সিনিয়ার এপ্ৰেন্টিস

সিনিয়ার এপ্ৰেন্টিস

কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থ যত পুরনো হয় তাদের কদর ততই বেড়ে যায়। নতুন যুগের লোক সে সব গ্ৰন্থ থেকে নতুন সমস্যার অতি প্রাচীন এবং চিরন্তন সমাধান পায় বলে তারা সব কেতাবকে অনায়াসে হার মানায়। শুধু ধর্মগ্ৰস্থ নয়, কোনো কোনো গল্পও অজরামর হয়ে থাকে ঐ একই কারণে। তারই একটা অতি মর্মান্তিকভাবে কাল মনে পড়ে গেল—কুড়িটি টাকা জেবে নিয়ে বাজার ঘুরে এলুম, ধুতি পেলুম না। গল্পটি হয়ত অনেকেই জানেন—তারা অপরাধ নেবেন না।

গণেশ বেচারী এপ্রেনিটিস মাইনে পায় না। কাজ শিখছে, এর ধাঁতানি ওর গুঁতানি চাঁদপানা মুখ করে সয়। আশা, একদিন পাকাপাকি চাকরি, মাইনে সব কিছুই পাবে। চাকরি খালি পড়লও, কিন্তু বড়বাবু সেটা দিয়ে দিলেন তার শালীর ছেলেকে—সে কখনো এপ্রেনটিসি করে নি। বড়বাবু গণেশকে ডেকে বললেন, ‘বাবা গণেশ, কিছু মনে করো না; এ চাকরিটা নিতান্তই অন্য একজনকে দিয়ে দিতে হল। আসছেটা তোমাকে দেব নিশ্চয়ই।’

কাকস্য পরিবেদনা, আবার চাকরি খালি পড়ল, বড়বাবু ফের ফক্কিকারি মারলেন, গণেশকে ডেকে আবার মিষ্টি কথায় চিড়ে ভেজালেন। এমনি করে দেদার চাকরি গণেশের সামনে দিয়ে ভেসে গেল, তার এপ্রেনটিসির আঁকশি দিয়ে একটাকেও ধরতে পারল না। শেষের দিকে বড়বাবু আর গণেশকে ডেকে বাপুরে, বাছারে বলে সান্ত্বনা মালিশ করার প্রয়োজনও বোধ করেন না।

গণেশের চোখ বসে গেছে, গাল ভেঙে গেছে, রাগের চুলের দু’এক গাছায় পাক ধরলো, পরনের ধুতি ছিড়ে গিয়েছে, জামোটা কোনো গতিকে গায়ে ঝুলে আছে। গণেশ এটুলে ও-টুলে, এর কাজ, ওর ফাইফরমাস করে দেয়-আর করে করে আপিসের বেবাক। কাজ তার শেখা হয়ে গেল। চাকরি। কিন্তু হল না।

এমন সময় বড় সাহেব একদিন বড়বাবুকে দোতলায় ডেকে বললেন, ‘আমায় একটা জরুরি রিপোর্ট লিখে আজকেরই মেল ধরতে হবে। কেউ যেন ডিসটার্বনা করে। দরজার গোড়ায় একজন পাকা লোক বসিয়ে দাও, কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়।’

দারোয়ানরা সেদিন করেছিল ধর্মঘট। বড়বাবু, গণেশকে দিলেন দোরের সামনে বসিয়ে। বললেন, ‘কিছু মনে করো না বাবা গণেশ, হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ, ইত্যাদি। গণেশ টুলে বসে ছেঁড়া ধুতিতে গিট দিতে লাগল।

এমন সময় নিচের রাস্তায় হৈহৈ রৈরৈ। এক বদ্ধ পাগল রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, পরনে কপ্লিনটুকু পর্যন্ত নেই-ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বার্থ-ডে-সুট’—আর পিছনে রাস্তার ছোঁড়ারা তাকে লেলিয়ে লেলিয়ে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

হবি তো হ, পাগলা করল গণেশের আপিসের দিকেই ধাওয়া। সিঁড়ি ভেঙে উপরের তলায় উঠে ঢুকতে গেল বড় সাহেবের ঘরে। গণেশ টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কিন্তু পাগলকে বাধা দিল না।

মারমার কাটকাট কাণ্ড। পাগলের পিছনে পিছনে ছোঁড়াগুলোও গিয়ে ঢুকেছে। বড়সাহেবের ঘরে। চিৎকার চেচামেচি। পাগলা আবার সাহেবকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ফেলে রিভলভিং-টিলটিঙ চেয়ারে বসতে চায়।

তাই দেখে কেউ বদ্যি ডাকে
কেউ বা ডাকে পুলিশ,
কেউ বা বলে কামড়ে দেবে
সাবধানেতে তুলিস!

শেষটায় পুরো লালবাজার এসে ঘর সাফ করল।

সায়েব রেগে কাঁই। বড়বাবুকে ধরে তো এই-মার কি তেই-মার লাগান আর কি। বলেন, ‘তুমি একটা ইডিয়েট, আর দোরে বসিয়েছিলে তোমার মত একটা ইম্বেসাইলকে। কোথায় সে, ডাকো তাকে।’

গণেশ এসে সামনে দাঁড়াল।

সায়েব মারমুখো হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইউ প্রাইজ-ইডিয়েট, পাগলকে তুমি ঠেকালে না কেন?’

গণেশ বড় বিনয়ী ছেলে। বললে, ‘আমি ভেবেছিলুম, উনি আমাদের আপিসের সিনিয়র এপ্রেনটিস। আমি তো জুনিয়র, ওঁকে ঠ্যাকাবো কি করে?’

সাহেব তো সাত হাত পানিমেঁ। বললেন, ‘হোয়াত্যু মীন বাই দ্যাটা?’

গণেশ বললে, ‘হুজুর, আমি তিন বৎসর ধরে এ আপিসে এপ্রেনটিসি করছি। খেতে পাই নে, পরতে পাই নে। এই দেখুন ধুতি। ছিড়ে ছিড়ে পট্টি হয়ে গিয়েছে। লজ্জা ঢাকবার উপায় নেই। তাই যখন একে দেখলুম। আমাদের আপিসে ঢুকছেন, একদম অবস্তর উলঙ্গ, তখন আন্দাজ করলুম, ইনি নিশ্চয়ই এ-আপিসের সিনিয়র এপ্রেনিটিস। তা না হলে তাঁর এ অবস্থা হবে কেন? এখানে এপ্রেনটিসি করে করে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে সিনিয়র এপ্রেনটিস হয়েছে।’

***

১৯৪৭ সালে স্বরাজ লাভ হয়। আমাদের এপ্রেনটিসি তখন শুরু হয়। তখনো পরনে ধুতি ছিল, গায়ে জামা ছিল। আর আমাদের সিনিয়র এপ্রেনটিস হওয়ার বেশি বাকি নেই। সবই আল্লার কেরামতী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *