০৩. পাল-চন্দ্ৰপর্ব – ব্ৰাহ্মণ্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি

পাল-চন্দ্ৰপর্ব ব্ৰাহ্মণ্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি

পাল-বংশ ও পাল-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় এবং তাহার দুই এক শতাব্দী আগে হইতেই বাঙলাদেশে সংস্কৃত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চা পরম উৎসাহে আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল। লোকনাথের ত্রিপুরা-পট্টোলীতে কিংবা ভাস্করবর্মার নিধানপুর-লিপিতে যে অলংকৃত কাব্যরীতির সূচনা দেখা গিয়াছিল সপ্তম শতকে, পাল-বংশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই রীতিরই পরিপূর্ণ বিকাশ ধরা পড়িল। দশম-একাদশ শতকের অগণিত প্রশস্তি লিপিমালায় সংস্কৃত সাহিত্যচর্চা ও রচনারীতির যে-সাক্ষ্য উপস্থিত তাহা মধ্য-ভারতীয় প্রশস্তি-কাব্যরীতির ধারানুযায়ী হইলেও একেবারে উপেক্ষা করিবার মতো নয়। তাহা ছাড়া এই লিপিগুলিতে সমসাময়িক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও শিক্ষা-দীক্ষার যে প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া যায়, ইতিহাসের দিক থেকে তাহা মূল্যহীন নয়। এই লিপিগুলি এবং চতুর্ভুজের হরিচারিত-কাব্য হইতে জানা যায়, বাঙলাদেশে যে-সকল বিদ্যার চর্চা হইত, বেদ, আগম, নীতি, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ, তর্ক, মীমাংসা, বেদান্ত, প্রমাণ, শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, কাব্য প্রভৃতি সমস্তই তাহার অন্তর্গত ছিল। চারি বেদেরই অধ্যয়ন-অধ্যাপনা হইত, যজুৰ্বেদীয় বাজসনেয়ী শাখার প্রসারই ছিল বেশি। এই সব বিচিত্র বিদ্যার চর্চা যে শুধু ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত ও বিদ্বজন সমাজেই আবদ্ধ ছিল তাঁহাই নয়; মন্ত্রী, সেনানায়ক প্রভৃতি রাজপুরুষেরাও এই সব শাস্ত্রের অনুশীলন করিতেন। দর্ভপাণি, কেদারমিশ্র ও গুরুত্বমিশ্রের অগাধ পাণ্ডিত্যের কথা, যোগদেব, বোধিদেব ও বৈদ্যদেবের বিস্তৃত শাস্ত্রানুশীলনের কথা, ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিত-সমাজে নানা বিদ্যাচর্চার কথা বর্ণ-বিন্যাস ও ধৰ্মকৰ্ম-অধ্যায়ে বলিয়াছি, এখানে আর পুনরুক্তি করিয়া লাভ নাই। এই বিদ্যানুশীলনের অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান কী কী ছিল, পাঠক্রম কী ছিল, তাহার বিবরণ বা আভাস পর্যন্ত কিছু পাইতেছি না; তবে, অনুমান হয়, ব্ৰাহ্মণ-পণ্ডিতেরা নিজেদের গৃহে কিংবা বড় বড় মন্দিরকে আশ্রয় করিয়া ক্ষুদ্র বৃহৎ চতুষ্পাঠী গড়িয়া তুলিতেন এবং সাধ্যানুযায়ী বিদ্যার্থী সংখ্যা গ্ৰহণ করিতেন। একজন আচার্যই যে সমস্ত বিদ্যার অধিকারী হইতেন এমন নয়; বিদ্যার্থীরা এক বা একাধিক শাস্ত্ৰে এক জনের নিকট শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া অন্য শাস্ত্ৰ পাঠ করিবার জন্য অন্য বিশেষজ্ঞ আচার্যের দুয়ারে উপস্থিত হইতেন। প্রয়োজন হইলে বিদ্যা ও শাস্ত্রাভ্যাসের জন্য বিদ্যার্থীরা ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশে গিয়া প্রবাস-জীবনও যাপন করিতেন। ক্ষেমেন্দ্রের দশোপদেশ-গ্রন্থের সাক্ষ্যে মনে হয়, বাঙালী বিদ্যার্থীরা কাশ্মীরে যাইতেন বিদ্যালাভের জন্য এবং সেখানে তর্ক, মীমাংসা, পাতঞ্জল-ভায্য প্রভৃতির অনুশীলন করিতেন। বাঙালী বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ আচার্যরাও যে আমন্ত্রিত হইয়া বাঙলার বাহিরে নানাস্থানে যাইতেন বিদ্যাদান ও ধর্মপ্রচারোদেশে, তাহার নানা প্রমাণ বিদ্যমান। অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা যাঁহারা করিতেন, রাজা-মহারাজ ও সামন্ত-মহাসামগুরা সম্পন্ন ব্যক্তিরা তাঁহাদের অধ্যয়ন-অধ্যাপনার জন্য অর্থদান, ভূমিদািন ইত্যাদি করিতেন, এমন সাক্ষ্যও ষে নাই তাহা নয়। পণ্ডিত, কবি, আচার্য প্রভৃতিদের মাঝে মাঝে তাহারা পুরুস্কৃতও করিতেন, সে সাক্ষ্যও বিদ্যমান। লিপিমালা ও সমসাময়িক সাহিত্যে এ-সব সাক্ষ্য বিস্তৃত।

ভাষায় কথা

এই পর্বে অর্থাৎ আনুমানিক ৮০০-১১০০র মধ্যে এবং তাহার পরেও বাঙলাভাষা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত সাহিত্যিক ভাষা হিসাবে বাঙলাদেশে সংস্কৃত, বিভিন্ন প্রকারের প্রাকৃত এবং শৌরসেনী অপভ্ৰংশ এই তিন রকমের ভাষা প্রচলিত ছিল। শিল্পে ও সাহিত্যে, জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে, দর্শনে ও বিচারে, শিক্ষায় ও দীক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা সকলেই সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করিতেন; সকলেরই চেষ্টা ছিল প্রাকৃতজনের কথ্যভাষাকে শুদ্ধ ও সংস্কৃত করিয়া ব্যাকরণসম্মত করিয়া নিজের বক্তব্যকে প্রকাশ করিবার। এই শুদ্ধ, ‘সংস্কৃত, ব্যাকরণসম্মত ভাষাই সংস্কৃত ভাষা। প্রাকৃতের চর্চা বাঙলাদেশে বড় একটা হইত না; অন্তত বাঙলাদেশে প্রাকৃতে সাহিত্যরচনার কোনো ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত হইতে পারে নাই; তাহার পরিচয়ও নাই। এ-দেশের মহাযানী-বজ্রযানী প্রভৃতি বৌদ্ধারাও যে-ভাষা ব্যবহার করিতেন তাহাও হয় শুদ্ধ সংস্কৃত না হয় প্রাকৃতাশ্রয়ী মিশ্র সংস্কৃত যাহাকে বলা হয় ‘বৌদ্ধ সংস্কৃত। দশম শতকে গৌড়জনের সাহিত্যরুচির পরিচয় দিতে গিয়া সেইজন্যই কাব্যমীমাংসার লেখক রাজশেখর বলিতেছেন,

গৌড়ােদ্যাঃ সংস্কৃতস্থঃ পরিচিতরুচিয়ঃ প্রাকৃতে লাটদ্দেশ্যাঃ।

স্পষ্টতই বোঝা যাইতেছে, গৌড় ও প্রতিবাসী জনপদগুলিতে সংস্কৃতের চর্চাই ছিল বেশি, প্রাকৃতের তেমন ছিল না। এদেশীয় পণ্ডিতদের সংস্কৃত উচ্চারণের প্রশংসাও রাজশেখর করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহাদের প্রাকৃত বাচনভঙ্গি ছিল কুষ্ঠিত।

পঠন্তি সংস্কৃতং সুঠু কুণ্ঠঃ প্রাকৃত বাচি তে।
বাণারসীতঃ পূর্বেণ যে কেচিন মগধাদয়ঃ ॥

রাজশেখর বাঙালীর এই কুষ্ঠিত প্রাকৃত উচ্চারণ লইয়া একটু বিদ্রুপই করিয়াছেন। দেবী সরস্বতী গৌড়বাসীর প্রাকৃত উচ্চারণে অতিষ্ঠ হইয়া নিজের অধিকার ত্যাগ করিবার সংকল্প করিয়া ব্ৰহ্মাকে গিয়া বলিলেন, হয় গৌড়জনেরা প্রাকৃত ছাড়ক, না হয় অন্য সরস্বতী হউক।

ব্ৰহ্মন বিজ্ঞাপয়ামি ত্বাং স্বাধিকারজিহাসয়া।
গৌড়স্ত্যজতু বা গাথামন্যা বাহঞ্জ সরস্বতী।

গৌড়ীয়দের প্রাকৃত উচ্চারণের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে রাজশেখর বলিয়াছেন, ইহাদের পাঠ অস্পষ্টও নয় আঁতি স্পষ্টও নয়, রুক্ষও নয় অতি কোমলও নয়, গভীরও নয় অতি-তীব্ৰও নয়।

যাহা হউক, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ছাড়া এবং প্রাকৃতের চেয়ে অনেক বেশি প্রচলিত ছিল পশ্চিমী বা শৌরসেনী অপভ্রংশ, যে-ভাষার প্রসার ও প্রতিষ্ঠা ছিল সমগ্র উত্তর-ভারত ব্যাপিয়া এবং মহারাষ্ট্র ও সিন্ধুদেশেও। বাঙলাদেশের সহজযানী সিদ্ধাচার্যরা এবং ব্রাহ্মণ্য কবিরাও কেহ কেহ শৌরসেনী অপভ্রংশে কিছু কিছু কাব্য রচনা করিয়া গিয়াছেন; কাহ্নপাদ, সরহপাদ প্রভৃতি সাধকেরা এই ভাষাতেই তাহদের দোহাগুলি রচনা করিয়াছিলেন আর পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় মৈথিল কবি বিদ্যাপতি এই শৌরসেনী অপভ্রংশেই তাঁহার কীর্তিলতা কাব্য রচনা করেন।

এই পর্বে লোকায়াত বাঙালী সমাজের লোকভাষা ছিল মাগধী অপভ্রংশের গৌড়-বঙ্গীয় রূপ যে-রূপ ক্রমশ প্রাচীন বাঙলা ভাষায় বিবর্তিত হইতেছিল। এই মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় রূপের সঙ্গে শৌরসেনী অপভ্রংশের খুব বড় একটা পার্থক্য কিছু ছিল না; একটা যিনি বুঝিতেন অন্যটা। বুঝিতে তাহার খুব বেশি পরিশ্রম করিতে হইত না। আর, এই দুই ভাষাই ছিল খুব সহজবোধ্য এবং নিরক্ষার জনসাধারণের অধিগম্য। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের উদ্দেশ্য ছিল, তাহাদের ধর্মের তত্ত্বকথা লোকায়ত ভাষায় জনসাধারণের চিত্তদুয়ারে পৌছাইয়া দেওয়া। এই উদ্দেশ্যে তাহারা এবং কোনও কোনও পণ্ডিতেরা, এই দুই ভাষাই বেশি ব্যবহার করিতে আরম্ভ করেন। ক্রমে মাগধী অপভ্রংশ যখন প্রাচীন বাঙলা ভাষায় বিবর্তিত হইতে আরম্ভ করিল। তখন সৃজ্যমান এই নূতন ভাষাকেও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা সানন্দে ও সাভার্থনায় গ্রহণ করিলেন। প্রাচীন বাঙলার চর্যাগীতিগুলিই এই নূতন সৃজ্যমান ভাষার একমাত্র পরিচয়। কিন্তু, এই ভাষা তখনও সূক্ষ্ম ও গভীর ভাব-প্রকাশের বাহন হইয়া উঠিতে পারে নাই; ধর্ম ও তুত্ত্বকথা বুঝাইবার জন্য যতটুকুই প্রয়োজন ততটুকুই মাত্র ইহার বিস্তার ও গভীরতা! বস্তুত, তুর্কী-বিজয়ের পূর্বে বাঙলাদেশে দুই-তিন শতাব্দী ধরিয়া শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং নৃত্ন বাঙলা ভাষা লইয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলিতেছিল মাত্র। শিক্ষিত, বিদগ্ধ ও সংস্কৃতিপূত চিত্ত লোকদের মধ্যে প্রাথ সরবুদ্ধি ও গণচেতনাসম্পন্ন মাত্র কিছু কিছু পণ্ডিত ও কবি এই কার্যে ব্ৰতী হইয়াছেন এবং তাঁহাদের মধে সকলেই কিন্তু সাহিত্যধর্মী বা কবিধর্মী ছিলেন না।

ধর্ম, দর্শন, ব্যাকরণ, অলংকার, ব্যবহার, চিকিৎসা-বিদ্যা প্রভৃতি সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা যখন গ্রন্থাদি লিখিতেন তখন সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনও ভাষার আশ্রয় লওয়ার কথা তাহাদের মনেই হইত না। কাজেই এ-পর্বে জ্ঞান বিজ্ঞান সম্বন্ধে যত গ্ৰন্থ রচিত হইয়াছে তাহা সমস্তই সংস্কৃত ভাষায় এবং সেই কারণেই এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার শিক্ষিত, পণ্ডিত ও উচ্চকোটি সমাজেই আবদ্ধ ছিল। বাঙলাদেশে সংস্কৃত-চৰ্চা এবং বিশেষভাবে সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্যচর্চার প্রাবল্য এর আগের পর্বেই দেখা দিয়াছিল, নহিলে গৌড়ীরীতির উদ্ভব এবং বিকাশই সম্ভব হইত না। এই পর্বে তাহা আরও সমৃদ্ধি, আরও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে এবং বাঙালীর কল্পনোজল প্রতিভা নানা সূক্তি ও শ্লোকে, নানা কাব্যে আপনাকে প্রকাশ করিয়াছে। ‘কালিদাস ভবভূতি-ভারবি বাণভট্ট-রাজশেখর পড়িয়া ব্লসগ্রহণের সামর্থ্য না থাকিলে এই পর্বের অগণিত বাঙালী কবির পক্ষে এই সব প্রকীর্ণ শ্লোক ও কাব্য রচনা সম্ভবই হইত না। এই অনুমানও বোধ হয় সঙ্গত যে, পণ্ডিত-সমাজেব বাহিরে একটি বৃহত্তর সাধারণ সংস্কৃত শিক্ষিত সমাজও ছিল যাহার লোকেরা এই সব শ্লোক ও কাব্য পড়িয়া তাহদের রস গ্রহণ করিতে পারিতেন! এই হিসাবে কাবা ও নাটকের সামাজিক বিস্তার বেশি ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু কথ্যভাষার সাহিত্যিক রূপ অপভ্রংশের সঙ্গে তাহার তুলনা হইতে পারে না। সংস্কৃতে যাঁহারা লিখিতেন, তাঁহাদের মানসিক ও সামাজিক পরিধির মধ্যে বৃহত্তর জনসমাজের স্থান ছিল না, এ-কথা বলিলে অনৈতিহাসিক কিছু বলা হয়। না; তবে, তাহাদের কাহারও কাহারও রচনায় বৃহত্তর জনসমাজের নানা সুখ-দুঃখ-আনন্দ –বেদনা-ভাবনা-কল্পনা বস্তুময় কাব্যময় রূপ লাভ করিয়াছে, এ-কথাও সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করিতে হয়। যাহাই হউক, এ-তথ্য অনস্বীকার্য যে, সংস্কৃত এখন আর শুধু কোনওপ্রকারে নিজেকে ব্যক্তি করিবার ভাষামাত্র নয়; এই পর্বে তাহা মানবজীবনের সূক্ষ্ম ও গভীর ভাবকল্পনা প্রকাশের ভাষা হইয়া উঠিয়াছে।

কিন্তু নানা বিদ্যা ও শাস্ত্ৰে যে পরিমাণ অধ্যয়ন-অধ্যাপনা-অনুশীলনের সংবাদ লিপিমালা ও সমসাময়িক সাহিত্যে পাইতেছি, সেই অনুপাতে গ্রন্থ-রচনা ও গ্রন্থ-রচয়িতাদের সংবাদ— রৌদ্ধ সংস্কৃত ও প্রাকৃত গ্রন্থের ছাড়া- কমই পাওয়া যাইতেছে, এবং যাহা পাওয়া যাইতেছে তাহাও সব বাঙালীর এবং বাঙলাদেশের রচনা কিনা, নিশ্চয় করিয়া বলা কঠিন। শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং প্রাচীনতম বাঙলায় রচিত বৌদ্ধ-গ্ৰস্থাদির কথা পরে বলিতেছি। আপাতত ব্ৰাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃত গ্রন্থাদির কথা বলা যাইতে পারে।

সংস্কৃত গ্রন্থাদি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য

প্রাচীন বাঙলায় বেদ-চর্চা যে খুব বেশি হইত, এমন নয়, তবে উচ্চ পণ্ডিত সমাজে কিছু কিছু নিশ্চয় হইত, এবং লিপিমালায়ও এমন প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। কিন্তু, বৈদিক ক্রিয়াকম-যাগযজ্ঞ সম্বন্ধে এই পর্বে মাত্র একখানা পুঁথির খবর পাইতেছি। কেশবমিশ্রর ছান্দোগ্য-পরিশিষ্ট গ্রন্থের উপর প্রকাশ নামে একটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন নারায়ণ নামে জনৈক বেদজ্ঞ পণ্ডিত। নারায়ণের পিতা ছিলেন গোণ, পিতামহের নাম উমাপতি এবং ইহারা ছিলেন উত্তর- রাঢ়ের অধিবাসী। উমাপতি ছিলেন জয়পালের সমসাময়িক এবং নারায়ণ, দেবপালের।

গৌড়পাদ বা গৌড়াচার্যের পর অধ্যাত্মচিন্তা এবং দর্শনশাস্ত্র সম্বন্ধে গ্রন্থ-রচনা করিয়া সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন ন্যায়কন্দলী-রচয়িতা শ্ৰীধর-ভট্ট। বেদ, বেদান্ত, বিভিন্ন দর্শনের চর্চা বাঙলাদেশে কম হইত না (লিপি-সাক্ষ্যই তাহার প্রমাণ) গ্ৰন্থ-রচনাও কিছু কিছু হইয়া থাকিবে, কিন্তু কালের হাত এড়াইয়া আমাদের কালে আসিয়া সে-সব পৌছায় নাই। শ্ৰীধরের ন্যায়কন্দলী শুধু বাচিয়া আছে এবং তোহা এই পর্বেরই রচনা। নায়কন্দলী ছাড়া শ্ৰীধর অদ্বয়সিদ্ধি, তত্ত্বপ্ৰবোধ, তত্ত্বসংবাদিনী এবং সংগ্ৰহটীকা নামে অন্তত আরও চারখানি বেদান্ত ও মীমাংসা বিষয়ের পুঁথি রচনা করিয়াছিলেন, কিন্তু ইহাদের একটিও আজ বাচিয়া নাই। প্রশস্তপাদের পদার্থ-ধর্ম-সংগ্ৰহ নামে বৈশেষিক সূত্রের যে ভাষ্য আছে, ন্যায়কন্দলী-গ্ৰন্থ তাহারই টীকা। শ্ৰীধর-ভট্টই বোধ হয় সর্বপ্রথম এই গ্রন্থে ন্যায়বৈশেষিক মতের আস্তিক্য ব্যাখ্যা দান করেন এবং সেই হিসাবেই ন্যায়কন্দলীর সবিশেষ মূল্য। ন্যায়কন্দলী বাঙলাদেশে খুব সমাদর লাভ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয় না; খুব পঠিত বা আলোচিতও বোধ হয় হইত না। এই গ্রন্থের একটি টীকাও বাঙলাদেশে রচিত হয় নাই। যে দু’টি মূল্যবান টীকার কথা আমরা জানি তাহার একটির রচয়িতা মৈথিলী পণ্ডিত পদ্মনাভ এবং আর একটির পশ্চিম-ভারতীয় জৈনাচার্য রাজশেখর। শ্ৰীধর-ভট্টের পিতার নাম ছিল বলদেব, মাতার নাম আবেবাকা বা অভ্ৰোকী; জন্ম দক্ষিণ-রাঢ়ের সুপ্ৰসিদ্ধ ভূরিশ্রেষ্ঠ গ্রামে, এবং ন্যায়কন্দলী-গ্ৰন্থ রচিত হইয়াছিল ৯১৩ বা ৯.১০ শকে, জনৈক “গুণরত্নাভরণ কায়স্থ কুলতিলক” পাণ্ডুদাসের অনুরোধে এবং পৃষ্ঠপোষকতায়।

শ্ৰীধর-ভট্টের সমসাময়িক ছিলেন লক্ষণাবলী, কিরণাবলী (দুইটিই প্রশস্তপাদাভায্যের টীকা), কুসুমাঞ্জলি এবং আত্মতত্ত্বৰিবেক-গ্রন্থের রচয়িতা উদয়ন। কুলজী—ঐতিহ্য মতে উদয়ন ছিলেন ভাদুড়ী-গাঞী বরেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণ; কিন্তু এই ঐতিহ্য কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন। উদয়ন তাহার রচনায় এক স্থানে বলিয়াছেন, গৌড়মীমাংসক যথার্থ বেদজ্ঞান বিরহিত ছিলেন। এই গৌড়মীমাংসক বলিতে তিনি কি শ্ৰীধর-ভট্টকে বুঝাইতেছেন, না, গৌড়ীয় মীমাংসা-শাস্ত্ৰজ্ঞ সকল পণ্ডিতকেই বুঝাইতেছেন, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় না। উদয়ন বাঙালী হইলে এই উক্ত করিতেন। কিনা সন্দেহ। আশ্চর্য এই, আনুমানিক ত্ৰয়োদশ শতকে বাঙালী গঙ্গেশ-উপাধ্যায়ও গৌড়মীমাংসক সম্বন্ধে একই উক্তি করিয়াছেন।

বেদান্তদর্শন চর্চা বাঙলাদেশে বোধ হয় খুব বেশি ছিল না; ন্যায়-বৈশেষিক এবং বৌদ্ধ মাধ্যমিক দর্শনের আদরই ছিল বেশি। কৃষ্ণমিশ্র রচিত প্ৰবোধচন্দ্ৰোদয়-নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে আছে, দক্ষিণ-রাঢ়বাসী ব্ৰাহ্মণ অহঙ্কার কাশীতে গিয়া সেখানে বেদান্ত-চৰ্চার বাহুল্য দেখিয়া বিদ্রুপ করিয়া বলিতেছেন,

প্ৰত্যক্ষাদি প্রমাসিদ্ধ বিরুদ্ধার্থবিবোধিনঃ।
বেদান্তাং যদি শাস্ত্ৰাণি বোদ্ধৈঃ কিমপরাধ্যতে।।
প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ যাঁরা অসিদ্ধ ও বিরুদ্ধার্থজ্ঞাপক বলিয়া মনে করেন, বেদান্ত যদি শাস্ত্ৰ হয়, তাহা হইলে বৌদ্ধরা কি অপরাধ করিল!

গৌড়নিবাসী এক অভিনন্দ নামীয় লেখকের যোগবাশিষ্ঠ-সংক্ষেপ নামে একটি গ্রন্থের সংবাদ আমরা জানি। নামেই প্রমাণ যে গ্রন্থটি যোগবাশিষ্ঠের সংক্ষিপ্ত সার; সমগ্র বিষয়বস্তু ৬ প্রকরণ এবং ৪৬টি সর্গে বিন্যস্ত। গ্রন্থের শেষে লেখক সম্বন্ধে একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় আছে : “তৰ্কবাদীশ্বর-সাহিত্যাচার্য-গীড়মণ্ডলালঙ্কার-শ্ৰীমৎ—”। অভিনন্দ ন্যায়শাস্ত্র এবং সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন বলিয়া মনে হয়।

ব্যাকরণ ও অভিধান-চৰ্চা

এই পর্বে ব্যাকরণ-রচনায় চন্দ্ৰগোমীর ধারা রক্ষা করিয়াছেন দুই বৌদ্ধ বৈয়াকরণিক, মৈত্ৰেয়-রক্ষিত এবং জিনেন্দ্রিবৃদ্ধি। জিনেদ্রবৃদ্ধি ‘বোধিসত্ত্ব-দেশীয়াচার্য বলিয়া আত্ম পরিচয় দিয়েছেন; তিনি বিবরণ-পঞ্জিকা (বা ‘ন্যাস নামে পরিচিত) নামে কাশিকার উপর একটি সুবিস্তৃত টীকা রচনা করিয়াছিলেন। মৈত্ৰেয়-রক্ষিত জিনেৰুদ্ৰবুদ্ধির বিবরণ পঞ্জিকার উপর তন্ত্রপ্ৰদীপ নামে একটি টীকা রচনা করিয়ছিলেন এবং ভীমসেন-রচিত ধাতুপাঠ অবলম্বন করিয়া ধাতুপ্ৰদীপ নামে আর একটি ব্যাকরণ-গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন। টাকাসর্বস্ব রচয়িতা সর্বানন্দ, শরণদেব, উজ্জ্বলদত্ত, বৃহস্পতি রায়মুকুট, ভট্টোজি দীক্ষিত অনেক ব্যাকরণ ও অভিধানকার মৈত্ৰেয়-রক্ষিতের তন্ত্রপ্ৰদীপ গ্ৰন্থ নিজ নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করিয়াছেন।

সুভূতিচন্দ্ৰ নামে একজন বৌদ্ধ অভিধানকার কামধেনু নামে অমরকোষের একটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন; গ্রন্থটি আজ বিলুপ্ত, কিন্তু তাহার তিব্বতী অনুবাদের কথা ত্যাঙ্গুরে তালিকাবদ্ধ করা হইয়াছে। রায়মুকুট ও শরণদেব কয়েকবারই সুভূতিচন্দ্রর মতামত উদ্ধার করিয়াছেন; সেই জন্যই অনুমান হয় সুভূতিচন্দ্র বাঙালী হইলেও হইতে পারেন।

চিকিৎসা-শাস্ত্ৰ চক্ৰপাণিদত্ত। সুরেশ্বর। বঙ্গসেন

এ পর্বের শ্রেষ্ঠ সর্বভারতীয় রোগনিদানবিদদের অন্যতম চক্ৰপাণি-দত্ত নিঃসন্দেহে বাঙালী। তাহার পিতা নারায়ণ জনৈক গৌড়রাজের পাত্র (রাজকর্মচারী) এবং রসবত্যধিকারী (রন্ধনশালার তত্ত্বাবধায়ক) ছিলেন। চক্ৰপাণির ষোড়শ শতকীয় বাঙালী টীকাকার শিবদাস-সেন যশোেধর বলিতেছেন, এই গৌড়রাজ ছিলেন পালরাজ জয়পাল। চক্ৰপাণির বংশ লোধুবলি কুলীন; শিবদাস-সেন বলিতেছেন, লোপ্ৰবলি কুলীনারা দত্ত-বংশেরই একটি শাখা এবং মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যমতে ইহাদের বাড়ি বীরভূমে। চক্ৰপাণির একত্ৰাতা ভানুও ছিলেন রোগ-নিদান শাস্ত্ৰে। সুপণ্ডিত ও সুচিকিৎসক বা অন্তরঙ্গ; তাহার (চক্ৰপাণির) গুরুর নাম ছিল নরদত্ত। চক্ৰপাণি-দত্ত চরকের যে টীকা রচনা করিয়াছেন তাহার নাম আয়ুর্বেদ-দীপিকা বা চরকা-তাৎপর্য-দীপিকা এবং তদ্রচিত সুশ্রুতি-টীকার নাম ভানুমতী! তাহার অন্য দুইটি ক্ষুদ্রতর গ্রন্থের নাম-যথাক্রমে শব্দচন্দ্রিকা ও দ্রব্যগুণসংগ্ৰহ। শব্দচন্দ্ৰিক ভেষজ গাছ-গাছড়া এবং আকর দ্রব্যাদির তালিকা এবং দ্রব্যগুণসংগ্ৰহ পথ্যাদি-নিরূপণ সংক্রান্ত পুঁথি। কিন্তু চক্ৰপাণির শ্রেষ্ঠ মৌলিক গ্রন্থ হইতেছে চিকিৎসা-সংগ্রহ; এই গ্ৰন্থ রোগবিনিশ্চয়-প্রণেতা মাধবের এবং সিদ্ধযোগ-প্রণেতা বৃন্দের আলোচনা-গবেষণার ধারাই অনুসরণ করিয়াছে, সন্দেহ নাই; কিন্তু তৎসত্ত্বেও চিকিৎসা-সংগ্ৰহ ভারতীয় চিকিৎসা-শাস্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক গ্ৰন্থ, এবং ধাতব দ্রব্য প্রকরণে চক্ৰপাণি যে মৌলিকত্ব দেখাইয়াছেন তাহা উল্লেখযোগ্য।

পাল-পর্বের শেষ অধ্যায়ে কিংবা তাহার কিছু পরেই আরও দুইজন নিদান-শাস্ত্রবিদ পণ্ডিতের কথা জানা যায়, একজন সুরেশ্বর বা সুরপাল, আর একজন বঙ্গসেন। সুরেশ্বরের পিতামহ দেবগণ চন্দ্ররাজ গোবিন্দ চন্দ্রের অস্তুরঙ্গ বা সভা-চিকিৎসক ছিলেন, পিতা ভদ্ৰেশ্বর ছিলেন। বঙ্গেশ্বর রামপালের সভা-চিকিৎসক; আর সুরেশ্বর নিজে ছিলেন ভীমপাল নামে জনৈক নরপতির অন্তরঙ্গ। তদ্রচিত শব্দপ্রদীপ এবং বৃক্ষায়ুৰ্বেদ দুইই ভেষজ গাছ-গাছড়ার তালিকা ও গুণাগুণবিচার; কিন্তু তাহার লোহ পদ্ধতি বা লৌহসর্বস্ব। লোহার ভেষজ ব্যবহার এবং লৌহঘটিত ঔষধাদি প্রস্তুত সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বঙ্গসেনের পিতা ছিলেন কাঞ্জিকবাসী গদাধর এবং তদ্রচিত গ্রন্থের নাম চিকিৎসা-সার সংগ্ৰহ। বঙ্গসেন সুশ্রুতিপন্থী। কিন্তু মাধব-রূচিত রোগ-বিনিশ্চয় গ্রন্থের প্রতি তাহার ঋণ সামান্য নয়।

ধর্মশাস্ত্ৰ। জিতেন্দ্ৰিয়। বালক

লিপি-সাক্ষ্যে মনে হয়, মীমাংসার চর্চা বাঙলাদেশে হইত না এমন নয়, কিন্তু মীমাংসা ও ধর্মশাস্ত্ৰ লইয়া এই পর্বে কেহ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ কিছু রচনা করিয়াছিলেন, এমন নিঃসংশয় প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে না। জিতেন্দ্ৰিয় ও বালক নামে দুইজন ধর্মশাস্ত্ৰxরচয়িতার উল্লেখ ও বচন উদ্ধার করিয়াছেন জীমূতবাহন, শূলপাণি, রঘুনন্দন, প্রভৃতি পররর্তী বাঙালী স্মৃত্তিকারেরা। কোনো অবাঙালী স্মৃতিকার ইহাদের উদ্ধার বা আলোচনা করেন নাই; সেই জন্য, মনে হয়। ইহারা দুইজনই ছিলেন বাঙালী এবং একাদশ শতকের কোনও সময়ে ইহারা প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। ইহাদের কাহারও রচনা কালের হাত এড়াইয়া বঁচিয়া নাই; তবে শুভাশুভকাল সম্বন্ধে জিতেন্দ্ৰিয়ের রচনা উদ্ধার করিয়া জীমূতবাহন তাহার সমালোচনা করিয়াছেন। কালবিবেক-গ্রন্থে; ব্যবহার ও প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে জিতেন্দ্ৰিয়ের বচন উদ্ধার ও সমালোচনা জীমূতবাহন করিয়াছেন দায়ভাগ ও ব্যবহার মাতৃকাগ্রন্থে এবং রঘুনন্দন করিয়াছেন দায়তত্ত্ব-গ্রন্থে। বালক ব্যবহার ও প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া থাকিবেন, কারণ জীমূতবাহন, শূলপাণি ও রঘুনন্দন এই তিনজনই দুই বিষয়ে বালকের মতামত সমালোচনা করিয়াছেন; জীমূতবাহন তো তাহার মতামতকে ‘বাল্যবচন বলিয়া বিদুপই করিয়াছেন। ইহাদের চেয়েও প্রাচীনতর (“পুরাতন”), যোগ্লোক নামে একজন স্মৃতিকারের মতামত আলোচনা করিয়াছেন জীমূতবাহন ও রঘুনন্দন , ইনি শুভাশুভ কাল সম্বন্ধে ব্যবহার সম্বন্ধীয় একটি ‘বৃহৎ ও একটি “লঘু গ্ৰন্থ রচনা করিয়া থাকিবেন। কিন্তু ধর্মশাস্ত্ৰ, মীমাংসা প্রভৃতি লইয়া বাঙালী স্মৃতিকারের যে উৎসাহ পরবর্তী সেনা-বর্মণ পর্বে দেখা যাইবে, সে-উৎসাহের সূত্রপাত এই পর্বে এখনও হয় নাই।

এই পর্বে একটি মাত্র জ্যোতিষ-গ্রন্থের খবর আমরা জানি; গ্রন্থটি জনৈক কল্যাণবৰ্মা রচিত সারাবলী। মল্লিনাথ (শিশুপালবধ-টীকা), উৎপল এবং আল-বেরুণী এই তিনজনই সারাবলী হইতে বচন উদ্ধার করিয়াছেন। কল্যাণবর্ম গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে “ব্যাঘাতটীশ্বর” বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। এই ব্যাঘ্রতটী নিঃসন্দেহে খালিমপুর-লিপির ব্যাঘ্রতটী।

সাহিত্য। কাব্য। নাটক

এই পর্বের প্রশস্তি-লিপিমালায় সমসাময়িক বাঙলার কাব্যসাহিত্যের এবং কাব্যচর্চার মোটামুটি একটা পরিচয় পাওয়া যায়। এই সব প্রশস্তি সাধারণত সভাকবিদেরই রচনা এবং উপমায় রূপকে, অনুপ্রাসে-অলংকারে, ছায়ায়-ছবিতে একান্তই মধ্য-ভারতীয়, বস্তুত সৰ্বভারতীয় কাব্যৈহিত্যের অনুগামী। কোনো মৌলিক কল্পনা বা রীতি বা ভঙ্গি এই প্রশস্তিরচনাগুলির মধ্যে ওয়া যায় না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও দুই চারিটি দৃষ্টান্ত উদ্ধার করিলেই বোঝা যাইবে, গতানুগতিক ধারার কাব্যরচনা-শক্তিতে সমসাময়িক বাঙালী কিছু হীন ছিল না।

সিদ্ধার্থস্য পরার্থ সুস্থিত মতেঃ সন্মাগমভ্যস্যতঃ
সিদ্ধিঃ সিদ্ধিমনুত্তরাং ভগবতস্তস্য প্রজাসু ক্রিয়াৎ।
যস্ত্ৰৈধাতুকসত্বসিদ্ধিপদবীরত্যুগ্রবীৰ্যোদয়াজ
জিত্ব নিবৃতিমাসসাদ সুগতঃ সন সর্বভূমীশ্বরঃ।

যাঁহার মতি পরার্থে সুস্থিত, যিনি সৎমার্গ অভ্যাস করিয়াছেন, যিনি অত্যুগ্রবীর্য বলে ত্ৰিলোকবাসী জীবের সিদ্ধির উপায় জয় করিয়া নিবৃত্তি লাভ করিয়াছেন, যিনি সুগত এবং যিনি সর্বভূমীশ্বর, এমন ভগবান সিদ্ধার্থের সিদ্ধি তাঁহার প্রজাদিগকে অনুত্তর সার্থকতা দান করুক।

(দেবপালদেবের মুঙ্গের ও নালন্দা-লিপির প্রথম শ্লোক)

মৈত্রীং কারুণ্যরত্নপ্রমুদিতহাদয়ঃ প্রেয়সীং সন্দধানঃ সম্যকসম্বোধিবিদ্যাসরিদমলজলক্ষালিতাজ্ঞানপঙ্কঃ।
জিত্ব যঃ কামকারি প্রভাবভিভবং শাশ্বতীং প্রাপ্য শান্তিং
স শ্ৰীমান লোকনাথো জয়ক্তি দশক লোহ নাশ্চ গোপালদেবঃ ॥

যিনি কারুণ্যরত্নপ্রমুদিত হৃদয়ে মৈত্রীকে প্রেয়সীরূপে ধারণ করিয়াছেন, যিনি সম্যক সম্বোধিবিদ্যারূপ নদীর অমল জলে অজ্ঞান পাঙ্ক ক্ষালন করিয়াছেন, যিনি মোররূপ অরির আক্রমণ পরাভূত করিয়া শাশ্বত শাস্তি প্রাপ্ত হইয়াছেন, এমন শ্ৰীমান দশাবল লোকনাথ এবং গোপালদেব জয়যুক্ত হউন।

(নারায়ণপালদেবের ভাগলপুর-লিপির প্রথম শ্লোক)

বন্দো জিনঃ স ভগবান করুণৈকপাত্ৰং ধর্মোেহপ্যাসৌ বিজয়তে জগদেকদীপঃ
যৎসেবয়া সকল এব মহানুভবঃ সংসারপারমুপগচ্ছতি ভিক্ষু সঙঘঃ ॥

করুণার একমাত্র পাত্র ভগবান জিন বন্দিত হউন; জগতের একমাত্র দীপ ধৰ্মও জয়যুক্ত হউন; ইহাদের সেবায় সকল মহানুভবভিক্ষুসংঘ সংসারের পার প্রাপ্ত হয়।

(শ্ৰীচন্দ্রদেবের রামপাল ও কেদারপুর-লিপির বন্দনা শ্লোক)

বাল্যৎ প্রভৃত্যহরহার্যদুপসিতাসি বাগদেবতে তদধুনা ফলতু প্ৰসীদ।
বক্তাস্মি ভট্টভবদেবকুলপ্রশস্তিসূক্তাক্ষরণি রসনাগ্রমধিশ্রয়েথাঃ।

হে বাগদেবি, বাল্যকাল হইতে তুমি প্রত্যহ উপাসিত হইয়াছ, সেই উপাসনা এখন ফলবতী হউক, তুমি প্রসন্না হও। ভট্টভবদেবের কুলপ্রশস্তি সুললিত ভাষায় বর্ণনা করিব, তুমি রসনাগ্রে অধিষ্ঠিত হও।

(ভট্ট-ভবদেবের ভুবনেশ্বর-প্রশস্তি; রচয়িত বাচস্পতি কবি)

ভট্ট গুরবমিশ্রেীর প্রশস্তি, ভোজ্যবর্মার বেলাব প্রশস্তি, সমস্তই এ-যুগের কাব্যচর্চার বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত। বৈদ্যদেবের কমৌলি-লিপিটির রচয়িতা কবি মনোরথ; এই লিপিটিতে সেকালের নৌযুদ্ধের একটি সুন্দর বর্ণনা আছে :

যস্যানুত্তরবঙ্গসঙ্গর জয়ে নৌবাটহীহীরব —
ত্ৰস্তৈদিকরিভিশ্চ যন্নচলিতং চেন্নাস্তি তদৃগম্যভূঃ।
কিঞ্চোৎপাত্তুককেনিপাতপতন প্রোৎসপি তৈঃ শীকরৈর
আকাশে স্থিরতা কৃতা যদি ভবেৎ স্যাম্নিষ্কলঙ্কঃ শশী৷

যাহার দক্ষিণবঙ্গযুদ্ধজয়ে নৌবাহিনীর হীহী রবে ত্ৰস্ত হইয়া দিগগজেরা যে পলায়ন করে নাই তাহার কারণ তাহাদের যাইবার স্থান ছিল না। তাহা ছাড়া দাড়গুলির উৎক্ষেপে উৎক্ষিপ্ত জলকণা যদি আকাশে স্থির হইয়া থাকিত – তাহা হইলে চন্দ্রের কলঙ্ক ঢাকা পড়িত।

গৌড় অভিনন্দ

সংকলয়িতা শার্সধর তাহার শার্স ধর-পদ্ধতি (১৩৬৩ খ্রী:) নামক গ্রন্থে গৌড়-অভিনন্দ নামে এক কবির দুইটি শ্লোক উদ্ধার করিয়াছেন; এই দুইটির একটি শ্লোক শ্ৰীধরদাস তাহার সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থেও উদ্ধার করিয়াছেন, কিন্তু শ্ৰীধরের মতে তাহার রচয়িতা কবি শুভাঙ্গ বা শুভঙ্ক। শাঙ্গধর-পদ্ধতি-গ্রন্থে আরও দুইটি শ্লোক উদ্ধার করা হইয়াছে (কবি) অভিনন্দের রচনা বলিয়া; এই অভিনন্দের গৌড় অভিধা অনুপস্থিত। গৌড় অভিধাবিহীন অভিনন্দর ৫টি শ্লোক কবীন্দ্রবচন-গ্রন্থে, ২২টি শ্লোক সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থে, ৬টি শ্লোক, কলহণের শুক্তিমুক্তাবলীতে এবং একটি পদ্যাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছে। এই অভিনন্দরই দুইটি শ্লোক রামচরিতে উদ্ধার করা হইয়াছে এবং একাধিক শ্লোকাংশ উজ্জ্বলদত্ত এবং বৃহস্পতি রায়মুকুটও ব্যবহার করিয়াছেন। কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-গ্রন্থে (একাদশ শতক) যে কবি অভিনন্দর উল্লেখ আছে তিনি খুব সম্ভবত এই অভিধাবিহীন অভিনন্দ, কিন্তু ইনি এবং গৌড়-অভিনন্দ একই ব্যক্তি কিনা, নিঃসন্দেহে বলা কঠিন। গৌড়-অভিনন্দ বাঙালী ছিলেন, তাহার অভিধাতেই প্রামাণ। অভিধাবিহীন কবি অভিনন্দের ২২টি শ্লোক বাঙালী শ্ৰীধরদাস কর্তক সংকলিত হইতে দেখিয়া মনে হয়, ইনিও বোধ হয় বাঙালী ছিলেন এবং তাহা হইলে এই দুই অভিনন্দ এক হইতে কিছু বাধা নাই। গৌড়-অভিনন্দ কাদম্বরী-কথাসার নামেও একখানি গ্ৰন্থ রচনা করিয়াছিলেন, পদ্যে।

অভিনন্দ ও রামচরিত

সােদৃঢলের উদয়সুন্দরীকথা-গ্রন্থে আর এক সুপ্রসিদ্ধ কবি অভিনন্দর কথা আছে। এই অভিনন্দ এক পালবংশীয় যুবরাজের সভাকবি ছিলেন এবং রামচরিত নামে একটি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। এই কাব্য হইতে জানা যায়, যুবরাজের বিরুদ ছিল হারবর্য এবং তিনি ছিলেন দিগ্বিজয়ী বীর। তাহার পিতার নাম ছিল বিক্রমশীল এবং তিনি স্বয়ং ছিলেন ধর্মপাল-কুল-কৈরব-কাননেন্দু এবং পালকুল-প্রদীপ, পালকুলচন্দ্র। সন্দেহ নাই যে, যুবরাজ হারবর্ষ ছিলেন পালবংশীয়, এবং নৃপতি ধর্মপালের বংশধর। ধর্মপালের অন্য একটি নাম বা বিরুদ ছিল বিক্রমশীল, এ-তথ্য তিব্বতী ঐতিহ্যে সুস্পষ্ট। সুতরাং এই অনুমান অনৈতিহাসিক নয় যে, যুবরাজ হারবর্ষ এবং দেবপাল একই ব্যক্তি। এ অনুমান সত্য হইলে রামচরিতের কবি অভিনন্দকে বাঙালী বলিতে আপত্তি হইবার কারণ নাই। তাহা ছাড়া, বাঙলাদেশে বাঙালী কবি কর্তৃক রচিত এই প্রাচীনতম রামচরিত বা রামায়ণ-কাব্যের একটি স্থানীয় বৈশিষ্ট্য আছে; তাহা দেবীমাহাত্ম্য কীর্তন, যদিও তাহা হনুমানের মুখে, শ্ৰীরামচন্দ্রের মুখে নয়।

সন্ধ্যাকর-নদীর রামচরিত

পাল-চন্দ্রপর্বে বাঙলা দেশে রামায়ণ কাহিনী সুপ্রচলিত ছিল এবং উচ্চকোটিস্তরে রাম-সীতার মূর্তিপূজা প্রচলিত থাকুক বা না থাকুক, অন্তত ইহারা লোকের শ্রদ্ধা এবং পূজা আকর্ষণ করিতেন, সন্দেহ নাই। অভিনন্দ-রচিত রামচরিতই প্রাচীন বাঙলার একমাত্র রাম-কাব্য নয়; সন্ধ্যাকর-নন্দী নামে প্ৰসিদ্ধতর আর একজন কবি রামচরিত নামেই আর একখানা ঐতিহাসিক কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। ঐতিহাসিক কাব্য বলিতেছি। এই অর্থে যে, সন্ধ্যাকরের কাব্যটি দ্ব্যর্থব্যঞ্জক; এক অর্থে রামচন্দ্রের কাহিনী, অপর অর্থে পালরাজ রামপাল এবং তাহার উত্তরাধিকারীদের ইতি-কাহিনী। গ্রন্থের শেষে যে-কবিপ্রশস্তি আছে তাহা হইতে জানা যায়, সন্ধ্যাকরের পিতার নাম ছিল প্রজাপতি-নন্দী, পিতামহের নাম পিণাক-নদী, এবং জন্মভূমি ছিল ব্লরেন্দ্ৰান্তৰ্গত পুণ্ড্রবর্ধনপুরে। প্রজাপতি-নন্দী ছিলেন রামপালের সান্ধিবিগ্রহিক। গ্রন্থ-রচনা আরম্ভ কবে হইয়াছিল, বলা কঠিন, তবে কৈবর্ত-বিদ্রোহ এরং দ্বিতীয় মহীপালের হত্যা হইতে আরম্ভ করিয়া মদনপালের রাজত্ব পর্যন্ত সমস্ত ইতিহাসের বর্ণনা হইতে মনে হয়, মদনপালের রাজত্বকালে গ্রন্থ-রচনা সমাপ্ত হইয়াছিল। সন্ধ্যাকর-নন্দী সমসাময়িক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য; সেই হিসাবে তাহার কাব্যের ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য। কিন্তু এই গ্রন্থের যথার্থ সাহিত্যমূল্য স্বল্প এবং মৌলিকত্বও তেমন কিছু নাই। কাব্যটি সুপ্ৰসিদ্ধ রাঘবপাণ্ডবীয়-কাব্যের ধারার অনুকরণ এবং প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত ইহার ২২০টি আর্যশ্লোক শ্লেষচাতুর্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। সন্ধ্যাকর আত্মপরিচয় দিতেছেন। ‘কলিকাল-বাল্মীকি বলিয়া, এবং তিনি যে শুধু অলংকারবিদ সুনিপুণ কবি তাঁহাই নয়, কুশলী ভাষাবিদও, এ-দাবিও করিতেছেন। তাঁহার শেষোক্ত দাবি সার্থক, কারণ, শব্দ ও ভাষার উপর যথেষ্ট দখল না থাকিলে আর্যর মতো সুকঠিন ছন্দে এবং মাত্র ২২০টি শ্লোকে একাধারে রামপাল-কথা এবং রামায়ণ-কথা বর্ণনা কিছুতেই সম্ভব হইত না। কিন্তু বাল্মীকির সঙ্গে তুলনা অলংকৃত দাবি, সন্দেহ নাই। অলংকার প্রিয়তায়, শ্লেষোক্তিতে এবং কাব্যের অন্যান্য লক্ষণে সন্ধ্যাকর-নদীর রামচরিত অষ্টম-নবম-দশম-একাদশ শতকীয় সংস্কৃত কাব্যের সমগোত্রীয়।

অবাস্তর হইলেও এ-প্রসঙ্গেই উল্লেখযোগ্য যে, রঘুপতি রামের পূজা এবং তাহার প্রতি শ্রদ্ধা পরবর্তী সেন-বৰ্মণ পর্বে বোধ হয় বাড়িয়াই গিয়াছিল, এবং হয়তো রামের মূর্তিপূজাও প্রচলিত হইয়া থাকিবে? ধোয়ী-কবি তাহার পবনদূতে যে ভাবে স্বর্ণদী বা ভাগীরথীতীরে রঘুকুলগুরু দেবতার উল্লেখ করিয়াছেন, মনে হয়, মধ্য ও দক্ষিণ-ভারতের মতো বাঙলাদেশেও রাম-সীতার পূজা প্রচলিত ছিল। পরে কোনও সময়ে তাহা অপ্রচলিত হইয়া গিয়া থাকিবে।

ক্ষেমীশ্বর চণ্ডকৌশিক

তবে, চণ্ডকৌশিক-প্রণেতা নাট্যকার ক্ষেমীশ্বর বাঙালী হইলেও হইতে পারেন। নাটকটির নদী অংশের একটি শ্লোক হইতে জানা যায়, গ্রন্থটি রচিত হইয়াছিল। মহীপালের প্লাজসভায়। এই মহীপাল পাল-রাজ মহীপাল হইতে পারেন, আবার গুর্জর-প্ৰতীহাররাজ মহীপাল হইতেও বাধা কিছু নাই। নাটকে বর্ণিত রাজা কর্ণাটক সৈন্যদের পরাভূত করিয়াছিলেন; এই রাজা মহীপাল হওয়া কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু পাল-রাজ মহীপাল যেমন একাধিক কর্ণাটক বাহিনীর সম্মুখীন হইয়াছিলেন, তেমনই প্ৰতীহার-রাজ মহীপালকেও রাষ্ট্ৰকুট-বাহিনীর সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল, এবং এই রাষ্ট্রকূট-বাহিনীকে যদি কর্ণাটক বাহিনী বলা যায় তাহা হইলে খুব অন্যায় কিছু করা হয় না। কিন্তু চণ্ডকৌশিক-নাটকের সর্বপ্রাচীন যে দুইটি পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান (১২৫০ ও ১৩৮৭ খ্ৰীষ্ট শতকে অনুলিখিত) দুইটিই পাওয়া গিয়াছে নেপালে; সন্দেহ নাই যে, বিহার-বাঙলাদেশ হইতেই সেগুলি নেপালে গিয়া থাকিবে। সেই জন্যই মনে হয়, ক্ষমীশ্বর বাঙালী হউন, বা না হউন তাঁহার কর্মক্ষেত্র বোধ হয় ছিল বিহার-বাঙলা দেশ, এবং চণ্ডকৌশিক-নাটকের প্রচলনও বেশি ছিল এই দুই দেশেই।

মার্কণ্ডেয়-পুরাণবর্ণিত বিশ্বামিত্র-হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী লইয়া পঞ্চাঙ্ক চণ্ডকৌশিক নাটক। সমস্ত কাহিনীটি নাটকীয় গুণে দুর্বল, এবং ক্ষেমীশ্বরের কবিকল্পনা ও কাব্যকৌশলও খুব উচ্চস্তরের নয়। সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে সেইজন্য চণ্ডকৌশিকের স্থান খুব গর্বের বস্তু নয়। মহাভারতীয় নল-কাহিনী লইয়া ক্ষেমীশ্বর নৈষধানন্দ নামে আর একটি সপ্তাঙ্ক নাটক রচনা করিয়াছিলেন।

কীৰ্তিবর্মার কীচকবধ

বরং অলংকারবহুল কাব্য হিসাব নীতিবর্মর কীচকবধ উল্লেখযোগ্য। মহাভারতীয় বিরাটপর্বের সুপরিচিত কীচকবধ উপাখ্যানটি ১৭৭টি শ্লোকে পাচটি সর্গে বর্ণিত, কিন্তু মহাভারতের সকল সারল্য নীতিবর্মীর রচনায় অনুপস্থিত। তাহার পরিবর্তে আছে শ্লেষ ও যমকালঙ্কার ব্যবহারের নৈপুণ্য, কবির শব্দ ও বাকভঙ্গির চাতুর্য। সেইজন্যই পরবর্তী বৈয়াকরণিক-অভিধানিক-আলঙ্কারিকেরা নীতিবর্মর কীচকবধ হইতে প্রয়োজন হইলেই দৃষ্টান্ত আহরণ করিতে কার্পণ্য করেন নাই।। ১০৬৯ খ্ৰীষ্ট শতকে নামি-সাধু নামে জনৈক আলংকারিক রুদ্রটের কাব্যালঙ্কারের একটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন; এই টীকায়ই সর্বপ্রথম কীচকবধ হইতে উদ্ধৃতি গ্রহণ করা হইয়াছে। নীতিবর্মার ব্যক্তিগত জীবন-সম্বন্ধে কোনও তথ্যই আমাদের জানা নাই, তবে তাহার পৃষ্ঠপোষক হয় কলিঙ্গের রাজা ছিলেন না হয় কলিঙ্গ জয় করিয়াছিলেন, এই রকমের একটু ইঙ্গিত কাব্যটির প্রথম সর্গেই আছে। কিন্তু বাঙলা অক্ষরের পাণ্ডুলিপি ছাড়া আর কোনো অক্ষরে কীচকবধের কোনও পাণ্ডুলিপি এ-পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই; তাছাড়া, কাব্যটির প্রত্যেকটির টীকাকুরিই বাঙালী। সেই জন্যই মনে হয়, নীতিবর্মার কর্মক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশ, এবং কাব্যটির প্রচলনও এই দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল।

কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়

একাদশ-দ্বাদশ শতকের আদি বঙ্গক্ষেরে লেখা একটি কবিতা-সংগ্ৰহ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়াছে নেপালে; পুঁথিটি খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ; নাম কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়। সংকলয়িতার নাম

জানিবার উপায় নাই, তবে তিনি বৌদ্ধ ছিলেন। বইখানি যে বাঙলাদেশেই সংকলিত হইয়া পরে অন্যান্য অনেক গ্রন্থের মতো নেপালে নীত হইয়াছিল, এই অনুমান অযৌক্তিক নয়। বইটিতে ১১১ জন বিভিন্ন কবি-বিরচিত ৫২৫টি শ্লোক আছে, এবং এই ১১১ জনের মধ্যে কালিদাস, অমরু, ভবভূতি, রাজশেখর প্রভৃতি সৰ্ব্বভারত প্ৰসিদ্ধ কবিদের রচনা যেমন আছে তেমনই এমন অনেকের রচনা আছে যাঁহাদের বাঙালী বলিয়া মনে করিবার কারণ বিদ্যমান। গৌড়-অভিনন্দ, ডিম্বোক বা হিম্বোক, কুমুদাকর মতি, ধর্মকর, বুদ্ধাকরগুপ্ত, মধুশীল, বাগোক, বীর্যমিত্র, বৈদ্দোক, শুভঙ্কর, শ্রীধর-নন্দী, রতিপাল, যোগোক, সিদ্ধোক, সোনোক বা সোন্নোক, হিঙ্গোক, বৈদ্যধন্য, অপরাজিত-রক্ষিত, প্রভৃতি কবিদের এই সব নাম হইতে বুঝিতে পারা যায়, ইহারা বাঙালী ছিলেন, এবং ইহারা অনেকেই ছিলেন বৌদ্ধ। সংস্কৃত সাহিত্যে এই ধরনের কবিতা-সংগ্রহ বা কবিতা-চয়নিকার-ধারার উদ্ভব বোধ হয়ে এই পর্বের বাঙলা দেশেই, এবং কবীন্দ্রবচনসমুচ্চই এই জাতীয় সর্বপ্রথম সংকলন-গ্ৰন্থ; এর পরের পর্বের সদুক্তিকর্ণামৃতের সংকলয়িতাও একজন বাঙালী।

মহাকাব্য, এমন কি ছোট ছোট রসহীন, পাণ্ডিত্যপূৰ্ণ কাব্য বোধ হয় সমসাময়িক শিক্ষিত বাঙালীর খুব বেশি রুচিকর ছিল না; তাহার বেশি রুচিকর ছিল অপভ্রংশ এবং প্রাকৃত পদ ও ছড়া, ছোট ছোট সংস্কৃত কবিতা, প্রকীর্ণ শ্লোক! এই সব সংস্কৃত শ্লোক ও পদের মধ্যে শুধু যে সমসাময়িক সংস্কৃত কাব্যরীতির পরিচয়ই আছে তাঁহাই নয়, বাঙলাদেশের প্রাকৃতিক রূপ এবং সমসাময়িক বাঙালীর কল্পনা এবং মানসপ্রকৃতিও সুস্পষ্ট ধরা পড়িয়াছে। দুই একজন মহিলা কবির পরিচয়ও পাইতেছি- ভাবাক বা ভাব-দেবী ও নারায়ণ-লক্ষ্মী।

নবম শতকের মধ্যভাগে কামরূপাধিপতি বনমালবর্মদেবের একটি লিপিতে বোধ হয় সর্বপ্রথম রাধাকৃষ্ণের ব্রজলীলার সুস্পষ্ট আভাস পাইতেছি। ভোজবর্মার বেলাবলিপিতেও সে উল্লেখ সুস্পষ্ট। কিন্তু কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-গ্রন্থে উদ্ধৃত বাঙালী কবি রচিত কয়েকটি বিচ্ছিন্ন শ্লোকে এই ব্রজলীলার যে-চিত্র দৃষ্টিগোচর, গীতগোবিন্দের আগে সে-চিত্র আর কোথাও দেখা যায় না। তিনটি শ্লোক এখানে উদ্ধার করিতেছি।

কোহয়ং দ্বারি হরিঃ প্ৰযাস্থ্য পবনং শাখা মৃগেনাত্র কিং
কৃষ্ণোহহং দয়িতে বিভেমি সুতরাং কৃষ্ণং কথঃ বানরঃ।
মুগ্ধোহহং মধুসূদনো ব্রজলতাং তামেব পুষ্পসবাম
ইত্থং নির্বাচনীকৃতো দায়িতয়া হ্রীণো হরিঃ পাতু বঃ৷।

(অজ্ঞাতনাম; সদুক্তিকর্ণামৃতে এই শ্লোকটি কবি শুভাঙ্কের নামে উদ্ধৃত)

[শীঘ্ৰং গচ্ছত] ধেনুদুগ্ধকলশানাদায় গোপ্যো গৃহং
দুগ্ধে বষ্কয়িণীকুলে পুনরিয়াং রাধা শনৈর্যাস্যতি।
ইত্যন্যব্যাপদেশ গুপ্তহৃদয়ঃ কুৰ্বন বিবিক্ত ব্ৰজং
দেবঃ কারণনন্দসূনুরশিবং কৃষ্ণঃ স মুষ্ণাতু বঃ।৷

(সোন্নোক)

ময়াম্বিষ্টো ধূতঃ স সখি নিখিলামেব রজনীম
ইহ স্যাদত্র স্যাদিতি নিপুণমন্যাভিসৃতঃ
ন দৃষ্টো ভাণ্ডীরে তটভূবি ন গোবৰ্দ্ধনগিরে-
কালিন্দ্যাঃ [কূলে] ন নিচুলকুঞ্জে মুররিপুঃ৷।

(অজ্ঞাতনাম)