০২.০৫ ব্রতোৎসব

ব্রতোৎসব

যাত্রা, ধ্বজপূজা প্রভৃতি মতো ব্রতোৎসবও বাঙালীর ধর্মজীবনে একটি বড় স্থান অধিকার করিয়া আছে। এই ব্ৰন্তোৎসবের ইতিহাস অতি জটিল ও সুপ্রাচীন তবে এই ধরনের ধর্মোৎসব যে প্রাক-বৈদিক আদিবাসী কোমদের সময় হইতেই সুপ্রচলিত ছিল এ-সম্বন্ধে সংশয় বোধ হয় নাই। আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি যাহাদের বলিয়াছে ‘ব্রাত্য’ বা ‘পতিত’ তাহারা কি ব্ৰতধর্ম পালন করিতেন। বলিয়াই ব্রাত্য বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন এবং সেইজন্যই কি আর্যরা তাঁহাদের পতিত বলিয়া গণ্য করিতেন? বোধ হয় তাহাই।* অন্তত সাংস্কৃতিক জনতত্ত্বের আলোচনায় ক্রমশ এই তথ্যই যেন সুস্পষ্ট হইতেছে যে, আমাদের গ্রাম্য-সমাজে বিশেষভাবে নারীদের ভিতর, যে-সব ব্ৰত আজও প্রচলিত আছে তাহার অধিকাংশই অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ও অব্রাহ্মণ্য এবং মূলত গুহ্য যাদু ও প্রজনন শক্তির পূজা, যো-পূজা গ্রাম্য কৃষিসমাজের সঙ্গে একান্ত সম্পূক্ত। ঋগ্বেদ হইতে আরম্ভ করিয়া আমাদের প্রাচীন ধর্মশাস্ত্র, ধর্মসূত্র কোথাও কোনও প্রচলিত ব্ৰতের কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নাই। আদি বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম যে এই ধর্মানুষ্ঠানকে স্বীকার করিত না এতথ্য পরিষ্কার। অশোক তো স্পষ্টই বলিয়াছেন, গ্ৰাম্য লোকায়াত ধর্মের আচারানুষ্ঠান তিনি পছন্দ করিতেন না; বিশেষত নারীদের মধ্যে প্রচলিত নানাপ্রকারের মঙ্গলানুষ্ঠান প্রভৃতি তাহার বড়ই অগ্ৰীতিকর ছিল। তিনি তঁহাদের আহ্বান করিয়াছিলেন এই সব মঙ্গলানুষ্ঠান ছাড়িয়া তাহারই অনুমোদিত ধর্মমঙ্গলের পথে চলিবার জন্য। নারীসমাজে প্রচলিত এইসব মঙ্গলানুষ্ঠান বলিতে অশোক ব্ৰতানুষ্ঠানের কথাই বলিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই, আর, সাধারণ মঙ্গলানুষ্ঠান বলিতে মধ্যযুগীয় বাঙলার মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদি জাতীয় পুরাপ্ৰচলিত পূজানুষ্ঠানের ইঙ্গিতই হয়তো করিয়া থাকিবেন। কিন্তু সে যাহাই হউক, বিষ্ণুপৰ্ব্বাণ, অগ্নিপুরাণ প্রভৃতি প্রধান প্রধান পুরাণগুলি যখন সংকলিত হইতেছিল তখন এবং বোধ হয় তাহার কিছুকাল আগে হইতেই ব্ৰতানুষ্ঠানের প্রতি আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মনোভাবের পরিবর্তন হইতেছিল, কারণ এই সব পুরাণে দেখিতেছি, লৌকিক অনেক ব্ৰতানুষ্ঠান ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের অনুমোদন লাভ করিয়া ঐ ধর্মের কুক্ষিগত হইয়া পড়িয়াছে এবং ব্রাহ্মণেরা সেই সব অবৈদিক, অস্মার্তা অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্যও করিতেছেন। প্রাক-আর্য ও অনার্য নরনারীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় আর্য-ব্রাহ্মণ্য সমাজ-সীমায় গৃহীত হইবার ফলেই ইহা সম্ভব হইয়াছিল, সন্দেহ নাই। বাঙলাদেশে সমস্ত আদি ও মধ্যযুগ ব্যাপিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দীর ভিতর দিয়া বহু অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ব্ৰতানুষ্ঠান এইভাবে ক্রমশ ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে; আজও করিতেছে। যে-সব ব্ৰত এই ধরনের স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভ করিয়াছে তাহাদের অনুষ্ঠানে ব্ৰাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হয়, যে-সব করে নাই সে-সব ক্ষেত্রে কোনও পুরোহিত্যেরই প্রয়োজন হয় না; গৃহস্থ মেয়েরাই সে-সব পূজা নিষ্পন্ন করিয়া থাকেন। আমাদের চোখের সম্মুখেই দেখিতেছি, পঁচিশ বৎসর আগে গ্রামাঞ্চলে যে সব ব্ৰতানুষ্ঠানে পুরোহিত্যের প্রয়োজন হইত না আজ সে-সব ক্ষেত্রে পুরোহিত আসিয়া মন্তর পড়িতে আরম্ভ করিয়াছেন, অর্থাৎ সেই সব ব্ৰত ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে। তবু, আজও যে-সব ব্ৰত এই স্বীকৃত-সীমার বাহিরে তাহাদের সংখ্যা কম নয়; সম্বৎসর ব্যাপিয়া মাসে মাসে এই সব বিচিত্ৰ ব্ৰতের অনুষ্ঠান আমাদের গ্রাম্য সমাজ-জীবনকে এখনও কতকটা সচল ও সজীব করিয়া রাখিয়াছে এবং বাঙালীর ধর্মকর্মে এই সব ব্ৰতানুষ্ঠান খুব বড় একটা স্থান অধিকার করিয়া আছে। অগণিত এই সব ব্ৰতের মধ্যে কয়েকটি তালিকাবদ্ধ করিতেছি :

বৈশাখে— পুণ্যপুকুর ব্ৰত (বারি বর্ষণের জন্য গুহা যাদুশক্তির পূজা), শিবপূজা ব্ৰত (প্রজনন শক্তির পূজা), চম্পা-চন্দন ব্ৰত (ঐ), পৃথ্বীপূজা ব্ৰত (ঐ এবং গুহ্য যাদুশক্তির পূজা), গােকাল ব্ৰত (কৃষিসংক্রান্ত প্রজনন শক্তির পূজা), অশ্বত্থপট ব্ৰত (ঐ), হরিচরণ ব্ৰত (গুহ্য যাদুশক্তির পূজা), মধুসংক্রান্তি ব্ৰত (ঐ), গুপ্তধন ব্ৰত (ঐ), ধানগোছানো ব্ৰত (ঐ), যাচাত পান ব্ৰত (ঐ), তেজোদর্পণ ব্ৰত (ঐ), রণে এয়ো ব্ৰত (ঐ), দশ পুতুলের ব্ৰত (ঐ), সন্ধ্যামণি ব্ৰত (ঐ), থোয় থায়ি ব্ৰত (ঐ), বসুন্ধরা ব্ৰত (বারি বর্ষণের জন্য প্রজনন শক্তির পূজা)।

জ্যৈষ্ঠ— জয়মঙ্গলের ব্ৰত (প্রজনন শক্তির পূজা)।। ভদ্রে- ভাদুরি ব্ৰত (কৃষিসংক্রান্ত গুহ্য যাদুশক্তির পূজা), তিলকুজারি ব্ৰত (কৃষিসংক্রান্ত প্ৰজনন শক্তির পূজা)।

কার্তিকে— কুলকুলটি ব্ৰত (গুহ্য যাদুশক্তির পূজা), ইতুপূজা ব্ৰত (প্রজনন শক্তির পূজা)। অগ্রহায়ণে—— যমপুকুর ব্ৰত (কৃষি সংক্রান্ত প্ৰজনন শক্তির পূজা), সেঁজুতি ব্ৰত (গুহ্যু যাদুশক্তির পূজা), তৃষাতুষালি ব্ৰত (কৃষিসংক্রান্ত প্রজনন শক্তির পূজা)।

মাঘে— তারণ ব্ৰত (কৃষি সংক্রান্ত প্রজনন শক্তির পূজা), মাঘমণ্ডল ব্ৰত (ঐ)। ফাল্লুনে— ইতুকুমার ব্ৰত (ঐ), বসন্তু রায় ও উত্তম ঠাকুর ব্ৰত (ঐ), সসপাতা ব্ৰত (ঐ)। চৈত্রে– নখছুটের ব্ৰত (গুহ্য যাদুশক্তির পূজা)।

এগুলি ছাড়াও বাঙালীর অন্তঃপুরে আরো অনেক ব্ৰত আছে যাহা মূলত গুহ্য যাদুশক্তি ও প্ৰজনন শক্তির পূজারূপে আদিবাসী কোমদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তেমন অনেক ব্ৰত ইতিমধ্যেই ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম কর্তৃক স্বীকৃত হইয়া আমাদের শুভকর্ম পঞ্জিকাতেও স্থান পাইয়া গিয়াছে, যেমন, ষষ্ঠী ব্ৰত, মঙ্গলচণ্ডী ব্ৰত, সুবচনী ব্রত ইত্যাদি। ব্রাহ্মণ্যধর্ম কর্তৃক স্বীকৃত এবং প্রাচীন বাঙলাদেশে প্রচলিত ব্ৰতের একটি তালিকা প্রাচীন বাঙলার স্মৃতিগুলি হইতেই ছাকিয়া বাহির করা যায় : সুখরাত্রি ব্ৰত (কাৰ্তিক মাস), পাষাণ-চতুর্দশী ব্ৰত (অগ্রহায়ণ), দূত-প্রতিপদ ব্ৰত (কার্তিকেয় শুক্ল প্রতিপদ), কোজাগর-পূর্ণিমা ব্ৰত (আশ্বিনের পূর্ণিমা), ভ্ৰাতৃদ্বিতীয়া ব্ৰত (কার্তিক), আকাশ-প্ৰদীপ ব্ৰত (কার্তিক), অক্ষয়-তৃতীয়া ব্ৰত, অশোকাষ্টমী ব্রত ইত্যাদি। এই সব ক’টি ব্রতের উল্লেখ জীমূতবাহনের কালবিবেক-গ্রন্থে পাওয়া যায়। জন্মাষ্টমী পূজা ও স্নানের কথাও জীমূতবাহন বলিয়া গিয়াছেন। ইহাদের কতকগুলি ব্ৰত একান্তই আদিম কৌম সমাজের ব্ৰতগুলির পরিবর্তিত, পরিমার্জিত রূপ; আবার কতকগুলি আদিম কীেম সমাজের ব্রতের আদর্শ এবং ভাবানুযায়ী নূতন ব্রতের সৃষ্টি। তিথি-নক্ষত্র আশ্রয় করিয়া যে-সব ব্ৰন্তোৎসব আছে তাহার। মূলে বহিরাগত শাকদ্বীপী ব্ৰাহ্মণদের কিছুটা প্রভাব বিদ্যমান, এ-কথা একেবারে অসম্ভব না-ও হইতে পারে। পুরাণগুলির ভিতর হইতেও ব্রাহ্মণ্যধর্ম কর্তৃক স্বীকৃত ব্ৰতের একটি তালিকা পাওয়া যায়, যেমন, শিবরাত্রি ব্ৰত, অখণ্ড দ্বাদশী ব্রত, পূর্ণিমা ব্ৰত, নক্ষত্ৰ ব্ৰত, দীপদান ব্রত, ঋতু ব্ৰত, কৌমুদী ব্ৰত, মদন বা অনঙ্গ ত্ৰয়োদশী ব্রত, রম্ভাতৃতীয়া ব্ৰত, মহানবমী ব্ৰত, বুধািষ্টমী ব্রত, একাদশী ব্ৰত, নক্ষত্রপুরুষ ব্রত, আদিত্যশয়ান ব্রত, সৌভাগ্যশয়ন ব্রত, রসকল্যাণী ব্ৰত, অঙ্গরক ব্ৰত, শর্করা ব্ৰত, অশূন্যাশয়ন ব্ৰত, অনঙ্গদান ব্ৰত ইত্যাদি। কিন্তু প্রাচীন বাঙলায় এই সব ব্ৰতের কোন কোনটি প্রচলিত ছিল তাহা বলিবার কোনও উপায় নাই।

ব্ৰতোৎসবের বাহিরে বাঙালী সমাজের নিম্নস্তরে অন্তত দুইটি ধর্মানুষ্ঠান আছে যাহার ব্যাপ্তি ও প্রভাব সুবিস্তৃত এবং যাহা মূলত অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ও অব্রাহ্মণ্য। একটি ধর্মঠাকুরের পূজা ও আর একটি চৈত্র মাসে নীল বা চড়ক পূজা। মালদহ অঞ্চলে যে গম্ভীরার পূজা বা বাঙলার অন্যত্র যে শিবের গাজন হয় তাহা এই চড়ক পূজারই বিভিন্নরূপ। শিবের গাজন যেমন, ধর্মঠাকুরেরও তেমনই গাজন আছে এবং এই গাজন-উৎসবের দুইটি প্রধান অঙ্গ, একটি ঘরভরা বা গৃহাভরণ এবং অন্যটি ‘কালিকা পাতা’ বা “কালি-কাচ’ নৃত্য, অর্থাৎ নরমুণ্ড হাতে লইয়া কালি বেশে অর্থাৎ কালির প্রতিবিম্বে নৃত্য।

————–
* ব্রতের সঙ্গে ব্রাতাদের সম্বন্ধ কোনো অকাট্য প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। তবে, এই অনুমান একেবারে অযৌক্তিক ও অনৈতিহাসিক নাও হইতে পারে। ঋগ্বেদীয় আর্যরা ছিলেন যজ্ঞধর্মী; যজ্ঞধর্মী আর্যদের বাহিরে যাহারা ব্ৰতধৰ্ম পালন করিতেন, ব্রতের গুহ্য যাদুশক্তি বা ম্যাজিকে বিশ্বাস করিতেন তাহারাই হয়তো ছিলেন ব্রাত্য! এই ব্রাত্যরা যে প্রাচ্যদেশের সঙ্গে জড়িত তাহা এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য এবং ইহাও লক্ষণীয় যে, ব্রতধর্মের প্রসার বিহার, বাঙলা, আসাম এবং উড়িষ্যাতেই সবচেয়ে বেশি। ব্ৰতকথাটির বুৎপত্তিগত অৰ্থ-ই বােধ হয় (বৃ-ধাতু জ্ঞ) আবৃত করা, সীমা টানিয়া পৃথক করা। নির্বাচন করাই ব্ৰতের উদ্দেশ্য; বরণ কথাটিরও একই ব্যঞ্জনা। ব্ৰতানুষ্ঠানে আলপনা দিয়া অথবা বৃত্তাকারে সীমা রেখা টানিয়া ব্ৰতস্থান চিহ্নিত করিয়া লওয়া হয়; এই সীমা রেখা টানা স্থান নির্বাচন বা চিহ্নিত করার মধ্যে যাদুশক্তির বা ম্যাজিকের বিশ্বাস প্রচ্ছন্ন। আমাদের দেশে মেয়েদের মধ্যে বরণ করার যে স্ত্রী-আচার প্রচলিত- যেমন নূতন বরের মুখের সম্মুখে হাত ও হাতের আঙুল নানা,ভঙ্গিতে ঘুরানাে, কুলার উপর প্রদীপ ইত্যাদি সাজাইয়া বরের দুই বাহুতে, বুকে কপালে ঠেকানো ও সঙ্গে সঙ্গে বরণের ছড়া উচ্চারণতাহার ভিতরেও ম্যাজিকেরই অবশেষ আজও লুক্কায়িত। এই বরণের অর্থও অশুভ শক্তির প্রভাব হইতে পৃথক করা, আবৃত করা, নির্বাচন করা। ব্রত এবং বরণের স্ত্রী-আচারগুলি লক্ষ্য করিলেই ইহাদের, সমগোত্রীয়তা ধরা পড়িয়া যায় এবং গোড়ায় যে ইহাদের সঙ্গে ম্যাজিকের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ ছিল তাহাও পরিষ্কার হইয়া যায়। ব্রত এবং বরণ উভয় অনুষ্ঠানেই শুধু মেয়েদেরই যে অধিকার এ তথাও লক্ষণীয়। এই মাজিক-বিশ্বাসী ব্রতচারী লোকেরাই ঋগ্বেদীয় আর্যদের চােখে বােধ হয় ছিলেন ব্রাত্য!