০৫. সৃজ্যমান বাংলাভাষা।। শৌরসেনী অপভ্ৰংশ

সৃজ্যমান বাংলাভাষা।। শৌরসেনী অপভ্ৰংশ

পাল-চন্দ্র পর্বে প্রধানত সংস্কৃত এবং হয়তো স্বল্পাংশে মাগধী প্রাকৃতের মাধ্যমে ব্ৰাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধৰ্মসম্প্রদায়কে আশ্রয় করিয়া যে সুবিপুল সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহার কিছুটা পরিচয় লাইতে চেষ্টা করিয়াছি। এ-কথাও আগে বলিয়াছি, লোকায়ত স্তরে মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় রূপ এবং উত্তর-ভারতের সর্বজনবোধ্য শৌরসেনী অপভ্রংশের প্রচলনও ছিল যথেষ্ট। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা কেহ কেহ এই শেষোক্ত ভাষায় কিছু কিছু গান এবং পদ রচনাও করিয়াছেন। মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় গৌড়-বঙ্গীয় রূপের সঙ্গে শৌরসেনী অপভ্রংশের খুব বড় কিছু পার্থক্যও ছিল না। নবসৃজ্যমান বাঙলা ভাষায় রচিত চর্যাগীতিগুলিতে যে-ভাষা আমরা প্রত্যক্ষ করি তাহা সদ্যোও মাগধী অপভ্রংশের গৌড়-বঙ্গীয় রূপেরই সহজ ও স্বাভাবিক বিবর্তন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাহার উপর শৌরসেনী অপভ্রংশের প্রভাবও কিছু কিছু পড়িয়াছে। আর, প্রাচ্যদেশে স্থানীয় লেখকদের জনসাধারণের লেখনীতে ও মুখে মুখে শৌরসেনী অপভ্রংশও অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক উপায়েই কিছু কিছু প্ৰাচ্য উচ্চারণ ও বানান, বাক ও পদবিন্যাসভূঙ্গি স্বীকার করিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছে। এই স্বীকৃত বাঙালী সিদ্ধাচার্যদের রচিত দোহা এবং পদগুলির মধ্যে সুস্পষ্ট।

শিক্ষিত বর্ণসমাজের উচ্চস্তরে প্রচলিত সংস্কৃত ভাষাকে বাদ দিলে মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় বিবর্তিত রূপই ছিল এই পর্বে রাঢ়-বরেন্দ্র-ব্যঙ্গ-সমতট-চট্টলের লোকায়ত ভাষা। মূলত এই আর্যভাষায় আর্যেতার অষ্টিক, দ্রাবিড় ও ভোটদ্ৰব্ৰহ্ম ভাষাগোষ্ঠীর নানা স্থানীয় বুলিরও যথেষ্ট প্রভাব ছিল, শুধু শব্দ ও উচ্চারণ-ভঙ্গিতেই নয়, কিছুটা বাকভঙ্গি ও পদবিন্যাসরীতিতেও, তাহাও অস্বীকার করা যায় না। সংস্কৃত হইতে মাগধী প্রাকৃত এবং প্রাকৃত হইতে মাগধী অপভ্রংশের বিবর্তন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া কী করিয়া হইতেছিল, এ-তথ্যও আজি আচার্য সুনীতিকুমারের গবেষণার ফলে সুবিদিত।

যাহাই হউক, সুবিস্তৃত আলোচনা-গবেষণার ফলে আজ এই তথ্য সুপ্রতিষ্ঠিত যে, আনুমানিক নবম-দশম-শতকে বাঙলাদেশে সংস্কৃত ছাড়া আরও দু’টি ভাষা প্রচলিত ছিল, একটি শৌরসেনী অপভ্রংশ, আর একটি মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় বিবর্তিত রূপ যাহাকে বলা যায় প্রাচীনতম বাঙলা। একই লেখক এই দুই ভাষায়ই পদ, দোহা ও গীত প্রভৃতি রচনা করিতেন; শ্রোতা ও পাঠকেরাও দুই ভাষাই বুঝিতে পারিতেন। নবম-দশম শতকের আগে এই লোকায়ত ভাষার রূপ। কী ছিল আজ আর তাহা জানিবার উপায় নাই; সে-ভাষার নমুনা কোনও সাহিত্যে কেহ ধরিয়া রাখে নাই। পরেও নবসৃজ্যমান যে প্রাচীনতম বাঙলা ভাষার কথা বলিতেছি, সে-ভাষায় লিখিত রচনার সংখ্যা অত্যন্ত স্বল্প। সংস্কৃতের মর্যাদা ও প্রভাব শিক্ষিত সমাজে ও উচ্চ বৰ্ণস্তরে ছিল। সর্বব্যাপী; তাহারা সকলে সংস্কৃতের চর্চাই করিতেন, এবং মধ্যযুগে চৈতন্যদেবের কালেও অধিকাংশ পণ্ডিত ও লেখক যখন যাহা কিছু রচনা করিয়াছেন— জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সাহিত্য-দর্শনে- সাধারণত সংস্কৃতের মাধ্যমেই করিয়াছেন। লোকায়ত ভাষার কৌলীন্য-মৰ্যাদা তখনও যথেষ্ট সুপ্রতিষ্ঠিত হয় নাই। এমন কি, পাল-চন্দ্র পর্বে তান্ত্রিক ও বজ্রযানী আচাৰ্যরা যে এক ধরনের প্রাকৃতধর্মী বৌদ্ধ-সংস্কৃতের প্রচলন করিয়াছিলেন দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে তাহাও পরিত্যক্ত হইয়াছিল, এবং তাঁহারও বিশুদ্ধ ব্যাকরণসম্মত সংস্কৃত লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। তবে, এক শ্রেণীর লোকেরা- তাহারা সাধারণত ইসলাম-প্রভাবে প্রভাবান্বিত— বাঙলাদেশের কোথাও কোথাও বোধ হয়। সেই প্রাকৃতধর্মী৷ ‘বৌদ্ধ-সংস্কৃতের ধারা বহমান রাখিয়াছিলেন; শোক-শুভোদয়া-গ্রন্থে সেই ভাষার কিছুটা আভাস ধরিতে পারা কঠিন নয়।

বলিয়াছি, সৃজ্যমান প্রাচীনতম বাঙলায় রচিত গ্রন্থের সংখ্যা অত্যন্ত স্বল্প। সাহিত্য বা জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার দিক হইতে তাহার উল্লেখযোগ্য মূল্য না থাকিলেও বাঙলাভাষা ও বাঙালীর সংস্কৃতির দিক হইতে লোকায়ত ভাষার এই প্রাচীনতম নমুনাগুলির মূল্য অপরিসীম। ইহার পশ্চাতে বহুদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের বা সমাজের শিক্ষিত উচ্চতর বর্ণস্তরের কোনও সক্রিয় সমর্থন বা সহযোগিতা ছিল না, এবং সংস্কৃত ভাষার মাধ্যম ও উচ্চস্তরের সংস্কৃতির আড়ালে লোকায়ত সংস্কৃতির এই প্রকাশ বহুদিন পর্যন্ত যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করিতে পারে নাই।

চর্যাগীতি

প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর আগে আচার্য হরপ্রাসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপাল হইতে চারিখানা প্রাচীন পুঁথি। সংগ্ৰহ করিয়া আনেন। প্রথমটিতে ছিল বিভিন্ন পদকর্তার রচিত ৪৬টি ছোট ছোট গান; বইটির নাম চর্যচর্যবিনিশ্চয় বা চর্যাগীতি। গানগুলির সুবিস্তৃত সংস্কৃত টীকাও গ্রন্থটিতে আছে। বহুদিন পর প্রবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয় মূল-গ্রন্থের একটি তিব্বতী অনুবাদও নেপালেই আবিষ্কার করেন। তিব্বতী অনুবাদে গীত কিন্তু ৫১টি; মূল সংখ্যা বোধ হয় ছিল তোহাই। এই গানগুলি প্রত্যেকটিই প্রাচীনতম বাঙলায় রচিত। দ্বিতীয় তৃতীয় পুঁথি যথাক্রমে সিদ্ধাচার্য সরহ এবং কাহ্ন-রিচিত দুটি দোহাসংগ্ৰহ। তৃতীয়টি ডাকার্ণব বা ডাক-রচিত দেহা-সংগ্ৰহ। এই শেষোক্ত তিনটি গ্ৰন্থই শৌরসেনী অপভ্রংশে রচিত এবং সংস্কৃত-টীকাযুক্ত।

আচার্য সুনীতিকুমার চর্যাগীতিগুলির ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করিয়া নিঃসন্দেহে প্রমাণ করিয়াছেন, ইহাদের ভাষা প্রাচীনতম বাঙলা-ভাষার লক্ষণাক্রান্ত। শুধু তাহাই নয়, ইহাদের ব্যাকরণরীতি ও বাকভঙ্গি একান্তই বাঙলা, এবং এখনও বাঙলা-ভাষায় স্বীকৃত ও প্রচলিত। গীতগুলিতে এমন অনেক প্রবাদ আছে যাহা আজও বাঙলাদেশে সুপ্রচলিত; তাহা ছাড়া, ইহাদের মধ্যে নৌকা, নদনদী প্রভৃতি লইয়া ছবিতে উপমায় যে পারিপার্শ্বিকের চিত্র সুপরিস্ফুট তাহা একান্তই নদীমাতৃক বাঙলা দেশের।

৪৬টি চর্যাগীতির ২২ জন কবি সকলেই সিদ্ধাচার্য, এবং চুরাশি সিদ্ধার নামের তালিকায় ইহাদের প্রত্যেকেরই সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তবে, ইহাদের প্রত্যেকের দেশ ও কালনির্ণয় কঠিন। আচার্য সুনীতিকুমার, প্ৰবোধচন্দ্ৰ বাগচী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রভৃতিরা নানাদিক হইতে বিচার করিয়া কাল-নির্ণয়ের চেষ্টা করিয়াছেন; সাক্ষ্য-প্রমাণ যাহা আছে তাহা কিছুটা পরস্পর বিরোধী, পরিমাণে স্বল্প এবং সর্বত্র সুস্পষ্ট এবং নিঃসংশয়ও নয়। তবে, এক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়া, আর সকলেই মনে করেন, এই সিদ্ধাচার্য কবিরা মোটামুটি নবম শতক হইতে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বিদ্যমান ছিলেন। ইহাদের মধ্যে লুই-পা, কাহ্ন-পা, জলন্ধৱী-পা বা হাড়ি-পা, শবরী-পা, ভুসুকু, তন্ত্রীপাদ প্রভৃতিরাই সমধিক প্রসিদ্ধ এবং ইহাদের দেশ ও কাল সম্বন্ধে আগেই বলিয়াছি। মনে হয়, এই গীত-রচয়িতারা সকলেই প্ৰাচীন বাঙলা দেশের অধিবাসী ছিলেন; যাঁহারা তাহা ছিলেন না তাহদেরও বাঙলা দেশ ও বাঙালীর জীবন সম্বন্ধে অন্তত প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিল। তবু, এ-তথ্যও একেবারে নিঃসংশয়, এমন বলা চলে না।

বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসের দিক হইতে এই গীতগুলির মূল্য অপরিমেয়। প্রায় প্রত্যেকটি গীতই মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত, এবং অন্তঃমিলে বাধা, প্রত্যেকটি গীত এক একটি বিশেষ বিশেষ রাগে গাওয়া হইত। বাঙলা পয়ার বা লাচাড়ী ছন্দ এই গীতিগুলির ছন্দ হইতেই বিবর্তিত। যত গুহ্য অধ্যািত্মসাধনার গুহ্যতার তত্ত্বই ইহাদের মধ্যে নিহিত থাকুক না কেন, স্থানে স্থানে এমন পদ দু’চারটি আছে যাহার ধ্বনি, ব্যঞ্জনা ও চিত্ৰগৌরব এক মুহূর্তে মন ও কল্পনাকে অধিকার করে। অথচ, এ-কথাও সত্য যে, সাহিত্যসৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই গীতগুলি রচিত হয় নাই, হইয়াছিল। বৌদ্ধ সহজসাধনার গুঢ় ইঙ্গিত ও তদনুযায়ী জীবনাচরণের (চর্যর) আনন্দকে ব্যক্ত করিবার জন্য। সহজ-সাধনার এই গীতিগুলি কর্তৃক প্রবর্তিত খাতেই পরবর্তীকালের বৈষ্ণব সহজিয়া গান, বৈষ্ণব ও শাক্ত-পদাবলী, আউল-বাউল-মারফতী-মুর্শিদা গানের প্রবাহ বহিয়া চলিয়াছে। এই গ্রন্থের নানা স্থানে নানা সূত্রে চর্যাগীতির নানা বিচ্ছিন্ন পদ উদ্ধার করিয়াছি; এখানেও দুই চারিটি উদ্ধার করিতেছি ইহাদের সাহিত্য-মূল্যের কিছুটা আস্বাদন দানের উদ্দেশ্যে।

উঁচা উঁচা পাবত তহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গী পীচ্ছ পরহিণ সবরী গুঞ্জরী মালী৷।
উমত সবারো পাগল সবারো মা কর গুলি গুহাড়া তোহৌরি।
নিঅ ঘরিণী নামে সহজ সুন্দরী।।
নানা তরুবর মোউলিল রে গঅণত লাগেলী ডালী।
একেলী সবরী এ বন হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী৷
তিএ ধাউ খাট পাড়িলা সবরো মহাসুখে সেজি ছাইলী।
সবর ভূজঙ্গ নৈরামণি দারী পেহ্ম রাতি পোহাইলি৷।

উঁচু উঁচু পর্বত, সেখানে বসতি করে শবরী বালিকা, শবরীর পরিধানে ময়ূরের পাখা, গলায় গুঞ্জার মালা। ওগো উন্মত্ত শবর, পাগল শবর, গোলে ভুল করিও না, দোহাই তোমার— আমি তোমারই গৃহিণী, নামে সহজ সুন্দরী। নানা তরু মুকুলিত হইল, গগন স্পর্শ করিল। ডাল, কর্ণকুণ্ডল বজধারী একেলা শবর এ-বনে ঘুরিয়া বেড়ায়। তিন ধাতুর খাট পাতিল শবর, মহাসুখে বিছাইল শয্যা, শবর ভূজঙ্গ এবং নৈরাত্মা স্ত্রী- উভয়ে একত্র প্ৰেমারাত্রি পোহাইল।

তিন না চুপই হরিণা পিবই ন পাণী।
হরিণা হরিণীর ণিলয় ণ জাণী৷
হরিণী বোলঅ সুণ হরিণা তো।
এ বন চছাড়ি হোহু ভান্তো৷

ভয়ে তৃণ ছোঁয় না হরিণ, না খায় জল; হরিণ জানে না হরিণীর নিলয়। হরিণী আসিয়া বলে, হরিণ, তুমি শোনো, এ—বন ছাড়িয়া ভ্রান্ত হইয়া চলিয়া যাও।

কুলেঁ কুলেঁ মা হোইরে মূঢ়া উজুবাট সংসারা।
বাল ভিণ একুবাকু ণ ভূলহ রাজপথ কন্ধারা৷।
মায়া মোহ সমুদারে অস্ত ন বুঝসি থাহা।
আগে নাব ন ভেলা দীসই ভপ্তি ন পুচ্ছসি নাহা।।
সুনাপাস্তুর উহ ন দীসই ভান্তি ন বাসসি জান্তে।
এষা অটমহাসিদ্ধি সিঝই উজ বাট জায়ন্তে৷।

হে মূঢ়, কুলে কুলে ঘুরিয়া ফিরিও না, সংসারে সহজ পথ পড়িয়া আছে। সম্মুখে যে মায়া-মোহের সমুদ্র তাহার যদি না বোঝা যায় অন্ত, না পাওয়া যায় থই, সম্মুখে যদি না দেখা যায় ভেলা বা নৌকা, তবে এ-পথের যাহারা অভিজ্ঞ পথিক, তাহদের নিকট সন্ধান জানিয়া লও। শূন্য প্রান্তরে যদি না পাও পথের দিশা, ভ্রান্ত হইয়া আগাইয়া যাইও — না; সহজ পথে চল, তাহা হইলেই মিলিবে অষ্টমহাসিদ্ধি।

কাহ্ন ও সরহপাদের দোহাকোষ

আগেই বলিয়াছি, পশ্চিম ও উত্তর-ভারতীয় শৌরসেনী অপভ্রংশে রচিত হইয়াছিল সরহ ও কাহেক্তর দোহাগুলি। এই দোহাগুলিও সহজেসিদ্ধির গুহ্যতত্ত্ব ও আচরণ সম্বন্ধীয়, এবং ইহাদেরও অর্থ নিরূপণ অত্যন্ত কঠিন, তবে চর্যাগীতি অপেক্ষা সরলতর। ছন্দে ও ধ্বনিগৌরবে: দোহাগুলিওঁ খুব সমৃদ্ধ, তবে অদীক্ষিতের পক্ষে ইহাদের সৌন্দর্যের অনেকখানি গুহ্যনিহিত। ঠিক বাঙলা ভাষা ও বাঙলা সাহিতা না হইলেও প্রাচীনতম বাঙলা সাহিত্যের ধারার সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধ নিবিড়; দুইই একই ভাব-মণ্ডলের সৃষ্টি। পরবতী কালের বাঙলা বৈষ্ণব-পদাবলীর সঙ্গে ব্রজবুলিতে রচিত বৈষ্ণব-পদাবলীর যে-সম্বন্ধ, ভাষা ও ভাব-পরিমণ্ডলের দিক হইতে চর্যাগীতির সঙ্গে দোহাকোষের সম্বন্ধ ঠিক তাহাই প্রাচীন বাঙলায় শৌরসেনীর এই প্রভাব উত্তর-ভারতের দান; এ-দান কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করিতেই হয়।

চর্যাগীতিগুলির পাঠ সর্বত্র সুস্পষ্ট নয়, গুহা অর্থ তাহাকে আরও যেন অস্পষ্ট করিয়া দেয়। সংস্কৃত টীকাটির ভাষা এবং অর্থও দুর্বোধ্য। দোহাকোষ সম্বন্ধেও বক্তব্য একই। চর্যার ভাষায় কোথাও শৌরসেনী অপভ্রংশের এবং কোথাও কোথাও মৈথিলীর প্রভাব সুস্পষ্ট। ঠিক তেমনই দোহাগুলির অপভ্রংশ কিছু কিছু স্থানীয় বাঙলা ও মৈথিলী প্রভাবও ঢুকিয়া পড়িয়াছে। কাহ্ন ও সরহপাদের ২/৪টি অপভ্রংশে দেহাংশ অন্য প্রসঙ্গে অন্যত্র উদ্ধার করিয়াছি; এখানেও একটি উদ্ধার করিলাম, কতকটা ইহাদের সাহিত্য মূলের সঙ্গে পরিচিত হইবার জন্য।

পণ্ডিত লোঅ খমহু মহু এখুনি কিঅই বিআপ্পু
জো গুরুবঅণে মই সুঅই তহি কিং কহুমি সুগোপ্পু
কমল কুলিস বেবি মজ কঠিউ জো সো সুরত্ম বিলাস
কো তহি রামই ন তিহু আণ কস্‌স ন পূরই আস৷।

পণ্ডিত লোক, আমাকে ক্ষমা কর; এখানে কিছু বিকল্প করা হইতেছে না; যাহা আমি শুনিয়াছি সুগোপন গুরুবাক্যে তাহা আমি কী করিয়া বলি! কমল এবং কুলিশ এই দুইয়ের মধ্যস্থিত যে সুরতবিলাস তাহাতে ত্ৰিভুবনে কোেনা সুখী হয় এবং কাহার না। আশা পূৰ্ণ হয়!

কৃষ্ণ-রাধা কাহিনী

প্রাচীনতম বাঙলা ভাষা যেমন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ভাবের ও তত্ত্বের বাহন হইয়াছিল, ব্ৰাহ্মণ্য সাহিত্যেও যে সে-ভাষা একেবারে ব্যবহৃত হয় নাই, এমন নয়। প্রাচীন বাঙলা সাহিত্যে রাধা-কৃষ্ণ কাহিনীর কয়েকটি নাম যে বিবর্তিত রূপে আমাদের গোচর তাঁহাদের ভাষাতত্ত্বগত ইঙ্গিত খুব সুস্পষ্ট বলিয়াই মনে হয়। কৃষ্ণ-কাহ্ন-কানু বা কানাই, রাধিকা-রাহী-রাই, কংস-কাংস, নন্দ-নান্দ, অভিমন্যু-অহিবণ্ণু বা অহিমণ্ণু-আইহণ, আইমন-আয়ান প্রভৃতি নামের বিবর্তনের মধ্যে অর্থাৎ সংস্কৃত হইতে প্রাকৃত এবং প্রাকৃত হইতে অপভ্রংশের মারফৎ প্রাচীন বাঙলায় রূপান্তরের মধ্যে বোধ হয় এ-তথ্য লুক্কায়িত যে কৃষ্ণ-রাধিকার কাহিনী কোনও না কোনও সাহিত্যরূপ আশ্রয় করিয়া কামরূপে ও বাঙলা দেশে প্রসার লাভ করিয়াছিল তুর্কী-বিজয়ের বহু আগেই। এই সাহিত্যরূপের প্রত্যক্ষ প্রমাণও কিছু কিছু আছে, যদিও তাহা সুপ্রচুর নয়। কামরূপরাজ বনমালদেবের একটি লিপিতে, ভোজ্যবর্মার বেলাব-লিপিতে, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-গ্রন্থের কয়েকটি প্রকীর্ণ শ্লোকে কৃষ্ণের ব্রজলীলার বর্ণনার কথা তো আগেই বলিয়াছি।

তাহা ছাড়া, চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১০৫১ শকে (১১২৯ খ্ৰীষ্ট বৎসরে) মানসোল্লোস বা অভিলষিতাৰ্থচিন্তামণি নামে একটি সংস্কৃত কোষগ্রন্থ রচিত হইয়াছিল; এই গ্রন্থের গীতবিনোদ অংশে ভারতবর্ষের সমসাময়িক সমস্ত স্থানীয় ভাষায় রচিত কিছু কিছু গানের দৃষ্টান্ত সংকলিত হইয়াছে; ইহাদের মধ্যে কয়েকটি প্রাচীনতম বাঙলায় রচিত গানও আছে। এই বাঙলা গানগুলির বিষয়বস্তু গোপীদের লইয়া শ্ৰীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা এবং বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার-বর্ণনা। এই গানগুলি বাঙলা দেশেই রচিত হইয়াছিল, সন্দেহ নাই, এবং এই প্রান্ত হইতেই মহারাষ্ট্র-প্রান্তে প্রচারিত হইয়াছিল।

গীতগোবিন্দের ভাষা

আচাৰ্য সুনীতিকুমার দেখাইয়া দিয়াছেন, জয়দেব গীতগোবিন্দ-গ্রন্থে এমন কতকগুলি পদ বা গান আছে যে-গুলি আগেও সুরে গাওয়া হইত, এখনও হয়। গীতগোবিন্দের ভাষা শব্দ ও ব্যাকরণের দিক হইতে সংস্কৃত সন্দেহ নাই, কিন্তু ইহার ছন্দ, রীতি ও ভঙ্গি, ইহার অনুভব, ইহার প্রাণবায়ু সমস্তই যেন লোকায়ত স্থানীয় ভাষার, সে-ভাষা প্রাচীনতম বাঙলাই হোক বা বাঙলা দেশে প্রচলিত শৌরসেনী অপভ্রংশই হোক। আর, আগেই বলিয়াছি, এই দুই ভাষায় বিশেষ পার্থক্যও কিছু ছিলনা। এমন কথাও কেহ কেহ বলেন, মূল গীতগোবিন্দ রচিত হইয়াছিল শৌরসেনী অপভ্রংশে বা প্রাচীনতম বাঙলায় পরে তাহার উপর একটা সংস্কৃত পোশাক পরাইয়া দেওয়া হইয়াছে মাত্র! এ-অনুমান সত্য হউক বা না হউক (সত্য বলিয়া মনে করিবার কারণ খুব নাই), একদিকে চর্যাগীতি ও অন্যদিকে গীতগোবিন্দের ধারায়ই পরবর্তী কালের বৈষ্ণব-পদাবলীর সৃষ্টি। চতুর্দশ শতকের শেষাশেষি প্রাকৃত-পৈঙ্গল নামে অবহঠাঁট (অপভ্রষ্ট) বা অপভ্রংশ-ভাষায় রচিত গীতিকবিতার একটি সংকলন গ্ৰন্থ রচিত হয়; প্রাকৃত ছন্দের বিভিন্ন রূপ ও প্রকৃতির দৃষ্টান্ত সংকলন-করাই ছিল অজ্ঞাতনামা গ্রন্থকারের উদ্দেশ্যে। এই গ্রন্থে একাদশ-চতুর্দশ শতকীয় শৌরসেনী অপভ্রংশে রচিত এমন কয়েকটি পদ আছে যে-গুলির মধ্যে কিছু কিছু বাঙলা শব্দ, বাঙলা ধরন-ধারণ প্ৰত্যক্ষ গোচর। ভাষার দিক হইতে গীতগোবিন্দের পদগুলির সঙ্গেও কয়েকটি পদের আত্মীয়তা কিছুতেই দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। এক কথায় ইহাদের আবহ যেন একান্তই বাঙলার, এবং খুব সম্ভব এই অপভ্ৰংশ পদগুলি বাঙলাদেশেই রচিত হইয়াছিল। কয়েকটি দৃষ্টান্ত উদ্ধার করিতেছি। ক্ষুদ্র পরিসরে ঘনীভূত ভাব ও রসের, ধ্বনি ও ছন্দের এমন সুন্দর প্রকাশ প্রাচীন কাব্যে খুব কমই দেখা যায়। আমার ধারণা, প্রাকৃত-পৈঙ্গলের অনেকগুলি শ্লোক ও কবিতায় বাঙলাদেশের যেটুকু পরিচয় পাইতেছি। তাহা প্ৰাক-তুর্কী বাঙলার।

কাঅ হউ দুবল, তেজি গারাস, খাণে খণে জানিঅ অচ্ছ ণিসাস।
কুহূরব তার দুরন্ত বসন্ত, নিদ্দঅ কাম নিদ্দঅ কস্ত৷।

দুর্বল হইল কায়, গ্রাস (অর্থাৎ আহার) হইল পরিত্যক্ত, ক্ষণে ক্ষণে (দীর্ঘ) নিঃশ্বাস জানা যাইতেছে; কুহুরব তীব্র, বসন্ত, দুরন্ত– কাম-নির্দয় কি কান্ত নির্দয়, জানি না।

সো মহকস্তাদূর দিগন্তা।
পাউস আএ চেউ চলাএ৷।

সেই আমার কান্ত (গিয়াছে) দূর দিগন্তে; প্রাবৃষ (বৰ্ষ) আসিতেছে, চঞ্চলিত হইতেছে চিত্ত।

গজ্জই মেহ কি অম্বর সামর
ফুল্লাই ণীব লি বুল্লই ভামর।
এক্কল জীঅ পরাহিণ অম্মহ
কীলউ পাউস কীলউ বাম্পহ।৷

মেঘ গর্জন করিতেছে, অম্বর শ্যামল, নীপ ফুটিয়াছে, ভ্রমর বুলিতেছে; আমার একলা জীবন পরাধীন; প্রাবৃষ (মেঘ) খেলা করিতেছে, মন্মথও খেলা করিতেছে।

তরুণ-তরুণি, তবই ধরণি, পাবণ বহখরা
লগ ণহি জল, বড় মরু থল, জনজীবন হরা।
দিসই বলই, হিঅ আ দুলাই, হামি একলি বহু
ঘর ণহি পিআ, সুণহি পহি আ, মণ ঈচ্ছই কহু৷

তরুণ সূর্যে ধরণী, তপ্ত, বাতাস বহিতেছে খর বেগে, নিকটে নাই জল, জল জীবননাশা বিস্তৃত মরুস্থল (সম্মুখে); ঘরে নাই আমার প্রিয়, আমি একেলা বধু— শোনো গো পথিক, আমার মন কী চায়।

শুধু প্রমের কবিতা, ভক্তিরসের কবিতাই নয়, বীররসের কবিতাও প্রাকৃত-পৈঙ্গলে মিলিতেছে, এবং সেই প্রসঙ্গে বাঙালীর বীরত্বের গৌণ প্রশংসাও আছে। সুকুমার সেন মহাশয় তাহার কিছু কিছু উদ্ধার করিয়াছেন। এই গ্রন্থে শ্ৰীকৃষ্ণরাধাকাহিনী, শ্ৰী রামচন্দ্র প্রভৃতি লইয়াও দুই চারিটি ছোট ছোট কবিতা আছে! একটি শ্লোকে দেখিতেছি, কয়েকটি বিশিষ্ট মাত্ৰা-সংস্থানের নামকরণই হইয়াছে বাঙলাদেশে পজিত চারিজন বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবীর নামানুসারে— লক্ষ্মী, গৌরী, চুন্দা ও মহামায়া। আর একটি শ্লোকে শিবজায়া পাৰ্ব্বতীর দারিদ্র্যময় সংসারের গাৰ্হস্থ্য দুঃখ বৰ্ণনা অত্যন্ত করুণ!

বাল কুমারো ছঅ মুণ্ডধারী, উবা অহীণা মুই এক্ক ণারী।
অহংণিসং খাই বিসং ভিখারী গঈ ভবিত্তী কিল কা হামারী।

ছয় মুণ্ডধারী বালকপুত্র আমার ছয়মুখে খায়, আর আমি এক উপায়হীনা নারী! আমার ভিখারী স্বামী অহৰ্নিশ কেবল বিষ খায়; কী গতি হইবে আমার!

এই বর্ণনা মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে শিবগৃহিণী পার্বতীর গাৰ্হস্থ্য-বৰ্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলিয়া যায়; সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থেরও একাধিক প্রকীর্ণ শ্লোকে একই চিত্র সুস্পষ্ট দৃষ্টিগোচর। সন্দেহ নাই, এ-চিত্র একান্তই বাঙালীর এবং বাঙলার আবহে-পরিবেশে আস্নাত।

শুদ্ধ ও সংযত, স্বচ্ছন্দ ও সমৃদ্ধ সংসারের সংক্ষিপ্ত বাস্তব বর্ণনাও আছে।

পুত্ত পবিত্ত বহুত্ত ধণা ভত্তি কুটুম্বিণি সুদ্ধমনা।
হাঙ্ক তারাসই ভিচ্চগণা কো কর বব্বর সগ্‌গমণা।৷

পুত্র পবিত্র; অনেক ধন; ভর্ত্রী অর্থাৎ স্ত্রী এবং কুটুম্বিনীরা শুদ্ধ স্বভাবা; হাঁকে ত্ৰস্ত হয় ভূত্যগণ; (এমন সব রাখিয়া) কোন বর্বর স্বর্গে যাইতে চায়!

 

গীতগোবিন্দ-রচয়িতা জয়দেব অপভ্রংশ ভাষায়ও গীতিকবিতা রচনা করিতেন। গুর্জরী ও মারূ রাগে গেয় জয়দেবের দুটি গান শিখদের শ্ৰীগুরুগ্রন্থে বা আদিগ্রন্থে স্থান পাইয়াছে, কিছুটা বিকৃত রূপে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তাহা উদ্ধার করিয়াছেন।

ধর্মাশ্রয়ী বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য গীতিকবিতা ছাড়া অপভ্রংশে কিছু কিছু প্রেমের কবিতাও যে বাঙলাদেশে রচিত হইয়াছিল তুর্কী-বিজয়ের আগেই, তাহার পরিচয় তো প্রাকৃত-পৈঙ্গলের কতকগুলি শ্লোকে পাওয়া যাইতেছে। ইহাদের মধ্যে কিছু বাঙলা শব্দ, বাঙলা বাকভঙ্গি, বাঙলা ধরন-ধারণ, সর্বোপরি বাঙলার আবহ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। খুব সম্ভব এই ধরনের কবিতাগুলি বাঙলাদেশেই রচিত হইয়াছিল, এমন অপভ্রংশে যাহার উপর প্রাচীনতম বাঙলা ভাষার প্রভাব অত্যন্ত বেশি।

সৰ্ব্বানন্দের টীকাসর্বস্ব গ্রন্থে বৌদ্ধ ধর্মদাসের বিদগ্ধমুখমণ্ডল-গ্ৰন্থ হইতে কিছু কিছু শ্লোকের উদ্ধৃতি আছে। সুকুমার সেন মহাশয় দেখাইয়াছেন, এই গ্রন্থের কোনও কোনও শ্লোক ও শ্লোকাংশ প্রাকৃত ও অপভ্রংশে, রচিত; প্রাচীনতম বাঙলাভাষারও দু’একটি ছত্র বিদ্যমান। সুনীতিবাবু দেখাইয়াছেন, শেক-শুভোদয়ার উনবিংশ অধ্যায়ে মধ্যযুগীয় বাঙলাভাষায় রচিত একটি প্রেমের কবিতা আছে; কবিতাটি প্রাক-তুর্কী আমলের রচনা বলিয়াই মনে হয়; পরে শোক-শুভোদয়া রচনাকালে সমসাময়িক ভাষায় রূপান্তরিত করা হইয়াছিল।

ডাক ও খনার নামে যে বচনগুলি বাঙলাদেশে আজও প্রচলিত তাহাও বোধ হয় প্রাক-তুর্কী আমলের চলতি প্রবাদ সংগ্রহ; কালে কালে তাঁহাদের ভাষা বদলাইয়া গিয়াছে মাত্র। শুভংকরের  নামে প্রচলিত গণিত-আর্যার শ্লোকগুলিতেও যে অপভ্রংশের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান তাহা অঙ্গুলি সংকেতে দেখাইবার প্রয়োজন আজ আর নাই।

লক্ষণীয় এই যে, এই পর্বে প্রাচীনতম বাঙলায় এবং অপভ্রংশে রচিত সাহিত্যের অল্পস্বল্প যে-সব দৃষ্টান্ত আমাদের গোচর তাহা সমস্তই গীতিকবিতা, এবং তাহার অধিকাংশ সুরে-তালে গোয়। বাঙলা দেশের এই সুপ্রাচীন গীতিকাব্যের ধারার সঙ্গেই মধ্যযুগীয় বাঙলা গীতিকাব্যের প্রবাহ যুক্ত, তাহা বৈষ্ণব-পদাবলীর ধারাই হোক, আর মঙ্গলকাব্যের ধারাই হোক।

মধ্যযুগের চণ্ডীমঙ্গল-মনসামঙ্গল-কাব্যে চাঁদ সদাগর-লখীন্দর-বেহুলা- ধনপতি-লহনা-খুল্লনা-শ্ৰীমন্ত-কালকেতুর যে-কাহিনীর সঙ্গে আমাদের পরিচয়, গোপীচাঁদের গানে রাজা গোপীচন্দ্র-লাউসেন-ময়নামতী বা মদনাবতী-আদুনা-পদুনার যে গল্প আমরা পাইতেছি, এই সব গল্প খুব সম্ভব প্রাক-তুর্কী বাঙলার লোকায়ত স্তরে জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল, এবং অসম্ভব নয়, কিছু কিছু নূতন রচনাও হয়তো হইয়া থাকিবে। তবে, এ-সম্বন্ধে জোর করিয়া কিছু বলিবার উপায় নাই। মনসামঙ্গলের গল্পে অন্তর্বাণিজ্য ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের যে ছবি তাহা মধ্যযুগীয় বাঙলার ছবি নয়; সে-যুগে বাঙলার এই সামুদ্রিক বাণিজ্যসমৃদ্ধি আর ছিল না। মনে হয়, এই চিত্র প্রাচীনতর কালের দূরাগত স্মৃতিমাত্র; তাহারই উপর সমসাময়িক কালের প্রলেপ পড়িয়াছে। তাহা ছাড়া, ব্রাহ্মণ্যধর্মে মনসার প্রতিষ্ঠা নবম-দশম- একাদশ-দ্বাদশ শতকেই; কাহিনীটিতে মনসার যে প্রতাপ দৃষ্টিগোচর তাহা প্রথম প্রতিষ্ঠাকালে হওয়াই স্বাভাবিক। আর, গোপীৰ্চাদের গল্পে তো একাদশ-দ্বাদশ শতকীয় সহজিয়া তান্ত্রিকধর্মের স্রোত সবেগে বহমান।