০৬. ভূমির চাহিদা

ভূমির চাহিদা

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভূমির চাহিদা বাড়ে, বিশেষভাবে কৃষিপ্রধান দেশে, ইহা তো প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছু না থাকিলেও এই অনুমান কিছু কঠিন নয় যে, প্রাচীন বাঙলায়ও জনসংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভূমির চাহিদা বাড়িতেছিল। যে সময় হইতে লিপি-প্রমাণ আমরা পাইতেছি, অর্থাৎ খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতক হইতে ইহার কিছু কিছু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। পাহাড়পুর-লিপিতে দেখিতেছি, জনৈক ব্ৰাহ্মণ, নাথশৰ্মা ও তাহার স্ত্রী রামী ১ কুল্যবাপ ও ৪ দ্রোণবাপ ভূমি কিনিয়া দান করিতেছেন বট-গোহালীর একটি জৈন বিহারে, সেই বিহারের পূজাৰ্চনাদির ব্যয় নির্বাহের জন্য। এই অনুমান খুবই স্বাভাবিক যে, সেই বিহারের নিকটবর্তী ভূমিই এই ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা উপযোগী হইত, আর নিকটবতী ভূমি যদি একান্তই পাওয়া সম্ভব না হইত, তাহা হইলে সমগ্র পরিমাণ ভূমি একই জায়গায় একই ভূখণ্ডে পাইলে ভালো হইত। নাথশৰ্মা কিন্তু তাহা সংগ্ৰহ করিয়া উঠিতে পারেন নাই; তাহাকে ১ কুল্যবাপ ৪ দ্ৰোণ ভূমি সংগ্ৰহ করিতে হইয়াছিল। পাশাপাশি চারিটি গ্রাম হইতে; পৃষ্ঠিমপোষক, গোষাটপুঞ্জক এবং নিত্বগোহালী গ্ৰামত্ৰয় হইতে যথাক্রমে ৪, ৪ এবং ২: দ্রোণ এবং বটগোহালী গ্রাম হইতে ১২ দ্রোণ বাস্তুভূমি এই অনুমান অত্যন্ত স্বাভাবিক হইয়া পড়ে যে, ভূমির চাহিদা এত বেশি হইয়াছিল যে, একটি গ্রামে একসঙ্গে ১ কুল্যবাপ ৪ দ্ৰোণ ভূমি সংগ্রহ করার সুযোগ এই দম্পতি পান নাই। বৈগ্রাম-পট্টোলীতে দেখিতেছি, দুই ভাই ভোয়িল এবং ভাস্কর একই ধর্মপ্রতিষ্ঠানে কিছু ভূমি দান করিলেন; তাহাও দুই জনে সংগ্ৰহ করিলেন দুই গ্রামে, এক গ্রামে ভোয়িল। কিনিলেন ৩ কুল্যবাপ খিলভূমি, আর-এক গ্রামে ভাস্কর কিনিলেন ১ দ্রোণবাপ বাস্তুভূমি। (অবান্তর হইলেও একটা প্রশ্ন। এখানে মনকে অধিকার করে। একই পিতার দুই পুত্র পৃথকভাবে পৃথক পৃথক গ্রামে ভূমি ক্রয় করিলেন কেন বিশেষত দানের পাত্র এবং উদ্দেশ্য যেখানে এক? একান্নবর্তী পরিবারের আদর্শে কোথাও ফাটল ধরিয়াছিল কি?) গুণাইঘর লিপিতেও দেখি, ১১ পাটক ক্রয়যোগ্য খিলভূমি যদিও একই গ্রামে পাওয়া যাইতেছে, কিন্তু তাহা একসঙ্গে এক ভূখণ্ডে পাওয়া যাইতেছে না, যাইতেছে পাচটি পৃথক ভূখণ্ডে। ৫ নং দামোদরপুর পট্টোলীদ্বারা যে ৫ কুল্যবাপ ভূমি বিক্ৰীত হইতেছে, তাহাও চারিটি বিভিন্ন গ্রামে। আস্রফপুর পট্টোলীদ্বারা সঙ্ঘমিত্রের বিহারে যে ভূমি দেওয়া হইতেছে, সেখানে দেখিতেছি, প্রথম দফার ৯ পাটক দ্রোণ ভূমি ৭টি পাড়া বা গ্রামে, দ্বিতীয় দফার ৬ পাটক ১০ দ্ৰোণ ভূমি ৮টি পাড়া বা গ্রামে। এইসব সাক্ষ্যপ্রমাণ হইতে সহজেই জনসাধারণের মধ্যে ভূমির চাহিদার পরিমাণ অনুমান করিতে পারা যায়। প্রতিষ্ঠিত গ্রাম ও জনপদগুলিতে প্রায় সমগ্র পরিমাণ ভূমিতেই জনপদবাসীদের বসতি এবং চাষবাস ইত্যাদি ছিল, কাজেই কোনও গ্রামেই একসঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ ভূমি সহজলভ্য ছিল না, এই অনুমান অসংগত নয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যানুযায়ী কন, অরণ্য ইত্যাদি কাটিয়া নূতন গ্রাম ও বসতির পত্তন করাও যে প্রয়োজন হইতেছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় ত্রিপুরা জেলার লোকনাথের পট্টোলীতে।

পরবর্তী কালেও এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রমাণ দুর্লভ নয়। ধূল্লা পট্টোলী দ্বারা রাজা শ্ৰীচন্দ্র ১৯ হল ৬ দ্রাণ ভূমি দান করিয়াছিলেন শান্তিবারিক ব্যাসগঙ্গশৰ্মাকে, কিন্তু এই ভূমিও সংগ্ৰহ করিতে হইয়াছিল। পাঁচটি গ্রাম হইতে। চট্টগ্রাম পট্টোলী দ্বারা রাজা দামোদারদেব মাত্ৰ পাচ দ্রোণ ভূমি দান করিয়াছিলেন, তাহাও দুই গ্রামে। ভাটরালিপিদ্ধারা ভট্টপাটকের শিবমন্দিরের সেবার জন্য যে ২৯৬টি বাড়ি এবং ৩৭৫ হল ভূমি দেওয়া হইতেছে, তাহা ২৮টি বিভিন্ন গ্রামে বিস্তৃত। সাহিত্য-পরিষদ-পট্টোলীদ্বারা রাজা বিশ্বরূপসেন জনৈক আবল্লিক পণ্ডিত হলায়ুধ শৰ্মাকে ৩৩৬২ উন্মানভূমি দান করিয়াছিলেন ছয়টি বিভিন্ন গ্রামে, ১১টি পৃথক পৃথক ভূখণ্ডে। বিশ্বরূপসেনের এই পট্টোলীটির সাক্ষ্য অন্যদিক হইতেও খুব উল্লেখযোগ্য। দানসংগ্রহ দ্বারা কোনও কোনও ধর্মপ্রতিষ্ঠান প্রচুর ভূমির অধিকারী হইয়াছে, এমন দৃষ্টান্ত দু-একটি আমাদের লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষ নিজের জন্য, হয় ক্রয় করিয়া না-হয় দান গ্রহণ করিয়া অথবা উভয় উপায়েই, নিজের প্রয়োজনাধিক ভূমি সংগ্ৰহ করিয়া ভূমির বড় মালিক হইয়া বসিতেছেন, “… এমন অন্তত একটি দৃষ্টান্ত বিশ্বরূপসেনের এই লিপিটি হইতে পাওয়া যাইতেছে। আরও আশ্চর্য হইতে হয় এই ভাবিয়া যে, এই ভূম্যধিকারীটি হইতেছেন। একজন ব্রাহ্মণপণ্ডিত, সাধারণত আমরা যাহাদের সর্বপ্রকারে নির্লেভ এবং বিত্তহীন বলিয়া মনে করি। এই আবল্লিক পণ্ডিতটি কী ভাবে ভূমি সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন, তাহার একটু পরিচয় লওয়া যাইতে পারে, এবং এই পরিচয়ের মধ্যে ভূমি সংগ্রহের ইচ্ছা সমাজের মধ্যে কী ভাবে রূপ লইতেছিল, তাহার একটু আভাসও পাওয়া যাইতে পারে।

১. রামসিদ্ধি পাটকে দুইটি ভূখণ্ড, ৬৬টি উদান পরিমাণ, আয় ১০০ (পুরাণ) উত্তরায়ণ সংক্রান্তি উপলক্ষে রাজার দান।
২. বিজয়তিলক গ্রামে ২৫ উদ্দীন, আয় ৬০ (পুরাণ)।
৩. আজিকুল পাটকে ১৬৫ উদান, আয় ১৪০ (পুরাণ)। হলায়ুধ নিজে এই ভূখণ্ড কিনিয়াছিলেন।
৪. দেউলহন্তী গ্রামে ২৫ উদান, আয় ৫০ (পুরাণ)।
২, ৩ ও ৪ নং ভূমি হলায়ুধ চন্দ্রগ্রহণ উপলক্ষে রানীমাতার নিকট হইতে দান গ্রহণ করিয়াছিলেন।
৫. দেউলহন্তী গ্রামে আরও দুইটি ভূখণ্ড, পরিমাণ ১০ উদান, আয় ২৫ (পুরাণ)। হলায়ুধ আগে উহা কিনিয়াছিলেন, পরে কুমার সূর্যসেনের নিকট হইতে দান গ্রহণ করিয়াছিলেন, কুমারের জন্মদিন উপলক্ষে।
৬. দেউলহস্তী গ্রামেই আরও দুইটি ভূখণ্ড, পরিমাণ ৭ উদান, আয় ২৫ (পুরাণ)। হলায়ুধ আগে উহা কিনিয়াছিলেন, পরে সান্ধিবিগ্রহিক নাঞীসিংহের নিকট হইতে দান গ্ৰহণ করিয়া ছিলেন।
৭. ঘাঘরাকাট্টি পাটকে ১২.৭৫ উদান ভূমি, আয় ৫০ (পুরাণ)। হলায়ুধ বাজপণ্ডিত মহেশ্বরের নিকট হইতে উহা কিনিয়াছিলেন।
৮. পাতিলাদিবীক গ্রামে ২৪ উদান, আয় ৫০ (পুরাণ)। উত্থানদ্বাদশী তিথি উপলক্ষে কুমার পুরুষোত্তম সেনের দান।

সর্বসুদ্ধ এই ৩৩৬.৫ উন্মান ভূমির বার্ষিক আয় ছিল ৫০০ শত (পুরাণ); তখনকার দিনে এই অর্থের পরিমাণ কম নয়। ব্রাহ্মণপণ্ডিত হলায়ুধ শৰ্মা বিভিন্ন গ্রামে বিস্তুত সমগ্র পরিমাণ এই ভূমি রাজার নিকট হইতে ব্ৰহ্মত্র দানস্বরূপ গ্রহণ করিয়া ভূম্যধিকারী হইয়া বসিয়াছিলেন; রাষ্ট্রকে তাহার কোনও করই দিতে হইত না, অথচ তাহার প্রজাদের নিকট হইতে সমস্ত করই তিনি পাইতেন। পাল ও সেন বংশীয় রাজারা ও অন্যান্য ছোটখাটো রাজবংশের রাজারা অনেক সময়ই অনেক ব্ৰাহ্মণকে যে গ্রামকে-গ্রাম দান করিয়াছেন, তাহার দৃষ্টান্ত তো ভুরি ভুরি পাওয়া যায়। প্রয়োজনাধিক ভূমির অধিকারী হওয়ার ইচ্ছা, ব্যক্তিবিশেষকে কেন্দ্ৰ করিয়া ভূমির স্বত্বাধিকার কেন্দ্রীকৃত হওয়ার ঝোক সমাজের মধ্যে কী ভাবে বাড়িতেছিল, এইসব সাক্ষ্যপ্রমাণের মধ্যে তাহার সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।

ভূমির ক্রমবর্ধমান চাহিদার ইঙ্গিত কতকটা ভূমির সূক্ষ্ম সীমা-নির্দেশের মধ্যেও পাওয়া যায়।। প্রত্যেকেই প্ৰত্যেকের ভূমির সীমা ও পরিমাণ সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন রাষ্ট্রও এ সম্বন্ধে। কম সচেতন ছিল না। ভূমি দান-বিক্রয়কালে অন্য কাহারও ভূমিস্বর্থ যাহাতে আহত না হয়, এ ন’ সম্বন্ধে প্রজার ও রাষ্ট্রের দৃষ্টি খুবই সজাগ ছিল। তাহা ছাড়া, প্রত্যেকটি লিপিতেই ভূমি সীমা এত সূক্ষ্মভাবে ও সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে যে, পড়িলেই মনে হয়, সূচ্যগ্ৰ ভূমিও কেহ সহজে ছাড়িয়া দিতে রাজী হইতেন না। কালের অগ্রগতির সঙ্গে এই চেতনাও বুদ্ধি পাইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। অষ্টম শতক-পূর্ব লিপিগুলিতে এই সীমা-বিবৃতি খুব বিস্তুত নয়; কিন্তু পরবর্তী লিপিগুলিতে ক্রমশ এই বিবৃতি দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইবার দিকে ঝোক অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

তাহা ছাড়া ভূমির পরিমাপের বর্ধমান সূক্ষ্মতাও ক্রমবর্ধমান চাহিদার দিকে ইঙ্গিত করে। অষ্টমশতকপূর্ব লিপিগুলিতে ভূমি-পরিমাপের নিম্নতম ক্রয় হইতেছে আঢবাপ বা আঢ়কবাপ, কিন্তু সেন আমলের লিপিগুলিতে দেখা যায়, নিম্নতম ক্রম আঢ়বাপ হইতে উন্মান, উন্মান হইতে কাকিণী পর্যন্ত নামিয়াছে। ভূমির চাহিদা যতই বাড়িতেছিল, লোকেরা সূক্ষ্মতিসূক্ষ্মী ভগ্নাংশ সম্বন্ধেও ক্রমশ সজাগ হইয়া উঠিতেছিল, এই অনুমানই স্বাভাবিক।