০৭. ভূমির সীমানির্দেশ

ভূমির সীমানির্দেশ

আগেই বলিয়াছি, ভূমি দান-বিক্রয়কালে সীমা-নির্দেশ খুব সূক্ষ্মভাবে ও সবিস্তারেই করা হইত। প্ৰস্তাবিত ভূমি দান-বিক্রয়ে যাহাতে গ্রামবাসীদের বসতি অথবা কৃষিকর্মের কোনও ব্যাঘাত না ঘটে, তাহা প্রজারা তো দেখিতেনই, স্থানীয় অধিকরণও এ সম্বন্ধে সচেতন থাকিত। পাহাড়পুর পট্টোলীতে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে যে, প্রস্তাবিত পরিমাণ ভূমি এমনভাবে নির্বাচিত ও চিহ্নিত করিতে হইবে, যাহাতে গ্রামবাসীদের কাজকর্মে কোনও প্রকার অসুবিধা না হয় (“স্বকৰ্মবিরোধেন”)। ভূমির সীমা নির্দেশ কী করিয়া করা হইত তাহার একটু ইঙ্গিত বৈগ্রাম পট্টোলীতে পাওয়া যায়। তুষের ছাই ইত্যাদি চিরকালস্থায়ী বস্তুদ্বারা চারিদিকের সীমা চিহ্নিত করাই ছিল প্রচলিত রীতি (“চিরকালস্থায়ী-তুষারাঙ্গাদি-চিহ্নের্চতুর্দিশ্যে নিয়ম্যা”)। খুব সম্ভব, চারিদিকে লাইন ধরিয়া মাটি খুঁড়িয়া, তুষের ছাই ইত্যাদি দিয়া গর্ত ভরাট করা হইত; তাহার ফলে এই সীমারেখার উপর কোনও ঘাস, গাছ ইত্যাদি জন্মাইত না, এবং এই অপ্ৰসূ অনুর্বর রেখাই সীমা-নির্দেশের কাজ করিত। মল্লসারুল গ্রামে প্রাপ্ত লিপিতে পদ্মবীচির মালাচিহ্নিত (কমলাক্ষমালাঙ্কিত) খুঁটি বা কীলক দ্বারা সীমা-নির্দেশ করার আর-এক প্রকার রীতির উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। সীমা চিহ্নিত করিবার এই রীতি তো ছিলই, তাহা ছাড়া গাছ, খাল, নালা, জেলা, নদী, পুষ্করিণী, মন্দির ইত্যাদি দ্বারাও সীমা নির্দিষ্ট হইত। যেখানে সমগ্র গ্রাম দান-বিক্রয়ের বস্তু, সেখানে গ্রামসীমা সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে। যেখানে খণ্ড খণ্ড ভূমি দান-বিক্রয় হইতেছে, সেখানেও প্রস্তাবিত ভূমির সীমা অন্য ভূমি হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া (“অপবিঞ্ছা”, ৩ নং দামোদরপুর লিপি) কমবেশি সবিস্তারে নির্দেশ করা হইয়াছে। অষ্টমশতকপূর্ব উত্তরবঙ্গের লিপিগুলিতে এই ধরনের সীমা-নির্দেশ অনুপস্থিত, কিন্তু সমসাময়িক কালের নিম্ন ও পূর্ববঙ্গের লিপিগুলিতে ভূমি-সীমা নির্দেশ সুবিস্তারিত। এই সীমা-নির্দেশের দুই-চারিটি দৃষ্টান্তের পরিচয় লওয়া যাইতে পারে।

বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর পট্টোলীতে পাঁচটি বিভিন্ন ভূমিখণ্ডের সীমা নির্দেশ করা হইয়াছে। প্রথম ভূমিখণ্ডটি ৭ পাটক ৯ দ্ৰোণ; ইহার পূর্ব দিকে গুণিকাগ্রহার (বর্তমান গুণাইঘর) গ্রামের সীমা এবং বিষ্ণুবর্ধকের ক্ষেত্র; দক্ষিণে মৃদুবিলালের ক্ষেত্র এবং রাজবিহার ক্ষেত্র; পশ্চিমে সূরীনশীর পূর্নেকের ক্ষেত্র; উত্তরে দোষীভোগ পুষ্করিণী এবং বম্পিয়ক ও আদিত্যবন্ধুর ক্ষেত্ৰসীমা। দ্বিতীয় খণ্ডটি ২৮ দ্রোণবাপ; ইহার পূর্ব দিকে গুণিকাগ্রহার গ্রামসীমা, দক্ষিণে পঙ্কবিললের ক্ষেত্র; পশ্চিমে রাজবিহারক্ষেত্র; উত্তরে বৈদ্যা-র ক্ষেত্র। তৃতীয় খণ্ডটি ২৩ দ্ৰোণ; ইহার পূর্বদিকে-র ক্ষেত্র, দক্ষিণে-এর ক্ষেত্ৰসীমা, পশ্চিমে জোলারির ক্ষেত্ৰসীমা, উত্তরে নগিজোদকের ক্ষেত্র। চতুর্থ খণ্ডটি ৩০ দ্ৰোণ; ইহার পূর্ব দিকে বুদ্ধকের ক্ষেত্ৰসীমা, দক্ষিণে কলকের ক্ষেত্ৰসীমা,-পশ্চিমে সূর্যের ক্ষেত্ৰসীমা, উত্তরে মহীপালের ক্ষেত্ৰসীমা। পঞ্চম খণ্ডটি ১। পাটক; ইহার পূর্ব দিকে খন্দবিন্দুগগরিকের ক্ষেত্র, দক্ষিণে মণিভদ্রের ক্ষেত্র, পশ্চিমে যজ্ঞরাতের ক্ষেত্ৰসীমা, উত্তরে নাদডদক গ্রামের সীমা। যে মহাযানিক অবৈবর্তিক ভিক্ষুসংঘবিহারে এই ভূমি দান করা হইয়াছিল, সেই বিহার সংলগ্ন কিছু নিম্নভূমি ছিল, তাহার সীমাও সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে; পূর্বে চূড়ামণি ও নগরশ্ৰী নৌযোগের (নৌকা বাধিবার জায়গা) মাঝখানের জেলা, দক্ষিণে গণেশ্বর বিললের পুষ্করিণীর সঙ্গে যুক্ত নৌখাট (নৌকা রাখিবার খাল), পশ্চিমে প্ৰদ্যুন্নেশ্বর মন্দিরের মাঠ, উত্তরে প্রডামার নৌযোগখাট। বিহারের কিছু হজ্জিাক খিল (হাজা, অনুর্বর) ভূমিও ছিল; তাহার সীমা পূর্বে প্ৰদ্যুম্নেশ্বর মন্দিরের মাঠ, দক্ষিণে বৌদ্ধ আচার্য জিতসেনের বিহার ক্ষেত্র সীমা, পশ্চিমে হাচাত খাল, উত্তরে দন্তপুষ্করিণী। ধর্মদিত্যের ১নং ও ২নং পট্টোলীতে, এবং বপ্যঘোষবাট পট্টোলীতে দত্ত ও বিক্ৰীত ভূমিসীমা এইভাবে নির্দেশ করা হইয়াছে:২নং পট্টোলীর ভূমিসীমায় পূর্বে সোেগ নামক ব্যক্তির তাম্রপট্টীকৃত ক্ষেত্রের সীমা, দক্ষিণে প্রাচীন পট্টকি (পর্কটা = পাকুড়) বৃক্ষচিহ্নিত সীমা, পশ্চিমে গোযান চলাচলের রাস্তা এবং উত্তরে গর্গ স্বামীর তাম্রপট্টীকৃত ক্ষেত্রের সীমা ৷ ধৰ্মপালের খালিমপুর তাম্রপট্টে দত্ত ক্ৰৌঞ্চশ্বভ্র গ্রামটির সীমা এবং তৎসংলগ্ন আরও তিনটি গ্রামের নাম সুস্পষ্ট ও সবিস্তারে দেয়া হইয়াছে।–

‘ইহার সীমা-পশ্চিমে গঙ্গিনিকা বা গাঙ্গিনা, উত্তরে কাদম্বরী (সূরস্বতী) দেবমন্দির ও খেজুরগাছ, পূর্বেত্তরে রাজপুত্র দেবটুকৃত আলি, [ এই আলি ] বীজপুরকে গিয়া প্রবিষ্ট হইয়াছে। পূর্ব দিকে বিটক-কৃত আলি খািটক-যানিকাতে গিয়া প্রবেশ করিয়াছে। তাহার পর জম্বুযানিকা আক্রমণ করিয়া জম্বুযানক পর্যন্ত গিয়াছে, তথা হইতে নিঃসৃত হইয়া পুণ্যারাম বিষ্কাের্ধস্রোতিক পর্যন্ত গিয়াছে। সেখান হইতে নিঃসৃত হইয়া নলচৰ্মটের উত্তর সীমা পর্যন্ত গিয়াছে। নলচৰ্মটের দক্ষিণে নামুণ্ডি-কায়িকা-হইতে খণ্ডমুণ্ডমুখ পর্যন্ত, তথা হইতে বেদসা-বিন্ধিকা, তাহার পরে রোহিতবাটী-পিণ্ডারবিটি জেটীকা-সীমা,। উক্তরাষোটের দক্ষিণ এবং গ্রামবিন্ধের দক্ষিণ পর্যন্ত দেবিক সীমাবিটি ধর্মজোটিকা। এই প্রকার মাঢ়াশািল্মলী নামক গ্রাম। তাহার উত্তরেও গঙ্গিনিকার সীমা; তাহার পূর্বে অর্ধস্রোতিকার সহিত। [ মিলিত হইয়া ] আম্রযানকোলার্ধযানিক পর্যন্ত গিয়াছে। তাহার পশ্চিমে [ গিয়া ] বিম্বঙ্গধর্ধস্রোতিকার গঙ্গিনিকায় গিয়া প্রবিষ্ট হইয়াছে। পালিতকের সীমা দক্ষিণে কাণদ্বীপিকা, পূর্বে কোঠিয়া-স্রোত, উত্তরে গঙ্গিনিকা, পশ্চিমে জেনন্দায়িকা; এই গ্রামের শেষ সীমায় পর্যকর্মকৃম্বদ্বীপ স্থলীঙ্কটবিষয়ের অধীন আম্রষণ্ডিকমণ্ডলের অন্তর্গত গো-পিপ্পলী গ্রামের সীমা, পূর্বে উড়গ্রামমণ্ডলের * সীমায় অবস্থিত গোপথ।‘

পরবর্তী সেন আমলের লিপিগুলিতে গ্রাম অথবা খণ্ডভূমির সীমা কমবেশি সবিস্তারেই দেওয়া হইয়াছে। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, সর্বত্রই এই সীমা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট, কোথাও ভুল হইবার সুযোগ নাই। ভূমির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভূমি লইয়া বাদ-বিসংবাদও হইত, এ অনুমান স্বভাবতই করা যায়; হয়তো এই কারণেও ভূমি-সীমা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন হইয়াছিল।

ভূমির এই সূক্ষ্ম, সুস্পষ্ট ও সবিস্তার সীমানির্দেশ, সুনির্দিষ্ট মূল্য, ভূমি পরিমাপের মানের ক্রমবর্ধমান সূক্ষ্মতা, বার্ষিক আয়ের পরিমাণ, হলমানদণ্ডের উল্লেখ ইত্যাদি একটু গভীরভাবে বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করিলে স্বভাবতই মনে হয়, ভূমি পরিমাপের, পরিমাণ নির্দেশের, জমি-জরিপ এবং জমির বার্ষিক আয়, জমির মূল্য ইত্যাদি নির্ধারণের কোনও না কোনও প্রকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ছিল, এবং পুস্তপালের দপ্তরে এইসব বিষয়সংক্রান্ত কাগজপত্র যথারীতি রক্ষিত হইত। এই কারণে ভূমি ক্ৰয়-বিক্রয় প্রস্তাবমাত্রই প্রথমে পুস্তপালের দপ্তরে পাঠাইতে হইত, এবং তিনি কাগজপত্ৰ দেখিয়া দান অথবা ক্ৰয়-বিক্রয়ে সম্মতি দিতেন। পঞ্চম শতকের লিপিতেই তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তী কালে এই ব্যবস্থা যে আরও সুনির্দিষ্ট ও সুনিয়মিত হইয়াছিল করা ইত্যাদি ধার্য করিবার উদ্দেশ্যে, মূল্য, আয়, ভূমি-পরিমাণ ইত্যাদি নির্ণয় করিবার উদ্দেশ্যে জরিপ ও ভূ-কর নিয়ামক বিভাগের কাজকর্ম যে আরও সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাতে আর সন্দেহ করিবার অবকাশ কোথায়?

——————–
* উড্রগ্রামমণ্ডলে কি ওড্রদেশবাসিরা অধিকসংখ্যায় বাস করিতেন? তাঁহাদের কলোনি?