৩.৮ টাকার সদ্ব্যবহার

হায় রে, টাকা দান করা আর সেই টাকার সদ্ব্যবহার হওয়া সে এক জিনিস নয় তা যদি সদানন্দ জানতো! সংসারে যারা সদানন্দ হয়ে জন্মায় তারা বোধ হয় তা জানতে পারেও না। সদানন্দরা যখন দান করে তখন তার ভালো-মন্দ খতিয়ে না-দেখেই দান করে। খতিয়ে দেখে কারা? যারা রাজনীতি করে। কিন্তু সদানন্দরা যে শুধু বিদ্রোহ করতেই জানে, রাজনীতি করবার জন্যে তো সংসারে প্রকাশ মামারাই আছে!

তাই প্রকাশ মামা তখনও সদানন্দর পেছন পেছন চলেছে। তখনও তার পেছু ছাড়েনি সে। নবাবগঞ্জ থেকে হেঁটে গিয়ে দুজনে বাসে উঠেছে। তখনও তার মুখে ওই একই কথা হ্যাঁ রে, টাকাগুলো তুই এইভাবে নয়-ছয় করে ফেলবি? জামাইবাবু কত করে টাকা উপায় করে গিয়েছিল, আর সে টাকা দিয়ে তুই এই ভূত-ভোজন করাবি।

সদানন্দ বললে–তুমি আমার সঙ্গে কেন ঘুরছে মামা? তোমাকে তো আমি বলেছি টাকা তুমি পাবে না

প্রকাশ মামা বললে–কেন পাবো না? নবাবগঞ্জের ওই ছোটলোকগুলোকে অতগুলো টাকা দিতে পারলি আর আমি তোর মামা হই, আমাকে দিতে পারবি না? আমি তোর কেউই নয় রে? ছোটবেলা থেকে তোকে আমি কত আদর করেছি, কত জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি, সব তুই একদম ভুলে মেরে দিলি?

সদানন্দ বললে–তোমাকে আমি টাকা দেব না, আমি রাধাকে টাকা দেব।

–রাধা!

–হ্যাঁ, যাকে তুমি তার বাড়ি থেকে ফুসলে নিয়ে এসে রাণাঘাটের বাজারের বস্তিতে রেখেছিলে।

–সে-সব কথা তুই জানলি কি করে?

সদানন্দ বললে–আমি একদিন রাধার বাড়িতে গিয়েছিলুম, তখন সে আমাকে সব বলেছে। তাকে আমি কিছু টাকা দিয়ে যাবো।

প্রকাশ মামা হেসে উঠলো হো হো করে। বললে–কিন্তু তাকে আর তুই খুঁজে পাবি কী করে রে?

–কেন? রাণাঘাটে গিয়ে?

প্রকাশ মামা বললে–আরে সে তো মারা গেছে কবে। কবে মরে ভূত হয়ে গেছে। বরঞ্চ তার টাকাগুলো তুই আমাকে দে। আমাকে দিলেই তাকে দেওয়া হয়ে যাবে!

কথাগুলো বলে এত জোরে হেসে উঠলো যে, মনে হলো প্রকাশ মামা যেন মৃত্যুকেও ব্যঙ্গ করছে। প্রকাশ মামার কাছে চিরকাল জন্ম-মৃত্যু সব কিছুই ব্যাঙ্গের জিনিস। জীবনটাই প্রকাশ মামার কাছে একটা প্রহসন। প্রকাশ মামার কাছে একটা জিনিসই কেবল সত্যি, তা হলো টাকা। টাকাই প্রকাশ মামা সারা জীবন চেয়েছে, আর সেই টাকাটাই প্রকাশ মামা পায়নি। পায়নি বলে টাকাটাকেই সারা জীবন ভজনা করে চলেছে।

ক’দিন ধরে পরিশ্রম হচ্ছিল খুব। কোথায় সেই কোর্ট, কোথায় ব্যাঙ্ক, আর কোথায় উকিল মুহুরি, ম্যাজিস্ট্রেট, কলকাতা, নবাবগঞ্জ। কোথায় কখন ঘুমিয়েছে, কোথায় কী খেয়েছে, কিছুরই কিছু ঠিক ছিল না। কখন যে সদানন্দ কোথায় যাবে তারও কোনও ঠিক নেই। অথচ অতগুলো টাকা পেয়েছে, তাকে একলা ছেড়ে দেওয়া যায় না। যাকে হাতের কাছে পাবে তাকেই হয়তো টাকাগুলো বিলিয়ে দেবে। অথচ হায় রে পোড়া কপাল, পাশেই এত বড় একটা অভাবী লোক রয়েছে তার দিকে একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না সদানন্দ।

ভাবতে ভাবতে প্রকাশ মামা কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল ছিল না। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসেছে। কোথায় গেল সদানন্দ! সদানন্দ কোথায় গেল!

মনে আছে সদানন্দর সঙ্গে সে রেলবাজার স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছিল। তারপর চলন্ত ট্রেনের দোলানিতে কখন সে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়েছিল জানতে পারেনি। ট্রেনটা তখনও চলছে। আশেপাশের লোকগুলোর দিকে চেয়ে দেখল সে। সবাই রয়েছে, শুধু সে-ই নেই।

একজনকে জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁ মশাই, আমার পাশে ফর্সা লম্বা মতন এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন, তিনি কোথায় গেলেন বলতে পারেন?

কেউ বলতে পারলে না। যে যার নিজের ধান্দা নিয়ে ব্যস্ত, কে আর খবর রাখতে যাবে পরের ব্যাপার। বললে–না মশাই, আমি দেখিনি–

কিন্তু একজন ভদ্রলোক দেখেছিলে। বললে–আপনার পাশে বসে ছিলেন তো? লম্বা ফর্সা গায়ের রং? হ্যাঁ হ্যাঁ, তিনি তো একটা স্টেশন আসতেই নেমে গেলেন–

–কোন্ ইস্টিশানে নেবে গেলেন? কোন্ ইস্টিশানে বলুন তো?

ভদ্রলোক বললে–তা তো মনে নেই—

প্রকাশ মামার মনে হলো পরের স্টেশনেই সে নেমে যাবে। কিন্তু সেখানে নেমেই বা কী হবে? কোথায় খুঁজবে তাকে? তার চেয়ে কলকাতায় চলে যাওয়াই ভালো। কলকাতায় গিয়ে বরং সেই ধর্মশালায় গিয়ে খোঁজ নেবে। যেখানেই সদা যাক, শেষ পর্যন্ত সেই ধর্মশালাতে তো তাকে যেতেই হবে।

শেয়ালদা স্টেশনে নেমে আর কোথাও দাঁড়ালো না প্রকাশ মামা। একটা ট্রাম ধরে সোজা একেবারে বড়বাজারে গিয়ে নামলো। বড়বাজারের ট্রামরাস্তায় নেমে সেখান থেকে। সোজা পাথুরেপটির ধর্মশালাতে–

–পাঁড়েজী, পাঁড়েজী—

বলে ডাকতে ডাকতে প্রকাশ মামা একেবারে ধর্মশালার ভেতরে গিয়ে ঢুকে পড়লো।

পাঁড়েজী বেরিয়ে এসে বললে–বাবুজী এসেছে?

প্রকাশ মামা বললে–আমি আগে এসে পড়লুম, পরে বাবুজী আসবে–

–কেন, বাবুজী কোথায় গেল?

প্রকাশ মামা বললে–আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে বাবুজী পরে আসবে বললে–তা আমি তোমার এখানে ক’দিন থাকবো পাঁড়েজী। আমাকে তুমি চিনতে পেরেছ তো? আমি সেই তোমার বাবুজীর মামা, আমার নাম প্রকাশ মামা। কী করবো বলো, ভাগ্নেকে ফেলে তো আমি চলে যেতে পারি নে!

পাঁড়েজী বললে–তা থাকুন না, আমার তো ঘর খালি রয়েছে, আমি দরজা খুলে দিচ্ছি–

প্রকাশ মামা বললে–শুধু থাকতে দিলে তো চলবে না পাঁড়েজী, আমাকে একটু খেতেও দিও, আমি খাবো আর কোথায় বলো। তোমার কাছেই যা হোক দুটি খাবো–

–ঠিক আছে—

বলে পাঁড়েজী চলে গেল। কিন্তু প্রকাশ মামার মনে মনে কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত সদা এখানে আসবে তো! কিন্তু যদি না আসে? যদি অতগুলো টাকা কাউকে দিয়ে দেয়? মরতে কেন সে অমন করে ঘুমিয়ে পড়েছিল ট্রেনের মধ্যে! ঠিক ওই সময়েই কি ঘুমিয়ে পড়তে হয় রে! আর এক ঘণ্টা জেগে থাকলে তো এই সর্বনাশটা তার হতো না!

প্রকাশ মামা মনে মনে আবার মা কালীকে ডাকলে–মা, একটু দেখো মা, আমি বড় দুঃখী ছাপোষা মানুষ। আমার ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে সংসার। আমি তোমাকে যে হিসেবটা দিয়েছি তা তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে মা। এক লাখ দিয়ে আমি একটা বাড়ি করবো, আর বাকি থাকলো তিন লাখ। সেই তিন লাখ টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট রেখে দেব, তার থেকে হাজার তিনেক টাকার মতন সুদ আসবে মাসে। তখন সেই টাকার সুদ খাবো আর, আর একটা কথা–দিশী মাল আর খাবো না মা। আমি শুধু হুইস্কি খাবো। দিশী খেয়ে খেয়ে আমার জিভে মরচে পড়ে গেছে মা, একেবারে মরচে পড়ে গেছে…

.

নৈহাটির বাড়িতে তখন নয়নতারা স্থির সিদ্ধান্ত করে ফেলেছে। সে সিদ্ধান্ত আর বদলাবে না সে। যে-মানুষ তার সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে, যে-মানুষ তাকে পদে পদে ঠকিয়েছে, তার সঙ্গে আর কোনও মতে সে সংসার করবে না।

নিখিলেশ সকাল-বেলাই যথারীতি অফিসে চলে গিয়েছিল। বহুদিন ধরেই দু’জনের মধ্যে কোনও কথা হয়নি। না হোক, তাতে নয়নতারার কিছু আসে যায় না। কিন্তু আর সে এখানে থাকবে না। এখানে থাকা মানেই তো নিজেকে বিক্রি করে দেওয়া। তার চেয়ে এখান থেকে চলে গিয়ে সে মালাদের বোর্ডিং হাউসে গিয়ে উঠবে। জায়গা হয়ত নেই সেখানে। কিন্তু মালা তার বন্ধু, একটা জায়গা সে তাকে করে দেবেই।

কয়েকটা কাপড় সে খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে নিলে। আর কিছু তার সঙ্গে নেবার দরকার নেই। অফিস থেকে মাইনে নিয়ে বাকি জিনিসগুলো সে সময়মত কিনে নেবে। কীসের জন্যে এমন মানুষের সঙ্গে এখানে থাকা!

গিরিবালাকে ডেকে নয়নতারা বললে–গিরিবালা শোন, তুমি তোমার মেয়ের কাছে একটু যাবে বলছিলে না, আজকে যেতে পারো, আজকে আমার কোনও কাজ নেই, তুমি সন্ধ্যেবেলা এলেই আমার চলবে–

গিরিবালা খুব খুশী। তার মেয়ে অন্য একজনের বাড়িতে কাজ করে। বেশ কিছু দূরে। অনেক দিন মেয়েকে দেখেনি সে। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিয়ে গিরিবালা চলে গেল। নয়নতারা সদর দরজা বন্ধ করে দিলে। তারপর শাড়িটাও বদলে নিলে। আর একটু পরেই সে বেরিয়ে যাবে। গিয়ে স্টেশন থেকে দুটোর ট্রেন ধরবে। সেখান থেকে একেবারে কলকাতায়।

দরজাটা অবশ্য খোলা পড়ে থাকবে। হয়ত চোর-ডাকাত ঢুকবে। তা ঢুকুক। এ সংসারে যখন সে আর থাকছে না তখন এখানে চুরি হলেই বা কী আর ডাকাতি হলেই বা কী! তার বয়ে গেল। একদিন নিখিলেশের জন্যে সে অনেক করেছে। তার যখন কোনও প্রতিদান সে পায়নি তখন আর তার নিখিলেশের জন্যে মায়া কীসের!

গিরিবালা অনেকক্ষণ হলো বেরিয়ে গেছে। নয়নতারা একটা ব্যাগের ভেতর কাপড়ের বাণ্ডিলটা পুরে নিয়ে উঠলো। তারপর উঠোনে এসে দাঁড়ালো। মাথার ওপরে ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ। নয়নতারার মনের ভেতরেও সেই ঝাঁঝের ছোঁয়াচ এসে উত্তাল হয়ে উঠলো। যাক্, সমস্ত রসাতলে যাক, যাক্, আর কোনও শৃঙ্খল নেই তার কোথাও। গিরিবালা এসে হয়ত অবাক হয়ে যাবে। তারপর নিখিলেশ এসেও আরো অবাক হয়ে যাবে সব শুনে!

একটা চিঠি অবশ্য লিখে রেখে গেলে হতো। কিন্তু না, কেন লিখতে যাবে, কাকে লিখতে যাবে? নিখিলেশকে? নিখিলেশ তার কে? কেউ না–

হঠাৎ বাইরে দরজার কড়া নড়ে উঠলো। এই অসময়ে আবার কে এল! গিরিবালা নাকি? গিরিবালা হয়ত কোনও জিনিস সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। সেটা নিতে এসেছে।

–কে? গিরিবালা?

সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে দিতেই অবাক হয়ে গেছে নয়নতারা। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সদানন্দ!

সদানন্দকে হঠাৎ দেখে নয়নতারা স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সেই মুহূর্তে কোনও কথাই তার মুখ দিয়ে বেরোতে পারলো না।

কিন্তু সদানন্দ নিজেই আগে কথা বললে–বড় অসময়ে এসে পড়েছি আমি—

তারপর নয়নতারার শাড়ি সাজগোজ দেখে কী একটা অনুমান করলে। বললে– তুমিও কোথাও বেরোচ্ছিলে নাকি?

তবু নয়নতারার মুখে কোনও কথা নেই। হাতের কাপড়ের ব্যাগটা সে তখন লুকোতে ব্যস্ত।

সদানন্দ আবার জিজ্ঞেস করলে–আমি সকালবেলার ট্রেনেই আসতে চেয়েছিলুম, কিন্তু রেলবাজার থেকে সে ট্রেনটা ধরতে পারিনি। তা তুমি বুঝি আজকে অফিসে যাওনি?

নয়নতারা পেছন ফিরে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললে–এসো, ভেতরে এসো–

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–নিখিলেশবাবু? নিখিলেশবাবু কোথায়?

–তাঁর আসতে একটু দেরি আছে–তুমি এসো—

বলে নয়নতারা সোজা নিজের ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে। সদানন্দকেও যেতে হলো তার পেছন পেছন। সদানন্দকে একটা চেয়ারে বসতে বলে নয়নতারা একটু দূরে আলমারিটার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালো। বললে–তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে–তোমার শরীর কেমন আছে?

সদানন্দ বললে—ভালো—

নয়নতারা বললে–কই, তুমি বসছো না যে, বোস, এই চেয়ারটাতে বোস—

সদানন্দ বললে–আমি বসতে আসিনি, শুধু দুটো কথা বলে চলে যাবো।

নয়নতারা বললে–এতদূর থেকে এসেছে, একটু বসবে না?

সদানন্দ বললে–কিন্তু তুমি যে দাঁড়িয়ে রইলে–

নয়নতারা বললে–আমি না বসলে বুঝি তোমার বসতে নেই! আচ্ছা এই আমি বসছি, হলো তো! এবার তুমি বোস–

সদানন্দ এবার বসলো। বললে–সত্যি বলছি আমি তোমার এখানে বসবো বলে আসিনি। আর তা ছাড়া…

নয়নতারা বললে–তা ছাড়া কী? বলতে বলতে থেমে গেলে যে?

সদানন্দ বললে–তা ছাড়া এখন এখানে বসবার অধিকারও তো আমার নেই—

নয়নতারা স্বীকার করলে–তা অবশ্য নেই। কিন্তু এককালে তো সে অধিকার ছিল।

সদানন্দ বললে–তা হয়ত ছিল–

–আবার ‘হয়ত’ বলছো কেন? এককালে আমাকে সাত পাকে বেঁধে তুমি তো আমার ওপর তোমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলে!

সদানন্দ বললে–সে-সব পুরোন কথা এখন কেন আবার তুলছো?

নয়নতারা বললে–ঠিক বলেছ, তবে তুমি অধিকারের কথা তুললে বলেই আমায় এত কথা বলতে হলো।

সদানন্দ বললে–এতদিন পরেও দেখছি তুমি কিছু ভুলে যাওনি–

নয়নতারা বললে–পুরুষমানুষ হলে অবশ্য ভুলেই যেতুম। কিন্তু মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি, ভুলবো কী করে বলো!

সদানন্দ বললে–আমি কিন্তু ভুলে যাইনি, পুরুষমানুষ হলেও আমি কিছুই ভুলতে পারিনি–

নয়নতারা বললে–তুমি মহানুভব, মহাপুরুষ, তোমার সঙ্গে কার তুলনা!

সদানন্দ বললে–শেষকালে তুমিও আমাকে ঠাট্টা করতে আরম্ভ করলে, আমাকে ভুল বুঝলে?

নয়নতারা বললে–ছিঃ, এত কাণ্ডের পরেও আমার সম্বন্ধে তোমার এই ধারণা?

সদানন্দ সেকথার উত্তর না দিয়ে অন্য কথা জিজ্ঞেস করলে–নিখিলেশবাবু কোথায়?

নয়নতারা বললে–দেখছি তুমি আমার কথা এড়িয়ে যেতে চাইছো!

–এড়াচ্ছি না, শুধু জিজ্ঞেস করছি নিখিলেশবাবু কোথায়?

–একবার তো বলেছি সে অফিসে গেছে, তার অফিস থেকে আসতে দেরি হবে, তবু আবার সেই একই কথা জিজ্ঞেস করছো কেন? অফিসে যারা যায় তারা কী দুপুরবেলা বাড়ি থাকে। তুমি কী তার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছ?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গেও আমার দরকার ছিল। তোমার সঙ্গেও আমার দরকার।

নয়নতারা বললে–তা তার সঙ্গে দরকার থাকলে ভোরবেলা এলেই পারতে–

–তা তো আসতে পারতুম। কিন্তু ওই যে বললুম, যেখানে গিয়েছিলুম সেখানে একটু দেরি হয়ে গেল বলে আগের ট্রেনটা ধরতে পারলুম না। ভেবেছিলুম তোমাদের কারো সঙ্গে দেখা হবে না। কারণ আমি জানতুম তুমিও অফিসে যাও–

–তাহলে এ সময়ে আসতে গেলে কেন?

–ভেবেছিলুম, স্টেশনের প্ল্যাটফরমে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো, তার চেয়ে তোমার বাড়িতে এসে তোমার ঝি-এর হাতে একটা চিঠি লিখে রেখে দিয়ে চলে যাবো।

–চিঠি?

–হ্যাঁ, একটা চিঠিতে সব কিছু কথা লিখে রেখে চলে যাবার ইচ্ছেই ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

নয়নতারা বললে–দেখা হয়ে খুবই খারাপ হলো না?

সদানন্দ বললে–কেন, খারাপ কেন হতে যাবে?

নয়নতারা বললে–দেখা না হলে আমার মুখ দেখবার দায় এড়াতে পারতে–

সদানন্দ বললে–অমন করে কথা বলছো কেন? তোমার মুখ দেখতে কী আমার ভালো লাগে না?

–ভালো লাগে? সত্যিই বলছো ভালো লাগে?

সদানন্দ বললে–-থাক, ও-সব কথা থাক।

নয়নতারা বললে–না, ও-সব কথা থাকবে কেন? বলো আমার মুখ দেখতে তোমার ভালো লাগে কিনা। বলো–

সদানন্দ বললে–ওকথা বার বার জিজ্ঞেস করো না–

–কেন, জিজ্ঞেস করলে দোষ কী?

সদানন্দ বললে–না, জিজ্ঞেস করতে নেই—

নয়নতারা বললে–কেন জিজ্ঞেস করতে নেই? আমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে?

সদানন্দ বললে–আমার এসব কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুমি তো জানো আমার জীবনটাই অভিশপ্ত।

নয়নতারা বললে–তার জন্যে তো তুমি নিজেই দায়ী।

সদানন্দ বললে,–না তুমি ভুল বলছো। তুমি সব জেনেও আমাকেই দোষী করছে। আমি কী স্বাভাবিক হতে চাইনি? আমি কী আর পাঁচজনের মত বিয়ে করে সুখে সংসার করতে চাইনি? আমি কী চাইনি যে আর সবাই যেমন সুখ-দুঃখে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে, পাপ-পূণ্য ভালো-মন্দ নিয়ে সংসার করে, তেমনি আমিও করি? আমি তো তাই-ই চেয়েছিলুম।

নয়নতারা বললে–তাই করলেই তো ভালো হতো, তাহলে আমার জীবনটা আর এমন করে নষ্ট হয়ে যেত না–

সদানন্দ অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–নষ্ট? তোমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে?

–নষ্ট হয়নি?

–কেন, তুমি তো আমার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গিয়ে বেঁচেছ। তুমি আমার চেয়ে ভালো স্বামী পেয়েছ, তিনি তোমায় লেখাপড়া শিখিয়ে ভালো চাকরি করিয়ে দিয়েছেন। তুমি তো বেশ সুখেই কাটাচ্ছ। তোমার জীবন নষ্টটা হলো কোথায়? বরং আমার স্ত্রী হয়ে থাকলে তো সেই শ্বশুর-শাশুড়ীর তাঁবে থেকে সারাদিন ঘোমটায় মুখ ঢেকে কাটাতে হতো, সূর্যের মুখ পর্যন্ত দেখতে পেতে না। এমন করে স্বাধীন ভাবে রাস্তায়-ঘাটে-ট্রেনে যখন যেখানে খুশী ঘুরতেও পারতে না। বিয়ে করে তুমি বেশ ভালোই আছে–

নয়নতারা চোখ দুটো ছল-ছল করে উঠলো।

বললে–বাইরে থেকে সবাই তাই-ই ভাবে–

সদানন্দ বললে–তুমি ঠিকই বলেছ নয়নতারা, বাইরে থেকে যা দেখি সেটা মোটেই আসল দেখা নয়। কিন্তু সংসারে সবাই সবাইকে আমরা বাইরে থেকে দেখেই তো বিচার করি। তাই তো আমি সকলের চোখে পাগল। তোমার মত স্ত্রী পেয়েও আমি তোমার সঙ্গে সংসার-ধর্ম করলুম না, এও বাইরের লোকের কাছে একরকম পাগলামিই বই কী।

নয়নতারা এ-কথার জবাবে কিছুই বললে না, শুধু চুপ করে রইল।

সদানন্দ বললে–কিন্তু বাইরের লোকে যা-ই বলুক, আজ তোমাকেই আমি জিজ্ঞেস করি, তুমিও কি আমাকে তা-ই বলবে? আমার এ-সব কাজকে কি তুমিও পাগলামি বলবে?

তবু নয়নতারা কোনও উত্তর দিলে না।

সদানন্দ বলতে লাগলো, জবাব দাও? অমন করে চুপ করে থেকো না, একটা কিছু বলো তুমি!

নয়নতারা বললে–আমি কী বলবো?

সদানন্দ বললে–কেন, বলতে পারো না কেন কপিল পায়রাপোড়া গলায় দড়ি দিয়ে মরে? কেন মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক চৌধুরীদের অত্যাচারে পাগল হয়ে যায়? কেন আমাদের ফুলশয্যার রাত্রে কালীগঞ্জের বউ খুন হয়ে যায়? কী দোষ করেছিল তারা? কার সুখ-শান্তির পথে তারা কাঁটা হয়েছিল? তাদের সর্বনাশের জন্যে কারা দায়ী? কে তার দায়ভাগ নেবে? কে তার প্রায়শ্চিত্ত করবে?

নয়নতারা এতক্ষণে কথা বললে। জিজ্ঞেস করলে–তা এত লোক থাকতে অন্যের পাপের দায় তুমি নিতে যাবে কেন?

সদানন্দ বললে–তা আমি যদি না নিই তো কে সে দায় নেবে?

–কেন, আর কেউ নেই? মাথার ওপর তো ভগবান আছে। তিনি তো সব দেখছেন, তিনিই তার বিচার করবেন।

–কিন্তু তুমি কি বলতে চাও ভগবানের ওপর সব ভার ছেড়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত থাকবো? তাহলে তোমার সেই ভগবান আমাদের বুদ্ধিই বা দিয়েছেন কেন? বিচার শক্তি দিয়েছেন কেন?

নয়নতারা বললে–ওই যাঃ দেখেছ, কথা বলতে বলতে একেবারে ভুলে গিয়েছি, তুমি বোস, তোমার জন্যে কিছু খাবার নিয়ে আসি–

সদানন্দ বললে–না, তার দরকার নেই, একদিন এখানে এসে তোমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করে গিয়েছি, তার প্রায়শ্চিত্ত করতেই আমি নিখিলেশবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলুম। তিনি যখন নেই, তখন আর কী করবো, আর একদিন বরং আসবো, এখন আমি যাই–

বলে সদানন্দ উঠে দাঁড়াচ্ছিল, কিন্তু নয়নতারা উঠতে দিলে না। জোর করে বসিয়ে দিলে। বললে–না, তুমি বোস, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে–

–কথা? আমার সঙ্গে?

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে কথা বলার এমন সুযোগ হয়ত আর কোনও দিন কখনও আসবে না। আর ঠিক এমন দিনে তুমি এসেছ যখন আমিও অফিসে যাইনি, বাড়িতে একলা রয়েছি–

সদানন্দ বললে–সত্যিই তো, অফিসে যাওনিই বা কেন?

নয়নতারা বললে–সেই কথা বলবার জন্যেই তো আমি তোমাকে বসতে বলছি, জানো, আমি আর কোনও দিন অফিসে যাবোও না–

–সে কী? অফিসে যাবে না কেন?

নয়নতারা বললে–আর তা ছাড়া তুমি একটু পরে এলে হয়ত আমার সঙ্গে তোমার দেখাও হতো না–আমি এবাড়ি ছেড়ে এখুনি চলেই যাচ্ছিলুম। এই দেখো, আমার কটা কাপড় ব্লাউজ এই ব্যাগটায় পুরে নিয়ে বাড়ি থেকে এখুনি বেরিয়েই যাচ্ছিলুম। উঠোনে নেমে সবে সদর-দরজাটা খুলতে যাচ্ছিলুম, এমন সময় তোমার কড়া নড়ে উঠলো–এমন কি আমি চলে যাবো বলে আমার ঝিকে পর্যন্ত বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি, তা জানো–

সদানন্দ বললে–কেন? কোথায় যাচ্ছিলে?

নয়নতারা বললে–জানি না কোথায় যাচ্ছিলুম, এখন আমার এমন অবস্থা হয়েছে যে নরকে যেতেও আমার আপত্তি নেই, এর চেয়ে নরকও বুঝি আমার কাছে ঢের ভালো–

সদানন্দ যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। বললে–হঠাৎ তোমার মনের অবস্থা এরকম হলোই বা কেন?

নয়নতারা বললে–তোমার জন্যে।

–আমার জন্যে?

–হ্যাঁ, সব তোমার জন্যে।

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমি কী দোষ করলুম? তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও বিরোধ বাধে এমন কিছু করবার কল্পনাও তো আমি কখনও করিনি। আমি যখন ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলুম তখন তুমি নিজেই তো আমাকে এখানে তোমার বাড়িতে এনে তুলেছিলে। তখন আমার জ্ঞান থাকলে আমি কিছুতেই আসতুম না। রাস্তায় বরং মরে পড়ে থাকতুম তবু তোমার এখানে আসতুম না–

নয়নতারা বললে–তা আমি জানি। তুমি বরাবর আমাকে ঘেন্না করো তাও আমার অজানা নয়–

সদানন্দ বললে–না, সেজন্যে নয়, আমি চেয়েছিলুম তুমি সুখী হও। আমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার ফলে তোমার কপালে যে কষ্টভোগ হয়েছিল, সে-সব আমি নবাবগঞ্জের দিদিমার কাছে আগেই শুনেছিলুম–

–তা তুমি কি আগে জানতে যে আমার আবার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

সদানন্দ বললে–না, সেটা জানলুম তোমার এখানে রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে। তোমরা পাশের ঘরে যা-সব কথা বলতে সব আমার কানে আসতো। তোমাদের কথাবার্তা শুনেই আমি জানতে পেরেছিলুম নিখিলেশবাবুর সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তিনি তোমাকে চাকরি করে দিয়েছেন, তুমি আমার জন্যে তোমার গলার হার বাঁধা দিয়ে আমার চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছো–

–আমার বিয়ের কথা শুনে কি তোমার খুব কষ্ট হয়েছিল?

সদানন্দ বললে–না, বরং শুনে আনন্দই হয়েছিল।

–আনন্দ হয়েছিল?

–হ্যাঁ, তা আনন্দ হবে না? আমি তোমাকে স্ত্রীর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে না পারলেও অন্য একজন কেউ তোমাকে সেই মর্যাদা দিয়েছে এ জানতে পারলে আনন্দ হবে না?

কথাগুলো শুনে নয়নতারা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। সে মুখটা নিচু করে নিলে। বললে–না, তোমার ধারণা ভুল!

–ভুল?

–হ্যাঁ, তুমি জানো না তাই ও-কথা বলছ। জানলে আর বলতে না। স্ত্রীর মর্যাদা পাওয়া আমার কপালে নেই।

সদানন্দ অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে-–কেন নিখিলেশবাবু তো বেশ ভালো লোক। তিনি নিজে তোমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, পরীক্ষায় পাস করিয়েছেন, পাস করে তোমাকে চাকরি করে দিয়েছেন। তিনি তোমার জন্যে যা করেছেন তা ক’জন স্বামী করে? সেদিক থেকে তিনি তো আমার চেয়ে তোমার অনেক ভালো স্বামী–

নয়নতারা বললে–না, তুমি জানো না ও যা-কিছু করেছে সব ওর নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, আমাকে একজামিনে পাস করিয়ে চাকরি করে দিয়েছে, আমাকে বিয়ে করেছে, সবই করেছে বটে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সব ওর নিজের স্বার্থে–

সদানন্দ বললে–কেন, এতে নিখিলেশবাবুর স্বার্থটা কী?

–স্বার্থ টাকা?

–টাকা!

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, আমি আগে জানতুম না। আগে বুঝতে পারিনি। বুঝলুম তোমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবার পর। তোমাকে দেখে ওর মনে প্রথমেই টাকা খরচের কথাটা উঠলো। প্রথমেই বললে–তোমাকে হাসপাতাকে পাঠিয়ে দিলুম না কেন। আচ্ছা, তুমিই বলো তো, মানুষের প্রাণটা বড়, না টাকা বড়? ও কী করে বলতে পারলে তোমাকে হাসপাতালে পাঠাবার কথা? হাসপাতালে পাঠালে কি তুমি বাঁচতে? সেখানে মাইনে করা নার্স দিয়ে কি তোমার সত্যিকারের সেবা হতো?

তারপর একটু থেমে বললে–তারপর যখন তোমাকে দেখাশোনা করবার জন্যে আমার অফিস কামাই করতে হলো তখন ওর সে কী রাগ! রাগ কেন বুঝতে পারলে তো?

–না।

–রাগ এইজন্যে যে আমার মাইনে কাটা যাচ্ছে। আসলে আমার টাকাটার ওপরেই ওর যত লোভ, আমার ওপরে ওর লোভ নেই। জিনিসটা যত দেখতে লাগলুম ততই আমার খারাপ লাগতে লাগলো। মনে হলো তাহলে এতদিন আমি যা-কিছু ভেবেছি সব ভুল। মনে হলো আমি এমন একটা লোকের হাতে পড়লুম যে আমাকে টাকা উপায়ের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। তোমার অসুখের সময় কিছু টাকা খরচ হয়েছিল বলে আমার সঙ্গে কিছুদিন কথাই বলেনি, এত রাগ হয়েছিল ওর! শেষে একদিন ও বলে গেল ও নবাবগঞ্জে যাবে–

–নবাবগঞ্জে? কেন?

–আমার গয়নাগুলো তোমার কাছ থেকে চেয়ে আনবে বলে।

–তোমার গয়না?

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, কিন্তু আসলে সব মিথ্যে কথা। ওই করে মিথ্যে কথা বলে আমাকে ভোলাতে চেয়েছিল। আসলে টাকার ওপরেই ওর যত লোভ তা জানো! ও তো জানত আমার বিয়ের সময় আমি কত গয়না পেয়েছিলুম! তাই আমাকে পেয়ে ওর লোভ মেটেনি, ওই গয়নাগুলো পেলে তবে ওর মনে শান্তি হতো। এতদিনে বুঝতে পারলুম যে আমার গয়নাগুলোর ওপরই ওর যত লোভ ছিল–

সদানন্দ চুপ করে রইল। নয়নতারা বললে–কই, তুমি কিছু কথা বলছে না যে?

সদানন্দ বললে–আমি এ ব্যাপারে কী বলবো!

–কিন্তু তুমিই তো এখুনি বলছিলে আমি খুব সুখে আছি। এখন আমার সুখের নমুনা শুনলে তো! আমি যে এখানে কত সুখে আছি তা তো জানতে পারলে? এর পরেও তুমি বলবে আমি সুখে আছি? আর তারপর নবাবগঞ্জ থেকে এসে ও কি বললে জানো?

নিখিলেশবাবু কি সত্যি-সত্যিই নবাবগঞ্জ গিয়েছিলেন নাকি?

নয়নতারা বললে–না, আসলে যায় নি তো! কিন্তু মিছিমিছি কোথা থেকে ঘুরে এসে আমাকে বললে–নবাবগঞ্জে গিয়েছিল। এসে বললে যে তুমি নাকি আবার বিয়ে করেছ! আর এমনই আমার পোড়া কপাল যে আমিও ওর সেকথা বিশ্বাস করলুম।

–বিশ্বাস করলে?

–না বিশ্বাস করে করবো কী বলো? আমিও যে তখন সন্দেহের দোলায় দুলছি। তুমি হঠাৎ আমাদের বাড়ি থেকে না বলে চলে যাওয়ার পর থেকে আমার যে সে মনের কী অবস্থা তা যদি তুমি জানতে! তোমার খবর জানবার জন্যে আমি যে তখন কী ছটফটই না করছি! অসুখ শরীর নিয়ে তুমি চলে গেলে, আর আমার ভাবনা হবে না? কেন তুমি অমন করে আমাকে না-জানিয়ে চলে গেলে বলো তো? আমাকে বলে গেলে তোমার কী এমন ক্ষতিটা হতো? আমি কি তোমাকে জোর করে ধরে রাখতুম? না তোমায় জোর করে ধরে রাখবার অধিকার আমার আছে। আমি তোমার কে বলো না যে আমার কথা তুমি রাখতে যাবে?

সদানন্দ কথার মধ্যেখানে হঠাৎ বললে–কটা বাজলো? কই, নিখিলেশবাবু তো এখনও আসছেন না!

নয়নতারা বললে–না আসুক গে না এলেই তো ভালো। তার আসতে যত দেরি হয় ততই তো ভালো। একবারে না এলে আরোই ভালো–ওর মুখ দেখতেও আজকাল আমার ঘেন্না হয় তা জানো! অথচ আগে আমি অতটা বুঝতে পারি নি! বুঝতে পারলুম নবাবগঞ্জে গিয়ে।

–তুমিও নবাবগঞ্জে গিয়েছিলে? কেন? কী করতে?

–তবে সত্যি কথা শুনবে? তোমাকে দেখতে। ভাবলুম দেখেই আসি না গিয়ে তুমি কেমন বিয়ে করলে! তোমার বউ কেমন দেখতে হলো! যখন দেখলুম সব ওর মিথ্যে কথা সেই থেকে আর ওর সঙ্গে কথা বলি নি। কথাও বলি নি, অফিসেও যাই নি। কীসের জন্যে চাকরি করবো? কার জন্যে চাকরি করবো? আর চাকরিই যদি করতে হয় তো আমি মেসে থেকে চাকরি করবো, মেয়েদির বোর্ডিং-এ থেকে চাকরি করবো। আমার চাকরির টাকাতে ও মদ খাবে তা আমি আর কিছুতেই সহ্য করব না। তা এই জন্যেই তো আমি এখুনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলুম, তুমি এসে না পড়লে এতেক্ষণে আমি হয়ত কলকাতায় পৌঁছে যেতুম–

তারপর হঠাৎ সদানন্দর দিকে ঝুঁকে পড়ে বললে–তা তুমি যখন এসেই পড়েছ তো তোমাকেই জিজ্ঞেস করি, তুমি আমার একটা কথা রাখবে?

–কী, বলো?

–কিন্তু তোমাকে বলতে আমার বড় ভয় করছে।

–কী কথা, বলোই না?

–তুমি আমার সঙ্গে যাবে?

সদানন্দ বুঝতে পারলে না। বললে–কোথায়?

–যেখানে তুমি যাবে, সেখানেই আমি যাবো। তোমার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে পারলে আমি বেঁচে যাই, আমার আর কিছুই ভালো লাগছে না। এ বাড়ি আমার কাছে এখন বিষ হয়ে গেছে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা ইট আমার কাছে এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে, এখানে আর একদিন থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো, সত্যি। এর থেকে একমাত্র তুমিই আমাকে বাঁচাতে পারো। আমাকে তুমি নিয়ে যাবে তোমার সঙ্গে?

সদানন্দ এ কথার কিছু জবাব দিল না। চুপ করে রইল।

নয়নতারা এবার আরো কাছে ঝুঁকে এল। বললে–কই, তুমি কিছু কথা বলছে না যে? আমি সঙ্গে থাকলে কি তোমার খুব খারাপ লাগবে? সত্যি বলছি, আমি তোমার বোঝা হয়ে থাকবো না, তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো, দরকার হলে তুমি না হয় অন্য ঘরে শোবে, আর আমি শোব অন্য ঘরে। রাত্তিরে না-হয় কেউ কারো মুখই দেখবো না, তাতে তুমি রাজি তো? বলো তুমি রাজি?

সদানন্দ এবারও কোনও কথা বললে না।

নয়নতারা বললে–দেখ, আমি চলে যাবো বলে আমার ঝিকে পর্যন্ত অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি, আর আমার সঙ্গে কিছু নেবারও নেই। এ বাড়ির একটা জিনিসও আমি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই না। অথচ এর অনেক জিনিস আমার নিজের টাকায় কেনা। একদিন এসব জিনিসের ওপর অনেক মায়া ছিল আমার। একদিন সাধ ছিল কলকাতায় একটা বাড়ি করবো, বেশ মনের মতন বাড়ি। কিন্তু সে-সব শখ এখন ঘুচে গেছে আমার–এখন মনে হয় আমি এতদিন যা-কিছু করেছি সব ভুল করে করেছি। তা সে যাক গে, পুরোন কথা এখন আর না ভাবাই ভালো। এখন না হয় আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করবো। তুমি যদি বলো তো আমার চাকরিটাও আমি ছেড়ে দিতে পারি–

তারপর হঠাৎ যেন আবার নয়নতারার খেয়াল হলো। বললে–কই, তুমি কিছু বলছো যে? আমিই কেবল বকবক করে মরছি। তুমি কি আমাকে সঙ্গে নেবে?

সদানন্দ বললে–তার চেয়ে আমি বরং উঠি, নিখিলেশবাবু তো এখনও এলেন না।

নয়নতারা বললে–তুমি বুঝি চাও সে এখন এসে পড়ুক।

সদানন্দ বললে—হ্যাঁ–

নয়নতারা বললে–কেন? কেন তুমি চাও সে আসুক! তাই যদি চাও তাহলে তুমি বরং এখানে থাকো, আমিই যাই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে–

সদানন্দ বললে–কিন্তু তুমি না-ই বা গেলে!

নয়নতারা বললে–তুমি বলছো কী? তুমি কি চাও আমি ওই মিথ্যে-বাদীটার সঙ্গে সংসার করি? তোমার যদি আমার মত অবস্থা হতো তো তুমিই কি এখানে থাকতে পারতে? কোনও মানুষ তা পারে? আমি বলে তাই এতদিন পেরেছি। অন্য কোনও মেয়ে হলে পারতো না, এ তোমায় আমি বাজি রেখে বলতে পারি–

বলে নয়নতারা কাপড়ের ব্যাগটা আবার হাতে তুলে নিলে। বললে–তাহলে তুমি যাবে না তো? সত্যিই যাবে না?

সদানন্দ কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইল।

–তাহলে তুমি থাকো, আমি যাই, এখুনি একটা ট্রেন আছে কলকাতার!

বলে নয়নতারা যাবার জন্যে পা বাড়াত গেল।

সদানন্দ দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে–তাহলে আমাকেও উঠতে হয়। তুমি চলে গেলে আমি একলা কী করে এ বাড়িতে বসে থাকি!

নয়নতারা বললে–তা একলা বসে থাকতে তোমায় কে বলেছে? আমি তো বলছি তুমি চলো। আমি তো বলছি তুমি যেখানে যাবে আমি সেখানেই যেতে রাজি। নবাবগঞ্জে যেতে বললে–আমি না-হয় নবাবগঞ্জেই যাবো–তুমি বললে–আমি আমার চাকরিটাও ছেড়ে দিতে পারি তা জানো! চলো, চললে চলো, দেরি করলে হয়তো কেউ আবার এসে পড়তে পারে–

হঠাৎ বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ হতেই নয়নতারার মুখটা কেমন যেন ভয়ে শুকিয়ে গেল। নিজের মনেই যেন বলে উঠল–এমন সময় আবার কে এল?

সদানন্দ যেন এতেক্ষণে নিষ্কৃতি পেয়েছে বলে মনে হলো। বললে–বোধ হয় নিখিলেশবাবু এলেন–

কথাটা শুনে নয়নতারা আরো মন-মরা হয়ে গেল। যদি সত্যিই নিখিলেশ হয়! অথচ গিরিবালা বাড়িতে নেই। তাকে নিজে গিয়েই দরজা খুলে দিতে হবে! নয়নতারা উঠোন পেরিয়ে সদর দরজাটা খুলতে গিয়েও একটু দ্বিধা করতে লাগলো।

তারপর বললে–কে?

–আমি দিদিমণি! আমি?

গিরিবালার গলা। গলাটা শুনেই নয়নতারা দরজার খিলটা খুলে দিলে।

–কী হলো? তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এল যে?

গিরিবালা ভেতরে ঢুকে বললে–-মেয়ে ভালো আছে দেখলুম তাই তাড়াতাড়ি চলে এলুম দিদিমণি, ভাবলুম তুমি একলা আছো বাড়িতে–

নয়নতারা বললে–তা মেয়ের কাছে আরো একটু থাকলে না কেন? আমি তো তোমাকে বলেই ছিলুম, আজকে আমার তেমন কোনও তাড়া নেই, তুমি দেরি করে এলেই পারতে

সদানন্দ ঘরটার ভেতরে বসে বসে সব কথা শুনতে পাচ্ছিল। হঠাৎ আবার নয়নতারার কথা কানে এল–তাহলে যখন এসে গেছ তখন আমার একটা কাজ করো দিকিন উনুনে তাড়াতাড়ি আগুন দিয়ে দুজনের একটু চা করে দাও–

সদানন্দর তখন আর একলা বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। তার কেবল মনে হচ্ছিল নিখিলেশবাবু এসে পড়লেই যেন ভালো হয়। এদের স্বামী-স্ত্রীর মনকষাকষির মধ্যে সে কেন মাথা গলাবে! নিজের সংসার নেই বলে পরের সংসারকে কেন সে ভাঙতে যাবে! কেন পরের ক্ষতিসাধনের কারণ হবে!

কিন্তু তখন কি সদানন্দ জানত যে যাদের ভালো করার জন্যে তার এত প্রচেষ্টা, যাদের মঙ্গল করার ব্রত নিয়ে সে এতদিন জীবন প্রদক্ষিণ করে এসেছে, তারাই একদিন তার সমস্ত স্বার্থত্যাগকে পরিহাস করবে? তার এতদিনকার সমস্ত কৃচ্ছ্রসাধন সকলের সমবেত চেষ্টায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে? কত বুদ্ধ, কত চৈতন্য, কত মহম্মদ, কত নানক আরো কত মহাপুরুষ এসে কত জীবন দিয়ে কত সত্যই তো প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, কিন্তু ক্ষণকালের জৌলুসের চোখ ধাঁধানো আলোয় কখন যে এই চিরকালের সত্যটা আচ্ছন্ন হয়ে গেছে তা কি কেউ টের পেয়েছে!

তা হয়ত সদানন্দর সেই শিক্ষারও দরকার ছিল! দরকার ছিল তার এই মোহ-ভঙ্গের! নইলে যে-মানুষ সব কিছু ত্যাগ করবার শক্তি অর্জন করেছে সে কেন নৈহাটির একটা অখ্যাত বাড়িতে আবার ফিরে আসতে গেল? কীসের লোভে? কার আকর্ষণে?

আর সদানন্দ যদি এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে নৈহাটিতে না-ই আসতো সে আসামী হতো কী করে? আর সদানন্দ একজন আসামী হয়েছিল বলেই তো এ-উপন্যাসের অবতারণা।

কিন্তু সে কথা এখন থাক।

.

সমাজের মধ্যবিত্ত আর অল্পবিত্ত মানুষের মন তখন এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখান থেকে বেশি দূরে আর কারোর নজর যায় না। তাদের কাছের জিনিস নিয়েই তারা তখন উদভ্রান্ত। তখন তাদের সামনে ছোটই বড় হয়ে উঠেছে, আর বড়ই হয়ে উঠেছে ছোট। সমসাময়িককেই তারা চিরকালের বলে তারস্বরে ঘোষণা করতে শুরু করেছে আর চিরকালের কথাটা তখন আর কারো মাথায় ঢুকছে না। দেশের নতুন সংবিধান তখন চালু হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে শুধু পাওনাগণ্ডার কথাটাই সবিস্তারে লেখা হয়েছে, মানুষের কর্তব্য বলেও যে একটা জিনিস আছে কোথাও সেটার কোনও উল্লেখ নেই তাতে। সেখানে লেখা আছে আজ থেকে সব মানুষের খাওয়া-পরার দায়টা আমরা নিলাম। কাউকে বেকার থাকতে দেব না, সকলকে আমরা লেখাপড়া শেখাবো, সকলের জন্যে একটা মাথা গোঁজবার আশ্রয় দেবার দায়িত্বটা আমাদের। সুখী সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ গড়ে তোলবার সংকল্পের কথাটাও আমরা পাকা খাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখে গেলাম। কেউ কাউকে শোষণ করতে পারবে না। গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের জয় আমরা ঘোষণা করছি, আজ এই ঘোষণাই আমাদের ভবিষ্যতের বংশধরদের রক্ষাকবচ হোক।

কিন্তু একটা কথা শুধু তাঁরা সেখানে লিখতে ভুলে গেলেন যে মানুষকে তার বদলে কিছু কর্তব্য পালন করতে হবে। লিখতে ভুলে গেলেন যে দেশের মানুষেরও কিছু দায়িত্ব আছে। আর তা লেখা নেই বলেই সরকারের কী করা উচিত সেটা সবাই জানতে পারলে, কিন্তু দেশের লোকেদের কী করা উচিত তা আর কেউ জানতে পারলে না। জানতে পারলে না যে মানুষকেও সৎ হতে হবে, মানুষকেও মানুষ হতে হবে। জানতে পারলে না বলেই চৌধুরী মশাই-এর ফেলে যাওয়া সম্পত্তির ভাগের ওপর প্রকাশ মামার অত লোভ। তাই সাহেব পাড়ায় ‘ম্যাসাজ ক্লিনিক’ খোলবার জন্যে বাতাসীকে মানদা মাসির অত খোশামোদ! তাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা কিছু ব্যবসা করে বড়লোক হবার জন্যে নিখিলেশের অত অস্থিরতা।

প্রতিদিনের মত সেদিনও নিখিলেশ অফিস থেকে বেরিয়েছিল। কিন্তু চারদিকে বড় বড় বাড়ি দেখেই তার মনটা কেমন বিষিয়ে গেল। এরকম প্রতিদিন তার মন বিষিয়ে যায়। মনে হয় সকলেরই সব কিছু হলো, শুধু আমার কিছু হলো না। আমিই চিরকাল কেরানী রয়ে গেলাম। রাস্তা দিয়ে একটা চকচকে ঝকঝকে নতুন গাড়ি দেখলে কেবল একদৃষ্টে সেই দিকে চেয়ে থাকে সে। নিখিলেশের কেবল মনে হতো আমরা হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা করে মরছি আর ওরা কেমন বেশ আরাম করে গাড়ি চড়ে চলেছে!

সেদিন আর এক কাণ্ড হলো। পাশ দিয়ে একটা গাড়ি যেতেই দেখলে পাশের কে একটা লোক গাড়ির গায়ে পচ্ করে একদলা পানের পিক ফেলে দিলে। গাড়ির মালিক লোকটা কিছুই জানতে পারলে না। গাড়িটা যেমন চলছিল তেমনি সামনের দিকে চলতে লাগলো। গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত নিখিলেশ সেই দাগটার দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো। ক্রিম রং-এর গাড়ির গায়ে পানের লাল পিকের দাগ। বাড়িতে গিয়ে ধুতে হবে। বেশ হয়েছে।

যে লোকটা পানের পিক ফেলেছিল তার দিকেও এবারে চেয়ে দেখলে নিখিলেশ। বেশ নির্বিকার কিন্তু লোকটা। গাড়ির গায়ে পানের পিক ফেলে যেন সে মহা কীর্তি করেছে এমনি একটা উল্লাস তার মুখেচোখে।

লোকটা নিখিলেশের দিকে চেয়ে নিজে থেকেই বলে উঠলো–এরাই মশাই ক্যাপিটালিস্ট, এরাই দেশের আসল শত্রু–

নিখিলেশ উত্তরে কিছু বললে না। লোকটা যেমন চলছিল তেমনি চলতে চলতে আবার ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। কিন্তু নিখিলেশের মন থেকে ঘটনাটা অত সহজে মুছলো না।

নিখিলেশের মনে হলো, সত্যিই তো! এরাই তো পুঁজিবাদী। এই গাড়ির মালিকরা। নিখিলেশ নিজে কত পুলিসের লাঠি খেয়েছে, কতবার জেল খেটেছে, কতবার মদের দোকানে পিকেটিং করেছে, খদ্দর পরেছে, ইংরেজ বেটাদের দেশ থেকে তাড়াবার জন্যে কত কী করেছে, আর সেই সাহেবরা যখন সত্যিসত্যিই চলে গেল তখন মাঝখান থেকে লুঠতে লাগলো কিনা অন্য লোকরা। যারা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে মজা লুঠতো, দেশ স্বাধীন হবার পরেও সেই তারাই আবার মজা লুঠতে লাগলো। এ কেমন বিচার! এর নাম কি স্বাধীন হওয়া?

নৈহাটি স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে যখন বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে কড়া নাড়তে যাবে তখন মনে হলো বাড়ির ভেতের যেন কাদের গলা শোনা যাচ্ছে। এ সময়ে বাড়িতে আবার কে এল! যেন পুরুষমানুষের গলার আওয়াজ মনে হচ্ছে!

তাড়াতাড়ি দরজার কড়াটা নাড়লে। দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে।

নিখিলেশ বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ডাকলে–গিরিবালা, ও গিরিবালা—

.

নিখিলেশ বুঝতে পারলে তার কড়া নাড়ার পরই ঘরের ভেতরের কথাবার্তার শব্দ হঠাৎ থেমে গেল। তাহলে কি নয়নতারা রোজই এই রকম করে! এই কারণেই অফিস কামাই করে নাকি নয়নতারা!

ভেতর থেকে গিরিলালার গলা শোনা গেল–কে?

–আমি, দরজা খোল।

গিরিবালা দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে নিখিলেশ ভেতরে ঢুকে রোজকার মত নিঃশব্দে সোজা নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। এই কদিন এমনি করেই সে রোজ অফিস থেকে এসেছে আর নিঃশব্দে নিজের ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে। তারপর নয়নতারা খেলে কি খেলে না, নিখিলেশই বা খেলে কি খেলে না তা নিয়ে দুজনের কেউ মাথা ঘামায় নি। যেন নেহাৎ এক বাড়িতে থাকতে হয় তাই থাকা, এক সংসারে খেতে হয় তাই খাওয়া। তার বেশি আর কিছু নয়।

কিন্তু সেদিন প্রথম ব্যতিক্রম ঘটলো। নিখিলেশ উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় উঠতেই সেই মানুষটার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতে হলো।

–নমস্কার!

আশ্চর্য, তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে এতক্ষণ গল্প করে আবার তাকেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নমস্কার করছে! এত বড় নির্লজ্জ মানুষ তো নিখিলেশ জীবনে আর কখনও দেখে নি!

বললে–আপনি? আপনি কতক্ষণ এসেছেন?

সদানন্দ বললে–আমি অনেকক্ষণ এসেছি, সেই দুপুরবেলা। আপনার সাথে দেখা করবার জন্যেই এতক্ষণ অপেক্ষা করছি–

নিখিলেশ বললে–কিন্তু আপনি তো জানতেন আমি দুপুরবেলা অফিসে থাকি, দুপুরবেলা আমরা দুজনেই অফিসে থাকি–

সদানন্দ বললে–তা জানতুম। তবু এসেছিলুম, কারণ আগেকার ট্রেনটা ধরতে পারিনি। দেরিতে এলেও আপনাদের সঙ্গে দেখা না করে আমি যেতুম না–

নিখিলেশ বললে–আসলে যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তার সঙ্গে দেখা যখন হয়ে গেল তখন আর আমার জন্যে অপেক্ষা করতে গেলেন কেন? আমি তো আপনার কেউ না–

সদানন্দ বাধা দিয়ে বললে–ওকথা বলবেন না। আপনার স্ত্রী আর আপনি আপনাদের দু’জনের সঙ্গেই যে আমার দরকার–

নিখিলেশ বললে–বলুন, আমার সঙ্গে আপনার কী দরকার?

নয়নতারা বললে–তুমি মুখ-হাত-পা ধুয়ে এসে বোস না। তুমি এখন অফিস থেকে এলে, এত তাড়াহুড়ো করবার কী আছে?

সদানন্দও বললে–হ্যাঁ আপনি এত দূর থেকে এলেন, একটু বিশ্রাম করে নিন, আমি বরং অপেক্ষা করছি–

নিখিলেশ বললে–না, আমার বিশ্রামের দরকার নেই, আপনি কী বলবেন বলুন! আপনার কী এমন জরুরী কাজ যে যে-সময়ে আমি বাড়িতে থাকি না বেছে বেছে ঠিক সেই সময়েই এসেছেন?

সদানন্দ বললে–আপনি অকারণে আমার ওপরে রাগ করছেন!

নিখিলেশ বললে–তা রাগ করা কি আমার অন্যায় হয়েছে? আপনি কেন এই অসময়ে আমাদের বাড়িতে এলেন? আপনি তো রবিবার দেখে আসতে পারতেন, যেদিন ছুটির দিন, তা না এসে আজকে এলেন কেন? আপনার সঙ্গে নয়নতারার এমন কিসের সম্পর্ক যে এখনও তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন?

সদানন্দ বললে–এই আমার শেষ আসা নিখিলেশবাবু, এর পরে আমি আর কখনও আসবো না–

নিখিলেশ বলে–তা আমার অনুপস্থিতিতে আপনার কি পরস্ত্রীর কাছে আসা ঠিক হয়েছে?

এতক্ষণে নয়নতারা কথা বললে। বললে–তুমি চুপ করো, উনি এসেছেন বেশ করেছেন, দরকার হলে আবার আসবেন–

নিখিলেশও গলা চড়িয়ে দিলে। বললে–না, আমি বলছি আসবেন না আমি আসতে দেব না–

নয়নতারা বলে উঠলো–তুমি আসতে না-দেবার কে? এবাড়ি আমারও বাড়ি! তুমি যদি ওঁকে আসতে না দাও আমি আসতে দেব ওঁকে, দেখি তুমি কী করতে পারো!

–তার মানে? তুমি আমার কথার ওপরে কথা বলো? এত দূর তোমার সাহস?

নয়নতারা বলে উঠলো–তোমারই বা এমন কী সাহস যে আমাকে তুমি চোখ রাঙাচ্ছো তুমি কি মনে করো তোমাকে বিয়ে করেছি বলে আমি তোমার ঝি? তুমি যা বলবে তাই ই আমাকে শুনতে হবে?

–খবরদার বলছি আমার সঙ্গে অমন করে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করতে এসো না—

নয়নতারা বললে–তোমার সঙ্গে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করতে আমার বয়ে গেছে! মানুষের সঙ্গেই মানুষ ঝগড়া করে, তুমি কি একটা মানুষ?

নিখিলেশ এ-কথার উত্তর না দিয়ে সদানন্দর দিকে চেয়ে বললে–আসুন সদানন্দবাবু, আমার সঙ্গে যেকথা বলবার আছে তা আমার ঘরে এসে বলুন, এখানে কথা বলা যাবে না–

বলে সদানন্দর হাত ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে।

নয়নতারা রাস্তা আটকে দাঁড়ালো। বললে–কেন তোমার ঘরে যাবে ও? যা বলবার এখানে আমার ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে বলবে, এখানে দাঁড়িয়েই ওর কথা তোমায় শুনতে হবে–

সদানন্দ নয়নতারার দিকে চাইলে। বললে–নিখিলেশবাবুর ঘরেই যাই না, তাতে তোমার কী আপত্তি? এতক্ষণ তো তোমার ঘরেই বসেছিলুম, এতক্ষণ তো তোমার সঙ্গেই কথা বললুম! তোমাকে যে কথাগুলো বলেছি সেই কথাগুলোই ওঁকে ওঁর ঘরে বসেই বলি না–

নিখিলেশ বললে–আসুন আসুন–সব ব্যাপারে ওর কথা শুনতে হবে তার কী মানে আছে–

নয়নতারা বললে–তাহলে আমিও সেখানে থাকবো, আমার আড়ালে আমার বিরুদ্ধে কোনও কথা আমি বলতে দেব না–

বলে সেও দু’জনের সঙ্গে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলো।

নিখিলেশ সদানন্দকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েই বললে–দেখুন সদানন্দবাবু, আপনি হয়ত জানেন না, আমি আপনার মত বড়লোকের ঘরের ছেলে নই। প্রথম জীবনে স্বদেশী করেছি, ভেবেছিলুম দেশের কাজ করেই সারা জীবন কাটাবো, কিন্তু দিনকাল বদলে গেল। আমরা যারা একসঙ্গে জেল খেটেছি তাদের মধ্যে কত লোক কত বড় হয়ে গেল। কেউ পেলে নুনের কনট্র্যাক্ট, কেউ পেলে ভালো চাকরি। আবার কেউ বা জেল-খাটার জন্যে পেলে ফরেন সারভিস। সবাই বড় বড় বাড়ি করে ফেললে কলকাতায়, তারা রাস্তা দিয়ে বড় বড় গাড়ি চড়ে বেড়ায়, আমাকে দেখলে এখন চিনতেই পারে না। তাদের মধ্যে আমিই কেবল এখনও সেই গরীবই রয়ে গেলাম। আমার কিছুই হলো না। এমন সময়ে নয়নতারাকে বিয়ে করতে হলো। ভাবলুম দু’জনে চাকরি করবো। একজনের মাইনের টাকা জমিয়ে কলকাতায় একটা ছোটখাটো বাড়ি করবো। তারপরে সুখে-স্বচ্ছন্দে দিন কাটাবো, যেমন আমার আগেকার বন্ধুরা কাটায়।

নয়নতারা মাঝখানে বলে উঠলো–এই সব কথা বলার জন্যেই তুমি ওঁকে তোমার ঘরে ডেকে নিয়ে এলে নাকি?

নিখিলেশ বললে–আমাকে বলতে দাও না সবটা–

সদানন্দ বললে–এ-সব কথা আমি জানি নিখিলেশবাবু, আমাকে কেন এ-সব কথা বলছেন?

নিখিলেশ বললে–আপনাকে এই জন্যে বলছি যে, আপনি আমার সমস্ত অশান্তির মূল–

সদানন্দ অবাক হয়ে গেল। বললে–আমি?

–হ্যাঁ, আপনিই আমাদের সমস্ত অশান্তির জন্য দায়ী।

–কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি না আমি আপনাদের অশান্তির জন্য কেন দায়ী হলুম!

নিখিলেশ বললে–আপনি যেদিন থেকে আমাদের বাড়িতে এসে ঢুকলেন সেই দিন থেকেই আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ভাঙন ধরলো। যে কটা টাকা আমরা জমিয়ে ছিলুম সব নষ্ট হয়ে গেল। একটা সোনার হার গড়িয়ে দিয়েছিলুম নয়নতারাকে, তাও আপনার অসুখের সময় হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন আর আমাদের জমানো টাকা বলে কিছু নেই–

সদানন্দ শুনে খানিক চুপ করে রইল। তারপর বললে–আমি স্বীকার করছি আমি দোষ করেছি। জ্ঞাতসারে নয়, অজ্ঞাতসারে আমি সব কিছুর জন্যে অপরাধী–

কিন্তু তার কথা শেষ হবার আগেই নিখিলেশ আবার বললে–আপনি যদি সত্যিই নিজেকে অপরাধী মনে করেন তো এখন তার প্রতিকারও আপনার হাতে–

সদানন্দ বললে–বলুন কী করলে তার প্রতিকার হবে?

–তাহলে নয়নতারার যে-সব গয়না আপনাদের কাছে ছিল সেগুলো অন্তত ফেরত দিন–অন্তত…

নয়নতারা হঠাৎ বলে উঠলো–না, চাই না আমার গয়না, তুমি কিছুতেই গয়নাগুলো দিও না ওকে, ও ওই গয়নাগুলোর লোভেই আমাকে বিয়ে করেছে তা জানো? গয়না গুলোর ওপরেই ওর যত লোভ–

–কী? তোমার গয়নার ওপরে আমার লোভ?

নয়নতারা বলে উঠলো–হ্যাঁ, লোভই তো। তুমি মনে করেছ আমি সত্যি কথা বলতে ভয় পাবো? তুমি গয়নাগুলো আনতে নবাবগঞ্জে যাও নি?

–গিয়েছিলুম সে কি আমার জন্যে? সেই গয়না বিক্রি করে যখন টাকা হতো সে টাকা কি আমি নিজের নামে ব্যাঙ্কে রাখতুম?

সদানন্দ দু’জনের মধ্যস্থতা করবার জন্যে বললে–দেখুন নিখিলেশবাবু, সে-সব তো অনেক দিন আগেকার ঘটনা, আমি সে-সব দেখিও নি, আর দেখলেও তা আমার মনে নেই। আপনি যদি বলেন সেই গয়নার কত দাম হতে পারে তো এখন আমি তা দিতে পারি

নয়নতারা বাধা দিয়ে বললে–না, তা দিতে হবে না। সে-গয়না সে-টাকা আমি কিছুই নেব না—

নিখিলেশ বললে–কেন নেবে না? তোমার গয়না, তার ওপরে তো তোমার অধিকার আছে, নেবে না কেন?

–আমি যদি না নিই তো তোমার কী? আমার গয়নার ওপর তোমার অত লোভ কেন?

নিখিলেশ বললে–লোভের কথা বার বার বলছো কেন?

–তা বলবো না?

নিখিলেশ বললে–না, কেন বলবে? কেন? তোমার গয়না কি আমার গয়না নয়? তুমি আমি কি আলাদা?

নয়নতারা বলে উঠলো–নিশ্চয়ই আলাদা, আলাদা না হলে আমার গলার হার বাঁধা দিয়েছিলুম বলে কেন তুমি আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছিলে?

নিখিলেশ রেগে উঠলো। বললে–কেন তুমি আবার সেই সব কথা তুলছো?

নয়নতারা বললে–তুলবোই তো। তুমি ভেবেছ আমাকে বিয়ে করেছ বলে তুমি আমার মাথা কিনে নিয়েছ? আমি কি তোমার মাইনে করা ঝি যে আমাকে তুমি যা বলবে তাই সহ্য করবো?

–থামো, চুপ করো!

নয়নতারাও গলা চড়িয়ে দিলে। বললে–কেন চুপ করবো? তোমার ভয়ে? তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাও? তুমি ভেবেছ আমি তোমার চোখরাঙানিতে ভয় পাবো?

নিখিলেশ সদানন্দর দিকে চাইলে। বললে–সদানন্দবাবু, কেন আপনি এলেন বলুন তো? কেন আপনি আমাদের মধ্যে এসে এমন করে আমাদের সংসার বিষিয়ে দিলেন? আপনি নিজের চোখেই সব কিছু দেখলেন তো! আপনি যেদিন থেকে আমাদের এখানে এসে উঠেছিলেন সেই থেকেই এই রকম শুরু হয়েছে, তার আগে আমরা কত সুখে ছিলুম। আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি দয়া করে আর আসবেন না। দয়া করে আপনি এখন চলে যান, আমাদের বাঁচতে দিন–

সদানন্দ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নয়নতারা বলে উঠলো–কেন তুমি ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছ? আমি বলছি উনি যাবেন না, উনি চলে গেলে আমিও এখানে আর থাকবো না–

নয়নতারার কোনও কথার উত্তর না দিয়ে নিখিলেশ সদানন্দর দিকে চাইলে। বললে– আপনি উঠুন সদানন্দবাবু, দোহাই আপনার, আপনি উঠুন–

নয়নতারা বললো, উনি উঠবেন না–

–নিশ্চয়ই উঠবেন। আপনি উঠুন সদানন্দবাবু—

নয়নতারা বললে–কিছুতেই উঠবেন না, আমি ওঁকে উঠতে দেব না—

নিখিলেশ বললে–তোমার জোর নাকি?

বলে নিখিলেশ সদানন্দবাবুর হাত ধরলে। বললে–দোহাই আপনার, আপনি উঠুন—

কিন্তু সদানন্দ তখন নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে–কিন্তু আমার কথা তো কিছু বলা হলো না–

–সে আর বলতে হবে না আপনাকে, আপনি এখন যান–

সদানন্দ তখন ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। নিখিলেশ বললে–দেরি করছেন কেন, আপনি যান—আসুন–

নয়নতারা বলে উঠলো–তাহলে আমিও এ বাড়িতে থাকবো না, আমিও চলে যাবো–

নিখিলেশ তখন সদানন্দকে ঠেলতে ঠেলতে উঠোন দিয়ে সদর-দরজার বাইরে ঠেলে দিয়েছে। বললে–দেখছেন তো আমি কী অবস্থার মধ্যে বেঁচে আছি-এর পরও আপনি এখানে আসবেন?

পেছন থেকে নয়নতারা দৌড়তে দৌড়তে এল। বললে–তুমি পথ ছাড়ো, পথ ছাড়ো, আমিও যাবো–

কিন্তু তার আগেই নিখিলেশ সদর দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিয়েছে। দিয়ে পথ আটকে দাঁড়িয়ে রইল।

নয়নতারা বললে–তুমি সরো–আমি বাইরে যাবো—সরো—

নিখিলেশ গলা চড়িয়ে বললে–না–

–আমি আর কিছুতেই থাকবো না এ বাড়িতে–আমিও চলে যাবো–সরো বলছি—

নিখিলেশ তখনও তেমনি করে পথ আটকে দাঁড়িয়ে রইল। বললে–না, কিছুতেই সরবো না–দেখি তুমি কী করে যাও—

.

বড়বাজার তখন আরো জম-জমাট। দেশের অবস্থা ভালো হোক আর মন্দই হোক বড়বাজারের বাড়বাড়ন্ত যেন কখনও কমতে নেই। বড়বাজারের মানুষ যেন কিছুতেই দমে না। উৎসবে ব্যসনে রাজদ্বারে শ্মশানে বড়বাজার চিরকালের জন্যে সকলের অন্তরঙ্গ বান্ধব। প্রকাশ মামা বেশিক্ষণ এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকবার মানুষ নয়। বিশেষকরে বড়বাজারের হট্টগোলের মধ্যে ধর্মশালার একটা অন্ধকার ঘরের কোণে প্রকাশ মামার মত মানুষ কী বেশিক্ষণ বন্দী হয়ে থাকতে পারে! আগেও প্রকাশ মামা কলকাতায় এসেছে বড়বাজারে। কিন্তু সে তো টাকা ওড়াতে। তখন নবাবগঞ্জই ছিল প্রকাশ মামার বড়বাজার। সেই নবাবগঞ্জের বড়বাজারে টাকা আয় করে তা খরচ করতে আসতো কলকাতার এই বড়বাজারে। এটা ছিল প্রকাশ মামার টাকা ওড়াবার বড়বাজার। বলতে গেলে প্রকাশ মামার কাছে সমস্ত কলকাতা শহরটাই ছিল তার বড়বাজার। রাতটা কাটাতো মানদা মাসির কালীঘাটের বস্তি বাড়িতে। আর দিনটা কাটতো এই বড়বাজারে। এখানে কোন দোকানে খাঁটি সিদ্ধির সরবৎ পাওয়া যায়, কোন গলির মধ্যে কার কোন্ কোটরে চোলাই মদ পাওয়া যায়, সে-সব ছিল প্রকাশ মামার নখদর্পণে!

আহা প্রকাশ মামার কত সাধের কলকাতা! জামাইবাবু মারা যাবার পর থেকে কত স্বপ্ন দেখে এসেছে প্রকাশ মামা। বরাবর মনে মনে চার লাখ-টাকার স্বপ্ন দেখে এসেছে। স্বপ্ন দেখেছে কলকাতায় একখানা বাড়ির। আর স্বপ্ন দেখেছে বিলিতি হুইস্কির। জীবনে বিলিতি হুইস্কি খাওয়ার বড় সাধ ছিল প্রকাশ মামার। যতদিন দিদি বেঁচেছিল ততদিন পেট পুরে বিলিতি হুইস্কি খেয়েছে। কিন্তু দিদি মারা যাওয়ার পর থেকে আর খাওয়ার পয়সা জোটেনি। দিশী হুইস্কি দু’একবার খেয়ে দেখেছে সে, কিন্তু সে ধেনো মদের মতন। তাতে নেশা হয় না, বরং নেশাটা কেটে যায়।

পাঁড়েজী দেখতে পেয়েছে। বললে–কোথায় যাচ্ছেন মামাবাবু?

প্রকাশ মামা কথাটা কী করে বলবে বুঝতে পরলে না। বললে–আমার ভাগ্নে তো এল না পাঁড়েজী, কোথায় গেল বলো তো? এখনও এল না কেন?

পাঁড়েজী কী করে জানবে কেন বাবুজী এল না!

প্রকাশ মামা বললে–অথচ জানো, একসঙ্গেই আমরা রেলবাজার থেকে ট্রেনে উঠলুম, আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম আর তারই ফাঁকে কোথায় কোন্ ইস্টিশানে সদা নেমে গেল টেরই পেলুম না।

একটু থেমে বললে–তা কোথায় গেল বল তো সে? কোথায় যেতে পারে?

পাঁড়েজী বললে–তা কী করে বলবো হুজুর–

প্রকাশ মামা বললে–তা তো বটেই, তুমিই বা কী করে বলবে? আসলে আমারই দোষ, পোড়া চোখে কী ঠিক সেই সময়েই ঘুম আসতে হয়? শালা ঘুমেরও কী একটা সময় অসময় নেই রে? জানো আমার এমন রাগ হচ্ছে নিজের ওপর, মনে হচ্ছে নিজের গালে নিজে কষে চড় মারি–

–আপনি অত ভাবছেন কেন? এসে যাবেন ঠিক, দু’দিন একটু সবুর করুন না।

প্রকাশ মামা অস্থির হয়ে উঠলো। বললে–তুমি বুঝছো না পাঁড়েজী, তুমি বুঝতে পারবেও না। আমার মতন অবস্থা তোমার হলে তুমি বুঝতে পারতে। একটা দুটো টাকা তো নয়, চার-চার লাখ টাকা আমার ভাগ্নে খোলামকুচির মত উড়িয়ে দিলে।

–চার লাখ টাকা? বাবুজী উড়িয়ে দিলে?

–হ্যাঁ পাঁড়েজী, তবে আর বলছি কি তোমাকে, একেবারে খোলামকুচির মত উড়িয়ে দিলে গো, তবু আমাকে একটা পয়সা পর্যন্ত দিলে না।

পাঁড়েজী এসব কথা কিছুই বুঝতে পারলে না। বললে–অত টাকা কোত্থেকে পেলে বাবুজী?

প্রকাশ মামা বললে–তুমি কিছু বুঝবে না, তোমাকে বলে কিছু লাভ নেই। আট লাখ রুপিয়া তোমার বাবুজী হাতে পেয়েছিল, সেই টাকাটা কেউ গাঁয়ের ছোটলোক-গুলোকে দেয়?

–কেন দিলে?

–দেখ পাঁড়েজী, তুমি বিচক্ষণ লোক তাই ওই কথা বললে। পৃথিবীর সব বিচক্ষণ লোকই ওই কথা বলবে। আমিও তাই তোমার বাবুজীকে বললুম যে কেন ওদের দিচ্ছিস? ওরা ছোটলোক, ওরা টাকার মর্ম কী বুঝবে? কিন্তু সদা তবু শুনলে না, বললে–ওদের টাকা আমি ওদেরই দিচ্ছি। শোন একবার ভাগ্নের কথা! বাপের টাকা তুই আইনত পেয়েছিস, ও-টাকা তোর হকের টাকা। কিন্তু ওদের ও টাকা কী কাজে লাগবে? ওরা হুইস্কি খেতেও জানে না, মেয়েমানুষও পুষবে না, ওরা টাকা-গুলো নিয়ে নয়-ছয় করে ফেলবে। তা আমার কথা তো শুনলে না, চার লাখ টাকা ওদের দিয়ে দিলে বললে–গাঁয়ের লোকের জন্যে হাসপাতাল হবে, ইস্কুল হবে, কলেজ হবে–

–চার লাখ রুপিয়া?

প্রকাশ মামা বললে–তবে আর বলছি কী! অথচ দেখ আমি ছাপোষা মানুষ, মাগ-ছেলে মেয়ে আছে আমার, তার ওপর বুঝলে আমার আবার নেশাভাঙ করার সামান্য বদ অভ্যেস আছে, আমাকেও তো তার থেকে কিছু দিবি তুই! আমি তোর গরীব মামা, আমার কথা তুই একেবারে ভুলে গেলি রে? এত বড় নেমকহারাম তুই? বলো পাঁড়েজী, তুমি নিজেই বলো, এটা নেমকহারামী হলো না? তুমি তো বিচক্ষণ লোক, তুমিই বলো–

পাঁড়েজী কী বলবে বুঝতে পারলে না।

প্রকাশ মামা বলল–আমার কী ভয় হচ্ছে জানো পাঁড়েজী, ভয় হচ্ছে, বাকী যে চার লাখ টাকা সঙ্গে রয়েছে সেটা আবার কাউকে না দিয়ে দেয়–

পাঁড়েজী বললে–বাবুজী তা দিতে পারে, বাবুজীর কাছে টাকা থাকলে যাকে সামনে পাবে তাকেই দিয়ে দেবে।

প্রকাশ মামা আরো ভয় পেয়ে গেল। বললে–তাই নাকি? তবে তো সব্বোনাশ–

–হ্যাঁ বাবুজী, আমি একবার একটা গায়ে দেবার শাল কিনে দিয়েছিলুম, সেটা বাবুজী একটা বুড়িকে দিয়ে দিলে–

–কে বুড়িটা?

–সে বাবুজী একটা বস্তির বুড়ি, খাটালে থাকে, ঘুঁটে বিক্রি করে বেড়ায়—

প্রকাশ মামা বললে–ইস, তাহলে তো সব্বোনাশ পাঁড়েজী। এখনও যে হাতে চার লাখ টাকা রয়েছে–

–নগদ চার লাখ টাকা?

প্রকাশ মামা বললে–না, ব্যাঙ্কে টাকা আছে, কিন্তু চেক্ কেটে দিলেই হলো, চেক বই তো তার সঙ্গেই রয়েছে।

আর ভাবতে পারলে না প্রকাশ মামা। যতই ভাবছিল ততই তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। এতদিন ধরে ভাগ্নেটাকে শিখিয়ে পড়িয়ে শেষকালে কিনা একটা অপোগণ্ড হয়ে গেল সদা। ছোটবেলা থেকে কত মেয়ে-মানুষের বাড়িতে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছে, ভেবেছিল একদিন না একদিন সে মানুষ হবে!

বেরোবার সময় বললে–আমি আসছি পাঁড়েজী, আমি এসে ভাত খাবো

–তা এখন আবার কোথায় বেরোচ্ছেন?

প্রকাশ মামা বললে–-বেশি দেরি হবে না, আমি যাবো আর আসবো। একটা জরুরী কাজে বেরোচ্ছি, আমি যাবো আর আসবো–এসে ভাত খাবো–

–যদি বাবুজী তার মধ্যে এসে পড়ে তো আমি কী বলবো?

–বলবে আপনার মামা এসেছে। এসে আপনার জন্যে বসে আছে। আমি না-আসা পর্যন্ত যেন তাকে ছেড়ো না বুঝলে? আমি যাবো আর আসবো—

বলে দু’পায়ে জুতোজোড়া গলিয়ে হনহন করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। বড়বাজারের ঘিঞ্জি রাস্তা। তার ওপর গিজগিজ করছে লোক। চলতে গেলে লোকের গায়ে ধাক্কা লেগে যায়। যেন দুনিয়ার সব লোক এখানে এসে হাজির হয়েছে। রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে ভেতরের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে একবার দেখলে। গোটা কয়েক টাকা রয়েছে তখনও। ওতেই এখানকার মত কাজ চলে যাবে তার। তারপর সদা এলে টাকা চেয়ে নিলেই চলবে।

–ও দাদা, শুনুন!

একটা বখাটে গোছের লোককে দেখে প্রকাশ মামা তাকেই ডাকলে। দেখে বোঝা যায় লোকটা মাল-টাল খায়।

থতমত খেয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে গেল। বললে–কী?

প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা বলতে পারেন মশাই শুড়ি-খানাটা কোন্ জায়গায়?

–শুঁড়িখানা?

প্রকাশ মামা বললে–হ্যাঁ, শুঁড়িখানা

লোকটার মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন দেখে প্রকাশ মামা আরো বিশদ করে বুঝিয়ে বললে–মানে মদের দোকান, দিশি মদের দোকান। আমি আগে অনেকবার এসেছি, এবার দিনের বেলা কিনা তাই চিনতে পারছি না, আগে রাত্তিরে এসেছিলুম তো–

লোকটা খানিকক্ষণ প্রকাশ মামার দিকে কী রকম কটমট করে তাকিয়ে বললে–আমি জানি না–

বলে হন-হন করে যেদিকে যাচ্ছিল তেমনি আবার চলতে লাগলো।

প্রকাশ মামা লোকটার দিকে হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো। আশ্চর্য তো! মদের নাম শুনেই এমন ঘেন্না! কেন, মদ কি খাবার জিনিস নয়। মদের নাম করে কী এমন অন্যায়টা করেছি।

মনে বড় আঘাত লাগলো প্রকাশ মামার। না, এমন বেআদপি সহ্য করলে চলবে না। লোকটা যেদিকে যাচ্ছিল প্রকাশ মামা সেইদিকেই দৌড়তে দৌড়তে চললো–ও মশাই, শুনুন শুনুন–

লোকটার কাছে যেতেই লোকটা শুনতে পেয়েছে। পেছন ফিরে দাঁড়ালো লোটা।

প্রকাশ মামা বললে–আপনি যে কটমট করে চাইলেন আমার দিকে, আমি কী করেছি আপনার?

লোকটা আরো হতবাক!

কিন্তু প্রকাশ মামা ছাড়বার পাত্র নয়। বললে–বলুন, আমি কী করেছি আপনার? আমি তো শুধু আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি শুঁড়িখানাটা কোথায়! তা আপনার গায়ে কি ওমনি ফোঁসকা পড়ে গেছে? মদ কি এত ঘেন্নার জিনিস সে আপনি আমার দিকে অমন কটমট করে চাইলেন?

লোকটা বললে–তা আমি কি মাতাল যে তুমি আমার কাছে শুঁড়িখানার হদিস জানতে চাইছো?

প্রকাশ মামা চটে গেল। বললে–খবরদার বলছি তুই-তোকারি কোর না, ভালো হবে না–

লোকটা বললে–মাতালকে আবার তুই-তোকারি করবো না তো কি আপনি-আজ্ঞে করবো নাকি?

–তার মানে? আমি মাতাল? আমি মদ খেয়েছি?

লোকটা বললে–তা মাতাল নয় তো শুঁড়িখানার খবর জানতে চাইছো কী করতে শুনি? ঠাকুর-পুজো করতে?

প্রকাশ মামা শাসিয়ে উঠলো–খবরদার বলছি, মাতাল বোল না আমাকে–

–মাতাল বলেছি বেশ করেছি মাতালকে মাতাল বলবো না তো কী বলবো? শ্বশুর বলবো? সেটা ভালো হবে?

সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপে গেছে প্রকাশ মামা। একেবারে লোকটার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল। কিন্তু আশেপাশের কয়েকজন লোক হাঁ হাঁ করে একেবারে ছুটে এল, এসেই প্রকাশ মামার হাতটা ধরে ফেলেছে। কী হলো মশাই, কী হলো? মুখ থাকতে হাতাহাতি কেন?

প্রকাশ মামা একটু জোর পেলে। বললে–দেখুন না মশাই, আমাকে শুধু-মুধু মাতাল বললে–

–কেন, উনি মাতাল বলতে গেলেন কেন? আপনি কি মদ খেয়েছেন?

প্রকাশ মামা বললে–রামঃ, আমি মদ খেতে যাবো কোন্ দুঃখে মশাই? এই তো আমি হাঁ করছি আপনাদের সামনে আপনারা শুঁকুন গন্ধ শুঁকুন–

বলে সকলের সামনে হাঁ করে বললে–কী? মদের মন্ধ পেলেন আমার মুখে? পেলেন গন্ধ?

কেউ ‘হাঁ’ কিছুই বললে–না। প্রকাশ মামা আবার বললে–দোষের মধ্যে আমি শুধু ওকে জিজ্ঞেস করেছি এখানে শুঁড়িখানাটা কোন্ দিকে। তা সেটা জিজ্ঞেস করাই আমার দোষ হয়ে গেল?

একজন বললে–তা আপনি শুঁড়িখানার খোঁজ নিতেই বা গেলেন কেন? আপনি কি মদ খান?

প্রকাশ মামা বললে–আপনারাও তো দেখছি তেমনি লোক মশাই, শুঁড়িখানার কথা জিজ্ঞেস করলেই ওমনি মদ খাওয়া হয়ে গেল? আমার আত্মীয়দের মদের দোকান থাকতে পারে না? আমরা তো মশাই জাতে শুঁড়ি, জাত-ব্যবসা করবো তাতেও দোষ? আমাদের সাত পুরুষের মদের কারবার। এই মদের কারবার করেই আমার ঠাকুর্দা সে-যুগে রায় বাহাদুর হয়েছিল তা জানেন? আমার কাকা মদের কারবার থেকে দু’লাখ টাকা দিয়েছিল দেশবন্ধু সি আর দাশের হাতে, সেই টাকায় এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। মদের টাকা দেশসেবার কাজে লাগাতে দোষ নেই আর মদ খেলেই দোষ?

অকাট্য যুক্তি সব। লোকগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। প্রকাশ মামা আর দাঁড়ালো না সেখানে। সকলের মুখে জুতো মেরে অন্য দিকে চলে গেল। দেশ স্বাধীন হয়েছে না কলা হয়েছে। নিজের পয়সায় মদ কিনে খাবো তারও স্বাধীনতা নেই তখন দেশ স্বাধীন হয়ে লাভটা কী হলো?

কিন্তু বড়বাজারে চেষ্টা করলে কী না পাওয়া যায়! খুঁজতে খুঁজতে শেষকালে সেই দোকানটা পাওয়া গেল। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ। কিন্তু সেই কড়া রোদের মধ্যেও দোকানে খদ্দেরের কমতি নেই। ভিড় ঠেলে একেবারে সামনের দিকে টাকাটা হাত বাড়িয়ে ধরে বললে–দেখি একটা দু’নম্বর পাঁট-

বোতলটা নিয়ে পাশের একটা কাঠের বেঞ্চির ওপর আয়েস করে বসলো প্রকাশ মামা। তারপর কোঁচার খুঁট দিয়ে মালটা ছেঁকে গেলাসে ঢালতে লাগলো। তারপর কাঁচা পেঁয়াজকুচো আর ভিজেছোলা চিবোতে চিবোতে গেলাসটায় আলতো করে চুমুক দিলে। আঃ, প্রকাশ মামার মনে হলো–যেন সমস্ত শরীরটা জুড়িয়ে গেল। হোক দিশী মাল, কিন্তু মালটা খাঁটি–

একটা পাঁটে ঠিক যেন শানালো না। আর তা ছাড়া এত ঝামেলা, এত ঝঞ্ঝাটের পর কি এক পাঁটে শানায়? জিভটা ভিজোতেই সবটা শেষ হয়ে গেল। এবার একটা ছোট বোতল নিয়ে নিলে। তখন একটু গরম হলে শরীরটা। পকেটে তখন আরো কয়েকটা টাকা রয়েছে। প্রকাশ মামা আবার হাত বাড়িয়ে দিলে–আর একটা ছোট দেখি দাদা–

আবার কাঁচা পেঁয়াজকুচো আর ভিজেছোলা খেতে খেতে বেশ মৌজ হলো যখন তখন বেঞ্চি ছেড়ে উঠলো।

সকলকে বললে–সরো সরো–হাটো ভাই, হাটো–

মাতাল দেখে সব মাতালই রাস্তা করে দিলে। মাতালরাই মাতালদের চেনে। প্রকাশ মামার মেজাজ তখন তর হয়ে এসেছে। তখন আর খারাপ লাগছে না কিছুই, খারাপ লাগছে না কাউকেই। সবাই ভালো, সবাই গুড! মাথার ওপর কড়া সূর্যটাকেও যেন তখন চাঁদ বলে মনে হলো। বেশ স্নিগ্ধ, বেশ নীল।

–এই রিকশাওয়ালা! রিকশাওয়ালা!

রিকশাওয়ালাটা দৌড়ে কাছে এল রিকশাটা নিয়ে।

বললে–কাঁহা যায়গা বাবুজী?

প্রকাশ মামা বললে–না বাবা, কোথাও যাবো না। শুধু বসবো তোমার রিকশার ওপর তুমি রিকশাটা রাখো।

রিকশাটা সামনে নামিয়ে রাখতেই প্রকাশ মামা তার ওপর উঠে বসলো। রিকশাওয়ালা রিশাটা টানতে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রকাশ মামা বাধা দিল। বললে–আরে, টানতা হ্যায় কেঁও। টেনো না, এমনি দাঁড়িয়ে থাকো–

রিকশাওয়ালা জীবনে এমন খদ্দের কখনও দেখেনি। সে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সওয়ারি রিকশার ওপর চুপ করে বসে থাকবে, এ কখনও সম্ভব?

কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে গেল কাণ্ড দেখে। বড়বাজারে কারণে-অকারণেই লোক জড়ো হয়।

সবাই জিজ্ঞেস করলে–ও মশাই, আপনি যাবেন কোথায়?

প্রকাশমামা বললে–কোথাও যাবো না–

–কোথাও যাবেন না তো এমনি করে রিকশার ওপর বসে থাকবেন?

–হ্যাঁ, আমি এখানে বসে থাকবো, বসে বসে ঘুমোব। তাতে তোমাদের কী?

একজন ততক্ষণে গন্ধ পেয়ে গেছে। বলে উঠলো–ওরে মাতাল রে, লোকটা মাতাল–

–কী বললে? আমি মাতাল?

–তা আপনি ওখানে বসে থাকবেন কেন? হয় আপনি কোথাও যান, না-হয় রিকশা থেকে নেমে পড়ুন। আর ঘুমোতে হয় তো বাড়িতে গিয়ে ঘুমোন–

প্রকাশ মামা বললে–না, আমার ইচ্ছে আমি এই চাঁদের আলোর তলায় ঘুমোব–

তখন লোকগুলো ক্ষেপে উঠলো। সবাই হাত ধরে টানলে–এই শালা নাম–নাম শালা–

–না আমি নামবো না।

–তবে রে মাতাল—

বলে সবাই মিলে–প্রকাশ মামাকে ধরে নামিয়ে দিলে। প্রকাশ মামার যেন তখন একটু চৈতন্য হয়েছে। চারদিকে এত ভিড় দেখে অবাক হয়ে গেল। বললে–কে? কে তোমরা?

একজন তার মাথায় চাঁটি মারলে।

–আরে মারছো কেন?

আরো একজন সুবিধে পেয়ে পেছন থেকে জামা ধরে টানতে লাগলো। সামনে পেছনে যে-যেখান থেকে পারছে ঠেলে দিচ্ছে। প্রকাশ মামা এদিকে চায় তো ওদিক থেকে ঠেলে। ওদিকে চায় তো এদিক থেকে ঠেলে।

না, নেশাটা জমতে দিলে না শালারা। প্রকাশ মামা অন্য দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে। কিন্তু সব দিকেই লোক গিজ গিজ করছে।

শেষকালে একটা ফাঁক দেখে মরীয়া হয়ে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু সবাই পেছন-পেছন তাড়া করে গেল। তখন প্রকাশ মামা প্রাণপণে দৌড়তে লাগলো–

পেছনে সবাই চেঁচিয়ে উঠলো-চোর—চোর—

‘চোর-চোর’ শুনে আরো কিছু লোক এসে জুটলো। বড়বাজারে ভিড় জমাবার লোকের অভাব নেই। সেখানে সবাই কাজের লোক, আবার সবাই বেকার।

দৌড়তে দৌড়তে একটা বড় রাস্তার ওপর পড়তেই হঠাৎ ‘হাঁ-হা-হাঁ’ চিৎকার উঠলো। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা মাল-বোঝাই লরীর ব্রেক কষার কর্কশ শব্দ!

-কী হলো মশাই, কী হলো?

আশেপাশে যারা কর্মব্যস্ত মানুষ ঘোরাঘুরি করছিল তাদের সকলের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সবাই আঁতকে উঠেছে এই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায়। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ গলির ভেতর থেকে লোকটা অমন দৌড়ে বেরোলই বা কেন? বড় রাস্তায় বেরোবার সময় চারদিকে দেখেশুনে বেরোতে হয় তো!

যারা পেছন থেকে এতক্ষণ তাড়া করছিল তারা আর এগোল না। এখনি আবার পুলিস পাহারাওয়ালা আসবে। তখন সাক্ষী হতে বলবে, চাক্ষুষ সাক্ষদের জবানবন্দি নেবে। অত ঝঞ্ঝাটে যেতে আছে! তার চেয়ে সসম্মানে কেটে পড়াই ভালো।

–নিয়তি মশাই নিয়তি! একেই বলে নিয়তি!

প্রকাশ মামা তখন লরীর তলায় পড়ে কার কাছে নিঃশব্দে তার আর্জি জানাচ্ছে কে জানে? মা কালী না মা-মঙ্গলচণ্ডী কার কাছে হুইস্কি খাবার প্রার্থনা জানিয়ে তার শেষ সাধ নিবেদন করছে তাই বা কে জানে! ইহকাল পরকাল কোনও কাল বলে যদি কোথাও কিছু থাকে তো প্রকাশ মামার সাধ কি তারা কেউ মেটাতে পারবে? কেউ কি কোনও দিন প্রকাশ মামাদের খাই মেটাতে পেরেছে! প্রকাশ মামার দিদি তা মেটাতে পারেনি, প্রকাশ মামার জামাইবাবুও তা মেটাতে পারেনি, তারপর তার ভাগ্নেও তা মেটাতে পারলে না।

জায়গাটা তখন টাটকা রক্তে একেবারে লাল হয়ে গেছে। সমস্ত লোকের পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ফ্যাকাশে পিচের রাস্তার ওপর যেন রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে।

.

নৈহাটির বাড়ির মধ্যে তখন আর এক দৃশ্য। আসলে এ দৃশ্য নয়, দৃশান্তর। একটু আগেই যে বাড়িতে ঝড় বয়ে গেছে তার সামান্যতম চিহ্নও তখন আর কোথাও নেই। সমস্ত বাড়িটা তখন স্তব্ধ। নয়নতারা খেয়েছে কি খায় নি সে-খবর রাখবার দরকার নেই যেন নিখিলেশের। নয়নতারার চোখ-মুখের চেহারা দেখে তার সঙ্গে কথা বলতেও তার ভয় হয়েছে। এত বড় দুর্যোগ যে নিখিলেশ শেষ পর্যন্ত সামলাতে পেরেছে এইটেই যথেষ্ট।

এই সব কাণ্ড দেখে গিরিবালাও যেন কেমন নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। নিখিলেশ তখনও নিজের খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল। কোথাও কোনও দিকে আর কোনও আশার চিহ্ন নেই। কেউ আর তার নেই। সে এই বিরাট পৃথিবীতে একা। একলাই তাকে তার এই শরীরটার মত এই সংসারটাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে, প্রতিদিন তাকে অফিসে যেতে হবে, প্রতি মাসে তাকে তার মাসকাবারি গোনাগুন্তি মাইনের টাকাটা নিয়ে আসতে হবে। কেউ আর তাকে সাহায্য করবে না। নয়নতারা চাকরি করবে না আর। নয়নতারা তার মাইনের টাকা বাড়িতে এনে তার সংসারে সাচ্ছল্য বাড়াতে আর সাহায্য করবে না।

তাহলে? তাহলে কী করবে সে? যা করে সে এতদিন চালাচ্ছে তেমনি করেই শেষ দিন পর্যন্ত চলবে? তারপর একদিন যখন রিটায়ার করবে, তখন শুরু হবে তার পেনশন। এখন যে-অবস্থা তার চলছে, সে-অবস্থা তখন আরো খারাপ হবে। তখন কী করে শেষ জীবনটা চলবে তার?

এ-কথা বহুদিন ধরেই ভাবছিল নিখিলেশ। কিন্তু আজকের ঘটনার পর ভাবনাটা যেন আরো জটিল হয়ে উঠলো। সত্যিই যদি শেষ পর্যন্ত নয়নতারা সদানন্দবাবুর সঙ্গে চলে যেত তাহলে কী হতো? আর তা ছাড়া আজ না-হয় নিখিলেশ নয়নতারাকে কোনও রকমে বাড়িতে আটকে রাখতে পেরেছে, কিন্তু কাল? কাল যখন নিখিলেশ অফিসে চলে যাবে, তখন যদি আবার সদানন্দবাবু আসে? আর নয়নতারা যদি তার সঙ্গে চলে যায়, তখন কে তাকে আটকাবে? কে তাকে ধরে রাখবে? চিরকাল তো কেউ অফিস কামাই করে বউকে পাহারা দিতে পারে না! আর, আর একটা উপায় আছে অবশ্য। নয়নতারার ঘরের বাইরে থেকে তার দরজায় তালা লাগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তা-ই কী সম্ভব? নয়নতারাই কী সেই রকম মেয়ে যে সেটা মাথা পেতে সহ্য করবে?

নিখিলেশের মনে হলো আজ রাতে আর তার ঘুম আসবে না।

কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হলো ঘরের আলোটা তখনও জ্বলছে। উত্তেজনায় উদ্বেগে সে আলোটা নিবোতেও ভুলে গিয়েছিল। বিছানা থেকে উঠলো নিখিলেশ। আলোর সুইচটা বন্ধ করে দিয়েই সে বিছানায় এসে লুটিয়ে পড়বে, ঘুমোবার জন্যে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে সে।

কিন্তু টেবিলের ওপর নজর পড়তেই দেখলে কার যেন একটা ব্যাগ পড়ে রয়েছে সেখানে। লম্বা-চওড়া একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ।

নিখিলেশ ব্যাগটা হাত তুলে নিলে। এটা কার?

হঠাৎ মনে পড়ে গেল। সদানন্দবাবুর হাতে তো সে এটা দেখেছিল। সে-ই ফেলে গেছে নাকি? হয়ত ভুল করে ফেলে গেছে। অত কাণ্ডের মধ্যে এটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছে।

ব্যাগের মুখটা সে খুলে দেখলে। তেমন কিছু নেই ভেতরে। নিখিলেশ ভেবেছিল হয়ত টাকাকড়ি আছে কিছু। কিন্তু ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিতেই কী একটা ভাঁজ করা কাগজ বেরোল। ভাঁজটা খুলতেই দেখলে একটা চিঠি। আর তার সঙ্গে একটা চেক্। ক্রসড চেক।

নিখিলেশের মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের সমস্ত শিরাগুলোর ভেতরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। এ কীসের চিঠি! কার চিঠি!

কিন্তু চিঠির ওপরেই নিখিলেশ আর নয়নতারার নাম দেখে আরো অবাক হয়ে গেল। বেশ স্পষ্ট অক্ষরে শিরোনামায় লেখা রয়েছে নিখিলেশ বন্দ্যোপাধ্যায় আর নয়নতারার নাম।

তার নিচের লাইনে লেখা রয়েছে—

“নিখিলেশবাবু, আজকে আমি যে কথা বলতে এসেছিলুম তা মুখে বলতে পারবো না বলে এই চিঠিতে লিখে এনেছি। একদিন আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি নয়নতারাকে স্ত্রীর মর্যাদা কেন দিইনি। কেন দিইনি তা আমি আপনাদের মুখে জানিয়েছিলুম। কিন্তু যুক্তিটাই তো জীবনে বড় কথা নয়। যুক্তির ওপরে আর একটা কথা আছে যা যুক্তি তর্কের ঊর্ধ্বে। আমি আপনাদের সংসারের অভাব অনটনের কথা নিজের চোখে দেখে এসেছি। সে অভাব-অনটন আমি দূর করতে পারবো এমন অহঙ্কার আমার নেই। কিন্তু তবু সে অভাব দূর করবার আশায় আমার সামান্য প্রচেষ্টা এই সঙ্গে জুড়ে দিলাম। জানি আপনাদের চাহিদা মোটানো আমার সাধ্যাতীত, তবু এই সামান্য দান গ্রহণ করলে আমি কৃতার্থ হবো। আমাকে খুঁজে বার করে কৃতজ্ঞতা জানাবার চেষ্টা করবেন না, কারণ এখন থেকে আমি চেনা জানা সকলের দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবো এই মনস্থ করেছি। আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল। ইতি—”

চিঠিটা পড়ে শেষ করার পর চেকটার দিকে আবার দেখলে নিখিলেশ। চার লাখ টাকা।

নিখিলেশের মনে হলো সে হয়ত পড়ে যাবে। হাত-পা তার অবশ হয়ে আসছে। চিঠিটা নিয়ে সে বিছানার ওপরে গিয়ে বসলো। আবার পড়তে লাগলো চিঠিটা। আবার পড়তে লাগলো চেকের অঙ্কটা একবার শুধু একটু সন্দেহ হলো সে ভুল দেখছে না তো! সে জেগে আছে তো ঠিক! একে একে বারকয়েক সে চিঠি আর চেকটা পড়লো। তারপর মনে হলো সদানন্দবাবুর উপর সে সত্যিই অবিচার করেছে। যে-মানুষ এত ভালো এত উদার তার সঙ্গে সত্যিই সে খারাপ ব্যবহার করেছে।

তাড়াতাড়ি ঘর থেরে বেরিয়ে পাশের দরজা ঠেলতে লাগলো নিখিলেশ–নয়নতারা নয়নতারা–ওঠো—ওঠো–

ভেতর থেকে কোনও সাড়া না-পাওয়ায় নিখিলেশ আবার ডাকলে–নয়নতারা, নয়নতারা, দরজা খোল, এই দেখ সদানন্দবাবু কী চিঠি লিখে রেখে গেছেন–

আগে হলে হয়ত নয়নতারা দরজা খুলতো না। কিন্তু সদানন্দবাবুর চিঠির কথা শুনে নয়নতারা দরজার খিল খুলে দিলে। বললে–কী বলছো তুমি?

নিখিলেশ হাতের চিঠি আর তার সঙ্গে লাগানো চেকটা নয়নতারার দিকে বাড়িয়ে ধরলে। বললে–এই দেখ সদানন্দবাবু তোমার আর আমার নামে কী চিঠি লিখে রেখে গেছেন–

নয়নতারা চিঠিটা হাতে নিয়ে মনে মনে পড়তে লাগলো। চেকটাও দেখলে মন দিয়ে খানিকক্ষণ ধরে। পড়তে পড়তে যেন খানিকক্ষণের জন্যে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল সে। তারপর নিখিলেশের দিকে মুখ তুলে চাইলে। চোখ দুটো তখন তার ছল্‌-ছল্‌ করছে।

নিখিলশে বললে–একটা ব্যাগের মধ্যে এইটে পড়ে ছিল। আমি প্রথমে দেখতে পাইনি, আলো নেবাতে গিয়ে দেখি টেবিলের ওপর এই ব্যাগটা পড়ে আছে। তার ভেতরে এইটে ছিল…

নয়নতারার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। নিখিলেশও যেন এই ঘটনায় একেবারে বিমুঢ় হয়ে গেছে। জীবনের সমস্ত হিসেব যেন হঠাৎ তাদের দুজনের কাছেই বেহিসেব হয়ে গেছে এক মুহূর্তে। যে-অঙ্ক দিয়ে সংসারী মানুষ সংসারের সব কিছুর মূল্যায়ন করে সেই গোড়ার অঙ্কতেই যেন তাদের গরমিল হয়ে গেছে হঠাৎ! একঘণ্টা আগে যে-বিপর্যযের চূড়োয় দাঁড়িয়ে তারা চরম সর্বনাশের জন্যে প্রস্তুত হয়ে প্রতীক্ষা করছিল, টাকার প্রলেপ লাগিয়ে সদানন্দ যেন তাদের সেই সমস্ত বিপর্যয় সমস্ত ক্ষত নিরাময় করে দিয়েছে।

নিখিলেশ বললে–অথচ দেখ, এখন ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে, আমি সদানন্দবাবুর সঙ্গে কী অভদ্র ব্যবহারই না করেছি—

তারপর হঠাৎ তার কী মনে হলো। বললে–একটু দাঁড়াও, দৌড়ে গেলে হয়ত এখনও স্টেশনে তাঁকে ধরতে পারা যাবে–

নয়নতারা বললে–তুমি এখন স্টেশনে যাবে নাকি?

নিখিলেশ ততক্ষণে জামাটা গায়ে গলিয়ে নিয়েছ। তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে-যেতে বললে–সত্যি বলছি আমি ভাবতে পারিনি, মানুষ এত ভালো হতে পারে। দেখি যদি তাঁকে ধরে আনতে পারি–

নয়নতারা পেছন থেকে একবার শুধু বললে–আমি যাবো তোমার সঙ্গে?

 নিখিলেশ বললেন, তুমি আর কেন মিছিমিছি এত রাত্তিরে কষ্ট করবে—

নয়নতারা বললে–তাহলে তুমি গিয়ে তাকে বোল আমি তাকে আসতে বলেছি, বোল সে না এলে আমি রাগ করবো।

নিখিলেশের আর তখন কোনও দিকে জ্ঞান নেই। রাস্তাটা ধরে সোজা স্টেশনের দিকে জোরে জোরে চলতে লাগলো। কিন্তু তাকে বেশি দূর আর যেতে হলো না। রাণাঘাট লোক্যালটা তখন হু-হু করে স্টেশনে এসে পৌঁছুলো আর আধ মিনিট থেমেই প্ল্যাটফরমের সমস্ত প্যাসেঞ্জারকে তুলে নিয়ে আবার কলকাতার দিকে রওনা দিলে।

তবু নিখিলেশ স্টেশনের প্ল্যাটফরম লক্ষ্য করে চলতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত নিখিলেশ প্ল্যাটফরমে গিয়ে একবার খুঁজে দেখবে সদানন্দবাবু আছে কি না।

কিন্তু নিখিলেশ জানতো না যে, যে-মানুষ এমন করে নিজের সর্বস্ব পরকে দিয়ে নিঃস্ব হতে পারে তাকে ফিরিয়ে আনে এমন ক্ষমতা ভূ-ভারতে কারো নেই। এমন কি নিখিলেশ বা নয়নতারা কারো বিধাতা পুরুষেরই তখন এমন সাধ্য নেই যে তাকে আবার তাদের এই ভাঙা সংসারের মাথায় এনে প্রতিষ্ঠা দেয়।

কিন্তু ওদিকে রাণাঘাট লোক্যালের একটা কামরার এক কোণে বসে তখন সদানন্দ জানালার বাইরের দুর্ভেদ্য অন্ধকারের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। চেয়ে আছে আর নিজের মনে এক অনির্দেশ্য আবাঙমনসোগোচর বিশ্ব-নিয়ন্তার কাছে একটা প্রার্থনাই শুধু করে চলেছে। সে বলছে–আমি জেনেছি তুমি আছো, এই বিশ্ব-সৃষ্টির অনাদি-অনন্ত স্বরূপ হয়ে তুমি আমাদের অন্তরেই বিরাজ করছে। তাই আজ তোমাকেই আমি জানিয়ে গেলাম আমার শেষ প্রার্থনা। তোমাকে জানিয়েই আমার ঊর্ধতন পিতৃপুরুষের সমস্ত পাপের প্রায়চিত্ত করে গেলাম। লোকে জানুক আমি পাগল, লোকে বলুক আমি নির্বোধ। তাতে আমার কোনও ক্ষতি নেই। আজ আমি সমস্ত লাভ-ক্ষতির বাইরে সমস্ত দেনা-পাওনার সীমান্ত অতিক্রম করে সুদূর নির্বাসনে আশ্রয় নিতে চলেছি। আজ আমার নিজের জন্যে আর কিছু কাম্য নেই। শুধু কামনা করি মানুষ সৎ হোক, মানুষ সুখী হোক, মানুষের মঙ্গল হোক, মানুষের শুভ হোক। আর আমি কিছু চাই না।

আর এদিকে নিখিলেশ তখন নৈহাটি স্টেশনের প্ল্যাটফরমের ওপরে একে-একে প্রত্যেকটা লোকের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে শুধু একটা মুখকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনুসন্ধান করে চলেছে। কই, কোথায় গেল সেই মানুষটা! সেই মহানুভব মহৎ মানুষটাকে খুঁজে বার করা তার কাছে যেন তখন একান্ত অপরিহার্য।

আর নয়নতারাও সেই বোসপাড়ার বাড়িটার সদর-দরজার সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে শবরীর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কিন্তু যার জন্যে নিখিলেশ আর নয়নতারার এই উদগ্রীব প্রতীক্ষা সে-মানুষটা তখন আরো দূরে আরো অনেক দূরের পথে চলতে শুরু করেছে। তার মনে তখন আর কোনও ক্ষোভ নেই, আর কোনও খেদ নেই। এবার সে প্রায়শ্চিত্ত করেছে, এবার আর কারো কোনও দুঃখ থাকবে না, নবাবগঞ্জ থেকে নিরক্ষরতা দূর হবে, নবাবগঞ্জের লোক ব্যাধি থেকে মুক্তি পাবে, নয়নতারার সংসারের সমস্ত আর্থিক কষ্ট দূর হবে। সবাই সুখী হবে, সকলের মঙ্গল হবে, সকলের শুভ হবে…শুভায় ভবতু…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *