৪. অন্তরা

অন্তরা

এই হলো সদানন্দ চৌধুরীর অতীত। এই অতীত-জীবন নিয়েই সেদিন নিজের কাহিনী লিখতে শুরু করেছিল সদানন্দ চৌধুরী। সদানন্দ জানতো তার এ জীবন অকিঞ্চিৎকর। জীবনে সে নিজের জন্যে কখনও কিছুই কামনা করেনি। শুধু কামনা করেছিল সকলে সৎ হোক, সকলের মঙ্গল হোক। সকলের সততা সুখ আর মঙ্গলের মধ্যে দিয়েই সে নিজের জীবনের চরিতার্থতা খুঁজে পেতে চেয়েছিল। কোথায় সেই সুলতানপুর, কোথায় সেই নৈহাটি আর কোথায় সেই কলকাতা, আর কোথায় এই চৌবেড়িয়া। এই চৌবেড়িয়ার গন্ডগ্রামে অজ্ঞাতবাসের মধ্যেই একদিন সে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিল। ভেবেছিল নিজেকে অস্বীকার করে, নিজেকে বিলুপ্ত করেই সে নিজের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে। ঊধ্বর্তন পূর্বপুরুষের সমস্ত পাপ-পূণ্যের দায় থেকে সে নিষ্কৃতি পাবে।

কিন্তু তবু মাঝে-মাঝে তার সব কিছু মনে পড়ে যেত। মনে পড়ে যেত সেই কর্তাবাবুকে, সেই দুর্গা পিসিকে। মনে পড়ে যেত প্রকাশ মামাকে। সেই বেহারি পাল, সেই কপিল পায়রাপোড়া, সেই মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক আর কৈলাস গোমস্তা মশাইকে। অজ্ঞাতবাসে এলে তার মন কখনও পড়ে থাকতো ধর্মশালার সেই পাঁড়েজীর কাছে, আবার কখনও বউবাজারের সেই নিঃসঙ্গ বউটির কাছে। আর পড়ে থাকতে নিখিলেশ আর নয়নতারার কাছে। মনে হতো, সকলে ভালো থাকুক, সকলের মঙ্গল হোক। সকলের অভাব অনটন দূর হোক। নবাবগঞ্জের মানুষ এবার লেখাপড়া শিখে মানুষ লোক, ব্যাধি থেকে তাদের মুক্তি হোক, তাদের সব শোক-তাপ দূর হোক।

কতদিন হরি মুহুরি জিজ্ঞেস করেছে–আপনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাদের কথা বলেন মাস্টারবাবু? কাদের নাম করেন? তারা আপনার কে?

সদানন্দ অবাক হয়ে যেত। বলতো–কেন? কাদের নাম করি?

–নয়নতারার নাম করেন আপনি! তা নয়নতারা কে? আপনার মা নাকি?

সদানন্দ এ-কথার কিছু উত্তর দিত না। হরি মুহুরি বলতো–আবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গানও করেন আপনি–

–গান?

–হ্যাঁ, আপনার গলায় বেশ সুর আছে। হরু ঠাকুরের কবির গান কোথা থেকে শিখলেন? এককালে কবির দলে ছিলেন নাকি?

সদানন্দ জিজ্ঞেস করতো–কী গান গাই?

হরি মুহুরি হাসতো। বলতো–ওই যে কী যেন গানটা?

বলে সমস্ত গানটাই মুখস্থ বলে যেত–

আগে যদি প্রাণসখি জানিতাম।
শ্যামের পিরিত গরল মিশ্রিত।
কারো মুখে যদি শুনিতাম…

সদানন্দ শুধরে দিত। বলতো ‘শ্যামের পিরিত’ নয় মুহুরি মশাই কথাটা হচ্ছে ‘টাকার পিরিত’। ‘টাকার পিরিত গরল মিশ্রিত কারো মুখে যদি শুনিতাম…’

–কেন? টাকার পিরিত কেন?

সদানন্দ বলতো–হ্যাঁ মুহুরি মশাই, আমি যদি ও-গান লিখতুম তো শ্যামের পিরিত না  লিখে টাকার পিরিত লিখতুম। সংসারে সবাই টাকাকে যত ভালবাসে আর কিছুকে তত ভালাবাসে না। পৃথিবীর মানুষের কাছে শুধু ওই একটা জিনিসই সত্যি, আর সব কিছু মিথ্যে–

হরি মুহুরি মাস্টারবাবুর কথা শুনে অবাক হয়ে যেত। সদানন্দ বলতো কথাটা হয়ত খুব খারাপ শোনাবে কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকে কেবল ওই টাকার খেলাই দেখে এসেছি মুহুরি মশাই, দেখে দেখে আমার টাকার ওপর ঘেন্না হয়ে গেছে

–তা সে যেন হলো, কিন্তু ওরা কারা? ওই আর যাদের নাম করেন আপনি?

–আর কাদের নাম করি?

সদানন্দর আবার সব মনে পড়ে যেত। মুখ-চোখ কেমন গম্ভীর হয়ে যেত শোনবার সঙ্গে সঙ্গে। আবার ভুলে যাবার চেষ্টা করতো। কিন্তু তবু কি ভোলা যায়? চৌবেড়িয়ায় রসিক পাল মশাই তাকে যে কী চোখে দেখেছিলেন কে জানে! তিনি বুঝেছিলেন এ মানুষটি ঠিক সাধারণ কেউ নয়। তার অতিথিশালায় কত লোক আসত যেত, সেখানে সদানন্দকেও তিনি তাদের সঙ্গে পরম আদরে রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু আদর বোধ হয় সদানন্দের কপালে ছিল না। খাওয়া-পরার কোনও বিলাসিতাই স্পর্শ করতো না তাকে। স্কুল উঠে যাবার পরেও সদানন্দকেও ছাড়তে চাইলেন না তিনি। ছেলে ফকির পালকে বলে দিয়েছিলেন–মাস্টার যতদিন থাকতে চাইবে ততদিন ওকে তোমরা এখানে রেখে দেবে, বুঝলে!

সত্যিই তো, কোথায়ই বা সদানন্দ যাবে! যাবার কোনও জায়গাও তো তার ছিল না। ভোরবেলা নদীতে গিয়ে স্নান করে আসার পর অন্য সকলের সঙ্গে তারও জল-যোগের ব্যবস্থা থাকতো। কোনও দিন সদানন্দ খেত, কোনও দিন খেত না। পৃথিবীতে কখন কোথায় কী ঘটছে তা চৌবেড়িয়াতে বসে জানাও যেত না। শুধু পূর্ব দিকে সূর্য উঠতো আর পশ্চিম দিকে সূর্য ডুবতো। ঠিক এই সময়েই একদিন সদানন্দ হরি মুহুরি মশাইকে বলেছিল–আমাকে একটা খাতা আর দোয়াত-কলম দিতে পারেন মুহুরি মশাই?

–কেন? খাতা-দোয়াত-কলম কী করবেন?

সদানন্দ বলেছিল বসে তো আছি, তাই একটু আঁকিবুকি করতাম আর কি?

মাস্টারবাবুর নামে সেই খাতা আর দোয়াত-কলমের বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল। সদানন্দ সেই দিন থেকেই বসে বসে লিখতে আরম্ভ করেছিল। প্রথমেই আরম্ভ করেছিল এইভাবে—”আমি অতি সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের কথা আজকালকার ক্ষমতালোভী মানুষেরা শুনিবে কিনা জানি না। ক্ষমতা পাইবার লোভে যখন আজকাল যে কোনও অন্যায় আচরণ করিতে প্রস্তুত সেই সময় আমার মত সাধারণ মানুষের কাহিণী শুনিবার লোক নাই জানিয়াও আমি আমার এই জীবনী লিখিতে বসিয়াছি। এই অবিশ্বাসীর যুগেও আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন বিশ্বাসী প্রাণ মানুষ আছে। সে-মানুষ এখনও সততা এবং সত্যবাদিতাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে ধর্মকে, বিশ্বাস করে ভালবাসাকে এবং বিশ্বাস করে ঈশ্বরকে। এই তিন শক্তিকে যে বিশ্বাস করে না তাহার জন্য এ কাহিনী নয়। তারা আমার এ কাহিনী না পড়িলেও আমি দুঃখ করিব না। ঈশ্বর যদি একজন যীশুখৃষ্টের জন্য হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করিতে পারেন তাহা হইলে আমার মত নগণ্য লোক একজন সৎ পাঠকের জন্য লক্ষ লক্ষ বছর অনায়াসেই অপেক্ষা করিতে পারিবে।”

এমনি আরম্ভ করে অনেক দূর এগিয়েছিল। আর তারপরেই এসে হাজির হয়েছিল এই হাজারি বেলিফ। কী অদ্ভুত এই লোকটা। কোর্ট-কাছারির মানুষেরা বোধ হয় এমনিই হয়। প্রকাশ মামাও একদিন তার সঙ্গ ছাড়তে চায়নি। পেছনে লেগে ছিল আঠার মত। অথচ প্রকাশ মামা তো কোটের বেলিফ ছিল না এর মত।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–কত দিন এই চাকরি করছেন আপনি?

লোকটা বললে–তা কি মনে আছে মশাই, সেই ছোটবেলা থেকেই তো এ-লাইনে আছি। এতকাল কত লোকের সর্বনাশ করেছি তারই কি ঠিক আছে! কত হাজার হাজার লোকের ভিটে-মাটি চাঁটি করেছি, কত হাজার হাজার লোক সর্বস্বান্ত হয়েছে আমার জন্যে। হাজারি বেলিফকে দেখলে তাই তো সবাই শিউরে ওঠে–

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–কেন?

–তা শিউরে উঠবে না? কাছারির বেলিফ তো কখনও কারো ভালো করে না মশাই। আমার বাপ-মা তো তাই জেনেশুনেই আমার নাম রেখেছিল-হাজারি! এই যেমন আপনি, আপনি তো বেশ চৌবেড়িয়ায় নিশ্চিন্তে খাচ্ছিলেন-দাচ্ছিলেন, হঠাৎ শনির মত হাজারি বেলিফ এসে আপনার কাছে হাজির হলো। হাজারি বেলিফ যাকে একবার ছুঁয়েছে তার আর কোনও কালে নিস্তার নেই–

সদানন্দ বললে–তাহলে আমারও নিস্তার নেই?

হাজারি বেলিফ বললে–নিস্তার থাকবে কী করে? ধর্মের কল বাতাসে নড়ে তা তো জানেন? আপনি লুকিয়ে অধর্ম করবেন আর ভাবছেন হাজারি বেলিফের হাত থেকে নিস্তার পাবেন? তাহলে জজ ব্যারেস্টার-উকিল-মুহুরি কোর্ট-কাছারি আছে কী করতে? তাদের পেট চলবে কী করে? তারা কি বসে বসে ঘাস কাটছে বলতে চান? এই যে আমাদের দেশের যত বড় বড় লোক দেখছে সবাই উকিল ব্যারিস্টার। মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে সি আর দাশ, সুভাষ বোস, সবাই উকিল। উকিল-মুহুরি না হলে দেশ চালানো যায়? দেশে যত লোক আছে তাদের সব্বাইকে একদিন না একদিন কোর্টে আসতেই হবে, তাদের হাত থেকে পালিয়ে আপনি যাবেন কোথায়?

তারপর কথা থামিয়ে হঠাৎ বললে–কী মশাই, আর কতদূর নিয়ে যাবেন আমাকে? আর তো পারছি না।

কিন্তু সদানন্দ সেকথার উত্তর দিলে না। হাজারি বেলিফের কথাগুলোই সে ভাবতে লাগলো। সকলকেই কি তাহলে একদিন কোর্টে যেতে হবে? কোর্টে গিয়ে নিজের পাপ পূণ্যের জবাবদিহি করতে হবে? এতদিন তো বেশ ছিল সে। নিজের মনের অন্তস্থলে নিজের কৃত কর্মের প্রশান্তির মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তির সন্তোষ নিয়ে অজ্ঞাতবাস করছিল। সে ভাবত নবাবগঞ্জের মানুষ এই পনেরো বছরে গ্রামের স্কুল-কলেজে লেখাপড়া শিখে মানুষ হচ্ছে, তার তৈরী করে দেওয়া হাসপাতালে নবাবগঞ্জের মানুষরা অসুখে ওষুধ পাচ্ছে সেবা পাচ্ছে। নয়নতারার সংসারে শান্তি এসেছে, সাচ্ছল্য এসেছে, তারা সুখী হয়েছে। তার নিজের বলতে যথাসর্বস্ব যা ছিল সব কিছু দিয়ে সে সকলকে সুখী করতে পেরেছে এর চেয়ে মহৎ কাজ আর কী থাকতে পারে! তবু কিনা তাকে বিচারালয়ে যেতে হবে।

–কী মশাই? আর কত দূর? কথা বলছে না যে?

সত্যিই তো, একদিন তো সকলকেই বিচারশালায় গিয়ে বিচারকের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। একদিন সকলকে সেই বিচারকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে হয় মানবজন্ম পেয়ে আমি কী কী করেছি। কিন্তু সেখানকার জন্যেও তো সদানন্দর বক্তব্য আছে। সদানন্দ সেখানে গিয়ে বলবে–আমার সমস্ত অর্থ আমি সকলকে দান করে দিয়েছি, আমার নিজের কোনও লোভ নিজের কোনও কামনাকে আমি প্রশ্রয় দিইনি, আমি এমন কোনও কাজ করিনি যা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে আমার লজ্জা হবে! আমি নিষ্পাপ, আমি নিষ্কলুষ!

হাজারি বেলিফ্‌ আবার বললে–আমি আর হাঁটতে পারছি না মশাই, আমি এই এখানে বসে পড়লুম–

জীবন-প্রদক্ষিণ কি অত সোজা! একদিন যে যাত্রা তার অনাদিকাল থেকে শুরু হয়েছিল, আবার শুরু থেকে সেই জীবন পরিক্রমা করা কি আজ অত সোজা নাকি! শুরু থেকে আবার সেই একই যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়া।

হাজারি বেলিফ সত্যিই সেখানে বসে পড়লো। নৌকো থেকে নেমে সেই যে দু’জনে হাঁটতে শুরু করেছিল সে-হাঁটা যেন তাদের আর শেষ হয় না। পথে অনেক গ্রাম পড়েছে, অনেক হাট, অনেক গঞ্জ অতিক্রম করে এসে তবে পড়বে বাসডিপো। সেখান থেকে বাসে উঠে তবে যেতে হবে কলকাতায়। তারপর ভাগলপুর। ভাগলপুর থেকে ফিরে আবার কলকাতায়। তারপর সেই কলকাতা থেকে ট্রেনে উঠে তবে যেতে হবে নবাবগঞ্জ।

সদানন্দ বললে–চলুন চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্রথম সুলতানপুরে যাবো–তারপর সেখান থেকে যাবো নবাবগঞ্জ–

হাজারি বেলিফ বললে–ও-সব জায়গা দেখে আর কী করবেন মশাই? মিছিমিছি কষ্টই সার হবে। পুলিস কি আর মিছে কথা বলতে গেছে আপনার নামে? মিছে কথা বলে তাদের লাভ কী?

–কিন্তু আপনি যে বলছেন আমি আমার বাবাকে খুন করেছি—

হাজারি বেলিফ বললে–হ্যাঁ, আপনি নিজেই নিজের বাপকে খুন করেছেন আর তবু বলছেন খুন করেছেন কিনা জানেন না? তাহলে তিনশো দুই ধারার চার্জ হলো কেন আপনার নামে? পুলিস কি মিথ্যে কথা বলছে?

হঠাৎ হাজারি বেলিফ বললে–তার চেয়ে মশাই একটা কাজ করুন না, আমাকে গোটা পাঁচেক টাকা দিয়ে দিন না–

–কেন? আপনাকে পাঁচ টাকা দিলে কী হবে?

–আমি কোর্টে গিয়ে রিপোর্ট দিয়ে দেব যে আসামীকে খুঁজে পেলুম না।

সদানন্দ বললে–কিন্তু আপনি তো আমাকে খুঁজে পেয়েছেন–

হাজারি বললে–খুঁজে পেলেও আমি গিয়ে বলবো খুঁজে পাইনি–এরকম তো আমরা হামেশাই করি মশাই। এরকম না করলে আমাদের পেট চলে? কী বলছেন আপনি? মাইনে তো পাই মাত্তোর তিরিশ টাকা, এই সব উপরি পেয়েই তো আমাদের সংসার চলছে। নইলে এই মাগ গি-গণ্ডার বাজারে মেয়ের বিয়ে, লোক-লৌকিকতা কী করে সব কিছু করছি? ঘুষ নিয়েই তো পেয়াদা-পেসকারদের সংসার চলে–। তা পাঁচটা টাকা পেলে আপনিও বাঁচেন, আমিও বাঁচি–

হাজারি যত না কাজ করে তার চেয়ে কথা বলে বেশি। আসামীর খোঁজে একবার গেছে নবাবগঞ্জে, সেখান থেকে গেছে সুলতানপুরে, তারপর গেছে নৈহাটিতে। নৈহাটি থেকে কলকাতার ধর্মশালাতে। যেখানে যেখানে সদানন্দ চৌধুরীকে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেখানেই সে গেছে। কোর্টের পেয়াদা, এইটেই তার কাজ–এই আসামীদের সমন ধরিয়ে দেওয়া। তার সঙ্গে কিছুই থাকে না বলতে গেলে। থাকবার মধ্যে থাকে শুধু একটা পুঁটলি। পুঁটলির মধ্যে থাকে একখানা ধুতি আর একখানা গামছা। আর থাকে দাড়ি কামাবার সাজ-সরঞ্জাম। সাজ-সরঞ্জাম মানে একখানা ধারালো ক্ষুর আর ক্ষুর শান দেবার একটা পাথর। আর কিছু না। গাছতলা পেলে তো গাছতলা, আর নয় তো কোনও হাটের অটচালা। আর খাওয়া? কোর্টের পেয়াদাকে কে আর জামাই-আদর করে খাওয়াবে! কোর্টের পেয়াদা কি কারো কাছে সুখের খবর দেয়? কোর্টের পেয়াদা মানেই তো ঝামেলা!

সদানন্দও ভাবছিল যেতে যেতে। কী এমন সে করেছে! সংসারের সকলের সুখ, সকলের সমৃদ্ধি, সকলের শুভকামনাই তো সে চিরকাল করে এসেছে। সকলের শেষে যেদিন নৈহাটি থেকে চলে এসেছে সেদিন সে তো একেবারে যাকে বলে নিঃস্ব। নয়নতারাকে বিয়ে করে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়নি বলে তার ওপর যে অন্যায় সে করেছিল তার প্রায়শ্চিত্তও তো সে সেদিন করে এসেছে টাকা দিয়ে। শুধু একটা মাত্র কামনাই সে করেছিল সেদিন যে নয়নতারা যেন সুখে থাকে। সেইজন্যেই তো সে প্রথমেই লিখেছিল–এই অবিশ্বাসের যুগেও আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন বিশ্বাসী-প্রাণ মানুষ আছে। সে মানুষ এখনও সততা এবং সত্যবাদিতাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে ধর্মকে, বিশ্বাস করে ভালবাসাকে, বিশ্বাস করে ঈশ্বরকে।

নয়নতারার বাড়ি থেকে চলে আসার সময় ট্রেনে বসে তার ইষ্টদেবতার উদ্দেশে সেই শ্লোকটা বারেবারে সে আবৃত্তি করেছিল?

সর্বেহত্র সুখীনঃ সন্তু।
সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ ॥
সর্বে ভদ্ৰানি পশ্যন্তি
মা কশ্চিৎ দুঃখং আপ্লুয়াৎ ॥

অর্থাৎ সকলে সুখী হোক, সকলে ব্যাধিমুক্ত হোক, সকলে শান্তি পাক, সকলের দুঃখ দূর হোক। এই একটি কামনাই তো সারাজীবন সে করে এসেছে। এই কামনার জন্যেই তো সে নিজের পিতা-পিতামহের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, এই কামনার জন্যেই তো সে মা’র মনে কষ্ট দিয়েছে, এই কামনার জন্যেই তো সে সমরজিৎবাবুর মনে দুঃখ দিয়েছে। এই কামনার জন্যেই তো সে পৃথিবীর সমস্ত বিলাস-বৈভব থেকে দূরে থেকেছে। নইলে বাস্তব-জগতে কীসের অভাব ছিল তার! ইচ্ছে করলে সে তো ভোগের শিখরে বসে সমস্ত বিলাসের উপকরণের সাহায্যে ষোড়শ উপচারে নিজের বাহ্যিক ইন্দ্রিয়কে পরিতুষ্ট করতে পারতো। তা না করে সে নবাবগঞ্জকে সোনার দেশে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। সেখানে বিরাট কলেজ হয়েছে। মানুষের জীবনের সব চেয়ে বড় যে আশীর্বাদ সেই জ্ঞানের আশীর্বাদ পাবার পথ সে দেখিয়ে দিয়েছে। আজ নবাবগঞ্জের ছেলেমেয়েদের আর জলকাদা মাড়িয়ে ছ’ক্রোশ দূরে পড়তে যেতে হয় না। নবাবগঞ্জ এখন স্বর্গে পরিণত হয়েছে। যে কাজ তার পিতা-পিতামহের করার কথা, সদানন্দই সেই কাজ সমাধা করে দিয়ে এসেছে। সেখানে হাসপাতাল হয়েছে, সেই হাসপাতালে আজ শুধু নবাবগঞ্জ কেন, আশেপাশের সব গ্রামের লোকের বিনামূল্যে চিকিৎসা হচ্ছে। নবাবগঞ্জের কোনও কপিল পায়রা পোড়াকে আর অভাবে-অনটনে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হবে না। মানিক ঘোষ আর ফটিক প্রামাণিকদেরও আর অর্থাভাবে পাগল হয়ে পথে ঘুরে বেড়াতে হবে না। এ সব কাজ তো সদানন্দই করেছে।

আর নয়নতারা? নয়নতারার সর্বনাশই বা সে কী এমন করেছে?

হাজারি বেলিফ একটা গাছতলায় বসে তখন নিজের দাড়ি কামিয়ে নিচ্ছে। বেশ ধারালো ক্ষুরটা তার। একটা ছোট আয়নার ওপর নিজের মুখটার প্রতিবিম্বের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে-চেয়ে আপন মনে দাড়ি কামিয়ে যাচ্ছে সে।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা হাজারিবাবু? নয়নতারার আমি কী সর্বনাশ করেছি?

হাজারি বেলিফ বললে–তা আমি কী জানি মশাই, আমার সমন ধরিয়ে দেওয়ার কাজ, আমি আপনাকে সমন ধরিয়ে দিয়ে খালাস, আপনি নয়নতারার কী সর্বনাশ করেছেন তা আপনিই জানেন–পুলিস যখন চালান লিখেছে তখন কি আর না-জেনে-শুনে লিখেছে? নয়নতারা তো আপনার বউ-এর নাম–

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ—

হাজারি ক্ষুর চালাতে চালাতে একটু থেমে নিয়ে বললে–তা আপনার বউ রইল সেখানে, আর আপনিই বা চৌবেড়েতে একা-একলা পরের অন্নদাস হয়ে রয়েছে কেন? বউ-এর সঙ্গে আপনার বনিবনাই বা হলো না কেন? কী করেছিল আপনার বউ?

সদানন্দ বললে–সে তো অনেক কথা। সব কথা কি আর এইটুকু সময়ে বলা যায়?

হাজারি বললে–তা আমাকে না বলুন জেরার সময় হাকিমের সামনে তো সবই বলতে হবে। বউকে আপনি ত্যাগ করলেন কেন এটা যদি হাকিম জিজ্ঞাসা করেন, এর জবাব কী দেবেন? তা বউ কি আপনার কালোকুচ্ছিৎ?

সদানন্দ বললে—না–

–তাহলে? নষ্ট?

–না, তাও নয়। খুব সুন্দর দেখতে। আর স্বভাব-চরিত্রও তার খুব ভালো।

–দেখতেও সুন্দর আর স্বভাব-চরিত্রও ভালো? তাহলে তাকে ছাড়লেন কেন মশাই? তাহলে তো আপনারই দোষ। তাহলে খেতে-পড়তে পাচ্ছে না বলে হয়ত আপনার বউ খোরপোষের জন্যে হাকিমের কাছে আর্জি পেশ করেছে-আপনি যখন অগ্নি সাক্ষী রেখে তাকে বিয়ে করেছেন তখন তাকে খাওয়ানো-পরানোর দায়িত্ব তো আপনারই।

সদানন্দ বললে–না, তা নয় আমার বউ আবার আর একজনকে বিয়ে করেছে–

–আবার বিয়ে করেছে? কেন?

সদানন্দ বললে–আমি তাকে নিয়ে ঘর করিনি বলে।

হাজারি অবাক হয়ে গেল। বললে–তাই বলুন, বিয়ে করলেন আর ঘর করলেন না, সে বউ তো আর একটা বিয়ে করবেই। তা তারপর?

বলে আবার একমনে দাড়ি কামাতে লাগলো। দাড়ি কামানো থামিয়ে জিজ্ঞেস করলে– তারপর কী হলো?

সদানন্দ বললে–তারপর তাদের খুব অভাব-অনটন চলতে লাগলো—

হাজারি বেলিফ জিজ্ঞেস করলে–কেন? তার বরটা কী করে?

সদানন্দ বললে–একটা ছোটখাটো চাকরি করে। বউও চাকরি করে একটা অফিসে–

–তা উপরি কিছু আছে সে-চাকরিতে? মানে ঘুষ-টুষ?

সদানন্দ বললে–তা জানি না।

হাজারি বললে–ঘুষ না থাক, ওভারটাইম?

–তাও জানি না। বোধ হয় নেই।

হাজারি বললে–ঘুষ কি ওভারটাইম একটা কিছু না থাকলে আজকাল ছোট চাকরিতে লোকে সংসার চালাবে কী করে!

সদানন্দ অবাক হয়ে গেল। বললে–কেন? দু’জনের চাকরিতেও সংসার চলবে না?

হাজারি বললে–আপনি আছেন কোথায় মশাই? চাল ডালের দর কত জানেন? থাকেন তো পরের বাড়িতে, জিনিস-পত্তোরের দামের হিসেব তো আর রাখতে হয় না আপনাকে।

বলে দাঁড়িয়ে উঠলো হাজারি। হাজারি বেলিফ কোর্টের পেয়াদাগিরি করে করে কেমন যেন ছটফটে স্বভাবের মানুষ হয়ে গেছে। কোথাও চুপ করে যেমন বসে থাকতেও জানে না, তেমনি আবার যেখানে সেখানে একফালি জায়গা পেলে ঘুমিয়ে পড়তেও পারে। ঘুম থেকে ধড়ফড় করে হঠাৎ উঠে বসে। বলে–কী মশাই, আপনি পালিয়ে যাননি তো? আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম–

সদানন্দ বলে–পালিয়ে আর যাবো কোথায় হাজারিবাবু?

হাজারি বেলিফ বললে–পালাবার জায়গার কি অভাব আছে মশাই, আমার কত আসামী পালিয়ে গেছে—। তা আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন না-ই বা কেন বলুন তো? আমাকে পাঁচটা টাকা দিলেই তো আপনি পালাতে পারেন, আমি হাকিমকে গিয়ে সোজা বলবো আপনাকে খুঁজে পাই নি। আজ পনেরো বছর তো এমনি করেই চালালুম, আরো না-হয় কয়েক বছর চালাবো। আর তার বদলে আমাকে শুধু মাঝে-মাঝে কিছু টাকা দিয়ে যাবেন, তাতে আমারও কিছু সুরাহা হবে।– ব্যাস–

সদানন্দ বললে–কিন্তু তাহলে তো পৃথিবীতে পাপীর শাস্তি হবে না–পৃথিবী যে পাপে একেবারে ভরে যাবে–

হাজারি বেলিফ বললে–পাপ-পুণ্যের কথা রেখে দিন, ও-সব ইস্কুলের কেতাবে লেখা থাকে। সব পাপী যদি ধরাই পড়বে তাহলে উকিল মুহুরি পেশকার কী খাবে শুনি? তাদেরও তো চলা চাই। আরে মশাই সেই জন্যেই তো আমাদের কোর্টে আশি হাজার মামলা এখনও ঝুলছে–

–আশি হাজার?

হাজারি বেলিফ বললে–হ্যাঁ, আসামীরা আমাদের কিছু কিছু করে দেয় তাই আমরাও সমন ঝুলিয়ে রাখি। এই রকম যত ঝুলবে তত উকিল-মুহুরি-পেশকারদের পকেট ভরবে। ফয়শালা হয়ে গেলেই তো আমাদের লোকসান। তাই তো বলছি আপনিও মশাই পালিয়ে যান–

সদানন্দ বললে–না হাজারিবাবু, আমি পালাবো না। আমি যদি দেখি যে সত্যিই পাপ করেছি তো হাকিম আমাকে যে শাস্তিই দিক আমি তা মাথা পেতে নেব–

হাজার অবাক হয়ে গেল। বললে–সে কী? আপনি দোষ স্বীকার করবেন? আপনি হলফ্‌-নামা করে বলবেন আপনি আপনার বাবাকে খুন করেছেন?

–হ্যাঁ, যদি সত্যিই খুন করে থাকি তো তা বলবো!

–আপনি বলবেন যে আপনি আপনার বউকে খেতে পরতে দেননি, তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন?

–তা সত্যি হলে তাও বলবো।

–আপনি বলবেন যে আপনার গাঁয়ের লোকদের ভিটে-মাটি চাঁটি করেছে?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, তাও বলবো। যদি আমি সত্যিই দেখি যে পৃথিবীর একজন মানুষেরও আমি ক্ষতি করেছি তো আমি তার জন্যে ফাঁসি যেতেও তৈরি–

কথাগুলো শুনে হাজারি বেলিফের চোখ দুটো গোল হয়ে গেল। বললে–আপনি মশাই দেখছি আসল শয়তান। আর মশাই, তা যদি বলেন তো সংসারে কে পাপী নয় বলুন? আমরা তো সবাই পাপী, সবাই আসামী! আপনি, আমি, আমাদের কোর্টের উকিল মুহুরি পেশকার, হাকিম, কে আসামী নয়?

সদানন্দ বুঝতে পারলে না। হাজারি আবার বলতে লাগলো–পৃথিবীর সবাই আসামী মশাই, সবাই আমরা আসামী। এই যে আমি, আমি তো কোর্টের বেলি, আমিই কি আমার ডিউটি করি? আমি তো ঘুষ নিই। তা আমার কথা না-হয় ছেড়েই দিন, আমাদের কোর্টের উকিল-মোক্তার মুহুরি-পেশকার এমন কি আমাদের কোর্টের হাকিম সাহেবরা, তারাও পর্যন্ত তাদের ডিউটি করে না! আর আপনার কথাই ধরুন না কেন, আপনিও তো একজনকে বিয়ে করেছিলেন, আপনিই কি কখনও স্বামীর ডিউটি করেছিলেন? সংসারে মশাই কেউই নিজের নিজের ডিউটি করে না। আজকাল বাবা বাবার টিউটি করে না, মা মা’র ডিউটি করে না, ছেলেও ছেলের ডিউটি করে না। ডিউটি করলে কি কেউ আসামী হয়! ডিউটি করি না বলেই তো আমরা সবাই আসামী–ডিউটি যদি সবাই করতে তো এ পৃথিবী তো তাহলে স্বর্গ হয়ে যেতো, আমাদের কোর্টের উকিল-মুহুরি-পেশকার-হাকিম, কাউকে তাহলে আর করে খেতে হতো না—

সদানন্দ বললে–না হাজারিবাবু, অন্য কেউ তার কর্তব্য করে কি না আমি জানি না, আমি তা জানতে চাইও না। কিন্তু আমি সারা জীবন আমার যা-যা কর্তব্য সব পালন করে এসেছি

–বলছেন কী? তাহলে আপনি কী বলতে চান আপনি দেবতা?

সদানন্দ বললেন, তা কেন বলবো, আমি মানুষ, মানুষ হয়ে জন্মে মানুষের যা কর্তব্য তা করেছি। আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি, ন্যায়ের সমর্থন করেছি, যেখানে প্রতিবাদ করে ফল হয়নি সেখানে বিদ্রোহ করেছি, সারা জীবন তাই সকলে আমাকে পাগল বলেছে–

হাজারি বললে–তা হতে পারে। আপনি পাগলই বটে। আমি তো মশাই এই তিরিশ বছর কোর্টের পেয়াদাগিরি করছি, এমন আসামী আমি আমার জীবনে দেখিনি–

হঠাৎ সদানন্দ বললে–এখানে নামুন, এই ভাগলপুর এসে গেছে–

ট্রেন থামতেই সদানন্দ নামলো। হাজারি বেলিফও পেছন-পেছন নামলো। ভাগলপুর স্টেশনে নেমে সুলতানপুরে যেতে হবে। সেই সুলতানপুর। চৌধুরী মশাই শেষ জীবনটা এই সুলতানপুরেই কটিয়েছিলেন। এতদিন পরে আসা এ যেন আসা নয়, আবির্ভাব সদানন্দ চৌধুরীর পুনরাবির্ভাব!

সদানন্দ বললে–হাজারিবাবু, একটা কথা, এখানে কাউকে বলবেন না যে আমার নাম সদানন্দ চৌধুরী, বলবেন না, যে আমি হরনারায়ণ চৌধুরীর বংশধর–

হাজারি বললে–ঠিক আছে–

বহু দিন আগে প্রকাশ মামাই তাকে সঙ্গে করে শেষ এখানে নিয়ে এসেছিল। তখনই মানুষগুলোকে চিনতে পেরেছিল সদানন্দ। সুলতানপুরের সবাই-ই ছিল যেন এক-একজন প্রকাশ মামা। সবাই-ই যেন টাকা-টাকা করে অস্থির। কারো মেয়ের বিয়ে কারো ছাদের টিন, কারো খামারের বলদ। অভাব থাকলেও তাদের অভাব, অভাব না-থাকলেও তাদের অভাব। টাকার গন্ধ পেলেই তারা ছেঁকে ধরবে। যতদিন চৌধুরী মশাই বেঁচে ছিল ততদিন তাকে ছেঁকে ধরেছে। তারপর যখন চৌধুরী মশাই মারা গেল তখন ছেঁকে ধরেছে প্রকাশ মামাকে। ভেবেছে প্রকাশ মামাই তার পিসেমশাই-এর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। প্রতিদিন সকাল থেকে সবাই তার মোসায়েবি করেছে। কিন্তু যেদিন জানতে পারলে চৌধুরী মশাই-এর ছেলেই সমস্ত টাকার উত্তরাধিকারী, সেই থেকে সদানন্দকেই তারা ছেঁকে ধরেছে টাকার জন্যে।

সুলতানপুরে নতুন মুখ দেখে সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠলো–কোথায় যাবেন আপনারা?

সদানন্দ বললে–এখানে প্রকাশ রায় বলে একজন ছিলেন, তিনি আছেন?

–প্রকাশ রায়? আজ্ঞে না, তিনি তো নেই।

–নেই মানে? তিনি এখানে থাকেন না আর?

লোকটা বললে–আগে থাকতেন, সে অনেক কাল আগে। প্রায় পনেরো বছর আগে। কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন।

–মারা গেছেন? কী করে মারা গেছেন?

দেখতে দেখতে তখন চারদিক থেকে আরো অনেক বেকার লোক জুটে গেছে। তারাও কথা শুনছিল এতক্ষণ। তাদের মধ্যে একজন লোক হলে উঠলো–সে অনেক কাণ্ড মশাই, প্রকাশ রায়ের এক ভাগ্নে ছিল, সেই ভাগ্নেটাই যত নষ্টের গোড়া। এক নম্বরের শয়তান ছিল সে–

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–তার ভাগ্নে? কী নাম তার?

লোকটা বললে–তার নাম সদানন্দ চোধুরী। একেবারে বখাটে ছেলে যাকে বলে। সে তার নিজের বাপকে পর্যন্ত খুন করেছে, তা প্রকাশ রায় তো দুরের কথা।

সদানন্দ বললে–সে কোথায় এখন?

সকলেই বললে–কোথায় আর থাকবে সে, খুন করে গা-ঢাকা দিয়েছে। সে তো আজ পনেরো বছর আগের কথা, পুলিস তাকে অনেক ধরতে চেষ্টা করেছিল মশাই, কিন্তু সেই যে গা-ঢাকা দিলে তারপর আর কেউ তার খোঁজ পায়নি–

–ছেলে হয়ে বাবাকে সে খুন করেছিল? এ কখনও সম্ভব?

বুড়োবুড়ো কয়েকজন লোক এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা সবাই-ই নাকি প্রত্যক্ষদর্শী। সকলেই সমর্থন করলে কথাগুলো। বললে–টাকা মশাই টাকা! টাকা এমনই জিনিস মশাই; বাপের অনেক টাকা ছিল তো। বাপ না মরলে তো আর ছেলে সে টাকাগুলো হাতাতে পারে না। আট লাখ টাকার লোভ কি ছাড়া সোজা? কলিযুগ মশাই, ঘোর কলিযুগ! রায় মশাই সকলেই কথা দিয়েছিল যে, টাকাটা পেলে সুলতানপুরের সকলকে কিছু কিছু দেবে। কিন্তু ওই যে সদানন্দ, ও এসেই সব ভণ্ডুল করে দিলে।

কথাগুলো শুনতে শুনতে সদানন্দর মনে হলো সে যেন রূপকথা শুনছে। বললে–তাহলে প্রকাশ রায় ভালো লোক বলছেন?

সবাই বললে–রায় মশাই-এর তুল্য লোক হয় না মশাই। একেবারে দেবতুল্য লোক। অথচ ওই ভাগ্নের জন্যে রায় মশাই একদিন কী-ই না করেছে। নিজে পাত্রী পছন্দ করে তার বিয়ে দিয়েছে। সারা জীবন নিজের ছেলে-মেয়ে বউ কাউকে দেখেনি, কেবল ওই ভাগ্নে কীসে মানুষ হয় সেই চেষ্টাই করেছে। কিন্তু সে-ভাগ্নেটাও যে একটা আস্ত অপোগণ্ড। নিজের বউটা পর্যন্ত তার অত্যাচারে বাপের বাড়ি চলে গেল। শেষে যখন শুনলে যে দাদামশাই-এর সম্পত্তিও বাপের হাতে এসেছে, তখন আর থাকতে পারলে না–একদিন রাত্তিরে বাপ ঘুমোচ্ছিল, তখন বাপকে খুন করে কিন্তু রায় মশাই দেখতে পেয়ে তাকে ধরে ফেললে–

–তারপর?

তারপরের ঘটনাও সবাই বলে গেল। এমন ভাবে বলে গেল যেন তারা সবাই ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছে। সে একেবারে নিখুঁত বর্ণনা সব। কেমন করে চৌধুরী মশাই-এর অপঘাতে মৃত্যু হলো, কেমন করে রায় মশাই পুলিসকে খবর দেবার জন্যে থানায় গেল, সব বৃত্তান্ত বলতে লাগলো তারা।

যারা আসল খুনী হয় তারা নাকি এমনি করেই গা-ঢাকা দেয়। বাপের সব টাকা ছিল ব্যাঙ্কে, সেই টাকাটা পর্যন্ত কালেক্টারিতে ঘুষ দিয়ে তুলে নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিল। এদিকে পুলিসও খুঁজছে তাকে, ওদিকে রায় মশাইও খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতে শেষকালে তাকে পাওয়া গেল কলকাতার এক ধর্মশালাতে।

প্রকাশ রায় সদানন্দকে সামনে পেয়েই একেবারে চেপে ধরলে।

বললে–তুই জামাইবাবুকে খুন করেছিস!

সদানন্দ বললে—হ্যাঁ—

প্রকাশ বললে–কেন খুন করতে গেলি? জামাইবাবু কী দোষ করেছিল?

সদানন্দ বললে–বেশ করেছি খুন করেছি, অমন বাপকে আগে খুন করলেই ভালো হতো–

প্রকাশ বললে–কিন্তু হাজার হোক, জামাইবাবু তো তোর নিজের বাপ। নিজের বাবাকে খুন করতে তোর হাত একটুও কাঁপলো না রে? তুই কি ভেবেছিস নরকেও তোর ঠাঁই হবে? তোর যে মহাপাতক হবে রে–

সদানন্দ বললে–আমি স্বর্গ নরক মানি না।

–স্বর্গ নরক না মানিস ভগবান তো মানিস?

 সদানন্দ বললে–না, ভগবানও আমি মানি না। ভগবান বলে কেউ নেই, কিছু নেই। ও-সব তোমাদের বানানো কথা, আজগুবী–

–তা কেন তুই জামাইবাবুকে খুন করলি তাই বল?

সদানন্দ বললে–টাকার জন্যে–

–টাকাই তোর কাছে এত বড় হলো? এত টাকা তুই কী করবি?

সদানন্দ বললে–লোকে টাকা পেলে যা করে আমিও তাই-ই করব। আমি টাকা দিয়ে মদ খাবো, মেয়েমানুষ রাখবো, ফুর্তি করবো, ওড়াবো।

প্রকাশ বললে–তা আমি গাঁয়ের লোককে বলেছি ওই টাকা দিয়ে গাঁয়ের লোকের দুঃখ ঘোচাবো, তাদের অভাব মেটাবো–

সদানন্দ বললে–গাঁয়ের লোকেরা টাকার মর্ম কী বুঝবে, তারা তো ছোটলোক, তারা জীবনে কখনও এত টাকা দেখেছে যে তাদের টাকা দেবে তুমি?

তখন প্রকাশ মামা বললে–তা আমি না হয় মামা হয়ে তোকে রেহাই দিলুম, কিন্তু পুলিস? পুলিস তো তোর পেছনে লেগে আছে, তোর নামে হুলিয়াও বেরিয়েছে, তাদের হাত থেকে তুই পালাবি কী করে?

সদানন্দ বললে–পুলিসকে আমি চিনি। ঘুষ দিলেই তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে—

প্রকাশ বললে–কিন্তু আমি? আমার মুখ বন্ধ করবি কী করে?

সদানন্দ বললে–তুমি যদি টাকা চাও তো তোমাকেও টাকা দিতে পারি। তুমি কত টাকা নেবে বলো?

প্রকাশ বললে–তুই কি আমাকে এত নীচ মনে করিস? টাকা দিয়ে তুই আমার মুখ বন্ধ করতে চাস?

সদানন্দ বললে–টাকা দিয়ে কার মুখ বন্ধ করা না যায় শুনি? তুমি তো কোন্ ছার মামা–

কিন্তু প্রকাশ রায় তেমনি পাত্রই নয় যে টাকার বদলে মিথ্যে বলে চালাবে। তা যদি রায় মশাই চাইতো তবে জীবনে কোনও দিন তার টাকার অভাব থাকতো না। তার নিজের বউ-ছেলে-মেয়ের দিকে না তাকিয়ে যাকে সে প্রাণের চেয়ে ভালবালতো সেই ভাগ্নেই যখন তাকে টাকা দেখাতে লাগলেন তখন তার মনে বড় কষ্ট হলো মশাই। হায় রে টাকা! টাকা সংসারে এমনই জিনিস। নিজের বাপকে খুন করতেও যার বাধে না, সেই টাকার ওপরে রায় মশাই-এর তখন ঘেন্না হয়ে গেল। সে তখন ভাবলে অমন ভাগ্নের মুখ সে আর দেখবে না। বলে ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে আসছে, পেছন পেছন সদানন্দও রাস্তায় বেরিয়ে এল।

রাস্তায় এসে বললে–কোথায় যাচ্ছো?

রায় মশাই বললে–কোথায় যাচ্ছি তা তোর শুনে দরকার কী?

সদানন্দ বললে–আমি জানি তুমি পুলিসে খবর দিতে যাচ্ছো!

রায় মশাই বললে–তোর ফাঁসি হলে তবে আমার শান্তি হয়। তুই টাকার জন্যে তোর বাপকে খুন করেছিস, এর পর তোর মুখদর্শন করাও পাপ–

সদানন্দ বললে–বুঝেছি, তুমি থানায় যাচ্ছ—

রায় মশাই বললে–তুই তোর বোঝা নিয়ে থাক, আমি তা নিয়ে তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাই না–

বলে তাড়াতাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই সদানন্দ রায় মশাইকে এক ধাক্কা দিয়েছে। ধাক্কা খেয়ে রায় মশাই রাস্তার ওপরেই পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই একটা চলন্ত লরী এসে তাকে একেবারে চেপটে দিয়েছে। যখন লোকজন জড়ো হলো তখন রায় মশাই-এর শরীরে আর প্রাণের চিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। রক্তে একেবারে জায়গাটা ভেসে গিয়েছে–

সমস্ত কাহিনীটা শুনে সদানন্দ কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। এমন করেই কি সমস্ত ঘটনাটাকে বিকৃত করতে হয়! এই-ই কি পৃথিবী! পাশে হাজারি বিলিফ নিঃশব্দে সব কিছু শুনছিল। এতক্ষণে তার মুখে যেন হাসি ফুটে উঠলো। জীবনে অনেক আঘাত সহ্য করেছে সদানন্দ। সে আঘাত যতটা এসেছে বাইরে থেকে তার হাজারগুণ আঘাত এসেছে তার নিজের ভেতর থেকে। এই ভেতরের আঘাতেই এতদিন বাইরের সমস্ত কিছুর প্রভাব থেকে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল। নিজের চারিদিকে আচ্ছাদন দিয়েই ভেবেছিল সে আত্মরক্ষা করবার সহজ পথটা আবিষ্কার করেছে। কিন্তু সেই আচ্ছাদনের কোন্ অদৃশ্য ফুটো দিয়ে কবে যে সে একেবারে নিরাবরণ হয়ে গেছে তা সে টের পায়নি। তাহলে এই-ই কি তার আসল স্বরূপ! আজকের সুলতানপুরের মানুষের কাছে এই-ই কি তার সঠিক পরিচয়!

হাজারি বেলিফ হঠাৎ উঠলো–আসুন মশাই, চলে আসুন–

কিন্তু সদানন্দ সে কথা শুনলে না। জিজ্ঞেস করলে–এ-সব কথা আপনারা কোত্থেকে শুনেছেন? এ-সব কি সত্যি কথা?

লোকটা বললে–এ-সব কথা তো খবরের কাগজেই বেরিয়েছে মশাই, আপনারা পড়েননি? খবরের কাগজে কি মিথ্যা কথা ছাপা হয় বলতে চান? আসলে তো মশাই টাকা। টাকার কাছে ছেলে বাপ-মামা-ভাগ্নে কিছু নেই, তা তো জানেন–

রাস্তায় চলতে চলতে সদানন্দের মনে হলো, কই, সুলতানপুরের মানুষ একজনও তো কেউ বললে–না চৌধুরী মশাই-এর ছেলের মহৎ লক্ষ্য ছিল, চৌধুরী মশাই-এর ছেলের ত্যাগের সাধনা ছিল, চৌধুরী মশাই-এর ছেলে উদার-প্রাণ ছিল। একজনও তো কেউ বললে না টাকা সে নিয়েছে পরকে আপন করার জন্যে। উত্তরাধিকারসূত্রে যে-টাকা সে পেয়েছে সে-টাকার এক কপর্দকও সে নিজের জীবন ধারণের জন্যে গ্রহণ করেনি তা তো কেউই বললে না। অথচ কত অবলীলায় প্রকাশ মামা এদের কাছে মহাপ্রাণ হয়ে উঠেছে। তার অজ্ঞাতবাসের এই পনেরো বছরের মধ্যে মিথ্যেটাই কি মুখে-মুখে এমন সত্যে পরিণত হয়ে গেছে যে, প্রতিবাদ করলেও তারা খবরের কাগজের দোহাই দেবে!

কোথায় সেই চৌবেড়িয়া, আর কোথায় এই সুলতানপুর। এই সুলতানপুর থেকেই আবার নবাবগঞ্জ। সদানন্দকে যেন আবার নতুন করে তার সমস্ত কর্মের পুনর্বিচার করতে হচ্ছে। এতদিন তাহলে যা সে বিশ্বাস করে এসেছে, তা সমস্তই কি তবে ভুল বিশ্বাস! তার সমস্ত পরিশ্রম কি তবে পণ্ডশ্রম!

রেল বাজার থেকে নেমে আবার সেই ছ’ ক্রোশ পথ! কখন সুলতানপুর থেকে বেরিয়ে চল্লিশ ঘণ্টা রাস্তায় কাটিয়ে আবার ট্রেনে উঠে রেলবাজারে নেমেছিল সেদিকে খেয়াল ছিল না সদানন্দর। তার মধ্যে হাজারি বেলিফ, শেয়ালদ’ স্টেশনের প্ল্যাটফরমে দাড়ি কামিয়ে নিয়েছে, চান করেছে। আবার ট্রেনে উঠেছে। তারপর রেলবাজারে এসে নেমেছে।

–আর কত দূর মশাই? আমি যে আর পারছি নে?

সদানন্দ বললে–এবার একবার যাবো নবাবগঞ্জে–

–তা নবাবগঞ্জ হলেই শেষ তো?

সদানন্দ বললে–না, নবাবগঞ্জটা দেখে একবার যাবো নৈহাটিতে–

–নৈহাটিতে কেন?

–নৈহাটিতে আমার স্ত্রী আছে।

হাজারি বেলিফ বললে–আপনার আবার স্ত্রী কোথায়? সে স্ত্রীকে তো আপনি ত্যাগ করেছেন–

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ ত্যাগ করেছি বটে, কিন্তু আপনি যে বলছেন সেই স্ত্রী আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। আমি শুধু একবার নৈহাটিতে জানতে যাব সে কেন আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছে, আমার বিরুদ্ধে কী তার অভিযোগ আমি তার কী ক্ষতি করেছি–

হাজারি বেলিফ বললে–কিন্তু অন্যায় একটা কিছু করেছেন আপনি নিশ্চয়ই, নইলে কেউ কি কারো মিথ্যে মিথ্যে দোষ দেয়? আপনি তো দেখলেন সুলতানপুরের লোক কী বললে! সবাই তো বললে–আপনিই আপনার বাপকে খুন করেছে–

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, তা তো দেখলুম

–তবে? তবে কেন আপনার নামে সবাই মিথ্যে মিথ্যে বলতে যাবে বলুন। একজন বললে–তবু না-হয় একটা তার মানে ছিল, দেশসুদ্ধ লোক আপনার নামে নালিশ করছে। কেন? আপনি কি বলতে চান মশাই যে সবাই খারাপ আর একলা আপনিই ভালো, আপনিই একেবারে ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির? আপনি মশাই আমাকে কি তেমন বোকা পেয়েছে যে আপনি যা বললেন তাই-ই আমি বিশ্বাস করবো–

সদানন্দ বললে–না হাজারিবাবু, তবু আমি নিজের চোখে একবার সব কিছু দেখতে চাই–আমাকে আর কিছু সময় দিন। শেষ বিচারের আগে আমি একবার দেখে যেতে চাই যে, আমি যা কিছু করেছি তা ভুল করেছি না ঠিক করেছি–

মুবারকপুরের কাছে আসতেই হঠাৎ সদানন্দ দেখলে নবাবগঞ্জের দিক থেকে দলে-দলে লোকজন পালিয়ে আসছে।

সদানন্দদের দেখে তারা বললে–কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?

সদানন্দ বললে–নবাবগঞ্জে—

লোকগুলো বললে–যাবেন না ওদিকে, যাবেন না মশাই, গুলি চলছে নবাবগঞ্জে–

–গুলি? গুলি চলছে কেন? আপনারা কারা?

লোকগুলো বললে–আমরা ভেণ্ডার, নবাবগঞ্জের হাটে সওদা করতে গিয়েছিলুম, এখন প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছি। ওই দেখুন আগুন জ্বলছে, ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছেন?

সদানন্দ দূর আকাশের দিকচক্রবালের দিকে চেয়ে দেখলে সেদিকটা ধোঁয়ায় ধোঁয়া হয়ে গেছে। কেন? আগুন জ্বলছে কেন?

–সি-আর-পি পুলিস গুলি চালিয়ে সব ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে—

–কেন? কী হয়েছে ওখানে?

ছেলেদের ইস্কুলে বোমা পড়েছে, তারা হরতাল করেছে। ছেলেরা পড়বে না—

সদানন্দ চমকে উঠলো। তারই দেওয়া টাকায় স্কুল হয়েছে। সেই স্কুলেই হরতাল হয়েছে নাকি? কেন, কীসের হরতাল?

কিন্তু সদানন্দর কথার উত্তর দেবার তখন সময় নেই কারো। পেছনে আর একদল লোক বড় বড় ঝাঁকা নিয়ে আসছিল। তারাও পালাচ্ছে। উত্তরটা তারাই দিলে। বললে– হাসপাতাল, ইস্কুল, কলেজ সব পুড়ছে মশাই–সব পুড়ছে–

–হাসপাতালও পুড়ছে? তাহলে রুগীরা কী করছে? ডাক্তাররা?

–আরে মশাই, রুগীরা কি হাসপাতালে ওষুধ পায় নাকি যে, হাসপাতালে রুগীরা থাকবে? ডাক্তাররা তো ওষুধ বিক্রি করে ফাঁক করে দিচ্ছে। নবাবগঞ্জের কেউ হাসপাতালে যায় না, ছেলে-মেয়েরাও কেউ লেখাপড়া করে না নবাবগঞ্জে–

সদাননন্দর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–তা, এরকম হলো কেন বলতে পারো?

লোকগুলো বললে–যত নষ্টের গোড়া নবাবগঞ্জের চৌধুরী মশাই-এর ছেলে। সেই ছেলেই তো নবাবগঞ্জের এই সব্বোনাশটা করে গেছে। আগে মশাই আমরা বেশ ছিলুম, এখানে আমাদের কোনও ঝঞ্ঝাট ছিল না, যেদিন থেকে ইস্কুল কলেজ আর হাসপাতাল হয়েছে সেই দিন থেকেই এই উটকো ঝঞ্ঝাট শুরু হয়েছে, সেই চৌধুরী মশাই-এর ছেলেই এখানকার সব্বোনাশটা করে গেছে–

তাদের কথা শেষ হবার আগেই দূর থেকে একটা বোমা-ফাটার শব্দ হলো। লোকগুলো যদিও বা আরো কিছু বলতো, তখন আর বললে না। সোজা রেলবাজারের দিকে চলতে লাগলো। হাটবার। হাটের লোক সওদা করতে এসেছিল, সব যে-যার দিকে ছিটকে পালাতে লাগলো। কিন্তু বোমা কেন? সদানন্দ সেখানে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে সেই ধোঁয়ার দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো। সত্যিই তো, বোমা কেন?

হাজারি বেলিফ বললে–আমি মশাই ওদিকে আর যাবো না, শেষকালে কি গুলি খেয়ে মরবো নাকি?

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমার যে গিয়ে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার গিয়ে দেখতুম স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল করে দিয়ে দেশের লোকের কী ক্ষতিটা আমি করেছি–

–তা আপনি মশাই লোকের উপকার করতে গেলেনই বা কেন? আপনার কীসের মাথার দায় পড়েছিল?

সদানন্দ বললে–উপকার করবো না? পরোপকার করা তো মানুষের ধর্ম!

হাজারি বেলিফ বললে–ইস্, আপনার তো ফাঁসি হওয়া উচিত মশাই, আপনি করেছেন কী?

–কেন? ফাঁসি হওয়া উচিত কেন?

–ফাঁসি হবে না? পরের উপকার করতে গেলেন আপনি কী বলে? দেখুন তো, লোকগুলো বেশ ছিল, মাঝখান থেকে আপনি তাদের এই সর্বনাশটা করলেন। তারা আপনার কী ক্ষতি করেছিল যে তাদের আপনি ইস্কুল কলেজ হাসপাতাল করে দিলেন?

হঠাৎ আবার বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনেই হাজারি বেলিফ একেবারে দশ হাত পেছিয়ে গেছে। বললে–না মশাই, আমি আর এগোচ্ছি না, আপনি ফিরে চলুন—

সদানন্দও আর এগোল না। সদানন্দও ফিরলো। কিন্তু এরকম কেন হলো? স্কুল-কলেজ হাসপাতাল করে দিয়ে সে নবাবগঞ্জের মানুষদের কী এমন ক্ষতি করেছে, সেটা দেখতে তার বড় ইচ্ছে হচ্ছিল–

কিন্তু হাজারি বেলিফ বললে–না মশাই, আপনার যদি দেখতেই ইচ্ছে হয় তো আপনি আমায় পাঁচটা টাকা দিয়ে যেখানে ইচ্ছে চলে যান, আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছিনে

সদানন্দ আর কী করবে। সেও আবার উল্টো-পথে রেলবাজরের দিকে চলতে লাগলো।

.

নৈহাটির বাজারের স্যাকরা মনোহর দত্ত নিজের দোকানে বসে তখন সোনার গয়না কেনা বেচা করছিল। হঠাৎ শো-কেসের ওপার থেকে কে যেন একজন বুড়ো মানুষ তাকে লক্ষ্য করে একটা কথা জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁ মশাই, একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে?

মনোহর দত্ত ভালো করে চেয়ে দেখলে সেদিকে। একজন বুড়োমানুষ, মুখময় কাঁচা পাকা দাড়িগোঁফ। তার পাশে আর একজন বুড়ো মানুষ। কিন্তু তার দাড়ি-গোঁফ সদ্য কামানো।

–বলুন, কী বলবেন?

–আচ্ছা, বলতে পারেন, এখানকার বোসপাড়ার নিখিলেশ ব্যানার্জি কোথায় গেছেন?

–নিখিলেশ ব্যানার্জি? কলিকাতার অফিসে চাকরি করতেন তো?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, তার বাড়ি থেকেই আমরা আসছি। সে বাড়িতে এখন দেখলুম কেউ নেই। তাঁর স্ত্রী নয়নতারা ব্যানার্জী, তিনিও কলকাতার একটা অফিসে চাকরি করতেন, তাঁকেও বাড়িতে পেলাম না। অন্য ভাড়াটেরা রয়েছে, তারাও কিছু বলতে পারলেন না কোথায় গেছেন তাঁরা–

মনোহর দত্ত বললে–তারা তো অনেক দিন আগেই নৈহাটি ছেড়ে চলে গেছে। সে প্রায় পনেরো বছর আগের কথা। তারা তো এখন কলকাতায় থাকে। থিয়েটার রোডে বিরাট বাড়ি করে উঠে গেছে। আপনারা কোথা থেকে আসছেন?

সদানন্দ বললে–নবাবগঞ্জ বলে একটা গ্রাম থেকে–

মনোহর দত্ত বললে–ও, তা তাদের অবস্থা এখন খুব ভালো হয়ে গেছে মশাই, এককালে তাদের খুবই দুরবস্থা ছিল, তারপর হঠাৎ একদিন কোথাকার লটারিতে চার-পাঁচ লাখ টাকা পেয়ে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি অবস্থা পালটে গেল–

–লটারিতে টাকা পেয়েছিল?

মনোহর দত্ত বললে–কপাল মশাই, সবই কপাল! শুনলুম এখানকার বাড়ি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছে। সেখানে থিয়েটার রোডে নাকি একটা বাড়ি করেছে–

সদানন্দ বললে–থিয়েটার রোডে? বাড়ির নম্বর কত?

মনোহর বললে–তা জানি নে মশাই, থিয়েটার রোডে গিয়ে পাড়ার লোকদের জিজ্ঞেস করলেই টের পারেন বড়লোকদের বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে কখনও অসুবিধে হয় না–

তা বলে! সদানন্দ আর সেখানে দাঁড়ালো না। আস্তে আস্তে আবার যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল সেই রাস্তা দিয়েই আবার উল্টোদিকে চলতে লাগলো। আবার স্টেশনের দিকে। পনেরো বছর আগে একদিন এই নৈহাটিতে কতবার এসেছে সে। পনেরো বছর আগে একদিন এই রাস্তা দিয়েই সে এখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিল। নিজের যাবতীয় অর্থ, নিজের যাবতীয় শুভেচ্ছা সমস্ত নিঃশেষ করে উজাড় করে ঢেলে দিয়ে গিয়েছিল এইখানে, এই বোসপাড়ার বাড়িটার দু’জন লোকের হাতে। তাদের সংসারের সাচ্ছল্য আর সমৃদ্ধি কামনা করে, তাদের পরস্পরের প্রতি আর সৌহার্দ্য অটুট থাকার প্রার্থনা করে সে এই রাস্তা দিয়েই চলে গিয়েছিল। সদানন্দ কল্পনাও করেনি যে আবার তাকে একদিন এই নৈহাটিতে ফিরে আসতে হবে। শুধু নৈহাটি কেন, সুলতানপুর, নবাবগঞ্জ কোনও জায়গাতেই ফিরে আসবার পরিকল্পনা ছিল না তার। এই হাজারি বেলিফ না এলে হয়ত এখানে আর কখনও আসতোও না সে।

–কী হলো মশাই? আবার কোথায় যাচ্ছেন?

পেছনে হাজারি বেলিফ হাঁফাতে হাঁফাতে আসছিল। সে আর হাঁটতে পারছিল না তখন। বললে–আপনার সঙ্গে বেরিয়ে তো মহা মুশকিলে পড়া গেল দেখছি।

সদানন্দ বললে–আর বেশি দূর নয় হাজারিবাবু, আর একটা জায়গা দেখলেই আমার সব দেখা হয়ে যাবে। আমি জানতে চাই, আমি দোষী না নির্দোষ

হাজির বললে–আপনি তো দেখছি মহা-আহাম্মক মানুষ। আমি এই তিরিশ বছর ধরে অনেক সমন ধরিয়ে এসেছি, কিন্তু আপনার মত এমন আসামী তো আমার বাপের জন্মেও দেখিনি–। তার চেয়ে আমাকে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিন না মশাই, আমি মুক্তি পেয়ে যাই। আমার এত টানা-হ্যাঁচড়া আর ভাল্লাগছে না মশাই–

কিন্তু সদানন্দর কানে যেন কথাটা ঢুকলো না। থিয়েটার রোডে বাড়ি করেছে! ভালোই করেছে নয়নতারা। এখানে ভাড়াটে বাড়িতে থাকার চেয়ে কলকাতায় নিজস্ব বাড়ি করে ভালোই করেছে তারা। হয়ত আর নিখিলেশবাবুকে চাকরি করতে হচ্ছে না। নয়নতারাকেও হয়ত আর চাকরি করতে হচ্ছে না টাকার জন্যে। হয়ত মনে মনে তারা সদানন্দর ওপর কৃতজ্ঞ! টাকাটা তো সে নিজে তাদের হাতে তুলে দেয়নি। একটা ব্যাগের মধ্যে চিঠির সঙ্গে চেকটা রেখে দিয়ে চলে এসেছিল। চেকটা পাবার পর কি নিখিলেশবাবু চমকে উঠেছিল। মনে কি আনন্দ হয়েছিল টাকাগুলো পেয়ে! অতগুলো টাকা আচমকা পেয়ে মধ্যবিত্ত মানুষের আনন্দ হওয়াই তো উচিত। আর তা ছাড়া ওদের সংসারের অশান্তির মূল কারণটাই তো ছিল টাকা। আর শুধু ওদের কেন, পৃথিবীর সমস্ত সংসারের অশান্তির মূলেই তো ওই টাকা! টাকার অভাব ছিল বলেই তো ওরা নয়নতারার বিয়ের সময়কার গয়নাগুলো ফিরিয়ে নিতে নবাবগঞ্জ পর্যন্ত গিয়েছিল! হয়ত ওদের মত পৃথিবীর সমস্ত মানুষই টাকা চায়। আর নয়নতারার দোষ কী, কিম্বা নিখিলেশবাবুরই বা দোষ কোথায়! সেই কর্তাবাবুই কি টাকা চায়নি? যাদের বেশি আছে তারাও টাকা চায়, যাদের কিছুই নেই তারাও টাকা চায়।

হাজারি বেলিফ বললে–আবার এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?

সদানন্দ বললে–সেই যে থিয়েটার রোডে!

হাজারি বেলিফ বললে–আপনার জন্যে তো আর পারা গেল না মশাই। এমন অদ্ভুত আসামী তো আমি দেখেনি! কোথায় চৌবেড়ে থেকে বেরিয়ে কাঁহা-কাঁহা ঘুরলুম বলুন তো!

সদানন্দ বললে–এইবারই শেষ হাজারিবাবু, এর পরে আপনাকে আর ঘোরাবো না। হাজারি বেলিফ তখন আর চলতে পারে না। বললে–আর কেন মিছিমিছি আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন। আপনারই যত দোষ মশাই, আপনিই তো যত গণ্ডগোল বাধিয়েছেন–

–কেন?

হাজারি বললে–আপনি তো কারোর সঙ্গে তাল দিয়ে চলতে পারলেন না। পৃথিবীর সবাই-ই তো বেশ তালে তাল মিলিয়ে চলেছে–তার সঙ্গে আপনিও তাল দিলে পারতেন। তাহলে আর এই আপনার নামে হুলিয়া বেরোত না।

কলকাতার রাস্তায় তখন ভিড়ের বন্যা বয়ে চলেছে। সদানন্দ ভিড়ের পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে এগিয়ে চলছিল। এতকাল পরে কলকাতায় ফিরে আসা। পনেরো বছর আগের ফেলে আসা সেই শহর। সদানন্দের চোখে শহরের এ চেহারা যেন নতুন মনে হলো। চিরকালের সেই উদার আকাশের তলায় এ শহরের মানুষগুলো যেন আরো রক্তহীন আরো বিবর্ণ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আকাশটাই বা এত ধূসর হলো কী করে? আগে তো এরকম ছিল না। চারিদিকে লজ্জাহীন দারিদ্র্য যেন হাঁ করে রয়েছে। কয়েকটা গোটা পরিবার রাস্তার যাত্রীদের করুণার ওপর আত্মসমর্পণ করে তাদের ঘর-সংসার পেতে বসেছে। এরা কারা? কোত্থেকে এখানে এল?

সদানন্দ বললে–আপনার কাছে একটা টাকা হবে হাজারিবাবু?

হাজারি বেলিফ চমকে লাফিয়ে উঠেছে। বললে–টাকা?

–হ্যাঁ, আমার কাছে আর টাকা নেই, ওদের কিছু দিতুম, দেখছেন না কীরকম অভাব ওদের!

হাজারি বেলিফ বললে–আপনি রাখুন মশাই, আপনার নামে কোর্টের হুলিয়া ঝুলছে আর আপনি ওদের দেবেন ভিক্ষে! আপনাকে কে ভিক্ষে দেয় তার ঠিক নেই! এই জন্যেই তো মশাই আপনার এত হেনস্থা!

সদানন্দ বললে–কিন্তু ওদের দেখে যে মায়া হচ্ছে বড়–

–মায়া? আপনার মায়া হচ্ছে? ওই দয়া-মায়াই তো পাপ। ওই পাপ করেই তো আপনি গেলেন!

সদানন্দ বললে–দয়া-মায়া পাপ? আপনি বলছেন কী? দয়া-মায়া ভালবাসা-স্নেহ মমতা পাপ, এ কথা কে বললে?

হাজারি বেলিফ বললে–চলে আসুন, চলে আসুন, এখানে দাঁড়াবেন না, দাঁড়ালেই সবাই পয়সা চাইবে। আজকাল সব মানুষ কেবল পয়সা-পয়সা করে ভিখিরি হয়ে গেছে–

সদানন্দ চারদিকে চেয়ে দেখলে। একশো জোড়া হাত তাদের ঘিরে ধরেছে। সকলের মুখে-চোখে কঙ্কালের ছাপ। হাজারি বেলিফ সদানন্দর হাত ধরে টানতে লাগলো। টেনে বাইরে নিয়ে আসবার চেষ্টা করলে। কিন্তু যেদিকেই যায় সেদিকেই ভিখিরিদের ভিড়।

হাজারি তাড়া দিতে লাগলো। বললে–চলে আসুন, শিগগির চলে আসুন–

সদানন্দ বললে–এরা কারা হাজারিবাবু? এর তো আগে এখানে ছিল না–আগে শুধু বড়বাজারেই থাকতো এরা। ভিক্ষের জন্যে সেখানে আমাকে সবাই রাজাবাবু বলে ডাকতো

হাজারি বেলিফ বললে–এরা সব মানুষ মশাই, মানুষ–

সদানন্দ বললে–আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করেছেন! এরা মানুষ তা কী আমি জানি না? কিন্তু দুটো হাত আর দুটো চোখ যাদের আছে তারাই কী মানুষ?

হাজারি বেলিফ বলে উঠলো–আরে মশাই, আজকাল এরাই কলকাতাময় ছড়িয়ে আছে। এদের জ্বালায় রাস্তায় হাঁটতে পারবেন না, যেখানে যাবেন সেখানেই এরা। এদের দিকে মোটে চোখ দেবেন না, একবার চোখ দিলেই এরা পেয়ে বসবে–আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন–

সদানন্দও চেয়ে দেখেলে, সত্যিই তাই। পনেরো বছরে এ শহরের শেষ পর্যন্ত এই হাল হয়েছে। মানুষগুলোরও এই হাল! অথচ আগে তো এমন ছিল না। এরা সবাই রাস্তায় কিলবিল করছে কেন?

হাজারি বললে–বাড়িতে যে এদের থাকবার ঘর নেই, তাই রাস্তায় কিলবিল করছে!

–তা বাড়িতে এদের ঘর নেই-ই বা কেন?

–ঘর থাকবে কী ঘরে? বছর বছর মানুষের ছেলে হলে তো আর সেই অনুযায়ী ঘর বাড়ানো যায় না। ছেলে তৈরী করতে তো কারো পয়সা লাগে না, কিন্তু ঘর তৈরি করতে যে পয়সা লাগে মশাই। আপনি চলে আসুন, ও-সব ভাবতে গেলে আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে–

সদানন্দ বললে–তাহলে ওদের কী হবে?

–থামুন মশাই, যত বাজে কথার জবাব দিতে পারি নে আমি। আপনি আসবেন তো আসুন, নইলে আমি এই চললুম–

কিন্তু হাজারি বেলিফ চলে যাবে বললেই কী চলে যেতে পারে! যেদিন সদানন্দ পৃথিবীতে জন্মেছে সেই দিনটি থেকেই যে সে তার সঙ্গে নিয়েছে। সেইদিন থেকেই সে বারবার সদানন্দকে জানিয়ে এসেছে কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়। ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান দেবার যিনি বিধাতা তিনি তো সমস্ত মানুষেরই সৃষ্টিকর্তা। একদিন কর্তাবাবু যখন জন্মেছিলেন সেদিন তার পেছনেও তিনি এই রকম হাজারি বেলিফদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও সমন পাঠিয়েছিলেন হাজারি বেলিফের হাত দিয়ে। কিন্তু হাজারি বেলিফের হাত দু’ টাকা চার টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি সে-সময় ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। আর শুধু কর্তাবাবুই বা কেন? ছোট মশাই সুলতানপুরের মুখুজ্জে মশাই থেকে শুরু করে সবাই-ই তো ছিলেন আসামী। আসামী হলেও তাঁদের কাউকেই আসামী কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। হাজারি বেলিফকে ঘুষ দিয়ে দিয়ে তারা বরাবর বিচারককে এড়িয়ে গেছেন। কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক আর কালীগঞ্জের বউরা তাঁদের বিষ-নিঃশ্বাসে নিঃশেষ হয়ে গেছে তবু কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার জন্যে কখনও জবাবদিহি করতে হয়নি। আর জবাবদিহি করতে হয়নি বলেই হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক আর কালীগঞ্জের বউরা আজ আবার এখানে এসে জন্ম নিয়েছে। আর পনেরো বছর পরে তাদের বংশধররা আজ এই কলকাতায় রাস্তায় রাস্তায় কিলবিল্ করে ঘুরছে বেড়াচ্ছে। আজকের কর্তাবাবু, আর আজকের ছোট মশাইদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে এমন সদানন্দ আবার কবে জন্মগ্রহণ করবে।

হঠাৎ যেন সমস্ত কলকাতাময় একটা শোরগোল পড়ে গেল। এসেছে, এসেছে! তোমার সব সাবধান, তোমরা সব হুঁশিয়ার! আসামী এসে পড়েছে! পনেরো বছর আগে যে একদিন আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল সে আবার এসেছে। তোমরা সব পাপ ঢাকা দিয়ে রাখো, সব ঘা লুকিয়ে ফেলো। সে দেখতে পেলে আবার অনর্থ বাধাবে। আবার তার ফুলশয্যার রাত্রে শোবার ঘর থেকে পালিয়ে যাবে, আবার নয়নতারাদের ওপর চরম প্রতিশোধ নেবে, আবার কাচের দোয়াতদানিটা নিয়ে নিজের কপালের ওপর ঠাঁই-ঠাঁই করে আঘাত করবে, আবার রক্তে মুখ ভেসে যাবে, আবার নয়নতারা সে রক্ত দেখে অজ্ঞান-অচৈতন্য হয়ে পড়বে।

আজকের কর্তাবাবুরা আবার চিৎকার করে উঠলো–দীনু–দীনু–

দীনু সামনে আসতেই কর্তাবাবু বলে উঠলেন–বংশী ঢালী কোথায়? বংশী ঢালীকে একবার ডাকো তো দীনু–

বংশী এসেই হুজুরকে পেন্নাম করলে। বললে–বলুন কর্তাবাবু কী কাজ, নিজের জান দিয়ে আমি আপনার কাজ করে দেব–

কর্তাবাবু বললেন–খুব সাবধানে করতে হবে কিন্তু বংশী, কেউ যেন জানতে না পারে–

বংশী বললে—আগে

 কি কখনও অসাবধান হয়েছি যে আপনি ওকথা বলছেন?

কর্তাবাবু বললেন–ওরে, তা বলছি নে, আবার একটা ঝামেলা হয়েছে, সেই ঝামেলাটা তোকে কাটাতে হবে–

বংশী বললে–বলুন না, কাকে খতম করবো?

কর্তাবাবু বললেন–এই এখুনি খবর পেলুম। সেবার জানিস তো খোকার বিয়ের পরদিন কালীগঞ্জের বউ এসেছিল?

বংশী বললে–খুব মনে আছে হুজুর, আমি তাকে খতম করে দিয়েছিলুম, কেউ কি সে খবর টের পেয়েছিল?

–না, তা পয়িনি। সেই জন্যেই তো তোকে এবার আবার ডেকেছি।

–তা বলুন না হুজুর, এবার কাকে খতম করতে হবে? আবার কে এসেছে? বড় বিশ্বাসী কর্মচারী এই বংশী ঢালীরা। সেই কর্তাবাবুর অনেক আগেকার আমলেও এরা ছিল, এই এতদিন পরেও এরা আছে। জমিদারি উঠে গেল, ইজিপ্ট, আফ্রিকা, এশিয়ার সব দেশ থেকে কর্তাবাবুরা সবাই চলে গেল, সব দেশ আবার স্বাধীন হয়ে গেল, গণতন্ত্র চালু হয়ে গেল, কিন্তু রয়ে গেল সেই আয়-আদায় আর সঙ্গে রয়ে গেল কর্তাবাবুদের সেই দাপট। আর তার সঙ্গে রয়ে গেল এই বংশী ঢালীরা। সত্যিই বড় বিশ্বাসী কর্মচারী এই বংশী ঢালীরা। সুখশান্তির দিনে তারা খেতে পাচ্ছে কি উপোস করে মরছে তা দেখবার দায় ছিল না কর্তাবাবুদের, এখনও তাদের সে দায় নেই। কিন্তু বিপদের দিনে এখনও তারাই ভরসা। তারাই বরাবর বুক দিয়ে বাঁচায় কর্তাবাবুদের। এবারও তাই বংশী ঢালীদের ডাক পড়েছে দরবারে।

–বলুন হুজুর, এবার কাকে খতম করতে হবে? কে এসেছে?

কিন্তু উত্তর দেবার আগেই টেবিলের টেলিফোনের বাজনাটা বেজে উঠলো।

কর্তাবাবু রিসিভারটা তুলেই বললেন–কে?

–চীফ-মিনিস্টার বলছেন?

কর্তাবাবু বললেন–হ্যাঁ, কী হলো? মিসেস ব্যানার্জি নাকি?

ওধার থেকে মিসেস ব্যানার্জির মিহিগলার কৃতজ্ঞ সম্মতির হাসি ভেসে এল।

–আজকে আমার এখানে আপনার আসবার কথা, আমি একবার রিমাইণ্ড করে দিচ্ছি, প্রথমের জন্মদিন, মনে আছে তো মিস্টার সেন?

কর্তাবাবু বললেন–শিওর, প্রথমের জন্মদিন, আমার মনেই ছিল না একেবারে। মনে করিয়ে দিলে ভালো করেছেন। সত্যি কী চমৎকার নাম রেখেছেন। প্রথম!

মিসেস ব্যানার্জি বললে–প্রথম নামটা সত্যিই পছন্দ হয়েছে আপনার?

–সত্যিই বড় বিউটিফুল নাম। এমন অরিজিন্যাল নাম কে দিলে মিসেস ব্যানার্জি?

মিসেস ব্যানার্জি বললে—ও–

–মিস্টার ব্যানার্জ? তাই নাকি? নাঃ ওঁর তো দেখছি ইমাজিনেশান আছে খুব!

–তা আপনার আর সময় নষ্ট করবো না মিস্টার সেন। মিসেস সেনকে নিয়ে আসবেন কিন্তু। সকলকেই আজকে আসতে বলেছি, মিস্টার নবিকভ্‌ও আসছেন–

–আর মিস্টার হেন্‌ডারসন?

–হ্যাঁ, মিস্টার হেন্‌ডারসনকেও বলেছি। সেদিক থেকে আমি কোনও ভুল করতে পারি?

–ও-কে।

শুধু চিফ-মিনিস্টার নয়, সকলেই এক-এক করে টেলিফোন পেতে লাগলেন। কর্তাবাবুকে বাদ দিলে যেমন চলে না, তেমনি প্রাণকৃষ্ণ সা’কেও বাদ দিতে পারা যায় না। তারিণী চক্রবর্তী, বেহারি পাল তারাও নবাবগঞ্জের গন্যমান্য লোক। নবাবগঞ্জের প্রজার বাড়িতে বিয়ে-অন্নপ্রাশন হলে গ্রামের যাঁরা মাথা তাদের ডাকতেই হবে। নইলে খোসামোদের সিঁড়ি বেয়ে ইজ্জতের শিখরে ওঠা যায় না। আর ইজ্জতের শিখরে ওঠার প্রধান ধাপই হচ্ছে পার্টি দেওয়া। ইজ্জতই যদি না পেলাম তো শুধু ব্যাঙ্কের টাকা নিয়ে কি আমি ধুয়ে খাবো? আর শুধু তো বাড়ি-গাড়ি বাবুর্চি-খানসামা নিয়ে পেট ভরে না! পদ্মশ্রীটা আজকাল বড় মামুলী হয়ে গেছে। পদ্মবিভূষণ না হোক, পদ্মভূষণটা অন্ততঃ পেতে হবে। তার পরে প্রথম না হয় এখন ছোট আছে। এই সবে বারো বছরে পড়লো। কিন্তু চিরকাল তো আর ছেলেমানুষ থাকবে না সে। একদিন প্রথম আরো বড় হবে। কলকাতায় থাকলে তো সে মানুষ হবে না। আরো পাঁচজন বখাটে ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে একই স্কুলে লেখাপড়া করলে সেও তাদের মত বখাটে হয়ে যাবে। এখন থেকেই তার ভবিষ্যতের কথা ভাবা উচিত। হয় রাশিয়া না হয় আমেরিকাতে তাকে পাঠাতে হবে। সুতরাং এমব্যাসিগুলোকে হাতে রাখা দরকার।

মিস্টার নবিকভ্‌ টেলিফোন-রিসিভারটা তুলে নিলেন–হ্যালো–

ওধার থেকে মিহি হাসির মত মিষ্টি গলায় আওয়াজ এল–আমি মিসেস ব্যানার্জি স্পিকিং–গুড মনিং মিস্টার নবিক, আজকে সন্ধ্যার কথা মনে আছে তো! আমার প্রথমের জন্মদিন, বার্থ-ডে, আমি একবার রিমাইণ্ড করে দিচ্ছি–

–ও শিওর শিওর। প্রথমের বার্থ-ডে!

মিসেস ব্যানার্জি বললে–আসা চাই কিন্তু, মিসেসকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন, ভুলবেন না–

–প্রথম মানে কী মিসেস ব্যানার্জি? আপনি বলেছিলেন বটে, কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছি!

মিসেস ব্যানার্জি বললে–-প্রথম মানে ফার্স্ট–

–ভেরি গুড নেম! বলে ডিপ্লোম্যাটিক হাসি হাসতে লাগলেন মিস্টার নবিকভ্‌।

এর পরে মিস্টার হেনডারসন। মিস্টার হেনডারসন ক্যালকাটায় পোস্টিং হবার আগে আমেরিকার এ্যামবাসাডার হয়ে ওয়েস্ট-এশিয়ায় ছিলেন। বলতে গেলে থার্ড-ওয়ার্ড সম্বন্ধে তিনি স্পেশ্যালিস্ট। প্রেসিডেন্টের বিশেষ প্রিয়পাত্র। ক্যালকাটায় পোস্টিং হবার আগে ভালো করে ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন। তিনি সেখানে জেনেই এসেছে বাঙ্গালীরা ভারি শ্রুড অথচ ইমোশনাল। একবার যদি তুমি ওদের ককটেল পার্টিতে ডাকো তো ওরা বর্তে যাবে। ফ্ল্যাটারির রাজা ওরা। কিন্তু বাইরে সবাই ওরা এমন সেজে থাকে যেন কত ইনটেলেকচুয়্যাল। আসলে সবাই ফুলিশ। একবার যদি ওদের আমেরিকা টুর করাবার লোভ দেখাও তো যেন হাতে চাঁদ পাবে। ওরা তোমাকে মাথায় নিয়ে নাচবে।

হেন্‌ডারসন জিজ্ঞেস করেছিল–ওরা যদি পার্টিতে মেনন্তন্ন করে তো যাবো?

–শিওর, সাদা চামড়া, বিশেষ করে আমেরিকানদের ওপর ওদের একটা উইকনেস আছে!

মিস্টার হেন্‌ডারসন বলেছিল কিন্তু আমি শুনেছিলুম, ওরা নাকি একটু রাশিয়া ঘেঁষা?

–রাবিশ! বরং বলতে পারো টাকা-ঘেঁষা। আসলে সব বাঙালীই এক-একজন পোয়েট, পোয়েটরা কি পলিটিক্স বোঝে? বোঝে? বোঝে শুধু হুজুগ। নিজের কেরিয়ারের জন্যে ওরা সব কিছু করতে পারে–ওই বাঙালীরা–

আসবার আগে ওয়াশিংটন থেকে হেন্‌ডারসনকে সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে ক্যালকাটায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর শুধু ওয়াশিংটন কেন, মসকো থেকেও মিস্টার নবিকভকে সব কিছু পাখীপড়া করে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই এখানে আসবার পর থেকে দু’জনেই বাঙালী-সমাজে মিশতে আরম্ভ করেছিল। সেই সূত্রেই মিসেস ব্যানার্জির সঙ্গে আলাপ।

আসলে একটুখানি শুধু হচ্ছে। ইচ্ছে আর টাকা ওই দুটো মূলধন থাকলে তুমি ইচ্ছের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে ইজ্জতের শিখরে গিয়ে উঠতে পারবে।

এর পরে পুলিস কমিশনার।

–হ্যাল্লো!

–মিস্টার সামন্ত আমি মিসেস ব্যানার্জি বলছি। আজকে আসছেন তো?

–মিস্টার সামন্ত বললেন নিশ্চয়ই। প্রথমের বার্থ-অ্যানিভার্সারি, আর আমি যাবো না? বলছেন কী আপনি?

–তাহলে একটা অনুরোধ করবো মিস্টার সামন্ত। আমার লোক্যাল থানার ওসি’কে যদি একবার বলে দেন, বাড়ির সামনে কয়েকজন কনস্টেবল-এর বন্দোবস্ত করতে।

–ও-কে, আমি এখনি ব্যবস্থা করছি।

এমনি করে সমস্ত নবাবগঞ্জের তাবৎ ভি-আই-পি’দের ডাকা হয়েছিল। আবার সেদিন সকলকে মনে করিয়েও দেওয়া হলো। কর্তাবাবুর বাড়ির কাজে সবাইকে আসতেই হবে। তাতে যারা আসবে তাদেরও ইজ্জৎ বাড়বে, আর যার বাড়িতে আসবে তাদেরও ইজ্জৎ বাড়বে।

কিন্তু কালীগঞ্জের বউ কেন বিনা নিমন্ত্রণে আসতে গেল?

কর্তাবাবু কৈলাস গোমস্তাকে জিজ্ঞেস করলেন–কৈলাস, তুমি কি কালীগঞ্জের বউকে নেমন্তন্ন করেছিল নাকি?

কৈলাস বললে–আজ্ঞে না–

–তা নেমন্তন্ন না করলে সে এখন এ বাড়িতে আসে কেন? কোন্ সাহসে আসে? কৈলাস বললে–আজ্ঞে নতুন বউ-এর মুখ দেখতে এসেছে–

–তা নতুন বউএর মুখ দেখতে কি আজকেই আসতে হয়? যা হোক, যখন এসে গেছে তখন আর তাড়িয়ে দেবার দরকার নেই? কিন্তু বেশিক্ষণ যেন না থাকে–

কৈলাস গোমস্তা চলে যাবার পরেও যেন কর্তাবাবু শান্ত থাকতে পারলেন না। তার মনে হলো সেরেস্তার পাশের যে চোর-কুঠুরিটা আছে সেখান থেকে যেন একটা অস্ফুট শব্দ হলো। বংশী ঢালী এতটুকু ভুল করে ফেলে তাহলে সব কিছু যেন আজ ভণ্ডুল হয়ে যাবে। সব যেন পণ্ড হয়ে যাবে। অথচ আজকের উৎসবে এত লোক এসেছে, এরা যদি কেউ দেখে ফেলে! চিফ মিনিস্টার মিস্টার সেন এসেছে, আমেরিকার অ্যামব্যাসাডার মিস্টার হেল্ডারসন এসেছে, এসেছে রাশিয়ার অ্যামব্যাসাডার মিস্টার নবিকভ, এসেছে কলকাতার পুলিস কমিশনার মিস্টার সামন্ত। আসতে কারো বাকি নেই। বাইরের রাস্তায় গাড়ির লাইন পড়ে গেছে। মিস্টার ব্যানার্জির ছেলের আজ বার্থ-ডে। মিসেস ব্যানার্জির প্রথম সন্তান। আজকে সে বারো বছরে পড়লো। প্রথমই আজকে সকলের লক্ষ্য। সকলের উপহারগুলো বিরাট একটা টেবিলের ওপর জড়ো হয়েছে। সবগুলো উপহার সেখানে ধরছে না। অনেকগুলো উপচেও পড়ছে। কিন্তু তবু উপহারের যেন শেষ নেই।

হঠাৎ কে যেন একজন কাছে এল। মিস্টার ব্যানার্জী তখন কাজে ব্যস্ত। কাজ এমন কিছু নয়। কাজ করবার তার লোকের অভাবও নেই। হোটেলকে কনট্র্যাক্ট দেওয়া হয়েছে। খাওয়ার বন্দাবস্ত সব কিছু করছে ওরাই। তারা কেটারিং এক্সপার্ট।

–ব্যানার্জি সাহেব কোথায়?

আর দোতলার একটা হল-এর ভেতর ককটেল-এর ব্যবস্থা। সেখানে ট্রে কোলে করা বয় আর ওয়েটারদের আনাগোনা। অনেকের সঙ্গে আছে সিগারেট-ঢালা একটা ট্রে। তারা সামনে দিয়ে গেলে ইচ্ছে করলে তুমি একটা সিগারেট তুলে নিতে পারো। মিস্টার সেন এর অনেক কাজ। সোজা রাইটার্স বিল্ডিং থেকে চলে এসেছেন। তাঁকে ঘিরেই যত মানুষের ভিড়। সকলের হাতেই গেলাস। একটা গেলাস খালি না হতেই আবার একটা ভর্তি গেলাস নিয়ে দাঁড়ায় বেয়ারা। কারো গেলাস তারা খালি রাখতে দেবে না।

লোকটা তখন নিচেয় সব জায়গায় ঘুরছে। জিজ্ঞেস করছে ব্যানার্জি সাহেব কোথায় রে?

একজন বেয়ারা হনহন করে কোথায় যাচ্ছিল। সে বললে–ব্যানার্জি সাহেব কোথায় তা আমি কি জানি? ওপরে গিয়ে দ্যাখ না–

বাজে কথা বলবার কি কারো আজ সময় আছে! আজ যারা এ বাড়িতে এসেছে তাদের তদ্বির-তদারক করতে এতটুকু ত্রুটি হলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে! গেটের বাইরে পাহারার ব্যাবস্থা আছে! আজকের অতিথি-অভ্যাগতরা সবাই ভি-আই-পি। তারা আগেও অনেকবার এ-বাড়িতে এসেছে, আবার আজকেও এসেছে।

কর্তাবাবু ছেলেকে ডেকে পাঠালেন।

চৌধুরী মশাই আসতেই কর্তাবাবু বললেন–খোকা কোথায়?

চৌধুরী মশাই বললেন–নিচেই আছে সে–

কর্তাবাবু বললেন–খোকাকে একটু নজরে রাখবে, যেন আবার পালাতে না পারে। গায়ে-হলুদের দিন যেমন পালিয়েছিল তেমনি যেন না করে–একটু দেখো–

চৌধুরী মশাই বললেন–হ্যাঁ নজর রাখা হচ্ছে, প্রকাশ পেছনে-পেছনে রয়েছে–

–খোকাকে খাইয়ে দাইয়ে একেবারে বউমার ঘরে ঢুকেয়ে দেবে। যখন দেখবে যে খোকা ভেতর থেকে খিল দিয়েছে, তখন আমাকে এসে বলে যারে–

আজ এখানেও সেই রকম। কর্তাবাবু সকাল থেকেই হুকুম দিয়েছেন। নজর রাখো ভালো করে। চিফ মিনিস্টার আসবে, ফরেন অ্যামবাসাডাররা আসবে, পুলিস কমিশনার আসবে। তাদের যেন কোনও অযত্ন না হয়, তাদের অভ্যর্থনা-আপ্যায়নে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। মিস্টার ব্যানার্জি সকাল থেকেই ব্যস্ত। শুধু টাকা খরচ করলেই তো কাজ হয় না, চারিদিকে নজর রাখা চাই। যেন কোনও ভাবে বাজে লোক ঢুকে না পড়ে।

দোতলার হলঘরের ভেতর মিস্টার সেন বলেন, না, আর দেবেন না, আর দেবেন না আমাকে–

মিসেস সেন বললে–আমিও আর বেশি নেব না মিসেস ব্যানার্জি–

–না না, একটু স্ন্যাকস নিন–

বলে মিসেস ব্যানার্জি দু’জনকেই আর একটা পেগ দিচ্ছিলেন। কিন্তু চিফ মিনিস্টার হাতটা পিছিয়ে নিলেন। বললেন–না না, আমাকে আবার এখনি একবার রাইটার্স বিল্ডিং-এ ফিরে যেতে হবে

মিসেস ব্যানার্জি বললে–কেন, এখন আবার রাইটার্সে যাবেন কেন?

মিস্টার সেন বললেন–আর বলেন কেন, এই এখানে আসবার একটু আগেই ফোন এল নদীয়া ডিসট্রিক্টে খুব গণ্ডগোল চলেছে–

–নদীয়া? নদীয়ার কোন্ জায়গায়? কী গণ্ডগোল?

–সেখানে স্কুল-কলেজের ছেলেরা বিল্ডিং-এ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। হাসপাতাল ছিল একটা সেখানে, শুনেছি তাতেও নাকি আগুন ধরিয়ে দিয়েছে

–কেন, কী হয়েছিল?

মিস্টার সেন বললেন–ওই যা সব জায়গায় হচ্ছে, আজকাল কেউ তো কারো ডিউটি করছে না। এক ভদ্রলোক লাখ-লাখ টাকা খরচ করে পনেরো বছর আগে সেখানে স্কুল কলেজ আর হাসপাতাল করে দিয়েছিল, সেই সব পুড়িয়ে দিচ্ছে, গ্রামের লোক সব পালিয়ে আসছে–সি-আর-পি পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন গিয়ে আর একবার খবর নেব টেলিফোনে

–জায়গাটা কোথায়? নাম কী জায়গাটার?

–নবাবগঞ্জ।

.

আর এদিকে সমস্ত নবাবগঞ্জটাকেই কেউ যেন আরো বড় আকারে এই কলকাতায় এনে বসিয়ে দিয়েছে। এখানেও বাইরে সেই পরমেশ মৌলিকের মত কাছারি বাড়িতে হিসেবের খাতা নিয়ে বসে থাকে মানদা মাসি। সকালবেলা মানদা মাসির কোনও কাজ থাকে না। এই পার্ক স্ট্রীটের পাড়ায় এই বাড়িটা আরো বড় দশটা বাড়ির মতই আরো একটা। অন্য বাড়িগুলোর সঙ্গে এ বাড়ির চেহারায় কোনও পার্থক্য নেই। এ-পাড়ার সব বাড়িগুলোই বড়। মানদা মাসির বয়স আরো পনেরো বছর বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পনেরো বছরের অভিজ্ঞতাও বেড়েছে। এই বয়েসে মাসি সত্যিই অনেক দেখলো। কালীঘাটের মন্দিরের রাস্তায় যে ভিখিরি মেয়েটা একদিন তীর্থযাত্রীদের পেছনে পেছনে ভিক্ষে করে বেড়িয়েছে, তারপর বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে একদিন আবার গায়ে গয়নাও উঠেছিল যে-মেয়েটার, সেই মেয়েটাই আবার একদিন কালীঘাটের গলিতে একটা ছোট খোলার ঘরে আরম্ভ করে দিয়েছিল এই ব্যবসা।

কিন্তু মানুষের উচ্চাভিলাষ থাকলে যে একদিন মানুষ কোথায় উঠতে পারে এই পার্ক স্ট্রীটের বাড়িটাই তার প্রমাণ। এইজন্যে মানদা মাসি কত লোককে কত খোশামোদ করেছে। একটা একটা করে মানদা মাসি পয়সা জমিয়েছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ভবিষ্যতের অভাবের কথা ভেবে নয়, আসলে ভবিষ্যতের প্রাচুর্যের কথা ভেবেই। সেই খোলার বস্তির ঘরের ভেতরে শুয়ে শুয়ে মানদা-মাসি স্বপ্ন দেখতো কবে সেই খোলার বাড়িটা এতদিন পাকা বাড়িতে রুপান্তরিত হবে। মেয়েরা সেজেগুজে সোফার ওপর বসে থাকবে। আর বড় গাড়ি এসে দাঁড়াবে সামনে। সেই গাড়ি থেকে বড় বড় লোকের ছেলেরা নামবে আর তাদের গা থেকে ভুর ভুর করে বিলিতি আতরের গন্ধ বেরোবে।

আর সেই জন্যেই মানদা মাসি কত খোশামোদ করেছে বাতাসীকে। বাতাসীর পা পর্যন্ত টিপে দিতে কসুর করেনি মানদা মাসি। ভেবেছিল বাতাসী অন্তত বড়বাবুকে বলে একটা টাকা পাওয়ার সুরাহা করে দেবে। হাজার হোক পুলিসের বড়বাবু তো!

কিন্তু কপাল! আমি যাই বঙ্গে তো কপাল যায় সঙ্গে। সেইবাতাসীর শেষকালে কী না হলো? ওরই নাম হলো কপাল। সেই বড়বাবু শেষকালে চাকরিতে আরো বড় হলো। বড়বাবুর বাপ মরে গেল। কত চাকর বাকর। সেই বাতাসীরই আবার কত খোয়াব শেষকালে। এক গেলাস জল পর্যন্ত গড়িয়ে খেতে হতো না তাকে। বড়বাবুর যখন আরো পয়সা হলো তখন মটরগাড়ি করে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেত। এমন কী একটা সতীন ছিল সেও একদিন গলায় দড়ি দিয়ে মরলো।

ওরই নাম হলো কপাল। কোথায় ছিল কোন্ বস্তিতে, আর কার হাতে পড়ে একে বারে রাতারাতি রাজরাণী হয়ে গেল।

আর মানদা মাসি!

মানদা মাসি তখনও যে-কে সেই। তার তখনও সেই আগেকার দুর্দশা। তখনও সেই খোলার ঘরে বস্তিতে দিশী মেয়ে আর দিশী মাল নিয়ে কারবার করে তাকে পেট চালাতে হয়।

ঠিক সেই সময়ে একদিন একটা অফিসের কেরানী এক বন্ধুকে নিয়ে এসে হাজির হলো। তার নামটাও আজ আর তেমন মনে নেই। শীতেশ না কী যেন নাম ছিল তার।

শীতেশ বললে–আমার এক বন্ধুকে এনেছি মাসি–

–বন্ধু? বন্ধুকে এনেছ তো ভালোই করেছ, তা কার ঘরে বসবে তোমরা?

শীতেশ বললে–বসতে আসিনি মাসি আজকে। আমার এই বন্ধু ব্যবসা করতে চায়, তা আমি বলেছি তোমার ব্যবসা বুদ্ধি খুব আছে, তোমার এ ব্যবসায় লাভ-লোকসান কী সেই সব শুনতে চায়। একে একটু বুঝিয়ে বল তো তুমি–

মাসি জিজ্ঞেস করলে–তোমার নাম কী বাবা?

ছেলেটা লাজুক খুব। বললে–অমার নাম নিখিলেশ, নিখিলেশ ব্যানার্জী।

বেশ নামটা। নামটা মনে ছিল মাসির। কিন্তু খানিকক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারলে টাকা তার তেমন নেই। ধার-ধোর করে বড়জোর হাজার পাঁচেক টাকা তুলতে পারে। অর্থাৎ বাজিয়ে দেখতে চাইছিল কোন কারবারে কত লাভ। মেয়েদের বোর্ডিং-হাউস করলেই বা কত লাভ, আর এই ব্যবসাতেই বা কত। হিসেবপত্র করে মাসি সেদিন প্রমাণ করিয়ে দিয়েছিল যে তেমন করে সাহেব পাড়ায় এই ব্যবসা করলে টাকায় দশগুণ লাভ। মানে এক টাকায় দশ টাকা।

কথাটা শুনে ছেলেরা চলে গিয়েছিল। মাসি ভেবেছিল আর আসবে না তারা, আর এ পথ মাড়ারে না।

কিন্তু আশচর্য! সত্যিই, আশ্চর্য না আশ্চর্য!

তার তিন মাস পরেই একদিন সেই খোলার বস্তির সামনে সদর রাস্তায় একটা মস্ত গাড়ি এসে হাজির। বলতে গেলে গাড়ি করে সে-পাড়ায় কোনও লোক আসতো না। কালীঘাটের খদ্দেররা সবাই-ই ছোটলোক।

কিন্তু তখন মাসি কল্পনা করতেও পরেনি। গাড়ির ড্রাইভার এসে খবর নিলে, মানদা মাসি নামে ইহা কোই হ্যায়?

মানদা মাসি বললে–হ্যাঁ বাছা, আমারই নাম মানদা।

ড্রাইভার বললে–সাহেব আপনাকে একবার ডাকছে—

–সায়েব? কে সায়েব? কোথায় তোমার সায়েব?

–গাড়িমে। বলে বড় রাস্তায় গাড়িটা দেখিয়ে দিলে ড্রাইভার।

মানদা মাসি তখনও বুঝতে পারেনি। তার কাছে আবার গাড়িতে কে আসতে যাবে! তখন বেশ অন্ধকার চারিদিকে। গলিটা পেরিয়ে বড় রাস্তার ওপর গাড়িটার কাছে গিয়েও চিনতে পারেনি।

–আমায় চিনতে পারছো মাসি?

মানদা মাসি বারবার করে চেহারাটা দেখেও চিনতে পারলে না।

–চিনতে পারলে না? শীতেশকে মনে আছে? সেই রোগা লম্বা মতন?

–হ্যাঁ হ্যাঁ। তা সে কোথায় বাবা?

–সে মরে গেছে। একদিন হার্ট-ফেল করে মরে গেছে। তা আমি অনেক দিন আগে তার সঙ্গে তোমার এখানে এসেছিলুম। আমার নাম নিখিলেশ। নিখিলেশ ব্যানার্জি। এখন মনে পড়েছে তো?

অনেক কষ্টে মনে পড়লো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সেই যারা একদিন অফিসে কেরানী-গিরি করতো, তাদের এরকম গাড়ি হলো কী করে সেটা বুঝতে পারলে না।

–তুমি আমার সঙ্গে একবার যেতে পারবে মাসি?

মানদা মাসি বললে–কোথায়?

–যেখানে হোক, এখানে বসে কথা হবে না, একটা নিরিবিলি কোনও জায়গায় বসে তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই। যে ব্যবসার কথা বলেছিলুম সেই ব্যবসা সম্বন্ধেই পরামর্শ করতে চাই–আমার সঙ্গে একবার চলো না এখন।

তা, সেই হলো সূত্রপাত। যে-মানুষটার কাছে একদিন পাঁচ হাজার টাকাও ছিল না, সেই মানুষটাই একদিন এক কথায় পঞ্চাশ হাজার টাকা বার করে দিলে। আর তারপরেই পার্ক স্ট্রীটের পাড়ায় একদিন গড়ে উঠলো এই ‘গ্রীন-পার্ক’। গ্রীন-পার্কে দিনের বেলা কিছু ব্যতিক্রম বোঝবার উপায় নেই। আশে-পাশের আরো দশটা অফিস বাড়ির মত এর চেহারা। কিন্তু সন্ধ্যের পর থেকেই এ বাড়ি যেন নেশা করে। নেশায় একেবারে টলতে থাকে। তখন নানা রং-বেরংএর গাড়ি এসে সামনের রাস্তায় দাঁড়ায়। তখন বড় বড় গণ্যমান্য ভদ্রলোকেরা লিফট দিয়ে ওপরে উঠে আসে। দরজার মুখে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের প্রথমে হাজির হতে হয় ম্যানেজারের কাছে। ম্যানেজার যেমন যেমন হুকুম দেয় তেমনি হুকুম তামিল হয়। কেউ চায় কালো, কেউ চায় ফর্সা, কেউ চায় নেপালী, কেউ চায় কাশ্মীরী, আবার কেউ চায় মেমসাহেব। ইংলিশ জার্মান ফ্রেঞ্চ মেমসাহেব। সব জাতের মেয়েমানুষের ব্যবস্থা আছে। ‘গ্রীন-পার্কে’।

কিন্তু সকলের আড়ালে থাকে মানদা মাসি। মানদা মাসিই বলতে গেলে এই গ্রীন পার্কের চাবিকাটি। আসলে বস্তির ব্যবস্থা আর এই পার্ক স্ট্রীটের ব্যবসায় কোনও তফাৎ নেই। সেই কালীঘাটের মেয়েদেরই সাজ-পোশাক পরিয়ে পরিয়ে কড়া ইলেকট্রিক আলোর তলায় দাঁড় করিয়ে দিলেই তাদের আবার তখন অন্য রকম চেহারা হয়ে যায়। আগে যাদের রেট ছিল এক টাকা, তারাই এখানে এসে ঘণ্টায় একশো টাকা দর হাঁকে। তারাই কেউ চীনে মেয়ে সাজে, কেউ কাশ্মিরী, কেউ বা মেমসাহেব।

এ ছাড়া যদি অন্য কিছু চাও তাও পাবে। বেঁটে লম্বা রোগা পাতলা, এক-একজন ভদ্রলোকের ছেলের এক-এক রকম পছন্দ। কাঠের পার্টিশান দেওয়া সব ঘর। আব্রুর ব্যবস্থা ভালো। কারো সঙ্গে কারো দেখা হবার ভয় নেই। ফেল কড়ি মাখো তেল। বাঁধা মেয়াদ সকলের। তারপর তোমার মেয়াদ ফুরোলেই তোমার ঘর খালি করে দিতে হবে।

ঘণ্টায় ঘণ্টায় ক্যাশ টাকা নিয়ে এসে ম্যানেজার জমা করে মানদা মাসির কাছে। এক একদিন জমে তিন হাজার, এক-একদিন চার হাজার। পাঁচ হাজারে গিয়েও এক-একদিন ঠেকে। পালে-পার্বণে বাড়ে। যেমন দুর্গা-পুজো। দুর্গাপুজো আর বড়দিনেই ‘গ্রীন-পার্কে’র মরসুম। তখন আবার কলকাতার বাইরে থেকেও লোক আসে। সোজা দিল্লী বোম্বাই থেকে লোক আকাশ দিয়ে উড়ে এসে নামে কলকাতায়। তখন মানদা মাসির আর নাইবার খাবার সময় থাকে না। অত টাকার হিসেব কি সোজা কথা!

কিন্তু টাকা বড় নচ্ছার জিনিস। বিশেষ করে ক্যাশ টাকা। ক্যাশ টাকার হিসেব যদি যখনকার তখন নগদনগদ না করা যায় তো সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। তাই সাহেবকে বলা আছে। প্রতিদিন সন্ধ্যেয় মানদা মাসি নিজের গাড়ি করে নিজের হাতে একেবারে ব্যানার্জি সাহেবের কাছে গিয়ে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসে।

ব্যানার্জি সাহেব অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে ওই টাকার জন্যে। হিসেবের খাতাটাও সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। কারবারের আধাআধি বখরার পাই-পয়সাটাও পর্যন্ত সব বুঝিয়ে দিতে হয় সাহেবকে। এমন কি মদের বিল পর্যন্ত।

সেদিন হঠাৎ টেলিফোন এল–কোথায়? মাসি কোথায়?

গলা শুনেই ম্যানেজার বুঝতে পারে। সোজা লাইনটা একেবারে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়।

মাসি লাইনটা পেয়ে বলে-হ্যালো–

ওদিক থেকে সাহেবের গলার শব্দ আসে–কিছু টাকা দরকার ছিল, এই হাজার পাঁচেকের মত।

–এক্ষুনি?

সাহেব বলে–হ্যাঁ, এখানে পার্টি বসে আছে–এখন কত কালেকশান হয়েছে?

–তিন হাজারের মত হয়েছে।

–ঠিক আছে, এখন তিন হাজারের মত হলেই চলবে। আমি বসে আছি—

সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার নিজে ব্যানার্জি সাহেবের বাড়িতে গিয়ে টাকা দিয়ে আসে। ব্যানার্জি সাহেবের সামনে তখন কে একজন বসে ছিল। ভারি সম্ভ্রান্ত চেহারা। ম্যানেজার চলে যেতেই টাকাটা নিয়ে সোজা ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিলেন মিস্টার ব্যানার্জি।

ভদ্রলোক টাকাটা পকেটে পুরতে যাচ্ছিল, কিন্তু মিস্টার ব্যানার্জি ছাড়লেন না। বললেন মিস্টার সামন্ত, টাকাটা গুনে নিন, প্লিজ–

মিস্টার সামন্ত বললেন–সে কী, আপনি যখন দিচ্ছেন তখন..

মিস্টার ব্যানার্জি বললেন–তা হোক, আপনি আমার বন্ধু হতে পারেন, কিন্তু বিজনেস ইজ বিজনেস–

অগত্যা মিস্টার সামন্ত টাকাগুলো এক-একটা করে গুনে নিয়ে উঠলেন। বললেন–হ্যাঁ, ঠিক আছে–ও কে–একটা সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা পের্টিকো। তাঁর গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ কানে এল। দারোয়ান গেট খুলে দিতেই গাড়িটা ধোঁয়া ছেড়ে বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে গেল।

নয়নতারা তখনও জেগে ছিল। নিখিলেশ ঘরে ঢুকতেই বললে–কী হলো, চলে গেছে!

নিখিলেশ বললে–হ্যাঁ আপদ গেছে, তিন হাজারের কম ছাড়লে না। বললে খুব টানাটানি চলছে। আর আমিও ভাবলুম পুলিসকে চটিয়ে লাভ নেই-

নয়নতারা বললে–যাক গে শুয়ে পড়ো, কালকে আবার পার্টি আছে–

ঘরের আলো নিভে গেল। সমস্ত নবাবগঞ্জ ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু অন্ধকার ঘরেও কর্তাবাবুর চোখে ঘুম নেই। হর্ষনাথ চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। বংশী ঢালী তার কাজ নিঃশব্দে সমাধা করেছে। আর কোনও ভাবনা নেই। কাল প্রথমেই পার্টিতে চিফ মিনিস্টার মিস্টার সেনকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে, ইউ-এস-এর মিস্টার হেন্‌ডারসনকে নেমন্তন্ন করা হয়েছে, মসকোর মিস্টার নাভিককেও নেমন্তন্ন করা হয়েছে, সকলেই মিসেসদের নিয়ে আসবে। নবাবগঞ্জের কাউকেই আর নেমন্তন্ন করতে বাকি নেই। যত ভি-আই-পি আছে সবাইকেই। এমন কি একটু আগেই যে লোকটা তিন হাজার টাকা নিয়ে চলে গেল সেই মিস্টার সামন্তও মিসেস সামন্তকে নিয়ে আসবে!

হঠাৎ চৌধুরী মশাই এল।

কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কে?

চৌধুরী মশাই বললেই–আমি—

কর্তাবাবু জিজ্ঞেস করলেন–কী খবর? খোকা পালায়নি তো?

–না, খাওয়া-দাওয়ার পর বউমার ঘরে শুতে ঢুকিয়ে দিয়ে আমরা চলে এসেছি–কর্তাবাবু তাতেও নিশ্চিন্ত হলেন না। জিজ্ঞেস করলেন–কিন্তু ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে কিনা তাই বলল না, খিল দিয়েছে?

–হ্যাঁ।

যাক, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলেন কর্তাবাবু। আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই। একদিন নিখিলেশ মদের দোকানে পিকেটিং করে জেলে গিয়েছিল। পুলিসের লাঠি খেয়েছিল। অনেক দিন ধরে অনেক দুঃখ ছিল তার। দেশ স্বাধীন হবার পর সকলের সব কিছু হলো, শুধু তারই কিছু হলো না। এবার সে-দুঃখ গেল। এবার আর কোনও দুঃখ নেই। এবার কর্তাবাবুর নাতি তার ফুলশয্যার রাত্রে শোবার ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে। এবার নতুন বউমার রূপ দেখে সে ভুলে যাবে। এবার নরনারায়ণ চৌধুরী তার পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে বংশপরম্পরায় অমর হয়ে থাকবেন, অনন্তকাল ধরে নিজের রক্তের ধারার মধ্যে অখণ্ড পরমায়ু লাভ করবেন। তিনি অক্ষয়, অব্যয় অজর-অমর হয়ে বিরাজ করবেন।

.

কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না যে তার বংশধর তার ফুলসজ্জায় শোবার ঘরের দরজা সবার দৃষ্টির অগোচরে বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উন্মুক্ত আকাশের তলায় একদিন আবার তার কন্টকশয্যাও পাতবে। তখনও তিনি জানতেন না যে বহুকাল পরে একদিন তার পৌত্র থিয়েটার রোডের একটা নতুন বাড়িতে এসে নতুন করে আবার তার ফুলশয্যা পাবে। হ্যাঁ, ফুলশয্যাই তো। নয়নতারার থিয়েটার রোডের বাড়িতে ফুলশয্যার আয়োজনই তো হয়েছিল। যত ছিল মদের আর খাবারের আয়োজন, ফুলের আয়োজনও তার চেয়ে কিছু কম ছিল না।

সেই সেদিন কলকাতার আর এক প্রান্ত থেকে তখন নরনারায়ণ চৌধুরীর বংশধর ঠিক তেমনি করেই হেঁটে আসছে। সঙ্গে হাজারি বেলিফ। হাজারি বেলিফ শেয়ালদ’ স্টেশনে নেমেই তাড়াতাড়ি পোঁটলা থেকে ক্ষুর বার করে দাড়িটা কামিয়ে নিয়েছে!

কিন্তু যত দক্ষিণে এগোতে লাগলো ততই সুন্দর সুন্দর রাস্তা, ততই বড় বড় বাড়ি। এদিকে আর কোথাও ভিখিরির উৎপাত নেই। এদিকে আর বড়বাজারের শেয়ালদার মত চিৎকার কোলাহল নেই।

সদানন্দ বললে–এদিকটা তো বেশ নিরিবিলি হাজারিবাবু, এদিকে তো আর ভিখিরির উৎপাত নেই–

হাজারি বললে–কী বলছেন মশাই, এদিকে ভিখিরি নেই? এ-পাড়ায় যত ভিখিরি আছে তত ভিখিরি দুনিয়াতে নেই, তা জানেন?

–তাই নাকি?

আরে মশাই এরা যে হচ্ছে অন্য রকমের ভিখিরি!

সদানন্দ বললে–তার মানে?

–আমি কোর্টের বেলিফ, আমি যে এদের সবাইকে চিনি। এদের নামেও যে হুলিয়া আছে।

–তাই নাকি। তা এদের তুমি সমন ধরাও না কেন?

হাজারি বললে–কেন সমন ধরাবো মশাই? তাহলে আমার পেট চলবে কী করে? এরা যে আমাকে দু-চার পাঁচ টাকা করে ঘুষ দেয়, আর আমিও কোর্টে গিয়ে রিপোর্ট দিই আসামী বেপাত্তা। তাতে এরাও বাঁচে আমিও বাঁচি। আর সঙ্গে সঙ্গে হাকিম পেসকার উকিল মোক্তার অ্যাটর্নী পেয়াদা সবাই-ই বাঁচে–

সদানন্দ বললে–তা তুমি কী করে জানলে এরাও ভিক্ষে করে?

হাজারি বললে–তা জানবো না? এদের বাড়িতে যে আমাকে রোজ আসতে হয়। আমি যে নিজের চোখে দেখেছি মশাই এরা জাত-ভিখিরি।

–তাই নাকি?

–হ্যাঁ, এরা ও-পাড়ার লোকেদের মত পয়সা ভিক্ষে করে না। এদের অল্প পয়সাতে পেট ভরে না তাই এরা লাখ-লাখ টাকা ভিক্ষে চায়। এরা বাড়ি ভিক্ষে করে, গাড়ি ভিক্ষে করে, মেয়েমানুষ ভিক্ষে করে, পারমিট লাইসেন্স আর পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ ভিক্ষে করে, এরা কি ভাবছেন ওদের মতন ছোটলোক ভিখিরি?

তারপর পাশের একটা বাড়ির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে-এই দেখুন, এই যে দেখছে বাড়িটা, এটাও একটা ভিখিরির বাড়ি, এর নাম ‘গ্রীন পার্ক’–

–‘গ্রীন পার্ক’ মানে?

–এখানে টাকা আর মেয়েমানুষের ভিক্ষে চলে। এর ভেতরে গেলে দেখবেন সার-সার সব ঘর। এটা হচ্ছে ব্যানার্জি সাহেবের নিজের ভিক্ষের জায়গা। এখানে মেয়েমানুষ লেলিয়ে দিয়ে নিজে টাকা ভিক্ষে করতে আসে ব্যানার্জি সাহেব। আসলে ব্যানার্জি সাহেবই এর মালিক কিন্তু দেখাশোনা করে সব মানদা মাসি–

–মানদা মাসি! নরনারায়ণ চৌধুরীর বংশধর চমকে উঠলো। নামটা যেন বড় চেনা চেনা ঠেকলো। মানদা মাসি যে তার চরণপূজো করেছিল, সে এখানে এল? কেন এখানে এল কী করে?

–আসুন, আসুন মশাই এখান থেকে।

সদানন্দ তবু ছাড়লে না। বললে–কেন চলে আসবো, আপনি আগে বলুন এখানে কী হয়?

হাজারি বেলিফ বললে–মশাই আপনার সঙ্গে আমি আর তক্কো করতে পারবো না, তার চেয়ে আমাকে না-হয় তিনটে টাকা দিন, আমি চলে যাচ্ছি–আমার কাজ নেই সমন ধরিয়ে–

বলে আগে আগে চলতে লাগলো। সদানন্দও চলতে লাগলো পেছন পেছন। আরো এগিয়ে গিয়ে আর একটা রাস্তা। তারপরে আরো একটা। তারপরে আবার আর একটা বড় রাস্তা। চলতে চলতে যেন সারা বিশ্বটাই তারা প্রদক্ষিণ করে চলেছে।

হাজারি বেলিফ বললে–আর তো হাঁটতে পারছিনে মশাই, আর কত দূর–?

সদানন্দ বললে–এইবার এসে গেছি, এই তো সামনেই–

সামনেই একটা জায়গায় গাড়ির ভিড় আছে এ-ধার থেকে ও-ধার পর্যন্ত। একটা বাড়ির সামনে অনেকগুলো আলো জ্বলছে। রাস্তার অনেকখানি জায়গা জুড়ে আলোয় আলো হয়ে গেছে। ওই-ই তো থিয়েটার রোড। এই-ই বোধ হয় নয়নতারার বাড়ি।

গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সদানন্দ। অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে একজন দারোয়ান। আশেপাশে আরো অনেক লোক। সব রাস্তার লোক মজা দেখতে দাঁড়িয়েছে।

সদানন্দ সামনে যেতেই দারোয়ানটা হাটিয়ে দিলে–এধার থেকে সরে যাও, হাটো, সব হাটো, দূর হাটো–

হাজারি বেলিফও পেছনে ছিল। সেও সরে দাঁড়ালো। পাশের একজন লোককে জিজ্ঞেস করলে–এ কার বাড়ি ভাই? কোন সাহেবের বাড়ি এটা?

রাস্তায় একটু ভিড় দেখলেই যারা দাঁড়িয়ে পড়ে লোকটা তাদেরই দলের। সেও বোধ হয় মজা দেখতেই এসে দাঁড়িয়েছিল।

বললে–এটা তো ব্যানার্জি সাহেবের বাড়ি–

ব্যানার্জি সাহেবের বাড়ি কথাটা কানে যেতেই সদানন্দ একটু সচেতন হয়ে উঠলো। তা হলে এইই নয়নতারার বাড়ি! সদানন্দ চারিদিকে ভালো করে চেয়ে দেখলে। এত বড় বাড়ি! এত বিলাস, এত ঐশ্বর্য! সদানন্দ মনে মনে খুশি হলো। ভালোই হয়েছে। নয়নতারার তা হলে আর কোনও অভাব অনটন নেই। এখন সচ্ছল সংসার। কিন্তু এ কীসের উৎসব এ বাড়িতে? এত অতিথি অভ্যাগত কীসের আকর্ষণে?

সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। কেউ ভেতরে যেতে দেবে না তাকে। আজকে এ বাড়ির ভেতরে তার জন্যে প্রবেশ নিষেধ। তবু একবার নয়নতারার সঙ্গে দেখা হলে ভালো হতো। একটু শুধু দেখা করে যেত। একটু শুধু জিজ্ঞেস করে যেত কেমন আছে সে? কী তার সর্বনাশ করেছে সে! জীবনের সর্বস্ব দিয়ে কী অপরাধ সে করেছে তার কাছে! নইলে তার বিরুদ্ধে এই অযৌক্তিক অভিযোগ!

হঠাৎ দারোয়ানটা হইহই করে উঠলো।

–হটো, হটো সব, হটো ইহাঁসে—

একটা রুল নিয়ে ভিড়ের দিকে এগিয়ে এল। ভিড় সরতেই একটা গাড়ি সোঁ-সোঁ করে একেবারে ভেতরের বাগানের দিকে ঢুকে গেল। বাইরের আলোর রেশ গাড়ির ভেতরে পড়তেই সদানন্দ দেখলে সেখানে একজন মহিলা বসে আছে। মানদা মাসি না? পনেরো বছর পরে দেখা, কিন্তু তবু চিনেত কষ্ট হলো না। এখন মাথার চুলগুলো একটু সাদা হয়ে গেছে, আর শাড়িটাও দামী ফরসা। গাড়ির পেছনে হেলান দিয়ে রাণীর মত বসে আছে। এত টাকা হলো কী করে তার? আর নয়নতারার বাড়িতেই বা কী করতে এল? নয়নতারার সঙ্গে মানদা মাসির সম্পর্ক কীসের? তাকে দেখেই দারোয়ান স্যালিউট করে সশ্রদ্ধ ভঙ্গি করলে। এ কী হলো! কালীঘাটের বস্তির খোলার বাড়ির সেই দ্রারিদ্র্য থেকে কীসের সিঁড়ি বেয়ে এখানে এই থিয়েটার রোডের ইজ্জতের শিখরে উঠে এসেছে সে? কীসের দৌলতে?

সঙ্গে সঙ্গে তখন আর একটা গাড়ি।

সদানন্দ অন্যমনস্ক ছিল। দারোয়নের তাড়া খেয়ে আবার পাশে সরে এল। এ কে? পাশ থেকে কে একজন বলে উঠলো-পুলিস কমিশনার সাহেব—

কিন্তু সদানন্দ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলে এ সেই সমরজিৎবাবুর ছেলে! সেই মহেশের বড়দাদাবাবু! এরা সব এ বাড়িতে এল কেন? এর কি সবাই নয়নতারাকে চেনে? নয়নতারার সঙ্গে এদের কীসের সম্পর্ক?

সদানন্দর চোখের সামনে দিয়েই গাড়িগুলো একে-একে ভেতরে ঢুকতে লাগলো। আর তার মনে হতে লাগলো সে যেন সেই পনেরো বছর আগেকার সেই নবাবগঞ্জের নিজেদের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তেমনি সমারোহে, তেমনি জৌলুস। সেদিন তার বিয়ে। বিরাট একটা হ্যাজাক বাতি জ্বলছে সদর দরজার মাথায়। আশে-পাশের সমস্ত গ্রামের লোকজন দল বেঁধে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসছে।

হাজারি বেলিফ দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলে–এখানে কী হচ্ছে দারোয়ানজী?

দারোয়ানের তখন বলবার সময় নেই। সে তখন গন্যমান্য অতিথি-অভ্যাগতদের সেলাম করতেই ব্যস্ত।

পাশে দাঁড়ানো একটা লোক বললে–পার্টি হচ্ছে–

–কীসের পার্টি?

–ছেলের জন্মদিন।

ছেলের জন্মদিন! কথাটা শুনেই সদানন্দর খুব ভালো লাগলো। ভাবতে ভালো লাগলো নয়নতারা সুখী হয়েছে, নয়নতারার সংসার করার সাধ মিটেছে। যে-সংসার সদানন্দ তাকে দিতে পারেনি সেই সংসার তাকে নিখিলেশ দিয়েছে। সদানন্দর বদলে নিখিলেশ নয়নতারার সব সাধ পূর্ণ করেছে। তা করুক, যে-কেউ একজন যে নয়নতারাকে খুশী করেছে তাতেই সদানন্দ খুশী।

হাজারি বেলিফ বললে–আপনি যে কেন দাড়ি কামান না মশাই তা বলতে পারি না। ওই দাড়ি কামান না বলেই তো আপনাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি তো সেইজন্যেই সব সময়ে পোঁটলার মধ্যে দাড়ি কামাবার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে বেরুই–

এবার হঠাৎ আর একটা বিরাট লম্বা গাড়ি এল। এমব্যাসির গাড়ি। ভেতরে যিনি বসে আছেন তিনি সাহেব। আর তার পাশে তার মেমসাহেব। শুধু সেই গাড়িখানাই নয়, আরো অনেক সাহেব-মেমসাহেব এলো। সদানন্দর মনে হলো নয়নতারা তার ছেলের জন্মদিনে সত্যিই অনেক জাঁকজমকের আয়োজন করেছে। কিন্তু সেই ‘গ্রীনপার্ক’! কার টাকায় আজকের এই উৎসব? এ কি তার দেওয়া উপার্জনের টাকা! গ্রীন পার্কের টাকা যদি না হবে তবে এ বাড়িতে সেই মানদা মাসি আসবে কেন? মানদা মাসির সঙ্গে এ বাড়ির কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠবে কেন?

সমস্ত জিনিসটাই কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হলো সদানন্দর কাছে। যে-কলকাতায় এত ভিখিরি, যে কলকাতায় এত অভাব, এত অভিযোগ সে কলকাতায় ছেলের জন্মদিনের উৎসবে এত ঘটা কেন? এত অপব্যয়, এত অপচয় কেন?

এক-একটা করে গাড়ি আসছে। দারোয়ানজী সেলাম করছে গাড়ির আরোহীদের। আর দর্শকরা গেটের দু-পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির ভেতরের ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যটা আঁচ করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু এই ঐশ্বর্যের বিলাসবাহুল্য বাইরের লোকের কাছে প্রদর্শনী করবার জন্যেই কী সেদিন নয়নতারাকে অত টাকা দিয়েছিল সদানন্দ? সদানন্দ কী তার দেওয়া অর্থের এই ব্যবহারই আশা করেছিল নয়নতারার কাছে?

সঙ্গে সঙ্গে নবাবগঞ্জের সেই দূর থেকে দেখা দৃশ্যটার কথাও মনে পড়ল সদানন্দর। এ কী হলো! মানুষ মানুষ হোক এই চিন্তাই তো সে করেছিল সেদিন। কখনও তো সে বলেনি যে আমার ইচ্ছে অনুযায়ীই তোমাদের এই সমাজ চলুক। অর্থটাকে উপকরণ মাত্র হিসাবেই তো মনে করেছিল সে। চেয়েছিল সেই উপকরণ ভাঙিয়ে মানুষের জীবনধারণের সমস্যাই শুধু মিটুক। উপকরণটাই প্রধান হোক এটা তো সে চায়নি। অর্থের অভাবের জন্যে মানুষের সমস্ত সৎ প্রচেষ্টা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলেই সকলের অভিযোগ ছিল। কারো চাই বিদ্যা, কারো চাই মুক্তি কারো চাই সেবা। আবার কারো চাই জ্ঞান। এই সমস্ত কিছু অধিগত করবার জন্যেই তো চাই অর্থ! যেমন অন্ন! অন্ন তো ভক্ষণ করবার জন্যেই। অন্ন গলাধঃকরণেই তো অন্নের আসল উপযোগিতা। কিন্তু তা না করে যদি কেউ তার শরীরে অন্ন মাখে তা হলেই তো তাকে উচ্ছিষ্ট হওয়া বলে! নবাবগঞ্জে তার দেওয়া অর্থ যেমন সমস্ত গ্রামকে উচ্ছিষ্ট করেছে, নয়নতারার বাড়িতেও যে তাই! এখানেও যেন মনে হচ্ছে নয়নতারার ঐশ্বর্য নয়নতারাকে উচ্ছিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু এই-ই কী সদানন্দ চেয়েছিল?

সদানন্দ যত ভাবলো ততই তার কষ্ট হতে লাগলো।

হাজারি বেলিফ বললে–কী ভাবছে মশাই? চলুন চলুন, দেখা তো হলো, এবার চলুন, চলে যাই–

সদানন্দ বললে–কিন্তু নয়নতারার সঙ্গে দেখা না করে যাই কী করে?

–কিন্তু দারোয়ান তো আমাদের ঢুকতে দেবে না। দেখছেন না কলকাতার সব বড় বড় লোক আসছে, এখানে আমাদের মত গরীব লোকদের ঢুকতে দেবে কেন? আপনি তো আবার দাড়িটাও কামাননি–

সদানন্দ বললে–তা হোক, তবু আমি ঢুকবো, নয়নতারার সঙ্গে দেখা না করে আমি যাবোই না।

–কিন্তু যদি ঢুকতে না দেয়?

সদানন্দ বললে–আপনি আমার পেছন পেছন থাকুন, আমি যেমন করে হোক ভেতরে ঢুকবোই। আমার নাম শুনলে নয়নতারা কিছুতেই আপত্তি করবে না, একবারের জন্যে সে দেখা করবেই।

হাজারি বললে–তা হলে ওই দিকের গেটে চলুন–ওই দিকটা দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করি একটু–

বলে হাজারি বেলিফ সামনে এগিয়ে গেল।

.

নবাবগঞ্জে তখনও বারোয়ারিতলার নিতাই হালদারের দোকানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বহুদিন আগে ওইখানে মাচার ওপর বসে একদিন সবাই দল বেঁধে তাস খেলেছে। কিন্তু এখন তাদের বয়েস হয়েছে। সে-যুগের মানুষ তারা, আজকের নতুন যুগের মানুষের কাছে তারা একেবারে অচেনা। এই পনেরো বছরে যারা নবাবগঞ্জে জন্মেছে তাদের অতীতও নেই, বর্তমানও নেই, হয়ত ভবিষ্যৎ নেই তাদের। কিন্তু তারা দেখছে যাদের হাতে তাদের মানুষ হবার ভার পড়েছে তারা নির্বিকার। নিয়ম করে মাইনে না পেলেই তারা মিছিল করে। তারা আকাশে ডান হাতের ঘুষি তুলে স্লোগান দেয়। আর যখন সকালবেলা স্কুলে কলেজে যায় তখন সেখানে তাদের পড়াবার বোঝাবার লোক কেউ নেই। আর তারপর যেদিন পরীক্ষায় বসে সেদিন অসহায় হয়ে পাশে বসা বন্ধুর খাতার দিকে চেয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার অক্ষম চেষ্টা করে।

কিন্তু কে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবে?

মানুষের ইতিহাসে এক-একটা যুগ যখন সমাজ-সংসারের প্রত্যেকটি মানুষ নিজেকে প্রবঞ্চনা করেই বুঝি একটা অদ্ভুত আত্মপ্রসাদ লাভ করে। আর সেই প্রবঞ্চনার প্রতিযোগিতায় হেরে গেলেই তখন সবাই অত্মহননের পথ ধরে। এ-যুগটাও বোধ হয় তেমনি। প্রবঞ্চনা করতে করতে যখন ধরা পড়ে যাবার উপক্রম হয় তখন হাতের কাছে নিজের থালা বাসনটাও ভেঙে চুরমার করে দিয়ে মানুষ তার অভাবের ক্ষোভ মেটায়। জিনিস কম পড়লেই তো ফাঁকিতে সেটা পূরণ করতে ইচ্ছে হয়। এখানেও তাই হয়েছে। এই ফাঁকির কারবারে কেউ আর এখন কারো চেয়ে কম যায় না। নবাবগঞ্জের মানুষ এখন ফাঁকির প্রতিযোগিতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। কলেজে পড়লেই যদি পাস করে বিদ্বান হওয়া যায় তো পাসই করবো। আর পাস করলেই যদি চাকরি পাওয়া যায় তো তাই-ই করবো। সোজা পথে পাস না করতে পারি তো ফাঁকি দিয়ে টুকে পাস করবো।

সূত্রপাতটা এখানেই হয়েছিল। তার পরে এরই ছোঁয়াচ লাগলো হাসপাতালে। রোগীদের ওষুধ দিলে তো ডাক্তারদের কিছু লাভ নেই, অথচ সেই ওষুধ বাইরে বেচলে বরং নগদ লাভ। পনেরো বছর আগে যখন নবাবগঞ্জে প্রথম হাসপাতাল শুরু হলো তখন যা ছিল আশীর্বাদ তাই-ই এখন হয়ে উঠেছে অভিশাপ!

এই অভিশাপই সেদিন হঠাৎ বুঝি বারুদ হয়ে ফেটে উঠলো।

কোথা থেকে যে দল বেঁধে কারা সব লুকিয়ে লুকিয়ে এসে জড়ো হয়েছিল তা আগে কেউ জানতে পারেনি। যখন জানলো তখন সেই অভিশাপের আগুন স্কুল আর কলেজ বাড়ি থেকে ছড়িয়ে একেবারে হাসপাতাল বাড়িতে গিয়ে ঠেকেছে। নবাবগঞ্জ যখন পুড়ে ছারখার হচ্ছে তখন দশ ক্রোশ দূরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তার বউকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গেছে। কিন্তু হাতের কাছে ছিল চৌকিদার। তার ওপরে ছিল পাঁচ ক্রোশ দূরের থানা। থানা থেকে ডি এস পি, তারপর ডি এস পি থেকে এস পি।

বারোয়ারিতলায় তখন হাট বসেছিল। কলকাতা থেকে ভেণ্ডার এসেছিল দলে-দলে। তারা রেলবাজারের ইস্টিশানে নেমে যথানিয়মে সোজা চলে এসেছে নবাবগঞ্জে। নবাবগঞ্জ থেকে পাঁচ-সিকে দরের ঢ্যাঁড়স কিনে নিয়ে গিয়ে কোলে মার্কেটে আড়াই টাকা দরে বেচবে। শুধু ঢ্যাঁড়সই নয়, কুমড়ো, বেগুন, ডাঁটা, লাউ সব কিছু এখান থেকে চলে গিয়ে উঠবে শহরের বাজারে। তখন হাটও চলছিল বেশ। কিন্তু হঠাৎ হই-চই-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। আগুনের ধোঁয়া এসে নাকে লাগলো সকলের। যে-যার বাড়ি থেকে বাইরে ছুটে এল। কী হয়েছে গো? কী হয়েছে এখানে?

বেহারি পাল তখন আরো বুড়ো হয়ে গেছে। বুড়ো মানুষ চোখে ভালো দেখতে পায় না। তাড়াতাড়ি আবার দোকানে ফিরে গেল। বললে–দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দাও কৈলাস, ইস্কুলবাড়িতে আগুন লেগেছে–

যেন দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করলেই আগুনকে ঠেকানো যাবে।

কিন্তু খানিক পরেই আবার খবর এল হাসপাতালে আগুন লেগেছে। তা হলে কী হবে? ও কৈলাস, ও পরমেশ, ও দীনু–

যার আছে তারই ভাবনা। যার নেই তার ভাবনাও নেই। বেহারি পালের অবস্থা তখন আরো ভালো। ছেলে নেই, মেয়ে নেই, শুধু বুড়ো আর বুড়ি। তার বাড়িটার সামনেই হাসপাতালটা। অত বড় চৌধুরীদের বাড়িটা তখন হাসপাতালে পরিণত হয়েছিল। এককালে কত জমজমাট ছিল ওই বাড়ি। শেষকালে হাসপাতাল হবার পর থেকে আরো জমজমাট হয়েছিল জায়গাটা।

কৈলাস দোকান বন্ধ করে দিয়ে বললে–আমিও একবার বাড়ির দিকে যাই পাল মশাই, আমার বাড়ির খড়ের চাল–

তা খড়ের চাল তো সকলেরই। পাকা বাড়িই যদি আগুনে পুড়তে পারে তো খড়ের চাল তো এক মিনিটের তোয়াক্কা।

ভেণ্ডাররা তখন খালি ঝাঁকা নিকে পালাতে অরম্ভ করেছে। পরমেশ মৌলিকও আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভরসা পেলে না। আগুনটা যে কোন্ দিকে মোড় ঘুরবে তা বলা যাচ্ছে না। যতক্ষণ বেলা ছিল ততক্ষণ তবু এদিকে-ওদিকে চোখে দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু তারপর অন্ধকার নেমে আসতেই সব ঝাপসা। আগুনের হলকার দাপটে কাছের মানুষকেও তখন যেন বীভৎস মনে হয়, ভয় করে।

ডাক্তারবাবু তখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে সাইকেল নিয়ে।

বেহারি পাল দূর থেকে দেখেই চিনতে পেরেছে। চিৎকার করে ডাকলে–ও ডাক্তারবাবু, কোথায় চললেন?

ডাক্তারবাবু শহরের মানুষ। এখানে পয়সা উপায় করবার জন্যে চাকরি নিয়েছিল। কিন্তু ফ্যামিলি ছিল শহরে। সেখান থেকে সাইকেলে রোজ যাতায়াত করতো। তখন বিপদ দেখে আবার সাইকেলে চেপে শহরের দিকে রওনা দিলে। বললে–আপনারাও পালান পাল মশাই, বাঁচতে চান তো পালান–

বেহারি পাল বললে–কিন্তু আমার যে বাড়ি এখানে ডাক্তারবাবু, আমি কোথায় পালাবো–

কিন্তু সে কথা আর কে শোনে! আর কেই বা তার উত্তর দেয়! কিম্বা হয়ত ডাক্তার বাবু একটা কিছু উত্তর দিলে, কিন্তু তা আর কারো কানে গেল না।

আর শুধু কি ডাক্তারবাবু, যারা ইস্কুল কলেজের মাস্টার তারাও তখন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে।

তাদেরও একজনকে চিনতে পারলে বেহারি পাল। বললে–ও তারক, তারক, আগুন কে লাগালে?

তারক মাস্টার যত না ইস্কুলে পড়ায় তার চেয়ে প্রাইভেটে ছেলে পড়ায় বেশি। এক একটা ছেলেকে পাস করাতে একশো টাকা করে রেট করে দিয়েছে। তার কোচিং ইস্কুলে পড়লে সবাই পাস।

সেও ছুটছে। বললে–নকশাল–

–নকশাল মানে?

মানে আর বলা হলো না। তারক মাস্টার তখন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই তারক মাস্টার কোচিং স্কুল করে আশি বিঘে জমি, বউ-এর পঞ্চাশ ভরি সোনার গয়না, আর দোতলা পাকা বাড়ি করে ফেলেছিল নবাবগঞ্জে।

কিন্তু ওদিক থেকে কারা যেন দৌড়তে দৌড়তে ছুটে আসছে। রাত্রের অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মত তাদের গতিবিধি। ওদিক থেকে এদিকে যায় আবার এদিক থেকে ওদিকে। বেহারি পাল একবার বাড়ির ভেতরে যায় আর আর-একবার বাইরে আসে। তার পাটের আড়তে যদি একবার আগুন লাগে তা হলে কী হবে!

গিন্নী ভালো করে চোখে দেখতে পায় না। কাছে এসে বললে–ওগো, দাঁড়িয়ে কী দেখছে, পুড়ে মরবে নাকি?

বেহারি পাল মশাই বললে–দশ হাজার টাকার পাট রয়েছে যে আড়তে, সেটার কী হবে?

গিন্নী বললে–তা তোমার পাট আগে না জীবন আগে?

বেহারি পাল মশাই বললে–তা হলে চলো–

–হ্যাঁ চলো, সদা যে আমাদের এমন সব্বোনাশ করবে তা কে জানতো! কে যে ওকে ইস্কুল-হাসপাতাল করতে বলেছিল এখেনে কে জানে, আমি তখনই জানতুম কাজটা ও ভালো করলে না–এ দেশের লোকের ভালো করবার জন্যে কে ওকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল!

–পালান, পালান, সি আর পি আসছে, সি আর পি আসছে, সি আর পি আসছে–

বলতে বলতে কার যেন তীরের মত অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিশ ক্রোশ দূরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যখন খবর গেল তখন নবাবগঞ্জের যা সর্বনাশ হবার তা হয়ে গেছে। সিনেমা দেখে বাড়িতে আসবার আগেই অনেকবার খোঁজাখুঁজি পড়েছে। কেউ জানে না কোথায় গেছেন তিনি। এস পি অনেকবার টেলিফোন করেছে।

–নবাবগঞ্জ? সে কোথায়?

এস পি বললে–সে এখান থেকে বিশ ক্রোশ দূরে। কলকাতা থেকে আরো পুলিস ফোর্স আনতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় টেলিফোন করা হলো। চিফ-মিনিস্টার মিস্টার সেন তখন রাইটার্স বিল্ডিং-এ কাজ সেরে উঠে পড়েছেন। এমন সময় টেলিফোন এল। টেলিফোন ধরেছে পি-এ।

পি-এ বললে–এখন তো তিনি বাইরে যাচ্ছেন কাল দিনের বেলা রিং করবেন–

ম্যাজিস্ট্রেট বললেন কিন্তু খুব আর্জেন্ট দরকার, এখনি সি আর পি পাঠাতে হবে নবাবগঞ্জে–সমস্ত নবাবগঞ্জ জ্বলছে। সবাই বাড়ি ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে–

শেষ পর্যন্ত মিস্টার সেন টেলিফোন ধরলেন। বললেন হঠাৎ আগুন লাগাবার কারণটাই বা কী?

ম্যাজিস্ট্রেট বললেন কারণ আমি নিজে স্পটে গিয়ে ইনভেস্টিগেট করছি। তার আগে আমার এখুনি সি আর পি ফোর্স চাই। লোকাল পুলিস পাঠানো হয়েছে, কিন্তু মনে হচ্ছে না তার কিছু করতে পারবে–

মিস্টার সেন বললেন–ঠিক আছে, আমি অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি, আপনি আজ রাত্রের মধ্যেই রিপোর্ট দেবেন, যত রাতই হোক–

বলে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন। তারপর পি-একে বললেন–আমি একবার থিয়েটার রোডে যাচ্ছি। মিসেস ব্যানার্জির বাড়িতে। টেলিফোন এলে আমাকে সেখানে রিং করবেন–

বলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

.

থিয়েটার রোডের মিসেস ব্যানার্জির বাড়িতে যখন মিস্টার সেন পৌঁছলেন তখন সেখানে অনেকেই পৌঁছে গেছে। উপলক্ষটা যা-ই হোক, সামাজিক মেলা-মেশাটাই হলো আসল। আর এই সব মেলামেশাতেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। এমনি করেই এই শহরের আরো অনেক লোক ক্ষমতার স্বর্গে উঠে চিরস্মরণীয় হয়ে উঠেছে। এমনি করেই সে-যুগে কেউ রায়সাহেব হয়েছে, কেউ বা রায়বাহাদুর হয়েছে। আর একবার ওসব হলে সে-গৌরব বংশানুক্রমিক ভাবে তোমার উত্তরাধিকারীদের ওপরেও বর্তাবে। অবশ্য সেই ব্রিটিশ আমল এখন আর নেই। না থাক, তাতে কোনও ক্ষতিও হয়নি। আমরা আমাদের নিজেদের জন্যে মানুষের সেই স্তর-বিভাগ এখনও বজায় রেখেছি। আমরা গণতন্ত্রের উপাসক হয়েও মানুষে-মানুষে বৈষম্যকে অস্বীকার করিনি। রায়সাহেব রায়বাহাদুরের বদলে আমরা পদ্মশ্রী-পদ্মভূষণ প্রবর্তন করেছি। কিন্তু সেই বৈষম্যের বেড়াজাল ভেদ করে সকলের মাথায় ওঠা কি সোজা? সেই জন্যেই তো আমি এখানে বাড়ি করেছি, এই থিয়েটার রোডে। যাতে তোমরা আমাকে নিজের স্তরে প্রমোশন দাও। আর সেই জন্যেই তো নৈহাটির মধ্যবিত্ত পরিবেশ ছেড়ে এখানে এলুম। এখানে না এলে কি তোমরাই আমার পার্টিতে আসতে? নইলে তো টালিগঞ্জ-যাদবপুর-শ্যামবাজার বাগবাজারের মত সাধারণ মানুষরাও তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের জন্মদিনের পার্টিতে সেখানে তোমাদের নেমন্তন্ন করতো। তখন?

মালা বোস তখন থেকেই আছে। বলতে গেলে নয়নতারার উত্থানের ইতিহাসের শুরু থেকেই। সেও আজ এসেছে। একদিন একসঙ্গে এক অফিসে পাশাপাশি বসে চাকরি করেছে। নয়নতারার যখন এ-পাড়ায় বসতি শুরু তখন থেকেই যাতায়াত। এই এখানে বাড়ি করার সময়েও অনেক দিন এসেছে। বাড়ির প্ল্যান থেকে শুরু করে গৃহ-প্রবেশ আর তারপর নয়নদির এই সন্তান হওয়া–সবই সে দেখেছে। তারপর এখানে যতবার পার্টি হয়েছে ততবার মালাকেও নেমন্তন্ন করেছে নয়নতারা। আর মালাও প্রত্যেকবার এসে কয়েকখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছে। মালার বড় শখ শহরের গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করা। এক-একজন গণ্যমান্য লোকের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। আর সে কৃতার্থ হয়ে গেছে। তার সব চেয়ে বেশী লোভ মিনিস্টারদের সঙ্গে পরিচয় করতে।

–তুই একটা গান গা ভাই!

–গান?

গান মালা গায় বটে, কিন্তু আজকের মত এত বড় পার্টিতে গান গাওয়া সোজা নাকি? মালার কেমন ভয় করছিল। কদিন থেকেই জিজ্ঞেস করছিল–কে কে আসবে?

নয়নতারা বলেছিল–সবাই আসবে–

–সবাই মানে? যারা বরাবর আসে?

নয়নতারা বলেছিলনা, এবার ফরেন এমব্যাসির লোকদের নেমন্তন্ন করেছি। মিস্টার হেন্‌ডারসন আসছে, মিস্টার নবিকভ্‌ আসছে–

–আর!

–আর মিস্টার সেন—

–মিস্টার সেন কে?

–আমাদের চিফ-মিনিস্টার!

–সত্যি বলছো তুমি?

–সত্যি বলছি না কি মিথ্যে বলছি? সবাই জোড়ায়-জোড়ায় আসবে, দেখিস। এবারও ককটেল। এবার ভালো ড্রিঙ্কস-এর ব্যবস্থা আছে–

মালা বলেছিল–আমি ওসব খাবো না নয়নদি, আমার বড় মাথা গুলোয়।

নয়নতারা বলেছিল–প্রথম প্রথম একটু ওরকম সকলেরই হয়, প্রথম-প্রথম আমারও হতো, দু-চার দিন খেলেই দেখবি তখন কেমন ভালো লাগবে।

–কিন্তু সবাই দেখতে পাবে যে!

–কেউ দেখতে পাবে না। আমি তো কোল্ড ড্রিঙ্ক-এর সঙ্গে একটু করে জিন মিশিয়ে দেব। সবাই ভাববে তুই কোল্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছিস–

নয়নতারার পার্টিতে বরাবরই সেই নিয়ম। মেয়েরা সফট ড্রিঙ্ক খায়, কিন্তু তার সঙ্গে একটু জিন মেশানো থাকে। যখন পার্টি শেষ হয় তখন বাড়িতে ফিরে গিয়ে বড় শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। তখন মনে হয় কালকের সন্ধ্যেটা বড় আনন্দে কেটেছে।

মালা সেদিনও এসেছিল। স্বামী মিস্টার বোসও এসেছিল। এতগুলো ভি আই পি এখানে আসবে, এ সুযোগ ছাড়বার নয়। এতে তাদের বোর্ডিং হাউসেরও ইজ্জৎ বাড়বে। কলকাতা শহরে ব্যবসা করতে গেলে কত রকম বিপদ-আপদ আসে। তা কি বলা যায়? তখন পরিচয়ের জের টেনে অনেক সুবিধে আদায় করা চলে।

হঠাৎ মিস্টার সেন এসে গেলেন। ওয়েস্ট বেঙ্গলের চিফ-মিনিস্টার। গাড়ি থেকে নামার সময় থেকেই হাতজোড় করে নমস্কারের পালা শুরু হয়েছিল। একেবারে সেই দারোয়ান থেকে শুরু করে বেয়ারা, বাবুর্চি ডিঙিয়ে শেষ-মেশ গৃহস্বামী পর্যন্ত।

–নমস্কার-নমস্কার-নমস্কার—

মিসেস ব্যানার্জি ছিল একেবারে দোতলার হলঘরে। তখন মালা বোস গান ধরে দিয়েছে। গলা কেঁপে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার যোগাড়। কী যে গাইবে তা-ই ঠিক করতে পারছিল না। নয়নতারা বললে–গা না তুই, যে কোনও একটা গান–

–রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবো? কাল একটা নতুন রবীন্দ্রসংগীত শিখেছি নয়নদি–

–বেশ তো, তা গা না। রবীন্দ্র সংগীত তো সাহেবরা খুব পছন্দ করে। টেগোর-সঙ্‌ বললে–সাত খুন মাপ–গা তুই, আরম্ভ করে দে–

হারমোনিয়ামটা সে তার নিজের বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছিল। গান গাওয়া তো তেমন অভ্যেস নেই। তবু সময় পেলেই মাঝে মাঝে প্যাঁ-পোঁ করেছে।

মালা গাইতে লাগল–

ও নিঠুর, আরো কী বাণ তোমার তুণে আছে—

মালার স্বামী যেন কেমন বিব্রত বোধ করলে। এ কী গান আরম্ভ করলে মালা! মিসেস ব্যানার্জি পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকেই বললে–এ কী গান আরম্ভ করলে মালা, আজকে আপনার ছেলের জন্মদিন, আনন্দের দিন…অন্য গান গাইতে বলুন ওকে মিসেস ব্যানার্জি–

মিসেস ব্যানার্জি বললে–তাতে কী হয়েছে মিস্টার বোস! এও তো টেগোর-সঙ– মালা তখন চোখ বুঁজিয়ে গাইছে–

ও নিঠুর, আরো কী বাণ তোমার তুণে আছে
তুমি মর্মে আমায় হিয়ার কাছে।

মিস্টার হেন্‌ডারসন আর মিসেস লেন্ডারসন গায়িকার দিকে চেয়ে গান শুনছিলেন। দুজনের হাতেই গেলাস। মিসেস ব্যানার্জির নজর পড়লো সেদিকে। দেখলে গ্লাস খালি। সঙ্গে সঙ্গে কাছে গিয়ে বেয়ারার কাছ থেকে দুটো গ্লাস নিয়ে তাদের দিলে।

মিসেস হেন্‌ডারসন হেসে গেলাসটা নিলে।

বললে–টেগোর-সঙ

–হ্যাঁ, কেমন লাগছে আপনার?

–ভেরি গুড।

বলে আবার গায়িকার দিকে ফিরে গান শুনতে লাগলো।

মালা বোস উৎসাহ পেয়ে তখন গেয়ে চলেছে–

আমি পালিয়ে থাকি মুদি আঁখি
আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি–

–এ কী মিসেস নবিকভ, আপনার গ্লাস খালি যেন? নিন আর একটা নিন—

মিস্টার আর মিসেস নভিকভ্‌ দুজনেই আবার গ্লাস নিলেন। দুজনেই গান শুনছিলেন একমনে। আর শুধু কি তারা? সকলের দিকেই নজর দিতে হচ্ছে নয়নতারাকে। মিস্টার ব্যানার্জি আজকে এই উৎসবের হোস্ট। তারও নজর সব দিকে। মিস্টার আর মিসেস সামন্তও এসেছেন। এই আগের রাত্রেই এ বাড়িতে এসে তিনি যে তিন হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে গেছেন তার ক্ষীণতম চিহ্নটুকু পর্যন্তও আজ আর তার মুখে নেই। বড় আনন্দ পাচ্ছেন গান শুনে।

হঠাৎ মিস্টার আর মিসেস সেন ঘরে ঢুকতেই মিসেস ব্যানার্জি এগিয়ে গেল।

বললে–নমস্কার, নমস্কার! এত দেরি হলো যে আপনার?

সস্ত্রীক অ্যামব্যাসাডাররাও এগিয়ে এলেন। সবার লক্ষ্য তখন তাদের দুজনের দিকে। এতক্ষণ যে-গান শোনবার জন্যে তাদের মনোযোগের শেষ ছিল না, এখন মিস্টার সেনের আবির্ভাবে যে তাদের সব ধ্যান ছারখার হয়ে গেল।

সবারই ওই এক প্রশ্ন–এত দেরি হলো যে?

মিস্টার সেন সকলকেই ওই এক উত্তর দিলেন-হঠাৎ একটা ট্রাঙ্ক কল এসেছিল–

ট্রাঙ্ককল! মিসেস ব্যানার্জি একটা বেয়ারাকে একেবারে সঙ্গে করে ধরে এনেছে। সামনে তার ট্রে ধরা। তাতে সার সার গেলাস সাজানো। আর একজনের ট্রে-তে স্ন্যাক্স।

–নিন মিসেস সেন–নিন—

মিস্টার সামন্ত এগিয়ে এলেন। তাকে দেখেই মিস্টার সেন একটু পাশে সরে দাঁড়ালেন। গলাটা নামিয়ে মিস্টার সেন বললেন–নদীয়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এখুনি টেলিফোন করেছিলেন–

তারপরে দুজনে কী কথা হলো কে জানে! সে-সব কেউ শুনতে পেলে না। কিন্তু সে বেশিক্ষণ নয়। অন্যদিকে মিসেস ব্যানার্জির ব্যস্ততা তখন আরো বেড়ে গিয়েছে। একবার একজনের কাছে যায়, আবার সেখান থেকে আর একজনের কাছে গিয়ে হাজির হয়। সব দিকে তার নজর রাখতে হবে। এই যে আজ তার বাড়িতে এত অতিথি, এত মান্যগণ্য অভ্যাগত, এ সবই মিসেস ব্যানার্জির বহুদিনের কলা-কৌশলের ফল। আর পনেরো বছরের অক্লান্ত সাধনায় ইজ্জতের এই শিখরে এসে উঠেছে সে। এককালে অনেক লাঞ্ছনা অনেক গঞ্জনা তাকে মাথা পেতে সহ্য করতে হয়েছে। নবাবগঞ্জের শ্বশুরবাড়িতে তার অপমানের শেষ ছিল না। আজ এতদিন পরে তার প্রতিশোধ নিতে পেরেছে সে, এ কী তার কম গৌরব! সেদিনকার সব লাঞ্ছনার যন্ত্রণা যে সে আজকের ককটেলের প্রলেপ দিয়ে মুছে দিতে পেরেছে, এইটুকুই কী কম! আজকে তাকে দেখে কে বলবে এই নয়নতারাই সেদিনকার সেই অসহায় নয়নতারা! যেদিন নবাবগঞ্জে তার শ্বশুরবাড়ির সমস্ত প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে তাদের মুখের ওপর দিয়ে সে মাথা উঁচু করে সদম্ভে চলে আসতে পেরেছিল, সেদিন কী কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল যে আবার একদিন মিসেস ব্যানার্জি হয়ে তার এই থিয়েটার রোডের বাড়িতে সে ককটেল পার্টি দিতে পারবে! আজকের এরা এই গণ্যমান্য অতিথিরা সেদিনকার নয়নতারাকে দেখেনি। দেখলেও হয়ত চিনতে পারতো না। কিম্বা যে নয়নতারা নৈহাটি স্টেশন থেকে পায়ে চটি গলিয়ে ডেলি-পাসেঞ্জারি করতো তাকেও তো এখন এখানে দেখলে কেউ চিনতে পারবে না। কিন্তু এও তো তার একদিনে হয়নি। এখানে উঠতেই কী তাকে কম অধ্যবসায় করতে হয়েছে। এর পেছনে কত অপব্যয়, কত তোষামোদের খেসারত দিতে হয়েছে তাকে তা এরা কেউ জানে না। আর জানে না বলেই আজ তার সব কৃচ্ছ্রসাধন সার্থক, সব প্রতারণা সুন্দর। আজ কলকাতার অভিজাত সমাজে তাই মিসেস ব্যানার্জীর এত মর্যাদা!

মালা বোস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লাইনগুলো তখন আবার গাইছে–

আমি পালিয়ে থাকি মুদি আঁখি
আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি
কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে
ও নিঠুর, আরো কী বাণ তোমার তুণে আছে—

মানদা মাসি এবার মিসেস ব্যানার্জির পাশে এসে দাঁড়ালো। বললে–দিদি তোমাকে একবার বাইরে কে ডাকছে–

–আমাকে? ডাকছে? কে ডাকছে? কোথায়?

–ওই যে আবদুল বলছে—

–কোথায় আবদুল? আবদুলকে আমার কাছে ডাকো তো!

মানদা মাসি গিয়ে বলতেই আবদুল এল। বললে–মধু বলছিল মেমসায়েবকে একজন কে ডাকছে–

–আমাকে ডাকছে? কে? নাম কী? আমাকে কী করতে ডাকছে? তুই মধুকে ডাক। মধুকে ডেকে দে আমার কাছে–

মিসেস ব্যানার্জি আবার তখন অন্যদিকে ছুটে গেছে। মিসেস সামন্ত একলা-একলা দাঁড়িয়ে আছে। একলা থাকা ভালো নয়। মিসেস সামন্তর কাছে গিয়ে বললে–একলা দাঁড়িয়ে আছেন কেন, আসুন, আসুন–

বলে তাকে একদল মেয়ের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলে সকলের সঙ্গে। এই হচ্ছে মিসেস সামন্ত আর এই হচ্ছে মিসেস সিনহা, ইনি মিসেস দীক্‌শিত ইনি হচ্ছেন…

তারপর পাশের দিকে চেয়ে বললে–এই যে মিস্টার সামন্ত, আপনি সব পাচ্ছেন তো ঠিক? টিকিয়া কাবাব নিয়েছেন?

–নিয়েছি নিয়েছি, খুব ভালো হয়েছে—

–প্লিজ চেয়ে চেয়ে নেবেন, আমি একলা সব দিকে দেখতে পাচ্ছি না—

.

আর ওদিকে তখন পেছনের সিঁড়ি দিয়ে সদানন্দ ওপরে উঠছে। সঙ্গে হাজারি বেলিফ। সিঁড়ি দিয়ে ওপর থেকেও কেউ-কেউ নিচেয় নামছে। সকলেরই ব্যস্ততা। কারো দিকে কারো চেয়ে দেখবার সময় নেই। অসংখ্য লোক এসেছে বাড়িতে আর অসংখ্য তাদের অনুচর। অনুচরদের অবশ্য বাইরের রাস্তায় গাড়িতে বসে থাকবার কথা। কিন্তু তাদের মধ্যে কারো কারো ভেতরে আসবারও দরকার হয়। তাদেরই একজনকে ডাকলে সদানন্দ। বললে–হ্যাঁ ভাই, ওপরে ব্যানার্জি সাহেবের বউকে একবার ডেকে দিতে পারো?

–মেমসায়েব?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, মেমসাহেব।

লোকটা বললে–ওই ওপরে মধুকে গিয়ে বলুন–

মধু! মধু আবার কে? কিন্তু সে-সব কথা শোনবার সময় নেই তখন বেয়ারাটার। তার কাজ আছে অনেক। থিয়েটার রোডের বাড়ির বেয়ারাদের কারো বাজে কথা বলবার সময়ই নেই। সে যেমন সিঁড়ি দিয়ে নামছিল তেমনি নেমে চলে গেল।

ওপরে তখন আরো অচেনা লোকের আনাগোনা। সদানন্দ চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো। এ কী সাজ-সরঞ্জাম নয়নতারার বাড়ির! জীবনে সদানন্দ এমন সাজানো বাড়ি দেখেনি। নয়নতারার সেই নৈহাটির ভাড়াটে বাড়ির চেহারাটাও মনে পড়লো। সে বাড়ি আর এবাড়ি! এ কী মেঝে, এ কী দেয়াল, এ কী আলো!

সদানন্দ আর একজনকে ধরলো। বললে–-শোন, তোমাদের মেমসাহেবকে একবার ডেকে দিতে পারো?

–মেমসাহেব? ডেকে দিচ্ছি–

–তোমার নাম কি মধু?

বেয়ারাটা বললে–না, আমি মধুকে বলে দিচ্ছি–

বলে কোথায় উধাও হয়ে গেল এক নিমেষে। সদানন্দ বুঝতে পারলে সত্যিই এবাড়ির সবাই ব্যস্ত। নয়নতারার ছেলের আজ জন্মদিন। সদানন্দও নয়নতারার ছেলেকে আশীর্বাদ করবে। এত লোক এসেছে নয়নতারার ছেলেকে আশীর্বাদ করতে আর সদানন্দই বা কেন বাদ পড়ে যাবে?

কিন্তু কোথায় কী? কেউ আর মেমসাহেবকে খবর দিলে না। সত্যিই তো, খবর দিলেই বা কী! নয়নতারা নিজেও তো ব্যস্ত এত লোককে সে আজ নেমন্তন্ন করেছে। তাদের দিকেই তো আগে নজর দিতে হবে তাকে! সদানন্দ তো আজ এখানে অনাহূত। সদানন্দ তো আজ এখানে অনাবশ্যক!

বারান্দাটা পেরিয়ে একটু উত্তর দিকে যেতেই অনেক লোকের গলার শব্দ কানে আসতে লাগালো। কেউ যেন ভেতরে মেয়েলি-গলায় গান গাইছে গানের কথাগুলো অস্পষ্ট কানে আসতে লাগলো।

আমি পালিয়ে থাকি মুদি আঁখি
আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি
কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে।

সামনেই একটা বিরাট হলঘর। লোকজনের জটলা সেখানেই। সদানন্দ আস্তে আস্তে একটা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কাচবন্ধ জানলা। কিন্তু কাচের ভেতর দিয়ে সদানন্দ উঁকি দিয়ে দেখলে। এত লোক! সকলের হাতেই গ্লাস। কী যেন খাচ্ছে সবাই। মাঝে-মাঝে সবাই-ই গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। হয়ত মদই হবে, কিম্বা হয়ত মদ নয়। হঠাৎ নজর পড়ে গেল নয়নতারার ওপর। অনেক দিন পরে দেখলে তাকে। পনেরো বছর পরে! কিন্তু কই, নয়নতারা তো এই পনেরা বছর পরেও একটুকু বদলায়নি। যেন বয়েস আরো অনেক কমে গেছে তার! আর কত সেজেছে! নড়ছে-চড়ছে, সকলের সঙ্গে ঘুরে কথা বলছে আর কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচলটা খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। শুধু তার শাড়ি নয়, নিজেকেও যেন আর সামলাতে পারছে না সে। তবে কি নয়নতারাও ওদের মত মদ খেয়েছে নাকি!

হঠাৎ দেখলে সেই মানদা মাসি! গাড়িতে করে ঢুকতে দেখেছিল যাকে। সেই মানদা মাসি কী যেন বললে নয়নতারাকে। কথাটা শুনেই নয়নতারা ঘুরে দাঁড়ালো। বললে– আমাকে? ডাকছে? কে ডাকছে? কোথায়?

–ওই যে আবদুল বলছে।

–কোথায় আবদুল? ডাকো তো আমার কাছে—

কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলবার কি সময় আছে নয়নতারার! কথাটা বলতে বলতে আবার অন্য দিকে চলে গেল। সদানন্দ হঠাৎ সেই সমরজিৎবাবুর ছেলে সুশীল সামন্তকে দেখতে পেলে, সেই মহেশ যাকে বড়দাদাবাবু বলতো। আর তার দিকে একটা ছোট বেদীর ওপরে বসে গান গাইছে এক মহিলা–

মারকে তোমার ভয় করেছি বলে
তাইতো এমন হৃদয় ওঠে জ্বলে—

ভেতরে তখন নিখিলেশ দৌড়তে দৌড়তে মিস্টার সেনের কাছে এসেছে।

–আপনার টেলিফোন মিস্টার সেন!

–টেলিফোন! চিফ-মিনিস্টারের ভাব দেখেই বোঝা গেল তিনি যেন এই টেলি-ফোনটার জন্যেই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। নদীয়ার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কথা দিয়েছিল রিপোর্ট দেবে। সি আর পি এতক্ষণে পাঠানো হয়েছে নিশ্চয়ই। মিস্টার সেন হাতের ঘড়িটা দেখলেন। যেতে আর কতক্ষণ লাগবে! বড় জোর দু’ঘণ্টা।

–হ্যালো।

ওদিকে তখন আগুনের শিখায় আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। লোক্যাল পুলিস গিয়েছিল কিন্তু তারা কিছু করতে না পেরে ফিরে চলে এসেছে। নিতাই হালদার দোকানের জিনিসপত্র কিছুই বার করতে পারেনি। একদিন কত আড্ডা দিয়েছে সবাই ওই দোকানের মাচার ওপর বসে আজ সেই আগুনের হলকা লেগে সেটাও মড় মড় করে ভেঙে পড়লো! হঠাৎ সেই মড় মড় শব্দ শুনে যেন কারা গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলো হো-হো করে। যেন তাদের বড় আনন্দ হয়েছে। গ্রামের লোকের যদি সর্বনাশ হয় তো কাদের এত আনন্দ! তারা কারা? কারা এত হাসছে! সমস্ত সর্বনাশ ছাপিয়ে কাদের উল্লাসের ধ্বনি এমন করে সমস্ত অঞ্চল। এত উচ্চকিত করছে। কে! কে ওরা?

অন্ধকারের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে যারা এতক্ষণ ছোটাছুটি করছিল, রাত বাড়তেই তারা আবার বুক ফুলিয়ে সকলের সামনে দাপাদাপি করতে শুরু করেছে। এতদিন আমরা অনেক অনেক সহ্য করেছি। একদিন কর্তাবাবুদের ভয়ে মাথা তুলতে পারিনি আমরা। এক কথায় আমরা বাড়ি-ঘর-জমি-খামার সব ছেড়ে রাস্তায় গিয়ে বসেছি, আমরা গলায় দড়ি দিয়েছি, পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। বংশী ঢালীর কুড়ুল আমাদের মাথায় পড়েছে। আমরা তবু সব মুখ বুঁজে সহ্য করেছি। এবার পাশার দান উলটে গেছে। এবার আমরা বেঁচে উঠেছি। যে গ্রামে একদিন কেউ আমাদের দিকে এতটুকু সহানুভূতি দেখায়নি, আমাদের চোখের জলে কারোর বুক ভেজেনি, কর্তাবাবুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটা কড়ে আঙুল উঁচিয়েও কেউ প্রতিবাদ জানায়নি, আজ সেই গ্রামের সকলকেই তার সমস্ত প্রতিশোধ সুদে আসলে মাথায় তুলে নিতে হবে। শুধু এ-গ্রামের নয়। এ-গ্রামের পাশের গ্রাম, তার পাশের পাশের গ্রাম, তারপরে সারা বাঙলা দেশ অতিক্রম করে সারা পৃথিবী জুড়ে আমরা আমাদের কর্তাবাবুদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেব।

বেহারি পালের সামনে দিয়েই কারা যেন তখন দৌড়ে যাচ্ছিল। বেহারি পাল ভয় পেয়ে গেল। কে রে তোরা? কারা? কারা ছুটে যাচ্ছিস?

লোকগুলো দাঁড়িয়ে গেল। তাদের মুখের দিকে চেয়েই বেহারি পালের মাথাটা বন্ বন্ করে ঘুরে উঠলো। বেহারি পালের মনে হলো যেন কপিল পায়রাপোড়া তার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত বার করে হাসছে।

–কপিল, তুই?

কে একজন পাশ থেকে আরো জোরে হেসে উঠলো। বেহারী পাল তার দিকে চাইতেই সে বলে উঠলো-আমাকে চিনতে পারছেন পাল মশাই?

–কে তুই?

–আমি মানিক ঘোষ। আর আমার পাশে এই যে একে দেখছেন, এ হলো ফটিক প্রামাণিক

বেহারি পাল সেখানেই মাথা ঘুরে অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেল।

.

সমস্ত বাড়িটার চোখে তখন কক্‌টেল আরো কুটিল নেশার ঘোর ঘনিয়ে এনেছে। নয়নতারার বুঝি একটু তখন সময় হলো। একটু সামান্য ফুরসৎ। এই ফুরসৎটুকুর মধ্যে যা বলবার বলে নাও। আমার সময় নেই বাজে লোকের সঙ্গে কথা বলবার।

–কোথায়? কে ডাকছে আমাকে? কে?

মধু বললে–এই যে, ইনি–

হলঘরের চড়া আলোর আওতা থেকে এসে প্রথম বাইরে একটু অস্বস্তি লেগেছিল। তারপর সামনে খোঁচা-খোঁচা গোফ-দাড়ি-ভর্তি মুখখানার দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল নয়নতারা। এ লোকটা আবার তার সঙ্গে দেখা করতে চায় কেন? ডেকরেটারের লোক নাকি? টাকা চাইতে এসেছে?

নয়নতারা তার কাছে গিয়ে বললে–এখন কোনও পেমেণ্ট হবে না–এখন পেমেণ্ট নিতে এলে কেন?

কথাটা বলেই যেন সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বললে–ও, তুমি!

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, আবার এলুম—

–কিন্তু–

সদানন্দ বললে–তুমি খুব ব্যস্ত—

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, আমার প্রথমের জন্মদিন তো, তাই–

–প্রথম মানে?

–আমার ছেলে!

সদানন্দ বললেও, খুব ভালো। আমাকে তুমি অবশ্য আসতে বলোনি, তবু আমিও আশীর্বাদ করছি তোমার ছেলেকে। সে সুখী হোক্‌–

আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিল, সদানন্দ, কিন্তু নয়নতারার তখন ওদিকে অনেক তাড়া। বললে–আজকে সবাই এসেছে ও-ঘরে, আমি ছাড়া আর তো কেউ দেখবার নেই? তা তুমি আর একদিন আসতে পারো না? ঠিক আজকেই তুমি এলে?

সদানন্দ বললে–-তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল—

নয়নতারা বললে–আজকেই?

–হ্যাঁ, এখনই। আর হয়ত কখনও সময় পাবো না আমি। হয়ত আর কখনও আমাদের দেখাও হবে না।

নয়নতারাও বললে–তা কাল যে-কোনও সময়ে তুমি একবার এসো না, যে-কোনও সময়। আমি সব সময়েই থাকবো। তখন হাতে অনেক সময় থাকবে। বেশ নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে

–না, কাল তো সময় হবে না আমার, আজই আমার শেষ আসা।

নয়নতারা বললে–তা কাল না-আসতে পারো, পরশুই এসো—

সদানন্দ বললে–কিন্তু আজ আমার জন্যে তুমি একটুকু সময়ও দিতে পারো না?

নয়নতারা বললে–তুমি দেখছো তো আমার অবস্থা, চিফ-মিনিস্টার এসেছেন, ফরেন আমবাসাডাররা এসেছেন, পুলিস কমিশনার এসেছে, আরো কত লোক সব এসেছে, সবাই গণ্যমান্য লোক। তাঁদের দেখাশোনা করতে তো সেই একলা আমিই–

সদানন্দ বললে–তারা অবশ্য আমার চেয়ে অনেক বড় লোক, তাদের দিকটাই তো তোমার আগে দেখা উচিত–

নয়নতারা বললে–তুমি অমন করে কথা বলছো কেন? মনে হচ্ছে তুমি যেন রাগ করলে!

সদানন্দ বললে–রাগ? আমি রাগ করলে কার কী এসে যায়! রাগের কথা হচ্ছে না, শুধু বলো তুমি কী সুখী হয়েছ? কারণ, বলতে গেলে তোমার সুখের জন্যেই আমি আমার সর্বস্ব একদিন তোমাকে দিয়ে গিয়েছিলুম–

নয়নতারা কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। বললে–বলছি তো ও-সব কথা বলবার সময় নেই এখন, তবু তুমি সেই কথাই আরম্ভ করলে। পরে একদিন এসো না, তখন ওই কথা বলবো–

নয়নতারার মুখে-চোখে যেন বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো। সদানন্দ এখান থেকে চলে গেলেই যেন যে বাঁচে। আজকে এখানে সদানন্দর উপস্থিতি যেন সে চাইছে না।

–কিন্তু তুমি সুখী হয়েছ কী না শুধু সেই কথাটুকু বলবারও তোমার সময় নেই আজ?

হঠাৎ ওদিক থেকে মিস্টার সেন এসে পড়তেই কথার মধ্যে বাধা পড়লো। মিস্টার সেন কাছে আসতেই নয়নতারার চোখে মুখে আবার আনন্দের ছাপ ফুটে উঠলো।

–মিসেস ব্যানার্জী আপনি এখানে? আমি চলি—

নয়নতারা চমকে উঠলো। বললে–সে কী, আপনি এখনই যাবেন?

মিস্টার সেন বললেন–এখনই টেলিফোনে কথা হলো, নদীয়া জেলায় খুব ট্রাবল শুরু হয়েছে–ফায়ারিং হয়ে গেছে অনেকগুলো ক্যাজুয়্যালটি, আমাকে এখুনি আর একবার রাইটার্সে যেতে হবে–

–নদীয়া ডিসট্রিক্টে? কোথায়?

–ওই যে বললুম নবাবগঞ্জ! নবাবগঞ্জ থেকে এখন আশেপাশের গ্রামেও নাকি গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়ছে শুনলুম–

সদানন্দ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার আর থাকতে পারলে না। বললে–নবাবগঞ্জ?

এতক্ষণে চিফ-মিনিস্টার সদানন্দর দিকে চেয়ে দেখলেন। আগে যেন তিনি তাকে দেখতেই পাননি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ মুখে, এ লোকটা আবার কে?

সদানন্দ বললে–নবাবগঞ্জের নরনারায়ণ চৌধুরীকে আপনারা অ্যারেস্ট করেছেন কী? তিনিই ওখানকার সব চেয়ে বড় কালপ্রিট।

অবাক হয়ে গেলেন মিস্টার সেন। লোকটা বলে কী?

–হ্যাঁ, সেই নরনারায়ণ চৌধুরীর জন্যেই ওখানে আজ যত অশান্তি। ওখানকার কপিল পায়রাপোড়া ওর জন্যেই গলায় দড়ি দিয়েছিল। মানিক ঘোষ পাগল হয়ে গিয়েছিল, ফটিক প্রামাণিক ওর জন্যেই রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়িয়েছিল, ওকে কী আপনারা ধরেছেন?

চিফ-মিনিস্টার আরো অবাক। সদানন্দকে কিছু না বলে মিসেস ব্যানার্জির দিকে চেয়ে বললেন–এ লোকটা কে?

মিসেস ব্যানার্জি বললে–ও কেউ না, আপনি ওদিকে চলুন ওদিকে চলুন–বলে মিস্টার সেনকে নিয়ে হলঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু চলতে চলতে খানিক দূর যেতেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ কানে এল। যেন অমানুষিক যন্ত্রণায় কেউ ছাদ-ফাটা চীৎকার করে উঠলো।

দু’জনেই পেছন ফিরে তাকালেন। কিন্তু ফিরে তাকিয়ে যা দেখলেন তাতে চমকে উঠেছে দু’জনেই। দেখলেন লোকটা পাশের একটা লোককে এক হাত দিয়ে ধরে উন্মাদের মত একটা ক্ষুর দিয়ে মারাত্মক আঘাত করে চলেছে। আর লোকটার আর্তনাদে সমস্ত বাড়িটাও যেন সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠছে।

চিৎকার শুনে তখন হলঘরের ভেতর থেকে সবাই ছুটে এসেছে। কী হলো? কে আর্তনাদ করে উঠলো? আজকে তো মিসেস ব্যানার্জির ছেলের জন্মদিন। এই শুভ দিনে কান্না কেন? চীৎকার কেন? আর্তনাদ কেন? মিস্টার আর মিসেস হেন্‌ডারসন, মিস্টার আর মিসেস নবিকভ, মিস্টার আর মিসেস সামন্ত, মানদা মাসি, মালা বোস সবাই ছুটে এসেছে।

কী হলো ওখানে? কী হলো?

বারান্দাটা তখন ভিড়ে ভিড়। সবাই দেখলে জায়গাটা রক্তে রক্তে একেবারে ভেসে গেছে। একটা ময়লা জামা পরা লোক হাতে ক্ষুর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। ক্ষুরটায় রক্ত মাখা। আর তারই পাশে একটা লোক মুমূর্ষ হয়ে মেঝের ওপর পড়ে আছে।

মিস্টার সেন লোকটার হাত ধরে ফেলেছেন। সবাই উত্তেজিত! মিস্টার ব্যানার্জিও কাণ্ড দেখে অবাক। লোকটাকে যেন চিনতে পারলে সে।

মিস্টার সামন্ত কাছে আসতেই মিস্টার সেন তার হাত ছেড়ে দিলেন।

–তুমি ওই লোকটাকে খুন করেছ?

সদানন্দ স্থির দৃষ্টিতে মিস্টার সামন্তর মুখের দিকে চাইলে। বললে–হ্যাঁ!

–তোমার নাম কী?

সদানন্দ বললে–আমার নাম বললে চিনবেন না–

–তবু নামটা বলো।

–আমার নাম সদানন্দ চৌধুরী।

–কোথায় থাক তুমি? তোমার বাড়ি কোথায়?

–নবাবগঞ্জে।

–নবাবগঞ্জ? নদীয়া ডিসট্রিক্টের নবাবগঞ্জ?

–তোমার বাবার নাম?

–আমার বাবার নাম হরনারায়ণ চৌধুরী।

–আর ও কে?

সদানন্দ বললে–ওর নামও সদানন্দ চৌধুরী।

–সে কী? একই নাম তোমাদের দু’জনের?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, ও আর আমি একই। ও আমারই ছায়া। সারা জীবন ও আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে, সারা জীবন ও আমাকে জ্বালিয়েছে। আমার বিবেকের মত ও কেবল আমাকে সারা জীবন যন্ত্রণা দিয়েই এসেছে। ওর সঙ্গেই আজ আমি এখানে এসেছি। ও-ই আমাকে এখানে আনলে। এখানে না এলে আমাকে আজকের এই সমস্ত কিছু দেখতে হতো না। আমি এতদিন বেশ ছিলুম, আমার তো কোনও কষ্টই ছিল না। কিন্তু কেন ও আমাকে এসব দেখালে! না দেখালে আমি তো জানতেও পারতুম না কিছু। আমি তো বরং জানতুম নবাবগঞ্জের লোক সুখে আছে। তারা হাসপাতাল থেকে ওষুধ পাচ্ছে, ডাক্তারের সেবা পাচ্ছে, তারা স্কুলে কলেজে লেখাপড়া শিখে মানুষ হচ্ছে। আমি জানতেও পারতুম না যে থিয়েটার রোডে নয়নতারার ছেলের জন্মদিনে এত মদের ফোয়ারা ছুটেছে, আমি তো জানতে পারতুম না আমারই টাকায় মোটা দরে ‘গ্রীন পার্কে’ মেয়েমানুষের মাংস বিক্রি হচ্ছে…।

বলতে বলতে সদানন্দর যেন দম ফুরিয়ে এল। সে হাঁপাতে লাগলো।

তারপর একটু দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো–আমাকে আপনারা অ্যারেস্ট করুন। দয়া করে আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করুন। আমি স্বীকার করছি আমি ওকে খুন করেছি আমি স্বীকার করছি আমি আসামী।

মিস্টার সামন্ত তখন সদানন্দর হাতটা চেপে ধরে আছে। জিজ্ঞেস করলে–কিন্তু এখানে তুমি আসতে গেলে কেন? এখানে মিসেস ব্যানার্জির বাড়িতে তুমি কিসের জন্যে এলে? এখানে কিসের কাজ তোমার? এখানে কে তোমাকে আসতে বলেছিল?

সদানন্দ বললে–সেকথা আপনারা মিসেস ব্যানার্জিকেই জিজ্ঞেস করুন–

–কী মিসেস ব্যানার্জি, আপনি একে চেনেন?

মিস্টার ব্যানার্জি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন–না না মিস্টার সামন্ত, আমরা তো কেউ চিনি না। ও কে? এখানে এলো কেন? আমার তো ওকে আসতেও বলিনি।

সদানন্দ বলে উঠলো–হ্যাঁ, ওরা সত্যি কথাই বলেছেন, ওঁরা কেউই আমাকে এখানে আসতে বলেননি। আমি ওঁদের কেউই না। আমার সঙ্গে ওদের কোনও সম্পর্ক নেই। এই লোকটাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। এই-ই আমাকে এখানে এনে এই সব দেখালে! সেই জন্যেই আমি একে খুন করেছি–! আমি আপনাকে অনুনয় করে বলছি আমাকে অ্যারেস্ট করুণ আপনারা। আমি আসামী।

–কিন্তু এই সামান্য কারণেই ওকে খুন করলে?

সদানন্দ বললে–আপনারা একে সামান্য কারণ বলছেন? জানেন এ লোকটা আমার কত বড় ক্ষতি করেছে? এই লোকটাই আমাকে দেখালে সত্যবাদিতা পাপ, এই লোকটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে যে মানুষকে বিশ্বাস করা অন্যায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে বিদ্রোহ করা পাগলামি। আসলে বিশ্বাস করুন ওর কথাই ঠিক, আমিই পাপ করেছি। মানুষকে বিশ্বাস করে আমি পাপ করেছি, মানুষকে ভালোবেসে আমি পাপ করেছি মানুষকে দয়া করে আমি পাপ করেছি। আমার সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি এখন প্রস্তুত, আপনারা আমাকে গ্রেফতার করুন, আমাকে ফাঁসি দিন, আমি আসামী–

মিস্টার সামন্ত পাশের দিকে কাদের ইঙ্গিত করতেই তারা এসে সদানন্দকে গ্রেফতার করতে গেল। কিন্তু তার আগেই নয়নতারা হঠাৎ সদানন্দর সামনে গিয়ে তাকে আড়াল করে দাঁড়াল। তারপর দুটো হাত দু’দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিস্টার সামন্তর দিকে চেয়ে বললে–একে অ্যারেস্ট করবেন না মিস্টার সামন্ত।

সবাই অবাক হয়ে গেল। মিসেস ব্যানার্জি এ কী বলছেন!

–সে কী মিসেস ব্যানার্জি, আপনি কেন বাধা দিচ্ছেন? এ তো একটা অ্যান্টি-সোশ্যাল, এ তো একটা ভ্যাগাবণ্ড

নয়নতারা বললে–প্লিজ মিস্টার সামন্ত, ওকে অ্যারেস্ট করবে না, ওর কোনও দোষ নেই–কোনও দোষ নেই ওর।

–ওর কোনও দোষ নেই তো তবে দোষ কার?

উত্তরটা দিলে সদানন্দ। বললে–সব দোষ আমার, আমাকে আপনি অ্যারেস্ট করুন, আমাকে আপনি ফাঁসি দিন, আমিই আসামী, আমি মানুষকে বিশ্বাস করেছিলুম, আমি মানুষকে ভালবেসেছিলুম, আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলুম, আমি নিজের টাকা মানুষের উপকারের জন্যে পরকে দান করে দিয়েছিলুম। আজকের মানুষের চোখে এর চেয়ে বড় পাপ আর নেই। সেই বড় পাপই আমি করেছিলুম–

কথাটা বলে নয়নতারাকে ঠেলে দিয়ে সদানন্দ নিয়ে মিস্টার সামন্তর দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলে।

কিন্তু নয়নতারা তখনও সকলের দিকে চেয়ে অনুনয়-বিনয় করে বলে চলেছে–না মিস্টার সামন্ত, আপনি একে ছেড়ে দিন, আপনারা ইচ্ছে করলে সব করতে পারেন, এর জন্যে যত টাকা খরচ হয় সব আমি দেব, একে ছেড়ে দেবার জন্যে আমি আমার সব কিছু দিতে প্রস্তুত বলুন আপনারা কী চান, কত টাকা চান?

কিন্তু সদানন্দ তার কথা অগ্রাহ্য করে বলতে লাগলো–না না, নয়নতারার কোনও কথা সত্যি নয়, নয়নতারা আমার কেউ নয়, আমিও নয়নতারার কেউ নই, আমার একমাত্র পরিচয় আমি আসামী, আমি মানুষকে বিশ্বাস করেছিলুম, আমি মানুষকে ভালবেসেছিলুম, আমি মানুষের শুভকামনা করেছিলুম। আমি চেয়েছিলুম মানুষ সুখী হোক, আমি চেয়েছিলুম মানুষের মঙ্গল হোক, কিন্তু আজ এই পনেরো বছরে জানলুম মানুষকে বিশ্বাস করা, মানুষকে ভালবাসা, মানুষের শুভকামনা করা পাপ, আমি তাই আজ পাপী, আমি তাই আজ অপরাধী, আমি তাই আজ আসামী, আমাকে আপনারা আমার পাপের শাস্তি দিন, আমাকে ফাঁসি দিন–

বলে নয়নতারাকে ঠেলে দিয়ে এবার সদানন্দ নিজেই এগিয়ে চললো। পুলিসের লোক তাকে ধরে নিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে চলতে লাগলো।

মিস্টার সেন তখনও হতবাক। বললেন মিসেস ব্যানার্জি, সত্যি বলুন তো ও কে?

নয়নতারা তখন আর সহ্য করতে পারলে না। বলে উঠলো–ওকে আপনারা শাস্তি দেবেন না মিস্টার সেন–শাস্তি দেবেন না। আপনি নিজে একটু বুঝিয়ে বলুন–

–কিন্তু সত্যি বলুন তো, উনি কে আপনার?

–উনি আমার স্বামী–

‘স্বামী’ বলবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পরিবেশের আবহাওয়ায় যেন একটা বিদ্যুৎ-চমক খেলে গেল।

মিস্টার ব্যানার্জি এতক্ষণ কিছু বলেননি। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার নয়নতারার হাতটা ধরে টান দিতে গেলেন।

বললেন–করছো কী তুমি? কী পাগলামি করছো?

কিন্তু তার আগেই নয়নতারা সেই মেঝের ওপরই সোজা অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেল। চোখের জলে তার মুখের গালের ম্যাক্স-ফ্যাকটার ধুয়ে মুছে ভেসে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু তখনও যেন তার কানে বাজতে লাগলো সদানন্দর বলা শেষ কথাগুলো–আমি আসামী, আমি মানুষকে বিশ্বাস করেছিলুম, আমি মানুষকে ভালবেসেছিলুম, আমি মানুষের শুভ কামনা করেছিলুম, আমি চেয়েছিলুম মানুষ সুখী হোক, আমি চেয়েছিলুম মানুষের মঙ্গল হোক। কিন্তু আজ এই পনের বছর পরে জানলুম মানুষকে বিশ্বাস করা, মানুষকে ভালবাসা, মানুষের শুভ কামনা করা পাপ, আমি তাই আজ পাপী, আমি তাই আজ আপরাধী, আমি তাই আজ আসামী, আমাকে আপনারা আমার পাপের শাস্তি দিন, আমাকে আপনারা ফাঁসি দিন–

সেদিন যারা সেখানে ছিল সবাই তখন স্তম্ভিত হয়ে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু মালা বোসের গাওয়া সেই গানটা তখনও যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল–

ও নিষ্ঠুর আরো কি বাণ তোমার তুণে আছে—

.

তারপর? তা তারপরের পরেও তো একটা তারপর থাকতে পারে। সেই তারপরের কথাটাই বলি। আজ থেকে এক হাজার ন’শো তিয়াত্তর বছর আগে সেদিনের সেই মানুষের পৃথিবী যেমন আর এক সদানন্দকে সমসাময়িক সমাজ থেকে নিমূর্ল নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করেছিল, এত কাল পরে আজকের মানুষের পৃথিবীও তার আর উত্তরসূরী আসামীকে শাস্তি দিয়ে নিজেদের নিরাপদ মনে করে নিশ্চিন্ত হলো। কর্তাবাবু, চৌধুরী মশাই আর প্রকাশ মামার পৃথিবী আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠলো আর এক নতুন আশ্বাসে, আবার নবাবগঞ্জের স্কুলে-কলেজে-হাসপাতালে নতুন উদ্যমে আর এক অরাজকতার বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ লক্ষ কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ আর ফটিক প্রামাণিকের দল কর্তাবাবুদের করুণার ওপর আত্মসমর্পণ করে অস্তিত্ব বজায় রাখবার আপ্রাণ চেষ্টায় ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগলো। ‘গ্রীন পার্কে’ আরো চড়া দরে নারীদেহের বেচা-কেনা হতে লাগলো। থিয়েটার রোডের বাড়িগুলোতে আবার ককটেল পার্টির আসরে জমায়েত হতে লাগলো কলকাতার গণ্যমান্য মানুষের দল। এক হাজার ন’শো তিয়াত্তর বছর আগে সব কিছু যেমন চলছিল, এতদিন পরেও আবার ঠিক তেমনি চলতে লাগলো সব কিছু। কোনও কিছুরই পরিবর্তন হলো না। কিন্তু সব কিছুর অন্তরালে আকাশ-বাতাস-অন্তরীক্ষ থেকে তখনও একজনের ক্ষীণ কণ্ঠ তার ভালোবাসার একমাত্র সাবধান বাণী শুনিয়ে যেতে লাগলো। সে বাণী কেউ বা হয়ত শুনলো, আবার কেউ বা হয়ত শুনতে পেলে না, কিন্তু সেই নিপীড়িত লাঞ্ছিত আসামীর বলার আর তবু বিরাম হলো না কোনও দিন। সে কণ্ঠ যুগ যুগ ধরে কেবল বলেই চললো–তোমারা সৎ হও, তোমরা সুখী হও, তোমরা মানুষকে বিশ্বাস করো, তোমরা মানুষকে ভালোবাসো, তোমাদের কল্যাণ হোক, তোমাদের শুভ হোক, তোমাদের জয় হোক–

সর্বেহত্র সুখীনঃ সন্তু
সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ
সর্বে ভদ্ৰানি পশ্যন্তি
মা কশ্চিৎ দুঃখং আপ্লুয়াৎ।

॥ উপন্যাস সমাপ্ত ॥

॥ ১৮ই মার্চ ১৯৭৩ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *