চরিত্র পরিচয়

চরিত্র পরিচয়

গল্প শুনেছি, ইংরেজ, ফরাসি, জর্মন আর স্কচ এই চারজনে মিলে একটা চড়ুইভাতির ব্যবস্থা করল। বন্দোবস্ত হল সবাই কিছু কিছু সঙ্গে নিয়ে আসবেন। ইংরেজ নিয়ে এল বেকন আর আন্ডা, ফরাসি নিয়ে এল এক বোতল স্যাম্পেন, জর্মন নিয়ে এল ডজনখানেক সসেজ, আর স্কচম্যান—? সে সঙ্গে নিয়ে এল। তার ভাইকে।

এ জাতীয় বিস্তর গল্প ইয়োরোপে আছে। স্কাচদের সম্বন্ধে গল্প আরম্ভ হলেই মনে মনে প্রত্যাশা করতে পারবেন যে গল্পটার প্রতিপাদ্য বস্তু হবে, হয় স্কাচদের হাড়কিপটেমিগিরি নয় তাদের হুইস্কির প্রতি অত্যধিক দুর্বলতা। ওদিকে আবার বিশ্বসংসার জানে স্কচরা ভয়ঙ্কর গোঁড়া ক্ৰীশ্চন আর মারাত্মক রকমের নীতিবাগীশ (বঙ্গজ হেরম্ব মৈত্র অতুলনীয়)। তাই এই তিন গুণ মিলে গিয়ে গল্প বেরল;-

এক স্কচ পাদ্রী এসেছেন লন্ডনে, দেখা করতে গেছেন তাঁর বন্ধুর সঙ্গে। গিয়ে দেখেন হৈহৈ রৈরৈ, ইলাহি ব্যাপার, পেল্লীই পাটি, মেয়েমদে গিসগিস করছে। বন্ধুর স্ত্রী হস্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে কঁচুমাচু হয়ে পাদ্রীকে অভ্যর্থনা জানালেন। কারণ জানতেন স্কচ পাদ্রীরা এরকম পাটি পরবের মাতলামো আদপেই পছন্দ করেন না। অথচ ভদ্রতাও রক্ষা করতে হয়, তাই ভয়ে ভয়ে শুধালেন,

‘একটুখানি চা খাবেন?’

পাদ্রী হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘নো টী!’

আরো ভয়ে ভয়ে শুধালেন, ‘কফি?’

নো কফি!’

‘কোকো?’

নো কোকো!’

ভদ্রমহিলা তখন মরীয়া। মৃদুস্বরে কাতর কণ্ঠে শেষ প্রশ্ন শুধালেন, ‘হুইস্কি সোডা?’

‘নো সোডা!’

অথচ কলকাতায় একবার অনুসন্ধান করে আমি খবর পাই, যে সব ব্রিটিশ এদেশে দানখয়রাত করে গিয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগই স্কচূ—ইংরেজের দান অতি নগণ্য। তারপর বিলেতে খবর নিয়ে জানলুম, স্কাচরা হুইস্কি খায় কম বেশীর ভাগ রপ্তানি করে দেয়, আর নিজেরা খায় বিয়ার!

ঠিক সেই রকমই বিশ্বন্দুনিয়ার বিশ্বাসী ফরাসি জাতটা বডই উচ্ছঙ্খল। পঞ্চমকার নিয়ে অষ্টপ্রহর বে-এক্তেয়ার। তাই ইংরিজি ‘ক্যারিইঙ কোল টু নিউ ক্যাসলের ফরাসি রূপ নাকি ‘ক্যারিইঙ এ ওয়াইফ টু প্যারিস’।

এ প্রবাদটি আমি ফরাসি ভাষায় শুনি নি; শুনেছি ইংরেজের মুখে ইংরেজি ভাষাতে। তাই প্যারিস গিয়ে আমার জানিবার বাসনা হল ফরাসিরা সত্যই উপরের প্রবাদবাক্য মেনে চলে। কিনা?

খানিকটা চলে, অস্বীকার করা যায় না। যৌন ব্যাপারে ফরাসিরা বেশ উদার কিন্তু একটা ব্যাপারে দেখলুম তারা ভয়ঙ্কর নীতিবাগীশ। ফষ্টিনষ্টি তারা অনেকখানি বরদাস্ত করে—অবশ্য নিয়ম, সেটা যেন বিয়ের পূর্বে না করে পরেই করা হয়—কিন্তু সেই ফষ্টিনষ্টি যদি এমন চরমে পৌঁছয় যে স্ত্রী স্বামীকে কিংবা স্বামী-স্ত্রীকে তালাক দিতে চায়। তবে ফরাসি মেয়ে মদ দু’দলই চটে যায়।’ ‘পরিবার’ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে ফরাসি জাত বড়ই সম্রামের সঙ্গে মেনে চলে। তাই পরকীয়া প্ৰেম যতই গভীর হোক না কেন, তারই ফলে যদি কোনো পরিবার ভেঙে পড়ার উপক্রম করে তবে অধিকাংশ স্থলে দেখা যায়, নাগর-নাগরী একে অন্যকে ত্যাগ করেছেন।

কাজেই মেনে নিতে হয়, এ-ব্যাপারে ফরাসিদের যথেষ্ট সংযম আছে।

ঈষৎ অবাস্তর, তবু হয়ত পাঠক প্রশ্ন শুধাবেন, তাহলে এই যে শুনতে পাই প্যারিসে হরদম ফুর্তি সেটা কি তবে ডাহা মিথ্যে?

নিশ্চয়ই নয়। প্যারিসে ফুর্তির কমতি নেই। কিন্তু সে ফুর্তিটা করে অফরাসিরা। যৌন ব্যাপারে ইংরেজের ভণ্ডামি সকলেই অবগত আছেন—লরেনস সেটা বিশ্বসংসারের কাছে গোপন রাখেন নি। তাই ইংরজে মোক পেলেই ছুটে যায় প্যারিসে। পাড়াপ্রতিবেশী তো আর সেখানে সঙ্গে যাবে না—বেশ যাচ্ছেতাই করা যাবে। শুধু ইংরেজ নয়, আরো পাঁচটা জাত আসে, তবে তারা আসে খোলাখুলি সরাসরিভাবে–ইংরেজের মত ফরাসি আর্ট’ দেখার ভান করে না। কোন জর্মনকে যদি বার্লিনে শুনতে পেতুম বলছে, ‘ভাই, হাপ্তাখানেকের জন্য প্যারিস চললুম।’ তখন সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেতুম আর পাঁচজন মিটমিটিয়ে হাসছে।–অবশ্য প্রথম জর্মনও সে হাসিতে যোগ দিতে কসুর করছে না।

তা সে যাই হোক, একটা প্ৰবাদ আমি বিশ্বাস করি। ফরাসিরা বলে, ‘পারফিডিয়স অ্যালবিয়ন’ অর্থাৎ ‘ভণ্ড ইংরেজ’। একটি গল্প শুনুন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার খবর শুনে এক বুড়ো শিখ মেজর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে কার বিরুদ্ধে লড়ছে?’

‘ইংরেজ-ফরাসি জর্মনির বিরুদ্ধে।’

সর্দারাজী আপসোস করে বললেন, ফরাসি হারলে দুনিয়া থেকে সৌন্দর্যের চর্চা উঠে যাবে আর জর্মনি হারলেও বুরি বাৎ, কারণ জ্ঞানবিজ্ঞান কলাকৌশল মারা যাবে।’ কিন্তু ইংরেজরা হারা সম্বন্ধে সর্দারাজী চুপ।

আর যদি ইংরেজ হারে?’

সর্দারাজী দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তবে দুনিয়া থেকে বেইমানি লোপ পেয়ে যাবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *