০৬. মাৎস্যন্যায়ের শতবৎসর ॥ আ ৬৫০-৭৫০ খ্ৰীষ্টাব্দ ৷ তিব্বত ও বাঙলা

মাৎস্যন্যায়ের শতবৎসর ॥ আ ৬৫০-৭৫০ খ্ৰীষ্টাব্দ ৷ তিব্বত ও বাঙলা

৬৪৬ বা ৬৪৭ খ্ৰীষ্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যু হইল। তাহার মৃত্যুর পর চীনা-পুরাণের মতে ন-ফু-টি ও-লো-ন-সুয়েন (অর্জন বা অরুণাশ্ব) নামে তি-ন-ফু-তি বা তীর-ভূক্তির (তিরহুত) শাসনকর্তা পুষ্যভূতি সিংহাসন দখল করেন। অর্জন বা অরুণাশ্ব মগধে হর্ষবর্ধনের নিকট প্রেরিত এক চীনা রাজদূত ওয়াঙ-হিউয়েনৎ-স্যের সমস্ত সাঙ্গোপাঙ্গোদের হত্যা করেন। রাজদূত নেপালে পলাইয়া গিয়া সে-দেশ ও তিব্বত হইতে একদল সৈন্য সংগ্রহ করেন এবং ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিয়া অরুণাশ্বের রাজধানী (বোধ হয় মগধ) ও অন্যান্য বহু প্রাচীর-বেষ্টিত নগর ধ্বংস করেন; অরুণাশ্বকেও বন্দী করিয়া চীনদেশে লইয়া যান। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মর সাহায্যও তিনি লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া চীনা-ইতিহাসে বর্ণিত আছে। এই ঘটনা বোধ হয় ঘটিয়াছিল ৬৪৮-র গোড়ায় বা শেষে, কিন্তু চীনা রাজবৃত্ত বর্ণিত এই কাহিনী কতদূর বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন। তবে, এ তথ্য নিঃসংশয় যে, হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর পূর্ব ভারতের রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলার সুযোগে চীন-তিব্বত-কামরূপের লোলুপ দৃষ্টি এইদিকে আকৃষ্ট হইয়াছিল এবং তিব্বতরাজ শ্ৰং-ৰহসন-গ্যাম্পে (৬০০-৬৫০) ভারতীয় রাষ্ট্রীয় আবর্তে বহুখ্যাত তিব্বতী বৌদ্ধ যোগদান করিয়াছিলেন। এই নরপতি আসাম ও নেপাল এবং ভারতবর্ষের বহুস্থান জয় করিয়াছিলেন কলিয়া দাবি করা হইয়াছে। মনে হয়, এই দাবি একেবারে নিরর্থক নয়। গ্যাম্পোর আমল হইতে আরম্ভ করিয়া নেপাল তো প্রায় দুইশত বৎসর তিব্বতের অধীন ছিল। কামরূপে ভাস্করবর্মার রাজবংশ এক ম্লেচ্ছ।রাজ কর্তৃক বিনষ্ট হইয়াছিল, এ তথ্যও সুবিদিত। এই ম্লেচ্ছ।রাজ গ্যাম্পো হওয়া বিচিত্র নয়, অথবা, গ্যাম্পোর মতই ভোট-ব্রহ্মীয় কোনও নরপতিও হইতে পারেন। কামরূপের শালস্তম্ভ ও তদবংশীয় রাজারা যে ভোট-ব্ৰহ্ম নরগোষ্ঠীরই প্ৰতিনিধি, এ সম্বন্ধে সন্দেহ কি? গ্যাম্পো ৬৫৩ খ্ৰীষ্টাব্দে তনুত্যাগ করেন এবং তাঁহার পৌত্র কি-লি-প-পু (৬৫০-৬৭৯) তিব্বতের অধিপতি হন। তিনিও দিগ্নিজয়ী বীর ছিলেন এবং মধ্য ভারত পর্যন্ত তাঁহার রাষ্ট্ৰীয় প্রভাব বিস্তৃত ছিল। ৭০২ খ্ৰীষ্টাব্দে নেপাল ও মধ্য ভারত তিব্বতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, কিন্তু এই বিদ্রোহ বোধ হয় রাষ্ট্ৰীয় উদ্দেশ্য সফল করিতে পারে নাই। কারণ, ৭১৩ হইতে ৭৪১ খ্ৰীষ্টাব্দের মধ্যে কোনও সময়ে তিব্বতী ও আরবীদের বিরুদ্ধে সহায়তা প্রার্থনা করিয়া মধ্য ভারত হইতে এক দৌত্য চীন রাজসভায় প্রেরিত হইয়াছিল বলিয়া চীন-রাজবৃত্তে বর্ণিত আছে। চীনা ইতিহাসের মধ্য-ভারত সাধারণত বর্তমান বিহার অঞ্চলকেই বুঝায়, অন্তত এই যুগে। যাহা হউক, এই সব রাষ্ট্ৰীয় উপপ্লবের ঢেউ বাঙলাদেশে আসিয়াও লাগিয়াছিল সন্দেহ নাই। তিব্বত রাষ্ট্রের ভীতিশঙ্কাময় প্রভাব বহুদিন ভারতবর্ষে, বিশেষত কাশ্মীর, কামরূপ, নেপাল এবং বাঙলাদেশে সক্রয় ছিল বলিয়া মনে হয় এবং সম্ভবত শুধু সপ্তম শতকেই নয়, সপ্তম-অষ্টম শতক এবং নবম শতকের কিয়দংশ জুড়িয়া বাঙলাদেশকে বারবার তিব্বতী অভিযানে বিব্রত ও পযুদস্ত হইতে হইয়াছিল, এমন কি পাল-সম্রাট ধর্মপাল সিংহাসনে আরোহণ করিবার পরও। নারায়ণপালের রাজত্বকালেও একাধিক তিব্বতী সামরিক অভিযান বাঙলাদেশের বুকের উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছে। তিব্বতরাজ খ্ৰী শ্ৰং-লদে বৎসন (Khere-strong-lde-tsan 755-97) ভারতবর্ষ জয়ের দাবি করিয়াছেন। তাহার পুত্র মুক্তিগ-বৎ সনা-পো (Mu-tig-Btsen-po)ও ভারতবর্ষে বিজয়বাহিনী প্রেরণ করিয়াছিলেন :

in the south the Indian kings there established the Raja Dharma-dpal and Drahu-dpun, both waiting in their lands under order to shut up their armies yielded the Indian kingdom in subjection to Tibet; the wealth of the Indian country, gems and all kinds of excellent provisions, they punctually paid. The two great kings of India, upper and lower, out of kindness to themselves (or in obedience to him), pay honour to commands.

ধর্মপালের উল্লেখ তো সুস্পষ্ট, কিন্তু Draihu-dipun কে বলা কঠিন। আর একজন তিব্বত-রাজ, রলপ-চন্‌ (Ral-pa-can, আ ৮১৭–৮৩৬) বাঙলাদেশ জয় করিয়া একেবারে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন বলিয়া লন্দাকী-রাজবৃত্তে দাবি করা হইয়াছে। তিব্বতী ও লদাকী-রাজতরঙ্গিনীর এই সব দাবিদাওয়া কতখানি সত্য, অত্যুক্তি কতখানি আছে বা নাই, বলা কঠিন। তবে, সপ্তম শতকের মাঝামাঝি হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে নবম শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত একদিকে কামরূপ-বাঙলা-বিহারকে এবং অন্যদিকে নেপাল ও কাশ্মীরকে বারবার তিব্বতী রাষ্ট্রীয় ও সামরিক পরাক্রমের সন্মুখীন হইতে হইয়াছে, সন্দেহ নাই। বঙ্গ-তিব্বত ইতিহাসের এই বিরোধ-মিলনপর্ব আজও খুব সুবিদিত নয়; তথ্য স্বল্প, অস্পষ্ট এবং অসমর্থিত। তবে, এ তথা অনস্বীকার্য যে, মাৎস্যনায়ের পর্বে একশত বৎসর ধরিয়া যে রাষ্ট্রীয় দুর্যোগে বাঙলার আকাশ সমাচ্ছন্ন তাহার খানিকটা মেঘ ও ঝড় বহিয়া আসিয়াছে তিব্বতের হিমতুষারময় পার্বত্যদেশ হইতে।

নবগুপ্ত বংশ

হৰ্ষের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে মগধ রাষ্ট্রীয় দূযোৰ্গে বিপর্যস্ত হইয়াছিল। বোধ হয়, এই বিপর্যায়ের পর্বেই মগধে এক নবগুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই বংশের প্রথম রাজা আদিত্যসেন। (গুপ্ত); ইনি মগধগুপ্তের পুত্র এবং পূর্বকথিত মহাসেনগুপ্তের প্রপৌত্র। কাজেই মগধের উপর বংশগত অধিকারের দাবি আদিত্যসেনের ছিলই। আদিত্যসেন এবং তাঁহার তিনজন বংশধর। প্রত্যেকেই স্বাধীন মহারাজাধিরাজরূপে পর পর মগধে রাজত্ব করিয়াছিলেন, প্রায় অষ্টম শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত। বাঙলাদেশের কোনও অংশ এই রাজবংশের করায়ও ছিল। কিনা বলা কঠিন; ছিল না বলিয়াই মনে হয়। তবে নিজেদের লিপিতে চতুঃসমুদ্র পর্যন্ত রাজ্যজয় এবং উত্তরাপথনাথ হইবার দাবি যে ভাবে জানানো হইয়াছে, তাহাতে মনে হয়, ইহাদের রাষ্ট্রীয় প্রভাব একেবারে তুচ্ছ করিবার মতন ছিল না।

শৈলাধিপত্য

এই নবগুপ্ত বংশের কোনও রাষ্ট্রীয় আধিপত্য থাকুক বা না থাকুক, অষ্টম শতকের প্রথম পাদের শেষে অথবা দ্বিতীয় পাদের প্রারম্ভেই শৈলবংশীয়কোনওরাজা পৌণ্ডদেশ, অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ জয় করিয়াছিলেন এবং পৌণ্ডাধিপকে হত্যা করিয়াছিলেন। শেলবংশ হিমালয় উপত্যাকাবাসী; কিন্তু ইহাদের রাষ্ট্রীয় পরাক্রম বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হইয়া গুর্জর, কাশী এবং বিন্ধ্য অঞ্চল গ্রাস করিয়াছিল। কিন্তু ইহাদের পৌণ্ডাধিকার বা ইহাদের বংশ ও রাজত্ব সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যয়ায় না।

যশোবর্মা কর্তৃক মগধ-গৌড়-বঙ্গ জয়

বাঙলাদেশে এই সব বৈদেশিক আক্রমণ ও তৎসম্পূক্ত রাষ্ট্ৰীয় বিপর্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় দেখা দিয়াছিল। কনৌজরাজ যশোবর্মার মগধ এবং গৌড়াইেক্রমণ ও বিজয়ের ফলে। এই দুর্ধর্ষ বিজয়মদমত্ত রাজা, ৭২৫ হইতে ৭৩৫-র মধ্যে কোনও সময় মগধাক্রমণ করিয়া মগধরাজকে প্রথমত বিন্ধ্য পর্বতে পলাইয়া যাইতে বাধ্য করেন, পরে সন্মুখ যুদ্ধে তাহাকে নিহত এবং তাহার সৈন্য-সামশুদিগকে পরাজিত করেন। বোধ হয় মগধ জয়ের পর তিনি গৌড়রাজকেও পরাজিত ও নিহত করেন। বাকপতিরাজ তাহার সভাকবি ছিলেন এবং তিনি এই মগধ ও গৌড় বিজয়কাহিনী লইয়া গৌড়বহো নামে একটি (অসমাপ্ত?) প্রাকৃত কাব্য রচনা করিয়াছিলেন; এই কাব্যে গৌড়রাজ বধের কাহিনী যে ভাবে প্রসঙ্গক্রমে মাত্র উল্লিখিত হইয়াছে, এই সমস্ত কাহিনীটির বর্ণনা যে ভাবে করা হইয়াছে তাহাতে এই অনুমান স্বাভাবিক যে, এই সময় গৌড়ের রাজাই মগধেরও রাজা ছিলেন এবং দুইজনই এক এবং অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন; কিন্তু তিনি কে ছিলেন বলা কঠিন। মগধ ও গৌড় বিজয়ের পর যশোবর্ম সমুদ্রতীরের দিকে অগ্রসর হন এবং বঙ্গদেশও জয় করেন। স্পষ্টতই দেখা যাইতেছে, প্ৰায় সমস্ত বাঙলাদেশই তাহার নিকট মস্তক অবনতি করিয়াছিল। কিন্তু যশোবর্মা অধিকদিন তাহার এই বৈদ্যুতিক দিগ্বিজয় ভোগ করিতে পারেন নাই।

কাশ্মীর ও বাঙলা

সম্ভবত্ব ৭৩৬ খ্রীষ্টাব্দের কিছু পরই যশোবর্মা কাশ্মীররাজ মুক্তাপীড় ললিতান্দিতা কর্তৃক অত্যান্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। ললিতাদিত্য কর্তৃক উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে বহু রাজা বিজয়ের কথা কহলন রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছেন। এই সব বিবরণের ঐতিহাসিকত্ব কতটুকু বলা কঠিন, তবে কহলনের বিবৃতি পাঠ করিলে মনে হয়, গৌড় কিছুদিনের জন্য হইলেও কাশ্মীরের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল। গৌড়রাজকে কাশ্মীররাজের আদেশে একদল হস্তী সেনা লইয়া কাশ্মীরে যাইতে হইয়াছিল। কাশ্মীররাজ সম্বন্ধে গৌড়রাজের বোধ হয় কিছু ভীতি ও অবিশ্বাসের কারণ ছিল। সেই হেতু ললিতাদিত্য বিষ্ণুমূর্তি সাক্ষী করিয়া প্রতিজ্ঞা করেন যে, গৌড়রাজের কিছু অনিষ্ট তিনি করিবেন না। কিন্তু গৌড়রাজ কাশ্মীরে পৌছিবার পর ললিতাদিত্য এই প্ৰতিজ্ঞা রক্ষা করেন নাই; গৌড়রাজকে তিনি হত্যা করেন। একদল গৌড়বাসী এই হত্যার প্রতিশোধ মানসে তীর্থযাত্রী সাজিয়া কাশ্মীরে গমন করেন এবং ললিতাদিত্যের শপথসাক্ষী বিষ্ণুমূর্তি ও মন্দির ধ্বংস করেন। ইতিমধ্যে কাশ্মীর রাজ্যের সৈন্যরা আসিয়া গৌড়বাসীদের খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলে। এই কাহিনীর উল্লেখের কোনও প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু এই উপলক্ষে কাশ্মীর-সন্তান কলহন গৌড়বাসীদের প্রভৃভক্তি, সাহস ও শৌর্য সম্বন্ধে যে স্তুতিবাদ কাব্যস্থ করিয়াছেন তাহা উদ্ধারযোগ্য এবং সেই জনাই এই কাহিনীর উল্লেখ। কলহন বলিতেছেন; গৌড়বাসীরা এই ব্যাপারে যাহা করিয়ছিল তাহা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তারও অসাধ্য বলিলে কিছু অত্যুক্তি হয় না (৩৩২ শ্লোক)। ( কলহনের সময়েও) রামস্বামীর মন্দিরটি যেমন একদিকে দেবতাশূন্য হইয়া পড়িয়াছে, তেমনই সেই গৌড়বীরদের অপূর্ব যশোগানে সমগ্র পৃথিবী পরিপূর্ণ হইয়া আছে (৩৩৫ শ্লোক)।

ললিতাদিত্যের পৌত্র জয়াপীড় সম্বন্ধে। কলহন আর একটি গল্পের উল্লেখ করিয়াছেন। জয়াপীড় দিগ্ধিজয়ে বাহির হইয়া নিজের সৈন্যদল কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া একা একা ঘুরিতে ঘুরিতে পুণ্ড্রবর্ধন নগরে আসিয়া উপস্থিত হন এবং ছদ্মবেশে এক বারাঙ্গনার গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করেন ৷ জয়ন্ত নামে এক ব্যক্তি তখন পুণ্ড্রবর্ধনের সামন্ত-রাজা; গৌড়ের রাজাদের তিনি অন্যতম সামন্ত। জয়ন্তের কন্যা কল্যাণদেবীর সঙ্গে জয়াপীড়ের প্রণয় সঞ্জাত হয় এবং তিনি তাহাকে বিবাহ করিয়া পঞ্চগৌড়াধিপতিদের পরাজিত করেন এবং জয়ন্তকে তাহাদের অধিরাজ পদে প্রতিষ্ঠিত করেন। কলহনের এই সব কাহিনীর ঐতিহাসিকত্ব সম্বন্ধে নিঃসংশয় হওয়া কঠিন; তবে মনে হয়, এই সময় গৌড়দেশ রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে বহুধা বিভক্ত ছিল এবং সর্বব্যাপী কোনও রাষ্ট্রীয় প্রভুত্বের অস্তিত্ব ছিল না, স্থানীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামঞ্জরাই নিজ নিজ স্থানে রাষ্ট্রপ্রধান হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। এই অবস্থায় বৈপ্রান্তিক পরাক্রান্ত শক্তিদের দ্বারা বারবার পর্যাদাপ্ত হওয়া

ভগদত্ত-বংশীয় হর্ষ

আনুমানিক অষ্টম শতকের দ্বিতীয় পাদে গৌড়ে আর একটি বৈপ্ৰাস্তিক অভিযানের খবর পাওয়া যায়। নেপালের লিচ্ছবিরাজ দ্বিতীয় জয়দেবের একটি লিপিতে দেখিতেছি (৭৫৯ অথবা ৭৪৮), জয়দেবের শ্বশুর (কামরূপের?)। ভগদত্তবংশীয় হর্ষ গৌড়, ওড্র, কলিঙ্গ এবং কৌশলের অধিপতি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন।

এই সব বিচিত্র বৈপ্রান্তিক বিজয়ী সমারাভিযান বাহিরের বা বাঙলাদেশের কোনও লিপি বা অন্য কোনও স্বতন্ত্র সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা অসমর্থিত; সুতরাং ইহাদের সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসংশয় হওয়া কঠিন। তবে, সদ্যোক্ত সমস্ত সাক্ষ্যগুলি একত্র করিলে এই তথ্যই মনকে অধিকার করে যে, এই একশত বৎসর গৌড়রাষ্ট্রে সর্বময় প্ৰভু কেহ ছিলেন না, রাষ্ট্রে কোনও সামগ্রিক ঐক্য ছিল না, এবং এই সমৃদ্ধ অথচ বহুধা বিভক্ত দেশ-পরিবার ভিন্নপ্রদেশি রাজা ও রাষ্ট্রের লোলুপ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছিল।

চন্দ্ৰবংশ ৷ বঙ্গবীরদের অপমান

গৌড়তন্ত্রের যখন এই অবস্থা বঙ্গরাষ্ট্রের অবস্থাও যে তখন ইহার চেয়ে উন্নত ও দৃঢ় ছিল তাহা বলা যায় না। তবে, আগেকার পর্বে দেখিয়াছি, বঙ্গ ও সমতট রাষ্ট্র সপ্তম শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত খড়্গ ও রাত বংশের নায়কত্বে একটা মোটামুটি সামগ্রিক ঐক্য বাঁচাইয়া রাখিয়াছিল। ভৌগোলিক দূরত্ব এবং কতকটা অনধিগম্যতাও বোধ হয় তাহার অন্যতম কারণ। সুপ্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ও রাষ্ট্রও তাহার অন্যতম কারণ হইতে পারে। বৌদ্ধধর্মের ঐতিহাসিক। তিব্বতী লামা তারনাথের মতে খড়্গ বংশের পতনের পর বঙ্গপ্লাষ্ট্র চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের করায়ও হয় এবং তাহারা বঙ্গে এবং কখনো কখনো গৌড়ে, প্রায় অষ্টম শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। গোবিন্দচন্দ্র এবং ললিতচন্দ্র এই বংশের শেষ দুই রাজা। বোধ হয়। ললিতচন্দ্রর আমলেই বঙ্গ যশোবর্মর বিজয়ী সমারাভিযানের সম্মুখীন হইয়াছিল। এই রাজা যিনিই হউন, গৌড়বহের কবি বাকপতিরাজ তৎকালীন বঙ্গবীরদের পরোক্ষে খুবই সুখ্যাতি করিয়াছেন। পরাজয়ের পর বঙ্গবীরেরা যখন যশোবর্মার সম্মুখে শির অবনত করিয়াছিল তখন তাঁহাদের মুখমণ্ডল (লজ্জা ও অপমানে) রক্তহীন পাণ্ডুবৰ্ণ ধারণ করিয়াছিল, কারণ তাহারা এইরূপ পরাজয়ে (লজ্জা ও অপমান স্বীকারে) অভ্যস্ত ছিল মা (৪২০ শ্লোক)।

নৈরাজ্য ৷ মৎস্যন্যায়

তারনাথের বিবৃতিমতে ললিতচন্দ্রর মৃত্যুর পর সমগ্র বাঙলাদেশ জুড়িয়া অভূতপূর্ব নৈরাজ্যের সূত্রপাত হয়। গৌড়ে-বঙ্গে সমতটে তখন আর কোনও রাজার আধিপতা নাই, সর্বময় রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব তো নাইই। রাষ্ট্র ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন; ক্ষত্ৰিয়, বণিক, ব্ৰাহ্মণ, নাগরিক স্ব স্ব গৃহে সকলেই রাজা। আজ একজন রাজা হইতেছেন, রাষ্ট্ৰীয় প্রভুত্ব দাবি করিতেছেন, কাল তাহার ছিন্ন মস্তক ধূলায় লুটাইতেছে। ইহার চেয়ে নৈরাজ্যের বাস্তব চিত্র আর কী হইতে পারে!! প্রায় সমসাময়িক লিপি (যেমন, খালিমপুর লিপি) এবং কাব্যে (যেমন, রামচরিত) এই ধরনের নৈরাজ্যকে বলা হইয়াছে মাৎস্যন্যায়। রাজা নাই, অথচ সকলেই রাষ্ট্রীয় প্রভুত্বের দাবিদার। বাহুবলই একমাত্র বল, সমস্ত দেশময় উচ্ছঙ্খল বিশৃঙ্খল শক্তির উন্মুণ্ডতা; এমন যখন হয় দেশের অবস্থা, প্রাচীন অর্থশাস্ত্ৰে তাহাকেই বলে মাৎস্যন্যায়, অর্থাৎ বৃহৎ মৎস্য কর্তৃক ক্ষুদ্র মৎস্য গ্রাসের যে ন্যায় বা যুক্তি সেই ন্যায়ের অপ্ৰতিহত রাজত্ব : বৎসরের পর বৎসর বাঙলাদেশ এই মাৎসান্যায় দ্বারা পীড়িত হইয়াছিল। শেষ পর্যন্তু এই উৎপীড়ন যখন আর সহ্য হইল না। তখন সমগ্র বাঙলাদেশের রাষ্ট্রনায়কের একএ হইয়া নিজেদেরই মধ্য হইতে একজনকে অধিরাজ বলিয়া নির্বাচন করিলেন এবং তঁহার সর্বময় আধিপত্য মানিয়া লইলেন; এই রাষ্ট্রনায়ক অধিরাজটির নাম গোপালদেব! কিন্তু এই বিপ্লবগর্ভ ইতিহাস পরবর্তী পর্বের।

এই মৎস্যন্যায়ের অপ্রতিহত রাজত্ব গোপালদেবের নির্বাচনের পূর্ববর্তী কয়েক বৎসরেই শুধু আবদ্ধ নয়; এ রাজত্ব চলিয়াছিল একশত বৎসর ধরিয়া, সপ্তম শতকের মাঝামাঝি হইতে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই পর্ব জুড়িয়াই তো বৃহৎ মৎস্য কর্তৃক বাঙলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্ররূপ মৎস্য-ভক্ষণের যুক্তি বিস্তৃত। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকার শশাঙ্কের পর হইতেই গৌড়তন্ত্র পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার সংবাদ দিতেছেন; শশাঙ্কের পর যাঁহারা রাজা হইতেছেন তাহারা কেহই পুরা এক বৎসর রাজত্ব করিতে পারিতেছেন না! শিশু নামক এক রাজার রাজত্বকালে নারীর প্রতাপ ও প্রভাব দুর্জয় হইয়া উঠিয়াছিল এবং হতভাগ্য রাজা এক পক্ষকাল মাত্র রাজত্ব করিবার পরই নাকি নিহত হন। বারবার বৈপ্ৰাদেশিক রাষ্ট্র ও রাজকর্তৃক পরাজিত পৰ্যাদাপ্ত হওয়ার কথা তো আগেই বলিয়াছি। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পে এই পর্বেই আবার পূর্বপ্রত্যন্ত দেশে এক নিদারুণ দুর্ভিক্ষের খবরও পাওয়া যাইতেছে। এ সমস্ত বিবরণ একত্র করিলে মনে হয়, এই সুদীর্ঘ একশত বৎসর বাঙলাদেশে, অন্তত গৌড়ে, কোথাও কোনও সামাজিক ও রাষ্ট্ৰীয় শৃঙ্খলা বজায় ছিল না। খালিমপুর লিপিতে আছে, মাৎস্যন্যায় দূর করিবার জন্যই প্রকৃতিপুঞ্জ গোপালকে রাজা নির্বাচন করিয়াছিল, কিন্তু এই প্রকৃতিপুঞ্জ মাৎস্যন্যায়ের ফলে কতদূর উৎপীড়িত হইয়াছিল তাহা এই সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও উল্লেখের ভিতর হইতে সুস্পষ্ট ধারণা করা যায় না। অবস্থা যে খুবই শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছিল তা হাতে আর সন্দেহ কী?

সামাজিক ইঙ্গিত, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতি

এই মাৎসান্যায়ের সামাজিক ইঙ্গিত ধরিবার মতন সাক্ষ্য-প্রমাণ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই, কিন্তু পূর্ব ও পশ্চাতের ইতিহাসের ধারা স্ট্রইতে মোটামুটি অনুমান হয়তো একেবারে অসম্ভব নয়। প্রথমত, রাষ্ট্রের এক বিশৃঙ্খল অবস্থা বিসা-বাণিজ্যের অবস্থা খুব ভালো থাকিবার কথা নয়। ব্যাবসা-বাণিজ্যের পশ্চাতে রাষ্ট্রের যে সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা-বিন্যাস থাকা প্রয়োজন। এই যুগে তাহার কোনও সাক্ষ্যই পাওয়া যাইতেছে না; শান্তি ও শৃঙ্খলা যেখানে অব্যাহত নাই। সেখানে ব্যাবসা-বাণিজ্যের সমৃদ্ধি কল্পনা করা কঠিন। ইহার পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়, সুবর্ণমুদ্রা এমন কি রৌপ্য মুদ্রারও অপ্রচলন হইতে। বস্তুত এই যুগের কোনও প্রকার মূল্যবান ধাতব মুদ্রা বাঙলাদেশের কোথাও এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। শশাঙ্ক-জয়নাগের কালে রৌপ্যমুদ্রা ছিল না, কিন্তু যত অপকৃষ্ট বা নকলই হউক না কেন, সুবর্ণমুদ্রা তো ছিল। বাঙলাদেশের মুদ্রাজগৎ হইতে সুবর্ণমুদ্রা এই যে অন্তৰ্হিত হইল মুসলমান আমলের আগে আর তাহা ফিরিয়া আসে নাই। আর একটি পরোক্ষ প্রমাণ পাইতেছি, তাম্ৰলিপ্তির ইতিহাসের মধ্যে। সপ্তম শতকের শেষ পাদেও ইৎ-সিঙ তাম্রলিপ্তি বন্দরের উল্লেখ করিতেছেন; অষ্টম শতকের সাক্ষোও, যেমন দুধপানি পাহাড়ের লিপিতো, ২/১ বার তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাইতেছি কিন্তু এই সব উল্লেখ হয় প্রাচীনতর স্মৃতিবহ অথবা শুধু উল্লেখই মাত্র। তাম্রলিপ্তির সেই সম্পদ-সমৃদ্ধির কথা আর কেউ বলিতেছেন না। অষ্টম শতকের শেষার্ধ হইতে উল্লেখও আর পাওয়া যাইতেছে না এবং চতুর্দশ শতকের আগে সমগ্র বাঙলাদেশের আর কোথাও বৈদেশিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের আর কোনও বন্দরই গড়িয়া উঠিল না! বস্তুত, সপ্তম শতকের চতুৰ্থপাদ হইতে অষ্টম শতকের মাঝামাঝির মধ্যে একমাত্র সামুদ্রিক বন্দর তাম্রলিপ্তির সৌভাগ্য চিরতরে ডুবিয়া গেল! সরস্বতীর প্রাচীনতর। খাত বন্ধ হওয়া ইহার একটি কারণ হইতে পারে, কিন্তু সুদীর্ঘকাল জুড়িয়া দেশব্যাপী এই অরাজকতাও অন্যতম কারণ নয়, তাহা কে বলিবে? দেশের অর্থসম্পদ ছিল না। এ কথা সত্যু নয়, কিন্তু এই অর্থসম্পদ ব্যাবসা-বাণিজ্যলব্ধ নয় বলিয়াই যেন মনে হয়- ভূমিলব্ধ, কৃষিলব্ধ সম্পদ। তিব্বতরাজ মু-তিগ-বৃৎ সান-পোর সঙ্গে ধর্মপালের সম্বন্ধের কথা আগেই বলিয়ছি; সেই সময়ও বাঙলাদেশ যথেষ্ট সম্পদশালী, শস্য ও মণিমাণিকে সমৃদ্ধ এবং এই সব শস্য ও মণিমুক্তাসম্পদ নিয়মিত তিব্বতে প্রেরিত হইত। বাৎসরিক উপটৌকন রূপে। ইহার কিছু অবশ্য অন্তর্দেশি ব্যাবসা-বাণিজ্য লব্ধ হইতে পারে, কিন্তু মোটের উপর দেশের সামাজিক ধন ক্রমশ যে উত্তরোত্তর কৃষিলব্ধ ধনে বিবর্তিত হইতেছে, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। কারণ পরবর্তী পাল যুগে বাঙলার সমাজ প্রধানত কৃষি এবং গৃহশিল্পনির্ভর হইয়া পড়িয়াছে অধিকাংশই কৃষিনির্ভর, কারণ, রাষ্ট্রে কৃষক বা ক্ষেত্রকর সমাজের স্থান যদি বা উল্লিখিত হইতেছে, শিল্পী বা বণিক সমাজ পৃথকভাবে উল্লিখিত হইতেছে না। দেখা যাইবে, ভূমির চাহিদাও পরবর্তীকালে উত্তরোত্তর বাড়িয়াই যাইতেছে।

সামন্ততন্ত্র

রাষ্ট্র-বিন্যাস ব্যাপারে নূতন করিয়া কিছু বলিবার নাই; সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রায় অনুপস্থিত। তবে, এই যুগের রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হইতেছে সামন্ততন্ত্র। সর্বময় অধিরাজ কেহ সাধারণত নাই; থাকিলে তো মাৎস্যন্যায়ই হইতে পারিত না। সামন্তরাই এ যুগের নায়ক এবং সকলেই স্ব স্ব প্রধান। বঙ্গে সমতটে খড়্গ বংশীয় রাজারা রাজতন্ত্র হয়তো বজায় রাখিয়াছিলেন, কিন্তু এই রাজতন্ত্রেও সামন্তরা প্ৰবল ও পরাক্রান্ত। লোকনাথের বংশ সামন্তবংশ; সামন্ত লোকনাথেরও আবার সামন্ত ছিল। মাৎস্যন্যায়ের শেষ পর্বে এই সব সামন্ত নায়কেরাই তো একত্র হইয়া গোপালদেবকে রাজা নির্বাচিত করিয়াছিলেন। প্রকৃতিপুঞ্জ বলিতে খালিমপুর লিপি ও রামচরিত এই সব সামন্ত নায়কদেরই বুঝাইতেছে; ইহারাই ছিলেন প্রকৃতিপুঞ্জের নায়ক।

সংস্কৃতি

ধর্ম ও সংস্কৃতির কথা আগেকার রাজবৃত্ত পর্বেই বলিয়াছি। বঙ্গের খড়্গ বংশীয় রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন, এ কথা আগেই বলা হইয়াছে; তোহারা বৌদ্ধধর্মের খুব উৎসাহী পোষকও ছিলেন। আর যাহান্দের, যে সব রাজা, রাজবংশ বা সামন্তদের খবর পাওয়া ফাইতেছে, তাহারা প্ৰায় সকলেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী। এই একশত বৎসরের মধ্যে ভিনদেশি বা বৈপ্ৰান্তিক যে সব অভিযাত্রীরা বিরোধের মধ্য দিয়া বাঙলাদেশের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন, তাহাদের মধ্যে তিব্বতী শ্ৰং-২ সান-গ্যাম্পো এবং তাঁহার পৌত্র কি-লি-প-পু ছাড়া আর প্রায় সকলেই ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কারাশ্রয়ী। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ইৎ-সিঙ ও সেং-চি’র বিবরণী পড়িলে মনে হয়, বৌদ্ধধর্মের প্রভাবও খুব কম ছিল না। কিন্তু যে ধর্মের যেরূপ প্রভাবই থাকুক না কেন, এই দুর্যোগে দুর্দিনে সকল ধর্ম ও সংস্কৃতিকেই দেশব্যাপী অনিশ্চয়তা ও অরাজকতার কিছু কিছু ফল ভোগ করিতে হইয়াছিল নিশ্চয়ই। তাহার কিছু কিছু প্ৰমাণ-পরিচয় বোধ হয় বাঙলার দুই চারিটি ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া যায়। পাহাড়পুরে পাল-সম্রাট ধর্মপালের আমলে বৌদ্ধ সোমপুর-মহাবিহার প্রতিষ্ঠার আগে সেইস্থানে যে একটি জৈন-বিহার ছিল, এ তথা, পাহাড়পুরের পট্টোলীতেই (৪৭৮-৭৯) প্রমাণ। এই বিহারের ধ্বংসাবশেষের উপরই সোমপুর-মহাবিহার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। মহাস্থানের ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও দেখা যায়, গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের ধ্বংসস্তুপের উপর। পরবর্তী পাল-আমলের বিহার মন্দির ইত্যাদি গড়িয়া উঠিয়াছে। নিশ্চিতভাবে বলিবার উপায় নাই, কিন্তু মনে হয়, এই সব ধ্বংসকার্য এই নৈরাজ্য ও বৈদেশিক আক্রমণের যুগেই সম্ভব হইয়াছিল। তাহা ছাড়া, বৌদ্ধধর্মের যে সমৃদ্ধ অবস্থাই য়ুয়ান-চোয়াঙ, ইৎ-সিঙ ও সেং-চি বৰ্ণনা করিয়া থাকুন না, পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্ম ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করিতেছিল, সন্দেহ নাই। 1 প্রায় সমসাময়িক লোকনাথ-পট্টোলী এবং কৈলান-পট্টোলীর সাক্ষ্য এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। শত শত বৌদ্ধ সঙ্ঘ, বিহার প্রভৃতি থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কার ক্রমশ জয়ী ও সর্বব্যাপী হইতেছিল। মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্পের গ্রন্থকার গোপালের নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বেকার বাঙলার কথা বলিতে গিয়া বলিয়াছেন–

‘এই সময় সমূদ্র পর্যন্ত বাঙলাদেশ তীৰ্থিকদের (ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী) দ্বারা পরিপূর্ণ, বৌদ্ধ মঠগুলি ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে এবং তাহারই ইটকািঠ কুড়াইয়া লোকে বাড়ি তৈয়ারী করিতেছে; দেশে অনেক ব্রাহ্মণ সামন্ত ভূম্যধিকারী ছিল এবং গোপালও ব্রাহ্মণানুরও ছিলেন।‘

ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক হইতে একশত বৎসর ধরিয়া বাঙলায় এক বৈপ্লবিক রূপান্তর সাধিত হইতেছিল বলিয়া মনে হয়। যে সংস্কৃত ভাষা বাঙালী পণ্ডিতদের হাতে কোনোপ্রকারে ভাব প্রকাশের উপায় মাত্র ছিল (পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের সংস্কৃত লিপিগুলিই তাহার প্রমাণ), সেই সংস্কৃত ভাষা সপ্তম শতকের মাঝামাঝি, বিশেষভাবে পাল আমলের সূত্রপাত হইতেই, অপূর্ব ছন্দলালিতাময় কাব্যময় ভােব প্রকাশের বাহন হইয়া উঠিয়াছে (দ্রষ্টব্য, লোকনাথের লিপি, পাল আমলের লিপিগুলি)। বৌদ্ধধর্ম আরও বিস্তৃত হইয়াছে শুধু তাঁহাই নয়, বাঙলার বহুস্থানে সুবৃহৎ মহাবিহার ইত্যাদিও স্থাপিত হইতেছে অষ্টম শতকের শেষপাদ হইতেই এবং বৌদ্ধ শিক্ষা-দীক্ষা বিস্তৃতি লাভ করিতেছে। যে ব্রাহ্মণ্যধর্মের দেবদেবীর সংখ্যা ও প্রসার ছিল সীমিত তাহাদের সংখ্যা যেমন বাড়িয়াছে, বিষ্ণু, শৈব, শাক্ত এবং নানা মিশ্র দেবদেবীতে দেশ যেমন ছাইয়া গিয়াছে, তেমনই তাঁহাদের প্রভাবও গিয়াছে বাড়িয়া। পাল আমলের সূচনা হইতেই বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই সমৃদ্ধি দৃষ্টি আকর্ষণ করে; সংস্কৃত ভাষার সমৃদ্ধিও দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়; বৌদ্ধধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তারের কারণ সুবোধ্য; পাল বংশই তো প্রধানত বৌদ্ধ বংশ ছিল। কিন্তু ব্ৰাহ্মণ্যধৰ্মও পূর্বযুগের অনুপাতে এই যুগে বহুতর বিস্তৃতি, প্রসার ও প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছে, এমন কি বৌদ্ধধর্মেরও সাংস্কৃতির আদর্শ অনেকটা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি অনুযায়ী। এই বিবর্তন সমস্তটাই সংঘটিত হইয়াছে মৎস্যন্যায়ের একশত বৎসরের মধ্যে এবং পাল আমলে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপিত হওয়ার পর তাহার সম্পূর্ণ রূপটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হইতেছে। এই একশত বৎসরের বৈদেশিক আক্রমণের দুর্যোেগ-দুর্বিপাককে আশ্রয় করিয়াই উত্তর ভারতের ক্রমবর্ধমান ক্রমপ্রসারমান ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি এবং সংস্কৃত ভাষা বাঙলাদেশে আসিয়া বিস্তৃততর সমৃদ্ধি লাভ করিয়াছে। আর, বাঙলাদেশের বৌদ্ধধর্ম যে পাল আমল হইতে উত্তরোত্তর তন্ত্রাশিত হইয়াছে তাহার মূলে স্ৰং-ৎসন-গ্যাম্পে এবং তাহার পৌত্রের এবং তাহারও পরবর্তী একাধিক তিব্বতী অভিযানের কোনও প্রভাব নাই, খড়্গ বংশীয় বৌদ্ধ রাজাদের কোনও প্রভাব নাই, এ কথাই বা কে বলিবে? খড়্গ বংশীয় রাজারা বহির্দেশাগত বলিয়াই তো মনে হয়। একশত বৎসরের রাষ্ট্ৰীয় দুর্যোগের কোন ফাকে কে বা কাহারা কোন সংস্কৃতির ধারায় কোন নূতন স্রোত বহাইয়া দিয়া গিয়াছেন, ইতিহাস তাহার হিসাব, এমন কি ইঙ্গিতও রাখে নাই। অথচ, বৃহৎ সামাজিক আবর্তন-বিবর্তন তো এই রকম দুর্যোগের মধ্যেই ঘটিয়া থাকে। বাঙলাদেশেও তাঁহাই হইয়াছিল; নহিলে পোল আমলের সূচনা হইতেই বৌদ্ধ এবং ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির, সংস্কৃত ভাষার এমন সুসমৃদ্ধ রূপ আমরা দেখিতে পাইতাম না।