• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৪. বিবর্তন ও পরিণতি, রাজপাদোপজীবী শ্রেণী

লাইব্রেরি » নীহাররঞ্জন রায় » বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব) » ০৭. শ্রেণী-বিন্যাস » ০৪. বিবর্তন ও পরিণতি, রাজপাদোপজীবী শ্রেণী

বিবর্তন ও পরিণতি, রাজপাদোপজীবী শ্রেণী

এই বিশ্লেষণের ফলে কী পাওয়া গেল, তাহা এইবার দেখা যাইতে পারে। রাজপুরুষদের লইয়াই আরম্ভ করা যাক। পঞ্চম হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত লিপিগুলিতে দেখিয়াছি, বিভিন্ন রাজপুরুষদের উল্লেখ আছে। মহারাজাধিরাজের অধীনে রাজা, রাজক, রাজনক-রাজন্যক, সামন্ত-মহাসামন্ত, মাণ্ডলিক-মহামাণ্ডলিক, এই সব লইয়া যে অনন্ত সামন্তচক্র ইহারাও রাজপদোপজীবী। রাজা-রাজনক-রাজপুত্র হইতে আরম্ভ করিয়া তরিক-শোন্ধিক -গৌলিক প্রভৃতি নিম্নস্তরের রাজকর্মচারী পর্যন্ত সকলের উল্লেখই শুধু নয়, তাহাদের সকলকে একত্রে একমালায় গাথিয়া বলা হইয়াছে “রাজ্যপাদোপজীবীনঃ”, এবং সুদীর্ঘ তালিকায়ও যখন সমস্ত রাজপুরুষের নাম শেষ হয় নাই, তখন তাহার পরই বলা হইয়াছে “অধ্যক্ষপ্রচারোক্তানিহকীর্তিতান”, অর্থাৎ আর যাঁহাদের কথা এখানে কীর্তিত বা উল্লিখিত হয়। নাই। কিন্তু তাহাদের নাম (অর্থশাস্ত্ৰ জাতীয় গ্রন্থের) অধ্যক্ষ পরিচ্ছেদে উল্লিখিত আছে। এই-যে সমস্ত রাজপুরুষকে একসঙ্গে গাথিয়া একটি সীমিত শ্রেণীতে উল্লেখ করা, তাহা পাল আমলেই যেন প্রথম আরম্ভ হইল; অথচ আগেও রাজপুরুষ, রাজপাদোপজীবীরা ছিলেন না, তাহা তো নয়। বোধ হয়, এইরূপভাবে উল্লেখের কারণ আছে। মোটামুটি সপ্তম শতকের সূচনা হইতে গৌড় স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় সত্তা লাভ করে; বঙ্গ এই সত্তার পরিচয় পাইয়াছিল। ষষ্ঠ শতকের তৃতীয় পাদ হইতে। যাহা হউক, সপ্তম শতকেই সর্বপ্রথম বাঙলাদেশ নিজস্ব রাষ্ট্র লাভ করিল, নিজস্ব শাসনতন্ত্র গড়িয়া তুলিল। গৌড় ও কর্ণসুবর্ণাধীপ শশাঙ্ককে আশ্রয় করিয়াই তাহার সূচনা দেখা গেল; কিন্তু তাহা স্বল্পকালের জন্য মাত্র। কারণ, তাহার পরই অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরিয়া সমস্ত দেশ জুড়িয়া রাষ্ট্ৰীয় আবর্ত, মাৎস্যন্যায়ের উৎপীড়ন। এই মাৎস্যন্যায় পর্বের পর পাল রাষ্ট্র ও পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙলাদেশ আবার আত্মসম্বিৎ ফিরিয়া পাইল, নিজের রাষ্ট্র ও রাজ্য লাভ করিল, রাষ্ট্ৰীয় স্বােজাত্য ফিরিয়া পাইল, এবং পাইল পূর্ণতর বৃহত্তর রূপে। মর্যাদায় ও আয়তনে, শক্তিতে ও ঐক্যবোধে বাঙলাদেশ নিজের এই পূর্ণতর বৃহত্তর রূপ আগে কখনও দেখে নাই। বোধ হয়, এই কারণেই রাষ্ট্র ও রাজপাদোপজীবীদের শুধু সবিস্তার উল্লেখই নয়, শাসনযন্ত্রের যাঁহারা পরিচালক ও সেবক, তাহারা নূতন এক মর্যাদার অধিকারী হইলেন, এবং তাহাদিগকে একত্রে গাথিয়া স্বসীমায় সুনির্দিষ্ট একটি শ্রেণীর নামকরণ করাটাও সহজ ও স্বাভাবিক হইয়া উঠিল। যাহাই হউক, সোজাসুজি রাজপাদোপজীবী অর্থাৎ সরকারী চাকুরীয়দের একটা সুস্পষ্ট শ্রেণীর খবর এই আমরা প্রথম পাইলাম।

 

ভূম্যধিকারির শ্রেণীস্তর

রাজপাদোপজীবী সকলেই আবার একই অর্থনৈতিক স্তরভুক্ত ছিলেন না, ইহা তো সহজেই অনুমেয়। ইহাদের মধ্যে সকলের উপরে ছিলেন রাণক, রাজনক, সামন্ত, মহাসামন্ত, মাণ্ডলিক, মহামাণ্ডলিক ইত্যাদি সামন্ত প্রভুরা; স্ব স্ব নির্দিষ্ট জনপদে ইহাদের প্রভুত্ব মহারাজাধিরাজাপেক্ষা কিছু কম ছিল না। সর্বপ্রধান ভূস্বামী মহাসামন্ত-মহামাণ্ডলিকেরা; তঁহাদের নীচেই সামন্ত-মাণ্ডলিকেরা- সামন্তসৌধের দ্বিতীয় স্তর। তৃতীয় স্তরে মহামহত্তরেরা— বৃহৎভূস্বামীর দল; চতুর্থ স্তরে মহত্তর ইত্যাদি, অর্থাৎ ক্ষুদ্র ভূস্বামীর দল এবং তাহার পর ধাপে ধাপে নামিয়া কুটুম্ব অর্থাৎ সাধারণ গৃহস্থ বা ভূমিবানপ্রজা, ভাগীপ্ৰজা, ভূমিবিহীন প্রজা ইত্যাদি। সামন্ত, মহাসামন্ত, মাণ্ডলিক, মহামাণ্ডলিক— ইহারা সকলেই সাক্ষাৎভাবে রাজপাদোপজীবী; কিন্তু মহত্তর, মহামহত্তর। কুটুম্ব প্রভৃতিরা রাজপাদোপজীবী নহেন, রাজসেবক মাত্র। রাষ্ট্রের প্রয়োজন আহূত হইলে রাজপুরুষদের সহায়তা ইহারা করিতেন, এমন প্রমাণ পঞ্চম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া প্ৰায় সকল লিপিতেই পাওয়া যায়।

 

রাজসেবক শ্রেণী

পূর্বোক্ত রাজপাদোপজীবী শ্রেণীর বাহিরে আর-একটি শ্ৰেণীর খবর আমরা পাইতেছি। অষ্টম শতক-পূর্ব লিপিগুলিতে এই শ্রেণীর লোকেদের খবর পাওয়া যায়। ইহারা রাজসরকারে চাকুরি করিতেন। কিনা ঠিক বলা যায় না, তবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আহূত হইলে রাজপুরুষদের সহায়তা করিতেন, তাহা বুঝা যায়; ইহাদের উল্লেখ আগেই করা হইয়াছে। পাল ও সেন আমলের লিপিগুলিতেও ইহাদের উল্লেখ আছে, কিন্তু এখানে ইহারা উল্লিখিত হইতেছেন রাষ্ট্রসেবক রূপে। ইঁহারা হইতেছেন, জ্যেষ্ঠ কায়স্থ, মহত্তর, মহামহত্তর, দাশগ্রামিক, করণ, বিষয়-ব্যবহারী ইত্যাদি। কোনও কোনও লিপিতে মহত্তর, মহামহত্তর ইতু্যাদি স্থানীয় ব্যক্তিদের এই শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে উল্লেখ করা হয় নাই, কিন্তু চাটভাট ইত্যাদি অন্যান্য নিম্নস্তরের রাজকর্মচারীরা সর্বদাই সেবকাদি অর্থাৎ (রাজ)-সেবকরূপে উল্লিখিত হইয়াছেন। অষ্টম শতক-পূর্ব লিপিগুলির জ্যেষ্ঠ কায়স্থ বা প্রথম কায়স্থ তো রাজপুরুষ বলিয়াই মনে হয়; যে পাঁচ জন মিলিয়া স্থানীয় অধিকরণ গঠন করেন, তিনি ছিলেন তাহাদের একজন। পরবর্তীকালে রাজপুরুষ না হইলেও তিনিও যে একজন রাজসেবক, তাহাতে আর সন্দেহ কী? এই (রাজ)-সেবকদের মধ্যে গৌড়মালব-খস-তৃণ-কুলিক-কর্ণাট-লাট-চোড় ইত্যাদি জাতীয় ব্যক্তিদের উল্লেখ পাইতেছি। ইহারা কাহারা? এটুকু বুঝিতেছি, ইহারাও কোনও উপায়ে রাষ্ট্রের সেবা করিতেন। যে-ভাবে ইহাদের উল্লেখ পাইতেছি, আমার তো মনে হয়, এই সব ভিনাপ্রদেশী লোকেরা বেতনভুক সৈন্যরূপে রাষ্ট্রের সেবা করিতেন। পুরোহিতরূপে লাট বা গুজরাটদেশীয় ব্ৰাহ্মণদের উল্লেখ তো খালিমপুর-লিপিতেই আছে। কিন্তু ঐ দেশীয় সৈন্যরাও এদেশে রাজসৈনিকররূপে আসিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। বিভিন্ন সময়ে অন্য প্রদেশ হইতে যে-সব যুদ্ধাভিযান বাঙলাদেশে আসিয়াছে, যেমন কর্ণাটীদের, তাহাদের কিছু কিছু সৈন্য এদেশে থাকিয়া যাওয়া অসম্ভব নয়। অবশ্য, অন্যান্য বৃত্তি অবলম্বন করিয়াও যে তাহারা আসেন নাই, তাহাও বলা যায় না। তবে, যে-ভাবেই হউক, এদেশে তাহারা যে-বুত্তি গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা রাজসেবকের বৃত্তি। অবশ্য, সমাজে সঙ্গে ইহাদের সম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ ছিল বলিয়া মনে হয় না।

যাহাই হউক, রাজপদোপজীবী শ্রেণীরই আনুষঙ্গিক বা ছায়ারূপে পাইলাম রাজসেবকশ্রেণী। এই দুই শ্রেণীর সমস্ত লোকেরাই এক স্তরের ছিলেন না, পদমর্যাদা এবং বেতনমর্যাদাও এক ছিল না, তাহা তো সহজেই অনুমান করা যায়। উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন স্তরের বিত্ত ও মর্যাদার লোক এই উভয় শ্রেণীর মধ্যেই ছিল; কিন্তু যে স্তরেই হউক, ইহাদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রাষ্ট্রের সঙ্গেই যে একান্তভাবে জড়িত ছিল, তাহা স্বীকার করিতে কল্পনার আশ্রয় লইবার প্রয়োজন নাই।

 

আমলাতন্ত্রের শ্রেণীস্তর

রাজ্যপাদোপজীবী শ্রেণীর বিভিন্ন স্তরগুলি ধরিতে পারা কঠিন নয়। সামন্ত, মহাসামন্ত, মাণ্ডলিক, মহামাণ্ডলিক প্রভূতির কথা আগেই বলিয়াছি। ইহাদের নীচের স্তরেই পাইতেছি উপরিক বা ভুক্তিপতি, বিষয়পতি, মণ্ডলপতি, অমাতা, সান্ধিবিগ্রহিক, মন্ত্রী, মহামন্ত্রী, ধর্মাধ্যক্ষ, দণ্ডনায়ক, মহাদণ্ডনায়ক, দৌঃসাধসাধনিক, দৃত, দূতক, পুরোহিত, শান্ত্যাগরিক, রাজপণ্ডিত, কুমারামোত্য, মহাপ্ৰতীহার, রাজামাতা, রাজস্থানীয় ইত্যাদি। সুবৃহৎ আমলাতন্ত্রে ইহারাই উপরতম স্তর এবং ইহাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ, অর্থাৎ শ্রেণী:স্বাৰ্থ একদিকে যেমন রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত, তেমনই অন্যদিকে ক্ষুদ্র বৃহৎ ভূস্বামীদের সঙ্গে। এই উপরতম স্তরের নীচেই একটি মধ্যবিত্ত, মধ্যক্ষমতাধিকারী রাজকর্মচারীর স্তর; এই স্তরে বোধ হয় অগ্রহারিক, ঔদ্রঙ্গিক, আবস্থিক, চৌরোদ্ধািরণিক, বলাধ্যক্ষ, নাবাধ্যক্ষ, দাণ্ডিক, দণ্ডপাশিক, দণ্ডশক্তি, দশাপরাধিক, গ্রামপতি, জ্যেষ্ঠকায়স্থ, খণ্ডরক্ষ, খোল, কোট্টাপাল, ক্ষেত্রপ, প্ৰমাতৃ, প্রান্তপাল, ষষ্ঠাধিকৃত ইত্যাদি। ইঁহাদের নিম্নবর্তী স্তরে শৌল্বিক, গৌল্মিক, গ্রামপতি, হট্টপটি, লেখক, শিরোরক্ষিক, শান্তকিক, বাসাগরিক, পিলুপতি ইত্যাদি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে এই সব রাজপুরুষদের ক্ষমতা ও মর্যাদার তারতম্য হইত, ইহা সহজেই অনুমেয়। সর্বনিম্ন স্তরও একটি নিশ্চয়ই ছিল; এই স্তরে স্থান হইয়াছিল ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্রসেবকদলের, এবং এই দলে কুণ-মালব –খস-লাট -কর্ণাট-চোড় ইত্যাদি বেতনভুক সৈন্যরা ছিলেন, ক্ষুদ্র করণ বা কেরানিরা ছিলেন, চাটভাটেরা ছিলেন এবং ছিলেন আরও অনেকে।

মহত্তর, মহামহত্তর, কুটুম্ব, প্রতিবাসী, জনপদবাসী ইত্যাদিরা কোন্‌ শ্রেণীর লোক ছিলেন, ইঁহাদের বৃত্তি কী ছিল? ইহাদের অধিকাংশই যে বিভিন্ন স্তরে ভূম্যধিকারী ছিলেন, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার অবসর কম। শাসনাবলীতে উল্লিখিত রাজপাদোপজীবী, ক্ষেত্রকর, ব্ৰাহ্মণ এবং নিম্নস্তরের চণ্ডাল পর্যন্ত লোকেদের বাদ দিলে যাঁহারা বাকী থাকেন, তাহাদের মধ্যে অধিকাংশ ভূমিসম্পদে এবং অল্পসংখ্যক ব্যক্তিগত গুণে ও চরিত্রে সমাজে মান্য ও সম্পন্ন হইয়াছিলেন; তাহারাই মহামহত্তর ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত হইয়াছেন এরূপ মনে করিলে অন্যায় হয় না। কুটুম্ব, প্রতিবাসী, জনপদবাসী— ইঁহারা সাধারণভাবে স্বল্পভূমিসম্পন্ন গৃহস্থ; কৃষি, গৃহ-শিল্প ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাবসা ইহাদের বৃত্তি ও জীবিকা। কৃষি ইঁহাদের বৃত্তি বলিলাম বটে, কিন্তু ইহারা নিজেরা নিজেদের হাতে চাষের কাজ করিতেন বলিয়া মনে করিতে পারিতেছি না। যদিও ভূমির মালিক পৃথকভাবে উল্লিখিত হইয়াছেন। অষ্টম শতকের দেবখড়েগর আম্রফপুর-লিপির একটি স্থানে দেখিতেছি, ভূমি ভোগ করিতেছেন। একজন, কিন্তু চাষ করিতেছে অন্য লোকেরা—“শ্ৰীশৰ্বান্তরেণ ভুজ্যমানকঃ মহত্তরশিখরাদিভিঃ কৃষ্যমাণকঃ” (এখানে মহত্তর একজন ব্যক্তির নাম)। এই ব্যবস্থা শুধু এখন নয়, প্রাচীন কালে এবং মধ্যযুগেও প্রচলিত ছিল।। বস্তুত, যিনি ভূমির মালিক, তাহার পক্ষে নিজের হাতেই সমস্ত ভূমি রাখা এবং নিজেরাই চাষ করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। জমি নানা শর্তে বিলি বন্দােবস্তু করিতেই হইত, সে ইঙ্গিত পূর্ববতী এক অধ্যায়ে ইতিপূর্বেই করিয়াছি। সাহিত্য-পরিষদে রক্ষিত বিশ্বরূপসেনের এক লিপিতে দেখিতেছি, হল্যায়ুধ শৰ্মা নামক জনৈক আবল্লিক মহাপণ্ডিত ব্ৰাহ্মণ একা নিজের ভোগের জন্য নিজের গ্রামের আশেপাশে তিন-চারিটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে ৩৩৬ই উন্মান ভূমি রাজার নিকট হইতে দানম্বরূপ পাইয়াছিলেন; এই ভূমির বার্ষিক আয় ছিল ৫০০ কপর্দক পুরাণ। এই ৩৩৬৪ উন্মানের মধ্যে অধিকাংশ ছিল নালভূমি অর্থাৎ চাষের ক্ষেত্র। ইহা তো সহজেই অনুমেয় যে, এই সমগ্ৰ ভূমি হলায়ুধ শৰ্মর সমগ্র পরিবার পরিজনবৰ্গ লইয়াও নিজেদের চাষ করা সম্ভব ছিল না, এবং হলায়ুধ শৰ্মা ক্ষেত্ৰকল্প বলিয়া উল্লিখিতও হইতে পারেন না। র্তাহাকে জমি নিম্নপ্রজাদের মধ্যে বিলি বন্দোবস্ত করিয়া দিতেই হইত। এই নিম্নপ্রজাদের মধ্যে যাঁহারা নিজেরা চাষবাস করেন, তাহারাই ক্ষেত্রকর। এইখানে এই ধরনের একটি অনুমান যদি করা যায় যে, সমাজের মধ্যে ভূমি-সম্পদে ও শিল্প-বাণিজ্যাদি সম্পদে সমৃদ্ধ নানা স্তরের একটি শ্রেণীও ছিল এবং এই শ্রেণীরই প্রতিনিধি হইতেছেন মহত্তর, মহামহত্তর, কুটুম্ব ইত্যাদি ব্যক্তিরা, তাহা হইলে ঐতিহাসিক তথ্যের বিরোধী বোধ হয় কিছু বলা যায় না। বরং যে প্রমাণ আমাদের আছে, তাহার মধ্যে তাহার ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন, এ-কথা স্বীকার করিতে হয়।

 

ধর্ম ও জ্ঞানজীবী শ্রেণী

ব্ৰাহ্মণেরা বর্ণ হিসাবে যেমন, শ্রেণী হিসাবেও তেমনই পৃথক শ্রেণী; এবং এই শ্রেণীর উল্লেখ তো পরিষ্কার। দান-ধ্যান-ক্রিয়াকর্ম যাহা-কিছু করা হইতেছে, ইহাদের সম্মাননা করার পর। ভূমিদানি ইহারাই লাভ করিতেছেন, ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ রাজপদোপজীবী শ্রেণীতে উল্লিখিত হইয়াছেন; মন্ত্রী, এমন-কি, সেনাপতি, সামন্ত, মহাসামন্ত, আবস্থিক, ধর্মধ্যক্ষ ইত্যাদিও হইয়াছেন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহারা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। সাধারণ নিয়মে ইহারা পুরোহিত, ঋত্বিক, ধৰ্মজ্ঞ, নীতিপাঠক, শাস্ত্যাগারিক, শান্তিবারিক, রাজপণ্ডিত, ধৰ্মজ্ঞ, স্মৃতি ও ব্যবহারশাস্ত্ৰাদির লেখক, প্রশস্তিকার, কাব্য, সাহিত্য ইত্যাদির রচয়িতা। ইহাদের উল্লেখ পাল ও সেন আমলের লিপিগুলিতে, সমসাময়িক সাহিত্যে বারংবার পাওয়া যায়। এই ব্ৰাহ্মণ-শাসিত ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ছাড়া পাল আমলের শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রাধান্যও কম ছিল না। ব্ৰাহ্মণেরা যেমন শ্রেণী-হিসাবে সমাজের ধর্ম, শিক্ষা, নীতি ও ব্যবহারের ধারক ও নিয়ামক ছিলেন, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মসংঘগুলিও ঠিক তেমনই সমাজের কতকাংশের ধর্ম, শিক্ষা ও নীতির ধারক ও নিয়ামক ছিল, এবং তাঁহাদের পোষণের জন্যও রাজা ও অন্যান্য সমর্থ ব্যক্তিরা ভূমি ইত্যাদি দান করিতেন; ভূমিদান, অর্থদান ইত্যাদি গ্রহণ করিয়া তাহারা প্রচুর ভূমি ও অর্থ-সম্পদের অধিকারী হইতেন, তাহার প্রমাণের অভাব নাই। এই বৌদ্ধ-জৈন স্থবির ও সংঘ-সভ্যদের এবং ব্ৰাহ্মণদের লইয়া প্রাচীন বাঙলার বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান-ধর্মজীবী শ্রেণী।

 

কৃষক বা ক্ষেত্রকর শ্রেণী

ক্ষেত্রকর শ্রেণীর কথা তো প্রসঙ্গক্রমে আগেই বলা হইয়াছে। অষ্টম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া যতগুলি লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাদের প্রায় প্রত্যেকটিতেই ক্ষেত্রকরদের বা কৃষক-কর্ষকদের উল্লেখ আছে। অথচ আশ্চর্য এই অষ্টম শতকের আগে প্রায় কোনও লিপিতেই ইহাদের উল্লেখ নাই, যদিও উভয় যুগের লিপিগুলি, একাধিকবার বলিয়াছি, ভূমি ক্ৰয়-বিক্রয় ও দানেরই পট্টোলী। এ তর্ক করা চলিবে না যে, ক্ষেত্রকর বা কৃষক পূর্ববর্তী যুগে ছিল না, পরবর্তী যুগে হঠাৎ দেখা দিল। খিল অথবা ক্ষেত্রভূমি দান ক্রয়-বিক্রয় যখন হইতেছে, চাষের জন্যই হইতেছে। এ-সম্বন্ধে তর্কের সুযোগ কোথায়? আর, ভূমি দান বিক্রয় যদি মহত্তর, কুটুম্ব, শিল্পী, ব্যবসায়ী, রাজপুরুষ, সাধারণ ও অসাধারণ (প্রকৃতয়ঃ এবং অক্ষুদ্র-প্রকৃতয়ঃ) লোক, ব্রাহ্মণ ইত্যাদি সকলকে বিজ্ঞাপিত করা যায়, তাহা হইলে ভূমিব্যাপারে র্যাহার স্বাৰ্থ সকলের চেয়ে বেশি, সেই কর্ষকের উল্লেখ নাই কেন? আর, অষ্টম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া পরবর্তী লিপিগুলিতে র্তাহাদের উল্লেখ আছে কেন? তর্ক তুলিতে পারা যায়, পূর্ববর্তী যুগের লিপিগুলিতে কৃষকদের অনুল্লেখের কথা যাহা বলিতেছি, তাহা সত্য নয়; কারণ তাহারা হয়তো ঐ গ্রামবাসী কুটুম্ব, গৃহস্থ, প্রকৃতয়ঃ অর্থাৎ সাধারণ লোক, ইহাদের মধ্যেই তীহাদের উল্লেখ আছে। ইহার উত্তর হইতেছে, তাহা হইলে এই সব কুটুম্ব প্রতিবাসী, জনপদবাসী জনসাধারণের কথা তো অষ্টম শতক-পরবর্তী লিপিগুলিতেও আছে, তৎসত্ত্বেও পৃথকভাবে ক্ষেত্রকরদের, কৃষকদের উল্লেখ আছে কেন? আমার কিন্তু মনে হয়, পঞ্চম হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত লিপিগুলিতে কৃষকদের অনুল্লেখ এবং পরবতী লিপিগুলিতে প্রায় আবশ্যিক উল্লেখ একেবারে আকস্মিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। ইহার একটি কারণ আছে এবং এই কারণের মধ্যে প্রাচীন বাঙলার সমাজ-বিন্যাসের ইতিহাসের একটু ইঙ্গিত আছে। একটু বিস্তারিত ভাবে সেটি বলা প্রয়োজন।

ভূমি-ব্যবস্থা সম্বন্ধে পূর্বতন একটি অধ্যায়ে আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, লোকসংখ্যা বৃদ্ধির জন্যই হউক বা অন্য কোনও কারণেই হউক— অন্যতম একটি কারণ পরে বলিতেছি— সমাজে ভূমির চাহিদা ক্রমশ বাড়িতেছিল, সমাজের মধ্যে ব্যক্তিবিশেষকে কেন্দ্র করিয়া ভূমি কেন্দ্রীকৃত হইবার দিকে একটা ঝোক একটু একটু করিয়া দেখা দিতেছিল। সামাজিক ধনোৎপাদনের ভারকেন্দ্রটি ক্রমশ যেন ভূমির উপরই আসিয়া পড়িয়াছিল; পাল ও বিশেষ করিয়া সেন-আমলের লিপিগুলি তন্ন তন্ন করিয়া পড়িলে এই কথাই মনের মধ্যে জুড়িয়া বসিতে চায়। কোন ভূমির উৎপন্ন দ্রব্য কী, ভূমির দাম কত, বার্ষিক আয় কত, ইত্যাদি সংবাদ খুঁটিনাটি সহ সবিস্তারে যে-ভাবে দেওয়া হইতেছে, তাহাতে সমাজের কৃষি-নির্ভরতার ছবিটাই যেন দৃষ্টি ও বুদ্ধি অধিকার করিয়া বসে। তাহা ছাড়া, জনসংখ্যা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নূতন নূতন ভূমি আবাদ, জঙ্গল কাটিয়া গ্রাম বসাইবার ও চাষের জন্য জমি বাহির করিবার চেষ্টাও চোখে পড়ে। বুস্তুত, তেমন প্রমাণও দু-একটি আছে; দৃষ্টান্তস্বরূপ সপ্তম শতকের লোকনাথের ত্রিপুরা-পট্টোলীর উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই ক্রমবর্ধমান কৃষিনির্ভরতার প্রতিচ্ছবি সামাজিক শ্রেণী-বিন্যাসের মধ্যে ফুটিয়া উঠিবে তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই, এবং পাল ও সেন-আমলের লিপিগুলিতে তাহাই হইয়াছে। সপ্তম শতক পর্যন্ত লিপিগুলিতে বর্ণিত ও উল্লিখিত ব্যক্তিদের মধ্যে পৃথক ও সুনির্দিষ্টভাবে কৃষক বা ক্ষেত্রকর বলিয়া যে কাহারও উল্লেখ নাই তাহার কারণ এই নয় যে, তখন কৃষক ছিল না, কৃষিকর্ম হইত না; তাহার যথার্থ ঐতিহাসিক কারণ, সমাজ তখন একান্তভাবে কৃষিনির্ভর হইয়া উঠে নাই, এবং কৃষক বা ক্ষেত্রকর সমাজের মধ্যে থাকিলেও তাহারা তখনও একটা বিশেষ অথবা উল্লেখযোগ্য শ্রেণী হিসাবে গড়িয়া উঠেন নাই। আমার এই যে অনুমান তাহার সবিশেষ সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ঐতিহাসিক গবেষণার বর্তমান অবস্থায় দেওয়া সম্ভব নয়; কিন্তু আমি যে-যুক্তির মধ্যে এই অনুমান প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করিলাম তাহা সমাজতাত্ত্বিক যুক্তি নিয়মের বহির্ভূত, পণ্ডিতেরা আশা করি তাহা বলিবেন না।

যাহাই হউক, এই পর্যন্ত শ্রেণী-বিন্যাসের যে-তথ্য আমরা পাইলাম তাহাতে দেখিতেছি, রাজপাদোপজীবীরা একটি সুসংবদ্ধ, সুস্পষ্ট সীমারেখায় নির্দিষ্ট একটি শ্রেণী এবং তাঁহাদেরই আনুষঙ্গিক ছায়ারূপে আছেন (রাজ)-সেবক শ্রেণী। ইহার রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালক ও সহায়ক। ইহাদের মধ্যে আবার বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্তর বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। বিদ্যা-বুদ্ধি -জ্ঞান-ধৰ্মজীবীরা আর-একটি শ্রেণী; ইহারা সাধারণভাবে জ্ঞান-ধর্ম-সংস্কৃতির ধারক ও নিমামক। ইহাদের মধ্যে ব্ৰাহ্মণদের সংখ্যাই অধিক; বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের সংঘগুরু এবং যতিরাও আছেন, সিদ্ধাচার্যরা আছেন এবং স্বল্পসংখ্যক কারণ-কায়স্থ, বৈদ্য এবং উত্তম-সংকর বা সৎশূদ্র পর্যায়ের কিছু কিছু লোকও আছেন। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি ধোয়ী তন্তুবায় ছিলেন এবং সমসাময়িক অন্য আর একজন কবি, জনৈক পাপীপ, জাতে ছিলেন কেবাট্ট বা কৈবর্ত। ব্ৰহ্মদেয় অথবা ধর্মদেয় ভূমি, দক্ষিণালব্ধ ধন ও সাময়িক পুরস্কার হইল এই শ্রেণীর প্রধান আর্থিক নির্ভর। ভূম্যধিকারীর একটি শ্রেণীও অল্পবিস্তর সুস্পষ্ট এবং এই শ্রেণীও বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। সর্বোপরি স্তরে সামন্ত শ্রেণী এবং নীচে স্তরে স্তরে মহত্তর, মহামহত্তর ইত্যাদি ভূমিসম্পৃক্ত অভিজাত শ্রেণী হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে কুটুম্ব ও প্রধান প্রধান গৃহস্থ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূস্বামীর স্তর। ইহারা, বিশেষভাবে নিম্নতর স্তরের ভূস্বামীরাই শাসনোক্ত ‘অক্ষুদ্র প্রকৃতয়ঃ’। চতুর্থ একটি শ্রেণী হইতেছে ক্ষেত্রকর বা কৃষকদের লইয়া। দেশের ধনোৎপাদনের অন্যতম উপায় ইহাদের হাতে; কিন্তু বণ্টন ব্যাপারে ইহাদের কোনও হাত নাই; ইহারা অধিকাংশই স্বল্পমাত্র ভূমির অধিকারী অথবা ভাগচাষী ও ভূমিহীন চাষী। পাল ও সেন লিপিতে পঞ্চম একটি শ্রেণীর উল্লেখ আছে; এই শ্রেণীর লোকেরা সমাজের শ্রমিক-সেবক, অধিকাংশই ভূমি-বঞ্চিত, রাষ্ট্ৰীয়-সামাজিক অধিকার বঞ্চিত। এই শ্রেণী তথাকথিত অন্ত্যজ ও স্লেচ্ছাবর্ণের ও আদিবাসী কোমের নানা বৃত্তিধারী লোকেদের লইয়া গঠিত। লিপিগুলিতে বিশদভাবে ইহাদের কথা বলা হয় নাই, এবং যেটুকু বলা হইয়াছে তাহাও পালপর্বের লিপিমালাতেই। অষ্টম শতকের আগে ইহাদের উল্লেখ নাই; পালপর্বের পরেও ইহাদের উল্লেখ নাই। পালপর্বেও ইহাদের সকলকে লইয়া নিম্নতম বৃত্তি ও স্তরের নাম পর্যন্ত করিয়া এক নিঃশ্বাসে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে, “মেদাস্ত্ৰচণ্ডালপর্যন্তান”— একেবারে চণ্ডাল পর্যন্ত। কিন্তু পাল ও সেন-আমলের সমসাময়িক সাহিত্যে— কাব্যে, পুরাণে, স্মৃতিগ্রন্থে— ইহাদের বর্ণ ও বৃত্তিমর্যাদা সম্বন্ধে বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়। আগেই বর্ণ-বিন্যাস ও বর্তমান অধ্যায়ে সে-সাক্ষ্য উপস্থিত করিয়াছি। লিপি প্রমাণদ্বারাও সমসাময়িক সাহিত্যের সাক্ষ্য সমর্থিত হয়। রাজক ও নাপিতরাও সমাজশ্রমিক, সঙ্গে সঙ্গে তাহারা আবার কর্ষক বা ক্ষেত্ৰকারও বটে। জনৈক রাজক সিরাপা ও নাপিত গোবিন্দের উল্লেখ পাইতেছি। শ্ৰীহট্ট জেলার ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত গোবিন্দকেশবের লিপিতে। মেদ, অন্ধ, চণ্ডাল ছাড়া আরও দু’একটি অস্ত্যজ ও স্লেচ্ছ পর্যায়ের, অর্থাৎ নিম্নতম অর্থনৈতিক স্তরের লোকেদের খবর সমসাময়িক লিপিতে পাওয়া যায়, যেমন পুলিন্দ, শবর ইত্যাদি। চর্যাপদে যে ডোম, ডোম্বী বা ডোিমনী, শবর-শবরী, কাপালিক ইত্যাদির কথা বার বার পাওয়া যায় তাহারাও এই শ্রেণীর। একটি পদে স্পষ্টই বলা হইয়াছে, ডোন্ধীর কুঁড়িয়া (কুঁড়ে ঘর) নগরের বাহিরে; এখনও তো তাহারা গ্রাম ও নগরের বাহিরেই থাকে। বাশের চাংগাড়ী ও বাঁশের তাত তৈরী করা তখন যেমন ছিল ইহাদের কাজ, এখনও তাঁহাই। শিল্পীশ্রেণীর মধ্যে তন্তুবায় সম্প্রদায়ের খবরও চর্যাগীতিতে পাওয়া যায়; সিদ্ধাচার্য তন্ত্রীপাদ সিদ্ধিপূর্বজীবনে এই সম্প্রদায়ের লোক এবং তািতগুরু ছিলেন বলিয়াই তো মনে হয়।

 

শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী

কিন্তু অষ্টম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া এই যে বিভিন্ন শ্রেণীর সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট ইঙ্গিত আমরা পাইলাম, ইহার মধ্যে শিল্পী, বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণীর উল্লেখ কোথায়? এই সময়ের ভূমি দান-বিক্রয়ের একটি পট্টোলীতেও ভুল করিয়াও বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর কোনও ব্যক্তির উল্লেখ নাই; ইহা আশ্চর্য নয় কি? অষ্টম শতক-পূর্ববর্তী লিপিগুলিও ভূমি দান-বিক্রয়ের দলিল, সেখানে তো দেখিতেছি, স্থানীয় অধিকরণ উপলক্ষেই যে শুধু নগরশ্ৰেষ্ঠী, প্রথম সার্থিবাহ ও প্রথম কুলিকের নাম করা হইতেছে, তাহাই নয়, কোনও কোনও লিপিতে “প্রধানব্যাপারিণঃ’ বা প্রধান ব্যবসায়ীদেরও উল্লেখ করা হইতেছে, অন্যান্য শ্রেণীর ব্যক্তিদের সঙ্গে বণিক ও ব্যবসায়ীদেরও বিজ্ঞাপিত করা হইতেছে। রাষ্ট্র-ব্যাপারেও তাঁহাদের বেশ কতকটা আধিপত্য দেখা যাইতেছে। কিন্তু অষ্টম শতকের পর এমন কি হইল, যাহার ফলে পরবর্তী লিপিগুলিতে এই শ্রেণীটির কোনো উল্লেখ রইল না? ভূমিদানের ব্যাপারে শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপিত করিবার কোনও প্রয়োজন হয় নাই, এই তর্ক উঠিতে পারে। এ যুক্তি হয়তো কতকট সত্য, কিন্তু প্রয়োজন কি একেবারেই নাই? যে-গ্রামে ভূমিদান করা হইতেছে, সে-গ্রামের সকল শ্রেণী ও সকল স্তরের লোক, এমন কি চণ্ডাল পর্যন্ত সকলের উল্লেখ করা হইতেছে, অথচ শ্রেণী হিসাবে শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ীদের কোনও উল্লেখই হইতেছে না। এতগুলি নাম ও তৎসম্পৃক্ত ভূমিদানের উল্লেখ আমরা পাইতেছি, অথচ তাহার মধ্যে একটি গ্রামেও শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোক কি ছিলেন না? আর যেখানে রাজসেবকদের উল্লেখ করা হইতেছে, সেখানেও তো নগরশ্ৰেষ্ঠী বা সার্থবহ বা কুলিক ইত্যাদির কাহারও উল্লেখ পাইতেছি না। অথচ, সপ্তম শতক পর্যন্ত তাহারাই তো স্থানীয় অধিকরণের প্রধান সহায়ক, তাহারা এবং ব্যাপারীরাই স্থানীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সংব্যবহারী। অথচ ইহাদের কোনো উল্লেখ নাই। এখানেও আমার মনে হয়, এই অনুল্লেখ আকস্মিক নয়। অষ্টম শতকের পরে শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী ছিলেন না, এইরূপ অনুমান মুখতা মাত্র। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারে, খালিমপুর লিপির “প্ৰত্যাপণে মানপৈঃ”— দোকানে দোকানে মানপদের দ্বারা ধর্মপালের যশ কীর্তনের কথা, তারনাথ কথিত শিল্পী ধীমান ও বীটপালের কথা, শিল্পী মহীধর, শিল্পী শশিদেব, শিল্পী কর্ণভদ্র, শিল্পী তথাগতসর, সূত্ৰধার বিষ্ণুভদ্র এবং আরও অগণিত শিল্পী যাহারা পাল লিপিমালা ও অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ করিয়াছিলেন তাহাদের কথা; বণিক বুদ্ধমিত্র ও বণিক লোকদত্তের কথা। মহারাজাধিরাজ মহীপালের রাজত্বের যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ রােজ্যাঙ্কে বিলকিন্দক (ত্রিপুরা জেলার বিলকান্দি) গ্রামবাসী শেষোক্ত দুই বণিক একটি নারায়ণ ও একটি গণেশমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। শুধু পাল আমলেই তো নয়; সেন আমলেও শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ীদের অপ্রাচুর্য ছিল না। শিল্পীদের তো গোষ্ঠীই ছিল এবং বিজয়সেনের আমলে জনৈক রাণিক শিল্পীগোষ্ঠীর অধিনায়ক ছিলেন। পূর্বোক্ত ভাটেরা গ্রামের গোবিন্দকেশবের লিপিতে এক কাংস্যকার (কঁসারী) এবং দন্তকারের (হাতির দাতের কাজ যাহারা করেন) খবর পাওয়া যাইতেছে। বল্লালচরিতে বণিক ও বিশেষভাবে সুবর্ণবণিকদের উল্লেখ তো সুস্পষ্ট। আর বৃহদ্ধর্ম ও ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণ দুটিতে তো শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর অগণিত উপবর্ণের তালিকা পাওয়া যাইতেছে। শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখ করা যায়, তন্তুবায়-কুবিন্দক, কর্মকার, কুম্ভকার, কংসকার, শঙ্খকার, তক্ষণ-সূত্ৰধার, স্বর্ণকার, চিত্রকার, অট্টালিকাকার, কোটক ইত্যাদি। বণিক-ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা পাইতেছি, তৈলিক, তৌলিক, মোদক, তাম্বলী, গন্ধৰ্ব্বণিক, সুবর্ণবণিক, তৈলকর, ধীবর ইত্যাদির।

শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী সমাজে তাহা হইলে নিশ্চয়ই ছিলেন; কিন্তু অষ্টম শতকের পূর্বে শ্রেণী হিসাবে তাহাদের যে প্রাধান্য রাষ্ট্রে ও সমাজে ছিল, সেই প্রাধান্য ও আধিপত্য সপ্তম শতকের পর হইতেই কমিয়া গিয়াছিল। বণিক ও ব্যবসায়ী বৃত্তিধারী যে-সব বর্ণের তালিকা উপরোক্ত দুই পুরাণ হইতে উদ্ধার করা হইয়াছে, লক্ষণীয় এই যে, ইহারা সকলেই ক্ষুদ্র বণিক ও ব্যবসায়ী স্থানীয় দেশান্তর্গত ব্যাবসা-বাণিজ্যেই যেন ইহাদের স্থান। প্রাচীনতর কালের, অর্থাৎ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের এবং হয়তো তাহারও আগেকার কালের শ্রেষ্ঠী ও সার্থবাহরা কোথায় গেলেন? ইহাদের উল্লেখ সমসাময়িক সাহিত্যে বা লিপিতে নাই কেন? আমি এই অধ্যায়েই পূর্বে দেখাইতেই চেষ্টা করিয়াছি, ঠিক এই সময় হইতেই অর্থাৎ মোটামুটি অষ্টম শতক হইতেই প্রাচীন বাঙলার সমাজ কৃষিনির্ভর হইয়া পড়িতে আরম্ভ করে, এবং ক্ষেত্রকর-কর্ষকেরাও বিশেষ একটি শ্রেণীরূপে গড়িয়া উঠেন, এবং সেইভাবেই সমাজে স্বীকৃত হন। অষ্টম শতকের আগে তাহাদের সুনির্দিষ্ট শ্রেণী হিসাবে গড়িয়া উঠিবার কোনও প্রমাণ নাই। শিল্পী, বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর পক্ষে হইল ঠিক ইহার বিপরীত। পঞ্চম হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত দেখি— বোধহয় খ্ৰীষ্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক হইতেই– বিশেষভাবে শ্রেণী হিসাবে তাঁহাদের উল্লেখ না থাকিলেও রাষ্ট্র ও সমাজে ইহাৱাই ছিলেন প্রধান, তাহাদেরই আধিপত্য ছিল অন্যান্য শ্রেণীর লোকদের অপেক্ষা বেশি। ইহার একমাত্র কারণ, তদানীন্তর বাঙালী সমাজ প্রধানত শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য নির্ভর। এই তিন উপায়েই ধনোৎপাদনের প্রধান তিন পথ, এবং সামাজিক ধন বণ্টনও অনেকাংশে নির্ভর করিত ইহাদের উপর। কৃষিও। তখন ধনোৎপাদনের অন্যতম উপায় বটে, কিন্তু প্রধান উপায় শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য। অষ্টম শতক হইতে সমাজ অধিকতর কৃষিনির্ভর, এবং উত্তরোত্তর এই নির্ভরতা বাড়িয়াই গিয়াছে; শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য ধনোৎপাদনের প্রধান ও প্রথম উপায় আর থাকে নাই, এবং সেইজন্যই রাষ্ট্র ও সমাজে ইহাদের প্রাধান্যও আর থাকে নাই। ব্যক্তি হিসাবে কাহারও কাহারও মর্যাদা স্বীকৃতি হইলেও শ্রেণী হিসাবে সপ্তম শতক-পূর্ব মর্যাদা আর তাহারা ফিরিয়া পান নাই। লক্ষণীয় যে, অনেক শিল্পী ও বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোক বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে মধ্যম-সংকর বা অসৎশদ্র পর্যায়ভুক্ত; যাঁহারা উত্তম-সংকর বা সৎশদ্র পর্যায়ভুক্ত তীহাদেরও মর্যাদা কারণ-কায়স্থ, বৈদ্য-অম্বষ্ঠ, গোপ, নাপিত প্রভৃতির নীচে। ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের সাক্ষ্যে দেখিতেছি, শিল্পী, স্বর্ণকার, সূত্ৰধার ও চিত্রকার এবং কোনও কোনও বণিক সম্প্রদায়কে মধ্যম সংকর পর্যায়ে স্থান দেওয়া হইয়াছে। বল্লালচরিতের সাক্ষ্য প্রামাণিক হইলে স্বীকার করিতে হয়, বণিক ও বিশেষভাবে সুবৰ্ণ বণিকদের তিনি সমাজে পতিত করিয়া দিয়াছিলেন। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, রাষ্ট্র ও সমাজে ইহাদের প্রাধান্য থাকিলে, ধনোৎপাদন ও বণ্টন ব্যাপারে। ইহাদের আধিপত্য থাকিলে এইরূপ স্থান নির্দেশ বা অবনতিকরণ কিছুতেই সম্ভব হইত না।

সদ্যোক্ত মন্তব্য ঐতিহাসিক অনুমান সন্দেহ নাই, তবু আমার যুক্তিটি যদি ঐতিহাসিক মর্যাদার বিরোধী না হয় এবং ধনসম্বল অধ্যায়ে সামাজিক ধনের বিবর্তনের ইঙ্গিত, মুদ্রার ইঙ্গিত আমি যে-ভাবে নির্দেশ করিয়াছি, ভূমি-বিন্যাস অধ্যায়ে আমি যাহা বলিয়াছি তাহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এই অনুমানও ঐতিহাসিক সত্যের দাবি রাখে, সবিনয়ে আমি এই নিবেদন করি। তবে, এই অনুমানের সপক্ষে সমসাময়িক যুগের (দ্বাদশ শতক) একটি কবির একটি শ্লোক আমি উদ্ধার করিতে পারি। এই শ্লোক ঐতিহাসিক দলিলের মূল্য ও মর্যাদা দাবি করে না। সত্য কিন্তু আমার ধারণা, এই শ্লোকটিতে উপরোক্ত সামাজিক বিবর্তনের অর্থাৎ বণিক-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অবনতি এবং কৃষক-ক্ষেত্রকর সম্প্রদায়ের উন্নতির ইঙ্গিত অত্যন্ত সুস্পষ্ট। গোবর্ধন আচার্য ছিলেন লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি; তাহারই রচনা এই পদটি। প্রাচীনকালে শ্রেষ্ঠীরা শক্ৰধ্বজোত্থান পূজা (ইন্দ্রের ধ্বজার পূজা) উৎসব করিতেন; দ্বাদশ শতকেও উৎসবটি হাইত কিন্তু তখন শ্রেষ্ঠীরা আর ছিলেন না।

তে শ্রেষ্ঠানঃ রূ সম্প্রতি শক্ৰধ্বজ যৈঃ কৃতস্তবোচ্ছায়াঃ।
ঈষাং বা মেঢ়িং বাধূনাতনাস্ত্ৰাং বিধিৎসন্তি ৷।
হে শক্ৰধ্বজ! যে শ্রেষ্ঠীরা (একদিন) তোমাকে উন্নত করিয়া গিয়াছিলেন, সম্প্রতি সেই শ্রেষ্ঠীরা কোথায়! ইদানীংকালে লোকেরা তোমাকে (লাঙ্গলের) ঈষ অথবা মেঢ়ি (গরু বাধিবার গোজ) করিতে চাহিতেছে।

এই একটি শ্লোকে ব্যাবসা-বাণিজ্যের অবনতিতে এবং একান্ত কৃষিনির্ভরতায় বাঙালী সমাজের আক্ষেপ গোবর্ধন আচার্যের কণ্ঠে যেন বাণীমূর্তি লাভ করিয়াছে। একটু প্রচ্ছন্ন শ্লেষও কি নাই!

Category: ০৭. শ্রেণী-বিন্যাস
পূর্ববর্তী:
« ০৩. উপাদান বিশ্লেষণ
পরবর্তী:
০৫. সার সংক্ষেপ – শ্রেণী-বিন্যাস »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑