২.৭ নয়নতারার সুখ

কালীকান্ত ভট্টাচার্যের সব দিকে নজর। সব জিনিস সহজ করে নিতে পারার মত মনের ধৈর্য ছিল বলেই হয়ত এত বড় শোকের মধ্যেও মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে শীতের তত্ত্ব পাঠাবার কথাটাও ভাববার সময় পেয়েছেন। ভেবেছিলেন তাঁর নিজের যাই হোক, মেয়ের শ্বশুর শাশুড়ীর কাছে অন্তত মেয়ের আদর হোক। নয়নতারার সুখ থাকলেই তাঁর সুখ।

নিখিলেশদেরও তাই বলতেন। বলতেন–আমার যা-কিছু আছে সবই তো নয়নতারার। বড়লোকের বাড়িতে সে পড়েছে, তাদের মর্যাদামত তত্ত্ব করতে হবে তো–

নিখিলেশই বলতে গেলে বাজার করে দিয়েছিল। কালীকান্ত ভট্টাচার্য তাকে বলে দিয়েছিলেন–যা কিছু কিনবে সব যেন বাজারের সেরা জিনিস হয়, বুঝলে? একেবারে সেরা সরপুরিয়া, একেবারে সেরা সন্দেশ, সেরা জামা কাপড়–

কালীকান্ত ভট্টাচার্যের নিজের ও-সব শখ-শৌখীনতার বালাই ছিল না কোনও কালে, তিনি একজোড়া চটি, একখানা ধুতি আর একটা উড়ুনি দিয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। জামা আছে। কিন্তু সে-জামা পরবার প্রয়োজন তেমন অনিবার্য হয় না কখনও। সেইজন্যেই নিখিলেশকেই ডেকে পাঠিয়েছিলেন বাড়িতে। তাকে সব বললেন। বললেন–মেয়ের শ্বশুর শাশুড়ী যেন না ভাবে যে মেয়ের মা নেই বলে বেয়াই মশাই শীতের তত্ত্বটাও বাদ দিলে।

তারপর বললেন–তুমি তো কলকাতায় যাও, সেখান থেকে সেরা দোকান থেকে গরম কাপড় কিনে সেরা দর্জিকে দিয়ে পাঞ্জাবি করিয়ে নিয়ে আসবে–

নিখিলেশ তাই-ই করিয়েছিল। কোনও খুঁত রাখে নি সে। মাস্টার মশাই-এর কথাটা মনে ছিল তার–টাকা যত লাগে তুমি চেয়ে নিও আমার কাছ থেকে। টাকার জন্যে যেন জিনিস খারাপ কোর না। একেবারে সরেশ জিনিস চাই। নবাবগঞ্জের লোক যেন তত্ত্ব দেখে বলে– হ্যাঁ, তত্ত্বের মতন তত্ত্ব পাঠিয়েছে চৌধুরী মশাই-এর বেয়াই—

কিন্তু তিনিই কি জানতেন, তাঁর অত কষ্টের টাকায় পাঠানো তত্ত্বর এমন হেনস্তা হবে। বিপিন প্রামাণিক ছাড়া কালীকান্ত ভট্টাচার্যের তত্ত্ব নিয়ে আসবার আর কে আছে। বিপিনই যোগাড় করেছিল আরও চারজন লোক। একজনের মাথায় দই রাবড়ি, একজনের মাথায় সরপুরিয়া সরভাজার থালা, একজনের মাথায় কমলালেবু ফুলকপি কড়াইশুটি ইত্যাদির ঝুড়ি, একজনের হাতে বিশ সের ওজনের একটা রুই মাছ, আর একজনের মাথায় জামা কাপড় শাড়ি এই সব।

প্রকাশ মামা ননী ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসে কাণ্ড দেখে অবাক। বললে–কী হে, তত্ত্ব নিয়ে এসেছ? বাঃ বাঃ, বেয়াই মশাই তো কাজের লোক দেখছি, সব দিকে খেয়াল আছে। সরপুরিয়া সরভাজাও তো রয়েছে দেখছি–

আর থাকতে পারলে না। সোজা চলে গেল ভেতর বাড়ির দিকে। দিদি–ও—দিদি—

এমন সুখবরটা দিদিকে না দিতে পারলে যেন তার পেটের ভাত হজম হচ্ছিল না। কিন্তু দিদি তখন সেখানে নেই। প্রীতি তখন বউমার কাছে গিয়ে খবরটা দিচ্ছিল। বলছিল–তোমার বাবা তত্ত্ব পাঠিয়েছেন বউমা, শীতের তত্ত্ব। তারা বোধ হয় তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে–তার আগে তুমি ওই শাড়িটা বদলে একটা ভালো শাড়ি পরে নাও, আয়নাতে মুখ-টুখ দেখে পরিষ্কার হয়ে নাও

কথাটা শুনে নয়নতারা যেন অন্য মানুষ হয়ে গেল। বাবা পাঠিয়েছে? তা হলে কি বিপিন এসেছে নাকি!

শাশুড়ী আবার বললেন–দেখো বউমা, তুমি যেন এসব কেলেঙ্কারির কথা ওদের বোল না, বুঝলে?

নয়নতারা আর কী বলবে! বাবা শীতের তত্ত্ব পাঠিয়েছে! সমস্ত রাত্রের যা-কিছু গ্লানি সব যেন এক মুহূর্তে মুছে গেল তার মন থেকে। সকাল থেকে বাড়িতে যা-যা কাণ্ড ঘটেছে, তাও যেন আর মনে রইল না। বাবা তত্ত্ব পাঠিয়েছে! নয়নতারা যেন এতক্ষণে একটা আশ্রয় খুঁজে পেলো। তাহলে তো সে একেবারে নিঃস্ব নয়, একেবারে নিঃসহায়, নিরাশ্রয় নয়। একটা জায়গা তো তার এখনও আছে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে তার একটা মাথা গোঁজবার আশ্রয় আছে। মা চলে গেলেও তো একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায় নি সে।

তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে গিয়ে নয়নতারা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে মুখটা মুছে নিলে। রাত জাগার পর চোখের তলায় কেমন একটা কালো দাগ পড়েছিল। সেখানটায় একটু পাউডার ঘষে নিলে। তারপর ঘরের এক কোণে গিয়ে একটা নতুন শাড়ি পরে নিলে। বাপের বাড়ির লোকদের বুঝতে দিতে হবে যে সে এখানে সুখে-শান্তিতে আছে, তার কোনও কষ্ট নেই। শ্বশুর-শাশুড়ী তাকে খুব আদরে-যত্নে রেখেছে।

বাইরে থেকে গলা শোনা গেল–দিদিমণি—

নয়নতারা তাড়াতাড়ি ভেজানো দরজাটা খুলে দিয়ে ডাকলে–এসো, এসো–

পাঁচজন লোক একসঙ্গে গিয়ে ঘরে ঢুকলো। তাদের সকলের আগে বিপিন। বিপিন একেবারে হাসতে হাসতে নয়নতারার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলে–কেমন আছো দিদিমণি–

–ভালো। তোমরা ভালো?

–হ্যাঁ দিদিমণি।

–বাবা? বাবা কেমন আছে?

–পণ্ডিতমশাই মুখে তো ভালো আছেন বলেন। কিন্তু তুমি আসার পর থেকে মনটা কেমন উড়ুউড়ু হয়ে গেছে। সে-মানুষ আর নেই। তারপর অত বড় একটা শোক-তাপ গেল। আমরা হলে তো ভেঙে পড়তুম দিদিমণি। নেহাৎ পণ্ডিতমশাই দিনরাত কাজ নিয়ে। থাকেন বলে তবু শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আছেন–

–কিন্তু এসব তত্ত্ব-টত্ত্বর ব্যবস্থা কে করলে? বাবা একলা সব করতে পারলো?

–তিনি একলাই করলেন। আর দোকলা কে আছে যে করে দেবে!

–বাবার খাওয়া-দাওয়ার কী হচ্ছে?

–ওই যে বামুন মেয়েটা আছে। সে-ই রান্না করে দিয়ে চলে যায়। আর বাবুর তো খাওয়া!

বলতে বলতে বিপিনের কী যেন সন্দেহ হলো। বললে–তোমার মুখটা কেমন শুকনো শুকনো দেখছি, তোমার শরীর ভালো আছে তো দিদিমণি?

নয়নতারা মুখে একটা হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করে বললে–আমি? আমার আবার কী হয়েছে যে খারাপ থাকবো? শ্বশুর-শাশুড়ীর এত আদর পাচ্ছি, খারাপ থাকবো কেন?

–আর জামাইবাবু? জামাইবাবুকে যে দেখছি না? জামাইবাবু কোথায়?

আবার সেই ব্যথার জায়গাটাতেই ঘা দিলে বিপিন। কিন্তু নয়নতারা মুখের হাসিটা সেই একই ভাবে মুখে ধরে রেখে বললে–এই তো এখুনি ছিলেন, বাড়িতেই কোথাও আছেন বোধ হয়–

হঠাৎ বাইরে যেন কী একটা গোলমালের আওয়াজ হলো। কে যেন চিৎকার করে উঠলো কোথায় গেল খোকা? গেল কোথায়? দিন-দিন এরকম বেয়াড়াপনা করে তো আমার ইজ্জৎ থাকে? কথাগুলো যিনি বললেন তিনি যেন খুব রেগে গেছেন বলে মনে হলো। গলার আওয়াজে যেন সমস্ত বাড়িটা গমগম করে উঠলো।

বিপিনের সঙ্গে যারা এসেছিল আওয়াজটা তাদের সকলের কানেই গেল। তারা সবাই শুনতে লাগলো কথাগুলো। বাইরে তখনও গোলমাল চলেছে। কে একজন যেন মেয়েলী গলায় জিজ্ঞেস করলেকী, হলো কী আবার? তুমি অত রেগে গেলে কেন?

–রাগবো না? তোমরাই তো ছেলেকে আদর দিয়ে একেবারে মাথায় তুলেছ! তুমি আর ওই প্রকাশ! কেন? ছেলের বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে ভেবেছে সে যা ইচ্ছে তাই করবে? আমি তাকে কিছু বলতেও পারবো না?

–তুমি চুপ করো। একটু আস্তে আস্তে কথা বলতে পারো না? অত চেঁচাবার কী আছে?

–বেশ করবো চেঁচাবো। আমি ননী ডাক্তারকে নিয়ে ওপরে বাবাকে দেখাতে গেছি, আর এদিকে বাবাজীর ত্রিশূলটা সরিয়ে নিয়ে সে চলে গেছে–

ততক্ষণে প্রকাশ এসে ঢুকলো। প্রকাশ ননী ডাক্তারের ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিতে গিয়েছিল। ফিরে এসে কাণ্ড দেখে অবাক। বাবাজীর ঘরে সিঁদুর মাখানো ত্রিশূলটা ছিল সেটা নাকি সদা আবার সরিয়ে নিয়ে চলে গেছে।

চৌধুরী মশাই বলে উঠলেন–এ তো তোমাদেরই দোষ! আমি সদাকে ঘরের ভেতর পুরে তালা-চাবি বন্ধ করে রেখে দিলুম আর তোমরাই তাকে ছেড়ে দিলে! এখন কোথায় গেল সে? সে গেল কোথায়?

কথার মাঝখানেই বাধা দিলে প্রীতি। বললে–ওগো, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি চুপ করো, কুটুমবাড়ি থেকে তত্ত্ব নিয়ে লোক এসেছে, তাদের সামনে আর কেলেঙ্কারি কোর না। ওরা চলে যাক, তখন যত ইচ্ছে ছেলেকে গালমন্দ করো–তার ওপর বউমা রয়েছে। বাড়িতে, বউমা কী ভাবছে বল দিকিনি। তোমার কি একটা আক্কেল বলে কিছু থাকতে নেই?

চৌধুরী মশাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন–তত্ত্ব এসেছে? কীসের তত্ত্ব? শীতের?

প্রকাশ মামা বললে–হ্যাঁ জামাইবাবু, আমি নিজে দেখেছি যে। সদার কাপড়-জামা, কমলালেবু, কপি, কড়াইশুটি, সরপুরিয়া, সরভাজা–

বিপিনের দলের লোকেরা এতক্ষণ সব শুনছিল। বিপিন নয়নতারার দিকে চেয়ে দেখলে। দিদিমণির মুখটা যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করলেও কা’র গলা দিদিমণি?

নয়নতারা এর কী উত্তর দেবে! তার যেন তখন লজ্জায় অপমানে মাথা কাটা গেছে।

কিন্তু তাকে আর এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলো না তখন।

বিপিন তখনি আবার জিজ্ঞেস করলে বাড়িতে কে আছে দিদিমণি? তার ত্রিশূল বুঝি জামাইবাবু নিয়ে গেছেন?

হঠাৎ শাশুড়ী ঘরে ঢুকলো। বললে–এসো বাবা, তোমরা খাবে এসো, তোমাদের খাবার দেওয়া হয়েছে–

বিপিন দিদিমণির শাশুড়ীকে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতেই বললে–থাক থাক বাবা, সব ভালো খবর তো তোমাদের?

ভেতর-বাড়িতে রান্না বাড়ির বারান্দায় সার সার আসন পেতে কুটুমবাড়ির লোকজনদের পেট-ভরা খাওয়াবার আয়োজন হয়েছিল। লুচি বেগুনভাজা থেকে শুরু করে ডাল মাছ দই মিষ্টি কিছুই বাদ নেই। যারা কুটুমবাড়িতে তত্ত্ব নিয়ে এসেছে তাদের খাওয়ার অধিকার আছে। গৌরী পরিবেশন করছিল আর প্রীতি তদারক।

বিপিন খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলে–জামাইবাবু কোথায়, তাঁকে তো দেখছি নে। সেবারে পণ্ডিতমশাই এসেছিলেন, তিনিও জামাইবাবুকে দেখতে পান নি, আসবার সময় বলে দিয়েছিলেন জামাইবাবুর সঙ্গে দেখা করতে–

প্রীতি বললে–তা খোকা তো বাড়িতে নেই এখন, মামলার কাগজপত্র নিয়ে সে রানাঘাটে গেছে উকিলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে–

কথাটা শুনে বিপিন যেন কেমন একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল। দিদিমণি এক রকম বললে, দিদিমণির শাশুড়ী একরকম বললে, আর দিদিমণির শ্বশুরের আর একরকম কথা।

চৌধুরী মশাই অনেকক্ষণ পরে এলেন। বিপিনদের তখন খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে। হাত-মুখ ধুয়ে পান খাচ্ছে।

–বেয়াই মশাই কেমন আছেন?

–আজ্ঞে, ভালোই আছেন।

–তোমাদের পেট ভরেছে তো?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব খেয়েছি। তাহলে আসি আমরা–

আর একবার প্রণাম করে তারা বিদায় নিচ্ছিল। যাবার আগে বিপিন বললে–সকলের সঙ্গেই দেখা হলো আজ্ঞে, শুধু জামাইবাবুর সঙ্গেই দেখা হলো না–

চৌধুরী মশাই বললেন–সে তো সকালে ছিল বাড়িতে, এই তোমরা আসবার কিছুক্ষণ আগে মাঠে গেছে ছোলা দেখতে। এবারে পাঁচশো বিঘে জমিতে ছোলা বোনা হয়েছে কি না, নিজেরা না দেখলে কে দেখবে, তাই…

বিপিন আরো অবাক হয়ে গেল। সমস্ত জিনিসটার পেছনে যেন একটা রহস্য মেশানো রয়েছে। একই বাড়ির লোক এক-এক রকম কথা বলে কেন? তবে কি কেউই জামাইবাবুর সঠিক খবর রাখে না?

বিপিনরা চলে যাবার পর প্রকাশ ছুটতে ছুটতে এসে চৌধুরী মশাইএর সামনে দাঁড়ালো। বললে–এই দেখুন জামাইবাবু, আপনি বলছিলেন সদা বাবাজীর ত্রিশূল নিয়ে পালিয়েছে, এই তো বাড়িতেই ত্রিশূল রয়েছে, আমি খুঁজে বার করলুম–

চৌধুরী মশাই বললেন–কোথায় ছিল?

–শশী কয়াল আমাকে দিলে। মরাই-এর পাশে পড়ে ছিল।

–তা ওখানে ওটা কে নিয়ে গেল?

প্রকাশ বললে–কে নিয়ে গেল কে জানে! হয়ত ভূতে নিয়ে গেছে। ভূত প্রেতদের চটিয়ে দিয়েছেন বাবাজী, তারা কি অত সহজে বাগ মানে? যাবার সময় হয়ত এই হাতিয়ারাটা সামনে পেয়ে তুলে নিয়ে গেছে।

ত্রিশূলটা নিয়ে চৌধুরী মশাই বাবাজীর ঘরের দিকে চলতে লাগলেন। প্রকাশও পেছন পেছন চলছিল। সে বললে–আপনি মিছিমিছি সদার নামে দোষ দিলেন….

–তুমি থামো, তুমি আর অত ফ্যাচফ্যাচ কোর না। ফ্যাচফ্যাচ করা আমার ভাল লাগে না। আমি মরছি আমার নিজের জ্বালায়, আর এই সময়ে কিনা কর্তাবাবুর অসুখ, কুটুমবাড়ির তত্ত্ব, বাবাজীর ত্রিশূল, ছেলের বেয়াড়াপনা, সদরের মামলা, সব একেবারে পঙ্গপালের মত পেছনে তাড়া করতে হয়–

বলতে বলতে দু’জনেই বাবাজীর ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। কিন্তু বাবাজী তখন চোখ বুজে জপ করছেন। একেবারে ধ্যানস্থ। বাহ্যজ্ঞানশূন্য। কোনও পার্থিব দিকে তাঁর আর মনোযোগ নেই। ধ্যানযোগে তখন হয়ত তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অলৌকিক-লোকে বিচরণ করছেন।

চৌধুরী মশাই আর প্রকাশ মামা যেমন ঘরে ঢুকেছিলেন তেমনি আবার বেরিয়ে এলেন। বাবাজীর ধ্যান ভাঙাতে আর ইচ্ছে হলো না।

.

একদিনের মধ্যেই বাড়িতে যেন ঝড় বয়ে গেল। কুটুম্বিতা, আতিথেয়তা, অসুখ আর ঝামেলার ঝড়! আসলে বলতে গেলে ঝড় শুরু হয়েছিল সেই সদানন্দর গায়ে-হলুদের দিন থেকেই। তারপর থেকে এই ঝঞ্ঝাটের আর যেন কামাই নেই। চৌধুরী মশাই আর প্রীতির যেন মাথা খারাপ হবার যোগাড়।

একলা প্রকাশ কোন্ দিক সামলাবে! তাকে একবার ডাক্তারবাড়ি যেতে হচ্ছে, আর একাবার সদানন্দকে সামলাতে হচ্ছে। তারও ঘুম হয় নি সারারাত। অন্ধকার বারান্দায় সারারাত সদার ঘরের দরজার সামনে ঠাণ্ডা মেঝের ওপর শুয়ে কি কারো ঘুম আসে!

ডাক্তারবাড়ি থেকে ওষুধটা কোনও রকমে কর্তাবাবুর ঘরে ফেলে দিয়ে এসেই একেবারে সোজা রান্নাঘরে ছুটে এসেছে। এসেই বললে–কই দিদি, আমাকে সরভাজা দিলে না যে?

দিদি তখন রান্নার তদারকে ব্যস্ত ছিল। কথাটা শুনে ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো–আমার এখন দেবার সময় নেই–পরে দেব’খন

–তার মানে? পরে তো খাবোই। এখন একটু চেখে দেখবো, তাও দেবে না?

দিদি আর রাগ সামলাতে পারলে না। ঝাঁঝিয়ে উঠলো–হ্যাঁ রে, তোর এই এত বয়েস হলো, বুড়ো ধাড়ি হলি, এখনও তোর নোলা গেল না? আমার কি মরবার সময় আছে এখন যে তোকে সরভাজা খেতে দেব?

–তা তোমাকে কে দিতে বলছে? আমাকে বলো না কোথায় রেখেছ, আমি নিজেই নিতে পারবো, তোমায় আর কষ্ট করতে হবে না। আর বেয়াই মশাই কী রকম তত্ত্বটা করলে, ভালো কি মন্দ, একবার পরখ করে দেখতে হবে না?

দিদি হঠাৎ হাতের কাজ ফেলে ভাঁড়ার ঘর থেকে সরভাজা আর সরপুরিয়ার দুটো হাঁড়ি প্রকাশের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। বললে–খা, গেল্‌–

প্রকাশ বললে–এ কী করলে? এতগুলো দিতে গেলে কেন? এতগুলো কি মানুষে খেতে পারে? তুমি নিজের জন্যে কিছু রাখলে না? জামাইবাবুও তো খাবে–

ওদিকে চৌধুরী মশাই স্নান করে এসে হাজির। বললে–কই রে গৌরী, আমায় ভাত দে–

তারপর প্রকাশের কাণ্ড দেখে অবাক। বললেন–এগুলো কী খাচ্ছো?

প্রকাশ বললে–এই দেখুন না জামাইবাবু, এত সরপুরিয়া সরভাজা কেউ খেতে পারে? এই দু’হাঁড়ি? শীতের তত্ত্ব এসেছে বেয়াইবাড়ি থেকে, এ তো একলা আমাকে দেয় নি। আপনি খাবেন, দিদি খাবে, সদা খাবে, বউমা খাবে। তা নয়, দিদি সব আমাকে দিয়ে গেল–

চৌধুরী মশাই-এর তখন তাড়া ছিল। সদর থেকে উকিলবাবু জরুরী তলব দিয়েছে। মামলা আছে সেখানে। রজব আলি গাড়ি নিয়ে তৈরি। খেয়ে উঠেই রওনা দেবেন তিনি।

গৌরী ভাতের থালা দিয়ে গেল। প্রীতি এসে বললে–খাক খাক, ও পছন্দ করে বউ এনে দিয়েছে, ওই-ই খাক্‌–

কিন্তু এসব কথা নিয়ে আলোচনা করার মত সময় তখন ছিল না চৌধুরী মশাই-এর। তাড়াতাড়ি খেতে লাগলেন। তারপর যখন দেখলেন বাইরের কেউ নেই তখন জিজ্ঞেস করলেন–সদা কোথায়? সদা সেই সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল আর বুঝি আসে নি?

প্রীতি বললে—না–

–আর বউমা কী বলছেন? কুটুমবাড়ির লোককে এখানকার ব্যাপার কিছু বলে নি তো?

প্রীতি বললে–বউমা না বললেই বা, কিন্তু তুমি এমন হইচই করলে তাতেই তো তারা সব জেনে গেল

–কী রকম?

–তোমার তো মাথা গরম হলে আর কাণ্ডাকাণ্ডি জ্ঞান থাকে না, তুমি এমন চেঁচাতে লাগলে যে পাশের বাড়ির লোকও সব জেনে ফেললে।

চৌধুরী মশাই খেতে খেতে বললেন–বেহারি পাল তার আগেই যে সব কর্তাবাবুকে বলে গেছে। সেই জন্যেই তো এত ডাক্তার–ওষুধের হিড়িক হলো।

কৈলাস গোমস্তা সবই বলেছে আমাকে–

প্রীতি বললে–সে তো তোমারই দোষ। আমি তো আর বাড়ি বয়ে ভেতরের ব্যাপার কাউকে বলতে যাই নি–আমার সেরকম স্বভাবও নয়। তুমি নিজেই সকলকে বলে বেড়াবে আর নিজেই আবার আমাদের সাবধান করে দেবে–

চৌধুরী মশীই এ কথার কোনও জবাব না দিয়ে বললেন–তা আজকে কী করবো? 

–কীসের কী?

–আজকে তো রাত্তিরে আমি থাকছি নে। কাজকর্ম মিটিয়ে রাণাঘাট থেকে কোর্টকাছারি করে ফিরে আসতে সেই পরশু গড়িয়ে যাবে–আজ যদি খোকা বাড়িতে আসে তো আজকে সে কোথায় শোবে?

প্রীতি বললে–সে তোমাকে ভাবতে হবে না, তুমি নিজের কাজ করো গে যাও। কালই বা তুমি কী করেছিলে? তুমি তো ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগলে। যা কিছু করবার তা আমি আর প্রকাশই তো করলুম–

–তা তুমি কি বলতে চাও আমার ভাবনা হয় না? আমি জমি-জমা নিয়ে ভাবি বলে ছেলে-বউএর ব্যাপার কি আমার নিজের ব্যাপার নয়? এত জমি-জমা তাহলে কার জন্যে করছি? এত মামলা-মকর্দমার ঝামেলাই বা কার জন্যে? আমি আর কদিন? আমি যখন থাকবো না তখন এসব কে দেখবে? আমার যা কিছু সব তো ওই ছেলের জন্যেই। ছেলে মানুষ হলো কি অমানুষ হলো তা আমি ভাববো না তো কে ভাববে? এই যে আমি রাণাঘাটে যাচ্ছি, তা সেখানে গিয়েই কি আমি শান্তি পাবো মনে করছো? আমার মন কেবল পড়ে থাকবে এখানে। রাত্তিরে সেখানে শুয়ে শুয়েও মনে পড়বে খোকা কী করছে, খোকা কোথায় শুয়েছে। খোকার সঙ্গে বউমার ভাব হলো কি না, এই সবই ভাববো। মামলার ব্যাপার যা-কিছু উকিলবাবু করবে, আমি তো এখানকার কথা ভেবেই সারাদিন সারারাত ছটফট করবো…

খাওয়া তখন হয়ে এসেছিল। তিনি উঠছিলেন।

প্রীতি বললে–এ কী? তুমি উঠলে যে? দুধ খাবে না?

–না, খাওয়া-দাওয়া এখন আমার মাথায় উঠেছে। ছেলের একটা ব্যবস্থা না করতে পারা পর্যন্ত আমার খেয়েও সুখ নেই–

প্রীতি বললে–ছেলের কথা তোমায় আর অত ভাবতে হবে না। আমি তো বলছি, সে ভার আমাদের ওপর তুমি ছেড়ে দাও। আমি আছি, প্রকাশও রইল। আমরা দুজনে যাহোক একটা ব্যবস্থা করবোই। ওই তো প্রকাশ বলছিল, কোন্ সাধুর কাছ থেকে একটা বশীকরণ মাদুলি নাকি ও এনে দেবে–

–মাদুলি তোমার ছেলে পরবে? খোকা কি সেই রকম ছেলে তোমার?

–খোকা কেন মাদুলি পরবে? বউমাকে পরিয়ে দেব। সে যা-হোক আমরা একটা ব্যবস্থা করবোই। তুমি দুধটা খেয়ে নাও, এখন তো দু-তিন দিন আর দুধ-ঘি কিছুই জুটবে না–

চৌধুরী মশাই দুধটা চোঁ-চোঁ করে চুমুক দিয়ে খেয়ে নিয়ে বললেন–ও সাধু-সন্নিসী মাদুলি-তাবিজের ওপর আমার আর বিশ্বাস নেই। আমার খুব শিক্ষা হয়ে গেছে।

এতক্ষণ প্রকাশের কানে এসব কথা যায় নি। জামাইবাবুকে উঠতে দেখেই খেয়াল হলো। বললে–এ কি, আপনি সরভাজা সরপুরিয়া খেলেন না জামাইবাবু? বেয়াই মশাই এত খরচ-পত্তোর করে তত্ত্ব পাঠালেন আর আপনি একটা মুখে দিলেন না–যাবার আগে অন্তত একটা সরভাজা চেখে দেখুন–

চৌধুরী মশাই যেতে যেতে বললেন–ওসব তুমি খাও বড়কুটুম, তোমার মনে তো কোনও অশান্তি নেই, মামলা-মকর্দমার ঝামেলাও নেই। মামলা-মকর্দমা যে কী ব্যাপার তা তুমিই বা কী বুঝবে আর তোমার দিদিই বা কী বুঝবে–

প্রীতি পেছনে ছিল। বললে–আমি খুব বুঝি। আমিও জমিদারের মেয়ে। বাবা বলতো– সম্পত্তি করবো অথচ মামলা-মকর্দমা করবে না, তা কি হয়!

জামাকাপড় পরে তৈরি হতে বেশি সময় লাগলো না। জুতো জোড়া পরে নিয়ে হাতে কাগজপত্রের পুঁটলিটা নিয়ে চৌধুরী মশাই গাড়ীতে উঠে বসলেন। অন্য সময় হলে কৈলাস গোমস্তা সঙ্গে যেত। কিন্তু সে চলে গেলে কর্তাবাবুকে কে দেখবে?

— দুর্গা দুর্গা, দুর্গা–দুর্গা–

পরম ভক্তিভরে পুব দিককে উদ্দেশ করে কিম্বা হয়ত ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে তিনি রওনা দিলেন।

গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো।

.

চৌধুরী মশাই না থাকলে সেরেস্তাদার পরমেশ মৌলিকই চণ্ডীমণ্ডপের কাজ চালাতো। একেবারে নির্বিকার নির্বিরোধ মানুষ। বাড়ির ভেতরের কোনও ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা তার ছিল না। যেমন ঝঞ্ঝাট ছিল কৈলাস গোমস্তার। শুধু হিসেবের খাতাটা নিয়ে কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে ঝিমিয়ে নিত। চৌধুরী মশাই চলে যাবার পর পরমেশ মৌলিকও বাড়িতে গিয়ে খেয়ে নিয়ে একটু দিবানিদ্রা দিয়েছিল। সেরেস্তার কাজে তেমন তাড়া ছিল না সেদিন। বাড়ির কর্তাই যখন বাড়িতে নেই তখন তার কাজেরও তাড়া নেই। চণ্ডীমণ্ডপের সামনেটায় গ্রীষ্মকালে বেশ ছায়া-ছায়া থাকে। কিন্তু শীতকালটাতেই যত বিপদ। বিরাট আতা গাছটার ডালপালার ছায়ায় রোদ এসে ঢোকে না।

পরমেশ মৌলিক চণ্ডীমণ্ডপ থেকে বাইরের দাওয়ায় বসে গায়ে একটু রোদের আঁচ লাগাচ্ছিল। ছোটবাবু নেই তাই পরমেশ মৌলিকের মনটাতেও একটু ছুটির আমেজ!

শালাবাবু হন হন করে বাড়ির ভেতরের দিকে আসছিল। পরমেশ মৌলিককে দেখেই জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁ গো সেরেস্তাদার, সদাকে দেখেছ?

–খোকাবাবু! কই, না তো!

-–দেখ নি? তা দেখবে কেন? তাহলে যে বাড়ির উপকার করা হবে। উপকার করবার সময় তো কেউ নেই, শুধু গায়ে রোদ লাগিয়ে বেড়াচ্ছো!

পরমেশ মৌলিক বললে–কেন? খোকাবাবু খেতে আসে নি?

–তোমার কি বুদ্ধি হে সেরেস্তাদার, খেতেই যদি আসবে তো আমি সারা গাঁ খুঁজে বেড়াবো কেন তাকে?

বলে আর দাঁড়ালো না সেখানে। একেবারে সোজা দিদির কাছে গিয়ে হাজির। বললে– কই, সদা এসেছে দিদি?

প্রীতি ছেলের জন্যে তখনও না-খেয়ে বসে ছিল। বললে–কই না তো–

–তা তুমি খেয়ে নিলে না কেন?

–আমি কী করে খাই বল! বউমাকে বলে কয়ে অনেক কষ্টে এখন খাইয়ে দিলুম। প্রথমে খেতে চাইছিল না। আমি বললুম, আমি শাশুড়ী হই, আমি তোমাকে বলছি, খেলে কোনও দোষ হবে না–

প্রকাশ বললে–দেখেছ কী রকম সতীসাধ্বী বউ এনেছি তোমার! সদাটা একটা আস্ত লক্ষ্মীছাড়া, অমন সতী-সাধ্বী বউ পেয়েছে আর তার এ কি হেনস্তা! বেশ করেছ তুমি খাইয়ে দিয়েছ, তা তুমিও খেয়ে নিলে পারতে? সে লক্ষ্মীছাড়ার জন্যে কতক্ষণ বসে থাকবে শুনি?

–সে খেলে না, আমি মা হয়ে কী করে খাই বল্ দিকিনি!

–আর বাবাজী? বাবাজীর সেবা হয়েছে?

প্রীতি বললে–ওই এক জ্বালা হয়েছে। তখনই তোর জামাইবাবুকে বললুম ও-সব হাঙ্গামা বাড়ির মধ্যে কোর না। অত পারবো না আমি। তো তোর জামাইবাবুর তো বিশ্বাস হলো না, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ হলো। এখন সামলাবার সময় তো সেই আমাকেই একলা সামলাতে হবে–

তারপর একটু থেমে বললে–তা খোকাকে কোথাও পেলি নে তুই?

প্রকাশ বললে–না, হেঁটে হেঁটে আমার পায়ের খিল খুলে গেছে। বারোয়ারিতলা চষে এলাম, নদীর ধারে গেছলুম, ভাবলুম সেখানেই বোধ হয় একলা-একলা শিবের গাজন গাইছে! যা ভাবুক ছেলে তোমার! কী যে এত ভাবনা ওর, তা বুঝতে পারি নে। রাগ করবি যত ইচ্ছে রাগ কর, ভাতের ওপর কেউ রাগ করে? এমন বোকা কেউ আছে? তুমিই বলো না–

–তা আর কোথাও পেলি নে তাকে?

–তারপর গেলাম দক্ষিণ পাড়ার দিকে, গেলাম পশ্চিম পাড়ায়। কোথাও নেই। ওই যে বললুম হেঁটে হেঁটে আমার পায়ের খিল্ খুলে গেছে। শেষকালে আমার ক্ষিদে পেয়ে গেল।

প্রীতি বললে–সে কী রে, এই তো এখুনি ভাত খেয়ে গেলি। তারপর সকালে অতগুলো সরভাজা সরপুরিয়া খেলি, এরই মধ্যে তোর আবার ক্ষিধে?

–তা ক্ষিধের কী দোষ বলো? তুমি আমার মত একটু হেঁটে এসে দেখবে তোমারও চড়চড় করে ক্ষিধে পেয়ে যাবে। বেয়াই মশাই যে কমলালেবু পাঠিয়েছিল, সে তো একটাও চেখে দেখি নি তখন

প্রীতির তখন ওসব কথা ভালো লাগছিল না। বললে–ভাঁড়ার ঘরে সব আছে, যে ক’টা পারিস খেগে যা–

প্রকাশ বললে–আরে আমি কি তাই বলেছি, বলছিলুম কমলালেবুগুলো মিষ্টি না টক সেটা চেখে দেখতে হবে তো

প্রীতি বললে–মিষ্টি হোক টক হোক ও তো আর ফেরত দিতে পারবো না। ও তো দোকানের জিনিস নয়–খেতেই হবে—

বলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল প্রীতি। সমস্ত বাড়িটা শীতের দুপুরে নিঝুম হয়ে রয়েছে। সকালবেলার কর্মব্যস্ত বাড়িটা তখন ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে বোধ হয় একমনে সন্ধ্যার প্রত্যাশায় ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে। কখন খোকা আসবে তার জন্যে হাঁড়িতে ভাত রাখা আছে। গৌরী গিয়ে রোদে গা দিয়ে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে। বিষ্ঠুর মাও তখন সারা দিনের কাজের অবসরে একটু গড়িয়ে নেবার আশায় বাড়ির কোনও জায়গায় আড়াল দেখে নিশ্চিন্ত আশ্রয় নিয়ে আত্মগোপন করে আছে।

তারপর বিকেল হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার সাজ-সাজ রব উঠবে। ছোটবাবু না-ই বা রইল বাড়িতে। কিন্তু অন্য সবাই-ই তো রয়েছে। তারা তো তা বলে আর পেটে খিল্ লাগিয়ে বসে থাকবে না। তাদের সব চাহিদা ঠিক ঠিক যুগিয়ে যেতে হবে প্রীতিকেই। ওপরে বুড়ো শ্বশুর অসুস্থ, বারবাড়িতে বাবাজী। পাশের ঘরে নতুন বউ-মানুষ। শুধু যার জন্যে এই সংসার করা, যার মুখ চেয়ে এই পরের বাড়ির মেয়েকে বউ করে আনা, সে-ই কোথায় রইল তার ঠিক নেই।

বাইরে কার পায়ের শব্দ হতেই প্রীতি চেয়ে দেখলে–কে?

বিষ্টুর মা! বিষ্টুর মা বললে–উনুনে আঁচ দেব মা?

প্রীতি রেগে গেল–ভরদুপুর বেলায় উনুনে আঁচ! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে বিষ্টুর মা?

বিষ্ঠুর মা বললে–দুপুর কোথায় মা! সন্ধ্যে হয়ে এসেছে যে–

সন্ধ্যে! প্রীতি ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠলো। শীতের বেলা দেখতে দেখতে পার হয়ে যায়। কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল তা টেরই পায় নি সে। গৌরী কোথায়? গৌরী মুখপুড়ী কোথায় গেল? আমাকে একবার ডেকে দেয় নি কেন সে?

গৌরী আসতেই প্রীতি ধমকে দিলে–হ্যাঁ রে, তোরা থাকিস কোথায়? আমাকে একবার ডাকতে পারলি নে? ঘরের মধ্যে আমি কি বেলা ঠাহর করতে পেরেছি? উনুনে এখনও আঁচও পড়ে নি, তোদের দিয়ে কি একটা কাজও হবার নয়? কর্তা বাড়িতে নেই বলে কি তোরা সবাই সাপের পাঁচ-পা দেখেছিস?

গৌরী বললে–তুমি যে ঘুমোচ্ছিলে দেখলুম বউদি, তাই আর ডাকি নি–

প্রীতি রেগে গেল। বললে–আমি ঘুমোচ্ছিলুম? তুই আমাকে ঘুমোতে দেখলি! জানিস খোকা খেতে আসে নি বলে আমি তখন থেকে না-খেয়ে বসে আছি, আর আমি ঘুমোব? আমার ঘুম আসে? চল, ভাঁড়ারের চাবি নে, চাল ডাল বার কর–আমি যাচ্ছি, একবার বউমাকে দেখে এখুনি আসছি–

ওদিকে পরমেশ মৌলিকও চণ্ডীমণ্ডপের কাজ সেরে হারিকেন বাতিটা জ্বালিয়ে সবে আবার হিসেবের খাতায় মন দিতে যাচ্ছে এমন সময় থানা থেকে একজন চৌকিদার এলো দৌড়তে দৌড়তে।

–সেরেস্তাদারবাবু! সেরেস্তাদারবাবু!

বংশী ঢালী চণ্ডীমণ্ডপের পেছনের ঘরখানাতেই তখন রান্না চড়িয়েছিল। থানার চৌকিদারের গলা শুনে সেও চমকে উঠেছে। ছোটবাবু নেই, এই সময়ে আবার থানার চৌকিদার আসে কেন? বাইরে বেরিয়ে দেখলে শুধু থানার চৌকিদার নয়, রেলবাজার থানার দারোগাবাবুও এসেছে।

–কী খবর বংশী? তোর ছোটবাবু কোথায়?

পরমেশ মৌলিকই জবাব দিলে–আজ্ঞে তিনি তো রাণাঘাটের সদরে গেছেন, মামলার দিন পড়েছে কাল–

–কর্তাবাবু?

–তাঁর তো অসুখ। সকাল থেকে মুখে কথা আটকে গেছে। ননী ডাক্তারবাবু দেখছেন। যায়-যায় অবস্থা তাঁর।

–তাহলে আর কে আছে বাড়িতে?

-শালাবাবু আছে, প্রকাশ মামা। তাঁকে ডাকবো?

–না, তাকে দিয়ে হবে না। সে আবার একটা মানুষ নাকি?

তারপর কী ভেবে দারোগা আবার বললে–তা তাঁকেই ডাকো একবার, কথাটা তাঁকেই বলে যাই, খুব জরুরী কথা ছিল–

বংশী ঢালী গিয়ে কর্তাবাবুর ঘর থেকে শালাবাবুকে ডেকে নিয়ে এল। প্রকাশ মামা আসতেই দারোগাবাবু বললে–কেউ যখন বাড়িতে নেই তখন আপনাকেই বলে যাই, সদানন্দ অ্যারেস্ট হয়েছে–

–সদানন্দ? অ্যারেস্ট হয়েছে? সে কোথায়? তাকেই তো আমি সকাল থেকে গরু খোঁজা করেছি, সে খায় নি দায় নি। দিদিও তার জন্যে সারাদিন জলগ্রহণ করে নি, একেবারে উপোস করে রয়েছে। কোথায় ছিল সে?

–কালীগঞ্জে!

–কালীগঞ্জে? কালীগঞ্জে কোথায়?

দারোগাবাবু বললে–কালীগঞ্জের সেই জমিদারের পোড়ো ভাঙা বাড়ির মধ্যে। আরও পাঁচজন ডাকাতদের সঙ্গে ছোটবাবুর ছেলেও ধরা পড়েছে। স্বরূপগঞ্জের ট্রেন ডাকাতির মামলার সব আসামী ওইখানে ছিল। পুরো দলটা একেবারে একসঙ্গে ধরা পড়ে গেছে–

প্রকাশ হতভম্ব হয়ে গেল। এ আবার কী উটকো বিপদ! এখন জামাইবাবু নেই, এখন এসব কে সামলাবে? বললে–তা সদা–সদা কেন ধরা পড়লো? সদাও কি ডাকাতি করেছে নাকি?

.

তা স্বরূপগঞ্জের ট্রেন ডাকাতির কথা নবাবগঞ্জের লোক জানতো। শুধু নবাবগঞ্জ নয়, কেষ্টনগরের ও-অঞ্চলটার সব লোকই অল্পবিস্তর জানতো। তা নিয়ে গ্রামে-গ্রামে আলোচনাও হয়েছিল। সে এক ভীষণ ডাকাতি। স্বরূপগঞ্জ দিয়ে মেল্ ট্রেনটা চলবার সময় হঠাৎ একদিন থেমে গিয়েছিল। রাত তখন কত কে জানে। প্যাসেঞ্জাররা ঘুমে অচৈতন্য। হঠাৎ পিস্তলের গুলির দুমদুম আওয়াজ শুনে সবাই জেগে উঠে ভয়ে থর-থর করে কাঁপতে লাগলো। এমন তো বড় একটা হয় না। যারা সাহসী লোক তারা জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করলে। কিছুই স্পষ্ট করে দেখতে পেলে না। শুধু দেখলে অন্ধকারে রেল লাইনের ধারে কয়েকজন লোক টর্চ নিয়ে এদিকে-ওদিকে ছুটছে আর গুলি ছোঁড়ার শব্দ হচ্ছে।

তারপর যেন কোন্ কামরা থেকে একটা আর্ত চিৎকার উঠলো।

তার কয়েক ঘণ্টা পরেই আরেকটা ট্রেনে অনেক পুলিস এসে পৌঁছোল। তারা সারা ট্রেনখানাকে তল্লাসী করলে। তারপর ট্রেনটা আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালো স্বরূপগঞ্জে। ততক্ষণে স্টেশনের প্লাটফরমে সেই অত রাত্রে অনেক ভিড় জমে গেছে। পুলিসে-পুলিসে জায়গাটা একেবারে ছেয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কৌতূহলী প্যাসেঞ্জারদের প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল–ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে নাকি দেড় লক্ষ টাকা ডাকাতরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

যারা ডাকাতি করেছে তারা নাকি ঠিক ডাকাত নয়। স্বদেশী কোন্ পার্টি!

এ-সব কয়েক মাস আগেকার ঘটনা। এ ঘটনার পর কর্তাবাবু খুব সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। খবরের কাগজটা যখন পড়িয়ে শুনিয়েছিল কৈলাস তখন কর্তাবাবু খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। যাদের কিছু আছে তাদেরই খোয়া যাবার ভয় থাকে। যাদের বেশি আছে তাদের আবার বেশি খোয়া যাবার ভয়। কর্তাবাবু সেই বেশি থাকার দলে। তাই তাঁর ভয়টাই আরো বেশি করে হয়েছিল।

তার পরে সপ্তাহে দু’বার যখনই কাগজ এসেছে তখনই কর্তাবাবু কৈলাসকে খুঁচিয়েছেন–কৈলাস, সেই ডাকাতদের কথা আর কিছু লেখে নি কাগজওয়ালারা?

কৈলাস তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সে-সম্বন্ধে আর কিছু নতুন খবর পায় নি। প্রত্যেকবারই বলেছে-আজ্ঞে না কর্তাবাবু–

এমনি প্রত্যেকবার। দেখতে দেখতে কত মাস কেটে গেল। তারপরে অন্য খবরের তলায় স্বরূপগঞ্জের ডাকাতির খবর একদিন চাপা পড়ে গেল। কর্তাবাবুর মনে হলো সব ঠিক হয়ে গেছে। আর কিছু হবে না। এবার শান্তি। এবার তাঁর জমি-জমা-টাকা-কড়ি আর কেউ কেড়ে নেবে না। এবার থেকে তিনি নিশ্চিন্তে নিরুপদ্রবে পৃথিবীর সব উপকরণ ভোগ-দখল করতে পারবেন। হয়ত তাঁর পা-ও একদিন আবার ভালো হয়ে যাবে। আবার তিনি হেঁটে চলে ঘুরতে পারবেন। তখন তিনি আবার ক্ষেত-খামার চষে বেড়াবেন। তখন আর পৃথিবাতে ডাকাত থাকবে না।

কিন্তু আশ্চর্য, তাঁর আশেপাশে তখন কেউ-ই আর বলবার ছিল না যে আসলে তিনিও একজন ডাকাত। তিনিও একদিন ওই স্বরূপগঞ্জের ডাকাতদের মতই ডাকাতি করেছেন। ডাকাতি করেই এই সংসার-সম্পত্তি-জমি-জমা করেছেন। স্বরূপগঞ্জের ডাকাতরা ট্রেন ডাকাতি করেছে আর তিনি করেছেন কালীগঞ্জের জমিদারি ডাকাতি। এ ডাকাতি আর ও-ডাকাতিতে যে কোনও তফাৎ নেই তা বোঝবার মত চেতনা ছিল না কর্তাবাবুর। আর কর্তাবাবুরই বা দোষ কী! কর্তাবাবুর চেয়েও যারা আরো বেশি বড় ডাকাত তাদেরই কি সে চেতনা থাকে? ইতিহাসের তো ওই একটাই শিক্ষা। আমরা তো ইতিহাস পড়েই শিখি যে ইতিহাস পড়ে আমরা কোন শিক্ষাই নিই না। নইলে এই কর্তাবাবুর বংশেই বা এই কালাপাহাড় সদানন্দর জন্ম হলো কেন!

ইতিহাসেই লেখা আছে আড়াই হাজার বছর আগে আর এক দেশে আর এক জমিদার বংশে আর এক সদানন্দর জন্ম হয়েছিল। সেই ছেলেরও সেই কর্তাবাবু একদিন পরমা রূপসী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। সেই সদানন্দর জন্যেও অনেক আদর অনেক যত্ন অনেক বিলাসের উপকরণের আয়োজন হয়েছিল, কিন্তু এই সদানন্দর মত সেই সদানন্দরও সেদিন মন ভরে নি। তারও মনে প্রশ্ন জেগেছিল–এ অন্যায়, এ পাপ! এই অন্যায় আর এই পাপের প্রতিকার চাই–

এই বলে কপিলাবস্তুর সেই সদানন্দও একদিন সব আয়োজন-উপকরণ-পত্নী-প্রিয়জন সবাইকে ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল।

নবাবগঞ্জের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই সদানন্দরও সেদিন মনে হলো–এ অন্যায়, এ পাপ। এই অন্যায় আর এই পাপের প্রতিকার চাই–এই বুজরুক, এই ভণ্ড, আর এই মিথ্যের সৌধ ছেড়ে সে রাস্তায় নামবে।

সকালবেলাই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সে। প্রকাশ মামা খানিক দূর পর্যন্ত এসেছিল। বলেছিল–কোথায় যাচ্ছিস তুই?

তারপর নিজেই আবার বলেছিল–তোকে নিয়ে দেখছি মুশকিল হলো আমার, এই সব দায়িত্ব দেখছি শেষকালে আমার ঘাড়েই পড়লো–

একটু আগে বাড়িতে যে কাণ্ড ঘটে গেছে সেটা তখনও প্রকাশ মামার মনে ছিল। একদিকে দিদির সঙ্গে জামাইবাবুর কথা কাটাকাটি, চাবি নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া, ওদিকে বাবাজীর হেনস্তা, আর তার ওপর কর্তাবাবুর হঠাৎ অসুখ। তারপরে ননী ডাক্তারকে ডাকতে যাওয়া। যত রকমের ঝঞ্ঝাট শুরু হয়ে গেল ওই নতুন বউ বাড়িতে আসবার পর থেকেই। তাহলে ওই বউটাই আসলে অপয়া।

আর সদানন্দর সঙ্গে বেশি দূর যাবার সময় ছিল না। প্রকাশ মামা ফিরলো। দূর হোক গে, সকাল থেকে তখনও প্রকাশ মামার কিছু পেটে পড়ে নি। না-খেয়ে ভাগ্নের পেছন পেছন কত ঘোরা যায়? ও তো একটা বাউণ্ডুলে মানুষ, ও খালি পেটে ঘুরতে পারে। কিন্তু প্রকাশের তো তা চলবে না। খাওয়া চাই, পেটটা আগে ভরানো চাই।

বললে–আমি আর যাবো না তোর সঙ্গে–তুই কখন আসছিস?

সদানন্দ সেকথার উত্তর না দিয়ে যেমন চলছিল তেমনিই চলতে লাগলো।

প্রকাশ মামা আবার বাড়িতে ফিরলো। বাড়ি নয় তো যেন আগুন। সেখানে ফেরা মানে আগুনের মধ্যে ফেরা। তবু না ফিরে উপায়ই বা কী! এমন হাত পাতলেই টাকা কোথায় পাওয়া যাবে? ভাগলপুরে গেলে তো আর এমন আরাম নেই। সেখানে সেই বউ-ছেলে মেয়ের ঝামেলা। আজ এটার অসুখ, কাল সেটার। এখানে দরকার হলে তো দিদির কাছে হাত পাতলুম। সেই টাকা থেকে কিছু পাঠিয়ে দিলুম বউ-এর কাছে। তারা সেখানে খেতে পাক আর না-পাক সেসব তো আমাকে আর চোখ মেলে দেখতে হচ্ছে না।

কিন্তু বাড়িতে এসেই দেখলে খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেছে দিদিতে আর জামাইবাবুতে।

সদানন্দর তখন ওসব সমস্যা নেই। মাথার ওপর আকাশ। বারোয়ারিতলার দিকে গেলে তাদের সেই গাছের তলায় দোকানের মাচার ওপর বসে বসে আড্ডা আর রাত্তিরে সেই মহড়া। তার চেয়ে আরো দূরে চলে চলো। একেবারে নদীর ধারে।

শীতকালে নদীটার চেহারাটাই একেবারে অন্য রকম হয়ে যায়। জল শুকিয়ে আসে তখন। নল-খাগড়ার ডগাগুলো তখন জলের ওপর মাথা তুলে আকাশের দিকে হাত বাড়ায়। যেন জলের বেড়া ডিঙিয়ে তারা সূর্যের নিঃসীমতায় প্রাণ খোঁজে। তখন ইছামতী হেঁটেই পার হওয়া যায়।

নদীটা পার হয়ে একেবারে ওপারে গিয়ে দাঁড়ালো সদানন্দ। যেদিকটায় লোকের ভিড় সেদিকে গেল না সে। আলের পথে রাস্তাটা বেশ ফাঁকা। যতদূর চোখ চাও কেবল ছোলার ক্ষেত। ছোট ছোট আধ ইঞ্চির মত সবুজ ছোলা গাছের চারা। কতকগুলো পাখি ক্ষেতের ওপর বসে বসে কী খাচ্ছিল কে জানে। সদানন্দকে দেখেই তারা ভয়ে উড়ে পালিয়ে গেল।

সদানন্দ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। চেয়ে দেখলে পাখিগুলো আরো দূরে কাদের একটা ক্ষেতের ওপর গিয়ে ঝাঁক বেঁধে বসলো। সদানন্দ কী করবে বুঝতে পারলে না। ওর পাশ দিয়েই রাস্তা। ওখান দিয়ে গেলে তো আবার পাখিগুলো ভয় পাবে। আবার উড়ে যাবে।

সদানন্দ সেখানে দাঁড়িয়েই বললে–আমি কিছু করবো না রে, তোদের কিচ্ছু ভয় নেই, তোরা খাচ্ছিস খা–

পাখীগুলো তার কথা বুঝতে পারলে কিনা কে জানে। তারা ঝাঁকে ঝাঁকে সবাই নিশ্চিন্ত মনে ছোলা গাছের কচি পাতা খেতে লাগলো। সদানন্দর নিজেরও ক্ষিধে পেয়েছিল। কিন্তু পাখিদের খেতে দিয়ে তার নিজের ক্ষিধেই যেন মিটে যেতে লাগলো। খা, খা, তোরা খা। যাদের ছোলার ক্ষেত তাদের অনেক আছে। তারা অনেক কপিল পায়রাপোড়া অনেক মানিক ঘোষ আর অনেক ফটিক প্রামাণিককে খেতে না দিয়ে উপোস করিয়ে মেরে ফেলেছে। তারা অনেক কালীগঞ্জের অনেক বউ-এর অনেক সর্বনাশ করেছে। ও ক’টা খেলে তাদের কোনও ক্ষতি হবে না। তোরা গরীব, তোদের বরং খাওয়াবার কেউ নেই। তোরা খা, পেট ভরে খা। আমি কিছু বলবো না। এখানে কর্তাবাবুরাও নেই, চৌধুরী মশাইরাও নেই, কৈলাস, দীনু, প্রকাশ মামা, মা কেউই নেই। কেবল আমি আছি। আমি তোদের কিছু বলবো না। আমিও তোদের মতন, জানিস। খা, খা, তোরা খুব খা–

তারপর নলগাড়ির মাঠ, বউমারীর বিল, একটা খেজুর গাছ। দুটো গরু। তারও পরে ওমরপুর। তারপরে শুধু আকাশ। কেবল আকাশ আর আকাশ। আর আকাশের ওপারে?

–কে?

কখন যে হাঁটতে হাঁটতে সে কালীগঞ্জে এসে পড়েছে তা তার নিজেরই খেয়াল ছিল না। কখন যে সূর্য ডুবে গেছে তারও খেয়াল ছিল না তার। একেবারে কালীগঞ্জের বাজারের কাছে এসে পড়েছিল।

–আমি।

–আমি কে?

সদানন্দ বললে–আমি সদানন্দ।

–কোথায় বাড়ি তোমাদের?

–নবাবগঞ্জে

বলে আর দাঁড়ালো না সেখানে সদানন্দ। শেষকালে হয়ত কুলুজীর পরিচয় দিতে হবে। বলতে হবে কেন সে এখানে এসেছে। কেন সে এখানে প্রায় আসে। নবাবগঞ্জের হরনারায়ণ চৌধুরীর ছেলের এখানে আসার দরকারটা কী? জিজ্ঞেস করলে সে কী উত্তর দেবে? কী উত্তর দেওয়া তার উচিত? আর উত্তর আছেই বা কি ছাই যে সে উত্তর দেবে! কেন যে সে ঘুরে ঘুরে কালীগঞ্জে আসে তা কি সে নিজেই জানে? সত্যিই তো, কেন সে এখানে আসে! সমস্ত মাঠ-ঘাট-প্রান্তর অতিক্রম করে এখানে এই কালীগঞ্জে?

হাটের একটা কোণে তখন বেশ ভিড় হয়েছে। চারিদিকে গোল হয়ে লোক দাঁড়িয়ে। ভেতর থেকে একটা মেয়েলী গলার গান ভেসে আসছে–

আগে যদি সখি জানিতাম।
শ্যামের পীরিত গরল মিশ্রিত
কারো মুখে যদি শুনিতাম ॥
কুলবতী বালা হইয়া সরলা
তবে কি ও-বিষ ভখিতাম ॥

আরে, এ তো সেই গান! বহুদিন আগে সেই রাণাঘটের সদরে রাধার মুখে শোনা। প্রকাশ মামা যাত্রা-শোনার পরে রাত দুটোর সময় তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তবে কি ও-বিষ ভখিতাম মানে খাইতাম! সদানন্দ সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গানটা শুনলো। আসলে গান শুনলো না! মনে হলো সে তার নিজেরই মনের কথা যেন শুনতে লাগলো। আগে যদি কালীগঞ্জের বউ জানতো যে বিয়েবাড়িতে গেলে তাকে এমন করে গুম খুন করে ফেলবে তাহলে কি সে নবাবগঞ্জে যেত! কপিল পায়রাপোড়া যদি জানতো তাকে বারোয়ারিতলায় একদিন গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হবে তাহলে কি সে কর্তাবাবুর নাতিকে বিনে পয়সায় রবারের বেলুন উপহার দিত! এই রকম কত যদি আছে তার জীবনে। কর্তাবাবু যদি বলতো যে কালীগঞ্জের বউকে টাকা দেবে না তাহলে সদানন্দ বিয়ে করতেই কি যেত! আর নয়নতারার বাবাই যদি জানতো যে টাকা না দিলে জামাই তার মেয়ের সঙ্গে ঘর করবে না তাহলে কি সদানন্দর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিত।

অথচ ইতিহাসের পাতায় তো সবই লেখা আছে। তারও আগে হাজার হাজার সদানন্দ তো এমনি করেই সংসারের সঙ্গে কত অসহযোগিতা করেছে। কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদন তো অনেক চেষ্টা করেছে সিদ্ধার্থকে ঘরে ফিরিয়ে আনবার জন্যে। নদীয়ার শচীমাতাও তো অনেক সাধ্য-সাধনা করেছে নিমাইকে সংসারী করবার জন্যে। আসলে ইতিহাসের তো ওই একটাই শিক্ষা। আমরা তো ইতিহাস পড়েই শিখি যে ইতিহাস পড়ে আমরা কিছুই শিখি না। নইলে নবাবগঞ্জের এত বংশ থাকতে কালীগঞ্জের নায়েব নরনারায়ণ চৌধুরীর বংশেই বা কেন সদানন্দর জন্ম হলো!

আবার সেই অদ্ভুত গলার শব্দটা–কে?

–আমি!

–আমি কে?

–আমি সদানন্দ।

–কোথায় বাড়ি তোমাদের?

–নবাবগঞ্জে।

কে কথাটা জিজ্ঞেস করলে, কোথা থেকে জিজ্ঞেস করলে, কিছুই বোঝা গেল না। তখন বেশ আবছা অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিকে। কালীগঞ্জের জমিদারের বাড়ির ভেতরে কতদিন সে লুকিয়ে ঢুকেছে, কতদিন এখানে কত সময় কাটিয়ে গিয়েছে। বাড়ি থেকে বেরিয়েই এখানে চলে এসেছে সকলের চোখের আড়ালে। এখানে এসে নিরিবিলিতে কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে দু’ দণ্ড কথা বলেছে, কিন্তু এমন করে কেউ কখনও তার নাম-ধাম জিজ্ঞেস করে নি, এমন করে তাকে চ্যালেঞ্জও করে নি।

কিন্তু এ-সময়ে এরা কারা?

হর্ষনাথ চক্রবর্তীর বাড়ি সহজ বাড়ি নয়। এককালে পয়সা ছিল তাঁর প্রচুর, জমিও ছিল প্রচুর। কিম্বা হয়ত কর্তাবাবুর মত কপিল পায়রাপোড়া, মাণিক ঘোষ আর ফটিক প্রামাণিকদের ঠকিয়েই তিনি পয়সা করেছিলেন। কিন্তু শেষ জীবনে আসক্তি ত্যাগ করে নবদ্বীপবাসী হতে গিয়েছিলেন হয়ত সেই কারণেই। আর হয়ত নরনারায়ণ চৌধুরীর মত নায়েব না থাকলে এ বাড়ির এমন দশাও হতো না। অর্থ আর প্রতিপত্তির শিখরে যখন তিনি উঠেছিলেন তখন তিনি এই বাড়ি করেছিলেন। তাই যতটা না প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি ছিল বাড়ির আয়োজন। যত না মানুষ তার চেয়ে বেশি ছিল ঘর। এবং যত না ঘর তার চেয়েও বেশি ছিল ঘরের আসবাবপত্র। তা আসবাবপত্র বোধ হয় পোড়াবাড়িতে পড়ে থাকার কথা নয়। তাই সেগুলো যথাসময়েই অদৃশ্য হয়েছে। কিন্তু ইট কাঠ? ও-গুলো তো আর একদিনে কাঁধে করে তুলে নিয়ে যাওয়া যায় না, তাই আছে। সেই ভাঙা ইট-কাঠের মধ্যেই সদানন্দ রোজ এসে যেন খানিকক্ষণের শান্তি খুঁজতো। তখন নিরিবিলিতে কালীগঞ্জের বউ-এর সঙ্গে দুদণ্ড কথা হতো। নিজের মনকে উজাড় করে ঢেলে দিত তার কাছে। বলতো–আমি আমার পূর্ব পুরুষের সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো কালীগঞ্জের বউ, তুমি কিছু ভেবো না, আমি প্রায়শ্চিত্ত করবোই–

কিন্তু সেদিন আর তা হলো না। ভাঙা পাঁচিলটা টপকে ভেতরের উঠোনের কাঁটাঝোপ মাড়িয়ে যখন সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দোতলার উঠেছে তখনই কাদের ফিসফিস আওয়াজ শুরু হয়েছিল।

–কে?

–আমি!

–আমি কে? কোথা থেকে আসছো তুমি?

–আমি সদানন্দ, নবাবগঞ্জে থাকি।

তারপর যারা এতক্ষণ অদৃশ্য ছিল তারা একে একে সবাই সামনে বেরিয়ে এল। একেবারে চার-পাঁচ জন। সবাই তারই বয়েসী। তারপর তাদের জেরা। কোথায় থাকেন? কেন এখানে আসেন রোজ? এই অন্ধকার ভূতের বাড়িতে আপনার কীসের প্রয়োজন? অনেক কথা তাদের, অনেক জিজ্ঞাসা। কিন্তু তবু মনে হলো তাদের যেন অনেক সন্দেহ।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–কিন্তু আপনারা কারা? আপনাদের তো কোনও দিন এ বাড়িতে দেখি নি?

–আমরা কালীগঞ্জে এসেছিলুম হাট করতে। আজ এখানে হাটবার। কাল সকালে আবার ফিরে যাবো।

তবু সদানন্দর সন্দেহ গেল না। হাট বার তো বাড়িতে যেতে কী! এর আগেও তো অনেক হাট গেছে এই কালীগঞ্জে। কোনও দিন তো তোমরা এখানে আসে নি। তোমরা এখানে খাবে কী! থাকবে কোথায়? ঘুমোবে কোথায়? কতক্ষণ থাকবে?

–আর আপনি? আপনি কী খাবেন? আপনি কোথায় ঘুমোবেন? আপনি বাড়ি যাবেন না?

সদানন্দ বললে–আমি তো রাত্তিরে এখানে থাকি না। আমি নবাবগঞ্জে চলে যাই, নবাবগঞ্জে আমাদের বাড়ি আছে–

তবু সন্দেহ গেল না তাদের। একজন চুপি-চুপি আর একজনকে বললে–ও নিশ্চয়ই পুলিসের লোক—চর–

আর একজন বললে–ওকে ছাড়িস নি, এখানেই আটকে রাখ, বেরিয়েই পুলিসে খবর দিয়ে দেবে–

একজন সদানন্দর দিকে এগিয়ে এল। একজনের হাতে রিভলবার। সদানন্দ তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করছে। ছেলেটা এসে তার দিকে রিভলবারটা তাগ করে বললে–কোথায় যাচ্ছেন?

–বাড়ি।

–বাড়ি, না পুলিসের হেডকোয়ার্টারে? আমরা সব জানি। আপনাকে যেতে দেওয়া হবে না।

সদানন্দ হাসলো। বললে–বেশ তো, এখানেই থাকবো। বাড়ির ওপর আমার এমন কিছু টান নেই যে সেখানে যেতেই হবে–

সবাই অবাক! সদানন্দ যে পুলিসের স্পাই এ-সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহই রইল না তাদের। অতি ধূর্ত না হলে কি এমন কথা কেউ বলে!

–খাবেন কী?

সদানন্দ বললে–খাওয়া? আমার অত ক্ষিধে পায় না–

এবার আরো নিঃসন্দেহ হয়ে গেল সবাই। বললে–তাহলে আপনাকে এই ঘরের মধ্যে রেখে আমরা বাইরে থেকে দরজায় শেকল দিয়ে দেব। তারপর সেই ভোরবেলা আবার দরজা খুলে দেব।

ঠিক আছে। তাই সই। তেমনি করেই তাকে ঘরের মধ্যে রেখে তারা বাইরে থেকে দরজায় শেকল দিয়ে চলে গিয়েছিল।

তারপর সেই কাণ্ডটা ঘটলো। সেই পোড়োবাড়ির পরিত্যক্ত একটা ঘরে। মনে আছে সদানন্দের জীবনে এর পরে অনেক কাণ্ডই ঘটেছে। কিন্তু সেদিনকার সেই ঘটনার যেন আর তুলনা নেই। যে-মানুষ একদিন আসামী হয়ে কাঠগড়ায় উঠবে, তার শুরু অনেক দিন আগে থেকেই অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল। কেমন করে সে এই পৃথিবীটাকে নিজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে এইটেই ছিল তার সব চেয়ে বড় সমস্যা। অথচ সবাই চাইতো তাদের সঙ্গেই সদানন্দ নিজেকে খাপ খাইয়ে নিক। সেখানেই তো ছিল তার যত বিরোধ। সেই বিরোধটাই সেইদিন প্রথম মোটা আকারে ধরা পড়লো সেই কালীগঞ্জের পোড়ো বাড়িটাতে।

হঠাৎ কখন কে জানে ঝনাৎ করে একটা শব্দ হয়ে দরজাটা খুলে গেল। আর খুলে যেতেই সদানন্দ দেখলে একগাদা পুলিস তার সামনে। তারা সবাইকে ধরে ফেলেছিল। এবার তাকেও তারা ধরে ফেললে। সদানন্দ কোনও প্রতিবাদ করলে না। পালাতেও চেষ্টা করলে। না। যে-অপরাধে আর পাঁচজন ধরা পড়লো, তার অপরাধও সেই একই। এর জন্যে তার কৈফিয়ৎ চাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, কেবল শাস্তির প্রশ্নই ওঠে। সেই ঘরখানার সামনে দাঁড়িয়েই যেন সদানন্দর ওপর শেষ বিচারের দণ্ড নেমে এলো। যেমন করে দণ্ড নেমে এসেছিল নবাবগঞ্জে তাদের নিজেদের বাড়িতে।

তারপর ছ’জনকেই হাতে হাতকড়া পরানো হলো। পুলিসের দল আসামীদের সকলকে নিয়ে সদরে চালান দিয়ে দিলে।

জিনিসটা এত তাড়াতাড়ি আর এত রোমাঞ্চকর ভাবে ঘটলো যে কাউকে যেন কিছু ভাবতেও সময় দিলে না।

.

প্রকাশ চণ্ডীমণ্ডপ থেকে একেবারে সোজা রান্নাবাড়ির দিকে ছুটলো। নয়নতারার রাতটা যেমন কাটে নি, দিনটাও তেমনি না কাটবার কথা। অন্য দিনের মত আবার তার রাত আসবে। দিনের পর রাত আসার নিয়ম আছে বলেই আসবে। অথচ রাতের কথা ভাবতেই নয়নতারার যেন আতঙ্ক হলো! আবার কি রাত আসবে? আবার কি সেই পুনরাবৃত্তি? আবার সেই অপমান! আবার সেই পোড়া মুখ ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হবে! সে-কথা ভাবতেও যেন ভয় লাগছিল নয়নতারার।

অথচ নতুন বউ সে এবাড়িতে। এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করা নতুন বউ-এর ধর্ম নয়। তার ধর্ম সমস্ত কিছু মান-অপমান অনাদর-আঘাত মুখ বুজে হজম করা। তোমাকে সবাই যা খুশী বলুক তোমার কর্তব্য চুপ করে থাকা। এখানে আসার আগে মা তাকে এই কথাই শিখিয়ে দিয়েছিল। তার মনে হলো মা যদি এখন বেঁচে থাকতে তো তাকে নয়নতারা জিজ্ঞেস করতো–মা, তুমি যদি আমার মত অবস্থায় পড়তে তো তুমি কী করতে? তুমিও কি আমার মত সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করতে? এমনি করে সমস্ত সহ্য করেই তুমি তোমার নারী-ধর্ম পালন করতে?

কিন্তু মা যখন নেই তখন এ-প্রশ্ন কাকেই বা সে করবে আর কে-ই বা এর উত্তর দেবে?

হঠাৎ বাইরে মামাশ্বশুরের গলা শোনা গেল–দিদি শুনেছ, সব্বনাশ হয়েছে–

শাশুড়ী সারাদিন খায় নি। তবু একটার পর একটা সর্বনাশ হয়ে হয়ে চরম সর্বনাশের গুরুত্বও বোধ হয় তার শাশুড়ীর কাছে তখন কমে গিয়েছিল। কিম্বা হয়ত সব রকম সর্বনাশের জন্যেই মনটাকে কঠোর করে নিয়েছিল তার শাশুড়ী।

নিরুদ্বেগ গলায় প্রীতি বললে–কী?

প্রকাশ বলল–সদার খোঁজ পাওয়া গেছে–

–পাওয়া গেছে? কোথায়? কোথায় ছিল সে?

প্রকাশ বললে–এই এখখুনি রেলবাজারের দারোগাবাবু এসেছিল, পুলিস-টুলিস নিয়ে। সদাকে পুলিস এ্যারেস্ট করেছে। সে নাকি স্বরূপগঞ্জের ট্রেন-ডাকাতির দলের সঙ্গে ধরা পড়েছে

–ট্রেন ডাকাতি? বলছিস কী তুই? সদা করবে ডাকাতি?

–আমিও তো শুনে তাই অবাক! এখন কী করবো তা বুঝতে পারছি না। সদা হঠাৎ ডাকাতিই বা করতে যাবে কেন? স্বরূপগঞ্জের ট্রেনে তো স্বদেশীরা ডাকাতি করেছিল শুনেছি। সে মাঝখান থেকে তাদের সঙ্গে জুটল কী করে?

প্রীতির তখনও বিশ্বাস হলো না কথাটা।

বললে–তুই ঠিক শুনেছিস তো? আমার ছেলে ডাকাতি করবে? আমার ছেলের কি টাকার অভাব যে ডাকাতি করতে যাবে সে? তাহলে এখন কী হবে?

প্রকাশ বললে–এ তো মহা মুশকিল হলো দেখছি। জামাইবাবু নেই, এই সময়েই কিনা যত ঝামেলা। আমি একলা মানুষ। কর্তাবাবুকে দেখবো, না সদাকে সামলাবো! কী করি বল দিকিনি এখন?

প্রীতি কথাটা শুনে সেখানেই বসে পড়লো। বললে–আমি সারাদিন খাই নি, আমার মাথাটা ঘুরছে, আমি কিছু ভাবতে পারছি না–

–তা আমিই কি ছাই কিছু ভাবতে পারছি! তা থাক গে, তুমি খেয়ে নাও, বুঝলে? খেলে তবু একটু বুদ্ধি বেরোবে। তা বাবাজীর কাছে একবার যাবো? দেখবো বাবাজী কী বলে?

প্রীতি বললে–তুই আর হাসাস নি! থাম্। তা হ্যাঁরে, তাকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা যায় না?

প্রকাশ বললে–আমি তো জীবনে কখনও জামিন-টামিন হই নি–কে জামিন দাঁড়াবে?

–তা পুলিসকে টাকা দিলে পুলিস তো কেস ছেড়েও দেয়। কত টাকা লাগে একবার জিজ্ঞেস করে আয় না। পুলিস তো আমাদের হাত-ধরা লোক।

প্রকাশ বললে–পুলিস তো চলে গেছে। খবরটা দিয়েই চলে গেছে

প্রীতি বললে–তুই তাহলে একবার এখুনি রেলবাজারে যা ভাই। হয়ত রাস্তাতেই তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে

–তাহলে টাকা দাও।

–কত টাকা দেব?

প্রকাশ বললে–পাঁচশো, হাজার, যা আছে তোমার কাছে দিয়ে দাও, ডাকাতির মামলা তো সস্তায় হবে না–

প্রীতি আর দাঁড়ালো না। তার শোবার ঘরেই সিন্দুক থাকে। সিন্দুকের তলায় গোছা গোছা নোট থাকে। একগাদা নোট বার করে গুনে বাইরে নিয়ে এল।

–কত আছে এতে?

–চারশো তিরিশ টাকা।

–এতে কি হবে?—

ওতে যা আছে এখন তাই নিয়ে খোকাকে ছাড়িয়ে নিয়ে তো আয়। তারপর তোর জামাইবাবু এলে বেশি দিতে পারবো।

প্রকাশ টাকা নিয়ে কোথায় চলে গেল।

ঘরের ভেতরে নয়নতারার কানে সব কথাগুলোই গিয়েছিল। শুনতে শুনতে যেন পাথর হয়ে গেল সে। এ কী হলো? এমন তো হবার কথা নয়। এ কোথায় কার সঙ্গে তার বিয়ে হলো! আস্তে আস্তে সে নিজের ঘর থেকে বেরোল। তারপর পায়ে পায়ে রান্নাবাড়ির কাছে এল।

–মা।

প্রীতির কানে গেছে কথাটা।

–কী বউমা? কিছু বলবে?

নয়নতারা বললে–কী হয়েছে মা? আপনারা কী বলাবলি করছিলেন?

–ও, তুমি শুনেছ সব?

নয়নতারা বললে–শুনেছি। এত বড় একটা কাণ্ড হলো, বাবাকে একটা চিঠি দেব?

–চিঠি? প্রীতি যেন কী ভাবলে। তারপর বললে–চিঠি দিয়ে আর কী হবে বউমা, এই তো তত্ত্ব নিয়ে তোমার বাপের বাড়ির লোকেরা সব গেল। এখনও বোধহয় তারা কেষ্টনগরেই পৌঁছোয় নি। তারা তো দেখেই গেছে তুমি ভালো আছো–

নয়নতারা বললে–মা, আমার কথা নয়। বাবা যদি শেষকালে বলেন, ওঁর এত বড় একটা বিপদ গেল আর তোরা কেউ আমায় একটা খবরও দিলি নে তখন? শেষকালে তো আমাকেই দোষ দেবেন।

প্রীতি বললে–তাঁকে বুড়ো মানুষকে আবার কেন মিছিমিছি ভাবাবে? তিনি তো সেখানে বসে এর কিছু সুরাহা করতে পারবেন না। উলটে মিছিমিছি তাঁর উদ্বেগ বাড়ানো। আর যা করবার তা তো আমরা এখান থেকেই করতে পারবো

নয়নতারা বললে–আমার মনে হচ্ছিল বাবাকে খবরটা দিলে ভালো হতো, শেষে জানতে পারলে আমার ওপর রাগ করবেন

প্রীতি বললে–তাহলে আর দুটো দিন সবুর করো বউমা। তোমার শ্বশুর তো রাণাঘাট থেকে পরশু ফিরছেন, তিনি এলে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে যা-হয় একটা কিছু করা যাবে। আর এ তো সাজানো মামলা বউমা! বোঝাই যাচ্ছে। সদার মত ছেলে ডাকাতি করতে যাবে এ কেউ বিশ্বাস করবে? তুমিই বলো না, তুমিও তো তাকে দেখেছ। আর কীসের জন্যে ডাকাতির মধ্যে থাকবে সে? তার এত কীসের টাকার দরকার পড়লো যে ডাকাতির মধ্যে যাবে সে?

নয়নতারা শাশুড়ীর কথার যুক্তি হয়ত বুঝলো, হয়ত বা বুঝলো না। আর যুক্তিটা যত ধারালোই হোক, শাশুড়ীর কথার ওপরে কথা বলা কি তার মানায়?

নয়নতারা আবার নিঃশব্দে তার নিজের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে ঢুকে গেল।

.

সকালবেলা নিখিলেশ তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। বাইরে থেকে ডাক এলো–নিখিলেশ, নিখিলেশ—

শেষ রাত্রের ঘুম। আসলে ঘুম নয়, তন্দ্রা। গলার আওয়াজটা শুনেই নিখিলেশ ধড়মড় করে উঠে পড়েছে বিছানা থেকে। পণ্ডিতমশাই এত সকালে তাকে ডাকছেন কেন? আর এত কীসের তাড়া যে একেবারে তার বাড়িতে এসে?

বাইরে বেরিয়ে আসতেই নিখিলেশ দেখে একেবারে জামাকাপড়-জুতো পরে পণ্ডিতমশাই দাঁড়িয়ে আছেন।

–তুমি ঘুম থেকে উঠেছ নিখিলেশ? আমি ভাবলাম তুমি হয়তো এখনও ঘুমোচ্ছ।

নিখিলেশ বললে–কাল অনেক রাত্তিরে ফিরেছি কলকাতা থেকে–

পণ্ডিতমশাই বললেন–বড় বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি নিখিলেশ। আমি সকালের গাড়িতেই একবার নবাবগঞ্জে যাচ্ছি, তুমি সঙ্গে গেলে ভালো হতো।

–নবাবগঞ্জে? নয়নতারার শ্বশুরবাড়ীতে? হঠাৎ?

পণ্ডিতমশাই বললেন–একটা বড় বিপদের সঙ্কেত পেলাম নিখিলেশ। বিপিনরা নবাবগঞ্জে গিয়েছিল শীতের তত্ত্ব নিয়ে, সে তো তুমি জানো!

–তার অসুখ-বিসুখ নাকি?

–না তা নয়, বিপিনরা তো রেলবাজার স্টেশন হয়ে ফিরছিল। স্টেশনে এসে দেখে একদল পুলিস ডাকাতদের একটা দলকে প্ল্যাটফরমে ধরে নিয়ে অপেক্ষা করছে ট্রেনের জন্যে। স্বরূপগঞ্জের ট্রেন ডাকাতির কথা তোমার মনে পড়ে?

–হ্যাঁ, খুব মনে পড়ে। খবরের কাগজে পড়েছিলুম।

–হ্যাঁ, সেই তাদের দলটাকেই পুলিস নাকি কালীগঞ্জের একটা বাড়ি থেকে ধরে কলকাতায় চালান দিচ্ছে। কলকাতা থেকে তার জন্যে বিশেষ পুলিস এসেছিল। তা সেই ডাকাত দলের মধ্যে নাকি আমার জামাইকেও তারা দেখেছে!

নিখিলেশ চমকে উঠলো–বলছেন কী? নয়নতারার স্বামী? সেও ডাকাতির মধ্যে জড়িয়ে ছিল নাকি?

–তা ওরা তো বললে–জামাইবাবুকে কোমরে নাকি দড়ি বাঁধা অবস্থায় দেখেছে।

নিখিলেশের বিশ্বাস হলো না। বললে–না না, তা কখনও হতে পারে? বিয়ের সময় আমি তো সদানন্দবাবুকে দেখেছি। কথাও বলেছি, সে রকম তো কিছু মনে হয় নি। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। হয়ত অন্ধকার প্ল্যাটফরমে কাকে দেখতে কাকে দেখেছে। অন্য কাউকে জামাইবাবু বলে ভুল করেছে

তারপর একটু ভেবে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলে–আর তাছাড়া বিপিনরা যখন তত্ত্ব নিয়ে নবাবগঞ্জে গিয়েছিল তখন জামাইবাবুকে বাড়িতে দেখে নি?

পণ্ডিতমশাই বললেন–না, তাইতেই তো আমার আরো সন্দেহ হচ্ছে। মেয়েটাকে তবে কি আমি না জেনে-শুনে জলে ফেলে দিলুম নিখিলেশ? ওরা শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করেছে জামাইবাবু কোথায়, তিনি এক রকম উত্তর দিয়েছেন, আবার বেয়াই মশাইকে জিজ্ঞেস করেছে, তিনি আবার তার উল্টো উত্তর দিয়েছেন, আমার মেয়ে আবার আর এক রকম উত্তর দিয়েছে। আমি যেদিন নয়নতারাকে শ্বশুরবাড়িতে রাখতে গিয়েছিলুম সেদিন সকলকেই বাড়িতে দেখলুম, জামাইবাবাজীকে তো কই দেখি নি। তারপর আমার গৃহিণী যখন মারা যান তাঁর শ্রাদ্ধের সময় নয়নতারা এখানেই ছিল, নয়নতারার মামাশ্বশুর এসেছিল নিমন্ত্রন রক্ষা করতে কিন্তু জামাইবাবাজী তো একবারও আসে নি–

কথাটা নিখিলেশকেও ভাবিয়ে তুললো। এর কী জবাব সে দেবে তা বুঝতে পারলে না।

কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–এই সব কথা আমার এখন মনে পড়ছে নিখিলেশ। আগে এসব ভাবিও নি। কাল অনেক রাত্রে বিপিনদের কাছে ঘটনাটা শুনে ভালো ঘুম হয় নি। তখন ট্রেন থাকলে তখনই নবাবগঞ্জে চলে যেতাম। কিন্তু সকালবেলার ট্রেন, ভাবলাম একলা কী করে যাই, তাই তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কথাটা মনে উদয় হলো। তুমি যাবে?

–নিশ্চয় যাবো, আপনি স্টেশনের দিকে যান। আমি তৈরি হয়ে নিয়ে এখুনি বেরোচ্ছি–

কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–আমি তাহলে এগোই, তুমি দেরি কোরো না–

বলে স্টেশনের দিকে চলতে লাগলেন। কেষ্টনগরে তখন ভালো করে রোদ ওঠে নি। ফার্স্ট ট্রেনটা ধরলে রেলবাজারে বেলা দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। সেখান থেকে যদি একটা সাইকেল-রিকশা পাওয়া যায়, তাহলে আর দেরি হবে না। ঘণ্টা দুয়েকেই মধ্যেই একেবারে নয়নতারার শ্বশুরবাড়ি।

খানিক দূর গিয়ে পেছন ফিরে দেখলেন একবার। বাজারের টিনের চালের বাড়িটার একেবারে ওধারে যেন মনে হলো নিখিলেশ হন্ হন্ করে এগিয়ে আসছে। সারা রাত ঘুম হয় নি। মাথাটা কী রকম করছিল। তাড়াতাড়ি হেঁটে আসতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ততক্ষণে নিখিলেশ পণ্ডিতমশাই-এর নাগাল পেয়ে গেছে।

পণ্ডিতমশাই বললেন–এসো, তুমি তো তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছ–খবরটা শোনার পর থেকে আমার মনটা কেমন করছে নিখিলেশ। আমি তো অনেক দেখেশুনেই বিয়ে দিয়েছিলাম নয়নতারার। তোমরা তো জানো নয়নতারার মত মেয়ের পাত্রের অভাব হবার কথা নয়। ওর রূপ গুণ দেখে কত জায়গা থেকে কত সম্বন্ধ এসেছিল, কিন্তু সবগুলো নাকচ করে এখানেই বিয়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বনেদী বংশ, প্রচুর অর্থ। কিন্তু শেষকালে এ কী হলো নিখিলেশ!

নিখিলেশ বললে–আপনি কিছু ভাববেন না, আমি তো যাচ্ছি, গিয়েই সব দেখতে পাবো– বলতে বলতে দুজনেই স্টেশনের প্ল্যাটফরমে গিয়ে উঠলো।

.

একদিন বিয়ের আগে নয়নতারা এই দিনগুলোর কথাই কল্পনা করতো। তখন সবে এখানে বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছিল। বাবা-মার কথাবার্তার টুকরো কথাগুলো মাঝে মাঝে কানে আসতো। নবাবগঞ্জের জমিদার, অনেক ধন-সম্পত্তি তাঁদের। তাঁদের একমাত্র ছেলে। স্বাস্থ্যবান সুন্দর সুপুরুষ। বাবা নিজে গিয়ে দেখে এসে মাকে সব বর্ণনা দিচ্ছিল। শুনতে শুনতে নয়নতারার চোখের সামনে যেন নবাবগঞ্জে তার ভাবী শ্বশুরবাড়ীর চেহারাটা ভেসে উঠছিল। কল্পনায় সে চেহারা দেখে নিজের মনেই একটা নিজস্ব জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছিল সে। বড় বড় ঘর, মস্ত বড় দু’মহলা বাড়ি, আর রাজপুত্রের মত একজন পুরুষ তার স্বামী।

মা জিজ্ঞেস করেছিল–সংসারে কে কে আছে?

বাবা বলেছিল–ওই তো, বাবা আর মা, আর এক বুড়ো ঠাকুরদাদা। খুব সচ্ছল সংসার। চৌধুরী মশাই-এর মত মানুষ হয় না। বললেন–আমার ওই একটিই সন্তান, ওর জন্যেই এই সংসার করা–

মা জিজ্ঞেস করেছিল-পাত্রের বোন-টোন কেউ নেই বুঝি?

–না।

মা শুনে খুব খুশী হয়েছিল–ভালোই হয়েছে, নয়নকে আর ননদ কাঁটা সহ্য করতে হবে না–

তারপর মা একটু পরে জিজ্ঞেস করেছিল–তা পাত্রকে দেখতে কেমন? আমার নয়নের সঙ্গে মানাবে তো?

বাবা বলেছিল–দেখতে নয়নতারার চাইতেও ভালো, যেমন স্বাস্থ্য তেমনি রূপ। যখন বিয়ে করতে আসবে লোকে বলবে–হ্যাঁ, পণ্ডিতমশাই জামাই-এর মত জামাই করেছে বটে–

এ-সব কথা শুনে নয়নতারা সেদিন মনের মধ্যে কল্পনার একটা প্রাসাদ গড়ে তুলেছিল। এরকম কল্পনার প্রাসাদ অনেকেই বিয়ের আগে গড়ে তোলে। শুধু বিয়ে কেন, মানুষ তার সব ব্যাপারেই একটা অলৌকিক আশা করতে ভালবাসে। মনে মনে আশার একটা সৌধও গড়ে তোলে। কিন্তু নয়নতারার মত এমন করে বুঝি কারো আশা ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে নষ্টও হয়ে যায় না।

রাত তখন বেশি হয় নি। সংসারে এত বড় একটা বিপর্যয় হয়ে গেল অথচ সংসারে দৈনন্দিন কাজকর্মের কোনও ব্যতিক্রম হলো না। সকলের সব কাজ ঠিক ভাবেই সমাধা হলো। নয়নতারাকেও খেতে ডাকতে এল গৌরী। এ যেন নিয়মরক্ষে। রাত্রে খেতে হয় বলেই খাওয়া।

প্রীতি তখনও নিজের ঘরে শুয়ে ছিল। গৌরীকে ডাকলে। জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁ-রে, বউমা খেয়েছে?

গৌরী বললে–খেতে চাইছিল না, আমি জোর করে খাইয়ে দিয়েছি। তুমি খাবে?

প্রীতি বললে–না।

গৌরী বললে–না খেলে শরীর টিকবে কেন? খেয়ে নাও।

প্রীতি বললে–তুই আর বকবক করিস নি আমার কানের কাছে, যা,–

কিন্তু গৌরীও ছাড়বার পাত্র নয়। বললে–না, তোমাকে খেতেই হবে। একে বাড়িতে এই কাণ্ড, এর মধ্যে তুমি বাড়ির গিন্নী, তুমি যদি অসুখে পড়ে যাও, তখন তোমার সংসার কে সামলাবে শুনি? আপন বলতে আর কে আছে তোমার যে তোমাকে সেবা করবে?

শেষ পর্যন্ত প্রীতি যা পারে মুখে পুরে দিয়ে আবার উঠে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ শুতে পারলে না। যেন পিঠে কাঁটা ফুটতে লাগলো। আস্তে আস্তে উঠে বউমার ঘরে গেল। ঘরের দরজা খোলা ছিল। নয়নতারা তখনও ঘুমোয় নি। দুজনে দুজনের মুখের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে দেখলে। যেন অনেক কথা রয়েছে দু’জনেরই, কিন্তু বলবার ক্ষমতা নেই কারো। শেষকালে অনেক কষ্টে শাশুড়ীর মুখ দিয়ে একটা কথা বেরোল–

–বউমা, তুমি খেয়েছ?

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, খেয়েছি, আপনি?

শাশুড়ী বললে–আমিও খেলাম বউমা। খোকা কোথায় রইল, সে খেলে কি খেলে না তার ঠিক নেই, কিন্তু আমি মা হয়ে খেলাম। আমার গলা দিয়ে ভাত গললো। আমি মা নই বউমা, আমি রাক্ষুসী। কিন্তু আমার কথা থাক, আমি তোমার কথাই কেবল ভাবছি বউমা। আমি কেন মরতে তোমাকে বউ করে নিয়ে এলাম বউমা, তোমাকে আমি কত কষ্ট দিচ্ছি, অন্য কোথাও বিয়ে হলে তোমার কত সুখ হতো। তুমি কত সুখে থাকতে সেখানে। কেন আমি এ-পাপ করতে গেলাম! এর সব দোষ আমার বউমা, আর কারো নয়, আমার। আমার ওপর তুমি রাগ করো বউমা, রাগ করে আমাকে তুমি কিছু বলো, একটু গালমন্দ দাও, তাতে যদি আমার প্রায়শ্চিত্ত হয়, তাতে যদি আমার কিছু শিক্ষা হয়। এর বেশি আমি আর কী বলতে পারি বলল বউমা? তোমার যা-কিছু কষ্ট তার জন্যে আমিই দায়ী বউমা, আমাকে তুমি ‘মা’ বলেও আর ডেকো না–

বলতে বলতে শাশুড়ী যেন ভেঙে পড়লো।

নয়নতারা শাশুড়ীকে ধরে ফেলে বিছানার ওপর বসিয়ে দিলে। বললে–আপনি চুপ করুন মা, আপনি স্থির হোন–

–না বউমা, আমাকে অমন করে মা বলে ডেকো না আর। আমি তোমার মায়ের কাজ করি নি। আমাকে তুমি ক্ষমা করো বউমা।

নয়নতারা বললে–মিছিমিছি আপনি কেন ও-সব কথা বলছেন মা, ওতে আপনার ছেলের অকল্যাণ হবে–

–ছেলে? তুমি আমার ছেলের কথা বললে? যে ছেলে নিজের বাপ-মার কথা ভাবলে না, নিজের বিয়ে করা বউ-এর দিকে ফিরে চাইলে না, তাকে আমি ছেলে বলবো? সে আমার ছেলে নয় বউমা, সে আমার শত্রু। আমি আমার শত্রুকে পেটে ধরেছিলুম বউমা, সে-ই আমার অপরাধ হয়ে গিয়েছিল–

নয়নতারা শাশুড়ীর হাত দুটো ধরলে–আপনি ঘুমোতে যান মা, সারা দিন আপনার কষ্ট গেছে, এর ওপর রাত জাগলে আপনার শরীর ভেঙে পড়বে–চলুন আমি আপনাকে আপনার ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসছি।

প্রীতি উঠলো। বউমা তাকে আদর করছে এটা তার বড় ভালো লাগলো। এমন লক্ষ্মী বউ পেয়েও কিনা খোকা তার মর্যাদা দিলে না। হাতের লক্ষ্মী এমন করে পায়ে ঠেললে কি তারই ভালো হবে? তা যদি হয় তাহলে তো ভগবানও মিথ্যে, ভগবানের পৃথিবীতে এই সূর্য-চন্দ্র-গ্রহ-নক্ষত্র তাও তো মিথ্যে।

–বউমা!

নয়নতারা শাশুড়ীকে তাঁর নিজের ঘরের ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বললে–বলুন মা–

–তোমার যদি রাত্তিরে একলা শুতে ভয় করে তো তুমি আজ আমার কাছে শোবে? তোমার শ্বশুর তো বাড়িতে নেই।

নয়নতারা বললে–না মা, আমার একলা শুতে ভয় করবে না–

–তাহলে তুমি যদি বলো, আমি তোমার ঘরে গিয়েও শুতে পারি—

নয়নতারা শাশুড়ীকে তাঁর ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললে–না মা, তার দরকার হবে না, আপনি কিছু ভাববেন না, আমার একলা শোওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে। শুধু প্রথম দিনটায় একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম–

শাশুড়ী তখন বিছানায় শুয়ে আর নয়নতারা তার সামনে দাঁড়িয়ে।

নয়নতারা বললে–আমি আলো নিবিয়ে দেব মা?

–না বউমা, তোমাকে কিছু করতে হবে না। গৌরী আছে, খেয়ে উঠে সে-ই সব করে দেবে।

নয়নতারা বললে–তাহলে আমি আসি মা?

–হ্যাঁ এসো। যদি তোমার ঘুম না আসে তো আমাকে ডেকো, বুঝলে? নয়নতারা তার নিজের ঘরের দিকেই চলে আসছিল। শাশুড়ী আবার ডাকলে বউমা,–

নয়নতারা আবার ফিরলো। বললে–আমাকে ডাকছেন মা?

শাশুড়ী বললে–-শোন বউমা, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি তোমাকে। খোকাকে তো জেলে ধরে নিয়ে গেছে, কবে ফিরবে তাও জানি না। আর কোনও দিন ফিরবে কিনা তারও ঠিক নেই। প্রকাশ তো গেছে থানায়, টাকাও নিয়ে গেছে, এখনও তো ফিরলো না। তোমার শ্বশুরও বাড়িতে নেই, তুমি আমার এই চাবিটা তোমার কাছে রেখে দাও

–চাবি? আমি চাবি নিয়ে কী করবো মা?

–তুমি এ বাড়ির বউ, আমি মারা গেলে তখন তো তোমাকেই এ সংসারের ভার নিতে হবে বউমা! তুমি ছাড়া আর তো কেউ নেই যার হাতে সব ভার দিয়ে নিশ্চিন্তে যেতে পারি।

নয়নতারা বলে উঠলো–আপনি কীসব বলছেন মা? আপনার কী হয়েছে যে আপনি এই সব কথা এখন বলছেন? আমি চাবি নেব না

বলে একটু দূরে সরে এল। কিন্তু শাশুড়ী ছাড়লে না। নিজের আঁচল থেকে চাবির গোছটা খুলে জোর করে নয়নতারার হাতে পুরে দিলে। বললে–তুমি এটা নিজের কাছে রাখো বউমা, আমি বলছি তোমাকে, আমি তোমার গুরুজন, আমার কথা অমান্য করতে নেই, তুমি রেখে দাও–

নয়নতারা চাবিটা নিলে। নিয়ে বললে–কিন্তু কেন আপনি অত ভাবছেন, মা। আপনার তো কিছুই হয় নি, আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন–

শাশুড়ী বললে–যদি তেমন কিছু না-হয় তো ভালোই, তখন তোমার কাছ থেকে না হয় আবার আমি চাবি চেয়ে নেব। কিন্তু আমি যা বলছি তোমাকে তা মিথ্যে নয় বউমা। তুমি জানো না, আমার সব সময়ে বুক ধফ-ফড় করে, আমি মাঝে মাঝে টলে পড়ে যাই, কেউ জানে না। যদি তেমন কিছু বিপদ হয় তখন আমার এ-সংসার তুমি ছাড়া আর কে দেখবে বউমা। এ-সংসারের হাতা-বেড়ি-খুন্তিটা পর্যন্ত যে আমার মায়ার জিনিস। যখন যেখানে গেছি কিনে এনেছি। তুমি জানো না, এ আমার বড় সাধের সংসার বউমা, আমার বড় সাধ ছিল ছেলের বিয়ে দিয়ে আমি ঘরে বউ আনবো, এমন বউ আনবো যে লক্ষ্মীপ্রতিমার মত বাড়ি আলো করে রাখবে। নাতিনানীতে বাড়ি একবারে ভরে যাবে। সে-সব একটা সাধও আমার মিটলো না, বোধ হয় এ-সাধ আর জীবনে কখনও মিটবেও না–

হঠাৎ গৌরী এসে ঢুকলো। বললে–কী বউমা, তুমি এখানে?

নয়নতারা বললে–মা আমাকে এই চাবিটা দিলেন

প্রীতি বললে–গৌরী, কাল সকালে ভাঁড়ারের চাবি বউমার কাছ থেকে চেয়ে নিবি, কাজ হয়ে গেলে আবার বউমাকে ফিরিয়ে দিবি

গৌরীও অবাক। বললে–কেন বউদি, তুমি নিজের কাছে চাবি রাখবে না?

নয়নতারা বললে–ওই দেখ না গৌরী পিসী, মা সব কী অলুক্ষণে কথা বলছেন বলছেন উনি আর বাঁচবেন না, আমার হাতে জোর করে চাবির গোছা গছিয়ে দিয়েছেন–

প্রীতি বললে–না রে গৌরী, আমি যা বলেছি ঠিকই বলেছি, আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না রে! এখন থেকে বউমাই তোদের সংসার চালাবে বউমার কাছ থেকেই তোরা চাবি চেয়ে নিস–

গৌরী পিসী প্রীতির দিকে চেয়ে ধমক দিয়ে উঠলো। বললে–তুমি থামো তো বউদি, সারাদিন না খেয়ে খেয়ে তোমার এই রকম হয়েছে, তখন কত বললুম খেয়ে নাও খেয়ে নাও, তা তো শুনলে না। এখন বুক ধড়ফড় তো করবেই। আর কথা বলতে হবে না, এখন ঘুমোতে চেষ্টা করো, আমি আলো নিবিয়ে দিচ্ছি–

তারপর নয়নতারার দিকে চেয়ে বললে–তুমিও শুয়ে পড়ো গে যাও বউমা, তুমি কেন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কষ্ট করবে? আমি তো আছি। আমি আজ এই ঘরের মেঝেতেই বিছানা করে নেব। তুমি তোমার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো গে–

নয়নতারা বললে–কিন্তু এই চাবি?

গৌরী পিসী বললে–চাবিটা তোমার কাছেই রেখে দাও, একটু সাবধানে রেখো। ওই চাবির মধ্যেই এ বাড়ির সব–কাল বিষ্টুর মা এলে আমি তোমার কাছ থেকে চাবি চেয়ে নেব–যাও–

নয়নতারা চাবিটা নিয়ে তার শাড়ির আঁচলে বেঁধে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। তারপর নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

সমস্ত রাতই কেমন যেন আধ-ঘুম আধ-জাগা অবস্থায় কাটলো নয়নতারার। সারাটা বাড়ি নিস্তব্ধ। এই সব নিস্তব্ধতার মধ্যে এতদিন কেবল কেষ্টনগরের কথাই মনে পড়তো তার। কেবল মনে পড়তো বাবার কথা। বাবার কথা আর তার সঙ্গে মার কথা। বিয়ের আগে মা কী বলতো, মা কী করতো।

কিন্তু সেদিন আর তা মনে পড়লো না। শুধু মনে পড়তে লাগলো নবাবগঞ্জের এই বাড়িটার কথা। তার এই শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরের কথা, শাশুড়ীর কথা। যেন একটু মায়া হতে লাগলো শাশুড়ীর জন্যে। সত্যিই তো, তাদের ছেলের অপরাধের জন্যে শ্বশুর-শাশুড়ীর কী দোষ! প্রথম দিন থেকে তারা তো এতটুকু অনাদর করে নি নয়নতারাকে। বরং নয়নতারা কীসে খুশী হয় সেই চেষ্টাই করে এসেছে বরাবর।

অন্ধকারে শুয়ে-শুয়েই এক সময়ে মনে হলো যেন ভোর হচ্ছে। দূর থেকে মুরগীর ডাক কানে এলো। সত্যিই বোধ হয় সকাল হয়ে এলো।

নয়নতারা আস্তে আস্তে উঠলো। উঠে ঘরের বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। পাশের শাশুড়ীর ঘরের দরজা তখনও বন্ধ। কেউ কোথাও নেই। সকালবেলা ক’টার সময় থেকে বাড়ির কাজ শুরু হয় তাও সে জানে না, অথচ তার কাছেই ভাঁড়ারের চাবি।

নয়নতারা আবার তার নিজের ঘরের দিকে চলে আসছিল হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এল–উঠে পড়েছ বউমা?

নয়নতারা পেছন ফিরে দেখল, গৌরী পিসী।

গৌরী পিসী বললে–দাও চাবিটা দাও, দিদি এখনো ওঠে নি, ঘুমোচ্ছে—

নয়নতারা জিজ্ঞেস করলে–মা কেমন আছে এখন?

গৌরী পিসী বললে–সারা রাতের পর এখন একটু ঘুমোচ্ছে-তুমি তৈরী হয়ে নাও, বিষ্টুর মা এখুনি এসে উনুনে আঁচ দেবে। এখন থেকে ভাঁড়ার বের না করলে আবার ওদিকে দেরি হয়ে যাবে–

বলে চাবি নিয়ে তার নিজের কাজে চলে গেল। নয়নতারা গা ধুয়ে কাপড় কেচে স্নান করে যখন রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালো, তখন দেখলে বিষ্টুর মা আর গৌরী পিসী ততক্ষণে অনেক কাজ সেরে ফেলেছে।

নয়নতারা বললে–আমাকে কিছু কাজ দাও পিসী, একলা তুমি সব পারবে না, আমি তৈরি হয়ে এসেছি—

গৌরী পিসী বললে–তুমি তোমার ঘরে যাও বউমা, আমি তোমার ঘরে জলখাবার দিয়ে আসছি–

নয়নতারা বললে– কেন, আমার এখন ক্ষিধে পায় নি, তোমার যদি কিছু কাজ থাকে বলো–আমার তো কোনও কাজ নেই, চুপ করে ঘরে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না—

গৌরী পিসী বললে–বসে থাকতে ভালো লাগছে না বলে তুমি এই ধোঁয়ার মধ্যে বসে থাকবে? তা যদি ভালো লাগে তো এই পিঁড়িটা নিয়ে বোস।

গৌরী পিসী আর বিষ্টুর মা দুজনে দু’হাতে কাজ করছে। নয়নতারা বসে বসে দেখতে লাগলো সব। জলখাবার গেল চণ্ডীমণ্ডপে। যাবে দোতলায় কৈলাস গোমস্তার কাছে। কর্তাবাবুর অসুখ তাই তার কাছে যাওয়ার কথা ওঠে না। তারপর দীনু আছে, বংশী ঢালীরা আছে। জলখাবারের পাটের পর ভাত ডাল তরকারি। বিষ্টুর মা রাঁধছে আর তরকারি কুটছে গৌরী পিসী। সারা বাড়ির লোক খাবে। অথচ রান্না করার লোক কম। প্রতিদিন এমনি করেই চলে এসেছে, এমনি করেই হয়ত আবহমান কাল ধরে চলবে। নয়নতারাও এদেরই একজন হয়ে গেছে এখন। তার জীবনও একদিন এই সংসারের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে।

হঠাৎ হইচই আওয়াজ করতে করতে প্রকাশ মামা এসে বাড়ির মধ্যে ঢুকলো। বললে–কই, দিদি কোথায়? দিদি—দিদি–

নয়নতারা মামাশ্বশুরের গলার শব্দ পেয়েই নিজের শোবার ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে নিলে। কিন্তু তার আগেই প্রকাশ মামা একেবারে রান্নাঘরে এসে হাজির।

গৌরী পিসী বললে–বউদির শরীর খারাপ, শুয়ে আছে।

–শরীর খারাপ? এই সময়ে কিনা শরীর খারাপ করে বসলো দিদি? বলতে বলতে দিদির ঘরে গিয়ে হাজির। চেঁচামেচিতে প্রীতির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।

বললে–কী হলো? খোকার খবর পেলি কিছু?

প্রকাশ মামা বললে–খোকার খবর না নিয়ে কি এসেছি? কিন্তু তুমি কেন এই কাজের সময় শরীর খারাপ করে বসলে বলো দিকিনি? এই সময়েই কিনা শরীর খারাপ করতে হয়? আসলে খাওয়াটা তোমার কম হচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি–

–আমার শরীরের কথা থাক, খোকার খবর কিছু পেলি কিনা তাই বল্।

প্রকাশ বললে–আমাকে শিগগীর শিগগীর খাবার দিতে বলো। আমি আবার এখনি কলকাতায় যাবো। এই কলকাতা থেকে আমি আসছি এখন–

–খোকা কি কলকাতায় নাকি?

প্রকাশ বললে–হ্যাঁ, শুনলুম কলকাতার জেলখানায় তাকে পুলিস আটকে রেখেছে। রেলবাজারের থানায় থাকলে এতক্ষণ তো তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতুম। কিন্তু তাকে যে কলকাতার পুলিস ধরে নিয়ে গেছে। শুনে কাল সন্ধ্যেবেলাই আমি কলকাতায় চলে গেলুম। সেখানে গিয়ে আসল ব্যাপারটা সব শুনলাম।

বলে আদ্যোপান্ত যা-যা ঘটেছিল সব বলে গেল প্রকাশ মামা।

–খোকার সঙ্গে দেখা হলো তাহলে?

প্রকাশ মামা বললে–কী করে দেখা হবে? তুমি টাকা দিয়েছ?

–কেন? তুই যে চারশো তিরিশ টাকা না কত যেন নিয়ে গেলি আমার কাছ থেকে পুলিসকে দেবার জন্যে?

–সে টাকা তো কিছু গেল রেলবাজারের পুলিসকে দিতে। তারপর আছে আমার রেলের যাতায়াতের ভাড়া, খাই-খরচ। বাকী কটা টাকা রইলো। কিন্তু কলকাতার পুলিসকে কি ওই কটা টাকায় খুশী করা যায়? আরো শ’পাঁচেক লাগবে, তার কমে তারা কথাই বলবে না–তুমি টাকাটা যোগাড় করো, আমি ততক্ষণে খেয়ে নিই, তারপর ট্রেন ধরে আবার এখুনি কলকাতায় ছুটতে হবে–

প্রীতি বললে–তা খোকাকে পুলিস ছাড়বে তো?

প্রকাশ বললে–তুমি বলছো কী দিদি? টাকা ছড়ালে কলকাতায় বাঘের দুধ পাওয়া যায়, আর খোকাকে ছাড়িয়ে আনতে পারবো না? আর তা ছাড়া খোকা তো আর সত্যি সত্যি ডাকাতি করে নি। ডাকাত ভেবে তাকে ভুল করে ধরে নিয়ে গেছে। এখানেই ছেড়ে দিত, শুধু টাকার যা তোয়াক্কা! টাকা টা দিলেই সুড়সুড় করে তারা ছেড়ে দেবে। নাও, চাবি দিয়ে তোমার সিন্দুক খোল, কটা টাকা আছে বার করো

প্রীতি বললে–চাবি আমার কাছে নেই, বউমাকে দিয়েছি–

–কেন, চাবি বউমার কাছে কেন?

–তা এখন থেকে তো বউমাই সব দেখবে। বউমাই তো একদিন এই সংসারের গিন্নী হবে, এখন থেকে আমি তার হাতেই সব ছেড়ে দিয়েছি–

প্রকাশ মামা বললে–ঠিক আছে, ততক্ষণ বউমার কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে তুমি টাকাটা বার করে রাখো, আমি ততক্ষণ চান-খাওয়া করে নি–

বলে প্রকাশ মামা কুয়োতলার দিকে চলে গেল। তারপর নয়নতারা আবার শাশুড়ীর ঘরে এল।

বললে—মা–

–কী বউমা?

–কেমন আছেন এখন?

সেকথার উত্তর না দিয়ে প্রীতি বললে–জানো বউমা, খোকার খোঁজ পাওয়া গেছে। এই এখখুনি প্রকাশ এসে বলে গেল। আসলে তাকে মিছিমিছি সন্দেহ করে ধরে নিয়ে গেছে। ডাকাতরা কালীগঞ্জের জমিদারের পোড়ো বাড়িতে লুকিয়ে ছিল তো, তা খোকাও সেখানে গিয়েছিল। পুলিস ভেবেছে ও-ও বুঝি তাদের দলের লোক, তাই ওকেও ধরে নিয়ে গেছে–

নয়নতারা বললে–আমি সব শুনেছি মা, কিন্তু উনিই বা কালীগঞ্জের সে পোড়ো বাড়িতে গিয়েছিলেন কেন? ডাকাতরা না হয় লুকিয়ে থাকবার জন্যে গিয়েছিল, কিন্তু উনি সেখানে কী করতে গিয়েছিলেন?

প্রীতি বললে–তুমি তো সব জানো না বউমা, সে অনেক কথা, সেই ব্যাপারের পর থেকেই তো খোকা ওই রকম হয়ে গেল। ও তো বিয়ে করতেই চায় নি ওই জন্যে–

–কিন্তু সেই কালীগঞ্জের বউ? সে কে?

প্রীতি বললে–আস্তে আস্তে তুমি সবই জানতে পারবে বউমা, পাগল আর কাকে বলে! জমিদারি রাখতে গেলে কত কী কাণ্ড করতে হয় তা তো তুমি জানো না বউমা। আমার বাবাও ভাগলপুরের জমিদার, আমি ছোটবেলা থেকে ও-সব দেখে এসেছি, আমার ও-সব শুনে কিছু মনে লাগে না। কারোরই মনে লাগে না। কিন্তু খোকা হয়েছে সৃষ্টিছাড়া ছেলে আমার–

প্রকাশ মামার ততক্ষণে খাওয়া-দাওয়া সারা হয়ে গিয়েছে। জামাকাপড় বদলে নিয়ে বললে–কই দিদি, কোথায়? টাকা বার করেছ?

প্রীতি বললে–বউমা তোমার চাবিটা দিয়ে ওই সিন্দুকের তালাটা খোল তো, খুলে শ’পাঁচেক টাকা ওর মধ্যে থেকে বের করে দাও–

নয়নতারা মামাশ্বশুরকে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়েছিল। বললে–আমি দেব?

–দাও না, দিতে দোষ কী? একদিন তো এ-সব একলা তোমাকে করতে হবে। তখন তো আমি থাকবো না।

প্রকাশ মামা বললো, দিদি ঠিক বলেছে, এখন থেকে সব প্র্যাকটিস করে নাও বউমা, একদিন এই সমস্তই তো তোমাকে ম্যানেজ করতে হবে–

নয়নতারা কিছু না বলে চাবি দিয়ে সিন্দুকটা খুললে। তারপর সিন্দুকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলে। হাতে যেন কত কী ঠেকলো। নয়নতারার মনে হলো যেন অনেক টাকা, অনেক সোনা, অনেক রূপো, অনেক হীরে, অনেক জহরৎ-এর স্পর্শে তার সমস্ত শরীর থর থর করে কেঁপে উঠলো। বিয়ের আগে যে রোমাঞ্চের স্বপ্ন সে দেখেছিল, তা সে পায় নি। কিন্তু তার বদলে আর এক জগতের আর এক ধরনের রোমাঞ্চের আস্বাদ পেয়ে তার বিস্ময়ের যেন শেষ রইল না। এত টাকা এদের, এত ঐশ্বর্য! কেষ্টনগরে তার মার হাতবাক্স খুলে সে দেখেছে, অনেক সময় কাজে-অকাজে তার ভেতর থেকে টাকা পয়সাও সে বার করে দিয়েছে। কিন্তু সে আর এ! এ যে অগাধ, এ যে অপরিসীম, এ যে অনন্ত! এত টাকা এবাড়ির কোথা থেকে এলো? সে নিজেই একদিন এই সমস্ত কিছুর মালিক হবে নাকি? এ টাকা কেমন করে উপার্জন করলে এরা? এও কি সেই কালীগঞ্জের জমিদারকে ঠকিয়ে পাওয়া, সেই কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ আর ফটিক প্রামাণিককে শোষণ করার সঞ্চয়? যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তার স্বামী আজ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে? এসে পর্যন্ত যাদের নাম সে কানাঘুষায় শুনতে আরম্ভ করেছে? এ সমস্তই কি তাদের নাকি?

–কই বউমা, পেলে না?

তাড়াতাড়িতে নয়নতারা একটা ছোট কৌটো বার করলে। আগাগোড়া রূপোর কাজ করা। ডালাটা খুলতেই দেখলে অনেক মোহর তার ভেতরে।

–ওটা না, ওটা না, বাঁদিকে হাত বাড়িয়ে দেখ একটা কাঠের বাক্স আছে, সেইটে বার করো। তার ভেতরে কাগজের নোট আছে–

এবার রূপোর বাক্সটা রেখে দিয়ে বাঁ দিকে হাত ঢোকালে নয়নতারা। বাঁ দিকে বাক্স একটা নয়, অনেকগুলো ছিল। তারই মধ্যে একটা বাক্স বেছে নিয়ে ডালাটা খুললে। তাতেও অনেক টাকা থাক-থাক্ সাজানো।

শাশুড়ী বললো ওই বাক্সটা, ওর থেকে টাকা গুনে বার করে দাও–

এক-এক করে নয়নতারা টাকাগুলো গুনতে লাগলো। দশটাকা, পাঁচটাকা একটাকার নোট সব। অত তাড়াতাড়ি গোনা কি সোজা! কত প্রজার কত রক্ত শুষে তবে এগুলো কাগজের নোটে রূপান্তরিত হয়েছে। এই টাকা দিয়ে নয়নতারা একদিন আরো জমি কিনবে, সে-জমিতে যারা ফসল ফলাবে তাদের খাটিয়ে নয়নতারা আরো টাকা করবে। সে টাকা সবই এনে সে জমা করবে এই সিন্দুকে। সেদিন নয়নতারার শ্বশুরও থাকবে না, শাশুড়ীও থাকবে না। তখন এই টাকা দিয়ে সে তার শাশুড়ীর মত হীরে-পান্না বসানো সীতাহার গড়াবে, ছেলের বিয়ে দিয়ে নতুন বউ আনবে। তখন নয়নতারা নিজেও শাশুড়ীর মত অসুখে পড়বে, আর নতুন বউ তখন আবার এই সিন্দুকের চাবি নিয়ে আঁচলে বাঁধবে। এমনি করে এক-একজনের বাড়িতে টাকার পাহাড় জমবে, আর কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ আর ফটিক প্রামাণিকেরা বারোয়ারিতলায় অশ্বথ গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করবে।

–কই বউমা, কত হলো? পাঁচশো টাকা গুনতে তোমার এত দেরি হচ্ছে কেন?

প্রকাশ মামা চেঁচিয়ে উঠলো–মোটে পাঁচশো টাকা? পাঁচশো টাকাতে কী হবে শুনি? পাঁচশো টাকা তো শুধু পান খাওয়াতেই খরচ হয়ে যাবে, তার ওপর আমার যাতায়াত খাওয়া থাকার হোটেল খরচ আছে। এ কি তুমি রেলবাজারের পুলিস-দারোগা পেয়েছ যে পাঁচশো টাকায় হবে? কলকাতার পুলিস। তারা পাঁচশো টাকায় কথাই বলবে না—

শাশুড়ী বললে–আচ্ছা বউমা, তাহলে হাজার টাকাই দিয়ে দাও পুরোপুরি। কিন্তু তোকে পুরো টাকার হিসেব দিতে হবে তা বলে রাখছি–

প্রকাশ মামা বললে–হিসেব? হিসেব কি তোমাকে আমি কখনও দিই নি যে হিসেব দেবার কথা বলছো তুমি আজ? তুমি আমাকে যত টাকা দিয়েছ তার সব হিসেব তো আমি তোমাকে পাই টু-পাই দিয়েছি। দিই নি? তুমিই বলো, দিই নি?

–আচ্ছা, পুরোপুরি হাজার টাকাই দিয়ে দাও, শেষকালে তোর জন্যে দেখছি তোর জামাইবাবুর কাছে আমাকে ধরা পড়ে যেতে হবে একদিন

নয়নতারা হাজার টাকার নোটের গোছাটা মামাশ্বশুরের হাতে দিতেই প্রকাশ মামা সেটা পকেটে পুরে ফেললে।

দিদি বললেও কি রে, টাকা গুনে নে, গুনে নিলি নে?

প্রকাশ মামা তখন টাকা পেয়ে যেতে পারলে বাঁচে। বললে–টাকা গুনে কী হবে? বউমা তো নিজে গুনেছে, বউমা কি আর আমাকে ঠকাবে বলতে চাও!

বলে বাইরে চলে গেল এক দৌড়ে। টাকা পকেটস্থ হয়ে গেছে যখন তখন আর কে তাকে দেখে। এখান থেকে সোজা রেলবাজারে যেতে হবে। সেখান থেকে প্রথম কাজ পোস্টাপিসে যাওয়া। পোস্টাপিসে গিয়ে ভাগলপুরে বউএর নামে টাকা মানি-অর্ডার করতে হবে। সেখানে ছেলে মেয়ে বউকে অনেকদিন কিছু পাঠাতে পারা যায় নি। তারা উপোস করে আছে এতদিন। এইবার এর থেকে অন্তত শ তিনেক সেখানে না পাঠালে ঠিক হবে না। তার পরে রাণাঘাটের সদরে রাধার বাড়িতেও অনেকদিন ঢুঁ মারে নি। সে তো টাকার জন্যে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে। তারপরে অনেকদিন ফুর্তির-প্রাণ-গড়ের মাঠ করা হয় নি। একটু আধটু ফুর্তি না করলে মন-মেজাজই বা ঠিক থাকবে কেন? জীবনে একটু ফুর্তির ছিটে ফোঁটা না মিললো তো বেঁচে থেকে ফয়দাটা কী? কলকাতায় গিয়েই একটা আড্ডায় বসে মা কালীমার্কা বোতল গলায় ঢালাই হবে প্রথম কাজ। তারপর, তারপর কলকাতা শহর। হাতে টাকা থাকলে তুমি যত ইচ্ছে ফুর্তি করো না, কেউ তোমায় বারণ করছে না।

টাকাগুলো দু’পাশের ট্যাকে জম্পেশ করে খুঁজে নিয়ে প্রকাশ মামা আকাশের দিকে চাইলে। একটা শঙ্খচিল দেখতে চেষ্টা করলে। শঙ্খচিল দেখলে যাত্রা শুভ হয়। তাহলে এই রকম পুলিস কেস হাতে আসে। এই রকম দু-চারটে পুলিস-কেস মাঝে-মধ্যে এলে তবু কিছু টাকার মুখ দেখা যায়। কিন্তু দিন কাল যা পড়েছে টাকা দুনিয়া থেকে যেন উবে যাচ্ছে!

না, আকাশের ত্রিসীমানায় একটা শঙ্খচিলের টিকিও দেখা গেল না। যে কটা উড়ছে সব গোদা-চিল। কী আর করা যাবে! একটা জলভরা কলসী দেখলেও কাজ হতো। তাও নেই।

কিন্তু আর দেরি করা যায় না। চণ্ডীমণ্ডপের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ নজর পড়লো বৈঠকখানার দিকে। বৈঠকখানার দরজাটা হাট করে খোলা। এখন দরজা খোলা কেন? বাবাজী তো কখনও দরজা খুলে রাখে না।

একটু উঁকি দিয়ে দেখতেই খটকা লাগলো। বাবাজী কোথায় গেল?

প্রকাশ মামার সন্দেহ আরো বাড়লো। বাবাজী নেই নাকি! তাড়াতাড়ি বৈঠকখানার ভেতরে গিয়ে ঢুকলো। কোথায় বাবাজী?

ওদিকে কলকাতায় যাবার ট্রেনের টাইম হয়ে যাচ্ছে। তবু জানতে ইচ্ছে হলো ব্যাপারটা কী! বাবাজীর ত্রিশূল রয়েছে, বাবাজীর খড়ম-জোড়াও রয়েছে। কিন্তু সেই ঝোলাটা নেই, বাবাজীর সেই ঝোলা। যার ভেতরে বাবাজীর গাঁজার কলকে-টলকে সব থাকতো।

কী রকম হলো! বংশী ঢালী সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। প্রকাশ মামা তাকেই ডাকলে–বংশী, বাবাজী কোথায় গেল রে?

বংশী বললে–আরে শালাবাবু, আমি তো বাবাজীকে সকাল থেকেই দেখি নি—

–তাহলে কি মাঠে গেছে? কিন্তু এই অসময়ে তো বাবাজী মাঠে যায় না।

শুধু বংশী ঢালী নয়। কেউ জানে না বাবাজী কোথায় গেল। ওপরে গিয়ে দীনুকে গিয়েও জিজ্ঞেস করলে। সে-ও কিছু জানে না। কৈলাস গোমস্তা মশাইও দেখে নি। এমন কি চণ্ডীমণ্ডপে বসে থাকে পরমেশ মৌলিক সেরেস্তাদার। সেও কিছু জানে না। সবাই-ই বললে–সকালবেলাও কেউ দেখে নি বাবাজীকে।

তারপর দিদিকে জিজ্ঞেস করতে প্রকাশ মামা ভেতরে যাচ্ছিল।–দিদি–দিদি—

কিন্তু তার আগেই একটা সাইকেল-রিকশায় চড়ে কারা যেন বারবাড়ির উঠোনে এসে হাজির হলো। ভালো করে চেয়ে দেখতেই অবাক হয়ে গেল প্রকাশ।

–আরে, বেয়াই মশাই যে! আসুন-আসুন—

কালীকান্ত ভট্টাচার্য আর নিখিলেশ দু’জনেই নামলো রিকশা থেকে। রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–হঠাৎ একটা দুঃসংবাদ পেয়ে চলে এলুম বেয়াই মশাই। এটি আমার ছাত্র, নিখিলেশ–

নিখিলেশ প্রকাশ মামাকে নমস্কার করলে। প্রকাশ মামা বললে–আপনি তো নিখিলেশবাবু, আমার ভাগ্নের বিয়ের সময় তো আপনাকে দেখেছি–

কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই বললেন–বৃদ্ধ বয়সে এত দূরে আসবো, তাই দেখা-শোনা করবার জন্যে একে সঙ্গে করে নিয়ে এলুম। তা বেয়াই মশাই কোথায়?

প্রকাশ মামা বললে–সেই তো মুশকিল হয়েছে, তিনি গতকাল রাণাঘাটের সদরে গেছেন, মুনসি কোর্টে একটা মামলা আছে, তার তদবিরে গেছেন। জরুরী ব্যাপার। অথচ কর্তাবাবুর ভীষণ অসুখ, নড়তেও পারছেন না, কথা বলতেও পারছেন না কদিন থেকে। এদিকে আমার ভাগ্নেকে আবার পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে

–ব্যাপারটা কী বলুন তো বেয়াই মশাই, আমি তো সেই খবর পেয়েই দৌড়ে এলাম।

প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করলে আপনি কী করে খবর পেলেন এর মধ্যে?

–ওই যে আমার বিপিন এসেছিল শীতের তত্ত্ব নিয়ে, ফেরবার সময় রেলবাজারের স্টেশনে দেখে ডাকাতদের মধ্যে জামাইবাবাজীও রয়েছে–

প্রকাশ মামা বললে–সেই ব্যাপারেই তো আমি এখন কলকাতায় যাচ্ছি–

–কলকাতায় যাচ্ছেন? এখন?

প্রকাশ মামা বললে–এই দুপুরের ট্রেনে না গেলে আবার ঠিক সময়ে কলকাতায় পৌঁছতে পারবো না, আজ রাত্তিরের আগেই তাকে বার করে নিয়ে আসতে হবে। আসলে সে তো ডাকাতি করে নি। তার কীসের দায় বলুন না যে ডাকাতি করতে যাবে। আমার জামাইবাবুর এত টাকা যে তাই-ই খেয়ে ফুরিয়ে উঠোতে পারবে না সে–

–তাহলে কি জামাই বাবাজী স্বদেশী দলের মধ্যে ছিল-টিল নাকি?

–আরে রামঃ, আমার ভাগ্নে করবে স্বদেশী, তাহলেই হয়েছে। আমি বলেছিলাম আপনাকে আমার ভাগ্নে একেবারে গো-বেচারা ভালোমানুষ! সংসারে ভালোমানুষেরই যত হেনস্তা আজকাল, এ তো আপনি চারদিকে দেখতে পাচ্ছেন

কালীকান্ত ভট্টাচার্য কী যেন ভাবলেন একটু। তারপর বললেন–তাহলে আপনিও চলে যাচ্ছেন, বেয়াই মশাইও বাড়িতে নেই, কর্তাবাবুরও অসুখ, কার সঙ্গে কথা বলবো আমরা?

–কেন? বউমা রয়েছেন। আপনার মেয়ে? এ তো আপনার নিজের মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। এবাড়ি কি আপনার পরের বাড়ি? নাই বা রইলেন বেয়াই মশাই, না-ই বা রইলুম আমি, আপনার মেয়ের কাছে এসেছেন, মেয়ের ঘরে গিয়ে বসবেন চলুন। মেয়ের সঙ্গে দেখা করুন। এখানে স্নান-খাওয়া করুন, বিশ্রাম করুন, আমি বউমাকে গিয়ে খবর দিচ্ছি–

বলে প্রকাশ মামা বাড়ির ভেতরে গিয়ে খবরটা দিলে।

–দিদি, বেয়াই মশাই এসেছেন কেষ্টনগর থেকে। নয়নতারাও পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার কানেও গেল কথাটা। কথাটা কানে যেতেই সমস্ত শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। বললে–আমার বাবা?

বাবা! বাবা এসেছে!

শাশুড়ী বললে–যাও বউমা, তোমার বাবাকে তোমার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও। আর গৌরীকে গিয়ে বলে এসো ওঁদের জন্যে খাবার ব্যবস্থা করতে।

প্রকাশ মামা বললে–দুজনের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গে তার এক ছাত্রও এসেছে। বুড়ো মানুষ একলা আসেনই বা কী করে! চানের জল তুলে দিতে বলছি দীনুকে, যেন কোনও ত্রুটি না হয়, আমি রইলুম না, জামাইবাবুও নেই, তুমি তোমার বাবাকে ভালো করে দেখো বউমা–যেন এ বাড়ির বদনাম না হয়, আমি চল্লুম–

আনন্দে নয়নতারার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। কেউ দেখে ফেলবে বলে তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে জলটা মুছে নিলে। কিন্তু তার আগেই শাশুড়ী ঠিক দেখে ফেলেছে। বললে–তুমি কাঁদছো নাকি বউমা, কাঁদছো কেন? কী হলো?

–না কাঁদি নি তো মা–বলে তাড়াতাড়ি শাশুড়ীর ঘর ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। বাবা এসেছে। তার বাবা! বাবা বোধ হয় তাকে ছেড়ে আর থাকতে পারে নি, তাই ছুটে এসেছে। আনন্দের চোটে নয়নতারা যে কী করবে তা বুঝতে পারলে না। ঘরে গিয়ে আয়নায় নিজের মুখটা দেখে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে নিলে।

বাইরে থেকে বাবার গলা শোনা গেল–নয়ন—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *