২.৮ এই কলকাতা

কলকাতা শহরের জনতা-বিধ্বস্ত অঞ্চলের একটা কেন্দ্রে তখন আর একটা মানুষের ভাবনা আর একদিকে কক্ষ পরিবর্তন করেছে। কোথায় সেই নবাবগঞ্জ, আর কোথায় এই কলকাতা! কলকাতাতে আগেও এসেছে সদানন্দ। কিন্তু আগে এসেছে বাবার সঙ্গে গড়ের মাঠ দেখতে। চিড়িয়াখানা দেখতে। ট্রাম, বাস, গাড়ি, মানুষ, ভিড় দেখতে। কালীঘাটে পুজো দিতে, মানুষের মহোৎসব প্রাণভরে উপভোগ করতে। তখন এমন জিনিসগুলো দেখেছে যাতে তার চোখ ভরে গেছে, মনও ভরেছে।

কিন্তু এই থানার হাজত-ঘরে বসে আর এক কলকাতা দেখলে সদানন্দ। কিন্তু কতটুকুই বা দেখলে সে! কতটুকুই বা দেখতে পেলে! সেই কালীগঞ্জের পোড়ো বাড়িটা থেকে তাকে হাতকড়া দিয়ে নিয়ে এসেছিল পুলিস। তারপরে রেলবাজার থেকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছিল তাদের। সঙ্গীন খাড়া করা পুলিসের পাহারায় তাদের দু’জনকে শেয়ালদায় একটা গাড়ির ভেতরে পুরে দিয়ে সোজা এখানে নিয়ে এল। এই লালবাজারের পুলিস হেড কোয়ার্টারে। তারপর থেকে ওদের সঙ্গেই কাটছিল।

ওদেরই মধ্যে একজন নিজে থেকেই তার সঙ্গে আলাপ করতে এল। জিজ্ঞেস করলে– আপনি কখনও কলকাতায় আসেন নি বুঝি?

সদানন্দ বললে–কেন? ওকথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

–আপনাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে। গাড়ির ভেতরে আপনি জালের জানালা দিয়ে যে রকম করে চেয়ে দেখছিলেন, তাই জিজ্ঞেস করছি। গ্রামের মানুষ না হলে এমন করে কেউ বাইরের দিকে চেয়ে দেখে না–

সদানন্দ বললে–না, আগে আমি বাবা-মার সঙ্গে অনেকবার কলকাতায় বেড়াতে এসেছি–

–আপনি কী করেন?

–কিছুই করি না।

–কিছুই করেন না? কিছু করবার দরকার হয় না বুঝি? পৈতৃক জমিদারি আছে?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ।

ভদ্রলোক বললে–আপনারাই হচ্ছেন আসল কালপ্রিট। আপনাদের জন্যেই ইণ্ডিয়ার যত অশান্তি। আপনারা ইংরেজদের চেয়েও বেশী শয়তান।

সদানন্দ বললে–ঠিকই বলেছেন।

ভদ্রলোক অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–ঠিকই বলেছি?

–হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। এতটুকু অন্যায় বলেন নি। আপনাদের সঙ্গে আমি একমত।

ভদ্রলোক আরো অবাক। ভদ্রলোক আর কিছু না বলে অন্য চারজনের কাছে গিয়ে ফিস্ ফিস্ করে কী যেন বলতে লাগলো। তার কথা শুনে সবাই সদানন্দর কাছে এল। আবার নতুন করে নাম-ধাম, পিতৃ-পরিচয়, জন্মস্থানের বিবরণ জানতে চাইলে। খানিকক্ষণের মধ্যেই বেশ ঘনিষ্ঠ আলাপ হয়ে গেল। তাকে তাদের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলবার জন্যে তারা দুঃখপ্রকাশও করলে। একজন বললে–আমাদের জন্যে আপনারও শাস্তি হয়ে যাবে–

শাস্তি?

শাস্তির কথা শুনে সদানন্দর হাসি পেল। বললে–শাস্তি তো আমি এমনিতেই পাচ্ছি, আবার নতুন করে আমাকে গভর্মেন্ট কী শাস্তি দেবে?

যারা কথা বলছিল, তারা সবাই সদানন্দরই বয়সী। ট্রেনে যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ বেশি কথা হয় নি। পুলিসের দল তাদের ঘিরে রেখে দিয়েছিল। সকলের কোমরেই দড়ি বাঁধা। প্লাটফরমে, ট্রেনের কামরায় বাইরের লোকেরা তাদের দিকে হাঁ করে চেয়ে দেখছে। সকলের চোখেই একটা কৌতূহলী দৃষ্টি। যেন মানুষের সমাজে এই ক’জন এক আলাদা জাত। এক ব্যতিক্রম।

একজন বললে–দেখছেন কী রকম করে লোকগুলো চেয়ে দেখছে আমাদের দিকে। আমরা যে ডাকাত!

সদানন্দ ওদের কথাগুলো শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল, এমন ধরনের মানুষ আগে কখনও দেখে নি সে। তাদের নবাবগঞ্জের নিতাই, কেদার, গোপাল, আরো কত ছেলে যারা বারোয়ারিতলায় বসে গল্প করে, রাত্রে যাত্রার রিহার্সাল দেয়, পূজোর সময় পাল খাটিয়ে থিয়েটার করে, এরা তাদের থেকে আলাদা।

–আপনি ওই ভাঙা বাড়িটার মধ্যে কেন গিয়েছিলেন?

সদানন্দ বললে–আমি ওখানে প্রায়ই যাই–ওখানে যেতে ভালো লাগে আমার–

কিন্তু আপনার বাড়ি তো নবাবগঞ্জে, আপনি কালীগঞ্জে যান কেন? বাড়িতে আপনার কে কে আছে?

–সবাই আছে। বাবা-মা-ঠাকুর্দাদা, আমার বউ–

–বউ? আপনি বিয়েও করেছেন নাকি?

সদানন্দ বললে–আমি বিয়ে করি নি, আমার বিয়ে হয়েছে–

অল্প সময়ের মধ্যে এমনি অনেক কথা হয়ে গেল তাদের মধ্যে। সদানন্দ জানতে পারলে যে তারা ডাকাতি করে টাকা যোগাড় করে সেই টাকা দিয়ে বন্দুক পিস্তল কেনে, দেশের শত্রুদের খুন করবার জন্যে।

সদানন্দ ওদের যতই দেখছিল, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিল। ওরা ক’জন বেশির ভাগই নিজেদের মধ্যে থাকতো। ফিস্ ফিস্ করে নিজেদের মধ্যে কী সব আলোচনা করতো। অথচ একসঙ্গে ধরা পড়েও সে যেন জেলখানার মধ্যেই একঘরে। সে যেন জাতিচ্যুত। তাকে যেন ঠিক বিশ্বাস করছে না ওরা। তবু একজনের সঙ্গে তার বেশ ভাব হয়ে গেল। তার নামটা আজও মনে আছে, প্রিয়তোষ। প্রিয়তোষ সরকার। ভারি চমৎকার দেখতে। যেন আগুনের একটা আস্ত টুকরো। প্রিয়তোষ বললে–আপনাকে বোধ হয় ছেড়ে দেবে এরা–

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–কেন?

–পুলিস ইনপেক্টর আমাদের জিজ্ঞেস করছিল আপনার সম্বন্ধে? আমি বলেছি ও আমাদের দলের নয়।

সদানন্দ বললে–কেন ওকথা বলতে গেলেন? আমি চাই আমারও আপনাদের সঙ্গে জেল হোক।

প্রিয়তোষ বললে–শুধু তো আর জেল নয়, হয়ত ফাঁসিও হতে পারে, কিছুই বলা যায় না।

সদানন্দ হাসলো–ভাবছেন ফাঁসির কথা শুনে আমি ভয় পাবো?

–ভয় পাবেন না?

–না। জেল হলেও আমার আপত্তি নেই, ফাঁসি হলেও আপত্তি নেই।

সদানন্দর কথা শুনে প্রিয়তোষ সরকার খানিকক্ষণ তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। তারপর চলে গেল নিজের দলের বন্ধুদের কাছে। তারপর সবাই মিলে দল বেঁধে আবার তার কাছে এল। এবার তার দিকে সবাই আরো স্পষ্ট করে চেয়ে দেখলে। তাদের ধারণা হয়েছিল বীরত্বের দিক থেকে তাদের বুঝি জুড়ি নেই। কিন্তু অচেনা আর একজনের সাহস দেখে যেন তার ওপর তাদের শ্রদ্ধা হতে লাগলো। একজন বললে–আগে জানলে আপনাকে আমাদের দলে নিয়ে নিতুম মশাই। আপনার মত হাজার হাজার ছেলে আমাদের দরকার। যারা প্রাণ দিয়ে দেশের শত্রুদের খুন করতে পারবে। কিন্তু বড় দেরিতে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ভাই–

সদানন্দ বললে–আপনারা বুঝি মানুষ খুন করেন?

প্রিয়তোষ বললে–নইলে কি আর টাকার জন্যে ট্রেন লুঠ করেছি?

সদানন্দ বললে–কিন্তু সব দোষ কি আর তাদের একলার? আমাদের মধ্যেও তো এমন অনেক লোক আছে, যাদের খুন করলে দেশে শান্তি আসে–

–আছে বইকি! তারা হলো মীরজাফর। সেই মীরজাফরদেরও আমরা খুন করি।

সদানন্দ বললে–কিন্তু যদি বিদেশীরা কোনোদিন চলে যায়, মীরজাফররাও চলে যায়, তখন কাদের খুন করবেন?

তারা এ-কথার মানে বুঝতে পারলে না। বললে–আপনি কাদের কথা বলছেন?

সদানন্দ বললে–তারা যে প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতেই রয়েছে। কেউ ঠাকুর্দা হয়ে বাবা হয়ে মা হয়ে মামা হয়ে যে অকথ্য অত্যাচার করছে, তাদের খুন করবার ব্যবস্থা করতে পারবেন আপনারা?

–তার মানে!

সদানন্দ বললে–একদিন-না-একদিন বিদেশীরা তো চলে যাবে, কিন্তু এরা তো আমাদের শহরে-শহরে গ্রামে-গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে থাকবে, তখন তাদের অত্যাচার বন্ধ করতে পারবেন আপনারা? সেই সব ঠাকুর্দাদের, বাবাদের, মাদের, মামাদের অত্যাচার? তারা কী রকম অত্যাচার করে তার কি খবর রাখেন আপনারা? তারা কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক আর কালীগঞ্জের বউদের একটার পর একটা খুন করে চলেছে। তাদের শাস্তি কবে হবে? আপনারা তাদের শাস্তি দিতে পারবেন?

হঠাৎ একজন ওয়ার্ডার এসে হাজির হলো। বললে–সদানন্দ চৌধুরী কার নাম?

সদানন্দ বললে–আমার, কেন?

–পুলিস-সুপার আই-বি আপনাকে নিচেয় ডাকছে, চলিয়ে—

সদানন্দ আর দাঁড়ালো না। যেমন অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই ওয়ার্ডারটার পেছনে পেছনে চলতে লাগলো।

সদানন্দ চলে যাবার পর প্রিয়তোষ বন্ধুদের দিকে চাইলে। বললে–আমি তোদের বলেছিলুম ছেলেটা পাগল। তখন তোরা কেউ বিশ্বাস করলি না। তখন তোরা বললি, স্পাই–

অন্য সবাইও ঠিক করলে পাগলই বটে! আসলে সারাজীবন সদানন্দকে সবাই পাগল বলেই ধরে নিয়েছিল। এও তার জীবনের এক ট্র্যাজেডি। অথচ এ-পৃথিবীতে কে যে পাগল আর কে-ই বা সেয়ানা সেইটেই বিচার করবার জন্যে একটা মানুষও কি খুঁজে পেয়েছে সে? মাঝখান থেকে বদনাম হলো শুধু তার! সে-ই নাকি পাগল!

কিন্তু সে-কথা এখন থাক।

ওদিকে একটা বিরাট টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তখন তাকে একটার পর একটা জেরা করে চলেছিল সাদা চামড়ার আই-বি অফিসার। কোথায় বাড়ি, তার বাবার নাম কী, পোড়ো বাড়ির মধ্যে সে কেন সেদিন গিয়েছিল। অনেক অনেক প্রশ্ন। কখনও ভয় দেখিয়ে কখনও মিষ্টি কথা বলে তার কাছে কথা আদায় করতে চেয়েছিল সাহেব। কিন্তু তার একটাই কেবল কথা যে তাকে জেলে পুরলেও তার আপত্তি নেই, ফাঁসি দিলেও না।

শেষকালে সাহেবের যখন সব সন্দেহের নিরসন হলো, আর রিপোর্টেও যখন কিছু পাওয়া গেল না, তখন হুকুম হলো–যাও, গেট আউট–গেট আউট অব দিস্ প্লেস্–

সদানন্দ প্রথমে বুঝতে পারে নি। বললে–কোথায় যাবো?

আর কয়েকজন বাঙালী ইনপেক্টর দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। তারা বললে–বাইরে চলে যান, আপনি ফ্রি–

–ফ্রি?

থানার বাইরেও যে সে ফ্রি নয়, সেটাও যে সদানন্দের কাছে একটা জেলখানা তা বাইরের লোক যারা, তারা জানবে কী করে? সদানন্দর চোখ দিয়ে তখন যেন কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল।

–হাঁ করে দেখছেন কী? চলে যান—

সদানন্দ বললে–ওদের সঙ্গে একবার দেখা করে আসতে পারি? ওই ওদের মধ্যে প্রিয়তোষ সরকারের সঙ্গে?

একজন বাঙালী অফিসার ধমক দিয়ে উঠলো–যা বলছি শুনছেন না কেন? আবার ইয়ার্কি হচ্ছে?

সদানন্দ আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বেরিয়ে বিরাট কমপাউণ্ড, কমপাউণ্ডের মধ্যে অনেক লাল পাগড়ি, অনেক সাদা পোশাক-পরা পুলিস, গাড়ি-ভ্যানের ভিড়। সবাই জানলে সদানন্দ চৌধুরী নামে যে-ছেলেটিকে কাল ধরে আনা হয়েছে, তাকে হাজত-ঘর থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু একটা কথা কেউই জানতে পারলে না যে সে সত্যিই ছাড়া পেলে না। শুধু একটা ছোট হাজত-ঘর থেকে সে আর একটা বড় হাজত-ঘরে গিয়ে ঢুকলো। এ-হাজত-ঘরে ছাদ নেই, আকাশ, আর দেওয়াল নেই, শুধু আছে বন্দী মানুষদের ভিড়। এইটুকুই যা তফাৎ। এখানে সবাই তারই মত মানুষ। তারা ভাবছে তারা স্বাধীন, কিন্তু না, আসলে বন্দী তারাও।

ছাড়া পেয়ে সদানন্দ রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। চারদিকে অসংখ্য ব্যস্ততা যেন মানুষের রূপ ধরে রাস্তায় ছুটে চলেছে। এ সেই নবাবগঞ্জের মত নয়। সেখানে সবাই ব্যস্ত হতে চায়, কিন্তু পারে না। কিন্তু সেখানে সমস্ত দিনখানা পড়ে আছে তোমার জন্যে। কত কাজ করার করো না। আর কাজ যদি না থাকে তো বারোয়ারি-তলায় কেদারের দোকানের মাচায় বসে পরচর্চা করো। সেখানে ঢালাও ক্ষেত-খামার। ইচ্ছে হলো তো নদীর ধারের নিরিবিলির মধ্যে নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করে। কিন্তু এখানে উলটো–সকলের মুখের দিকে চেয়ে সদানন্দর মনে হলো এখানে যেন কেউ কারো নয়। সবাই নিঃসঙ্গ। তবু সবাইকে জড়িয়ে নিয়েই একসঙ্গে মরতে চাইছে।

–শুনুন—

সদানন্দ পাশ ফিরে দেখলে। একজন লোক তার দিকে চেয়ে হাত পেতে আছে।

–একটা পয়সা দেবেন?

সদানন্দ বুঝলো, লোকটা ভিখিরি। অথচ গায়ে জামা, পরনে ধুতি, পায়ে জুতোও রয়েছে। বাইরে থেকে ভিখিরি বলে বোঝাই যায় না। সদানন্দ পকেটে হাত দিলে। পয়সা তার কাছে আছে কিনা তাও জানা ছিল না। পুলিসে ধরবার পর তার জামা কাপড় সব কিছু তল্লাসী করেছিল তারা। হঠাৎ খেয়াল হলো পকেটে তো তার কিছু নেই। অথচ নবাবগঞ্জে ফিরে যেতে গেলে তো ট্রেন-ভাড়া লাগবে। তখন তো টাকার দরকার। কী করে ফিরবে সে তাহলে।

সদানন্দ বললে–আমার কাছে একটা পয়সাও নেই, আমি কিছুই দিতে পারবো না–

কথাটা লোকটা বিশ্বাস করলে কিনা কে জানে। হয়তো কল্পনাও করতে পারে নি যে, সদানন্দ সদ্য সদ্য পুলিস-হাজত থেকে বেরিয়েছে। আর কল্পনা করতে পারবেই বা কী করে? তার জামা কাপড়ে চেহারায় তো লেখা নেই সে আসামী!

লোকটা চলে গেল যেদিকে যাচ্ছিল। তারপরে হয়ত আর একটা লোকের কাছে গিয়ে আবার নতুন করে হাত পাতবে সে। লোকটার কাছে সবাই বড়লোক। সবাই তার চেয়ে অর্থবান! সুতরাং চাইতে তার কিছু লজ্জা নেই। কিন্তু সদানন্দ এই শহরে কার কাছে হাত পাতবে? তার বাড়ি ফেরার ট্রেন ভাড়ার টাকা সে কার কাছে ভিক্ষে করবে?

সমস্ত কলকাতা শহরটা ততক্ষণে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারো অভাব-দুঃখ দারিদ্র্যের দিকে দেখবার সময় আর তখন নেই কলকাতার। সদানন্দ সেই নিষ্ঠুর নির্মম কলকাতার দিকে চেয়ে সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝতে পারলে না এখানে সে কোন্ কাজে লাগবে! এ পৃথিবীতে তার কীসের প্রয়োজন!

.

নয়নতারার কিন্তু বাহাদুরি আছে বলতে হবে। শাশুড়ীও অবাক হয়ে গেছে বউমার কাজ কর্ম দেখে। বাবা এসেছে, সুতরাং নয়নতারাও যেন অন্য মানুষ হয়ে উঠলো একেবারে। একবার রান্নাঘরে যাচ্ছে। আর একবার যাচ্ছে বাবার কাছে। শাশুড়ী একবার ডাকলে–বউমা–

শাশুড়ী সেই সকাল থেকেই আর ঘর ছেড়ে বেরোয় নি। সেই আগের দিন রাত্রে যে শুয়েছে, তার পরে আর ওঠে নি। মাঝখানে শুধু উঠে বসেছিল একবার। বউমাকে সিন্দুকের চাবি খুলে প্রকাশকে টাকাটা বার করে দিতে বলেছিল।

শাশুড়ী বললে–এমন সময় তোমার বাবা এলেন, আমি উঠেও বসতে পারছি না। তুমি একলা দেখাশোনা করতে পারবে তো? বাড়িতে পুরুষমানুষ কেউ নেই যে খাতির-যত্ন করবে। তোমার ওপরেই ভার দিলুম বউমা, দেখো যেন তোমার শ্বশুরবাড়ির বদনাম না হয়–

নয়নতারা বলেছিল–সে আপনাকে ভাবতে হবে না মা, আমি তো আছি, আমি সব দেখবো–

শাশুড়ী বউমার মুখের চেহারা দেখে ভরসা পেলে। বাবার আসার খবর পেয়ে বউমা যেন একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেছে। মুখে হাসি, অথচ উদ্বেগও কম নেই তার।

বললে–চান করবার ব্যবস্থা করতে বলে দিও বউমা।

নয়নতারা বললে–বাবার সঙ্গে তার একজন ছাত্রও এসেছে। বুড়ো মানুষ তো, তাই একলা আসতে ভরসা পান নি।

–ভালোই তো। গৌরীকে আমার কাছে একবার ডেকে দিয়ে তুমি বাবার কাছে গিয়ে বোসো গে। আমি গৌরীকে বলে দিচ্ছি কী কী রাঁধতে হবে।

বাড়িতে কুটুম এসেছে। সুতরাং এ বাড়ির গিন্নীর নিজেরই সব করার কথা। গৌরী আসতেই শাশুড়ী বললে–হ্যাঁ রে, বেয়াই মশাইরা খাবেন, যেন নিন্দে না হয় দেখিস, তোর দাদা বাড়িতে নেই, একা সব পারবি তো, না আমি যাবো?

গৌরীর তখন সময় ছিল না কথা বলবার। বললে–তুমি ও-সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছো কেন বউদি, তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো না, আমি আছি, বিষ্টুর মা আছে, বউমা রয়েছে, কাজের লোকের কী অভাব?

সত্যিই কোনও অসুবিধেই হলো না কারো। নয়নতারা অদ্ভুত মানিয়ে নিলে। একবার রান্নাঘরে যায়, গিয়েই জিজ্ঞেস করে–পিসী, আমি একটু হাত লাগাবো?

গৌরী বলে–না না বউমা, তুমি তোমার বাবার সঙ্গে গিয়ে কথা বলো গে। বেয়াই মশাইদের চান হয়ে গেলেই আমাকে খবর দেবে–

নয়নতারা বললে–চান করা তো হয়ে গেছে।

–তাহলে তুমি বাবার কাছে গিয়ে বোস, আমি এদিকে গুছিয়ে নিয়ে তোমাকে খবর দিচ্ছি–

নয়নতারা বললে–বাবার কাছে বসেই তো এতক্ষণ গল্প করছিলুম, মাঝখানে শুধু একবার দেখতে এলুম তুমি একা সব কি পারবে?

–খুব পারবো, তুমি এখান থেকে যাও তো। এই তো সামান্য দুজনের খাওয়া, এই গৌরী একদিন একশো জনকে এক হাতে রান্না করে খাইয়েছে

নয়নতারা আর দাঁড়ালো না সেখানে। এক দৌড়ে আবার সোজা চলে গেল বাবার কাছে।

কালীকান্ত ভট্টাচার্য আর নিখিলেশ তখন স্নান-টান সেরে বসে আছে আরাম করে। এতদিন পরে নয়নতারার সঙ্গে দেখা। অনেক সাধ করে তিনি এই নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে আসবার সময় অনেক দুর্ভাবনা নিয়ে এসে হাজির হয়েছিলেন। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কী দেখবেন কী শুনবেন তারই ভাবনা ছিল। কিন্তু এসে পৌঁছনোর পর থেকে মেয়ে তাঁর খাতির-যত্ন করতেই ব্যস্ত, একটা কথা বলবার পর্যন্ত সময় পান নি। এবারই প্রথম নয়নতারার শ্বশুরবাড়ির ভেতরটা এত ভালো করে দেখলেন তিনি। বারবাড়ির চেহারাটা সেবারই দেখেছেন। কিন্তু এবার মেয়ে একেবারে বাবাকে ভেতরের বাড়িতে নিয়ে বসিয়েছিল। সেবার মেয়েকে এখানে পৌঁছিয়ে দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার অন্যরকম। তিনি চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন। গ্রামের বাড়ি বটে, কিন্তু তারই মধ্যে কী চমৎকার ব্যবস্থা। উত্তর দিক দিয়ে বাড়ির সদরে ঢুকতে হয়, তারপরে বার বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপ বাঁয়ে রেখে সোজা ভেতরে ঢুকে যাও। বাঁয়ে দক্ষিণে ধান চাল-সরষে-ছোলার মরাই। আর বাঁয়ে সার সার ঘর। বৈঠকখানা থেকে শুরু করে অতিথি অভ্যাগতদের জন্যে থাকার ব্যবস্থা। তার শেষপ্রান্তে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। দোতলায় যা কিছু একখানা দেড়খানা ঘর আছে সবই কর্তাবাবুর দখলে। সেটা তাঁরই এলাকা। এর পর উঁচু একটা পাঁচিল। তারই মাঝখানে দরজা। সেই দরজা দিয়ে ভেতর-বাড়ির উঠোনে গিয়ে পড়বে।

কালীকান্ত ভট্টাচার্য কুয়োতলায় স্নান করতে করতে সবই দেখছিলেন। পশ্চিম দিকে কত বড় বাগান। বাগানের দক্ষিণে ভেতর বাড়ির পুকুর। ইট-বাঁধানো ঘাটের ওপর সিমেন্টের বেঞ্চি। এই ঘাটে নয়নতারা চান করে নাকি?

নয়নতারা বললে–না বাবা, আমি কুয়োতলায় ঘেরা ঘরে চান করি, শাশুড়ী আমাকে পুকুরে নামতে দেন না, বলেন তুমি সাঁতার জানো না বউমা, তুমি পুকুরে নেমো না—

ভট্টাচার্য মশাই বললেন–তা শাশুড়ী তো তোর খুব ভালো বলতে হবে–

–হ্যাঁ, খুব ভালো বাবা। গয়নাগাঁটি টাকাকড়ি সিন্দুকের চাবি পর্যন্ত আমাকে দিয়ে দিয়েছে, এই দেখ না–

শুধু বাবা নয়, নিখিলেশও দেখলে। নয়নতারা চাবিটা হাতে নিয়ে দেখালে।

ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–দেখলে তো নিখিলেশ, আমি তোমায় বলেছিলুম নয়নতারার স্বামীভাগ্য ভালো– হ্যাঁ রে, তা সদানন্দকে ছাড়িয়ে আনবার ব্যবস্থা তোর মামাশ্বশুর করতে পারবে তো?

নয়নতারা বললে–তুমি তাহলে আমার মামাশ্বশুরকে চেনো না বাবা, তিনি খুব পাকা লোক–

–তা পুলিস যদি না ছাড়ে?

নয়নতারা বললে–সেই জন্যেই তো এক হাজার টাকা নিয়ে গেলেন, আমিই তো নিজে সিন্দুক থেকে টাকা বার করে দিলুম–

ভট্টাচার্যি মশাই যেন খুশী হলেন। বললেন–তাহলে টাকা-কড়িও বুঝি তোর হাতে! তুই-ই-টাকাকড়ি রাখিস নাকি?

নয়নতারা বললে–বা রে, সিন্দুকের চাবি থাকবে আমার হাতে আর টাকা নাড়াচাড়া করবে অন্য লোক? তুমি যে কী বলো বাবা তার ঠিক নেই।

–তাহলে তুই-ই দেখছি বলতে গেলে এ বাড়ির আসল গিন্নী!

নয়নতারা হাসলো।

বললে–আমার শাশুড়ীর তো অসুখ কাল থেকে। আমি সংসার না দেখলে আর কে দেখবে? আমার শ্বশুর গেলেন রাণাঘাটে মামলার তদ্বির-তদারক করতে, দোতলায় কর্তাবাবু বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন, মামাশ্বশুর গেছেন কলকাতায় পুলিসের থানায় দরবার করতে, এদিকে শাশুড়ীর আবার অসুখ, অথচ খাবার বেলায় এক গাদা লোক–

খেতে বসে মেয়ের গল্প শুনছিলেন ভট্টাচার্যি মশাই। বললেন–এটা খেতে তো খুব ভালো হয়েছে রে। এটা কে রেঁধেছে? এই মাছের মুড়ো দিয়ে ছোলার ডাল?

–কে আবার রাঁধবে? আমিই রেঁধেছি—

নিখিলেশও পাশে বসে খাচ্ছিল। সেও বললে–হ্যাঁ, সব রান্নাগুলোই ভালো হয়েছে–

নয়নতারা উৎসাহ পেয়ে গেল। বললে–তা হলে মুড়ি-ঘণ্টটা আর একটু নিয়ে আসি, যাই

ভট্টাচার্যি মশাই বাধা দিলেন। বললেন–ওরে না না, এত সব খেতে হবে, একটা তো মাত্র পেট, ধরবে কী করে অত? তা আমি ভাবছি তুই এত শিখলি কবে? তোর মা’ও মুড়িঘণ্ট খুব ভালো রাঁধতো। তোর মা’র কাছেই এসব রাঁধতে শিখেছিলি, না-রে? বিপিনও এখানে খেয়ে গিয়ে রান্নার খুব প্রশংসা করছিল–

নয়নতারা বললে–তা মা ছাড়া আর কার কাছে রান্না শিখবো, এখানে তো সবে এসেছি–

ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–তা এখেনে এসে তোকে রান্না-বান্না করতে হয় নাকি?

–কী যে বলো তুমি বাবা তার ঠিক নেই। এখানে রান্নার লোকের কী অভাব?

বিষ্টুর মা আছে, গৌরীপিসী আছে, কিন্তু আমার শাশুড়ীর ইচ্ছে যে আমি রাঁধি। আমার রান্না আমার শ্বশুর-শাশুড়ীর খুব খেতে ভালো লাগে–

–আর সদানন্দ? সে কী বলে? তোর রান্না পছন্দ হয় তার?

নয়নতারা হাসলো। বললে–আসলে তাঁর জন্যেই তো আমাকে রান্নাঘরে যেতে হয়। তাঁর আবার আমার রান্না না হলে যে মুখে রোচে না–

বাবা খুব খুশী হলেন মেয়ের কথাটা শুনে। নয়নতারা বললে–আর একটু দই দিই তোমাকে বাবা–

ভট্টাচার্য মশাই ততক্ষণে উঠে পড়েছেন। বললেন–এর বেশি খেলে আমার অসুখ করবে মা, আমার কি আর খাবার বয়েস আছে? এই নিখিলেশকে বরং দে, এদের কম বয়েস, এরা খেতে পারবে।

নিখিলেশও উঠে পড়লো। বললে–আমিও আর খেতে পারবো না–

খাওয়া-দাওয়ার পর ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–তুই আমার সঙ্গে যাবি মা কেষ্টনগরে? তুই বেয়ানকে একবার জিজ্ঞেস করে আয় না। বলবি বাবা নিয়ে যাবার কথা বলছেন–

প্রীতি নিজের ঘরে শুয়েছিল তখনও। বউমাকে দেখে বললে–তোমার বাবার খাওয়া হলো? কোনও কষ্ট হলো না তো? আমি তো দেখতেই পেলুম না কী কী রান্না হলো, কী রকম পরিবেশন করলে তুমি–

–না মা, খাওয়ার কোনও অসুবিধে হয় নি। বাবা বলছিলেন আমাকে কেষ্টনগরে নিয়ে যাবেন। আমি যাবো?

শাশুড়ী বললে–তা যাও না বউমা, দুদিনের জন্যে ঘুরে এসো না, তুমি তো বলছিলেই কেষ্টনগরে যাবে। বাবা যখন এসে গেছে তখন যাও না। এ বাড়িতে এ অবস্থায় থাকলে তোমার কষ্ট হবে, তার চেয়ে বরং তুমি কিছুদিনের জন্যে ঘুরে এসো–

নয়নতারা বললে–কিন্তু মা, আপনার শরীরের এই অবস্থা…।

শাশুড়ী বললে–তা হোক বউমা, আমার যদি এখন বরাবরই শরীর খারাপ হয় তা বলে তুমি একবার বাপের বাড়ি যাবে না? আমার জন্যে তুমি কেন মিছিমিছি কষ্ট করতে যাবে বউমা? তুমি এখানে কোন্ সুখে পড়ে থাকবে? তার চেয়ে তোমার বাবা এসেছেন, এমন সুযোগ আর হবে না, তুমি বরং চলেই যাও

নয়নতারা একটু ভেবে বললে–আমি যাবো? এখন বাবা বাড়িতে নেই, তিনি ফিরে এসে যদি কিছু বলেন?

শাশুড়ী বললে–সে তোমায় ভাবতে হবে না বউমা, তিনি কিছু বলবেন না, যদি কিছু বলেন তো আমি তাঁকে সব বুঝিয়ে বলবো। আর কার জন্যে তুমি এখানে থাকবে বউমা? এখানে কে আছে তোমার? আমার ছেলে কি তোমার মুখ-দর্শন করে? যার স্বামী অমন সে কোন্ সুখে স্বামীর ঘর কররে?

এর জবাব কি দেবে নয়নতারা! বললে–তা হলে আমি বাবাকে সেই কথা বলি গে?

–হ্যাঁ, বউমা, আমি বলছি তুমি যাও। জানো বউমা, তুমি এখানে মুখ ভার করে থাকলে আমার আরো কষ্ট হয়। আসলে তোমার কথা ভেবে ভেবেই আমার এই অসুখ, নইলে অসুখের তো আর অন্য কোনও কারণ নেই–

–আচ্ছা মা, আমি বাবাকে তাহলে তাই বলি গিয়ে–

বলে নয়নতারা আবার বাবার কাছে গেল। বললে–না বাবা, শাশুড়ী মত দিলেন না। বললেন–কর্তা এখন বাড়ি নেই, উনিও নেই, এ সময়ে আমার চলে যাওয়া ঠিক হবে না। আর আমিও ভেবে দেখলুম এ সময়ে গেলে এদের সংসারে খুব অসুবিধে হবে। সিন্দুকের চাবি-টাবি সব তো আমার কাছে, শাশুড়ীর শরীরও ভালো নয়। আমার তো তোমার সঙ্গে খুব যেতে ইচ্ছে করছিল, তোমার সঙ্গে গেলে কিছু দিন তবু তোমার দেখাশোনা করতে পারতুম, কিন্তু এই অবস্থায় কী করি বলো তো?

ভট্টাচার্যি মশাই বললেন– না, বেয়ান তো ঠিক কথাই বলেছে। আমার কথা তোকে ভাবতে হবে না মা। আমার কোনো অসুবিধে হয় না সেখানে। তুমি এখানে সুখে আছো ভাবলেই আমার সুখ। তোমার এত সুখ এত ঐশ্বর্য, এসব তোমার মা কিছু দেখে যেতে পারলেন না, সেইটেই আমার দুঃখ রয়ে গেল। তাহলে আমি আসি মা, তোমার শাশুড়ী শ্বশুরকে বলে দিও, আমি আর থাকতে পারলুম না, আমার কালকে কলেজ আছে–আমি তাহলে আসি-সদানন্দ এল কি না খবরটা যেন কোনও ভাবে পাই–

নয়নতারা বাবার পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ঠেকালে। বাবা মেয়ের মাথায় হাত ছুঁইয়ে আশীর্বাদ করলেন, বেঁচে থাকো মা, স্বামীর সংসারে লক্ষ্মী হয়ে বিরাজ করো, এই প্রার্থনা করি–

বলে বিদায় নিয়ে বাইরে এলেন। নিখিলেশও সঙ্গে সঙ্গে আসছিল। দীনু আগের থেকেই সব বন্দোবস্ত করে রেখেছিল। রজব আলি স্টেশনে পৌঁছে দেবে।

নয়নতারা বার বাড়ির সীমানায় এসে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলো। গাড়িতে উঠলেন বাবা। নিখিলেশও উঠলো। তারপর গাড়িটা ছেড়ে দিলে। সদর দিয়ে বেরিয়ে গাড়িটা একেবারে রাস্তায় গিয়ে পড়লো। তারপর আর দেখা গেল না। নয়নতারার চোখ দুটো ছল-ছল করে উঠলো। তারপর জানালাটার পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিলে।

গাড়িটা তখন বারোয়ারিতলা দিয়ে চলেছে। ভট্টাচার্যি মশাই-এর মনটা বড় ভারি-ভারি লাগছিল। মেয়ের সুখ, মেয়ের ঐশ্বর্য দেখে খুশী যেমন হয়েছিলেন, তেমনি মেয়েকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। পাশে নিখিলেশ চুপ করে বসে ছিল।

ভট্টাচার্যি মশাই বললেন–কী নিখিলেশ, তুমি চুপ করে আছো যে? কেমন দেখলে? আমি বলেছিলুম না যে নয়নের ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। কত বড় বাড়ি দেখলে? আর নয়নের রান্না কী চমৎকার সেটাও বলো, সব ওর মায়ের কাছে শেখা, বুঝলে? ওইরকম ছোলার ডালের মুড়িঘণ্ট নয়নের মাও রাঁধতো—

নিখিলেশ স্বীকার করলে। বললে–হ্যাঁ, রান্নাটা খুব ভালো হয়েছিল মাস্টার মশাই—

রাস্তার পাশে বেহারি পালের বেনে-মশলার দোকান। গরুরগাড়িটার ভেতর অচেনা মুখ দেখে একটু কৌতূহল হলো বেহারি পালের। গাড়িটা যে কর্তাবাবুর তা রজব আলিকে দেখে বুঝতে পারলে। কিন্তু গাড়ির ভেতরে ওরা কারা?

সেখানে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলে বেহারি পাল–মশাইরা কোত্থেকে আসছে?

ভট্টাচার্যি মশাই-এর সেদিকে নজর পড়লো। কিন্তু উত্তর দিলে রজব আলিই। সে বললে–আমাদের বেয়াই মশাই, মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন–

বেহারি পাল হাত জোড় করে কপালে ঠেকালে। বললে–আপনারা ব্রাহ্মণ? প্রণাম হই।

ভট্টাচার্যি মশাইও নিয়মানুযায়ী প্রণাম করলেন। বললেন–আপনি?

–আমার নাম বেহারি পাল। আমার এই বেনে-মশলার দোকান। তা মেয়ের আপনি বিয়ে দিয়েছেন বটে, কিন্তু কুটুম ভালো হয় নি–

হঠাৎ কথাটার আকস্মিকতায় ভট্টাচার্যি মশাই যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কোথাকার কে বেহারি পাল, তার এ মন্তব্য করবার কতটুকু অধিকার তাও তিনি বুঝতে পারলেন না। হঠাৎ এ মন্তব্য করার উদ্দেশ্য কী তাও তাঁর বোধগম্য হলো না। কথাটা শুনে তিনি কিছুক্ষণের জন্যে যেন হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন ভদ্রলোকের দিকে।

কিন্তু রজব আলি তখন গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। বেহারি পালের বেনে-মশলার দোকান ছাড়িয়ে যখন অনেক দূর চলে এসেছে তখন যেন ভট্টাচার্যি মশাই-এর মুখে প্রথম কথা বেরোল।

বললেন–নিখিলেশ, ভদ্রলোকের কথাটা শুনলে? ও ভদ্রলোক ও কথাটা বললে কেন বলো দিকিনি?

নিখিলেশ বললে–পাড়াগাঁয়ের লোক তো, ওরা ওমনি পরশ্রীকাতর হয় মাস্টার মশাই–ওকথা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাবেন না–

কথাটা ভট্টাচার্যি মশাই এর খুব মনঃপুত হলো। বললেন–তুমি ঠিক বলেছ নিখিলেশ, ঠিক বলেছ তুমি, এ পরশ্রীকাতরতার কথা। পল্লীগ্রামে কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। অথচ তুমি তো নিজের চোখেই সব দেখলে। নিজের কানেই সব শুনলে, কুটুম কি খারাপ করেছি নিখিলেশ? তুমিই বলো? মেয়ে আমার ভালো ঘরে পড়ে নি? ডাকাত বলে ভুল করে যদি জামাইকে ধরে নিয়ে যায় তো জামাই কী করবে? আমার জামাই-এর তো কোনও দোষ নেই–

নিখিলেশ বললে– কে কী বললে তা নিয়ে আপনি অত ভাবছেন কেন মাস্টার মশাই? লোকে কি কারো ঐশ্বর্য সহ্য করতে পারে? আপনার মেয়ে ভালো ঘরে পড়েছে এতেই ওদের ঈর্ষা হয়েছে। ওদের রাগ কেন চৌধুরীদের বাড়িতে অত সুন্দরী বউ হয়েছে। আসল কথাটা হলো তাই–

ভট্টাচার্য মশাইও নিখিলেশের কথায় সায় দিলেন। বললেন–তুমি বিচক্ষণ ছেলে নিখিলেশ, তুমি ঠিক বলেছ, সব ওদের ঈর্ষা, আমি আর ও নিয়ে মাথা ঘামাবো না। এই আমি চুপ করে রইলুম–

বলে তিনি চুপ করে রইলেন।

আর গ্রামের ধুলোর রাস্তার ওপর দিয়ে রজব আলি গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।

.

সদানন্দর পেছন থেকে হঠাৎ কে যেন বলে উঠলো–আরে সদা, তুই এখানে? আর আমি তোকে গরু-খোঁজা করে বেড়াচ্ছি–

সদানন্দ পেছন ফিরে দেখলে–প্রকাশ মামা।

প্রকাশ মামা বলতে লাগলো–কখন ছাড়া পেলি তুই?

সদানন্দ বললে–এই একটু আগে–

–একটু আগে অথচ আমি সারা থানাটা হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছি তোর জন্যে। বড় দারোগাটা ভারি বজ্জাত, জানলি! মোটে কথা বলতে চায় না। শেষকালে হাজার টাকা যখন হাতে তুলে দিলুম তখন হুকুম দিয়ে দিলে তোকে ছাড়বার। আমাকে বড় দারোগা বললে–-ছেড়ে দিয়েছে। তা ছেড়ে দিলে তো আমি দেখতেই পেতুম–। আমি তখন থেকে একবার ঘর একবার বার করছি। আর এদিকে তুই এখানে দাঁড়িয়ে ভ্যারেণ্ডা ভাজছিস!

সদানন্দ বললে–তুমি ঘুষ দিলে?

প্রকাশ মামা বললে–ঘুষ, দেব না? ঘুষ না দিলে তুই এখন এখানে দাঁড়িয়ে গায়ে হাওয়া লাগাতে পারতিস? এতক্ষণ হাজাতখানার ঘরে তোকে পচে মরতে হতো না? তা আয়, আমার সঙ্গে আয়, যা ঠাণ্ডা পড়েছে। শরীরটাকে একটু গরম না করতে পারলে আর চলছে না। আয়–

সদানন্দ তবু জিজ্ঞেস করলে–কোথায়?

প্রকাশ মামা এবার সদানন্দর একটা হাত ধরে টান দিলে। বললে–তুই আয় না, এত রাত্তিরে তো আর নবাবগঞ্জের ট্রেন নেই, একটা রাত কলকাতাতেই তো কাটাতে হবে। আয়, তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই–

বলে প্রকাশ মামা সদানন্দকে টানতে টানতে যে কোনদিকে নিয়ে চললো তা সে বুঝতে পারলে না। সত্যিই প্রকাশ রায় যেন নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়িতে শনি হয়েই ঢুকেছিল। নইলে কোথাকার কোন্ নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়ির বংশধরকে সে সেদিন কালীঘাটের মানদা মাসির বস্তি বাড়িতেই বা নিয়ে গেল কেন?

তা মানদা মাসির প্রসঙ্গ পরে বলবো। তার আগে নবাবগঞ্জের কথা আগে কিছু বলতে হবে। কারণ এ-গল্পের শেষ যেখানেই হোক, নবাবগঞ্জেই এ-গল্পের শুরু।

সেই নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়িটার ভেতরে যে তখন ভাঙন ধরতে শুরু হয়েছে, বাইরে থেকে কিন্তু তা এতটুকু বোঝবারই উপায় ছিল না। বাইরে তখনও বিধু কয়ালের ছেলে শশী কয়াল দাঁড়িপাল্লায় ধান-চাল মেপে মেপে গোলায় তোলে। পরমেশ মৌলিক প্রতিদিন চণ্ডীমণ্ডপে এসে কাঠের বাক্সখানা সামনে নিয়ে বসে। তারপর খেরো খাতাখানা খুলে হিসেবের কুটিল অঙ্কগুলো কষতে কষতে জলের মত তরল-সরল করে আয় ব্যয়ের সমতা সাধন করে। কিন্তু আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলেই তার মাথায় টনক নড়ে ওঠে।

কিন্তু পরমেশ মৌলিকের মাথার ওপর আছে কৈলাস গোমস্তা। কৈলাস গোমস্তা আরো পাকা লোক। সে সেই খাতাগুলো দেখে আর দেখার পর মঞ্জুর করে দেয়। কোথাও বা খরচ জোড়ে, তারপর তা থেকে সেগুলো পাকা খাতায় তোলে।

যতদিন কর্তাবাবু সুস্থ ছিলেন ততদিন তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন।

বলতেন–এটা এখানে কী লিখেছ কৈলাস? এই দুটো পয়সা কীসের খরচা?

কৈলাস বলতো–আজ্ঞে দু’পয়সার বিড়ি–

–বিড়ি?

বিড়ি শুনে চমকে যেতেন কর্তাবাবু। বলতেন–বিড়ি খেয়েছে কে? এবাড়িতে বিড়ি কে খায়?

কৈলাস বলতো-আজ্ঞে ওই যে কাঞ্চন স্যাকরা এসেছিল, সে বিড়ি খেতে চাইলে কিনা, তাই– কর্তাবাবু রেগে যেতেন। বলতেন–কাঞ্চন স্যাকরা বিড়ি খেলে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–তা সে বিড়ি খাক আর গাঁজাই খাক, তার জন্যে আমি পয়সা দেব কেন? তার নেশার খরচ যোগাবার জন্যে আমার কীসের গরজ?

কৈলাস গোমস্তা কিন্তু-কিন্তু করতো। বলতো–আজ্ঞে, সে যে বিড়ি খেতে চাইলে…

কর্তাবাবু বলতেন–না, ওসব চলবে না আমার কাছে, বিড়ি খেতে হয় তো সে নিজের পয়সায় খাক। তুমি এক কাজ করো, ওর’ নামে তো একশো টাকা আগাম বায়না লেখা আছে, ওই জায়গায় ওটা কেটে লিখে রাখো একশো টাকা দু’পয়সা আগাম। আর এবার থেকে যদি আর কখনও বিড়ি খেতে চায় তো তবিল থেকে আর পয়সা দেবে না। বারোয়ারিতলায় পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান আছে, তুমি তাকে দোকান দেখিয়ে দেবে–

কৈলাস মাথা পেতে অপরাধ স্বীকার করে নিত। বলতো–আজ্ঞে, তাই দেব।

এককালে কর্তাবাবু কালীগঞ্জের হর্ষনাথ চক্রবর্তীর গোমস্তাগিরি করেছেন, সুতরাং গোমস্তারা কী রকম করে হিসেবের কারচুপি করে তা তিনি জানতেন। এখন তারই গোমস্তা আবার তেমনি করে হিসেবের কারচুপি করবে তা তিনি বরদাস্ত করতে পারবেন না।

দু’টো তো মাত্র পয়সা। কিন্তু সেই দুটো পয়সার অপব্যয়ও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। এখন এই যে তিনি চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ে আছেন, তিনি জানতেও পারছেন না তার কৈলাস গোমস্তা কত দু’পয়সা হিসেবে কারচুপি করছে।

তবু বাইরে থেকে সবাই ঠিক আছে। ননী ডাক্তার নিয়ম করে আসছে, ওষুধও পড়ছে নিয়মমত। দীনুও সেবা করে যাচ্ছে দিনরাত। আর সে সেবাও ঠিক তেমনি সেবা। নিজের পরিবারও এমন করে কোনও স্বামীকে সেবা করতে পারে না।

অথচ দীনুর কি একটা কাজ! বেয়াই বাড়ি থেকে লোক এল তত্ত্ব নিয়ে, তাদের চান করবার জন্যে তাকেই কুয়ো থেকে জল তুলে দিতে হবে। বিশ্বাস করবার মত নির্ভর করবার মত লোক ওই এক দীনুই। দীনু যে কখন ঘুম থেকে ওঠে, কখন খায় কখন ঘুমোয় তা কেউ দেখতে পায় না। ডাকলেই দীনু এসে হাজির হবে। বলবে–আমাকে ডাকছিলেন আজ্ঞে?

এরই মধ্যে চৌধুরী মশাই সেদিন রানাঘাটের কোর্ট থেকে দৌড়তে দৌড়তে ফিরলেন। তার যেন আর তর সইছিল না। চণ্ডীমণ্ডপে পরমেশ মৌলিক আপনমনে কাজ করছিল। ছোট মশাইকে দেখেই দাঁড়িয়ে উঠলো।

–কী পরমেশ, খবর সব ভালো তো? প্রাণকেষ্ট সা’ মশাই-এর আড়ত থেকে পাটের টাকা দিয়ে গেছে?

পরমেশ মৌলিক বললে–আজ্ঞে, কই, না তো!

–আর ভুবন বসাক? ভুবন বসাক আর এসেছিল?

–আজ্ঞে না।

চৌধুরী মশাই রেগে গেলেন। বললেন–দেখলে, আমি নেই, আর সবাই সাপের পাঁচ পা দেখেছে–

পরমেশ মৌলিক হঠাৎ কথার মাঝখানে বলে উঠলো–আজ্ঞে দারোগাবাবু এসেছিল, পরশু

–দারোগাবাবু? রেল-বাজারের দারোগাবাবু? কেন? আবার পাওনা-গণ্ডা চায় নাকি?

–আজ্ঞে না, তা নয়, বলতে এসেছিলেন খোকাবাবু ধরা পড়েছেন।

–খোকাবাবু? আমাদের সদা? ধরা পড়েছে? তার মানে?

–আজ্ঞে ধরা পড়েছে মানে পুলিসে অ্যারেস্ট করেছে।

–সে কী? কী জন্যে অ্যারেস্ট করেছে সদাকে? কী করেছিল সে?

এত বড় একটা ঘটনা শুনে চৌধুরী মশাই যেন প্রথমে একটু নাড়া খেলেন। দুটো দিন মাত্র বাড়িতে গরহাজির, এর মধ্যে এমন দুর্ঘটনা ঘটে গেল! হঠাৎ নজর পড়লো বৈঠকখানার দিকে। কী হলো? ঘরের দরজা হাট করে খোলা কেন?

আর দাঁড়ালেন না সেখানে। সোজা বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখেন সেখানে কেউ নেই। চারদিকে যেখানকার জিনিস সেখানেই রয়েছে, শুধু বাবাজীই নেই কোথাও। তাঁর খড়ম, ত্রিশূল, গেরুয়া কাপড়খানা পর্যন্ত উধাও হয়ে গেছে।

তারপর কী যেন সন্দেহ হলো। ভেতর বাড়ির দরজা পেরিয়ে ডাকলেন–গৌরী, গৌরী–সব গেলি কোথায়?

.

প্রীতি ঘরের ভেতর নিজের বিছানায় শুয়ে ছিল। নয়নতারা পাশে বসে পাখার হাওয়া করছিল শাশুড়ীকে। অত ঠাণ্ডার মধ্যেও শাশুড়ী ঘামছিল শুয়ে শুয়ে। বড় ভয় করছিল নয়নতারার। এই কদিন আগে তার মা হঠাৎ চলে গেছে। অথছ তার বিয়ের দিনও কেউ কল্পনা করতে পারে নি তার মা এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে। এই ক’টা দিন ধরে তার জীবনে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বাবার কথাও মনে পড়তে লাগলো। বাবা এতক্ষণ বোধ হয় ট্রেনে উঠে বসেছে।

হঠাৎ শাশুড়ী বললে–বউমা—

নয়নতারা শাশুড়ীর মুখের কাছে মুখ এনে বললে–কিছু বলবেন মা?

শাশুড়ী বললে–তুমি আর কেন কষ্ট করছে বউমা, তুমি এবার যাও, নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো গে, গৌরী খেয়ে এখুনি আসছে, তুমি যাও, তোমার কষ্ট হচ্ছে–

নয়নতারা বললে–আমার আর কীসের কষ্ট? আমার তো কিছু কষ্ট হচ্ছে না–

কথাটা শুনে শাশুড়ীর যেন ভালো লাগলো। বললো–আমার বড় সাধ ছিল বউমা যে ছেলের বিয়ে দিয়ে আমি বউ-এর হাতে সেবা নেব, কিন্তু তা আমার কপালে নেই।

নয়নতারা বললে–ও কথা কেন বলছেন মা? আপনার সেবা করতে তো আমার ভালো লাগছে

শাশুড়ী বললে–আমার একটা কাজ করতে পারবে বউমা?

নয়নতারা বললে–বলুন? কী করতে হবে বলুন? জল খাবেন?

শাশুড়ী বললে–না, জল খাবো না। খোকা যখন বাড়িতে আসবে তখন একটা কাজ করতে হবে বউমা তোমাকে। পারবে?

নয়নতারা ভয় পেয়ে গেল। বললে–আপনি বললে নিশ্চয় পারবো। বলুন কী করতে হবে?

শাশুড়ী বললে–-দেখ বউমা, আমার তো কোনও অভাব নেই দেখছো তুমি? মেয়েমানুষ যা চায় আমি সে-সবই পেয়েছি। আমার এই জমজমাট সংসার, আমার স্বামী, আমার সন্তান, আমার গয়নাগাঁটি বাড়ি জমি-জমা টাকাকড়ি কিছুরই অভাব রাখেন নি ভগবান। কিন্তু একটি জিনিস আমি পাই নি বউমা। তোমার শ্বশুরেরও সেই একটাই অভাব। তুমি আমাকে তা দেবে বউমা? দিতে পারবে?

নয়নতারা অবাক হয়ে গেল শাশুড়ীর কথা শুনে। বললে–আমি?

–হ্যাঁ বউমা, তুমিই কেবল আমাকে তা দিতে পারো, আর কেউ দিতে পারে না। আমার বুড়ো অথর্ব শ্বশুর কবে থেকে আশা করে আছেন তার জন্যে। কিন্তু আর বোধ হয় তাঁর সে-আশা পূর্ণ হলো না?

নয়নতারা বললে–বলুন মা, আমাকে কী করতে হবে বলুন–

–কিন্তু তুমি যদি না পারো, তাহলে কী হবে? আমার শ্বশুর অসুখে পড়বার আগে আমাদের এখানকার কাঞ্চন স্যাকরাকে দিয়ে একটা কুড়ি ভরির সোনার হার পর্যন্ত গড়াবার বায়না দিয়েছেন।

তবু নয়নতারা যেন ঠিক জিনিসটা কী তা বুঝতে পারলে না। কিম্বা হয়ত শুধু খানিকটা আন্দাজ করতে পারলে।

শাশুড়ী বললে–কিন্তু খোকার কাণ্ড দেখে আমি বড় ভয় পেয়ে গেছি বউমা, আমার সে সাধ বোধ হয় এ-জীবনে আর মিটবে না—

নয়নতারা এ কথার উত্তরে কিছুই বললে না। যেমন পাখা করছিল তেমনিই পাখা করতে লাগলো। কিন্তু তখন আর সে-পাখার হাওয়া লাগছে না শাশুড়ীর গায়ে।

–কই বউমা, তুমি কোনও কথা বলছো না যে!

নয়নতারা মুখ নিচু করে বললে–আমি কী বলবো বলুন?

শাশুড়ী বললে–তুমি চুপ করে থাকলে আমি কার ভরসায় বেঁচে থাকি বলো বউমা? আর আমার কে আছে? তুমি ছাড়া এ-সাধ আমার কে মেটাবে বলো? দেখছো তো, তোমার মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্যে তোমার শ্বশুর এক বাবাজীকে ধরে কত তুক-তাক, পূজো-যাগ যজ্ঞ হোম করবার ব্যবস্থা করলেন। সেও একটা বুজরুক। বুজরুকের পাল্লায় পড়ে মাঝ থেকে এক গাদা টাকাই নষ্ট হয়ে গেল মিছিমিছি, কোনও ফলই হলো না। উল্টে খোকা কোথায় পুলিসের হাতে কিনা ধরা পড়লো। এখন কী হবে ভগবানই জানেন। কোথায় রইল খোকা আর কোথায় রইলে তুমি

নয়নতারা বললে–আপনি কেন ও নিয়ে ভাবছেন মিছিমিছি মা, তাকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করতে তো উনি গেছেন!

শাশুড়ী বললে–তুমি প্রকাশের কথা বলছো? তাহলেই হয়েছে। এতদিন এ বাড়িতে আছো আর তুমি প্রকাশকে চিনলে না? ওর কথায় কি বিশ্বাস আছে বউমা?

–কিন্তু উনি যে এক হাজার টাকা নিয়ে গেলেন। আমি নিজের হাতে যে ওঁকে সিন্দুক খুলে টাকা বের করে দিলুম, উনি যে বললেন পুলিসকে নাকি ঘুষ দিতে হবে–আমি তো বাবাকে তাই-ই বললুম, বাবাও যে তাই শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেন–

শাশুড়ী বললে–তা খোকা যদি ছাড়া পায় তো ভালই, তারপরে আমার আর তোমার ভাগ্য! কিন্তু আমি যে কথা তোমাকে বললুম তার তো কোনও জবাব তুমি দিলে না বউমা?

–কোন্ কথার জবাব মা?

শাশুড়ী বললে–ওই যে বললুম, আমার বড় সাধ আমি নাতির মুখ দেখবো, একটা কোল আলোকরা নাতি। তুমি আমাকে নাতি দিতে পারবে বউমা? আমি তাকে কোলে নিয়ে আদর করবো,  আমি তাকে চুমু খাবো, আমি তাকে নিয়ে খেলা করবো–দেবে বউমা, দেবে?

কথার মাঝখানেই নয়নতারার পাখাটা হাত থেকে খসে পড়লো। শাশুড়ীর বুকের ওপর মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।

–কী বউমা তুমি কাঁদছো? তুমি পারবে না? আমার একটা মাত্র সাধ তা-ও তুমি মেটাতে পারবে না বউমা?

নয়নতারা শাশুড়ীর বুকে মুখ রেখেই বলতে লাগলো–আপনি আমাকে কেন বউ করে আনলেন মা? এই-ই যদি আপনার মনে ছিল তাহলে অন্য কোনও মেয়েকে ঘরে আনলেন না কেন? সে হয়ত আপনার সব সাধ মেটাতে পারতো…..

শাশুড়ী দু’হাত দিয়ে নয়নতারার মাথায় হাত বুলোত বুলোতে বলতে লাগলো–না বউমা, তুমি আমার বড় লক্ষ্মী বউ, তুমি পারবে, একটু চেষ্টা কোর, তুমিই পারবে বউমা–

নয়নতারা বললে–কিন্তু আমি কী করে পারবো মা? আমার কি অত ক্ষমতা আছে?

শাশুড়ী বলে উঠলো–কেন পারবে না বউমা? তোমার এই রূপ দেখেই তো তোমাকে আমি বউ করে ঘরে এনেছি। তোমাকে ভগবান এত রূপ দিয়েছে আর তুমি কিনা বলছো তুমি পারবো না? আর কিছু না হোক তোমার রূপ দিয়েও তো আমার ছেলেকে ধরে রাখতে পারো! আর তা যদি না পারো তো আমি কী নিয়ে থাকবো? আমার খোকাই যদি বিবাগী হয়ে যায় তো কাকে নিয়ে আমি সংসার করবো তাই বলো?

নয়নতারা মুখ তুললো। বললে–তা আমি কী করবো বলুন, আমাকে দেখলেই যে তিনি মুখ ফিরিয়ে চলে যান–

–তা খোকা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তোমাকে অপমান করবে আর তুমি তা বোবার মত সহ্য করবে? তোমার মুখ নেই? তুমি কথা বলতে জনো না? তুমিও তাকে অপমান করতে পারো না?

নয়নতারা বুঝতে পারলে না কথাটা। বললে–আমি পরের বাড়ির মেয়ে হয়ে এ বাড়ির ছেলেকে অপমান করবো?

–কে বললে তুমি পরের বাড়ির মেয়ে? পরের বাড়ির মেয়ে তুমি যখন ছিলে তখন ছিলে, কিন্তু এখন তুমি এবাড়ির বউ, এবাড়িতে আমার ছেলের যতখানি অধিকার, তোমারও যে ঠিক ততখানিই অধিকার বউমা। তুমি ভুলে যেও না বউমা আমার ছেলে যদি তোমাকে অপমান করে তো সে-অপমান আমার গায়েও লাগে! আমার ছেলে তোমাকে অপমান করবে আমি তা সহ্য করবো না। তোমার জায়গায় যদি আমি হতুম বউমা তো আমি কিন্তু তোমার মত মুখ বুঁজে এ অপমান সহ্য করতুম না। আমি এর একটা হেস্ত-নেস্ত করতুমই–

নয়নতারা বললে–কিন্তু আমি হেস্তনেস্ত করবো কী করে?

শাশুড়ী বললে–সেই কথাই তো তোমাকে বলছি বউমা, সেই কথা বলতেই তো তোমায় আমার কাছে ডেকে এনেছি। তুমি জোর করবে। খোকা যদি জোর করে তোমার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তো তুমিও জোর করে ঘরে আটকে রাখবে–তাও পারবে না তুমি?

–কিন্তু সেদিন তো আপনি বাইরে থেকে দরজায় শেকল দিয়ে দিয়েছিলেন, তবু তো আমাকে উনি অপমান করলেন, সারারাত আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রইলেন—

শাশুড়ী বললে–তা যদি আবার তা করে তো তুমি খোকার হাত ধরে তোমার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেবে। দেখো তখন কী করে! তোমার গায়ে তো আর তা বলে হাত তুলবে না সে! তখন তো আমি আছি–

–আপনি কী বলছেন মা? আমি ওঁর হাত ধরবো? ওঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি কাজ করবো? এর চেয়ে যে আমার মরণও ভালো! মেয়েমানুষ হয়ে এত নিচেয় নামবো?

শাশুড়ী বললে–একে তুমি নিচেয় নামা বলো? তা এতই যদি তোমার উঁচু-নিচু জ্ঞান তো মরতে মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছিলে কেন তুমি? পুরুষ-মানুষ হয়ে জন্মাতে পারলে না? তাহলে আর তোমাকে এই অপমান সইতে হতো না, আর বউ হয়ে পরের বাড়িতেও যেতে হতো না–! আর অপমানের কথা বলছো? এই পড়ে পড়ে মার খাওয়া বুঝি অপমান নয়? এ-অপমানের চেয়ে তো অন্তত সে-অপমানও ভালো! তাতে তোমার কী এমন গায়ে ফোস্কা পড়বে?

নয়নতারা অসহায়ের মত শাশুড়ীর দিকে চাইলে। বললে–তাহলে আমাকে কী করতে বলেন আপনি বলুন? আপনি যা করতে বলবেন আমি তাই-ই করবো, বলুন–

শাশুড়ী নয়নতারার থুতনিতে হাত দিয়ে আদর করলে। যেন বড় খুশী হয়েছে প্রীতি। বললে–এই তো লক্ষ্মী বউ-এর মত কথা। তবে শোন বউমা, প্রকাশ আজ হোক কাল হোক যখন খোকাকে নিয়ে আসবে আমি খোকাকে বলে দেব বউমাকে তার বাবা এসে কেষ্টনগরে নিয়ে গেছেন। আমি তোমার শ্বশুরকে, মামাশ্বশুরকেও সেই কথাই বলবো। তারাও জানবে যে তোমার বাপ এসে কেষ্টনগরে নিয়ে চলে গেছেন, বুঝলে?

নয়নতারা অবাক হয়ে গেল। বললে–কিন্তু আমাকে যে দেখতে পাবে সবাই—

শাশুড়ী বললে–তোমাকে দেখতে যাতে না পায় তারই ব্যবস্থা করবো

–কী ব্যবস্থা করবেন আপনি?

শাশুড়ী বললে–আমি তোমাকে একটা ঘরে লুকিয়ে রাখবো, যাতে তোমাকে কেউ দেখতে না পায়–

নয়নতারা জিজ্ঞেস করলে-কেউ দেখতে পাবে না আমাকে?

শাশুড়ী বললে–তোমাকে দেখতে তো পাবেই না, আর জানতেও পারবে না যে তুমি এবাড়িতে আছে। আর গৌরী, বিষ্ঠুর মা, ওরা আমার হাত ধরা লোক, আমি যদি বলে দিই ওদের গলা টিপে মেরে ফেললেও ওরা কখনও সত্যি কথা বলবে না–

নয়নতারা বললে–কিন্তু বাবা মামাবাবু–ওঁরা তো ভেতর-বাড়িতে আসবেন, ওদের নজরে যদি পড়ে যাই?

শাশুড়ী বললে–আমি তো বলছি সে-ব্যবস্থা আমি করবো, সে তোমাকে ভাবতে হবে না–তোমার ঘরের পাশে যে-ঘরটা আছে আমি তোমাকে সেখানে রেখে দিয়ে বাইরে থেকে তালা-চাবি লাগিয়ে দেব। কিন্তু তুমি বলো আমি যা বলেছি তোমাকে তা তুমি করতে পারবে?

নয়নতারার কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। রূপ দেখিয়ে জোর করে স্বামীর ভালবাসা আদায় করতে হবে, নিজেকে অপমান করার এর চেয়ে নীচ পদ্ধতি আর কী থাকতে পারে!

শাশুড়ী বললে–কী ভাবছো বউমা? স্বামীকে বশ করার জন্যে এর চেয়ে কত নিচু কাজ মেয়েমানুষকে করতে হয় তা তুমি জানো না? রামায়ণ-মহাভারতে পড়ো নি? আর আমার সংসারের ভালোর জন্যে, তোমার আমার সকলের ভালোর জন্যে তুমি এইটুকুও করতে পারবে না?

নয়নতারা বললে–আমি চেষ্টা করবো মা, আমি পারতে চেষ্টা করবো ঠিক এই সময় বাইরে চৌধুরী মশাই-এর গলার শব্দ শোনা গেল–গৌরী, গৌরী।

শাশুড়ী তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো। বললে–চলো বৌমা, তোমার শ্বশুর এসেছেন, শিগগির এখান থেকে চলো–নইলে তোমাকে ওঁরা দেখে ফেলবেন–

বলে নয়নতারাকে নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে কোণের একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে। তারপর বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিলে।

গৌরী ততক্ষণে চৌধুরী মশাই-এর গলা পেয়ে সামনে এসেছে।

চৌধুরী মশাই গৌরীকে দেখেই বললেন–কী রে, কারোর যে সাড়াশব্দ পাচ্ছিনে, বাবাজীর ঘর হাট করে খোলা, কোথায় গেল সব? খোকাকে নাকি পুলিস ধরেছে? আমি দুদিন বাড়িতে নেই এরই মধ্যে এতকাণ্ড ঘটে গেল–

গৌরী বললে–বউদির অসুখ–

–বউদির অসুখ? সে কী? কী অসুখ হলো আবার? কখন অসুখ হলো?

বলতে বলতে চৌধুরী মশাই নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন। প্রীতি ততক্ষণে আবার নিজের ঘরের বিছানায় এসে চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়েছে।

চৌধুরী মশাই বললেন–কী হলো, তোমার নাকি অসুখ?

প্রীতি বললে–হ্যাঁ, শরীর খারাপ—

চৌধুরী মশাই বললেন–তোমার আবার এই সময়ে শরীরটা খারাপ হলো? সময়টা আমার খুবই খারাপ চলছে দেখছি। ওদিকে খোকাকে নাকি পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে? ব্যাপারটা কী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবাজীই বা কোথায় গেলেন?

প্রীতি বললে–সেই সব ভেবেই তো আমার শরীর খারাপ হয়েছে। তুমি আগে হাত মুখ ধুয়ে এসো আমি বলছি

কিন্তু খোকাকে পুলিসে ধরলো কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রকাশই বা কোথায় গেল?

প্রীতি বললে–-সে গেছে কলকাতায়।

–কলকাতায় কেন?

–খোকাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে। পুলিস তাকে ধরে কলকাতায় নিয়ে গেছে। তুমি এত দূর থেকে এলে, হাত মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হয়ে এসো, আমি সব বলছি–

চৌধুরী মশাই বললেন–তার আগে আমি একবার ওপরে গিয়ে বাবাকে দেখে আসি–

বলে বাইরে চলে গেলেন। চৌধুরী মশাই চলে যেতেই গৌরী ঘরে ঢুকলো। প্রীতি বললে–গৌরী, এদিকে আয়, একটা কথা শোন, কাউকে বলিস নি যেন। বউমাকে আমি উত্তরের কোণের ঘরে লুকিয়ে তালাবন্ধ করে রেখেছি, বুঝলি? কেউ যেন না জানতে পারে! ছোট মশাই কি কেউ যদি জিজ্ঞেস করে বলবি বউমার বাবা এসে বউমাকে কেষ্টনগরে নিয়ে গেছে, বুঝলি? বিষ্টুর মা’কেও তাই বলে দিবি–

গৌরী বললে–কেন বউদি, কী হয়েছে?

প্রীতি বললে–তোর অত সাত-সতেরোয় দরকার কী? আমি যা বলছি তাই করবি, বুঝলি?

.

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই সদানন্দ চারদিকে চেয়ে দেখলে। এ কোথায় এসেছে সে! কোথায় রাত কাটিয়েছে! কাদের বাড়ি!

এক মুহূর্তে আগের দিনের ঘটনাটা সব মনে পড়ে গেল। অত দেরিতে তখন আর নবাবগঞ্জে ট্রেন ছিল না, তাই পুলিসের হাজত-ঘর থেকে প্রকাশ মামা এখানে এনে তুলেছিল তাকে। প্রকাশ মামা বলেছিল–তোর কিছু ভাবনা নেই, কলকাতা শহরে রাত কাটাবার জায়গার অভাব নেই। ভাত ছড়ালে আবার কাকের অভাব? আমার ট্যাঁকে টাকা রয়েছে, ভাবনাটা কীসের?

বলে এখানে নিয়ে এসেছিল তাকে। মনে আছে চারদিকের আবহাওয়া দেখে সদানন্দর কেমন সন্দেহ হয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল–এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি আমাকে?

প্রকাশ মামা বলেছিল–এ জায়গার নাম কালীঘাট–

তারপরে তাকে এক টিনের চালের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উঠিয়েছিল। ছোট-ছোট মাপের সব টিনের চালের বাড়ি চারদিকে। মাঝখান দিয়ে সরু সরু গলি-রাস্তা। চারদিকে গিশ-গিশ করছে লোকজন। জনা কয়েক মেয়েমানুষও ঘুরে বেড়াচ্ছে আশে-পাশে। মাথা নিচু করে ঘরের ভেতরে ঢুকতে হয়। ঘরের ভেতরে সাজানো-গোছানো একটা ডবল-খাট, মুখ দেখবার বড় আরশি।

প্রকাশ মামা বললে–দাঁড়া, আগে খাবার ব্যবস্থা করে আসি–

বলে প্রকাশ মামা তাকে রেখে কোথায় বেরিয়ে গেল। তারপর কোথা থেকে একটা লোককে ধরে নিয়ে এল। তার হাতে দু’থালা ভাত তরকারি।

প্রকাশ মামা বললে–আয়, বসে পড়, আগে পেট ঠাণ্ডা করি।

বলে নিজেই মাটিতে খেতে বসে পড়ল। সদানন্দও পাশে বসলো। কিছু তো খেতে হবে। কিন্তু ভাত মুখে দিতেই যেন সমস্ত ক্ষিদে চলে গেল এক মিনিটে। যেমন ঝাল আর তেমনি ঠাণ্ডা! বহুদিন পরে এই কালীঘাটের টিনের বস্তিতে রাত কাটানোর স্মৃতিটা বহুবার সদানন্দর মনে পড়েছে। জীবনের উত্তরকালে যাকে একদিন আসামী হয়ে জীবন কাটাতে হবে তার পক্ষে এই শিক্ষানবিশিটা বোধ হয় দরকার ছিল। দরকার ছিল এই কৃচ্ছ্রসাধনের। ধনীর সন্তান হয়েও তার যে সে ধনের ওপর একদিন কোনও অধিকার থাকবে না এটাই বোধ হয় ছিল তার সৃষ্টিকর্তার বিধান। তাই কোনও অপরাধ না করেও যেমন কালীগঞ্জের বউকে খুন হতে হলো, কোনও পাপ না করেও কপিল পায়রাপোড়াকে যেমন বারোয়ারিতলার বটগাছে গলায় দড়ি দিতে হলো, তেমনি কোন অন্যায় না করেও তাকে একদিনের জন্যেই হাজত-ঘরে কাটাতে হলো। জন্মালেই যেমন মানুষকে মরতে হয় তেমনি মরবার জন্যেই মরবার আগে মানুষকে অনেকবার মরতে হয়। বার বার মরে মরে মরবার শিক্ষানবিশি করতে হয় মানুষকে। এও সেই শিক্ষানবিশির মতন। এ শিক্ষানবিশি না করলে ভালো করে মরতে পারবো কেন? ভালো করে বাঁচবার জন্যে যেমন শিক্ষানবিশি দরকার, মরবার জন্যেও তেমনি। তোমার পৈতৃক অনেক টাকা আছে স্বীকার করি, কিন্তু সেই টাকা, সেই ঐশ্বর্য তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে কি রক্ষা করতে পারবে? তার চেয়ে আগে থেকেই তৈরী হয়ে নাও। যেন মরবার সময় মুখে হাসি ফোটাতে পারো।

আজ যে সদানন্দ রসিক পালের কাছারিবাড়িতে পরান্নভোজী, সেদিনের সেই ছোটবেলার সদানন্দও ঠিক তাই-ই ছিল। তখনও ছিল সে পরান্নভোজী। বাড়ি তার বাড়ী নয়, বাবা তার বাবা নয়, মা–ও তার মা নয়, স্ত্রীও তার স্ত্রী নয়। অথচ সবাই-ই তার আপন। সবাই-ই তার আপনার জন।

প্রকাশ মামা হঠাৎ বলে উঠলো–কী রে, খাচ্ছিস না যে, আর একটা মাছ নিবি?

প্রকাশ মামা যখন খেতো তখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে বসে থাকতো। এক-একজন মানুষ থাকে সংসারে যারা বোধ হয় পৃথিবীতে খাবার জন্যই বাঁচে। আবার এমন লোকও থাকে যারা বাঁচার জন্যই খায়। কিন্তু প্রকাশ মামা খেতো শুধু খাবার জন্যেই। নিজে খাবে শুধু তাই-ই নয়, পরকেও খাওয়াবে। বউ-ছেলে-মেয়েকে খাওয়াবে, রাণাঘাটের বাজারের রাধাকে খাওয়াবে। যাকে সামনে পাবে তার সঙ্গে মিলে-মিশে খাবে। যদি সদানন্দর মা না থাকতো তাহলে বোধ হয় প্রকাশ মামা না খেতে পেয়েই মরতো।

খাওয়া সেরে উঠে প্রকাশ মামা তাকে শুতে বলে কোথায় যেন চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল–তুই এই খাটে শুয়ে ঘুমো রে, আমি পাশের ঘরে আছি

তিন রাত ঘুমোয় নি সদানন্দ। তার ওপর সেই বিয়ের দিন থেকেই উদ্বেগ চলেছে মনের ভেতরে। ক্লান্তিতে চোখ দুটো জুড়ে আসছিল। হঠাৎ কোথায় যেন হারমনিয়ামের সঙ্গে গানের সুর ভেসে এল। এ কোথায় নিয়ে এল তাকে প্রকাশ মামা! এ কার বাড়ি! প্রকাশ মামার সঙ্গে এদের সম্পর্কই বা কী!

হঠাৎ কে যেন ঘরে ঢুকলো। তখন বেশ তন্দ্রা এসেছে সদানন্দর চোখে। তবু পায়ের আওয়াজ কানে এসেছে।

সদানন্দ ঝাপসা অন্ধকার চেয়ে দেখলে একজন মেয়েমানুষ। মেয়েটা সোজা খাটের ওপর শুতে গিয়ে একেবারে সদানন্দর গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। পড়েই চিৎকার ওমা, আমার খাটে কে শুয়ে গো, এখানে কে?

যেন কেউটে সাপের ওপর পা পড়েছে এমনি ভাবে আঁতকে উঠে মেয়েটা দাঁড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার তার গায়ের ওপর ধপাস করে পড়লো। তারপর চিৎকার করে উঠলো–ও মাসি, দেখ তো গো, কে এখানে আমার খাটে শুয়ে রয়েছে–

মেয়েটার চিৎকার শুনে বাইরে থেকে কার গলা কানে এল–কী হলো রে বাতাসী, কী হলো? কে ধরেছে রে তোকে? কে? কোন্ হারামজাদা?

বলতে বলতে হাতে লম্ফ নিয়ে মাসি ঘরে ঢুকলো। কিন্তু ততক্ষণে বাতাসী নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। লম্ফর আলোয় ঘরটা তখন আলো হয়ে গিয়েছে। মাসি ভালো করে চেয়ে দেখল সদানন্দর দিকে। বাতাসীও চেয়ে দেখলে। একেবারে অচেনা লোক।

মাসি সদানন্দকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও চিনতে পারলে না। বাতাসীও চিনতে পারলে না। অচেনা লোক, বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে তার ঘরে এসে ঘাপটি মেরে শুয়ে রয়েছে।

মাসি জিজ্ঞেস করলে-তুমি কে গা? কে তোমাকে এ ঘরে এনে বসালে? বেরোও ঘর থেকে, বেরোও

সদানন্দ ততক্ষণে উঠে বসেছে। দুজনের চেহারা দেখে কেমন সন্দেহ হলো। বললে–আমাকে এক ভদ্রলোক নিয়ে এসেছে এখানে। এখানে শুতে বলে বাইরে গেছে–

–ভদ্দরলোক? ভদ্দরলোক আমাদের এখানে আসে নাকি যে ভদ্দরলোকের কথা বলছো? আর কোথা থেকে কে একজন তোমাকে এখানে এনে শুইয়ে দিলে আর তুমিও শুয়ে পড়লে? এ কি ঘুমোবার জায়গা? এখানে কি কেউ ঘুমোতে আসে?

চেঁচামেচি শুনে আরো দু’চারজন মেয়ে এসে হাজির হলো। তারাও সদানন্দকে দেখে অবাক। বললে–এ কে গা মাসি? কার লোক?

মাসি বললে–কে জানে বাছা, ঘর খালি পেয়ে নাকি ঘুমোচ্ছে এখেনে–এখুনি যদি বড়বাবু এসে পড়ে–

কথাটা শুনে সবাই খিল্ খিল করে হেসে উঠলো। ঘুমোবার কথা শুনে সবারই হাসি পেল। এত বড় কলকাতা শহরে ঘুমোবার আর জায়গা পেলে না, ঘুমোতে এলো কিনা এখানে?

সদানন্দর তখন প্রায় অসহ্য হয়ে উঠছিল। চারপাশের এই আবহাওয়া দেখে বুঝতে পারলে প্রকাশ মামা তাকে কোথায় এনেছে। বললে–আমি যার সঙ্গে এসেছিলুম সে কোথায়?

মাসি জিজ্ঞেস করলে–কার সঙ্গে এসেছিলে তুমি? কার কথা বলছো?

সদানন্দ বললে–আমার মামা।

মাসি বললে–মামা? তা তোমার মামা কোন্ ঘরে আছে আমি জানবো কী করে বাছা? বাড়িতে কি একটা লোক? কত ঘরে কত লোক আছে তার হিসেব রাখা কি সোজা? তা তুমি বাছা বাতাসীর ঘরে থাকবে। থাকবে তো বলো! পাঁচ টাকা লাগবে। রাজি থাকো তো থেকে যাও, আমার কোনও আপত্তি নেই–

সদানন্দ সেকথার উত্তর না দিয়ে বললে–আমার কাছে টাকা নেই। আর টাকা থাকলেও আমি থাকতুম না। আমি একবার আমার মামার সঙ্গে কথা বলতে চাই–

মাসি বললে–তোমার মামা কার ঘরে আছে তা আমি কী জানি!

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমার মামা যে বলে গেল পাশের ঘরে থাকবে–

মাসি বললে–তোমার মামাও যেমন তুমিও তেমনি। তা খালি পকেটে তোমরা কেন আসো বাছা এখানে?

সদানন্দ বললে–তাহলে আমাকে এখান থেকে চলে যেতে দিন আমি চলে যাই–

মাসি বললে–চলে যাবে মানে? চলে ওমনি গেলেই হলো? ঘর-ভাড়া কে দেবে শুনি? বাতাসীর ঘর-ভাড়া বাতাসী নিজের গাঁট থেকে দেবে নাকি? আমি তোমার কাছ থেকে আগে ঘর-ভাড়া আদায় করবো তবে ছাড়বো। নইলে এখুনি পুলিস ডাকবো–

তারপর পাশের একটা মেয়ের দিকে চেয়ে বললে–যা তো লা পুঁটি, গিরিধারীকে একবার ডেকে নিয়ে আয় তো–যা তো–

সদানন্দ এবার সোজা দরজার দিকে এগিয়ে এল। বললে–পুলিসের ভয় দেখাবেন না আমাকে, আমি পুলিসকে ভয় করি না। টাকা আমার কাছে নেই, আমাকে যেতে দিন–

বাতাসী তখন ভয় পেয়ে গিয়েছে। হাউ-মাউ করে চিৎকার করে উঠলো–ও মাসি, তোমাকে মারবে, তুমি সরে যাও

–ইঃ, মারবে! অমনি মারলেই হলো! টাকা না দিয়ে চলে গেলে আমি পাড়ার লোক ডেকে জড়ো করবো না! তুই অত ভয় পাচ্ছিস কেন লা? বড়বাবুকে খবর দিলে এখখুনি কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাবে না–

ততক্ষণে চেঁচামেচিতে আরো লোক জড়ো হয়ে গেছে সেখানে। রাত তখন কত হয়েছে কে জানে। সবাই কিল-বিল করতে করতে এসে হাজির হলো সেখানে। সকলের একই প্রশ্ন কী হয়েছে মাসি? কী করেছে লোকটা?

মাসি বললে–দ্যাখ না মেয়ে, বাতাসীর ঘরে বসলো, এতক্ষণ বসে বসে মদ গিললো, এখন চুপি চুপি পালিয়ে যাচ্ছে, বলে কিনা ট্যাকা নেই। ট্যাকা নেই তো ফুর্তি মারতে এখানে এসেছিলে কেন শুনি? শখ-টখ করে এখন ট্যাকা নেই বললে–তোমাকে ছাড়বো কেন? এ কি ঘরের বিয়ে করা বউ পেয়েছ তুমি?

সদানন্দ আর সহ্য করতে পারলে না। সকলকে ঠেলে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। বললে–পুলিশ আপনাদের ডাকতে হবে না, তার আগে আমিই পুলিস ডাকবো।

ততক্ষণে গিরিধারী এসে গিয়েছিল। তাকে আর কিছু বলতে হলো না। সে এসেই সদানন্দর গলা টিপে ধরেছে–চুপ কর শালা মাতাল–

কিন্তু তার কথাটা শেষ হবার আগেই সদানন্দ তাকে এক ধাক্কা দিয়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে সে উঠোনের ওপর গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আর বাড়ির মেয়েরা সবাই মিলে পাড়া কাঁপিয়ে মড়াকান্না জুড়ে দিল। আশেপাশের যত বাড়িতে যত মেয়ে ছিল সবাই এসে হাজির–কী হয়েছে লা? কী হয়েছে তোদের বাড়িতে?

সদানন্দ তখন চিৎকার করে বলে উঠলো–আমার সামনে যে আসবে তারই ওই দশা করবো–ছাড়ো–পথ ছাড়ো–

গিরিধারীকে ধরাশায়ী দেখে সবাই-ই ভয় পেয়ে গিয়েছিল তখন। কিন্তু মাসির ভয় করা চলে না। সে এ-সব ঝামেলা আগে অনেক সামলেছে। সে আর কোনও উপায় না পেয়ে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো–ওগো, তোমরা সবাই এসে দেখে যাও গো, লোকটা মেয়েমোনুষের টাকা না দিয়ে পালাচ্ছে–

সদানন্দ যদিও বা চলে যেত কিন্তু চলে যেতে গিয়েও তখন থমকে দাঁড়ালো। বললে–হ্যাঁ, আসুক সবাই, আমি এই এখানে দাঁড়িয়ে রইলুম–

বললে–আরো লোকজনের অপেক্ষায় সেই উঠোনের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আবার বললে–কই, কোথায় সব? কেউ আসছে না কেন?

মাসি আবার চেঁচালে–কই গো, তোমরা কে কোথায় আছো এসো, আসামী পালাচ্ছে–

এবার দু’চারজন গুণ্ডা গোছের লোক কোত্থেকে এসে হাজির হলো। বললে–কী হয়েছে মাসি? কোন্ শালা পালাচ্ছে? কোথায় সে?

মাসিকে আর দেখাতে হলো না। সদানন্দ নিজেই বলে উঠলো–এই যে আমি!

একজন সঙ্গে সঙ্গে সদানন্দর গলা ধরবার জন্যে এগিয়ে এসেছে। পেছনের তিনজনও সঙ্গে রয়েছে।

সদানন্দ বললে–খবরদার, সামনে এগোবে না, যা বলবার ওখান থেকে বলো–

–তবে রে!

সে এক হই-হই কাণ্ড বেধে গেল সেই রাত্রে। একদিকে মেয়েমানুষের কান্না, আর একদিকে পুরুষমানুষের পাড়া কাঁপানো কথা কাটাকাটি। আর একটু হলেই হয়ত খুনোখুনি কাণ্ড ঘটে যেত। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে প্রকাশ মামা এসে হাজির। অন্ধকারে প্রকাশ মামাকে ভালো করে চিনতে পারে নি। একটা গেঞ্জি গায়ে, পরনে লুঙ্গি। মাথার চুল উসকো-খুসকো। পা দুটোও ঠিকমত মাটিতে পড়ছে না। কথাগুলোও স্পষ্ট নয়। সেই অবস্থাতেই টলতে টলতে এসে হাজির। গণ্ডগোলের আন্দাজ পেয়ে বাইরের উঠোনে এসেছিল। সেখান থেকে সদানন্দকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে কাছে এসেছে। এসেই সদানন্দর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ঘুষি বাগিয়ে চিৎকার করে উঠলো–দেখি কোন শালা মারে আমার ভাগ্নেকে, আয় শালারা, লড়ে যাবি আয়–

বলে শুন্যের মধ্যে ঘুষি ঘোরাতে লাগল।

সদানন্দও প্রকাশ মামাকে দেখে অবাক। এতক্ষণ যারা আস্ফালন করছিল তারাও তখন চুপ। মাসি এতক্ষণে এগিয়ে এল। বললে–এই কি তোমার ভাগ্নে নাকি বাবা! তা সে কথা তো তোমার ভাগ্নে বলে নি এতক্ষণ!

প্রকাশ মামা বললে–কে আমার ভাগ্নের গায়ে হাত তুলেছে শুনি, কোন্ শালা হাত তুলেছে আমি তার নাম জানতে চাই–

সদানন্দ বলে উঠলো–প্রকাশ মামা, আমি আর এখানে থাকবো না—

প্রকাশ মামা চেঁচিয়ে উঠলো সদানন্দের কথা শুনে তার মানে? থাকবি না মানে? আমি টাকা দিই নি? আলবৎ থাকবো। আমাদের হক আছে থাকবার। আমি ঘর-ভাড়ার টাকা দিইচি চলে যাবার জন্যে? আমি আমার ঘর-ভাড়া দিইচি, তোর ঘর ভাড়া দিইচি, আমি কি মুফোৎ আছি নাকি এখানে?

তারপর মাসির দিকে চেয়ে বললে–কী হলো মাসি, তুমি চুপ করে আছো যে? তোমার মুখে কথা নেই কেন? আমি তোমাকে টাকা দিয়েছি কিনা বলো! বুকে হাত দিয়ে বলো তুমি! আমি তোমায় ঘর ভাড়ার টাকা, মালের টাকা আগাম মিটিয়ে দিই নি?

ততক্ষণে সমস্ত আবহাওয়াটা যেন একেবারে উল্টে গেছে। ঘটনাটা বেশি দূর গড়ালো না দেখে সবাই যেন বিমর্ষ হয়ে যে-যার কাজে চলে গেল। গুণ্ডাগুলোও কখন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু প্রকাশ মামার তখনও রাগ থামে নি। তার ভাগ্নের অপমান যেন তার গায়েও লেগেছে। বললে–আমিও আর থাকবো না এখানে। আমিও চলে যাবো, চল সদানন্দ, এ বাড়িতে আর জীবনে আসবো না, এই বলে রাখলুম–চল-ভাত ছড়ালে কাকের অভাব? বাজারে কি মেয়েমানুষের আকাল পড়েছে?

বলে সেখানে দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো রাধা, তুইও চলে আয়, এখুনি চলে যাবো এখান থেকে, এ কলকাতা শহর, টাকা ফেললে এখানে ফুর্তি মারবার জায়গার অভাব?

রাধা! ওদিকের কোন্ ঘর থেকে একটা মেয়েমানুষ ঘোমটা দিয়ে এসে হাজির হলো প্রকাশ মামার সামনে। সদানন্দ ভালো করে নজর করে দেখলে চিনতে পারলে রাধাকে। সেই রাণাঘাটের সদরের বাজারে থাকতো। প্রকাশ মামা তাকে নিয়ে গিয়েছিল রাধার বাড়িতে। সে এখানে এল কী করে?

মাসি বললে–তুমি রাগ করছো কেন বাবা? আমি কি জানতুম ও তোমার ভাগ্নে!

প্রকাশ মামা বললে–চিনতে না পারলেই তুমি অপমান করবে তাকে? জানো, ও কত বড়লোকর ছেলে? তোমার মত হাজারটা মাসিকে ও পুষতে পারে তা জানো?

মাসি বললে–তা চিনতে না পারলে কী করবো বাবা? ওকে বাতাসীর ঘরেই বা তুমি রেখে দিয়েছিলে কেন? জানো তো ও বড়বাবুর বাঁধা মেয়েমানুষ। বড়বাবু নিজে ওকে এখানে এনে রেখে গেছে–

প্রকাশ মামা বললে–ও-ঘরে কেউ থাকে তা আমি জানবো কী করে? আগে যখন এসেছি তখন তো ও-ঘরটা বরাবর খালি পড়েই থাকতো। আমি কি আজকে প্রথম আসছি তোমার বাড়িতে? আমি সব সইতে পারি কিন্তু অপমান আমার ধাতে সয় না–আমার ভাগ্নেকে তুমি অপমান করেছ, আমি তা সইবো না। চল রাধা, আমার কাপড়টা দে, আমি এখানে আর থাকছি না–

মাসি আর থাকতে পারলে না তখন। প্রকাশ মামার হাত দুটো খপ করে ধরে ফেললে। বললে–আমার ঘাট হয়েছে বাবা, তুমি কিছু মনে কোর না। তুমি থাকো–

প্রকাশ মামা বললে–না, আমি কিছুতেই থাকবো না–আমার রাগ তুমি জানো না, রাগ হলে আমি কারোর নই–

রাধা বললে–হ্যাঁ গো, মাসি এত করে বলছে থাকো না–আমি যে তোমাকে বলেছিলুম কালীঘাটের মন্দিরে মায়ের পূজো দেব, কালীঘাটের গঙ্গায় চান করবো–

–তুই থাম মাগী! আগে তোর গঙ্গাচ্চান না আগে আমার ভাগ্নে? দেখছিস আমার ভাগ্নেকে অপমান করেছে মাসি, আর এখন কিনা তোর গঙ্গাচ্চানটাই বড়ো হলো? তোরা বাজারের মেয়েমানুষ, তোদের আবার গঙ্গাচ্চান কী হবে রে? তোদের পাপ কোনওকালে ঘুচবে ভেবেছিস?

কিন্তু মাসি ছাড়লে না। প্রকাশ মামার হাত দুটো ধরে বলতে লাগলো–তুমি রাগ কোর না বাবা, আমি বুড়োমানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলেছি, তুমি চলো। তোমার ভাগ্নেকেও আমি যেতে দেব না, আমি বাতাসীকে বলে দিচ্ছি তোমার ভাগ্নেকে তার ঘরে বসাবে। আগে তো ঘরখানা খালি পড়েই থাকতো, এই কমাস হলো বড়বাবু বাতাসীকে এনে ওখানে তুলেছে

প্রকাশ মামা সদানন্দর দিকে চাইলে। বললে–কী রে? থাকবি তুই? এরা এত করে বলচে।

সদানন্দ বললে–না, আমি আর থাকবো না এখানে–

মাসি বললে–কিন্তু এত রাত্তিরে কোথায় যাবে বাবা? গাড়ি-ঘোড়া বাস-ট্রাম তো বন্ধ সব! রাত্তিরটা অন্তত আমার এখানে কাটাও, তোমার মামা আমার পুরোন খদ্দের, খদ্দের হলো গিয়ে লক্ষ্মী, তোমরা চলে গেলে আমার কি ভালো হবে বাবা বলতে চাও? আমার অকল্যেণ হয় তাই কি চাও বাবা তোমরা?

প্রকাশ মামাও বললে–ওরে, যাকগে, যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে–তুই থেকে যা, একটা রাত্তিরের তো মামলা, কাল ভোরবেলা উঠেই ট্রেন ধরে নবাবগঞ্জে চলে যাবো–

কিন্তু কথার মধ্যেই বাধা পড়লো। বাইরের দরজায় যেন কারা এসে হাজির হলো। মাসি ভেতর থেকেই বলে উঠলো–কে গো? কে ওখানে?

কিন্তু তার আগেই গিরিধারী দৌড়ে এসেছে–মাসি, বড়বাবু এসেছে–

বড়বাবু কথাটা শুনেই মাসি যেন কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলো। বললে–ওমা, বড়বাবু? নিয়ে আয়, নিয়ে আয়, ভেতরে ডেকে নিয়ে আয়–

সঙ্গে সঙ্গে এক ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলো। বেশ লম্বা-চওড়া দশাসই চেহারা। পায়ের জুতো মশ মশ আওয়াজ করছে। কোট-প্যান্ট পরা ভব্যসভ্য মানুষ। মুখে সিগারেট। গায়ে ভুরভুর করছে মদের সুগন্ধ।

মাসি সামনে গিয়ে যেন একেবারে জুজু হয়ে দাঁড়ালো। বললে–আসুন বড়বাবু, কী ভাগ্যি আমার, আপনার চরনের ধুলো পড়লো আমার বাড়িতে–আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলুম–

বড়বাবু কোনও দিকে না চেয়ে জিজ্ঞেস করলে–বাতাসী আছে?

মাসি বললে–আছে বইকি বড়বাবু, বাতাসী আপনার জিনিস, যাবে আবার কোথায়? আসুন, আসুন–

তারপর চেঁচিয়ে ডাকলে–ওলো ও বাতাসী, কোথায় গেলি রে? কে এসেছে দ্যাখসে, তোর বাবু এসেছে–

বড়বাবু সদানন্দ প্রকাশ মামা রাধা সকলকে পাশ কাটিয়ে সোজা বাতাসীর ঘরের দিকে চলতে লাগলো। সামনে দিয়ে যাবার সময় সদানন্দ হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখটা দেখেই চমকে উঠেছে। এ সেই পুলিস ইনসপেক্টরটা না? এই লোকটাই তো তাকে থানার হাজতে বার বার জেরা করেছিল। এই লোকটাই তো তাকে জেরা করতে গিয়ে কখনও শাসিয়েছিল, কখনও ভয় দেখিয়েছিল, কখনও লোভ দেখিয়েছিল, আবার কখনও মিষ্টি কথা বলেছিল। আসলে কি এরাও সব এই রকম। এইসব লোক দিয়েই কি এরা চোর-ডাকাত-গুণ্ডা ধরবে? এরাই রাজত্ব চালাবে? রেলবাজার কিম্বা নবাবগঞ্জের সঙ্গে তাহলে কলকাতা শহরের কোনও তফাৎ নেই!

প্রকাশ মামার গলা শোনা গেল হঠাৎ–কী রে, কী দেখছিস? দেখলি তো কত বড় বড় লোক সব এখেনে আসে? দেখতে টিনের চালের বাড়ি হলে কী হবে, এখেনে যারা আসে তারা সবাই আমাদের মত ভদ্রলোকের ছেলে, জানিস? তোকে আমি বাজে জায়গায় নিয়ে এসেছি ভাবিস নি-একেবারে খানদানি বাড়ি–

কিন্তু সদানন্দর কানে এসব কথা ঢুকলো না। তার মাথায় তখন অন্য কথা ঘুরছে। আগে প্রকাশ মামার ওপর তার ঘেন্না হচ্ছিল। কিন্তু প্রকাশ মামা তাকে এখানে না নিয়ে এলে তো সে এই শহরের আর একটা দিক দেখতেও পেত না। জানতেও পারতো না যে দিনের বেলা যাদের দেখে মানুষ শ্রদ্ধা করে, ভয় পায়, সমাজের গণ্যমান্য বলে মাথা উঁচু করে বেড়ায়, রাত্রের অন্ধকারে তাদের আর এক চেহারা, আর এক রূপ! আর এক প্রবৃত্তি।

.

উত্তরের কোণের ঘরের ভেতরে নয়নতারা তখন চুপ করে বসেছিল। ঘরটা এমনি একটা বাড়তি ঘর। কেউ থাকেও না কখনও। থাকবার দরকারও হয় না। এককালে কর্তাবাবু যখন এবাড়ি করেছিলেন তখন ভেবেছিলেন ছেলে-মেয়ে-নাতনিতে তাঁর ঘর ভরে যাবে। কিন্তু তাঁর নিজের সন্তান বলতে হলো ওই একটা মাত্র। তা এক ছেলেই কি কম! সেই এক ছেলের ছেলে-মেয়ে হলেও তো বাড়ি ভরে যাবার কথা। কিন্তু তাও হলো না। হলো মাত্র একটি নাতি। ওই সদানন্দ যখন হলো তখন মস্ত ঘটা করে অন্নপ্রাশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তারপর আরো ক’বছর কাটলো। বছরের পর বছর গড়িয়ে গেল। কিন্তু আর কোনও সন্তান হলো না ছেলের। কর্তাবাবুর ঘরবাড়িও আগেকার মতই ফাঁকা পড়ে রইলো।

সন্ধ্যেবেলার দিকে একবার চুপি চুপি শাশুড়ী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো।

বললে–বউমা, তোমার ভয় পাচ্ছে না তো?

নয়নতারা বললে–না মা–

শাশুড়ী বললে–ভয় পেও না, আমি বাইরেই আছি। খোকা তো এখনও এল না, প্রকাশেরও তো দেখা নেই–

নয়নতারা জিজ্ঞেস করলে–আপনি কেমন আছেন?

–আমার কথা ছেড়ে দাও বউমা। আমি নিজের কথা আর ভাবছি না। তোমার শ্বশুর রাণাঘাট থেকে এসে জিজ্ঞেস করছিলেন তোমার কথা। আমি বলেছি তুমি বেয়াই মশাই এর সঙ্গে কেষ্টনগরে চলে গেছে–

তারপর একটু থেমে বললে–আমি এখন আসি বউমা, নইলে কেউ আবার টের পেয়ে যাবে। তোমাকে আজকে আগে-আগে খাইয়ে দেব। তখন তুমি নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পোড়, বাইরে থেকে আমি তোমার দরজায় তালা লাগিয়ে দেব, তাহলে আর কেউ টের পাবে না। আবার ভোর না হতে দরজা খুলে দেব

এই রকম ব্যবস্থাই হলো। কিন্তু বিকেল হলো, সন্ধ্যে হলো, তবু খোকাও এলো না, প্রকাশও এলো না।

চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–কই, প্রকাশ তো এখনও এলো না–আমি নিজে একবার যাবো কলকাতায়?

প্রীতি বললে–তুমি গিয়ে আর কী-ই বা করবে। ও-সব কাজ প্রকাশই করবে ভালো। আর তুমি চলে গেলে এদিকটা আবার কে সামলাবে? বাড়িতে এই কর্তাবাবুর অসুখ, এখন এখানে একজন পুরুষ-মানুষ না থাকলে চলে?

তা বটে। চৌধুরী মশাই বুঝলেন। কিন্তু তিনি যুক্তি বুঝলে কী হবে, মন তো যুক্তি বুঝতে চায় না। তার মনের সমস্ত খেই যেন হারিয়ে গেছে একদিনের মধ্যেই। একদিনের মধ্যেই যেন তার সমস্ত দৈনন্দিন কাজগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। দৈনন্দিন কাজের মধ্যেও তো একটা শৃঙ্খলা থাকে। সেই শৃঙ্খলাটা নষ্ট হলেই মন বড় বিপন্ন হয়। অথচ যে-মানুষটা বড় বেশি করে সংসার-ধর্ম করতে চেয়েছিলেন তার আর কোন দিকেই হুঁশ নেই। তিনি অচল-অটল হয়ে পড়ে আছেন। জানতেও পারছেন না যে তার এত সাধের সংসারের ভিতেই আজ ফাটল ধরেছে। কৈলাশ গোমস্তা আর দীনুই কেবল তাকে সামলাচ্ছে। আগে রাণাঘাট থেকে ছেলে ফিরে এলে মামলার ধারাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতেন। মামলা করে করে কর্তাবাবু মামলার ঘুণ হয়ে গিয়েছিলেন শেষের দিকে। উকিলকেও কর্তাবাবু মামলার খেই ধরিয়ে দিতেন। সেই তিনিই আজ জানতে চাইছেন না কোর্টে কতদূর কী হলো। জানতেও চাইছেন না তাঁর অত আদরের নাতি কোথায় গেল। তিনি সুস্থ থাকলে কি আর এই অবস্থায় বউমাকে বাপের বাড়ি যেতে দিতেন!

পরের দিন রাত থাকতে নয়নতারাকে জাগিয়ে দিয়েছে শাশুড়ী।

–কী বউমা, রাত্তিরে তোমার ভয় করে নি তো?

নয়নতারা বললে–-না মা—

শাশুড়ী বললে–এখনও ভোর হয় নি, তোমার শ্বশুর এখনও ঘুমোচ্ছেন, তাড়াতাড়ি তুমি তৈরী হয়ে নাও, তারপরে আবার তোমাকে উত্তরের ঘরে রেখে দিয়ে আমি দরজায় তালা দিয়ে দেব—

নয়নতারা হঠাৎ বললে—মা—

শাশুড়ী বললে–কী বউমা?

–আজকেও যদি ওঁরা ফিরে না আসেন?

শাশুড়ী বললে–যদি না আসে তো তোমার কপাল! কাল সারা রাত তো কেবল ভগবানকে ডেকেছি। তুমিও ভগবানকে ডাকো বউমা। নিশ্চয়ই তিনি মুখ তুলে চাইবেন। একমনে ডাকলে কি আর ভগবান মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন? বেহুলার গল্প জানো তো? সেই বেহুলা কেমন করে তার মরা স্বামীকে বাঁচিয়েছিল সে গল্প তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ! তা তুমিও পারবে বউমা। ভগবান সহায় থাকলে কোনও কাজই মানুষের অসাধ্য নয়। তুমি সব সময়ে একমনে তাঁকে ডাকো, নিশ্চয়ই ফিরে আসবে খোকা–

সত্যিই নয়নতারা তখন ভগবানে বিশ্বাস করতো। তারপরে আঘাত পেতে পেতে কখন যে একদিন তার সব বিশ্বাসের সলিল-সমাধি হয়ে গিয়েছিল তা তার চিরকাল মনে থাকবে। কিন্তু কেন তার বিশ্বাস ভেঙ্গে গেল? কেন আস্থা হারালো সে? আস্থা হারালো কি শুধু ভগবানের ওপর আস্থা হারালো নিজের জীবনের ওপর, নিজের শ্বশুর, শাশুড়ী সকলের ওপর। যে-বিশ্বাস হারিয়ে একদিন সদানন্দ শেষ পর্যন্ত অমন আসামী হয়ে গেল, নয়নতারাও তো সেই আস্থা হারিয়েই একদিন আত্মঘাতী হতে গিয়েছিল।

কিন্তু সে কথা এখন থাক।

পরের দিন সন্ধ্যে কেটে রাত হয়েছে।

শাশুড়ী আবার ঘরের তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো। বললে–খেয়ে নাও বউমা, খাবার এনেছি–

খেতে বসে নয়নতারার চোখ দিয়ে টস্ টস্ করে জল পড়তে লাগলো।

শাশুড়ী বললে– কেঁদো না বউমা, কাঁদতে নেই। কাঁদবার কথা তো আমার, কিন্তু আমি তো কাঁদছি না। আমি যদি কাঁদতুম তো কবে আমার এই সংসার করা ঘুচে যেত বউমা, তা জানো? কাঁদবার দিন অনেক পাবে বউমা। এত তাড়াতাড়ি চোখের সব জল ফুরিয়ে দিও না। শেষকালে যখন একটার পর একটা শোক-তাপ পাবে তখন কাঁদবার মত চোখে অত জল কোথায় পাবে বলো তো? তুমি তো সবে সংসারে ঢুকলে, এরই মধ্যে যদি এত কান্না পায় তাহলে শেষ জীবনে কী করবে?

নয়নতারা শাশুড়ীর কথায় চোখের জল মুছে একটু শক্ত হবার চেষ্টা করলে। কোনও রকমে খাওয়াটা সারলে। যেন নিয়ম রক্ষে করলে।

শাশুড়ী বললে–এরকম উপোস করে থাকলে তো তোমার চলবে না বউমা। না খেলে তখন আরো দুর্বল হয়ে পড়বে, তখন তোমার অপমানের শোধ নেবে কী করে?

হঠাৎ বাইরে থেকে প্রকাশের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল–দিদি, দিদি-সদাকে নিয়ে এসেছি—দিদি–

চৌধুরী মশাই তখন দোতলায় কর্তাবাবুর কাছে ছিলেন। তাঁর কানেও আওয়াজটা পৌঁছোল। আওয়াজটা পেয়েই তিনি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে নেমে এলেন।

–কই, কই, খোকা কই?

প্রকাশের পেছনেই সদানন্দ শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–কী হলো? পুলিসের হাত থেকে ছাড়া পেলে?

প্রকাশ মামা বললে–সহজে কি ছাড়ে জামাইবাবু? পুলিসে ছুঁলে তো আঠারো ঘা, সে তো কথাতেই আছে। কিন্তু এ আবার পুলিসের বাবা। কলকাতার পুলিস। হাজার টাকার কমে তো কথাই বলতে চায় না। শেষে হাতে-পায়ে ধরতে তবে কথা রাখলে।

চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–তা খুব কষ্ট হয়েছে তো?

প্রকাশ মামা বললে–কষ্ট বলে কষ্ট। হাতে তো টাকা ছিল না বেশি। সব তো পুলিসের পেটে ঢুকিয়েছি। শেষে যে কটা পয়সা ছিল তাতে গাড়ি ভাড়াটা কোনও রকমে দিয়ে তবে আসতে পেরেছি–নইলে কলকাতার রাস্তাতেই আমাদের রাত কাটাতে হতো

তারপর আর দাঁড়ালো না সেখানে। বললে–যাই, আগে দিদিকে খবরটা দিয়ে আসি গে, দিদি হয়ত আবার খুব ভাবছে–

চৌধুরি মশাই বললেন– তোমার দিদির তো আবার শরীরটা খুব খারাপ হয়েছে

প্রকাশ মামা বললে–সে তো আমি যাবার সময়ই দেখে গেছি, খোকার আসার খবর পেলেই দিদির শরীর ভালো হয়ে উঠবে

তারপর ভেতর বাড়ির বারান্দায় গিয়ে ডাকতে লাগলো–দিদি দিদি–

প্রীতি প্রকাশের গলার আওয়াজ পেয়ে আর সময় নষ্ট করে নি। বউমাকে নিয়ে তার শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিলে।

নয়নতারাকে বলে দিলে–যা বলেছি তা তোমার মনে আছে তো বউমা?

নয়নতারা ঘাড় নাড়লে।

–হ্যাঁ, মনে রেখে দিও, ভুলো না যেন। খোকা যেন জানতে না পারে যে তুমি ঘরে আছ। আমি ওদের বলবো তুমি বাপের বাড়ি চলে গেছ, বুঝলে? আজ খোকাকে বোঝানো চাই যে তুমিও অপমানের শোধ তুলতে পারো, বোঝানো চাই মেয়েমানুষ হলেও তুমি একজন মানুষ, বোঝানো চাই যে তোমার মান-অপমান লজ্জা-সম্ভ্রম বলে একটা জিনিস আছে, আরো বোঝানো চাই খোকার যেমন অধিকার আছে এ-বাড়ির ওপর, তোমারও তেমনি সমান-সমান অধিকার আছে, বুঝলে? যা যা বলছি তাই ঠিক-ঠিক কোর, যেন ভয় পেও না। খোকা যদি ঘর থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে তো তুমি যেন ওকে জোর করে ধরে রাখতে ভয় পেও না। আর আমি তো আছি, ও যদি তোমাকে কিছু করে তখন আমি তোমার দিকে আছি, তুমি আমাকে ডেকো। আমাকে চেঁচিয়ে ডাকলেই আমি ছুটে আসবো, বুঝতে পারলে? এখন আমি চললুম।

বলে দরজায় তালা বন্ধ করে প্রীতি তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের ভেতর গিয়ে ঢুকলো।

বাইরে থেকে প্রকাশ ডাকতে ডাকতে ভেতরে এল।

বললে–কই গো দিদি, কোথায় গেলে, তোমার খোকাকে তো এনেচি, উঃ, সে কী কাণ্ড, কলকাতায় গিয়ে কম হেনস্তা আমার। আমি না গেলে সদাকে ছাড়িয়ে আনাই যেত না–

তারপর বউমার ঘরের দিকে চেয়ে বললে–বউমা কোথায়?

প্রীতি বললে–বউমার বাবা এসেছিল, বউমাকে নিয়ে কেষ্টনগরে চলে গেছে

–সে কী? এই সময়ে তুমি বউমাকে বাপের বাড়ি যেতে দিলে? এত কষ্ট করে সদাকে হাজত-ঘর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলুম আর ঠিক এই সময়েই কিনা বউমা চলে গেল বাপের বাড়ি? এই তো সবে সেদিন বাপের বাড়ি থেকে এল বউমা, আবার এরই মধ্যে বাপের বাড়ি যাওয়া?

দিদি সেকথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলে–কই? খোকা কোথায়? খোকা যে আমার কাছে এল না?

প্রকাশ বললে–আমি ডেকে নিয়ে আসছি–

খোকা এসেছে, এই খবরটাই যেন একটা অসুস্থ মানুষের রোগমুক্তির পক্ষে যথেষ্ট। প্রীতির শরীরটা যেন এক মুহূর্তের মধ্যে হাল্কা হয়ে উঠলো।

প্রকাশ মামা আবার বললে–ওঃ, সদার জন্যে যে কী ঝঞ্ঝাট গেল তোমায় কী বলবো দিদি। কথায় বলে পুলিসে ছুঁলে আঠারো ঘা, তার ওপর আবার কলকাতার পুলিস। সোজা আঙ্গুলে তো সেখানে ঘি ওঠে না। আমিও তাই ব্যাঁকা রাস্তা ধরলুম। আমি বললুম সদাকে ছাড়াতেই হবে। তার জন্যে যত টাকা লাগে তা আমার জামাইবাবু খরচা করতে প্রস্তুত। তা টাকার কথা শুনেই পুলিসের মুখের চেহারা বদলে গেল। আমার হাতে তখন কাঁচা নোটগুলো রয়েছে। সেগুলো দেখে বললে–কত আছে ওতে? আমি বললুম—পাঁচশো–

দিদি বললে–তা পাঁচশোতে রাজি হয়ে গেল?

প্রকাশ মামা বললে–ক্ষেপেছ? তেমন বান্দাই নয় তারা–

–তারপরে?

–তারপরে শেষ পর্যন্ত সাতশো টাকায় রফা হলো। নগদ টাকাটা চুকিয়ে দিতেই হুকুম হয়ে গেল আসামী খালাস। তখন দেখি কাঁদতে কাঁদতে সদা আসছে। না-খেয়ে না-ঘুমিয়ে সদার মুখ একেবার শুকিয়ে আসি হয়ে গেছে! কান্নায় চোখ ফুলে একেবারে টোপাকুল।

দিদি বললে–আহা, তা বাছাকে খেতেও দেয় নি? সারাদিন না খেয়ে কাটিয়েছে?

 প্রকাশ মামা বললে–সে তোমার ভাবনা নেই। পুলিস না খেতে দিক, আমি পেট ভরে খাইয়ে দিয়েছি তোমার খোকাকে। কী কী খাইয়েছিলুম শুনবে? বড় বড় রাজভোগ, কাঁচাগোল্লা সন্দেশ, তারপর রাবড়ি। তাতেও পেট ভরে না। শেষকালে তোমার ছেলে বলে ভাত খাবো। তা নিয়ে গেলাম তোমার ছেলেকে হোটেলে। সেখানে গিয়ে পোনা মাছের কালিয়া আর সরু বালাম চালের ভাত খাইয়ে দিলুম। বললুম-খা, যত পারিস পেট ভরে। খেয়ে নে। আমার কাছে তখনও তিনশো টাকা রয়েছে–

কিন্তু অত খাওয়ার কথা শুনতে তখন ভালো লাগছিল না প্রীতির। বললে–খাওয়ার কথা রাখ তুই, খোকা এখনও আসছে না কেন, তাকে ডেকে দে না–

চৌধুরী মশাই তখন সদানন্দকে নিয়ে পড়েছিলেন। সব শুনে বললেন–তা তুমিই বা ওই কালীগঞ্জের পোড়ো বাড়ির মধ্যে গিয়েছিলে কেন? সেখানে তোমার কী আছে? কে থাকে সেখানে?

সদানন্দ বললে–কেউ না–

–কেউ যদি না থাকে তো তোমার সেখানে যাবার দরকার কী ছিল? বাড়িতে তোমার মন টেকে না? বাড়িতে তোমার যদি কোনও কাজ না থাকে তো চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে সেরেস্তার খাতা-পত্তোরগুলো দেখলেও তো পারো। তা দেখলেও তা আমার উপকার হয়। সেটাও কি তোমার দ্বারা হবে না?

সদানন্দ এ-কথার কোন জবাব দেওয়া দরকার মনে করলে না।

–বলি, কথার জবাব দিচ্ছ না যে? আমি যা বলছি তা তোমার কানে যাচ্ছে না, না কথাগুলো গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতে চাও না! ভাবছো যা বলছি আমার ভালোর জন্যেই বলছি তোমার ভালোটা দেখছি না। কিন্তু আমার ভালোটা কি তোমারও ভালো নয়? এই যে এত খেটে-খুটে সম্পত্তি রেখে যাচ্ছি; এ কি আমি নিজে ভোগ করবো বলে? আমি মরবার সময় এসব আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো বলে? এ সব তো তখন তুমি একলাই ভোগ করবে! সব তো তোমারই রইল। আমরা আর কদ্দিন? আমিও থাকবো না, তোমার মা ও থাকবে না। তখন তুমি আর বউমাই এ-সব ভোগ-দখল করবে। তখন আমরা দেখতেও আসবো না এ-সব তোমরা উড়িয়ে দিলে না বেচে দিয়ে রাস্তার ফকির হয়ে গেলে। কিন্তু যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তো আমাকে বাপের কর্তব্য করে যেতে হবে।

সদানন্দ এবারও কোনও কথার জবাব দিলে না।

চৌধুরী মশাই তখন রেগে গেলেন। বললেন–তুমি কি ঠিক করেছ আমার কোনও কথারই জবাব দেবে না? আমার সঙ্গে আর কথাই বলবে না? তা যদি ঠিক করে থাকো তো বলো, এখন থেকে বলে দাও। আমি তাহলে সেই রকম ব্যবস্থাই করবো। তোমার মত বেয়াদব ছেলেকে কী করে ঢিট করতে হয় তাও জানি

নয়নতারাকে খাইয়ে-দাইয়ে ততক্ষণে শাশুড়ী তার শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। অন্ধকার ঘর। বাইরে থেকে শাশুড়ী আবার দরজায় তালা-চাবি লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে। নয়নতারার বুকটা কাঁপছিল। শ্বশুরের সঙ্গে তার স্বামীর কথাগুলো কানে আসছিল। কান পেতে কথাগুলো সে একমনে শুনতে লাগলো। সবাই জেনে গেছে নয়নতারা কেষ্টনগরে চলে গেছে। এতটুকু টুঁ শব্দ করা চলবে না। তাহলেই জানাজানি হয়ে যাবে যে সে এ বাড়িতেই আছে।

একদিকে ভেতরবাড়িতে শাশুড়ীর সঙ্গে তার মামাশ্বশুরের কথা হচ্ছে। তাও কানে যাচ্ছে। আবার ওধারে তার শ্বশুরের গলা।

এই রকম বন্দী অবস্থায় সে কাল রাতটা কাটিয়েছে, তারপর আজ সমস্ত দিনটাও কাটলো। আরো কতক্ষণ তাকে এমন করে কাটাতে হবে কে জানে! আর একটু পরে খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন তার স্বামী এ-ঘরে শুতে আসবে, তখন?

শাশুড়ী তাকে পাখি-পড়া করে শিখিয়ে দিয়েছে। অনেক কথাই শিখিয়ে দিয়েছে তাকে। কথাগুলো মনে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে কাঠ হয়ে এল শরীরটা। একটা বিপদ ঘটাবার আগেই যেন সে ভয়ে ভয়ে মুহূর্ত গুনতে লাগলো। বেহুলা তার স্বামীকে যমের হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। তাকেও কি সেই বেহুলা হতে হবে!

নয়নতারা এক মনে অদৃশ্য ঈশ্বরকে কল্পনা করে নিয়ে প্রার্থনা করতে লাগলো–ভগবান আজকে তুমি আমার মুখ রেখো। শুধু আমার নয়, সকলের মুখ রাখবার ভার তোমার ওপর ভগবান। আমি যেন পারি। আমি যেন আমার স্বামীর মন ফেরাতে পারি। আমাকে তুমি সাহস দিও, শক্তি দিও, সামর্থ্য দিও–আমি যেন হেরে না যাই–

হঠাৎ শাশুড়ীর গলা শোনা গেল–এসেছিস খোকা?

তার স্বামীর গলার কিছু আওয়াজ শোনা গেল না। কিন্তু নয়নতারা বুঝতে পারলে তার স্বামী ভেতর বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে।

নয়নতারা কান পেতে রইল সেদিকে। সমস্ত বাড়িটার ক্ষীণতম শব্দও যেন তার কানকে এড়িয়ে যেতে না পারে। তার মামাশ্বশুরের গলা শোনা গেল এবার।

প্রকাশ মামা বললে–মা’র দুঃখু কি ছেলে বুঝতে পারে দিদি, কোনও ছেলেই তা বুঝতে পারে না। আমি নিজেই তো মাকে কত কষ্ট দিইছি। তখন বুঝতুম না, এখন মা নেই, এখন বুঝতে পারছি–

শাশুড়ী সে কথার উত্তর না দিয়ে ছেলেকে আবার জিজ্ঞেস করলে-–কেন আমাদের কথা শুনিস না বল তো বাবা? আমাদের কথা শুনলে তো তোর আজ আর এই এত হেনস্তা ভোগ করতে হতো না। এত ভালো বাড়ি থাকতে তুই কেন গিয়েছিলি বাবা সেই কালীগঞ্জের পোড়ো বাড়ির ভেতরে? ডাকাত যদি না-ও থাকতো তো সাপ-খোপও তো থাকতে পারে? সেখানে ঢোকা কি ভালো? এ না-হয় পুলিসের কাছে টাকাকড়ি দিয়ে খালাস করে আনা গেল, কিন্তু যদি সাপ-খোপে কামড়াতো, তখন? তখন কী হতো?

চৌধুরী মশাইও এবার ভেতরে এলেন। বললেন–ও শুনবে না আমাদের কথা, তুমি ওকে হাজার বলো, কোনও কথাই ওর কানে ঢুকবে না। তুমি যেসব কথা বলছো আমি ওকে সেই সব কথা অনেক বলেছি। ও যে কী ভাবে, কী করে, কী ওর মতলব, আমি কিছুই বুঝি না–

শাশুড়ী বললে–তুমি আবার ভেতরে এলে কেন? ওকে যা বলবার আমিই তো বলছি, তুমি তোমার নিজের কাজ করো না গিয়ে–

চৌধুরী মশাই ধাক্কা খেয়ে আবার বাইরে চলে গেলেন। ডাক্তার আসবার কথা ছিল একটু পরে। তিনি সেই জন্যেই বাইরে অপেক্ষা করে করে যখন ডাক্তার এলোই না তখন বাড়ির ভেতরে এসেছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনে আবার বাইরে চলে এলেন। দীনু এসে ডাকলো।

বললে–ছোট মশাই, ডাক্তারবাবু এসেছেন, আসুন—

.

বহুদিন আগে একদিন সদানন্দর যখন অসুখ হয়েছিল তখন এই ডাক্তারই দেখে গিয়েছিল তাকে। এই ননী ডাক্তার। অসুখ সামান্য। কর্তা মশাই তখন সুস্থ মানুষ। জিজ্ঞেস করেছিলেন–ডাক্তার কত টাকা নিলে কৈলাস?

কৈলাস সামন্তই বরাবর সব হিসেব রাখতো। খাতা দেখে বললে–আজ্ঞে ওষুধ আর ভিজিট মিলিয়ে সতেরো টাকা—

সতেরো টাকা? যেন সাপের মুখের সামনে পা বাড়িয়েছেন এমনি করে কর্তা মশাই আঁতকে উঠেছিলেন টাকার অঙ্কটা শুনে। অকারণ বাজে খরচ যেমন দেখতে পারতেন না কর্তা মশাই তেমনি ডাক্তার-খরচটাও কর্তা মশাই বাজে খরচ বলে মনে করতেন।

কিন্তু আজ আর তিনি বুঝতেও পারছেন না তাঁর অত সাধের টাকা-পয়সা কেমন করে তাঁর নিজের অসুখের সূত্রে জলের মত খরচ হয়ে যাচ্ছে। একদিন দুটো পয়সা লোকসানের অভিযোগে তিনি কপিল পায়রাপোড়ার অপমৃত্যু ঘটিয়েছেন। একদিন মানিক ঘোষ দুপুরবেলা ক্ষেত থেকে এসে ভাত খেতে বসেছিল, সেই অবস্থায় ওই বংশী ঢালীর দল গিয়ে তার ভাতের থালা পা দিয়ে উল্টে দিয়েছিল। দিয়ে টিনের চাল খুলে নিয়ে তাকে সপরিবারে রাস্তায় বার করে দিয়েছিল। তার অপরাধ? অপরাধ সে সময়মত তার হাওলাত নেওয়া টাকার সুদ দিতে পারে নি। অনেক টাকা বাকি পড়ে গিয়েছিল। তারপর ফটিক প্রামাণিক। তার কথাও সবাই জানে। ফটিক প্রামাণিকের দুটো গাইগরু কর্তা মশাই-এর ধানক্ষেতে গিয়ে মুখ দেওয়ার অপরাধে তার খড়ের চালে হঠাৎ একদিন আগুন লেগে গেল। সেই আগুনে ফটিক প্রামাণিকের বউ তো পুড়ে মারা গেলই, ফটিক নিজেও সেই শোকে একদিল পাগল হয়ে গেল।

অথচ সেই লোকসানের গুণোগার দেবার জনেই বোধ হয় তার ছেলের শালা রাণাঘাটের রাধাকে গঙ্গাস্নান করাতে কালীঘাটে নিয়ে যায়। ননী ডাক্তারের পেছনে হাজার হাজার টাকা জলের মত খরচ হয়ে যায়। আর নাতি, যে নাতি তাঁর বংশে বাতি জ্বালাবে বলে কাঞ্চন স্যাকরাকে কুড়ি ভরির সোনার হার গড়াবার বায়না দেন তার ভাবী ছেলের অন্নপ্রাশনের উপহার হিসেবে, সে তার নতুন বউএর দিকে ফিরেও চেয়ে দেখে না। তবু আজ এসব কিছুই তাঁর নজরে পড়ে না। তিনি যেন তখন শিলীভূত মাংস-পিণ্ড। তাঁকে ধরে পাশ ফিরিয়ে দিতে হয়, তাঁর ঠোঁট ফাঁক করে ওষুধ খাইয়ে দিতে হয়।

চৌধুরী মশাই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতেন–আর কতদিন এমন করে বাঁচাবেন ডাক্তারবাবু?

ননী ডাক্তার বলতো–তা কি বলা যায়? কত মানুষ এমনি করে বছরের পর বছর বেঁচে থাকে।

–কিন্তু যদি মারাই যাবেন তাহলে আর চিকিৎসা করে লাভ কী?

ননী ডাক্তার বলতো–তা বলে নিজের বাবাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে?

চৌধুরী মশাই বলতেন–কিন্তু ওঁর দিকে তো আর চেয়ে দেখতে পারি না। একটা কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন না?

–কী ব্যবস্থা করবো?

কী যে ব্যবস্থা ননী ডাক্তার করবে আর কী ব্যবস্থার প্রস্তাব চৌধুরী মশাই করতে চান তা দুজনের কেউই খুলে বলতেন না। কিন্তু বুঝতে পারতেন দুজনেই। একমাত্র রোগীকে হত্যা করা ছাড়া এর যে আর কোনও প্রতিকার নেই তা বোধ হয় দুজনেই জানতেন। জানতেন বলেই সে-কথাটা আর কেউই মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে অপরাধের ভাগী হতে চাইতেন না।

কিন্তু রাণাঘাটের সদরে বসেই মনে মনে সংকল্প করে নিয়েছিলেন চৌধুরী মশাই। সংকল্প করে নিয়েছিলেন–আর নয়। প্রতিদিন এতগুলো টাকা খরচ! খরচের অঙ্কটা হিসেব করতেই চৌধুরী মশাই-এর আতঙ্ক হতো। এতগুলো টাকা! এই টাকা খরচেরও কি শেষ নেই? আরোগ্যের কোনও আশাই যখন নেই তাহলে কেন এই খরচান্ত হওয়া? এর প্রতিকার তো তাঁর নিজের হাতেই আছে! তবে?

এই ‘তবে’র উত্তর খোঁজবার জন্যেই তিনি কদিন ধরে ছটফট করছিলেন। যদি খরচান্ত হওয়া নিরর্থক হয় তাহলে তো কর্তাবাবুকে বাঁচিয়ে রাখাও নিরর্থক! অথচ এই নিরর্থক জিনিসটাকে এতদিন ধরে শুধু কর্তব্য আর মানবতাবোধের দোহাই দিয়ে তিনি বরদাস্ত করে চলেছেন। কিন্তু কতদিন, আর কতদিন এমন করে বরদাস্ত করা সম্ভব হবে?

ডাক্তারবাবু নিয়ম করে সেদিনও রোগীকে পরীক্ষা করলে। যেমন করে রোগীর বুকে স্টেথিসকোপ বসিয়ে বুকের সুস্থতা পরীক্ষা করা নিয়ম, তেমনি করেই পরীক্ষা করলে। দু’একটা নিয়মমাফিক প্রশ্নও করলো। যেমন রোজই করে।

আর তারপর হাত বাড়িয়ে টাকা ক’টা নিয়ে চলেই যাচ্ছিল। রাত বাড়ছে। বাড়িতে তার আরও অনেক রোগী। বাড়ির বাইরেও অনেক রোগী তার অপেক্ষায় বসে মুহূর্ত গুনছে।

চৌধুরী মশাই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে এলেন।

পেছন থেকে ডাকলেন–ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার পেছন ফিরলো।

চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–কর্তাবাবুকে আজ কেমন দেখলেন?

ননী ডাক্তার বললে–কী রকম আর দেখবো? সেই একই রকম।

চৌধুরী মশাই বললেন–তা রোজ যদি একই রকম দেখেন তাহলে আপনার রোগী দেখতে আসারই বা কী দরকার আর ওষুধ খাওয়ানোরই বা কী দরকার? ওষুধ কিনতেও তো টাকা লাগে!

ননী ডাক্তার বললে–তা লাগে। টাকা লাগলে যদি আপনার বাজে-খরচ বলে মনে হয় তো তাহলে আর ওষুধ খাওয়াবেন না

–হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি। ভাবছি ওষুধ তো আর ওঁর কাজে লাগছে না।

ননী ডাক্তার বললে–না, কাজে আর লাগবেও না।

–তাহলে ওষুধ না দিয়ে কী করবো?

–যদি যন্ত্রণা বাড়ে তো একটু করে আফিম খেতে দিন। টাকাও কম খরচ হবে আর যন্ত্রণাও কমবে।

বলে আর দাঁড়াল না ডাক্তার। উঠোন পেরিয়ে সদর দিয়ে সাইকেলে উঠে বসলো। তারপর ঘন্টা বাজিয়ে রাস্তার ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

চৌধুরী মশাই সেই অন্ধকার বারান্দার ওপরেই কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আফিম? কিন্তু আফিমই বা কিনতে যাবেন কেন? আফিম কিনতেও তো পয়সা লাগে! আর আজ রাত্রের মধ্যে আফিমই বা আসছে কোথা থেকে? কাল দিনমানের আগে তো আর রেলবাজারের আবগারি দোকান খুলছে না। আর আফিম কিনতে গেলেও তো তার একটা প্রমাণ থেকে যাবে। প্রমাণ থেকে যাবে যে চৌধুরী মশাই-এর লোক কর্তাবাবুর মারা যাবার আগের দিন রেলবাজারের আবগারি দোকান থেকে আফিম কিনে নিয়ে গিয়েছিল। এত ঝঞ্ঝাটে দরকার কী? তার বদলে সোজা পথ তো অনেক খোলা রয়েছে।

চৌধুরী মশাই নিজের করণীয় কর্তব্য ঠিক করে ফেললেন। একেবারে নিশ্চিন্ত। তারপর আবার সোজা একেবারে ওপরে উঠে গেলেন। কর্তাবাবুর তখনও সেই একই অবস্থা। নিশ্চল নিথর হয়ে শুয়ে আছেন।

কৈলাস গোমস্তা তখন কর্তাবাবুকে ওষুধ খাওয়াবার ব্যবস্থা করছিল। চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–ওষুধ তৈরি করছ কার জন্যে?

কৈলাস বললে–আজ্ঞে ডাক্তারবাবু যে বলে গেলেন!

চৌধুরী মশাই বললেন–না, ডাক্তারবাবু আমাকে অন্য কথা বলে গেলেন। আর ওষুধ খাওয়াতে হবে না আজ থেকে

–খাওয়াতে হবে না?

–না—

ঘরময় ওষুধের শিশি-বোতল জমে একদিন পাহাড় হয়ে উঠেছিল। সেগুলোর দিকে চেয়ে দেখলেন চৌধুরী মশাই। যতগুলো শিশি-বোতল তার একশো গুণ টাকা করচ হয়েছে। সব ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে এতদিন। কিন্তু এতদিন যা হয়েছে তা হয়েছে, এবার থেকে আর তা নয়! এবার থামা। কর্তাবাবু সজ্ঞানে থাকলে তিনিও এত টাকা নষ্ট হতে দিতে আপত্তি করতেন। কর্তাবাবুর কাছেও তার জীবনের চেয়ে টাকার দাম বেশি ছিল। তিনি জানতে পারলে এ অনাচার হতে দিতেন না কখনও। এত বেহিসেব তিনিও কখনও সহ্য করতেন না।

বললেন–ওই শিশি-বোতলগুলো কাল এ-ঘর থেকে সব সরিয়ে চণ্ডীমণ্ডপের পাশে বংশী ঢালীর ঘরের পাশে জমা করে রাখবে। তারপর রেলবাজারে গিয়ে পুরোন শিশি বোতলের দোকানে বিক্রি করার ব্যবস্থা করবে, বুঝলে?

কৈলাস গোমস্তা মাথা নাড়লে বটে, কিন্তু একটা অজ্ঞাত আতঙ্ক তার মনটায় জুড়ে বসলো। তবে কি কর্তাবাবুর এবার চলে যাবার সময় এসেছে। তাহলে তার চাকরি! তার চাকরিটাও কি চলে যাবে কর্তাবাবুর সঙ্গে সঙ্গে!

বললে–ডাক্তারবাবু কী বলে গেলেন ছোট মশাই? কর্তাবাবু কি আর বাঁচবেন না?

চৌধুরী মশাই রেগে গেলেন। বললেন–আমি যা বলছি আগে তাই করো। কর্তাবাবু বাঁচবেন কি বাঁচবেন না, তা নিয়ে তুমি কেন অত মাথা ঘামাচ্ছো–?

তারপর একটু থেমে বললেন–আর একটা কথা। রাত্তিরে তুমি তো এখানেই শোও?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনিই তো আমাকে এতদিন এখানেই শুতে বলেছিলেন।

–হ্যাঁ, আমি বলেছিলুম বটে, কিন্তু এখন থেকে তোমার আর এখানে শোবার দরকার নেই, আজ থেকে তুমি তোমার নিজের বাড়িতেই গিয়ে শুয়ো–

–আজ্ঞে তাই-ই শোবো।

চৌধুরী মশাই দীনুর দিকে চাইলেন–আর তুই?

দীনু বললে–আজ্ঞে আমি তো বরাবর ওই বাইরের বারান্দাতেই শুই–

–তা তাই-ই শুবি। আমি আজ থেকে কর্তাবাবুর ঘরের ভেতরে শোব।

বলে আবার সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নেমে এলেন। মাথাটার মধ্যে সমস্ত ঝঞ্ঝাটগুলো যেন কিল্‌ বিল্ করতে লাগলো। এমনিতে ধীর স্থির মানুষ চৌধুরী মশাই। সহজে নুয়ে পড়েন না। কিন্তু সেদিন যেন কেমন আতঙ্ক হতে লাগলো বুকের মধ্যে। এতদিন ধরে তিনি অনেক সহ্য করেছেন। এখন সহ্যের সীমা উৎরে গেছে। এখন একটা হেস্তনেস্ত করবার সময় এসে গেছে।

সুযোগ জীবনে একবারই আসে। ঠিক সেই সুযোগের সময়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কর্তাবাবু বহুদিন আগে এক চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বংশী ঢালীকে ডেকে কালীগঞ্জের বউ খতম্ করার হুকুম দিয়েছিলেন। তারপরই তিনি দেখে গেছেন তাঁর নাতির বেয়াড়াপনা বন্ধ। নাতির এত যে কথা সেসব ফুলশয্যার রাত্রেই ঠাণ্ডা। সুন্দরী বউএর মুখ দেখেই জোয়ান ছেলের মাথা ঘুরে গেছে। তারপরে সেই কালীগঞ্জের বউকে দশ হাজার টাকা দেবার কথা আর সে মুখে আনে নি। ছেলেকে ডেকে কর্তাবাবু বলেছিলেন কী হলো? আমি যা বলেছিলুম তা ঠিক-ঠিক ফলেছে তো?

চৌধুরী মশাই সব জেনেও মিথ্যে কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন–হ্যাঁ ফলেছে–

আর দশ হাজার টাকা দেবার নামগন্ধ করে?

চৌধুরী মশাই বলেছিলেন–না।

কর্তাবাবু বলেছিলেন–আর নাম-গন্ধ করবেও না। দেখে নিও। আর কখনও বেয়াড়াপনা করবে না। তোমরাই তো তখন ভয় পেয়েছিলে সবাই। বলেছিলে কালীগঞ্জের বউকে টাকাটা দিয়ে দেওয়াই ভালো! তা এখন দেখলে তো, তোমরা যেটা বলেছিলে সেটা ভালো ছিল, না আমি যেটা বলেছিলুম সেইটেই ভালো! সেই-ই ফুলশয্যার রাত্তিরে খোকা বউ-এর সঙ্গে শুলো তো? বলো, শুলো কি না?

চৌধুরী মশাই বলেছিলেন–হ্যাঁ, শুলো, আপনি যা বলেছিলেন তাই-ই হলো।

–তা হলে তোমাদের কথা শুনলে মাঝখান থেকে আমার শুধু-শুধু দশটি হাজার টাকা জলে চলে যেত!

–তা যেত।

–তোমরা ছেলেমানুষ তাই এখনও কিছু বোঝ না। জমি-জমা রাখতে গেলে এসব বুদ্ধি খরচ করতে হয়। এই যা কিছু করেছি দেখছো সমস্ত এমনি করেই করেছি, বুঝলে? যদি সম্পত্তি রাখতে চাও তো মায়া-দয়া করলে চলবে না, মায়া-দয়া করলে সব গোল্লায় যাবে

কর্তাবাবুর ‘মায়া-দয়া’ কথাটাই বিশেষ করে মনে পড়লো চৌধুরী মশাই-এর। মায়া-দয়া করলে নাকি জমি-জমা-টাকাকড়ি সমস্ত চলে যাবে, কিছুই থাকবে না। না, আর মায়া দয়া কিছুই করবেন না তিনি। কারোর ওপরেই মায়া-দয়া নয়। এমন কি কর্তাবাবুর ওপরেও মায়া-দয়া নয় আর। আজ রাত্রেই মায়া-দয়ার গলা টিপে মারবেন তিনি।

সোজা নিচেয় এসে আবার ভেতর বাড়িতে ঢুকলেন। রান্না বাড়ির বারান্দায় গৃহিণী একলা বসে ছিল।

কাছে এসে চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–কী হলো? তোমার শরীর খারাপ, তুমি ঠাণ্ডার মধ্যে এখানে বসে কেন? খোকা কই?

–খোকা পুকুরঘাটে গেছে, হাত-পা ধুতে। তাকে খেতে দেব।

চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–খোকা কী বললে?

প্রীতি বললে–কী আবার বলবে! খুব কষ্ট হয়েছে, এই সব কথাই বললে–

–না, সেকথা নয়। বউমা বাপের বাড়ি চলে গেছে শুনে কিছু বললে নাকি?

প্রীতি বললে–না।

–জিজ্ঞেস করলে না কেন বাপের বাড়ি গেল! কে তাকে নিয়ে গেল!

–না।

চৌধুরী মশাই প্রসঙ্গ বদলে বললেন–আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব, আজ থেকে আমি কর্তাবাবুর ঘরে শোব–

প্রীতি বললে–কেন? গোমস্তা মশাই তো থাকে সেখানে?

চৌধুরী মশাই বললেন, আজ থেকে তাকে থাকতে বারণ করেছি আমি। বলেছি, এবার থেকে নিজের বাড়িতে গিয়ে শুতে–

–তা তুমি যে শোবে, বিছানা?

–দীনুকে বিছানা করতে বলে দিয়েছি, গৌরীকে বলো আমার খাবার দিয়ে দিতে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ি গে যাই, আমার কিছু ভালো লাগছে না। কর্তাবাবুর অসুখও সারবে না, আর আমারও ঝামেলা শেষ হবে না। ননী ডাক্তার এখনি বলে গেল কর্তাবাবু নাকি এই রকম করেই বরাবর বেঁচে থাকবে–

প্রীতি বললে–তা মানুষ যদি বেঁচে থাকে তো তুমি কী করবে? তা বলে তো আর কাউকে গলা টিপে মেরে ফেলা যায় না। যতদিন কপালের ভোগান্তি আছে ততদিন সহ্য করতেই হবে–

চৌধুরী মশাই বললেন–কী বলছো তুমি? সহ্যও করবো আবার ওষুধও খাইয়ে যাবো? ওষুধ কিনতে বুঝি টাকা লাগে না? বলো তো এ ক’দিনে কতগুলো টাকা মবলক জলে চলে গেল! ওই টাকায় পাঁচশো বিঘে জমি হয়ে যেত আমার। বুঝতুম যে ওতে অসুখ ভাল হয়ে যাবে তা হলেও না-হয় মনে কিছু লাগতো না, কিন্তু এ যে ন-দেবায় ন-ধর্মায়…..

এমন সময় রান্নাবাড়ির দাওয়ায় গৌরী ভাত দিয়ে গেল। চৌধুরী মশাই গিয়ে খেতে বসলেন। কিন্তু খেতে-খেতেও কর্তাবাবুর কথাগুলো তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতে লাগলো–যদি সম্পত্তি রাখতে চাও তো মায়া-দয়া করলে চলবে না। মায়া-দয়া করলে সব গোল্লায় যাবে–

সত্যিই আর মায়া-দয়া নয়। মায়া-দয়া করলে সব গোল্লায় যাবে। কিছু থাকবে না। তাড়াতাড়ি কোনও রকমে নাকে-মুখে খাবারটা খুঁজে একেবারে দোতলায় কর্তাবাবুর ঘরে গিয়ে হাজির হলেন আবার। কৈলাস গোমস্তা তখন তার বাড়ি চলে গেছে। আজ থেকে তার আরাম। আর দুর্গন্ধের মধ্যে তাকে রাত কাটাতে হবে না।

দীনু দাঁড়িয়ে ছিল। চৌধুরী মশাই বললেন–তুই আর মিছিমিছি দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা, নিচেয় গিয়ে গৌরীর কাছে খাবার চেয়ে খেয়ে নিগে যা–

দীনু চলে যেতেই চৌধুরী মশাই কর্তাবাবুর কাছে সরে এলেন। সত্যিই কর্তাবাবু তখন একটা অচল মাংসপিণ্ড বই আর কিছু নয়। একটু চেতনাও নেই মানুষটার। এত যে বিছানার দুর্গন্ধ তাতেও মানুষটার কোনও বিকার নেই। পঞ্চেন্দ্রিয় লোপ পেয়ে গেছে তবু মানুষটা বেঁচে আছে কেমন করে কে জানে! অথচ এই মানুষটারই এককালে কত বুদ্ধি-বিবেচনা ছিল। শুধু বুদ্ধি-বিবেচনা নয়। কূট বুদ্ধি-বিবেচনা। সেই কূট বুদ্ধিতে কোর্টের হাকিম, পেশকার-উকিল-মুহুরি মোকতার সবাই হিমসিম খেয়ে যেত। এই মানুষটাই একদিন বলেছিল—যদি সম্পত্তি রাখতে চাও তো মায়া-দয়া করলে চলবে না। মায়া-দয়া করলে সব গোল্লায় যাবে! কিন্তু আজ আমিও যদি সম্পত্তি রাখবার জন্যে মায়াদয়া না করি। আমি আজ মায়া-দয়া করলে তো এই সব সম্পত্তিও গোল্লায় যাবে। তা হলে?

চৌধুরী মশাই নিজের দু’হাতের দুটো বুড়ো আঙ্গুল পরীক্ষা করে দেখলেন। ওষুধ লাগবে না, বিষ লাগবে না, ছোরা লাঠি কিছুই লাগবে না, শুধু এই দুটো বুড়ো আঙুল দিয়েই সব শেষ করে দেওয়া যায়।

–কে? কে তুমি?

চৌধুরী মশাই চমকে উঠেছে। কর্তাবাবুর কি তবে জ্ঞান আছে যে সব টের পাচ্ছেন তিনি?

–তুমি কে? কথা বলছো না কেন? কথার জবাব দাও। তোমাকে তো আমি খুন করে ফেলেছি, তবে আবার কী করে তুমি এখানে এসেছ? তুমি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলে মনে আছে? তুমি বলেছিলে আমি নির্বংশ হবো, বলেছিলে তুমি বামুনের মেয়ে, তোমার অভিশাপ ফলবেই! মনে আছে?

বলতে বলতেই কর্তাবাবু ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন।

–কিন্তু ফলেছে কী? আমার নাতি কি তোমার কথা শুনেছে? সুন্দরী বউ পেয়ে সে সব ভুলে গেছে কালীগঞ্জের বউ, সব ভুলে গেছে। সে এখন রোজ বউ-এর সঙ্গে এক ঘরে শোয়। তা জানো? আমি আমার বংশধরের মুখ দেখবো বলে কাঞ্চন স্যাকরাকে সোনার হারের বায়না দিয়ে রেখেছি। তুমি যাও এখন, যাও–আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না, তুমি যাও, যাও–চলে যাও বলছি।

হঠাৎ হারিকেন নিয়ে দীনু ঢুকতেই আবার সব চুপ।

চৌধুরী মশাই বললেন–খাওয়া হলো তোর?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–তাইলে তুই শুয়ে পড় বারান্দায়, আমি এখানেই শোব।

দীনু বারান্দায় গিয়ে বিছানা পাতলে। চৌধুরী মশাই তখনও একদৃষ্টে চেয়ে দেখছেন কর্তাবাবুর মুখের দিকে। কই, কিছু তো নেই! এ তো ঠিক আগেকার মত নিথর নিশ্চল শিলীভূত মাংসপিণ্ড! এর তো কথা বলবার কোনও ক্ষমতা নেই। তবে এতক্ষণ কে কথা বলছিল! না, আর মায়া-দয়া করলে চৌধুরী বংশ গোল্লায় যাবে–মায়া-দয়া আর তিনি করবেন না।

বাইরে তখন দীনুর নাক-ডাকা শুরু হয়ে গেছে। চৌধুরী মশাই আর দেরি করলেন না। টিপি টিপি পায়ে আবার এগিয়ে গেলেন কর্তাবাবুর দিকে।

আবার কর্তাবাবু চিৎকার করে উঠলেন–কে? কে তুমি? তোমাকে তো আমি খুন করে ফেলেছি, তবে আবার কী করে তুমি এখানে এলে? কে তোমাকে এখানে নিয়ে এল? কৈলাস, কৈলাস–

দীনুর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। ধড়ফড় করে উঠে ভেতরে এসেছে। বললে–ছোট মশাই, আমাকে ডাকছেন?

ছোট মশাই দীনুকে দেখেই নিজেকে সামলে নিলেন।

বললেন–না, আমি তো ডাকি নি–

দীনু নিশ্চিন্ত মনে চলে গেল। চলে যেতেই চৌধুরী মশাই আবার উঠলেন। না, মায়া দয়া করলে চলবে না। মায়া-দয়া করলে চৌধুরী বংশ গোল্লায় যাবে–

চৌধুরী মশাই টিপি টিপি পায়ে কর্তাবাবুর দিকে আবার এগিয়ে যেতে লাগলেন।

.

কালীগঞ্জের বউ যে মিছিমিছি কর্তাবাবুকে অভিশাপ দেয় নি–তার প্রমাণ সেই দিন রাত্রেই পাওয়া গেল। সদানন্দ আর নয়নতারার জীবনে সে এক স্মরণীয় রাত। নয়নতারা এতক্ষণ তার নিজের ঘরের মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে ছিল। এবার যেন সে তার অন্তরাত্মার আর্তনাদ শুনতে পেলে। তার অন্তরাত্মা তখন আর্তনাদ করে তাকে বলছে–খোকা তোমাকে অপমান করলে তুমিও তাকে অপমান করতে পারো না? তোমার গায়ে জোর নেই?

নয়নতারার মনে হলো সে যেন এখনি দম বন্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তুমি যখন পরের বাড়ির মেয়ে ছিলে তখন ছিলে, এখন তুমি এ বাড়ির বউ। এ সংসারের ওপর খোকারও যতখানি অধিকার, তোমারও অধিকার ঠিক ততখানি। কোনও অংশে এতটুকু কম নয়। তাহলে তোমার কিসের ভয়? খোকা যদি তোমার গায়ে হাত তোলে তুমিও তার গায়ে হাত তুলবে! আমি তো পাশের ঘরেই আছি, তুমি আমাকে ডাকবে। ডাকলেই আমি ছুটে যাবো। তুমি ভয় পেও না বউমা, মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছ বলে কি সব কিছু তোমাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হবে?

হঠাৎ দরজাটার তালা খোলার শব্দ হলো।

শাশুড়ীর গলা শোনা গেল বাইরে। শাশুড়ী বললে–তুই শুয়ে পড়গে যা, আলো নিতে হবে না, গৌরী তোর বিছানা ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে রেখে দিয়েছে–

নয়নতারা দেখলে মানুষটা ঘরে ঢুকে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলে। তারপর আর কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলে। বোধ হয় খুবই ক্লান্ত ছিল। শুধু শুয়ে পড়তেই যা দেরি, তারপরেই লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো তার।

এত কাছে, এত ঘনিষ্ঠভাবে মানুষটার সঙ্গে কখনও থাকে নি নয়নতারা। অথচ যতটা পেরেছে বিছানার একেবারে শেষপ্রান্তে নিজেকে লুকিয়ে রেখে দিয়েছে সে। মানুষটা জানেও না যে যাকে সে সব চেয়ে এড়িয়ে চলতে চায় সে তারই সঙ্গে এক ঘরের এক ছাদের তলায় আর একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে।

এমনি করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিজের হৃৎপিণ্ডের ওঠা-পড়ার শব্দ কতক্ষণ শোনা যায়? তবু শুনতে হবে, তবু এক ঘরে এক বিছানায় প্রতি রাত্রে শুতে হবে। এই-ই হচ্ছে বিধান। তাতে তোমার শয্যাসঙ্গী তোমাকে ঘৃণাই করুক আর তাচ্ছিল্যই করুক।

হঠাৎ অজান্তে নয়নতারার হাতের চুড়ির শব্দ হতেই মানুষটা চমকে বিছানায় উঠে বসেছে।

–কে?

–তারপর বোধ হয় অস্পষ্ট অন্ধকারে একটা কিছু অনুমান করেই মানুষটা আর বিছানায় বসে থাকতে পারলে না। উঠেই সোজা দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে খিল খুলে বাইরে যাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু নয়নতারা তার আগেই গিয়ে তার হাত চেপে ধরেছে।

বললে–কোথায় যাচ্ছো?

নয়নতারার এই অপ্রত্যাশিত ব্যবহার সদানন্দ বোধ হয় কল্পনাও করতে পারে নি। তাই প্রথমটায় একটু হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর কী জবাব দেবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল।

নয়নতারা বললে–আমি তোমার কী করেছি যে তুমি ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছো?

সদানন্দ নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে বললে–আমাকে ছেড়ে দাও, আমার হাত ছাড়ো, আমি বাইরে যাবো–

নয়নতারা তবু সদানন্দর হাত ছাড়লো না। শরীরে যত জোর ছিল তাই দিয়ে সদানন্দর হাতটা চেপে ধরে বললে–না, তোমাকে ছেড়ে দেব না, আগে বলো তোমার কাছে আমি কী দোষ করেছি যে তুমি আমার ঘরে থাকবে না? আমাকে তোমার এত ঘেন্না কেন?

সদানন্দ এমন অবস্থার জন্যে তৈরি ছিল না। বিয়ের পর এতদিন কেটে গেছে, কিন্তু এই মোকাবিলার ঝামেলায় যে তার স্ত্রীই এক দিন তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবে, তার ব্যবহারের কৈফিয়ৎ চাইবে জবাব চাইবে তার জানা ছিল না। জানা থাকলে তার দিকের জবাবদিহিটাও সে আগে থেকে তৈরি করে রাখতো। আর তা ছাড়া সে যদি জানতে পারতো নয়নতারা এই ঘরের ভেতরেই নিঃশব্দে শুয়ে আছে তাহলে কি সে-ই এ ঘরে শুতে আসতো!

মুখে প্রকাশ করবার মত কোনও তৈরি জবাব না থাকাতে সে আবার বললে–আমার হাত ছাড়ো-হাত ছাড়ো বলছি

নয়নতারা বললে–হাত ছাড়লে কি তুমি আমার কথার জবাব দেবে?

সদানন্দ নয়নতারার তরফ থেকে এতখানি দৃঢ়তা আশা করে নি। বললে–তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে এমন কোনও অন্যায় আমি করি নি। তুমি আমার হাত ছাড়ো বলছি

নয়নতারা তবু হাত ছাড়লে ন। তেমনি ভাবে সদানন্দর হাতটা ধরে রেখেই বললে– ন্যায় অন্যায়ের কথা কেন তুললে? আমি তো ন্যায়-অন্যায়ের কথা তুলি নি। আমি শুধু তোমার এই রকম ব্যবহারের কারণ জানতে চেয়েছি।

সদানন্দ বললে–আমি তোমার সঙ্গে কী এমন খারাপ ব্যবহার করেছি? আমি তো তোমাকে কোনও রকম কষ্ট দিই নি, এ বাড়িতে তোমার আদর-যত্নের কোনও ত্রুটি হয়েছে, তাও তো নয়।

নয়নতারা বললে–কিন্তু আমি তো সে কথাও বলি নি তোমাকে। আমি কি তোমাকে কখনও বলেছি শ্বশুরবাড়িতে এসে আমার আদর-যত্ন হচ্ছে না? কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, এটা তো সত্যি? এটা তো অস্বীকার করতে পারবে না? আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছ। তারপরেও কি আমার ওপর তোমার কোন কর্তব্য নেই?

–কর্তব্য? সদানন্দ কথাটা শুনে যেন নিজের মনেই শব্দটা একবার উচ্চারণ করলে।

–হ্যাঁ, কর্তব্য! আমার ওপরেও তো তোমার একটা কর্তব্য আছে। বউ-এর ওপর স্বামীর যেমন একটা কর্তব্য থাকে তেমনি।

সদানন্দ বললে–তোমার সঙ্গে আমি কর্তব্য করা নিয়ে ঝগড়া করতে চাই না। এটা ঝগড়া করবার সময়ও নয়।

–ঝগড়া?

নয়নতারা যেন অবাক হয়ে গেল। বললে–ঝগড়া আমি তোমার সঙ্গে কখন করলুম? আমি কি তোমার সঙ্গে একটাও ঝগড়ার কথা বলেছি? আর এখন যদি কথাগুলো না বলি তো কখন বলবো? তোমার সঙ্গে আমার দেখাই বা হচ্ছে কখন? তুমি তো আমাকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নাও

সদানন্দ বলে উঠলো–দেখ, বিয়ে আমি তোমাকে করেছি সত্যি, কিন্তু তুমি যদি ভেবে থাকো যে, আমি তোমার সঙ্গে স্বামীর মতন ব্যবহার করবো, আমরা দুজনে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করবো ত সে কথা তুমি ভুলে যাও। তোমার সঙ্গে পারতপক্ষে আমার দেখা হবে না–

নয়নতারা সদানন্দর এই স্পষ্ট কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। খানিকক্ষণ তার মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরোল না।

তারপর জিজ্ঞেস করলে–এই-ই কি তোমার শেষ কথা?

সদানন্দ বলেল–হ্যাঁ, এই-ই আমার শেষ কথা। কিন্তু এর পরেই তুমি হয়ত জিজ্ঞেস করবে, তাহলে আমি তোমায় বিয়ে করলুম কেন! তার উত্তরে বলি আমি ভুল করেছিলুম। আমি অন্য লোকের কথায় বিশ্বাস করে ভুল করেছিলুম। আমাকে তারা সবাই স্তোকবাক্য দিয়েছিল। সেই তাদের কথা বিশ্বাস করাই আমার অন্যায় হয়েছিল। সেই বিশ্বাস করার মধ্যে যদি কিছু অন্যায় হয়ে থাকে তো স্বীকার করছি আমি অন্যায় করেছি। তার জন্যে তুমি আমায় যা শাস্তি দেবে আমি তা মাথা পেতে নিতে রাজি আছি–

নয়নতারার চোখ ফেটে জল আসতে চাইল। কিন্তু অনেক কষ্টে তা চেপে রেখে বললে–শাস্তি? আমি তোমায় শাস্তি দেব? স্ত্রী হয়ে আমি তোমাকে শাস্তি দেব?

–তা অন্যায় যখন করেছি তখন শাস্তি অস্বীকার করবো কী করে?

নয়নতারা বললে–যখন অন্যায় করেছিলে তখন তো শাস্তির কথা তোমার মনে পড়ে নি? তখন তখন শাস্তির কথাটা মনে পড়লে হয়ত আমার জীবন এমন করে নষ্ট হতো না–হয়তো আমি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতুম!

সদানন্দ খানিকক্ষণ কী ভাবলে। তারপর বললে–তুমি শাস্তিও দেবে না আবার যন্ত্রণাও ভোগ করবে, এর প্রতিকার আমি কী করে করবো বলো তো?

নয়নতারা বললে–কিন্তু তুমিই বলে দাও আমি তোমায় কী শাস্তি দেব?

সদানন্দ বললে–-তোমার যা শাস্তি মনে পড়ে তাই-ই দাও, আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু ওই যে বললুম তোমার সঙ্গে পারতপক্ষে আমার দেখা হবে না

–কিন্তু আমি যদি সেই শাস্তিই দিই? আমি যদি বলি তোমাকে রোজ রাতে আমারই ঘরে আমারই বিছানায় শুতে হবে?

সদানন্দ যেন একটু দ্বিধায় পড়লো। বললে–আমি তোমার সব শাস্তি মাথা পেতে নেব, শুধু ওই একটা শাস্তি ছাড়া–

–কিন্তু আমার মুখের দিকে চেয়ে দেখ, ও কি তোমার কাছে একটা শাস্তি?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ।

নয়নতারা সদানন্দর হাতটা তখন ছেড়ে দিয়েছে। হাত ছেড়ে দিয়ে আরো কাছে এসে সদানন্দর মুখোমুখি দাঁড়ালো। বললে–তাহলে আমি কী করবো?

–তুমি কি করবে তা তুমিই জানো, আমি কী বলব?

–কিন্তু আমি তো তোমার স্ত্রী! স্ত্রীকে সাহায্য করাও তো স্বামীর একটা ধর্ম! তুমি না সাহায্য করলে কে আমায় সাহায্য করবে? আমার আর কে এখানে আছে?

সদানন্দ বললে–কেন, তোমার শাশুড়ী আছে, শ্বশুর আছে, তোমার নিজের বাবা আছে। কে নেই তোমার? কীসের অভাব তোমার? স্বামী যার নেই সে কি বেঁচে থাকে না? মনে করো আমি নেই। মনে করে নাও বিয়ের পরই তোমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে, আমি মরে গিয়েছি। এমন কি হয় না? এমন তো পৃথিবীতে কত মেয়ের জীবনে ঘটছে! আর তারাও তো বেঁচে আছে–

নয়নতারা বললে–এসব তুমি কী বলছো?

সদানন্দ বললে–যা বলছি তা ঠিকই বলছি। এখন আমায় যেতে দাও–

নয়নতারা দরজার দিকে পিঠ করে সদানন্দর দিকে চেয়ে রইল। বললে–আমি তোমাকে যেতে দেব না, এতদিন পরে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলবার একটা সুযোগ পেয়েছি, এ সুযোগ আমি ছাড়বো না। আজকে তোমাকে আমার কাছে থাকতেই হবে।

–তার মানে তোমার হুকুম মেনে আমাকে চলতে হবে, এই বলতে চাও?

–হুকুম বললে যদি তোমার পৌরুষে ঘা লাগে তাহলে অনুরোধ বলো। আমার এ অনুরোধ না হয় শুনলেই।

সদানন্দ বললে–যে অনুরোধ রাখা সম্ভব নয় তেমন অনুরোধ তুমি আমাকে কোর না। আমি তোমাকে মিনতি করছি, তোমার অনুরোধ আমি রাখতে পারবো না।

–কিন্তু কেন? কেন আমার অনুরোধ রাখতে পারবে না তুমি? আমাকে কি তোমার পছন্দ হয় নি? আমাকে কি খারাপ দেখতে? আমার বাবা-মা কিম্বা আমি কী তোমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেছি?

–না।

–তাহলে?

সদানন্দ বললে–বলছি তো, তুমি সুন্দরী। তোমার মত সুন্দরী বউ কম লোকেরই আছে। কিন্তু তাতে কী? আমি তো তোমার কোনও দোষ দিচ্ছি না।

–তবে কার দোষ?

সদানন্দ বললে–দোষ যে করেছে আমি তাকে শাস্তি দেবার জন্যেই তোমার অনুরোধ রাখতে পারছি না। তুমি জানো না কত তাদের দোষ! তুমি জানো না তারা কত নিষ্ঠুর তারা কত নীচ! শুনলে তোমারও ঘেন্না হবে তাদের ওপর। জানতে পারলে আমার জন্যে তোমারও কষ্ট হবে নয়ন। তখন আর আমাকে ঘরে শুতে অনুরোধ করবে না–

–আমি জানি।

সদানন্দ অবাক হয়ে গেল। বললে–তুমি জানো? তুমি সব শুনেছ?

–শুনেছি।

–কালীগঞ্জের বউকে আমাদের এই বাড়িতে খুন করা হয়েছে তা তুমি শুনেছ? জানো, তার কোনও অপরাধ ছিল না? এই যা কিছু আমাদের সম্পত্তি দেখছো সব তাদের টাকায়। মা’র সিন্দুকের মধ্যে কত টাকা কড়ি-গয়না-হীরে-মুক্তো আছে সব সেই কালীগঞ্জের বউ এর টাকায় কেনা।

নয়নতারা বললে–জানি।

–তাও জানো তুমি? আর এও কি জানো তুমি যে সেই কালীগঞ্জের বউকে কর্তাবাবু দশ হাজার টাকা দেবে বলেছিল? তাও পাছে দিতে হয় তার জন্যেই তাকে খুন করা হয়েছে? তুমি জানো, কপিল পায়রাপোড়া বলে একজন প্রজা ছিল আমাদের, সে কর্তাবাবুর অত্যাচারে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে? জানো তুমি, মানিক ঘোষ নামে একজন প্রজা একদিন ভাত খেতে বসেছিল, সেই ভাতের থালা আমাদের বংশী ঢালী পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল বাকি খাজনার দায়ে? জানো, ফটিক প্রামাণিক বলে আর একজন….

নয়নতারা কথার মধ্যিখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো–জানি জানি, আমি সব জানি–

কথা বলতে বলতে সদানন্দ উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছিল। বললে–তুমি জানো?

–হ্যাঁ জানি। এতদিন তোমাদের বাড়িতে এসেছি, কানও খুলে রেখেছি, জানতে পারবো না? শুধু আমি কেন, এ বাড়ির কারো সেসব জানতে আর বাকি নেই–বলতে গেলে বোধ হয় এ গাঁয়েরও সবাই তা জানে।

–তাহলে? তাহলে কেন তুমি এর পরেও আমায় এ অনুরোধ করছো?

নয়নতারা বললে–যারা দোষ করেছে তাদের তুমি যত ইচ্ছে শাস্তি দাও না, আমি কিছু বলতে যাবো না, আমি কী দোষ করলুম যে আমাকে তার জন্যে শাস্তি পেতে হবে?

সদানন্দ বললে–এর উত্তর তুমি চাও?

নয়নতারা বললে–এর উত্তর না দিলে আজ আমি তোমাকে ঘর থেকে যেতে দেব না। তোমাকে বলতেই হবে তোমার কর্তাবাবুর পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে হবে কেন?

সদানন্দ বললে–কর্তাবাবুর পাপের প্রায়শ্চিত্ত তুমি করতে যাবে কেন? প্রায়শ্চিত্ত করবো আমি। আমিই কর্তাবাবুর একমাত্র বংশধর। আমি চাই আমার সঙ্গেই এ বংশের শেষ হয়ে যাক, এ বংশ নির্বংশ হোক, এ বংশ থেকে সব পাপ নিশ্চিহ্ন হোক–এ বংশ পবিত্র হোক–

নয়নতারা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে–কিন্তু আমার কথার জবাব তো আমি পেলুম না! তুমি করবে প্রায়শ্চিত্ত, কিন্তু তার জন্যে আমি ভুগবো কেন?

সদানন্দ এ প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারলে না।

নয়নতারা বললে–কই চুপ করে রইলে যে, জবাব দাও–আমি তোমার স্ত্রী হয়েছি বলে কি তোমার প্রায়শ্চিত্তের ভাগ আমাকেও নিতে হবে? এই কি তোমার জবাব?

সদানন্দ বললে–ধরে নাও না-হয় তাই–

নয়নতারা বললে–কিন্তু আমাকে কেন তুমি তাহলে এর মধ্যে জড়ালে? আমার কি তাহলে এখন থেকে কোন সাধ-আহ্লাদ থাকবে না? আমি কি তাহলে সারা জীবন এমনি করেই তোমাদের বাড়িতে একা একা রাত কাটাবো? আমার মনের কথা বলবার কোনও লোকই থাকবে না?

সদানন্দ কী জবাব দেবে বুঝতে পারলে না।

নয়নতারা সদানন্দর দুটো হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললে–কী? চুপ করে রইলে কেন? জবাব দাও–বলো আমি কী নিয়ে থাকবো? আমি কাকে আশ্রয় করে বাঁচবো? আমার জীবন কেমন করে সার্থক হবে? আমি কেন তোমার পূর্বপুরুষের পাপের ভাগী হতে যাবো? এর জবাব না দিলে আমি তোমাকে আজ ছাড়বো না। তোমাকে এর জবাব আজকে দিতেই হবে–

সদানন্দ আর পারলে না। নয়নতারার দুটো হাত সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো–পাগলামি কোর না। সরো, পথ ছাড়ো, আমাকে যেতে দাও–

নয়নতারা চিৎকার করে উঠলো। বললে–পাগলামি আমি করছি, না তুমি করছো! বলছি তো, আমার কথার জবাব না দিলে আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না–

সদানন্দ বললে–এই রাত্তিরবেলা কেলেঙ্কারি না করে তুমি ছাড়বে না?

নয়নতারা বললে–কেলেঙ্কারির আর বাকিটা কী রেখেছ যে কেলেঙ্কারির ভয় দেখাচ্ছ আমাকে? আমি যে এখনও তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারছি, এখনও যে আত্মঘাতী হই নি এইটেই তো আমার পক্ষে যথেষ্ট।

সদানন্দ এবার কঠোর হয়ে উঠলো। বললে–ওসব কথা আমি শুনতে চাই না। তুমি আমাকে যেতে দেবে কি না তাই বলো?

নয়নতারা বললে–আমার কথার জবাব না দিলে আমি তোমাকে যেতে দেব না–

–কীসের জবাব চাও তুমি? কোন্ কথার জবাব?

–ওই যে বললুম, তুমি যদি আমার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রাখো তাহলে আমি কি নিয়ে থাকবো? আমি কাকে আশ্রয় করে বাঁচবো?

সদানন্দ বললে–তুমি কি নিয়ে থাকবে তার জবাবদিহি কি আমাকে করতে হবে?

নয়নতারা বলে উঠলো–আমি তো তোমারই স্ত্রী, এর জবাবদিহি তুমি করবে না তো কে করবে?

–আবার ওই এক কথা? বলছি, আমাকে যেতে দাও–সরো—

নয়নতারা বন্ধ দরজার ওপর পিঠ ঠেকিয়ে বললে–না, আমি আজ তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না, তুমি তোমার যা ইচ্ছে তাই করতে পারো–

–তাহলে যেতে দেবে না তো?

বলে সদানন্দ তার প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায় না থেকে হঠাৎ এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলো। সদানন্দ যেন কী ভাবলে একবার। তারপর সেখান থেকে একবার তার টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। টেবিলের ওপর কী যেন সে খোঁজবার চেষ্টা করতে লাগলো। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। সদানন্দ হঠাৎ সামনে যা পেলে তাই-ই হাতে তুলে নিলে। নয়নতারার মনে হলো একটা কাঁচের ভারি দোয়াতদানি সেটা। সেই দোয়াতদানিটা দিয়েই সদানন্দ তার নিজের কপালে ঢাঁই ঢাঁই করে মারতে লাগলো।

নয়নতারা এই অভাবনীয় ঘটনার পরিণতিতে এক মুহূর্তের জন্যে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর সদানন্দর সামনে গিয়ে বাধা দেবার চেষ্টা করলে। বললে–করছো কী, করছো কী?

কিন্তু সদানন্দকে রুখবে এমন শক্তি কার আছে তখন? নয়নতারা সদানন্দর হাত দুটো চেপে ধরে বিপদ আটকাবার চেষ্টা করলে। কিন্তু সদানন্দর গায়ে তখন যেন অসুরের শক্তির আবির্ভাব হয়েছে। সে তখনও একমনে ভারি কাঁচের দোয়াতদানিটা দিয়ে নিজের কপাল লক্ষ্য করে জোরে জোরে একটার পর একটা অনবরত আঘাত করে চলেছে। নিজেকে মারাত্মক আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে যেন সে পৃথিবীর তাবৎ লোকের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবার পথ বেছে নিয়েছে–

আর নয়নতারা সেই অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পেলে মানুষটার কপাল থেকে মুখে গায়ে কাপড়ে অঝোরধারায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে–

দেখতে দেখতে নয়নতারার মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। সেই অস্পষ্ট অন্ধকার ঘরের ভেতরে সেই রক্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে প্রাণপণ আর্তনাদ করে উঠলো—মা—মা–মা গো—

.

হয়ত তখন মাঝরাত। মাঝরাতের বোধ হয় একটা যাদু আছে। বিশেষ করে শীতকালের মাঝরাতের। কদিন ধরে প্রীতির শরীর আর মনের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। সেই সেদিনই প্রথম একটু চোখ দুটো বুজিয়েছিল। তারপর শেষ রাত্রের দিকে ঘুম থেকে উঠল প্রীতি। সবাই তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। চারিদিকে কোথাও কারো সাড়াশব্দ নেই। প্রীতির যখন প্রথম বিয়ে হয়েছিল তখন শাশুড়ীর সঙ্গে নদীতে স্নান করতে যেত। কী কনকনে ঠাণ্ডা তখন। গ্রীষ্মকালে অত কষ্ট হতো না। কিন্তু শীতকালে ঘুম ভাঙতে চাইত না মোটে।

শাশুড়ী বলতো–তোমার কোনও ভয় নেই বউমা, দেখবে নদীর জল গরম। একবার নদীতে ডুব দিলে দেখবে সব শীত পালিয়ে গেছে–

তা সত্যিই, একবার নদীর জলে ডুব দিলে আর শীত করতো না। বাড়ি থেকে নদী বেশী দূর নয়। রাস্তার দুপাশে চৌধুরীদের বাঁশঝাড়। কেউ কোথাও নেই। ছোট মশাই কর্তাবাবুর ঘরে গিয়ে শুয়েছেন। বাইরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আকাশে তারাগুলো তখন পিট পিট করে চাইছে। কোথাও এতটুকু ধোঁয়া নেই, কুয়াশা নেই। কী মনে করে হঠাৎ তার খেয়াল হলো সেই নদীতে গিয়ে স্নান করে এলে ভাল হয়।

পাশেই রান্নাঘর। রান্নাঘরের ওপাশে গৌরী থাকে। সেখানে দরজার সামনে গিয়ে ডাকলে–গৌরী, ওলো গৌরী–

গৌরী বউদির গলা পেয়ে ধড়মড় করে উঠে পড়েছে। কিছু বিপদ হলো নাকি বউদির!

দরজা খুলেই বাইরে এসেছে। বললে–কী বউদি? কী হয়েছে?

প্রীতি বললে–হ্যাঁ রে, নদীতে যাবি?

–নদীতে?

প্রীতি বললে–হ্যাঁ, তোর ছোট মশাই কর্তা মশাই-এর ঘরে শুয়েছে আজ, হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে পড়ে গেল আজ তো শুক্লা ষষ্ঠী, আজকে নদীতে গিয়ে চান করে এলে হয়, তা চ–খোকাও ফিরে এসেছে, বউমার ঘরে গিয়ে শুয়েছে—

তা গৌরীও আপত্তি করবার লোক নয়। সেও তৈরি হয়ে নিয়ে সঙ্গে গেল। রাস্তা নির্জন। নদীতে একটা ডুব দিয়ে সবে উঠেছে, দেখলে একজন সাধু। সাধুকে দেখে প্রীতি তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা দিতে যেতেই সাধু এগিয়ে এল।

বললে–এত রাত্রে তুই স্নান করতে এসেছিস যে বেটি?

প্রীতি বললে–আমার মানত ছিল বাবা–আজ শুক্লা ষষ্ঠী, আমার ছেলে আজ ঘরে ফিরে এসেছে তাই চান করতে এসেছি–

সাধু কী ভাবলে কে জানে, তারপর বললে–সামনে তোর খুব বিপদ আসছে বেটি, খুব হুঁশিয়ার–

প্রীতির বুকটা থরথর করে কেঁপে উঠলো। বললে–কী বিপদ বাবা? কীসের বিপদ? আমার খোকার কোন খারাপ হবে না তো?

সাধু বললে–হবে, খারাপ হবে। তুই তোর বাড়ি থেকে আমার ভক্তকে তাড়িয়ে দিয়েছিস, তাকে অপমান করেছিস–তোর খারাপ হবে না তো কার খারাপ হবে?

প্রীতি সাধুর পা জড়িয়ে ধরতে গেল, বলতে গেল–তুমি আমার খোকার কোনও অমঙ্গল কোর না বাবা, তুমি যা চাও আমি তাই-ই দেব, আমি আমার সর্বস্ব দেব তোমাকে, আমার যা হয় হোক, আমার খোকার যেন কোনও অমঙ্গল না হয় বাবা….

বলতে বলতে সেই নদীর ধারেই প্রীতি সাধুর পা-দুটো জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও তার গলা দিয়ে কান্নার শব্দ বেরোল না। তারপর একটা অসহ্য যন্ত্রণায় আচমকা ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘুম ভেঙে যেতেই প্রীতি চারদিকে চেয়ে দেখলে। কোথায় সাধু, গৌরীই বা কোথায়? সে তো নিজের বিছানাতেই শুয়ে রয়েছে। কেউ তো কোথাও নেই তবে?

অন্ধকারের মধ্যে চোখ দুটো ভালো করে খুলে সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা আবার মনে করবার চেষ্টা করলে সে। এমন স্বপ্ন কেন সে দেখতে গেল! কীসের বিপদ হবে তার? কখন সে সাধুকে অপমান করলে? সাধুবাবা তো নিজেই একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।

না, স্বপ্ন স্বপ্নই। স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না। তার কেন বিপদ হবে। খোকা এতদিন পরে বাড়ি ফিরে এসেছে। এতদিন পরে আজ সে বউমার ঘরে শুয়েছে। খোকার কেন অমঙ্গল হতে যাবে!

প্রীতি এক মনে অদৃশ্য বিধাতা-পুরুষকে লক্ষ্য করে প্রার্থনা করতে লাগলো আমার খোকার কোনও অমঙ্গল কোর না ঠাকুর। সে ভাল থাকুক, আমার বড় সাধের একটি মাত্র ছেলে, তাকে তুমি দেখো ঠাকুর। তার ভাল কোর–

হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ শব্দে প্রীতি চমকে উঠলো।

বউমার গলার আওয়াজ না? বউমা যেন চেঁচিয়ে খোকার সঙ্গে কথা বলছে। তবে কি ঝগড়া করছে নাকি দুজনে?

আর তারপরেই সেই বুকফাটা আর্তনাদ—মা–মা–মা গো—

ধড়মড় করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠেছে প্রীতি। তারপর আলোটা জ্বেলে নিয়ে খোকার ঘরের সামনে গিয়ে ডাকতে লাগলো–খোকা–খোকা–খোকা–

কেউ সাড়া দিলে না–

প্রীতি আবার ডাকলে—বউমা–বউমা, বউমা কী হলো? চেঁচিয়ে উঠলে কেন? দরজা খোল– দরজা খোল–খোকা, দরজা খুলে দে–বলে প্রীতি দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো–

আর সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে গেল ভেতর থেকে। দরজা খুলতেই হারিকেনের আলোয় প্রীতি দেখতে পেলে খোকা দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তার কপাল দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত গড়িয়ে মুখে গায়ে কাপড়ে মাখামাখি হয়ে গেছে।

খোকার চেহারাটা দেখেই ভয়ে আতঙ্কে আঁতকে উঠেছে প্রীতি।

বললে–ওমা, কী সব্বোনাশ, এত রক্ত এলো কোত্থেকে খোকা? তুই কী করেছিস? কে মেরেছে তোকে? এ কাণ্ড কী করে হলো বাবা? বউমা কোথায়?

সদানন্দ কোন উত্তর দেবার আগেই প্রীতি দেখলে ঘরের ভেতরে টেবিলের তলায় মেঝের ওপর বউমার শরীরটা লুঠোচ্ছে।

প্রীতি আলোটা নিয়ে ভেতরে গিয়ে বউমার কপালে হাত দিয়ে দেখলে শরীরে কোনও সাড় নেই। মুখের কাছে মুখ নিয়ে প্রীতি ডাকতে লাগলো–বউমা, বউমা, ও বউমা, কী হলো তোমার? কী হলো?

মেঝের আশেপাশেও নজর দিয়ে দেখলে। জায়গাটা রক্তে একেবারে ভেসে গেছে। এত রক্ত কোত্থেকে এল! কে কাকে মারলে! তবে কি বউমা মেরেছে খোকাকে?

–খোকা!

প্রীতি পেছন ফিরে দেখলে। কিন্তু খোকা কোথায় গেল? খোকা, ও খোকা, খোকা……………

প্রীতি চিৎকার করে ডাকতে লাগলো–খোকা, কোথায় গেলি! ও খোকা—

কেউ সাড়া দিলে না। তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে এসে আবার ডাকলে–খোকা–খোকা—

কিন্তু তবু কেউ সাড়া দিলে না। প্রীতি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সেখানেও খোকা নেই। তারপর বারান্দা থেকে বেরিয়ে বারবাড়িতে ঢুকে ডাকলে–খোকা–খোকা–

একবার বার বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালে সোজা সদরের রাস্তা। সেখানেও দৌড়তে দৌড়তে গেল। ডাকতে লাগলো–খোকা, খোকা—খোকা–

কোনও সাড়া-শব্দ নেই খোকার। খোকা কোথাও নেই–

প্রীতি হারিকেনটা নিয়ে সেই উঠোনের মধ্যেই খানিক দাঁড়ালো। বারবাড়ির কুকুরটা বাড়ির গিন্নীকে দেখে কাছে এসে আদর করে ল্যাজ নাড়াতে লাগলো।

হঠাৎ পেছনে গৌরী এসে দাঁড়িয়েছে। প্রীতির চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। গৌরীকে দেখে প্রীতি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো–ওরে গৌরী, সর্বনাশ হয়েছে রে–

–কী সব্বোনাশ বউদি? কী হয়েছে?

–ওরে, খোকা আমার রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়েছে!

গৌরী কিছুই বুঝতে পারলে না। বললে–খোকা কোথায় বউদি? খোকা তো ঘরে গিয়ে শুয়েছিল। তারপর কী হলো?

প্রীতি কাঁদতে কাঁদলে বললে–ওরে গৌরী, আমার খোকা পালিয়ে গেল—

গৌরী বললে–তা বউমা তো ঘরে ছিল, বউমা কোথায়?

প্রীতি বললে–ওরে গৌরী, আমিই বউমার সর্বনাশ করলুম রে, বউমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মেঝের ওপর। আমার হাত-পা কাঁপছে। তুই যা, একবার তোর ছোট মশাইকে ওপর থেকে ডেকে নিয়ে আয় গিয়ে, ছোট মশাই কর্তাবাবুর ঘরে শুয়েছে আজ—যা যা, শিগগির যা তুই–আমি বউমার কাছে গিয়ে বসি গে–

নয়নতারা তখনও অজ্ঞান অচৈতন্য!

প্রীতি আবার খোকার ঘরে এল। বউমার কাছে নিচু হয়ে বসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকতে লাগলো–বউমা, বউমা, কী হয়েছে তোমার? বলো, কথা বলো? খোকা তোমার কী করেছে?

নয়নতারা তখনও কোনও উত্তর দিচ্ছে না।

গৌরী দৌড়তে দৌড়তে আবার ফিরে এল।

বললে–-ছোট মশাইকে ডেকেছি বউদি, তিনি আসছেন–

প্রীতি বললে–তুই এক কাজ কর গৌরী, ঘটি করে একটু ঠাণ্ডা জল নিয়ে আয় তো, বউমার মুখে-চোখে ছিটোই, বউমার জ্ঞান ফিরছে না, আমার কথারও জবাব দিচ্ছে না–

চৌধুরী মশাই ততক্ষণে এসে গেছে।

বললেন কী হলো? তুমি যে বললে–বউমা বাবার সঙ্গে বাপের বাড়ি চলে গেছে? আবার কোত্থেকে এল? তা খোকা কোথায়? এত রক্ত কোত্থেকে এল? দোয়াতদানিটা এখানে কে ফেললে?

প্রীতি বললে–খোকা রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়েছে–

–সে কী? খোকা বউমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে নাকি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এই কাল তুমি বললে–বউমা বাপের বাড়ি গেছে, আর এখন বলছো খোকা বউমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে!

ততক্ষণে গৌরী এক ঘটি জল এনে হাজির করেছে।

প্রীতি ঠাণ্ডা জল আঁজলা করে নিয়ে নয়নতারার মাথায় ছিটোতে লাগলো। আর মুখ নিচু করে ডাকতে লাগলো–বউমা, ও বউমা, কথা বলো, কী হয়েছে বলে বউমা–বলো–

–প্রথম খণ্ড সমাপ্ত–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *