২.৬ ফুলশয্যার সেই অমোঘ রাত

আবার সেই রাত। ফুলশয্যার সেই অমোঘ রাতটার পর এই দ্বিতীয়বার নয়নতারা আবার একবার রাত কাটাবে এই ঘরে। এই রাতটার কথা ভাবতেই কেমন যেন তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এতদিন মা ছিল, তাই ততো ভয় করে নি, কিন্তু এবার কেউ নেই তার। অভিযোগ করবার, আবদার করবার, আত্মসমর্পণ করবারও যেন কোনও লোক তার নেই। তবে এবার থেকে তাকে তার অদৃশ্য ভাগ্যের কাছেই অভিযোগ আবদার আত্মসমর্পণ যা-কিছু সব করতে হবে। নিজেকে তার নিজের কাছেই বড় অসহায় মনে হলো।

শাশুড়ী সামনে বসিয়ে খাওয়ালে। বললে–তোমার মা নেই বউমা, কিন্তু আমি তো আছি, তোমার কোনও কষ্ট হলে তুমি আমাকে বলবে। বলতে যেন কোনও লজ্জা কোর না–

খাওয়ার পর বউমা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে।

শাশুড়ী বললে–তুমি আবার দাঁড়িয়ে রইলে কেন বউমা, তুমি তোমার ঘরে যাও–

নয়নতারা বললে–আপনাদের কারো যে খাওয়া হয় নি মা–

–আমাদের খাওয়া হোক না-হোক, তুমি বাচ্চা মেয়ে বসে থাকবে কেন? তুমি এতদূর থেকে এলে, এত ধকল গেল তোমার শরীরে, তুমি তোমার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো গে—যাও–

নয়নতারা আস্তে আস্তে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। ঢুকে চার পাশের জানালার পাল্লা বন্ধ করে দিলে। বিছানার ওপর দুটো মাথার বালিশ, দুটো পাশবালিশ পাশাপাশি সাজানো। বাবা এতক্ষণ কেষ্টনগরের পথে ট্রেনে চড়ে চলেছে হয়ত। হয়ত নয়নতারার কথা ভুলেও গেছে বাবা। কেষ্টনগরে গিয়ে বাবা আবার হয়ত তার কাজের মধ্যে ডুবে যাবে। বাবার কি সময় কাটাবার কাজের অভাব? সকাল-সন্ধ্যেয় ছাত্ররা আসবে পড়া জানতে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে করতেই কোথা দিয়ে বেলা পুইয়ে যাবে বাবা তা টেরও পাবে না, তখন খাওয়ার জন্যে তাগাদা দিতে হবে। বাবা খেয়ে নিলে তবে তো রান্নাঘর দেওয়া এঁটো বাসন মাজা শেষ হবে। বাবা খেয়ে নিতে যত দেরি করবে সংসারে কাজ শেষ হতে ততই দেরি হবে। বাবা কখনও নিজে সংসার দেখে নি। সব দেখতো মা-ই। নিজের হাতে সংসার করলেই তবে সংসারের জ্বালা মানুষ বুঝতে পারে। নইলে দূর থেকে হুকুম দিতে পারে সবাই।

কাপড় ব্লাউজ বদলে নয়নতারা শুতে গিয়েও কেমন একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলো। দরজায় খিল দিয়ে শোবে নাকি সে?

কী করবে বুঝতে পারলে না। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এখনই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

হঠাৎ বাইরে থেকে শাশুড়ীর গলা শোনা গেল-বউমা, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?

নয়নতারা তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে বললে–না মা–

শাশুড়ী বললে–হ্যাঁ, তোমাকে তাই বলতে এলাম, তুমি এতদূর থেকে এসেছ, জেগে থাকবার দরকার নেই, কিন্তু দরজায় যেন খিল দিও না, কিছু ভয়ডর নেই এখানে। খোকা খেয়ে-দেয়ে এই ঘরেই শুতে আসবে—

কথাটা শুনেই নয়নতারার বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো। শাশুড়ী কথাটা বলে আবার তার নিজের কাজে চলে গেল। কিন্তু নয়নতারার মনের মধ্যে তার জের চলতে লাগলো অনেকক্ষণ ধরে।

প্রকাশ মামা দিদির কাছে এসেছিল। জিজ্ঞেস করলে–কী হলো দিদি? বউমা দরজা খুলে শুয়েছে?

দিদি বললে–হ্যাঁ, পাছে দরজায় খিল দিয়ে দেয় তাই বলে এলাম—

তারপর যেন মনে পড়লো। জিজ্ঞেস করলে–খোকাকে পেলি?

প্রকাশ মামা বললে–সেই তাকে খুঁজতেই তো গিয়েছিলুম। কোথাও নেই। বারোয়ারিতলায় গোপাল কেদার ওদের সঙ্গে দেখা হলো। সবাই তাস খেলছে। ওরা বললে–সদা ওখানে অনেকক্ষণ ছিল। বসে বসে তাস খেলা দেখছিল, তারপর কখন কোথায় চলে গেছে কেউ টের পায় নি–

–তাহলে কোথায় গেল?

প্রকাশ মামা বললে–তারপর বারোয়ারিতলা থেকে আমি ওদের যাত্রা পার্টির ক্লাবে গিয়েছিলুম, সেখানে দেখি ওদের ‘পাষাণী’র রিহার্সাল চলেছে। পূজোর সময় পাষাণী প্লে হবে কিনা। সেখানে গিয়েও জিজ্ঞেস করলুম, তারা বললে–বাড়ির দিকে গেছে সদা। তাই ভাবলুম হয়ত বাড়ির দিকেই এসেছে সে, বাড়িতে এসে দেখি সে আসে নি–এখন কী করা যায় বলে দিকিনি। আমি তো মহা ভাবনায় পড়লুম–

প্রীতি বললে–বউমা বাড়িতে এসেছে সে-খবরটা সে পেয়েছে নাকি?

–সে-খবর সে পাবে কী করে?

–যদি রাস্তায় কেউ গাড়ি দেখে থাকে তো সে হয়ত বলে দিয়েছে খোকাকে।

প্রকাশ মামা কথাটা শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে–তাহলে আমাদের বাবাজী কী করছে?

প্রীতি বললে–যখন বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে তখন নিশ্চয়ই হবে। আমি তো ওই ভরসাতেই আছি–

–যজ্ঞ কবে হবে?

–সে আমি কী করে বলবো? যেদিন বাবাজীর আদেশ হবে।

–এই বাড়িতেই হবে তো?

–সেই রকমই তো কথা আছে।

বাবাজী ততদিনে বেশ বহালতবিয়তেই আছেন। সারা বাড়িতেই বাবাজীর জন্যে তোড়জোড় চলে সারা দিন। রেলবাজার থেকে ফল-ফুলুরি-মিষ্টি আসে। বাড়িতে দুধ আছে, তার বেশির ভাগটাই ছানা তৈরি হয় বাবাজীর জন্যে। বাবাজী চাল-আটা-মাংস-ডিম কিছুই স্পর্শ করে না। বাবাজীর কাছে শালগ্রাম-শিলা আছে। তিনি সকালে সন্ধ্যেয় সেই শালগ্রাম শিলার সামনে আরতি করেন। সেই আরতির জন্যে গব্যঘৃত, চন্দন, দুগ্ধ, তুলসীপত্র, ফুল, বেলপাতা যোগাড় করতে হয়। গৌরী পিসী সারাদিন সেই সব তদারকিতেই থাকে। কর্তাবাবুর বাড়িতেই অনেক বিগ্রহ। সে বিগ্রহ নামে মাত্র। প্রত্যেক বিগ্রহের মাথা পিছু পঁচাত্তর বিঘে জমিজমা বরাদ্দ। পূজারী ঠাকুর রোজ ফুল-বেলপাতা চড়িয়ে নিয়ম করে পূজো করে যায়। তার জন্যে কোনও দিন কোনও ঘটাও হয় নি, উৎসবও হয় নি। সে-পূজো কখন হলো তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তার জন্যে বরাদ্দ ব্যবস্থা আছে। পূজারী ঠাকুর তার জন্যে জমি পেয়েছে। পুরোপুরি সে-পূজোর জিম্মাদারি তারই।

কিন্তু এ আলাদা পূজো।

বেহারি পালের বউ এসেও খানিকটা হাত চালায়। কখনও ফল কেটে দেয়, কখনও আরতির সময়ে গিয়ে হাজির থাকে। তারপর যখন আরতি হয়ে যায় তখন গলবস্ত্র হয়ে আর সকলের সঙ্গে প্রণাম করে।

বাড়িতে যেতেই বেহারি পাল গিন্নীকে জিজ্ঞেস করে–আজকে কী হলো গো ওদের বাড়িতে?

গিন্নী বলে–কী আবার হবে, ওই পূজো–

বেনে-মশলার দোকান করেই বেহারি পালের অনেক বাড়তি পয়সা। সেই বাড়তি পয়সাতেই আবার মহাজনি কারবার চলে। ধান-পাট-তিসি-সরষের বদলে টাকা ধার দেয়। তবে মালের দরটা বাজারের থেকে কম। কিন্তু দর কম হলে কী হবে, অমন নগদ টাকা কে দেবে হাতে তুলে! কর্তাবাবুও এককালে ওই কারবার করেছিলেন। তারপর যখন অনেক টাকা হয়ে গিয়েছিল তখন জমি কিনে ফেললেন সেই টাকায়। সুদের কারবারে ইজ্জৎ নেই তেমন। কর্তাবাবু তখন একটু ইজ্জতের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

বেহারি পাল জিজ্ঞেস করে–তা হঠাৎ বাবাজীকে কোত্থেকে আমদানি করলে?

–হিমালয়ের সাধু। রাণাঘাটে এসেছিলেন কোন্ শিষ্যের বাড়িতে। সেখান থেকে নাকি চৌধুরী মশাই নিজের বাড়িতে এনে তুলেছে। এবার যজ্ঞ হবে, তারপর সাধু আবার চলে যাবেন হিমালয়ে।

–তা সাধুবাবাজী কী করে সারাদিন?

গিন্নী বলে–সাধু-সন্নিসীদের ব্যাপারে তুমি অমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কোর না, কার মনে কী আছে কে বলতে পারে! ভাল না করুক মন্দও তো করতে পারে। তখন? আর আমার তো এতে পয়সা খরচ হচ্ছে না—

বেহারি পাল বলে–ওসব কর্তাবাবুর বুজরুকি। বুঝলে? যাকে বলে ভড়ং–ভেতরে ভেতরে কালীগঞ্জের হর্ষনাথ চক্রবর্তীর সব সম্পত্তি গ্রাস করে এখন বোধ হয় পরকালের ভয় ঢুকেছে মনে! যাবে একদিন সব এই তোমায় বলে রাখলুম, সব যাবে। ওই নাতিই ওদের বংশে পেল্লাদ হয়ে জন্মেছে–দৈত্যকুলে পেল্লাদ-। কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক কি মিছিমিছি মরেছে বলতে চাও?

তা বেহারি পাল যা-ই বলুক তাতে কারোর কিছুই আসে যায় না। টাকা হলেই ও রকম পরস্পর হিংসা-ঈর্ষা দ্বেষ বিদ্বেষ থাকেই। তা নিয়ে মাথা ঘামালে সংসার চলে না। নইলে বাবাজীদেরই বা চলবে কেমন করে? তাদেরও তো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা চাই। চৌধুরী মশাই-এর সংসারে যদি শান্তিই থাকবে তো তাহলে কি আর বাবাজীকে বাড়িতে এনে এত খাতির করতো কেউ? না, দিনরাত তার সেবার জন্যে এত খরচান্তের আয়োজন অনুষ্ঠান হতো।

বাবাজী এক একদিন এক-এক ব্রত করেন।

বলেন–আজ ‘ভূতাপসারণ দিগ্বন্ধন’ করবে–

–সেটা কী?

বাবাজী বলেন–তার অর্থ এই বাড়ির চৌহদ্দি থেকে ভূত-প্রেত দূর করবো। তাদের দৃষ্টি পড়েছে এ বাড়িতে

–তাতে কী কী উপচার চাই?

বাবাজী ফর্দ দেন-–গঙ্গাজল, পুষ্প আর শ্বেতসর্ষপ। বেশি কিছু নয়।

তা তারই ব্যবস্থা হলো। সবাই এসে জুটলো। সত্যিই যদি বাড়ির ওপর ভূত-প্রেতের নজর পড়ে থাকে তো তা আগে দূর করতে হবে।

যখন সব যোগাড় হলো তিনি দিগ্বন্ধন করতে করতে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। ধূপ-ধূনোর গন্ধে তখন চোখে অন্ধকার দেখছে সবাই।

বাবাজী বলল–কাঁসর-ঘন্টা কই?

প্রকাশ মামা কাঁসর নিয়ে ঝাঁইঝাঁই করে বাজাতে লাগলো। আর একজন ঘণ্টা।

বাবাজী চিৎকার করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন–ওঁ অপসৰ্পন্তু তে ভূতা যে ভুতা ভুবি সংস্থিতাঃ…

আরো কী সব অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলেন তার মানে কেউ বুঝতে পারলে না। তা না পারুক, শব্দ যত দুর্বোধ্য হয় সকলের ভক্তি ততই বাড়ে। শেষকালে হাতে তুড়ি দিতে লাগলেন বাবাজী। ওঁ যং লিঙ্গ শরীরং শোধয় শোধয় স্বাহাঃ..

যখন পূজো শেষ হয়ে আসছিল তখন হঠাৎ বাবাজী চিৎকার করে বলতে লাগলেন– ফট…ফট…ফট…ফট স্বাহাঃ…

শেষ পর্যন্ত দিগ্বন্ধন হলো, ভূতাপসারণও হলো। পরের দিন চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–হ্যাঁ বাবা, ভূত কি ছিল বাড়িতে?

বাবাজী বললেন–ছিল বৈকি। অনেকগুলো ভূত ছিল। তার মধ্যে আবার একটা ছিল পেতনী

কথাটা শুনেই চৌধুরী মশাই-এর বুকটা যেন ছাঁৎ করে উঠলো। কালীগঞ্জের বউ কি তাহলে অশরীরী হয়ে এই বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল নাকি?

–তা এখন সবই দূর হয়েছে তো?

–দূর হবে না মানে? চোখের জল ফেলতে ফেলতে সবাই পালিয়েছে।

–কিন্তু যজ্ঞ করবেন কবে? আপনি যে বলেছিলেন যজ্ঞ করলে অমঙ্গল কেটে যাবে?

–আরে আগে-ভাগে যজ্ঞ করলেই হলো? ভৃগুর কষ্ট হচ্ছিল ভূত-প্রেতের উপদ্রবের জন্যে। এবার তারা দূর হলো, এখন ভৃগু সুস্থ হলেন।

ঠিক এই সময়েই কেষ্টনগর থেকে বেয়াই মশাই তার মেয়েকে নিয়ে এসে হাজির হলেন। বেয়াই মশাই কিম্বা তার মেয়ে কেউই জানতে পারলে না তাদের অসাক্ষাতে এই বাড়ি এই বংশ ভূতের উপদ্রব থেকে মুক্ত হয়ে গেছে।

কর্তাবাবুও জানতে পারলেন না ভেতরে ভেতরে এত কাণ্ড চলেছে। তার নাকে তখনও ধূপ-ধুনোর গন্ধ যায় আর কানে যায় কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ। বলেন–বেহারি পালের দেব-দ্বিজে ভক্তি-টক্তি ওসব ভড়ং, বুঝলে কৈলাস! সব ভড়ং। ও হলো আসলে টাকার গরম। সুদে টাকা খাটিয়ে খাটিয়ে টাকা করে এখন লোককে দেখাচ্ছে–ওগো তোমরা দ্যাখো, আমার কত টাকা হয়েছে

সেদিন বাবাজীর কাছে গিয়ে চৌধুরী মশাই বললেন বাবাজী, আজ আমার বউমা এসেছে–

–এসে গেছে? তা ভালোই হয়েছে।

–এবার ছেলেকে বউমার কাছে শুতে পাঠাবো তো?

–নিশ্চয় পাঠাবি।

–কিন্তু ছেলে যদি আবার বিগড়ে বসে?

বাবাজী হাসলেন। বললেন–না রে না, সে ভয় তোর নেই। আমি তো দিগ্বন্ধন করে দিয়েছি, এর পর আমি একটু পাদোদক দিয়ে দেব সেইটে খাইয়ে দিস। এখন এই পর্যন্তই চলুক, তারপর তো আমি আছিই–তোর কিছু ভয় নেই–

অনেক রাত্রে কখন নিঃশব্দে সদানন্দ বাড়িতে ঢুকলো। রোজ এমনি করে নিঃশব্দেই সে ঢোকে। কখন কোথায় থাকে, কার সঙ্গে মেশে তাও যেন কেউ জানে না। কখনও দেখা যায় বারোয়ারিতলায় গিয়ে বসেছে। তারপর আবার কখন সেখান থেকেও সে উঠে যায় কেউ টের পায় না। তারপর একে একে যখন রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা পাতলা হয়ে আসে তখন ক্ষিধে পেয়ে যায়। নদীর ধারে বিরাট চড়া পড়ে থাকে। সেখানেই হয়ত শুয়ে পড়লো। এপারে নবাবগঞ্জ ওপারে কালীগঞ্জ। নদীটা পেরিয়ে ওপারে খানিকটা হেঁটে গেলেই হর্ষনাথ চক্রবর্তীর ভাঙা দোতলা বাড়িটা। সেই বাড়ির সামনে গিয়েও খানিক দাঁড়ায়।

সেই বাড়ির রাস্তায় চলতি কোনও লোক দেখতে পেলে ভালো করে ঠাহর করতে পারে না।

জিজ্ঞেস করে–কে?

সদানন্দ বলে–আমি।

বুড়ো লোকটা জিজ্ঞেস করে–তুমি কাদের বাড়ির?

সদানন্দ বলে–আমি নবাবগঞ্জের চৌধুরী মশাই-এর ছেলে

–ও, তুমি গোমস্তা মশাই-এর নাতি? তা এত রাত্তিরে এখেনে কেন? কী দেখছো?

সদানন্দ বলেনা, কিছু দেখছি না, এমনি।

–এ বাড়ি কার জানো? হর্ষনাথ চক্কোত্তির বাড়ি। তোমার ঠাকুর্দাদা এই চক্কোত্তি মশাই এর গোমস্তা ছিলেন। এ কী বাড়িই ছিল এককালে বাবা, আর এখন কী বাড়িই হলো। একেবারে ভুতের বাড়ি হয়ে গেল রাতারাতি।

সদানন্দ আর বেশি দাঁড়ায় না সেখানে। ক’দিন আগেও সে এখানে এসেছিল। এই বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিল। এরই মধ্যে যেন জঙ্গলে ভর্তি হয়ে গেছে জায়গাটা। দু-চারটে গাছ, ভাঙা ইটের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিতে শুরু করেছে। লোকজন কেউ নেই কোথাও। ভেতরে কোথাও একটা আলোও জ্বলছে না। সত্যিই ভূতের বাড়ি হয়ে গেছে দেখছি।

আবার হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে ফেরে। মনে হয় যেন পেছন পেছন কে আসছে। পেছন ফিরে দেখে একবার। কেউ কোথাও নেই। আবার যেন কার গলা শোনা যায়। সদানন্দ আবার পেছন ফেরে। কাউকে দেখতে পায় না।

হঠাৎ যেন কে বলে ওঠে–আমার দিকে চেয়ে দেখ, এই যে আমি—

আবার পেছন ফেরে সদানন্দ। একেবারে ঠিক কালীগঞ্জের বউ-এর গলা।

–তুমি বাবা আমার জন্যে কেন কষ্ট পাচ্ছো? আমি তো মরে গিয়েছি।

সদানন্দ সামনের ধূ-ধূ নিঃসীম অন্ধকারের দিকে চেয়ে অশরীরী শব্দটার মধ্যে একটা অবয়ব খুঁজতে চেষ্টা করে।

–তুমি নতুন বিয়ে করেছ, তোমার সামনে অনেক ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে, তুমি আমার কথা আর ভেবো না বাবা। বুঝলে? ভাবলে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে, তুমি বাড়ি ফিরে যাও

সদানন্দ কাঁদো কাঁদো গলায় একবার ক্ষীণ প্রশ্ন করলে–তুমি কই কালীগঞ্জের বউ? তুমি কই?

–আমি? আমি তো আর নেই বাবা?

–তুমি নেই তো কথা বলছো কী করে? তুমি কোথায়?

–আমি? আমি আর কোথায় থাকবো? আমাকে যে তোমার গোমস্তা মশাই একবারে শেষ করে দিয়েছে। আমি যে হারিয়ে গিয়েছি বাবা।

বলতে বলতে একটা কাঠফাটা আর্তনাদে হঠাৎ যেন বাতাসটা চৌচির হয়ে গেল আর সদানন্দর সমস্ত শরীরটা সেই শব্দে থর-থর করে কেঁপে উঠলো। হঠাৎ নজরে পড়লো তার সামনেই একটা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর অচেনা মানুষ দেখে তার দিকে চেয়ে তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করছে।

সদানন্দ চিৎকার করে বলে উঠলো–আমি এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো কালীগঞ্জের বউ, তুমি দেখে নিও, আমি আমার দাদুর সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো একদিন–

আশ্চর্য! একটা তুচ্ছ কুকুরও তাকে আজ পর মনে করছে। তাকে অবিশ্বাস করছে। তাকে অশ্রদ্ধা করছে। সে যে এক নিষ্ঠুর হত্যাকারী পরস্বাপহারীর বংশধর তা এই রাস্তার কুকুরটাও যেন কেমন করে বুঝতে পেরেছে।

লজ্জায় মাথা নিচু করে সদানন্দ আবার তার বাড়ির পথ ধরলে। অন্য দিন হলে সে কুকুরটাকে তাড়া করতো। কিম্বা তাকে লক্ষ্য করে একটা ঢিলও ছুঁড়তো। কিন্তু আজ তার মনে হলো কুকুরটার কোনও অপরাধ নেই। সে কোনও অন্যায় করেনি। নবাব গঞ্জের মানুষও যে তাকে এতদিন এমনি করে কামড়াতে আসে নি এই-ই যেন তার পরম সৌভাগ্য!

প্রকাশ মামাই প্রথমে তাকে দেখতে পেয়েছে। দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠেছে–ও দিদি এই যে, এতক্ষণে তোমার খোকা এসে গেছে

গৌরী পিসীও রান্নাবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। সকলকেই বলা ছিল বউমা যে বাড়িতে এসেছে এ কথা কেউ যেন খোকাকে না জানায়! সদানন্দ সকলের মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। এমন করে তো অন্যদিন কেউ চায় না তার দিকে। অন্তত কেউ এত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখে না।

মা বললে–আয় খেতে বোস–

সদানন্দ কুয়োতলা থেকে হাত-পা ধুয়ে এসে যথারীতি খেতে বসলো। প্রতিদিনকার নিয়ম বাঁধা কাজ। সেই সকালবেলা খেয়ে দেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া আর রাত্রে এসে খেয়ে নিজের ঘরটাতে শুয়ে পড়া। আর তাও খাওয়া-না-খাওয়া। কোনও রকমে গলা দিয়ে ভাত সেঁধিয়ে দেওয়া।

মা বললে–হ্যাঁ রে, সারাদিন কোথায় থাকিস? তোর কি ক্ষিধেও পেতে নেই রে? না কারো বাড়িতে খেয়ে নিস?

এ অভিযোগ নিত্য-নৈমিত্তিক। এতে কান দেওয়ার মত ছেলে সদানন্দ নয়।

গৌরী পিসী এসে ভাতের থালা রেখে দিয়ে গেল সামনে।

মা বললে–ওরে খাবার আগে এইটে চুমুক দিয়ে খেয়ে নে বাবা–যেন পায়ে না ঠেকে–বলে ছোট পাথরের একটা বাটি সামনে এগিয়ে দিলে।

–কী এটা?

–পূজোর চন্নোমেত্তর! পূজো হয়েছিল তারই পেসাদ।

সদানন্দ বললে–এ আমি খাবো না–

–কেন, খাবি নে কেন? পেসাদ খেতে দোষ কী তোর?

সদানন্দ বললে–এ খেয়ে কী হবে?

মা বললে–খেলে তোর ভালো হবে। তোর মতিগতি ফিরবে—

সদানন্দ বললে–আমার মতিগতি কি খারাপ যে ফেরাতে হবে?

মা বললে–অত তক্কো করিস নি তুই, আমি বলছি খেয়ে নে, মার কথা শুনতে হয়, খা, খেয়ে নে–

সদানন্দ হাত দিয়ে বাটিটা ঠেলে দিতেই বাটিটা উল্টে জল পড়ে গেল।

মা বললে–ও কী করলি? ঠাকুরের পেসাদ ফেলে দিলি? ওতে যে পাপ হয় রে–

–হোক পাপ। পাপ হলে আমার হবে। আমার পাপ হলে তোমাদের কী? তোমরা আমার কথা কেউ ভাবো?

বলে সদানন্দ থালা থেকে ভাত তুলে মুখে পুরতে লাগলো। যেন কোনও রকমে ভাত গিলে মার সামনে থেকে উঠে যেতে পারলে সে বাঁচে। তারপর যা পারলে খেয়ে নিয়ে কুয়োতলায় গিয়ে মুখ ধুয়ে তার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়লো।

প্রকাশ মামা এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ততক্ষণ আড়ালে ওৎ পেতে ছিল। সদানন্দ ঘরে গিয়ে ঢুকতেই বাইরে থেকে দরজায় শেকল তুলে দিয়েছে।

সদানন্দর তখন আর কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তাড়াতাড়ি গায়ের জামাটা খুলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন সাপের ছোবল খেয়ে দাঁড়িয়ে উঠে পড়লো। মনে হলো পাশে যেন কে শুয়ে রয়েছে। একটা কী যেন সন্দেহ হলো তার। তারপর জানলাটা খুলে দিলে। ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে চাঁদের আলো এসে বিছানাতে পড়তেই দেখলে নয়নতারা। নয়নতারা বিছানার একপাশে সরে গিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে।

কিন্তু এমন করে তার বউ যে হঠাৎ এসে পড়বে তা সদানন্দ কল্পনা করতে পারে নি। নয়নতারার মা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সে সেখানে চলে গিয়েছিল এই খবরটাই সে জানতো। কিন্তু ফিরে আসার খবরটা তো তাকে কেউই দেয় নি।

কী করবে সে বুঝতে পারলে না। ঘটনার আকস্মিকতায় একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল প্রথমে। তার পরে সোজা ঘর থেকে বাইরে যেতে গিয়েই বুঝলে বাইরে থেকে শেকল বন্ধ।

সদানন্দ দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলোমা, মা, দরজা খোল, দরজা বন্ধ করে দিলে কেন? দরজা খোল মা–

প্রকাশ মামা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল মজা দেখবার জন্যে। দিদির দিকে চেয়ে বললে– খবরদার, দরজা খুলে দিও না যেন–ওই রকম বন্ধ থাকুক–

প্রীতির তখনও সন্দেহ হচ্ছিল। বললে–কিন্তু শেষে যদি খোকা কিছু করে বসে?

–কী করে বসবে? করলে তখন তো আমি আছি। আমার কাছে তো তারও ওষুধ আছে।

সদানন্দ ভেতর থেকে তখনও দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে–মা, দরজা খোল মা–

চৌধুরী মশাইও বাবাজীকে রেখে দেখতে এসেছিলেন। বললেন–সেই চন্নোমেত্তরটা খাইয়েছে তো?

প্রীতি বললে–খোকা কি তোমার সেই ছেলে যে খাবে? আমি পাথর বাটিটা দিতেই সে ঠেলে ফেলে দিলে।

চৌধুরী মশাই রেগে গেলেন। বললেন–তা এই সামান্য কাজটুকুও তোমাদের দিয়ে হবে না? এখন বাবাজীকে আমি কী বলি বলো তো?

প্রীতি বললে–তুমি আর কথা বলো না। এতই যদি তোমার ক্ষমতা তো তুমি নিজেই খাওয়াবার ভার নিলে পারতে, দেখতুম তোমার ছেলে কী রকম বাধ্য তোমার! তুমি কি মনে করেছ আমি ওকে খাওয়াবার চেষ্টা করিনি?

প্রকাশ মামা চৌধুরী মশাইকে ঠেলে সেখান থেকে সরিয়ে দিলে। বললে–আপনি যান তো জামাইবাবু এখান থেকে, আপনি যান। আপনি গিয়ে বাবাজীকে দেখুন গে। আমরা এ-দিকটা সামলাচ্ছি, আপনি যান–

চৌধুরী মশাই আর দাঁড়ালেন না। কিন্তু মন থেকে তাঁর দুর্ভাবনাও গেল না। এত সাধ্য সাধনা, এত হোমব্রত, এত পূজো-আস্রা, এত টাকা খরচান্ত, সবই কি তাহলে ব্যর্থ হলো? তাহলে কি ভগবান বলে কেউ নেই?

প্রীতি বললে–হ্যাঁ রে প্রকাশ, শেষকালে হিতে বিপরীত হবে না তো?

প্রকাশ মামা নির্ভয় দিলে। বললে–হিতে-বিপরীত কী হবেটা শুনি? হবেটা কী?

প্রীতি বললে–যদি খোকা বিবাগী হয়ে বেরিয়ে যায়? এখন তো তবু বাড়িতে আসছিল রাত্তিরবেলাটা, এর পর যদি বাড়ি আসাও ছেড়ে দেয়?

–পাগল হয়েছ? বাড়িতে না এলে খাবে কোথায় শুনি? ঘুমোনো যেখানে-সেখানে চলতে পারে, কিন্তু খাওয়া? সেটা কে দেবে ওকে? তোমার ছেলের তো সে ক্ষমতাও নেই যে নিজে রোজগার করে খাবে! তাহলে বাড়ি আসবে না তো যাবে কোথায়? তুমি অত ভাবছো কেন দিদি, আমি তো আছি। এতে ফয়সালা না হয় তো অন্য পথও তো আছে–

–অন্য কী পথ?

প্রকাশ মামা বললে–সে একরকম মাদুলি আছে, সে একেবারে অব্যর্থ–

প্রীতি বললে–হ্যাঁ, মাদুলি পরতে বয়ে গেছে তোর ভাগ্নের। বলে চন্নোমেত্তোরই ফেলে দিলে, সে আবার পরবে মাদুলি!

প্রকাশ মামা বললে–আরে সদা মাদুলি পরবে কেন। মাদুলি পরিয়ে দেব বউমাকে। দেখবে সেই মাদুলি পরিয়ে দিলে সদা একেবারে বউমার পা চাটতে চাটতে পায়ের চামড়া ক্ষইয়ে ফেলবে তবে ছাড়বে-তুমি যদি ফুলশয্যের দিনের ব্যাপারটা আগে বলতে আমি তো সেই ব্যবস্থাই করতুম। তাহলে এই বাবাজীর পেছনে এত খরচান্ত করতেও হতো না—

ভেতর থেকে সদা তখনও দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে–মা, দরজা খুলে দাও, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, দরজা খোল মা…

প্রকাশ মামার মুখ দিয়ে তখন হাসি বেরোচ্ছে। জয়ের হাসি। বাহাদুরি দেখাবার এমন সুযোগ তার বহুদিন আসে নি। যেন সদানন্দর সব রোগের অব্যর্থ ওষুধ সে প্রয়োগ করেছে। এবার রোগী বাঁচবেই।

প্রকাশ দিদির মুখের কাছে মুখ এনে চুপি চুপি বললে–তুমি এবার নিশ্চিন্তে নাক ডাকিয়ে ঘুমোওগে। আর কোনও ভয় নেই। তোমার শরীর খারাপ, তুমি কেন আর কষ্ট করবে–

কিন্তু প্রীতি যেন তখনও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। বললে–শেষকালে উল্টো ফল হবে না তো রে? আমার বাপু ভয় করছে কিন্তু–

–ভয়? প্রকাশ অবাক হয়ে গেল। বললে–আমি রয়েছি তবু তোমার ভয়? তুমি জানো আমি এর চেয়ে বড় বড় কেস মিটিয়ে দিয়েছি, আর তুমি এখনও সন্দেহ করছো?

প্রীতি বললে–আমি বউমার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছি। হাজার হোক বেচারি তো নতুন এসেছে আজ। এই সবে মা মারা গিয়েছে। আর তা ছাড়া বউমাকে তো আগে থেকে সাবধান করে রাখা হয়নি।

প্রকাশ বললে–বর বউ এক ঘরে শোবে তাতে আবার সাবধান করে দেওয়ার কী আছে? মেয়েমানুষের চরিত্র তুমি আমাকে শেখাচ্ছো? তুমি ভাবছো আমি মেয়েদের স্বভাব জানি না? সদা যদি একটু চালাক হয় তো আজকে এই চান্স আর ছাড়বে না। প্রথম দিন যা করেছে তা করেছে, আজকে যদি আবার এ চান্স হাতছাড়া করে তো ওর কপালে অনেক দুঃখু আছে, এই তোমাকে বলে রাখলুম–

প্রীতি বললে–আর কতক্ষণ দরজায় এমনি করে শেকল দিয়ে রাখবি?

প্রকাশ হাসলো। বললে–ঘি যখন গলে যাবে তখনই দরজা খুলে দেব–

–তার মানে?

–তার মানে বুঝলে না তুমি! আগুনের পাশে ঘি রাখলেই তো গলে যায়। আর একটু সবুর করো না, তখন ওই সদা নিজেই ভেতর থেকে দরজায় খিল বন্ধ করে দেবে–আমাকে আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না–

প্রীতি বললে–কী জানি বাপু তোর কী মতলব, তুই থাক, আমি যাই, আমার ঘুম পেয়ে গেছে, আমি আর পারছি নে–

বলে প্রীতি তার নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। চৌধুরী মশাই তার আগেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। তিনিও তখন হাঁ করে ছিলেন সব শোনবার জন্যে। গৃহিণীকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন–কী হলো? ওদিকের কী খবর?

প্রীতি বললে–প্রকাশ রইলো আমি চলে এলুম। আমার ঘুম পেয়ে গেছে–

চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–তা এখনও কি প্রকাশ সেই রকম শেকল দিয়ে রেখেছে নাকি?

–রেখেছে।

–কখন খুলবে?

প্রীতি বললে–কে জানে কখন খুলবে! ছেলের যেমন কাণ্ড! এত ছেলের বিয়ে দেখেছি, এমন কাণ্ড বাপের জন্মে কখনও কারো দেখি নি–এও আমার কপাল!

চৌধুরী মশাই এ-কথার কিছু জবাব দিলেন না। আর কী জবাবই বা তাঁর দেবার ছিল। এমনধারা কাণ্ড তিনিও জীবনে দেখেন নি! লোকের বিয়ে হয়, বর-কনে ফুলশয্যার রাত থেকে এক বিছানায় শোয়, পরের দিন সারা রাত জাগার দরুণ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। তার পরদিন থেকে লোকে কখন রাত হবে কখন আবার বউএর সঙ্গে দেখা হবে সেই আশায় সারাদিন ছটফট করে। তাঁর নিজেরও একদিন বিয়ে হয়েছিল। তিনিও বিয়ের পর তাই-ই করেছেন। এই-ই হলো নিয়ম। এইটেই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। সকলের জীবনে এই-ই তো ঘটে! তা নয়, এ কী অসম্ভব কাণ্ড! এ কথা লোকে জানলে তারাই বা কী ভাববে! বউমার বাবার কানে গেলে তিনিই বা কী ভাববেন! কোথাও কিছু নেই, ঠাকুরদাদা কী দোষ করলো, বাবা কী অপরাধ করলো তাই নিয়ে কোনও ছেলে এমন পাগলামি করেছে এ-কথা কখনও কেউ শুনেছে?

চৌধুরী মশাই গৃহিণীর দিকে ফিরে বললেন–ওগো, শুনছো!

গৃহিণী জেগেই ছিলেন। বললেন–কী?

–বউমাকে বলে দিয়েছ তো যে এ-সব কথা যেন বেয়াই মশাইকে না বলে?

প্রীতি বললে–বলেছি তো। আগেই বলেছি, বার বার এ-সব কথা বলতেও আমার লজ্জা করে। শাশুড়ী হয়ে এসব কথা বউকে বার বার বলতে ভালো লাগে?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা আমারই কি বলতে ভালো লাগে মনে করো? কিন্তু কী করবো বলো? ছেলে যদি এমন বেয়াড়া না হতো আমিই কি ভাবছো এসব নিয়ে আলোচনা করতুম?

প্রীতি বললে–তা তোমাদেরই তো যত দোষ!

–কেন? আমরা আবার কি দোষ করলুম? আমরা মানে কারা?

প্রীতি বললে–তুমি আর তোমার বাবা! তোমরা কাকে ঠকিয়ে টাকা কড়ি-জমি-জমা করবে, কাকে খুন করবে তা ওর মনে লাগবে না? সত্যিই তো, কালীগঞ্জের বউ যেমন মানুষই হোক, জলজ্যান্ত মানুষটা যাবেই বা কোথায়? দারোগা পুলিস এল, তারাই বা কিছু কূল-কিনারা করতে পারলে না কেন? তাদেরও তোমরা টাকা খাইয়ে হাত করবে! তা এখন আমার কী, তোমরাই সামলাও–

চৌধুরী মশাই কথাটাকে চাপা দেবার চেষ্টা করতে গেলেন। বললেন–তুমি আর ও সব নিয়ে মাথা ঘামাতে যেও না।

প্রীতি বললে–কেন? মাথা ঘামাবো না কেন?

চৌধুরী মশাই বললেন–তোমরা মেয়েমানুষ বাড়ির ভেতরে থাকো, বাড়ির বাইরের ব্যাপারে তোমাদের মাথা ঘামাবার দরকারটা কী! জমিদারি-জোতদারির কথায় তোমাদের মেয়েমানুষদের না-থাকাই ভালো।

প্রীতি বললে–ওই মাথা ঘামাতে দাও না বলেই তো আজকে আমার বউমার এই হেনস্থা! মাথা ঘামাতে দিলে আর বাড়ির ভেতরে এই অবস্থা হতো না–

কথাটা চৌধুরী মশাই-এর পছন্দ হলো না। বললেন–তা হলে বলো জমি-জমা বেচে দিয়ে সন্নিসী হয়ে যাই, সন্নিসী হয়ে সংসার-ধর্ম ছেড়ে বনে চলে যাই। তাও তো পারবে না। তাতেও তো তোমার কষ্ট হবে।

প্রীতি বললে–তা সংসার-ধর্ম ছাড়বার কথা আমি কি একবারও বলিচি? রাত-দুপুরে কী যে তুমি সব আজেবাজে কথা বলো–

চৌধুরী মশাই বললেন–এ-সব বাজে কথা হলো? তোমার সঙ্গে দেখছি এসব কথা বলাও পাপ–

প্রীতি বললে–তা বাজে কথা না তো কী! আমি তোমায় সংসার ছেড়ে বনে চলে যেতে একবারও বলিচি?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা হলে কালীগঞ্জের বউ-এর কথা তুমি তুললে কেন? কালীগঞ্জের বউকে কি আমরা খুন করেছি? আর যদি খুনই করতুম তো দারোগা-পুলিস কি তার কোনও কিনারা করতে পারতো না? তারা কি সবাই ঘাস খায়?

তারপর একটু থেমে আবার গলা চড়িয়ে বললেন–আর তা ছাড়া জমিদারির তুমি কী বোঝ শুনি? জমি-জমা করতে গেলে খুন-খারাবি না করলে চলে? তাহলে কাল থেকে তুমিই চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে বসলে পারো, আমি রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকি! দেখি কীরকম জমিদারি চালাও তুমি!

প্রীতি বললে–যাও, তুমি আর কিছু তো পারো না, কেবল ঝগড়া করতেই পারো–

চৌধুরী মশাই বললেন–আমি ভালো কথাই বলছি, আর তোমার কাছে এটা ঝগড়া করা হলো?

–ঝগড়া না তো কী! কোথায় আমি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কথা বলতে এলাম আর তুমি এলে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে! তুমি ঘুমোও না। তোমার কি ঘুমও পায় না? তোমায় কে জেগে থাকতে বলেছে?

চৌধুরী মশাই বললেন বাড়ির মধ্যে ছেলের এই কাণ্ড, এতে কারো ঘুম আসে?

–তা তুমি ঘুমোও আর না-ঘুমোও আমাকে ঘুমোতে দাও। সারা দিন সংসারে খেটে খেটে আমার হাড়-মাস কালো হয়ে গেছে, আমি একটু ঘুমোব, কাল সকালে উঠেই তো আবার আমাকে সংসারের পিণ্ডি রাঁধবার ব্যবস্থা করতে হবে। তখন দানা-পানি না পেলে তো আবার তোমরাই চেঁচাবে

চৌধুরী মশাই বললেন–তোমার শরীর খারাপ, তুমি অত খাটোই বা কেন? তুমি ছাড়া কি আর লোক নেই? গৌরী সারা দিন কী করে? ও তো কেবল নেচে নেচে বেড়ায় দেখেছি। ওকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিতে পারো না? গৌরী রয়েছে, বিষ্টুর মা রয়েছে, লোকের তো তোমার আমি কমতি রাখি নি। তাদের কি কেবল বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবার জন্যে রেখেছি! তারা যদি কিছু কাজই না করে তো তাদের ছাড়িয়ে দাও না। আপদ বিদেয় হোক–

প্রীতি আর পারলে না। বললে–দেখ, যা জানো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। বাইরে থেকে ও-সব অনেক কথা বলা যায়, কথা বলতে তো কারো ট্যাক্স লাগে না, হাতে কলমে করলে তবে ঠ্যালা বুঝবে!

চৌধুরী মশাই বললেন–তা তুমি একদিন রান্নাঘরে না-গিয়েই দেখ না, কাজ ঠিক হয় কি না, কেউ খেতে পায় কি না–

প্রীতি বললে–সে আমি যখন মরে যাবো তখন তোমরাই দেখো। আমি তখন আর দেখতে আসছি নে–

–ওই তো! ওই তোমার এক কথা। যখন তর্কে হেরে যাবে তখন ওই মরার কথা বলা ছাড়া তোমার উপায় নেই–

–তুমি থামো দিকি! তুমি থামো।

বলে রেগে চেঁচিয়ে উঠলো প্রীতি। বললে–আমার সঙ্গে যদি কথা বলতে তোমার এতই খারাপ লাগে তো আমার ঘরে আসো কেন? এখানে না শুয়ে চণ্ডীমণ্ডপে শুলেই পারো। কাল থেকে আমি তোমার সেই ব্যবস্থাই করে দেব–

বলে উল্টো দিকে পাশ ফিরে শুলো। তারপর বললে–আমার এখন কিছু ভাল লাগছে না, আমার ঘুম পেয়ে গেছে, আমি ঘুমোব–

বলে প্রীতি পাশ বালিশটা জড়িয়ে ধরে দু চোখ বুঁজে ঘুমোবার চেষ্টা করলে। চারদিকে নিঝুম। কোথাও কোন শব্দ নেই। নবাবগঞ্জ এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। এই সব অন্ধকার রাত্রে বারোয়ারিতলা থেকে মাঝে মাঝে যাত্রার গানের শব্দ আসে, এবার পূজোর সময় তাদের ‘পাষাণী’ পালা হবে। প্রকাশ বলে গেছে। নিশ্চয় অনেক রাত হয়েছে। প্রীতি দু চোখের পাতা জোর করে খুঁজে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলো। খানিক পরে একসময়ে পাশ থেকে চৌধুরী মশাইএরও নাক ডাকার শব্দ শুরু হলো। অদ্ভুত মানুষটা। বেশ চট করে কথা বলতে বলতে ঘুমোতে পারে। কাজের মধ্যেও মানুষ যে কেমন করে এমন নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে পারে সেইটেই আশ্চর্য। তার মানে মনে কোনও দাগ লাগে না মানুষটার। যেমন সারাদিন নাকে দড়ি দিয়ে খাটবে, তেমনি আবার রাত্রে বিছানায় পড়েই ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোবে। প্রীতিরও যদি ওই রকম হতো তো ভালো হতো। জীবনে কোনও দিন বিছানায় শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এলো না। এও এক রকমের রোগ! রোগ বই কি! নইলে সারাদিন তো ধকল কম যায় নি। যত রাত বাড়বে ততই হাই উঠবে। কিন্তু চোখ দুটো বোঁজার সঙ্গে সঙ্গে যত ঘুম সব যে কোথায় পালিয়ে যাবে ঠিক পাওয়া যাবে না।

তারপর আবার অন্য দিকে পাশ ফিরলো প্রীতি। আবার সেই চোখ বুজে ঘুমের সাধনা। আবার সেই হাজারটা ভাবনা এসে মাথায় ঢোকে। এতক্ষণ খোকা আর বউমা ঘরের মধ্যে কী করছে কে জানে। হয়ত দু’জনের ভাব হয়ে গেছে। এতক্ষণে হয়ত দুজনে কথা বলছে।

আর প্রকাশ?

প্রকাশের কথা মনে আসতেই ঘুমটা যেন আসতে আসতে আরো দূরে পালিয়ে গেল। প্রীতি দু’চোখ খুলে অন্ধকারের মধ্যেই চেয়ে দেখলে। পাশেই চৌধুরী মশাই ওপাশ ফিরে ঘুমে অসাড়। পাশে একজন মানুষ অমন করে অঘোরে ঘুমোলে কি কারো ভালো লাগে? অথচ কাল সকাল থেকেই আবার সংসারের চাকা ঘুরতে আরম্ভ করবে। ভোরবেলা দেখা হলেই গৌরী ভাঁড়ারের চাবি চাইবে। বিষ্টুর মা জিজ্ঞেস করবে কী রান্না হবে। খাবে সবাই-ই কিন্তু কী রান্না হবে তা ভাবতে হবে একা প্রীতিকেই। যেন সংসার তার একারই, আর কারো নয়।

কিন্তু না, প্রকাশের কথাটা মনে পড়লেই প্রীতি বিছানা ছেড়ে উঠলো। জ্বালাতন হয়েছে তার। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে রাত্তিরে যে একটু আরাম করে ঘুমোবে তারও উপায় নেই। গায়ের কাপড় ভালো করে সামলে নিয়ে প্রীতি ঘর থেকে বেরোল।

রাত কত হয়েছে কে জানে! কোনও দিক থেকে কারো কোনও শব্দ আসছে না। প্রীতি আস্তে আস্তে খোকার ঘরের দিকে গেল।

কিন্তু খোকার ঘরের সামনে গিয়ে অবাক। দেখে প্রকাশ সেই ঘরের দরজার সামনে খালি মেঝের ওপর শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে।

প্রীতি ডাকলে–এই প্রকাশ, প্রকাশ–এই প্রকাশ–

প্রকাশের ঘুম নয় তো যেন হাতীর ঘুম। কেউ যদি তাকে কাঁধে করে তুলে নিয়েও যায় তবু তার ঘুম ভাঙবে না।

–এই প্রকাশ, প্রকাশ—

এবার তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ঠেলতে হলো। মোষের মত ঘুমোচ্ছে। তার কাপড় খুলে নিলেও যেন সে টের পাবে না, এমন ঘুম।

ধাক্কা খেয়ে প্রকাশ ধড়মড় করে উঠে বসলো। বললে–কে? কে? কী হয়েছে?

একে ঘুমের জড়তা, তার ওপর মাঝরাত। তারপর একটু যেন জ্ঞান ফিরলো। প্রীতির মুখের দিকে চাইলে। বললে–কী হলো? আমি কোথায়?

প্রীতি বললে–আমি তোর দিদি রে। আমি তোর দিদি কথা বলছি–

দিদির কথা শুনে যেন ধাতস্থ হলো প্রকাশ। বললে–তাই বলো! তা অমন করে ঠেলতে আছে? আমি তো জেগেই ছিলুম। শুধু চোখ দুটো বুজিয়ে রেখেছিলুম আর কি। তা তুমি আবার কেন কষ্ট করে আসতে গেলে? আমি যখন ভার নিয়েছি তখন তুমি অত ভাবছো কেন?

সে-সব কথায় কান না দিয়ে প্রীতি বললে–খোকা আর দরজা ঠেলেছিল? ধাক্কা দিয়েছিল ভেতর থেকে?

–খোকা? সদা? কই, না তো। ধাক্কা দিলে তো আমি শুনতে পেতুম! আমি তো জেগেই আছি–

প্রীতি যেন মনে মনে খুশী হলো।

–তাহলে এতক্ষণে খোকার ভাব হয়ে গেছে বউমার সঙ্গে, কী বল–

প্রকাশ বললে–আরে, তোমাকে তো আমি বলেই রেখেছি যে তোমার কিচ্ছু ভাবনা নেই। যতক্ষণ আমি আছি তুমি গ্যাঁট হয়ে পায়ের ওপর পা দিয়ে চুপ করে বসে থাকো না। আমিই সদার বউ পছন্দ করে দিয়েছি, ওর দায়িত্ব আমারই–

প্রীতি বললে–সে তো আমি জানি রে। কিন্তু তোর জামাইবাবু যে ভেবে ভেবে ছটফট করছে। ও নিজেও ভাবছে, আমাকেও ভাবিয়ে মারছে।

প্রকাশ বললে–কেন যে জামাইবাবু এত ভাবছে। তা বুঝতে পারছি না। তুমি কি বলতে চাও আমি মেয়েমানুষ কখনও দেখি নি, না মেয়েমানুষকে কখনও বিয়ে করি নি? আমার ও তো এককালে বিয়ে হয়েছে গো! আগুনের পাশে ঘি রাখলে কী হয় তা কি আমি জানি না বলতে চাও? তুমিই বলো আগুনের পাশে ঘি রাখলে কী হয়, তুমিই বলো? তোমারও তো বিয়ে হয়েছে–

প্রীতি কিছু বুঝতে পারলে না। প্রকাশ যে কথা বলছে সে তো সোজা হিসেব। কিন্তু সংসারের সব হিসেব যদি অত সোজা হিসেব হতো তাহলে তো আর কোনও ভাবনাই থাকতো না। তাহলে কি আর প্রীতির এত ভাবনা না চৌধুরী মশাই-এরই এত খরচান্ত। চৌধুরী মশাই যে কেমনভাবে দিন কাটাচ্ছেন তা বাইরের কেউ জানতে পারে না। কিন্তু প্রীতি তো মানুষটার যন্ত্রণার কথা আন্দাজ করতে পারে! কর্তাবাবুকে পর্যন্ত এসব ব্যাপার কিছু বলা হয় নি। কর্তাবাবু জানে সকলে যেমন সংসার-ধর্ম করে তাঁর নাতিও তেমনি সংসারধর্ম করে যাচ্ছে। রেল বাজারের কাঞ্চন স্যাকরাকে গয়না গড়াতে দিয়েছে, বউমার ছেলে হলে তাই দিয়ে তার মুখ দেখবেন। কর্তাবাবুর আগ্রহটাই যেন সব চেয়ে বেশি। বউমার ছেলে হলে কর্তাবাবুই সব চেয়ে খুশী হবেন। কিন্তু বাড়িতে যে শাঁখকাঁসর-ঘণ্টা বাজছে তাঁকে সে-সম্বন্ধে কিছুই বলা হয় নি। তিনি ভাবছেন বেহারি পালের বাড়িতে পূজো হচ্ছে। এখন যদি আসল খবরটা তাঁর কানে যায় তখন কী হবে?

প্রকাশ বললে–তুমি ঘুমোত যাও দিদি, তুমি কেন এখানে দাঁড়িয়ে কষ্ট করবে? এই খুপরির মধ্যে–

প্রীতি বললে–আর তুই? তুই আর কতক্ষণ শেকল বন্ধ করে দরজা আগলে থাকবি?

প্রকাশ বললে–কিন্তু দরজার শেকল খুলে দিলে যদি সদা ঘর থেকে পালিয়ে যায়?

প্রীতি বললে–তুই আস্তে আস্তে শেকল খুলে দে না, আওয়াজ না হলেই তো হলো। ও তো আর টের পাচ্ছে না। আর তা ছাড়া খোকা আর বউমা দুজনেই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই

–কী যে তুমি বলো তার ঠিক নেই। এই বলতে গেলে প্রথম ওদের দেখা, আজ রাত্তিরে কখনও ঘুমোয়? আমি তো আমার ফুলশয্যের রাত্তিরে ঘুমোই নি। তুমি ঘুমিয়েছিলে?

প্রীতি সে কথার ধার দিয়ে গেল না। বললে–তাহলে তুই কী করবি? এখেনে সারা রাত বসে থাকবি এমনি করে?

প্রকাশ বললে–রাত তো আর বেশি নেই, ভোর তো হয়ে এল—

তারপর যেন কী ভাবলে। বললে–দাঁড়াও, একটা মতলব বার করেছি। আমি একবার খিড়কির দরজা খুলে বাগানের দিকে যাই; ওখানে গিয়ে সদার ঘরের জানালা যদি খোলা থাকে তো উঁকি মেরে দেখি যে কী করছে তারা–তুমি এখেনে দাঁড়াও–

বলে আর সেখানে দাঁড়ালো না প্রকাশ। বারান্দা পেরিয়ে উঠোন। ভেতরবাড়ির উঠোন। উঠোনে নেমে পশ্চিম দিক দিয়ে বাগানের বেড়ার দরজা। সেই দরজা খুলে ভেতরে বাগান। ভোর হয়-হয়। চাঁদটা ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। গাছ-পালা মাড়িয়ে প্রকাশ একেবারে সদার ঘরের উত্তর দিকের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সেদিকটা ঝোপঝাড়। কলাগাছ, নেবুগাছের ঝাড়। মাথায় কাটা ফুটে রক্তারক্তি হবার মত অবস্থা। গিয়ে দেখলে জানালার পাল্লা দুটো খোলা। টিপি-টিপি পায়ে প্রকাশ মাথা নিচু করে সেখানে গিয়ে উঁকি দিলে। উঁকি দিয়ে দেখে অবাক।

প্রকাশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখলে।

তারপর যে পথ দিয়ে গিয়েছিল আবার সেই পথ দিয়েই উঠোন পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। প্রীতি সেখানেই হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রকাশ আসতেই জিজ্ঞেস করলে– কী রে, কী দেখলি? দেখতে পেলি কিছু? কী করছে ওরা? ঘুমোচ্ছে? ঘুমিয়ে পড়েছে?

প্রকাশ বললে–তুমিও দেখবে এসো না–

–আমি? আমি আবার কী দেখবো?

প্রকাশ বললে–চলো না, তুমি তোমার ছেলের কাণ্ড নিজের চোখেই দেখবে চলো না।

প্রীতি বললে–তুই নিজেই বল না, আমি আবার কী দেখবো?

প্রকাশ নাছোড়বান্দা। বললে–না, তোমার নিজের চোখেই দেখা উচিত, এসো, আমার সঙ্গে এসো। তোমার ছেলের কাণ্ড দেখবে এসো–

বলে প্রকাশ দিদির একটা হাত খপ করে ধরে ফেললে। ধরে টানতে লাগলো। বললে– এসো, এসো, দেখবে এসো–

প্রীতি বললে––ওরে না না, হাত ছাড়, আমি মা হই, আমার দেখতে নেই, আমার দেখা ঠিক নয়–

কিন্তু প্রকাশ দিদির কথা শুনবে, এমন পাত্রই সে নয়। সে দিদির হাত ধরে টানতে লাগলো। টানতে টানতে একেবারে বাগানের ভেতরে নিয়ে গেল। তারপর হাতটা ছেড়ে দিলে। বললে–এবার একটু আস্তে এসো। পা টিপে টিপে এসো। শুকনো পাতা যেন মাড়িয়ে ফেলো না, শব্দ হবে।

প্রীতি আবার একবার আপত্তি করতে যাচ্ছিল। প্রকাশ বললে–না, তোমার ছেলের কীর্তি তোমার নিজের চোখে দেখা ভালো। নইলে আমার মুখ থেকে শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে না। এসো–

প্রীতিও প্রকাশের পেছন পেছন পা টিপে টিপে চলতে লাগলো। উত্তর দিকের দেয়ালের জানালার কাছে এসো প্রকাশ গলা নিচু করে প্রীতির কানের কাছে ফিসফিস্ করে বললে–এইখান দিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে দেখো–

প্রীতির যেন কেমন সঙ্কোচ হলো। বললে–আমি দেখব?

প্রকাশ বললে–হ্যাঁ, দেখ না, চাঁদের আলো ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েছে, সব স্পষ্ট দেখতে পাবে–

প্রীতি বললে–কিন্তু আমি যে মা হই রে, আমাকে দেখতে নেই যে

প্রকাশ বললে–একটু আস্তে কথা বলো না, শুনতে পাবে যে–দেখো এবার ভেতরে উঁকি মেরে দেখ, কিছু অন্যায় হবে না। আমি বলছি তোমার কিছু অন্যায় হবে না–

প্রীতি কী আর করবে। মাথাটা উঁচু করে জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিলে।

দেখে অবাক হয়ে গেল। দেখলে খোকা ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা চেয়ারের ওপর মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। মুখের চেহারাটা যেন মনে হলো গম্ভীর-গম্ভীর। যেন খুব কষ্ট পাচ্ছে মনে মনে। আর খাটের দক্ষিণ দিকে বিছানার একটা কোণের ওপর পেছন ফিরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে বউমা। মাথায় একগলা ঘোমটা। কারো মুখে কোনও সাড়া নেই শব্দ নেই। যেন দুজনেই বোবা।

তা হলে কি সারা রাতই ওরা ওইভাবে রাত কাটিয়েছে নাকি?

প্রীতির দু-চোখ ভরে জল এসে গিয়েছিল। আর দেখতে ভালো লাগলো না। তাড়াতাড়ি জানালা থেকে চোখ নামিয়ে নিলে।

প্রকাশ বললে–কী? কী দেখলে দিদি?

প্রীতি কিছু কথা বললে–না। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল সেই রাস্তা দিয়েই আবার ফিরে চলতে লাগলো। তারপর বাগান পেরিয়ে উঠোনে এসে পড়লো।

প্রকাশও পেছন-পেছন আসছিল। এতক্ষণ সেও কোনও কথা বলে নি। এবারে উঠোনে পড়েই জিজ্ঞেস করলে–দেখলে তো? দেখলে তো তোমার ছেলের কাণ্ড?

তবু প্রীতির মুখে কোনও কথা নেই। সে যেন খানিকক্ষণের জন্যে বোবা হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে বারান্দায় উঠলো।

প্রকাশ বললে–কী হলো? তুমি কথা বলছে না যে?

প্রীতি বললে–আমি আর কী বলবো?

প্রকাশ বললে–কী অদ্ভুত ছেলেই পেটে ধরেছিলে তুমি দিদি! ধিক্ তোমার ছেলেকে, ধিক্‌! আমি এতদিন ধরে চেষ্টা করেও ওকে মানুষ করতে পারলুম না। আমারই লজ্জা হচ্ছে, বুঝলে দিদি। লজ্জা আমারই হচ্ছে, অথচ অত সুন্দরী দেখে ওর বউ এনে দিলুম। আমি জানতুম আগুনের পাশে ঘি রাখলে ঘি গলে জল হয়ে যায়, এ যে দেখছি একেবারে আইস, একেবারে বরফ—

প্রীতি তখনও যেন নিজের মনেই কী ভাবছিল। বললে–আমার মনে হয় ওর বিয়ে না দিলেই ভালো হতো রে। ও তখন আপত্তি করেছিল। কেন যে তখন আমি অত জোর জবরদস্তি করলুম। কী জানি, মা হয়ে ওর ভাল করলুম কি মন্দ করলুম–আর পরের বাড়ির একটা নিরপরাধ মেয়ের জীবনটাও মাঝখান থেকে বোধ হয় নষ্ট করে দিলুম–

প্রকাশ সান্ত্বনা দিলে। বললে–এসো, তুমি ও নিয়ে আর ভেবো না, তোমারও তো আবার কথায় কথায় বুক ধড়ফড় করে। আর ভেবো না তুমি। আমি সব ঠিক করে দেব, আমাকে দেখছি সেই মাদুলিই আনতে হবে–

সত্যিই প্রীতির বুকটার কাছে তখন কেমন ব্যথায় টনটন করছিল। এ রকম প্রায়ই হয় প্রীতির। একটু অনিয়ম হলেই এই রকম হয়। বিয়ের হাঙ্গামে কত দিন ধরে ভালো করে ঘুমই হয় নি। তার ওপর বিয়ের হাঙ্গামা চুকে যাবার পরও অনিয়ম চলছে। হার্টের আর দোষ কী?

প্রীতি বললে–ওরে, ভোর হয়ে এসেছে, এবার তুই শেকলটা খুলে দে–আর কষ্ট দিস নে খোকাকে–

প্রকাশও বুঝলো আর দরজায় শেকল দিয়ে রেখে লাভ নেই।

বললে–খুলে দিই তাহলে?

প্রীতি বললো, খুলে দে।

প্রকাশ বাইরে থেকে চেঁচিয়ে সদার নাম ধরে ডাকলে–সদা-সদা–

বলে শব্দ করে শেকলটা খুলে দিলে। আর খানিক পরেই ভেতর থেকে নিঃশব্দে দরজাটা খুলে বেরিয়ে এল সদানন্দ।

প্রকাশ মামা সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। সদানন্দ তার দিকে একবার চেয়ে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিলে। তারপর প্রকাশ মামাকে পাশ কাটিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল।

প্রকাশ মামা তাকে গিয়ে ধরলে। বললে–কী রে, এত সকালে উঠে পড়লি যে? তুই ঘুমোস নি নাকি?

তাকে দেখে মনে হলো সদানন্দ যেন রাগে ফুলছে। প্রকাশ মামার কথায় কান না দিয়ে যেদিকে যাচ্ছিল সেইদিকেই চলতে লাগলো। প্রকাশ মামা সদানন্দর সামনে গিয়ে তার রাস্তা আটকে দাঁড়ালো।

বললে–কী রে, তুই কি আমার সঙ্গে কথাই বলবি না নাকি? আমার ওপর রাগ করলি কেন? আমি তোর কী করলুম?

সদানন্দ বললে–তুমি ছাড়ো আমাকে–

প্রকাশ মামা বললে–তা ছাড়বো না তো কি তোকে আমি ধরে রাখবো? কিন্তু তোর কী হলো তা আমাকে বলবি তো?

সদানন্দ বললে–তুমি কেন মিছিমিছি আমাকে বিরক্ত করছে প্রকাশ মামা? আমার শরীর খারাপ, কিছু ভালো লাগছে না–

প্রকাশ মামা সদানন্দর সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে বললে–কেন, শরীর খারাপ কেন? রাত্তিরে ঘুম হয় নি?

সদানন্দ রেগে উঠলো। বললে–তোমরা কি আমাকে পাগল করতে চাও প্রকাশ মামা? আমাকে কি তোমরা মেরে ফেলতে চাও? তোমরা কী পেয়েছ আমাকে? আমি পাগল?

প্রকাশ মামা বললে–দূর, তুই পাগল কেন হতে যাবি, তুই যে কাণ্ড করছিস তাতে আমাদেরই পাগল করে ছাড়বি–

সদানন্দ বললে–তার চেয়ে তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও প্রকাশ মামা, আমার যেদিকে দু চোখ যায় সেই দিকেই চলে যাই। আমার কিছু ভালো লাগছে না–

প্রকাশ মামা সদানন্দর পিঠে হাত বুলোতে বুলোত বললে–না না, অমন কাজ করিস নি তুই সদা, তুই লেখাপড়া-জানা ছেলে, পাগলামি করিস নি তুই। কী হয়েছে তাই তুই বল্ আমাকে–

সদানন্দ রেগে গেল। বললে–কাকে কী বলবো? কতবার বলবো? কেউ যদি আমার কথা না শোনে তো আমি কী করবো? কেন তুমি আমাকে বিয়ে করতে বললে প্রকাশ মামা? কেন আমাকে তোমরা মিছিমিছি ধাপ্পা দিলে? কেন তোমরা আমার কথা রাখলে না? কেন তোমরা কালীগঞ্জের বউএর এমন সর্বনাশ করলে? কেন তোমরা তাকে তার দশ হাজার টাকা দিলে না? কেন? কেন দিলে না, কেন?

প্রকাশ মামা বললে–কেন টাকা দিলে না তা তোর দাদু জানে, তোর বউ কী দোষ করলো? তোর দাদুর দোষের জন্যে তুই তা বলে তোর বউএর ওপর প্রতিশোধ নিবি?

ওদিকে প্রীতি তাড়াতাড়ি খোকার ঘরে ঢুকে পড়েছে। ভেতরে ঢুকেই ডাকলে বউমা—

নয়নতারা তখনও খাটের কোণের দিকে ঠায় সেই একই ভাবে বসে ছিল। শাশুড়ীর গলার শব্দে তার ঘোমটাটা যেন একটুখানি কেঁপে উঠলো। কিন্তু তখনই সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। শাশুড়ী যখন সামনে এসে দাঁড়ালো তখন চোখের জলে সব কিছু ঝাপসা হয়ে গিয়েছে।

শাশুড়ী সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে–কী বউমা, কাঁদছো যে? কী হয়েছে?

নয়নতারা তার মাথাটা আরো নিচু করে নিলে। যেন পোড়ামুখ দেখাতেও তার লজ্জা হচ্ছিল।

শাশুড়ী আবার বউমাকে জিজ্ঞেস করলে–কী হলো? কথা বলছো না যে? আজ তো খোকা রাত্তিরে তোমার ঘরে ছিল? আজ তো আর পালিয়ে যায় নি?

তবু নয়নতারার মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরোল না। তার মাথাটা যেন আরো নিচু হয়ে গেল।

প্রীতি এবারে নয়নতারার চিবুকে হাত দিয়ে তার মুখটা নিজের দিকে তুলে ধরলে। নয়নতারা সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় ঘৈন্নায় অপমানে চোখ দুটো বুঁজিয়ে ফেলেছে। কিন্তু চোখ বুঁজলেই কি আর চোখের জলকে আটকানো যায়! সেটা তখন অঝোর ধারায় গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

প্রীতি বললে–আমার কথার জবাব দাও বউমা, আমি জানতে চাইছি আজকে খোকা তোমাকে কী বললে? তোমার সঙ্গে কোনও কথা বলেছে সে?

নয়নতারা মুখে কিছু বললে না। শুধু ঘাড় নেড়ে জানালে—না–

–কোনও কথা বলে নি?

–না।

–তা হলে সমস্ত রাত ঘুমিয়ে কাটালে?

–না।

–সমস্ত রাত জেগে ছিলে? বলো, জবাব দাও? দুজনেই জেগে কাটালে অথচ দুজনের মধ্যে কোনও কথা হলো না মোটে? সেই জন্যেই বুঝি তোমার চোখ দুটো এত ফুলে উঠেছে? একে রাত জাগা তার ওপর সমস্ত রাত কেঁদেছ, চোখ তো ফুলবেই।

তারপর এ সমস্যার কী সমাধান করবে তা ভেবে না পেয়ে প্রীতি বললে–তা হলে তুমি একটু এখন শুয়ে পড় বউমা, একটু ঘুমোবার চেষ্টা করো, ভোর হয়ে এসেছে, আমি বাসি কাপড় বদলে তোমার জন্যে একটু দুধ গরম করে আনতে বলি

বলে প্রীতি চলে যাচ্ছিল। নয়নতারা এবার কথা বলে উঠলো। বললে—মা–

–কী বউমা, আমাকে কিছু বলবে? কী বলতে যাচ্ছিলে, বলো?

নয়নতারা আধ-ফোটা গলায় বললে–আমাকে বাবার কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দিন–

প্রীতি স্তম্ভিত হয়ে গেল বউমার প্রস্তাব শুনে। বললে–ছি বউমা, অমন কথা বলতে নেই, লোকে বলবে কী? তাতে তোমারও নিন্দে হবে, তোমার শ্বশুরবাড়িরও নিন্দে হবে। বলবে চৌধুরী মশাই এমন বউ করেছিল যে সে শ্বশুর-শাশুড়ীকে মানিয়ে চলতে পারলে না। আর তোমার বাবার কথাটা একবার ভাবো তো! সবে তিনি এত বড় একটা শোক সামলে উঠেছেন, এর পরে যদি শোনেন যে তোমারও কপাল ভেঙেছে তা হলে কি আর তিনি বাঁচবেন?

নয়নতারা কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। কিছু উত্তর দিলে না।

প্রীতি বললে–তার চেয়ে তুমি আর কটা দিন সহ্য করো, দেখি আমি কী করতে পারি। আমাকে একটু ভাবতে সময় দাও–

নয়নতারা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে কিন্তু আমি কী অন্যায় করেছি মা, কী এমন অন্যায় করেছি যে, আমাকে এত শাস্তি পেতে হবে? আমাকে তো আপনারা দেখে শুনে পছন্দ করে বউ করে এনেছেন। আমি তো নিজে থেকে যেচে আপনাদের বাড়ি আসি নি যে এমন করে তার প্রতিশোধ নেবেন আমার ওপর–

বলতে বলতে নয়নতারা যেন ভেঙে পড়লো। মনের জ্বালায় হয়তো আরো অনেক কিছু সে বলতো কিন্তু বলতে গিয়ে তার গলাটা কথার মাঝখানেই ঝুঁজে এল।

প্রীতি নয়নতারার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললে–দোষ তুমি কেন করতে যাবে বউমা, সব দোষ আমার আর আমার ছেলের। আমরাই দোষ করেছি। আমার ছেলে বিয়েই করতে চায় নি। তবু তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তা তুমি তার জন্যে ভেবো না বউমা, প্রথম প্রথম অনেক ছেলেই বিয়ে করতে চায় না, কিন্তু শেষকালে তো সবই ঠিক হয়ে যায়। তখন আবার ছেলেমেয়ে হয়ে ঘর একেবারে ভরে যায়। এরকম অনেক দেখেছি আমি। আমাদের সুলতানপুরেই আমি কত দেখেছি। কিন্তু তুমি যেন এ নিয়ে এখন সাতকান কোর না। কথাটা যদি একবার পাড়ার লোকের কানে যায় তো আর রক্ষে থাকবে না। তখন গাঁয়ে এই নিয়ে ঢি-ঢি পড়ে যাবে একেবারে–

হঠাৎ বাইরে থেকে ডাক এলো—বউদি–

প্রীতি বললে–ওই গৌরী ডাকছে, এখনই বিষ্টুর মা রান্নাঘরে ঢুকবে, গৌরী ভাঁড়ারের চাবি চাইতে এসেছে। আমি এখনই আসছি, উনুনে আগুন দিলেই তোমার জন্যে একটি গরম দুধ নিয়ে আসছি। সারারাত জেগে আছো, শরীরটা একটু সুস্থ হবে–

বলে বাইরে চলে গেল প্রীতি।

.

কিন্তু সেই সেদিন থেকেই যেন শনির দৃষ্টি পড়লো চৌধুরী বংশের ওপর। সেই যেদিন কালীগঞ্জের বউ এসেছিল নতুন বউ-এর মুখ দেখতে সেই দিন থেকে। রানাঘাট থেকে লোক এসে খবর দিয়ে গেল যে, উকিলবাবু খবর দিয়েছেন কোর্টে আর একটা মামলা উঠেছে। চৌধুরী মশাইকে একবার সেখানে যেতে হবে।

জমি-জমা থাকলেই অবশ্য মামলা-মোকর্দমা থাকবে। কথাটা তা নয়। কিন্তু এটা বড় জটিল মামলা। উকিলবাবুর চিঠিটা দুদিন আগেই এসেছিল। চৌধুরী মশাই ভেবেছিলেন বউমা কেষ্টনগর থেকে আসার পর ছেলের কী মতিগতি হয় তা দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে রানাঘাটে যাবেন। বাবাজীকেও তাই বলেছিলেন। বাবাজী বলেছিলেন–তুই নিশ্চিন্ত থাক, আমি তো রইলুম–আমি সব ঠিক করে দেব–

চৌধুরী মশাই বলেছিলেন–কিন্তু আপনার দিগ্বন্ধনের কিছু ফল দেখে না গেলে বড় ভয় করছে বাবাজী, জানেনই তো আমার ওই একমাত্র সন্তান, ওই একই ছেলে। যদি কিছু উল্টো ফল হয় তো তখন বড় মুশকিলে পড়বো। এখনও পর্যন্ত বাবাকে কিছুই বলা হয় নি।

–না বলেছিস ভালো করেছিস। গুহ্য কথা কাউকে বলতে নেই—

আগের দিনই এই সব কথা হয়ে গিয়েছে। পরের দিন যখন ঘুম থেকে উঠলেন তখন দেখলেন বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। তিনি মস্ত বড় বিছানায় একলাই শুয়ে আছে, পাশে কেউ নেই। ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। ঘরের বাইরে এসে দেখলেন ভেতর বাড়িতে সেদিনকার কাজকর্ম সব শুরু হয়ে গিয়েছে। গৃহিণীর দেখা পাবার জন্যে একবার রান্না বাড়ির দিকে উঁকি দিলেন। সেখানেও তিনি নেই।

কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। ফিরেই যাচ্ছিলেন। তারপর চলে গেলেন কুয়োতলার দিকে। কদিন আগেই বাড়িতে বিয়ে হয়ে গেছে। বড় বড় গর্ত খুঁড়ে ভিয়েনের উনুন তৈরী করা হয়েছিল। সে উনুন আর কাজে লাগবে না। পোড়ামাটির ভাঙা ঢ্যালাগুলো তখনও জমা হয়ে রয়েছে সেখানে। কুয়োতলার পাশে মুখ-হাত-পা ধোবার বড় বড় মাটির জালা রাখা ছিল। সেখান থেকে জল নিলেন। একটু পরেই রোজকার কাজকর্ম শুরু হয়ে যাবে। তখন আসবে কৃষাণ, কয়াল, প্রজা-পাঠক। তখন চৌধুরীদের বারবাড়ি একেবারে গম্-গম্ করে উঠবে। বিধু কয়ালের ছেলে শশী কয়াল সেই নিয়মমত সরষে ঝাড়তে বসবে। মাঠ থেকে সরষে গাছগুলো এনে গোবর-দেওয়া উঠোনের ওপর ছড়িয়ে রেখেছে। গোছ-গোছ শুকনো সরষে গাছের আঁটি। সেগুলোকে ঝাড়তে হবে মাড়তে হবে। তারপর দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে মেপে মেপে মরাইতে তুলবে। রজব আলিও আসবে দামড়া দুটোর তদারক করতে। তাদের খাওয়ানো তাদের সেবা-শুশ্রূষার ভারও তার ওপর। তারপর যেদিন চৌধুরী মশাই সদরে যাবেন সেদিন ভোর থেকেই গরুর গাড়ির চাকায় রেড়ির তেল মাখাবে। গাড়ির ছইটা ঝাড়বে মুছবে। পাতবার শতরঞ্জিটা পুকুরে নিয়ে গিয়ে কেচে রোদে শুকোতে দেবে। শুধু শশী কয়াল, রজব আলিই নয়, হাজারটা লোকের হাজার রকম কাজের বরাদ্দ। সবাই কাজ করছে কিনা তার তদারক করার কাজ চৌধুরী মশাই-এর। এই এতগুলো লোক ঠিকমত কাজ করলেই তবে চৌধুরী বংশের সংসার যন্ত্রের চাকা নিয়ম করে ঘুরবে।

গৌরী তখন রান্নাবাড়ির দিক থেকে আসছিল। তারও সকাল বেলা থেকে ফুরসৎ নেই। চৌধুরী মশাইকে ভেতর বাড়িতে আসতে দেখে একটু পাশ দিচ্ছিল। চৌধুরী মশাই তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন–হ্যাঁ রে, তোর বৌদি কোথায়?

প্রীতিও সেই সময়ে ছেলের ঘর থেকে দুধের বাটি হাতে নিয়ে এই দিকে আসছিল।

বললে–কী হলো, তুমি ঘুম থেকে উঠেছ?

চৌধুরী মশাই কাছে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন–বউমার কী খবর?

প্রীতি বললে–এই তো বউমার কাছ থেকে আসছি। একটু গরম দুধ খাইয়ে এলুম–

–আর খোকা? খোকা কোথায়?

প্রীতি বললে–সারা রাত নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে এখন তোমার খোকার কথা মনে পড়লো?

চৌধুরী মশাই বললেন কী জানি কেন, কালকে খুব ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। কেন যে এত ঘুমিয়ে পড়লুম হঠাৎ কে জানে!

প্রীতি বললে–কবে তুমি ঘুমোও না বলো তো? তুমি তো চিরকাল বিছানায় শুলেই নাক ডাকাও। তোমার মতন অমন ঘুম হলে আমি বেঁচে যেতুম। সরো, আমার কাজ আছে–

চৌধুরী মশাই বললেন–কাজ তো আমারও আছে, কিন্তু কালকে কী হলো তা তো আমাকে বললে না। খোকাকে তো শেকল দিয়ে গিয়েছিলে বাইরে থেকে, শেষকালে প্রকাশ শেকল খুলে দিয়েছিল নাকি?

প্রীতি বললে–এখন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার সঙ্গে অত কথা বলবার সময় নেই। বলছি যে আমার কাজ আছে—

চৌধুরী মশাই বললেন–কাজ কি আমারই নেই? আমাকে আবার একবার রানাঘাটে যেতে হবে। উকিলবাবুর জরুরী চিঠি আছে। তা বলে আমার কথার জবাব দিতে আর কতক্ষণ সময় লাগে! জবাব দেবে না তাই-ই বলো!

প্রীতি বললে–তা তোমার কথার জবাব দিতে গেলে আমার সংসার চলবে? আর জবাব দিয়েই বা কী করবো? তোমাকে দিয়ে তো আমার কাজের কোনও সুরাহা হবে না–

–তার মানে? এ যেমন তোমার সংসার তেমনি তো আমারও সংসার। এ সংসারের ভালোমন্দ কি আমিও ভাবি না?

প্রীতি বললে–অত চেঁচিও না, একে তো লজ্জায় বউমার কাছে আমার মাথা হেঁট হয়ে গেছে, তার ওপরে তুমি আমার মাথাটা আরো হেঁট করে দিও না। আমি বলে সারারাত ঘুমোই নি, এমনিতেই আমার বুক ধড়ফড় করছে, তার ওপরে তোমার বাক্যবাণ আমি আর সইতে পারছি না–

চৌধুরী মশাই বললেন–তোমার শরীরের কথা ভেবেই তো আমি জিজ্ঞেস করছি কাল রাত্তিরে কী হলো, তা তুমি অত মেজাজ গরম করবে তা জানলে আর ভেতরবাড়িতে আসতুম না–

প্রীতি বললে–আমার শরীরের জন্যে যেন ভেবে ভেবে তোমার ঘুম হচ্ছে না–

–বেশ, আমার কথা বিশ্বাস না করলে আমি নাচার, কিন্তু এখনই তো বাবাজীর কাছে যাবো, যখন তিনি জিজ্ঞেস করবেন তখন তো বলতে হবে কিছু–

প্রীতি বলে–তাঁর মন্তরে কোনও কাজ হয় নি-আর কাজ হবেও না–

–কেন? কাজ হয় নি কেন?

প্রীতি বললে–তা কাজ হলে আমার এই হেনস্তা? এই সক্কালবেলা বউমাকে গিয়ে গরম দুধ খাইয়ে আসি? কোথায় বউ আমার সেবা করবে, না আমি বউ-এর সেবা করে করে মরছি। আমারও যেমন কপাল–

চৌধুরী মশাই বললেন–তা প্রকাশ কি ঘরের শেকল খুলে দিয়েছিল রাত্তিরে বেলা? খোকা পালিয়ে গেল কী করে?

প্রীতি বললে–শেকল খুলে দেবে কেন? ঘরের মধ্যেই দুজনে মুখ ফিরিয়ে বসে রাত কাটিয়েছে।

–সমস্ত রাত?

প্রীতি বললে–হ্যাঁ, সমস্ত রাত। তাই জানতে পেরেই তো আমার এত হেনস্তা। এমন ছেলে আমি বাপের জন্মে কখনও দেখি নি! বউমা তো তাই বলছিল তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে–

–কেন?

প্রীতি বললে–তা বউমার দোষ কী? তোমার ছেলে অমন করে তাকে অপমান করবে, তার দিকে ফিরে তাকাবে না, তাকে দেখলেই ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাবে, একঘরে থাকলেও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকবে, তাতে তার কষ্ট হয় না? এতটুকু আত্মসম্মান-জ্ঞান থাকলে কোনও মেয়েমানুষ তা সহ্য করতে পারে? আমার তো ভয় হচ্ছে বউমা শেষকালে কোনও কাণ্ড না বাধিয়ে বসে!

কী কাণ্ড বাধাবে?

–আরে মেয়েদের মনের হিসেব তোমরা পুরুষমানুষরা কী করে বুঝবে? আমি ভাবছি শেষকালে আত্মঘাতী না হয়! শেষকালে গলায় দড়িটরি দিয়ে একটা কেলেঙ্কারি না করে বসে!

এতক্ষণে যেন চৌধুরী মশাই-এর হুঁশ হলো।

বললেন–কেন? খুব কাঁদছে নাকি বউমা? কিছু বলছে?

–তা বলবে না? এই সবে দুদিন আগে একটা শোক পেয়েছে, তারপর তোমার ছেলের এই কাণ্ড, এর পর যদি কিছু বলেই তো আমি তার মুখ বন্ধ করতে পারবো?

–তা বলো না, বউমা কী বলছিল, বলো না?

–বলবে আবার কী! দুঃখের জ্বালায় বলছিল যে আমরা তাকে দেখে শুনে পছন্দ করে নিয়ে এসেছি, সে তো নিজে থেকে আসে নি, তাহলে কেন তার ওপর আমরা এত প্রতিশোধ নিচ্ছি–সে কী দোষ করেছে!

–তা তুমি কী বললে–তার জবাবে?

প্রীতি বললে–এ কথায় আমার কী জবাব থাকতে পারে বলে দিকিনি। আমিও তো মেয়েমানুষ। আমি নিজে মেয়েমানুষ হয়ে মেয়েমানুষের দুঃখ যদি না বুঝি তো কি তুমি বুঝবে, না তোমার ছেলে বুঝবে?

–তারপর?

প্রীতি বললে–তারপর আর কী, তারপর কেবল কাঁদতে লাগলো হাউহাউ করে। তা আমি আর কী করবো, আমারও খুব কষ্ট হলো দেখে। আমিও খানিক কাঁদলুম। বেচারী সারারাত ঠায় একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল কেঁদেছে আর জেগে কাটিয়েছে। তাই এখন একটু গরম দুধ খাইয়ে দিয়ে এলুম–

–আর খোকা? খোকা কোথায় গেল? সে—

হঠাৎ কানে এল বার বাড়ি থেকে যেন একটা কী আওয়াজ এল। যেন গোলমালের আওয়াজ। কান খাড়া করলেন চৌধুরী মশাই। বললেন–ও কীসের গোলমাল?

অনেকক্ষণ শব্দটা শুনলেন তবু কিছু বুঝতে পারলেন না। প্রীতির তখন অত সব বাজে কথা শোনবার সময় নেই। এত বড় সংসারের সব লোকের সমস্ত দাবি তার মুখের দিকেই হাঁ করে চেয়ে আছে। সারারাত তার ঘুম হোক আর নাই হোক তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। সকলেরই এক কথা : আমার দাবি মেটাতে হবে। কোথা থেকে টাকা আসছে, কে উপার্জন করছে, তা যাচাই করবার দায়িত্ব আমার নেই। আমি শুধু ঠিক সময়ে মাইনে পেলেই হলো আর খেতে পেলেই হলো। আমরা শুধু নেব, তোমার দেবার শক্তি-সামর্থ আছে কিনা সে তোমার বিবেচ্য। অথচ পান থেকে চুন খসলেই আমি তোমাকে দায়ী করবো। নইলে তুমি এ বাড়ির গিন্নী হয়েছিলে কেন?

চৌধুরী মশাই আর দাঁড়ালেন না সেখানে। তাড়াতাড়ি ভেতরবাড়ি পেরিয়ে সোজা গিয়ে বারবাড়িতে পড়লেন। ততক্ষণ আওয়াজটা স্পষ্ট কানে আসছে–

তারপর মনে হলো এ যেন খোকার গলার আওয়াজ–

বার বাড়ির মুখেই একটা বড় ঘরে বাবাজীর থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেই ঘরের ভেতরে বসেই বাবাজীর পূজো-আস্রা-সেবা যা-কিছু সব হতো। আওয়াজটা সেই ঘরের দিক থেকেই আসছে। সেখানে যাবার পথেই দেখলেন, চণ্ডীমণ্ডপ থেকে উঠোন থেকে নানা দিক থেকে কৌতূহলী লোকজন বাবাজীর ঘরের দিকে আসছে।

–এই শশী, কী হচ্ছে রে ওখানে?

শশী দাঁড়িয়ে পড়লো। বললে–কী জানি ছোটবাবু, আমি তো তাই জানতেই যাচ্ছি–

দীনু ভেতর দিক থেকে দৌড়ে বাইরে আসছিল।

তাকেও জিজ্ঞেস করলেন–চৌধুরী মশাই–কী হচ্চে রে ওখানে? কীসের গোলমাল?

–আজ্ঞে আপনাকে ডাকতেই যাচ্ছিলুম, খোকাবাবু বাবাজীকে মারছে—

–খোকাবাবু!

যেন বজ্রপাত হলো চৌধুরী মশাই-এর মাথায়। বললেন–কেন? মারছে কেন?

দীনু বললে–আজ্ঞে আমি তো তা জানি নে, শব্দ শুনে দৌড়ে এসে কাণ্ড দেখলুম। দেখেই আপনাকে ডাকতে যাচ্ছিলুম–

সমস্ত জিনিসটা এতক্ষণে যেন চৌধুরী মশাই আন্দাজ করতে পারলেন। তারপর বাবাজীর ঘরের দিকেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু যেতে গিয়েও থেমে গেলেন। পেছন ফিরে বললেন–হ্যাঁ রে, কর্তাবাবু কী করছে?

–আজ্ঞে তিনি তো ভোরবেলাই ঘুম থেকে উঠেছেন। এখন পুজোয় বসেছেন।

–এই গোলমাল কানে গেছে নাকি?

–তা জানি নে। আমি এখন গেলে জানতে পারবো। এখনও গোমস্তা মশাই আসেন নি–

চৌধুরী মশাই বললেন–তা হলে তুই কর্তাবাবুর কাছে গিয়ে তাঁকে সামলে রাখ। যদি জিজ্ঞেস করেন নিচেয় কীসের গোলমাল তাহলে যেন কিছছু বলিস নে! বলবি বেহারি পালের বাড়িতে ঝগড়া হচ্ছে–

বলে আর দাঁড়ালেন না। দৌড়তে দৌড়তে এক লাফে গিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছেন। চৌধুরী মশাইকে দেখে রাস্তা করে দিলে সবাই। ঘরের ভেতরে তখন তুমুল কাণ্ড। চৌধুরী মশাই ঘরে ঢুকে দেখেন সদানন্দ এক হাতে বাবাজীর মোটা মোটা জটাগুলো পাকিয়ে ধরেছে, আর এক হাতে বাবাজীর সিঁদুর-মাখা ত্রিশূলটা ধরে তাঁর দিকে তাগ করে আছে।

বলছে–আর করবি তুই? আর এমন করবি কখনো?

বাবাজীও নাচার হয়ে বলেছেন–আমাকে ছাড়ুন বাবা, আমাকে ছাড়ুন।

সদানন্দর শক্ত মুঠির তেজ, অত বড় দশাসই বাবাজী যেন একেবারে ভয়ে কুঁকড়ে গেছেন।

চৌধুরী মশাই আর থাকতে পারলেন না। ঘরে ঢুকেই বাবাজীর ত্রিশূলটা সদানন্দর হাত থেকে কেড়ে নিতে গেলেন। কিন্তু সদানন্দর গায়েও যেন অসুরের শক্তি। সেও আটকে ধরেছে সেটা।

চৌধুরী মশাই বললেন কী হচ্ছে কী খোকা? ছাড়ো, এটা ছাড়ো–

–আমি ছাড়বো না। আপনি কেন বাধা দিচ্ছেন? ছেড়ে দিন—

চৌধুরী মশাইও ছাড়বেন না, সদানন্দও ধরে থাকবে।

–ছাড়ো, ছাড়ো—

সদানন্দ গলা চড়িয়ে বলে উঠলো–না ছাড়বো না-আমি বুজরুকটাকে খুন করে ফেলবো–

এতক্ষণে চৌধুরী মশাই-এর নজরে পড়লো একপাশে প্রকাশ মামা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। চৌধুরী মশাই তার দিকে চেয়ে তাকে ধমকে উঠলেন। বললেন–তুমি এখেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছো, খোকার হাত থেকে ত্রিশূলটা কেড়ে নিতে পারছো না?

প্রকাশ বললে–আজ্ঞে জামাইবাবু, আমি তো তখন থেকে সদাকে তাই বলছি। বাবাজী কী দোষ করলেন? বাবাজীর তো কিছুই দোষ নেই। তা ও কিছুতেই আমার কথা শুনছে না, আমি কী করব?

চৌধুরী মশাই বললেন–তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া। তোমার জন্যেই তো যত গণ্ডগোল হয়েছে

প্রকাশ মামা যেন আকাশ থেকে পড়লো। বললে–আমি? আমিই যত নষ্টের গোড়া? সদা দোষ করলো, আর দোষ পড়লো আমার মাথায়?

–তা দেখছ ত্রিশূলটা দিয়ে খোকা মানুষ খুন করতে যাচ্ছে আর তুমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছো? এতখানি বয়েস হলো, আর তোমার এতটুকু আক্কেল হলো না? তারপর সদানন্দর দিকে চেয়ে বললেন–এখনও ছাড়ছে না, ছাড়ো বলছি–

–আমি ছাড়বো না।

বলে পাথরের মত কঠোর হয়ে সদানন্দ বাবাজীর মাথার জটগুলো আরো জোরে ধরে রইল।

বাবাজী তখন মাথার যন্ত্রনায় ছটফট করছেন। বলছে–ছেড়ে দিন বাবা, ছেড়ে দিন, আমি তো আপনার ভালো করবার চেষ্টাই করেছি। আমি আপনার মঙ্গলই চাই—

সদানন্দ চিৎকার করে বলে উঠলো–দরকার নেই তোর মঙ্গল করে, তুই আগে এ বাড়ি থেকে বিদেয় হ—

এর জবাব দিলেন চৌধুরী মশাই। বললেন–কেন, বিদেয় হবেন কেন? বাবাজীকে বিদেয় করবার তুমি কে শুনি? বাবাজীকে আমি এবাড়িতে ডেকে এনে তুলেছি, উনি তো নিজের থেকে আসেন নি, এবাড়ির মালিক আমি, ওকে বিদেয় করতে হয় তো আমি বিদেয় করবো, তুমি কে?

সদানন্দ বললে–কিন্তু ও কেন আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসে?

–কেন? উনি কী করেছেন তোমার? উনি তো আমাদের সকলের মঙ্গল কামনাই করেন।

–না, আমি কী করিনা করি তা দেখবার দরকার কী ওর? আমি রাত্তিরে বাড়িতে শুয়েছিলুম কিনা তা জানবার কীসের দরকার পড়েছে?

–তা গুরুজনরা জিজ্ঞেস করেন না? জিজ্ঞেস করেছেন তো ভালো কাজই করেছেন।

সদানন্দ বললে–ও কি আমার গুরুজন বলতে চান আপনি? একটা বুজরুক ঠগ জোচ্চোর হবে আমার গুরুজন, আর ও যা বলবে আমি তাই মানবো?

–কেন মানবে না? তোমাকে মানতেই হবে ওঁর কথা। উনি যখন আমার গুরুজন, তুমিও যখন আমার ছেলে তখন উনি তোমারও গুরুজন। ছাড়ো, ওঁর জটা ছেড়ে দাও, ত্রিশূল ছেড়ে দাও, ছেড়ে দিয়ে ওঁকে প্রণাম করো–

সদানন্দ যেন চৌধুরী মশাই-এর কথার প্রতিবাদেই বাবাজীর জটা ধরে আরো জোরে টান দিলে। বললে–আমি ওকে আজ বাড়ি থেকে বিদেয় করবো তবে ছাড়বো–

–কী, এত বড় আস্পর্ধা তোমার? তুমি আমার মুখের ওপর কথা বলো?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ কথা বলবো, আলবৎ বলবো–

–খবরদার!

চৌধুরী মশাই রাগে গরগর করতে লাগলেন। তার গলার আওয়াজে সমস্ত ঘরখানা যেন থর-থর করে কেঁপে উঠলো।

প্রকাশ আর থাকতে পারলে না। এতক্ষণ জামাইবাবুর সামনে সে বেশি কথা বলে নি। এবার যখন দেখলে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়েছে তখন সদানন্দর দিকে এগিয়ে গেল। বললে–এই সদা, করছিস কী? তোর কি জ্ঞান-গম্যি কিচ্ছু নেই? কার সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তাও জানিস না?

–তুমি থামো প্রকাশ মামা!

–পাগল না কী তুই?

চৌধুরী মশাই সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রকাশকে বললেন–তুমি সরো, আমি দেখছি–

বলে প্রকাশকে জোরে পাশে ঠেলে দিলেন। প্রকাশ ঘরের মেঝের ওপর গিয়ে ছিটকে পড়লো। কে একজন তাকে ধরে তুলতে এল। প্রকাশ রেগে গেল। বললে–যা, সরে যা, কে তুই? আমাকে তুলতে হবে না, আমি নিজেই উঠবো, যা

কিন্তু উঠতে গিয়েই আবার পড়ে গেল। মাথায় খুবই লেগেছিল বোধ হয়। মাথা দিয়ে তখন তার রক্ত পড়ছে।

কিন্তু সেদিকে তখন চৌধুরী মশাই এর খেয়াল নেই। তিনি তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সদানন্দর ওপর। সদানন্দর হাত থেকে বাবাজীকে ছাড়িয়ে নিয়ে ত্রিশূলটাও কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। তারপর সদানন্দকে দুই হাতে ধরে ফেলেছেন।

বললেন–চলো, চলো, ভেতরে চলো—

সদানন্দ তখন চেঁচিয়ে উঠেছে–আমি যাবো না, আমি কিছুতেই যাবো না—

চৌধুরী মশাই জোরে চিৎকার করে ডাকলেন–দীনু, দীনু–

দীনু কাছে দাঁড়িয়েই ভয়ে ভয়ে সব দেখছিল এতক্ষণ। ছোটবাবুর ডাক শুনেই দৌড়ে এল।

চৌধুরী মশাই বললেন–খোকাবাবুকে ধর তো– খোকাবাবুকে ধরতে যেন সঙ্কোচ হচ্ছিল তার। ধরতে গিয়েও যেন আড়ষ্ট হয়ে রইল।

চৌধুরী মশাই ধমক দিলেন। বললেন–হাঁ করে দেখছিস কী? ধর একে, ধরে টেনে নিয়ে আয়, আমি আজ একে আটকে রেখে দেব ঘরের ভেতরে। আমি জব্দ করবো একে, বড় বাড় বেড়েছে এ–

বলে আর কারো ভরসা না করে নিজেই সদানন্দকে টানতে টানতে ভেতর বাড়ির দিকে নিয়ে চললেন। আশেপাশে যারা কাণ্ড দেখতে এসেছিল তারা তখন আড়ালে লুকিয়েছে। আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখছিল।

চৌধুরী মশাই তাদের দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠলেন–বেরো সব এখান থেকে বেরো, বেরিয়ে যা

সবাই হুড়মুড় করে যে-যেদিকে পারলে পালিয়ে বাঁচল। সদানন্দ তখন ছটফট করছে ছাড়া পাবার জন্যে। বলছে-আমি যাবো না, আমাকে ছেড়ে দিন–

কিন্তু চৌধুরী মশাই-এর গায়ে যেন তখন অসুরের শক্তি নেমে এসেছে। তিনি সদানন্দকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে একেবারে ভেতর বাড়িতে একটা ঘরে পুরে দিলেন। তারপর ডাকলেন–গৌরী—গৌরী–

গৌরী আসবার আগে প্রীতি দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির। বললে–কী করছ, খোকাকে ধরেছ কেন? খোকা কী করেছে?

–সে তোমাকে পরে বলবো, গৌরী কোথায়?

গৌরী পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে চেয়ে বললেন–একটা তালা-চাবি নিয়ে আয় তো–

গৌরী তালা-চাবি এনে দিতেই সদানন্দকে ঘরে পুরে দরজায় চাবি বন্ধ করে দিলেন চৌধুরী মশাই। বললেন–থাকুক এখানে পড়ে, যেমন ব্যবহার তেমনি জব্দ হোক—

প্রীতি তখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। বললে–তুমি করছো কী? বাড়িতে নতুন বউ রয়েছে, তুমি এ কী করছো?

চৌধুরী মশাই সেকথায় কান না দিয়ে বললেন–সে তুমি বুঝবে না, ওদিকে উকিলবাবুর চিঠি এসেছে, আমার মামলার তারিখ পড়েছে, আর এদিকে ছেলের এই বেয়াড়াপানা, আমি কত সহ্য করবো? আমিও তো মানুষ, আমারও তো একটা সহ্যের ক্ষমতা আছে.

প্রীতি কী যেন বলতে যচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বাধা পড়লো। কৈলাস গেমস্তা দৌড়তে দৌড়তে এলো।

–ছোটবাবু!

–কী?

চৌধুরী মশাই অবাক হয়ে গেছেন। এ-সময়ে আবার কৈলাস এলো কেন? কৈলাস বললে–কর্তাবাবু কেমন করছেন! আপনাকে একবার ডাকছেন।

–কর্তাবাবু? কর্তাবাবু কি এই খবর পেয়েছেন নাকি?

–হ্যাঁ।

–কে এ খবর দিলে কর্তাবাবুকে? আমি যে দীনুকে বলে দিলুম যেন কর্তাবাবুর কানে খবরটা না পৌঁছোয়, তবু কে তাঁর কানে দিলে?

–বেহারি পাল মশাই।

চৌধুরী মশাই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বেহারি পালের আর সময় নেই, ঠিক এই সময়েই কিনা আসতে হয়!

চৌধুরী মশাই তখন চাবিটা নিজের ট্যাঁকে গুঁজে ফেলেছেন। বললেন–চলো কৈলাস, চলো—

.

সদানন্দের মনে আছে বাড়িতে তখন সে কী বিশৃঙ্খলা! যে বাড়িতে এতদিন সব কাজ নিয়ম করে চলেছে, যে বাড়িতে সকাল থেকে সবাই নিয়ম মেনে চলেছে, সেই বাড়িতেই যেন হঠাৎ এক অরাজক অবস্থা নেমে এল। একদিকে কর্তাবাবুর অসুখ, অন্যদিকে মামলা আর বাড়ির ভেতরে তখন বেনিয়ম। অথচ সমস্ত কিছুর পেছনে সদানন্দ। তার সামান্য একটু অসহযোগিতার জন্যে এতদিনের সব অইনকানুন যেন একেবারে ভেঙে-চুরে তছনছ হয়ে গেল।

এমনই হয়। সত্যিই এমনি হয়। কারণ সবাই তো সংসারের নিয়মের সঙ্গেই নিজেকে মানিয়ে নেয়। সংসারের সঙ্গে আপস করে চলেই সবাই সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারলে বর্তে যায়। কিন্তু এমন লোকও সংসারে জন্মায় যারা সংসারের নিয়মের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে না চলে সংসারকেই নিজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। লোকে এদেরই বলে বেহিসেবী। অথচ এই বেহিসেবী লোকগুলোর জন্যেই আমাদের এই পৃথিবীটা এগিয়ে চলে। তাদের অমানুষিক কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়েই পরবর্তী যুগের মানুষ অনেক অনাচার আর অনেক অত্যাচারের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে বাঁচে।

সদানন্দও বোধ হয় এমনি এক বেহিসেবী মানুষ!

নইলে বেশ তো ছিল সে। তার পূর্বপুরুষের পাপের কৈফিয়ৎ তো কেউ তার কাছে চাইতে যায় নি। কেউ তো বলে নি তুমি প্রায়শ্চিত্ত করো। কেউ তো তাকে বলে নি, তুমি তোমার পূর্বপুরুষের সব কলঙ্ক নিজের আত্মাহুতির প্রলেপে মুছে ফেল। কেউ তো বলে নি তোমার জন্মতাদার সব অপরাধের উত্তরাধিকারী তুমি। আর তুমিই তার প্রায়শ্চিত্ত করবার একমাত্র হকদার।

বেহারি পাল প্রথমে বুঝতে পারে নি। কিন্তু খবরটা কানে পৌঁছুল তার গিন্নির মারফত। পাশাপাশি বাড়ি। এ বাড়ির চিলেকোঠায় বেড়াল এসে বসলে ওবাড়ির বেড়াল রাগে গোঁ-গোঁ করে। সেই বেহারি পালের কানে গেল খবরটা।

গিন্নী বললে–ছি ছি ছি, আমার বাপের জন্মেও এমন কাণ্ড কখনও শুনি নি মা–

বেহারী পালের কৌতূহল আরো বেড়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–তা খবরটা তুমি কার কাছে শুনলে?

–ওই বিষ্টুর মা। বিষ্টুর মার সঙ্গে যে আমার ঘাটে দেখা হল। মাগী বদমাইশ হলে কী হবে, মানুষটার মনটা ভালো।

–কী রকম?

গিন্নী বললে–ওই মাগীই তো বললে–ওদের নতুন বউএর সঙ্গে নাকি চৌধুরী মশাই এর ছেলে একঘরে এক বিছানায় শোয় না। আমার তো শুনে বিশ্বাস হলো না। বিষ্ঠুর মা বললে–বউটা নাকি নষ্টা–

–সে কী?

এ-খবর ক’ দিন থেকেই বেহারি পালের কানে যাচ্ছিল। বেহারি পাল মশাই নিজের কাজকর্ম করে, আর চৌধুরী বাড়ি থেকে কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজও শোনে। কিন্তু কারণটা এতদিনেও বুঝতে পারতো না। এবার যেন সেটা একটু স্পষ্ট হলো। বুঝতে পারলে চৌধুরী মশাইএর বংশের মেরুদণ্ডেই ঘুণ ধরেছে। এইবার জব্দ হবে বুড়ো। এইবার মচকাবে কর্তাবাবু।

গিন্নীকে বেহারি পাল একান্তে ডেকে বলে দিলে–তুমি যেন এখন এসব কথা কাউকে বলে ফেলো না আবার। বুঝলে?

–কেন? বললে–দোষ কী?

বেহারী পাল সাবধানী লোক। বললে–এখন বললে–জিনিসটা আর বাড়বে না, এখন একটু বাড়তে দাও, বেড়ে বেড়ে ওর ডাল-পালা গজাক, তখন বলো–

অবশ্য বেহারি পাল বুঝতো মেয়েমানুষদের ও-কথা বলাও যা আর না বলাও তাই। তবু যে কথাটা বলে রাখলো তারও একটা দাম আছে। কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হওয়া গেল না। কখন কোন ফাঁকে মেয়েমানুষের মুখ ফসকে কথাটা বাইরে ফাঁস হয়ে যায় সেই ভাবনাতেই রাতটা কাটলো। বলতে গেলে রাত্তিরে ভালো করে ঘুমও হলো না বেহারি পালের। তাই ভোর-ভোর ঘুম থেকে উঠে সামনের বাগানের সামনে পায়চারি করছিল। দেখলে কৈলাস গোমস্তা যাচ্ছে।

বললে–কী গো কৈলাস, খবর কী? কী রকম সরষে উঠলো তোমাদের?

কৈলাস বললে–এবার তো নাবি সরষে, তাই ভালো হলো না। শ’পাঁচেক বস্তা হয়েছে। কোনও রকমে।

–তা কর্তাবাবু কেমন আছেন?

–কর্তাবাবু আর কেমন থাকবেন, সেই একই রকম।

বেহারি পাল পায়ে-পায়ে কৈলাস গোমস্তার সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলো। বললো–চলো, অনেক দিন তোমাদের কর্তাবাবুকে দেখি নি, আজ দেখে আসি গে চলো—

এইভাবেই কর্তাবাবুর কাছে বেহারি পালের আসা। পাশাপাশি বাড়ি, অথচ দেখাশোনা হয় না। প্রথমে কিছু শিষ্টাচারসম্মত কথা হলো। তারপরেই হঠাৎ কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করে বসলেন–তোমার বাড়িতে অত শাঁখকাঁসর-ঘণ্টা বাজে কেন হে বেহারি? তুমি কি দীক্ষা নিয়েছে নাকি?

–দীক্ষা?

–হ্যাঁ, দীক্ষা না নিলে অত পূজা আস্রার ঘটা কেন তোমার বাড়িতে?

বেহারি পাল তো অবাক! বললে–আমার বাড়িতে শাঁখ-কাঁসর-ঘণ্টা? ও তো আমার বাড়িতে নয় কর্তাবাবু, ও তো আপনার বাড়িতে বাজে। আপনার বাড়িতেই তো এক সাধু বাবাজী এসেছেন, তিনিই যাগযজ্ঞ করেন দিনরাত, বাড়ি থেকে দিগ্বন্ধন করে ভূত-প্রেত তাড়িয়ে দেন। আপনি এ-সব কিছু জানেন না?

কর্তাবাবু কথাটা শুনে রেগে আগুন। বললেন–তার মানে? শাঁখ-কাঁসর-ঘণ্টা বাজলো তোমার বাড়িতে আর তুমি বলছো আমার বাড়িতে পূজো হচ্ছে? তুমি কি আজকাল জেগে ঘুমোচ্ছ নাকি হে বেহারি? সুদে টাকা খাটিয়ে কিছু টাকা হয়েছে বলে একেবারে মুখে যা আসে তাই-ই বলতে আরম্ভ করেছ?

তারপর কৈলাসের দিকে চাইলেন। বললেন–শুনলে কৈলাস, বেহারির কথাটা শুনলে?

কৈলাসের তখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। কর্তাবাবুর কথার না করতে পারে প্রতিবাদ আর না করতে পারে সমর্থন।

বেহারি পাল ভেতরের কথা অত-শত জানে না। সে বললে–আজ্ঞে, সুদে আমি টাকা খাটাই বটে, কিন্তু সে কি আজ নতুন কর্তাবাবু? তার জন্যে আমি খামোকা মিথ্যে কথা বলতে যাবো কেন আপনার কাছে? আর শাঁক কাঁসর-ঘণ্টা বাজাটা কি অন্যায় কর্তাবাবু?

কর্তাবাবু আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন–তার চেয়ে বলো না ওটা তোমার ভড়ং–ভড়ং বলতে তোমার অত লজ্জা কীসের?

–কী আশ্চর্য, আমি এলুম আপনার কাছে আপনি কেমন আছেন তাই জানতে, আর আপনি আমাকে গাল মন্দ করছেন?

–আমি তোমাকে গালমন্দ করলুম? বা রে মজা! তোমার বাড়িতে শাঁখকাঁসর-ঘণ্টা বাজার কথা বললেও গালমন্দ করা হলো? তুমি তো আজকাল ভারি বেআক্কেলে হয়ে গেছ হে বেহারি? দুটো টাকা হলেই মানুষকে এমন বেআক্কেলে হতে হয়, ছি ছি ছি–

শেষের ছি-টার ওপর একটু বেশী জোর দিয়ে কর্তাবাবু কথাটা শেষ করলেন। ভাবলেন এই চিৎকারেই বেহারি পাল নরম হয়ে আত্মসমর্পণ করবে।

কিন্তু না, কর্তাবাবু বেহারি পালকে চেনেন নি। ভেবেছেন সেই আগেকার বেহারি পালই আছে। সেই সবে গোঁফ-গজানো নিরীহ গোবেচারী মানুষ। কিন্তু তারপরে এতকাল ইছামতীতে যে কত জল গড়িয়ে গেছে, চারপাশের দুনিয়াটা যে কত বদলে গেছে, ঘরের মধ্যে বসে সে খবর তিনি পান নি। ভেবেছেন সেই কালীগঞ্জের হর্ষনাথ চক্রবর্তীর আমল বুঝি এখনও চলছে। এখনও জমিদার যা বলবে সবাই বেদবাক্য বলেই তা মেনে নেবে। তিনি নিজে যখন নবাবগঞ্জের সব চেয়ে ধনী ব্যক্তি তখন যেন আর কোনও ধনী ব্যক্তি এ দিগরে থাকতে পারবে না, থাকতে পারা যেন বে-আইনী। নিজে পঙ্গু মানুষ, তাই ভেবে নিয়েছেন পৃথিবীটাও যেন তাঁরই মত পঙ্গু হয়ে শুয়ে পড়ে আছে।

কথাটা চরমে উঠলো তার পরেই। বেহারি পাল হঠাৎ বলে বসলো–আগে নিজের বাড়ির দিকে নজর দিয়ে দেখুন কর্তাবাবু, পরের ব্যাপার পরই ভাল করে নজর দিতে পারবে–

–কী বললে–তুমি? কী বললে?

বেহারি পাল বললে–এখন তো সবে নাতির বিয়ে দিলেন। এখন নাতবউও বাড়িতে এসেছে। এখন সেই দিকেই নজর দিন, নইলে আপনারই ক্ষতি, আমার কলা–

বলে বেহারি পাল তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো। কিন্তু উঠে পড়বার আগেই যা হবার তা হয়ে গেল। কর্তাবাবুর মুখ দিয়ে কি রকম একটা গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোতে লাগলো। যেন কী বলতে যাচ্ছিলেন, সে কথাটা জিভের মধ্যেই আটকে গেল। রাগের মাথায় দুটো সচল হাত তুলে কী বলতে চাইলেন তা আর কেউ জানতে পারলে না। বেহারি পাল আর দাঁড়ালো না। সে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

কিন্তু মুশকিল হলো কৈলাস গোমস্তার। সে ভয় পেয়ে গেল। সে আর সেখানে দাঁড়ালো না। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় একতলায় নেমে এসেছে।

নিচেয় তখন চৌধুরী মশাই সদানন্দকে ঘরের ভেতর পুরে দরজায় তালা-চাবি বন্ধ করে দিয়েছেন। আর বাড়ি যত লোক আশ-পাশ থেকে উঁকি মেরে কাণ্ডটা লক্ষ্য করছে।

সদানন্দের ঘরের দরজায় তালাবন্ধ হলে কী হবে, পাশেই একটা বিরাট জানালা। গরাদের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল সদানন্দ এতটুকু প্রতিবাদ করছে না, বাধাও দিচ্ছে না। তালা চাবি বন্ধ হবার পর সে মাথা নিচু করে ঘরের ভেতরে রাখা খাটটার পরে গিয়ে বসে মাথা নিচু করে রইলো।

সমস্ত ব্যাপারটা প্রীতির চোখের সামনেই ঘটলো! বললে–ওগো দরজাটা খুলে দিয়ে যাও, দরজা বন্ধ করে চলে গেলে কেন?

গৌরীও এতক্ষণ নির্বাক হয়ে সব কিছু দেখছিল। সে-ই নিজের হাতে ছোটবাবুকে তালা চাবি এনে দিয়েছে। এক মুহূর্তের মধ্যে যে কী কাণ্ড ঘটে গেল তা যেন কেউ তখনি-তখনি কল্পনাও করতে পারলো না। কী যে অপরাধ সদানন্দের আর কত বড় অপরাধের যে এত বড় শাস্তি, তাও কেউ অনুমান করতে পারলে না।

প্রীতি বাইরের জানালা দিয়ে জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁ রে খোকা, তুই কী করেছিলি রে? কর্তা এমন রেগে গেলেন কেন তোর ওপর? তুই কী করেছিলি?

প্রকাশ মামাও এতক্ষণ কোনও কথা বলে নি। পেছনে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। এত যে বাক্যবাগীশ মানুষটা সেও যেন ঘটনার আকস্মিকতায় খানিকক্ষণের জন্যে একেবারে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল।

প্রীতি তার দিকে চেয়েও জিজ্ঞেস করল কী রে, কী হয়েছিল রে? তোর জামাইবাবু এত রেগে গেল কেন রে? কী করেছিল খোকা?

প্রকাশ বললে–বাবাজীর ত্রিশূল কেড়ে নিয়েছিল, আর বাবাজীর জটা টেনে ধরে গালাগালি দিচ্ছিল–

–গালাগালি দিচ্ছিল? খোকা গালাগালি দিচ্ছিল? এ হতেই পারে না। খোকা কখনও কাউকে গালাগালি দিতেই পারে না–

ভেতরে সদানন্দ তখনও মুখ নিচু করে খাটের ওপর চুপ করে বসে ছিল। প্রীতি তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে কী রে খোকা, তুই বাবাজীকে গালাগালি দিয়েছিলি? কী করেছিল বাবাজী?

সদানন্দ যেমন বসে ছিল তেমনিই বলে রইল। এ কথার কোনও জবাব দিলে না।

প্রীতি আবার জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁ রে, কথার জবাব দে–

জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে একজন প্রশ্ন করছে আর ভেতরে যে শুনছে সে পাথর না গাছ তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।

কথার জবাব দিবি না? বলি, আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?

তবু সদানন্দর দিক থেকে কোনও উত্তর নেই।

প্রীতি যেন নিজের মনেই বললে–এ আমার কী মুশকিল হলো বল্ তো প্রকাশ। এ আমি কাকে কী বলি? তোর জামাইবাবু তো খোকাকে ঘরের ভেতরে রেখে দিয়ে চলে গেল। আবার ওদিকে কর্তাবাবুর কী হলো কে জানে। এখন আমি সংসার দেখবো, না এই ছেলেকে সামলাবো। ছোট ছেলে হলে না হয় তবু তাকে সামলাতে পারা যায়, কিন্তু বুড়ো ধাড়ি ছেলেকে নিয়ে আমি কী করি? বাবাজী সন্নিসী মানুষ, তিনি তো কোনও ক্ষতি করেন নি, তাকে কেন খামোকা তুই মারতে গেলি মাঝখান থেকে। তিনি তোর কী করেছিলেন?

প্রকাশ বললে–দাঁড়াও, তুমি কিছু ভেবো না দিদি, তুমি এখান থেকে সরে যাও দিকি, তোমরা সবাই এখান থেকে সরে যাও, সবাই সরে যাও–

গৌরী, বিষ্টুর মা, ঝি, শশী, আরো সব ভেতর বাড়ির ঝি-ঝিউড়ি যে-যে আশপাশ থেকে উঁকিঝুঁকি মারছিল সবাই ধমক খেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। অদৃশ্য হয়ে গিয়েও পাছে কাছাকাছি থাকে সেই জন্যে প্রকাশ আবার বললে–সবাই ভাগো এখান থেকে, ভাগো–

প্রীতি নিজের জ্বালায় জ্বলেপুড়ে আগেই রান্না বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছিল। তার তখন মাথা ঘুরছে একেবারে বনবন্ করে। একেকটা রাত ঠায় জাগা। তার ওপর এই উটকো ঝামেলা। কিন্তু খাবার সময় কেউ পেট খালি করে খাবে না। তখন পান থেকে চুন খসলে যত দোষ বাড়ির গিন্নীর। বিষ্টুর মা গৌরী তারাও প্রীতির সঙ্গে তখন চলে গেছে। প্রকাশ তবু চারিদিকে খুঁটিয়ে দেখে নিলে। না, কেউ কোথাও নেই। প্রকাশ জানালার কাছে এগিয়ে গেল।

বললে–এই সদা, শোন! আয় ইদিকে—

কিন্তু কাকে কথা বলা! সদা প্রকাশ মামার কথা শুনলে তবে তো!

প্রকাশ মামা আবার ডাকলে–আমার কথা শুনবি না?

এতক্ষণে সদানন্দ মুখ তুললো। চেহারা দেখলে বোঝা যায় সে যেন রাগে ফুঁসছে।

–চা। আমার দিকে চেয়ে দেখ!

সদানন্দ বলে উঠলো–কী বলবে বলো না

প্রকাশ মামা বললে–আয়, একবার জানালার কাছে আয়, তোর কানে কানে একটা কথা বলবো–

সদানন্দ বললে–যা বলবে তুমি ওখান থেকেই বলো।

প্রকাশ মামা জানালার গরাদের কাছে মুখ নিয়ে গেল। গলাটা একটু নামালে। বললে– দ্যাখ, একটা কথা শোন্, মন দিয়ে শোন, বাড়িতে এখন পরের বাড়ির মেয়ে রয়েছে, এই সময় তুই কেন এমন কেলেঙ্কারি করছিস বল তো? জামাইবাবুর কথা একটু শুনলে তোর কী এমন ক্ষতিটা হয়? তোকে তো এমন কিছু শক্ত কাজ কেউ করতে বলছে না?

বলে প্রকাশ মামা চুপ করলো। তারপর সদানন্দর তরফ থেকে কোনও জবাব না পেয়ে আবার বললে–কী রে, জবাব দিচ্ছিস নে যে?

সদানন্দ বলে উঠলো–তুমি এখান থেকে যাও প্রকাশ মামা, আমাকে বিরক্ত কোর না–

প্রকাশ মামা বললে–আমি তোকে বিরক্ত করছি? কী বলছিস তুই? আমি তোর ভালোর জন্যে বলছি, আর তুই কিনা বলছিস আমি তোকে বিরক্ত করছি?

তারপর একটু থেমে বললে–তা যাক গে, আমি জামাইবাবুকে এখুনি ডেকে নিয়ে আসছি, তুই শুধু তার সামনে বলবি তুই আর অমন করবি না, যা করেছিস তার জন্যে মাপ চাইবি, চুকে যাবে ল্যাঠা। পারবি না? এইটুকুও বলতে পারবি না?

সদানন্দ তবু কিছু জবাব দিলে না। চুপ করে রইল।

–কী রে, আবার চুপ করে রইলি? জানিস ওপরে এখন কী হচ্ছে? তোর দাদুর হঠাৎ অসুখ বেড়েছে, যায়-যায় অবস্থা। বাড়িতে এই রকম বিপদ চলছে আর তোর কি না এই আক্কেল! তোর মা বাবা আমি–সবাই কোন্ দিকটা সামলাই বল্ দিকিনি। তুইও তো সারা রাত জেগে কাটিয়েছিস। বউমারও তো সেই অবস্থা। ওদিকে বাবাজী মানুষটার সেবার ব্যবস্থা আছে। এই সময়ে কে কাকে দেখে বল তো? একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তুই সেয়ানা ছেলে হয়ে এ কী করছিস আমি বুঝতে পারছি না।

এমন সময় দীনু ওপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে আসছিল। তাকে দেখেই প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করলে কী রে, কর্তাবাবুর কী রকম অবস্থা?

দীনু হাঁফাচ্ছিল। বললে–কর্তাবাবু অজ্ঞান হয়ে গেছে

–কেন? অজ্ঞান হয়ে গেছে কেন? মারা যাবে নাকি?

কিন্তু তার আগেই চৌধুরী মশাই নিজেই আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। এসেই প্রকাশকে সামনে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন–প্রকাশ, ও দীনুকে দিয়ে হবে না, তোমাকেই যেতে হবে

প্রকাশ বললে–কোথায়?

–ননী ডাক্তারকে ডাকতে। বাবার অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। চোখ উল্টে গেছে।

–তা হঠাৎ এমন হলো কেন?

চৌধুরী মশাই বললেন–সে-সব কথা পরে হবে। আগে তুমি যাও, ননী ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসো। আমি ভালো বুঝছি না। বেহারি পাল মশাই-এর সঙ্গে কী নাকি কথা কাটাকাটি হয়েছিল শুনলাম, এখন কী করি!

প্রীতিও চৌধুরী মশাই-এর গলার শব্দ পেয়ে দৌড়ে এলো। বললে–কী হলো! ওপরে কী দেখে এলে?

প্রকাশকে যে কথাগুলো বলেছিলেন সেই কথাগুলোই চৌধুরী মশাই গিন্নীকে বললেন। কিন্তু প্রীতি সে কথায় কান দিলে না। বললে–তা তুমি যে খোকাকে ঘরে তালা-চাবি দিয়ে গেলে, ও খাবে না? ও মুখ-হাত-পা ধোবে না? রাগ হলে কি তোমার এই রকমই মাথা গরম হয়ে যায়?

চৌধুরী মশাই এ-কথায় আরো রেগে গেলেন। বললেন–মাথা গরম হবে না? তুমি আমার মাথারই দোষ দেখলে? আর তোমার ছেলে যে কত বেয়াড়া তা তো একবারও দেখতে পাও না?

প্রীতি বললে–তা বুঝলাম না-হয় যে আমার ছেলে বেয়াড়া, তা বলে তাকে ঘরে তালা চাবি বন্ধ করে রেখে দেবে? তালা-চাবি বন্ধ করলে ছেলে তোমার শোধরাবে? এ কি ছেলেমানুষ ছেলে যে মেরে-ধরে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে ভালো করে তুলবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা অত বড় বুড়ো ধাড়ি ছেলে, ওর এতটুকু জ্ঞানগম্যি থাকবে না তা বলে? ভেবেছে ওর যা খুশি তাই করবে? যে ছেলে নিজের বাপের মুখের ওপর কথা বলে তাকে এই রকম শাস্তিই দিতে হয়। দরকার নেই ওর খেয়ে। ও-ছেলে আমার থাকলেই বা কী আর না থাকলেই বা কী! তুমি ওরকম ছেলেকে পেটে ধরেছিলে কেন?

-–আঃ—

বলে প্রীতি বিরক্তিতে একেবারে ফেটে পড়লো। বললে–-তোমার কী মুখের আড় থাকতে নেই? তুমি কী বলছো তাও তুমি জানো না। দাও, আমাকে চাবি দাও, আমি দরজা খুলে দেব

চৌধুরী মশাই চাবিটা চেপে ধরলেন। বললেন–না, চাবি কখনো দেব না—

প্রীতি বললে–পাগলের মতো কাণ্ড কোর না। দাও চাবি দাও–

–কিন্তু তোমার ছেলে তাহলে বাবাজীর কাছে এখনি ক্ষমা চাক। এখুনি বাবাজীর কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চাক।

প্রীতি আর কথা না বলে চৌধুরি মশাই-এর কাছ থেকে এক টানে চাবি কেড়ে নিলে। তারপর দরজার তালাটা খুলতে যেতেই চৌধুরী মশাই গিন্নীর হাতটা চেপে ধরলেন। বললেন–চাবি দাও, চাবি দাও আমাকে–তালা খুলতে পারবে না–

বলে চাবিটার জন্যে গিন্নির হাতটা ধরে টানতে লাগলেন।

প্রকাশ মামা এতক্ষণে চৌধুরী মশাই-এর হাতটা ধরতে গেল। বললে–জামাইবাবু, আপনি করছেন কী? আপনি ঠাণ্ডা হোন–

চৌধুরী মশাই প্রকাশের হাতটা ঠেলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বললেন–খবরদার, তুমি আমার হাত ধরবার কে? যাও এখান থেকে চলে যাও। একবার তোমাকে ঠেলে দিয়েছি! আমার গায়ে হাত দিলে এবার উঠোনের কুয়োর মধ্যে ফেলে দেবে–যাও–

প্ৰকাশ বললে–কিন্তু আপনি মাথা ঠাণ্ডা করে জিনিসটা ভেবে দেখুন জামাইবাবু, দিদি যা বলছে ঠিকই বলছে

–আবার? আবার তুমি আমার সামনে আসছো?

–কিন্তু প্রীতি তখন সেই ফাঁকে তালাটা খুলে ফেলেছে। খুলে ফেলে সদানন্দকে ডাকলে–আয় খোকা, আয়, আয়, বেরিয়ে আয়।

সদানন্দ কিন্তু বেরিয়ে আসবার কোনও চেষ্টাই করলে না। প্রীতি এবার নিজেই ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকে সদানন্দর হাতটা ধরে টানতে লাগলো। বললে–হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? বেরিয়ে আয়–

চৌধুরী মশাই তখনও প্রকাশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে ব্যস্ত। বললেন–তুমি আমাদের ব্যাপারে কেন মাথা ঘামাতে আসো শুনি? তোমার নিজের বাড়ি-ঘর-দোর নেই?

প্রকাশ বললে–আমি তো যেতে চাই-ই। আমার ছেলে-মেয়ে বউ সেখানে পড়ে রয়েছে, আমি তো যেতেই চাই সেখানে–

–তা যাচ্ছো না কেন–গেলেই তো পারো? আপদ চোকে–

–কিন্তু দিদি যে আমাকে যেতে দেয় না। সদানন্দর বিয়ের পরই তো আমি যেতে চেয়েছিলুম, কিন্তু দিদিই তো আমাকে আটকে রাখলে।

চৌধুরী মশাই বললেন–দিদি কে? এ আমার বাড়ি, আমি এ বাড়ির মালিক। আমি বলছি তুমি এখান থেকে চলে যাও তুমি কেন এখানে বসে বসে আমার অন্ন-ধ্বংস করছো–

প্রকাশের মতন হ্যাংলা মানুষেরও বোধ হয় মান-অপমান জ্ঞান আছে। নইলে জামাইবাবুর কথায় সেই বা অমন হঠাৎ চুপ হয়ে যাবে কেন? এতক্ষণ তার মুখের যা-চেহারা ছিল তা যেন হঠাৎ এই কথাগুলোয় চুপসে গেল। সে মুখ চুন করে একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। এতগুলো বাড়ির লোকের সামনে এত বড় অপমান তার জীবনে আর কখনও ঘটে নি।

শুধু একবার বললে–তাহলে ননী ডাক্তারকে ডাকতে যাবো না?

এত কাণ্ডের মধ্যে চৌধুরী মশাই-এর বোধ হয় মাথার ঠিক ছিল না। প্রকাশের কথায় যেন মনে পড়ে গেল। বললেন–তা ডাক্তারের কাছে যেতে কি আমি তোমাকে বারণ করেছি? আগে ডাক্তারের কাছে যাও–

প্রকাশ বললে–তা আপনি যে এখখুনি আমায় বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেন?

চৌধুরী মশাই বললেন–তুমি দেখছি বড় বে-আক্কেলে মানুষ। ডাক্তারকে ডেকে দিয়ে নিজের দেশে চলে যাওয়া যায় না? ডাক্তারকে ডেকে দিয়ে খেয়ে-দেয়ে দুপুরের গাড়িতে চলে যেও–

এতক্ষণে প্রীতির কানে কথাগুলো গেছে। সে এগিয়ে এল। বললে–কী হলো? কাকে যেতে বলছো? কে বাড়ি থেকে চলে যাবে?

প্রকাশ মুখ কাঁচুমাচু করে বললে–জামাইবাবু আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছেন

–কেন? প্রকাশ চলে যাবে কেন?

এতক্ষণ হঠাৎ চৌধুরী মশাই-এর নজরে পড়লো ঘরের দরজাটা খোলা। ভেতরে চেয়ে দেখলেন খোকা নেই।

বললেন–খোকা কোথায় গেল?

প্রীতি বললে–তাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি

–ছেড়ে দিয়েছ মানে? কোথায় গেল সে?

–কোথায় গেল তা আমি কী জানি!

চৌধুরী মশাই বললেন–তুমি কেন দরজার চাবি খুলে দিতে গেলে? আমি নিজে তাকে তালাবন্ধ করে দিয়ে গেলুম তবু তুমি তাকে দরজা খুলে বার করে দিলে কেন?

প্রীতি বললে–বেশ করেছি–

চৌধুরী মশাই স্তম্ভিত হয়ে স্থানুর মত সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর যেন একটু সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললেন–তুমি এই কথা বললে?

প্রীতি বললে–বলবো না? কেন তুমি এত বড় সেয়ানা ছেলেকে সকলের সামনে এমন অপমান করলে? তার এখন বয়েস হয়েছে, তার বিয়ে হয়েছে, ঘরে তার নতুন বউ রয়েছে, এই সময়ে তুমি এমন করে তার ইজ্জৎ নিলে, আর আমি তালা খুলে দেব না?

চৌধুরী মশাই বললেন–তার ইজ্জৎ? তার ইজ্জতের কথাটাই তুমি ভাবলে? আর আমি? আমি এবাড়ির মালিক, আমার ইজ্জতের কথাটা তো একবারও ভাবলে না? তোমার কাছে তোমার ছেলের ইজ্জৎটাই বড় হলো?

প্রকাশ কী করবে তখনও বুঝতে পারছে না। একবার জামাইবাবুর মুখের দিকে চাইছে আর একবার দিদির মুখের দিকে। চৌধুরী মশাই রাগে ফুলছেন। দিদির সঙ্গে জামাইবাবুর এমন ঝগড়া আগে কখনও প্রকাশ দেখে নি। দিদিও বলছে বেশ করেছে সদানন্দকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে, জামাইবাবুও বলছে–কেন তালা খুলে দিলে! তাহলে কি জামাইবাবুর কথার কোনও দাম নেই?

জামাইবাবু মাঝখানে বলে উঠলো–তাহলে আমি যদি এ বাড়ির কেউই না হই তো হয় আমি এবাড়ি ছেড়ে চলে যাই, আর নয় তো তুমিই চলে যাও–

দিদি বললে–তুমি কেন যাবে? তুমি কী দোষ করেছ? যেতে হলে আমিই যাবো। আমাকে তুমি বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও, আমি যে কটা দিন বাঁচি সেখানেই থাকবো সারাদিন তুমি নিশ্চিন্তে তোমার জমি-জমা বউ-ছেলে নিয়ে আরাম করে কাটাবে–কেউ আর তখন তোমাকে কথা শোনাতে আসবে না–

চৌধুরী মশাই বললেন–ওটা তো তোমার রাগের কথা হলো। আমি কি তোমাকে রাগের কথা বলেছি কিছু যে ভাগলপুরে চলে যাবো বলছো?

প্রীতি বললে–তা কোন্ কথাটা বলতে আমাকে বাকি রেখেছ তুমি? মানুষ আবার কী রকম করে লোককে হেনস্তা করে? এই তো প্রকাশ সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও–ও তো সব শুনেছে। ও-ই বলুক না, তুমি আমাকে অপমান করলে, না আমি তোমায় অপমান করলুম? বলুক ও, বুকে হাত দিয়ে ও বলুক–

প্রকাশ বললে–দিদি তুমি চুপ করো না, কেন কথা বাড়াচ্ছো? তুমি নিজের কাজ করো গে যাও না–

চৌধুরী মশাই যেন এতক্ষণে আবার প্রকাশের উপস্থিতি টের পেলেন। বললেন–তুমি থামো তো হে। তোমাকে কে মাতব্বরি করতে বলেছে? আমি তোমাকে ননী ডাক্তারকে ডাকতে বললুম না–

এমন সময় হঠাৎ ভেতর থেকে মৃদু গলায় আওয়াজ এলো—মা–

এতক্ষণে যেন সবাই সম্বিৎ ফিরে পেলে। যেন এতক্ষণে হঠাৎ খেয়াল হলো যে এ বাড়িতে এমন একজন লোক আছে যার সামনে এমন ব্যবহার করা অসঙ্গত। অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরেও যেন সে-মানুষটার সামনে একটু সংযত হয়ে কথা বলা দরকার। এছাড়াও যেন নতুন করে চৌধুরী মশাই-এর মনে পড়ে গেল যে ওপরে কর্তাবাবুর মরণাপন্ন অসুখ। তারপর আরো মনে পড়ে গেল যে একটু দূরেই বাবাজী রয়েছেন, তাঁর কানেও এই স্বামী-স্ত্রীর কথা কাটাকাটির শব্দ পৌঁছোনো সম্ভব। সকলের সব কথাই মনে পড়ে গেল। পাশের বাড়ির শ্যেনচক্ষু বেহারি পালের কানেও যে শব্দটা পৌঁছতে পারে সে কথাটাও যেন এতক্ষণে সকলের খেয়াল হলো। খেয়াল হতেই এক মুহূর্তের জন্যে সবাই নিজের আসল স্বরূপটা ফিরে পেলে। লজ্জায় চৌধুরী মশাই যেন যেখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচেন। সামনেই দেখলেন প্রকাশ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নিয়েই বার বাড়ির দিকে চলতে চলতে বললেন–তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছো বড়কুটুম, ওদিকে যে কর্তাবাবু ছটফট করছেন–

জামাইবাবুর এরূপটা প্রকাশের দেখা আছে। যখন প্রকাশকে দিয়ে কোনও জরুরী কাজ করাতে হবে তখন জামাইবাবুর মুখে এই আদরের বড়কুটুম শব্দটা বেরিয়ে আসে।

প্রকাশও জামাইবাবুর কথায় গদগদ হয়ে গেল। বললে–আপনি কিছু ভাববেন না জামাইবাবু, আমি এখখুনি যাচ্ছি, যাবো আর আসবো। প্রকাশ থাকতে আপনার কিছু ভাবনা করবার দরকার নেই–এই আমি চললুম–

বলে প্রকাশ বেরিয়ে চলে গেল।

প্রীতি পাশের বারান্দায় গিয়েই দেখলে, খোকার ঘর থেকে সামনের বারান্দায় বউমা এসে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোমটায় মাথাটা ঢাকা। কিন্তু ফাঁক দিয়ে মুখের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যায় বউমার চোখ-মুখ যেন শুকিয়ে গেছে। একটুখানি শুধু মা ডাক! কিন্তু ওই ডাটুকুতেই যেন প্রীতি আবার অন্য মানুষ হয়ে গেল। এতক্ষণ যে-মানুষটার স্বামীর সঙ্গে নির্লজ্জের মত ঝগড়া করতে বাধে নি সেই মানুষটাই যেন একেবারে স্নেহ মমতা করুণায় এক মুহূর্তে জননীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। বউমার কাছে গিয়ে বললে– কী বউমা, আমাকে ডাকছিলে?

নয়নতারা তেমনি মুখটা নিচু করেই রইল। যেন তার মুখের কথাটা খানিকক্ষণের জন্যে মুখেই আটকে রইল। তারপর যেন অনেক কষ্টে তার মুখ দিয়ে কথা বেরোল। বললে–মা, বলছিলাম কি, আমাকে আমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিন না—

প্রীতি বললে–ছি মা, ওকথা কি বলতে আছে? এতক্ষণ দেখলে না তোমার শ্বশুর তোমার কথা ভেবে ভেবে কী রকম মাথা গরম করে ফেলেছেন। তোমার কানে তো সব কথাই গেছে। ও নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না, তোমার শ্বশুরের ওই এক স্বভাব, রেগে গেলেন তো গেলেন, তখন একেবারে অগ্নিকাণ্ড, আবার ওই মানুষটাই অন্য সময় একেবারে জল। ওঁর কথায় তুমি কান দিও না বউমা, ওঁর কথায় যদি আমি কান দিতুম তো আমিই কোনদিন বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি পালিয়ে যেতুম। এ বাড়ির সব পুরুষমানুষই ওই রকম। ও-সব কথায় কান দিলে কি সংসার চলে বউমা! শ্বশুরকে আজ যেমন দেখলে, উনি আমার সঙ্গেও ঠিক তেমনি করেন। রাগলে এবাড়ির পুরুষমানুষদের কোনও দিকে আর জ্ঞান থাকে না–

নয়নতারা বললে–কিন্তু আমাকে নিয়েই যখন এত অশান্তি, তখন আমি চলে গেলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি কিছুদিনের মত চলে যাই না, তারপর যখন বাবার রাগ পড়বে না-হয় আবার ফিরে আসবো–

–না না বউমা, তা হয় না, তুমি পাগলামি কোর না, তুমি ঘরে গিয়ে একটু বোস, আমি রান্নাঘরের দিকটা একবার দেখে আসি, আমি যেদিকে দেখব না সেই দিকেই তো চিত্তির হয়ে যাবে–

বলে বাইরে এসে বিষ্ণুর-মার খোঁজে রান্নাবাড়ির দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ দীনু মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। বললে–মা, বউমার বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে তত্ত্ব নিয়ে–

–তত্ত্ব? কীসের তত্ত্ব?

–শীতের তত্ত্ব!

কথাটা শুনেই প্রীতির মাথাটা আবার গরম হয়ে উঠলো। আর সময় পেলেন না বেয়াই মশাই তত্ত্ব পাঠাবার! ঠিক এই সময়েই কি না তত্ত্ব পাঠাতে হয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *