কোদণ্ড মুথহানা (জীবনী)

কোদণ্ড মুথহানা (জীবনী)

দ্বিতীয়বার বিলেতে যাওয়ার সময় জাহাজে চড়ে যে অনুভূতিটা হয়, তার সঙ্গে দোজবরের মনের অবস্থা তুলনা করা যেতে পারে। ঔৎসুক্য, আশঙ্কা সব কিছুরই তখন কমতি ঘটে, বাড়িতে থাকে শুদ্ধমাত্ৰ হাঁশিয়ারি, অর্থাৎ প্রথমবারে যে-সব ভুল করেছি, আবার যেন সেগুলো নতুন করে না করতে হয়। প্রথমবারের উৎসাহের চোটে বউকে কুমার জীবনের দু’একটা রোমান্টিক কাহিনী বলে ফেলে যে মারাত্মক ভুল করেছিলুম, এবারে আর সেটি করব না। প্রথমবার বিলেতে যাওয়ার সময় প্রকাশ করে ফেলেছিলুম যে পকেট লাইট-ওয়েট চেম্পিয়ান, এবারে আর সে পাঁচালি না, এবার ব্লাফ দিয়ে স্টুয়ার্ড, কেবিনবয় সঙ্কলের কাছ থেকে পুরোমাত্রায় খাতির যত্ন উশুল করে মামুলী টিপ দিয়েই মোকামে পৌঁছোব।

তারই ব্যবস্থা করতে করতে থানার ঘণ্টা বেজে গেল। প্রথমবার বিলেতে যাবার সময় ঘণ্টা শুনে জেলের কয়েদীর মত হস্তদন্ত হয়ে ছুটি মেরেছিলুম খানা-কামরার দিকে, এবারে গেলুম। ধীরে-সুস্থে, গজ-মস্থরে। এবারে ভয় নেই, ভরসাও নেই।

ভেবেছিলুম, গিয়ে দেখব, সায়েব-মেমের হৈ-হাল্লার এক পাশে নেটিভূরা মাথা গুজে ছুরি-কঁটার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে এমনি ব্যস্ত যে একে অন্যের মুখের দিকে তাকাবার ফুরসৎ পাচ্ছেন না, কিন্তু যা দেখলুম, তাতে একেবারে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়।

উত্তম বিলিতি কাটের ডবলা-ব্রেস্ট, কোট, মানানসই শর্টকলার, শিষ্ট-সংযত টাইপরা এক শ্যামবর্ণের দোহারা গঠন দীর্ঘকৃতি ভদ্রলোক তুর্কী টুপির ট্যাসেল দুলিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে গল্প বলে আসার জমিয়ে তুলেছেন আর আটজন ভারতীয় অন্নগেলা বন্ধ করে গোগ্রাসে তার গল্প গিলছে। আমি টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক অতিশয় সপ্রতিভভাবে গল্প বলা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। ন্যাপকিনে হাত মুছতে মুছতে মৃদু হেসে বললেন, ‘এই যে আসুন, ডাক্তার সাহেব, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলুম। টেবিলের মাথাটা আপনার জন্যেই রেখেছি, আর তো সব ছেলে-ছোকরার দল! এদের সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দিই।’ বলে বেশ গট গট করে বোস, চাটুজ্যে, শুক্ল, মিশ্র, চৌধুরী ইত্যাদি আটজন ভারতীয়ের নাম অবলীলাক্রমে বলে যেতে লাগলেন।

লোকটি গুণী বটে! দশ মিনিট হল যাবার ঘণ্টা পড়েছে। এরি মধ্যে আটজন লোকের সঙ্গে শুধু যে আলাপই করে নিয়েছে তাই নয়, সক্কলের নাম বেশ স্পষ্ট মনেও রেখেছে।

সব শেষে বললেন, ‘আমার নাম মুথহানা।’

এ আবার কোন দিশী নাম রে বাবা। পরনে সুট, মাথায় তুর্কীর টুপি! গড়গড় করে ভুল-শুদ্ধে-মেশানো ইংরিজি বলছে। মিশরের লোক? উঁহু! সিংহলী? কি জানে। মুসলমান তো নিশ্চয়ই-তুর্কী টুপি যখন রয়েছে।

গল্প শোনাচ্ছি।’ বলে গোড়ার দিকটা যে আমি শুনতে পাই নি, তার জন্যে যেন মাপ চাওয়ার মৃদু হাসি হেসে বললেন, ‘আশ্চর্য লোক রাসূল পাশা। প্রথম তো মিশর থেকে তাড়ালেন হসীস। তারপর এসে জুটল ককেইন। সে যে কি অদ্ভুত কায়দায় মিশরে ঢুকতো, তার সন্ধান না পেয়ে সি.আই.ডি. যখন হার মানলো, তখন রাসল পাশাই কায়দোটা বের করলেন। কি করে যে লক্ষ্য করলেন, ভিয়েনা থেকে টেবিলের পায়ার ভিতরে করে গুপ্তি ককেইন আসছে, সেটা তাকে না জিজ্ঞেস করে সি আই ডি পর্যন্ত ঠাহর করতে পারে নি। রাস্‌ল্‌ পাশাই বুঝিয়ে বললেন, ‘ভিয়েনার চেয়ে কাইরোর কাঠের আসবাব অনেক বেশি মিহিন, সস্তাও বটে। তার থেকেই বুঝলুম, নিশ্চয়ই কোনরকম শয়তানির খেল রয়েছে। একটা টেবিলের পায়া ভাঙতেই ককেইন বেরিয়ে পড়ল।’ বুঝুন, লোকটার কড়া চোখের তেজ। কাস্টম অফিসে কি মাল আসছে যাচ্ছে, তাতে যেন এক্সরে হয়ে ঢুকছে বেরুচ্ছে।

তারপর গল্প ক্ষান্ত দিয়ে নিপুণ হাতে দুখানি ফর্ক দিয়ে মাছের কঁটা বাছতে লাগলেন। ভদ্রলোকের খাওয়ার তরিবৎটা দেখবার মত হেকমৎ-যেন পাকা সার্জনের অপারেশন। এবং তার চেয়েও তারিফ করবার জিনিস তার গল্প করা এবং সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে যাওয়ার মেকদার জ্ঞান। খাওয়ার সময় যারা গল্প বলতে ভালোবাসে, তাদের বেশির ভাগই খাওয়াটা অবহেলা করে শেষের দিকে হাড়হড় করে সব কিছু গিলে ফেলে। এ ভদ্রলোক দুটোই একসঙ্গে চালালেন ধীরে-সুস্থে, তাড়াহুড়ো না করে। আমি বললুম, ‘আপনি দেখছি মিশরের অনেক কথাই জানেন।’ তাঁর মুখে তখন মাছ। কথা না বলে আমার দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। ভাবখানা এই ‘একটু দাঁড়ান, গ্রাসটা গিলি, তারপর বলব।’ বললেন, ‘জানিব না? আমি আঠার বছর কাইরোতে কাটালুম যে।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মিশর ছাড়লেন কবে?’

তিনি বললেন, ‘ছাড়বো কেন, এখনও তো সেখানেই আছি।’

আমি যেন হাতে স্বৰ্গ পেলুম। বললুম, ‘বিলাত থেকে ফেরার মুখে কিছুদিন মিশরে কাটানো আমার বাসনা। কাইরোতেই থাকব ভাবছি।’

প্লেটের মাছের দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘হঁ।’

আমি তো অবাক! এরকম অবস্থায় দেশের লোক অন্ততপক্ষে বলে, আসবার খবরটা দেবেন, সহৃদয় লোক নানাপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ ভদ্রলোকের কথাবার্তা চালচলন দেখে তো মনে হয়েছিল, ইনি কাইরোর মত পাণ্ডববর্জিত দেশে স্বদেশবাসীকে লুফে নিন। আর নাইনিন, গতানুগতিক ভদ্রতার সম্বর্ধনাটা অন্তত করবেন। তাই তার দরদহীন ইটার ভেজাকম্বল আমার সর্বাঙ্গে যেন কাঁপন লাগিয়ে দিল। আর পাঁচজনও যে একটু আশ্চর্য হয়েছেন স্পষ্ট বুঝতে পারলুম। তারপর গালগল্প তেমন করে আর জমলো না।

খাওয়ার পর উপরে এসে ডেকচেয়ারে শুয়ে বিরস বিবৰ্ণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় সেই ভদ্রলোক আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার মুখ তিনি ঈষৎ অবহেলার ভাব লক্ষ্য করলেন। কিনা জানি নে, তবে বেশ সপ্রতিভভাবেই আমার পাশের ডেকচেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘আপনি আমায় মাপ করুন।’ আমি বললুম, ‘সে কি কথা, কি হয়েছে?’ বললেন, ‘আমি ভারতবাসী, তাই ভারতীয়দের প্রতি আমার একটু অভিমান আছে। এই আঠার বৎসর ধরে আমি মিশর ভারতবর্ষ করে আসছি। প্রতিবারই দু’চারজন ভারতীয় উৎসাহের সঙ্গে কাইরো আসবে বলে প্রতিজ্ঞা করে-আজ পর্যন্ত কেউ আসে নি। আপনি আসবেন কিনা জানি নে; তবে স্ট্যাটিসটিক্স যদি পাকাপাকি বিজ্ঞান হয়, না আসার সম্ভাবনাই বেশি। তাই আমার অভিমান, এখন কেউ কাইরো যাবার প্রস্তাব করলে আমি গা করি নে।’

তারপর তিনি হঠাৎ খাড়া হয়ে বসলেন। বেশ একটু গরম সুরে বললেন, ‘আশ্চর্য হই বার বার স্বদেশবাসী ছাত্রদের দেখে। বিলেতে ডিগ্ৰী পাওয়া মাত্রই ছুটি দেয় দেশের দিকে, সেই ক্যাশ সার্টিফিকেট ভাঙাবার জন্যে। কতবার কত ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছি, মিশরীয় সভ্যতা ভাল করে দেখবার জিনিস, ওর থেকে অনেক কিছু শেখাবার মত আছে, এমন কি নেমন্তন্ন করেছি। আমার বাড়িতে ওঠবার জন্যে কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! কি হবে এদের দিয়ে বুঝতে পারি নে।’

আমি চুপ করে শুনে গেলুম। কি আর বলব? তারপর বললেন, ‘আমি নিজে লেখাপড়া করবার সুযোগ-সুবিধে পাই নি। বাবা অল্প বয়সে মারা যান বলে। তাই-’

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘সে কি কথা? আপনি তো চমৎকার ইংরিজি বলছেন।’

মুথহানা মুচকি হেসে বললেন, ইংরেজ চাষা আমার চেয়ে ভাল ইংরিজি বলে। তাই বলে সেও শিক্ষিত নাকি? আপনিও এই কথাটা বললেন? আপনি না হের ডাকটর!’

এক মাথা লজ্জা পেলুম।

বললেন, ‘তবু আপনার নেমন্তন্ন রইল। ইউরোপ থেকে ফেরবার মুখে আসবেন তবে আলেকজ্যানড্রিয়ায় নেমে আমাকে তার করবেন। আমার টেলিগ্ৰাকী ঠিকানা ‘মোহিনী টি’, আমার চায়ের ব্যবসা।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘মিশরের লোক কি চা খায়?’

বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘আগে খেত না। এখন তার বাপ খায়। আমি খাইয়ে ছেড়েছি। আপনি কিন্তু ঠিকই জিজ্ঞেস করেছেন—আগে তারা শুধু কফি খেত।’

আমি আরও আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘আপনি খাইয়ে ছেড়েছেন, তার মানে?’

খুব একগাল হেসে নিয়ে বললেন, ‘তাহলে আপনার সামনে একটু উঁচু ঘোড়া চড়ে নিই। আপনাদের তো লেখাপড়ার হাই-জম্প লঙ-জম্প। আমার ব্যবসায়ে-বলব সব?

আমি বললুম, ‘ভারতের লোক মিশরে চা বেচছে, একথা শুনে কার না আনন্দ হয়? আপনি ভাল করে সব কিছু বলুন।’

মুথহানা বললেন, ‘তবে শুনুন। আমার বাড়ি কুর্গে। বাবা অল্প বয়সে মারা যান, আগেই বলেছি। তাই ১৯১৬ সনে ঢুকে পড়লাম। কুর্গ পল্টনে, জানেন তো, কুর্গের লোক আর সব ভারতীয়ের চেয়ে আলাদা। রাইফেলাটা, লড়াইটার নাম শুনলে ভয় পায় না। আমাদের পল্টনের সঙ্গে সঙ্গে আমি গেলুম আলেকজ্যানড্রিয়া। তারপর তাস্তা দামানহুরু জগজিগ করে করে শেষটায় কাইরো। আড়াই বছর ছিলুম কাইরোতে। তারপর লড়াই থামাল। মহাত্মা গাঁধী শুরু করেছেন অসহযোগ আন্দোলন। ইংরেজের উপর আমারও মন গিয়েছে বিগড়ে-বিশেষ করে লড়াইয়ের সময় কালো-ধলায় তফাৎ করার বাঁদরামি দেখে দেখে। ভাবলুম, কি হবে দেশে ফিরে গিয়ে? তার চেয়ে এখানে যদি জগালুল পাশার দলে ভিড়ে যেতে পারি, তবে ভারতবর্ষের আন্দোলনের সঙ্গে এদের স্বাধীনতা আন্দোলন মেলাবার সুবিধে হলে হয়েও যেতে পারে।

‘পড়ে রইলুম কাইরোয়। পল্টন থেকে খালাস পাওয়ার সময় যা-কিছু টাকাকড়ি পেয়েছিলুম, তাই দিয়ে বঁধিলুম ছোট একটি বাসা-অৰ্থাৎ ফ্ল্যাট। জগলুলের দলের সঙ্গে যোগাযোগও হল, কিন্তু মুশকিলে পড়লুম। অন্নবস্ত্রের সমস্যা নিয়ে। ওঁরা অবশ্যি আমার এসব ভাবনা পার্টির কাধে তুলে নিতে খুশি হয়েই রাজী হতেন, কিন্তু হাজার হোক। ওঁরা বিদেশী, ওঁদের টাকা আমি নেব কেন? তাই ফাঁদতে হল ব্যবসা। খুললুম চায়ের দোকান। পার্টির মেম্বাররাই হলেন প্রথম খদ্দের। ওঁরা আমার ফ্ল্যাটে চা খেয়ে খেয়ে চায়ের তত্ত্ব সমঝে গিয়েছিলেন।

‘তখন লাগল আমাতে কফিতে লড়াই। আর সে লড়াই এমনি মারাত্মক হয়ে দাঁড়ালো যে বাধ্য হয়ে আমাকে পলিটিক্স ছাড়তে হল। নেংটি পরে অসহযোগ করতে পারে গাঁধী, আমি পারি নে। অবশ্য লড়াইয়ের লুট তখন কিছু কিছু আসতে আরম্ভ করেছে—অর্থাৎ দু’পয়সা কামাতে শুরু করেছি। পার্টিমেম্বারদের চাটা-আসটা ফ্রি খাওয়াই, তাইতেই তারা খুশি। টাকা-কড়িও মাঝে মাঝে-কিন্তু সেকথা যাক।’

আমি দুটো শরবতের অর্ডার দিলুম। মুথহানা আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘আপনি এখনো কামাতে শুরু করেন নি-আমি কারবারী, বিলটা আমিই সই করি।’

আমি কঁচুমাচু হয়ে বললুম, ‘সামান্য দু’পয়সা—।’

হেসে বললেন, ইকুসেকট্ৰলি! বেশি হলে দিতুম না।’

আমি শুধালুম, ‘আপনার সঙ্গে কফির লড়াইটা কতদিন চলেছিল?’

‘বহু বৎসর। এখনো চলছে। কিন্তু পয়লা রোদে মার খেয়েই বুঝতে পারলুম, মাত্র একখানা চায়ের দোকান সমস্ত দেশের কফির সঙ্গে কখনই লড়তে পারবে না। তাই আরম্ভ করলুম চায়ের পাতা বিক্রি। কিন্তু ব্রুকবন্ড লিপটন বিক্রি করে আমার লাভ হয় কম, আর যে ইংরাজকে দেখলে আমার ব্ৰহ্মরন্ধ দিয়ে ধুঁয়ো বেরোয়, তার হয়ে যায় প’বারো। কাজেই আনাতে হল চায়ের পাতা আসাম থেকে, দাৰ্জিলিং থেকে, সিংহল থেকে। কিন্তু ব্লেণ্ডিঙের জানি নে কিছুই, চায়ের স্বাদও ভাল করে বুঝতে পারি নে-ছেলেবেলা থেকে খেয়েছি কফি, কারণ কুর্গের লোক মিশরীদের মতোই কফি খায়। তখন জিহ্বােটাকে স্বাদকাতর করবার জন্য বাধ্য হয়ে ছাড়তে হল সিগার, খাবারদাবার থেকে বর্জন করতে হল। লঙ্কা আর সর্বপ্রকারের গরম মসলা।’

আমি বললুম, ‘এর চেয়ে অল্প কৃচ্ছসাধনে তো মিশরের রাজকন্যে পাওয়া যেত!’

‘তা যেত। কিন্তু আমি তখনও কফির ড্রাগের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছি। আরেকটা কথা ভুলবেন না। মিশরীয়রা যদি ভারতের কফি খেত, তাহলে আমি ভারতীয় চা’কে ভারতীয় কফির পেছনে লেলিয়ে দিতুম না। ভায়ে ভায়ে লড়াই আমি আদপেই পছন্দ করি নে। যাক সেকথা। আমি দেশ থেকে হরেক রকম চা আনিয়ে ব্লেন্ড করে ব্র্যান্ড ছাড়লুম, তারই নাম দিলুম ‘মোহিনী টি’, মোহিনী আমার মায়ের নাম।’

বলে যেন বড় লজ্জা পেলেন। আমি তো বুঝলুম না। এতে লজ্জার কী আছে। কফির সঙ্গে এক লড়নেওয়ালা, কঠোর কৃচ্ছসাধনের ঘড়েল-ব্যবসায়ী মায়াদরাদহীন কারবারের মাঝখানে যে মায়ের কথা স্মরণ রেখেছে, এ যেন মিশরীয় মরুভূমির মাঝখানে সুধাশ্যামলিল মরূদ্যান। কিন্তু আমাকে কোনও কথা বলতে না দিয়েই তিনি যেন লজ্জা ঢাকবার জন্যেই উঠে দাঁড়ালেন। ‘আরেক দিন হবে’ এরকম ধারা কি যেন খানিকটে বলে আস্তে আস্তে আপন কেবিনের দিকে রওয়ানা হলেন।

আমার তখন খেয়াল হল মোহিনী নামটার দিকে। মুসলমান মেয়ের নাম মোহিনী হল কি করে? আর হবেই না বা কেন? বাংলা দেশে যদি ‘চাঁদের মা’ ‘সুরুযের মা’ হতে পারে, কুর্গের মেয়ের ‘মোহিনী’ হতে দোষ কী?

***

আস্তে আস্তে মুথহানা সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানতে পারলুম। কিন্তু সব চেয়ে বেশি দুঃখ হল একদিন যখন শুনলুম, কফিকে খানিকটে হার মানিয়ে তিনি যখন মোহিনীকে চালু করতে সক্ষম হয়েছেন, তখন বাজারে এসে জুটল লিপটন আর ব্রুকবল্ড, তার তাঁর পাকা ধানে মই দিলে না বটে, কিন্তু ধানের প্রবেশ খানিকটা বড় ভাগ তুলে নিয়ে খেতে লাগল। মুথহানা বললেন, ‘আমি হার মানি নি বটে, কিন্তু এদের সঙ্গে লড়বার মত পুঁজি আমার গাঁটে নেই। ভারতবর্ষের দু’একজন চায়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করে দেখলুম, তারা আমার লড়াইটাকে বুনো মোষ তাড়া করার পর্যায়ে ফেলে দিয়েছেন-নাইলের জলে আপন রেস্ত ডোবাতে চান না।

অথচ ব্যক্তিগতভাবে কোনও ইংরেজের সঙ্গে তার কোনও দুশমনি নেই। জাহাজ ভর্তি ইংরেজের প্রায় সব কটাই দেখি তাঁর সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা কয়। এ-লাইনের সব কটা জাহাজ তিনি ভাল করে চেনেন বলে কি ভারতীয় কি ইংরেজ সকলেরই ছোটখাটো সুখসুবিধা অনায়াসে করে দিতে পারেন। ভদ্রলোক যেন প্যাসেঞ্জার আর জাহাজ-কতাঁদের মাঝখানে বেসরকারি লিয়েজোঁ অফিসার।

কিন্তু তার আসল কেরামতি স্বপ্রকাশ হল আদন বন্দরে এসে।

আদন বন্দরে কোনও প্রকারের শুষ্ক নেই বলে আদনের আরব ব্যবসায়ীরা দুনিয়ার হরেক রকম জিনিস জাহাজে বেচাতে আসে। আর মেমসাহেবরাও এ তত্ত্বটা জানেন বলে হন্যে হয়ে থাকেন দেশের পাঁচজনের জন্য আদান বন্দরে সস্তায় সওগাত কিনবেন বলে।

ডেক-চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপ করে দরকষাকষি দেখছিলুম–আর সব ভারতীয়েরা আদন দেখতে গেছেন, প্রথমবারে আমিও গিয়েছিলুম—এমন সময় হেলেদুলে মুথহানা এসে উপস্থিত। আর যায় কোথায়? সব মেম একসঙ্গে চেচিয়ে বলল, আসুন, মিস্টার মুথহান। এই আরবদের হাত থেকে আমাদের বাঁচান।’

মুথহানা আশ্চর্য হবার ভান করে বললেন, ‘সে কি মেদাম, ইংরেজ হল ব্যবসায়ীর জাত। তাকে ঠকাচ্ছে আরব? আর ব্যবসায়ে কানা আমি ভারতীয় বঁচাবো সেই ইংরেজকে? ড্রাগনকে বাঁচাবো ডোমসেলের হাত থেকে?’

তারপর ছোটালেন আরবী ভাষার তুবড়ি। সঙ্গে সঙ্গে কখনও ব্যঙ্গের হাসি, কখনও ঠাট্টার অট্টহাস্য, কখনও অপমানিত অভিমানের জলদ গৰ্জন, কখনও সর্বস্ব লুষ্ঠিত হওয়ার ভূয়ে দুর্বলের তীক্ষু আৰ্তরব, কখনও রুদ্রের দক্ষিণ মুখের প্রসন্ন কল্যাণ অভয়বাণী, সর্বশেষে দু’চার পয়সা নিয়ে ছেলেছোকরার মত কাড়াকড়ি। আমি গোটাপাঁচেক স্ন্যাপশট্‌ নিলুম।

কিন্তু আরবরা বেহদ্দ খুব! হাঁ! লোকটা দরদস্তুর করতে জানে বটে। এর কাছে ঠিকেও সুখ। তার উপর মুথহানা কপচাচ্ছেন মিশরের আরবী-অতি খানদানী, তার সর্বশরীরে নীল নদের মত নীল রক্ত, আদনের আরবী তার সামনে সুকুমার রায়ের—

‘কানের কাছে নানান্‌ সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে।’

দরদস্তুর, কারবার-বেসাতি শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি মুগ্ধ হয়ে বললুম, ‘কি চমৎকার আরবী বলতে পারেন আপনি!’

মুথহানা বললেন, ‘আবার! মিশরের যে-কোনোও গাড়োয়ান আমার চেয়ে ভাল আরবী বলতে পারে এবং গাড়োয়ানের মতই আমি না পারি। আরবী লিখতে, না পারি পড়তে।

আমি বললুম, ‘খানিকটে নিশ্চয়ই পড়তে পারেন। মধ্যবিত্ত ঘরের সব মুসলমানই তো ছেলেবেলায় কুরান পড়তে শেখে।’ মুথহানা বললেন, ‘তুর্কী টুপি দেখে আপনিও আমাকে মুসলমান ঠাউরে নিয়েছেন, কিন্তু আমি তো মুসলমান নাই!’ তারপর একটুখানি ভেবে নিয়ে বললেন, ‘হিন্দুই বা বলি কি প্রকারে? হিন্দুধর্মের কি-ই বা জানি, কি-ই বা মানি!’

তারপর বললেন, ‘এবারে যখন মাকে দেখতে গেলুম কুর্গে, তখন গায়ের মুসলমানরা আমার খানিকটা জমি কিনতে চাইল মসজিদ গড়ার জন্য। আমি বললুম, ‘এক-রাত্তি জমির জন্য আর পয়সা নেব না। মুসলমান দেশের নুন-নিমক খাই, না হয় দিলুম তাদের জাতভাইদের মসজিদ বানাবার জায়গা। ওদিকে মহীশূর দরবারে কে গিয়ে লাগিয়েছে আমি নাকি ‘আজ প্রভোকাতর’, কমু্যুনাল রায়ট লাগাবার তালে ইংরেজ আমাকে দেশে পাঠিয়েছে। কী মুশকিল! এল এক ডেপুটি তদন্ত করার জন্যে। আমাকে দেখেই শুধাল, ‘আপনি হিন্দু, আপনার মাথায় তুর্কী টুপি কেন?’ আমি বললুম, ‘আপনি হিন্দু, আপনার পরনে কেরেস্তানি সুট কেন? আপনি যদি বিলেতে না গিয়েও সুট পড়তে পারেন। তবে মিশরে আঠারো বৎসর থাকার পরও কি আমার তুর্কী টুপি পরার হক বর্তলো না?’ আশ্চর্য, আপনিই বলুন তো, সিংহের মাথায় লর্ড’ পরালে যদি মানুষ ইংরেজ না হয় তবে আমার মাথায় তুর্কী টুপি চড়ালেই আমি মুসলমান হয়ে যাব কেন? যে দেশে থাকবে, সে দেশের পাঁচজনকে হিন্দিতে যাকে বলে আপনাতে’ হবে অর্থাৎ আপন করে নিতে হবে। তার জন্য বেশভুষা, আহার-বিহার, সব বিষয়েই মনকে সংস্কারমুক্ত না রাখলে চলবে কেন? কিন্তু আপনাকে এসব বলার কি প্রয়োজন? আপনিও তো অনেক দেশ দেখেছেন।’

এমন সময় আরব কারবারীরা এসে আমাদের কাছে দাঁড়াল। মুথহানা চেয়ার থেকে উঠে তাদের সঙ্গে হাত মেলালেন। কথা কইলেন এমনভাবে যেন জন্ম-জন্মাস্তরে পরম আত্মজন! বুঝলুম, কারবারীরা এসেছিল বিশেষ করে তাঁর কাছ থেকেই বিদায় নেবার জন্য। যাবার সময় বলে গেল, এ জাহাজে তাদের অর্থলাভ হয় নি বটে কিন্তু বন্ধুলাভ হল।

তারপর যে কদিন তিনি জাহাজে ছিলেন, প্ৰায় সমস্ত সময়টা কাটালেন গাদা গাদা চিঠিপত্র টাইপ করে। কিন্তু লৌকিকতার স্মিতহাস্য, সী-সিকদের তত্ত্ব-তাবাশ, পাঁজনের সাতটা ফরমাইশ-সুপারিশ করাতে তৎপর। আর তুর্কী টুপির ট্যাসেল দুলিয়ে দুলিয়ে খানাটেবিল যে বিলক্ষণ তপ্ত-গরম রাখলেন, সে-কথা আমি না বললেও এনকের লাইন জাহাজ কোম্পানি হলপ খেয়ে বলবে।

সুয়েজবন্দরে তিনি নেমে গেলেন-জাহাজ অন্ধকার করে। এর চেয়ে ভাল বর্ণনা আমি চেষ্টা করে খুঁজে পেলুম না। এমন সব পুরনো অলঙ্কার আছে যার সামনে হালফ্যাশান হামেশাই হার মানবে।

ইউরোপে দশ মাস কেটে গেল এটা-সেটা দেখতে দেখতে। তার প্রথম চার মাস কাটল কলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক পণ্ডিত অজিত বসুর সঙ্গে। তিনি সস্ত্রীক ফ্রান্স, সুইটজারল্যান্ড, জর্মনি, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লাভাকিয়া ঘুরলেন যক্ষ্ণা-হাসপাতাল দেখে দেখে–কিছু না কিছু কয়লার গুড়ো লাগবেই, আতরওয়ালার সঙ্গে আশনাই হলে গায়ে কিঞ্চিৎ খুশবাই লাগবে।’ বিয়াল্লিশটা স্যানাটরিয়া ঘুরে আমার গায়ে কয়লা না আন্তর লাগল। সে সমস্যা এখনও সমাধান করতে পারি নি। তবে যক্ষ্মার যে বিশেষ কোনও চিকিৎসা নেই। সে কথাটা দোভাষীগিরি করে বেশ ভাল করেই হৃদয়ঙ্গম হল। (১৯৩৩-৩৪ এর কথা : এখন অবস্থা অন্যরকম।) ডাক্তারে ডাক্তারে কথা বলার সময় সাধারণত সত্য গোপন করে না।

তারপর একদিন শুভ প্রাতে ভেনিস বন্দরে পৌঁছলুম। শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে লিডোতে সাঁতার কেটে, সিনমার্ক দর্শন করে, চন্দ্রালোকে গন্ডেলা চড়ে, টুরিস্ট ধর্মের তিন আশ্রম পালন করার পর ভেনিস থেকে সন্ন্যাস নিলুম। তিন দিন পরে আলেকজ্যান্ডিয়া বন্দর। সেখান থেকে কাইরোয় ট্রেনে চাপাবার পূর্বে তার করলুম, ‘মোহিনী টি’কে।

এ দশ মাস ইচ্ছে করেই মুথহানাকে কোনও চিঠিপত্র লিখি নি। স্থির করেছিলুম ভদ্রলোককে তাক লাগিয়ে দেব। আর পাঁচটা ভারতীয়ের তুলনায় বাঙালি যে প্রতিজ্ঞা পালনে জান-কবুল, সে কথাটা হাতে-নাতে দেখিয়ে দেব-’বাঙালির বাত নড়ে তো বাপ নড়ে।’

কাইরো স্টেশনে নেমে কিন্তু তাক লাগল আমারই। যে-লোকটি নিজেকে মুথহানা বলে পরিচয় দেয় তার সঙ্গে জাহাজের মুথহানার যে কোনোখানে মিল আছে সে কথা আপন স্মৃতিশক্তিকে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস না করে মানবার উপায় নেই। ওঁর গায়ে সুটটি পরা ছিল যেন সর্জেনের হাতে রবারের দস্তানা-এর গায়ে সুট ঝুলছে যেন ভিখিরির ভিক্ষের বুলি। ওঁর মুখে ছিল উজ্জ্বল হাসি, ওঁর ছিল পুরুষ্ট টোল-খেকো বাচ্চা ছেলের তুলতুলে গাল, এর দেখি কপালের টিপি আর দুই ভাঙা গালের উনুনের বিক। উঁচু কলারের মাঝখানে এই যে কণ্ঠা প্রথম দেখলুম, সেটাকে তিনি ডবল সাইজ করে দিলেও মাঝখানের ফাক ভরবে না!

আর সেই চোখ দুটি গেল কোথায়? কেউ হাসে দাঁত দিয়ে, কেউ হাসে ঠোঁট দিয়ে, বেশির ভাগ লোক মুখ আর গাল দিয়ে-মুথহানা হাসতেন। সুদ্ধ দুটি চোখ দিয়ে। আর তার ঝিলিমিলি এতই অদ্ভুত যে, তখনই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে জোয়ার জলের চাদের বিকিমিকি।

এঁর বয়স তো এখনও আটত্রিশ পেরোয় নি। এ বয়সে তো চোখে ছানি পড়ে না।

ট্যাক্সি ডাকলেন। আমার তো আবছা-আবছা মনে পড়ল, নিজের গাড়ির কথা যেন কোনও কথার ফাঁকে আপন অনিচ্ছায় জাহাজে বলেছিলেন। কি জানি হয়ত গাড়ি কারখানায় গিয়েছে।

কন্তারা-তুল-দিক্কা স্টেশন থেকে দূরে নয়। ফ্ল্যাট পাঁচতলায়। মুথহানা ড্রয়িং রুমের সোফার উপর নেতিয়ে পড়ে প্রাণপণ হাঁপাতে লাগলেন। আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘আপনার কি হয়েছে বলুন।’ বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘কিছু না, একটু কাশি।’ এই মুথহানা সেই মুথহানা! আমি চুপ করে গেলুম।

স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। নাম হেলেনা। সাইপ্রিস দ্বীপের গ্ৰীক মেয়ে। গ্ৰীক ছাড়া জানেন অতি অল্প কিচেন-আরবী আর তার চেয়েও কম ইংরিজি। আমি জানি গ্ৰীক ব্যাকরণের শব্দরূপ ধাতুরূপ-ক্লাস নাইনের ছোকরা যেমন উপক্ৰমণিকা জানে। অনুমান করলুম, গ্ৰীক রমণী বিদেশীর মুখে ভুল উচ্চারণে আপনার ভাষার ধাতুরূপ শোনার জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হবে না। তাই আরবী ইংরেজির গুরু চণ্ডালী দিয়ে যতটা পারি ভদ্রতা রক্ষা করলুম। মুথহানা গ্ৰীক বললেন অক্লেশে।

দুবার যে ভুল করেছি। সে-ভুল। আর করলুম না। শুধু জিজ্ঞেস করলুম, ‘গ্ৰীক শিখতে আপনার ক’বৎসর লেগেছিল?’ বললেন, ‘এই আঠারো বছর ধরে শিখছি। এখানকার কারবারী মহলে গ্ৰীক না জেনে ব্যবসা করা কঠিন।’ ব্যাস, সুদ্ধ প্রশ্নের উত্তরটুকু। জাহাজে হলে এরই খেই ধরে আরো কত রসালাপ জমত।

খানা-কামরা নেই। ড্রইংরুমে টেবিল সাফ করে খানা সাজানো হল। একটি ন’দশ বছরের ছোকরা ছুরিটা, কঁটাটা এগিয়ে দিল। মোট খাটুনিটা গেল হেলেনার উপর দিয়ে। বুঝলাম রোধেছেনও তিনিই। চমৎকার পরিপাটি রান্না।

খাওয়ার সময় টেবিলে বসলেন মুথহানার বিধবা শালী তার ছোট মেয়ে নিয়ে। আভাসে ইঙ্গিতে অনুমান করলুম, এঁরা তার পুষ্যি।

ইতিমধ্যে আমার মনে আরেক দুর্ভাবনার উদয় হল। হাত ধুতে যাবার সময় চোখে পড়েছে মাত্র দু’খানা শোবার ঘর। আমি তবে শোবো কোথায়? হোটেলে যাবার প্রস্তাব মুথহানার কাছে পাড়ি-ই বা কি প্রকারে? ভদ্রলোক যে-রকম ঠোঁট সেলাই করে নীরবতার উইয়ের ঢিবির ভিতর শামুকের মত বসে আছেন তাতে আমি সূচ্যগ্রও ঢোকাবার মত ভরসা পেলুম না। তবে কি ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করব, মমিকে যেরকম এদেশে কাঠের কফিনে পুরে রাখে, অতিথিকেও তেমনি রাত্রে কাঠের বাক্সে তালাবন্ধ করে রাখার রেওয়াজ আছে কিনা! আহারাদির পর হেলেনা আমার প্রথম সিগারেটটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে রাত্রের মত বিদায় নিলেন। খানিকক্ষণ পরে রান্নাঘরে বাসনবর্তন ধোয়ার শব্দ শুনতে পেলুম।

মুথহানা সোফায় শুয়েছিলেন। আমাকে বললেন, ‘পাশে এসে বসুন, কথা আছে। আমি আর একটি সিগারেট ধরালুম। বললেন, ‘আপনি আমার দেশের লোক, আপনাকে সব কথা বলতে লজা নেই। সংক্ষেপেই বলব, আমার বেশি কথা বলতে কষ্ট হয়।

‘জাহাজে আপনার সঙ্গে অনেক কথাই খোলাখুলি বলেছিলুম। তার থেকে হয়ত আপনি আন্দাজ করেছিলেন, আমার দু’পয়সা আছে, বাড়ি-গাড়িটাও আছে, আর এখন দেখছেন। আপনাকে শুতে দেবার মত আমাদের একখানা ফালতো কামরা পর্যস্ত নেই। হয়ত আপনি ভাববেন, আমি ধাপ্পা দিয়েছিলুম। আপনি কখনো মিশরে আসবেন না এই ভরসায়।’

আমি বাধা দিতে যাচ্ছিলুম। কিন্তু মুথহানা তার হাডিসার হাতখানা তুলে আমাকে ঠেকালেন। বললেন, না ভেবে থাকলে ভালই। আপনাদের শরৎবাবুর এক উপন্যাসেআমি মাতৃভাষা কানাড়ায় পড়েছি, যে অবিশ্বাস করে লাভবান হওয়ার চেয়ে বিশ্বাস করে ঠিক ভাল। যাক সে কথা।’ বলে বেশ একটু দম নিয়ে কি বলবেন সেটা যেন মনের ভিতর গুছিয়ে নিলেন।

সংক্ষেপেই বলি। যে গ্ৰীক রাস্কেলটার হাতে আমি আমার ব্যবসা সঁপে দিয়ে দেশে গিয়েছিলুম, ফিরে দেখি সে সব কিছু ফুঁকে দিয়েছে। বাড়িভাড়া দেয় নি, ওভারড্রাফটু নিয়েছে, শেষটায় সন্টকের চা পর্যন্ত জলের দরে বিক্রি করে দিয়েছে। এখানে ওখানে কত ছোটোখাটো ধার যে নিয়েছে, তার পুরো হিসাব এখনও আমি পাই নি। আমার নাম জাল করেছে। যখনই দরকার হয়েছে। আপনি ভাবছেন আমি এরকম লোকের হাতে সব কিছু সঁপে দিয়ে গেলুম কেন? কী করে জানব বলুন? দশ বৎসর ধরে সে আমার সঙ্গে কাজ করছে, বিয়েরটা সিগারেটটা পর্যন্ত স্পর্শ করত না। আর সব কিছু ফুঁকে দিয়েছে–একটুখানি হেসে বললেন, ‘ফাস্ট উইমেন আর স্লো হর্সের পিছনে।’

নিজে দুদৈর্বের কাহিনী বলার ভিতরেও রসিকতা করতে পারেন যার মনের কোণে— হয়ত নিজের অজানাতেই ধনজনের প্রতি জন্মলব্ধ বৈরাগ্য সঞ্চিত হয়ে আছে। ‘বহু দেশ ঘুরেছি এ কথাটা বলতে আমার সব সময়েই বাধো বাধো ঠেকে, কিন্তু এখানে বাধ্য হয়ে সে কথাটা স্বীকার করতে হল, মুথহানার এই দুর্লভ গুণটির পরিপ্রেক্ষিত দেখবার জন্য।

 

জিজ্ঞেস করলুম, ‘আপনার স্ত্রীও জানতে পারেন নি?’ বললেন, ‘তিনি তখন সাইপ্রিসে, বাপের বাড়িতে। কিন্তু আজকের মত থাক। এ-সব কথা। আমার সংসারের অবস্থা দেখে আপনি বাকিটা আন্দাজ করে নিতে পারবেন।

‘শুয়ে শুয়ে তাই নিয়ে কিন্তু অত্যধিক দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আবার সব কিছু গড়ে তুলবো। এই আপনার চোখের সামনেই। এখন শুয়ে পড়ুন, আমি ওমরকে ডেকে দিচ্ছি। সে আপনার বিছানা ঐ কোণে দিভানটার উপর করে দেবে। কষ্ট হবে–’ আমি বাধা দিলুম। মুথহানাও চুপ করে গেলেন।

সেই ছোকরা চাকরীটি এসে বেশ পাকা হাতে বিছানা করে দিল। বুঝলুম, মুথহানার অতিথিদের জন্য প্রায়ই তাকে এরকম বিছানা করে দিতে হয়।

ঘর থেকে বেরুবার সময় মুথহানা শেষ কথা বললেন, ‘আমি কিন্তু সব কিছু আবার গড়ে তুলব। আমি অত সহজে হার মানি নে।’ একমাত্র জর্মন বৈজ্ঞানিকদের গলায় আমি এরকম আত্মবিশ্বাসের অকুণ্ঠ ভাষা শুনেছি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মুথহানার গলা থেকে বেরুল একটু খুসখুসে আওয়াজ।

অতি অল্প, কিন্তু আমার ভাল লাগল না।

শুনেছি রাজশয্যায় নাকি যুবরাজেরও প্রথম রাত্রে ভাল ঘুম হয় না। সত্যি মিথ্যে জানি নে, কিন্তু কাইরোতে যে হবে না। সে বিষয়ে আমার মনে দ্বিধা নেই। আধো ঘুম আধো জাগরণে সেই পাঁচতলার উপর থেকে শুনেছিলুম সমস্ত রাত ধরে ফারাও-প্রজাদের ফুর্তির পিছনে ছুটোছুটি হুটোপুটির শব্দ।

কলকাতা ঘুমোয় এগারোটায়, বোম্বাই বারোটায় আর কাইরো দেখলুম অন্ধকারে ঘুমোতে ভয় পায়। সকাল বেলা আটটার সময় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখি, কাইরো শহর রাত বারোটার ভাতঘূমে অচেতন। স্থির করলুম, একদিন ভোরের নামাজের সময় মসজিদে গিয়ে দেখতে হবে ইমাম (নামাজ পড়ানেওয়ালা) আর মুয়াজিন (আজান দেনেওয়ালা) ছাড়া কজন লোক মসজিদে সে সময় হাজিরা দেয়। অনুমান করলুম। ব্যাপারটা-দত্তের প্রবন্ধ লেখার মত। তিনি লেখার ইমাম আর কম্পাজিটর পড়ার মুয়াজ্জিন। কিন্তু যাক এসব কথা—আমি কাইরোর জীবনী লিখতে বসি নি।

সেই অসুস্থ শরীর নিয়ে মুথহানা পরের চিস্তায় মাথা ঘামাতে আরম্ভ করলেন সকালবেলা থেকে। দেখি, দুনিয়ার যত বিপদগ্ৰস্ত লোক আস্তে আস্তে তাঁর ড্রইংরুমে জড়ো হতে আরম্ভ করেছে। বেশির ভাগ ভারতীয়, প্রায় সকলেরই পাসপোর্ট নিয়ে শিরঃপীড়া। এদের সকলেই দর্জি-এ দেশে আর্মি কনট্রাকটারদের সঙ্গে এসেছিল চাকরি নিয়ে। কনট্রাকটররা চলে যাওয়ার পর এখানেই ঘর বেঁধেছে-কাঁইরোর অতি সাধারণ মেয়েও পাঞ্জাবী দর্জির হৃদয়খানা খানখান করে ফেলতে পারে। কারো কারো হৃদয় ইতিমধ্যে জোড়া লেগে গিয়েছে অর্থাৎ নেশা কেটে গিয়েছে। এখন কেটে পড়তে চায়, কিন্তু পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছে—মুথহানা যদি ব্রিটিশ কনসুলেটে গিয়ে একটুখানি সুপারিশ করেন। কারো বা মিশরে বসবাস করার মেয়াদ পেরিয়ে গেছে।–মুথহানা যদি মিশরে বিদেশী দপ্তরে গিয়ে একটুখানি ধস্তাধস্তি করে আসেন। কেউ বা তার পাসপোর্টখানা কালোবাজারে ইহুদীকে বিক্রি দিয়েছিল (ইহুদী কেমিক্যাল দিয়ে তার ফটো মুছে ফেলে প্যালেস্টাইনী জাতভাইয়ের জন্য তাই দিয়ে জাল পাসপোর্ট বানিয়ে ধর্ম আর অর্থ দুইই সঞ্চয় করবে) এখন মুথহানা যদি কোনও মালজাহাজের কাপ্তেনকে বলে কয়ে কিংবা ‘টু পাইস’ দিয়ে তাকে চোরাই মালের মত দেশে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দেন।

দু-একজন পয়সাওয়ালা পাঞ্জাবী কনট্রাকটারও এলেন। মুথহানা যদি রেজিমেন্টের কর্নেলের সঙ্গে দেখা করে একখানা নতুন বুইক ভেট দিয়ে আসেন। না অন্য কোনও রকম লুব্রিকেশনের খবর তিনি বলতে পারেন?

দুপুর বেলা খাবার সময় মুথহানাকে দু’একখানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেই বুঝতে পারলুম, জাহাজে যে-রকম তিনি প্যাসেঞ্জার ও কতাঁদের মাঝখানের বেসরকারি লিয়েজোঁ অফিসার ছিলেন। এখানেও তিনি তেমনি দুঃস্থ ভারতীয় ও মিশরীয়, ইংরেজ সর্বপ্রকার কর্তব্যক্তির মধ্যিখানের অনাহারী লিয়েজোঁ অফিসার।

শরীর সুস্থ থাকলে বনের মোষ তাড়ানোটা বিচক্ষণ জনের কাছে নিন্দনীয় হলেও স্বাস্থ্যের পক্ষে সেটা ভালো, কিন্তু এই দুর্বল শরীর নিয়ে ভদ্রলোক কেন যে হয়রান হচ্ছেন সে-কথার একটু ইঙ্গিত দিতেই মুথহানা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আ-আমি কি করব? আমি যে এখানকার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি।’

‘ঐ দর্জির পাল আর দু-চারটে ভ্যাগাবিন্ড।’

‘আর কেউ সেক্রেটারি হতে পারে না?’

‘সব টিপসইয়ের দল। কনসুলেটে গিয়ে ইংরিজিতে কথা বলবে কে?’

‘তাহলে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন না কেন?’

‘প্রেসিডেন্টের পক্ষে কনসুলেটে ছুটোছুটি করা কি ভাল দেখায়? এসোসিয়েশনের তো একটা প্রেস্টিজ দেখানো চাই।’

‘প্রেসিডেন্ট কে?’

‘এক বুড়ো দর্জি। ইংরিজিতে নাম সই করতে পারে।’

আমি আর বাক্যব্যয় করলুম না। এরকম লোককে কোনো প্রকারের সদুপদেশ দেয়া অরণ্যে রোদন-এবং সেই অরণ্যেই যেখানে সে মোষ তাড়াচ্ছে, শুনেও শুনবে না।

মুথহানা আপিসে চলে গেলেন। আমি হেলেনাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘মুথহানার এই কাশিটা কবে হল এবং কি করে?’

হেলেনা বললেন, ‘খেটে খেটে। ভারতবর্ষ থেকে ফিরে এসে যখন দেখলেন। কারবার একবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তখন গাড়ি বেচে দিয়ে বড় বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে উঠলেন। তারপর নূতন করে ব্যবসা গড়ে তোলবার জন্য এই দশ মাস ধরে দিন নেই রাত নেই চব্বিশ ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করছেন। বাড়ি ফেরেন রাত দুটো, তিনটে, চারটে! কথা শোনেন না, ফিরে এসে ঠাণ্ডাজলে স্নান করেন, কখনও কখনও আবার খেতেও রাজী হন না, বলেন ক্ষিদে নেই। আগে তিনি সব সময় আমার কথামত চলতেন, এই নূতন করে কারবার গড়ে তোলার নেশা যাবে থেকে তাঁকে পেয়েছে তখন থেকে তিনি আর আমার কোনও কথা শোনেন না। এর চেয়ে তিনি যদি অন্য কোনো স্ত্রীলোকের প্রেমে পড়েও আমাকে অবহেলা করতেন, আমি এতটা দুঃখ পেতুম না। তবু তো তিনি সুস্থ থাকতেন!’

আমি কথাটার মোড় ফেরাবার জন্য বললুম, ‘জ্বরটর হয়েছিল?’ বললেন, প্রায় মাস তিনেক আগে তিনি ভেঙে পড়েন। দিন পনেরো শুয়ে ছিলেন, আর সেই পনেরো দিনেই যেন শরীর থেকে সব মাংস-চর্বি খসে পড়ে গেল। আর জানেন, তিনি কখনও ডাক্তার ডাকান নি।’

আমি বললুম, ‘এ কথা তো বিশ্বাস করা যায় না।’

হেলেনা উঠে চলে গেলেন। আমি থামালুম না। একা একা যতক্ষণ খুশি কাঁদা যায়।

চায়ের সময় আমি মুথহানাকে বেশ পরিষ্কার, জোর গলায় বললুম, তিনি যদি ভাল ডাক্তার না ডাকান, তবে আমি কাল সকালেই বিছানা-পত্র নিয়ে তাঁর বাড়ি ত্যাগ করব। তবে আমি অভিমান করতে পারি যে-ভারতীয় স্বদেশবাসীর সামান্যতম অনুরোধ পালন করে না, তার মুখদর্শন না করলেও আমার চলবে।

ডাক্তার এল। যক্ষ্মা। বেশ এগিয়ে গেছে। এক্সরে না করেই ধরা পড়ল।

তারপর যে এগারো মাস আমি কাইরোতে কাটালুম তার স্মৃতি আমার মন থেকে কখনো মুছে যাবে না। ওমর খৈয়াম বলেছেন :–

প্রথম মাটিতে গড়া হয়ে গেছে শেষ মানুষের কায়
শেষ নবান্ন হবে যে ধান্যে, তারো বীজ আছে তায়।
সৃষ্টির সেই আদিম প্ৰভাতে লিখে রেখে গেছে তাই
বিচারকর্ত্রী প্ৰলয় রাত্ৰি পাঠ যা করিবে ভাই।।
–সত্যেন দত্ত

আর আইনস্টাইনও নাকি বলেছেন, পৃথিবীর সব কিছু চলে এক অলঙ্ঘ্য নিয়ম অনুসারে। ওমর খৈয়াম ছিলেন আসলে জ্যোতির্বিদ-কাজের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি রুবাঈয়াৎ লিখেছেন মাত্র-এবং আইনস্টাইনের চোখও উপরের দিকে তাকিয়ে। এই দুই পণ্ডিত গ্ৰহনক্ষত্রের নিয়ম-মানা দেখে যা বলেছেন, আমি মুথহানার জীবনে তাই দেখতে পেলুম।

কত অনুনয়বিনয়, কত সাধ্যসাধনা, কত চোখের জল ফেললেন হেলেনা-আমার কথা বাদ দিচ্ছি—না, না, না, তিনি তাঁর কারবার ফের গড়ে তুলবেনই। ডাক্তার পই পাই করে বলে গিয়েছেন, কড়া নজর রাখতে হবে তিনি যেন নড়াচড়া না করেন—কিন্তু থাক, ডাক্তারের বিধানের কথা তুলে আর কি হবে, মধ্যবিত্ত কোন বাঙালি পাঠক সাক্ষাৎ কিংবা পরোক্ষভাবে যক্ষার সঙ্গে পরিচিত নয়-সব কিছু উপেক্ষা করে তিনি বেরুতেন রোজ সকালে চায়ের কারবারে। তাও না হয় বুঝতুম তিনি যদি শুধু অফিসে ডেকচেয়ারে শুয়ে থাকতেন। কতদিন মর্নিং-কলেজ থেকে ফেরার মুখে দেখেছি মুথহানা চলেছেন ক্লান্ত, শ্লথ গতিতে, দ্বিপ্রহর রৌদ্র উপেক্ষা করে, বড়-বড় খদ্দেরের আফিসে আরও কিছু চা গছাবার জন্য। বাড়ি ফিরতেন রাত আটটা, ন’টা, দশটায়।

খৈয়াম আইনস্টাইন ঠিকই বলেছেন সব কিছু চলেছে এক অদৃশ্য অলঙ্ঘ্য নিয়মের বেত্ৰাঘাতে। মুথহানা-পতঙ্গ ধেয়ে চলেছে কারবারের আগুনে আপন পাখা পোড়াবে বলে।

খুক খুক তখন অদম্য হয়ে উঠেছে। শালী টের পেয়ে মেয়েকে নিয়ে পালালেন। সুভাষিতে আছে, ‘পরান্নং দুর্লভং লোকে’ কিন্তু, সে পরান্ন। যদি যক্ষ্মার বীজাণুতে ঠাসা থাকে, তবে তা সৰ্বথা বর্জনীয়।’

হেলেনা কিন্তু হাসিমুখে বোনকে গাড়িতে তুলে দিলেন।

আশ্চর্য এই মেয়ে হেলেনা! মুথহানাকে যা সেবা করলেন, তার কাছে মনে হয়, বাঙালি মেয়ের সেবাও হার মানে। অন্য কোনও দেশে আমি এ জিনিস দেখি নি, হয়ত এরকম দুর্যোেগ চোখের সামনে ঘটেনি বলে।

ঘুম থেকে উঠে। কতবার তিনি মুথহানার শরীর মুছে দিতেন, সে শুধু তঁরাই বলতে পারবেন যাঁরা যক্ষ্মা রোগীর সেবা করেছেন। ডাক্তার নিশ্চয়ই বারণ করেছিলেন, তবু হেলেনা মুথহানার সঙ্গে এক খাটেই শুতেন। আমি তাই নিয়ে যখন হেলেনাকে একদিন অত্যন্ত কাতর অনুনয়বিনয় করলুম, তখন তিনি বললেন, ‘আমি কাছে শুয়ে তার বুকের উপর হাত রাখলে তিনি কাশেন কম, ঘুম হয় ভাল।’ আমি বললুম, ‘এ আপনার কল্পনা।’ হেসে বললেন, ‘ঐ কল্পনাটুকুই তো তিনি বিয়ে করেছেন। আমি তো আর আসল হেলেনা নই।’ আমি চুপ করে গেলুম।

কত না হাঁটাহাঁটি খোঁজাখুঁজি করে তিনি নিয়ে আসতেন বাজার থেকে সব চেয়ে সেরা জাফার কমলালেবু, কী অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তৈরি করতেন টমাটোর রস, রান্না করতেন স্বামীর কাছ থেকে শেখা ভারতীয় কায়দায় মাংসের ঝোল, কোপ্তা-পোলাও, মাদ্রাজি রসম, স্নান করিয়ে দিতেন স্বামীকে আপন হাতে, মুথহানা বেশি কাশলে জেগে কাটাতেন সমস্ত রাত। তিনি নিজে রোগা, কিন্তু ধন্বন্তরী যেন তখন তাঁকে বর দিয়েছেন যমের সঙ্গে লড়বার জন্য।

কইরোতে বৃষ্টি হয় বছরে দেড় না আড়াই ইঞ্চি, আমার মনে নেই। দিনের পর দিন মেঘমুক্ত নীলাকাশ দেখে দেখে বাঙালির মন যেন হাঁপিয়ে ওঠে। যখনই উপরের দিকে তাকাই দেখি নীল আকাশ প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। প্রথমবার যখন ইউরোপের পাড়াগাঁয়ে বেড়াতে গিয়েছিলুম, তখন মাঝে মাঝে নীলচোখো মেমসাহেবরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত—এই অদ্ভুত জংলী লোকটার বিদঘুটে চেহারা দেখে, আর অস্বস্তিতে আমার সর্বাঙ্গ ঘোমে উঠত। কইরোর সেই নীলাকাশ সেই নির্লজাদের নীল চোখের মত হরবকত আমার দিকে তাকিয়ে আছে, একবার পলক পর্যন্ত ফেলে না; মেঘ জমে না, দরদের অশ্রুবর্ষণ বিদেশী বিরহীর জন্য একবারের তরেও ঝরল না।

পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ থেকে কত রকমের হাওয়া কইরোর উপর দিয়ে বয়ে গেল, কত না মুখের বোরকা সরিয়ে ক্ষণেকের তরে নিশিকৃষ্ণ চোখের বিদ্যুৎ ঝলক দেখিয়ে দিলে, কিন্তু তাদের কেউই এক রাত্তি মেঘ সঙ্গে নিয়ে এলো না। সাহারা থেকে লাল দরিয়া পেরিয়ে, হাবশী মুল্লুকের পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে মধ্যসাগরের মধ্যিখান থেকে চার রকমের হাওয়া বইল, যেন হলদে, লাল, কালো, নীল রঙ মেখে কিন্তু মেঘ। আর জমে ওঠে না।

ভুল বললুম, মেঘ জমে উঠতে লাগল হেলেনার মুখের উপর। পূব-সাগরের পার হতে একদা যে নীল মেঘ সাইপ্রিস রমণীর চিত্তাকাশ প্রেমের বেদনায় ভরে দিয়েছিল, আজ সে মেঘ তার সমস্ত মুখও ছেয়ে ফেলল। দু’চোখের চতুর্দিকে যে কালো ছায়া জমে উঠল, সে যেন চক্রবাল-বিস্তৃত বর্ষণ-বিমুখ খরা মেঘ; আমি মেঘের দেশের লোক, আমার বাড়ি চেরাপুঞ্জির ঘা ঘেষে, ছেলেবেলা থেকে মেঘের সঙ্গে মিতালি-কিন্তু হে পর্জন্য! এ রকম ঘন যেন আমাকে আর না দেখতে হয়।

কানাড়া ভাষায় উত্তম বিরহের কবিতা আছে, এ কথা কখনো শুনি নি। কুর্গের লোক খুব সম্ভব মেঘের দিকে নজর দেয় না। মুথহানা হেলেনার মুখের উপর জমে-ওঠা মেঘ দেখতে পেলেন না।

দ্রোণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৎস অৰ্জ্জুন, তুমি লক্ষ্যবস্তু ভিন্ন অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছ কি? তোমার ভ্রাতৃগণ, তোমার আচার্য, তোমার পিতামহ?’

অৰ্জ্জুন বললেন, ‘না গুরুদেব, আমি শুধু লক্ষ্যবস্তু দেখতে পাচ্ছি।’

মুথহানার নজর কারবারের দিকে।

কিন্তু তৎসত্ত্বেও আমার মনে ধোঁকা লাগল, মুথহানা লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন। কিনা। বিশেষ করে যেদিন শুনলুম, তার রেস্ত নেই বলে তিনি ব্যাঙ্কের মুচছুদ্দিগিরিতে মাল ছড়াচ্ছেন। সে মাল মজুদ থাকে ব্যাঙ্কেই—মুথহানা কিছুটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করে দাম শোধ করলে আরো খানিকটা পান। ওদিকে ব্রুকবল্ড লিপটন অঢেল মাল ঢেলে দিয়ে যায় দোকানে দোকানে বিনি পয়সায়, বিনি আগামে। ব্যাঙ্কের গুদোমে রাখা মাল লড়বে দোকানে দোকানে সাজানো মালের সঙ্গে!

ব্যাঙ্কের টাকার সুদ তো দিতেই হয় বুকের রক্ত ঢেলে, তার উপর গুদোমভাড়া। মিশরী ব্যাঙ্কের নির্দয়তার সামনে সাহারা হার মানে।

কাজেই মুথহানার মাথার ঘাম যদি ব্যবসা গড়ে তোলাকে এগিয়ে দেয় এক কদম, যক্ষ্মাকে এগিয়ে দেয় এক ক্ৰোশ।

এ-তত্ত্বটা মুথহানা বুঝতে পারেন নি। তিনি ব্যবসা নিয়ে মশগুল। আমি তো ব্যবসা জানি নে। কিন্তু সিগারেট যে খায় না, গন্ধ পায় সে-ই বেশি।

মুথহানার সব চেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়াল ঐ পাঁচতলা বাড়ির বিরাশিখানা সিঁড়ি। সুস্থ মানুষ আমাদের ফ্ল্যাট চড়তে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যায়, ড্রইংরুম পৌঁছে প্রথম দশ মিনিট সোফার উপর নেতিয়ে পড়ে ম্যালেরিয়া রোগীর মত ধোঁকে, অথচ মুথহানাকে ভাঙতে হচ্ছে প্রতিদিন অন্তত দুবার করে এই গৌরীশঙ্কর। একতলা বাড়ির জন্য মুথহানা যে চেষ্টা করেন নি তা নয়, কিন্তু কইরোতে নতুন বাড়ির সন্ধান নতুন কারবার গড়ে তোলার চেয়েও শক্ত। সেলামীর টাকা যা চায়, তা দিয়ে কলকাতায় নতুন বাড়ি তোলা যায়।

ছোকরা চাকর ওমরকে নাকি মুথহানা কোনও এক ড্রেন থেকে তুলে এনে বঁচিয়ে তুলেছিলেন, তার বয়স যখন চার। মুথহানার তখন পয়সা ছিল, ওমরের তখন সেবা করেছে এক ফ্যাশনেবল আয়া আর স্বয়ং হেলেনা। আজ দশ বৎসরের ওমর নিজের থেকে ছোকরা চাকরের জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির ছেলের মত অনায়াসে সব কাজ করে, আমার ভুল আরবী শুনে মিটমিটিয়ে হাসে আর হেলেনার গ্ৰীক পড়ানো থেকে পালাবার জন্য অন্ধি-সন্ধির সন্ধানে থাকে।

এইটুকু ছেলে, কিন্তু মুথহানার প্রতি তার ভক্তি-ভালবাসার অন্ত ছিল না। রান্নাঘরে কাজ করছে কিন্তু গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ দীর্ণ করে তার কান যেন গিয়ে সেঁটে আছে ফুটপাথের সঙ্গে (আমরা কেউ কিছু শুনতে পাই নি—হঠাৎ কাজকর্ম ফেলে ছুটলো বেতের হালকা চেয়ার নিয়ে নিচের তলার দিকে। কি করে যে সামান্যতম খুকুখুক। শুনতে পেত, তা সেই জানে। প্রতি তলায় সে চেয়ার পাতবে, মুথহানা বসে জিরোবেন। এই করে করে সে মুথহানাকে পাচতলায় নিয়ে আসত। কেউ বাতলে দেয় নি, আবিষ্কারটা তার সম্পূর্ণ নিজস্ব।

মুথহানাকে কখনো দেখি নি ওমরের সঙ্গে আদর করে কথা কইতে। অল্প কথা বলতেন, না, অন্য কোনও কারণে জানি নে, কিন্তু এটা জানি তার চলাফেরাতে আচারব্যবহারের কি যেন এক গোপন যাদু লুকোনো ছিল, যার দিকে আকৃষ্ট না হয়ে থাকা যেত না-বাচ্চা ওমরাও বাদ পড়ে নি।

পয়লা ট্রায়েলেই খুশি হয়ে ওমর ঈদের জোব্বা আঁকড়ে ধরেছিল। মুথহানা কিন্তু তিন-তিন বার এদিকে কাটালেন, ওদিকে ছাঁটালেন। ঈদের দিন ওমর যখন নূতন জোব্বা পরে আমাদের সবাইকে সেলাম করল, তখন মুথহানা বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওমর তো আমাদের ডাগর হয়ে উঠেছে, কনের সন্ধানে লেগে যাও।’

মিশরেও আমাদের দেশের মত অল্প বয়সে বিয়ে হয়। ওমর তিন লম্বেফ ঘর ছেড়ে পালালো! মিশরের বাচ্চারাও বিয়ের কথা শুনলো লজা পায়।

এ-রকম মানুষকে পরোপকার করার প্রবৃত্তি থেকে ঠেকানো আজরাঈলেরও (যমেরও) অসাধ্য। আমি গিয়েছিলুম। ব্রিটিশ কনসুলেটে পাসপোর্ট রেজিস্ট্রি করাতে। গিয়ে দেখি, মুথহানা কনসুলেটের এক কেরানীকে আদি, রৌদ্র, বীর, হাস্য সর্বপ্রকারের রস দিয়ে ভিজিয়ে ফেলে কোন এক ভবঘুরের জন্য একখানা পাসপোর্ট যোগাড় করতে লেগে গেছেন। সাহেব যতই বুঝিয়ে বলে, ‘ভারতীয় জন্মপত্রিকা না দেখানো পর্যন্ত আমরা পাসপোর্ট দেব কি করে?’ মুথহানা ততই ইমান ইনসাফ দয়াধর্মের শোলোক কপচান, কখনো সাহেবের হাত দু’খানা চেপে ধরেন, কখনো রেডক্রসে পয়সা দেবেন বলে লোভ দেখান, কখনও ‘দি ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন লিমিটেড, কাইরো’র প্রতিভূ হিসাবে সদম্ভে সগর্বে দুহাতে বুক চাপড়ান:

রুমাল দিয়ে চোখের কোণ মেছেন নি— নবরসের ঐটুকুই বাদ পড়েছিল। সাহেব না। হয়ে কেরানী মেম হলে সেটাও বোধ হয় বাদ পড়ত না।

সাহেব যখন শেষটায় রাজী হল, তখন দেখা গেল, লক্ষ্মীছাড়া ভবঘুরেটার কাছে পাসপোর্টের দাম পাঁচটি টাকা পর্যন্ত নেই। এক লহমার তরে মুথহানা হ’কচাকিয়ে গিয়েছিলেন। সামলে নিয়ে অতি সপ্ৰতিভাভাবে জেব থেকে টাকাটা বের করে দিলেন।

এ টাকা তিনি কখনও ফেরত পান নি। আমি যখন বললুম, টাকাটা এসোসিয়েশনের খৰ্চায় ফেলুন, তখন তিনি হঠাৎ তেড়ে খোকখেঁকিয়ে বললেন, ‘লোকটা হজে যেতে চায়। সুদিন থাকলে আমি কি শুধু পাসপোর্ট-’

আমি তাড়াতাড়ি মাপ চাইলুম। মুখহানা চুপ করে গেলেন। উঠে যাবার সময় আমার সামনে এসে মাথা নিচু করে বললেন, ‘আমার মেজাজটা একটু তিরিক্ষি হয়ে গেছে। আপনি আমায় মাফ করবেন।’ আমি তার হাত দুখানি ধরে বললুম, ‘আপনি আমার বড় ভাইয়ের মত।’

আমি কইরো আসার পরও মুথহানা আট মাস কারবার গড়ে তোলবার জন্য লড়াই করেছিলেন। তারপর একদিন হার মানলেন। কারবারের কাছে নয়, যক্ষ্মার কাছে।

গ্ৰীসের রাজকুমারীর সঙ্গে ইংলন্ডের রাজকুমারের বিয়ে। কাইরোবাসী হাজার হাজার গ্ৰীক আনন্দে আত্মহারা। সবাই যেন জাতে উঠে যাচ্ছে, চাড়ােল যেন দৈববেগে পৈতে পেয়ে যাচ্ছে। এবার থেকে গ্ৰীকদের সমঝে চলতে হবে। রাজপুত্ত্বরের শালার জাত, বাবা, চালাকি নয়! আমাদের পাড়ার গ্ৰীক মুদিটা পর্যন্ত পিরামিডের মত মাথা খাড়া করে মােরগটার মত দোকানের সামনের ফুটপাথে গিটার-গটর করে টহল দেয়, আমাকে আর সেলাম করে না। কি আর করি, রাজপুত্ত্বরের শালা, বাবা, চাট্টিখানি কথা নয়, আমি সেলাম করে জিজ্ঞেস করি, বর-কনে কিরকম আছেন?’ মিশররাণী গ্ৰীক রমণী ক্লিওপাত্রার দম্ভ মুখে মেখে আমার দিকে সে পরম তাচ্ছিল্যাভরে তাকিয়ে বলে, ‘কনগ্রেচুলেট করে তার করেছি, জবাব এলেই খবর পাবে!’

আমি তো ভয়ে মর-মার। সিন্ধী ভাষায় প্রবাদ আছে-সিংহটাও নাকি শালাকে ডরায়।

সে বিয়ের পরবের ফিল্ম এলো কাইরোয়। গ্রীক মেয়ের গর্ভের বাচ্চা পর্যন্ত ছুটলো সে ছবি দেখতে। আমাদের ওমর আধা-ভারতীয়, আধা-গ্ৰীক (যদিও রক্তে খাস মিশরী)। সে ধরে বসলো ছবি দেখতে যেতেই হবে। আমিও সায় দিলুম! ভাবলুম মুথহানার মনটা যদি চাঙ্গা হয়। হেলেনা বায়োস্কোপ যেতে ভালবাসতেন। কিন্তু স্বামীর অসুখ হওয়ার পর থেকে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

গিয়ে দেখি ‘কিউ’ লম্বা হতে হতে প্যাঁচ খেয়ে ‘ইউ’ হয়ে তখন ‘ডবল ইউ’ হওয়ার উপক্রম। আমরা সবাই একটা কাফেতে গিয়ে বসলুম। ওমর কালাবাজার থেকে টিকিট আনল।

ভিতরে গোলমাল, চেঁচামেচি, চিৎকার। বাঙালি যজ্ঞিবাড়িকে চিৎকারে গ্ৰীকরা হার মানায়। মুথহানা যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, আমরা লক্ষ্য করি নি। সিনেমা থেকে ফিরেই গলা দিয়ে অনেকখানি রক্ত উঠল। আমরা বিচলিত হয়ে পড়েছি দেখে হঠাৎ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গ্ৰীকগুলো হন্যে হয়ে উঠেছে। ওদের দেখলে ভাবখানা কি মনে হয় জানেন?’

আমি বললাম, ‘না’।

বললেন, মনে হয় না, যেন বলতে চায়—’হেই, ঐ ড্যাম দুনিয়াটার দাম কত বল তো, আমি ওটা কিনব’?

হাসলেন না। কাশলেন ঠিক বুঝতে পারলুম না। অসুখ, খিটখিটেমি আর খাপছাড়া রসিকতা-এ তিনের উদ্ভট সংমিশ্রণের সামনে আমি ভ্যাবোচাকা খেয়ে গেলুম।

অনেক রাত অবধি ঘুম এলো না। মনটা বিকল হয়ে গিয়েছে। যক্ষ্মাতে মরে বহু, লোক, তার উপর চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এ মানুষটা রক্ত-সূত্র দিয়ে দিনের পর দিন মরণ-বধুর ডান হাতে রাখী বেঁধেই চলেছে। যে ব্যবসামন্ত্র এতদিন তাঁকে অন্ন-বস্ত্ৰ ভোগবিলাস দিচ্ছিল, আজ যেন সে-ই হঠাৎ এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মত তার হাতছাড়া হয়ে তারই কণ্ঠরুদ্ধ করে সবলে দুই বাহু নিষ্পেষিত করে বিন্দু-বিন্দু রক্ত নিঙড়ে নিচ্ছে।

হঠাৎ শুনি হেলেনার কান্না। দরজা খুলে বেরুতেই দেখি, মুথহানার শোবার ঘরের দরজা খোলা আর মুথহানা ঠাস ঠাস করে হেলেনার গালে চড় মারছেন। আমি ছুটে গিয়ে তাকে ধরতেই তিনি যেন চৈতন্য ফিরে পেয়েছেন এরকমভাবে আমার দিকে তাকালেন।

আমি তাঁকে খাটে শুইয়ে দিয়ে আপন ঘরে ফিরে এলুম।

ভোরের দিকে ঘুম ভাঙিল। দেখি ঘরে আলো জুলছে আর হেলেনা আমার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে। আমি আশ্চর্য হলুম না, বললুম, ‘বসুন।’

আমি স্থির করেছিলুম, সুযোগ পাওয়া মাত্রই তাকে বুঝিয়ে বলব, তিনি যেন মুথহানাকে মাপ করেন। অসুখে ভুগে ভুগে মানুষ কি-রকম আত্মকর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে, সে কথা বুঝিয়ে বলব। অন্তত এটা তো বলতেই হবে।–তা সে সত্যই হোক আর মিথ্যেই হোক—সেবার পরিবর্তে ভারতবাসী আঘাত দেয় না।

কিন্তু আমাকে কিছুই বলতে হল না। হেলেনা চোখের জল দিয়ে আমাকেই অনুনয়বিনয় করলেন আমি যেন মুথহানাকে ভুল না বুঝি। এ মুথহানা সে মুথহানা নয় যিনি তিন বৎসর ধরে তাঁকে সাধ্যসাধনা করেছিলেন তার প্ৰেম গ্রহণ করতে। বাড়ি-গাড়ি টাকা-পয়সা, তার সর্বস্ব তিনি হেলেনাকে দিয়ে তিন বৎসর ধরে বার বার তাকে বলেছিলেন তিনি তাকে গ্ৰহণ না করলে তিনি দেশত্যাগী হবেন।

হেলেনা বললেন, ‘আপনি ভাবছেন, দেশত্যাগী হবেন শুধু কথার কথা। তা নয়। আমার মামা তো ব্যবসায়ের ভিতর দিয়ে মুথহানাকে চিনতেন দশ বৎসর ধরে। তিনিই বলেছেন, ‘এই কাইরোর মত শহরে মুথহানা কোনও মেয়ের দিকে একবারের তরে ফিরেও তাকান নি। সাত বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে, টাকা-পয়সা যখন তার ছিল তখন কত ফরাসী কত হাঙ্গেরিয়ান মেয়ে তাঁর পিছু নিয়েছে, কিন্তু এই সাত বছরের ভিতর একদিন একবারের তরেও আমার মনে এতটুকু সন্দেহ হয় নি যে তিনি আমায় ফাঁকি দিতে পারেন। মুথহানা তো ফকির মানুষ নন।’

আম চুপ করে শুনতে লাগলুম। বললেন, ‘আজি না হয় তিনি দুরবস্থায় পড়েছেন বলে আমাকে তাঁর ব্যাঙ্কের হিসেব দেখান না, কিন্তু এমন দিনও তো ছিল যখন তিনি ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে বলতেন,-’সব টাকা উড়িয়ে দাও হেলেনা, আমি তাহলে বেশি কামাবার উৎসাহ পাব।’ আমার গায়ে হাত তুলেছেন? তুলুন, তুলুন। ঐ করে যদি তাঁর রোগ বেরিয়ে যায়। তবে তিনি জুড়োবেন, তার শরীর সেরে যাবে।’

তারপর বললেন, ‘বলুন, আপনি মুথহানাকে ভুল বোঝেন নি?’

আমি বললুম, ‘না। আমি আরেকটি কথা বলতে চাই। আপনি মুথহানাকে যে সেবা করেছেন, তার চেয়ে বেশি সেবা। আমার মাও আমার বাবাকে করতে পারতেন না।’

এর বাড়া তো আমি আর কিছু জানি নে। হেলেনার মুখে গভীর প্রশান্তি দেখা গেল। বললেন, ‘আপনি আমায় বাঁচালেন। সব সময় ভয় মুথহানা হয়ত ভাবেন, বিদেশী মেয়ে বিয়ে করে তিনি হয়ত মনের মত সেবা পেলেন না। আমার বুকের কতটা ভার নেবে গোল আপনি বুঝতে পারবেন না।’

কথাটা ঠিক। আমি অতটা ভেবে বলিও নি। পরদিন ছুটি ছিল। মুথহানা এসে কোনও ভূমিকা না দিয়েই বললেন, ‘কথা আছে।’

তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বললে, ‘স্থির করেছি, কারবার গুটিয়ে ফেলব।’

আমি আশ্চর্য হলুম, খুশিও হলুম, বললুম, ‘সেই ভাল।’ বললেন, ‘আমি হার মানি নি; গুটোতে হচ্ছে অন্য কারণে। আমার দম নিতে বড্ড কষ্ট হয়। আর এই কাইরোতে আমার শরীর সারবে না। কুর্গে এক মাস থাকলেই আমার শরীর সেরে যাবে।’ তারপর খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আপনি তো কখনও কুর্গে যান নি, তা না হলে আমার’ কথাটার মর্ম বুঝতে পারতেন। এই সাহারার হাওয়া আমি একদম সইতে পারি নে। আমার বুক যেন ঝাঁঝরা করে দেয়।’

কিছু বললুম না। কারণ জানতুম, জেনে-শুনে মিথ্যে কথা বলছেন না। সাহারায় এই বালু-ছক শুকনো বাতাস দিয়ে ফুসফুস পরিষ্কার করার জন্য অগুণতি। ইয়োরোপীয় যক্ষ্মা রোগী প্রতি বৎসর মিশরে আসে।

উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘জানেন হের ডক্টর, ট্যামারিন্ড ট্রি কাকে বলে?’

আমি বললুম, ‘বিলক্ষণ।’

‘আমার বাড়ির সামনে এক বিরাট তেঁতুল গাছ আছে। তারই ছাওয়ায় যদি আমি তিনটি দিন ডেক-চেয়ারে শুতে পারি। তাহলে সব কাশি সব ব্ৰঙ্কাইটিস ঝেড়ে ফেলতে পারব। যক্ষ্মা না কচু! হোয়াট রট্‌!’

আপন মনে মুচকি মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘আমি কী বোকা! এতদিন এ কথাটা ভাবিনি কেন বুঝতে পারি নে। আর কঁজির কথা কেন মাথায় খেলে নি তাও বুঝতে পারিনে। খাবো মায়ের হাতে বানানো কঁজি, শুয়ে থাকব তেঁতুল-তলায়, দম নেব তেঁতুল-পাতা-ছাঁকা হাওয়া। ব্যস! তিন দিনে সব ব্যামো বাপ বাপ করে পালাবে। যক্ষ্মা! হোয়াট ননসেন্স।’

তারপর হঠাৎ কি যেন মনে পড়ল। বললেন, ‘হেলেনা যে খারাপ রাধে তা নয়। কিন্তু কঁজি বানানো তো সোজা কর্ম নয়! আর এই মিশরী চালে কঁজি হবেই বা কী করে?’

উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘কারবার গুটোনোও তো কঠিন কাজ।’ তারপর খুব সম্ভব ঐ কথাই ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কিন্তু রাম উল্টো বুঝলেন। মুথহানা খাটতে লাগলেন টপ গিয়ারে। আমি জেলে নই তাই বলতে পারব না, জাল ফেলাতে মেহনত বেশি না গুটোতে। তবে এ কথা জানি, নদী

চোখের জলে নাকের জলে হতে হয়। মুথহানারও হল তাই।

এখন শুধু আর ওমরের চেয়ারে চলে না। দারোয়ান ধরে ধরে উপরের তলায় উঠিয়ে দিয়ে যায়। আর কথা বলা বেড়ে গিয়েছে।

‘বুঝলেন হের ডক্টর, আমার মা অজ পাড়া গেয়ে মেয়ে। নামটা পর্যন্ত সই করতে জানে না। আপনার মা জানেন?’

ভাঁড়াবার প্রলোভন হয়েছিল। কিন্তু মিথ্যেবাদীর স্মরণশক্তি ভাল হওয়া চাই।

একটু যেন নিরাশ হয়ে বললেন, ‘তাহলে আপনি সহজে বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু আমাদের অঞ্চলের সবাই জানে, হেন ব্যামো নেই মা যার দাওয়াই জানে না। আসলে কিন্তু দাওয়াই নয়, ডক্টর। মা সারায় পথ্যি দিয়ে। কচু, ঘেঁচু, দুনিয়ার যত সব বিদঘুটে আবোলতাবোল দিয়ে মা যা রাধে, তা একবার খেলেই আপনি বুঝতে পারবেন ওর হাতে যাদু আছে। কিন্তু ওসব কিছুরই দরকার হবে না। আমার। ঐ যে বললুম কঁজি আর তেঁতুলের ছায়া! তারপর ফিরে এসে দেখিয়ে দেব ব্যবসা গড়া করে কয়!’

একদিন লক্ষ্য করলুম, আগে বরঞ্চ মুথহানা মাঝে মাঝে গাড়িতে করে বাড়ি ফিরতেন, এখন প্রতি দিন হেঁটে। তাই নিয়ে একটুখানি মতামত প্ৰকাশ করলে পর মুথহানা বললেন, ‘আপনাকে সব কথা খোলসা করে বলি নি, শুনুন। আমি চাই হেলেনাকে যতদূর সম্ভব বেশি টাকা দিয়ে যেতে। ওর তো কেউ নেই যে ওকে খাওয়াবে। আমি অবশ্যি শিগগিরই ফিরে আসব। কিন্তু ও বেচারী এ কমাস বড্ড কেটেছে, এখন একটুখানি আরাম না করলে ভেঙে পড়বে যে।’

আমি বললুম, ‘ওঁকে বলেছেন যে আপনি একা দেশে যাচ্ছেন?’

মুথহানা ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘হুঁ, বড্ড কাঁদছে।’

আমি বললুম, ‘দেখুন মিস্টার মুথহানা, আর যা করুন-করুন, কিন্তু দুটি টাকা বেশি রেখে যাবার জন্য ব্যামোটা বাড়বেন না।’

বুনো শুয়োরের মত মুথহানা ঘোৎ করে উঠলেন। বললেন, যান যান, বেশি উপদেশ কপচাতে হবে না। বিয়ে তো করেন নি যে বুঝতে পারবেন। হেলেনা আমার কে?’

তারপর গট গট করে রান্নাঘরে গিয়ে লাগালেন ওমরকে দুই ধমক। সে অবশ্যি এসব ধমকে থোড়াই কেয়ার করে।

ফিরে এসে বললেন, সৈয়দ সাহেব?’

‘জী?’

‘রাগ করলেন?’

‘পগলা না কি।’

বললেন, ‘আমার মা’র কথা বলছিলুম না। আপনাকে? অদ্ভুত মেয়ে। বাবা যখন মারা গেলেন তখন আমার বয়স এক। বিশেষ কিছু রেখে যেতেও পারেন নি। কি দিয়ে যে আমায় মানুষ করলো, এখনও তার সন্ধান পাই নি। এই যে আমি কারবারে হার মানি নে, কনসুলেটে ঘাবড়াই নে, ইংরেজ গুপ্তচরকে ডরাই নৌ-সে-সব ঐ মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। আপনি বললেন, লেখাপড়া শেখে নি-’

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘আমি ককখনো বলি নি।’

চোখ দুটি অগাধ মেহে ভরে নিয়ে বললেন, ‘যদি কোনদিন কুৰ্গ আসেন তবে নিজেই দেখতে পাবেন।’ তারপর হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘আমি না থাকলেও আসতে পারেন-নিশ্চয়ই আসবেন। শুধু বলবেন, ‘আমি মুথহানাকে চিনি, ব্যস। আর দেখতে হবে। না। বুড়ি আপনাকে নিয়ে যা মাতামাতি লাগাবে। কিন্তু কথা কইবেন কি করে? মা তো কানাড়া ছাড়া আর কিছু জানে না।’

***

পূর্ণ তিনটি মাস আমি মুথহানার কাছ থেকে তাঁর মায়ের গল্প শুনেছি। একই গল্প পাঁচ সাত বার করে। আমার বিরক্তি ধরে নি। কিন্তু এ কথাও মানি আর কেউ বললে আমি এ কথা বিশ্বাস করতুম না। এক মাস যেতে না যেতেই আমার মনে হল, ফটোগ্রাফের দরকার নেই, গলার রেকর্ডের দরকার নেই, মুথহানার মাকে আমি হাজার পাঁচেক অচেনা মানুষের মাঝখানে দেখলেও চিনে নিতে পারব।

কুৰ্গ গেলে আমি প্রথম দিন কি খাবো তাও জানি, নাইতে যাবার সময় লাল না। নীল কোন রঙের গামছা পাবো তাও জানি, শুধু-গায়ে চলাফেরা করলে মায়ের যে আপত্তি নেই তাও জানি এবং বিশেষ করে জেনে নিয়েছি, বিদায় নেবার সাত দিন আগের থেকে যেন রোজই যাবার তাগাদ দিই, না হলে বোম্বায়ে এসে জাহাজ ধরতে পারব না।

এ তিন মাসের প্রথম দু’মাস মুথহানার জীবনে মাত্র দুটি কর্ম ছিল। ধুঁকতে ধুঁকতে ঠোক্কর খেয়ে পড়ি-মরি হয়ে এ দোকান, ও দোকান ঘুরে ঘুরে সমস্ত দিন ব্যবসা গুটোনো, আর রাত্রে আমাকে মায়ের গল্প বলা।

তারপর মুথহানাকে শয্যা নিতে হল। এদিকে আমার পয়সাও ফুরিয়ে এসেছে। মুথহানা জানতেন, আমি একমাস পরেই দেশে ফিরব। টাকা থাকতেই আমি টিকিট কেটে রেখেছিলুম। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আরও কিছু দিন থাকার কিন্তু তাহলে হেলেনার হিস্যায় ভাগ বসাতে হত। সে তো অসম্ভব।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান পেতে অপেক্ষা করছেন, আমি কখন বাড়ি ফিরব।

‘হের ডক্টর!’

‘আপনি আমাকে সব সময় ‘ডক্টর’, ‘ডক্টর’ করেন কেন?’

‘রাগ করেন কেন? আমি তো লেখাপড়া শিখি নি। আমার বন্ধু ‘ডক্টর’, সেটা ভাবতে ভাল লাগে না? কিন্তু সে কথা যাক। বলছিলুম কি, আমার মা—না থাক-’

আমি বললাম, ‘আপনাকে বলতেই হবে।’

‘আপনি শকট্‌ হবেন। আর কেন যে বলছি তাও জানি নে। আমার মা ব্লাউজশেমিজ পরেন না, শুধু একখানা শাড়ি।’

আমি বললুম, ‘আমার মাও গরমের দিনে ব্লাউজ শেমিজ পরেন না।’

‘আঃ, বাঁচালেন।’

***

কইরো ছাড়ার দিন সাতেক আগে মুথহানা তাঁর ঘরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। খান ত্ৰিশোক খাম দিয়ে বললেন, ‘এই ঠিকানা সব খামে টাইপ করে দিন তো।’

দেখি লেখা,

  1. D. Muthana
    Virarajendrapeth
    Marcara
    South Coorg. India.

বললেন, ‘হেলেনা শুধু গ্ৰীক লিখতে পারে। তাই এই খামগুলো দেশে যাবার সময় তার কাছে রেখে যাব। আমাকে চিঠি লিখতে তাহলে তার কোনও অসুবিধে হবে না। আমিও তো শিগগিরই দেশে যাচ্ছি।’

টাইপ করছি আর ভাবছি, এর কটা খামের প্রয়োজন হবে? এ বড় অমঙ্গল চিন্তা, পাপ চিন্তা-কিন্তু শত চেষ্টা করেও তার থেকে মুক্ত করতে পারলুম না।

কইরো ছাড়ার আগের দিন মুথহানা আমাকে ডেকে বললেন, ‘ওমর বলছিল। আপনি নাকি বিকেলের দিকে আজহর অঞ্চলে যাবেন। আমার জন্যে তিনখানা কুরান শরীফ কিনে আনবেন?’

আমি বললুম, ‘কার জন্য কিনছেন?’

‘আমার গাঁয়ের মোল্লাদের জন্য। তারা বলেছিল, ভারতবর্ষে ছাপা কুরানে নাকি বিস্তর ছাপার ভুল থাকে। কইরোর কুরান নিয়ে গেলে তারা যা খুশিটা হবে!’

আমার ভুল অমূলক। বিদায় নেবার দিন দেখি মুথহানা ভারি খুশিমুখ। বার বার বললেন, শিগগিরই ভারতবর্ষে দেখা হবে।’ হেলেনা-থাক সে কথা। ও-রকম অসহায়ের কান্না আমি জীবনে কখনও দেখি নি, কখনও দেখতে হবে না, তাও জানি।

দেশে ফিরেই মুথহানাকে চিঠি লিখলুম। জবাব পেলুম না। তখন অতি ভয়ে ভয়ে তাঁর মাকে লিখলুম। ‘কোদণ্ডের শরীর একটুখানি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে তিনি কিছুদিনের জন্য দেশে আসবেন বলেছিলেন। আপনার কথা আমাকে সব সময় বলতেন। আর দেশের ঘরবাড়ির জন্য তাঁর মন অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছিল। আমি তার সঙ্গে এক বৎসর একই বাড়িতে ছিলুম। আপনার কথা সব সময় ভাবতেন আর আমাকে রোজই আপনার কথা বলতেন। কম ছেলেই মাকে এত ভালোবাসে। আপনি আমার প্রণাম নেবেন।’ বহু ভেবেচিন্তে এই কটি কথা লিখেছিলুম, পাছে আমার কোনও কথা তার মনে ব্যথা দেয়।

এ চিঠিরও উত্তর পেলুম না। তার মাস খানেক পর কইরো থেকে খবর পেলুম, কোদণ্ড মুথহানা আমি চলে আসার তিন দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেন।

1 Comment
Collapse Comments

কুরগ গেলে আমার মনে পড়বে মুথহানা কে। মনে পড়বে তেঁতুল ছাওয়ায় সে বিশ্রাম নিতে চেয়েছিল। মায়ের হাতে কন্জি খেতে চেয়েছিল।
মনে পড়বে এক সামান্য ভারতবাসী কিভাবে পরদেশেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা বোধ করত না।এক দৃঢ় চিত্তের মানুষ।কি বিয়োগান্তক!মা র সাথে তার আর দেখা হল না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *