৩.২ কোথায় গেল সেই টাকা

কিন্তু আশ্চর্য, কোথায় গেল সেই কর্তাবাবু আর কোথায় গেল তাঁর সেই টাকা। তাঁর অত সাধের নাতির বিয়ের পর তিনি ভেবেছিলেন জীবনে যা-কিছু অন্যায় যা-কিছু অত্যাচার তিনি করেছে সব বুঝি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল। ভেবেছিলেন ভবিষ্যৎ কাল তাঁকে তাঁর বংশধরদের মধ্যে দিয়েই বুঝি অমর করে রাখবে। ক্ষণকালের পাপের দাগ চিরকালের কষ্টিপাথরে ধরা পড়বে না। তিনি যাবার আগে এই মিথ্যে বিশ্বাস নিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন যে পরবর্তীকালের কাছে মহাপুরুষ আখ্যা পেয়ে তিনি ধন্য হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি জানতেও পারেননি যে-অপমৃত্যু দিয়ে তিনি নিজের হাত সুদৃঢ় করেছেন সেই হাতই তাঁর আত্মজের হাত হয়ে একদিন তাঁকেই আবার কলঙ্কিত করবে। পরোক্ষভাবে তাঁর কৃত সমস্ত অপঘাত-মৃত্যু একদিন সুদে-আসলে তাঁরও অপঘাত-মৃত্যুকে ডেকে আনবে!

মানুষের জীবন যদি অত সহজ-সরল হতো তাহলে ইতিহাসের পাতায় যত যুদ্ধ-বিগ্রহের বিবরণ লেখা আছে তার একটাও ঘটতো কিনা সন্দেহ। কিম্বা যত মহাপুরুষের নাম পৃথিবীতে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছে তাদের আবির্ভাব হয়ত এত সত্যও হতো না। আর এত অনিবার্যও হয়ত হয়ে উঠতো না। ধর্মের গ্লানির সঙ্গে মহাপুরুষের অভ্যুদয়ের বোধহয় এটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কটা যখনই বিচ্ছিন্ন হয় তখনই বাধে যত বিরোধ। তাই এক-একবার বিরোধ বাধে আর বিশ্বসংসার আর সমাজ কয়েক যুগ ধরে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যারা জীবনে ভোগ-সর্বস্ব তারা তখন বলে–বেশ আছি। বেশ থাকার সংজ্ঞা তাদের আলাদা, তাই বিপর্যয়ের মধ্যেই তারা আরাম পায় স্বস্তি পায়। কিন্তু সংসারে এমন এক-একজনও থাকে যে বলে এর থেকে আমাকে মুক্তি দাও প্রভু, এর থেকে আমাকে পরিত্রাণ করো।

কর্তাবাবুর অত সাধের গড়া সংসারে চৌধুরী মশাই মুক্তি চাননি। তিনি বলেছিলেন– বেশ আছি। আমার অনেক জমি, আমার অনেক সম্পত্তি, আমার অনেক প্রজা। আমার সিন্দুকে অনেক হীরে, অনেক জহরৎ, অনেক টাকা। চৌধুরী মশাইএর গৃহিণীও ভাবতে এই তো বেশ আছি। আমি আমার সন্তানের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছি, আমার ঘর-আলো করা বউ হলো, এবার ঘর-আলোকরা একটা নাতি হবে। আমার কত আরাম, কত সুখ, কত শান্তি। এই আরাম-সুখ আর শান্তির আশাতেই প্রকাশমামা এই নবাবগঞ্জ ছাড়তে চাইতো না। কখনও যেত রাণাঘাটের রাধার বাড়ি, কখনও কালীঘাটের মাসির বাড়ি। আবার কখনও সেই আরামকে দীর্ঘস্থায়ী করতে মা কালী-মার্কা বোতলের আশ্রয় নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকতো। মনে মনে বলতো–বেশ আছি। আর তাদেরই বা দোষ কী! কে-ই বা সুখে ছিল না! তাস পাশা-দাবা খেলে আর যাত্রার মহড়া দিয়ে নিতাই হালদার, গোপাল ষাট, কেদার, গোবর্ধনও আরামে দিন কাটিয়ে দিচ্ছিল সারা জীবন। বলতো যুদ্ধের কথা থাক, আগে তাস ফেলো। আর ওদিকে কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে এদিকের বেহারি পাল পর্যন্ত কেউ এর ব্যতিক্রম ছিল না।

কিন্তু এদের মধ্যে একজনই শুধু বলে উঠলো–আমি বেশ নেই। আমি এ সহ্য করবো না। এর থেকে আমাকে মুক্তি দাও, এর থেকে আমাকে পরিত্রাণ করো।

সংসার থেকে পালিয়ে গেলেই কি মুক্তি আসে? পরিত্রাণ চাইলেই কি পরিত্রাণ পাওয়া যায়?

রাত তখন অনেক। নবাবগঞ্জে তখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সদানন্দ সেই অবস্থাতেই নবাবগঞ্জের রাস্তা দিয়ে দৌড়তে শুরু করেছে। ওরা আমাকে সংসারের নাগপাশ দিয়ে বাঁধতে চাইছে। ওরা আমাকে অন্যায়ের জাল ফেলে বন্দী করতে চাইছে। আমাকে তুমি মুক্তি দাও, আমাকে তুমি পরিত্রাণ করো। সমস্ত কলুষ বিনাশ করে আমাকে তুমি পরিশুদ্ধ করো। আমাকে বাঁচাও।

আস্তে আস্তে এক সময়ে পৃথিবীতে দিন হলো। দিগন্তে সূর্য উঠলো, লোকালয়ে কোলাহল। নবাবগঞ্জ পেরিয়ে কোমলপুর, কোমলপুর পেরিয়ে ছুটিপুর। ছুটিপুর পেরিয়ে আরো অনেক দূরে চলো। আরো অনেক দূর তোমাকে যেতে হবে সদানন্দ। আরো অনেক দেশ।

মনে আছে যখন খেয়াল হলো তার তখন নবাবগঞ্জ ছাড়িয়ে সে অনেক দূর চলে এসেছে।

মনে হলো কে যেন পেছন থেকে ডাকলে–কে গো তুমি? বাড়ি কোথায় গো তোমার?

মেয়েলি গলা। গলাটা শুনেই সদানন্দ পেছন ফিরলো। হাতে বাজারের থলি, মাথায় ঘোমটা। ডুরে শাড়ি পরা মেয়েমানুষ।

রাস্তার মেয়েমানুষ এমন করে সাধারণত কোনও অচেনা পুরুষকে ডাকে না। সদানন্দ অবাক হয়ে গেল দেখে।

–প্রকাশবাবু তোমার কে হয় বল তো? মামা না?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ–

–আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। আমার নাম রাধা। আমাকে মনে পড়ে তোমার? সেই তোমার মামার সঙ্গে তুমি আসতে আমার বাড়িতে। মনে পড়েছে?

সদানন্দ যেদিকে যাচ্ছিল সেই দিকেই চলতে চলতে বললে—হ্যাঁ—

কিন্তু রাধা একেবারে সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো। বললে–তোমার মাথায় কী হয়েছে? ব্যাণ্ডেজ বেঁধেছ কেন?

সদানন্দ বললে–ডাক্তার বেঁধে দিয়েছে–

–তুমি যাচ্ছো কোথায়?

সদানন্দর তখনও যাবার কোনও নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। হঠাৎ তার মুখ দিয়ে কোনও উত্তর না বেরোতে রাধার কেমন সন্দেহ হলো। সদানন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ দেখেও অবাক লাগলো। একটা ধুতি আর গেঞ্জি শুধু। গায়ে অন্য কোনও জামাও নেই। সন্দেহ হতেই রাধা সদানন্দর হাতটা ধরে ফেললে। বললে–এসো, আমার বাড়িতে এসো—

সদা আপত্তি করতে গেল। কিন্তু রাধা ছাড়বার পাত্রী নয়। বললে–আমি তোমাকে ছাড়ছি নে, তোমার মামা শুনলে কী বলবে বলো তো! বলবে তুমি সদাকে রাস্তায় দেখলে তবু এই অবস্থায় তাকে ছেড়ে দিলে?

আর কোনও ওজর-আপত্তিতে কাজ হলে না। রাধার সেই পুরোন বাড়িটা। অনেকবার সদানন্দ মামার সঙ্গে গিয়েছিল আগে। সে-সব ছোটবেলাকার ব্যাপার। তখন সদানন্দ বুঝত না কিছু। যাত্রা শুনে ফেরবার মুখে শেষরাত্রে রাধার বাড়িটাই ছিল প্রকাশমামার আশ্রয়। প্রকাশমামা এসে রাধাকে খুব চোটপাট করতো। এই রাধা ঘুম থেকে ওঠবার পর ঘোলের সরবৎ করে দিয়েছে। রাধার বাড়িতে বসে মাছের ঝোল দিয়ে দু’জনে মিলে কতদিন ভাত খেয়েছে। তারপর সন্ধ্যেবেলা প্রকাশমামা বোতল বের করে মদ খেতে শুরু করেছে। তখন রাধা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়েছে। সেসব দিনে সদানন্দ কিছু বুঝতো না বলে প্রকাশমামা অনেক রকম মিথ্যে কথা বলে ভুলিয়েছে তাকে। রাধার বাড়িতে রাধার হাতের রান্না খেলে জাত যায় বলে প্রকাশমামা বারবার রাধার বাড়িতে ভাত খাওয়ার কথা বাবাকে বলতে বারণ করে দিয়েছে।

সেদিন সেই সকালবেলা সদানন্দকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাধা অনেক খাতির করলে। সদানন্দ চেয়ে দেখলে ঘরের ভেতর সেই তক্তপোষটা তখনও রয়েছে, সেই পুতুল ভরা কাঁচের আলমারিটা। কাঠের জলচৌকির ওপর রাধার সেই ঠাকুর। কেষ্ট ঠাকুর। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রাধা পূজো করতো রোজ। দেখে মনে হলো সেদিনও সে পুজো করেছে। তখনও ঠাকুরের সামনে ফুল বেলপাতা রয়েছে।

দুপুরবেলা খেয়ে উঠে সদানন্দ বললে–আমি এবার যাই–

রাধা বললে–তোমার তো বিয়ে হয়েছে, না?

সদানন্দ বললে—হ্যাঁ–

–বউ কেমন হলো?

সদানন্দ বললে–ভালো।

রাধা বললে–তোমার মামা কিন্তু আমাকে বলেছিল তোমার নাকি বউ পছন্দ হয়নি। তুমি বউএর সঙ্গে নাকি শোও না।

সদানন্দ বললে–আমার মামার কথা তুমি বিশ্বাস করো নাকি?

রাধা বললে–বিশ্বাস আর কী করেই বা করি! তোমার মামাই তো আমাকে এ-পথে এনেছিল। তখন অনেক কিছু কথা দিয়েছিল, অথচ একটা কথাও রাখলে না–

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–কী কথা দিয়েছিল?

রাধা বললে–তুমি তার ভাগ্নে হও, সব কথা তোমাকে বলাও যায় না। আর সে-সব আজকের কথাও নয়, বলতে গেলে এখন আর মনেও পড়ে না সে-সব কথা। তখন যে কী মতি হয়েছিল আমার, তোমার মামার কথাতেই ভুলে গিয়ে চলে এসেছিলুম, নইলে কি আর আজ আমার এই দশা হয়? তখন শুনেছিলুম তোমার মামার নাকি অনেক টাকা, মস্ত বড় জমিদার। ভেবেছিলুম শান্তি না-পাই সুখ তো পাব। ভালো শাড়ি পরতে পাবো, ভালো-ভালো গয়না পরতে পাবো

কথা বলতে বলতে সেদিন রাধার চোখ দুটো কেমন যেন ভারি হয়ে উঠতে লাগলো।

–ওই শাড়ি-গয়নার লোভই আমাকে পথে নামিয়েছিল বাবা। নইলে তো অন্য কোনও লোভ ছিল না। গরীবের ঘরে জন্মেছিলুম বলে বড় দুঃখ ছিল আমার। ভেবেছিলুম তোমার মামার সঙ্গে গেলে যদি দুঃখটা ঘোচে তো তাই-ই বা মন্দ কী! কিন্তু পরে বুঝলুম সব মিথ্যে কথা। তোমার মামার যে কিছুই নেই তা কী করে তখন আমি বুঝবো? বাড়িতে যে তোমার মামার একটা বউ আছে সেকথাটাও আমাকে একবার বলেনি মুখ ফুটে–

সদানন্দ বললে–তা তুমি মামাকে ছেড়ে চলে গেলে না কেন?

রাধা বললে–ছেড়ে যাবো কোথায় বাবা, ছেড়ে গেলে কে আর আমায় দেখবে বলো? আর তোমার মামাকে তো চেন, যতবার কথাটা কানে তুলেছি ততবার একটানা-একটা ছুতো দিয়েছে। আর তারপর এখন তো বয়েস হয়ে গেছে, এখন এই বয়েসে আর কোথায় যাবো, বেশ আছি। একবার কালীঘাটে মায়ের দর্শন করবার ইচ্ছে হয়েছিল, তাও হলো না–

সদানন্দ বললে–তা তুমি পালিয়ে গেলে না কেন? মামাকে ছেড়ে তোমার বাবা-মার কাছেও ফিরে যেতে পারতে?

রাধা বললে–তুমি ছেলেমানুষ বাবা তাই ওকথা বলছো। বয়েস হলে বুঝতে সংসারে কেউ কারো নয় বাবা, কেউ কারো নয়, বাবাই বলো আর মাই বলো, সবাই পর। শুধু একলা তোমার মামার দোষ দিয়ে লাভ কী? তোমার মামাকে ছেড়ে যদি অন্য কারো কাছে গিয়ে দাঁড়াতুম তো সেও এই একই রকম করতো–

বলে রাধা কাঁদতে লাগলো।

সদানন্দ আর কথা বাড়াতে দিল না। কথা বাড়ালেই কান্না বাড়বে রাধার। এ রাধাকে আগে কখনও দেখেনি সদানন্দ। আগেকার রাধা গান গেয়েছে, পান-দোক্তা খেয়ে হেসেছে, বোধবয় মদও খেয়েছে প্রকাশমামার সঙ্গে। কিন্তু এতদিন পরে এ এক অন্য রাধাকে দেখলে সদানন্দ। এবারকার এরাধা ঠাকুরপূজো করে। এরাধা কালীঘাটে মায়ের দর্শন করতে চায়। এরাধা কাঁদে। নিজের দুঃখের কথা বলতে গিয়ে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর রাধা বললে–তুমি শুয়ে পড়ো বাবা-দরজায় খিল দিয়ে দাও, আমি আসি

–কিন্তু তুমি? তুমি কোথায় শোবে?

–আমার জন্যে তুমি ভেবো না। আমার কি আর শোবার জায়গার অভাব? এ-পাড়ায় আমাদের অনেক বাড়ি আছে, যার-তার বাড়ির একটা ঘরে গিয়ে পড়ে থাকবো। আমার জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না–

বলে রাধা চলে গিয়েছিল। মনে আছে সেই তক্তপোষের ওপর শুতে কেমন খারাপ লেগেছিল সদানন্দর। তবু রাধার মনে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হয়নি তার। পরের দিন সকালে উঠেই কোথাও চলে যেতে চেয়েছিল সে, যেখানে গেলে নবাবগঞ্জের কেউ আর তার নাগাল পাবে না।

কিন্তু মাঝ রাত্রে হঠাৎ একটা শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো দুম-দুম্ করে কেউ যেন তার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।

সদানন্দ ধড়মড় করে উঠে পড়েছে। রাধা নাকি! ঘরে হয়ত রাধার জিনিসপত্র আছে, তাই নিতে এসেছে।

খিলটা খুলতেই সদানন্দ দেখলে একজন অচেনা লোক। টলছে। খুব মদ গিলেছে বোধহয়।

–এতক্ষণ ধরে দরজা ঠেলছি, খুলছিস না কেন? মরণ-ঘুম ঘুমিয়েছিলি নাকি?

কথাটা বলেই তারপর বোধহয় একটু খেয়াল হলো। বললে–তুমি কে বাবা? হ্যাঁ?

নেশার ঘোরের মধ্যেও লোকটার বোধহয় একটু জ্ঞান ছিল তখনও। বুঝতে পেরেছে। যে-লোকটার সঙ্গে কথা বলছে সে মেয়েমানুষ নয়, পুরুষমানুষ।

–কাকে চাই?

লোকটা বললে–আপনাকে ডিস্টার্ব করলুম নাকি ভাই? হাত জোড় করছি, আমাকে মাফ করুন, আমি জানতুম না, রাধার যে বাঁধাবাবু আছে তা একদম স্রেফ ভুলে গিয়েছিলুম–

সদানন্দ বললে–ঠিক আছে, আপনি আসুন, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি বলে যেমন অবস্থায় ছিল তেমনি অবস্থাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো সে। লোকটা তখনও বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। বললে–আপনি কোথায় যাচ্ছেন ব্রাদার?

কিন্তু সদানন্দ সেকথায় কান দিলে না। রাধার বাড়ি ছেড়ে একেবারে বাজারের রাস্তায় গিয়ে পড়লো। বাজার তখন ফাঁকা। রেল-স্টেশনের বাজার। বন্ধ দোকান-ঘরগুলোর সামনের মাচাতেই অনেক ব্যাপারি শুয়ে আছে। তারপর সেখান থেকে একেবারে সোজা রেল-স্টেশনের প্লাটফরম্।

শব্দটা রাধার কানেও গিয়েছিল। যা ভয় করছিল সে তাই-ই হয়েছে। দৌড়তে দৌড়তে নিজের ঘরের কাছে এসেই যা দেখলে তাতে মাথায় রক্ত উঠে গেল। বললে–তুমি হঠাৎ কোত্থেকে এলে? আমার ঘরে লোক ছিল তাকে কোথায় বার করে দিলে?

লোকটা হেসে উঠলো দাঁত বার করে, বললে–তা আমি কী করে জানবো তোমার বাবু এসেছে আজকে? আমার অপরাধটা কী দেখলে? দরজায় তাহলে নোটিশ লিখে দেওয়া উচিত ছিল। এমন বেদিনে আসে কেন তোমার বাবু?

রাধা আর থাকতে পারলে না। সোজা একেবারে লোকটার গলাটা চেপে ধরলে। বললে–তাবলে তুমি আমার ঘরের লোককে তাড়িয়ে দিলে কেন তাই আগে বলো? কেন তাড়িয়ে দিলে? বলো? না বললে–তোমাকে আমি খুন করে ফেলবো, বলো?

লোকটা একে নেশায় টলছে, তার ওপরে মাঝরাত, তার ওপর আবার রাধা খুব জোরে গলাটা টিপে ধরেছে। এমন অবস্থার জন্যে তৈরি ছিল না সে। বলতে গেল–ছাড়ো আমাকে, ছেড়ে দাও…

কিন্তু রাধা তাকে কিছুতেই ছাড়বে না। বললে–আগে তুমি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও আগে–

লোকটা তখন কাবু হয়ে গেছে। তার গলাটা তখনও ধরে রেখেছে রাধা।

বললে–আমি তোমার এখানে থাকবো বলেই যে এসেছিলুম, আমি না-হয় আরো বেশি টাকা দেব–যত টাকা চাইবে তত টাকাই না-হয় দেব

রাধা চেঁচিয়ে উঠলো তোমার টাকায় আমি ঝাঁটা মারি, আমায় তুমি টাকা দেখাচ্ছ, বেরোও এখন থেকে বেরিয়ে যাও–

লোকটা সেই ঝাপসা অন্ধকারের মধ্যে বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

আবার সেদিন চৌধুরী মশাই-এর বাড়ির ভেতর থেকে গোলমাল উঠলো।

সদানন্দ বাড়ি থেকে চলে যাবার পর প্রথম প্রথম কেউ বুঝতে পারেনি। ঘটা করে শ্রাদ্ধ হলো কর্তাবাবুর। ঘটা বটে, কিন্তু আগেকার মত তেমন ঘন-ঘটা যেন নয়। আগের মত ভিয়েন বসলো বারবাড়ির উঠোনে। গ্রামের লোকও এল পাত পেড়ে খেতে। কিন্তু সবাই নয়। নেমন্তন্নর ব্যাপারেও কিছু উনিশ-বিশ করা হলো। চৌধুরী মশাই বললেন–একটু কষে লিস্টি করো কৈলাস, খরচা আর বাড়াতে চাই নে। এমনি কর্তাবাবুর অসুখে অনেক খরচ হয়ে গেছে–

রাত্রে যখন যে-যার বাড়ি চলে গেছে তখন বেহারি পালের বউও কাজকর্ম সেরে বাড়ি চলে আসছিল। হঠাৎ দেখলে নয়নতারা নিজের ঘরের দরজার চৌকাট ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

কেমন খারাপ লাগলো দেখতে। এত লোক-জন, এত খাওয়া-দাওয়া, এর মধ্যে বাড়ির পুত্রবধূ এ-রকম মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

জিজ্ঞেস করলে–কী বউমা, তোমার মুখটা শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে কেন? তুমি খাওনি?

নয়নতারা এতক্ষণে যেন একজন শুভাকাঙ্খীর দেখা পেয়েছে এমনি ভাবে জিজ্ঞেস করলে আপনি খেয়েছে দিদিমা?

দিদিমা বললে–আমার কথা ছেড়ে দাও, আমি তো খাবোই, কিন্তু তুমি এবাড়ির বউ, তোমাদের বাড়িতে এত লোকজনের আনাগোনা, তুমি কোথায় সকলকে দেখাশুনা করবে, আর তুমিই কিনা মুখ গম্ভীর করে আছো?

নয়নতারা মুখে একটু হাসি ফোঁটাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললে–কই, গম্ভীর মুখ করে থাকিনি তো!

দিদিমা বললে–নিশ্চয় কিছু হয়েছে। বলো তো বউমা কী হয়েছে তোমার? খাওয়া হয়নি বুঝি? খেয়েছ? খেয়েছ তুমি?

ও-দিক থেকে শাশুড়ি বুঝি হঠাৎ সেই দিকেই আসছিল। তার কানে গিয়েছে কথাটা।

বললে–কে? কে খায়নি মাসিমা? কার কথা বলছো?

মাসিমা বললে–এই বউমার কথা বলছি। বউমার মুখখানা শুকনো-শুকনো দেখলুম কি না তাই জিজ্ঞেস করছিলুম বউমা খেয়েছে কি না—

শাশুড়িও বউয়ের দিকে চেয়ে বললে–কী বউমা, তুমি খাওনি?

নয়নতারা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু উত্তর দিলে না। উত্তর দিলে বলতে হতো কেউ তাকে খেতে বলেনি তো সে খাবে কী করে?

কিন্তু শাশুড়ি সে দিক দিয়েও গেল না। বললে–খাওনি তুমি? কিন্তু খাওনি কেন? এত লোক খেয়ে গেল আর তুমিই বা খেলে না কেন? কেউ বলবে তবে তুমি খাবে? একটু খেয়ে নিয়ে আমার উপকার করবে তাও তোমার দ্বারা হবে না?…তবু যদি একটা ছেলে বিয়োতে পারতে তো বুঝতুম–

মাসিমা বললে–আহা কেন তুমি ওকে বকছো বউ, ও পরের বাড়ির মেয়ে, সেদিন সবে নতুন বউ হয়ে এসেছে, ও নিজের মুখে কী করে খাওয়ার কথা বলে? তোমারই ওকে খাওয়াতে বসানো উচিত ছিল।

–তুমি রাখো তো মাসিমা! নতুন বউ! আমরা কি কোনওকালে বউ হইনি, না শাশুড়ির ঘর করিনি। আমি যদি আমার শাশুড়ির কাছে অমন বেয়াড়াপনা করতুম তা আমার শাশুড়ি আমার মুখে ঝামা ঘষে দিত না—

মাসিমা বললে–বউ, তুমি তোমার শাশুড়ির নামে অমন করে কথা বলো না, আমি তাঁকে চিনতুম, তিনি স্বগ্যে গেছেন, একদিনের জন্যেও তিনি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করেননি–

প্রীতি বললে–তুমি তো আমার শাশুড়ির দিকটাই কেবল দেখলে মাসিমা। আমার দিকটার কথাও ভাবো। আমি কি আমার শাশুড়ির সঙ্গে কোনওদিন গলা উঁচু করে কথা বলেচি, না বলবার সাহস হয়েছে।

–যাকগে, সেসব পুরোন কথা থাক, এখন তুমি খেয়ে নেবে এসো বউমা–-এসো– বলে বেহারি পালের বউ নয়নতারার হাত ধরে টানলে।

প্রীতি তার আগেই চেঁচিয়ে ডাকলে–ওলো ও গৌরী, বউমাকে খেতে দিসনি কেন, হ্যাঁ? কোনও দিকে কি তোর হুঁশ থাকে না?

গৌরীরও তখন খাওয়াদাওয়া চুকে গেছে। সে তখন পান চিবুচ্ছে। সে রান্নাবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বললে–ওমা, তাই নাকি? বউমা খায়নি? তা আমাকে বলবে তো? বউমা কি কুটুম্ব মানুষ নাকি যে ডেকে খাতির করে খাওয়াতে বসাতে হবে? আমরা সবাই যখন খেতে বসলুম তখন একটা পাতা পেতে নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসে পড়লেই হতো–

বেহারি পালের বউ বললে–তুমি আর কথা বাড়িও না বাছা, কী দেবার আছে দাও দিকিনি বউমাকে, আমি পাশে বসে খাওয়াচ্ছি–

খেতে খেতে নয়নতারা যখন দেখলে কেউ কোথাও নেই তখন কান্নায় ভেঙে পড়লো। বললে–আর খেতে পারবো না দিদিমা, আমাকে আর খেতে বলবেন না আপনি।

দিদিমা বললে–না খাও, ওদের কথায় রাগ করতে নেই, রাগ করলে নিজেই ঠকবে–

নয়নতারা বললে–এর পরেও এই ছাই আমার গলায় ঢোকে?

দিদিমা বললে–গলায় ঢুকুক আর না ঢুকুক, জোর করে গিলে ফেল। তোমার তো এই খাওয়ার বয়েস। আর তা ছাড়া খাবেই বা না কেন? কার ওপর রাগ করে তুমি উপোস করবে? শাশুড়ি মানুষেরা ওরকম বলেই থাকে। আমার শাশুড়িও আমাকে ওরকম কত বলেছে। তোমার শাশুড়ি যখন বউ মানুষ ছিল তখন কত খোঁটা খেয়েছে নিজের শাশুড়ির কাছে। এখন মারা গেছে তাই অত তার গুণপনা ব্যাখ্যা হচ্ছে। আবার তুমিও যখন শাশুড়ি হবে তখন তুমিও তোমার বেটার বউকে অমনি বকবে। এ সব বাড়ির নিয়ম। ও নিয়ে রাগ করতে নেই–

নয়নতারা বললে–আপনি সব জানেন না তাই ওকথা বলছেন দিদিমা, জানলে আর বলতেন না–

দিদিমা বললে–কেন, আগে যে তোমাকে শাশুড়ি খুব আদর করতে দেখেছি। তোমাকে সিন্দুকের চাবি দিয়ে দিয়েছিল।

নয়নতারা বললে–সে চাবি এখন নিয়ে নিয়েছেন–

–সে কী? নিজে থেকে যে তোমার আঁচলে বেঁধে দিয়েছিল, আবার নিজেই সে-চাবি নিয়ে নিয়েছে?

–হ্যাঁ!

–কেন? কী করেছিলে তুমি?

–আমি আবার কী করবো! চাবি আমার কাছে থাকলেও আমি সিন্দুক কোনও দিনই ছুঁইনি। একদিন উনিই আমাকে বললেন চাবি দিয়ে দিতে, আমিও দিয়ে দিলুম

হয়ত আরো কথা হতো এ প্রসঙ্গে কিন্তু ঠিক সেই সময়ে শাশুড়ি সেখানে আসতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল। বললে–কী, এখন বউমার রাগ ভাঙলো?

মাসিমা বললে–তুমি আর অমন খোঁটা দিয়ে কথা বোল না বউ, একটু আদর করলেই পারো তুমি নিজে

প্রীতি বললে–আমাকে কে আদর করে তার ঠিক নেই আমি করবো বউ-এর আদর। আমার কি সময় আছে মাসিমা যে জনে জনে দেখে বেড়াবো কে আদর পাচ্ছে কে পাচ্ছে না। সেই রাত থাকতে উঠিচি আর কখন যে শুতে যেতে পারবো তার ঠিক নেই, আমার মাথা-হাত-পা সব টনটন করছে তা জানো?

ততক্ষণ আরো অনেক রাত হয়েছে। সারা বারবাড়ির উঠোনে তখন কলাপাতা নিয়ে রাস্তার কুকুরদের টানাহ্যাঁচড়া চলছে। বেহারি পালের বউ আর দাঁড়ায়নি সেখানে।

বাড়িতে আসতেই বেহারি পাল জিজ্ঞেস করলে কীগো এত দেরি যে তোমার?

গিন্নী বললে–এদের শাশুড়ি বউ-এর কাণ্ড দেখছিলুম, তাই দেখতেই দেরি হয়ে গেছে। নইলে খাওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।

–শাশুড়ি বউ-এর ঝগড়া? বেহারি পাল উৎসাহিত হয়ে উঠলো।

তা এসব সেই গোড়ার দিকের কথা। এর পর অনেক কাণ্ড ঘটে গেছে। অনেক ঝড় বয়ে গেছে চৌধুরীবাড়ির ওপর দিয়ে। সেদিনকার সেই ঘটনার পর বেহারি পালের বউ এরও ওবাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। বলতে গেলে দুবাড়ির মধ্যে আর মুখ-দেখাদেখিও নেই।

তারপর সেদিন হঠাৎ বিকেল বেলাই চৌধুরী মশাই-এর বাড়ির ভেতর থেকে আবার সেইরকম গোলমাল উঠলো।

রেল বাজারের পাটের আড়তদার প্রাণকৃষ্ণ সা মশাই বেহারি পালের দোকানে বসে বৈষয়িক কথাবার্তা বলছিল।

হঠাৎ চৌধুরী মশাই-এর বাড়ির ভেতরের গোলমাল শুনে বললেও কীসের গোলমাল পালমশাই?

বেহারি পাল বললে–ওই, শাশুড়িবউতে শুরু হয়েছে–

–শাশুড়িবউ?

প্রাণকৃষ্ণ সা মশাই অবাক। বললে–গলা তো একজনেরই শুনতে পাচ্ছি। ও বোধহয় চৌধুরী মশাই-এর গিন্নীর গলা। কাকে বকছে এত?

–ওই ছেলের বউকে।

–কেন? ছেলে তো শুনি নিরুদ্দেশ। তা ছেলের বউ আবার কী দোষ করলো?

বেহারি পাল বললে–কে জানে কী দোষ করেছে। ছেলে পালিয়ে গেছে সেটাও বউ এর দোষ। বউকে শুনি শাশুড়ি নাকি পেট ভরে খেতেও দেয় না। আমার গিন্নী মাঝে মাঝে লুকিয়ে-গিয়ে খাইয়ে আসতো, এখন আবার তাও বন্ধ হয়ে গেছে–

–কেন?

বেহারি বললে–ওই যে আমার কারবার একটু বড় হয়েছে। আপনি আগে ওখেনে যেতেন এখন আমার কাছে আসেন এটাও ওদের ভালো লাগে না। সহ্য হয় না আর কি!

প্রাণকৃষ্ণ সা তবু খুশী হলো না কারণটা শুনে। বললো–তাই ছেলেই বা বিয়ে থা করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল কেন? আমরা তো কিছু বুঝতে পারিনে। আর তারপর থেকে চৌধুরী মশাইও দেখেছি ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে আর মন দিচ্ছেন না আগের মত। ছেলে চলে যাওয়াতে বোধ হয় মনটা ভেঙে গেছে।

খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর সা মশাই নিজের কাজে চলে গেল। বেহারি পাল বাড়ির ভেতরে যেতেই দেখলে গিন্নী চৌধুরীবাড়ির দিকে কান পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কর্তাকে দেখেই বললে–ওই শোন, শুনছো তো?

বেহারি পাল বললে–শুনেছি তো, কিন্তু শুনে তো কোনও লাভ নেই। কিছু তো করতে পারবো না আমরা। শুধু মনের কষ্ট–

গিন্নী বললে–ওসব আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, জানো? যাতে আমার কানে আসে। অথচ আমি কী দোষ করলুম। তোমাদের শাশুড়ি-ছেলে-বউ-এর ব্যাপার, আমি তার মধ্যে কে? আমি তো কেউই নই। নেহাৎ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমার বাড়িতে ছুটে এসেছিল, এই আমার দোষের মধ্যে দোষ হয়েছিল! তা আমি এর কী করবো বল?

বেহারি পাল বললে–তুমি না-শুনলেই পারো? শুনছো কেন? আসলে তো রাগ তোমার ওপরে নয়, রাগ আমার ওপরে। আমার অপরাধ আমার কারবার কেন বড় হয়েছে, আমার কেন টাকা হয়েছে। প্রাণকৃষ্ণ সা মশাই এখন আমার এখানে কেন এত আসে….তা তুমি তোমার নিজের কাজ করো গিয়ে, ওদিকে কান দিয়ে লাভ নেই।

বলে ওদিককার পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিলে বেহারি পাল।

.

বাতাসীর নতুন বাড়িটা ভালো। মাসির সস্তার বাড়ি ছেড়ে বড়বাবু বাতাসীকে একেবারে পাকা দোতলা বাড়িতে এনে তুলেছিল। মাসির বাড়িতে বড় আজেবাজে লোকের আনাগোনা। ওতে ইজ্জৎ চলে যেত বড়বাবুর।

বড়বাবুদের কাছে ইজ্জতের দামটাই সব চেয়ে বেশি। ঘরের দরজায় খিল দিয়ে আমি যা-ই করি, বাইরে তো ইজ্জৎ বাঁচিয়ে চলতে হবে। সেই ইজ্জতের জন্যেই বাতাসীর পাকাবাড়ির সঙ্গে সঙ্গে তার গায়ে দামী-দামী গয়নাও উঠেছিল। সারাদিন ধরে বাতাসীর আর কোনও কাজ থাকে না। দুপুর বেলা বিছানায় শুধু গড়ানো আর বিকেল হতে-না-হতে গা ধুয়ে খোঁপা বেঁধে সেজেগুজে তৈরি হয়ে বসে থাকা। কখন বড়বাবু আসবে তারই জন্যে প্রতীক্ষা।

একটা তো মাত্র মেয়েমানুষ। কিন্তু তার জন্যে সাজ-সরঞ্জামের কিছু কমতি নেই। দারোয়ান, ঝি, রাঁধুনী। বড়বাবুর সেবায় যেন কোনও ত্রুটি না হয়। সন্ধ্যে হয় আর ঘড়ির দিকে তাকায় বাতাসী। হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে।

তা সেদিন বেলাবেলিই এসে গেল বড়বাবু।

ঘরে ঢুকেই দেখে বাতাসী একমনে কী একটা দেখছে।

বড়বাবু জিজ্ঞেস করলে–কী দেখছিলে?

–এই ছবিটা!

–ছবি? ফটো? এ কার ফটো? বড়বাবু ফটোটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। উস্কোখুস্কো মাথার চুল, লম্বা নাক, গায়ের রংটাও ফরসা মনে হচ্ছে।

–এ কার ছবি?

–মাসি দিয়ে গেছে আমাকে। এই ছেলেটা বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। এর মামা এসেছে কলকাতায় খুঁজতে। কোথাও পাচ্ছে না একে। তুমিই তো ফোটো চেয়েছিলে এর। বলেছিলে ফোটো না পেলে খুঁজে বার করতে পারবে না। এর নাম নিচেয় লেখা রয়েছে। পড়ে দেখ না–

বড়বাবু পড়ে দেখলে ফোটোর তলায় লেখা রয়েছে–সদানন্দ চৌধুরী–

সদানন্দ চৌধুরী! বড়বাবু ছবিখানা নিয়ে দেখতে লাগলো। তারপর বললে–এ বাড়ি থেকে পালিয়েছে কেন?

বাতাসী বললে–সে আমি কী জানি–মাসি আমাকে দিয়েছে আমি তাই তোমাকে দিলুম–

বড়বাবু অফিসে উদয়াস্ত খাটে। অফিসের কাজে কখনও তাকে যেতে হয় কলকাতার বাইরে। আবার অনেকদিন কলকাতাতেই দিন কাটে। অফিসের লোক থেকে শুরু করে অফিসের বাইরের লোক বাই তটস্থ থাকে বড়বাবুর ভয়ে। অফিসে কনস্টেবলরা বড়বাবুকে দেখলে চোখের আড়ালে চলে যায়। বড় জাঁদরেল সাহেব বড়বাবু। এককালে স্বদেশী ছোকরাদের ধরে ধরে আগা-পাশ-তলা বেত মেরে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। সেকালে কত স্বদেশী ছেলে যে বড়বাবুর হাতে খুন হয়েছে তার ঠিক নেই। তারপরে যুদ্ধ হয়েছে, যুদ্ধ থেমেও গেছে। কিন্তু প্রতাপ তখনও কমেনি বড়বাবুর। বরং বেড়েছে।

এক-একদিন সন্ধ্যেবেলা এসে পৌঁছোয় আর যখন রাত কাবার হয়ে যায় তখন উঠে পড়ে। কোথা থেকে একটা জিপগাড়ি এসে বাড়ির তলায় রাস্তায় দাঁড়ায় আর বড়বাবু তখন ঘুম থেকে উঠে গিয়ে সেই গাড়িতে গিয়ে বসে। আর গাড়িটা বড়বাবুকে নিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়। বাতাসী আর দেখতে পায় না বড়বাবুকে।

তখনকার মত বাতাসীর ছুটি। তারপর যখন আবার বিকেল হবে তখন থেকে শরীরটাকে ঘষে মেজে তৈরি করে নিতে হবে। সেজে-গুজে অপেক্ষা করতে হবে বড়বাবুর পথ চেয়ে।

কিন্তু বড়বাবুর অফিসে সেই সময়ই যত কাজ। মোটা বুট-জুতোর ভারি শব্দে তখন লালবাজার থর থর করে কাঁপবে! লালবাজারটা বড়বাবুর অফিস, কিন্তু সারা কলকাতাটা জুড়ে বড়বাবুর দাপট। বড়বাবুর দাপটে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে পুলিস কমিশনার পর্যন্ত সবাই নিশ্চিন্ত। যখনই কোথাও গোলমাল হবে তখন কে সামলাবে–? সামন্ত!

এক-একটা তেমন ঘোরালো কেস হলেই ভার পড়ে সামন্তর ওপর। একটা মস্ত ডাকাতির কেস থেকেই নাম-ডাক হলো সুশীল সামন্তর। ডাকাতিটা স্বদেশীদের করা। কিন্তু কিছুতেই তার কিনারা করা যায় না। হোম-মিনিস্ট্রি থেকে কড়া অর্ডার এলো। এক একজনকে ভার দিয়ে পাঠানো হলো। সবাই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো।

শেষকালে ফাইলটা এলো সামন্তর কাছে।

সামন্ত শুধু কালপ্রিটদের ধরে ফেললে তাই-ই নয়, সব ছেলেগুলোর লম্বা জেলও হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সামন্তর প্রমোশন। সামন্তর পার্সোন্যাল ফাইল গেল ডেপুটি কমিশনারের কাছে। ডেপুটি কমিশনার ডেকে পাঠালে সামন্তকে।

বললে–সামন্ত, তোমার জন্যে আমি প্রমোশনের রেকমেণ্ড করে দিলুম–

শেষকালে ফাইলটা গেল কমিশনারের কাছে। সেখানে এক কথায় চোখ বুজেই সই হয়ে গেল।

কিন্তু প্রমোশন হওয়াই কাল হলো সুশীল সামন্তর। প্রমোশন না হলে হয়ত এ-সব কিছুই হতো না।

একদিন হাতেনাতে একটা কেস ধরে ফেললে সুশীল সামন্ত। বড়বাজারের মস্ত বড় একজন মার্চেন্ট। ইলেকট্রিক কারেন্ট চুরি করে ফ্যাক্টরির জন্যে। লক্ষ লক্ষ টাকা গভর্নমেন্টকে ফাঁকি দিয়ে কারবার চালাচ্ছে বহু বছর ধরে। খবরটা পেয়েই লুকিয়ে লুকিয়ে ইনভেস্টিগেশন শুরু করে দিলে। তারপর একদিন সোজা গিয়ে হাজির হলো ফ্যাক্টরিতে। ফ্যাক্টরি তখন চলছে। সামন্ত গিয়েই সোজা হাজির পাওয়ার-হাউসে।

পাওয়ার-হাউসের চিফ-ইনজিনীয়ার খবর দিলে মূলচাঁদ আগরওয়ালাকে। মূলচাঁদ আগরওয়ালা হুঁশিয়ার ব্যবসায়ী মানুষ। সহজে দমে না। এ খবরেও দমলো না। সঙ্গে সঙ্গে চিফ-ইনজিনীয়ারকে বললে–তুমি গিয়ে দারোগা সাহেবকে খাতির করে বসাও, আমি আসছি–

মূলচাঁদ আগরওয়ালা বহুদিনের কারবারী। অনেক মিনিস্টার চরিয়েছে, অনেক লাটসাহেবকেও চরিয়েছে। সে জানে কী করে ক্ষমতাওয়ালাদের চরাতে হয়। গাড়িটা নিয়ে বেরোল। সোজা চলে গেল কমিশনারের অফিসে। মূলচাঁদ আগরওয়ালার মুখ চেনে সবাই। কমিশনারের ঘরে বসে অনেকক্ষণ কী সব কথা হলো কেউ জানে না।

যখন কমিশনারের ঘর থেকে মূলচাঁদ বেরোল তখন একটা ঘণ্টা কেটে গেছে। সবাই দেখলে মূলচাঁদ ঘরে ঢোকবার সময়েও যেমন হাসিমুখ, বেরোবার সময়েও তেমনি। সোজা বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িতে উঠে নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি চলে গেল।

কিন্তু এ-ঘটনার তিন দিন পরে হঠাৎ ডেপুটি সামন্তকে ডেকে পাঠালো।

বললে–সামন্ত, তুমি কী করেছিলে হে?

সুশীল সামন্ত তো অবাক। বললে–কেন স্যার?

ডেপুটি বললে–তোমার ডিমোশন হয়ে গেল যে হঠাৎ–

সামন্ত বললে–কেন স্যার? কী করেছি আমি?

–কী জানি। হঠাৎ বড় সাহেব আমাকে ডেকে তোমার ফাইলটা চেয়ে পাঠালো, তারপর এই দেখ কী রিমার্ক লিখে দিয়েছে। আনফিট ফর কনফারমেশন। কনফার্ম হবার যোগ্য নয়।

সুশীল সামন্ত অবাক হয়ে গেল দেখে। এই সেদিন অত বড় একটা কেস ধরে ফেললে। গভর্নমেন্টের বছরে লাখ লাখ টাকার লোকসান বেঁচে গেল। কোথায় তার স্পেশ্যাল রিওয়ার্ড হবার কথা, তা নয় একেবারে ডিমোশান!

ডেপুটি বললে–তোমার হাতে কী কেস আছে এখন বল তো!

সামন্ত বললে–এখন তো স্যার মূলচাঁদের ফ্ৰড কেসটা হাতে রয়েছে। প্রায় এক কোটি টাকার ফ্ৰড কেস–

ডেপুটি মূলচাঁদের নাম শুনে একেবারে চমকে উঠেছে। বললে–করেছ কী তুমি, মুলচাঁদকে ধরেছ? মূলচাঁদ আগরওয়ালা? সর্বনাশ করেছ! একেবারে ভীমরুলের চাকে ঘা দিয়েছ?

সামন্ত বুঝতে পারলে না। বললে–কেন স্যার? মূলচাঁদ কত বড় জোচ্চোর তাকে ধরে কী খারাপটা করেছি? আমার তো রিওয়ার্ড পাওয়ার কথা

–আরে দূর, মূলচাঁদ কে জানো? ও যে বড় সাহেবের পেয়ারের পার্টি। মাসে যে পনেরো-কুড়ি হাজার টাকার ভেট দেয় বড় সাহেবকে। তারপর আছে মিনিস্টারেরা। তুমি আর ধরবার লোক পেলে না! ধরতে গেলে কিনা একেবারে মূলচাঁদকে?

এ সেই ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকের কথা। পুলিসের লাইনে তখনও সাদা চামড়ার রাজত্ব। সুশীল সামন্তর জীবনেও তখন চাকরির গোড়ার দিক। তখন কলেজ থেকে বেরিয়ে সামনে বড় আদর্শ নিয়ে কাজ করতে ঢুকেছিল পুলিসের চাকরিতে।

কিন্তু চাকরিতে ঢুকে সুশীল সমস্ত পৃথিবীটা যত দেখতে লাগলো ততই সব আদর্শ ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে লাগলো। দেখলে এ পৃথিবীতে যে সৎ হবার চেষ্টা করবে তারই যত দুর্ভোগ। যে সত্যি কথা বলবে তাকেই তত শাস্তি পেতে হবে। অথচ তুমি চুরি করো, ঘুষ নাও, মিথ্যে কথা বলো, চড়চড় করে তোমার চাকরিতে উন্নতি হয়ে যাবে।

তা সেই দিন থেকেই সামন্ত একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেল। দু’হাত ঘুষ নিতে লাগলো, দশ মুখে মিথ্যে কথা বলতে লাগলো। সামন্তর আসামীদের মধ্যে সৎ লোকের জেল হয়ে গেল, অসৎ লোকেরা ছাড়া পেয়ে যেতে লাগলো। লালবাজারের হেড় কোয়ার্টারে সামন্তর তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ! যে মূলচাঁদকে ধরতে গিয়ে তার এত বদনাম, সেই মূলচাঁদের কাছ থেকেই সে তখন দু’হাতে মুঠো-মুঠো ঘুষ নিতে লাগলো। গভর্ণমেন্ট মরে মরুক, আগে তো নিজের পেট। আগে নিজের পেট ভরলে তখন গভর্নমেন্টের ভালোর কথা ভাবা যাবে। তখন কেউ কোনও আর্জি নিয়ে এলেই সামন্ত বলতো–মাল-টাল কিছু এনেছ?

মাল মানে টাকা! টাকা না ছাড়লে সামন্ত কথাই বলবে না। আগে কড়ি ফেল তখন তেল মেখো।

এই হলো বড়বাবু। সেই সামন্তই পুলিস লাইনে থেকে-থেকে শেষকালে একদিন রাঘব বোয়াল হয়ে উঠলো। মদের গন্ধ একবার নাকে গেলেই হলো, টাকার ছোঁয়াচ একবার পেলেই হলো, মেয়েমানুষের নাম একবার শুনলেই হলো। তখন আর সামন্তকে পায় কে।

সেই একদিন কোথায় কোন্ কেসের ভার নিয়ে কোথায় গিয়েছিল, সেখান থেকে যখন ফিরলো তখন সঙ্গে একটা মেয়ে মেয়েমানুষ।

সামন্ত জিজ্ঞেস করলে–তোমার নামটা যেন কী?

মেয়েটে বললে–বাতাসী।

–বাতাসী? শুধু বাতাসী? আর কিছু নেই?

মেয়েটা বললে–বাতাসীবালা দাসী।

ও দাসী-ফাসীর দরকার নেই। সেখান থেকে মেয়েটাকে সোজা একেবারে নিয়ে এসে তুললো মাসির বাড়িতে।

সামন্ত গিয়ে জিজ্ঞেস করলে–তোমার এখানে খালি ঘর আছে? এ থাকবে–

মাসি তো হাতে চাঁদ পেয়ে গেল–ওমা, কী বলছেন বড়বাবু! দরকার হলে আপনার জন্যে আমি ঘর খালি করে দেব

তারপর বাতাসীর দিকে চেয়ে বললে–কী নাম তোমার মেয়ে?

বাতাসী বললে–বাতাসী—

মাসি বললে–বাঃ, খাসা নাম। যেমন খাসা দেখতে, তেমনি খাসা নাম।

এ হলো সেই দিককার কথা। তখনই সদানন্দকে ভুল করে এই বাতাসীর ঘরেই বসিয়ে দিয়েছিল প্রকাশমামা। আসলে তখন প্রকাশমামাও জানতো না যে ঘরটার ভেতরে আবার একটা মেয়ে এসে জুড়ে বসেছে!

সেই থেকেই বড়বাবু একটা আলাদা বাড়ির সন্ধান করছিল। শেষকালে যখন এ বাড়িটা পেলে তখন এখানেই তুলে নিয়ে এল বাতাসীকে। কিন্তু বাতাসী বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও মাসি বাতাসীকে ছাড়লে না। বড়বাবুর মেয়েমানুষকে খাতির করা মানে বড়বাবুকেই খাতির করা।

সেদিনও মাসি এল। বললে–কীরে, বড়বাবুকে ছবিটা দিয়েছিস?

 বাতাসী বললে–দিয়েছি মাসি, এখন বড়বাবুর তো মেজাজ, কাজের ভিড়ে যদি ছবিখানা হারিয়ে যায় তো গেল।

–তোকে তো বলেছি তুই টাকা পাবি। বড়লোকের এক মাত্তোর ছেলে, বাড়ি থেকে পালিয়েছে, খুঁজে দিতে পারলে তুইও টাকা পাবি, আমারও দুপয়সা হবে। তুই একটু বাছা মনে করিয়ে দিস আজ। তার মামা এসে আমার বাড়িতে বসে ধরনা দিচ্ছে। বুঝলি, আজকে বড়বাবু এলে খোঁচাবি।

.

কিন্তু যে-সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে একদিন নয়নতারার কাহিনী গড়ে উঠেছিল তা নিয়ে যে একদিন এমন করে আগুন জ্বলে উঠবে তা সেদিন কেউ কল্পনা করে উঠতে পারেনি। নবাবগঞ্জের মানুষ কেউই এত কাণ্ডের জন্যে তৈরি ছিল না। গ্রামের লোক সবাই যার যার আপন-সংসার নিয়েই বিব্রত থাকে। তার মধ্যে সবটুকুই কাটে তাস-পাশায়। এরই মধ্যে কারও বউএর ছেলে হয়, কারো আবার ছেলে হয়ে মরেও যায়। ছেলে হলে শাঁখ বাজে, অন্নপ্রাশনে দু’চারজন নেমন্তন্নও পায়। আবার সেই ছেলেই মারা গেলে গলা ফাটিয়ে ছেলের মা দু’চারদিন কাঁদে, তারপর আবার নদীর ঘাটে গিয়ে পাড়ার বউ ঝিদের সঙ্গে ঝগড়াও করে।

তা এবার অন্য রকম।

প্রাণকৃষ্ণ সা’মশাই সেদিনও এসেছিল বেহারি পালের সঙ্গে কথা বলতে।

বেহারি পাল বললে–সা’মশাই, একটা কাজ আপনাকে করতে হবে, বড় জরুরী কাজ—

সা’মশাই বললে–কী কাজ?

বেহারি পাল বললে–পরশুদিন সকাল বেলার দিকে আপনাকে একবার নবাবগঞ্জে আসতে হবে–

–কেন?

–হ্যাঁ, আমরা দল বেঁধে সবাই সেদিন চৌধুরী মশাই-এর বাড়ি যাবো। আপনাকেও সঙ্গে থাকতে হবে–

প্রাণকৃষ্ণ সা’মশাই অবাক। বললে–কেন? দল বেঁধে চৌধুরি মশাই-এর বাড়ি যাবেন কেন আপনারা?

বেহারি পাল বললে–সে এক কাণ্ড হয়েছে–

–কী কাণ্ড বলুনই না?

প্রাণকৃষ্ণ সা’মশাই-এর কৌতূহল আরো বেড়ে গেল।

বেহারি পাল বললে–তবে একটা কথা আপনাকে চুপি চুপি বলি, কথাটা এখন কাউকেই বলবেন না। চৌধুরী মশাই-এর ছেলের বউ আমাদের সবাইকে যেতে বলেছে–

–চোধুরী মশাই-এর ছেলের বউ? এই তো সেদিন শাশুড়ি-বউতে খুব ঝগড়া হচ্ছিল শুনতে পাচ্ছিলুম।

বেহারি পাল বললে–হ্যাঁ, সেই ব্যাপারেই ওদের বউ আমার গিন্নীকে ডেকে যেতে বলেছে। বলেছে সবাইকে নিয়ে আসবেন–

তা শুধু প্রাণকৃষ্ণ সা’মশাই-ই নয়, আরো অনেককেই বলা হলো। সে এক সর্বনেশে কাণ্ড ঘটে গেল। বেহারি পালের গিন্নী নিজে গিয়ে সবাইকে বলে এল।

নিতাই হালদারের বিধবা মা বললে–কী, ব্যাপারটা কী বউ-মা, গিয়ে কী হবে?

বেহারি পালের বউ বললে–তুমি গিয়েই দেখো না কী হবে। আমি আগের থেকে কী করে বলবো কী হবে? ওদের বেটার-বউ আমাদের যেতে বলেছে তাই তোমাকে বলছি–

–কখন যাবো?

–কাল। কাল সকাল বেলাই তোমরা সবাই আমাদের বাড়ি যেও, তখন আমরা একসঙ্গে সব যাবো।

–তবে যে সেদিন বলেছিলে কাউকে ঢুকতে দেয় না ভেতরে? বউ-এর সঙ্গে নাকি কাউকে কথা বলতে দেয় না, দেখা করতেও দেয় না–

বেহারি পালের বউ বললে–-দেখা করতে না-ই বা দিলে, আমরা যদি জোর করে ঢুকে পড়ি তো কে কী করবে? আমাদের তাড়িয়ে দেবে? তা বলে একটা দুধের মেয়েকে বাড়িতে পুরে কষ্ট দেবে, আর আমরা গাঁয়ের পাঁচজন থাকতে কিছু মুখ ফুটে বলতেও পারবো না? আমরা কি মরে গেছি, না ওদের ভয়ে মুখ বুঁজে বসে থাকবো?

সকলেরই ওই এক কথা। সকলেই বললে–ওদের বাড়ির মধ্যে যদি ওরা বউকে মারে ধরে তো আমরা পর হয়ে কী করতে পারি?

বেহারি পাল বললে–আমরা সব করতে পারি। দরকার হলে চৌধুরী মশাই-এর বেয়াইকে কেষ্টনগরে খবর দিতে পারি, চাই কি পুলিসেও ডাইরি করতে পারি–

কথাটা অনেকের মনঃপুত হলো, আবার অনেকের মনঃপুত হলোও না। চৌধুরী মশাই গ্রামের একজন গণ্যমান্য লোক। অনেকেই আবার নানাভাবে চৌধুরী মশাই-এর কাছে উপকৃত। অনেকের টিকিও আবার চৌধুরী মশাই-এর কাছে বাঁধা। পালে-পার্বণে চৌধুরী মশাই-এর বাড়িতে বলতে গেলে সবাই-ই পাত পেড়ে খেয়ে এসেছে। শুধু চৌধুরী মশাইই নয়, কর্তাবাবু যখন সক্ষম মানুষ ছিলেন তখন সবাই তাঁকে ভয়-ভক্তি-সমীহ করে এসেছে। এই তো সেদিন কর্তাবাবুর শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খেয়ে এলুম, তার কয়েক মাস আগে ছেলের বিয়েতেও খুব ঘটা হয়েছিল। তখনও কত আদর-আপ্যায়ন পেয়েছি। এখন চৌধুরী মশাই এর অবস্থা একটু কমজোরী হয়েছে বলে কি একেবারে মুখের ওপর কথা বলবো? মাথার ওপর তো এখনও চন্দ্র-সূর্য উঠছে। এখনও তো কলি উল্টে যায়নি।

কিন্তু এত কাণ্ডের পেছনে যে কী হয়েছিল তা কেউ প্রত্যক্ষভাবে জানে না।

বেহারি পালের বউ বললে–তবে বলি শোন খুড়ীমা, আসলে কী হয়েছিল…

এ যেন যাত্রা-থিয়েটার কবিগানের মত ঘটনা। সেদিনও অনেক রাত। সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। চৌধুরী বাড়িটা নিঝুম হয়ে আছে তখন। কর্তাবাবু মারা যাবার পর থেকেই কৈলাস সামন্তের কাজ কমে গেছে। সে সকাল-সকাল বাড়ি চলে যায় তখন। দীনুরও তেমন কোনও জরুরী কাজ থাকে না। এক চণ্ডীমণ্ডপের সেরেস্তার পরমেশ মৌলিক অনেকক্ষণ খেরো খাতাখানা নিয়ে ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকে। যখন চৌধুরী মশাই উঠতে বলে তখন সে উঠে হারিকেনটা জ্বালিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। তা তখন সে-ও বাড়ি চলে গেছে।

তা ইতিহাসের এও এক অমোঘ পরিহাস বই কি। একজন হর্ষনাথ নিচেয় নামে, তার জায়গায় আর একজন নরনারায়ণ চৌধুরী ওঠে। প্রাণলক্ষ্মী বোধহয় এমনিই রহস্যময়ী। তাই বোধহয় সে একজনের ঘরে সপ্রতিষ্ঠ থাকতে চায় না। একজনের ঐশ্বর্য যখন দম্ভের আকাশ ছুঁয়ে ঈশ্বরকে নাগালের মধ্যে পেতে চায় তখন সে বুঝি অন্য আর একজন লোকের উদার আশ্রয় খোঁজে। ঐশ্বর্য যখন অত্যাচারের প্রতীক হয়ে ওঠে তখনই বোধহয় প্রাণলক্ষ্মীর কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। সে তখন নিঃশব্দে সকলের অগোচরে কণ্টক আশ্রয়ের অবরোধ ত্যাগ করে বাইরে এসে দাঁড়ায়। বলে–আমাকে বাঁচতে দাও দিদিমা, আমাকে বাঁচাও–

কিন্তু কে শোনে কার কথা! তার আর্তনাদ হয়ত কারোর কানেই পৌঁছোয় না কোনভাবে। নবাবগঞ্জের লোক তখন নেশার ঘোরে ঘুমোবে, না প্রাণলক্ষ্মীর যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ শুনবে! কার এত সময় আছে? এমনি করে হয়ত মাসের পর মাস প্রাণলক্ষ্মীর কান্না গুমরে গুমরে একদিন মুখর হয়ে ওঠে, তখন সে গ্রাম ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, নগর জনপদ মহাদেশ ছেড়ে আর এক মহাদেশ, আর এক যুগের আশ্রয়ের জন্য প্রতিক্ষা করে। তখন সেই মহাদেশ সেই যুগ আবার কিছুদিনের জন্যে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে প্রাণলক্ষ্মীর আশীর্বাদে। আবার ধন-ধান্যে ঐশ্বর্যে শান্তিতে ভরে ওঠে সে যুগ। আবার ধন্য হয়ে ওঠে মানুষের সমাজ। ইতিহাসের এমনি নিয়ম। এই নিয়মের এতদিন পৃথিবী চলে আসছে, হয়ত কোটি-কোটি বছর এই নিয়মেই চলবে।

সেদিন কী সৌভাগ্য হয়েছিল কে জানে। শুধু একজন তার কান্না শুনতে পেলে।

দিদিমা সেদিন অঘোরে ঘুমিয়ে ছিল। ডাকাডাকিতে জেগে উঠলো। বললে–কে? কে?

বড় আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল নয়নতারা। দরজা খুলতেও তার ভয় হচ্ছিল সেদিন। মনে হলো কে যেন তার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। বউমা, বউমা–

বাইরে থেকে শাশুড়ির গলা। বউমা, খিল দিয়ে শুয়েছ কেন? তোমায় বলেছি না দরজা খুলে শোবে! তবু দরজা বন্ধ করেছ? খোল দরজা, দরজা খোল—

না, নয়নতারা তখন তার বুকখানাকে পাথর করে ফেলেছে। কিছুতেই সে দরজা খুলবে না। যে যতই বলুক তাকে কেউ অপবিত্র করতে পারবে না। দম্ভের লেহন সে প্রাণ দিয়ে প্রতিরোধ করবে।

তারপর আবার শাশুড়ির সেই চিৎকার কথা শুনছো না যে, খোল দরজা–

নয়নতারা ঘরের মধ্যে পাথরের মত নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দেখা যাক, কে কী করে। দরজা যদি ভেঙে ফেলতে চায় তো ভেঙে ফেলুক। দরজা ভেঙে যদি ভেতরে ওরা ঢুকতে চায় তো ঢুকুক। তোমাদের পীড়নে আমি নতজানু হবো না, আত্মসমর্পণ করবো না কারোর কোনও প্ররোচনায়।

–খুলবে না তো দরজা? ঠিক আছে, দেখি তুমি কত বড় শয়তান মেয়ে হয়েছো… বৃষ্টি তখন আরো জোরে জোরে পড়ছে। পাশের বাগানের গাছগুলোর পাতায় তখন আরো আলোড়ন চলেছে। পৃথিবী বোধহয় রসাতলে তলিয়ে যাবে তখন। নয়নতারা তখন স্থাণুর মত ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে মুহূর্তের পদধ্বনি শুনছে।

কে জানে কেন, তারপর আর দরজায় ধাক্কা পড়লো না। নয়নতারা জানলাটা খুলে বাইরে চেয়ে দেখলে। তার মনের ভেতরের সমস্ত আলোড়ন যেন বাইরের প্রকৃতিতে প্রতিরূপ গ্রহণ করেছে। বাইরে যা ঘটছে সে যেন আর শুধু বাইরেরই নয়, তার ভেতরেরও। ঝড়ে-বৃষ্টিতে ভেতর আর বাহির তার কাছে যেন একাকার হয়ে গেছে।

নয়নতারা জানালা বন্ধ করে দিয়ে আবার তার বিছানায় এসে বসলো। কে তাকে বাঁচাবে! কে তাকে আশ্রয় দেবে! যে ছিল আশ্রয়দাতা সে নিজের আদর্শ নিয়েই নিরুদ্দেশ। সত্যিই তো, তোমার কাছে যদি আমার নিরাপত্তার চেয়ে তোমার নিজের আদর্শই বড় হয় তো হোক, আমি আর কোনও দিন তোমার কাছে আশ্রয়ের জন্যে ভিক্ষে চাইতে যাবো না। তোমার ভীরুতাই তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। একদিন আমিও যেদিন আমার আশ্রয় খুঁজে নিতে আরো দূরে সরে যাবো সেদিন তোমার ভীরুতাই আমাকে সাহস যোগাবে। আমাকে পথ দেখাবে।

অনেকক্ষণ পরে মনে হলো বৃষ্টিটা যেন একটু থেমেছে। জানালার বাইরে তখন আর বাতাসের দাপাদাপি নেই। নয়নতারা কান পেতে শুনতে চাইলে কারো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে কি না। কেউ কোথাও জেগে আছে কি না।

তারপর যখন নিশ্চিন্ত হলো তখন আবার দরজা খুললো সে। খুব আস্তেই দরজা খুলতে হলো যাতে কেউ না জেগে ওঠে। তারপরে সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলে না কী করবে সে। তবে কি এখান থেকে সে চলে যাবে? যেমন করে তার আশ্রয়দাতা একদিন তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল, তেমনি করে এবাড়ি ত্যাগ করবে।

দিদিমার মনে হলো যেন স্বপ্ন দেখছে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।

ফকির আবার ডাকলে—মা–মা—

এবার দিদিমা উঠে পড়লো। বললে–কে রে? ফকির?

ফকির বেহারি পালের মুহুরি। বাড়ির পেছনের বাগানের দিকে গোলাঘরের পাশে থাকে।

ফকির বললে–মা, ও-বাড়ির বউমা তোমাকে ডাকছেন।

বেহারি পালের বউ বললে–ও বাড়ির বউমা? আমাকে ডাকছে?

ফকির বললে–হ্যাঁ, মা–

–তা তুই কী করে জানলি? তোকে কি ডাকলে?

–হ্যাঁ, কুয়োতলা থেকে আমাকে ডেকে বললেন তোমাকে ডেকে দিতে—

বেহারি পালের বউ আর দাঁড়ালো না। একেবারে সোজা বাগানের শেষ প্রান্তে চলে এল। একটু আগেই ঝড়-বৃষ্টি হয়ে জল-কাদা-পেছল হয়ে গেছে চারদিকে। শুকনো পাতা পড়ে জায়গাটা ভরে গেছে। তারই ওপর দিয়ে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে একেবারে গোলাঘরের পেছনে বেড়ার কাছে এসে দাঁড়ালো। বেড়ার ঠিক ওপারেই চৌধুরীদের কুয়োতলা। সেই কুয়োতলার চারপাশে ভ্যারেণ্ডাগাছের ঝোপ্। রাত্তির বেলা সেখানে সাপ-খোপ থাকতে পারে। কিন্তু সে-সব ভয় করতে গেলে নয়নতারার চলবে না।

দিদিমা বেড়ার ওপারে এসেই নয়নতারাকে দেখে জিজ্ঞেস করলে কী বউমা। তুমি ডেকেছ আমাকে?

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ দিদিমা, আমাকে এরা মোটে বেরোতে দেয় না। পাছে আপনার কাছে চলে যাই। চারদিকে দরজায় চাবি দিয়ে রেখে দেয়–এক দণ্ডের জন্যে বেরোতে দেয় না–

–আমিও বউমা ক’দিন থেকে তোমার কথা খুব ভাবছি। তোমার শাশুড়ি তো আমাকেও ঢুকতে দেয় না তোমাদের বাড়িতে, পাছে তোমার সঙ্গে আমি কথা বলতে যাই। সেদিন তোমার চেঁচামেচি শুনে আমি তোমাদের ভেতর বাড়ির দরজা পর্যন্ত গিয়েছিলুম, কিন্তু তোমার শাশুড়ি আমাকে যাচ্ছেতাই করে অনেক কথা শুনিয়ে দিলে। তারপর থেকে আর চেষ্টা করিনি– তা আজ যে বড় তুমি আমাকে ডাকলে? তোমার শাশুড়ি জানতে পারবে না?

নয়নতারা বললে–আমি আর কাউকে ভয় করি না দিদিমা। আমি এতদিন অনেক সহ্য করেছি, আর সহ্য করবো না ঠিক করেছি

দিদিমা বললে–কিন্তু আমি তো বুঝতে পারি না তোমার দোষটা কী? তোমার ওপর কেন তোমার শাশুড়ির এত রাগ

নয়নতারা বললে–দোষ আমার অনেক দিদিমা, সত্যি আমার অনেক দোষ। আজও আমার ঘরে একজন ঢুকতে চেয়েছিল–আমি তাই একদিন রোজ রাত্তিরে দরজায় খিল দিয়ে শুচ্ছি। আজকে আমার শাশুড়ি শাসিয়ে গেছে, বলেছে এবার দেখে নেবে আমি কত বড় শয়তান মেয়ে–

–সে কী? এই কথা তোমাকে বলেছে? কেন, তুমি কী করেছিলে?

–ওই যে আমি ঘরের দরজায় খিল দিয়ে শুয়েছি!

–তা দরজায় খিল দিয়ে শুয়ে অপরাধটা কী করেছ তুমি? তুমি একলা ঘরে শুয়ে থাকো, দরজায় খিল তো দেবেই। খিল দেবে না?

নয়নতারা বললে–না, শাশুড়ি চায় আমি রোজ দরজার খিল খুলে রেখে দিয়ে শুই

–সে কী বউমা? কেন? এ তো ভালো কথা নয়!

 নয়নতারা বললে–সেই কথা বলতেই তো আমি আজকে কুয়োতলায় এসেছি।

–কিন্তু তুমি দরজার খিল বন্ধ করে শুলে তোমার শাশুড়ির কীসের লোকসান?

নয়নতারা বললে–লোকসান আছে দিদিমা।

–কী লোকসান? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

নয়নতারা বললে–বলছি তো, সেই কথা বলতেই এত রাত্তিরে আপনাকে ডেকেছি দিদিমা। আপনি শুনুন মন দিয়ে। আমি যা বলব তা লুকিয়ে ছাপিয়ে বলব না, আমি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের সামনেই বলবো, গ্রামের দশজনকে শুনিয়ে বলবো।

দিদিমা বললে–তার মানে কী বউমা? তুমি কী বলছো আমি তো তার কিছুই বুঝতে পারছি না–তোমার শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের সামনে কী বলবে?

নয়নতারা বললে–কী বলবো তা তখনই আপনারা সবাই শুনতে পাবেন–কিন্তু আপনার আসা চাই দিদিমা, দাদামশাইকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন আপনি। আর গাঁয়ের যাঁরা যাঁরা মাতব্বর লোক তাঁদের সবাইকে নিয়ে আসবেন আমাদের বাড়িতে–

দিদিমা আরো অবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্যে তার মুখে কোনও কথা বেরোল না।

নয়নতারা বললে–আসবেন তো দিদিমা ঠিক? যদি না আসেন তো আমার এ মুখ আর আপনারা দেখতে পাবেন না। জানবেন আমি নির্ঘাত আত্মঘাতী হবো, এই আপনাকে আজ আমি বলে রাখছি–

দিদিমা বললে–ছিঃ বউমা, ওকথা মুখে আনতে নেই। তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে, ওকথা কি বলতে আছে কখনও?

নয়নতারা বললে–না, আমি যা বলছি তা ঠিকই বলছি। বলুন আপনারা ঠিক আসবেন? আসবেন বলুন?

দিদিমা বললে–তা আসবো–

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ আসবেন। সকলকে ডেকে নিয়ে আপনারা দল বেঁধে আসবেন–

দিদিমা বললে–অন্য লোকের কথা বলতে পারি নে বউমা, দেখবো চেষ্টা করে। আর তোমার দাদামশাইকে বলবো আরো দশজনকে বলতে। পাড়া-গাঁয়ের ব্যাপার, বুঝতেই তো পারছো? কে আসে না-আসে তা আগে থেকে কিছুই বলা যায় না–

–তবু আপনারা চেষ্টা করবেন সকলকে আনতে। আর যদি কেউ না আসতে চায় তবু আপনি আর দাদামশাই নিশ্চয় আসবেন–

দিদিমা বললে–কিন্তু বউমা, তুমি তো বলছে আসতে, কিন্তু যদি আমাদের ভেতরে ঢুকতে না দেয়? সেদিন ঢুকতে গিয়ে কি অপমানটা আমাকে সইতে হলো তা তো তুমি জানো। তাই ভাবছি অপমান করলে তখন কী করবো?

নয়নতারা বললে–তখন তো আমি আছি দিদিমা। আপনারা আমার নাম করবেন। বলবেন আপনার বউমা আমাদের ডেকেছে–। আর আপনারা এসেছেন জানলে আমিই ভেতরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবো–

দিদিমার তবু যেন ভয় গেল না। বললে–কী জানি বউমা, শেষকালে যদি কিছু হয়?

–কী আর হবে?

তখন যদি তোমার শাশুড়ি তোমার ওপর আরও হেনস্থা করে?

নয়নতারা বললে–হেনস্থার আর বাকি কী রেখেছে দিদিমা! হেনস্থার আর কতটুকু আপনারা জানেন আর কতটুকু আপনারা কল্পনা করতে পারেন? হেনস্থার আমার কিছুই বাকি নেই দিদিমা, হেনস্থার চরমে এসে ঠেকেছে এখন, নইলে এই ঝড় বৃষ্টির রাতে এই কুয়োতলায় এসে এমন করে আপনাদের মুহুরিকে দিয়ে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে আপনাকে ডেকে পাঠাই? আপনি বুঝতে পারছেন না দিদিমা যে আমি মরে বেঁচে আছি? দিনের আলো হলে বুঝতে পারতেন আমার চোখে এখন আর জল বেরোয় না, শরীরে বোধ হয় রক্তও নেই আমার, নইলে চোখ দিয়ে হয়ত রক্তই বেরোত। কিন্তু এখন আর জলও বেরোয় না, রক্তও বেরোয় না, এখন আমি বুকটাকে পাথর করে ফেলেছি দিদিমা–সেদিন আমি সব বলবো, আপনাদের সব বলবো, কোনও কথা লুকিয়ে রাখবো না–

বলতে বলতে নয়নতারা হাঁপিয়ে উঠেছিল।

দিদিমা বললে–আচ্ছা বউমা, তুমি এখন যাও, শেষকালে আবার তোমার শাশুড়ি দেখতে পেলে অনত্থ বাধাবে। আমরা ঠিক যাবো, কাল বাদে পরশু ঠিক যাবো। কালকের দিনটায় সকলকে খবর দিতে হবে, তারপর পরশু শুক্রবার, সেদিন সকাল বেলাই যাবো

এর পরে নয়নতারা আর দাঁড়ায়নি সেখানে। যেমন এসেছিল তেমনি আবার নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে দরজায় খিল দিয়ে দিলে।

বেহারি পালের বউ বাড়িতে এসে নিজের ঘরে ঢোকবার আগে একবার কর্তাকে ঘুম ভাঙিয়ে ওঠালে–ওগো শুনছো?

বেহারি পালের ঘুমে তখন চোখ জুড়ে ছিল। তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। বললে–কী হলো আবার? আবার কী হলো?

নয়নতারা বারান্দাটার কাছে গিয়ে টিপি টিপি পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে দরজায় খিল দিয়ে দিলে।

হঠাৎ আকাশ ভেঙে তখন আবার ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি নামলো।

.

পৃথিবীতে যারা একটা বাঁধা-ধরা পথ ছেড়ে হঠাৎ অন্য পথ ধরে তাদের কেউ পাগল বলে, কেউ বলে প্রতিভা। কিন্তু সদানন্দ পাগলও নয়, প্রতিভা তো নয়ই। সাধারণ গ্রামের একজন ছেলে মাত্র। কিন্তু কেমন করে যেন এই সাধারণ সংসারের সাধারণ নিয়মগুলোর বিরুদ্ধেই সে একদিন বিদ্রোহ করে বসলো। অথচ আপোস-রফা করে চললে তার তো কোনও দুঃখই ছিল না। বেশ আরামে সংসারের একজন হয়ে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো।

সমরজিৎবাবু যখন সদানন্দকে প্রথম দেখেছিলেন তখনই বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেটার মধ্যে যেন কোথায় একটা বৈশিষ্ট্য আছে। আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। শুধু আলাদাই নয়, যেন বিশেষ একজনও বটে।

প্রথমে সদানন্দকে দেখেই গৃহিণী জিজ্ঞেস করেছিল–এ কে গো? একে কোত্থেকে আনলে?

সমরজিৎবাবু বলেছিলেন–একে নিয়ে এলুম সঙ্গে করে–এ আমার কাছে থাকবে–

সেকালের আদর্শ সংসার। ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে সংসার জম-জমাট। কত লোক এসে বাড়িতে থাকছে, খাচ্ছে, আবার একদিন চলেও যাচ্ছে। দেশের কোনও অনাত্মীয় লোক হয়ত রোগের চিকিৎসা করতে কলকাতায় এল। কিন্তু উঠবে কোথায়? চলো, সরকার মশাই-এর বাড়িতে গিয়ে ওঠা যাক। তারপর চিকিৎসা করতে হয়ত একমাস দু’মাস লাগলো। ততদিন এখানেই থাকো, এখানে খাও, এখানেই রাত্তিরে ঘুমোও।

সদানন্দ ঘটনাচক্রে এসে এই রকম এক সংসারেই আশ্রয় পেলে।

সমরজিৎবাবুর সঙ্গে হঠাৎ রানাঘাট স্টেশনে দেখা হয়ে গিয়েছিল সদানন্দর। এমন তো কত লোকের সঙ্গে কত লোকেরই দেখা হয় কত জায়গায়। তা বলে কেউ তো কাউকে একেবারে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোলে না!

সমরজিৎবাবু বলেছিলেন–তুমি আমাদের বাড়ি যাবে?

সদানন্দ বলেছিল–আপনি নিয়ে গেলে যাবো।

–কিন্তু তোমার বাবা-মা, তোমার আত্মীয়-স্বজন, তারা?

সদানন্দ বলেছিল–তারা সবাই আছে–

–তাহলে?

এ প্রশ্নের উত্তর দেয়নি সেদিন সদানন্দ। সমরজিৎবাবু ভূয়োদর্শী লোক। অনেক দেখে, অনেক শুনে, অনেক ভুগে এক-একজন ভূয়োদর্শী হয়। কিন্তু অনেকে আবার জন্মসংস্কারের বশেই সংসারে ভূয়োদর্শী হয়ে জন্মায়। সমরজিৎবাবু হয়ত তাদেরই দলে। অনেক টাকার মালিক হলেই কেউ পুঁজিপতি হয় না, কিম্বা নিঃসম্বল হলেই কেউ সর্বহারা লক্ষ্মীছাড়া হয়না। সমরজিৎবাবুর সব কিছু থেকেও নিজে তিনি ছিলেন নিরাসক্ত মানুষ। অন্তত নিজের বাড়িতে তিনি নিরাসক্ত হিসেবে জীবন-যাপন করতেন। ঐশ্বর্য তাকে স্পর্শ করতে না বলে পরের দুঃখ-দুর্দশা অনুভব করবার মত অন্তঃকরণটা তার ছিল।

কিন্তু পৃথিবী তার দাবী কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নিয়ে তবে তো মানুষকে মুক্তি দেয়। তাই বোধহয় সমরজিৎবাবুরও টাকার প্রয়োজন তখনও ফুরিয়ে যায়নি।

গৃহিণী জিজ্ঞেস করলেন–তা কোথায় পেলে তুমি ওকে?

সমরজিৎবাবু বললেন–রানাঘাট স্টেশনে–

গৃহিণী বললেন–ইস্টিশানে একজন অচেনা লোককে দেখলে আর তাকে বাড়িতে এনে তুললে? ওকে দিয়ে কী কাজ হবে তোমার?

সমরজিৎবাবু বললেন–এই দেখ তোমার বুদ্ধি, আমি কি ওকে কাজ করাবার জন্যে বাড়িতে এনে তুলেছি? আমার যারা আছে তারা সবাই-ই কি কাজের লোক? তুমি যে টবে গণ্ডা গণ্ডা ফুলগাছ পুঁতেছ, ফুলগাছ দিয়ে কি তোমার কিছু কাজ হয়?

গৃহিণী বললে–ওমা, ফুলগাছ পুঁতেছি তো ফুলের জন্যে–

–তা সদানন্দকেও একটা ফুল বলে মনে করো। ফুলগাছে যেমন জল দিতে হয়, ওকেও না হয় তেমনি ভাত খেতে দিলে। সংসারে মানুষের জঙ্গলের মধ্যে ওই সদানন্দর মত এক-একজন মানুষ ফুল হয়েই জন্মায়–এইটে ভুলে যেও না–

গৃহিণী কর্তার কথায় খুশি হলো না। সমরজিৎবাবু বললেন–কথাটা তোমার পছন্দ হলো না তো? তা তো হবেই না!

গৃহিণী বললে–তা অচেনা-অজানা মানুষকে বাড়িতে এনে তুললে রাগ হবে না? সেবার তো তুমি পুরী থেকে ওমনি একটা ছেলেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলে, শেষকালে সে তোমার ঘড়ি চুরি করে পালালো না? শেষকালে এও যদি সেই রকম হয়?

সমরজিৎবাবু বললেন–হলে হবে! না হয় কিছু চুরি করেই পালাবে! ঘড়ি চুরি হওয়াতে কি আমি রাস্তার ভিখিরি হয়ে গেছি? কী জানো, অবিশ্বাস করে লাভ করার চেয়ে বিশ্বাস করে ঠকাও ভালো

–তাহলে তুমি ঠকো–বলে গৃহিণী রাগ করে চলেই যাচ্ছিল।

সমরজিৎবাবু বললেন–চলে যেও না, চলে যেও না, দাঁড়াও–

বলে এক কাজ করলেন। বলে নিজের চেয়ার থেকে উঠলেন। তারপর দেরাজ থেকে পাঁচশো টাকা বার করলেন। পাঁচটা একশো টাকার নোট।

গৃহিণী কিছুই বুঝতে পারলে না। বললে–টাকা বার করছে কীসের জন্যে?

-–দেখ না, কী করি!

বলে সদানন্দ ডেকে পাঠালেন। সদানন্দ আসতেই সমরজিৎবাবু বললেন–একটা কাজ করতে পারবে বাবা, এই পাঁচশো টাকা পোস্টাফিসে গিয়ে মনিঅর্ডার করে আসতে পারবে?

সদানন্দ বললে–দিন, কিন্তু কোন ঠিকানায়, কার নামে মনি-অর্ডার করবো?

সমরজিৎবাবু একটা কাগজে নাম-ঠিকানা লিখে দিলেন। বললেন–এই নাও, রাঁচি রামকৃষ্ণ মিশনের নামে–

বলে কাগজটা এগিয়ে দিলেন সদানন্দর দিকে। সদানন্দ কাগজটা আর নোটগুলো নিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।

গৃহিণী বললে–এতগুলো টাকা তুমি দিলে বিশ্বাস করে? যদি পালিয়ে যায়?

সমরজিৎবাবু বললেন–চাঁদা তো আমায় দিতেই হয়। দান-খয়রাতের টাকা যদি খোওয়া যায় তো যাবে। বিশ্বাস করে না হয় ঠকলুমই–

কিন্তু না, আধঘন্টার মধ্যেই আবার সদানন্দ ফিরে এল। হাতে মনি-অর্ডারের রসিদ।

–করেছ?

সদানন্দ বললে–করেছি, কিন্তু আমি আর এখানে থাকবো না কাকাবাবু, আমার থাকতে আর ভালো লাগছে না।

–কেন?

–আমার মনে হচ্ছে আপনি মনিঅর্ডার করবার জন্যে আমাকে পাঠাননি, আপনি আমাকে পরীক্ষা করবার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। আমাকে আপনি অবিশ্বাস করেছেন–বলুন আপনি আমায় অবিশ্বাস করেছে কি না?

সমরজিৎবাবু হাসলেন। হেসে গৃহিণীর দিকে চেয়ে বললেন–কী উত্তর দেবে দাও, সদানন্দর কথার জবাব দাও–

গৃহিণী বললে–আমি কী জবাব দেব?

সমরজিৎবাবু বললেন–অবিশ্বাস তোমায় আমি করিনি সদানন্দ। অবিশ্বাস করেছে তোমার কাকীমা। তোমার কাকীমার জন্যেই আমি তোমায় পরীক্ষা করলুম—

সদানন্দ বললে–কিন্তু আপনি তো জানেন আমি নিজে থেকে আপনার এখানে আসতে চাইনি-আপনিই আমাকে জোর করে আপনার বাড়িতে নিয়ে এলেন।

তা সত্যি! রাণাঘাট স্টেশনে তখন শেষ রাত। রাধার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সদানন্দ সোজা স্টেশনেই এসেছিল। ভেবেছিল আর যেখানেই সে যাক নিজের বাড়িতে সে আর যাবে না।

–না বাবা, এর পরে আর তোমাকে যেতে দিতে পারব না। অবিশ্বাস আমিই করি আর তোমার কাকীমাই করুক, ও একই কথা, অপরাধ আমাদের দুজনেরই–

কাকীমা বললে–তুমি কিছু মনে কোর না বাবা, এর আগে অনেকবার উনি ঠকেছেন তো, তাই আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল। তোমার কাকাবাবুর কিছু দোষ নেই, দোষ আমারই। সব মানুষ কি সমান হয় বাবা? তুমিই বলো না সমান হয়?

সমরজিৎবাবু বললেন–আমি তোমাকে বললুম সদানন্দ তেমন ছেলে নয়, তবু তুমি কেন সন্দেহ করলে? তোমার জন্যেই তো এই কাণ্ড হলো! এখন তুমি সামলাও।

গৃহিণী রেগে গেল। বললে–তুমি কেবল আমার দোষই দেখলে। তোমাকে তো সংসার করতে হয় না। সংসার যে করে সে বোঝে! এই এতগুলো লোক কী খাবে, কী পরবে, সে কি তুমি কোনও দিন ভেবেছ? সব তো সেই আমাকে ভাবতে হবে।

সমরজিৎবাবু বললেন–ওই দেখ তুমি আবার ঝগড়া আরম্ভ করলে? আমি ঝগড়ার কথাটা কী বলেছি তোমাকে? তুমিই তো কেবল বলতে জানা-নেই শোনা-নেই কাকে বাড়ির মধ্যে তুললে

সদানন্দ দেখলে তাকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীতে কথাকাটাকাটি হতে হতে প্রায় ঝগড়ার উপক্রম হতে চলেছে। সদানন্দ কথার মধ্যেখানেই বাধা দিলে।

বললে–কেন আপনারা আমার মত একটা সামান্য লোককে নিয়ে অশান্তির সৃষ্টি করছেন, তার চেয়ে আমি বরং চলে যাই–

সমরজিৎবাবু বললেন–হ্যাঁ, তুমি চলেই যাও বরং, তোমাকে আনা আমারই দোষ হয়েছিল–

কাকীমা বললে–না, তুমি যেতে পারবে না, তোমার কাকাবাবু বরাবর আমার নামে দোষ দিতে পারলে আর ছাড়বেন না। কেন, আমি কী অন্যায়টা করেছি শুনি? সেবার তোমার ঘড়ি চুরি যায়নি? সেবার কী আমি উটকো লোক ঘরে এনে তুলেছিলুম?

সদানন্দ বললে––কেন অশান্তি করছেন কাকীমা, আমি তো বলছি আমি উটকো লোক, আমি চলে যাচ্ছি

কাকীমা এবার সদানন্দের দিকে চেয়ে বললে–তুমি থামো তো, তোমার যাওয়া হবে না। তোমাকে যেতে দিলে তবে তো তুমি যাবে!

সমরজিৎবাবু বললেন–বাঃ, তুমি তো বেশ, এদিকে ওকে বিশ্বাসও করবে না, আবার ওকে চলে যেতেও দেবে না, এতো বেশ মজা

কাকীমা হয়তো কাকাবাবুর কথায় রেগে গিয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সদানন্দ বললে–-ঠিক আছে, কাকীমা, আপনি থামুন, আমি যাব না, আমি থাকবো

এমন সময় বাইরে থেকে কে যেন দৌড়তে দৌড়তে এসে বললে–মা, দাদাবাবু এসেছে–

–খোকা এসেছে? খোকা এসেছে?

সমরজিৎবাবুও যেন একটু উৎসুক হয়ে উঠলেন। বললেন–কে? খোকা? এতদিন পরে খোকা এলো?

কাকীমা আর দাঁড়ালো না। সোজা ভেতরে চলে গেল।

কে-ই বা খোকা আর সেই খোকা এলে এত হৈ-চৈই বা কেন তা সদানন্দ সেদিন জানতো না। খোকা আসার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সমরজিৎবাবু আর কাকীমার মুখের চেহারা আমূল বদলে গেল।

সদানন্দ ঘর ছেড়ে চলে আসতে যাচ্ছিল। বললে–আমি আসি কাকাবাবু–

সমরজিৎবাবু বললেন–আসি মানে? তুমি চলে যাচ্ছো? এই যে এখখুনি তুমি বললে তুমি যাবে না! আবার চলে যাচ্ছো যে? যদি যেতে হয় তো তোমার কাকীমাকে বলে যাবে। আমি কিছু জানি না–

সদানন্দ আর কথা না বলে একতলায় চলে এল। এসে নিজের ঘরখানার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলে সারা বাড়িময় যেন হঠাৎ সোরগোল পড়ে গেছে। চাকর-ঠাকুর-ঝি সবাই যেন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে দাদাবাবুর আসবার খবর পেয়ে! কে দাদাবাবু? এতদিনের মধ্যে একদিনও তো সে-দাদাবাবুর নাম শোনেনি!

মহেশ শশব্যস্ত হয়ে ওপরের দিকে যাচ্ছিল। সদানন্দ তাকেই ডাকলে। বললে–কে এসেছে গো!

মহেশের তখন কথা বলবার সময় নেই। বললে–দাদাবাবু—

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–দাদাবাবু কে?

কিন্তু সে-কথার জবাব দেবার মত সময় মহেশের ছিল না। তার আগেই সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল।

সদানন্দ সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে মনে হলো যেন একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। গাড়িটা বোধহয় দাদাবাবুকে নামিয়ে দিয়েই আবার চলে গেল। তারপর সেখানে দাঁড়িয়েই সদানন্দ দেখলে একটা সাদা কোট-প্যান্ট পরা লোক ভারি জুতো পরে দুম-দুম্ শব্দ করতে করতে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। তারপর ভেতরে ঢুকে সোজা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। পেছন থেকে মুখটা স্পষ্ট দেখা গেল না। কিন্তু মনে হলো দাদাবাবুর বয়েস খুব কম নয়। পেছন থেকে দেখে যতটুকু বোঝা যায় তাতে মনে হলো– ত্রিশ কি বত্রিশ বছর। কিন্তু বেশ ভালো স্বাস্থ্য।

মহেশ আবার তরতর করে নিচেয় নেমে এসে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল।

সদানন্দ তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।

মহেশ এসে বললে–আপনি তখন কী বলছিলেন আমাকে?

সদানন্দ বললে–বলছিলুম কে এলেন?

–দাদাবাবু।

–দাদাবাবু? দাদাবাবু কে?

মহেশ বললে–আজ্ঞে বাবুর ছেলে। এই একই ছেলে বাবুর! এই এখনি বাড়িতে এলেন কিনা, তাই বউদিদিকে খবর দিতে গিয়েছিলুম।

তবু কথাটা কেমন দুর্বোধ্য লাগল সদানন্দের কাছে। এবাড়ির ছেলেই যদি হয় তো তাহলে এত হৈ-চৈ কেন? বাড়ীর ছেলে বাড়িতে আসবে তার জন্যে সবাই এত সন্ত্রস্তই বা কেন?

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–দাদাবাবু কোত্থেকে এল?

লোকটা গলা নিচু করে বললে–দাদাবাবু তো রোজ বাড়িতে থাকে না, অনেক দিন পর পর বাড়িতে আসে, তাই–

এরপর আর কিছু কথা জিজ্ঞেস করা ভালো হবে কি না বুঝতে পারলে না সদানন্দ। এবাড়িতে সে নতুন এসেছে। বলতে গেলে সমরজিৎবাবু তাকে জোর করেই ধরে নিয়ে এসেছেন। তার পক্ষে এত কৌতূহল থাকা ভালো না।

কিন্তু মহেশ নিজে থেকেই আবার বলে ফেলল–দাদাবাবু পুলিসে চাকরি করে কি না, তাই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে হয় দাদাবাবুকে। এই তো দাদাবাবু এখন এল, এখুনি খাওয়া-দাওয়া করে আবার আপিসে চলে যাবেন–

এতক্ষণে বুঝতে পারলে সদানন্দ। মহেশও চলে গেল। সদানন্দ তার নিজের ঘরখানার মধ্যে এসে ঢুকলো। কোথায় কী করতে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, আর কোথায় বৌবাজারের কোন্ এক সংসারের ভেতরে একেবারে অন্দরমহলে এসে ঢুকে পড়ল। অচেনা অনাত্মীয় লোক। কোনও দিন কোনও সূত্রে এদের সঙ্গে তার পরিচয়ও ছিল না। অথচ এই কদিনের মধ্যেই একেবারে একাকার হয়ে গেল সে কেমন করে?

আসলে এর পেছনে যা কিছু কৃতিত্ব সবই সমরজিৎবাবুর। সেই রাণাঘাটের অন্ধকার প্লাটফরমের ওপর সেদিন যদি সদানন্দ না থাকতো তো সমরজিৎবাবুর অনেক টাকার লোকসান হয়ে যেত। ট্রেন তখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। সদানন্দ ব্যাগটা নিয়ে এক লাফে ট্রেনে উঠেই বললে–এই ব্যাগটা কি আপনার? আপনি ফেলে যাচ্ছিলেন–

সমরজিৎবাবু তখন গাড়িতে উঠে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিলেন। অত রাত্রে অন্ধকারে তিনি যে ট্রেনে উঠতে পেরেছিলেন তাই-ই যথেষ্ট। হঠাৎ অচেনা একটা গলার শব্দে ছেলেটার দিকে চাইতেই দেখলেন সে তার ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই অবাক হয়ে গেছেন। এই ব্যাগটার মধ্যেই তো তার টাকা কড়ি যা-কিছু সর্বস্ব।

তাড়াতাড়ি বললেন–হ্যাঁ, এটা তো আমারই ব্যাগ কোথায় পেলে তুমি?

–প্লাটফরমের ওপর পড়ে ছিল, অন্ধকারে বোধহয় আপনার সঙ্গের লোক দেখতে পায়নি

সমরজিৎবাবু বললেন–এই দেখ মহেশের কাণ্ড–মহেশ তো থার্ড ক্লাসের কামরায় রয়েছে-ভাগ্যিস তুমি ছিলে তাই বাবা, নইলে তো আমার সব্বোনাশ হয়ে যেত–

ট্রেন তখন ছেড়ে দিয়েছে। সদানন্দ বললে–তাহলে আমি আসি–

বলে চলন্ত ট্রেন থেকে নামতে যাচ্ছিল। সমরজিৎবাবু বললেন–আরে, করছো কী, করছো কী? কাটা পড়ে যাবে যে–

বলে সদানন্দর হাতটা চেপে ধরলেন। তারপর নিজের কাছে বসিয়ে বললেন–বোস এখানে, পরের স্টেশনে নেমে যেও–

ট্রেন তখন সত্যিই জোরে চলতে আরম্ভ করেছে। সদানন্দ আর নামতে পারলে না।

সমরজিৎবাবু বললেন–তোমার তো টিকিট নেই, স্টেশনে যদি টিকিট চায় তো টিকিট দেখাবে কী করে? সঙ্গে টাকা আছে?

সদানন্দ বললে—না–

–টাকা নেই? আমার কাছে টাকা আছে, আমি তোমাকে টাকা দিচ্ছি, এই নাও বলে একটা দশ টাকার নোট পকেট থেকে বার করে সদানন্দর দিকে এগিয়ে দিলেন।

সদানন্দ বললে–দশ টাকা নিয়ে কী করবো? এক টাকার বেশি তো লাগবে না। আর আপনার ঠিকানাটা আমায় দিন, যদি কম লাগে তো বাকি পয়সা আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব–

সমরজিৎবাবু অবাক হয়ে গেলেন কথাটা শুনে। এমন কথা তো কেউ বলে না আজকাল! এ কী ধরনের ছেলে!

বললেন–তোমার নাম কী? থাকো কোথায়?

একে একে অনেক প্রশ্ন করলেন সমরজিৎবাবু। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলেন। সদানন্দও কিছু কিছু উত্তর দিলে। কিন্তু সমরজিৎবাবুর কেমন যেন সন্দেহ হলো। তিনি বুঝতে পারলেন ছেলেটা আসল খবরটা বলতে চাইছে না। এইটুকু শুধু বুঝলেন যে সৎবংশের ছেলে, কিন্তু কোনও কারণে বাড়িতে আর ফিরে যেতে চায় না।

শেষকালে দশ টাকার একটা নোট সদানন্দের হাতে গুঁজে দিতে চাইলেন। বললেন—টাকাটা তুমি রাখোই না, পরে না-হয় আমার ঠিকানায় বাকিটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিও, আর তুমি আমার যা উপকার করেছ তার জন্যেও তো কিছু তোমার বখশিশ পাওয়া উচিত। ওগুলো তো আমার খোওয়া যেতোই–তুমি না থাকলে কি আমি ও-সব ফেরত পেতুম মনে করেছ?

তারপর যখন পরের স্টেশন এল, সদানন্দের নামবার কথা। তখন হঠাৎ সমরজিৎবাবু বললেন–তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবে?

–আপনার বাড়িতে?

–হ্যাঁ, আমার বাড়িতেও যেতে পারো–কলকাতায় বউবাজারে আমার নিজের মস্ত বাড়ি আছে। আমার বাড়িতে অনেক ঘর, তোমার কোনও কষ্ট হবে না।

সদানন্দ বললে–আমাকে সেখানে একটা কাজ যোগাড় করে দিতে পারবেন?

–কাজ করবার তোমার দরকার কী?

সদানন্দ বললে–কিন্তু আপনার বাড়িতে আমি কী করবো? আমি আপনার ঘাড়ে বসে থাকবো কেন? আপনি যদি কোনও কাজ যোগাড় করে দিতে পারেন তো আমি যেতে পারি–

তা সেই কথাই রইল। সমরজিৎবাবুর সঙ্গে সেই কলকাতাতেই সেদিন চলে এসেছিল সদানন্দ। তারপর থেকেই সে রয়ে গেছে এখানে। মাঝে-মাঝে সমরজিৎবাবুর কাছে গিয়ে বলে–কই, আমাকে কিছু কাজ দিলেন না তো আপনি?

সমরজিৎবাবু বলেন–দেব, দেব, হুট করে অমনি বললেই কি আর কাজ দেওয়া যায়? আমার ছেলেকে বলে তোমাকে একটা কাজ করে দেব। তুমি অত ব্যস্ত হচ্ছে কেন? কাজ দিলেই তো হলো?

–কবে আপনার ছেলেকে বলবেন?

সমরজিৎবাবু বললেন– ছেলে আসুক আগে, তবে তো বলবো–সে তো সব সময় কলকাতায় থাকে না, বাইরে বাইরে ডিউটি পড়ে তার। যখন হেডকোয়ার্টারে আসবে–তখনই বলবো–

সেই ছেলে এতদিন পরে হেড-কোয়ার্টারে এসেছে। এইবার বোধহয় সমরজিৎবাবু তাকে সদানন্দের কথা বলবেন। সদানন্দ নিজের ঘরের মধ্যে চলে গেল। কিন্তু মন থেকে ভাবনাটা গেল না। সমরজিৎবাবু কী করে বুঝবেন যে কারো বাড়িতে অন্নদাস হওয়ার অগৌরব কত! তার জন্যে সমরজিৎবাবুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সবই হচ্ছে, তবু প্রতিদানে সে কোনও কাজ করছে না। এর যন্ত্রণা সদানন্দ কী করে ব্যাখ্যা করবে!

খানিক পরে হঠাৎ আবার একটা গাড়ির শব্দ হলো রাস্তায়। বাড়ির ভেতরে চাকর ঠাকুরের আবার সেই ব্যস্ততা। অনেক পায়ের শব্দের আনাগোনা। তারপর মনে হলো যেন গাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার শব্দ হলো।

সদানন্দ বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

মহেশের যেন তখন আর তত ব্যস্ততা নেই। বললে–দাদাবাবু চলে গেল–

–চলে গেল মানে?

মহেশ বললে–দাদাবাবু খেয়ে-দেয়ে অফিসে চলে গেল–

–আবার কখন আসবে?

মহেশ বললে–তার কি কিছু ঠিক আছে? হয়ত অনেক দিন আর আসবেই না। পুলিসের চাকরির তো এই নিয়ম। দাদাবাবুর আসা যাওয়ার কোনও ঠিকঠাক নেই। দাদাবাবুর বিয়ে হবার আগে থেকেই এই রকম চলছে, ওই জন্যেই তো বউদির মনেও সুখ নেই

কথাগুলো বলে মহেশ মুখটা ভারি করে নিজের কাজে চলে গেল।

.

বউবাজারে সমরজিৎবাবুর বাড়িতে নিজের ঘরখানায় সদানন্দ যখন একলা শুয়ে থাকতো তখন নানা চিন্তা এসে মাথায় ভিড় করতো। কোথায় সেই নবাবগঞ্জ, সেই নবাবগঞ্জের বারোয়ারিতলা, কালীগঞ্জ, প্রকাশমামা, সেই কর্তাবাবু, সেই চৌধুরীমশাই, সেই নয়নতারা। নয়নতারার শেষ কথাটা তখনও তার কানে বাজতো–আমি তোমার স্ত্রী হয়েছি বলে কি তোমার প্রায়শ্চিত্তের ভাগ আমাকেও নিতে হবে?

কথাগুলো মনে পড়লেই সদানন্দ অন্যমনস্ক হয়ে যাবার চেষ্টা করতো। সব কিছু ভুলে যাবার চেষ্টা করতো। নবাবগঞ্জের জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে আনবার চেষ্টা করতো। মনে করতে চেষ্টা করতো যে সে-সদানন্দ মারা গেছে, সে-সদানন্দ আত্মহত্যা করেছে, সে সদানন্দ খুন হয়ে গেছে। তারপর আস্তে আস্তে কখন সে আবার এক সময়ে ঘুমিয়েও পড়তো তাও খেয়াল থাকতো না।

কালীকান্ত ভট্টাচার্য সেই নয়নতারার মা’র মৃত্যুর পর থেকেই ভেঙে পড়েছিলেন। একদিন কাজ করেন তো পরের দিন শুয়ে থাকেন।

ক’দিন থেকেই বলেছিলেন–জামাইষষ্ঠীর তত্ত্বর ব্যবস্থাটা করতে হবে নিখিলেশ, ওটা যেন ভুলো না–

তা নিখিলেশ সে-সব ব্যবস্থা আগেই করে দিয়েছিল। তবু মাঝে-মাঝে বলতো–নয়নতারাকে একবার খবর দেব মাস্টার মশাই?

মাস্টার মশাই বলতেন–না না, সে সেখানে আরামে রয়েছে, তাকে আবার কেন বিব্রত করবে, এ অসুখ আমার দু’দিনেই ভালো হয়ে যাবে–তুমি বরং তত্ত্ব পাঠাবার ব্যবস্থাটা করে দাও। ওর মা নেই যখন তখন ও-দায়িত্বটাও আমার, বুঝলে না–

সেই ব্যবস্থাই হচ্ছিল। ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন কলকাতা থেকে নিখিলেশ শেষ ট্রেনে ফিরছে, হঠাৎ মাস্টার মশাই-এর বাড়ি থেকে লোক এসে ডাকাডাকি–

নিখিলেশ বিছানা থেকে উঠে বাইরে এসে অবাক।

–কে?

–আমি বিপিন দাদাবাবু, আপনাকে একবার ডাকতে এলুম।

–তোমার তো কালকে তত্ত্ব নিয়ে নবাবগঞ্জের যাবার কথা। ও-সব কেনাকাটা তো তৈরি।

বিপিন বললে–তা তো তৈরি কিন্তু মাস্টার মশাই-এর শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে। তাই আপনাকে একবার খবর দিতে এলুম–

–এখন কেমন আছে?

–ভালো নয় দাদাবাবু। আমি খবর পেয়েই দৌড়ে গেলুম। গিয়ে দেখি ওই কাণ্ড। আপনাকে ছাড়া আর কাকে খবর দেব বলুন।

নিখিলেশ তাড়াতাড়ি জামাটা গায়ে গলিয়ে নিয়ে বাইরে এসে বললে–চলো চলো–

কিন্তু যার কাছে জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব পাঠাবার জন্যে কালীকান্ত ভট্টাচার্যের এত আগ্রহ, তার শ্বশুরবাড়িতে সেদিন তখন আর এক কাণ্ড শুরু হয়েছে। সকলের সঙ্গে প্রাণকৃষ্ণ সা’মশাই, বেহারি পাল, বেহারি পালের বউ, নিতাই হালদারের মা সবাই এসে হাজির।

পরমেশ মৌলিক ভেতরে খবর দিতে গেল। চৌধুরী মশাই খবর শুনে বললেন–কেন? ওরা এসেছে কেন? কী দরকার ওদের?

পরমেশ মৌলিক বললে–আজ্ঞে তা জানি নে, বলছেন একবার আপনার সঙ্গে দেখা করবেন

–সবাই মিলে দেখা করবে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

গিন্নীর কানেও কথাটা গেল। বললে–তাই নাকি? বেহারি পালের বউও এসেছে? নিতাই হালদারের মা?

চৌধুরী মশাই বললেন–তাই তো শুনলুম। শুনলুম সা’মশাইও নাকি ওদের সঙ্গে আছে।

–কী বলতে চায় ওরা?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা তো কিছু বলেনি। সবাইকে বৈঠকখানা ঘরে নাকি বসিয়েছে–

চৌধুরী মশাই আর দাঁড়ালেন না। সোজা যেমন অবস্থায় ছিলেন তেমনি ভাবেই বেরিয়ে গেলেন। তখনও তিনি কল্পনা করতে পারেননি কতখানি বিস্ময় তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

বেহারি পালের বউ হঠাৎ ভেতরবাড়িতে ঢুকে পড়েছে। পেছনে গ্রামের আরো কয়েকজন মহিলা।

–আমরা এলাম বউ।

প্রীতি বললে–কী ব্যাপার মাসিমা? হঠাৎ?

মাসিমা বললে–বউমা ডেকেছে আমাদের–

–আমার বউমা তোমাদের ডেকেছে?

–হ্যাঁ বউ, বলেছে গ্রামের সকলকে ডেকে নিয়ে আসতে–

প্রীতি যেন চমকে উঠলো। বললে–কই কোথায় গেল বউমা, দেখি জিজ্ঞেস করে কী জন্যে ডেকেছে

ওদিকে বার বাড়িতে চৌধুরী মশাই যখন গেলেন তখন দেখলেন নবাবগঞ্জের তাবৎ গণ্যমান্য লোক সবাই এসে সেখানে বসে পড়েছে। পরমেশ মৌলিক না-জেনে সবাইকে বৈঠকখানা ঘরের দরজা খুলে বসতে দিয়েছে।

–কী ব্যাপার, আপনারা হঠাৎ আমার বাড়িতে এ-সময়ে?

প্রাণকৃষ্ণ সা’মশাই অগ্রণী হয়ে বলে উঠলেন–আপনার বউমা সকলকে আসতে বলেছেন।

চৌধুরী মশাই তো হতবাক। খানিকক্ষণ পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন–আমার বউমা? আমার বউমা আপনাদের ডেকে পাঠালেন আর আমরা জানতে পারলুম না! আমি তো এর রহস্য কিছুই বুঝতে পারছি না—

প্রাণকৃষ্ণ সা’মশাই বললেন–হয়ত আপনি জানেন না চৌধুরী মশাই। সব কথা তো পুরুষ-মানুষেরা জানতে পারেন না, জানা সম্ভবও নয়। মেয়েদের ব্যাপার, মেয়েরাই জানে–

চৌধুরী মশাই-এর রাগ হয়ে গেল। বললেন–তা আপনারা তো হলেন পুরুষ, আপনাদের কাছে গিয়ে কি আমার বউমা আসতে বলেছেন? এ বাড়ির বউদের তো সে নিয়ম নেই? কী করে তিনি আপনাদের ডাকলেন? আপনাদের বাড়িতে গিয়ে? না চিঠি দিয়ে?

বেহারি পাল মশাই বললে–না চৌধুরী মশাই, আপনার বউমা আমার পরিবারকে ডেকে বলেছেন

চৌধুরী মশাই এতক্ষণে যেন বুঝলেন। বললেন–ও, এতক্ষণে বুঝলাম। তা তিনি আপনার পরিবারকে কী বলেছেন?

–বলেছেন সবাইকে নিয়ে আজ আপনার বাড়িতে আসতে—

চৌধুরী মশাই বললেন–কী উপলক্ষে?

–তা তিনি বলেননি। শুধু বলেছেন আসতে

 চৌধুরী মশাই বললেন–আমার বউমা ছেলেমানুষ, তিনি কাকে কী বললেন আর আপনারও তাই শুনে নাচলেন? আপনাদের তো উচিত ছিল আমাকে জিজ্ঞেস করা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেই আমি বলে দিতুম আপনাদের আসতে হবে কি আসতে হবে না–

এ কথায় সকলেই চুপ করে রইলেন।

–বলুন সা’মশাই, আপনিও বলুন পাল মশাই, হালদার মশাই, সরকার মশাই, আপনারাই বলুন। চুপ করে রইলেন কেন? আমি অন্যায় কিছু বলিনি, আপনারাই বুঝে দেখুন। আমার বাড়ির কুলবধূ হয়ে তিনি আমাকে খবর না দিয়ে আপনাদের খবর দিলেন, এটা কী রকম কথা? আপনারা কি বলতে চান তিনি আপনাদের সামনে এসে হাজির হবেন? এও কি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?

সা’মশাই এ-কথার কোনও উত্তর খুঁজে না পেয়ে পাল মশাই-এর মুখের দিকে চাইলেন।

পাল মশাই বললে–আপনার বউমার হয়ত এমন কোনও কথা আছে যা সকলকে না শোনালে তার চলবে না! তাই হয়ত ডেকেছেন আমাদের

–খবরদার! একটু ভেবে-চিন্তে কথা বলবেন। আমার বংশের কুলবধূ, তার সম্বন্ধে অমন যা-তা কথা বলবেন না–

পাল মশাই বললে–তাহলে আপনার বউমাকে জিজ্ঞেস করে আসুন, তিনিই বলবেন তিনি কী জন্যে আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি যদি আমাদের চলে যেতে বলেন তো আমরা চলে যাবো–

হঠাৎ ভেতর থেকে একটা মেয়েলি গলায় চিৎকার উঠলো–বউমা, বউমা, তুমি ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? কোথায় যাচ্ছো–বউমা–

কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটবার ঘটে গেছে। সবাই দেখলে চৌধুরী বাড়ির কুলবধূ হঠাৎ হাঁফাতে হাঁফাতে সশরীরে একেবারে বৈঠকখানার ভেতরে এসে হাজির।

সবাই-ই কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। চৌধুরী মশাই এতক্ষণ বেশ গম্ভীরভাবেই কথা বলছিলেন। কিন্তু এবার তিনিও তার বউমার কাণ্ড দেখে যেন হতবাক হয়ে গেলেন।

ভেতর থেকে শাশুড়ি তখনও ডাকছে–বউমা বউমা, চলে এসো, ভেতরে চলে এসো–

নয়নতারা তখনও ঘোমটায় মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিল। সে শাশুড়ির কথায় কোনও কান না দিয়ে সকলকে উদ্দেশ করে বলে উঠলো–আপনারা কেউ যাবেন না, আমি এবাড়ির কুলবধূ, হ্যাঁ কুলবধূ, আমার অধিকার আছে আপনাদের ডাকবার। সেই অধিকারেই আমি আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছি–

পেছন থেকে শাশুড়ি আবার ডাকলে—বউমা–

–আপনারা সবাই শুনুন, আমার পিতৃতুল্য শ্বশুরমশাই এখানেই আছেন, আপনারাও রয়েছে, আমি যা বলবো সকলের সামনে প্রকাশ্যেই বলবো। আমার শ্বশুরমশাই একটু আগেই আমাকে এ বাড়ির কুলবধূ বলেছেন আপনাদের কাছে। আমি সেই চৌধুরীবংশের কুলবধূ হিসেবেই আমার সব কথা আপনাদের কাছে পেশ করবো–

চৌধুরী মশাই বললেন–বউমা, তুমি ভেতর বাড়ি ছেড়ে বার-বাড়িতে এলে যে? যা বলবার ভেতরবাড়িতে গিয়ে তোমার শাশুড়িকে বললেই পারতে। এখানে এলে কেন তুমি?

নয়নতারা বললে–না, আমি এখানে সকলের সামনে বলবো–এতদিন আমার লজ্জার মর্যাদা যখন কেউ দেয়নি তখন আর কারোর কাছ থেকে লজ্জা-সম্ভ্রম-শালীনতার কথা আজ আর আমি শুনবো না।

–কিন্তু বউমা তুমি চৌধুরী বাড়ির বউ হয়ে বৈঠকখানা ঘরে আসবে তা বলে?

নয়নতারা শ্বশুরের মুখের ওপরেই বলে উঠলো–হ্যাঁ আসবো। এখানে না এলে আমার সব লজ্জার কথা সকলকে বলবো কী করে? আপনারা কি আমার লজ্জার মুখ রেখেছেন যে বৈঠকখানা ঘরে আসতে আমি লজ্জা পাবো?

চৌধুরী মশাই এবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন– তোমার তো বড় বাড় হয়েছে বউমা, তুমি আমার মুখের ওপর কথা বলো?

নয়নতারা বললে–আপনি গুরুজন, আমার সঙ্গে আপনি যদি গুরুজনের মতন ব্যবহার করতেন তা হলে নিশ্চয়ই আমিও আপনার মুখের ওপর কথা বলতে সাহস পেতুম না। কিন্তু আজকে আমি যা করেছি তা বাধ্য হয়েই করেছি। আপনারাই আমাকে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে এমনি করে নিজের কথা কবুল করতে বাধ্য করেছেন—

শাশুড়ি পেছন থেকে আবার ডাকলে–বউমা, ভেতরে এসো বলছি–ভেতরে এসো–

বেহারি পালের বউ এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। বললে–বউমা কী বলছে বলতে দাও না বউ, তুমি কেন বাগড়া দিচ্ছ মাঝখান থেকে?

শাশুড়ি বললে–বাগড়া দেব না? বাড়ির বউ হয়ে সকলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? আর তোমরা সবাই মজা দেখবে বলতে চাও?

নিতাই হালদারের মা’র অনেক বয়স হয়েছে। গণ্ডগোলের মধ্যে তার বুকটা কেমন কাঁপছিল। সবাই মিলে তাকে এখানে ডেকে এনেছিল। বুড়ি আসতে চায়নি প্রথমে। সবাই যা বলছিল তা তার কানে যাচ্ছিল। এবার তার মুখ ফুটলো। বললে–বউমার কী হয়েছে গা? একঘর লোকের সামনে বৈঠকখানায় গেল কেন?

একদিকে বৈঠকখানার ভেতরে পুরুষের ভিড় আর এধারে ঘরের বাইরে বার বাড়ির বারান্দায় মেয়েরা দাঁড়িয়ে।

পরমেশ মৌলিক চণ্ডীমণ্ডপ থেকে বেরিয়ে চৌধুরী মশাইকে ডেকে দিয়েছিল। তারপর বাড়ির বউমার আবির্ভাবে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। এতদিন খোকাবাবুর বিয়ে হয়েছে, তবু একদিনের জন্যেও বউমার মুখ দেখেনি। সেই বউমাকে বৈঠকখানা ঘরে আসতে দেখে সে আরো ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

কৈলাস গোমস্তার তখন কাজ কমে গিয়েছিল। কর্তাবাবুর মারা যাওয়ার পর থেকেই বলতে গেলে তেমন আর কোনও কাজ ছিল না। সকাল বেলা আসতো, কিছুক্ষণ চণ্ডীমণ্ডপে বসে পরমেশ মৌলিকের খাতাগুলো দেখতো। তারপর দুপুরবেলা নিজের বাড়িতে খেতে চলে যেত। আবার খাওয়াদাওয়ার পর ফিরে এসে চৌধুরী মশাইয়ের কাছে বসে হিসেবের বাকি কাজগুলো করে দিত।

সেদিনও এসেছিল কৈলাস। কিন্তু হঠাৎ হৈ-চৈ গোলমাল শুনে একেবারে নিচেয় চলে এসেছে। পাশেই দীনু দাঁড়িয়েছিল। তার কাছে এসে কৈলাস জিজ্ঞেস করলে–এখেনে কী হচ্ছে রে দীনু–

নয়নতারা বৈঠকখানা ঘরের ভেতরে তখনও বলে চলেছে–আপনারা অনেকেই আমার বিয়ের সময় আমাকে দেখেছেন, সেদিনও আমাকে আপনারা দেখেছেন, আজ আবার এতদিন পরেও দেখছেন। বলতে পারেন আমার এ-চেহারা হয়েছে কেন? কেন আমি এত শুকিয়ে গিয়েছি?

প্রশ্নটা করে নয়নতারা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আবার নিজেই বলতে লাগলো–মানুষ শুকিয়ে যায় মনের কষ্টে। আমার পাশের বাড়ির দিদিমা আমাকে অনেক দিন বলেছেন–বউমা, তোমার শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? তুমি একটু ভালো করে খাওয়া দাওয়া করতে পারো না? না খেলে তোমার শরীর যে টিকবে না। আমি এর উত্তরে কিছুই বলতে পারিনি দিদিমাকে। বলবো কী করে? আমার মনে যে কষ্ট তা বাইরের লোককে আমি বলবো কী করে? বাড়ির বউ হয়ে বাইরের লোকের কাছে তা কি বলা যায়? কারণ এ তো আমার শ্বশুরবাড়ি, এ তো আমার স্বামীর বাড়ি–। শ্বশুরবাড়ি, স্বামীর বাড়ি, সে তো মেয়েমানুষের কাছে তীর্থস্থান। সেখানকার নিন্দে করতে নেই, সেখানকার নিন্দে শুনতেও নেই। আমার মা এখানে আসবার আগে বার বার করে আমাকে বলে দিয়েছিল–শ্বশুর-শাশুড়িকে দেবতার মত ভক্তি করবে। তাদের মুখের ওপর কথা বোল না। আমার মা আর আজকে বেঁচে নেই। মা যদি আজ বেঁচে থাকতো তো মাকে বলতুম–মা তোমার কথা আমি রাখতে পারলুম না, আমাকে তুমি ক্ষমা কোর। আর তা ছাড়া বিয়ের পর তো নিজের বাবা-মাও পর হয়ে যায়, তখন শ্বশুর-শাশুড়িই বাবা-মা’র জায়গা নিয়ে নেন। তাদের মেয়ে হয়ে তাদের বাড়ির পুত্রবধূ হয়ে আমি কি তাদের নামে নিন্দে করতে পারি? নিন্দে করলেও তা কি কোনও শিক্ষিত মেয়ের পক্ষে করা উচিত? বলুন, আপনারা সকলেই বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনারাই বলুন, তা কি করা উচিত?

প্রাণকৃষ্ণ সা’মশাই একেবারে সামনের দিকে বসে ছিল।

বললেন–না না বউমা, তা করা উচিত নয়, তারা তোমার পিতৃ-মাতৃ তুল্য! তাদের নিন্দে তোমার মুখে শোভা পায় না–

নয়নতারা বলতে লাগলো–-হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই বলছেন, তাঁদের নিন্দে মহাপাপ, আমি যদি আজ আপনাদের কাছে তাদের নামে কোনও অপবাদ দিই তাহলে পরলোকে গিয়ে নরকেও আমার স্থান হবে না। আমি সেজন্যে আপনাদের আজ ডেকে পাঠাইনি।

এতক্ষণে চৌধুরী মশাই-এর যেন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো।

পেছন দিকে ঘরের বাইরে চৌধুরী মশাই-এর গৃহিণী এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। এবার চৌধুরী মশাই-এর দিকে চেয়ে বললে–ওগো, তুমি এখনো শুনছো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? বউমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে আসতে পারছো না? বউমাকে ধরে টেনে নিয়ে এসো–

চৌধুরী মশাই কাছে এলেন। কথাটা ভালো করে শুনতে পাননি। জিজ্ঞেস করলেন–কী বলছো?

–বলছি, আমার বাড়ির বউকে নিয়ে সবাই যে মজা দেখতে এসেছে, এটা বুঝতে পারছো না?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা তুমি কি বলতে চাও আমি সবাইকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দোব?

-–হ্যাঁ, তাড়িয়ে দেবে। আমার বাড়ির ভেতরের ব্যাপারে ওঁরা কেন নাক গলাতে আসবেন? ওঁরা কে? ওরা আমাদের খাওয়ায় না আমাদের পরায়?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা ভদ্দরলোকদের কি সোজাসুজি তাড়িয়ে দেওয়া যায় নাকি?

গৃহিণী বললে–তা তুমি তাড়িয়ে দিতে না পারো, আমি ভেতরে গিয়ে ওদের চলে যেতে বলি।

–তুমি ওদের সামনে যাবে? কী বলছো তুমি?

–তা সামনে গেলে দোষ কী? আমাদের ইজ্জৎ যদি ওরা রাখতে না পারে তো ওদের ইজ্জৎ রাখতে আমাদের বয়ে গেছে

চৌধুরী মশাই বললেন–না না, এখন অমন করো না, শেষকালে গায়ে ঢি-ঢি পড়ে যাবে–

বলে চৌধুরী মশাই আবার ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন।

নয়নতারা তখনও ঘরের ভেতরে তেমনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তখনও এক মনে বলে চলেছে–আপনারা জানেন আমার স্বামী আমার সঙ্গে ঘর করেন নি। কিন্তু কেন করেন নি তা কি জানেন আপনারা? জানেন? যদি না জেনে থাকেন তো আমি আপনাদেরকে বলে দিচ্ছি। ঘর করেন নি কারণ তিনি ছিলেন সত্যিকারের পুরুষমানুষ! হ্যাঁ, সত্যিকারের পুরুষমানুষ!

সমাগত ভদ্রলোকদের মধ্যে তখন বেশ একটা অস্পষ্ট গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।

–বিশ্বাস করুন, তার ওপর আমার কোনও অভিযোগ নেই। তিনি এ বাড়িতে জন্মে যা কিছু দেখেছেন তাতে তার এবংশের ওপরেই অশ্রদ্ধা হয়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝেছিলেন এর থেকে মুক্তি পেতে গেলে তাকে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও ছাড়তে হবে–

বলতে বলতে নয়নতারার যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। একবার খানিকক্ষণের জন্যে দম নিয়ে সে আবার বলতে লাগল–তারপর আমার স্বামী একদিন এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন–আমাকে ত্যাগ করে গেলেন।

ততক্ষণে ওদিকে বারোয়ারীতলায় খবর চলে গেছে। কেদার দৌড়তে দৌড়তে নিতাই হালদারের দোকানে এসে হাজির।

সবাই তখন একমনে তাস নিয়ে মেতে ছিল।

কেদার তখনও হাঁফাচ্ছে! বললে, ওরে, মজার কাণ্ড হয়েছে, চৌধুরীবাড়ীতে মজার কাণ্ড শুরু হয়েছে–

–কী কাণ্ড?

–চৌধুরী বাড়ির বৈঠকখানায় সদার বউ নাকি সওয়াল-জবাব করছে–

–কীসের সওয়াল-জবাব?

ব্যাপারটা অনেকের কানেই তখনও যায়নি। জিনিসটা বুঝতে অনেকেরই তখনও সময় লাগলো। নিতাই বললে–তারক জ্যাঠা থেকে বেহারি পাল মশাই পর্যন্ত সবাই হাজির।

নিতাই হালদার শুনে বললে–-হ্যাঁ, তাই বোধ হয় আমার মা-ও গেছে সেখানে। বলছিল বটে চৌধুরী বাড়িতে যাবে–তা কী জন্যে গেছে রে?

–সদার বউ যে সবাইকে ডেকেছিল। তার নিজের কথা নাকি শোনাবে সকলকে!

সদার বউ! সদার বউকে বিয়ের সময় সবাই-ই দেখেছে। বউ দেখে সেদিন সদার ওপর সকলের হিংসেও হয়েছিল। কী ফর্সা সুন্দরী বউ সদার! তারপর সে বউকে আর কখনও দেখেনি তারা। তারপর শুধু শুনেছিল সদা বউ ছেড়ে বাড়ি ছেড়ে কোথায় পালিয়ে গিয়েছে।

–তুই জানলি কী করে?

কেদার বললে–আরে, আমি যে ওখান দিয়ে আসছিলুম, আসতে গিয়ে দেখি ওখানে ওদের সদরে খুব ভিড়। তা ভিড় দেখে আমিও ভেতরে ঢুকলুম। গিয়ে দেখি সবাই হাজির। সামনে বারবাড়ির উঠোনে লোকের ভিড়ে ভেতরে কিছু দেখতে পাইনে। শেষকালে উঁকি দিয়ে দেখি ভেতরে সবাই বসে। সব চেনা মুখ। তারক জ্যাঠা আর সা’মশাই একেবারে সামনের সারিতে। আর ঘরের মধ্যে সকলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সদার বউ–

সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো–সদার বউ?

কেদার বললে–হ্যাঁ রে, সদার বউ!

তবু যেন কারো বিশ্বাস হলো না। জিজ্ঞেস করলে–কী বলছিস তুই? সদার বউ? বৈঠকখানা ঘরে? একঘর বেটাছেলের সামনে? গুল মারবার আর জায়গা পাসনি? সদার বউ বৈঠকখানা ঘরে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে?

কেদার বললে–মাইরি বলছি, মা-মঙ্গলচণ্ডীর দিব্যি, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না– তোরা যদি বিশ্বাস না করিস তো এই আমি মা-মঙ্গলচণ্ডীর মাথা ছুঁয়ে দিব্যি করে আসছি, এই দেখ–

বলে বটগাছটার দিকে দৌড়ে চলে গেল। বটগাছের তলায় সিমেন্ট বাঁধানো বেদীর ওপর মঙ্গলচণ্ডীর একটা পাথরের মূর্তি ছিল। সেখানে গিয়ে মূর্তির মাথাটা ছুঁয়ে বললে–এই দেখ, মার মাথা ছুঁয়ে দিব্যি করছি, মাইরি বলছি সদার বউ বৈঠকখানায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে এলুম–

এতক্ষণে যেন সকলের বিশ্বাস হলো। জিজ্ঞেস করলে–কী রকম দেখলি?

কেদার বললে–উঃ, কী ফর্সা তোদের কী বলবো, যেন রূপ ঠিকরে বেরোচ্ছে—

গোপালেরই যেন বেশি আগ্রহ, বললে–কী বলছিল?

–আমি কি সব শুনেছি। ভিড়ের জ্বালায় কি ভেতরে ঢোকা যায় যে সব শুনবো?

গোপাল ষাট সকলের দিকে চেয়ে বললে–চল ভাই দেখে আসি–

তাস-টাস সব পড়ে রইলো। নিতাই হালদার তার দোকানের ভার তার চাকরটার হাতে ছেড়ে দিয়ে ছুটলো চৌধুরী বাড়ির দিকে। যেন দেরি হয়ে গেলে সব মজা খতম হয়ে যাবে।

ওদিকে বৈঠকখানার ভেতরে তখন নাটকের পঞ্চম অঙ্ক চলছে।

তারক চক্রবর্তী বলছেন–আপনি আপনার বউমাকে বলতে দিন চৌধুরী মশাই, উনি যা বলছেন তা আগে বলতে দিন, তারপরে আপনার যা বলবার তা বলবেন।

চৌধুরী মশাই বললেন–তা আপনারা কি ভাবেন বউমা মিছে কথাগুলো বলে যাবে আর আমি চুপ করে সব শুনে যাবো?

নয়নতারা বলে উঠলো–না, আমি একটাও মিছে কথা বলিনি। আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তাই বললুম। আমি নিজের চোখে দেখেছি উনি কর্তাবাবুর গলা চেপে ধরেছেন…

–মিথ্যে কথা! সব আগাগোড়া মিথ্যে কথা!–চৌধুরী মশাই জোরে প্রতিবাদ করে উঠলেন।

ভেতর থেকে প্রীতি বলে উঠলো–বউমা, এত বড় আস্পর্ধা তোমার, শ্বশুরের নামে তুমি এত বড় মিছে কথা বলো! তোমার জিভ খসে যাবে বলছি, মাথার ওপর ভগবান আছে সে কথা ভুলে যেও না–

বেহারি পালের বউ বললে–তুমি চুপ করো না বউ, বউমা কী বলছে আগে বলতে দাও না–

–তুমি থামো মাসীমা, পরের বাড়ির কেচ্ছা শুনতে খুব ভালো লাগছে তোমাদের, না? কিন্তু আমিও জানি এ বউকে কেমন করে শায়েস্তা করতে হয়।

ভেতর থেকে নয়নতারাই এ কথা উত্তর দিলে–শায়েস্তা আমাকে যথেষ্ট করেছেন মা। আপনারা, শায়েস্তা করে করেই তো আপনারা আজকে আমাকে এতগুলো ভদ্রলোকের সামনে আমার মুখ খুলতে বাধ্য করলেন। আপনারা শায়েস্তা না করলে কি আমারই আজকে এত সাহস হতো? আজ যখন আমাকে শায়েস্তা করে করে আমাকে একেবারে মরীয়া করে তুলেছেন, তখন আর আপনাদের বারণ শুনবো কেন? আজকের কথা তো তখনই আপনাদের ভাবা উচিত ছিল। তখন কত কেঁদেছি কত আপনার পায়ে ধরেছি, তখন তো আমার একটা কথাও শোনেননি আপনারা?

তারপর একটু থেমে নয়নতারা আবার বলতে লাগলো–না, আমার একটা কথাও তখন কেউ শোনেনি। আমার চোখের সামনে একজন মানুষ খুন হয়ে গেলেও আমি মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারলুম না যে এ বাড়িতে আর একটা খুন হয়েছে! খুন এ বাড়িতে আগে আরও অনেক হয়েছে। সে-সব আমার শোনা কথা। আমার স্বামীই আমাকে তখন বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু টাকার জন্যে কি মানুষ এতই অন্ধ হয় যে নিজের বাবাকেও খুন করতে বাধে না? তাহলে এ টাকা কীসের জন্যে? সুখের জন্যে, না খুনের জন্যে? আর টাকাই যখন সমস্ত তাহলে আমাকে কেন এ বাড়ির বউ করে আনা হয়েছিল? আমার বাবা গরীব, আমার বিয়ের সময় বাবা তো একটা পয়সাও নগদ দিতে পারেননি। তাহলে কি রূপ? আমার রূপের জন্যে?

নয়নতারা নিজেই প্রশ্নটা করে নিজেই উত্তরের প্রতীক্ষায় সকলের দিকে চাইলে। বললে–আপনারা বলুন রূপ ছাড়া আর কী হতে পারে? রূপ ছাড়া আর কীসের জন্যে আমাকে এই নরক-পুরীতে বউ করে আনা হলো?

কেউ এ প্রশ্নের উত্তর দিলে না। উত্তর বোধহয় চায়ওনি নয়নতারা। এবার সে নিজেই তার নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলে।

বললে–হ্যাঁ, রূপই আমার কাল হলো। এই রূপের জন্যেই আমি এ বাড়ির বউ হয়ে এলুম। আমার কাজ হলো আমার স্বামীকে আমার রূপ দেখিয়ে ভুলিয়ে বশ করা। ছলা কলা করে বশ করে তাকে দিয়ে এই চৌধুরী বাড়ির বংশরক্ষা করা। আর কিছু নয়, শুধুই বংশরক্ষা আর তারই প্রতিবাদে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। আর আমি?

নয়নতারার সমস্ত শরীরে তখন দরদর করে ঘাম ঝরছে। বলতে বলতে তার যেন নেশা লেগে গিয়েছিল! জ্যৈষ্ঠ মাসের গুমোট গরম। শুধু নয়নতারাই নয়, যারা যারা ঘরের মধ্যে বসে ছিল, দাঁড়িয়ে ছিল, আশে-পাশে থেকে সব কিছু শুনছিল তাদেরও সকলেরই যেন তখন নেশা লেগে গিয়েছিল।

–আর আমি?

নয়নতারা চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগলো। প্রশ্নটা সকলের মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে সে যেন সুবিচারের আশায় তাদের করুণার কাছে আত্মসমর্পণ করলো।

বললে–আর আমি? আমার তখন কী কর্তব্য আপনারাই বলুন? আপনারা সবাই গ্রামের বিচক্ষণ গণ্যমান্য ভদ্রলোক, আমি আপনাদের কাছেই প্রশ্ন করছি এমন অবস্থায় আমার কী কর্তব্য থাকতে পারে? আমার এই রূপ এই বয়স তখন কার কোন্ কাজে লাগবে? আমাকে দিয়ে তখন আমার শ্বশুর-শাশুড়ির কোন উদ্দেশ্য সার্থক হবে? বলুন? আমি সেই অবস্থায় তাদের সেই আশা কেমন করে মেটাবো, আপনারাই বলুন?

এবারেও কেউ এ প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলে না।

–বলুন, আমি মেয়েমানুষ হয়ে তাঁদের এ আশা কেমন করে মেটাবো? হাজার সদিচ্ছে থাকলেও কি আমি তাদের সে ইচ্ছে মেটাতে পারি? মেয়েমানুষের দ্বারা কি তা সম্ভব?

তারপর আবার একটু থেমে বলতে লাগলো–না, পারি না। কেউই পারে না। আমার বিয়ের আগে আমার মা আমাকে অনেক করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিল। আমি মার সব কথা বর্ণে বর্ণে মেনেছি। মা বলে দিয়েছিল শ্বশুরকে দেবতার মত ভক্তি করবে, তা করেছি। শাশুড়ির সেবা করতে বলেছিল মা, তা-ও করেছি। মা যা-যা বলেছিল, আমি তা সমস্তই মেনেছি। কিন্তু মা’র একটা কথা শুধু আমি রাখতে পানিনি, কিছুতেই মানতে পারিনি

তারক চক্রবর্তী মশাই আর থাকতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন–কী কথা মানতে পারোনি মা?

–সেই কথা বলতেই তো আজকে আপনাদের সকলকে ডেকেছি। আমার মা যদি আজ বেঁচে থাকতো তো আজকে আমি মাকেই বলতুম যে, মা তোমার সব কথা আমি মাথা নিচু করে মানতে পারলুম না। আমাকে তুমি সেজন্যে ক্ষমা কোর। মা বেঁচে থাকলে মা আমার কথার উত্তরে কী বলতো জানি না। কিন্তু আমার মা নেই, তাই আপনাদের মত গুরুজনদেরই আমি জিজ্ঞেস করছি, আপনাদের কাছেই আমি প্রশ্ন রাখছি, আপনারাই বলুন, আমার কি অন্যায় হয়েছে? আমি কি অন্যায় করেছি?

এবার সা’মশাই জিজ্ঞেস করলেন–কোন কথাটা তুমি রাখতে পারোনি মা?

–আমার শাশুড়ি আমায় বলেছিলেন রাত্রে আমার ঘরের দরজা খুলে শুতে–

–কেন?

নয়নতারা বললে–আমিও আমার শাশুড়িকে সেই কথাই জিজ্ঞেস করেছিলুম, কেন? কেন আমি দরজা খুলে শোব? তা শাশুড়ি কোন কারণ বলেননি। যখন আরো একবার জিজ্ঞেস করেছিলুম, তখন তিনি বলেছিলেন–তর্ক কোর না বউমা, আমি যা বলছি তাই করো—

শাশুড়ি পেছন থেকে বলে উঠলো–মিছে কথা বোল না বউমা, তোমার ভালোর জন্যেই আমি তোমাকে দরজা খুলে শুতে বলেছিলুম। বলেছিলুম–তোমার একলা ঘরে শুতে ভয় করতে পারে, আমি সংসারের কাজকর্ম সেরে তোমার পাশে গিয়ে শোব।

নয়নতারা বললে–হয়ত আপনি তাই-ই বলেছিলেন মা, হয়ত আমিই শুনতে ভুল করেছিলুম, হয়ত আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনি কি তারপর একদিনও আমার ঘরে আমার পাশে এসে শুয়েছিলেন? আমার নিজের মা হলে যা করত তা কি আপনি কোনও দিন করেছেন তারপর? না অন্য একজনকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন?

–বউমা!

চৌধুরী মশাই এবার চিৎকার করে উঠলেন। বললেন–মনে রেখো বউমা, তুমি তোমার শাশুড়ির নামে যা-তা দোষ দিচ্ছ! শাশুড়ি তোমার মায়ের মতন, তার নামে দোষ দিলে নরকেও কিন্তু তোমার স্থান হবে না।

নয়নতারা এবার শ্বশুরের দিকে মুখ তুলে চাইলে। বললে–নরকেই তো এখন আমার স্থান হয়েছে বাবা, নরকেই তো আমি এখন বাস করছি। এ-বাড়িকে নরক ছাড়া আর কী বলবো বলুন? নরক কি এর চেয়েও কষ্টের জায়গা মনে করেন? নরকের কি এর চেয়েও জঘন্য চেহারা? নরকের কথা কি শুধু মহাভারতেই লেখা আছে, এ পৃথিবীতেও কি নরক নেই? আর তাছাড়া এ-বাড়িই যদি নরক না হয়, তবে নরক আর কোথায়? কোথায় নরক খুঁজতে যাবো?

পেছন থেকে শাশুড়ি বলে উঠলো–তোমার বড় বাড় বেড়েছে বউমা। কিছু বলি না বলে তুমি একেবারে সাপের পাঁচ পা দেখেছ! হা-ঘরের বাড়ি থেকে মেয়ে এনেছিলুম বলেই আজ আমার এই দুর্দশা!

নয়নতারা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো–মা, দোহাই আপনার, আমাকে যা বলেন বলুন, আমার বাবাকে আপনি আর গালাগালি দেবেন না আমার সামনে। আমি যত অপরাধই করে থাকি, আমার বাবার কিন্তু কোনও দোষ নেই। তাকে আর দয়া করে এই নরককুণ্ডে টেনে আনবেন না, আপনার পায়ে পড়ছি–

তারক চক্রবর্তী মশাই অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন। বললেন–তারপর মা? তারপর তুমি ঘরে দরজা খুলে শুলে, না দরজা বন্ধ করে শুলে?

নয়নতারা বললে–আমি শাশুড়ির কথা অমান্য না করে দরজা খুলেই শুলুম, কিন্তু সেইদিনই রাত্তিরে আমার ভুল ভেঙে গেল।

কেদাররা তখন এসে গেছে। একেবারে উঠোনের মধ্যে ঢুকে পড়ে ভিড়ের ভেতর দিয়ে উঁকি মেরে দেখবার চেষ্টা করলে।

গোপালরাও ছিল পেছনে। তারাও একবার সদার বউকে চোখের দেখা দেখবে। সেই কতদিন আগে বিয়ের সময় সদার বউকে দেখে সবাই চক্ষু সার্থক করেছিল। এতদিন বাদে আবার তাকে দেখবার সুযোগ এসেছে। এমন রূপসী বউকে ছেড়ে সদা কেমন করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, এটা নিয়ে বহুদিন গবেষণা করেছে তারা। তাসের আড্ডায় বসে অনেক তর্ক-বিতর্কও হয়েছে। কিন্তু কোনও ফয়সালা হয়নি কোনদিন। সেই বউ কিনা আজ দ্রৌপদীর মত একেবারে কৌরবদের সভায় এসে হাজির হয়েছে! এটাও তো এক তাজ্জব কাণ্ড! তবে কি কোনও কেলেঙ্কারি কাজ করে ফেলেছে নাকি রে বউটা!

কেদার একেবারে সকলকে ঠেলে ঠুলে সামনে একটা জায়গা করে নিয়েছে। গোপালদেরও কাছে টেনে নিয়ে বললে–উই দ্যাখ–

কেদারও দেখলে। গোপালও দেখলে। সবাই-ই দেখলে। আহা, কী রূপ রে! দেখেছিস মাথার চুলগুলো কী রকম কোকড়ানো? চোখ দুটো খুব বিউটিফুল, না?

–চুপ কর না, কী বলছে শুনি ভালো করে?

সা’মশাই আবার জিজ্ঞেস করলেন–কী দেখলে মা? বললো, বলো, কী দেখলে বলো?

শাশুড়ি কিন্তু তখন তার আগের কথার জের ছাড়েনি। বলে উঠলো– তোমার বাবার নাম কেন তুলবো না? তিনি তো শুনেছি মাস্টার, তা মাস্টার হয়ে নিজের মেয়েকে এই শিক্ষা দেওয়া? এ কোন্ শিক্ষা শুনি? যে-মেয়ের লঘু-গুরু জ্ঞান নেই, যে-মেয়ে একঘর ভর্তি পুরুষমানুষের সামনে ঘোমটা খুলে খ্যামটা নাচতে পারে, তার বাবা কি আবার মাস্টার?

–মা! নয়নতারার বুকে যেন কথাগুলো শেলের মত বিঁধলো। বললে–আমি আপনার পায়ে ধরে বলছি মা আমাকে আপনি যা-তা বলুন, যত ইচ্ছে শাস্তি দিন সে আমার সহ্য হবে, কিন্তু আমার বাবার বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না–আপনাদের পায়ে পড়ছি—

শাশুড়ি বললে–তা এতই যদি বাপের ওপরে তোমার টান তো কই, বাপ তো তোমার একটা খবরও নিলে না এতদিনে, একবার তো দেখতেও এল না যে, যাই মেয়েকে একবার দেখে আসি গিয়ে! আর মেয়ের খোঁজ না-হয় না নিলে কিন্তু জামাইকেও তো একবার দেখতে ইচ্ছে করে–মেয়ে-জামাই কেমন আছে, একটা চিঠি লিখেও তো সে-খবরটা মানুষ নেয়–

বেহারি পালের বউ-এর তখন আসল কথাটা জানবার ইচ্ছে। বললে–তুমি থামো না বউ, বউমা যা বলতে চায় তা বলতে দাও না—

কিন্তু শাশুড়ির কথার উত্তর দিলে নয়নতারা। বললে– দোহাই মা আপনার, এমন প্রার্থনা করবেন না আপনি, আমি তো দিনরাত ভগবানকে তাই বলছি যেন এর মধ্যে বাবা আর না এসে পড়েন! আমি যা কষ্ট পাচ্ছি তা পাচ্ছি, বাবা আমার এ-কষ্ট দেখলে আর বাঁচবেন না–তাকে আর বাঁচাতে পারবো না। আর শুধু বাবা কেন, আমার কষ্টের কথা জানলে আজ এখানে যাঁরা হাজির, তারাও কানে আঙুল দেবেন–

তারক চক্রবর্তী মশাই বললেন–আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছিনে মা, কী এমন ব্যাপার যে শুনলে কানে আঙুল দিতে হবে?

চৌধুরী মশাই বললেন–আপনারা উঠুন সা’মশাই, আপনারা আর কেন বসে আছেন, আমার বউমা পাগল, পাগল না হলে এমন প্রলাপ কেউ বকে?

নয়নতারা সঙ্গে সঙ্গে যেন ক্ষেপে উঠলো। বললে–পাগল? আমি পাগল? আমি প্রলাপ বকছি? কিন্তু রোজ রাত্রে তাহলে আপনি পাগলের ঘরে ঢোকেন কেন? কীসের জন্যে, কোন্ আকর্ষণে পাগলের কাছে তবে যান? আমি পাগল। অন্ধকারে রাত্রে আমার ঘরে ঢোকবার সময় তো মনে থাকে না আমি পাগল? তখন তো আমি পাছে টের পাই, তাই টিপি-টিপি পায়ে আমার ঘরে ঢোকেন! বলুন, আমার কথার জবাব দিন? বলুন, কেন আমার ঘরে ঢোকেন বলুন?

চৌধুরী মশাই-এর মুখ-চোখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। পাথরের মত তিনি তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।

–বলুন? চুপ করে থাকবেন না। আমার কথার জবাব দিন? নিজের হাতের আঙুল দিয়ে নিজের বাবার গলা টিপে মারতে পেরেছেন বলে ভেবেছেন আমাকেও গলা টিপে মারবেন? বলুন, জবাব দিন? একটু আগে আমাকে নরকের ভয় দেখালেন! ভয় দেখাতে আপনার লজ্জা করে না? এর চেয়ে বীভৎস নরককুণ্ডু আর কী হতে পারে? নরককুণ্ডু না হলে শ্বশুর হয়ে ছেলের বউ-এর ঘরে কেউ ঢুকতে পারে? হায় রে, আজ আমিই হলুম পাগল, আশ্চর্য! আপনি ভেবেছেন আমাকে পাগল বলে আপনি পার পাবেন? পাগল হলে কি এবাড়িতে আমি কাউকে আস্ত রাখতুম? বলুন, জবাব দিন আমার কথার?

চারিদিকে থমথমে আবহাওয়া। সবাই যেন বোবা হয়ে গেছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের গুমোট গরম যেন হঠাৎ এক মুহূর্তে উত্তাপের বরফ হয়ে জমাট বেঁধে গেছে।

প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙলো বেহারি পাল। বললে–ছি ছি চৌধুরী মশাই, এটা সত্যি একটা বড় অন্যায় কাজ হয়েছে আপনার–

তারক চক্রবর্তী বললেন–কই চৌধুরী মশাই, আমরা তো বিশ্বাস করতে পারছি না আপনি এ কাজ করতে পারেন–আপনি আমাদের নবাবগঞ্জের বিশিষ্ট একজন ভদ্রলোক হয়ে…।

চৌধুরী মশাই-এর নিচু মাথা তখন আরো নিচু হয়ে গেছে। সকলের ধিক্কার-গঞ্জনার মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে তখন।

কিন্তু পেছন থেকে চৌধুরী-গিন্নীর গলার আওয়াজ হঠাৎ সব গুঞ্জন স্তব্ধ করে দিলে। পেছন থেকে চৌধুরী গিন্নী বলে উঠল– চৌধুরী মশাইকে আপনারা সবাই মিলে দোষ দিচ্ছেন কেন? চৌধুরী মশাই-এর কী দোষটা দেখলেন আপনারা? দোষ দিতে হয় আমাকে দোষ দিন। আমি যেমন বলেছি চৌধুরী মশাই তেমনি করেছেন। এছাড়া আমাদের উপায় কী ছিল বলুন? আমার ছেলে নেই, ছেলে অনেকদিন হলো নিরুদ্দেশ, তাহলে আমার এই এত সম্পত্তি এ-সব কে খাবে? কে দেখবে? কার জন্যে তাহলে এই সংসার করা? তাহলে সব কিছু ছেড়ে বনে চলে গেলেই হয়! কোন্ সুখের জন্যে লোকে ছেলের বিয়ে দেয়? কীসের আশায়? বংশই যদি না রইল তো এ ছাই সংসার দিয়ে হবেই বা কী? আমার শ্বশুর অনেক সাধ করে নাতির জন্যে সোনার হার গড়িয়ে রেখে দিয়ে গেছেন, সে হার তাহলে কার গলায় পরাবো? এছাড়া আমাদের আর কী গতি ছিল বলুন? বউমা আমাদের নামে দোষ দিচ্ছে এখন, কিন্তু বউমারও তো মা হতে ইচ্ছে করে? সেই বউমাই বা কী নিয়ে বেঁচে থাকবে? আমরা যখন থাকবো না, তখন তো বউমাই এ-সংসারের মালিক হবে, তখন? তখন বউমার কার জন্যে কীসের আশায় সংসার করবে? আপনারা অন্যায়টা আমাদেরই দেখলেন, কিন্তু আমাদের দুঃখটা তো বুঝলেন না–

তারক চক্রবর্তী উপস্থিতদের মধ্যে সব চেয়ে প্রবীণ লোক। বললেন কিন্তু বউমা, হাজার দুঃখ থাক তোমার, তা বলে চৌধুরী মশাই-এর এই আচরণ তো সহ্য করা যায় না–

চৌধুরী-গিন্নী ভেতর থেকে বললে–যদি সহ্য করা না যায় তো আমরাও আর বউমাকে সহ্য করবো না। ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ এনেছিলুম, সেই ছেলেকেই যখন বউমা বশ করতে পারলে না, তখন অমন বউমাকেও আমার দরকার নেই। যাদের বাড়ির মেয়ে তাদের বাড়িতেই আবার চলে যাক–দুষ্ট গরুর চেয়ে আমার শূন্য গোয়াল ভালো–

তা বললে তো চলবে না বউমা–আমরা পাঁচজন গ্রামের ভদ্রলোক থাকতে তোমার বউমাকে আমরা অপমান করে তাড়িয়ে দিতে দেব না–তোমরা তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না। তাতে আমাদের গ্রামের অকল্যাণ হবে–

চৌধুরী-গিন্নী তেমনি গলা উঁচু করেই বললে–কিন্তু অমন বউও আমার দরকার নেই, আমি অমন বউকে খাইয়ে পরিয়ে বাহার করে ঘর সাজিয়ে রাখতে পারবো না। ও এখুনি বিদেয় হয়ে যাক–

কথাটা খুবই রূঢ়। সকলেরই খট করে কানে লাগলো।

নয়নতারা বললে–কিন্তু আমিও আর থাকতে চাই না মা এখানে, এই নরককুণ্ডুতে। আমাকে পায়ে ধরে সাধলেও আমি থাকছি না—

–তাহলে তোমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাও। তা সে বাপের বাড়িই যাও আর রেল বাজারে গিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকো আমি সে-সব দেখতে যাচ্ছিনে–আমার বংশই যদি রক্ষে না হলে তোমার মত বউ নিয়ে কি আমি ধুয়ে খাবো?

নয়নতারা বললে–বংশ আপনাদের রক্ষে হবে না মা। আপনি হাজার চেষ্টা করলেও হবে না, আমিও হাজার চেষ্টা করলেও হবে না। কালীগঞ্জের বউ-এর যে-সর্বনাশ আপনারা করেছেন, তারপরে তার অভিশাপ ফলবে না বলতে চান?

চৌধুরী মশাই-এর মুখ দিয়ে এতক্ষণ কোনও কথাই বেরোয়নি। তারক চক্রবর্তীমশাই তার দিকে চেয়ে বললেন–বউমাকে যদি বাপের বাড়ি পাঠাতেই হয় চৌধুরী মশাই তো এমনি পাঠালে চলবে না, রীতিমত যেমন নিয়ম আছে তেমনি নিয়মে পাঠাতে হবে–

সা’মশাই বললো এমনি পাঠিয়ে দেবেন না, আপনার বউমাও তো চলে যেতে চাইছেন। আপনার সরকার আর একজন দাসীকে সঙ্গে দিয়ে ওঁর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিন। সেই ভালো–

বেহারি পালও একটা কী বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই বাধা পড়লো। চৌধুরীবাড়ির সদরে নজর পড়তেই সবাই দেখলে জনতিনেক লোক হাঁড়ি, থালা, বারকোষ নিয়ে ভেতরে ঢুকছে। একজনের মাথায় আবার আম কাঁঠালের ঝুড়ি।

বিপিনও বাড়ির ভেতরে এত ভিড় দেখে অবাক হয়ে গেছে।

কে একজন এগিয়ে গিয়ে বুঝি জিজ্ঞেস করলে কোত্থেকে আসছে গো তোমরা? এ সব কী?

বিপিন বললে–আসছি কেষ্টনগর থেকে, জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব নিয়ে–

সঙ্গে সঙ্গে খবরটা এক মুখ থেকে আর এক মুখে রটে যেতে যেতে একেবারে আসরের ভেতরে গিয়ে কথাটা পৌঁছুলো। বেহারি পালের বউ দাঁড়িয়ে সব শুনছিল এতক্ষণ। তার পাশেই নিতাই হালদারের মা। তার পাশে পাড়ার আরো ক’জন মেয়েমানুষ ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর দরজার একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল চৌধুরী-গিন্নী। ঘরের ভেতরে চৌধুরী মশাই, তারক চক্রবর্তী, বেহারি পাল, সা’ মশাই, সকলের কানেই কথাটা গিয়ে পৌঁছলো। কে? কোথা থেকে এসেছে? কেষ্টনগর থেকে? জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব?

সমস্ত আবহাওয়াটা যেন সঙ্গে সঙ্গে অন্যরকম হয়ে গেল। এতক্ষণ ছন্দ তাল লয় সব ঠিক মত বজায় ছিল, কিন্তু এবার যেন সব বেতাল হয়ে গেল।

চৌধুরী-গিন্নী তত্ত্বওয়ালাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। বিপিনের সামনে এসে বললে–এসো এসো বাবা তোমরা, এসো–

কিন্তু নয়নতারার কানে কথাটা যেতেই নয়নতারা ভিড় ঠেলে নিজেই বৈঠকখানার বাইরে চলে এসেছে। দিদিমণিকে সেই অবস্থায় দেখে বিপিনও যেন হাসতে ভুলে গিয়েছিল।

নয়নতারা বিপিনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে–বিপিন, তুমি?

–মাস্টার মশাই জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব পাঠিয়েছেন দিদিমণি। তুমি ভালো আছো?

নয়নতারা সেকথার উত্তর না দিয়ে বলে উঠলো– জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব আর নামাতে হবে এখানে, তোমরা সব ফিরিয়ে নিয়ে যাও–

বিপিন চমকে উঠেছে। বললে–কেন দিদিমণি, দাদাবাবু এত কষ্ট করে সব যোগাড় যন্তর করলেন, ফিরিয়ে নিয়ে যাবো?

–হ্যাঁ, এখুনি ফিরিয়ে নিয়ে যাও

তখনও বিপিন কিছু বুঝতে পারছে না– সে স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল নয়নতারার দিকে। বাড়ির ভেতরে যত লোক জমেছিল সবাই তখন একদৃষ্টে নয়নতারার কাণ্ড দেখছে।

চৌধুরী-গিন্নী বললে–ওরা তত্ত্ব নিয়ে এসেছে, তুমি ফেরত পাঠাচ্ছো কেন বউমা?

–হ্যাঁ ফেরত যাবে ওরা। যে বাড়িতে জামাই নেই, সেখানে আবার বাবা জামাইষষ্ঠী পাঠিয়েছে! ফিরে যাও, ফিরে যাও বলছি!

বিপিনদের তখনও হতভম্ব ভাবটা কাটেনি। বললে–ফিরে যাবো?

নয়নতারা বললে–হ্যাঁ, আমি বলছি ফিরে যাবে। যদি ফিরিয়ে নিয়ে না যাও তো আমি এই মাটিতে সব ফেলে দেব। যাও ফিরে, এখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছো? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? তোমাদের জামাইবাবু এ বাড়িতে নেই। এ বাড়িতে আর কখনও তিনি আসবেনও না। আমিও আর এ বাড়ির কেউ নই, তোমরা যাও, যাও-চলে যাও–

বিপিনরা কী করবে বুঝতে পারছিল না। চৌধুরী মশাই হঠাৎ এসে মাঝখানে দাঁড়ালেন। বললেন– কী করছো বউমা, ওদের তাড়িয়ে দিচ্ছ কেন? ওরা তত্ত্ব নিয়ে এসেছে, ওদের কী অন্যায় হয়েছে? ওরা থাক্‌, এসো, তোমরা এসো-–

 কিন্তু নয়নতারা হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসলো। বললে–না, ওরা আর এখানে দাঁড়াবে না–বলে বিপিনের হাতের বারকোষটা ঠেলে দিতেই তার ওপরের দুই রাবড়ির মাটির হাঁড়িগুলো মাটিতে পড়ে ভেঙে একেবারে চুরমার হয়ে সমস্ত উঠোনময় ছড়িয়ে গেল।

.

এসব কতদিনের কথা। সেসব দিনের কথা এমন করে যে আবার একদিন পর্যালোচনা করতে হবে এ-কথা কি সেদিনকার সদানন্দ ভেবেছিল! তখন কি একবারও মনে হয়েছিল যে এই সমস্ত ঘটনা-পরম্পরার জন্যে তাকে আবার একদিন জবাবদিহি করতে হবে!

আজ তো তার সর্বস্ব নিঃশেষ হয়ে গেছে। একদিন নবাবগঞ্জের সমস্ত সম্পত্তির যে একমাত্র ওয়ারিশন হতে পারতো, তার মাতামহের ভাগলপুরের সমস্ত সম্পত্তিরও যে একমাত্র উত্তরাধিকারী হতে পারতো সে-ই কিনা আজ নিঃস্ব। চৌবেড়িয়ায় রসিক পালের অতিথিশালার এক কোণে তাকে যে আজ দিনাতিপাত করতে হয় এও নাকি তার অপরাধ! আশ্চর্য!

তবে কি সদানন্দ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে শুধু অপরাধই করেছে?

তার চেয়ে যদি সে নবাবগঞ্জের সংসার-জীবনকেই স্বীকার করে নিত, পিতৃপুরুষের পাপের আর অন্যায়ের আর অত্যাচারের ওয়ারিশন হয়ে সব সহ্য করে যেত তাহলে আর আজ এমন করে তাকে রসিক পালের আশ্রয়েও থাকতে হতো না, আর আসামী হতেও হতো না।

মনে আছে সেদিন কলকাতার সেই অন্ধকার দিনগুলোতে এক-একবার তার বাড়ির কথা মনে পড়তো। মনে পড়তো কালীগঞ্জের বউ-এর কথা। মনে পড়তো নয়নতারার কথা। নয়নতারার কথা মনে পড়লেই মনটাকে সে অন্য খাতে বইয়ে দেবার চেষ্টা করতো। অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করতো। তার অতীতকে সে মন থেকে মুছে ফেলবার চেষ্টা করতো। তারপর যখন আর কিছু ভালো লাগতো না তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তো। বেরিয়ে যত দূর ইচ্ছে হেঁটে-হেঁটে চলে যেত। তারপর আবার এক সময়ে বাড়িতে এসে ঢুকে পড়তো। দেয়ালে-দেয়ালে কত রকম পোস্টার লাগানো থাকতো। কোনওটাতে লেখা থাকতে সাবধান, শত্রুর চর নিকটেই আছে।

সমরজিৎবাবু বেশ অদ্ভুত লোক। কোনও কিছুতেই বিকার নেই তাঁর। এত বড় একটা যুদ্ধ চলে গেছে, কলকাতার বুকের মধ্যে জাপানীদের বোমা পড়েছে, দলে দলে কলকাতার লোক শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু তিনি নির্ভয়ে কলকাতায় ছিলেন।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করতো–আপনার তখন ভয় করেনি?

সমজিৎবাবু হাসতেন। বলতেন–কীসের ভয়? তা সে তো যেখানে যাবে সেখানেই প্রাণের ভয় আছে। ধরো ট্রেনে চড়ে যাচ্ছে, সে-ট্রেনও তো কলিশন্ হয়ে গুঁড়ো হয়ে যেতে পারে, তখন? তুমি পালাবে কোথায় সদানন্দ? বইতে পড়োনি–পলাইবার পথ নাই যম আছে পিছে–

সমরজিৎবাবুর কাজের মধ্যে কাজ ভোর চারটের সময় উঠে ট্রামে করে গঙ্গায় যাওয়া, সেখানে গিয়ে অবগাহন স্নান করে বাড়িতে এসে পূজো করা। সেই পূজোই চলতো এক ঘণ্টা ধরে। তারপরে খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন।

সদানন্দ মাঝে মাঝে কাছে যেত। বলতো–আমার কথাটা একটু ভেবেছেন কাকাবাবু? আপনি আমাকে বলেছিলেন একটা কাজ যোগাড় করে দেবেন–

সমরজিৎবাবু বলতেন–কেন, তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে নাকি?

সদানন্দ শেষকালে একদিন বলছিল–হ্যাঁ, অসুবিধে হচ্ছে, আমি আর কতদিন আপনার ঘাড়ে বসে বসে খাবো? আমার লজ্জা করে। কারো দয়ার দান নিতে আমার ভালো লাগে না। একদিন-দুদিন হয়, তাতে কিছু আসে যায় না, কিন্তু মাসের পর মাস এরকম ভালো লাগে? এবার আমাকে আপনি ছেড়ে দিন।

বলে আর কোনও দিকে না চেয়ে সোজা তার নিজের ঘরে চলে এসেছিল। সমরজিৎ বাবু যে-ঘরটায় তাকে থাকতে দিয়েছিলেন সেটা বেশ বড়। বৌবাজারের মত জায়গার তুলনায় বলতে গেলে সে-ঘরে আলো-হাওয়া ভালোই ছিল। সদানন্দ প্রথম দিন থেকেই ঘরটার মধ্যে শুয়ে পড়ে থাকতো। কোনও কাজ নেই, আবার কোন অকাজও নেই তার। বাড়িটার ভেতরে চাকর বাকরের অনেক খুচরো কথাবার্তা কানে আসতো। তার মধ্যে অনেক কথাই তাদের নিজেদের সম্পর্কে। সংসারের ছোটোখাটো খুঁটি-নাটি নিয়ে বচসা, আর নয়তো হাসি-হাট্টা এক-এক সময় সদানন্দকে নিয়েও আলোচনা হতো। লোকটা কে? বাবুর কে হয়, কেন এখানে আছে, কত দিন এখানে থাকবে, এখানে কী সূত্রে এল, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক প্রসঙ্গ।

সেদিন নিজের ঘরে চলে আসবার সঙ্গে সঙ্গে মহেশ তার ঘরে এল। বললে, আপনি বাবুর সঙ্গে ঝগড়া করেছেন নাকি দাদাবাবু? বাবু বলছিলেন।

সদানন্দ বললে–আমার আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না মহেশ। তুমি তো জানো আমি এখানে আসতে চাইনি, তোমার বাবুই এখানে জোর করে নিয়ে এসেছেন–

মহেশ বললে–কিন্তু এখানে না থাকলে আপনি যাবেন কোথায়? আপনি তো রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন–

সদানন্দ চমকে উঠলো–আমি রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি কে বললে?

মহেশ হাসতে লাগলো। বললে–আমি জানি–

সদানন্দ উঠে বসলো। বললে–তুমি কী করে জানলে? বলতেই হবে তুমি কী করে জানলে?

মহেশ বললে–বাবু যে মা’কে বলছিল। মা আপনার কথা বাবুকে বলছিল কিনা। মা’র কথায় বাবু বললে–ওকে কিছু বোল না তুমি, ও বড়ঘরের ছেলে, রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে

তারপর একটু থেমেই বললে– আপনি বাবুর ওপর রাগ করবেন না দাদাবাবু, বাবুর কষ্টটা আপনি তো দেখতে পান না। বাইরে তো বাবু বেশ হাসি-খুশী, কিন্তু বাবুর মনের ভেতরে কোনও সুখ নেই–

সদানন্দ অবাক হয়ে গেল। বললে–মনে সুখ নেই? কেন?

মহেশ বললে–সে দাদাবাবু অনেক কথা। টাকা থাকলেই কি মানুষের সুখ হয়? আমাদের টাকাকড়ি কিছু নেই, তবু আমরা বাবুর চেয়ে শতগুণে সুখী। আমরা পড়ি আর ঘুমোই। কিন্তু বাবুর দু’চোখে ঘুম নেই—

প্রথম প্রথম অবাক লেগেছিল সদানন্দর। যে-মানুষ সদানন্দর মত অসুখী লোককে বাড়িতে ডেকে এনে নিজের মত আদর-যত্ন করছে তার সুখ-দুঃখের দিকটা তো কখনও সদানন্দ ভাবেনি। নিজের দুঃখটাকেই বড় করে দেখে পৃথিবীর আর সকলকে সুখী মনে করার মধ্যে কেমন আত্মরতির আনন্দ থাকে। সেই আনন্দেই সে এতদিন বিভোর হয়ে ছিল। এবার যেন তার মনের তৃতীয় নয়ন খুলে গেল।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–কাকাবাবুর কিসের দুঃখ সত্যি করে বলো তো?

মহেশ বললে–আপনি তো জানেন না, ওই যে সেদিন দাদাবাবুকে দেখলেন!

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ দেখেছি, কখনও বাড়ি আসে আবার কখনও বাড়ি আসে না–

মহেশ বললে–-হ্যাঁ, তা আপনি যেন কাউকে বলবেন না, সেই দাদাবাবু তো বাবুর নিজের ছেলে নয়–

–সে কী? নিজের ছেলে নয়?

–না। বাবু ওকে পুষ্যি নিয়েছেন—

সদানন্দ অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে। এতদিন এ বাড়িতে এসেছে, অথচ এ-কথাটা তো কখনও কানে আসেনি তার। এতদিনের সমস্ত ঘটনাটা পর্যালোচনা করে করে অনেক ঘটনার অনেক ব্যাখ্যা খুঁজতে চেষ্টা করলে সে। কিন্তু পালিত-পুত্ৰই যদি হয় তো তাতে দুঃখটা কিসের! ছোটবেলা থেকে যদি এমন বাবার কাছেই মানুষ হয়ে থাকে তো তাকে নিয়ে তো সুখী হবারই কথা। আর, তা ছাড়া ছেলেও তো জানে একদিন এই সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে সে নিজেই।

–না, আপনি আমার বাবুর ওপর রাগ করবেন না দাদাবাবু। বড়দাদাবাবু যদি মানুষ হতো তো বাবুর কোনও দুঃখু থাকতো না। কিন্তু বড়দাদাবাবু যে মানুষ নয়। দেখেন না অনেক দিন রাতে বাড়িতেই আসে না বড়দাদাবাবু!

–তা তোমার বাবুর কোনও ছেলেমেয়ে কিছুই হয়নি?

মহেশ বললে– না, ছেলে-মেয়ে কিছু হয়নি বলেই তো বাবুর দুঃখু। আবার যাকে পুষ্যি নিলেন সেও তো কেমন মনের মতো হলো না। তাই আপনার ওপর এত টান পড়ে গেছে। আপনাকে বাবুর খুব পছন্দ হয়েছে দাদাবাবু। আমাকে আড়ালে জিজ্ঞাসা করেন আপনাকে ভালো খেতে দিচ্ছি কিনা। আপনি যা খেতে ভালোবাসেন তা-ই বাজার থেকে আনতে বলেন। সত্যি দাদাবাবু, আপনাকে বাবু কী চোখে যে দেখেছেন তা বলতে পারি নে–

সদানন্দ বললে–আমার কথা ছেড়ে দাও মহেশ, তোমাদের বড়বাবু মনের মতো ছেলে কেন হলো না তাই বলো তো? বাবু তো ভালো করে দেখে শুনেই তবে তাকে নিয়েছিলেন, তবে? বড়দাদাবাবু দোষটা কী করেছে?

মহেশ বললে, ওই যে বললুম, বড়দাদাবাবু রাত্তিরে বাড়িতে থাকে না–

–তা বাড়ি থাকে না সে তো চাকরির জন্যে। পুলিসের চাকরিতে যখন যেখানে ডিউটি পড়ে সেখানে তো যেতেই হবে। বড়দাদাবাবুকে তো চাকরির জন্যই বাইরে বাইরে রাত কাটাতে হয়–

মহেশ গলা নিচু করে এবার বললে–না দাদাবাবু নয়। ও আপনি ভুল শুনেছেন, আসলে বৌদিদিকে পছন্দই হয় না বড়দাদাবাবুর।

সদানন্দ বললে–পছন্দ হয় না কেন? দেখতে খারাপ?

–আজ্ঞে না, বাবু নিজে হাজার-হাজার মেয়ে দেখে তার মধ্যে থেকে বেছে তবে এই বৌদিকে ঘরে এনেছে। খারাপ দেখতে হলে কি বাবু এঁকে ঘরের বউ করতেন? সেজন্যে নয়। বড়দাদাবাবুর যে বাইরে-বাইরে মন। বড়দাদাবাবুর যে বাইরেও একটা সংসার আছে– সেই দিকেই যে বড়দাদাবাবুর মন পড়ে থাকে–

সদানন্দ বললে–সে কে?

–আজ্ঞে তাকে বড়দাদাবাবু বাড়ি ভাড়া করে রেখে দিয়েছে। মাইনে-টাইনে বড়দাদাবাবু যা পায় সব সেখানেই ঢালে, বাবুকে একটা পয়সাও দেয় না। অথচ বড়-দাদাবাবু আগে এমন ছিল না–

সদানন্দ বললে–তা তোমার বাবু কি ছেলের মাইনের টাকা চায়?

মহেশ বললে–আজ্ঞে তা চাইবে কেন? বাবুর কি টাকার অভাব যে বাবু ছেলের মাইনের টাকা নিয়ে সংসার চালাবে? রাণাঘাটে বাবুর অত জমি-জমা পুকুর বাগান, সেই টাকাই কে খায় তার ঠিক নেই। শুধু আম কাঁঠালের বাগানই তো তিনশো বিঘের, তারপরে একটা বিল সেটাও চারশো বিঘের ওপর, সে সব টাকাও খাবার লোক নেই, সে-সব দেখাশোনা করবারও লোক নেই, বড়দাদাবাবুর চাকরি করবার তো দরকারই ছিল না। বাবুর সঙ্গে তো এই নিয়েই বড়দাদাবাবুর মনকষাকষি। বাবুর কথা না শুনে বড়দাদাবাবু ওই চাকরি নিলে, আর তখন থেকেই বড়দাদাবাবুর স্বভাব-চরিত্তির খারাপ হয়ে গেল। তা পুলিসের চাকরিতে মানুষের স্বভাব-চরিত্তির কি ঠিক থাকে? আপনিই বলুন দাদাবাবু? আমার বাবুও তো তাই বলেন। ওই চাকরিতে ঢোকবার আগে তো বড়দাদাবাবুর কোনও গণ্ডগোল ছিল না। লেখাপড়া করতো, তারপর একদিন বিয়ে হলো–তারপর কার পাল্লায় পড়ে যে চাকরি নিয়ে বসলো, সেই তখন থেকেই এই কাণ্ড–। এখন চাকরি করে যা কামায় সব সেই রাক্ষুসীর গভ্যে ঢালে–

মহেশ হয়তো আরো অনেক কিছু বলতো, কিন্তু হঠাৎ দোতলা থেকে সমরজিৎবাবু ডাকতেই সে চলে গেল।

সদানন্দ সেখানে বসে বসে মহেশের কথাগুলোই ভাবতে লাগলো। এক জায়গার অশান্তি থেকে দূরে থাকবার জন্যেই সে পালিয়ে এসেছে, কিন্তু এখানে এই কলকাতায় এসেও সে আর এক অশান্তির মধ্যে জড়িয়ে পড়বে নাকি? এক বন্ধন থেকে আর এক বন্ধনে? রাণাঘাটের জমি-জমা বাগান-পুকুর থেকে টাকা আনবার সময়েই তাহলে তার সঙ্গে সমরজিৎবাবুর দেখা! আর সেই জন্যেই এ বাড়িতে তার এত খাতির! সমরজিৎবাবু কি চান সে এবাড়ির পালিত পুত্র হয়ে জীবন কাটাবে আর তাঁর জমি-জমা বাগান-পুকুর দেখাশোনা করে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে খাবে! তা যদি হতো সে তো নবাবগঞ্জেই থাকতে পারতো। নবাবগঞ্জের জমি-জমা বাগান-পুকুর নিয়ে সে তো দিব্যি দিন কাটাতে পারতো আর আরাম করে চৌধুরী-পরিবারেরও বংশবৃদ্ধি করে যেত।

সদানন্দ ঠিক করলে–না, এখানে থাকা তার আর চলবে না এখানকার এই নির্ঝঞ্ঝাট স্বাধীনতাও তার কাছে দাসত্বেরই সমান। কিন্তু এখান থেকে চলে গিয়েই বা সে কী করবে? কোথায়ই বা যাবে? যেখানে যার কাছেই যাবে সেখানেই তো তারা তার কাছ থেকে মূল্য চাইবে। মুল্য না দিলে সংসারে কেউই কিছু দেয় না! পৃথিবীতে বাঁচতে গেলেই কি তবে ট্যাক্স দিতে হবে? আত্মসম্মানের ট্যাক্স, নয়তো পরাধীনতার ট্যাক্স, আর নয়তো স্বার্থত্যাগের ট্যাক্স!

মহেশের কাছে কথাগুলো শুনে আর বাড়ির ভেতরে থাকতে পারলে না সে। রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু রাস্তাতেই কি শান্তি আছে! মানুষগুলোকে দেখে দেখে মনে হলো সবাই যেন ছুটছে। কোথায় ছুটছে সবাই? বউবাজারের মোড়ের কাছে আসতেই একজন লোক এসে তাকে জিজ্ঞেস করলে–দাদা, আপনার কাছে দেশলাই আছে?

দেশলাই!

লোকটা যেন কল্পনা করে নিয়েছে সদানন্দ সিগারেট খায়।

বললে–আপনি সিগ্রেট খান না? ঠিক আছে–

বলে দেশলাই-এর খোঁজে বোধহয় অন্য একজনের সন্ধানে চলে গেল। নেশার খোরাকে টান পড়েছে লোকটার। অথচ দেশলাই কিনবে না। কত পান-বিড়ি-দেশলাই-এর দোকান রয়েছে। সেখানে পয়সা খরচ করে দেশলাই কিনলেই পারো। আর দেশলাই কিনতেই যদি এত পয়সার টানাটানি তাহলে নেশা করা কেন!

বাড়ির কাছে আসতেই একটা ভিখিরি এসে দাঁড়ালো–একটা পয়সা দাও বাবু–

সদানন্দ তার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলে। লোকটার হাত-পা খসে গেছে। হাতের পায়ের আঙুলগুলো নেই। সদানন্দ পকেট থেকে পয়সা বার করে দিতে গেল। কিন্তু পকেটে হাত দিয়েই চমকে উঠলো। টাকা-পয়সাগুলো কোথায় গেল? একটা ব্যাগের মধ্যে রেখেছিল টাকা-পয়সা। সমরজিৎবাবু তার হাত-খরচের জন্যে দিয়েছিলেন। জামার কোনও পকেটেই নেই। অথচ বেরোবার সময় মনে আছে বুকপকেটে ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়েছিল সে।

লোকটা তখনও হাতটা বাড়িয়ে আছে।

সদানন্দ বললে–-পয়সা নেই আমার কাছে–

বলে আবার বাড়ির রাস্তা ধরলো। কিন্তু মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে আসতেই মহেশের সঙ্গে দেখা। মহেশ বললে–বাবু আপনাকে ডাকছিলেন দাদাবাবু–

–আমাকে?

–হ্যাঁ, বলছিলেন নতুন লোক, কোথায় ঘুরে বেড়ায় একলা একলা! এখন দিনকাল খারাপ, সন্ধ্যের সময় তুই বেরোতে দিলি কেন একলা? আমার ওপরে বকুনি।

সদানন্দ সোজা ওপরে চলে গেল। সমরজিৎবাবু সেই রোজকার মত নিজের বিছানার ওপর বসে ছিলেন। বললেন,–সন্ধ্যেবেলা কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আমি মহেশের কাছে শুনে ভাবনায় পড়েছিলুম। এ কলকাতা শহর, তুমি নতুন মানুষ এখানে, নতুন মানুষ দেখলেই এখানকার গুণ্ডাবদমায়েসরা চিনতে পারে। আর কখনও সন্ধ্যেবেলা বেরিও না, বুঝলে? যুদ্ধের পর এ-জায়গা আরো খারাপ হয়ে গেছে–

সদানন্দ উত্তরে কিছু বললে না।

–তোমার কাছে হাত খরচের টাকা আছে তো?

সদানন্দ বললে–হাত খরচের টাকা আমার আর চাই না–

–কেন? তোমাকে যে দশটা টাকা দিয়েছিলুম সেটা খরচ হয়ে গেছে?

–না খরচ হয়ে যায়নি, চুরি হয়ে গেছে।

সনরজিৎবাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন–চুরি হয়ে গেছে মানে? কে চুরি করলে? আমার বাড়ির চাকর-বাকর কেউ?

–না, রাস্তার একটা লোক। আমার কাছে দেশলাই চাইবার নাম করে এসে কখন ব্যাগটা তুলে নিয়েছে টের পাইনি বলে সমস্ত ঘটনাটা বলে গেল।

সমরজিৎবাবু বললেন–ওই জন্যেই তো আমি তোমাকে বলি তুমি গ্রামের ছেলে, তোমাকে সবাই ঠকিয়ে নিতে পারে। তা যাকগে, এই নাও, এই টাকা কটা রাখো তোমার কাছে। এবার খুব সাবধানে রেখো। টাকাকে অত তাচ্ছিল্য কোরো না, বুঝলে? সংসারে টাকা খুব খারাপ জিনিস নয়। টাকা ব্যবহার করতে সবাই জানে না বলেই টাকার এত বদনাম–

টাকা ক’টা নিয়ে সদানন্দ আবার তার নিজের ঘরে চলে এল।

কিন্তু অনেক রাত্রে হঠাৎ একটা গোলমালের শব্দে সদানন্দের ঘুম ভেঙে গেছে। মনে হলো দোতলায় যেন তুমুল হট্টগোল চলছে। সমরজিৎবাবুর চড়া গলা শোনা যাচ্ছিল একদিকে আর অন্যদিকে একজন পুরুষের গলা।

সদানন্দ ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো। গোলমালটা ঠিক মাথার ওপর হচ্ছিল।

বাইরে বারান্দায় আসতেই দেখলে মহেশও দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির নিচে।

সদানন্দ জিজ্ঞেস করলে–ওপরে কীসের গোলমাল মহেশ?

মহেশ বললে–বড়দাদাবাবু এসেছে–

সদানন্দ বললে–বড়দাদাবাবু এসেছে তো কাকাবাবু এত চেঁচাচ্ছেন কেন? মনে হচ্ছে যেন খুব রাগ করেছেন?

–বড়দাদাবাবু আজকে মদ খেয়েছে যে। এসে বউদিকে খুব মারধোর করেছে

–সে কী? কেন, মারধোর করেছে কেন?

মহেশ বললে–মদ খেলে কী মানুষের জ্ঞান-গম্যি কিছু থাকে! বড়দাদাবাবু যে এক-একদিন বেশি খেয়ে ফেলে!

ওদিকে সমরজিৎবাবু তখন চিৎকার করছেন–বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে, বেরিয়ে যাও–আর যদি কখনও মদ খেয়ে বাড়ি ঢোক তো তোমাকে আমি বাড়ি ঢুকতে দেব না–

ওদিক থেকে ছেলেও চিৎকার করছে–হ্যাঁ ঢুকবো, আলবাৎ ঢুকবো—

সমরজিৎবাবু এবার ডাকলেন-মহেশ, মহেশ, এদিকে আয় তো–

মহেশ সব শুনছিল সদানন্দের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সে বোধহয় জানতো এবার তার ডাক পড়বে।

সদানন্দ বললে–ওই তোমার ডাক পড়েছে মহেশ, যাও–

মহেশ বললে–দেখেছেন, আমার কপালের গেরো! এখন বড়দাদাবাবুকে বাড়ি থেকে ধরাধরি করে বার করে দিতে হবে।

–বাড়ি থেকে বার করে দেবে মানে?

এ-কথার উত্তর না দিয়ে মহেশ সোজা ওপরে উঠে গেল। তাকে দেখে সমরজিৎবাবু বললেন–যা, খোকাকে বাড়ির বাইরে বার করে দিয়ে আয়। আর যেন কখখনো ভেতরে না ঢোকে। যত সব নচ্ছার কুলাঙ্গার হয়েছে, এমন ছেলের আমি মুখদর্শন করতে চাই নে– যা —

কিন্তু মাতালকে জব্দ করা কি অত সহজ! মহেশ কাছে যেতেই বড়দাদাবাবু তার দিকে তেড়ে এসেছে। বললে–আয়, আমার দিকে এগিয়ে আয়, দেখি তোরই একদিন কি আমার একদিন!

বলে হঠাৎ নিজের দরজায় দুম-দুম্ করে লাথি মারতে লাগলো। দরজা খোল, দরজা খোল।

সমরজিৎবাবু বলে উঠলেন–দরজা খুলো না বউমা, খবরদার দরজা খুলো না, দেখি ও কী করতে পারে?

বউমা বোধহয় ভয় পেয়ে তার আগেই ঘরের ভেতর থেকে দরজায় খিল দিয়ে দিয়েছিল। তখন সে আরো ভয় পেয়ে গিয়েছে। শ্বশুর বললেও হয়ত দরজা খুলতো না।

সমরজিৎবাবুর ছেলে তখন রাগে একবার দরজায় লাথি মারে আর একবার মহেশকে মারতে আসে!

এসব ঘটনা নতুন নয় মহেশের কাছে। মহেশের যেমন নতুন নয়, এ বাড়ির অন্য কারো কাছেও আবার তেমনি নতুন নয়। মাঝে-মাঝে এরকম ঘটনা যে ঘটে তা মহেশের কথাতেই বোঝা গিয়েছিল। শুধু সদানন্দ নতুন এ বাড়িতে এসেছে বলে তার কাছে সবটাই নতুন লাগছিল।

কিন্তু বড়দাদাবাবুর গায়ে যত জোরই থাক, মদ খেয়ে নেশা হবার পর মানুষ বোধ হয় দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন সেই দুর্বল মানুষকে নিয়ে বিশেষ সমস্যা থাকে না। মহেশ তার বড়দাদাবাবুকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে এল। তারপর সেই মাঝরাত্রে বাড়ির বাইরে রেখে দিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে দিলে।

সদানন্দ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দৃশ্যটা দেখেছিল। সদর দরজা বন্ধ করতেই সদানন্দ বললে–মহেশ, তোমার বড়দাদাবাবু কি বাইরেই সারা রাত পড়ে থাকবে নাকি?

পেছন থেকে সমরজিৎবাবুর গলা শোনা গেল। তিনি বললেন–হ্যাঁ, ও বাইরেই পড়ে থাকুক আর জাহান্নমেই যাক তোমার তা দেখবার দরকার নেই। তুমি ও নিয়ে মাথা ঘামিও না—

সদানন্দ বুঝতে পারেনি সমরজিৎবাবু কখন সিঁড়ির নিচেয় এসে দাঁড়িয়েছেন। সমরজিৎবাবুর মুখ-চোখের চেহারা যেন তখন অন্য রকম হয়ে গেছে।

সদানন্দ আর কথা না বলে নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। সমরজিৎবাবু তাকে ডাকলেন।

বললেন—শোন–

সদানন্দ কাছে যেতেই বললেন–তুমি তো চাকরি চাইছিলে আমার কাছে, চাইছিলে না? আমার খোকাকেও আমি চাকরি করতে দিতে চাইনি। নিজে থেকেই ওই চাকরি যোগাড় করে নিয়েছে। যোগাড় করে নিয়ে এখন এই কাণ্ড করছে। অথচ ওর চাকরি করার কোনও দরকার ছিল না। আমার যা সম্পত্তি আছে তা দেখাশোনা করলেই ওর চলে যেত। কিন্তু ক্ষমতা। ক্ষমতার লোভই ওর সর্বনাশ করে দিয়েছে। এর পরও তুমি চাও আমি এই ছেলেকে বলে তোমার চাকরি করে দিই? বলো? জবাব দাও?

সদানন্দ কোনও জবাব দিলে না। জবাব দেবার অবশ্য তার অনেক কিছুই ছিল। অবশ্য জবাব দিতে পারতো যে চাকরি করলেই কি আর আপনার ছেলের মত সবাই মাতাল হবে। লক্ষ-লক্ষ লোকই তো চাকরি করছে, কই, সকলেই কি আপনার ছেলের মত মদ খেয়ে মাতলামি করছে?

কিন্তু সব জিনিসেরই একটা সময় আছে। তখন সেই রাত দু’টোয় তো আর এ-কথা বলবার সময় নয়। তাই-কিছুই বললে না সদানন্দ। আস্তে আস্তে নিজের ঘরের ভেতরে চলে এল। তারপর আলো নিভিয়ে বিছানায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু মন থেকে ঘটনাটা কিছুতেই দূর করতে পারলে না। সমরজিৎবাবুর কথাই ঘুরে-ফিরে কেবল মনে পড়তে লাগলো। ভগবান সমরজিৎবাবুকে দিয়েছেন যেমন অনেক, আবার অনেক কিছু তেমনি কেড়েও নিয়েছেন। এমন করে যদি কেড়েই নেবেন তাহলে এমন করে তাঁকে দেওয়াই বা কেন? আর, একটা কথাও মনে পড়তে লাগলো। যেদিন সদানন্দ প্রথম এখানে এসেছিল সেদিন তার মনে হয়েছিল এরা কত সুখী! মনে হয়েছিল অন্তত এদের সংসারে কোনও ফাঁকি নেই। কিন্তু এই-ই কি এদের সুখের নমুনা? তাহলে পৃথিবীতে কোনও সংসারেই কি সুখ নেই?

আর মনে পড়তে লাগল আর একজনের কথা। এতদিন এ বাড়িতে সে এসেছে, কিন্তু একদিনও তাকে দেখেনি সদানন্দ। শুধু মহেশের কাছে শুনেছে তার কথা। সমরজিৎবাবু হাজার-হাজার মেয়ের মধ্যে থেকে বেছে তাকে এ বাড়ির ছেলের বউ করেছে। তার রূপ দিয়ে ছেলেকে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন এ-রকম হলো! তাকে দেখা দূরে থাক্ তার গলার আওয়াজটুকু পর্যন্ত শুনতে পায়নি সে। সে যে আছে এবাড়িতে তারও তো কোনও প্রমাণ পায়নি সদানন্দ।

তবে কি এও আর একজন নয়নতারা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *