৩.৩ স্টেশনে চেনা মুখ

রেল বাজারের স্টেশনে চেনা মুখ দেখেই গৌর মোদক ডাকলে–ও শালাবাবু, আসুন– আসুন—

খদ্দের দেখলেই গৌরের ডাকা অভ্যেস। ট্রেন থেকে যারা নামে তারা গৌরের দোকানে এসে বসে, এটা-ওটা খায়। ট্রেন এসে থামলেই গৌর ভেতরের ক্যাশ বাক্সতে চাবি দিয়ে রাস্তার সামনে এসে খদ্দের ধরে।

প্রকাশ রায় খেতেও যেমন, পকেটের পয়সা খরচ করতেও তেমনি।

বললে–কী আছে আজ?

গৌর বললে–কচুরি, সিঙ্গারা, রাজভোগ, কাঁচাগোল্লা, পান্তুয়া–

প্রকাশমামা আর বলতে দিলে না। বললে–থা থাক, আর বলতে হবে না। অত টাকা নেই আমার কাছে। শুধু চা দাও—

–শুধু চা?

–হ্যাঁ হ্যাঁ, কলকাতায় গিয়ে সব টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। এখন একেবারে হাত খালি। এখন নবাবগঞ্জে গিয়ে টাকা নেব তবে আবার কলকাতায় যেতে পারবো।

যখন প্রকাশমামার খাওয়া প্রায় হয়ে গিয়েছে সেই সময় হঠাৎ গৌর মোদক কথাটা বললে। বললে–শালাবাবু, আপনাদের বউ সেদিন বাপের বাড়ি গেল দেখলুম।

বাপের বাড়ি! সদার বউ! কথাটা খট করে যেন প্রকাশমামার কানে বাজলো। বললে–কী বললে তুমি?

–আজ্ঞে সেদিন এখান দিয়ে আপনাদের বউ বাপের বাড়ি গেলেন কিনা, তাই বললুম।

প্রকাশমামা অবাক হয়ে গেল। বললে–তুমি ঠিক দেখেছ? কবে?

গৌর বললে–এই তো ক’মাস আগে। সঙ্গে আপনাদের কৈলাস গোমস্তা মশাই ছিল। তিনিই তো বললেন, বউমাকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন–

প্রকাশমামা আর দাঁড়ালো না। চায়ের দামটা দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো। ট্রেন থেকে নেমে আরো কিছু খদ্দের তখনও দোকানে ঢুকে পড়েছে। গৌর মোদক তাদের নিয়ে বস্ত হয়ে উঠলো।

একটা সাইকেল-রিকশা ধরে একেবারে সোজা নবাবগঞ্জে এসে হাজির। কতদিন পরে প্রকাশমামার নবাবগঞ্জে আসা। সেই যে সদানন্দরই খোঁজে গিয়েছিল, তারপর সেই ব্যাপারেই মানদা মাসিকে খোসামোদ করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে গেছে। দু’হাতে টাকাও খরচ হয়েছে, অথচ কাজের কাজও কিছু এগোয়নি। দিদি তো তা বোঝে না। কলকাতা কি সোজা জায়গা! সেখানে একটা পয়সা ছাড়া কেউ কথা বলে না। চারদিকে মারামারি কাটাকাটি। তারপর যুদ্ধের পর ভিড় তেমনি বেড়েছে। কোথা থেকে সব পঙ্গপালের মত দলে দলে লোক এসে হাজির হয়েছে। শেয়ালদা স্টেশনের কাছে গেলেই ছোট-ছোট ছেলেরা হাত পাতে। বলে–পয়সা দাও, একটা পয়সা দাও না—

আসবার সময় মাসি বলেছিল–তুমি যেন আসতে বেশি দেরি কোর না ছেলে, টাকা নিয়েই চলে এসো–

বড়বাবুও কথা দিয়েছে সদানন্দকে খুঁজে বার করে দেবে। কিন্তু দেরি হচ্ছে শুধু সময়ের অভাবে। আর সময়টাও সত্যিই বড় খারাপ পড়েছে চারদিকে। সব কিছু যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। মানদা মাসিরও যেন টাকার টানাটানি পড়ে গেছে ঠিক এই সময়ে। কেবল টাকা চায়। রাধার কাছে গেলেও সে টাকা-টাকা করে। বাড়ি থেকে বউও লিখেছে টাকা পাঠাও। চারদিক থেকে যদি সবাই এমন টাকা-টাকা করে তো সে একলা মানুষ কোত্থেকে এত টাকা পাবে? টাকা দেবার মালিক তো ওই একজনই। দিদি! সেই দিদি যদি একদিন হাত গুটিয়ে বসে তো তা হলেই চিত্তির।

কিন্তু প্রকাশমামা জানতো না যে পৃথিবী তখন তলে-তলে অন্য এক ভূগোল সৃষ্টি করে চলেছে। ভূগোলের রং বদলাতে শুরু করেছে নিঃশব্দে। যা ছিল লাল তা সমস্তই তখন বুঝি সবুজ হতে শুরু করেছে। শুধু ভুগোলই বা কেন, ইতিহাসও তখন নতুন মানুষের কলমে নতুন করে লেখা হয়ে চলেছে আর এক নতুন কালিতে। একের সঙ্গে বিরোধ বেধেছে বহুর, বড়র সঙ্গে ছোটর আর ভেতরের সঙ্গে বাইরের। মতবাদের সঙ্গে মতবাদের বিরোধে সারা পৃথিবীটা তখন ভাগ-ভাগ হয়ে গেছে। নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়িটার মত অতীতের কর্তাবাবুরা নিজেদের সমস্ত কৃতকার্যের মধ্যে নিজেদের ধ্বংসস্তূপ দেখে নিজেরাই হতবাক হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। আর কপিল পায়রাপোড়া মাণিক ঘোষ আর ফটিক প্রামাণিকের দল তখন কবরের তলা থেকে হা-হা করে প্রতিশোধের অট্টহাসি হেসে সমস্ত নবাবগঞ্জকে সচকিত করে তুলছে।

বেহারি পাল তার দোকানে বসে দেখলে রিকশাটা আসছে।

–কবে এলে হে শালাবাবু?

–আজ্ঞে, আজ পাল মশাই আজ–আপনাদের খবর সব ভাল তো?

বারোয়ারিতলায় নিতাই হালদারের দোকানের মাচার ওপরকার পৃথিবীটার মূলও বুঝি তখন সব কাণ্ডকারখানা দেখে ধসে গিয়েছিল। আগেকার সে জলুস আর নেই কারো। অন্যদিন হলে তারা শালাবাবুকে ডাকতো। তার সঙ্গে দু’একটা রসিকতার কথা বলতো। কিন্তু সবাই শালাবাবুকে দেখে নিঃশব্দে শিউরে উঠলো। একটা উদ্যত খড়গ যেন সকলের মাথার ওপর ঝুলছে।

রিকশার ওপর বসে শালাবাবু নিজ থেকেই বললে–কী গো, আমি এলুম! কেমন আছো গো সব তোমরা?

-ভালো।

শালাবাবু কথার রেশটা বাড়াবার জন্যে বলে উঠলো–কলকাতায় থেকে থেকে আর নবাবগঞ্জে আসতে ইচ্ছে করে না হে–তোমরা সব কেমন ঝিম্ মেরে গেছে মনে হচ্ছে। তোমাদের তাস খেলা কেমন চলছে?

এ-কথার আর কেউ কোনও সাড়-শব্দ দিলে না। রিকশাটা গিয়ে দাঁড়ালো একেবারে চৌধুরীবাড়ির সদরে।

–এই রাখ রাখ, এখানেই রাখ বাবা।

দাম মিটিয়ে দিয়ে চারদিকে চেয়ে কেমন অবাক হয়ে গেল প্রকাশ। কই, সব কোথায় গেল? চণ্ডীমণ্ডপে এমন সময় তালা ঝুলছে কেন? পরমেশ মৌলিক কোথায় গেল সেরেস্তা ছেড়ে? বাড়ির সদরের কাছে কাদের একটা গরু বেশ গুছিয়ে আয়েস করে বসে জাবর কাটছিল।

প্রকাশ বললে–এ কাদের গরু রে বাবা, আর জায়গা পেলে না, যাওয়া-আসার রাস্তার ওপর বসে পড়েছে, একেবারে আক্কেল বলে কিছু নেই

ভেতরে বার বাড়ির উঠোনে ঢুকে আরো অবাক–দীনু দীনু–

শালাবাবুর গলার আওয়াজ পেয়ে কোথা থেকে সেই বার-বাড়ির কুকুরটা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে আদর দেখাতে এল। তাকে দেখে প্রকাশমামা কিছু বুঝতে পারলে না। কুকুরটা এমন একটা জীব নয় যে তাকে প্রশ্ন করলে কিছু হদিস পাওয়া যাবে। কিন্তু এরা সব গেল কোথায়? কৈলাসেরও তো থাকার কথা!

–কৈলাস, কৈলাস!

কৈলাস কি আজকাল এত সকাল-সকাল বাড়ি চলে যায় নাকি?

কিন্তু বারবাড়ির বৈঠকখানার দিকে নজর পড়তেই আরো অবাক হয়ে গেল। সে-ঘরের দরজাতেও তালা ঝুলছে। আশ্চর্য তো, তালা ঝুলছে কেন? ভেতরে কারো সাড়াশব্দই বা নেই কেন? গৌরী, বিষ্টুর মা–তারাও তো অন্তত ভেতরে থাকবে।

ভেতরে বাড়িতে যাবার পথেই আটকে যেতে হলো। সেখানেও তালা ঝুলছে। এ কী হলো! এমন তো হয় না! তাহলে সব গেল কোথায়? বউমা না হয় বাপের বাড়ি গেছে বুঝলাম। কিন্তু এরা? এরা সবাই কোথায় গেল? জামাইবাবু দিদি, বাড়ি ছেড়ে সবাই গেল কোথায়?

সেই বারবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে দোতলার ঘরখানার দিকেও চেয়ে দেখলে। জানালাগুলো সব বন্ধ। তাহলে কি কেউ বাড়িতে নেই?

হঠাৎ পায়ে একটা কী ঠেকতেই চমকে উঠেছে প্রকাশ। পেছন ফিরেই দেখে সেই কুকুরটা। কুকুরটা একেবারে পায়ে-পায়ে তার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরছে।

প্রকাশ একটা লাথি ছুঁড়লে তার দিকে–যা যা, পালা এখান থেকে, পালা যা–

-কেমন আছেন শালাবাবু? এখন এলেন?

পাশের বেড়ার ওধার থেকে কার যেন গলা ভেসে এল।

প্রকাশ চেয়ে দেখলে ফকির। বেহারি পালের মুহুরি ফকির। ফকিরের দিকে এগিয়ে গেল প্রকাশ। বললে–এরা সব গেল কোথায় বলো তো ফকির? আমি যাবার আগে দেখে গেলুম একরকম, আর এসে এ-সব কী দেখছি! দিদি কোথায়? জামাইবাবু? তোমরা কিছু জান?

ফকির বললে–-চৌধুরী মশাই তো নেই, উনি ভাগলপুরে চলে গেছেন–

–ভাগলপুরে? কেন? তাহলে এখানকার সব দেখাশোনা কে করছে? আরি দিদি? দিদিও কি জামাইবাবুর সঙ্গে ভাগলপুরে গেল নাকি?

রাস্তা থেকে হঠাৎ কে যেন বললে–কে? শালাবাবু নাকি? কখন এলেন?

প্রকাশ চেয়ে দেখলে পরমেশ মৌলিক। পরমেশ মৌলিক রাস্তা দিয়ে বারোয়ারি-তলার দিকে যাচ্ছিল। শালাবাবুকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছে।

পরমেশ মৌলিককে দেখে প্রকাশ যেন অকূলে কূল পেলে। তাকে লক্ষ্য করে রাস্তার দিকেই চলতে লাগলো সে। বললে–কী হে, চণ্ডীমণ্ডপে তালা ঝুলছে কেন? তোমরা সব কাজকর্ম করো না?

পরমেশ বললে–আজ্ঞে চৌধুরী মশাই তো নেই, তিনি ভাগলপুরে চলে গেছেন–

প্রকাশ বললে–তা জামাইবাবু ভাগলপুরে চলে গেছেন বলে কি একেবারে চিরকালের মত চলে গেছেন? তিনি না থাকলে কি আর তোমরা কাজকর্ম কিছু করবে না? আর দিদি? দিদিও কি সঙ্গে গেছে নাকি? এসব এখন দেখছে কে? কৈলাস কোথায় গেল? আর দীনু? দীনু কোথায়?

পরমেশ তবু কিছু উত্তর দিলে না। তার মুখে যেন কথা ফুরিয়ে গিয়েছে।

–কী গো, উত্তর দিচ্ছ না কেন? আমার দিদির কথা বলছি!

পরমেশের মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরোচ্ছিল না। কী কথাই বা সে বলবে? সে সব দিনের মর্মান্তিক ঘটনা তো নবাবগঞ্জের লোকের কারো আর জানতে বাকি নেই! এমন সর্বনাশ যে হবে তা বুঝি কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। অথচ এই তো সেদিনের ঘটনা।

রাস্তায় তখন আর একজন কে যাচ্ছিল। সেও প্রকাশকে দেখতে পেয়েছে। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললে–কী শালাবাবু, কখন এলেন?

প্রকাশ দেখলে–বংশী ঢালী। তারপর আস্তে আস্তে আরো অনেকে জুটে গেল। সকলেরই এক প্রশ্ন। কখন এল শালাবাবু? এতদিন কোথায় ছিল? প্রকাশ বললে–আমার দিদিও কেন এই সময়ে ভাগলপুরে চলে গেল? কবে আসবে তারা?

ততক্ষণে সদর দিয়ে যারা যাচ্ছিল তারাও শালাবাবুকে দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে। এত ঘটনার পর যে চৌধুরীবাড়ির মালিকপক্ষের কেউ আবার এ বাড়িতে আসবে তা তারা ভাবতেও পারেনি। সে-সব কাণ্ড কি সহজ কাণ্ড! সারা গাঁ-ময় তখন ঢি ঢি পড়ে গেছে। চৌধুরী মশাই-এর নামে তখন ছিছিকার পড়ে গেছে সব জায়গায়। সবাই আড়ালে আলোচনা করে, কিন্তু গণ্যমান্য ভদ্রলোকের বাড়ির বউ ঝির ব্যাপার, সব কথা প্রকাশ্যেও বলতে চায় না কেউ, অথচ বলবার মত এমন বিষয়টা চেপে রাখতেও কেউ পারে না। কানাঘুষো থেকে প্রথমে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে সেটা পৌঁছোয়। তারপর গ্রাম ছাড়িয়ে একেবারে মহকুমা শহরে।

.

তারপর?

শালাবাবুর মাথায় তখন বজ্রাঘাত হয়েছে। আবার বললে–তারপর?

এ কি সহজ ব্যাপার যে এক কথায় সব কাণ্ডটা বলতে পারবো! এত সময় তোমারও নেই, আর আমার কলমেও এত জোর নেই যে সেদিনকার সব কেলেঙ্কারির কাহিনী তোমাকে বিশদ করে বলতে পারবো!

কোথাকার কোন্ নরনারায়ণ চৌধুরী একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, এখানে এই নবাবগঞ্জে তিনি একটা কালজয়ী বংশের প্রতিষ্ঠা করে যাবেন আর পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে তাঁর অবিনশ্বর কীর্তিকলাপ যুগ যুগ ধরে এখানে সুচিহ্নিত হয়ে থাকবে। তাঁর সেই স্বপ্নের কী গতি হলো তা তিনি দেখে যেতে পারলেন না বটে, কিন্তু দেখলে তাঁর পুত্র, তাঁর পৌত্র। আর নবাবগঞ্জের এপাড়া-সেপাড়ার অগণিত জনসাধারণ। আর যাদের দেখবার সৌভাগ্য হলো না তারা শুনলো। শুনে ছি ছি করতে লাগলো বটে কিন্তু যার উদ্দেশ্যে ছি ছি করলে তিনি তা শুনতে পেলেন না। নিজের অপঘাত-মৃত্যুর পাপে তাঁর আত্মা তখন কোথায় কোন্ লোকে ছটফট করছে কে জানে! এক গণ্ডুষ জলের জন্যে তিনি কোথাও অশরীরী আর্তনাদ করছেন কিনা তারও কোনও সংবাদ জানবার তখন উপায় নেই।

.

কিন্তু যারা হাতের কাছের মানুষ, তাদের খবর তখন জানা যাচ্ছে। চৌধুরী মশাই তখন আর বাড়ি থেকে বেরোন না। চণ্ডীমণ্ডপের কাছারিতেও আসেন না। যখন কারো দেখা করবার দরকার হয় তখন তার কাছেই সবাই যায়। দরকার হলে টাকা চায়, টাকা দেয়। খাজনার টাকা দিতে গেলে চৌধুরীবাড়ির বার বাড়ির উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে একেবারে দোতলায় গিয়ে উঠে তাঁর কাছে যেতে হয়।

নয়নতারা চলে যাবার পর থেকেই যেন বাড়িটার লক্ষ্মীশ্রী চলে গিয়েছিল। হয়ত নয়নতারা ছিল লক্ষ্মী। লক্ষ্মীকে ধরে রাখতে পারেননি চৌধুরী মশাই। সদানন্দকে যেমন একদিন কেউ ধরে রাখতে পারেননি তেমনি নয়নতারাকেও কেউ ধরে রাখতে পারেনি চৌধুরীবাড়িতে। যাবার দিন বারোয়ারিতলায় আর লোক ধরে না। চৌধুরীবাড়ির সদরেও আর লোকের কমতি নেই।

আগে আগে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে কৈলাস গোমস্তা। মাঝখানে রজব আলির ছই-ঢাকা গরুরগাড়ি। গরুরগাড়িতে সামনে-পেছনে পর্দা। ভেতরের কাউকে দেখা যায় না। তুমি যে কায়দা করে নয়নতারার চেহারাটা একবার দেখবে তারও উপায় নেই। পর্দা তুলে ভেতরে উঁকি দেবারও উপায় নেই কারোর। সেখানে আছে দীনু। দীনু গাড়ির পেছন-পেছন পাহারা দিতে দিতে চলেছে।

কেদার কাছাকিাছি গিয়ে দীনুকে জিজ্ঞেস করলে–ভেতরে তোমাদের বউ কি একলা যাচ্ছে নাকি গো? আর কেউ নেই?

দীনু বললে–না, বউমানুষ কি একলা বাপের বাড়ি যায়? সঙ্গে গৌরীপিসী আছে–

বেহারী পালের বউ বাগানের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখছিল। নয়নতারা একলা ঘর থেকে বেরিয়ে গরুরগাড়িতে গিয়ে উঠলো। ওঠবার আগে একবার দিদিমার বাড়ির দিকেও চাইলে। কাউকে সেখানে দেখতে পাবার কথা নয়। তবু চেয়ে দেখলে। তারপর কাউকে দেখতে না পেয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসলো। আর তার পেছনে-পেছনে গৌরীও গিয়ে গাড়িতে উঠলো।

নয়নতারা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত গ্রামে একটা চাপা হাহাকার পড়ে গেল।

–তা হ্যাঁ গো, বউমার বাপকে খবর দেওয়া হয়েছ তো?

একজন বললে–এ কি আর দেবার মত খবর যে আগে থেকে দেবে। মেয়ে যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে তখনই বাপ জানতে পারবে।

আর একজন বললে–আহা, কী কপাল করেই বউটা এসেছিল! একদিনের তরেও সুখ পেল না গো। নিজের ভাতারই যাকে ছেড়ে চলে গেল তার আবার শ্বশুরবাড়ি! আর শ্বশুরের তো ওই কীর্তি! কী ঘেন্না মা, কী ঘেন্না!

অন্য একজন বললে–আর বউ-এর গয়না? গয়নাগাঁটি সঙ্গে নিয়ে গেল তো?

–সে তারক-জ্যাঠা আগেই বলে রেখে দিয়েছিল। যেমন সেজেগুজে বউ শ্বশুরবাড়িতে এসেছিল তেমনি সাজিয়ে-গুছিয়েই বউকে বাপের বাড়ি পাঠাতে হবে। এমনি তাড়িয়ে দিলে চলবে না।

আগের লোকটা বললে–তা এতই যদি নাতির শখ চৌধুরী মশাই-এর তো চৌধুরী মশাই নিজেই তো আর একটা বিয়ে করতে পারতো!

–তাতেও যে লোকলজ্জা!

–এতই যদি লোকলজ্জার ভয় তো তখন মনে ছিল না? এখন লজ্জা-সরমের আর বাকীটা কী রইল?

পাশের লোকটা বললে–তা অত হ্যাঙ্গামে যাবার দরকারটা কী ছিল? গায়ে তো ছেলের অভাব নেই, কারো কাছ থেকে দেখে-শুনে পছন্দ করে একটা পুষ্যিপুত্ত্বর নিলেই পারতো চৌধুরী মশাই!

নিতাই বললে–কেন, তার চেয়েও তো সোজা পথ ছিল একটা–

সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠলো–কী পথ? কী পথ?

নিতাই বললে–কেন, চৌধুরী-গিন্নীর কি ছেলে হবার বয়েস ফুরিয়ে গিয়েছে? একটা ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, তা আর-একটা তো বিয়োতে পারতো–

সবাই হো হো করে হেসে উঠেছে।

কেদার বললে–দূর, চৌধুরী-গিন্নীকে সেদিন দেখলি নে তুই? কী রকম বুড়ি হয়ে গিয়েছে! সে-পথ থাকলে কি আর চৌধুরী মশাই চেষ্টা করতো না?

কিন্তু যাঁদের নিয়ে এত আলোচনা, এত কানাঘুষো, তাঁদের তখন আর চোখে দেখতে পায় না কেউ। আগে চৌধুরী মশাই নিজেই ক্ষেত-খামার দেখতে বেরোতেন। যেদিন বাগান ঘেরা হবে সেদিন নিজে সকাল থেকে গিয়ে জন-মজুরের কাজের তদারকি করতেন। কিন্তু তার পর থেকে আর তাঁর টিকি দেখতে পাওয়া যেত না।

লোকে বলতো–আহা, মনে বড় কষ্ট পেয়েছে চৌধুরী মশাই–

–কীসের কষ্ট? কষ্টটা কীসের?

–না, অমন জোয়ান ছেলে, এই বুড়ো বয়সে একমাত্তর ছেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে বাপের মনে কষ্ট হয় না?

–তা অমন লোকের কষ্ট হওয়াই উচিত। খুব হয়েছে, বেশ হয়েছে। মাথার ওপর ভগবান বলে কেউ নেই ভেবেছে চৌধুরী মশাই? ভেবেছে ডুবে-ডুবে জল খেলে কেউ টের পাবে না?

একজন বললে–তবে ভাই বউ বটে, হ্যাঁ! বউ-এর মত বউ! অন্য কেউ হলে ঘেন্নায় গলায় দড়ি দিত। এ-বউ লেখাপড়া জানা বলে সকলকে জানান দিয়ে শ্বশুরের মুখে জুতো মেরে চলে গেল!

–যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল!

একজন অনেকক্ষণ ধরে বিবেচনা করে ভেবেচিন্তে বললে–আসলে ছেলেটারই দোষ! সব দোষই সদার। বাড়িতে সোমত্ত বউ রেখে সদা পালালোই বা কেন?

নিতাই বললে–কেন পালাবে না? সে কি আমাদের মত গো-মুখ্য? আমাদের বাপ মা যাকে-তাকে একটা গলায় ঝুলিয়ে দিলে আর আমরাও তাকে নিয়ে ঘর করি। কিন্তু সদা তো কলেজে পড়েছে। রেলবাজারের ইস্কুলে আর কলেজে যে এত বছর পড়লো তা কি মিছিমিছি! পেটে তার বিদ্যে পড়েছে যে!

–তুই থাম, সেজন্যে সদা বাড়ি ছাড়েনি। ছেড়েছে অন্য কারণে।

–কী কারণে ছেড়েছে?

এই প্রশ্নে এসেই সবাই থেমে যায়। কেউ বলে বাপের ওপর রাগ করে, কেউ বলে কলকাতার কোন মেয়ের সঙ্গে নাকি লাভ ছিল।

–দূর দূর, সব বাজে কথা! ছেড়েছে সংসার করবে না বলে।

–কেন সংসার করবে না?

–আরে, দেখতিস না ছোটবেলা থেকেই কেমন বিবাগী-বিবাগী ভাব। কখনও আমাদের সঙ্গে তাস খেলেছে? আমাদের ক্লাবে যাত্রা করেছে? সেবার কত করে ধরলুম ‘পাষাণী’ বইতে বিশ্বামিত্র ঋষির পার্টটা নিতে, তা নিলে? কতবার দেখেছি একলা-একলা মাঠে-মাঠে ঘুরতে। ওপারে কালীগঞ্জের বাবুদের ভাঙা বাড়িটা পড়ে আছে, কতদিন হাট করতে গিয়ে দেখেছি সে ভাঙা বাড়ির মধ্যে ঢুকেছে। দেখা হলে জিজ্ঞেস করতুম–কী রে, ওখানে ঢুকছিস কী করতে? সদা হাসতো, কিছু বলতো না। আমি তখনই জানি ও একদিন বিবাগী হয়ে যাবে!

–বিবাগী হয়ে যাবে কেন! কোন্ দুঃখে?

–তোদের মতো মুখ্য মানুষদের নিয়েই যত জ্বালা! বিষ্ণুপ্রিয়া পালায় দেখিসনি, নিমাই বউকে ছেড়ে চলে গেল?

আসলে চৌধুরী বংশ নিয়ে তর্কই হয়, কিন্তু ফয়শালা কিছুই হয় না। কিংবা হয়ত একটা ফয়শালা হোক সেটা কেউ চায় না। মনে হয় তারপর কী হবে সেইটেই তারা দেখবে। এখন তো বউ চলে গেছে, এখন চৌধুরী মশাই কী করবে? আবার কি বিয়ে করবে, না পুষ্যি নেবে?

কিন্তু একদিন দেখা গেল ননী ডাক্তারকে নিয়ে কৈলাস সামন্ত হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির সদরে ঢুকছে!

ডাক্তারবাবুকে ডেকেছে কেন গো গোমস্তা মশাই? কার অসুখ?

কৈলাস বললে–গিন্নীমার!

অসুখ এমন সব বাড়িতেই হয়ে থাকে। তবে নবাবগঞ্জের কারো বাড়িতে অসুখ করলে হুট করে কেউ ডাক্তার ডাকে না, টোটকা-টাটকা খেয়েই সেরে যায় সকলের জ্বরজারি। রেলবাজারের ননী ডাক্তারকে ডাকলে মোটা টাকার গুনোগার দিতে হয়। কর্তাবাবুর যখন অসুখ হয়েছিল তখন রোজ আসতো ননী ডাক্তার। টাকার বাণ্ডিল নিয়ে গেছে তখন। কিন্তু আবার কার অসুখ? ছোটখাটো অসুখ হলে তো আর ননী আসতো না।

তারপর সেই ননী ডাক্তার রোজ-রোজ আসতে লাগলো।

কৈলাস গোমস্তাকে দেখেই সবাই জিজ্ঞেস করে কী গো গোমস্তা মশাই, তোমাদের গিন্নীমা কেমন আছেন?

কৈলাস মুখ গম্ভীর করে বলে–না গো, ভালো না, বড্ড বাড়াবাড়ি–

কৈলাস গোমস্তা আড়ালে চলে গেলেই সবাই বলাবলি করে বাড়াবাড়ি হবে না? পাপের ফল ফলবে না? চোখের জল ফেলতে ফেলতে বউটা চলে গেছে, তার চোখের জল কি মিথ্যে হবে গো?

কথাটা সবাই সায় দেয়। চোখের সামনে সমস্ত বাড়িটার ওপর যে অলক্ষ্মী নেমে আসছিল তা সকলের চোখেই পড়েছিল। সন্ধ্যে হলেই আলো নিভে যেত চণ্ডীমণ্ডপের। পরমেশ মৌলিক অনেকক্ষণ চৌধুরী মশাই-এর জন্যে খেরো খাতা কোলে করে বসে থাকতো। তারপর যখন দেখতো চৌধুরী মশাই তখনও আসছেন না তখন আস্তে আস্তে দীনুকে দিয়ে ভেতরে খবর পাঠাতো। দীনু ভেতর থেকে এসে বলতো–আজ আর ছোট মশাই খাতা দেখবেন না, কালকে দিনের বেলা দেখবেন বললেন–

আর তারপর একদিন বজ্রাঘাত হলো।

সবাই শুনলো–চৌধুরী-গিন্নী মারা গেছে।

সে এক অদ্ভুত মৃত্যু! কোনও কান্নাকাটির শব্দ নেই। আর কাঁদবার তখন কে-ই বা ছিল বাড়িতে যে কাঁদবে! গৌরী গিয়ে ডেকে এনেছিল বেহারি পালের বউকে। বেহারি পালের বউ এল। বেহারি পাল নিজেও এল। খবর পেয়ে আরো অনেকে এল। বুড়োমানুষ তারক চক্রবর্তী লাঠি হাতে টুক টুক করে এসে হাজির হলো।

বেহারি পালের বউ যখন ভেতরের ঘরে গিয়ে পৌঁছুল তখন চৌধুরী-গিন্নী স্থিরদৃষ্টিতে ছাদের দিকে চেয়ে আছে। মনে হলো যেন বলছে-তোমরা বলে দাও, আমি কী দোষ করেছি, আমাকে বলে দাও তোমরা–

কিন্তু তখন কে-ই বা সে কথা বলে দেবে, আর কে-ই বা সে প্রশ্নের উত্তর শুনবে! প্রশ্ন আর উত্তরের ঊর্ধ্বলোকে আর এক মহাজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তখন চৌধুরী গিন্নীর ছোট প্রশ্নটা যেন একেবারে নিরর্থক হয়ে গেছে। যখন চৌধুরী-গিন্নীকে নিয়ে পাড়ার ছেলেরা নদীর ধারের শ্মশানের চিতার ওপর তুললো, তখনও সেই প্রশ্নটা যেন তার চোখের তারায় অনির্বান হয়ে ঝুলছিল। আর তারপর যখন তার সমস্ত শরীরটা আগুনের শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল, তখনও বুঝি তার সে প্রশ্নটার উত্তর মেলেনি। তাই বুঝি সে প্রশ্নটা ধোঁয়া হয়ে সমস্ত আকাশ বাতাস আচ্ছন্ন করে কি-দিগন্তে ছুটে বেড়াতে লাগলো। অনুচ্চারিত শব্দে যেন জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে সকলকে প্রশ্ন করতে লাগলো–তোমরা বলে দাও, কী অপরাধ করেছি আমি, বলে দাও তোমরা–

–তারপর?

তারপর চৌধুরী মশাই একেবারে একলা হয়ে গেলেন। একেবারে একলা। সেই যে দোতলার ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন, সেখান থেকে আর বেরোলেন না। গৌরী রান্না করে খাবার দিয়ে আসে তাঁর ঘরে। আপন মনে বিড়বিড় করে তিনি যেন সব-সময় কী বকেন আর তারপর যখন সন্ধ্যে হয় তখন চারদিকে জানালা দরজা বন্ধ করে বিছানায় এলিয়ে পড়েন।

কিন্তু তারও ওই এক প্রশ্ন! তোমরা বলে দাও, কী অপরাধ করেছি আমি, বলে দাও তোমরা–আমার পূর্বপুরুষের এই সম্পত্তি, এই ঐশ্বর্য, এই স্থাবর অস্থাবর এত গয়নাগাঁটি- জমিজমা-পুকুরবাগান এ কার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি যাবো? কার ওপর গচ্ছিত করে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হবো? এই সর্ষে ছোলা-ধান-পাটের ক্ষেত, এই পুকুর, বিল, বাগান–এসব কিছুর স্বত্ব কে ভোগ করবে? কার উত্তরাধিকারের মধ্যে দিয়ে আমি অতীন্দ্রিয়লোকে গিয়ে অনন্তকাল ধরে অক্ষয় হয়ে বাঁচবো?

এক-একদিন রাত্রে হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ হতো। কথা বন্ধ হয়ে গেলে যেমন মানুষের গলা দিয়ে অস্পষ্ট একরকম শব্দ বেরোয় ঠিক তেমনি। কর্তাবাবুর অশরীরী উপস্থিতি যেন তাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলতো।

কর্তাবাবুর অশরীরী উপস্থিতির অসহ্যতায় চৌধুরী মশাই সন্ধ্যেবেলাই দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিতেন। তবু রেহাই পেতেন না তিনি। কর্তাবাবুর গলা তখন স্পষ্ট হয়ে উঠতো। তিনি স্পষ্ট গলায় বলতেন–মায়া-দয়া কোর না বাবা, কারোর ওপর মায়া-দয়া কোর না, মায়া-দয়া করলেই সর্বনাশ, তাহলে এই জমি-জমা, পুকুর-বাগান কিছুই আর থাকবে না–

চৌধুরী মশাই বলতেন–কিন্তু আমি তো মায়া-দয়া করিনি কর্তাবাবু, আমি তো কারোর ওপর কোনও মায়া-দয়া দেখাইনি। আমি তো কারোর এক পয়সার বাকি খাজনা ছাড়িনি, যে আমায় ঠকাতে চেয়েছে তাকে তো আমি রেহাই দিইনি, আমি তো স্বার্থসিদ্ধির জন্যে নিজের পুত্রবধূকেও অব্যাহতি দিইনি? তবে? তবে কেন আমার এ সর্বনাশ হলো? তোমার কথা বর্ণে বর্ণে মেনেও কেন আমি সর্বস্বান্ত হলাম?

এ-প্রশ্নের কোনও জবাব মিলতো না কারো কাছে। সবাই তখন চৌধুরী মশাই-এর জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনিও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন সকলের সান্নিধ্য থেকে। সে তখন তার এমন এক জীবন যাকে গ্রহণ করাও বলে না আবার বর্জন করাও বলে না। তখন তিনি নিজের জন্মভূমি, নিজের বাড়ি থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। কেউ এলেও তার সঙ্গে তিনি দেখা করেন না। যেন নিজের কৃতকর্মের অপরাধের বোঝায় তিনি নিজেই ক্লান্ত, বিভ্রান্ত, বিপর্যন্ত।

শালাবাবু সমস্ত ঘটনাগুলো শুনলে। তার চোখের সামনে দিয়ে অনেকগুলো স্বপ্ন, অনেকগুলো স্মৃতি যেন খুব তাড়াতাড়ি ভেসে গেল। সেই কবে দিদির বিয়ের সময় সে নিজের বউ আর ছেলে মেয়ে ছেড়ে ভাগলপুর থেকে চলে এসেছিল, তার পর থেকে এই নবাবগঞ্জকে কেন্দ্র করেই তার জীবন কত দিক পরিক্রমা করেছে। সেই সদানন্দ যখন ছোট ছিল তখন তাকে নিয়ে কোথায় কোথায় গেছে। কতদিন রানাঘাটে রাধার বাড়িতে, কতদিন কলকাতার কালীঘাটে। আর যখনই টাকার দরকার পড়েছে তখনই এসে হাত পেতেছে দিদির কাছে। টাকা চাইলেই দিদি তার সিন্দুকটা খুলেছে আর দু’হাতে টাকা বার করে দিয়েছে। সেই দিদির মারা মাওয়ার খবর শুনে প্রকাশের মত লোকও কেমন অসহায়ের মত বাড়িটার দিকে শেষবারের মত চেয়ে দেখলে। তার মনে হলো সব শেষ। চিরকালের মত সব শেষ।

–আর জামাইবাবু? জামাইবাবু কোথায় গেল?

বেহারি পাল মশাই বললে–তোমার জামাইবাবু তো কিছুদিন এখানেই ছিল। একদিন দেখলুম গরুর গাড়িতে করে ইস্টিশানের দিকে যাচ্ছেন। আমি জিজ্ঞেস করলুম–কোথায় যাচ্ছেন চৌধুরী মশাই, তা চৌধুরী মশাই বললেন–ভাগলপুরে শ্বশুর মশাই-এর নাকি অসুখ–

শালাবাবু চমকে উঠেছে। বললে–পিসেমশাইএর অসুখ? তাই নাকি? কী রকম অসুখ?

বেহারি পাল বললে–তা কী জানি, তোমার জামাইবাবু তো গেছেন সেই মাসখানেক হলো এখনও তো এলেন না। আর কী জন্যেই বা আসবেন বলে? এখেনে তো আর কেউ রইল না। তোমার দিদি রইল না, তোমার ভাগ্নেও রইল না, আর তোমার ভাগ্নে বউ সেও পর্যন্ত রইল না। তাহলে আর এখানে একলা একলা পড়ে থাকবেন কী নিয়ে বলো না? কার জন্যে পড়ে থাকবেন? আর সম্পত্তি? যাদের জন্যে সম্পত্তি করা তারাই যখন রইল না তখন আর কাদের জন্যেই বা সম্পত্তি দেখবেন?

এরপর শালাবাবু আর দাঁড়ালো না। বললে—যাই–

বেহারি পাল আবার বললে–আর তা ছাড়া তোমার পিসেমশাই-এরও তো কেউ নেই? কীর্তিপদবাবুর? তারও তো অনেক টাকা! সুলতানপুরের অত সম্পত্তি! তিনি মারা গেলে তো তোমার জামাইবাবু সব পাবে। তোমার পিসেমশাই-এর তো আর কোনও সন্তান নেই?

প্রকাশ বললে–না।

–তাহলে? তোমার জামাইবাবুই তো এখন সেই সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশান। তারপর তোমার জামাইবাবুর পর আর কে পাবে? সদা ফিরে এলে সদা পাবে, আর নয় তো তুমি!

এত কথা প্রকাশের মনে পড়েনি। তাহলে? তাহলে তো শেষ পর্যন্ত পিসেমশাই-এর সমস্ত সম্পত্তি তার কপালেই নাচছে। কী আশ্চর্য! কথাটা খেয়াল হতেই আর দাঁড়ালো না প্রকাশ। বললে–যাই পাল মশাই, আমি যাই

তারপর সকলের দিকে চেয়ে বললে–যাই হে, কিছু মনে কোর না তোমরা, পিসেমশাই এর অসুখ, এ সময়ে আমার বাইরে থাকা উচিত নয়–

বলে রেলবাজারের দিকে হন হন করে হাঁটা দিলে। তাড়াতাড়ি পা চালালে দুটোর ট্রেনটা ধরা যাবে!

পেছন থেকে বেহারি পাল জিজ্ঞেস করলে–খাওয়ার কী হবে তোমার শালাবাবু? দুটো খেয়ে গেলে হতো না?

চুলোয় যাক গে খাওয়া! টাকা ছড়ালে কপালে খাওয়া অনেক জুটবে। এখন যদি গিয়ে ভালোয় ভালোয় প্রকাশ দেখে পিসেমশাই মারা গেছে তবেই সুরাহা। জামাইবাবু একলা আর কত খাবে! দেখা-শোনা করতেও তো লোক দরকার। আর তারপরে জামাইবাবুই বা আর ক’দিন? জামাইবাবু মারা গেলে তখন?

কথাটা কল্পনা করতেই প্রকাশ দু’হাত জোড় করে উদ্দেশ্যে প্রণাম করলে। হে মা কালী, হে মা মঙ্গলচণ্ডী, আমি জীবনে কোনও পাপ করিনি, জীবনে কখনও কোনও অন্যায় করিনি, জীবনে কারো টাকা মারিনি, আমার দিকে একটু দেখো মা। আমি বড় অনাথ! কে সম্পত্তি করে যায় আর কে তা খায়! ইচ্ছাময়ী সবই তোমার ইচ্ছা, আমরা তো কেবল নিমিত্ত মাত্র। জয় মা কালী, জয় মা মঙ্গলচণ্ডী!

বলে মোবারকপুরের রাস্তা ধরলে। মোবারকপুরের রাস্তাটা পেরোলেই সাইকেল রিকশার আড্ডা। সেখান থেকে এক দৌড়ে একেবারে সোজা রেলবাজার।

প্রকাশ হনহন করে রাস্তা মাড়াতে লাগলো।

.

সমরজিৎবাবু ঠিকই করে ফেলেছিলেন। রোজ-রোজ অশান্তির চেয়ে চিরকালের মত একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে রাখা ভালো। যেদিন রাণাঘাট স্টেশনে সদানন্দকে দেখেছিলেন সেইদিন থেকেই একটা ক্ষীণ ইচ্ছে তাঁর মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল। তারপর বাড়িতে অশান্তিটা যত বেড়েছে ততই সে ইচ্ছেটা আরো বড় হয়ে মনের মধ্যে দৃঢ়মূল হয়েছে। পৈত্রিক সম্পত্তিটার কথা ভেবেই একদিন নিজের করে নিয়েছিলেন তাঁর খোকাকে। ভেবেছিলেন স্বভাবচরিত্র ভালো, বংশটাও ভদ্র, এক বিধবা ছাড়া তখন খোকার কেউ ছিল না আর। যতদিন বুড়ি-মা বেঁচে ছিল ততদিন তাকে মাসে মাসে পাঁচশো টাকা পাঠিয়েছেন। তারপর যেদিন তিনি মারা গিয়েছে তখন থেকে মুক্তি।

একদিন খোকা এসে সামনে দাঁড়ালো। সমরজিৎবাবু বললেন–কী হলো? চাই কিছু তোমার?

খোকা বললে–না, চাই না কিছু–

–তাহলে?

খোকা বললে–আমি একটা চাকরি নিয়েছি–

চাকরি! চাকরি শুনেই সেদিন বিস্মিত হয়ে উঠেছিলেন সমরজিৎবাবু। বললেন–চাকরি নিয়েছ মানে? কে তোমায় চাকরি নিতে বলেছে? কিসের চাকরি?

–পুলিসের।

পুলিসের চাকরি! সমরজিৎবাবুর তখন যেন বিস্ময়ের আর সীমা রইল না। বললেন– হঠাৎ যে তুমি চাকরি নিলে? কত মাইনে?

–দেড় শো টাকা।

–দেড় শো টাকা মাইনে নিয়ে কি তুমি রাজা হবে? আমি তো চারদিকে চাঁদাই দিই মাসে দেড় শো টাকা করে। আর তুমি এ বাড়ির ছেলে হয়ে কিনা দেড় শো টাকা মাইনের চাকরি করবে?

গৃহিণী গোলমাল শুনে ঘরে এসে দাঁড়ালো। বললে–কী হয়েছে গো? কী বলছে খোকাকে?

সমরজিৎবাবু বললেন–ওই দেখ, তোমার ছেলে দেড় শো টাকা মাইনের পুলিসের চাকরি নিয়েছে–

গৃহিণী বললে–সে কী রে খোকা, তোকে চাকরি নিতে কে বললে?

খোকা বললে–কেউ বলেনি–

–কেউ বলেনি তো চাকরি নিতে গেলি কেন? দরখাস্ত করেছিলি?

–না।

অন্য ছেলের বাবা-মা’রা ছেলের চাকরি পাওয়ার খবরে খুশী হয়, খুশী হয়ে কালী বাড়িতে গিয়ে পূজো দেয়। কিন্তু এবাড়িতে সেদিন উল্টো হয়েছিল। ছেলের চাকরি পাওয়ার খবর যেন তাদের কাছে শোক সংবাদ বলে মনে হয়েছিল। খোকা রোজ ময়দানে ফুটবল খেলতে যেত। সেখান থেকেই একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে তাদের বাড়ি গিয়েছিল। বন্ধুর বাবা পুলিসের একজন বড় অফিসার। খোকার স্বাস্থ্য দেখে তাঁর খুব ভালো লেগেছিল।

বলেছিলেন–তুমি চাকরি কররে?

কী খেয়াল হয়েছিল খোকার কে জানে! বলেছিল—হ্যাঁ—

বলতে গেলে খোকার সেই স্বাস্থ্য দেখেই, চাকরি। আর তার সঙ্গে তার ফুটবল খেলতে পারার গুণ। সমরজিৎবাবুও যে তাকে নিজের ছেলে করে নিয়েছিলেন সেও সেই স্বাস্থ্য। অন্য লোকের যে জিনিসটা থাকলে জীবন সুখের হয়, খোকার কাছে সেই জিনিসটাই শেষ পর্যন্ত হলো কাল।

প্রথম দিকে সমরজিৎবাবু বলেছিলেন–তুমি চাকরি ছেড়ে দাও–তোমার চেয়ে যাদের অবস্থা খারাপ তারা এ চাকরি পেলে বেঁচে যাবে–

কিন্তু খোকার মনে তখন ক্ষমতার লোভ। বাড়িতে বসে বসে খাওয়ার মধ্যে আরাম থাকলেও ক্ষমতা নেই। চাকরিতে ক্ষমতা আছে। দশজনকে হুকুম করতে পারবে। দশজনে ভয়-ভক্তি করবে। চোর-গুণ্ডা বদমায়েরাও খাতির করবে।

তখন একদিন সমরজিৎবাবু দেখলেন ছেলে রাত করে বাড়ি ফিরছে। আবার কোনও দিন রাত্রে বাড়িতে ফিরছেও না। জিজ্ঞেস করলে বলে–ডিউটি ছিল। তারপরে একদিন দেখলেন মুখ দিয়ে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। সেদিন আর দেরি করলেন না। একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে শুভদিনে খোকার বিয়ে দিয়ে দিলেন।

এসব ঘটনা সদানন্দ এবাড়িতে আসার অনেক আগেকার ঘটনা। কিন্তু ক দিন এখানে থাকতে থাকতে সদানন্দ সব জেনে ফেললে! যেদিন অনেক রাত্রে প্রথম কাকাবাবুর সঙ্গে তার ছেলের কথা কাটাকাটি হয়েছিল, যেদিন মহেশ তার বড় দাদাবাবুকে বাড়ি থেকে রাস্তায় বার করে দিয়েছিল, সেইদিন থেকেই সন্দেহটা গাঢ় হয়েছিল তার। তারপর থেকে আরো অনেকবার ওই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হলো। সমরজিৎবাবু ক্রমেই যেন কেমন অস্থির হয়ে উঠছিলেন। ভালো করে আগেকার মত আর কথা বলতেন না সদানন্দের সঙ্গে। কিন্তু সদানন্দও ক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল। সময় পেলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়তো। কোথায় সেই নবাবগঞ্জের ফাঁকা অবহাওয়া আর কোথায় এই ঘিঞ্জি শহরের গোলমাল। ক’দিন আগেই এখানে দাঙ্গা হয়ে গিয়েছে, চলতে ফিরতে ভয় করে সকলের। তবু বাড়ি থেকে না বেরিয়েও কেউ থাকতে পারে না। কিন্তু এই শহর ছাড়া কোথায়ই বা সে যাবে! বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন কিছুই ঠিক ছিল না কোথায় সে যাবে। কিন্তু ঘটনাচক্রে যখন সে এখানে এসে পড়েছে তখন কী কাজই বা সে এখানে করবে! এ পৃথিবীটাই হয়ত এমনি। এখানে পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরের কেবল প্রয়োজনের সম্পর্ক ছাড়া আর কোনও সম্পর্ক নেই। প্রয়োজন থাকলে তোমার সঙ্গে আমি কথা বলবো, তোমার সঙ্গে আমি এক বিছানায় শোব, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই আমি আবার তোমাকে দূর করে দেব। কিন্তু কেন ভালবাসার সম্পর্ক থাকবে না তোমার সঙ্গে? কেন প্রয়োজনের বদলে প্রীতি দিয়ে তুমি আমাকে আকর্ষণ করবে না?

সেদিন রাস্তায় চলতে চলতে দেখলে বুড়ি মতন একজন মেয়েমানুষ তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে। সদানন্দ অবাক হয়ে গেল! তার দিকে এমন করে চেয়ে দেখছে। কেন?

মনে হলো বুড়িটা যেন গঙ্গাস্নান করে বাড়ি যাচ্ছে। যেতে যেতে তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–আপনি আমায় কিছু বলবেন?

বুড়িটা বললে–তোমার বাড়ি কোথায় বাবা?

সদানন্দ বললে–আমি বউবাজারে থাকি।

–বউবাজারে! বউবাজারে থাকো বাবা তুমি তা এদিকে এসেছে কেন? কোনও কাজ আছে বুঝি?

সদানন্দ বললে–না এমনি বেড়াচ্ছি–কেন? আপনার কিছু দরকার আছে?

বুড়িটা বললে–দরকার তো ছিল বাবা, কিন্তু তোমাকে তা বলি কী করে তাই ভাবছি। তুমি বামুন তো?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, আমি ব্রাহ্মণ! কেন?

–আমি বললে কি আর তা বিশ্বাস করবে বাবা? তোমরা তো আজকালকার ছেলে, ঠাকুর-দেবতাতে তো তোমাদের বিশ্বাস নেই। তাই বলবো কি না ভাবছি।

সদানন্দ বললে–বলুন না কী বলবেন?

বুড়ি বললে–আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলুম বাবা।

স্বপ্ন?

–হ্যাঁ বাবা স্বপ্ন। ঠাকুর স্বপ্ন দিয়েছিল যে সকাল বেলা চান করে আসার পথে যদি কোনও বামুনের ছেলেকে দেখতে পাস তা তাকে বাড়িতে এনে তার চরণ পুজো করিস!

সদানন্দ অবাক হয়ে গেল। এ আবার কী কথা! চরণ-পুজো।

বললে–আপনি আমার চরণ-পূজো করবেন? কেন?

বুড়ি বললে–ওই যে বললুম বাবা ঠাকুরের স্বপ্ন। তা আমার সঙ্গে একবার আমার বাড়িতে যাবে? আমি তোমার চরণ-পূজো করবো!

সদানন্দর কেমন সন্দেহ হলো। চেনা নেই শোনা নেই যার-তার বাড়িতেই বা যাবে কেন সে?

বললে–দেখুন, আমি আপনাকে চিনি না আর আপনি আমার চরণ-পূজো করবেন কেন তাও বুঝতে পারছি না। এরকম স্বপ্নই বা আপনি দেখতে গেলেন কেন? আর আমি ছাড়া কি আর বামুন কেউ নেই কলকাতায়? আপনার বাড়ির পাশেই তো কত বামুন পেতে পারেন।

বুড়ি বললে–তাতে তো কাজ হবে না বাবা! চান করে উঠেই যে আমি তোমার মত বামুনকে প্রথম দেখেছি। অন্য কোন বামুনের চরণ-পূজো করলে তো আমার কোনও লাভ হবে না!

সদা তবু বুঝতে পারলে না। বললে–লাভ মানে? আমার চরণ-পূজো করে আপনার কী লাভ?

বুড়ি বললে–তোমাকে আর দুঃখের কথা বলবো কী বাবা। আমার বাতের অসুখ। বাতের অসুখে আমি জেরবার হয়ে যাচ্ছি। শেষকালে বাবা তারকনাথের মন্দিরে গিয়ে হত্যে দিয়েছিলুম। সেখানে বাবা স্বপ্ন দিলেন যে পূর্ণিমের দিন গঙ্গায় চান করবি, চান করে আসার পথে প্রথম যাকে বামুন বলে জানতে পারবি তার চরণ-পূজো করলে তোর বাতের ব্যথা সেরে যাবে। এ কোমরের ব্যথা আমার এমন যে একেবারে নড়ে বসতে পারিনে। তা তুমি বাবা আমার এ উবকারটা করতে পারবে না!

এ এক অদ্ভুত প্রস্তাব! এমন ঘটনা সদানন্দ জীবনে কখনও শোনেনি কারো কাছ থেকে।

বললে–আমার চরণ-পূজো কী করে করবেন? কতক্ষণ সময় লাগবে?

বেশিক্ষণ তোমায় কষ্ট দেব না বাবা। তোমার পায়ে ফুল-গঙ্গাজল দিয়ে পেন্নাম করবো আমি আর বাজারের মিষ্টি এনে তোমাকে দেব, আর তুমি পেসাদ করে দেবে! আধঘণ্টার মধ্যেই তোমায় আমি ছেড়ে দেব বাবা-বেশি সময় লাগবে না–

–আপনার বাড়ি এখান থেকে কতদূর?

–এই তো কাছেই বাবা, বেশি দূর নয়।

সদানন্দ কী ভেবে বললে–আচ্ছা চলুন–

তার সামান্য চরণ-পূজোয় যদি বুড়ির ওবাতের ব্যথা সারে তো কী এমন তার ক্ষতি। সদানন্দ বুড়ির পেছন-পেছন চলতে লাগলো। একটা গলি দিয়ে ঢুকে আর একটা গলির ভেতরে কিছুক্ষণ গিয়ে বুড়ি বললে–এই আমার বাড়ি, এসো বাবা, আমার সঙ্গে এসো–

বলে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলো। তারপর একটা দরজার সামনে গিয়ে কড়া নাড়তে লাগলো। কে একজন এসে দরজা খুলে দিলে। পাশেই একটা ঘর। সেই ঘরের মধ্যে সদানন্দকে নিয়ে গিয়ে বললে–তুমি এখেনে একটু বোস বাবা

সদানন্দকে ঘরে বসিয়ে তারপর বুড়ি ভেতরের দিকে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

তারপর ভেতরে গিয়ে গলা নামিয়ে ডাকতে লাগলো–কই রে বাতাসী, কোথায়? ও বাতাসী

বাতাসী ভেতরে কী করছিল কে জানে! মাসির ডাকে সামনে এসে বললে–কী মাসি?

মাসি বললে–ওলো, সেই ছেলেটাকে এতদিনে পেয়েছি রে?

–কোন্ ছেলেটাকে?

মাসি বললে–সেই যে, সেবার খোঁজখবর করবার জন্যে তোকে দিয়ে বড়বাবুকে একটা ছবি দিয়েছিলাম, সেই যে আমার প্রকাশ ছেলের কাছ থেকে আগাম একশো টাকা নিইছিলুম। পরে আরো ন’শো টাকা দেবার কথা আছে? তোর মনে পড়ছে না?

–তা কী করে তাকে চিনতে পারলে?

মানদা মাসি বললে–চিনতে পারবো না বাছা? তার ছবি তো তোর কাছে দিইছিলুম বড়বাবুকে দেবার জন্যে। বড়বাবুকে ছবিটা দিয়েছিলি তুই?

বাতাসী বললে–সে তো আমি সেই দিনই দিয়েছিলুম—

মানদা মাসি বললে–তা সে ছবিটা এখন কোথায়? বড়বাবুর কাছে না তোর কাছে?

–সে তো বড়বাবুর কাছে দিইছিলুম, বড়বাবুর কাছেই আছে।

–তা বড়বাবু আজকে আসবে তো?

বাতাসী বললে–এই তো ভোর বেলাই বাড়ি চলে গেল, বড়বাবুর বাড়িতে এখন আবার গণ্ডগোল চলছে কিনা, কলকাতায় থাকলে আপিস থেকে সোজা এখেনেই চলে আসবে

মানদা মাসি বললে–এখন ছেলেটাকে তো ভুজুং দিয়ে তোর বাইরের ঘরে এনে বসিয়ে রেখে এসেছি। যতক্ষণ না বড়বাবু আসে ততক্ষণে তোর এখানে আটকে রাখতে পারবি নে? তুই খাবার-দাবারের কিছু বন্দোবস্ত কর। আমি যাই অনেকক্ষণ ছেলেকে বসিয়ে রেখে দিয়ে এসেছি—

.

সমরজিৎবাবুর পূর্বপুরুষ যেমন গ্রামের জমি-জমা করেছিলেন, তেমনি বুঝেছিলেন যে গ্রামে যত জমিজমাই থাক, কলকাতায় একটা সম্পত্তি করতেই হবে। ভাঁড়ার যখন উপচে পড়ে তখন বাড়তি সম্পত্তি কোথায় লগ্নী করবো তার সমস্যা উদয় হয়। সেই আদিকালে এই বউবাজার অঞ্চলের বাড়িটার উদ্ভব হয় সেই কারণেই। তখন কর্তারা থাকতেন গ্রামে। গ্রামের জমিজমা থেকে গ্রাসাচ্ছাদন আসতো। কিন্তু ছেলেদের লেখা-পড়া করতে থাকতে হতো কলকাতায়। তখন এই আজকালকার মতন হোস্টেল বোর্ডিং এসব থাকলেও কর্তাব্যক্তিরা সেখানে ছেলেদের পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারতেন না। খাওয়ার কষ্ট থাকার কষ্ট ছাড়াও আরো ছিল একটা ভয় সেটা হচ্ছে কুসঙ্গে পড়ে খৃষ্টান বা বাহ্ম হয়ে যাবার ভয়! তারপরে আছে চরিত্রহানির আশঙ্কা।

সমরজিৎবাবুর পূর্বপুরুষরা তাই কেউ এখানে থেকে লেখা-পড়া করবার সময় অন্য ছেলেদের মত কুসঙ্গে পড়ে মদ্যপান যেমন করেননি, তেমনি খৃষ্টানও হননি কিম্বা ব্রাহ্মও হননি। বরং দেব-দ্বিজে ভক্তি আর পূজো-পার্বণের প্রতি আসক্তিই তাঁদের উত্তরোত্তর বেড়ে এসেছে। সেই বংশের শেষ পুরুষ হচ্ছেন সমরজিৎবাবু। আর সেই সমরজিৎবাবু একাই তখনও অতি কষ্টে বংশের ঐতিহ্যটা টানতে টানতে এত দূর টেনে নিয়ে এসেছিলেন। কোথাও বন্যা কিম্বা দুর্ভিক্ষ হলে মনে কষ্ট হতো। বাপ-পিতামহের টাকা এই সব কাজে ব্যয় করতে পারলে মনে হতো তিনি টাকা সদ্ব্যয় করছেন। এ ছাড়া ছিল দান। সৎ-উদ্দেশ্য দাতব্য করতে তাঁর আপত্তি হতো না। রামকৃষ্ণ মিশনের যতগুলো শাখা আছে সবগুলোতে মাঝে-মাঝে টাকা পাঠাতেন। টাকা পাঠিয়ে মনের কষ্ট লাঘব করতে পেরে যেন মনে মনে পরিত্রাণ পেতেন।

কিন্তু উদ্বেগ ছিল ওই একটা বিষয়েই। ছেলে ফুটবল খেলতে পারে ভালো এ-খবরটা শুনে তাঁর ভালো লেগেছিল। খেলার জন্যে স্কুল থেকে পাওয়া অনেক মেডেল দেখে তিনি তাকে বরাবর উৎসাহই দিয়েছিলেন। কিন্তু যেদিন সেই ছেলেই আবার প্রথম মাতাল হয়ে বাড়িতে ঢুকলো সেই দিনই তাঁর টনক নড়লো।

ছেলের সামনে গিয়ে তিনি মুখোমুখি দাঁড়ালেন। খোকা তখন টলছে। জিজ্ঞেস করলেন–তুমি মদ খেয়েছ?

খোকা লজ্জায় মাথা নিচু করলো।

সমরজিৎবাবু আবার গলা চড়ালেন কথা বলছো না কেন? তুমি মদ খেয়েছ?

খোকা অনেক পীড়াপীড়ির পর উত্তর দিলে–দেখতে তো পাচ্ছো মদ খেয়েছি, আবার জিজ্ঞেস করছো কেন মিছিমিছি?

সমরজিৎবাবু রাগতে যাচ্ছিলেন। রেগে গিয়ে হয়ত একটা অশালীন কাণ্ড করেও ফেলতেন, কিন্তু গৃহিণী এসে বাধা দিলে। সমরজিৎবাবুকে ধরে ফেললে। বললে–করছ কী তুমি?

বলে খোকাকে নিয়ে গিয়ে ঘরে শুইয়ে দিলে। তারপর কর্তার কাছে এসে বললে–তুমি করছিলে কী? ওর সঙ্গে অমন কথা বলতে আছে? তুমি জানো ও রাগী ছেলে!

ততক্ষণে সমরজিৎবাবুও নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। সাধারণত তিনি মেজাজ কখনও গরম করেন না। কিন্তু তাঁর সাধের সংসারের ভিতের ওপরেই বুঝি আঘাত লেগেছিল সেদিন। এত সাধ করে তিনি যে ছেলেকে নিজের করে নিয়েছিলেন তার কাছ থেকে আঘাত আসাতেই সেটা এত বেশি করে লেগেছিল তাঁর বুকে।

তারপর আর বেশিদিন দেরি করেননি তিনি। তার কিছুদিন পরেই সেই ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছিলেন।

কিন্তু যা ভেবেছিলেন তা হয়নি। তার পর যত দিন গেছে, মনে মনে যত দুঃখ পেয়েছেন আর সংসারের ওপর বৈরাগ্য তাঁর তত বেড়েছে। আরো বেশি পূজোপাঠের দিকে মন গেছে। গঙ্গায় ডুব দেবার সময় আরো বেশি করে ভগবানকে ডেকেছেন। একেবারে যখন অনিবার্য হয়েছে তখন ছাড়া আর কখনও দেশে যাননি। যখন গেছেন তখন কলকাতা থেকে দিন কতকের জন্যে মুক্তি পাবার জন্যেই গেছেন। পূর্বপুরুষের বিরাট দালানবাড়িটার ভেতরের ঘরে গিয়ে অনেক দিন চুপ করে খাটের ওপর শুয়ে থেকেছেন। গোমস্তানায়েব এসে জমিজমার ফসলের হিসেব দিয়েছে। ধান-পাট-তরিতরকারি বেচার টাকা দিয়েছে। তিনি যথারীতি তা নিয়েছেন। কিন্তু কখনও হিসেবের চুলচেরা বিচার করে নিজের অবসর যাপনের শান্তি ক্ষুণ্ণ করেননি। তর্ক করে গোমস্তার ভুল ধরতেও চেষ্টা করেননি। কার জন্যেই বা সে-সব করবেন। নিজের একটা তো শরীর। তার ওপর তাঁর জীবনের মেয়াদও প্রায় শেষ হয়ে আসবার দিকে। তিনি জানতেন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এই সব কিছুই একদিন নষ্ট হয়ে যাবে। কেউ আর এখানে আসবে না। তারপর যারা এখানে থাকবে তারাই সব কিছু ভোগ দখল করবে। সুতরাং মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?

কিন্তু সদানন্দ আসবার পর থেকেই যেন আবার তাঁর আশা হয়েছিল।

গৃহিণী ঘরে এলে ডাকলেন। বলতেন–শোন—

গৃহিণী কাছে আসতো।

তিনি বলতেন–একটা কথা কাউকে যেন বোল না। সদানন্দ ছেলেটাকে তোমার কেমন লাগে?

গৃহিণী বলতো–ভালোই তো, কেন? ওকথা জিজ্ঞেস করছো কেন?

–না, এমনি তোমায় জিজ্ঞেস করছি। এতকাল এ বাড়িতে তো রয়েছে! তুমিও তো দেখছো। স্বভাব-চরিত্র কেমন মনে হচ্ছে তোমার?

গৃহিণী বলতো–স্বভাব-চরিত্র আমি কেমন করে জানবো, আমি থাকি বাড়ির ভেতরে, সে থাকে বাইরে বাইরে, আমি কি আর দেখতে গেছি সে বাইরে গিয়ে কী করছে না করছে?

সমরজিৎবাবু বলতেন–তা তুমি যা জানো তা জানো, আমার কিন্তু ছেলেটিকে পছন্দ হয়েছে–আমি মহেশকে ওদের দেশে পাঠিয়েছি খবরাখবর আনতে–

–কীসের খবর?

–ওই সদানন্দর দেশে কে আছে না-আছে, এই সব জানতে। কলকাতা থেকে নবাবগঞ্জ তো আর বেশি দূর নয়। রাণাঘাট থেকে আরো কাছে। সকালবেলা গিয়ে আবার রাত্তিরেই ফিরে আসা যায়।

গৃহিণী বললে–সে-খবর নিয়ে তুমি কী করবে?

সমরজিৎবাবু বললেন সদানন্দকে যা-যা জিজ্ঞেস করেছি তার তো সবই ঠিক ঠিকই উত্তর দিয়েছে। এখন মহেশ গিয়ে দেখে এসে কী বলে দেখি, তারপর ভাবছি ও যদি রাজী হয় তো আমি ওকে বরাবর এখানেই রেখে দেব।

–রেখে দেবে মানে? তোমার কি এক ছেলেকে নিয়েও মনের আশ মিটলো না? তার বিয়ে দিয়েছ, তার বউ এখানে রয়েছে। একে বাড়িতে রাখলে তার কী হবে? সে কোথায় যাবে?

সমরজিৎবাবু বললেন–সে সব আমি ভাবিনি ভাবছো? বউমা আমার সঙ্গে থাকে ভালো আর নয়ত খোকার সঙ্গে চলে যাক। আমি কাউকে এ বাড়িতে থাকতেও বলবো না কিম্বা চলে যেতেও বলবো না। কিন্তু আমার এই শেষ বয়সে আর এ-সব সহ্য হচ্ছে না। আমি অন্তত যাবার সময় দেখে যেতে চাই যে আমি বাড়িতে এমন একজনকে রেখে গেলাম যে মানুষের মত মানুষ। আমার পূর্বপুরুষের এই সমস্ত সম্পত্তি একজন অমানুষের হাতে পড়বে এটা ভাবলে আমি পরলোকে গিয়েও শান্তি পাবো না। এ ব্যাপারে তুমি আর কোনও আপত্তি কোর না–

গৃহিণী বললে–তুমি তো বললে, কিন্তু ওর তো বাপ-মা আছে, ভাই-বোন কেউ আছে–তারা যদি অমত করে?

–তাদের সঙ্গে যদি অত সম্পর্ক থাকবে তো কেউ এমন করে বাড়ী ছেড়ে চলে আসতে পারে?

গৃহিণী বললে–কী জন্যে চলে এসেছে তা কি তুমি জানো?

–সে সব আমি এবার জিজ্ঞেস করবো। তাই তো মহেশকে পাঠিয়েছি সেখানে। দেখি মহেশ এসে কী বলে।

তারপর জিজ্ঞেস করলেন–বউমা কোথায়?

–বউমা নিজের ঘরে শুতে গেছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

–তুমি বউমাকে যেন এ-সব কথা আবার বলো না। ভেবো না বউমাকে আমি কোনও রকমে বঞ্চিত করবো। আমি যখন তাঁকে এবাড়িতে বউ করে এনেছি তখন তার ভরণ পোষণের সব রকম ব্যবস্থা করে তবে সব করবো। খোকা থাকুক আর না থাকুক, বউমার কোনও কষ্ট হবে না–

সদানন্দ নিচের ঘরে শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। তার ধারণাও ছিল না যে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে তারই মাথার ওপরকার আর একটা ঘরে তখন দুজন মানুষ দুর্ভাবনার জাল পাততে বসেছে। হঠাৎ সদরে আওয়াজ হতেই কি যেন দরজা খুলে দিলে।

ভেতর থেকে ঠাকুর বললে–কে?

–আমি মহেশ। দরজা খোল ঠাকুর।

সারাদিন মহেশের দেখা পাওয়া যায়নি। এতক্ষণ কোথায় ছিল সে! সদানন্দ বিছানা ছেড়ে উঠলো। দরজার বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখলে মহেশ। একেবারে ধুলোমাখা চেহারা। সারাদিন রোদে-ধুলোতে ঘুরলে যেমন তামাটে চেহারা হয় মানুষের তেমনি হয়ে গেছে মহেশ।

–কোথায় ছিলে মহেশ? সারাদিন তোমায় দেখতে পাইনি!

মহেশ হাসলো। এক মুখ হাসি। বললে–আপনি এখনও ঘুমোননি? খাওয়া হয়েছে?

সদানন্দ বললে–আমার এত সকাল সকাল ঘুম আসে না। তুমি বুঝি ভোরবেলা বেরিয়েছিলে?

–হ্যাঁ, ভোরের ট্রেন না ধরলে যে বেলা পুইয়ে যায়, মাথায় কড়া রোদ লাগে।

–রাণাঘাটে গিয়েছিলে বুঝি?

–হ্যাঁ, বাবু পাঠিয়েছিলেন। সেই সাতসকালে গিয়েছি, আর এখন আসছি। যাই বাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি

বলে মহেশ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। সদানন্দ আবার নিজের ঘরের মধ্যে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম এলো না। রাণাঘাট! মহেশ রাণাঘাটে গিয়েছিল। রাণাঘাটের আর চারটে স্টেশনের পরেই রেলবাজার। রেলবাজারে নেমে পাঁচ মাইল হেঁটে পার হলেই তো নবাবগঞ্জ। নবাবগঞ্জের কথাটা মনে পড়তেই সদানন্দ যেন একেবারে সশরীরে সেখানে চলে গেছে। মনে হলো বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে। বিরাট সমারোহ চারিদিকে। কীসের উৎসব চলেছে যেন ভেতরে। সে যে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে তার জন্যে সেখানে যেন কোথাও তো কোনও দুঃখ নেই, অনুতাপ-অনুশোচনা কিছুই নেই। বেশ সুখে আছে সবাই। বারোয়ারিতলার সেই মঙ্গলচণ্ডীর মন্দিরের পাশে নিতাই হালদারের দোকানের মাচার ওপর বসে তখনও সবাই তাস খেলছে। এ কী হলো? এমন তো হবার কথা নয়। এত বড় আঘাত সে নিজের মাথায় তুলে নিলে, এত বড় আঘাত সে সকলকে দিতে চাইলে, অথচ কারোর মনে কোনও দাগ তো লাগলো না? সে তো সকলের ভালোর জন্যেই, সকলের মঙ্গলের জন্যেই এই আচরণ করেছিল।

হঠাৎ নজরে পড়লো নয়নতারা দাঁড়িয়ে আছে।

নয়নতারার পরনে একখানা বেনারসী শাড়ি। বিয়ের সময় যে-বেনারসীটা সে পরেছিল সেইটে। সিঁথির সামনে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর।

সদানন্দ নয়নতারার দৃষ্টি এড়িয়ে চলে আসছিল, কিন্তু নয়নতারা দেখতে পেয়ে গেছে। একেবারে সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো সে।

বললে–তুমি?

সদানন্দ কোনও জবাব দিলে না তার কথার।

–তুমি তো চলে গিয়েছিলে। আবার এলে যে?

সদানন্দ চারিদিকে চেয়ে বললে–এখন দেখছি না-এলেই হয়ত ভালো হতো!

–কেন?

–আমি চলে গেলুম বলে কোথাও কোনও ব্যতিক্রম নেই। কোনও দুঃখ, কোনও ফাঁক কিছুই নেই। তুমিও তো আর সেরকম নেই।

নয়নতারা বললে–কেন সেরকম থাকবো? তুমি কি ভেবেছিলে তুমি না থাকলে পৃথিবীর চলা বন্ধ হয়ে যাবে? আকাশে চন্দ্র-সূর্য উঠবে না? না আমিও আর সিঁথিতে সিঁদুর দেব না, আমিও বেনারসী শাড়ি আর পরবো না। তুমি ভেবেছিলেটা কী? ভেবেছিলে তুমি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সব ওলোট-পালট হয়ে যাবে!

সদানন্দ বললো–আমারই ভুল হয়েছিল।

নয়নতারা বললে–শুধু ভুল নয়, তোমার অন্যায়ও হয়েছিল। কিন্তু তোমার ভুলের জন্য আমি ভুগতে রাজি নই, তোমার অন্যায়ের ভাগ আমি নিতে রাজি নই, এটা জেনে রেখো। তুমি ভেবেছিলে সকলের তালে তাল না দিয়ে তুমি অক্ষয় কীর্তি রেখে যাবে। তা হবে না। পৃথিবী তোমাকে তা হতে দেবে না। আমিও তোমাকে তথাগত বুদ্ধদেব হতে দেব না, শ্রীচৈতন্যদেবও হতে দেব না। সেই জন্যেই আজ এত ঘটা করে বেনারসী পরেছি, এত জাঁক করে সিঁথিতে সিঁদুর পরেছি–এ বাড়িতেও তাই এত বেশি ঘটা করে আজ লক্ষ্মীপূজো হচ্ছে–দেখছো তো, তুমি থাকবার সময় যত ঘটা হতো তার চেয়েও বেশ ঘটা হচ্ছে তুমি চলে যাবার পর–

–দাদাবাবু, দাদাবাবু!

হঠাৎ ঘরের দরজায় ধাক্কার শব্দে সদানন্দর তন্দ্রা ভেঙে গেল। তবে কী স্বপ্ন দেখছিল সে এতক্ষণ! এইটুকুর মধ্যেই এতখানি স্বপ্ন দেখে ফেললে সে! আর যাদের চিরকালের মত সে ত্যাগ করে এসেছে, যাকে ত্যাগ করে সে চরম আঘাত দিয়েছে, যার জীবন নষ্ট করে দিয়ে সে নিরুদ্দেশের অনিশ্চয়তার মধ্যে নিজের পরিত্রাণ খুঁজেছে, তাদের স্বপ্নই কি দেখতে হয় এই সময়ে?

–দাদাবাবু, দাদাবাবু—

সদানন্দ বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার খিলটা খুলে দিতেই দেখলে মহেশ দাঁড়িয়ে আছে।

মহেশ সারাদিন রাণাঘাটে কাটিয়ে এসেছে। ট্রেনে গেছে এসেছে। মুখ-হাত-পা তখনও ধোওয়া হয়নি। সেই অবস্থাতেই ওপরে বাবুর সঙ্গে কথা বলেছে। তারপর সেখান থেকে আবার তাকে ডাকতে এসেছে।

বললে–আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি! আমি যে বাবুকে বললুম আপনি জেগে আছেন

–তোমার বাবুও কি এখনও জেগে আছেন?

–হ্যাঁ, বাবুর রাত্তিরে ভালো ঘুম হয় না। বাবুও জেগে আছেন, মাও জেগে আছেন। আপনি যদি পারেন তো একবার ওপরে যান–তিনি একবার ডাকছে আপনাকে–

সদানন্দ বললে–যাচ্ছি, এখুনি যাচ্ছি। কিন্তু কী এত জরুরী কাজ যে এখুনি ডাকছেন।

বলে গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে নিলে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো।

.

সেদিন সকাল থেকেই মনের ভেতরে বড় অস্থিরতা ভোগ করছিলেন সমরজিৎবাবু। মহেশকে পাঠিয়েছিলেন নবাবগঞ্জে। সারাদিনের পর যখন সন্ধ্যে হলো তখন একবার ঘড়ি দেখলেন। তারপর যখন রাত আটটা বাজলো তখন আর একবার ঘড়ি দেখলেন। তারপর রাত ন’টা বাজলো, দশটা বাজলো। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই শুয়ে পড়লো। গৃহিণী ঘরে আসতেই জিজ্ঞেস করলেন–মহেশ এখনও এল না কেন?

তা ভাবলেন হয়ত ট্রেন লেট আছে। তারপর যখন অনেক রাত্রে মহেশ এল তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

বললেন কী রে, কী হলো? নবাবগঞ্জে গিয়েছিলি?

মহেশ বললে–হ্যাঁ বাবু গিয়েছিলুম। নবাবগঞ্জ কি এখেনে? রেলবাজারে নেমে পাঁচ ক্রোশ রাস্তা, গিয়ে পৌঁছুতেই তো দু ঘন্টা গেল।

–তারপর গিয়ে কি দেখলি তাই বল্! দাদাবাবু যা বলেছে সব সত্যি? হরনারায়ণ চৌধুরী বলে কেউ আছে সেখানে? কত বড় বাড়ি দেখলি? জমিদার তারা?

মহেশ বললে–না বাবু, তারা ওখানে কেউ নেই।

–কেউ নেই মানে? সব মিথ্যে কথা বলেছে নাকি তবে?

মহেশ বললে–আজ্ঞে না বাবু, মিথ্যে কথা নয়। দাদাবাবু যা বলেছে সব সত্যি। সেই বাড়িও দেখে এলুম, বাড়িটাও আজ্ঞে খুব বড়। কিন্তু বাড়িতে কেউ লোক নেই–

–কেউ নেই? কেউ নেই মানে? বাব-মা সব কোথায় গেল? সদানন্দ তো বললে–ও বিয়ে করেছে, ওর বউও তো আছে সেখানে, তারা কোথায় গেল? কাউকে জিজ্ঞেস করলি না কেন?

মহেশ বললে–সোজা কথায় কি জিজ্ঞেস করা যায়? আমাকে নতুন লোক দেখেই তো সবাই ছেঁকে ধরলে। সবাই জিজ্ঞেস করে কোথায় বাড়ি তোমার, কে তোমাকে পাঠিয়েছে, এত খবর তোমার জানার দরকারটা কী, হ্যান-ত্যান অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো গাঁয়ের লোক। আমার নাম-ধাম জানতে চাইলে। মহামুশকিলে পড়েছিলুম। শেষকালে একটা মিছে কথা বলে পার পেয়ে গেলুম–

–কী মিছে কথা?

বললুম আমি ঘটক। পাত্তরের খোঁজে এসেছি। তা শুনে সবাই হেসে অস্থির। সবাই বললে–তার তো বিয়ে হয়ে গেছে মশাই। তার বউকে ছেড়ে সে ছেলেও কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।

সমরজিৎবাবু বললেন–আর অবস্থা কেমন ওদের?

মহেশ বললে–অবস্থা খুব ভালো। জমি-জমার নাকি শেষ নেই। লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি। কিন্তু খাবার লোক দ্বিতীয় কেউ নেই।

–তা বাবা-মা কোথায় গেছে কিছু শুনলি?

মহেশ বললে–শুনলুম ঠাকুর্দাদা মারা গেছে, মা-ও ক’মাস আগে নাকি মারা গেছে। বাপ ছিল কিন্তু তিনিও নাকি চলে গেছেন সুলতানপুরে–

–সুলতানপুর? সে কোথায়?

মহেশ বললে–ভাগলপুরে। ভাগলপুরের কাছে সুলতানপুরে নাকি দাদাবাবুর মামার বাড়ি। দাদামশাই-এর কোনও ছেলে নেই, তাই জামাই গেছে সেখানে দেখা-শোনা করতে। তাঁরও নাকি অসুখ। সবাই বললে–দাদামশাই-এর আর বাপের সমস্ত সম্পত্তির একমাত্তোর ওয়ারিশান নাকি একলা দাদাবাবু–

সমরজিৎবাবু সমস্ত শুনলেন। সদানন্দ যা যা বলেছিল তা সবই বর্ণে বর্ণে মিলে গেল। এতটুকু এদিক-ওদিক হলো না।

তারপর গৃহিণীর দিকে চাইলেন। বললেন–দেখলে তো, শুনলে তো সব? আমি বলেছিলুম তোমাকে যে সদানন্দ মিছে কথা বলবার ছেলে নয়।

তারপর মহেশের দিকে চেয়ে বললেন–হ্যাঁ রে, দাদাবাবু এখন কি জেগে আছে, না ঘুমিয়ে পড়েছে?

–আজ্ঞে দেখলুম তো জেগে আছেন।

সমরজিৎবাবু বললেন–তা হলে একবার আমার কাছে ডেকে দে তো। বলবি আমি একবার ডাকছি–

মহেশ চলে গেল।

মহেশ চলে গেলেই গৃহিণী বললে–এত রাত্তিরে আবার ডেকে পাঠাচ্ছ কেন ওকে?

সমরজিৎবাবু বললেন–আমি সব ঠিক করে ফেলেছি।

–কী ঠিক করেছ?

–আমি সদানন্দকে এখানেই রাখবো। অনেক দিন ধরেই ঠিক করেছিলুম। কিন্তু কাউকে বলিনি। যেদিন রাণাঘাট থেকে আসছিলুম সেই দিনই আমার অবাক লেগেছে।

কেউ তো অমন করে কারো জিনিষের জন্য ঝুঁকি নেয় না। আর জিনিসটা ও নিয়ে নিলেই বা আমি কী বলতুম! তা এবার আমি আর কোনও কথা শুনবো না–

গৃহিণী বললে–বামুনের ছেলে তোমার এখানে থাকতে রাজি হবে কেন?

ঠিক সেই সময়েই সদানন্দ এসে ঘরের সামনে দাঁড়ালো। বললে–আমাকে ডেকে ছিলেন কাকাবাবু?

সমরজিৎবাবু বিছানার ওপর বসেছিলেন। বললেন–এসো, এই চেয়ারটায় বসো—

সদানন্দ তখনও কিছু বুঝতে পারেনি। সে সোজা একটা চেয়ারের ওপর গিয়ে বসলো।

সমরজিৎবাবু বললেন–একটা কথা তোমাকে অনেক দিন ধরে বলবো বলবো করছি। কিন্তু বলা হয়নি। তুমি আমার কাছে অনেক দিন চাকরির কথা বলেছ। আমিও তোমাকে কথা দিয়েছিলুম তোমায় একটা চাকরি করে দেব। কিন্তু তুমি তো এ বাড়িতে অনেকদিন আছো বাবা, আর আমাদেরও দেখছে। আমার যা টাকাকড়ি দেশের জমিজমা আছে তাতে চাকরি আমার কোনও দিন করতে হয়নি। শুধু আমার নয়, আমার ছেলেরও চাকরি না করলেও চলতো। কিন্তু আমার অমতেই ও চাকরি নিয়েছে। চাকরি নিয়েছে বলে আমার তত দুঃখ নেই, দুঃখ আমার অন্য কারণে জানো?

বলে সমরজিৎবাবু একটু থামলেন।

সদানন্দ মনে হলো এতদিন যা ভয় করছিল সে সেই কথাগুলোই হয়ত বলবেন কাকাবাবু।

সমরজিৎবাবু তারপর একে একে তাঁর জীবনের চরম দুঃখের কাহিনীগুলো বলতে লাগলেন। সেই পূর্বপুরুষের আদি-পত্তন থেকে শুরু করে একেবারে বর্তমান কাল পর্যন্ত সমস্ত কাহিনী। তাঁদের বংশ-পরিচয় তাঁদের ঐতিহ্য, তাঁদের শিক্ষা-দীক্ষা-চিন্তা-ভাবনার কথাও বাদ দিলেন না। তারপর শুরু করলেন তাঁর নিঃসন্তান জীবনের মর্মান্তিক দিকটার কথা। কেমন করে দত্তক নিলেন খোকাকে। সেই খোকাকে কেমন করে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করলেন। আর তারপর সেই ছেলেই আবার কেমন করে অমানুষ হয়ে গেল তাঁরই চোখের সামনে। তারপর কেমন করে সেই ছেলেকে সৎপথে আনবার জন্যে তার বিয়ে দিলেন। সমস্ত বলে গেলেন গড়গড় করে মুখস্থ পড়ার মতন।

তারপর বললেন–এই দেখ, তোমার কাকীমা রয়েছে, তোমার কাকীমাকেই জিজ্ঞেস করো, আমি একটি কথাও বাড়িয়ে বলছি না, বা অতিরঞ্জিতও করছি না–

সদানন্দ চুপ করে সব শুনছিল। এ আবার কীরকম সংসার! এ আবার মানুষের কী রকম সমস্যা!

সমরজিৎবাবু হঠাৎ বললেন–তোমার নিজেরও বাবা আছেন, তিনি গুরুজন। তাঁদের মনে আমি কোনও আঘাত দিতে চাই না। কিন্তু তুমি তো নিজেই বলেছ যে তুমি আর সেখানে ফিরে যেতে চাও না। বলেছ তো?

সদানন্দ বললো, আমি আর সেখানে ফিরে যেতে চাই না

–কিন্তু তোমার স্ত্রী? তুমি তো বিয়ে করেছ!

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গেও আর কোনও সম্পর্ক রাখতে চাই না।

সমরজিৎবাবু জিজ্ঞেস করলেন–তোমার কি কোনও সন্তান হয়েছে?

সদানন্দ বললে–না, সন্তান যাতে না হয় সেই জন্যেই আমি স্ত্রীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছি—

উত্তরটা শুনে সমরজিৎবাবু কেমন অবাক হয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন–তার মানে? তুমি সন্তান চাও না?

–সদানন্দ বললে—না—

সমরজিৎবাবু আরো অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–সন্তানের জন্যেই তো মানুষ বিবাহ করে, আমাদের শাস্ত্রের তো তাই-ই বিধান। সন্তানই যদি না চাইবে তো তুমি বিবাহ করলে কেন?

সদানন্দ বললে–আমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি–আমি বিয়ে করতে চাইনি।

–বিবাহ করতে যদি না চেয়ে থাকো তো কেউ কি কাউকে বিবাহ করাতে বাধ্য করতে পারে? তোমার তো আর বাল্যবিবাহ হয়নি? তুমি তো উপযুক্ত বয়েসেই বিবাহ করেছ

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, আমি উপযুক্ত বয়েসেই বিয়ে করেছি, তখন আমার সব কিছু বোঝবার বয়েস হয়েছে

–তাহলে? এ তো বড় অদ্ভুত কথা শোনালে তুমি আমাকে সদানন্দ। তাহলে তোমার স্ত্রীর সঙ্গে কি তোমার কোনও মনোমালিন্য হয়েছে?

সদানন্দ বললে–না, তাও না–

–তোমার স্ত্রীর সঙ্গে তোমার মনোমালিন্য হয়নি তবু সন্তান চাও না? আর তোমার স্ত্রী? তোমার স্ত্রীও কি তোমার মত সন্তান কামনা করেন না?

সদানন্দ বললে–তিনি কী চান তা আমি জানি না–

–জানো না মানে?

সদানন্দ বললে–সে-সম্বন্ধে আমার স্ত্রী আমাকে কিছু বলেননি।

সমরজিৎবাবুর কেমন যেন সন্দেহ হলো। জিজ্ঞেস করলেন–তোমার স্ত্রীর স্বাস্থ্য কেমন?

সদানন্দ বললে–মনে হয় ভালো–

–মুখশ্রী?

সদানন্দ বললে–মুখশ্রী সুন্দর। আমার বাবা সুন্দরী দেখেই আমার জন্যে পাত্রী পছন্দ করেছিলেন।

তবু কিছু আন্দাজ করতে পারলেন না সমরজিৎবাবু। বললেন–তোমার স্ত্রীর সঙ্গে তোমার বাক্যালাপ হয়েছে তো?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ।

–কতদিন তোমরা বিবাহিত জীবন যাপন করেছ?

সদানন্দ বললে–একদিনও না—

 সমরজিৎবাবু স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বললেন–আশ্চর্য তো… কিন্তু তার কথা আর শেষ হলো না। কথাটা শেষ হবার আগেই সেই আগের দিনের মতই একটা হট্টগোল-গোলমাল শুরু হয়ে গেল। মহেশ দৌড়তে দৌড়তে এসে বললে–মা, বড়দাদাবাবু এসেছে–

কথাটা শুনেই সমরজিৎবাবু আর তাঁর গৃহিণীর মুখটা যেন কেমন বিস্বাদ হয়ে গেল। একটা যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টি দিয়ে সমরজিৎবাবু গৃহিণীর দিকে চাইলেন। বললেন–তুমি বউমাকে বলো দরজায় খিল দিয়ে দিতে, আমি নিচেয় যাচ্ছি–

বলে তিনি শশব্যস্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলেন।

সদানন্দ এর পর আর সেখানে দাঁড়ালো না। সোজা নিজের ঘরে চলে এসে দরজায় খিল দিয়ে দিলে।

.

ক’দিন ধরে সদানন্দর এই সব কথাগুলোই মনের মধ্যে তোলপাড় করে বেড়াচ্ছিল। কোথায় একটা বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার জন্যে সে এতদূর এসে আত্মগোপন করে আছে, আর এখানেই কি না তার জন্যে আর একটা বন্ধন প্রস্তুত! কদিন ধরে সর্বক্ষণ সে ছটফট করে ঘুরে বেড়িয়েছে। বাড়িতে থাকতে ভালো লাগেনি। একটু বিশ্রাম করেই আবার সে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। কখনও কখনও ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়েছে। সমরজিৎবাবু ভোররাত্রে গঙ্গাস্নান করতে বেরোন। সেই শব্দটা কানে যেতেই সেও বেয়োয়। বেরিয়ে চলতে চলতে অনেক দূর চলে যায়। দরকার হলে কখনও বাসে উঠে পড়ে, আবার কখনও বা উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটে।

এমনি সেদিনও হাঁটছিল। সেইদিনই সেই কাণ্ডটা ঘটলো। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে সে বাসে উঠে পড়েছিল আবার একসময়ে বাস থেকে নেমেও পড়েছিল সে খেয়াল ছিল না তার। তারপর গঙ্গার ধারে আসতেই এই ঘটনা।

ঘরটার মধ্যে একটা চেয়ারের ওপর সদানন্দ অনেকক্ষণ ধরে বসে ছিল। অনেকক্ষণ কারো কোনও সাড়া-শব্দ নেই। কোথায় যে কার বাড়িতে এসেছে সে তাও জানা ছিল না।

এমন সময় আবার সেই বুড়িটা এসে হাজির হলো। সঙ্গে আর একজন কে একটা লোক। খালি গায়ে খালি পায়ে। গলায় একটা ময়লা পৈতে ঝুলছে। দেখলে মনে হয় যেন পুরুত ঠাকুর। বুড়িটার হাতে একটা রেকাবি। তার ওপর বেলপাতা ধান দুর্বোঘাস, আর চন্দনের ছোট একটা বাটি। আর একপাশে একটা জ্বলন্ত প্রদীপ।

বুড়ি ঘরের ভেতরে এসেই বললে–তোমার খুব দেরি করিয়ে দিলুম বাবা, কিছু মনে করলে না তো?

সদানন্দ কিছু জবাব দিলে না সে-কথার।

বুড়িটা হাতের রেকাবিটা মেঝের ওপর রেখে বললে–এসো বাবা, আমার সঙ্গে এসো, মুখ-হাত-পা ধুয়ে নেবে এসো–

বলে আগে আগে চলতে লাগলো। সদানন্দও চলতে লাগলো তার পেছন-পেছন।

ভেতরে একটা কল-ঘরের ভেতরে ঢুকে সদানন্দ হাত-পা-মুখ ভাল করে ধুয়ে নিয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে এল। বললে–শিগগীর শিগগীর করুন, আমি বেশিক্ষণ দেরি করতে পারবো না

হঠাৎ পাশের জানলার দিকে নজর পড়তেই দেখলে এক জোড়া চোখ তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখছে।

বুড়ি মানুষটা বললে–ও মেয়ে, তুই বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে আয় না—

বলতেই একজন মেয়েমানুষ একেবারে ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়ালো।

সদানন্দ এদের কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেছে তখন। এ সব কারা? এ কোন্ বাড়িতে সে এসেছে? এ মহিলাটিই বা কে? তাকে ঘিরে এই উৎসব, এ তার ভালো লাগলো না।

পুরুত-ঠাকুর সদানন্দর দিকে চলে বললে–আপনি এখানে এই মেঝের ওপর একটু দাঁড়ান–

সদানন্দ চেয়ার থেকে উঠে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। ততক্ষণে ধূপ জ্বালা হয়ে গেছে। মানদা মাসি আয়োজনের কিছু ত্রুটি রাখেনি। অনেক দিন থেকে আশা ছিল এই টাকাটা পাবার। একশো টাকা আগাম হাতে পাওয়া গেছে। বাকি ন’শো টাকা পাওয়া যাবে তার এই ভাগ্নেকে খুঁজে দিতে পারলে। এতদিনে বুঝি সে-আশা তার মিটবে। তারপর ছেলেটিকে যেমন করে হোক বড়বাবু ফিরে আসা পর্যন্ত আটকে রাখলেই হলো। বড়বাবু এলে একেবারে সরাসরি তার হাতে তুলে দেবে। বাতাসীকেও সেই টাকার কিছু ভাগ দিতে হবে। অবশ্য তা দিতে মানদা মাসির আপত্তি নেই। বড়বাবু না হলে এ-সব কে সামলাবে!

বাতাসী পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। এবার পুরুত-ঠাকুর বুড়ির দিকে চেয়ে বললে–আপনি আসুন মা এখেনে। এই ঘটিতে জল নিয়ে ছেলের পায়ে ঢালুন–

পুরুত-ঠাকুর যা বললে–বুড়িও তাই করতে লাগলো। একবার জল ঢালে, আর একবার ফুল দেয় পায়ের পাতার ওপর। ফুল-বেলপাতা-গঙ্গাজল পায়ের পাতার ওপর পড়ে জায়গাটা বেশ নোংরা হয়ে গেল। সঙ্গে চলেছে সংস্কৃত শ্লোক। পুরুতটা শ্লোক বলে আর বুড়ি সেটা আওড়ায়। চরণ-পূজো যেন শেষ হতে চায় না।

শেষকালে একটা ছোট পাথরের বাটিতে গঙ্গাজল রাখা হলো। পুরুত-ঠাকুর সদানন্দকে তার বাঁ পায়ের বুড়ো-আঙুলটা সেই জলের ওপর ছোঁয়াতে বললে। সদানন্দও ঠিক তেমনিই করলে। তারপর সেই জলটা বুড়ি চুমুক দিয়ে মুখে ঢেলে দিলে।

সদানন্দ দেখে অবাক হয়ে গেল। তার পায়ের ধুলোসুদ্ধ জলটা বুড়ি নির্বিকার চিত্তে খেয়ে নিলে!

সদানন্দ বললে–এবার তাহলে আমি যাই?

বুড়ি বললে–ওমা কোথায় যাবে? তোমাকে মিষ্টি দেব, আমাকে পেসাদ করে দেবে না?

কিন্তু বুড়ির কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ নিচের সিঁড়িতে দুম দুম করে জুতোর আওয়াজ হতে লাগলো। আওয়াজটা ক্রমেই ওপরের দিকে উঠে আসছে।

বাতাসীর মুখটা তখন শুকিয়ে গেছে। বড়বাবু হঠাৎ আবার ফিরে আসছে নাকি?

বাতাসী বললে–ও মাসি, ওই বোধ হয় বড়বাবু এল?

মাসিও চমকে উঠেছে। বলল–সে কী রে? বড়বাবু? এখন? এই অসময়ে?

বাতাসী যা ভেবেছে তাই-ই। সিঁড়ি দিয়ে আওয়াজটা উঠতে উঠতে একেবারে সশরীরে ঘরের মধ্যে এসে পৌঁছুলো। বড়বাবু সারা রাত এই বাড়িতেই কাটিয়েছে। ভোরবেলার দিকে চলে গিয়েছিল। এখন আর তার আসবার কথা নয়। কিন্তু কী একটা কাজে আবার এসেছে। এসেই এ-সব কাণ্ড দেখে অবাক। সোজা সদানন্দর দিকে চেয়ে দেখলে। সদানন্দও বড়বাবুর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

বড়বাবু গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলে–এ কে?

বড়বাবু আসলে বাতাসীর দিকেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিল, কিন্তু যে-কেউ এর উত্তর দিলেই চলতো। কারণ বড়বাবুর প্রশ্ন করবার অধিকারও ছিল এ-ক্ষেত্রে। এ বাড়ির ভিতরে যদি এমন সব অবাঞ্ছিত লোকের আনাগোনাই হয় তাহলে কীসের জন্যে পকেটের পয়সা খরচ করে বাতাসীকে নিয়ে আলাদা বাড়ি ভাড়া করা! তাহলে সেই আগে যেমন মানদা মাসির টিনের বস্তিবাড়িতে ঘর ভাড়া করেছিল তেমনি সেখানেই তো বাতাসীকে রাখতে পারতো।

–বলো এ কে?

অথচ কয়েক ঘণ্টা আগে যখন বড়বাবু চলে গেছে তখন এখানে কেউই ছিল না।

মানদা মাসির হাতে গঙ্গাজলের খালি পাথরের বাটিটা তখনও ধরা রয়েছে। মানদা মাসি কল্পনা করতেও পারেনি যে এই অসময়ে বড়বাবু এসে হাজির হবে।

পাণ্ডা ঠাকুর বড়বাবুকে চেনে না, সদানন্দকে চেনে না, বাতাসী, মানদা মাসি কাউকেই সে চেনে না। দু’চার আনা পয়সার লোভে সে এই যজমানের বাড়ি এসেছিল। এইটেই তার পেশা। তখনও তার হাতে নৈবেদ্যের রেকাবি আর ঘণ্টা রয়েছে। কিন্তু ঘটনার এত আকস্মিকতায় সেও হতবাক হয়ে গিয়েছিল। এ লোকটাই বা কে? আর যার চরণপূজোর জন্যে তাকে ডেকে আনা হয়েছে সে-ই বা কে? এই নতুন বাবু আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাই এমন করে চমকেই বা উঠলো কেন?

মানদা মাসি কৈফিয়তের সুরে বলতে লাগলো–আজ্ঞে বড়বাবু, আমিই একে ডেকে এনেছি, আমারই দোষ হয়েছে, বাতাসীর কোনও দোষ নেই–

বড়বাবু পূজোর আয়োজনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে–এসব কী হচ্ছে? এ কীসের পূজো?

এর উত্তর কে কী দিত তা জানবার আগেই বাতাসী বড়বাবুকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। বললে–তুমি এদিকে এসো, তোমাকে বলছি সব–

বড়বাবু বললে–কেন ওঘরে যাবো? আমার বাড়িতে এ-সব কী হচ্ছে তা আমাকে জানতে হবে না? আমি কি কেউ নই? আমার বিনা হুকুমে কে কী করছে এ-সব তাও তোমরা বলবে না?

বাতাসী বললে–আঃ তুমি চেঁচাচ্ছ কেন অত? সব বলছি তোমাকে, তুমি ও-ঘরে চলো না?

বড়বাবু হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। বললে–কেন ওঘরে যাব? আমাকে এখানে এই ঘরে সকলের সামনেই বলতে হবে। এতো লুকোচুরির কী আছে?

–আছে, লুকোচুরির আছে। কেন আছে তা ও-ঘরে তোমাকে বলবো বলে বাতাসী জোর করে বড়বাবুকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল।

পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বাতাসী বললে–তুমি আবার হঠাৎ ফিরে এলে কেন?

বড়বাবু বললে–আমার অফিসের চাবিটা ফেলে গিয়েছি। তা আমার বাড়িতে আমি ফিরে আসবো তার জন্যে তোমাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে নাকি? ও কে? ও-সব পূজোটুজো করছে কেন তোমার মাসি?

বাতাসী বললে–ওকে তুমি চিনলে না?

বড়বাবু বললে–না, কেন? কে ও?

–ও সেই যার ছবি তোমাকে দিয়েছিলুম, বলেছিলুম ওকে খুঁজে বার করবার জন্যে। ওই লোকটাই সে। ও বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। নাকি খুব বড়লোকের ছেলে, ওর মামা এসে মাসিকে ধরেছিল। বলেছিল কিছু টাকা দেবে। তাই ওকে আজ রাস্তায় ধরেছে মাসি। ধরে আমার এখানে এনেছে তোমাকে দেখাবার জন্যে।

বড়বাবু বললে–তা আমি কী করবো?

বাতাসী বললে–তুমি পুলিসের লোক, ভয় দেখিয়েই ধরে রাখবে, নইলে আবার পালিয়ে যেতে পারে তো।

বড়বাবু তখন আলমারি থেকে ফেলে-যাওয়া চাবিটা নিয়েছে। বললে–এই সব ঝঞ্ঝাট আমার বাড়ির মধ্যে কেন? আমি এ-সব টলারেট করবো না এই তোমায় বলে রাখছি। তুমি ওদের চলে যেতে বলো–

বাতাসী বললে–ওরা তো আজ বাইরের ঘরে বসেছে–তাতে তোমার ক্ষতি কী হচ্ছে?

বড়বাবু বললে–আজ বাইরের ঘরে ঢুকেছে, কাল যদি আবার ভেতরের ঘরে ঢোকে? আজ আমি দেখে ফেললুম তাই, অন্য দিনও কেউ ঢোকে কিনা তা কে জানে! তুমি ওদের বেরিয়ে যেতে বলো–

বাতাসী বললে–ওমা, বেরিয়ে যেতে অমনি বলা যায়?

–তাহলে আমার বাড়িতে কোন্ সাহসে ওরা ঢোকে?

–তা মাসির সঙ্গে আমাদের এতদিনের জানা-শোনা, আমার বাড়িতে এলে তাড়িয়ে দেব?

বড়বাবু বললো, তাড়িয়ে দেবে, তুমি না তাড়িয়ে দিতে পারো, আমি এখুনি গিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিচ্ছি

বলে বড়বাবু গটগট করে সোজা বাইরের দিকে যাচ্ছিল, কিন্তু বাতাসী এসে রাস্তা আটকে দিলে। বললে–ওগো, না না, অমন কাজ কোর না, মাসির অনেকগুলো টাকা নষ্ট হবে—

বড়বাবু জ্বলে উঠলো–মাসির টাকা নষ্ট হবে তা আমার কী? মাসি আমার কে? মাসি কেন আমার বাড়ি আসে? তুমি তাকে বারণ করে দিতে পারো না? ওরা এখখুনি চলে যাক, ওরা চলে না গেলে আমি কিন্তু ওদের জুতো মেরে তাড়িয়ে দেব, এই তোমায় বলে রাখছি। ওদের তুমি চলে যেতে বলো গিয়ে–

বাতাসী বললে–সে না হয় আমি চলে যেতে বলছি, কিন্তু ওর কী হবে? ওই লোকটার?

–ও কে?

–ওরই নাম তো সদানন্দ চৌধুরী?

বড়বাবু কী যেন ভাবলে। বললে–দেখি, ও-ঘরে গিয়ে কী করতে পারি—

বলে বড়বাবু পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। বাতাসীও গেল সঙ্গে সঙ্গে।

তখনও সদানন্দ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বুড়িটার দিকে চেয়ে বলছে–আমি যাই তাহলে এবার, আপনার কাজ তো হয়ে গেছে–আমি এবার চলি

মানদা মাসি অত বিপদের মধ্যেও বড়বাবুর আসার সঙ্গে সঙ্গে একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। সে কিছু বলবার আগেই বড়বাবু ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঢুকেই সদানন্দর দিকে চেয়ে বললে–আপনি কে? কী নাম আপনার?

সদানন্দ তখন এই আকস্মিক প্রশ্নের জন্যে তৈরী ছিল না। তবু সহজে ঘাবড়ে যাবার মানুষ সে নয়। বললে–আমার নাম সদানন্দ চৌধুরী–

–আপনি বাড়ি থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন?

সদানন্দ জবাবে কী বলবে প্রথমে ভেবে উঠতে পারলে না। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললে–আমার খুশী পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। আমি যা করেছি, তা খুব বুঝেশুনেই করেছি। তার জন্যে কারো কাছে কৈফিয়ৎ দিতে আমি রাজি নই–

–তার মানে? আপনি জানেন কারো বাড়িতে ঢুকে পড়া একটা ক্রাইম? কার হুকুমে আপনি আমার বাড়িতে ঢুকেছেন? বলুন, এবাড়িতে আপনি কেন ঢুকেছে?

সদানন্দ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলে বড়বাবুর দিকে। বললে–আপনি জানেন না আমি কেন এবাড়িতে এসেছি?

বড়বাবু বললে–না, আমি শুনিনি, আপনি বলুন—

সদানন্দ বললে–যদি এখনও না শুনে থাকেন তো এই বৃদ্ধা মহিলাকে জিজ্ঞেস করুন।

–ওকে জিজ্ঞেস করতে যাবো কেন? ও কে? ও এ বাড়ির কেউ নয়। আপনাকে জিজ্ঞেস করছি আপনিই এর জবাব দিন।

মানদা মাসি কথার মাঝখানে বলে উঠলো–হ্যাঁ, বড়বাবু, আমিই ওকে এ বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছি। আমার কথাতেই ও এখানে এসেছে–

বড়বাবু ধমকে উঠলো–তুমি চুপ করো, তুমি কেন কথা বলছে? যাকে জিজ্ঞেস করেছি সে জবাব দেবে।

মানদা মাসি বাতাসীর দিকে হতাশ ভাবে চাইলে। বললে–ও বাতাসী, তুই বল্ না মেয়ে, বল না আমিই ওকে ডেকে এনেছি–

বাতাসী কী বলবে! বড়বাবুর মুখের সামনে কথা বলবার সাহস আছে নাকি তার। সেও তখন ভয়ে কাঁপছে। তারও তো দোষ। সে-ই তো বড়বাবুকে না বলে বাইরের লোককে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে।

বড়বাবু আবার চেঁচিয়ে উঠলোবলুন কেন এসেছেন এ বাড়িতে?

সদানন্দ আর থাকতে পারলে না। বললে–দেখুন, আপনি কে আমি জানি না। আমি এখানকার কাউকেই চিনি না। কিন্তু আপনি সব কিছু না জেনে কেন আমার নামে দোষ দিচ্ছেন?

বড়বাবু বললে–আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তাই বলছি। আপনি এখানে থাকেন কোথায়?

সদানন্দ বললে–আপনার অত কথা জিজ্ঞেস করার দরকার কী! আপনি যখন এতই রাগ করছেন আমাকে চলে যেতে দিন, আমি চলে যাচ্ছি–

বলে সদানন্দ বাইরের দিকে পা বাড়াচ্ছিল, কিন্তু বড়বাবু যেতে দিলে না। একেবারে বাইরে যাবার পথ আটকে দাঁড়ালো।

বললে–যাচ্ছেন কোথায়? আমার কথার জবাব দিন আগে–

সদানন্দ বললে–আপনি কি ভেবেছেন আপনার চোখরাঙানি দেখে আমি ভয় পাবো? আপনি ভদ্রভাবে কথা বলতে পারেন না?

–কী—

বড়বাবু সদানন্দর গলা টিপে ধরেছে। সদানন্দও বড়বাবুর গলায় হাত দিয়ে টিপে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা হাতাহাতি কাণ্ড হয়ে যেত হয়তো। কিন্তু তার আগেই একটা অঘটন ঘটলো। হঠাৎ সেই নাটকীয় ঘটনার মধ্যে আবির্ভাব হলো মহেশের।

–বড়দাদাবাবু।

মহেশ ঘরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে গেছে। এমন কাণ্ড হবে তা সে আশা করেনি। সে দৌড়তে দৌড়তে আসছিল। তখনও হাঁফাচ্ছে সে। এক ঘরের মধ্যে বড়দাদাবাবু আর দাদাবাবু দুজনকে দেখতে পাবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। মহেশকে দেখে বড়বাবুও অবাক, সদানন্দও অবাক।

বড়বাবু যেন মিইয়ে গেল মহেশকে দেখে। বললে–তুই?

মহেশ তখনও হাঁফাচ্ছে। কিন্তু এখানে আসবার আগে তার বিশ্বাসই হয়নি যে তার জন্যে এখানে এতখানি বিস্ময় জমা হয়ে আছে। আগেও ঘটনাচক্রে কয়েকবার এখানে আসতে হয়েছে তাকে। কখনও বাবুকে জানিয়ে আবার কখনও না-জানিয়ে। তবে বিশেষ বিপাকে না পড়লে সে কখনও আসেনি। কিন্তু এবার সদানন্দ চৌধুরীকে এখানে দেখে সে আরো অবাক হয়ে গেছে।

সদানন্দর তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। এই অপরিচয়ের জগতে এতক্ষণে একটা চেনা মুখ দেখে যেন সে বেঁচে গেল। বললে–মহেশ তুমি?

মহেশও বলে উঠলো–দাদাবাবু আপনি? আপনি এখানে কী করতে। আমার বাবুর অসুখ তাই আমি বড়দাদাবাবুকে খবর দিতে এসেছি।

এতক্ষণে সমস্ত আবহাওয়াটা কেমন যেন এই সামান্য কথাতেই একেবারে হাল্কা হয়ে উঠলো। সদানন্দর আজো মনে আছে সেদিন সেই মহেশের সেখানে আসার পর যেন নতুন করে সবাইকে চিনতে পারলে সে। এই হলো মহেশের বড়দাদাবাবু। আর ওই যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওই-ই তাহলে সেই মেয়েটা, যাকে মহেশ রাক্ষুসী বলে বর্ণনা করেছিল। কী বিচিত্র মানুষের নিয়তি আর কী বিচিত্র এই কলকাতা শহর!

জীবনে আরো অনেকবার সদানন্দ কলকাতায় এসেছে, কিন্তু এমন বিচিত্র ঘটনার মুখোমুখি কখনও হয়নি সে। আজও ভাবলে অবাক হতে হয় তার নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে।

কিন্তু তখন সেই মুহূর্তে সে-সব কথা অত ভাববার সময় ছিল না তার। বড়দাদাবাবুও যেন তখন সেই ঘটনার পর একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। এতগুলো লোকের সামনে বড়দাদাবাবু যে কী করবে তা বুঝতে পারছিল না।

বললে–বাবার অসুখ? কী অসুখ?

সদানন্দও জিজ্ঞেস করলে কখন অসুখ হলো? কাল রাত্তিরেও তো আমার সঙ্গে কাকাবাবুর কথা হয়েছে—

মহেশ বললে–ভোরবেলা তো বাবু চান করতে গেলেন, তারপরে ফিরে আসতেই বুকটা কেমন ব্যথা করতে লাগলো, তারপর শুয়ে পড়লেন–

বড়দাদাবাবু বললে–তা আমাকে খবর দিতে কে বলেছে তোকে?

মহেশ বললে–কেউ বলেনি। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম খুব। তাই ডাক্তারবাবুকে ডেকে দিয়েই এখানে ছুটে এলুম–

সদানন্দ বললে–চলো মহেশ আমি যাই,–

মহেশ বড়দাদাবাবুর দিকে চেয়ে বললে–আপনি যাবেন না বড়দাদাবাবু?

–আমি পরে যাবো, তুই যা—

বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে মহেশ বললে–আপনাকে যে আমি এখানে পাবো তা ভাবতে পারিনি, আপনি এখানে কেমন করে এলেন?

সদানন্দ সমস্ত ঘটনাটা বলে গেল মহেশকে। মহেশ শুনে অবাক। বললে–কী আশ্চর্য, আমি যদি না এসে পড়তুম তো কী হতো বলুন তো? দেখলেন তো ওই রাক্ষুসীটাকে? সাধ করে কি বাবু আমার অত রেগে গেছেন ছেলের ওপর? আর আপনিই বা কেন যার তার কথায় সেখানে-সেখানে যান বলুন তো! বাবু কতদিন আপনাকে বারণ করেছেন না!

.

ওদিকে সমরজিৎবাবু তখন বউবাজারের বাড়িতে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। একটু আগেই ডাক্তার তাঁকে দেখে বিদায় নিয়ে গেছে। সমস্ত বাড়িটাই তখন থম থম করছে। অন্য দিন একতলার পেছন দিকটা চাকর-ঠাকুর-ঝিদের কথাবার্তা ঝগড়া-ঝাঁটিতে মুখর হয়ে থাকে। কখনও বা ভেতর বাড়ি থেকে রান্নার শব্দও আসে। কিন্তু সেদিন সে-সব কিছুই নেই। দেখে বোঝা যায় কোথায় যেন একটা অঘটন ঘটে গেছে। সুখের সংসারের ভিতে কোথায় যেন একটা সর্বনাশের ফাটল ধরেছে।

মহেশ আগে আগে বাড়িতে ঢুকছিল, সদানন্দও ঢুকলো পেছন পেছন। মহেশ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই সদানন্দ বললে–তুমি ওপরে গিয়ে দেখে এসো মহেশ, আমি পরে যাবো–

মহেশ বললে–না, আপনিও আসুন না দাদাবাবু, আসতে কী হয়েছে?

কথাটা শুনে সদানন্দও ওপরে গেল। তারা ওপরে যেতেই কে যেন মাথায় ঘোমাটা দিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে অন্য ঘরে অদৃশ্য হয়ে গেল। কাকাবাবু তখন বিছানায় চোখ বুঁজে শুয়ে আছেন। তাঁর পাশে বসে আছে কাকীমা। কাকীমা মহেশকে দেখতে পেলে, সদানন্দকেও দেখলে। কিন্তু মুখে কিছু কথা বললে–না। সমরজিৎবাবু চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর দিকে চেয়ে সদানন্দর মনে হচ্ছিল তিনি যেন সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তির কোলে আশ্রয় পেয়েছেন।

কাকীমা মহেশকে ডেকে গলা নিচু করে কী যেন বললে। মহেশ এসে বললে–দাদাবাবু, মা একবার আপনাকে ডাকছে–

সদানন্দ যেতেই কাকীমা বললে–কোথায় বেরিয়েছিলে তুমি, উনি তোমায় খুঁজছিলেন–এখন ওষুধ খেয়ে একটু ঘুমোচ্ছেন–

মাথার ওপর পাখাটা বন বন করে ঘুরছিল। সমরজিৎবাবু মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে অনেক কথা মনে হচ্ছিল সদানন্দর। কোথাকার মানুষ সে, কোন্ চৌধুরী বংশের সন্তান, সেখান থেকে কোন অমোঘ নির্দেশে এ কোথায় এসে আর এক সম্পর্কের জালে জড়িয়ে গেল!

হঠাৎ সদর রাস্তায় একটা গাড়ির শব্দ হতেই মহেশ বললে–এই বড়দাদাবাবু এসেছে–

কাকীমা বুঝতে পারেনি প্রথমে। বললে–কে? খোকা? খোকা এ-সময়ে আসবে কেন? সে তো এ-সময়ে আসে না কখনও–

সদানন্দর কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। আবার সেই লোকটার সঙ্গে এখানে মুখোমুখি দেখা হয়ে যাবে। কথাটা ভাবতেই খারাপ লাগলো তার। বললে–কাকীমা, আমি এখন আসি তাহলে–

কাকীমা বললে–কেন বাবা, ওকে তুমি দেখনি, ও আমার ছেলে আসছে, তুমি থাকো না এখানে—

সদানন্দ বললেন, না আমি যাই–

বলে ঘর থেকে বেরোতে যেতেই আবার সেই বড়বাবুর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। সদানন্দকে দেখেই তার চোখ দুটো যেন কেমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো। তার কালীঘাটের বাড়িতেও যে-দৃষ্টি দিয়ে সদানন্দকে দেখেছে এখানে তার নিজের পৈতৃক বাড়িতেও সেই একই দৃষ্টি। যেন পারলে সদানন্দকে জেলে পুরে দিয়ে সে বাঁচে।

সদানন্দকে দেখিয়ে বললে–মা, এ কে?

কাকীমা বললে–ও? ও সদানন্দ!

বড়বাবু বললে–সদানন্দ তো বুঝলুম, কিন্তু ও আমাদের বাড়িতে কেন? কে আমাদের বাড়িতে ওকে ঢুকতে দিয়েছে?

কাকীমা বললে–-আঃ, তুই অত চেঁচাচ্ছিস কেন? দেখছিস কর্তার অসুখ–

–অসুখ বলে কি সব সহ্য করতে হবে? আমি তোমার কাছে জানতে চাই কেন তুমি যাকে তাকে এ বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছ? কে একে এ বাড়িতে আনলে?

–কাকীমা বললে–আমাকে কেন ও-সব কথা জিজ্ঞেস করছিস? আমি কি কোনও ব্যাপারে থাকি? যে বাড়ির মালিক তার অসুখ ভালো হলে তাকে জিজ্ঞেস করিসখ, এখন ও-মানুষ ঘুমোচ্ছেন, এখন চেঁচামেচি করছিস কেন?

বড়বাবু বললে–তা যতদিন কর্তার অসুখ থাকবে ততদিন ওকে এ বাড়িতে রাখবে নাকি তোমরা?

কাকীমা বললে–ওরে খোকা, তুই চুপ কর, একটু আস্তে কথা বলতে পারিস নে?

–আমি যা বলছি আগে সেই কথার জবাব দাও। এ কতদিন আমাদের এখানে আছে? কী করতে আছে? এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা কী? আমি তোমার কাছে সেই কথাটা আগে জানতে চাই–

কাকীমা বললে–ওরে তুই কেন এখন আসতে গেলি? কে তোকে এখন আসতে বললে? আমি সকাল থেকে ওই মানুষকে নিয়ে পড়েছি, বিপদের ওপর বিপদ চলছে আমার, আর তার ওপর তুই এখন এলি জ্বালাতে? তোর এত বয়েস হলো, একটা আক্কেল-জ্ঞান বলে কিছু থাকতে নেই?

বড়বাবু বলে উঠলো–আমার আক্কেলের কথা আমি বুঝবো, কিন্তু তোমাদের আক্কেলটাই বা কী রকম? একটা চোর-ডাকাত কি না ঠিক নেই, তাকে তোমরা একেবারে অন্দরমহলে এনে ঢোকালে!

কাকীমা বলে উঠলো–তোর সঙ্গে আমি এখন কথা বলতে পারি নে, তুই যা, তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা এখন–

–কেন বেরিয়ে যাব? আমার নিজের বাড়ি থেকে কেন বেরিয়ে যাবো?

কাকীমা মহেশকে ডাকলে–ওরে মহেশ, তোর বড়দাদাবাবুকে বাইরে বার করে দিয়ে আয় না, আমি যে আর পারছি না-রে–

বড়বাবু বললে–দেখ, অনেকদিন তোমরা আমাকে বার করে দিয়েছ বাড়ি থেকে। কিন্তু ভেবো না আজকে আমি নেশা করেছি। আমি যা বলছি সব ভেবেচিন্তেই বলছি, আমি আজ আর বেরিয়ে যাবো না।

মহেশ তখন কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।

কাকীমা তাকে লক্ষ্য করে বললে–কী রে, কথা কানে যাচ্ছে না তোর?

মহেশের তবু সাহস হচ্ছিল না। সে যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনি দাঁড়িয়েই রইল।

বড়বাবু এবার সদানন্দের দিকে এগিয়ে এল। বললে–আপনি দাঁড়িয়ে কী দেখছেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান

সদানন্দ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। এতটুকু নড়লো না। যেন কারোর কোনও কথা তার কানে ঢোকেনি।

কাকীমা নিজেই এবার ছেলে আর সদানন্দর মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। বললে–কেন ওকে যেতে বলছিস তুই? কর্তা ওকে নিজে এখানে এনে তুলেছেন, চলে যেতে বললে–কর্তা নিজেই বলবেন—

বড়বাবু বললে–আমিও এ বাড়ির মালিক, আমারও ওকে চলে যেতে বলবার অধিকার আছে। আমিই ওকে চলে যেতে বলছি, ও যাক–

এতক্ষণে কর্তার বোধ হয় একটু তন্দ্রা ভাঙলো। চেঁচামেচিতে তিনি চাইলেন এদিকে। দুর্বল গলায় বললেন–কে? কী হয়েছে?

কাকীমা সঙ্গে সঙ্গে কাকাবাবুর কাছে গিয়ে বললেন তুমি কেমন আছো? বুকের ব্যথাটা আছে এখনও?

সে কথার উত্তর না দিয়ে সমরজিৎবাবু বললেন–ও কে এসেছে?

কাকীমা বললে–খোকা তোমার অসুখের খবর পেয়ে এসেছে–

–ও চেঁচাচ্ছে কেন?

বড়বাবু বললে–আমি বলছি এ আমাদের বাড়িতে আছে কেন? একে আপনি আমাদের বাড়িতে কেন থাকতে দিয়েছেন?

–কার কথা বলছিস তুই?

কাকীমা বললে–খোকা সদানন্দকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে–

–কেন?

সমরজিৎবাবু সামান্য কথা বলতে গিয়ে হাঁফাচ্ছিলেন। যেন মনে হলো তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।

বড়বাবু বললে–আপনি কেন যেখান থেকে যাকে-তাকে বাড়িতে এনে ঢুকিয়েছেন? যাকে চেনেন না তাকে কী বলে বাড়িতে তুলেছেন?

সমরজিৎবাবু সেই অসুস্থ শরীর নিয়েই ছেলের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর উঠে বসলেন। ক্লান্ত শরীরটা যেন তিনি আর বইতে পারছে না। বললেন–কী করে তুমি জানলে যে আমি ওকে চিনি না, জানি না? আমি না জেনে ওকে আমার বাড়িতে এনেছি, কে তোমাকে বললে?

কাকীমা কাছে গিয়ে বললে–ওগো তুমি উঠে বসলে কেন, শোও, শুয়ে পড়ো–

সমরজিৎবাবু কাকীমার কথায় কান না দিয়ে বললেন–বলো কে তোমাকে বললে।

বড়বাবু বললে–কেউ আমাকে বলেনি, আমি নিজে জানি। আমাদের পুলিস রিপোর্ট আছে–

–রেখে দাও তোমাদের পুলিস রিপোর্ট! আজ তোমাকে একটা কথা বলে রাখছি শুনে নাও, আজ থেকে তুমি আমার ছেলে নও–

কাকীমা বলে উঠলো–ওগো তুমি চুপ করো, তোমার শরীর খারাপ, শুয়ে পড়ো তুমি–

–না, আমি শোব না, এ ভেবেছে কী? ভেবেছে ও যা করবে আমি তাই সহ্য করবো? ও পুলিসের চাকরি করে বলে আমি ওকে ভয় পাবো? ও জানে না যে এ বাড়ির ছেলে নয় ও! আমি এ বাড়িতে ওকে ঠাঁই না দিলে ও এই লেখাপড়া শিখতো, না খেতে পেত? ওকে মানুষ করেছে কে? ওর বাবা না আমি? কে ওকে ছোটবেলা থেকে খাইয়ে-পরিয়ে বড় করেছে? ও আজ এত বড় লায়েক হয়েছে যে আমারই খেয়ে-পরে আবার আমার ওপরেই চোটপাট করে? এত বড় নির্লজ্জ যে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আমার বাড়িয়ে ঢোকে। বাড়িতে বউমা থাকতে বাইরে রাত কাটায়?

বড়বাবুও গলা চড়ালো। বললে–যা করি বেশ করি, যা করি আমি আমার নিজের উপায় করা পয়সায় করি। আপনার কাছ থেকে তো আমি একটা পয়সাও নিই না–

–ঠিক আছে, আমার-পয়সার ওপরে যদি তোমার এতই অশ্রদ্ধা তবে এবার থেকে আমার টাকা-পয়সা আর একটাও পাবে না তুমি। আমার সব টাকা-পয়সা জমি-জমা সব আমি ওই সদানন্দকেই দিয়ে যাবো–আমি সদানন্দকেই এবার উইল করে সব দিয়ে যাবো।

বড়বাবু বললে–আপনার টাকা-পয়সা আমি চাইও না। কিন্তু যাকে আপনার টাকা-পয়সা দিয়ে যাবেন বলছেন জানেন সে একটা স্কাউন্ড্রেল? আজকে তাকে কোন্ পাড়ায় আমি দেখেছি তা জানেন?

সমরজিৎবাবু বললেন–সে যাই হোক, তোমার চেয়ে সদানন্দ ভালো তার প্রমাণ আমার আছে–সে প্রমাণ নিয়ে তবে আমি কথা বলছি–

বড়বাবু বললে–আমার কাছেও প্রমাণ আছে–

সদানন্দ এবার আর পারলে না। সে সমরজিৎবাবুর কাছে গিয়ে বললে–কাকাবাবু আপনি চুপ করুন, আপনার শরীর খারাপ, আমি আর এ সমস্তর মধ্যে থাকতে চাই না। আমাকে আপনি মুক্তি দিন, আমি চলে যাই–আপনাদের সংসারে আমি কেন মিছিমিছি অশান্তির সৃষ্টি করি মাঝখান থেকে–

সমরজিৎবাবু বললেন–কেন তুমি চলে যাবে? তুমি কি ওকে ভয় পাচ্ছ নাকি? ও পুলিসের চাকরি করে বলে ভেবেছে ওর যা ইচ্ছে তাই করবে?

সদানন্দ বললে–না, সেজন্যে নয়, আমার টাকা-পয়সা-জমি-জমার কিছুতেই দরকার নেই–ওসব আমি অনেক দেখেছি–

সমরজিৎবাবু বললেন–তোমাকে কিছু বলতে হবে না, আমি তোমার সম্বন্ধে সব খবর পেয়ে গেছি, মহেশকে নবাবগঞ্জে পাঠিয়ে আমি সমস্ত খবর এনেছি। আমি তোমাকে আমার বাড়িতে রাখবো। তোমার টাকার অভাব নেই তাও আমি জানি। কিন্তু আমার অভাব আছে তোমার মত ছেলের–

বড়বাবু বললে–কিন্তু যদি প্রমাণ করতে পারি ও একটা ইমপসটার, একটা স্কাউন্ড্রেল–

সমরজিৎবাবু বললেন–স্কাউন্ড্রেল ও নয়, তুমি! আমি অনেক পাপ করেছিলুম তাই তোমার মত স্কাউন্ড্রেলকে আমি নিজের ছেলের মতন মানুষ করতে চেয়েছিলুম–

কাকীমার আবার ভয় হয়ে গেল। কাছে গিয়ে বললে–ওগো তুমি চুপ করো, চুপ করে শুয়ে পড়ো–তোমার শরীর খারাপ–

সমরজিৎবাবু বললেন–আমায় তুমি চুপ করতে বোল না, আমার যদি আজ শক্তি থাকতো তো আমি অমন ছেলের গলা টিপে মেরে ফেলতুম, তবে চুপ করতুম–সদানন্দকে বলে কিনা স্কাউন্ড্রেল, বলে কিনা সদানন্দের পুলিস-রিপোর্ট আছে–

–হ্যাঁ আছে, আমি আপনাকে প্রমাণ দেখাচ্ছি এক্ষুনি–প্রমাণ আমার ব্যাগের মধ্যেই আছে–

বলে বড়বাবু হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে তার পাশের ঘরে চলে গেল। আর তার খানিকক্ষণ পরেই একটা ছবি নিয়ে ফিরে এল। বললে–এই দেখুন, এটা ফোটোগ্রাফ কিনা। আপনারা দেখুন, মিলিয়ে দেখে নিন–

কাকীমা দেখলে, সমরজিৎবাবুও দেখলেন–হ্যাঁ, সদানন্দেরই ফোটোগ্রাফ সেটা। কোনও সন্দেহ নেই।

বড়বাবু বললে–এতক্ষণ আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না, এখন বিশ্বাস হলো তো?

সবাই তখন বিস্ময় বিমূঢ়।

বড়বাবু আবার জিজ্ঞেস করলে–বলো, বলো কার ছবি এটা?

কারোর মুখেই কোনও কথা নেই। সকলের মনের এতদিনকার বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি যেন একটা প্রচণ্ড নাড়া খেয়ে একেবারে অসাড় হয়ে গেছে।

–বলো তোমরা, চুপ করে রইলে কেন, বলো?

কাকীমা আর থাকতে পারলে না। খোকাকে জিজ্ঞেস করলে–তা ওর ছবি তোর কাছে এলো কী করে?

বড়বাবু বললে–যার ছবি তাকেই জিজ্ঞেস করো না! সে তো তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে!

সদানন্দ আর দাঁড়ালা না সেখানে। সকলের বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে থেকে নিজেকে আড়াল করবার জন্যে সে ঘরের বাইরে চলে এলো। তারপর সোজা সিঁড়ি দিয়ে একেবারে তার নিজের ঘরে। আর তারপর ঘরের ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজায় খিল তুলে দিলে।

.

কিন্তু সেইভাবে কতক্ষণ কেটেছিল কে জানে, হঠাৎ বাইরে থেকে মহেশ দরজায় ধাক্কা দিতে লাগেলো–দাদাবাবু, দরজা খুলুন, দাদাবাবু–

সেদিন সেই কতকাল আগে বৌবাজারের একটা বাড়ির একখানা দরজা বন্ধ ঘরের ভেতরে সদানন্দর মনে যে-প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা আজও মনে আছে। তারপরে এতদিন কেটে গেছে, এত বিপর্যয় আর এত বিশৃঙ্খলার মধ্যেও তার স্মৃতি এতটুকু ম্লান হয়নি।

মনে আছে সারাদিন সে সেই ঘরের মধ্যেই কাটিয়ে দেবে ঠিক করেছিল। তার মনে হয়েছিল কী হবে তার সেখানে থেকে। ভাগ্যের কোন্ এক অমোঘ তাড়নায় যখন সে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে তখন সারা পৃথিবীটাই তো তার ঘর। তবে আর কেন সে ঘরের মায়া করছে। এই চারটে দেয়াল ঘেরা আশ্রয়ে এসে সে কি আর একটা বন্ধনের মধ্যে আটকে থাকবে?

মাঝখানে কতবার মহেশ দরজায় ধাক্কা দিয়েছে–দাদাবাবু দরজা খুলুন–দরজা খুলুন–

কিন্তু যে স্থির-প্রতিজ্ঞ মানুষ একদিন সহস্র মায়ার আকর্ষণকে উপেক্ষা করে আসতে পেরেছে, সে কি আর এই সামান্য সমরজিৎবাবুর ক’টা টাকার আকর্ষণে ভুলবে। একদিন কর্তাবাবুর কথায় ভুলেছে সে, একদিন কর্তাবাবুর কথায় নয়নতারার মত একটা নির্দোষ মেয়ের জীবন সে নষ্ট করে দিয়েছে। নয়নতারা তার স্বামীকে হারিয়েছে, নয়নতারার মা হবার সম্ভাবনাও সে নষ্ট করে দিয়েছে, এর পরও যদি এখানে এই সমরজিৎবাবুর আশ্রয়কেই সে আঁকড়ে ধরে থাকে তাহলে তার বিধাতাপুরুষের কাছে সে কোন্ কৈফিয়ৎ দেবে? নিজের জীবনে তার কি আরাম করবার কোনও অধিকার আছে? তার শরীরের আর মনের সুখভোগ করবার সমস্ত মালিকানা স্বত্বই তো সে স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করে চলে এসেছে। এই ত্যাগ আর কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়েই তো তাকে সারাজীবন পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে। এর থেকে তো তার আর মুক্তি নেই। অন্যের জীবন নষ্ট করে দিয়ে নিজের আরাম-ভোগের মধ্যে যে নীচতা তা যেন তাকে কখনও স্পর্শ না করে। সেই নীচতা থেকে যেন সে পরিত্রাণ পায়।

আবার দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো মহেশ।

ডাকতে লাগলো–দাদাবাবু, দরজা খুলবেন না? দরজা না খুললে কিন্তু আমি দরজা ভেঙে ফেলবো–

কিন্তু এততেও সদানন্দ অচল-অটল-প্রতিজ্ঞ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে যেমন শুয়ে ছিল তেমনিই শুয়ে রইল।

শেষকালে সদানন্দ আর থাকতে পারলো না। কাকীমার গলার আওয়াজ এল বাইরে থেকে–হ্যাঁ বাবা সদানন্দ, তুমি না খেলে যে আমরাও কেউ খেতে পারছি না, আমরাও তোমার মত সারাদিন উপোস করে থাকবো বলতে চাও?

সদানন্দ তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলে। খুলতেই দেখলে মহেশ দাঁড়িয়ে আছে। পাশে কাকীমা।

কাকীমা বললে–কী বাবা, তুমি কি চাও আমরাও তোমার মত সারা দিন উপোস করি?

সদানন্দ অপরাধীর মত চুপ করে রইল।

কাকীমা আবার বললে–তোমার কাকাবাবু রোগী মানুষ, জানো তুমি খাওনি শুনে তিনিও জলস্পর্শ করেননি। বউমাও এতক্ষণ খায়নি, আমি এখুনি তাকে খাইয়ে দিলুম। কত বেলা হলো তা জানোনা। বিকেল তিনটে বেজে গেছে যে ঘড়িতে–

সদানন্দ বললে–কিন্তু আপনি আর কাকাবাবু আপনারা খেয়ে নিলেন না কেন?

কাকামী বললে–তুমি তো বেশ কথা বললে–বাবা, তুমি বাড়ির ছেলে হয়ে না-খেয়ে রইলে আর আমরা বুড়োবুড়ি খেয়ে নেব? তা কখনও কেউ পারে?

সদানন্দ বললে–কিন্তু কাকাবাবু তো রোগী মানুষ, তাঁকে যা খাওয়ার খেতে দিলেন না কেন?

কাকীমা বললে–আমি তো অনেক বলেছি, এখন তুমি বলে কয়ে যদি তাঁকে খাওয়াতে পারো তো দেখ, আমার কথা তিনি শুনবেন না–

সদানন্দ আর কী করবে। বললে–চলুন দেখি, আমি বুঝিয়ে বলছি–

বলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে কাকাবাবুর ঘরে গেল। সমরজিৎবাবু তখন ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। সকাল থেকে অনেক উত্তেজনা গেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক করেছেন ছেলের সঙ্গে। জীবনে তিনি কখনও কষ্ট পাননি। অনায়াস-লব্ধ অর্থ তাঁকে কেবল আরামই দিয়েছে, কিন্তু সে-অর্থের অসদ্ব্যয় করবার দুর্মতি তাঁর কখনও হয়নি। তিনি জানতেন তার অনুপার্জিত অর্থের ওপর তাঁর নিজস্ব কোনও অধিকার নেই। তাই নিজের ভরণ-পোষণের জন্যে যেটুকু দরকার সেটুকু রেখে বাকিটুকু তিনি দান-ধ্যান ব্যয় করেছেন। তারপরে আছে পরলোকের চিত্তা। পূর্বপুরুষের স্মৃতিটুকুই ছিল তাঁর একমাত্র পুঁজি। ওই পুঁজিটুকু তিনি কার কাছে গচ্ছিত রেখে যাবেন এই চিন্তাই মাঝে-মাঝে তাঁকে পীড়িত করত। যাকে তিনি দত্তক নিয়েছিলেন তার ওপরেই তার ভরসা ছিল। কিন্তু দিনে দিনে যখন তাঁর ছেলের উদ্ধৃঙ্খলতা তাঁকে উৎপীড়নের শেষ সীমায় নিয়ে গিয়ে পৌঁছিয়েছিল ঠিক তখনই এই সদানন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তারপর যত দিন যেতে লাগলো ততই তিনি সদানন্দের দিকে আকৃষ্ট হতে লাগলেন। স্থির করলেন এই সদানন্দের হাতেই তিনি পূর্বপুরুষের সমস্ত স্মৃতির পুঁজি গচ্ছিত রেখে দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলবেন।

কিন্তু সদানন্দ নিজেই সে-সাধে বাধ সাধলো সেদিন।

কেন যে সদানন্দ সমস্ত কিছু অস্বীকার করলে তার কিছু যুক্তিসঙ্গত কারণ তিনি খুঁজে পেলেন না। তবে কি সদানন্দ এ-সব কিছুই পছন্দ করছে না? তাহলে তিনি কী করবেন? কার হাতে সব কিছু তুলে দিয়ে তিনি নিজের শেষ-জীবনের পরিত্রাণ খুঁজবেন?

–ওগো, এই তোমার সদানন্দ এসেছে।

সমরজিৎবাবু চোখ খুললেন। খুলে সামনেই সদানন্দকে দেখে তাঁর ঠোঁটের ফাঁকে একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠলো।

সদানন্দ বললে–কাকাবাবু, আপনি কিছু খাচ্ছেন না কেন?

সমরজিৎবাবু বললেন–তুমি না খেলে কি আমি খেতে পারি? আমিও ঠিক করেছি খাবো না কিছু–

–কিন্তু কেন? কেন আপনি খাবেন না? আমার না খাওয়ার কারণ তো আপনি জানেন! চোখের সামনে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগগুলোর প্রতিবাদ করতেও আমার ঘেন্না হলো। অথচ সেই কথাগুলোই দেখলুম আপনারা নির্বিবাদে বিশ্বাস করে গেলেন–

সমরজিৎবাবু বললেন–তা বলে কোনও অবস্থাতেই কি অত রাগ করতে আছে সদানন্দ। আমি তোমাকে সুস্থ মানুষ বলেই জানতুম। তোমার কাছে আমি এরকম ব্যবহার আশা করিনি। তুমি কি জানো না যে বিশ্বাস করার মধ্যেই মনের উদারতা প্রকাশ পায়?

সদানন্দ বললে–তা বলে কারো মুখের কথায় কালোটাকে সাদা বলে বিশ্বাস করতে হবে?

সমরজিৎবাবু বললেন–তুমি এতদিনেও আমার ছেলেকে চিনলে না? তা যদি না চিনে থাকো তো তুমি আমাকেও চেনোনি। আমাকে যদি ভালো করে চিনতে তাহলে আর এমন করে আমার ওপর রাগ করে নিজেও কষ্ট পেতে না, আমাকেও কষ্ট দিতে না–

কাকীমা হঠাৎ বলে উঠলো–কিন্তু বাবা, তুমি করেছিলে কী যে তোমার ছবি খোকাদের অফিসে চলে গেল?

সদানন্দ বললে–আমার কাছে এর উত্তর চাইবেন না কাকীমা। যদি উত্তরের জন্যে বেশি পীড়াপীড়ি করেন তো আমাকে এবাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। এর চেয়ে ঘৃণ্য জিনিস আর কিছুই নেই–

–তা তোমার নামে কি কোনও পুলিস-কেস হয়েছিল কখনও?

সমরজিৎবাবু মাঝখানে বাধা দিয়ে উঠলেন। গৃহিণীর দিকে চেয়ে বললেন–তোমার ছেলেই ভালো আর সদানন্দ খারাপ এই-ই কি তোমার কথা?

সদানন্দ বলে উঠলো–আত্মসমর্থনে কোনও কথা বলাই আমার কাছে ঘেন্নার জিনিস। তার জন্যে আমি কারো কাছে কোনও কৈফিয়ৎ দিতে রাজি নই, এমন কি তার চেয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াও আমার পক্ষে সোজা–

কাকীমা বললে–না বাবা, তাহলে তোমাকে বলতে হবে না। বরং তুমি খেয়ে নাও, আমরাও দুটি মুখে দিই–

বলে ডাকলে–মহেশ, দাদাবাবুর খাওয়ার ব্যবস্থা করে দে–

সদানন্দ বললে–আমি খাবো, কথা দিচ্ছি আমি খাবো, কিন্তু কাকাবাবু অসুস্থ মানুষ, আগে কাকাবাবু খান–

কথাটা শুনে সমরজিৎবাবু হাসলেন। হাসি ঠিক নয় সেটা, যেন কান্নারই তা আর এক রূপ।

তিনি গৃহিণীর দিকে চাইলেন। বললেন–আমি জানতুম সদানন্দ আমার কথা রাখবে। তুমিই কেবল বলছিলে সদানন্দ আর থাকবে না এবাড়িতে, এবাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। কেমন, এখন আমার কথাটা বিশ্বাস হলো তো?

কাকীমা বললে–তা আমি কী করে জানবো বলো, মহেশ ওদের দেশের বাড়ি দেখে এসে যা বললে–তাতে মনে হয়েছিল ও কেন এখানে থাকতে যাবে। এ-বাড়ির চেয়ে হাজার গুণ বড় ওদের বাড়ি, এদের জমি-জমা-সম্পত্তির কি শেষ আছে? মহেশ তো সব শুনে এসেছে–

সমরজিৎবাবু বললেন–আমি তোমাকে আজ একটা অনুরোধ করবো বাবা, তোমাকে আজ কথা দিতে হবে। তোমার কাছ থেকে কথা পেলে তবে আমি আজ খাবো।

সদানন্দ বললে–বলুন কী কথা?

সমরজিৎবাবু বলতে লাগলেন–তুমি এতদিন আমার এবাড়ির সব কিছু জেনে গেছ নিশ্চয়ই, আর আমরা যে ব্রাহ্মণ নই তাও তো তুমি জানো।

সদানন্দ বললে–আমি জাত মানি না–

সমরজিৎবাবু বললেন–সেই সাহসেই আমি তোমাকে বলতে সাহস পাচ্ছি বাবা, আমার কেউ নেই, আমার এমন কেউ নেই যে যাকে রেখে যার হাতে সব কিছুর ভার ছেড়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যেতে পারি। তবু অন্তত বুঝবো এমন একজনের হাতে সব ভার দিয়ে গেলাম যে আমার পূর্বপুরুষের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবে–

বলে একটু দম নিলেন। তারপর বললেন–তুমি হয়ত বলবে আমার তো ছেলে রয়েইছে, তাহলে আর নতুন করে তোমাকে কেন অনুরোধ করছি। করছি এই জন্যে যে তার ওপর আমার আর ভরসা নেই–সে অমানুষ। সেই অমানুষের হাতে সব কিছু দিয়ে চলে গিয়ে আমি নরকে থেকেও শান্তি পাবো না–

সদানন্দ চুপ করে সব শুনছিল। কিছু উত্তর দিলে না।

সমরজিৎবাবু বললেন–তোমাকে আমি সেদিন এই কথাগুলোই বলতে গিয়েছিলাম, কিন্তু বাধা পড়েছিল। এখন আজ তুমি আমার সামনে বলো তুমি রাজি–

সদানন্দ বললে–আপনি কী বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না—

সমরজিৎবাবু গৃহিণীর দিকে চেয়ে বললেন–তুমি বলে দাও আমি কী বলতে চাই—

কাকীমা বললে–আমি আর কী বলবো, তুমিই বলো না–

সমরজিৎবাবু বললেন–ঠিক আছে, তাহলে আমিই বলি। আমি আমার ছেলেকে আমার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তোমাকে আমার সব কিছুর উত্তরাধিকারী করতে চাই–তুমি রাজি?

সদানন্দ কথাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। এমন প্রস্তাব যে সমরজিৎবাবু কোনও দিন করতে পারেন তা সে কল্পনাই করতে পারেনি।

তার মুখ দিয়ে খানিকক্ষণ কোনও কথা বেরোল না। তারপর অনেক কষ্টে বললে–কিন্তু এ কথা আমাকে বলবার আগে আপনি কি সব দিক বিবেচনা করে দেখেছেন?

–হ্যাঁ, আমি সব ভেবে দেখেছি। যেদিন থেকে তুমি এখানে এসেছ সেইদিন থেকেই আমি ভেবেছি। ভেবে ভেবে আমি এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছিয়েছি শেষ পর্যন্ত। আমি জানি তুমি ব্রাহ্মণ, আর আমি শুদ্র। তুমি বিবাহিত, তোমার অভিভাবকরা আছেন, তাও ভেবেছি। তারপর মহেশকে তোমাদের দেশে পাঠিয়ে অন্যান্য সব খবরও সংগ্রহ করেছি। তার পরেও আমি তোমাকে এই প্রস্তাব করছি–

সদানন্দ বললে–এ সম্বন্ধে আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন কাকাবাবু–আমি এখনই এ-সম্বন্ধে কোনও কথা দিতে পারছি না—

সমরজিৎবাবু বললেন– না, তোমাকে আর ভাবতে কোনও সময় দেব না। এখনই তোমায় মত দিতে হবে

সদানন্দ বললে–এখনই মত দিই কী করে বলুন, আপনার ছেলেকেও তো জিজ্ঞেস করতে হবে, তিনি রাজি আছে কি না–

–ছেলে? আমার ছেলে? যার কথা বলছো তুমি সে আমার ছেলে নয়, সে কুলাঙ্গার, তাকে আবার জিজ্ঞেস করবো কী? জানো তুমি সে মদ্যপ, লম্পট, সে চরিত্রহীন। অমন সোনার প্রতিমা দেখে তাকে বিয়ে দিয়েছি, তবু সে রাত্রে বাড়িতেও আসে না, অন্য আর একটা সংসার আছে তার। অমন ছেলেকে জিজ্ঞাসা করবো আমি? সে কী মানুষ যে তাকে আমি জিজ্ঞেস করবো? আমার বউমাকে তুমি দেখনি বাবা, বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমার বউমার মুখে কেউ কখনও হাসি দেখেনি, তা জানো? ছেলে শুধু আমাদের জীবনই নষ্ট করেনি, সে বউমার জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছে। আমার বউমার জন্যে আমার বড় কষ্ট হয়, মনে হয় তার কষ্টের জন্যে তো আমিই দায়ী। বউমা সারাদিন কারো সঙ্গে কথা বলে না, কেউ তার মুখও দেখতে পায় না। এ দুঃখ তো আমার জন্যেই, আমিই তো ওই বউকে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ঘরে এনেছি–

সদানন্দ বললে–কিন্তু তবু সব শোনার পর আপনার ছেলে যদি আপত্তি করেন?

–আপত্তি করলে করতে পারে। কিন্তু আমার জিনিস আমি যাকে খুশী দিয়ে যাবো তাতে কার কী আপত্তি আছে তা জানবার আমার দরকার নেই; জানতে চাইও না।

–কিন্তু তার সঙ্গে আমার এ বিরোধ বাধিয়ে দরকার কী? আমি তো এ-সব কিছুই চাই না, আমার এসব দরকারও নেই। অথচ এই নিয়ে হয়ত তিনি ঝগড়া বিবাদ-মামলা করবেন, তখন কী হবে? তারপর তিনি বিবাহিত, তাকে যদি আপনি ত্যাগ করেন তাহলে তো এবাড়িও তাঁকে ত্যাগ করতে হবে?

–নিশ্চয় ত্যাগ করতে হবে। তাকে আমি আর এবাড়িতে থাকতে দেব না—

সদানন্দ যেন মহা বিপদে পড়লো। এ কী বিপত্তি!

বললে–কিন্তু তাঁর স্ত্রী? তাঁর সহধর্মিণী?

সমরজিৎবাবু বললেন–তুমি কি ভেবেছ আমি সেকথা ভাবিনি? সে ব্যবস্থাও আমি করে রেখেছি। তার যাবজ্জীবন ভরণ-পোষণের জন্যে যা করা প্রয়োজন তার সমস্ত ব্যবস্থা আমি করে যাবো। তিনি ইচ্ছে করলে এ বাড়ির একটা অংশে থাকতে পারেন আর তাঁর যদি অভিরুচি হয় তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে চলে যেতেও পারেন–তার ভবিষ্যতের জন্যে আমার একটা দায়িত্ব আছে বলেই আমি এটা করেছি–

বলে গৃহিণীর দিকে চেয়ে বললেন–আমার সেই দলিলটা কোথায়?

কাকীমা বললে–তোমার বালিশের তলায় দেখ, ওখানেই রেখে দিয়েছ—

দলিলটা সমরজিৎবাবু নিজেই বালিশের তলা থেকে বার করে সামনে খুললেন। বললেন–এই দেখ, উকিলকে দিয়ে আমি সব কিছু পাকা করিয়ে রেখে দিয়েছি, তোমার নামটাও বসিয়ে দিয়েছি এখানে। তুমি রাজি হলে শুধু তোমার সইটা এখানে নিয়ে নেব, কালই উকিলবাবু এখানে আসবেন, তুমি রাজি তো?

সদানন্দ চুপ করে রইল।

–বলো রাজি কি না?

সদানন্দ বললে–আমাকে ক্ষমা করুন কাকাবাবু, আমি রাজি হতে পারলাম না– সমরজিৎবাবু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে খানিকক্ষণ সদানন্দর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন–তুমি রাজি নও?

–না।

‘না’ শব্দটা বড় নিষ্ঠুর শোনালো সমরজিৎবাবুর কাছে। তিনি ঠিক এতখানি হয়ত আশঙ্কা করেননি। কিম্বা তাঁর মনে হলো তিনি হয়ত ভুল শুনছেন।

বললেন–সত্যিই তুমি রাজি নও?

সদানন্দ বললে–আমি একজনের সংসার ভাঙতে রাজি নই।

–আমার মনের শান্তির জন্যেও রাজি হতে পারো না? না হয় আমি মারা যাবার পর তুমি এ-সম্পত্তি অন্য কাউকে দিয়ে দিও। তখন তো আমি দেখতে আসছি না। কিন্তু আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিনের জন্যেও তুমি রাজি হতে পারো না সদানন্দ?

সদানন্দ বললে—না–কিছুতেই না, আমাকে আপনি এ ব্যাপারে আর মিছিমিছি পীড়াপীড়ি করবেন না–

বলে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর আবার যেমন এসেছিল তেমন নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামতে লাগলো। আসবার সময় তার মনে হলো যেন পেছনে অনেক দীর্ঘশ্বাস অনেক অশ্রুপাতের বোঝা সে কাকাবাবু আর কাকীমার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে চলে এল। কিন্তু কাকে সে বোঝাবে যে এ তার ত্যাগ নয়, এ তার যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে সে এতদূরে এসে পৌঁছিয়েছে, এখানে এসেও কি সে সেই যন্ত্রণার শৃঙ্খল স্বেচ্ছায় নিজের গলায় তুলে নেবে! সদানন্দর মনে হলো তার পায়ের তলার মাটিটা যেন টলছে।

–শোন সদানন্দ; শোন, যেও না–

সমরজিৎবাবুর গলার আওয়াজ শুনে সে থমকে দাঁড়ালো। তারপর পায়ে-পায়ে আবার সে এসে ঘরে ঢুকলো। বললে–আমায় ডাকছিলেন?

–তুমি কী রকম ছেলে আমি বুঝতে পারছি না সদানন্দ! আমি তোমায় টাকা দিতে চাইছি আর তুমি নিচ্ছ না, এ তো বড় তাজ্জব ঘটনা? এমন তো হয় না। তুমি কি জানো আমার এ সম্পত্তির দাম?

সদানন্দ বললে–আমার জেনে কী লাভ?

সমরজিৎবাবু বললেন–কিন্তু একদিন তো তুমি আমার কাছে একটা চাকরিই চেয়ে ছিলে। তা তুমি চাকরি করবে?

–কী চাকরি?

–এই ধরো তুমি আমার কাছে কাছে থাকবে, আমার দেখাশোনা করবে, আমার সম্পত্তির হিসেবপত্র রাখবে। তার বদলে তুমি মাইনে নেবে, থাকবে, আর এখানে দুবেলা খাওয়া পাবে, রাজি?

সদানন্দ বললে–আগে হলে হয়ত রাজি হতুম কাকাবাবু, কিন্তু এত কাণ্ডর পর আর আমার রাজি হওয়া চলে না–

বলে আবার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু কাকীমা বললে–তাহলে বাবা তোমার কাকাবাবু তো আজ কিছুই খাবেন না। তুমিও যখন খেলে না–

সদানন্দ বললে–আমার আর এসব কথা নিয়ে আলোচনা করতে ভালোই লাগছে না কাকীমা। কেবল মনে হচ্ছে আপনারা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চাইছেন। আমি তাহলে কীসের জন্যে বাড়ি থেকে চলে এসেছি, কীসের অভাব ছিল আমার? আমি কি আমার নিজের বাড়িতে নিজের পরিচয়ে নিজের সংসার নিয়ে আরামে থাকতে পারতুম না?

কাকীমা বললে–তা তো সত্যিই, তুমি সে-সব ছেড়েই বা চলে এলে কেন? কীসের জন্যে?

সদানন্দ বললে–সে বললেও আপনি বুঝতে পারবেন না কাকীমা, মানুষ কত নীচ হতে পারে তা কি আপনি জানেন? আপনারা আপনাদের ছেলেকে দেখেছেন, ভাবছেন অত বড় নীচ মানুষ আর নেই, কিন্তু আমার ঠাকুর্দাকে তো দেখেননি, তাহলে বুঝতেন পশুরাও বোধ হয় তার চেয়ে ভালো। আমার ঠাকুর্দার তুলনায় আপনার ছেলে তো দেবতা। তাই আপনারা যখন তার নিন্দে করছিলেন আমি তখন মনে মনে হাসছিলুম। ভাবছিলুম আপনারা যদি আমার ঠাকুর্দাকে দেখতেন, আমার বাবাকে দেখতেন তাহলে কী বলতেন। আমার লজ্জা এই যে আমি সেই বংশের ছেলে।

বলে সদানন্দ দুই হাতে মুখ ঢাকলো।

কাকীমা বললে–কিন্তু বউমাকে যে ছেড়ে চলে এলে, তাকে কে দেখবে? তার কী করে চলবে? কী নিয়ে সে থাকবে?

–ছেড়ে চলে না এসে কী করি বলুন? তার সঙ্গে সংসার করলে আমি শুধু চৌধুরী বংশ বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কিছুই যে করতে পারতুম না।

–তা তুমি তো বাপের এক ছেলে?

–আপনারা কেউ বুঝবেন না কাকীমা, আমার যন্ত্রণার কথাটা কেউই কিছুতে বুঝবেন না। আমি কাকাবাবুর সঙ্গে যখন এখানে চলে এসেছিলুম তখন ভেবেছিলুম এখানে এসে অন্তত একটা চাকরি যোগাড় করে নিয়ে সকলের চোখের আড়ালে যে কটা দিন বাঁচি কাটিয়ে দেব, কিন্তু তাও আমার হলো না। আমি এখানে এসেও আবার আর একটা বাঁধনে জড়িয়ে পড়লাম, এখন আমি কী করি বলুন তো? আপনারা এমনভাবে আমাকে ভালবাসবেন এ তো আমি ভাবতে পরিনি। আপনারা কেন আমায় এত ভালবাসলেন? আপনারা কেন আমায় এত আপনার করে নিলেন? আপনারা কেন আমায় আপনাদের নিজের সর্বস্ব দিতে চাইছেন? কেন আমার এই ক্ষতি করছেন?

বলতে বলতে সদানন্দর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো। যেন জ্বালা করতে লাগলো সে দুটো।

সদানন্দ চোখ দুটো কাপড় দিয়ে মুছে নিয়ে আবার বলতে লাগলো–আমার অনেক দুর্ভাগ্য যে আমি নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশে জন্মেছি, নাহলে আর আমাকে এই এত দুর্ভাগ্য সইতে হতো না। এত পাপ চোখ দিয়ে দেখতে হতো না। তার বদলে যদি আপনাদের এই সংসারে জন্মাতুম তো পৃথিবীতে কার কী ক্ষতিটা হতো? আমি নিজের জন্মের অধিকারেই এই যা-কিছু সব ভোগদখল করতুম। কারো কিছু বলবারও থাকতো না তাহলে–বাড়ি ছেড়ে পালাবারও দরকার হতো না–

কাকীমা বললে–তাহলে তো আর কোনও কথাই ছিল না বাবা–তাহলে আর ভেবে ভেবে তোমার কাকাবাবুর এই রকম শরীর খারাপও হতো না। কিন্তু কপাল বাবা, আমাদেরই কপাল, নইলে তোমার মত ছেলে থাকলে কি আমাদের এত কষ্ট!

সমরজিৎবাবু উঠে বসে ছিলেন এতক্ষণ, এবার শুয়ে পড়লেন। কী রকম যেন ছটফট করতে লাগলেন।

কাকীমা কাছে গেল। বললে–কী হলো? তোমার কষ্ট হচ্ছে? বুকে হাত বুলিয়ে দেব?

মহেশ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, বাবুর কষ্ট দেখে সে এবার কাছে এগিয়ে এল।

সবাই সমরজিৎবাবুর সামনে গিয়ে মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল। কাকীমা বললে–কিছু খাবে? ওষুধ এনে দেব?

সমরজিৎবাবু মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ, না।

–কিছুতেই খাবে না!

সদানন্দ অসহায়ের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। কাকীমা সদানন্দর দিকে চেয়ে বললে–তুমি একটু বলো না বাবা, তুমি বললেই উনি ওষুধ খাবেন, ডাক্তার অত করে বলে গেছে, তবু উনি কিছু খাননি–ডাক্তার ছানা খেতে বলেছিলেন, তাও তৈরি করিয়েছি, সকাল থেকে বকাবকিতে সে-সব কিছুই মুখে দিলেন না।

সদানন্দ কাকাবাবুর সামনে গিয়ে বললে–কাকাবাবু, ওষুধটা খেয়ে নিন না—

সমরজিৎবাবু আবার মাথা নাড়লেন–না–

সদানন্দ আবার বললে–ডাক্তারবাবুকে কি আবার ডেকে আনা হবে কাকাবাবু? মহেশ যাবে ডাক্তারবাবুকে ডাকতে?

সমরজিৎবাবু তখনও সেই একইভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন–না–

কী যে হলো, সেই ভোরবেলা থেকে শুরু করে এই সংসারে যেন ঝড় বয়ে যেতে শুধু করেছিল। কিন্তু তার পরিণতি যে এমন হবে তা কে জানতো!

সদানন্দ কী যে করবে বুঝতে পারলে না। কাকীমার দিকে চেয়ে বললে–আপনি একটু বলুন কাকীমা, আপনার কথা হয়ত কাকাবাবু শুনবেন।

কাকীমা বললে–আমার কথা শুনবেন না, বরং তুমিই বলো। তোমাকে বড্ড ভালোবাসেন উনি, তোমার কথায় আপত্তি করতে পারবেন না–

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমি কী বলবো বলুন তো কাকীমা, আমি কি ওঁর কথা রেখেছি যে উনি আমার কথা রাখবেন?

কাকীমা বললে–তা তুমি বলো না যে ওঁর কথায় রাজি, তাহলে আর উনি কিছুতেই খেতে আপত্তি করবেন না–

–বলবো?

–হ্যাঁ, বলো না। মুখের কথা বলতে তোমার ক্ষতিটা কী? তারপর যা ভালো বিবেচনা হয় তাই-ই করবে। বলো বাবা বলো, বুড়ো মানুষ, তোমার মুখের কথা শুনলে তবু ওঁর প্রাণটা ঠাণ্ডা হবে–

সদানন্দ আর দেরি করলে না। সমরজিৎবাবুর মুখের ওপর মুখ নিয়ে গিয়ে বললে– কাকাবাবু, আপনি যা বললেন তাইতেই আমি রাজি–আপনি শান্ত হোন, ওষুধ খেয়ে নিন–

এতক্ষণে সমরজিৎবাবুর মুখটা যেন কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সদানন্দর দিকে চেয়ে কী যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু বলতে না পেরে স্থির দৃষ্টি দিয়ে শুধুই সদানন্দকে দেখতে লাগলেন।

সদানন্দ বললে–আমি রাজি কাকাবাবু, আমি রাজি–

এবার ঠোঁটটা শুধু একটু নড়ে উঠলো।

–কিছু বলবেন?

সমরজিৎবাবু কী বললেন কেউ বুঝতে পারলে না।

–ডাক্তারবাবুকে ডাকবো?

সমরজিৎবাবুর ঠোঁটটা একটু যেন ফাঁক হলো। অস্পষ্ট গলায় বললেন—উকিল–

এতক্ষণে সবাই বুঝতে পারলে। মহেশ উকিলবাবুকে ডাকতে গেল। তারপর যখন উকিলবাবু এল তখন আরো অনেক বেলা হয়ে গেছে। তখন অনেকটা সামলে নিয়েছেন তিনি। বালিশের তলা থেকে সেই দলিল বেরোল, উইল বেরোল। সমরজিৎবাবুর সই করাই ছিল। সেখানে উকিলবাবুও নিজে সই করলে। সদানন্দকেও একটা সই দিতে হলো। সমরজিৎবাবুর এবং তাঁর স্ত্রীর অবর্তমানে তার যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে শ্রীমান সদানন্দ চৌধুরী। নিবাস নবাবগঞ্জ, স্টেশন রেলবাজার, থানা। হাঁসখালি, জেলা নদীয়া। আর তাঁর পালিত পুত্র শ্রীমান সুশীল সামন্তকে সমস্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি..

সমস্ত ঘটনাটা যখন মিটলো তখন বৌবাজারে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। নবাবগঞ্জে অত সকাল সকাল সন্ধ্যে হয় না। সমরজিৎবাবুকে ওষুধ খাইয়ে সকলে খাওয়া দাওয়া সেরে রান্নাঘরের পাট উঠতে আরো অন্ধকার হয়ে গেল। সমরজিৎবাবু তখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন।

কাকীমা বললে–তুমি এবার শুতে যাও বাবা, আমি তো আছি, তোমার সারাদিন খাটুনি গেছে খুব–

নিজের ঘরে এসেই সদানন্দ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। আলোটা নিভিয়ে দেবার কথাও তার খেয়াল হলো না। এ সে কী করলে! নয়নতারার জীবনটা নষ্ট করে দিয়ে সে এখানে এই সমরজিৎবাবুর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে জীবন কাটাবে নাকি! এই নিচিন্ত আরামের মধ্যে এতদিনকার এত বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটবে! তাহলে নবাবগঞ্জ কী দোষ করলে!

কাল সকালে ওই দলিল যথারীতি রেজিষ্ট্রি হয়ে যাবে। আইনকানুন-স্ট্যাম্প-সই-সাবুদ সমেত পাকাপোক্ত দলিল। কারো এক্তিয়ার নেই দলিলের হেরফের করে। তারপর থেকে। এই বাড়ির অকাতর উত্তরাধিকার একমাত্র তার। সমরজিৎবাবুর একমাত্র ওয়ারিশান সদানন্দ চৌধুরী। ও শুধু সম্পত্তির হিসেব। আসল চুক্তিটা আরো কঠিন আরো কঠোর। সদানন্দকে সারা জীবন এই সম্পত্তির দায়ভাগ বয়ে বয়ে বেড়াতে হবে। সমরজিৎ সামন্তর পূর্ব-পুরুষের সমস্ত পাপের বোঝা তার ওপরেই বর্তালো। স্বেচ্ছায় এবং বহালতবিয়তে সে এক মুহূর্তে নিজের পরিচয় আমূল পরিবর্তন করে দিলে! এক কালির আঁচড়ে, এক কলমের খোয়ায়। এ কী বিচিত্র জীবনের গতি তার। তার সৃষ্টিকর্তার এ কী নির্দয় পরিহাস।

হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস সদানন্দর নজরে পড়লো। সদানন্দ দেখলে তার ঘরের দরজার তলা দিয়ে কে যেন নিঃশব্দে একটা ভাজ করা কাগজ ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বিছানা ছেড়ে উঠেছে। উঠেই কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে ভাঁজ খুলে পড়তে লাগলো। ওপরে নিচেয় কারো নাম নেই। তাতে মোটা মোটা মেয়েলী অক্ষরে লেখা রয়েছে–

“আপনি আমাদের সংসারে আসার পর থেকে আমার জীবনে বিপর্যয় শুরু হয়েছে। আমার অতীত তো ছিলই না, বর্তমানও ছিল না। একমাত্র ভবিষ্যটুকুই টিম-টিম করে প্রদীপের মত জ্বলছিল। আপনি আসার পর আজ তাও হঠাৎ নিভে গেল। আমার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব আজ নিঃশেষ হয়ে গেল। আপনি কেন এলেন? আমার মত হতভাগিনী নারীর এ সর্বনাশ করে আপনার কী লাভ হলো? আপনি কি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে পারেন না? আমার মত নিরপরাধ নারীর উপকারের জন্য আপনি কি এই সামান্য কাজটুকুও করতে পারেন না? যদি এই উপকারটুকু করতে পারেন তো আমি আপনার ওপর চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। ইতি

.

কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের শেষ জীবনটা যে নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাটবে তা আগেই তার জানা ছিল। গৃহিণী আগেই গিয়েছিলেন, থাকবার মধ্যে ছিল এক মেয়ে। কিন্তু কন্যা-সন্তান হবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ধরে নেয় যে সে পরের ঘরে যাবার জন্যেই জন্মেছে। সুতরাং তার ওপর আশা-ভরসা কেউ করে না। কিন্তু সেই মেয়ের মৃত্যু-সংবাদও যখন কানে এল তখন আর তাঁর বেঁচে থাকবার কোনও অর্থ রইল না। ভেবেছিলেন সকলকে রেখে সকলকে সুস্থ সমর্থ দেখে তিনি পৃথিবী থেকে চলে যেতে পারবেন। তা আর হলো না। আগে মাঝে মাঝে নবাবগঞ্জ থেকে তবু চিঠি আসতো। চিঠির মধ্যে যদি দেখতেন লেখা আছে প্রীতিলতা ভালো আছে, সদানন্দ ভালো আছে, জামাইও সুস্থ আছে তাহলেই তিনি নিশ্চিন্ত হতেন। তাঁর আর কিছু কামনা ছিল না। পৃথিবী ভেসে যাক, ডুকে যাক, তাতে তাঁর কিছু এসে যেত না। শুধু প্রীতিলতা, সদানন্দ আর জামাই ভালো থাকলেই হলো।

আর জমি-জমা? ও তো থাকবেই। জমি-জমা থাকলেই প্রজা-পাঠক থাকবে, আর প্রজাপাঠক থাকলেই তারা খাজনা দেবে। আর যতদিন তারা খাজনা দেবে ততদিন তিনিও খেতে-পরতে পাবেন। তাছাড়া মানুষ আর কী চায়? একটা তো পেট তাঁর, কত আর তিনি খাবেন? জামাইএরও এমন অবস্থা নয় যে তাঁর সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে চাইবে। বাকি রইল সদানন্দ। এই যা-কিছু তিনি রেখে গেলেন সবই শেষ পর্যন্ত তার।

এ-সব কথা তিনি অবসর সময়ে ভাবতেন আর ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়তেন। তখন প্রকাশের বউ এসে ডাকতো–পিসেমশাই, উঠুন, আপনার খাবার দেওয়া হয়েছে–

কীর্তিপদবাবু বলতেন–তুমি আমার খাবার ঢাকা দিয়ে চলে যাও, আমি পরে উঠে খাবো–

আসলে প্রকাশকেই দেখতে পারতেন না পিসেমশাই। তাঁর গৃহিণী কবে মারা গেছে তার ঠিক নেই কিন্তু টাকার লোভে গৃহিণীর সম্পর্কিত লোকেরা তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি। তারা তখনও পেছনে লেগে রয়েছে, আঠার মত আটকে আছে সারা জীবন।

শেষকালে প্রকাশের বউ একদিন রাত্রে আবার ডাকতে লাগলো–পিসেমশাই উঠুন, আপনার খাবার দেওয়া হয়েছে–

কিন্তু সেদিন আর কেউ সাড়া দিলে না। আরো আনেকবার ডাকাডাকি হলো তবু সাড়া দিলেন না কীর্তিপদবাবু। তখনই চারদিকে খবরটা ছড়িয়ে পড়লো যে সুলতানপুরের কীর্তিপদবাবু মারা গিয়েছেন।

ধ্বংস যখন শুরু হয় তখন বোধ হয় এমনি করেই শুরু হয়। একদিন কালীগঞ্জের হর্ষনাথ চক্রবর্তীর শেষ দেখেছে পৃথিবী, শেষ দেখেছে নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীর, আবার বৌবাজারের সমরজিৎবাবুর শেষ দেখবার জন্যেও পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে। আর এবার শেষ দেখলে ভাগলপুরের কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের। সে বড় নিঃশব্দ শেষ। আগে বাবার মৃত্যু হয়, তারপরে মৃত্যু হয় সন্তানের। এইটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু কীর্তিপদবাবুর বেলা সে-নিয়ম উল্টে গেল। আগে সন্তান, তার পরে বাবা। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসে পৃথিবীর সব নিয়মকানুন বুঝি পালটে গেল।

ছোটমশাই যখন সুলতানপুরে এসে পৌঁছোলেন তখন সব শেষ। নেহাৎ শেষ-কৃত্যটা না করলে নয় তাই করলেন। শ্রাদ্ধ-শান্তি সব কিছু চুকিয়ে আবার তার নবাবগঞ্জে ফিরে যাবার কথা। সেইভাবেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন মনে মনে। কিন্তু ফিরেই বা যাবেন কোথায়? সেই নবাবগঞ্জেও যা, এই সুলতানপুরেও তাই। সেখানেও সেই খাঁ-খাঁ বাড়িটার ভেতরে দম আটকে আসা নিঃসঙ্গতা, এখানেও তাই। শ্বশুরমশাই-এর বিরাট বাড়িটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন ছোটমশাই তাঁর দীর্ঘশ্বাসের নিঃশব্দ আর্তনাদ শুনতে পেলেন। খাতা-পত্ৰ-দলিল দস্তাবেজ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এত সম্পত্তি, এত ঐশ্বর্য, এত জমি-জমার মালিক ছিলেন তাঁর শ্বশুর, এতও বোধ হয় আগে কল্পনা করতে পারেননি তিনি। এ সব কিছুর মালিক তাহলে একলা তিনি।

একজন বৃদ্ধ লোক সেদিন খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনে এল।

–কে? কে তুমি?

–পেন্নাম হই ঠাকুর মশাই। আমি গরীব ব্রাহ্মণ এ-গ্রামের। অধীনের নাম শ্ৰীনিরাপদ চক্রবর্তী, আপনার প্রজা।

–কী চাই তোমার, বলো?

–মুখুজ্জে মশাই-এর কাছে আমার মাসোহারা বরাদ্দ ছিল তিন টাকা করে। তিনি প্রতি মাসে আমাকে টাকাটা দিতেন।

ছোটমশাই রেগে উঠলেন। বললেন–যিনি আপনাকে টাকা দিতেন তিনি তো আর এখন নেই। তিনি থাকলে নিশ্চয়ই আপনাকে মাসোয়ারা দিয়ে যেতেন, কিন্তু আমি এখন আর ওসব দিতে পারবো না।

নিরাপদ চক্রবর্তী বললে–তিনি ছিলেন আমাদের মা বাপ, তিনি নেই, এখন আপনিই আমাদের মা-বাপ, তাই আপনার কাছেই হাত পাতছি। দিলে গরীবের বড় উপকার হতো–

বিরক্ত হয়ে ছোটমশাই বাক্স থেকে একটা টাকা বার করে বৃদ্ধকে দিলেন। বললেন–যান, এর বেশি আর হবে না, এটা নিয়ে খুশী হয়ে চলে যান–

নিরাপদ চক্রবর্তী টাকাটা হাত পেতে নিয়ে আশীর্বাদ করতে করতে চলে গেল। ছোটমশাই ভাবলেন আপদের শান্তি হলো। কিন্তু বিপদ শুরু হলো পরের দিন থেকেই। পরের দিন সকাল থেকেই দলে দলে লোক আসতে লাগলো। একজন আসে তো পিছু পিছু আসে আর একজন। সকলেরই এক আর্জি। টাকা। মুখুজ্জেমশাই নাকি সবাইকেই জীবদ্দশায় সাহায্য করতেন। সেই সাহায্য তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যেন বন্ধ না হয়ে যায়। এই তাদের মিনতি।

সুলতানপুরের মানুষ যে এত ভিখিরি তা জানলে বোধ হয় ছোটমশাই আগে থেকেই সাবধান হয়ে যেতেন।

বললেন–আপনারা কি টাকার গাছ পেয়েছেন আমাকে? আমার শ্বশুরমশাই-এর কেউ ছিল না, তাই তিনি দিতে পারতেন, কিন্তু আমার তো তা নয়, আমার নবাবগঞ্জে সংসার রয়েছে–সেখানে খরচ করতে হয়–

একজন বললে–তাহলে নিরাপদ চক্রবর্তী মশাইকে কালকে দিলেন কেন?

হঠাৎ কোথা থেকে একজন ষণ্ডামার্কা লোক এসে হাজির হলো। হাজির হয়েই সকলকে তাড়া করলে–যান যান, আপনারা যান এখান থেকে, ঠাকুরমশাই এসেছেন এখানে, শোকে দুঃখে এখন কাতর হয়ে রয়েছেন, আর এই সময়ে কিনা তাঁকে বিরক্ত করা—যান–

বলতে গেলে সে-ই সকলকে তাড়িয়ে দিতে তবে ঠাণ্ডা হলো। একান্তে অত্যন্ত শুভাকাঙ্ক্ষীর মত কাছে এসে বললে–শুনুন ঠাকুরমশাই, এই সুলতানপুরের লোকগুলো বড় নচ্ছার পাজি, কাউকে একটা পয়সা দেবেন না, দেখেছে আপনি ভালো লোক, তাই একেবারে পেয়ে বসেছে। আপনি এখেনে নতুন লোক, কাউকে চেনেন না। আপনি যদি এমনি করে দান-খয়রাত শুরু করেন তো বিপদে-পড়বেন, আপনার জীবন একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলবে এরা। আমি যাকে যাকে দিতে বলবো কেবল তাকে তাকে দেবেন–

ছোটমশাই হঠাৎ অতি-আত্মীয়তার সাবধানবাণীতে অবাক হয়ে গেলেন। বললেন–আপনি কে? আপনাকে তো আমি চিনতে পারছিনে–

লোকটা বললে–চিনবেন চিনবেন, আপনার শ্বশুরমশাই আমার পরামর্শ ছাড়া এক-পা নড়তেন না। হঠাৎ দরকার হলে রাত-বিরেতেও আমাকে ডাকতেন। বলতেন–অশ্বিনী, একবার আমার কাছে এসো তো একটা পরামর্শ আছে। তা তিনি তো এখন স্বর্গে চলে গিয়েছেন, এবার থেকে আপনিও ডাকবেন। তা খাওয়া-দাওয়ার কী ব্যবস্থা হয়েছে আপনার?

ছোটমশাই বললেন–আমার শালার পরিবার আছে। তারাই দু’বেলা যা’হোক দুমুঠো ফুটিয়ে দিচ্ছে–

–তা সে-খাবার আপনার মুখে রুচছে তো?

–কেন, ওকথা বলছেন কেন?

–না–না, মানে প্রকাশকে তো অমি চিনি। সে তো বরাবর বাউণ্ডুলে মানুষ ছিল। জানি না, এখন কেমন আছে। সে তা বউ ছেলে মেয়ে এখানে রেখে চিরকাল আপনার ঘাড়ে বসে খেয়েছে। তা এখন কোথায় আছে সে?

ছোটমশাই বললেন–কলকাতায়

–তা সে কলকাতায় থাকুক আর যেখানেই থাকুক, আপনার ও-সব-যা-তা খাওয়ার দরকারটা কী! এই মুখুজ্জেমশাই যে অকালে মারা গেলেন, তা কেন মারা গেলেন তা জানেন? কারণ ভালো যত্ন-আত্তি তো হতো না। আমায় একবার আড়ালে ডেকে বলেছিলেন–অশ্বিনী, আমি-আর এ সব ছাইপাঁশ খেতে পারছিনে, এই রকম খাওয়া খেলে আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। তুমি আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচাও। আমি বললুম ঠিক আছে, এবার থেকে আপনার বউমা রান্না করে দেবে, আপনি তাই-ই খাবেন, কিন্তু হলে হবে কী, দুদিন যেতে না-যেতেই গাঁয়ে কথা উঠলো। লোকে বলাবলি করতে লাগলো, আমি নাকি সম্পত্তি লিখিয়ে নেবার জন্যেই মুখজ্জেমশাইকে তোয়াজ করছি। এ রকম ছ্যাঁচড়া জায়গা তো আর পৃথিবীতে নেই ঠাকুরমশাই, তা শেষ পর্যন্ত যা হবার তা হলো, মুখুজ্জেমশাইকে মেরে তবে সবাই ঠাণ্ডা হলো।

লোকটার নাম অশ্বিনী ভট্টাচার্য। পর পর কদিন সকালে-বিকেলে আসতে লাগলো। এসেই জিজ্ঞেস করতো-খাওয়া হয়েছে?

ছোটমশাই বলতেন—হ্যাঁ–

–পেট ভরেছে তো?

–হ্যাঁ হ্যাঁ পেট ভরেছে

অশ্বিনী ভট্টাচার্য বললে–দেখবেন, এখানে লজ্জা করলে ঠকবেন। এমনি সবাই আপনাকে খাওয়ানোর জন্যে খুব আগ্রহ দেখাবে, বুঝলেন। প্রথম প্রথম আপনাকে সবাই অমন খোসামোদ করতে চাইবে, কিন্তু আপনি যেন কারো খোসামোদে ভুলবেন না, খোসামোদে ভুললেই একেবারে সব্বোনাশ–

–কেন আমাকে খোসামোদ করবে কেন সবাই?

অশ্বিনী ভট্টাচার্য বললে–খোসামোদ করবে না? কী বলছেন? আমার মতন কী নিঃস্বার্থ মানুষ সবাই? এখানকার সব মানুষ যে আপনার টাকার গন্ধ পেয়েছে। আপনার নিজের টাকা তো আছেই, তার ওপর মুখুজ্জে মশাই-এর টাকা, সবই যে আপনি একলা পেয়েছেন সেটা জানতে তো কারোর বাকি নেই। আমি নিজে ঠাকুরমশাই এই টাকা জিনিসটাকে বড্ড ঘেন্না করি। এই যে আপনার কাছে আমি আসি, কেন এত ঘন ঘন আসি বলুন তো? কেন?

ছোটমশাই বুঝতে পারলেন না। বললেন–কেন?

–কেন আসি শুনবেন? আসি, কারণ আপনাকে ভালোমানুষ পেয়ে সবাই যাতে ঠকিয়ে নিতে না পারে তাই। সুলতানপুরের লোক তো কেউ ভাল নয় ঠাকুরমশাই। মুখুজ্জেমশাইকেও ঠিক এই রকম ঠকাতো, আমি ছিলুম বলে তাই তিনি বেঁচে গেছেন, নইলে ভাবছেন এ-সব কিছু থাকতো, সব দশভূতে লুঠে-পুটে চেটে খেয়ে নিত–

অশ্বিনী ভট্টাচার্যি রোজ সকাল বেলা এসেই জিজ্ঞেস করতো–কেমন আছেন ঠাকুর মশাই আজ?

সেদিন ছোটমশাই-এর শরীর ভালো ছিল না। বললেন–তেমন ভালো নয়–

অশ্বিনী ভট্টাচার্য চিন্তিত হয়ে উঠলো–কেন? ভালো নয় কেন? খাওয়া-দাওয়া ভালো হচ্ছে না নিশ্চয়ই! এই জোয়ান বয়েসে ভালো করে না খেলে শরীর ভালো থাকবে কেমন করে? দুধ খাচ্ছেন?

ছোটমশাই বললেন–দুধ? দুধ এখানে কে দেবে?

–কেন? দুধ এখেনে কে দেবে মানে? ছিঃ ছিঃ লজ্জার কথা, আপনি গাঁয়ের জমিদারও বটে, আবার জামাইও বটেন, আপনি দুধ খেতে পাবেন না? ক’টা গরু আপনি চান বলুন? আমি গরু যোগাড় করে দেব। গরুর অভাব সুলতানপুরে? টাকা ফেললে এখানে কী না পাওয়া যায়?

ছোটমশাই বললেন–না না, গরু-টরু আমার দরকার নেই, আমি তো আর সুলতান পুরে থাকতে আসিনি, নবাবগঞ্জেই আমার নিজের কত গরু রয়েছে–

–দাঁড়ান, কাল থেকে আপনার দুধের ব্যবস্থা করছি আমি—

বলেই উঠে চলে গেল। পরদিন সকালেই আবার এসে হাজির। সঙ্গে একটি মেয়ে। মেয়েটির হাতে একটি দুধের গেলাস।

ছোটমশাই চমকে উঠলেন। এ আবার কে?

–পেন্নাম কর, পেন্নাম কর। দুধের গেলাসটা রেখে আগে ঠাকুরমশাইকে পেন্নাম কর।

মোটা আটপৌরে একটা তাঁতের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দুধের গেলাস নিয়ে মেয়েটা একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। গেলাসটা তক্তপোশের ওপর রেখে ছোট মশাইকে গড় হয়ে প্রণাম করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ছোটমশাই দু’হাত বাড়িয়ে বাধা দিতে গেলেন। বললেন—থাক্‌।

অশ্বিনী ধমকে উঠলো-–কেন, থাকবে কেন ঠাকুরমশাই? কর পুঁটি, পেন্নাম কর। পেন্নাম করলে তোর সাত-জন্ম সার্থক হয়ে যাবে, এমন বামুনঠাকুর এ তল্লাটে আর পাবিনে–

বাপের কথায় পুঁটি ছোটমশাই-এর পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ছুঁয়ে প্রণাম করলে। ছোটমশাই ভালো করে দেখলেন মেয়েটাকে। বেশ আঁটসাঁট করে খোঁপা বাঁধা। দেহটাও তার খোঁপার মত বেশ আঁটসাঁট। গড়ন-পেটনও বেশ। সকাল বেলাই বেশ সেজেছে-গুঁজেছে। বললেন–এ কে তোমার অশ্বিনী?

–আজ্ঞে এ হলো পুঁটি। আমার মেয়ে। ওর ভালো নাম একটা আছে, সেটা ওর গর্ভধারিণী জানতো। হ্যাঁ রে, তোর ভালো নামটা কী রে?

মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে বললে–নলিনী!

–হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, নলিনী। আমরা পুঁটি বলেই ডাকি। নে, এইবার দুধের গেলাসটা এগিয়ে দে, নিন ঠাকুরমশাই, দুধটা খেয়ে নিন–পুঁটি রোজ ভোরে আপনাকে দুধ দিয়ে যাবে। দুধ না খেলে শরীর টিকবে কেন?

ছোটমশাই দুধের গেলাসটা নিয়ে বললেন–আবার দুধ কেন কষ্ট করে আনতে গেলে অশ্বিনী, দুধ খাইয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রেখে কার কী লাভ বলো দিকিনি? আর কার জন্যেই বা বেঁচে থাকবো? কেন বেঁচে থাকবো বলতে পারো? এত টাকা-কড়ি কাকে দিয়ে যাবো? কে আছে আমার?

অশ্বিনী রেগে গেল। বললে–ও-সব অলক্ষুণে কথা বলবেন না ঠাকুরমশাই, আপনার সম্পত্তি আপনার বংশধররাই ভোগ-দখল করবে–

–আমার বংশধর? আমার বংশধর আবার কোথায়?

অশ্বিনী ভট্টচার্য বললে–সে কী, বংশধর নেই বলে আপনি শরীরটা ঠিক রাখবেন না? আপনি বলছেন কী? বংশধর না-হয় এখন নেই, কিন্তু বংশধর হতে কতক্ষণ? আবার একটা বিয়ে করে ফেলুন, তখন আবার বংশধর হবে!

এবার আর হাসি চাপতে পারলেন না ছোটমশাই। বললেন–কী যে তুমি বলো অশ্বিনী, তার ঠিক নেই। এই বয়েসে আবার বিয়ে?

–কেন? আপনার আবার বয়েসটা এমন কী শুনি!

ততক্ষণে দুধ খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। গেলাসটা নিয়ে পুঁটি চলে যাচ্ছিল। অশ্বিনী মেয়ের দিকে চেয়ে বললে–রোজ ভোরে এমনি করে দুধ নিয়ে আসবি, বুঝলি? মনে থাকে যেন। ভুলিসনে—যা–

পুঁটি চলে গেল। কিন্তু অশ্বিনী গেল না। এই এত টাকার সম্পত্তির লোভটা সে মন থেকে দূর করতে পারলে না। সেই দিন থেকেই পুঁটি রোজ ভোরবেলা এসে দুধ দিয়ে যেতে লাগলো। একেবারে টাটকা গরুর দুধ। সেই গরম দুধ খেয়েই ছোটমশাই-এর শরীরটা বেশ ক’দিনের মধ্যেই চাঙ্গা হয়ে উঠতে লাগলো আবার। বেশ কাজ করতে ইচ্ছে হলো। মনেও বল পেলেন। এত শোক-দুঃখ সব ভুলে যেতে লাগলেন। গরম দুধ খাইয়ে পুঁটি চলে যেতেই অশ্বিনী এসে হাজির হতো। অশ্বিনী ভট্টাচার্য আসার পর থেকে বাজে লোকদের আনাগোনা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। বাজে লোকরা বাজে কথা বলে আর ছোটমশাই এর কাজ থেকে কিছু খসাতে পারতো না। অশ্বিনী ভট্টাচার্য একাই তখন মালিক, একাই তখন মালিকের রক্ষাকর্তা।

কিন্তু সব পণ্ড করে দিলে প্রকাশ। অশ্বিনী ভট্টাচার্য তখন কিছুই জানে না। বড় আনন্দে তখন দিন কাটছে তার। একবার যদি কোনও রকমে মেয়েটাকে ছোটমশাই-এর গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারে তো বাস্। তখন আর কে তাকে পায়। তখন এই সুলতান-পুরের আর নবাবগঞ্জের বুকের ওপর বসে সকলের দাড়ি ওড়াবে সে, এইটেই তার জীবনের বড় জয়।

সেদিনও ভাগলপুরে সকাল হয়েছে, অন্য দিনকার মত সেদিনও অশ্বিনী ভট্টাচার্য পুঁটিকে সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠিয়ে দুধ আনতে পাঠিয়েছে। তারপর সেই দুধ উনুনে জ্বাল দেওয়া হয়েছে। তারপর সেজে-গুজে ছোটমশাইকে সেই দুধ আবার খাওয়াতে গেছে।

প্রকাশ রায় তখন ট্রেন থেকে নামলো। নেমে আর বেশি দেরি করেনি। সেখান থেকে সোজা একেবারে সুলতানপুর। তাড়াতাড়ি রিকশা থেকে নেমেই বাড়িটাতে ঢুকে পড়েছে। কতদিন সুলতানপুরে আসেনি সে। আগে বউ-ছেলে-মেয়ের কাছেই যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা তো রইলই। সে তো আর ফসকে যাচ্ছে না। আগে জামাইবাবুর সঙ্গে দেখা না করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। দিদি নেই যে শুধু দিদিকে খাতির করলেই চলবে। এখন প্রকাশ রায়ের ভগবান বলো, আল্লা বলো, সব কিছুই ওই জামাইবাবু। জামাইবাবু রাখলে রাখবে মারলে মারবে।

কিন্তু জামাইবাবুর শোবার ঘরে গিয়ে দেখে অবাক কাণ্ড! এমন কাণ্ড যে দেখতে হবে তা প্রকাশ আশা করেনি। দেখে, জামাইবাবু একটা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে দুধ খাচ্ছে, আর একটা মেয়ে পায়ের কাছে বসে জামাইবাবুর পা টিপে দিচ্ছে!

ওই অবস্থায় জামাইবাবুকে দেখে, প্রকাশ যেন এক মুহূর্তের জন্যে আড়ষ্ট হয়ে রইলো। জামাইবাবুও তেমনি, আর পুঁটির তো কথাই নেই। ছোটমশাই সোজা হয়ে বসে পুঁটিকে বললেন–থাক, থাক, আর পা টিপতে হবে না

পুঁটি পা ছেড়ে দিয়ে গেলাসটা নিয়ে চলে যেতে চাইছিল, কিন্তু প্রকাশ তখন পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঘরের বাইরে যাবার রাস্তা নেই।

জিজ্ঞেস করলে–এ কে জামাইবাবু?

ছোটমশাই বললেন–এ হলো অশ্বিনী ভট্টাচার্যির মেয়ে–তা তুমি কখন এলে?

–অশ্বিনী ভট্টাচার্যির মেয়ে? তা এখানে কেন?

–ও দুধ দিতে এসেছে, পা’টা কামড়াচ্ছিল কিনা তাই….

প্রকাশ বললে–তা পায়ের আর দোষ কি? পা তো কামড়াবেই, কিন্তু তা বলে অশ্বিনী ভট্টাচার্যের মেয়ে এসে আপনার পা টিপে দেবে? পা টেপবার আর কোনও লোক পেলেন না আপনি?

–এই সুলতানপুরে আমার কে আর আছে বলো! আর তো কেউ নেই—

–আর কেউ না থাকে, আমি তো আছি।

বলে পুঁটিকে তাড়া করলে। বললে–যা, তুই বাড়ি যা–

পুঁটি তখন পালাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু প্রকাশ আর দেরি করলে না। জামাই বাবুর পায়ের কাছে বসে দু’হাতে তাঁর পা দুটো কোলে তুলে নিয়ে টিপতে লাগলো।

ছোটমশাই ব্যস্ত হয়ে বললেন–তুমি আবার কেন পা টিপতে বসলে?

–তা আপনার পা কামড়াচ্ছে,আমি টিপবো না? কোথাকার কোন্ অশ্বিনী ভট্টাচার্যর মেয়েকে দিয়ে কী বলে আপনি পা টেপাতে গেলেন? ওর গায়ে কি জোর আছে আমার মত?

ছোটমশাই বললেন–না না, থাক্ থাক্‌, আর টিপতে হবে না, আমার পা আর কামড়াচ্ছে না তুমি পা ছাড়ো–

বলে ছোটমশাই নিজের পা দুটো প্রকাশের কোল থেকে টেনে নিলেন। তারপরে বললেন–তুমি তো ট্রেন থেকে নেমে সোজা এসেছ, এখন যাও, বউমার সঙ্গে দেখা করে এস, আমি এখানেই আছি–

প্রকাশ উঠলো। বললে–ঠিক আছে, আপনি যেন কোথাও বেরোবেন না, আমি এখুনি আসছি–

বলে বেরোল। কিন্তু বাড়ির দিকে নয় একেবারে সোজা চলে গেল অশ্বিনী ভট্টাচার্যির বাড়ি। আগে জিনিসটার ফয়শালা হয়ে যাক, তারপর নিজের বাড়িতে যাবে সে।

অশ্বিনী ভট্টাচার্যির বাড়ির সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো–অশ্বিনী–অশ্বিনী—

অশ্বিনী বেরিয়ে আসতেই প্রকাশ বলে উঠলো–বলি ভেবেছিস কী তুই? নিজের আইবুড়ো মেয়ে পাঠিয়ে দিয়ে ভেবেছিস আমার ভগ্নিপতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিবি? আমি তোর মতলব বুঝি না ভেবেছিস? খবরদার বলছি তোর মেয়ে যদি ও-মুখো হয় তো ওর ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব, এই তোকে বলে রাখছি–

অশ্বিনীও কম যায় না। বললে–কী, এত বড় আস্পর্ধা তোর, আমার বাড়ি বয়ে তুই গালাগালি দিতে আসিস–

ততক্ষণে আশেপাশে লোকজন জমে গিয়েছিল। একজন তেড়ে যায় তো ও-দিক থেকে আর একজন তেড়ে আসে।

সব লোক তখন প্রকাশ রায়ের দলে ভিড়ে গেছে। প্রকাশ চেঁচিয়ে উঠলো–আয় দেখি তোর কত তেজ, আমার ভগ্নিপতিকে তোর জামাই করা বার করছি। ভেবেছিস আমি মরে গেছি?

নিরাপদ চক্রবর্তী বললে–-দেখ না বাবা, অশ্বিনী তোমার ভগ্নিপতির কাছে আমাদের কাউকে ঘেঁষতে দেয় না। ভেবেছে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সব সম্পত্তি নিয়ে গ্রাস করবে!

প্রকাশ বললে–গ্রাস করা দেখাচ্ছি, আমি ছিলুম না বলে তলে তলে এত মতলব। আমি এসে দেখি ওর মেয়েটা আমার ভগ্নিপতির পা দুটো কোলে নিয়ে টিপে দিচ্ছে। তার চেয়ে তোর মেয়েকে বাজারের বস্তিতে ভাড়া খাটাতে পাঠালি না কেন? তাতে মেয়ের রোজগারে আরো বেশি করে পেট ভরতো—

এতক্ষণে অশ্বিনী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। প্রকাশের দিকে ছুটে আসতে আসতে বললে–তবে রে শালা, আমার মেয়ের নামে বদনাম দেওয়া, তোকে আজ মেরেই ফেলবো–

শেষ পর্যন্ত হয়তো সেইখানেই একটা রক্তারক্তি কাণ্ড বেধে যেত কিন্তু তার আগেই বাড়ির ভেতর থেকে পুঁটি এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে বাবা, তুমি ওদের কাছে যেও না, ওরা তোমাকে একলা পেয়ে মেরে ফেলবে—

জিনিসটা এর পরে আর আর বেশি দূর গড়ালো না। অশ্বিনী ভট্টাচার্যিও রাগে গজ গজ করতে লাগলো, প্রকাশও তাই। মাঝখানে নিরাপদ চক্রবর্তীরা শুধু একটু হতাশ হলো। একটা গুরুতর কিছু ঘটলে যেন তাদের ভালো লাগতো।

প্রকাশ চলে আসার সময় শুধু বলে এলো–ঠিক আছে, আজ কিছু বললুম না, কিন্তু সাবধান, আর কখনও এ-মুখো হলে তোরই একদিন কি আমারই একদিন—হ্যাঁ—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *