, বেশ চালাক ছেলে ভাই তুমি, এখন সদার ঠিকানাটা ভাই দাও দিকিনি আমাকে। তার বাবা মারা যাবার পর লাখ লাখ টাকা রেখে গেছে, সে সব এখন কে খাবে বল তো? তা খবরটা তাকে না দিলে সব টাকা যে গভর্ণমেন্টের পেটে যাবে, তাই অত কষ্ট করে তার খোঁজে আসা, নাহলে আমার আর কী, আমার কলা, তারই ভালো, সে মাঝখান থেকে অনেকগুলো টাকা পেয়ে যাবে–
মহেশ হাসলো। বললে–আজ্ঞে টাকার কথা বলছেন? টাকার লোভ তার নেই—
প্রকাশ বললে–সদার টাকার লোভ নেই তা তুমি কেমন করে জানলে?
–আমি জানবো না, দাদাবাবু যে আমাদের এখানে ছিল আগে! আমার বাবু তো তাকে বাবুর সমস্ত সম্পত্তি উইল করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তো তা নিলেন না–
–তোমার বাবুর কত টাকা?
–বাবুরও যে দেশে অনেক জমি-জমা, তার ওপর কলকাতার এই বাড়ি, এ সব তো বাবুর নিজের। এই সবই বাবু দাদাবাবুকে উইল করে লিখে দিয়েছিলেন–
–তারপর?
–সেই টাকা নেবার ভয়েই তো দাদাবাবু এবাড়ি ছেড়ে একদিন পালিয়ে গেলেন।
প্রকাশ অবাক হয়ে গেল কথাগুলো শুনে। সদার মত আহাম্মক আর দুনিয়াতে কেউ আছে এটা কল্পনাই করতে পারলে না প্রকাশ। সদা টাকা চায় না, আর টাকাই কিনা সদার পেছনে পেছনে ধাওয়া করছে! হায়রে, প্রকাশকে তো কেউ টাকা নিতে বলে না। একেই বলে টাকা-কপালে ছেলে!
–আমার ভাগ্নেটার বরাবর ওই রকম স্বভাব ভাই। আহম্মকের এক-শেষ! টাকাকে কি অত অচ্ছেদা করতে আছে? তুমিই বলো না, তুমি তো খুব চালাক-চতুর ছেলে। টাকা লক্ষ্মী তো, সেই লক্ষ্মীকে তুই অচ্ছেদ্দা করলি, তাহলে লক্ষ্মীও তো তোকে অচ্ছেদ্দা করবে, মা লক্ষ্মীকে কি অত অচ্ছেদ্দা করতে আছে? তুমিই বলো?
তারপর সে-প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বললে–যাক গে, যে যা ভালো বোঝে করুক গে, তাতে তোমার আমার মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই ভাই। এখন সে কোথায় গেল সেইটে বলো দিকিনি। আমি তাকে কিছু বলবো না, শুধু তার বাপের টাকাটা তার হাতে তুলে দিয়ে আমি ছুটি পেতে চাই ভাই। পরের টাকার ঝঞ্ঝাট নিয়ে আমার আর ভাল্লাগছে না…।
মহেশ বললে–কিন্তু দাদাবাবু কাউকে বলতে বারণ করেছে যে–
–আরে আমি তো আর পর নই। আমি তো তার মামা। আমি তো তার ভালোর জন্যেই তাকে খুঁজছি। আমি তার বউকেও পর্যন্ত বলবো না। আমার ভাগ্নেটা এমন লক্ষ্মীছাড়া যে কী বলবো। নইলে শুনলাম তার বউটাও নাকি আবার বিয়ে করেছে
–বউ আবার বিয়ে করেছে? কে বললে–আপনাকে? আমি তো জানতুম না।
–আমি কি জানতুম? আমি কেষ্টনগর থেকে শুনে এসেছি। কেষ্টনগরে তো সদার শ্বশুরবাড়ি ছিল? যেই তার শ্বশুর মারা গেছে, আর বউটাও একটা ছোঁড়াকে বিয়ে করে তার সঙ্গে ভেগে পড়েছে। এখন সে বউ নাকি সেই ছোঁড়ার সঙ্গে নৈহাটিতে থাকে–
মহেশ বললে–দাদাবাবু বড় ভালো লোক–
প্রকাশ বললে–ভালো লোক বলেই তো এত ঝঞ্ঝাট। ভালো লোক না হলে কারো বউ এমন করে পালায়? তুমিই বলো না! তা তার ঠিকানাটা কোথায় বলো তো, আমি একবার গিয়ে ধরি তাকে এখন–
মহেশ বললে–আপনি বড়বাজার চেনেন তো? পাথুরেপটি? সেইখানে একটা মস্ত বড় ধর্মশালা আছে, সেই ধর্মশালায় খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন–
হঠাৎ পেছন থেকে মানদা মাসি চিৎকার করলে–এই হারামজাদা, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে, আর আমি যে চেঁচিয়ে গলা…
–মাসি!
প্রকাশ চিনতে পেরেছে। এই মাসির খোঁজেই সে কালীঘাট থেকে এখানে এসেছে।
মাসি কিন্তু চিনতে পারলে না। বললে–কে গো বাছা তুমি?
–আমাকে চিনতে পারছো না? আমি প্রকাশ গো! সেই প্রকাশ রায়। তোমাকে সেই আমার ভাগ্নের ছবি দিয়ে গিয়েছিলুম। মনে পড়ছে? সেই যে সেই বাতাসীর বাবুকে দেখাবে বলেছিলে! মনে পড়ছে না?
এতক্ষণে বুঝি চিনতে পারলে মাসি। বললে–তা তুমি আমার এখানকার ঠিকানা পেলে কী করে বাছা?
–কেন, বাসন্তী! তোমার কালীঘাটের বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলুম। সে-ই তোমার ঠিকানা দিলে। তা তুমি তোমার অত ফলাও কারবার ছেড়ে এখেনে চলে এলে যে?
মাসি সেকথার জবাব না দিয়ে বললে–তোমার ভাগ্নে কোথায়? তাকে খুঁজে পেলে?
–না, সেই তাকে খুঁজতেই তো এইচি। আমার সেই ভগ্নীপতি মারা গিয়েছে, জানো? আমার সেই বড়লোক ভগ্নীপতি! এদিকে আবার ভাগ্নেও নিরুদ্দেশ। তার বাপ আট লাখ টাকা রেখে গেছে, সেই খবরটা আমার ভাগ্নেকে দিতে এসেছি–
এতক্ষণে যেন একটু নরম হলো মানদা মাসি। বললে–আট লাখ টাকা?
প্রকাশ বললে–হ্যাঁ–
সঙ্গে সঙ্গে মাসি যেন একেবারে অন্য রকম মানুষ হয়ে গেল। সমস্ত মুখের চেহারাটাই বদলে গেল মাসির। বললে–তা বাবা, তুমি এরকম করে বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন, ভেতরে এসো, ভেতরে এসে বোস না। ওরে, এই মহেশ, তুই হারামজাদা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? ভদ্দরলোকের ছেলেকে বাড়ির ভেতরে এনে বসাতে পারছিস নে?
তারপর প্রকাশের দিকে চেয়ে বললে–দেখেছ বাবা এদের আক্কেলখানা? তোমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে গল্প করছে, এসো বাবা এসো, ভেতরে এসো, ছিঃ ছিঃ–
বলে খপ করে প্রকাশের হাতখানা ধরে টানতে লাগলো। বললে–এই সব হারামজাদাদের নিয়ে হয়েছে আমার সংসার, যেদিকে দেখবো না সেই দিকেই চিত্তির!
প্রকাশকে টানতে টানতে মাসি একেবারে বাড়ির ভেতরের বৈঠকখানা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। বললে–তোমার ভগ্নীপতি কত টাকা রেখে গেছে বললে?
প্রকাশ আবার বললে–আট লাখ টাকা, তা ছাড়া সোনা রুপো-জড়োয়ার গয়না, বাসনপত্তোর, তারও দাম কম করে কয়েক হাজার টাকা
–সবই তোমার সেই ভাগ্নের? আর কেউ ওয়ারিশন নেই?
–না। সদা যে আমার ভগ্নীপতির একই সন্তান–
–তা এখন যদি তোমার ভাগ্নেকে খুঁজে না পাও, তখন? তখন টাকাটা কে পাবে?
প্রকাশ বললে–তখন সব পাবো আমি—
পাশে দাঁড়িয়ে মহেশও সব শুনছিল। মাসি তার দিকে চেয়ে থমকে উঠলো–তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? বেটার কোনও দিকে যদি খেয়াল থাকে। ভদ্দরলোক বাড়িতে এসেছে আর তুই ঠুটো জগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস? যা, দৌড়ে চা-জলখাবার নিয়ে আয়, ঠাকুরকে বলবি চায়ের জল বসাতে, আর দোকান থেকে পাঁচ টাকার মিষ্টি আনবি, রাজভোগ, রাবড়ি যা ভালো-ভালো খাবার দেখবি নিয়ে আসবি—যা–
তারপর প্রকাশের দিকে চেয়ে বললে–তুমি একটু বোস বাবা। আমি মহেশকে টাকাটা বার করে দিই–আচ্ছা, তোমার ভাগ্নে বড় ভালো ছেলে ছিল, জানো একদিন তাকে ডেকে আমি তার চরণ-পূজো করেছিলুম–
বলে মাসি ভেতরে চলে যাচ্ছিল। প্রকাশ বলে–অত জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হবে না মাসি, আমি অত খেতে পারবো না–
মাসি বললে–খেতে পারবে না মানে? এই তো তোমাদের খাবার বয়েস গো আর এতদিন পরে এলে আমি তোমাকে না-খাইয়ে ছেড়ে দিতে পারি? তুমি বোস, আমি আসছি—
বলে মাসি ভেতরে চলে গেল। মাসির পেছনে-পেছনে মহেশও চলে গেল ভেতরে।
প্রকাশ উঠলো। মাসির খপ্পরে একবার পড়লে আর ছাড়া পাওয়া যাবে না। মাসি টাকার গন্ধ পেয়েছে। টাকার গন্ধ পেলে মাসিকে আটকানো দায়। সামনের রাস্তায় নেমে আর কোনও দিকে চেয়ে দেখলে না প্রকাশ। একেবারে বড়বাজারের পাথুরেপটির দিকে পা বাড়িয়ে হন্ হন্ করে এগিয়ে চললো।
.
আস্তে আস্তে আবার রাত নেমে এল পৃথিবীতে। রাত নেমে এল বউবাজারে। বড়বাজারের পাথুরেপটিতেও রাত নেমে এল। আর রাত নেমে এল নৈহাটিতে নয়নতারার বাড়িতে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই গ্রহটিতে আগে আরো অনেক কোটি কোটি বার রাত নেমে এসেছে, হয়ত ধ্বংস হয়ে যাবার আগে আরো অনেকবারই রাত নামবে। কিন্তু এরাত যেন এক মহা স্মরণীয় রাত। নয়নতারার জীবনের আগেকার অনেক রাতের সঙ্গে যেন এর কোনও মিল নেই। সেই নরনারায়ণ চৌধুরীর অত সাধের পুত্রবধূর জীবনে এমন রাত যেন আগেও কখনও আসে নি।
অঘোর ঘুমের মধ্যে নয়নতারার মনে হলো ঘরের দরজায় যেন টোকা পড়লো একবার। প্রথম বারের টোকাটা অস্পষ্ট, কিন্তু দ্বিতীয়বার টোকা পড়তেই নয়নতারা ভালো করে চারিদিকে চেয়ে দেখলে। পাশেই শুয়ে আছে নিখিলেশ। ঘুমে অচৈতন্য। নয়নতারা আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠলো। এমন সময় কে আর দরজায় ধাক্কা দেবে!
কিন্তু দরজা খুলতেই দেখলে সদানন্দ।
–তুমি?
সদানন্দ বললে–আমি চলে যাচ্ছি–
নয়নতারা বললে–চলে যাচ্ছ? কিন্তু তুমি যে এখনও ভালো করে সেরে ওঠো নি।
সদানন্দ বললে–আমি না-সারলেও চলে যাবো। এখান থেকে আমাকে চলে যেতেই হবে, আর আমি একলাও এখান থেকে যাব না, তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবো, তুমিও চলো–
নয়নতারা খানিকক্ষণ বিমূঢ় হয়ে সদানন্দর মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বললে—কিন্তু–
কিন্তু যে কথা সে বলতে চাইছিল তা আর মুখ দিয়ে বেরোল না তার। তার আগেই সদানন্দ বললে–তুমি যদি না-ই যাবে তো কেন তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে এনে তুলেছিলে?
–তখন যদি তোমাকে আমার বাড়িতে না আনতুম তা হলে যে তোমার বিপদ হতো!
সদানন্দ বললে–আমার বিপদ হলে তোমার কী? আমি তো তোমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলুম। তা হলে কেন তুমি আবার আমার সঙ্গে সম্পর্ক পাতালে?
নয়নতারা কেমন যেন স্তিমিত হয়ে এল। বললে–আমি তোমার সঙ্গে কখন সম্পর্ক পাতালুম?
-সম্পর্ক না পাতালে নিখিলেশবাবুকে লুকিয়ে কেন তুমি আমার অসুখ সারাবার জন্যে তোমার সোনার হার বাঁধা দিয়েছিলে? কেন সারা রাত জেগে জেগে আমার অসুখের সময় সেবা করেছিলে? নিখিলেশবাবু যখন ওষুধের নাম করে বিষ কিনে এনেছিলেন কেন তখন তুমি সে-বিষ আমাকে খাওয়ালে না? কেন তখন তোমার সন্দেহ হয়েছিল? কেন তুমি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলে? একেও কি সম্পর্ক পাতানো বলে না?
নয়নতারা বললে–আজকে তুমি এই কথা বলছো!
সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, আজকে আমার ভুল ভেঙেছে বলেই এই কথা বলছি–
–ক’বছর আগে তোমার এ-ভুল ভাঙলো না কেন? ক’বছর আগে ভুল ভাঙলে তো আমি কোনও কিছু না ভেবে তোমার সঙ্গেই চলে যেতে পারতুম। এতদিন পরে কেন এমন করে তোমার ভুল ভাঙলো? এখন যে বড় দেরি হয়ে গেছে–
সদানন্দ বললে–যত দেরিই হোক, তবু আমার তো বেশি দেরি হয় নি, এখনও অনেক সময় আছে। চলো, সকাল হয়ে গেলে সবাই আবার জেনে ফেলবে, রাত থাকতে থাকতেই চলো বেরিয়ে পড়ি–
নয়নতারা যেন ককিয়ে উঠলো। বললে–ওগো, তুমি অমন করে বোল না–
–কেন বলবো না?
–না, তুমি বুঝতে পারছে না, আর যে তা হয় না—
সদানন্দ বলে উঠলো–হয় হয়, তুমি ইচ্ছে করলেই হয়। তুমি যাবে না তাই বলো–
–ওগো তুমি চলে যেও না, তুমি থাকো। যে যাই বলুক আমি তোমার কোনও কষ্ট কোনও অপমান হতে দেব না, তুমি থাকো, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি থাকো–
সদানন্দ বললে–আর এখানে থাকা যে আমার চলে না নয়নতারা, আমাকে যে চলে যেতেই হবে–
–কেন? তোমাকে চলে যেতে হবে কেন? আমি তো আছি, আমি যখন থাকতে বলছি তখন তোমার থাকতে আপত্তি কী?
সদানন্দ গলা চড়িয়ে বলে উঠলো—না–না–সে কিছুতেই হয় না–
বলে চলে যেতেই সদর দরজাটা তার মুখের ওপর শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দূরের স্টেশন থেকে একটা ট্রেনের হুইলের শব্দে মনে হলো যেন নিখিলেশ তাকে ডাকছে–ওগো, কী হলো, কী হলো তোমার? স্বপ্ন দেখলে নাকি?
নয়নতারা যেন এতক্ষণে বাস্তবে ফিরে এল। তারপর বিছানা থেকে উঠলো। নিখিলেশ বললে–কী হলো? যাচ্ছো কোথায়?
নয়নতারা বললে–ও-ঘরে গিয়ে একবার দেখে আসি ও কেমন আছে–ঘুমের ওষুধটা ওকে খাওয়াতে ভুলে গিয়েছিলুম–
নিখিলেশ বললে–তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি, ভোরবেলা গেলেই তো হতো–
নয়নতারা সেকথার উত্তর না দিয়ে দরজার খিল খুলে বাইরে চলে গেল, নিখিলেশও বিছানা থেকে উঠে পেছন পেছন চললো।
কিন্তু পাশের ঘরে গিয়ে যা-দেখলে তাতে নয়নতারার আর বিস্ময়ের শেষ রইল না। কোথায় গেল মানুষটা! বিছানা যেমন ছিল তেমনি পড়ে আছে। ঘরের অন্য জিনিসগুলোও যেখানে থাকবার সেখানে রয়েছে শুধু সদানন্দই নেই। একবার কী যেন সন্দেহ হলো নয়নতারার। ঘরের বাইরে গিয়ে উঠোনের দরজাটাও লক্ষ্য করলে। দরজার খিল খোলা। তবে কি মানুষটা চলে গেল? এই অন্ধকারে এত রাত্রে অসুখ শরীর নিয়ে কোথা গেল সে!
হঠাৎ নিখিলেশের দিকে চেয়ে নয়নতারা বললে–এ নিশ্চয় তোমার কাজ—
নিখিলেশ বললে–আমার কী কাজ?
–তুমি নিশ্চয় তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ। তুমি সব পারো।
নিখিলেশ বললে–আমি সদানন্দবাবুকে তাড়িয়ে দেবো কেন?
নয়নতারা বললে–তুমি ছাড়া আর কে তাড়াবে তাকে? তুমিই তো তাকে খুন করবার মতলব করেছিলে। আমি তোমাকে খুব চিনে গেছি।
–কিন্তু গিরিবালাও তো কিছু জানতে পারে। তাকে একবার জিজ্ঞেস করো না–
–সে তোমার মত অত নীচ নয়, সে বুড়ো মানুষ সারাদিন খেটে-খুটে ঘুমোচ্ছ, সে কিছু জানলে আমাকে নিশ্চয়ই বলতো, এ তুমি ছাড়া আর কেউ নয়, এ তোমারই কাজ–
নিখিলেশ বললে–বিশ্বাস করো সত্যি বলছি আমি আর কিছু জানি না–
–তাহলে সে কোথায় গেল তাই বলো? তুমি কী বলতে চাও সে নিজের থেকে চলে গেছে? এত রাত্তিরে কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়? তাকে তো হঠাৎ ভুতে ধরে নি। এ নিশ্চয়ই তোমার কাজ—নিশ্চয়ই–নিশ্চয়ই–
নিখিলেশ বলতে গেল–তুমি মিছিমিছি আমার ওপর রাগ করছো নয়ন–শোন–
–না, তোমার কথা আমি শুনতে চাই না, তোমার মুখও আমি দেখতে চাই না–তুমি যাও, আমার সামনে থেকে তুমি বেরোও।
বলে নিখিলেশের মুখের ওপর নয়নতারা ঘরের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিলে। তারপর সদানন্দর খালি বিছানাটার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগলো।
নিখিলেশ বাইরে থেকে ডাকতে লাগলো-নয়ন, দরজা খোল, দরজা খোল—