২.৫ সদানন্দ যখন বাড়ি ঢুকলো

সমস্ত দিন কোথায় ঘুরে ঘুরে সদানন্দ যখন বাড়ি ঢুকলো তখন সব শান্ত। এই কাল পর্যন্ত যে বাড়িতে লোকজন গিসগিস করেছে, যে বাড়িতে ঢুকলেই লুচি-ভাজার ঘিয়ের গন্ধ ভুর ভুর করেছে তা আর তখন নেই। একদিন আগেও এখানে উৎসবের জাঁকজমক সব কিছু ভরাট ছিল। প্রকাশ মামা একাই ছিল একশো। তার হাঁক-ডাকে বাড়িতে কাক-পক্ষী পর্যন্ত বসতে পারছিল না।

কিন্তু সেই প্রকাশ মামাও তখন আর নেই।

কর্তাবাবু তখন নিজের ঘরের মধ্যে আসর জাঁকিয়ে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন। বহুদিন আগে একদিন তিনি এই বংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেদিন মনে নানা সংশয় ছিল তাঁর। সংশয় ছিল নানা কারণে। একে তো সোজা পথে তাঁর যাত্রা শুরু হয় নি। অনেক বাধা এসেছে তার জীবনে। একদিক থেকে যেমন উন্নতি অন্যদিক থেকে তেমনি শত্রুতা। শুধু বিধাতার শত্রুতাই নয়, মানুষের শত্রুতাও কম ছিল না। তার জমির আয়তন বেড়েছে, কিন্তু সেই আয়তন বাড়াতে গিয়ে কতবার রাজদ্বারে উপস্থিত হতে হয়েছে তাকে। একটার পর একটা মকর্দমা। সঙ্গে সঙ্গে ছিল অর্থব্যয়। দু’হাতে টাকা বিলিয়েছে সকলকে। উকিল, মুহুরি, পেশকার থেকে শুরু করে কোর্টের একটা সামান্য পোকা-মাকড় পর্যন্ত তার টাকায় পেট ভরিয়েছে। তারপর আছে পুলিস-দারোগা-চৌকিদার। সবাই যেন এক-একটা রাঘব বোয়াল। আর তিনিও ছিলেন মুক্তহস্ত। তিনি বলতেন–টাকা নিচ্ছ নাও, কিন্তু দেখো আমার কাজটা যেন উদ্ধার হয় বাপু–

তা নেমকহারামি যে কেউ করে নি তা নয়, করেছে। কিন্তু অনেকে আবার তার কাজ উদ্ধারও করে দিয়েছে। লাভ-লোকসান ক্ষয়-ক্ষতি মিলিয়ে শেষমেষ যা দাঁড়িয়েছে তাতে মোটা লাভের দিকেই তার পাল্লা ঝুঁকেছে।

এ সব অতীতের কথা। এখন বলতে গেলে সব দিক থেকেই সুরাহা হয়েছে তার। এখন আর তার জমিদারি নেই বটে। সরকারী আইনের আওতায় এখন তাকে আর জমিদার বলা যাবে না। সরকারী সেরেস্তার খাতায় জমিদারের তালিকাটাই পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু তা হোক, তাতে তার কোনও উনিশ-বিশ হয় নি। তিনি আগেও যেমন ছিলেন, এখনও তেমনিই আছেন। বরং এখন তার সমৃদ্ধি বলতে গেলে আরো বেড়েছে। তার একমাত্র দাবীদার যে এতদিন বেঁচে ছিল সে–ও এখন নিঃশেষ হয়েছে। আর বাকি ছিল নাতির বিয়েটা। তা ভেবেছিলেন সেদিক থেকেও হয়ত কিছু বাধা আসবে। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তাও নির্বিঘ্নে সমাধা হয়ে গেল কাল। কাল সমস্ত অতিথি-অভ্যাগতরা তাঁর বাড়িতে এসে নববধূকে আশীর্বাদ করে গিয়েছে। ভেবেছিলেন তার নাতি ফুলশয্যার রাত্রে হয়ত বাড়ি থেকেই নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। কিন্তু না, সে শোবার ঘরে ঢুকে রীতিমত দরজায় খিল দিয়েছে। নতুন বউ এর সঙ্গে রাত্রিযাপনও করেছে।

কিন্তু তাহলে রাত্রে অমন অমঙ্গলের কান্না কে কেঁদেছিল?

দীনু ভোরবেলার দিকে এল। কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–হ্যাঁ রে দীনু, রাত্তিরে তুই কোথায় শুয়েছিলি?

দীনু বললে–আজ্ঞে, বাইরের বারান্দায়–

কর্তাবাবু বললেন, বেশ করেছিস, বারান্দায় শুয়েছিস। তা হ্যাঁ রে, রাত্তিরে কিছু শুনতে পেয়েছিলি?

–কী শুনবো?

–কারোর কান্না?

দীনু কিছু বুঝতে পারলে না। বললে–কান্না? কার কান্নার কথা বলছেন কর্তাবাবু?

কর্তাবাবু বললেন–কার কান্না তা কি ছাই আমিই জানি। মনে হলো যেন কে কোথায় কাঁদছে। তা আমি তোকে ‘দীনু দীনু’ বলে বার-দুই ডাকলুম, কিন্তু তোর তো কোনও সাড়া শব্দই পেলুম না–

দীনু অপরাধীর মত বললে–আজ্ঞে আমি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম–

–তা ঘুমিয়েছিস বেশ করেছিস। সারাদিন খাটুনি গেছে, ঘুমোবি না? হাজার হোক শরীর তো বটে।

তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন–তুই নিচেয় গিয়েছিলি?

দীনু বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ, নিচের থেকেই তো আসচি–

–নিচেয় কী দেখে এলি?

–দেখলুম ঠাকুররা উঠেছে, এইবার সব জল-খাবারের ব্যবস্থা হবে, উনুনে আগুন পড়েছে–

কর্তাবাবু বললেন না না, ও কথা বলছি না, বলছি ভেতরবাড়িতে কী দেখলি?

–ভেতর-বাড়িতে এখনও সবাই ঘুমোচ্ছে।

–ঘুমোচ্ছে? তাই নাকি রে! সবাই-ই ঘুমোচ্ছে?

–না, ওদিকে কাল তো শুতে অনেক রাত হয়েছিল, তাই এখন জাগে নি কেউ। তা ছোট মশাইকে ডেকে দেব আমি?

–দূর, ছোট মশাইকে ডেকে দিয়ে কী হবে! আমি বুড়ো মানুষ, আমার তো খাটা খাটুনি হয় নি বেশি, তাই ভালো ঘুমও হয় নি। ঘুমোচ্ছে ঘুমোক না। এখন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট সব চুকে গেছে। এখন তো ঘুমোবেই।

তারপর একটু হেসে বললেন–তা ওদিকের কী খবর রে?

–কোন্ দিকের?

–বর-কনের!

–আজ্ঞে, খোকাবাবুর কথা বলছেন? খোকাবাবু তো দেখলুম শালাবাবুর সঙ্গে বার বাড়ির উঠোনে কথা বলছেন।

কর্তাবাবু যেন বিশ্বাস করতে চাইলেন না। বললেন–ঠিক দেখেছিস তো তুই?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি ভুল দেখতে যাবো কেন?

–কিন্তু এত ভোর-ভোর, তাহলে উঠতে গেল কেন? নতুন বউ কোথায়?

–আজ্ঞে নতুন বউমার ঘরের দরজা তো ভেজানো রয়েছে দেখলুম! 

কর্তবাবু কেমন যেন চিন্তায় পড়লেন। নতুন বউ, ফুলশয্যার রাত, সেই রাতে বর কেন এত সকালে উঠলো! এ-দিনে তো একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে সবাই!

বললেন–তুই একবার ছোট মশাইকে ডেকে আন তো আমার কাছে

দীনু আর দাঁড়ালো না। কিন্তু ততক্ষণে প্রাণকৃষ্ণ শা’ মশাইও এসে গেছেন। আড়তদার মানুষ। নতুন বউয়ের মুখ দেখবেন সোনা দিয়ে। একটু পরে কৈলাস গোমস্তাও এসে গেল। আর তার পরেই এল চৌধুরী মশাই নিজে।

নিচের থেকে খবর এল, বউমার তৈরি হতে একটু দেরি হবে। কর্তাবাবু বললেন একটু বসতে হবে শা’ মশাই, বুঝতেই তো পারছেন, কাল অনেক রাত হয়েছে সব শেষ হতে…

কিন্তু এই-ই সব নয়। যখন প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই বউকে আশীর্বাদ করে চলে গেলেন তখন চৌধুরী মশাইকে ডাকলেন কর্তাবাবু। একেবারে একান্তে।

ঘর থেকে তখন সবাইকে বার করে দেওয়া হয়েছে।

কর্তাবাবু গলাটা একটু নামালেন। বললেন–রেলবাজার থেকে দারোগাবাবুর লোক এসেছিল নাকি?

চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ। আমি সব শোধ করে দিয়েছি।

–কত দিলে?

–আজ্ঞে আপনি যা দিতে বলেছিলেন। পুরোপুরি পাঁচশোই দিয়েছি।

–আর বংশী ঢালী?

চৌধুরী মশাই বললেন–ওরা একটু দরকষাকষি করছিল এবার। দেড়শো টাকার কমে ছাড়লে না।

–দেড়শো!

কর্তাবাবু যেন কেমন চমকে উঠলেন। বললেন–কেন? সেবার সেগুনবেড়ের বিলের দখলের সময় পনেরোটা লাস গুম করে মাত্র পঞ্চাশটা টাকা দিয়েছিলুম, তা-ই নিয়ে তো খুশী হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ওরা সেলাম করেছিল। আর এবার হঠাৎ একেবারে আড়াই গুণ রেট বাড়িয়ে দিলে কেন? এই কদিনের মধ্যেই টাকা কি এতই সস্তা হয়ে গেল?

চৌধুরী মশাই বললেন–না, তা নয়, খুবই কান্নাকাটি করতে লাগলো। এমন করতে লাগলো যেন দেড়শো না পেলে একেবারে মাগ-ছেলে নিয়ে উপোস করে মরবে!

কর্তাবাবুর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন–সে উপোস করে মরবে বললে–আর তুমিও তাই বিশ্বাস করলে? দেখছি এই রকম করেই তুমি আমার সম্পত্তি রক্ষে করবে! ওরা হলো ছোটলোক, ছোটলোকদের অত প্রশ্রয় দিতে আছে? যদি এতই হাতে-পায়ে ধরেছিল তো আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেই পারতে!..লোক ক’জন?

–আজ্ঞে, চারজন।

–চারজনের লাশের জন্যে দেড়শো টাকা! এ কি মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি! টাকা কি গাছের ফল যে পাড়লুম আর খেলুম? কালীগঞ্জে আমি যখন নায়েব ছিলুম তখন এসব কাজে মাথা পিছু পাঁচ টাকা দিয়েছি, তারাও খুশী হয়ে তাই নিয়ে সেলাম করেছে। এই করেই তোমরা দেখছি সব জিনিসের দর বাড়িয়ে দাও। এমনি করে যদি ওরা রেট বাড়িয়ে যায়, তাহলে তো আর শেষকালে জমি-জিরেত রাখতে কুল পাবে না। তা টাকাটা দেবার আগে একবার আমাকে জিজ্ঞেস করবে তো! আমাকে জিজ্ঞেস করলে তোমার কী এমন লোকসান হতো! আমি তো এই ঘরেই রয়েছি। পা দুটোই না হয় গেছে, কিন্তু একেবারে তো মরে যাই নি? আমি মরে গেলে তোমরা যা ইচ্ছে তাই করো, আমি সে-সব দেখতেও আসবো না–

বকুনি খেয়ে চৌধুরী মশাই বাবার সামনে মাথা নিচু করে রইলেন।

কিন্তু তখনই খবর এল নিচেয় কেষ্টনগর থেকে লোক এসেছে!

কর্তাবাবু বললেন–কেষ্টনগর? তোমার বেয়াই বাড়ির লোক নাকি?

বেয়াই বাড়ির লোক যে কেন আবার সাত সকালে এসে হাজির তা প্রথমে কেউই বুঝতে পারে নি। কিন্তু সকলের বোধের এক্তিয়ারের মধ্যেই যে সংসারের সব কিছু ঘটনা ঘটবে এমন কড়ার সৃষ্টিকর্তা তার বিশ্বসৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের সঙ্গে তো করেন নি! তাই বিপিনের মুখে যখন খবর প্রথম শুনলেন তখন সকলের অবাক হবারই কথা।

কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–শেষকালে কী হয়েছিল?

বিপিন বললে–কিছুই হয় নি। বিয়ের দিন খুবই খাটুনি গিয়েছিল সকলের, তার পরের দিন মেয়ে-জামাইকে বিদেয় দেবার পরই তিনি শুয়ে পড়লেন। বললেন–বুক কেমন করছে। তারপর ডাক্তারবাবু এলেন। ইনজেকশন দিলেন। ইনজেকশনের পরই ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু সে-ঘুম তার আর ভাঙলো না।

চৌধুরী মশাই সেখানে আর দাঁড়ালেন না।

বললেন–আমি একবার পুরুত মশাইকে খবর দিই গে—

কিন্তু তখন একেবারে তাই নিয়েই হইচই পড়ে গেল বাড়িময়। একদিকে নতুন বউ তারপরে প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই, তার ওপর দারোগা, বংশী ঢালী। আর সকলের ওপর কেষ্টনগরের দুঃসংবাদ। সে যে কী দুর্যোগ গেছে সমস্তটা দিন তা কল্পনা করতেও যেন ভয় হয়। তার মধ্যে সদানন্দ যে কোথায় ছিল তা কেউ লক্ষ্যই করে নি। সে বাড়িতে খেলে কি খেলে না সেদিকেও কারো খেয়াল ছিল না।

শুধু কর্তাবাবু চৌধুরী মশাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন–খোকার কী খবর?

চৌধুরী মশাই বললেন–সে ভালোই আছে–

–আর কোনও গণ্ডগোল-টোল করে নি তো?

চৌধুরী মশাই বললেন–না–

–তবে যে দীনু বলছিল, শুনলাম, খোকা নাকি ভোরবেলাই বউমার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে?

চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ, দিনু ঠিকই বলেছে–

–তা ফুলশয্যার দিন ও সকাল-সকাল ঘর ছেড়ে বেরোল যে? বউমার সঙ্গে কোনও ঝগড়া-টগড়া করে নি তো?

চৌধুরী মশাই বললেন–না, ঝগড়া কেন করতে যাবে?

কর্তাবাবু বললেন–না, যেরকম বেয়াড়া ছেলে তোমার, ও সব পারে। যা হোক, ভালোয় ভালোয় যখন মিটে গেছে তখন আর ভয় নেই। আমার তো ওই ভয়ই ছিল কিনা। তা নতুন-বউমা কেমন আছে? কেষ্টনগরের খবরটা তাকে দেওয়া হয়েছে?

চৌধুরী মশাই বললেন–না, এখনও দেওয়া হয়নি। খবর দেওয়া হবে কি না তাই ভাবছি। খবরটা দিলে তো আবার কান্নাকাটি করবে। তারপর পুরুত মশাইকে জিজ্ঞেস করে তিনি যেমন বলেন তেমনি করা যাবে–

এ সব ঝঞ্ঝাট যখন শেষ হলো, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। কদিন ধরে যে ধকলটা গেল তা যেন তখন খানিকটা শান্ত হলো। কর্তাবাবু মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন একটা। যাক্, তার বংশরক্ষা পেয়ে গেল। আর কোনও ভয় নেই। মনে মনে ঠিক করলেন তার নাতবউয়ের সন্তান হলে কী দিয়ে তার মুখ দেখবেন। একটা দামী কিছু দিতে হবে। এইটেই বোধ হয় তাঁর শেষ দেওয়া। নাতবউয়ের সন্তানকে দিলে সেটা তার নিজেকেই দেওয়া হবে। হয় একটা গিনির মালা না হয় একজোড়া হীরের বালা। একজোড়া হীরের বালার কত দাম হবে সেটা জিজ্ঞেস করতে হবে স্যাকরাকে। বেশ ভালো কমল হীরে দিয়ে বালাজোড়া গড়াতে হবে। তা টাকা যা লাগে তা তিনি দেবেন।

হঠাৎ নিচেয় শাঁখ বেজে উঠলো। দীনু এল। কর্তাবাবু তার মুখের দিকে চাইলেন। বললেন–কী রে, ওরা রওনা হয়ে গেল?

–আজ্ঞে হ্যাঁ কর্তাবাবু।

–সঙ্গে কে গেল?

–আজ্ঞে, শালাবাবু আর গৌরী পিসী!

কথাটা শুনে আরো নিশ্চিন্ত হলেন কর্তাবাবু। তারপর মনে পড়ে গেল কথাটা। বললেন–একটা কাজ করতে পারিস! রেলবাজারের কাঞ্চন স্যাকরাকে একবার খবর দিতে পারিস?

–কাঞ্চন স্যাকরা?

কর্তাবাবু বললেন–হ্যাঁ, বলবি সময়মত যেন একবার আমার সঙ্গে দেখা করে—

.

চৌধুরীবাড়ির সদর রাস্তায় তখন দুটো গরুর গাড়ি সামনে পেছনে চলেছে। সামনেটাতে নতুন বউ নয়নতারা, আর তার পাশে গৌরী। গৌরী পিসী। আর পেছনেরটাতে শালাবাবু। শালাবাবু চিৎকার করে বললে–একটু পা চালিয়ে চলো রজব, একটু পা চালিয়ে চলো, ট্রেনের টাইম হয়ে গেছে–দুর্গা, দুর্গা…

সদর রাস্তা ছেড়ে গাড়ি দুটো বারোয়ারিতলায় পড়লো। বিরাট বিরাট বট আর অশ্বথ গাছের ছায়াঘেরা বারোয়ারিতলা। বারোয়ারিতলায় দোকানগুলোর মাচার ওপর তখন বিকেলের তাসের আড্ডা চলেছে। হঠাৎ গাড়ির ভেতরে সদানন্দর বউকে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। পেছনের গাড়িতে শালাবাবুকে দেখে একটু সাহস পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো–এ কি শালাবাবু, কোথায়? নতুন বউকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

শালাবাবুর তখন অত সময় নেই বাজে কথা বলবার। বললে–এখন ট্রেন ধরতে হবে ভাই, কথা বলবার সময় নেই–

বলে সামনের গাড়ির গাড়োয়ানকে আবার তাগাদা দিলে–একটু পা চালিয়ে চলো রজব, ট্রেনের টাইম হয়ে গেছে, পা চালিয়ে চলো–

এদিকে বাড়ির ভেতরে সদানন্দকে দেখে মা অবাক হয়ে গেছে। বললে–এ কী রে, তুই কোথায় ছিলি সারাদিন, বাড়িতে এত ঝঞ্ঝাট চললো, আর তোরই দেখা নেই–

প্রকাশ মামা থাকলে এতক্ষণে হই-হই লাগিয়ে দিত। কিন্তু প্রকাশ মামাও নেই, গৌরী পিসীও নেই। যারা দুজন বাড়ি জমিয়ে রাখে তারা কেউই নেই। বাড়িতে আস্তে আস্তে ঢুকেই লোকজন না দেখে কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল সদানন্দ। কদিন আগেও এখানে ভিড় ছিল। পুকুরের পাড়ের দিকে ভিয়েন বসেছিল। বারোয়ারিতলার তাসের আড্ডার সবাই-ই এখানে এসে নেমন্তন্ন খেয়ে গিয়েছিল। বউ দেখেও খুব তারিফ করেছে তারা। সকাল বেলা বারোয়ারিতলায় যেতেই সবাই ধরেছে কী রে, এত সকালে?

সদানন্দ বললে–বাড়িতে আর ভালো লাগলো না ভাই, বড্ড ভিড়–

গোপাল ষাট বলে–কাল তোদের বাড়িতে খুব খেয়েছি রে, একেবারে পেট ফেটে যাবার দাখিল

কেদার বললে–তা কী রকম বউ হলো বল সদা, পছন্দ হয়েছে তো তোর?

পছন্দর কথা শুনে আশেপাশে যারা শুনছিল সবাই কেদারের কথায় হেসে উঠেছে। অমন যার বউ তার আবার পছন্দর কথা ওঠে নাকি! নতুন বরকে দেখে ক্রমে ক্রমে আরো ভিড় জমে উঠলো মাচার ওপর। এতকাল ধরে এই সদানন্দকে তারা দেখে আসছে, অথচ সকলের কাছে আজ রাতারাতি যেন সে নতুন মানুষ হয়ে উঠেছে। এই মানুষটাই তাদের সঙ্গে এতদিন আড্ডা দিয়েছে, কথা বলেছে, তাস খেলেছে, যাত্রা করেছে, উঠেছে, বসেছে, তবু যেন সে আজ একটা রাত্রের মধ্যেই সম্পূর্ণ এক অচেনা মানুষ হয়ে উঠেছে সকলের কাছে। সকলেরই জানতে ইচ্ছে করছে গোপনে শুনে নেয় তার ফুলশয্যার রাতটা কেমন কাটলো। ওর ফুলশয্যা কি ঠিক আমার মত? সকলেরই নিজের নিজের ফুলশয্যার রাতের কথা মনে পড়তে লাগলো। নিজেদের সঙ্গে সদানন্দর ফুলশয্যার ঘটনাটা একবার মিলিয়েও নিতে চাইলে সবাই। অত সুন্দরী বউ বরের সঙ্গে প্রথমে কী কথা বললে–সেটাও তাদের জানতে হবে। কিন্তু সদানন্দ শুধু হাসতে লাগলো।

ভৈরব বললে–কী রে, হাসছিস যে?

সদানন্দ বললে–তোদের কথা শুনে ভাই–

–কেন, আমরা গরীব বলে কি মানুষ নই, না আমাদের কালো বউ বলে সে আর বউ নয়?

একজন বলে–ওরে না, যা ভাবছিস তা নয়, অন্ধকারে কালো বউও যা ফরসা বউও তাই, সব সমান!

–তুই থাম–বলে ধমকে উঠলো কেদার। বললে–তুই যা জানিস না, তা নিয়ে কথা বলতে আসিস নি। তুই বিয়ে করিস নি, বিয়ের মর্ম তুই কী বুঝবি রে?

কথাটা মর্মে মর্মে সত্যি। সবাই-ই স্বীকার করলে বিয়ে না করলে বিয়ের মর্ম বোঝা যায় না। সবাই বললে–তুই এখেন থেকে যা দিকিনি, যা চলে যা–

এতগুলো বিবাহিত লোকের মধ্যে থেকে অবিবাহিতকে সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দেওয়া হলো। এবার সবাই গোল হয়ে বসলো সদানন্দকে ঘিরে। বললে–এবার বল্ ভাই, কী হলো তোর?

সদানন্দ বললে–কিছুই হয় নি

–কিচ্ছু হয় নি মানে? আমাদের বোকা পেয়েছিস তুই?

সদানন্দ বললে–ওসব কথা থাক ভাই, অন্য কথা বল্—

কিন্তু অন্য কথা বলতে তখন কার ভালো লাগে! এর পরে যখন প্রসঙ্গটা পুরোন হয়ে যাবে তখন তো কেউ আর এসব কথা তুলবেও না সদানন্দর কাছে। তখন সদানন্দ এই সব লোকদের মতই সাধারণ হয়ে যাবে।

হঠাৎ গরুর গাড়ি দুটো দেখে কেদার বলে উঠলো–ওরে, তোর বউ বাপের বাড়ি যাচ্ছে রে, ওই দ্যাখ—

গাড়ি দুটো সামনে পেছনে চলেছে রেলবাজারের দিকে। কেদার চিৎকার করে উঠলো–একি শালাবাবু, কোথায়? নতুন বউকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

শালাবাবু সেদিকে না চেয়েই বলে উঠলো–এখন ট্রেন ধরতে হবে ভাই, কথা বলবার সময় নেই–

গাড়ি দুটো জোর কদমে ছুটে চলতে লাগলো। সকলেই সদানন্দর দিকে চাইলে। জিজ্ঞেস করলে–কী রে, তোর বউ সাত-তাড়াতাড়ি বাপের বাড়ি যাচ্ছে কেন রে? এই তো সবে কাল বউভাত হল, এরই মধ্যে চলে গেল?

ভৈরব বললে–তাহলে আজ রাতটা তোর বালিশ আঁকড়ে কাটবে সদা–তোর বরাতটাই খারাপ–

সদানন্দ বললে–আমি উঠি ভাই–

বলে আর সেখানে দাঁড়ালো না। মনে হলো এবার যেন আর কোনও বাধা নেই তার সামনে। সে যেন এবার স্বাধীন।

সবাই বলে উঠলো–কী রে, ওদিক কোথায় যাচ্ছিস্?

সেই সকাল থেকে আড্ডা দিয়েছে সে বারোয়ারিতলায়। তারপর আড্ডা দিতে দিতে সময়ের জ্ঞান ছিল না তার। একেবারে সোজা পশ্চিম দিকের রাস্তাটা ধরলে। যেতে যেতে বললে–একটা কাজ আছে ভাই পশ্চিমপাড়ায়–

আসলে পশ্চিমপাড়াও নয়, দক্ষিণপাড়াও নয়। মনে হলো সে যেন সমস্ত পৃথিবীটাই পরিক্রমা করে আসতে পারে এখন। তবু তার ক্লান্তি আসবে না, তবু তার শ্রান্তি আসবে না।

কেদার বললে–নতুন বিয়ে করে সদাটার মুণ্ডুটা ঘুরে গেছে। ও-রকম সকলেরই হয়–

বাড়িতে আসতেই মা বললে–শুনেছিস, তোর শাশুড়ী মারা গেছে, কেষ্টনগর থেকে লোক এসেছিল, তাই বউমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলুম।

সদানন্দ হাঁ না কিছুই বললে না। যেমন খেতে হয় তেমনি খেয়ে নিলে। মা আঁচল থেকে চাবির গোছা থেকে একটা চাবি খুলে দিয়ে বললে–তোর ঘরে চাবি দিয়ে রেখেছি, বউমার জিনিসপত্তর রয়েছে তো, তাই! এই নে চাবি–

চাবি নিয়ে সদানন্দ ঘরের দরজাটা খুললে। খুলতেই একটা কেমন-কেমন মিষ্টি গন্ধ নাকে ভেসে এল। ঘরের সমস্ত জানালা বন্ধ। পেছনের দিকের দরজাটাতেও আজ তালাচাবি পড়ে গেছে। কোথাও কোনও দিক দিয়ে আর পালাবার পথ নেই। ঘরের কোণের দিকের আলনায় একটা কোঁচানো শাড়ি, তার পাশে একটা ব্লাউজ।

মা হঠাৎ ঘরে এসে ঢুকলো–কী রে, আজকে ঘরে শুবি তো ঠিক? না শুস্ তো বল্। বউমার বাক্স-প্যাটরা সব রয়েছে, সেগুলো তাহলে আমার ঘরে সরিয়ে রাখবো।

সদানন্দ তবু কিছু কথা বললে না। মার মনে হলো হয়তো ছেলের মতিগতি ফিরেছে।

বললে–তাহলে আমি চলি, তুই আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়–

সদানন্দ গায়ের জামাটা খুলে রাখলে। তারপর আলোটা নেবাবার আগে ছাদের কড়িকাঠের দিকে একবার চেয়ে দেখলে। কই, সেই কপিল পায়রাপোড়ার ঝুলন্ত শরীরটা তো আর দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেল সেটা? নিজের গেঞ্জিটার দিকে চেয়ে দেখলে। সেই কালীগঞ্জের বউ-এর রক্তের দাগটাও তো কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। কেন এরকম হলো? এমন তো হবার কথা নয়। তবে কি সব দাগ মুছে গেল এক রাত্রেই! একটা ফুলশয্যার রাত্রের প্রলেপের এত ক্ষমতা! সদানন্দর মনে হলো তখনও যেন সেই গন্ধটা নাকের কাছে ঘুরঘুর করছে। ক’ঘন্টা আগেও একটা মানুষ এ-ঘরে ছিল। তার শরীরের আর তার যৌবনের সান্নিধ্যের স্পর্শ যেন এই ঘরের সর্বাঙ্গে লেগে রয়েছে তখনও। একটা ছাড়া শাড়ির কোঁচানন কুটিলতার মধ্যে যেন তার মনটাকে সে এখানে লুকিয়ে রেখে গেছে। সে লুকিয়ে লুকিয়ে চেয়ে দেখছে। দেখছে শাড়িটা আর ব্লাউজটা সে সকলের দৃষ্টির অগোচরে একবার স্পর্শ করে কি না। তার স্পষ্ট ধারণা সদানন্দ ওগুলো স্পর্শ করবেই, ওগুলোর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে সদানন্দ বাঁচতে পারবে না। তার পূর্বপুরুষ এক মোহিনী জাল বিছিয়েছে তাকে অভিভূত করবার জন্যে। সে তাতে ধরা পড়বেই, সে তাতে ধরা পড়ে ধ্বংস হবেই–

বোধ হয় সত্যিই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ তার দরজায় ঠকঠক্ করে টোকা পড়লো। বাইরে মা ডাকছে!

–ও খোকা, খোকা, ওরে, দরজা খোল্‌–বউমা এসেছে!

সদানন্দ কী করবে বুঝতে পারলে না। কেষ্টনগরে যার যাবার কথা, কেষ্টনগরেই যার দু’তিন দিন থাকবার কথা, সে হঠাৎ আবার ফিরে এল কেন?

-–ওরে খোকা, দরজা খোল। বউমা এসেছে। কেষ্টনগরের ট্রেন ফেল করে আবার এখানে ফিরে এসেছে, দরজা খোল

সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ মামার গলাও শোনা গেল। আশ্চর্য, ঠিক আজকেই কিনা তাদের ট্রেন ফেল করতে হয়!

সদানন্দ দরজাটা খুলে দিলে।

বাইরে অল্প-অল্প আলো। সেই আধো-অন্ধকারের মধ্যে মূর্তিটা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। সদানন্দ দরজা খুলতেই নয়নতারা আস্তে আস্তে ঘরের ভেতরে এগিয়ে এল।

সদানন্দ বউ-এর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। চোখ দুটো ভিজে উঠেছে।

পেছন থেকে তখন প্রকাশ মামার গলা শোনা গেল–আমরা স্টেশনে গেছি আর ট্রেনটাও ঠিক সেই সময়ে ছেড়ে দিলে–

গৌরী পিসীও ফিরে এসেছে। সেও বলে উঠলো–কপালের দুর্ভোগ বউদি, গায়েগতরে একেবারে ব্যথা হয়ে গেল, অথচ কোনও লাভ হলো না।

মা বললে–বউমার খুব কষ্ট হলো মাঝখান থেকে–

সদানন্দ তখনও পাথরের মত সেইখানে দাঁড়িয়ে ছিল। কী যে সে করবে তা বুঝতে পারলে না। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, না ঘরেই থাকবে! নাকি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে হয়ত প্রকাশ মামা আবার তাকে দেখতে পাবে।

হঠাৎ কী যে হলো, নয়নতারার দিকে একটু এগিয়ে গেল সদানন্দ। একটা কিছু কথা বলা তার উচিত। কাল সে ঘর থেকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেন সে বেরিয়ে গিয়েছিল তা নয়নতারাকে বলা হয় নি। আর কাউকে না বললে কিছু আসে যায় না, কিন্তু তার নিজের বিয়ে করা বউকে অন্ততঃ কিছু কৈফিয়ৎ দেওয়া উচিত।

সদানন্দ নয়নতারার কাছে গিয়ে বললে–দেখ—

কিন্তু কিছু বলার আগেই নয়নতারা ফোঁস করে উঠেছে। বলে উঠল–আমাকে ছুঁও না–

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমটা ভেঙে গেছে। সদানন্দ মাথাটা বালিশ থেকে তুলে চারদিকে চেয়ে দেখলে। কই, কেউ তো কোথাও নেই। ঘর অন্ধকার। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠলো সে। তারপর আলোটা জ্বাললে। দরজায় যেমন খিল দেওয়া ছিল, তেমনিই রয়েছে। কেউ কোথাও নেই! ঘরের ভেতরে সে একলাই শুয়ে ছিল এতক্ষণ। ঘরে কেউই ঢোকে নি। আলনার ওপর কোঁচানো শাড়ি আর পাট-করা ব্লাউজ। তখনও একভাবে একই জায়গায় রয়েছে। কেউ তা স্পর্শ করে নি। আশ্চর্য-আশ্চর্য স্বপ্ন তো! কিন্তু স্বপ্নই যদি দেখতে হয় তো এমন স্বপ্ন দেখল কেন সে? কেন সে এমন স্বপ্ন দেখলে?

আলোটা নিবিয়ে আবার সে বিছানায় গিয়ে শুলে। আবার সব অন্ধকার। আবার ঘুমোবার চেষ্টা করলে একটু। মনে হলো আর কোনও ভয় নেই। ট্রেন তারা ফেল করে নি। মিছিমিছি সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণ তারা তিনজনেই হয়ত কেষ্টনগরে পৌঁছে গিয়েছে। এতক্ষণ হয়ত খুবই কান্নাকাটি করছে তার স্ত্রী। বিয়ের একদিন পরেই মা মারা গেল। এমন তো সাধারণত হয় না।

কিন্তু অত ভাবতে গেলে সদানন্দর চলবে না। সে কারো স্বার্থ কারো ভালোমন্দ দেখবে না। তার স্বার্থ, তার ভালোমন্দের কথা কি কেউ কোনও দিন ভেবেছে! সবাই শুধু তাকে কেন্দ্র করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছে। তার দাদু চেয়েছে এই বংশ, এই বংশের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা অক্ষয় করতে। তার বাবা চেয়েছে সদানন্দ যেন বংশের ধারাকে জীইয়ে রেখে দেয়। কেউ আর কিছু চায় না তার কাছ থেকে। সদানন্দর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কারো কাম্য নয়।

কালীগঞ্জের বউ সেদিন সদানন্দকে সেই কথাই বলেছিল। বলেছিল–তুমি কেন আমার কথা ভাবছো বাবা? তোমার বিয়ে হবে, তোমার সংসার হবে, তোমার ছেলে হবে, তোমার সামনে এখন মস্ত লম্বা ভবিষ্যৎ পড়ে আছে, আমার তো গঙ্গামুখো পা, আমি যেতে পারলেই এখন বাঁচি। আমার কথা আর তুমি ভেবো না বাবা–

বালিশের ওপর মুখটা গুঁজে বার বার কথাগুলো না-ভাববারই চেষ্টা করতে লাগলো সদানন্দ। সত্যিই সে কেন কালীগঞ্জের বউ-এর কথা ভাবে! কেন সে কপিল পায়রাপোড়ার কথা ভাবে! কেন সে মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিকের কথা ভাবে! পৃথিবীর আর কেউ তো তার মত এত বাজে কথা ভাবে না!

না, সদানন্দ এবার আর কিছু ভাববে না। এবার কারোর কথা সে ভাববে না। শুধু নিজের কথা ভাববে। নিজের স্বার্থের কথা, নিজের সুখের কথা। কোথাকার কে কপিল পায়রাপোড়া, কোথাকার কে কালীগঞ্জের বউ, তারা তো আর এ পৃথিবীতে নেই। তাদের কথা ভেবেও তো সে তাদের কোনও উপকার করতে পারবে না। তারা মারা গেছে। তাদের দলে কেউ নেই। তাদের পুলিস নেই, দারোগা নেই, আইন নেই, গভর্নমেন্ট নেই, সমাজও তাদের বিরুদ্ধে। কেন তাদের কথা সে ভাববে! কেন তাদের কথা ভেবে সে মন খারাপ করবে! তার চেয়ে সে বরং নিজের কথাই ভাববে। নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ, নিজের স্ত্রী, নিজের সম্পত্তির কথা ভাববে। এই পারিবারিক লাখ-লাখ টাকার জমিদারি, এসব কী করে আরো বাড়ানো যায়, কী করে পরের জমি কোন্ কৌশলে দখল করে নিজের সম্পত্তির পরিমাণ দ্বিগুণ করা যায় কেবল সেই কথাই সে ভাববে।

এবার নয়নতারা যদি আসে তা হলে এই ঘরেই সে রাত্রে শোবে। এই ঘরের বিছানাতেই সে তার স্ত্রীর সঙ্গে শোবে।

তারপর আস্তে আস্তে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে তা সে নিজেও জানতে পারল না।

.

বহুদিন আগের আর একটা দিনের ঘটনা। নবাবগঞ্জে তখন বেশ ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। গ্রামের লোক শীত পড়লেই ভোরবেলা উঠোনে বেরিয়ে পড়ে। খোলা-মেলা চারিদিক। তখন ক্ষেতেও কাজ থাকে না কারো। তখন ধান কাটা হয়ে গেছে, পাটও উঠে গেছে। ক্ষেতে শুধু তখন সরষে। সরষে ক্ষেত তখন শুকিয়ে কালো হয়ে যাচ্ছে। চৌধুরীবাড়ির বাইরে চণ্ডীমণ্ডপের পশ্চিমে উঠোনময় সরষে ছড়ানো। চারদিকে বাকারির বেড়া দেওয়া থাকে। যাতে গরু-ছাগল এসে খেয়ে না যায়। সেই সরষে কেটে বেছে মরাইতে তুলতে হবে। তারপর খেপে খেপে যাবে রেলবাজারের প্রাণকৃষ্ণ শা’ মশাই-এর আড়তে। সেখান থেকে নগদ টাকা আসবে নরনারায়ন চৌধুরীর সিন্দুকে। সেই টাকা দিয়ে আবার জমি কেনা হবে সেই জমিতে আবার ফসল ফলবে। এই জমি কেনা আর ফসল ফলানো আর ফসল বেচার টাকায় নরনারায়ণ চৌধুরী মশাই পঙ্গু পা দুটো নিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে অখণ্ড সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখবে আর সেই স্বপ্নের নেশাতেই বছরের পর বছর পরমায়ু নিঃশেষ করে দেবে।

ছোটবেলায় সদানন্দ ওই ধান মাড়া, পাট-কাচা, সরষে ভাঙা দেখত। বিধু কয়াল সেগুলো আবার দাঁড়িপাল্লায় ওজন করতো। চৌধুরী মশাই অনেক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করতো–হ্যাঁ গো বিধুকাকা, এত সরষে কে খাবে গো?

বিধু কয়াল বলতো–কে আবার খাবে, লোকে খাবে—

সদানন্দ বলতো–তা এত সরষে লোকে খেতে পারবে?

বিধু কয়াল হাসতো। বলতো–পৃথিবীতে লোক কি কম খোকাবাবু লোকের শেষ নেই। পৃথিবীতে রোজ কত লোক জন্মাচ্ছে, তা জানো?

–কত লোক?

–কোটি কোটি লোক জন্মাচ্ছে। আবার কোটি কোটি লোক মরছেও। যত লোক জন্মাচ্ছে সবাই এই চাল, ডাল, সরষে সব খাবে।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করতো–কী করে জন্মায় এত লোক?

বিধু কয়াল বলতো-সে-সব তুমি এখন বুঝবে না, বড় হলে তবে বুঝতে পারবে।

সদানন্দ বলতো–তুমি বলো না, আমি তো বড় হয়েছি, আমি ঠিক বুঝতে পারবো–

বিধু কয়াল তবু বলতো না। কিংবা হয়তো ও সব কথা নিয়ে আলোচনা করতে চাইত না ছোট ছেলের সঙ্গে। আর অত কথা বলবার হয়ত সময়ও ছিল না বিধু কয়ালের। তার অনেক কাজ ছিল। যখন দাঁড়িপাল্লার কাজ থাকতো না তখন তাকে অন্য কাজ দেওয়া হতো। কাজ কি চৌধুরী মশাই-এর বাড়িতে একটা! গোয়ালের গরু দেখবার রাখাল ছিল, ক্ষেত খামারে কাজ করবার জন্যে কৃষাণ ছিল, মাল ওজন করবার কয়াল ছিল, কাছারির কাজ করবার গোমস্তা ছিল। তার ওপর ছিল সংসারের কাজকর্ম দেখাশোনার লোক। লোকে লোকে ভর্তি ছিল সেই বাড়ি। ভোরবেলা থেকে চৌধুরীদের বাড়িতে কাজ শুরু হতো, সে কাজ শেষ হতে সন্ধ্যের পর। সন্ধ্যের পরেই যেন একটু ঠাণ্ডা হতো নবাবগঞ্জ।

তা সেই বিধু কয়ালই একদিন হঠাৎ মারা গেল।

সে এক কাণ্ড বটে! একদিন হঠাৎ হই-হই পড়ে গেল চৌধুরীবাড়িতে। কী হয়েছে, না বিধু কয়ালকে সাপে কামড়েছে। সবাই ছুটলো বিধু কয়ালের বাড়িতে। বিধু কয়ালের বাড়িতে কখনও আগে যায় নি সদানন্দ। গিয়ে দেখলে মাটির দাওয়ার ওপর বিধু কয়াল চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আর একজন বুড়ো ওঝা মন্তর পড়ছে। ঝাড়-ফুঁক করছে। মনে আছে সদানন্দ একদৃষ্টে সেই বিধু কাকার দিকে চেয়ে দেখছিল। সে কী বীভৎস মৃত্যু! কপিল পায়রাপোড়ার মৃত্যু একরকম, সেও বীভৎস। সে–ও এক রকমের অপমৃত্যু। কিন্তু বিধু কয়ালের অপমৃত্যু যেন অন্য রকম। বিধু কাকার অপমৃত্যুর জন্যে সে যে কাকে দায়ী করবে তা সেদিন ঠিক করতে পারে নি। সকলকে জিজ্ঞেস করেছিল সদানন্দ। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে, মাকে জিজ্ঞেস করেছে। গৌরী পিসীকে জিজ্ঞেস করেছে। এমন কি প্রকাশ মামাকেও জিজ্ঞেস করেছে। প্রকাশ মামা ভাগ্নের কথা শুনে অবাক। বলেছে–আরে, সাপে কামড়ালে মানুষ মরবে না? আবার তেমনি বাগে পেলে যে মানুষও আবার সাপকে মেরে ফেলে। যে-যাকে বাগে পায় তাকেই মারে, বুঝলি না?

সদানন্দ তবু বুঝতে পারে নি। বলেছে–তার মানে?

–তার মানে সবাই সবার শত্রু। সবাই সবাইকে বাগে পাবার চেষ্টা করছে। এই যেমন দ্যাখ না, তোর দাদু কপিল পায়রাপোড়াকে বাগে পেয়েছিল তাই সে মরলো, আবার কপিল পায়রাপোড়া যদি তোর দাদুকে বাগে পেত তো তোর দাদুকেও তাহলে মরতে হতো। এই-ই তো নিয়ম রে। এই নিয়মেই তো দুনিয়া চলছে–

কথাটা অনেক দিন ধরে সদানন্দকে খুব ভাবিয়েছিল। সদানন্দ মাঝে মাঝে বিধু কয়ালের কথা ভাবতো। তারপর সেই বিধু কয়ালের জায়গায় একদিন তার ছেলে শশী কয়াল এল। তখন থেকে শশী কয়ালই তাদের বাড়িতে কাজ করতো। শশী কয়ালও ঠিক তার বাবার মত ধান মাপতো, পাট মাপতো, সরষে মাপতো। সদানন্দ তাকে দেখতো আর ভাবতো, দাদু কবে তাকেও হয়ত বাগে পাবে।

একদিন শশীকেও সদানন্দ জিজ্ঞেস করেছিল–আচ্ছা শশী, তুমি কাকে বাগে পাবার চেষ্টা করছো বলো তো?

শশী কয়াল তো অবাক! বললে–তার মানে?

সদানন্দ বললে–তার মানে জানো না?

–না।

সদানন্দ বললে–নিশ্চয় মানে জানো তুমি, আমার কাছে বলছো না শুধু। তুমি নিশ্চয়ই কাউকে খুন করবার চেষ্ট করছে। সবাই সেই চেষ্টাই করে। এই-ই নিয়ম। এই নিয়মেই দুনিয়া চলছে–

শশী তার হাতের কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইল সদানন্দর দিকে। খোকাবাবু বলছে কী!

কাছ দিয়ে চৌধুরী মশাই যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন–কী শশী, কী কথা হচ্ছে তোমাদের?

শশী বললে–আজ্ঞে, দেখুন না খোকাবাবু কী বলছে, আমি নাকি কাকে খুন করার মতলব করছি!

–তার মানে?

চৌধুরী মশাইও অবাক। সদানন্দর দিকে চেয়ে চৌধুরী মশাই বললেন–কে তোমাকে এ-সব কথা বললে? শশী কাকে খুন করবে?

সদানন্দ বললো, আমি জানি—

–জানি মানে? কী জানো তুমি?

সদানন্দ বললে–সবাই সবাইকে খুন করবার মতলব করছে!

চৌধুরী মশাই আরো অবাক। বললেন–এসব বাজে কথা কে তোমাকে শেখালে?

সদানন্দ বললে–প্রকাশ মামা।

–প্রকাশ মামা?

–হ্যাঁ, প্রকাশ মামা বলেছে। কেন, বিধু কাকাকে সাপে কাটে নি? কপিল পায়রাপোড়াকে দাদু খুন করে নি?

এরপর আর কথা বলেন নি চৌধুরী মশাই। তখনই ছেলেকে নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে চলে গিয়েছিলেন, তারপর অনেক জেরা করতে লাগলেন ছেলেকে। কে তাকে এ-সব কথা বলেছে। কে শিখিয়েছে তাকে এ-সব প্রশ্ন। সব কথার উত্তরেই সদানন্দ বললে–প্রকাশ মামা।

প্রকাশ মামাকেও ডাকা হলো, চৌধুরী মশাই তাকেও জেরা করলেন–এই সব কথা তুমি শিখিয়েছ সদানন্দকে?

প্রকাশ মামা বললে–আমি? আমি কেন শেখাতে যাবো জামাইবাবু? আমার দায় পড়েছে। সদা কি ভাবছেন সোজা ছেলে? ও আমাকে সব শেখাতে পারে, তা জানেন?

রাত্রে গৃহিণীকে গিয়ে চৌধুরী মশাই সব কথা বললেন–তোমার ভাই কিন্তু খোকাকে খারাপ করে দিচ্ছে, ওর সঙ্গে খোকাকে বেশি মিশতে দিও না–

গৃহিণী বললে–কী যে তুমি বলো তার ঠিক নেই। ছেলেমানুষ কী বলেছে তাই নিয়েই তুমি মাথা ঘামাচ্ছো? তুমি তোমার নিজের কাজকম্মো নিয়ে থাকো না, ছেলেমানুষদের কথায় অত কান দিতে গেলে চলে?

এরপর আর কোনও কথা হয় নি এ-সম্বন্ধে। সদানন্দ নিঃশব্দে বড় হয়েছে। সে যা দেখবার তা দেখেছে যা শেখবার তা শিখেছে। কী দেখেছে আর কী শিখেছে তা জানবার সুযোগ হয় নি কারো। চৌধুরী মশাই ব্যস্ত ছিলেন তাঁর সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আর প্রীতি জড়িয়ে পড়েছিল সংসারের বেড়াজালে। প্রীতির তখন রোজ নতুন করে গয়না গড়ানো হতো আর দুদিন পরেই তা কাঞ্চন স্যাকরাকে দিয়ে ভেঙে আবার অন্য প্যাটার্নের গয়না গড়ানো হতো। তখন ছেলে ছোট। মা বাবা ভেবেছে ছেলে যেমন ছেলেমানুষ আছে, তেমনি বরাবর ছেলেমানুষই থাকবে, কিন্তু সেই রবারের বেলুন কেনা থেকে শুরু করে কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ, আর ফটিক প্রামাণিকের হয়রানির ঘটনাগুলো যে সে এতদিন ধরে মনের ভেতর পুষে রাখবে তা কে কল্পনা করতে পারবে? শশী কয়ালকেই বা কেন সে তার বাবা বিধু কয়ালের কথা জিজ্ঞাসা করবে? আর কালীগঞ্জের বউ?

পরের দিন যথারীতি সকাল হলো।

সদানন্দ সকালবেলাই খেয়ে-দেয়ে কোথায় বেরিয়ে গেল। আগের দিনের লোকজনের আনাগোনাও আর নেই। হট্টগোলও তেমনি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকাশ মামা নেই, গৌরী নেই। দুটো লোকের অনুপস্থিতিতে সমস্ত বাড়িটাই যেন তখনও খাঁ-খাঁ করছে।

চৌধুরী মশাই দুপুরবেলা ভেতর বাড়িতে খেতে এসেছিল। খেয়ে উঠে নিজের শোবার ঘরে শুয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। খানিক পরে প্রীতিও এল।

চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–খোকা কোথায়? সে খেয়েছে?

প্রীতি বললে–হ্যাঁ, খেয়েই বেরিয়ে গেল।

–কোথায় গেল?

প্রীতি বললে–তা আমি কী করে বলব? সে কি কখনও আমাকে বলে যায়?

–কালকে রাত্তিরে তো নিজের ঘরেই শুয়েছিল? বউমা এলেও ওই ঘরেই শোবে তো এবার থেকে?

প্রীতি বললে–আমি তো সে-কথা জিজ্ঞেস করেছিলুম। তা কিছু জবাব দিলে না।

–কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড না বাধিয়ে বসে! ও যা ছেলে, ও সব পারে, কেন শুচ্ছে না তার কারণটা কিছু বলেছে ও তোমাকে?

প্রীতি বললে–ওর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারি নে। ওকে বললে ও কোথাকার কে কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ, কোন্ ফটিক প্রামাণিক, কালীগঞ্জের বউ তাদের কথা তোলে। তা আমি তাই ওসব কথা আর জিজ্ঞেসও করি না, ওসব বুঝিও না।

চৌধুরী মশাই যেন নিজের মনেই বলে উঠলেন–পাগল, একেবারে আস্ত পাগল! কই, দেশে-গাঁয়ে তো এত ছেলে আছে, এত ছেলে বিয়ে করছে, কেউ তো এমন পাগলামি কখনও করে নি!

প্রীতি বললে–তা যাদের নাম করছে ও, তারা কারা? তারা ওর কী করেছে?

চৌধুরী মশাই বললেন–ভগবান জানে! কে যে ওর মাথায় ওই সব কথা ঢোকালে তাই-ই ভেবে পাচ্ছি না। ও নিশ্চয়ই প্রকাশের কাণ্ড!

প্রীতি বললে–প্রকাশ? প্রকাশের নামে কেন দোষ চাপাচ্ছো শুনি? দোষ করলো তোমার ছেলে আর দায়ী হলো প্রকাশ–তুমি সব ব্যাপারে প্রকাশকে দায়ী করো কেন বলো তো?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা ছোটবেলা থেকে প্রকাশই তো ওকে নিয়ে ঘুরছে। কোথায় রাণাঘাটে নিয়ে গিয়েছে যাত্রা শুনতে। কোথায় ঢপ কীর্তন হচ্ছে সেখানে নিয়ে গেছে। আমি তো তখন থেকেই তোমাকে বারণ করেছিলুম ওর সঙ্গে মিশতে দিও না তুমি আমার কথা শুনতে না–এখন যা হবার তাই হয়েছে–

প্রীতি বললে–এখন যত দোষ সেই আমার ঘাড়েই পড়লো। তোমার ছেলে, তুমি সব সময় নিজের কাছে রেখে দিলেই তো পারতে৷

চৌধুরী মশাই বললেন–তা আমার কি আর কোনও কাজকর্ম নেই? ছেলে ঘাড়ে করে নিয়ে থাকলে আমার চলবে? নানান ঝঞ্ঝাটের মধ্যে আমাকে থাকতে হয়, আমি কখন খোকাকে দেখি বলো দিকিনি? তুমি বাড়ির মধ্যে থাকো, তুমি দেখবে না তো কে দেখবে?

প্রীতিরও রাগ হয়ে গেল। বললে–তা তোমার একলারই বুঝি কাজ আছে, আর আমি ঝাড়া হাত-পা, না? আমার কোনও কাজ নেই বুঝি? এই যে এতগুলো লোক বাড়িতে পুষেছ তাদের তদারকি কে করে শুনি? তার বুঝি কোনও মেহনৎ নেই?

চৌধুরী মশাই দেখলেন কথাগুলো ঝগড়ার দিকে মোড় নিচ্ছে। আর বিশ্রাম নেওয়া হলো না। আর একটু হলে একেবারে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যাবে। তিনি উঠলেন।

বললেন–একবার চণ্ডীমণ্ডপের দিকে যাই। প্রকাশ বোধ হয় এবার আসবে, তাদের আসবার টাইম হলো!

বলে বাইরের দিকে চলে যাচ্ছিলেন। তারপর হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল। আবার ফিরে এলেন।

বললেন–একটা কথা, একজন বলছিল নানা রকম দৈব ওষুধ নাকি দেয় একজন সাধু–

–দৈব ওষুধ?

–হ্যাঁ, সবাই নাকি ফল পেয়েছে। হাঙ্গামা কিছু নেই, শুধু হাতে পরলেই কাজ হয়।

প্রীতি বললে–মাদুলি?

চৌধুরী মশাই বললেন–মাদুলিও দেয়, খাবার ওষুধও দেয়। ব্যাপারটা আমি ঠিক পুরোপুরি জানি না। আমি তাকে ডেকে পাঠিয়েছি

প্রীতি বললে–তোমার ছেলে যা, ও কি মাদুলি-টাদুলি পরবে?

–ছেলে না পরে বউমা পরবে! বশীকরণ-টশীকরণ কত রকম জিনিস তো থাকে ওদের। কাল রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে আমি তাই ভাবছিলুম।

প্রীতি বললে–-ছেলে পরবে না। বউমা পরলে যদি কাজ হয় তো না হয় চেষ্টা করে দেখতে পারি। কিন্তু খাবার ওষুধ আমি খাওয়াতে পারবো না, শেষকালে কী হতে কী হয়ে যাবে তার ঠিক নেই। তখন উল্টে উৎপত্তি হয়ে যাবে হয়ত–

–দেখি, সে লোকটার এখনি আসবার কথা আছে—

বলে চৌধুরী মশাই চণ্ডীমণ্ডপের দিকে এগোতে লাগলেন।

.

বিকেল বেলার দিকেই হই-হই করে প্রকাশ মামা আর গৌরী পিসী এসে হাজির হলো। তারা কেষ্টনগরে বউমাকে পৌঁছিয়ে দিয়ে এক রাত সেখানে কাটিয়ে ভোরের ট্রেনে আবার এসেছে। এসব কাজে প্রকাশ মামার জুড়ি নেই। শুধু তাকে মাতব্বরী করতে দিতে হবে। অর্থাৎ মোড়লী। মোড়লী করতে পেলে আর কিছু চায় না প্রকাশ মামা।

গৌরী এসেই সোজা ভেতরবাড়িতে ঢুকেছে। কিন্তু সদানন্দ যখন বাড়ি ঢুকলো তখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গিয়েছে। সকালে খেয়ে দেয়ে সেই যে বেরিয়েছিল তখন থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বাড়িতে কী ঘটেছে তা তার জানা ছিল না। চণ্ডীমণ্ডপের কাছে আসতেই চৌধুরী মশাই ভেতর থেকে দেখতে পেয়েছেন।

ডাকলেন–শোন–

সদানন্দ ভেতরে ঢুকতেই দেখলে চৌধুরী মশাই-এর সামনে কে একজন বসে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। লোকটার মাথায় ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল। তেল-চকচকে মুখের চামড়া। গায়ে একটা নামাবলী। আর দুটো ভুরুর মধ্যে কপালে একটা মস্ত বড় সিঁদুরের টিপ।

চৌধুরী মশাই ছেলের দিকে চেয়ে বললেন–এঁকে প্রণাম করো–

সদানন্দ কী করবে বুঝতে পারলে না। কে এ, কেন এখানে এসেছে! চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সাধু-সন্ন্যাসী মানুষের মত।

–করো, প্রণাম করো। কী, দেখছো কী চেয়ে?

সদানন্দ বললে–কেন, প্রণাম করবো কেন?

চৌধুরী মশাই বললেন–ইনি তোমার ভালো করবেন, এঁকে প্রণাম করলে তোমার ভালো হবে।

সদানন্দ বললে–আমার কী ভালো করবেন?

চৌধুরী মশাই বললেন–তুমি তো বড় তর্ক করো দেখছি। আমি যা বলছি তাই করো। প্রণাম করলে তোমার ক্ষতিটা কী?

সদানন্দ বললে–আমার ভালোর দরকার নেই, আমি প্রণাম করবো না। যাকে-তাকে আমি প্রণাম করবো কেন?

চৌধুরী মশাই আর থাকতে পারলেন না। হঠাৎ রাগের ঝোঁকে একেবারে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমার মুখের ওপর কথা বলো? আমি বলছি ওঁকে প্রণাম করো।

সদানন্দ তবু নির্বিকার। বললে–আমি তো বলেছি আমি প্রণাম করবো না, আবার কতবার বলবো?

–প্রণাম করবে না?

–না।

এর পর চৌধুরী মশাই ঝোঁকের মাথায় কী করে ফেলতেন বলা যায় না, কিন্তু সেই সন্ন্যাসী উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে হাত বাড়িয়ে বাধা দিলেন। বললেন–থাম, তুই থাম–

সামান্য কথা, সঙ্গে সঙ্গে চৌধুরী মশাই জল হয়ে গেলেন। যেন মন্ত্রের মত কাজ হলো।

চৌধুরী মশাই সন্ন্যাসীর দিকে চেয়ে বললেন–দেখলেন তো বাবা, আমার ছেলে কী রকম বাপের অবাধ্য! কেমন মুখের ওপর আমার কথার জবাব দিচ্ছে! আমি কোথায় ছেলের ভালোর জন্যে ভাবছি, আর ছেলে কী রকম ব্যবহার করছে আমার সঙ্গে, দেখলেন তো?

সন্ন্যাসী বললেন–তুই শান্ত হ, মাথা গরম করিস নি, সব ঠিক হয়ে যাবে

–ঠিক হবে বাবা? সব ঠিক হবে?

সন্ন্যাসী ভদ্রলোক বললেন–হ্যাঁ রে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

চৌধুরী মশাই তখন আবার নিজের জায়গায় বসে পড়েছেন বটে, কিন্তু উত্তেজনায় তখনও হাঁফাচ্ছেন। বললেন–জানেন বাবা, এই ছেলের জন্যেই আমি কী করেছি জানেন? হাজার হাজার টাকা খরচ করেছি ওর পেছনে। যাতে ও মানুষ হয়, যাতে ও দশজনের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে তার জন্যেই তো খরচ করেছি। নইলে আমার আর কী স্বার্থ? আমি আর কদিন? আমি যা কিছু রেখে যাবো একদিন ও-ই তো তার মালিক হবে। কিন্তু এ এমনই নেমকহারাম যে আমার মুখের ওপর কথা বলে! এত বড় ওর আস্পর্ধা!

সন্ন্যাসী ভদ্রলোক কিন্তু এত কথার পরও বিচলিত হলেন না। হাসতে হাসতেই বলতে লাগলেন–সব ঠিক হয়ে যাবে রে, তুই কিছু ভাবিস নি। আমি যখন এসে পড়েছি তখন তোর আর কিছুছু ভাবনা নেই–

চৌধুরী মশাই যেন বিগলিত হয়ে গেলেন। বললেন–সেই জন্যেই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি বাবাজী! এখন আপনিই আমার ভরসা–

বাবাজী বললেন–তোর ভাগ্য খুব ভালো যে ঠিক সময়েই আমার দেখা পেয়েছিস—

তারপর সদানন্দর দিকে চেয়ে বললেন–তোর নাম কী রে বেটা?

সদানন্দ ক্ষেপে উঠলো। বললে–আমাকে বেটা বলছো কেন?

বাবাজী সদানন্দর কথা শুনে কোথায় রেগে উঠবেন তা নয়, হো-হো করে একেবারে ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন। বললেন–এখনও রক্ত গরম আছে তো, তাই গরম গরম কথা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। এখনও ষড়ৈশ্বর্যের জাঁক যায় নি।

তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সদানন্দের কপালের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে দেখলেন।

বললেন–আরে, তোর কপালে যে ভৃগুপদচিহ্ন রয়েছে রে! কী আশ্চর্য, আগে তো দেখি নি–

চৌধুরী মশাই বললেন–ভৃগুপদচিহ্ন? তার মানে? তার মানে কী বাবাজী?

বাবাজী বললেন–তোর ছেলে আসলে কে জানিস?

–কে?

–স্বয়ং ভৃগু ঋষি এ-জন্মে তোর ছেলে হয়ে তোর ঘরে জন্মেছে। ভৃগু ঋষির খুব সংসার করবার ইচ্ছে হয়েছিল একবার। গেল জন্মে সংসার করার শখ মেটেনি তো, তাই এ জন্মে তোর ছেলে হয়ে এই নবাবগঞ্জে এসেছে। তোর বংশের খুব সুসার হবে রে। তোর বংশে দেশ-আলো করা বংশধর জন্মাবে। তোর বংশের যশ-খ্যাতি সারা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে

সদানন্দ এতক্ষণ সব শুনছিল। এবার বললে–ও সব বুজরুকি ছাড়ো, ওই বলে বাবার কাছ থেকে টাকা হাতাবার জন্যে চেষ্টা করছো…..

-খোকা!

চৌধুরী মশাই আবার গর্জন করে উঠলেন ছেলের দিকে চেয়ে।

বাবাজী চৌধুরী মশাইকে আবার ধমক দিলেন। বললেন–আবার তুই ছেলের ওপর রাগ করছিস! ঠিক আগেকার জন্মের মত রাগী মেজাজ নিয়ে যে ও জন্মেছে। ঋষি মানুষের রাগ, ও আর কতক্ষণ! ও রাগতেও যতক্ষণ, আবার ওরাগ জল হতেও ততক্ষণ। ভৃগু ঋষি যে এই রকমই রাগী মানুষ ছিলেন রে, তা জানিস না?

চৌধুরী মশাই জীবনে কখনও ভৃগু ঋষির নামই শোনেন নি। শুধু ভৃগু ঋষি কেন, কোন ঋষিরই নাম শোনেন নি তিনি। মুনি-ঋষিদের ধারকাছ দিয়েও কখনও যাবার দরকার হয় নি তাঁর। বরাবর জমি-জমা-টাকা কড়ি-সুদ-আড়তদার-উকিল-মুহুরি জজ নিয়েই কেবল মাথা ঘামিয়েছেন। উকিল কিম্বা জজের জীবনী জানতে চাইলে তবু তিনি কিছু বলতে পারতেন। কোন্ জজ রাগী, কোন্ জজ অমায়িক, কোন্ জজ সৎ, কোন্ জজ অসৎ তা তাঁর মুখস্থ। হঠাৎ বাবাজীর মুখে মুনি-ঋষির কথা শুনে নির্বাক হয়ে রইলেন। সত্যি সত্যিই যদি ভৃগু ঋষি তাঁর ছেলে হয়ে এসে থাকে তাহলে তাঁর যে আরো সম্পত্তি হবে সেই সহজ কথাটা সহজেই বুঝতে পারলেন। তাই ছেলের বেয়াদপির জবাবে কিছু বলতে গিয়েও তিনি থেমে গেলেন।

বাবাজী হঠাৎ তখন এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলেন। সদানন্দর দুটো পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকাতেই সদানন্দ তিন হাত পেছিয়ে এল।

বললে–রাখো রাখো, বুজরুকি রাখো তোমার!

বাবাজী কিন্তু রাগলেন না। বললেন তুমি রাগ করছো কেন বাবা? আমি তো তোমাকে প্রণাম করছি না, আমি ঋষিশ্রেষ্ঠ ভৃগুকে প্রণাম করছি

সদানন্দ অনেকক্ষণ বুজরুকি সহ্য করেছে। কিন্তু এবার আর পারল না।

বললে–ওসব বুজরুকি আমি অনেক দেখেছি, আর দেখতে চাই না, আমি যাই–

চৌধুরী মশাই বললেন–চলে যাচ্ছ কেন?

সদানন্দ বললে–চলে যাবো না তো কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই ন্যাকামী দেখবো? আমি আর দাঁড়াবো না এখানে। যা করতে পারেন আপনি করুন গে

বলে ঘর থেকে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই প্রকাশ মামা ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঢুকে পড়ে সব দেখেশুনে অবাক। সদানন্দের দিকে চেয়ে বললে–কী রে, কী করছিস এখানে!

চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–ও-দিকের খবর সব ভালো তো প্রকাশ? বেয়াই মশাইকে কেমন দেখলে?

প্রকাশ মামা বললে–খুবই মুষড়ে পড়েছেন বেয়াই মশাই। আমি সান্ত্বনা দিলুম তাঁকে। বললুম-মৃত্যু কি কারো হাত-ধরা! জীবন-মৃত্যু সবই ভগবানের দেওয়া, সবই মাথা পেতে নেওয়া ছাড়া মানুষের আর কোনও উপায় নেই।

–আর বউমা?

–বউমা খুব কান্নাকাটি করছিলেন। তাঁকেও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এলুম।

–বউমাকে আবার কবে এখানে পাঠাবেন?

প্রকাশ মামা বললে–বলেছি তো তাড়াতাড়ি পাঠাতে। বলেছি যত শিগগির পারেন পাঠিয়ে দেবেন, আমরা বউমার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকবো।

তারপর সদানন্দর হাত ধরে তাকে বাইরে নিয়ে এল। বাইরে নিয়ে এসেই বললে– কী রে, তুই নাকি ফুলশয্যের রাত্তিরে বউমার সঙ্গে শুসনি? তুই নাকি বউমাকে একলা ঘরে ফেলে বাইরে পালিয়ে গিয়েছিলি?

সদানন্দ কোনও কথা বললে না।

–কী রে, কথার জবাব দিচ্ছিস না যে? অমন সুন্দরী বউ এনে দিলুম, আর তুই কিনা তার কাছেই শুলিনে? ব্যাপার কী বল্ তো? দিদির কথা শুনে আমি তো অবাক! দিদি তো আমাকেই বকছে। আমারই দোষ দিচ্ছে দিদি। বলছে–তুই কী রকম বউ এনে দিলি যে আমার ছেলেকে ঘরে আটকে রাখতে পারলে না? কী ব্যাপার বল দিকিনি? তুই তো আমাকে কিছুই বলিস নি। আমি ভেবেছি তুই আয়েস করে নতুন বউ নিয়ে রাত কাটিয়েছিস, আর এদিকে এই কাণ্ড? কী হলোটা কী? তোর বউ তোকে কিছু বলেছে? না তোর বউ পছন্দ হয় নি? ব্যাপারটা কী? আমি অত খুঁজে খুঁজে ডানাকাটা-পরী এনে দিলুম তোকে আর তুই কিনা তাকে অপগেরাহ্যি করছিস এমনি করে?

সদানন্দ তবু সে কথার কোন জবাব দিলে না। ভেতর বাড়ি থেকে কে একজন লোক আসছিল, তাকে দেখেই প্রকাশ মামা কথা বলতে বলতে থেমে গেল। বললে–আয়, ইদিকে আয়, তোর সঙ্গে সিরিয়াস কথা আছে আমার, একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে জিনিসটার ফয়সালা করতে হবে

বলে সদানন্দকে পুকুরপাড়ের দিকে টেনে নিয়ে গেল।

চণ্ডীমণ্ডপের ভেতরে বাবাজী তখন ভৃগু ঋষির মাহাত্ম্য বর্ণনা করছিলেন। ত্রিকালজ্ঞ ঋষি। অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ যাঁর ছিল নখদর্পণে। একদিন তিনিই দিব্যচক্ষে দেখতে পেলেন কলিযুগে তিনি নবাবগঞ্জের হরনারায়ণ চৌধুরীর ঔরসে আবার সংসার-ধর্ম পালন করবার জন্যে জন্মগ্রহণ করবেন।

চৌধুরী মশাই একসময়ে বললেন–আচ্ছা বাবাজী, আমার ছেলের আসল রোগের কথাটা বলি–

–রোগ? কী রোগ?

চৌধুরী মশাই বললেন–আপনি জানেন তো আমার এত জমিদারি এত সম্পত্তি, কিন্তু মাত্র ওই একটি ছেলে। এই ছেলের আমি সবে বিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ছেলে ফুলশয্যার রাত্তিরে বউ-এর সঙ্গে শোয়নি। কখন সকলের চোখের আড়ালে ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছে—

বাবাজী চোখ বুজিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। আর মৃদু মৃদু হাসছিলেন। তেমনি হাসতে হাসতেই বললেন–তারপর?

–তারপর আর কী। সকালের দিকে ওর মা ওকে জিজ্ঞেস করলে কেন ও ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, জবাবে ও বললে–বউ-এর সঙ্গে ও শোবে না।

বাবাজী বললেন– কেন? শোবে না কেন?

–ওই কথা বলে কে? আপনিই বলুন, আমার যদি বংশরক্ষে না হয় তাহলে আমার এত সম্পত্তি খাবে কে? কেন তাহলে আমি আমার ছেলের বিয়ে দিলুম? অথচ রূপে গুণে একেবারে জগদ্ধাত্রীর মত রূপ দেখে আমার পুত্রবধূ করেছি।

কথা বলতে বলতে চৌধুরী মশাই-এর যেন হঠাৎ খেয়াল হলো। জিজ্ঞেস করলেন–আজকে রাত্রে আপনার আহারের কী বন্দোবস্ত করবো বাবা?

বাবাজী বললেন–আমি আহার করি না রে, আমি সেবা করি। সন্ন্যাস গ্রহণ করবার পর থেকে আহার করা আমি ছেড়ে দিয়েছি–

চোধুরী মশাই শশব্যস্ত হয়ে বললেন–ঠিক আছে, আপনি বসুন, আমি আপনার সেবার ব্যবস্থাটা আগে করে ফেলি–

ভেতর বাড়িতে গিয়ে চৌধুরী মশাই একেবারে সোজা গৃহিণীর সঙ্গে দেখা করলেন। বাবাজী যে আহার করেন না, শুধু সেবা করেন সেটা বুঝিয়ে বললেন।

প্রীতি বললে–আর কী বললেন উনি?

চৌধুরী মশাই বললেন–বললেন তো অনেক ভালো কথা। এত ভালো ভালো কথা বললেন, যে সে-সব বিশ্বাস করতেও ভয় হয়।

–কী রকম?

বললেন–খোকা নাকি আগের জন্মে ভৃগু ঋষি ছিলেন, এ জন্মে তোমার ছেলে হয়ে এসেছে। ওকে বকাবকি করতে বারণ করলেন।

প্রীতি কথাগুলো শুনে খানিকক্ষণ চৌধুরী মশাই এর মুখের দিকে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর বললে–সত্যি?

চৌধুরী মশাই বললেন–সত্যি মিথ্যে বুঝি না। উনি যা বললেন তা যদি সত্যি হয় তাহলেই ভালো। ওঁর কথা শুনে মনটা একটু ভালো হলো। কিন্তু তোমার ছেলে যেরকম বেয়াড়া, বললাম যে বাবাজীকে একবার প্রণাম করো, তা কিছুতেই করলে না। বললে কী জানো? বললে, বুজরুক!

–বুজরুক বললে?

–হ্যাঁ, মুখের ওপর ওঁকে বুজরুক বলে উঠলো। তা আমি আর কী করব! ছেলের হয়ে আমিই ক্ষমা চেয়ে নিলুম। এখন ভালো করে ওঁর সেবার ব্যবস্থা করে দাও। ছানা, দুধ, ফল মিষ্টি যা আছে তাই দিয়ে ওঁর সেবা করো–

তা সেই রকম ব্যবস্থাই হলো। বাবাজী সেদিন থেকেই বাড়িতে রয়ে গেলেন। বাবাজী মহাশক্তিধর পুরুষ। নিজের কথা বেশি বলতে চান না। যত না কথা বলেন তার চেয়ে বেশি অনুভব করেন। চৌধুরী মশাই বাবাজীর ব্যবহারে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। চৌধুরী মশাই-এর গৃহিণীও এল। এসে প্রণাম করলে।

বাবাজী আশীর্বাদ করলেন।

বললেন–তোর ভালো হবে মা, আমি সব জানি। তোর কিছু ভয় নেই। এবার তো আমি এসে পড়েছি।

প্রীতি বললে–আমার ওই ছেলেকে নিয়েই যত ভাবনা বাবা। ও সংসারী হবে তো?

বাবাজী বললেন–আমি তো আছি রে, আমাকে তুই বকলমা দিয়ে দে, তোর ভাবনাটা আমি ভাববো।

এ রকম করে আগে কখনও ভরসা দেয়নি কেউ। প্রীতি গলে গেল। তার মনে হলো এত কিছু ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা সব বুঝি তার দূর হয়ে গেল। বললে–আমার ওই ছেলেই সব চেয়ে বড় ঝামেলা বাবা। লোকের মেয়ে নিয়ে ঝঞ্ঝাট হয়, আমার ঝঞ্ঝাট হয়েছে ছেলে নিয়ে।

একবার কথা বলতে আরম্ভ করলে মেয়েদের পেটে আর কোনও কথা বাকি থাকে না। সমস্ত কথা বলে যেন প্রীতি তৃপ্তি পেলে।

হঠাৎ প্রকাশ ঘরে ঢুকলো। বাবাজী তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন–এ কে?

প্রীতি বললে–-সম্পর্কে আমার ভাই হয় বাবা—

বাবাজী এবার আরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চাইলেন তার দিকে।

চৌধুরী মশাই বললেন–প্রকাশ, তুমি এঁকে প্রণাম করো–

প্রকাশ মামা শুধু প্রণামই করলে না। একেবারে বাবাজীর পায়ের ধুলো নিয়ে জিভে ঠেকালে। তারপর হাত জোড় করে সামনে বসলো। ততক্ষণে বাবাজীর সেবা হয়ে গেছে। সমস্ত বাড়িতে তখন আর কোনও কাজ নেই, কোনও সমস্যাও নেই। সমস্ত শক্তি সমস্ত সামর্থ্য যেন বাবাজীর সেবায় ন্যস্ত করেই এ বংশের কর্তা গিন্নী পরিত্রাণ পেতে চাইছে। বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে সবাই যেন এই বাবাজীকে আশ্রয় করেই বেঁচে থাকতে চাইছে। বলছে–আমাদের সব দুঃখ দূর করো বাবা, আমাদের শান্তি দাও, সুখ দাও, ঐশ্বর্য দাও, সমৃদ্ধি দাও। আমাদের একমাত্র সন্তানকে সুমতি দাও সে যেন সংসারী হয়, সহজ হয়, স্বাভাবিক হয়, সাধারণ হয়। আর কিছু আমরা চাই না–

কিন্তু সুখ শান্তি সৌভাগ্য দেবার বিধাতা বোধ হয় মনে মনে হাসলেন। হাসলেন কিংবা হয়ত কটাক্ষ করলেন। সদানন্দ সবই শুনলো। সব কথাই কানে গেল তার। সে বুঝতে পারলে তার জন্যেই এত আয়োজন, এত সেবা, এত পরিশ্রম।

তা পরিশ্রমও কি কম! সেদিন থেকেই বাড়ির অন্য চেহারা। প্রকাশ মামা আবার একটা কাজ পেয়ে গেল। কর্তাবাবু ওপরের ঘরে একলা পড়ে থাকেন। কৈলাস গোমস্তা খাতা নিয়ে হিসেব লেখে, আদায়পত্রের খবরাখবর দেয়। তার ওপর দীনু আছে।

কাজ করতে করতে হঠাৎ কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করেন–নিচে শাঁখ বাজাচ্ছে কে কৈলাস?

কৈলাস সব জেনেও বলে–আজ্ঞে ও শাঁখ তো আমাদের বাড়িতে বাজছে না, পালেদের বাড়িতে বাজছে

–এমন অসময়ে শাঁখ বাজাচ্ছে কেন?

কৈলাস গোমস্তা বলে–কোনও পুজোটুজো হচ্ছে বোধ হয়। বেহারি পাল তো খুব ভক্তমানুষ।

তা হবে। এর পরে আর কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু পরের দিনও তেমনি।

কর্তাবাবু বলেন–বেহারি পালের পয়সা হয়েছে, বুঝলে, কৈলাস! বেনে-মশলার দোকান করে দুটো পয়সা হয়েছে বলে দেব-দ্বিজে ভক্তি বেড়ে গেছে। ও সব ভড়ং আমরা বুঝি।

কৈলাস বলে–আজ্ঞে ভক্তি-টক্তি সব বাজে কথা, আসল হচ্ছে টাকা

কর্তবাবু বলেন–বেহারি পাল টাকা ছাড়া আর কিছুকেই পুজো করে না, বুঝলে কৈলাস! টাকাই ওর কাছে ঠাকুর দেবতা যা-কিছু সব–

ক’দিন ধরে খুবই কাঁসরঘণ্টার আওয়াজ আসতে লাগল কর্তাবাবুর কানে। আসুক। কর্তাবাবুর তাতে আর কোনও ক্ষোভ নেই। হোক, সকলেরই টাকা হোক। আমার আর কোনও ভয় নেই। আমার মত এত সম্পত্তি, এত ঐশ্বর্য, এতখানি কারো না হলেই হলো। তা হলেই অমি নিশ্চিন্ত।

–আচ্ছা কৈলাস, তুমি তো অনেক বাড়ির বউ দেখেছ, এমন রূপে গুণে আলো করা বউ আর কারো দেখেছ? বলো তুমি, দেখেছ কখনও?

কৈলাস বললে–আজ্ঞে, আপনার বউমার সঙ্গে কার তুলনা! এ লক্ষতে একটা হয়।

–আর আমার নাতি? সদানন্দ? অমন নাতি কারো আছে? গাঁয়ে তো কত ছেলেই রয়েছে, এমন ছেলে কজনের আছে শুনি? ও বেহারি পাল যতই পূজো করুক আর কাঁসর ঘণ্টা বাজাক আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে?

কৈলাস বলে–কী যে বলেন! আপনি হাসালেন কর্তাবাবু। আপনার সঙ্গে বেহারি পালের তুলনা?

কর্তাবাবু বলেন–না না, আমি কথার কথা বলছি। কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ কানে আসে কিনা রোজ, তাই কথাটা বললুম–

কৈলাস বলে–আজ্ঞে বেহারি পাল কি মানুষ? বেহারি পাল সুদে টাকা খাটায়। সুদখোর। সুদখোরকে কখনও কেউ ভক্তি-শ্রদ্ধা করে? অথচ আপনাকে? আপনাকে তো সবাই ভক্তি করে শ্রদ্ধা করে।

কর্তাবাবুর জানতে আগ্রহ হয়। জিজ্ঞেস করেন–ভক্তি-শ্রদ্ধা করে নাকি আমাকে?

–তা করে না? আপনার সামনে যেমন শ্রদ্ধা করে তেমনি আবার আপনার আড়ালেও আপনাকে শ্রদ্ধা করে। আর করবে না-ই বা কেন? আপনার মত মানুষ তো হয় না।

–লোকে তা–ও বলে নাকি?

কৈলাস বলে-বলে বইকি।

–কী বলে?

কৈলাস বলে–বলি কর্তাবাবুর মত মানুষ হয় না।

কথাটা শুনে কর্তাবাবুর মনটা খুশী হয়। কর্তাবাবু খুশী হলে তা সবাই বুঝতে পারে। তখন তাঁর গোঁফ-জোড়া একটু কাঁপতে থাকে, চোখ দুটো একটু কুঁচকে যায়। সবাই বুঝতে পারে। কর্তাবাবুর কাছে তখন যদি কিছু আর্জি করা যায় তো চটপট মঞ্জুর হয়ে যাবে। তখনই সবাই যা চাইবার তা চেয়ে নেয়। কেউ জমি-জমা চায় কেউ টাকা হাওলাত চায়। কেউ বা ঝাড় থেকে দু’খানা বাঁশ। আবার কেউ বা নগদ টাকা পয়সা।

নাতির বিয়ের পর থেকেই কর্তাবাবুর মেজাজটার মধ্যে যেন বেশ একটা খুশী-খুশী ভাব ছিল। ফুলশয্যার পরদিন যেদিন তিনি শুনলেন যে তাঁর নাতি বউ-এর সঙ্গে এক ঘরে এক বিছানায় রাত কাটিয়েছে, তখন থেকেই একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। তাঁর আসল শত্রু ছিল কালীগঞ্জের বউ, তার জীবনের রাহু। সেই রাহুই যখন চিরকালের মত বিদায় নিয়েছে তখন আর কাকে পরোয়া! যখন মানুষের শত্রু থাকে না তখনই উদার হতে পারে। তখনই তার মুখে হাসি ফোটে। তখন সবাই তার উদারতার প্রশংসা করে। কিন্তু উদার যে হবো তার উপাদান কে দেবে? কে আমার অভাব ঘোচাবে, কে আমার শত্রু নিপাত করবে, কে আমার মাথা উঁচু করে দেবে? তুমি আমার অভাব ঘোচাও, তুমি আমার শত্রু নিপাত করো, তুমি আমার মাথা উঁচু করো, আমি তখন সৎ হবো, সাধু হবো, মহৎ হবো, দাতা হবো। আরো কত কী হবো। রেলবাজারের দারোগা টাকা নিয়েছে বটে, তা নিক। ন্যায্য পাওনা নিলে কর্তাবাবুর কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু বংশী ঢালীরা বড্ড বেশি টাকা নিয়ে ফেলেছে। তা নিক। বৃহৎ কাজে অমন অপব্যয় একটু হয়েছে, তার জন্যে মেজাজ খারাপ করলে কি চলে?

তারপর হঠাৎ যেন কাজের কথা মনে পড়ে যেত কর্তাবাবুর। বলতেন–তারপর কী হলো কৈলাস, তারপর পড়ে যাও–

একটা অর্ধ সাপ্তাহিক বাংলা খবরের কাগজ কিনতেন কর্তাবাবু। কৈলাস গোমস্তা সেটা অবসরমত পড়ে পড়ে শোনাতো।

–কই, থামলে কেন? পড়ে যাও?

কৈলাস গেমস্তা ভালো করে পড়তে পারতো না। হোঁচট খেতে খেতে পড়তো–

বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, বরোদার মহারাজা গাইকোয়াড আজ কলিকাতায় আসিয়া পৌঁছাইতেছেন…

কোথাকার কোন্ গাইকোরাড, সে কোন্ দেশ, কে তার মহারাজা, কেনই বা তার নাম গাইকোয়াড তা কৈলাসও যেমন জানতো না, কর্তাবাবুও তেমনি জানতেন না। তবু খবরের কাগজে যখন খবরটা বেরিয়েছে তখন তিনি নিশ্চয়ই কেষ্ট-বিষ্ণু কেউ হবেন। আর মহারাজা মানুষ যখন নিশ্চয়ই তিনি অনেক টাকার মালিক! অনেক টাকার মালিকদের ওপর কর্তাবাবুর খুব শ্রদ্ধা ছিল বরাবর।

কর্তাবাবু বলতেন–আচ্ছা কৈলাস, মহারাজাদের অনেক টাকা আছে, কী বলো?

কৈলাস বলতো-আজ্ঞে, তা তো আছেই–

তা কত টাকা থাকতে পারে মহারাজাদের?

মহারাজাদের কত টাকা থাকতে পারে তার কোনও আন্দাজ জানা ছিল না কৈলাসের। তবু আন্দাজ করে বলতো–দশ বারো লাখ টাকা নিশ্চয়ই–

কর্তাবাবু বলতেন–আরে দূর দশ-বারো লাখ টাকা কি আবার টাকা! তোমার যেমন বুদ্ধি! আমারই তো দশ বারো লাখ টাকার সম্পত্তি আছে। তুমি তো হিসেব জানো, হিসেব করো না–

হিসেব অবশ্য শেষ পর্যন্ত করতে হতো না। কৈলাস জানতো কর্তাবাবু কত টাকার সম্পত্তির মালিক। কিন্তু মহারাজাদের কাছে কখনও গোমস্তাগিরি করে নি বলে তাদের টাকার অঙ্কটাও আন্দাজ করতে পারতো না কৈলাস গোমস্তা।

ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত যখন কোনও ফয়সালা হতো না তখন অন্য প্রসঙ্গ উঠতো। কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করতেন–তা সে যাকগে, গাইকোয়াড মহারাজা কলকাতাতে আসছেনই বা কেন বলো তো? তোমার কী মনে হয় কৈলাস?

কৈলাস বলতো–আজ্ঞে, আমি সামান্য লোক, আমি কী করে তা জানবো!

–তা সামান্য লোক হলেই বা, একটু মাথা খাটিয়ে ভাবো না, কেন আসছে মহারাজা? কাগজে কিছু লিখেছে সে সম্বন্ধে?

কৈলাস পাঁতিপাঁতি করে খুঁজেও মহারাজার কলকাতায় আসার কোনও হদিস পেলে না। শুধু মহারাজার আসার খবরটাই ছাপা হয়েছে, কোনও কারণের উল্লেখ নেই কোথাও।

কর্তাবাবু খুঁজে খুঁজে অনেক কষ্টে একটা কারণ বার করলেন। বললেন–বুঝলে কৈলাস, আমার মনে হয় মহারাজা আসছে শিকার করতে

–শিকার?

–হ্যাঁ, বাঘ শিকার করতে আসছে, বুঝলে? কলকাতার কাছেই তো সুন্দরবন। সুন্দরবনে অনেক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আছে, তা-ই শিকার করতে আসছে। বুঝতে পেরেছি। নইলে সেই বরোদা থেকে মহারাজা কলকাতায় আসবেনই বা কেন?…তারপর অন্য কী খবর আছে, পড়ো–

এই রকম করেই দিন কাটতো কর্তাবাবুর। সদানন্দের বিয়ের পর থেকেই কর্তাবাবুর মনটা বেশ সরেস ছিল, তাই খবরের কাগজের খবরে বেশি মন দিতেন। কখনও বরোদার গাইকোয়াডের কলকাতায় আসার খবর, কখনও ধান-চাল-পাটের দর, আবার কখনও বেহারি পালের টাকার গরমের কথা। সব কথাই হতো।

হঠাৎ একদিন কৈলাস বললে–কেষ্টনগরের চিঠি এসেছে কর্তাবাবু

–চিঠি? কে লিখেছে? বউমার বাবা? বউমা আসছে নাকি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, শ্রাদ্ধশ্রান্তি মিটে গেছে তো, এবার আসছেন বউমা।

কথাটা বলতেই মনে পড়ে গেল কর্তাবাবুর। বললেন–কই, তুমি তো কাঞ্চন স্যাকরাকে ডাকলে না কৈলাস? আমি যে তোমাকে ডাকতে বলেছিলুম।

–আজ্ঞে, আমি তো খবর দিয়েছিলুম।

–তা তবু সে এল না কেন? তাহলে আবার একবার ডেকে পাঠাও তো—

কাঞ্চন স্যাকরাকে শেষ পর্যন্ত একদিন লোক পাঠিয়েই ডেকে আনতে হলো। কাঞ্চন আসতেই কর্তাবাবু খুব একচোট ধমক দিলেন। বললেন–তুমি যে একেবারে লবাব-পুত্তুর হয়ে গেলে হে, কাঞ্চন! তোমার বুঝি খুব টাকা হয়েছে? টাকার গরম হয়েছে খুব? তা অতই যদি টাকার গরম তো তুমি এলে কেন হে বাপু? না এলেই পারতে!

কাঞ্চন খুব বিনয় করে জানালে যে তার অসুখ হয়েছিল বলেই এতদিন আসতে পারে নি। নইলে আগেই আসতো ইত্যাদি ইত্যাদি…

কিন্তু তবু কিছুতেই কর্তাবাবুর রাগ কমে না। বললেন–তুমি বেরিয়ে যাও। আমার চোখের সামনে থেকে বেরিয়ে যাও। আমি তোমাকে দিয়ে আর জীবনে কখনো গয়না গড়াবো না। যাও–তুমি বেরিয়ে যাও–

এ-সব কথা যে রাগের কথা তা কাঞ্চন স্যাকরা জানতো।

শেষকালে বুঝি অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর কর্তাবাবুর রাগ কমলো।

বললেন–তুমি আমার গয়না গড়াবে কিনা আগে সেই কথা বলে দাও, নইলে বাজারে অন্য অনেক স্যাকরা আছে। স্যাকরার অভাব নেই দুনিয়াতে। পয়সা ফেললে অমন তোমার চেয়ে অনেক ভালো ভালো স্যাকরা এসে আমার খোশামোদ করবে, তা জানো?

তারপর একটু কেশে নিয়ে বললেন–তুমি ভেবেছ কী শুনি? তুমি ভেবেছ কী? তুমি কী ভেবেছ তুমি ছাড়া বাড়ির নাতি-নাতবউ-এর গয়না গড়াবার লোক পাব না।

শেষকালে একসময় কর্তবাবু কাঞ্চন স্যাকরাকে ক্ষমা করলেন। শুধু যে ক্ষমা করলেন তাই নয় আগাম টাকাও দিলেন শখানেক। ওটা বায়না। কাঞ্চন বায়না নিতে চায় নি। তবু কর্তাবাবু টাকাটা দিলেন। বললেন–ওটা তুমি নাও কাঞ্চন। তুমি গরীব লোক, তুমি টাকা পাবে কোত্থেকে? টাকা না পেলে তোমার চাড় হবে না। আমার অনেক টাকা আছে, বুঝলে? গাইকোয়াডের মহারাজাদের মত টাকা নেই বটে, কিন্তু টাকা আমার অনেক আছে। সোজা কথা, জিনিসটা ভালো আর খাঁটি হওয়া চাই–এটা মনে রেখো

কুড়ি ভরির একটা হার। তার ওপর মিনের কাজ করা। লোকে দেখে যেন বলে– হ্যাঁ, কর্তাবাবু একটা জিনিসের মত জিনিস দিয়েছে বটে!

বাইরে এসে কাঞ্চন স্যাকরা টাকাগুলো ভালো করে ট্যাঁকে গুঁজে নিলে। কৈলাস গোমস্তা সঙ্গে সঙ্গে আসছিল। কাঞ্চন জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা গোমস্তা মশাই, কার জন্যে এ হার গড়ানো হচ্ছে বলুন তো? এ কাকে দেবার জন্যে? কর্তাবাবু কাকে হার দেবেন?

কৈলাস হাসতে লাগলো। বললে–চৌধুরী মশাই-এর নাতির জন্যে

–চৌধুরী মশাইয়ের নাতি? কিন্তু এই তো সবে সেদিন চৌধুরী মশাই-এর ছেলের বিয়ে হলো, এর মধ্যে নাতি হয়ে গেল তার? এখনও তো দশ মাস হয় নি গো?

কৈলাস গোমস্তা আরো হাসতে লাগলো। বললে–নাতি হয় নি, কিন্তু হবে তো একদিন!

কাঞ্চন অবাক হয়ে গেল। যে নাতি হয় নি তারই জন্যে কর্তাবাবুর এত হাঁক ডাক! একেবারে এই মারে তো সেই মারে! যেন নাতির অন্নপ্রাশন আটকে যাচ্ছে হারের জন্যে!

কৈলাস গোমস্তা বললে–পাগল হে কাঞ্চন, আস্ত পাগল। নেহাৎ চাকরি করতে হয় তাই এত কথা শুনি নইলে আমাকে তো দুবেলায় যাচ্ছেতাই করে বলেন। তুমি ভেবেছ চৌধুরী মশাই-এর নাতি হবে? হবে না। তুমি দেখে নিও, হবে না–

–হবে না? হবে না মানে?

কৈলাস বললে–সে-সব পরে তোমাকে বলবো। তুমি এখন যাও–

কাঞ্চন বললে–কিন্তু শেষকালে হার নেবেন তো কর্তাবাবু? নইলে আমার মেহনতই যে সার হবে গোমস্তা মশাই?

কৈলাস বললে–আরে তোমার কী? তুমি মাল দেবে পয়সা নেবে। চৌধুরী মশাই-এর নাতি হোক না-হোক তোমার কী? তুমি তো মজুরী পেলেই খুশি!

–কিন্তু কেন নাতি হবে না গোমস্তা মশাই?

কৈলাস গোমস্তা তখন বাড়িতে খেতে যাচ্ছিল। তার খিদে পেয়ে গিয়েছিল। বললে– আরে, তোমার কেবল ওই এক কথা। বলছি তো সে তোমাকে পরে বলবোখন। আমি আসি–

বলে কৈলাস বাড়ির দিকে চলে গেল।

.

কালীগঞ্জের বউ যে একদিন কর্তাবাবুকে নির্বংশ হবার অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল সে কথাটা এখন কাউকে না বলাই ভালো। ওটা চাপা থাক। ওটা আর কারো মনে না থাকলেও শুধু কৈলাস গোমস্তারই মনে থাকুক। যে-কথাটা মনে করলেও বুকটা কেঁপে ওঠে সেটা তোমাদের কারো জানবার দরকার নেই। দশ হাজার টাকা মাত্র! দশ হাজার টাকার খেসারত দেবে কর্তাবাবুর নাতি! সেই খেসারত দেবার বৃন্তান্ত কাঞ্চন স্যাকরা নাই বা জানলো!

তা সত্যিই কেষ্টনগর থেকে একদিন বেয়াই মশাই-এর চিঠি এসেছিল।

শ্রাদ্ধশ্রান্তি নির্বিঘ্নে চুকে গেছে। তিনি নিজেই নয়নতারাকে নিয়ে নবাবগঞ্জে আসছেন।

কিন্তু এ আসা বড় মর্মান্তিক আসা। নিয়ম ছিল মেয়ের সন্তান না হলে বাবা-মা কাউকেই বেয়াই বাড়িতে আসতে নেই! কিন্তু কী করা যাবে? আর কে আছে তার? কার সঙ্গে পাঠাবেন মেয়েকে?

নয়নতারা বলেছিল–বাবা এত তাড়াতাড়ি কেন আমাকে পাঠাচ্ছো, আর কিছুদিন না-হয় তোমার কাছে থাকি। আমি চলে গেলে কে তোমার দেখাশোনা করবে?

কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই-এর কিন্তু অনেক সহ্যক্ষমতা। পাছে মেয়ের কান্না পায় তাই স্ত্রী-বিয়োগের শোকে মেয়ের সামনে নিজেও কোনোদিন কাঁদেন নি। মেয়ের সামনে বলেছেন–তাতে কী হয়েছে মা! মানুষ কি চিরকাল বাঁচে? একদিন না একদিন তো তাকে যেতেই হয়। তোমার মাও তাই চলে গেছেন–

এও এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে তার ঠিক নেই। মেয়ে বাবার মুখের দিকে চায় আর বাবা চায় মেয়ের মুখের দিকে। তবু যে তিনি যাবার আগে মেয়ের বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছেন এইটেই তো সান্ত্বনা। নইলে কী হতো বলো তো মা!

ভট্টাচার্য মশাই বলেন–তুমি আমার জন্যে ভেবো না মা। আমার ছাত্ররা রয়েছে তারাই আমাকে দেখবে।

মেয়ে বলে–তুমি তোমার শরীরের দিকে একটু দেখো বাবা। তুমি নিজেকে না দেখলে কেউ তোমাকে দেখবে না।

–সে তোকে বলতে হবে না রে। আমি দেখবি ঠিক চালিয়ে যাবো। আমার তো কোনও অসুখ নেই

–অসুখ না-ই বা থাকলো, অসুখ হতে কতক্ষণ! এতদিন মা ছিল তাই তোমাকে দেখেছে, এখন তো আর মা নেই! আর আমাকেও তো তুমি আবার নবাবগঞ্জে পাঠিয়ে দিচ্ছ। আমি আর কিছুদিন থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো!

ভট্টাচার্যি মশাই বলেন–আমার কিছু ক্ষতি হতো না মা, কিন্তু তোর?

–বা রে, আমার কী ক্ষতি?

ভট্টাচার্যি মশাই বলেন—না না মা, তোর শ্বশুর-শাশুড়ী, সদানন্দ তারা কী ভাববে বল দিকিন–

মেয়ে বলে–হ্যাঁ, আমার জন্যে তাদের ভাবতে বয়ে গেছে। আমার কথা যদি তারা এতই ভাবতো তো এতদিনের মধ্যে তারা অন্তত একবার একখানা চিঠি দিত। কই, মার শ্রাদ্ধে তো খবর দিয়েছি, তা তারা কেউ এল?

কথাটার মধ্যে যুক্তি আছে। সত্যিই তো, তারা তো কেউই আসেনি। শুধু মেয়ের মামাশ্বশুরকে পাঠিয়ে দিয়েছিল একবার নামমাত্র। তাও তো আবার নিজের মামাশ্বশুর নয়।

ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–তাই তো মা, সদানন্দও তো একবার আসতে পারতো?

মেয়ে বলে–কেন আসবে? কেন আসতে যাবে তারা?

ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–সে কি কথা, আসবে না? জ্ঞাতি কুটুমের বিপদে-আপদে আসবে না?

মেয়ে বলে–না, তারা আসবে না। বড়লোক কেন গরীব লোকের বাড়ি আসবে? তুমি তো বড়লোক বলেই তাদের বাড়িতে আমার বিয়ে দিয়েছিলে! আমি খেয়ে পরে সুখে থাকবো বলে তোমার লোভ লেগেছিল। এখন? এখন দেখলে তো?

এসব কথা শুনে ভট্টাচার্য মশাই মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন। পাড়ার লোকেরাও কেউ কেউ মন্তব্য করলে। বললে–এত বড় একটা কাণ্ড হলো, অথচ জামাই তো কই এল না–

ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–আরে বাপু, জামাই কি আমার বেকার মানুষ যে বললেই হুট করে চলে আসবে! জমিদার মানুষ, কাজকর্ম থাকতে নেই? হয়ত কোর্টকাছারির দিন পড়েছে। তা জামাই না এলেও মামাকে তো পাঠিয়ে দিয়েছে–

–কিন্তু বেয়াই মশাই? বেয়াই মশাই একবার আসতে পারতেন না?

–তোমরা বিশ্বনিন্দুক। সবাই তোমরা বিশ্বনিন্দুক হে! বেয়াই মশাইদের কত বড় জমিদারি কত বড় তালুক তা তোমরা জানো? না যদি জানো তো ওই বিপিন দাঁড়িয়ে রয়েছে, বিপিনকেই জিজ্ঞেস করো না। বিপিন ফুলশয্যার তত্ত্ব নিয়ে গিয়েছিল। ও দেখে এসেছে। এক হাজার লোক পাত পেড়ে কালিয়া পোলোয়া খেয়ে গিয়েছে। আর নয়নতারাও তো ছিল, ওকেও জিজ্ঞেস করো। ও–ও দেখেছে। ওর শাশুড়ী কত বড় সীতাহার দিয়েছে দেখেছ? ওজন করলে অন্তত দু’শো ভরি হবে–

প্রশ্নকর্তারা দু’শো ভরি ওজনের কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। বলে–না, না, কী যে বলেন আপনি পণ্ডিত মশাই, দু’শো ভরির হার কখনও নয়–

–কখনও নয়? আচ্ছা এখখুনি প্রমাণ করে দিচ্ছি–ও নয়ন, নয়ন–

বলে তখনি পাশের ঘরে চলে যান। একেবারে নয়নতারার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বলেন– হ্যাঁরে তোর শাশুড়ী যে-হারটা তোকে গায়েহলুদে দিয়েছিল সেটার ওজন কত রে? দু’শা ভরি নয়? নিখিলেশ বলে কি না, দুশো ভরি কখনও হতে পারে না–

নয়নতারা বলে–আমি জানি না–

-জানি না মানে? তুই সে হার দেখিস নি? তুই আয় না আমার সঙ্গে, একবার বাইরে আয়। ওদের বুঝিয়ে বলবি আয় তো!

নয়নতারা আর পারে না। বলে–তুমি চুপ করো তো বাবা। আমি বলতে পারবো না–

–আয় না মা, আয় না। একবার এলে তোর ক্ষতিটা কী?

নয়নতারা শেষকালে অধৈর্য হয়ে ওঠে। বলে–তুমি যাও তো বাবা, আমি যেতে পারবো না, আমায় আর বিরক্ত করো না তুমি যাও

বলে নিজের দুই হাতে নিজের মুখটা ঢেকে ফেলে।

কিন্তু মুখ ঢাকলেই কি আর মান ঢাকা যায়! যার নিজের মান ঢাকবার দায় পরের ওপর নির্ভরশীল, তার মান-অপমানের দামই বা কতটুকু! কতটুকুই বা তার দায়িত্ব। কেমন করেই বা পরের অপরাধ সে তার মুখের কথা দিয়ে ঢাকবে! একটা পাতলা লজ্জাবস্ত্র দিয়ে যে তার সমস্ত মান-সম্ভ্রমের দায়িত্ব নেবার শপথ নিয়েছে তার পক্ষ নিয়ে কৈফিয়ৎ দেওয়াটাই তো লজ্জাকর। এ যেন সেই চোরের পক্ষ নিয়ে চোরের মা’র গলাবাজি।

তবু আশ্চর্য, শেষ পর্যন্ত আবার মাথা নিচু করে সেই অপরাধীদের কাছেই কিনা আসতে হয়। মেয়ে-মানুষের জীবনে এ-বিড়ম্বনার চেয়ে বুঝি বড় বিড়ম্বনা আর কিছু নেই। তাই বাবার সঙ্গে যখন আবার নয়নতারা নবাবগঞ্জে তার শ্বশুরবাড়িতে এসে নামলো তখন কে যেন ঘোমটা দেওয়া নিচু মাথাটাকে আরো নিচু করে দিয়ে তবে অব্যাহতি দিলে।

কিন্তু ততদিনে চৌধুরীবাড়িতে আরো অনেক কাণ্ড ঘটে গেছে। সন্ধ্যেবেলা শাখ-কাঁসর ঘন্টা বাজে আর বাবাজী যজ্ঞ করে। যজ্ঞের সময় বাবাজীর সে কী মুর্তি। যজ্ঞের মন্ত্র পড়া। দেখে চৌধুরী মশাই-এর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রীতিও যজ্ঞস্থলে গলাবস্ত্র হয়ে হাত-জোড় করে বসে থাকে।

বাবাজী মন্ত্র পড়তে পড়তে এক-একবার বিকট চিৎকার করে ওঠেন–মা মা—মা–

প্রকাশ মামা আর থাকতে পারে না। দু’হাতে গায়ের জোরে কাঁসরে ঘা দেয়। আর চেঁচিয়ে ওঠে–জয়, জয় জগদম্বা–

এব্যাপারে প্রকাশ মামারই যেন সব চেয়ে বেশি উৎসাহ। এই সেদিন বাড়িতে একটা বিয়ের ঘটা গেছে। তখন গোগ্রাসে গিলেছে কদিন ধরে। তার পরে গেছে কেষ্টনগরে শ্রাদ্ধ বাড়িতে। সেখানেও গণ্ডে-পিণ্ডে খেয়েছে। সেখান থেকে এসেই আবার এই উৎসব। উৎসব মানেই সেবা। বাবাজী তো আহার করেন না, শুধু সেবা করেন। প্রকাশ মামাও এসে পর্যন্ত আহার করা ছেড়ে দিয়ে সেবা শুরু করে দিয়েছে। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা দিস্তে দিস্তে ময়দার লুচি, নলেনগুড়ের কাঁচাগোল্লা, বেলের পানা, মিছরির সরবৎ, পেস্তাবাদাম আর আরো কত রকমের মেওয়া।

বাবাজী বলেন–যজ্ঞ সার্থক করতে হলে মনটা সাত্ত্বিক করার সঙ্গে সঙ্গে সাত্ত্বিক সেবাও চাই–

প্রকাশ মামা বলে–নিশ্চয়ই, সাত্ত্বিক সেবাই শ্রেষ্ঠ সেবা বাবাজী। ওতে মনটাও ভালো থাকে, পেটটাও তেমনি–

এই সাত্ত্বিক সেবার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ মামার পেটটা ভালো যাচ্ছিল বলে মনটাও বেশ উদার হয়ে উঠছিল। সে বলতো আপনি কিছু ভাববেন না জামাইবাবু, ও সদা এবার ঠিক হয়ে যাবে। দেখবেন একেবারে কেঁচোর মতন বউ-এর পায়ে লেপটে থাকবে–

লেপটে থাকলেই ভালো। চৌধুরী মশাই সেই ভরসাতেই দু’হাতে টাকা খরচ করেন। কাজকর্ম সব ছেড়ে-ছুঁড়ে বাবাজীর পায়ের ওপর পড়ে আছেন।

প্রীতি ভক্তিগদগদ হয়ে বাবাজীকে প্রশ্ন করতো আমার ছেলে সংসারী হবে তো বাবা?

বাবাজী বলতেন–হবে না মানে? ওর কপালে ভৃগু-পদচিহ্ন রয়েছে, আর সংসারী হবে না?

প্রীতির বোধ হয় তবু সন্দেহ যেত না। জিজ্ঞেস করতো–কবে সংসারী হবে বাবা?

বাবাজী বলতেন–তোর বউমা এবার আসুক, বউমা এলেই দেখতে পাবি কেমন সংসারী হয়েছে তোর ছেলে।

প্রীতি জিজ্ঞেস করতো–তা আমার ছেলে বউতে ভাব হবে তো?

–হ্যাঁ রে হ্যাঁ, হবে। আমি যখন বলছি তখন হবেই–দেখে নিস–

–বউ-এর সঙ্গে একঘরে শোবে তো বাবা? ফুলশয্যার রাত্তিরে সারারাত আমি বউমার সঙ্গে শুয়েছি বাবা। আমার কপালে সে যে কী কষ্ট গেছে তা আপনাকে আমি আর কী বলবো! বউমাও যত কাঁদে আমিও তত কাদি। এত কান্নার ফল ফলবে তো বাবা?

প্রকাশ মামা বলতো–তুমি অত ভাবছো কেন বলো তো দিদি। আমিও তো আছি। আমাকে যদি তুমি এ-কথা আগে বলতে তো অনেক আগেই আমি মুশকিল আসান করে দিতুম। তুমিও বলো নি, সদাও কিছু বলে নি। আমি ভেবেছি সদা ফুলশয্যের রাত্তিরে বউয়ের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে। আমি কি এ-সব ছাই আগে জানতুম!

দিদি বলতো–তুই কী করে ঠিক করতিস?

প্রকাশ মামা বলতো–আমি? আমি কী করে ঠিক করতুম তা আমি এবারই দেখিয়ে দেব তোমাকে। আমি সদাকে বউমার শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরের দরজায় শেকল তুলে দেব। দেখি কী করে সদা বউকে রেখে পালায়! তাহলে আর এত যাগ-যজ্ঞ করতে হতো না, আর এত টাকাও খরচ করতে হতো না।

তারপরই আবার নিজেকে শুধরে নিয়ে বলতো–তা যাগ-যজ্ঞ করছো ভালোই করছো। বাবাজী ওদিক থেকে কল চালাবে আর আমি এদিক থেকে কল চালাবো, দেখি এবারে বাছাধন কী করে পার পায়?

দোতলায় বসে কর্তাবাবুর কানে সব শব্দই যায়।

বলেন–বেহারি পালের বড় বাড় বেড়েছে কৈলাস, বড় বাড় বেড়েছে–এত বাড় ভালো নয়

কৈলাস গোমস্তাও সায় দেয়। বলে–হ্যাঁ কর্তাবাবু, আপনি ঠিকই বলেছেন, বড় বড় বেড়েছে

কর্তাবাবু বলেন–সুদখোর মানুষ তো। সুদখোররা এদিকে পয়সার পিশাচ আর বাইরে ওই দেব-দ্বিজে ভক্তি, ওই কাঁসর-ঘণ্টা শাঁখ ও-সব ভড়ং–

হঠাৎ দীনু এসে খবর দিলে–কেষ্টনগর থেকে বউমা এসেছে–

কর্তাবাবুর মুখ প্রসন্ন হলো। কাঞ্চন স্যাকরাকে কুড়ি ভরির হার গড়াতে দিয়েছেন। একশো টাকা বায়নাও দিয়েছেন তার জন্যে। তার গয়না গড়ানো সার্থক হোক!

জিজ্ঞেস করলেন–বউমাকে কে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে?

–আজ্ঞে বউমার বাবা।

এই-ই প্রথম বলতে গেলে কালীকান্ত ভট্টাচার্য মেয়ের শ্বশুরবাড়ি এলেন। মেয়ের বিয়ের আগে একবার এসেছিলেন, কিন্তু সে আসা বেয়াই হিসেবে আসা নয়। এ বাড়ির কুটুম হিসেবে এই-ই তার প্রথম আসা। কিন্তু বেশিদিন যে তিনি থাকতে পারবেন না সেটা প্রথমেই জানিয়ে দিলেন। দুপুরে এলেন আবার বিকেলের গাড়িতেই চলে যাওয়া।

বললেন–থাকলে কি আমার চলে বেয়াই মশাই, ওদিকের কাজ-কর্ম তো সবই ফেলে রেখে এসেছি–আর বাড়িতেও তো কেউ নেই। বাড়িও একেবারে ফাঁকা রয়েছে।

তারপর বউমার মায়ের কথা উঠলো। শেষকালে কী হয়েছিল, ডাক্তার দেখে কী বললে, আগে কোনও অসুখ-বিসুখ হয়েছিল কিনা। জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে যে-সব বাঁধা বুলি সবাই-ই বলে থাকে সেই সব কথাও হলো। জীবনকে যারা বেশি আঁকড়ে ধরে থাকে তারাই জীবনের অনিত্যতা সম্বন্ধে বেশি মুখর। তাই কর্তাবাবুই বেশি করে জীবনের নশ্বরতা সম্পর্কে বক্তৃতা করতে লাগলেন।

কালীকান্ত ভট্টাচার্য বললেন–আমাদের শাস্ত্রে আছে ফল যখন পাকবে তখন তার বোঁটা আলগা হবেই, তা তার জন্যে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু অকালমৃত্যুটাই দুঃখের কারণ। আমার গৃহিণীর বয়েস হয়েছিল তাই তিনি গেছেন। তাই আমি তার জন্যে কোনও দুঃখ করি নে কর্তাবাবু। আর তিনি তো নিজের হাতেই নয়নতারার বিয়ে দিয়ে গেছে। দেখে যেতে পেরেছেন কন্যা তাঁর সৎপাত্রেই পড়েছে–

প্রকাশ মামা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বললে–সৎ পাত্র যে তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই, সদানন্দ আমার ভাগ্নে বলে বলছি না, অমন সৎ পাত্র এ-যুগে জন্মায় না বেয়াই মশাই। আমি নিজে সে-সম্বন্ধে সার্টিফিকেট দিচ্ছি–

ভট্টাচার্যি মশাই হঠাৎ বললেন–কই, আমার বাবাজীকে তো দেখছি নে? কোথাও কাজে গেছে বুঝি?

চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ, একটু বেরিয়েছে–

প্রকাশ মামা বাকিটা পূরণ করে দিলে। বললে–সদার কাজের কি অন্ত আছে বেয়াই মশাই। এই এত বড় জমিদারি সবই বলতে গেলে একলা ওই সদাই দেখছে। জামাইবাবু বুড়ো হয়ে গেছে তো, তাই সদা বাবাকে বলেছে–তোমাকে কিছুছু দেখতে হবে না বাবা, এবার থেকে আমি নিজেই সব দেখবো–

ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–উপযুক্ত ছেলের মতই কথা বলেছে–

প্রকাশ মামা বললে–উপযুক্ত ছেলে মানে? সদা কি ভাবছেন উপযুক্ত ছাড়া অনুপযুক্ত কথা বলবে? বাপ-ঠাকুর্দার তেমন শিক্ষাই নয় বেয়াই মশাই। এই যে আমার জামাইবাবুকে দেখছেন, ইনিও বাপের উপযুক্ত ছেলে। এই এখনও এই বুড়ো বয়েস পর্যন্ত জামাইবাবু বাপ বলতে অজ্ঞান–। আপনার মেয়ের অনেক পুণ্যবল তাই এমন বংশে পড়েছে–

প্রকাশ মামা একটু আবার বলে উঠলো–আর তা ছাড়া এই আমার কথাই ধরুন না, আমি তো এবংশের কেউ নই, কিন্তু সদা ঠিক আমার ক্যারেক্টারের ধাঁচ পেয়েছে। আমি পিতৃ-মাতৃ ভক্ত, সদাও পিতৃ-মাতৃ ভক্ত। আপনাদের সংস্কৃতে যে শ্লোক আছে না, নরানাং মাতুলঃ ক্রমঃ, সদা একেবারে হুবহু তাই…

কথাটা বলে প্রকাশ মামা চৌধুরী মশাই-এর দিকে চাইলে। বললে–কী বলেন জামাইবাবু, ঠিক বলি নি?

কেউ তার কথায় সায় দিলে না দেখে প্রকাশ মামা তখন অন্য প্রসঙ্গ ওঠালো। বললে– তবে হ্যাঁ, একটা কথা, আপনি বেয়ানের শ্রাদ্ধে খাইয়েছিলেন বটে। বুঝলেন জামাইবাবু, অমন খাওয়া আমি বহুদিন খাই নি। আমি বোধ হয় দু’ডজন সরভাজা খেয়েছি। আঃ কী সোয়াদ–

কিন্তু এ কথাটাও কারো মনে গিয়ে দাগ কাটলো না। ওদিকে ভট্টাচার্যি মশাইএরও যাবার সময় হয়ে যাচ্ছিল। তিনি বললেন–এবার আমাকে উঠতে হয় বেয়াই মশাই–

যাবার আগে একবার মেয়ের সঙ্গে দেখা করবেন। প্রকাশ মামা সে ব্যবস্থা করে দিলে। বেয়াই মশাইকে একেবারে অন্দরমহলে নিয়ে গেল। ভট্টাচার্যি মশাই ঘরে ঢুকে চারিদিকে চেয়ে দেখলেন। বেশ সাজানো ঘর। আসবাবপত্রে মোড়া, দামী আয়না, দামী আলমারি, দামী চাদরে ঢাকা বালিশ বিছানা। তিনি নিজে ফুলশয্যার তত্ত্বের সঙ্গে যা পাঠিয়েছিলেন তা ছাড়াও আরো অনেক আসবাব দিয়েছে মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ী। ভট্টাচার্যি মশাই-এর মনটা ভারি হয়ে উঠলো। এসব কিছুই দেখে যেতে পারলে না নয়নতারার মা। মেয়ের এই সুখ এই ঐশ্বর্য চোখে দেখতে পেলে তিনিও খুশী হতেন।

বাবাকে দেখে নয়নতারা বিছানা থেকে নেমে এসে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল।

ভট্টাচার্যি মশাই আশীর্বাদ করলেন–সুখে থাকো মা, স্বামীর সংসারে লক্ষ্মী হয়ে থাকো, মনেপ্রাণে স্বামীর সেবা কোর, মেয়েমানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর নেই–

নয়নতারার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। ভট্টাচার্যি মশাই বললেন কাঁদতে নেই মা, ছিঃ, বাপ-মা কারো চিরকাল থাকে না। তোমাকে সুখী দেখতে পেলেই আমাদের সুখ। তুমি মনেপ্রাণে স্বামীর সংসার করো, তাই দেখেই তার স্বৰ্গত আত্মা সুখী হবে–তোমার দুঃখ কী মা, তোমার মতন স্বামী ক’জন পায় বলো তো। তা এবার চলি, সদানন্দর সঙ্গে দেখা হলো না, শুনলাম সে নাকি মামলার কাজে রানাঘাটে গেছে। বাড়ি এলে তাকে বলে দিও মা যে আমি এসেছিলুম, তাকেও আশর্বাদ করে গেছি–

নয়নতারা আর একবার বাবার পায়ে প্রণাম করলে। ভট্টাচার্যি মশাই আর দাঁড়ালেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। মায়া জিনিসটা এমন যে তা যত বাড়াও ততই বেড়ে যায়। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।

চৌধুরী মশাই বললেন–আবার আসবেন বেয়াই মশাই–

প্রকাশ মামা বলে উঠল–এবারের আসা ঠিক মনের মত আসা হলো না বেয়াই মশাই, এবার এসে জামাই-এর বাড়িতে রাত কাটিয়ে যেতে হবে কিন্তু

ভট্টাচর্যি মশাইও ভদ্রতা করে বললেন–ওদিকপানে গেলে আপনারাও কিন্তু যাবেন, একবার পায়ের ধুলো দেবেন।

প্রকাশ মামা বললে–আমাকে সে আর বলতে হবে না, নিশ্চয়ই যাবো, নিশ্চয়ই যাবো, গিয়ে আবার সরপুরিয়া সরভাজা খেয়ে আসবো–

আর তারপর ‘দুর্গা’ ‘দুর্গা’ বলে যাত্রা। গাড়ি ছেড়ে দিলে রজব আলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *