০৫. পাল যুগ : বর্ণ বিন্যাসের তৃতীয় পর্ব

পাল যুগ : বর্ণ বিন্যাসের তৃতীয় পর্ব

বর্ণ হিসাবে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের ইঙ্গিত আভাস পরবর্তী পাল আমলেও(১) দেখা যাইতেছে না। একমাত্র “বামচরিত” গ্রন্থের টীকাকার পাল-বংশকে ক্ষত্রিয়-বংশ বলিয়া দাবি করিয়াছেন।(২) কিন্তু এই ক্ষত্রিয় কি বর্ণ অর্থে ক্ষত্রিয়? রাজা-রাজন্য মাত্রই তো ক্ষত্ৰিয়; সমসাময়িক কালে সব রাজবংশই তো ক্ষত্ৰিয় বলিয়া নিজেদের দাবি করিয়াছে, এবং একে অন্যের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হইয়াছে। রাজা-রাজন্যের বিবাহ-ব্যাপারে কোন ও বর্ণগত বাধা-নিষেধ কোন ও কালেই ছিল না। তারানাথ তো বলিতেছেন গোপাল ক্ষত্রিয়াণীর গর্ভে জনৈক বৃক্ষদেবতার পুত্র(৩); এ-গল্প নিঃসন্দেহে টটেম-স্মৃতিবহ ! আবুল ফজল বলেন পাল রাজারা কায়স্থ(৪); মঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থ তাঁহাদের সোজাসুজি বলিয়াছে দাসজীবী(৫)। পালেরা বৌদ্ধ ছিলেন, এবং মনে রাখা দরকার তারানাথ এবং মঞ্জশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার দুইজনই বৌদ্ধ। পালের যে বর্ণহিসাবে দ্বিজশ্রেণীর কেহ ছিলেন না, তারানাথ, আবুল ফজল এবং শেষোক্ত গ্রন্থের লেখক সকলেব ইঙ্গিতই যেন সেই দিকে। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বর্ণের নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উল্লেখ আর কোথাও দেখিতেছি না। তবে রাজা, রাণক, রাজন্যক প্রভৃতিরা ক্ষত্ৰিয় বলিয়া নিজেদের পরিচয় দিতেন, এমন অনুমান অসম্ভব নয়, কিন্তু বর্ণ হিসাবে তাঁহারা যথার্থই ক্ষত্রিয় ছিলেন কিনা সন্দেহ। ক্ষত্রিয়-পরিবারে বিবাহ অনেক রাজাই করিয়াছেন, কিন্তু শুধু তাহাই ক্ষত্ৰিয়ত্ব জ্ঞাপক হইতে পারে না।

 

করণ-কায়স্থ

করণ-কায়স্থদের অস্তিত্বের প্রমাণ অনেক পাওয়া যাইতেছে। রামচরতের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা ছিলেন “করণানামাগ্ৰণী”,অর্থাৎ করণ কুলের শ্রেষ্ঠ(৬); তিনি ছিলেন পালরাষ্ট্রের সন্ধিবিগ্রহিক। শব্দপ্রদীপ নামে একখানি চিকিৎসা গ্রন্থের লেখক আত্মপরিচয় দিতেছেন “করণান্বয়”, অর্থাৎ করণ-বংশজাত বলিয়া; তিনি নিজে রাজবৈদ্য ছিলেন, তাঁহার পিতা ও প্রপিতামহ যথাক্রমে পালরাজ রামপাল ও বঙ্গালরাজ গোবিন্দ চন্দ্রের রাজবৈদ্য ছিলেন।(৭) ন্যায়কন্দলী- গ্রন্থের লেখক শ্ৰীধরের (৯৯১খ্রী) পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পাণ্ডুদাস, তাঁহার পরিচয় দেওয়া হইয়াছে ‘কায়স্থ কুলতিলক’ বলিয়া(৮)। পাণ্ডুদাসের বাড়ী বাংলাদেশে বলিয়াই তো মনে হইতেছে, যদিও এসম্বন্ধে নিঃসংশয় প্রমাণ নাই। তিব্বতী গ্রন্থ পাগ্‌-সাম-জোন্‌-জা (Pag-Sam-Jon-Zang) পাল-সম্রাট ধর্মপালের এক কায়স্থ রাজকর্মচারীর উল্লেখ করিতেছেন, তাহার নাম দঙ্গদাস(৯)। জড্‌ঢ নামে গৌড়দেশবাসী এক করণিক খাজুরাহোর একটি লিপির (৯৫৪) লেখক(৫)। যুক্ত প্রদেশের পিলিভিট্‌ জেলায় প্রাপ্ত দেবল প্রশস্তির (৯৯২) লেখক তক্ষাদিত্যও ছিলেন একজন গৌড়দেশবাসী করণিক(১১)। চাহমান রাজ রায়পালের নাডোল লিপির লেখক ছিলেন (১১৪১) ঠকুর পেথড নামে জনৈক গৌড়ান্বয় কায়স্থ(১২), বীসলদেবের দিল্লী-শিবালিক স্তম্ভলিপির (১১৬৩) লেখক শ্রীপতিও ছিলেন একজন গৌড়ান্বয় কায়স্থ(১৩)। সমসাময়িক উত্তর ও পশ্চিম ভারতে করণ-কায়স্থেরা পৃথক স্বতন্ত্র বর্ণ বা বংশ বলিয়া গণ্য হইত, এসম্বন্ধে অনেক লিপি প্রমাণ বিদ্যমান। রাষ্ট্রকূট অমোঘবর্ষের একটি লিপিতে (নবম শতক) বলভ-কায়স্থ বংশের উল্লেখ, ১১৮৩ বা ১১৯৩ খৃষ্টাব্দের একটি লিপিতে কায়স্থ বংশের উল্লেখ(১৪), প্রভূতি হইতে মনে হয় নবম-দশম-একাদশ শতকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সর্বত্রই কায়স্থরা বর্ণহিসাবে গড়িয়া উঠিয়াছিল। বাস্তু হইতে উদ্ভূত এই অর্থে বাস্তব্য কায়স্থের উল্লেখ ও একাধিক লিপিতে পাওয়া যাইতেছে; একাদশ শতকের আগে এই বাস্তব্য কায়স্থেরা কালঞ্জর নামক স্থানে বাস করিত, এই তথ্যও এই লিপিগুলি হইতে জানা যাইতেছে। বুদ্ধ গয়ায় প্রাপ্ত এই আমলের একটি লিপিতে(১৫) পরিষ্কার বলা হইয়াছে যে বাস্তব্য কায়স্থেরা করণবৃত্তি অনুসরণ করিত; এবং তাহদের বর্ণ বা উপবর্ণকে যেমন বলা হইয়াছে কায়স্থ তেমনই বলা হইয়াছে করণ, অর্থাং করণ এবং কায়স্থ যে বর্ণহিসাবে সমর্থিক ও অভিন্ন তাহাই ইঙ্গিত করা হইয়াছে। নবম-দশম শতক নাগাদ বাংলাদেশেও করণ-কায়স্থেরা বর্ণহিসাবে গড়িয়া উঠিয়াছিল, এই সঙ্গন্ধে অন্তত একটি লিপিপ্ৰমাণ বিদ্যমান। শাকম্ভরীর চাহমানাধিপ দুলৰ্ভরাজের কিনসরিযা লিপির (৯৯৯) লেখক ছিলেন গৌড়দেশবাসী মহাদেব, মহাদেবের পরিচয় দেওয়া হইয়াছে “গৌড়কায়স্থবংশ” বলিয়া (১৬)।

কায়স্থদের বর্ণগত উদ্ভব সম্বন্ধে লিপিমালায় এবং অর্বাচীন স্মৃতিগ্রন্থাদিতে নানা প্রকাল কাহিনী প্রচলিত দেখা যায়। বেদব্যাস স্মৃতিমতে কায়স্থরা শূদ্রপপর্যায়ভূক্ত(১৭)। উদয়সুন্দরী কথা-গ্রন্থের লেখক কবি সোঢ্‌ঢল (একাদশ শতক) কায়স্থবংশীয় ছিলেন(১৮), তাহার যে বংশপরিচয় পাওয়া যাইতেছে তাহাতে দেখা যায় কায়স্থরা ক্ষত্ৰিয় বর্ণান্তর্গত বলিয়া দাবি করিতেন। ১০৪৯ খ্রীস্টাব্দের কলচুরীরাজ কর্ণের জনৈক কায়স্থ মন্ত্রীর একটি লিপিতে কায়স্থদের বলা হইয়াছে ‘দ্বিজ’ (৩৪: শ্লোক), অন্য স্থানে ইঙ্গিত করা হইয়াছে যে তাঁহারা ছিলেন শূদ্র(১৯।) ব্ৰাহ্মণেরাও যে করণবৃত্তি গ্রহণ করিতেন তাহার একাধিক লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান। ভাস্করবমর্ণের নিধনপুর লিপি-কথিত জনৈক ব্রাহ্মণ জনাৰ্দন স্বাধী ছিলেন ন্যায়-করণিক। এই লিপিতে জনৈক কায়স্থ দুন্ধুনাথেরও উল্লেখ আছে(২০)। উদয়পুরের ধোড়লিপিতে (১১৭১) এক করণিক ব্রাহ্মণের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় (২১)। করণিক শব্দ এইসব ক্ষেত্রে যে বৃত্তিবাচক সে সম্বন্ধে সন্দেহ নাই; তবে, সাম্প্রতিক কালে কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন যে, বাংলার কায়স্থরা নাগর ব্রাহ্মণদের বংশধর, এবং এইসব নাগর ব্রাহ্মণ পঞ্জাবের নগরকোট, গুজরাট-কাথিয়াবাড়ের আনন্দপুর (অন্য নাম নগর) প্রভৃতি অঞ্চল হইতে আসিয়াছিলেন (২২)। এই মত সকলে স্বীকার করেন না; এসম্বন্ধে একাধিক বিরুদ্ধ-যুক্তি যে আছে, সত্যই ত ই অস্বীকার কর যায় নাই (২৩)। বিদেশ হইতে নানাশ্রেণীর ব্রাহ্মণেরা বাংলাদেশে আসিয়া বসবাস করিয়াছেন, তাহার প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রমাণ বিদ্যমান; কিন্তু পৃথক পৃথক বর্ণস্তর গড়িয়া তুলিবার মতন এত অধিক সংখ্যায় তাহারা কখনও আসিয়াছিলেন, এমন প্রমাণ নাই।

 

বৈদ্য-অম্বষ্ঠ

পাল আমলের সুদীর্ঘ চারিশত বৎসরের মধ্যে ভারতবর্ষের অন্যত্র বৈদ্যবংশ ও পৃথক উপবর্ণ হিসাবে গড়িয়া উঠিয়াছে। প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থাদিতে বর্ণহিসাবে বৈদ্যের উল্লেখ নাই, অর্বাচীন স্মৃতি-গ্রন্থে চিকিৎসাবৃত্তিধাবী লোকদের বলা হইয়াছে বৈদ্যক। বৃহদ্ধর্মপুরাণে বৈদ্য ও অম্বষ্ঠ সমার্থক বলিয়া ধরা হইয়াছে, কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অম্বষ্ঠ ও বৈদ্য দুই পৃথক উপবর্ণ বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে (২৪)। ব্রাহ্মণ পিতা ও বৈশ্য মাতার সহবাসে উৎপন্ন অম্বষ্ঠ সংকব বর্ণের উল্লেখ একাধিক স্মৃতি ও ধর্মসূত্র গ্রন্থে পাওয়া যায়। বৃহদ্ধর্মপুরাণোক্ত অম্বষ্ঠ-বৈদ্যের অভিন্নতা পরবর্তী কালে বাংলাদেশে স্বীকৃত হইয়াছিল; চন্দ্রপ্রভা-গ্রন্থ এবং ভট্টিটীকার বৈদ্য লেখক ভরত মল্লিক (সপ্তদশ শতক) অম্বষ্ঠ এবং বৈদ্য বলিয়া আত্মপরিচয় দিয়াছেন (২৫)। কিন্তু বাংলার বাহিরে সর্বত্র এই অভিন্নতা স্বীকৃত নয়; বর্তমান বিহার এবং যুক্তপ্রদেশের কোনও কোনও কায়স্থ সম্প্রদায় নিজেদের অম্বষ্ঠ বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন; এবং অন্ততঃ একটি অর্বাচীন সংহিতায় (সূত-সংহিতা) অম্বষ্ট ও মাহিষ্যদের অভিন্ন বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে। যাহা হউক, দক্ষিণতম ভারতে অষ্টম শতকেই বৈদ্য উপরর্ণের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে। জনৈক পাণ্ড্যরাজার তিনটি লিপিতে(২৬) কয়েকজন বৈদ্য সামন্তের উল্লেখ পাওয়া বাইতেছে, এবং ইঁহারা প্রত্যেকেই সমসাময়িক রাষ্ট্র ও সমাজে সম্ভ্রান্ত ও পরাক্রান্ত বলিয়া গণিত হইতেন, তাহা বুঝা যাইতেছে। ইহাদের একজনের পরিচয় দেওয়া হইয়াছে বৈদ্য এবং “বৈদ্যকশিখামণি” বলিয়া; তিনি একজন প্রখ্যাত সেনানায়ক এবং রাজার অন্যতম উত্তরমন্ত্রী ছিলেন। আর একজনের জন্মের ফলে বঙ্গলণ্ডৈব (পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার?) বৈদ্যকুল উজ্জ্বল হইয়াছিল; তিনি ছিলেন গীতবাদ্যে সুনিপুণ। আরও এক জনের পরিচয় বৈদ্যক হিসাবে; তিনি ছিলেন একাধারে কবি, বক্তা এবং শাস্ত্রবিদ পণ্ডিত। এই লিপিগুলির বৈদ্যকুল, ‘বৈদ্য’ ‘বৈদ্যক’ শব্দগুলি ভিষক্‌বৃত্তিবাচক বলিয়া মনে হইতেছে না, এবং বৈদ্যকুল বলিতে যেন কোনো উপবর্ণই বুঝাইতেছে। বাংলার সমসামধিক কোনো লিপি বা গ্রন্থে এই অর্থে বা অন্য কোনো অর্থে বৈদ্যক, বা বৈদ্যকবংশ বা বৈদ্যক কুলের কোনো উল্লেখ নাই। বস্তুত, তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় পরবর্তী পাল ও সেন-বর্মণযুগে, একাদশ শতকের পাল লিপিতে দ্বাদশ শতকে শ্রীহট্টজেলায় রাজা ঈশানদেবের ভাটেরা লিপিতে। ঈশানদেবের অন্যতম পট্টনিক বা মন্ত্রী বনমালী কর ছিলেন “বৈদ্যবংশ প্রদীপ” (২৭)। পূর্ববতী পাল-চন্দ্রযুগে বরং দেখিয়াছি শব্দপ্রদীপ গ্রন্থের লেখক, তাহার পিতা এবং প্রপিতামহ যাহাবা সকলেই ছিলেন রাজবৈদ্য বা চিকিৎসক তাহাদের আত্মপবিচয় ‘করণ’ বলিয়া সেইজন্য মনে হয়, একাদশ-দ্বাদশ শতকের আগে, অন্ততঃ বাংলাদেশে, বৃত্তিবাচক বৈদ্য-বৈদ্যক শব্দ বর্ণ বা উপবর্ণ-বাচক বৈদ্য শব্দে বিবর্তিত হয় নাই অর্থাং বৈদ্যবৃত্তিধারীরা বৈদ্য-উপরর্ণে গঠিত ও সীমিত হইয় উঠেন নাই। কিন্তু, পূর্বোক্ত পাণ্ড্যরাজার একটি লিপিতে যে বঙ্গলণ্ডৈর বৈদ্যকুলের কথা বলা হইয়াছে, এই বঙ্গলণ্ডৈ কোথায়? এই বঙ্গলণ্ডৈর সঙ্গে কি বঙ্গ-বঙ্গালজনের বা বঙ্গাল-দেশের কোনও সম্বন্ধ আছে? আমার যেন মনে হয়, আছে। এই বৈদ্যকুল বঙ্গ বা বঙ্গালদেশ (দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গ) হইতে দক্ষিণ প্রবাসে যায় নাই তো? বাংলাদেশে বৈদ্যকুল এখনও বিদ্যমান; দক্ষিণতম ভারতে কিন্তু নাই, মধ্যযুগেও ছিল বলিয়া কোনো প্রমাণ নাই। তাহা ছাড়া পূর্বোক্ত তিনটি লিপিই একটি রাজার রাজত্বের, এবং যে-তিনটি বৈদ্য-প্রধানের উল্লেখ করা হইয়াছে তাহারা যেন একই পরিবারভুক্ত। এইসব কারণে মনে হয়, বৈদ্যকুলের এই পরিবারটি বঙ্গ বা বঙ্গালদেশ হইতে দক্ষিণ ভারতে গিয়া হয়ত বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। বঙ্গলণ্ডৈ হয়ত পাণ্ড্যদেশে বঙ্গ-বঙ্গাল দেশবাসীর একটি উপনিবেশ, অথবা একেবারে মূল বঙ্গ-বঙ্গালভূমি। যদি এই অনুমান সত্য হয় তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, অষ্টম শতকেই বাংলাদেশে বৈদ্য উপবর্ণ গড়িয়া উঠিয়াছিল।

————————
(১) পাল পর্বের লিপিমালা দ্রষ্টব্য।
(২) রামচরিত, ১।১৭ শ্লোকের টীকা দ্রষ্টব্য।
(৩) Taranath’s Geschichte der Buddhismus. — p. 202.
(৪) Ain-i-Akbari. Trs. Blochmann & Jarret, II, p. 145.
(৫) Manjusrimulakalpa, ed. Jayaswal. v. p. 883.
(৬) রামচরিত, কবিপ্রশস্তি, ৩নং শ্লোক।
(৭) Eggeling, Cat. of Sans, Mss. In the Library of the India Office, London. 1887. v. p. 974
(৮) সুকুমার সেন, বাঙ্গলা সহিত্যের ইতিহাস, ১ম খণ্ড; JASB. 1912, p. 34I.
(৯) Ed.S. C. Das, lnt o. p. iii; দুই পৃষ্ঠা পরেই এক কায়স্থ-বৃদ্ধের উল্লেখ আছে এই গ্রন্থে।
(১০) Eр, Ind. 1. р. 122
(১১) Ep. Ind, I, p, 81
(১২) Ep. Ind. XI, p. 4 I
(১৩) lnd. Ant. XIX, p. 2 18
(১৪) Ep. Ind. XVIII, p 25 I, P oc. A. S. B. 1880, p 78
(১৫) Ep Ind, J, p 332
(১৬) Ep. Ind. XI 1. p. 61
(১৭) Kane, History of the Dharmasastras, p. 76.
(১৮) উদয়সুন্দরীকথা, Gaekwad Or. Ser. p. 11.
(১৯) Ep lnd. XXlV, p. 101
(২০) কামরূপশাসনাবলী, পু ৪৩
(২১) Bhandarkar, List of Insciptions no. 350.
(২২) Ind. Ant., LXI, p. 48, I. H. Q. VI, p. 60
(২৩) H.B. (D. U.), p. 589.
(২৪) পরে দ্রষ্টব্য
(২৫) চন্দ্রপ্রভা, কলিকাতা সং
(২৬) Ep. Ind. XVII, 291-3o9; VIII, 317-38 1, Ind. Ant., 1893, 57 pp.
(২৭) Proc. A. S. B. 188o, 141 pp. Ep. lnd. XIX, 277 pp.

 

কৈবর্ত

পাল আমলে কৈবর্তদের প্রথম ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে। বরেন্দ্রীর কৈবর্তনায়ক দিব্য বা দিব্বোক পালরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সামন্ত কর্মচারী ছিলেন বলিয়া মনে হয়; অনন্তসামন্তচক্রের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পালরাষ্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহপরায়ণ হইয়া রাজা দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করেন, এবং বরেন্দ্রী কাড়িয়া লইয়া সেখানে কৈবর্তধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। বরেন্দ্রী কিছুদিনের জন্য দিব্য, রুদোক ও ভীম পর পর এই তিন কৈবর্ত রাজার অধীনতা স্বীকার করিয়াছিল। এই ঐতিহাসিক ঘটনা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় সমসাময়িক উত্তরবঙ্গ-সমাজে কৈবর্তদের সামাজিক প্রভাব ও আধিপত্য, জনবল ও পরাক্রম যথেষ্টই ছিল। বিষ্ণুপুরাণে কৈবর্তদের বলা হইয়াছে অব্রহ্মণ্য, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও সংস্কৃতি বহির্ভূত।(১) মনুস্মৃতিতে নিষাদ-পিতা এবং আয়োগব মাতা হইতে জাত সন্তানকে বলা হইয়াছে মার্গব বা দাস; ইহাদেরই অন্য নাম কৈবর্ত।(২) মনু বলিতেছেন, ইহাদের উপজীবিকা নৌকার মাঝিগিরি। এই দুইটি প্রাচীন সাক্ষ্য হইতেই বুঝা যাইতেছে, কৈবর্তরা কোনও আর্যপূর্ব কোম বা গোষ্ঠী ছিল, এবং তাহারা ক্রমে আর্য-সমাজের নিম্নস্তরে স্থানলাভ করিতে ছিল। বৌদ্ধ জাতকের গল্পেও মৎস্যজীবিদের বলা হইয়াছে কেবত্ত = কেবর্ত।(৩) আজ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের কৈবর্তরা নৌকাজীবী মৎস্যজীবী। দ্বাদশ শতকে বাঙালী স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট সমাজে কেবর্তদের স্থান নিদেশ করিতেছেন অন্ত্যজ পর্যায়ে, রজক, চর্মকার, নট, বরুড়, মেদ এবং ভিল্লদের সঙ্গে (৪); এবং স্মরণ রাখা প্রযোজন ভবদেব রাঢ়দেশের লোক। অমরকোষেও দেখিতেছি, দাস ও ধীবরদের বলা হইতেছে কৈবর্ত। মনুস্মৃতি এবং বৌদ্ধজাতকের সাক্ষ্য একত্র যোগ করিলেই অমকোষের সাক্ষ্যের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। দ্বাদশ শতকের গোড়ায় ভবদেব ভট্টের সাক্ষ্য ও প্রামাণিক। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, ঐ সময়ে ও কৈবর্তদের সঙ্গে মাহিষ্যদের যোগাযোগের কোনও সাক্ষ্য উপস্থিত নাই; এবং মাহিষ্য বলিয়া কৈবর্তদের পরিচয়ের কোনও দাবিও নাই, স্বীকৃতি ও নাই। পরবর্তী পর্বে সেই দাবি এবং স্বীকৃতির স্বরূপ ও পরিচয় পাওয়া যাইবে; কিন্তু এই পর্বে নয়। কৈবর্তদের জীবিকাবৃত্তি যাহাই হউক, পালরাষ্ট্রের উদার সামাজিক আদর্শ কৈবর্তদের রাষ্ট্ৰীয় ক্ষমতালাভ ও সঞ্চয়ের পথে কোন ও বাধার সৃষ্টি করে নাই, করিলে দিব্য এত পরাক্রান্ত হইয়া উঠিতে পারিতেন না। সন্ধ্যাকরনন্দী পালরাষ্ট্রের প্রসাদভোজী, রামপালের কীর্তিকথার কবি, তিনি দিব্যকে দস্যু বলিয়াছেন, উপধিব্রতী বলিয়াছেন, কুংসিত কৈবর্ত নৃপ বলিয়াছেন, তাঁহার বিদ্রোহকে অলীক ধর্ম বিপ্লব বলিয়াছেন, এই ডমর উপপ্লবকে ‘ভবস্য আপদম’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন—শত্রু এবং শত্রুবিদ্রোহকে পক্ষপাতী লোক তাহা বলিয়াই থাকে—কিন্তু কোথাও তাঁহার বা তাঁহার শ্রেণীর বৃত্তি বা সামাজিক স্থান সম্বন্ধে কোন ও ইঙ্গিত তিনি করেন নাই। মনে হয়, সমাজে তাহাদের বৃত্তি বা স্থান কোনটাই নিন্দনীয় ছিল না। কৈবর্তরা যে মাহিষ্য, এ-ইঙ্গিতও সন্ধ্যাকর কোথাও দিতেছেন না। একাদশ-দ্বাদশ শতকে ও কৈবর্তরা বাংলাদেশে কেবট্ট বলিয়া পরিচিত হইতেন এবং তাঁহাদের মধ্যে অন্ততঃ কেহ কেহ সংস্কৃতচর্চা করিতেন, কাব্যও রচনা করিতেন, এবং ব্রাহ্মণ্যধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির ভক্ত অনুরাগী ছিলেন। ‘সদুক্তি কর্ণামৃত” নামক কাব্যসংকলন গ্রন্থে (১২০৬) কেবট্ট পপীপ অর্থাং কেওট বা কৈবর্ত কবি পপীপ রচিত গঙ্গাস্তবের একটি পদ আছে। পদটি বিনয়-মধুর, সুন্দর!

—————-

(১) ৪।২৪।৮
(২) ১০।৩৪
(৩) Rhys Davids, Buddhist India; Fick, Social Organisation.
(৪) প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ, ১১৮ পৃ।

 

বর্ণসমাজের নিম্নস্তর

পালরাজাদের অধিকাংশ লিপিতে সাময়িক বর্ণসমাজের নিম্নতমস্তরের কিছু পরোক্ষ সংবাদ পাওয়া যায়। লিপিগুলির যে অংশে ভূমি দানের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হইতেছে সেখানে বাজপাদোপজীবী বা রাজকর্মচারীদের সুদীর্ঘ তালিকার পরেই উল্লেখ করা হইতেছে ব্রাহ্মণদের, তাহার পরে প্রতিবাসী ও ক্ষেত্রকর বা কৃষকদের, এবং কুটুম্ব অর্থাং স্থানীয় ধান প্রধান গৃহস্থ লোকদের (লক্ষণীয় যে ক্ষত্ৰিয়বৈশ্যাদের কোনও উল্লেখ নাই; ইহাদের পরই অন্যান্য যেসব স্তরের লোক তাহাদের সকলকে একত্র করিয়া গাঁথিয়া উল্লেখ করা হইতেছে মেদ, অন্ধ্র ও চণ্ডালদের। চণ্ডালরাই যে সমাজের নিম্নতম স্তব তাতে লিপির এই অংশটুকু উল্লেখ করিলেই বুঝা যাইবে : প্রতিবাসিনশ্চ ব্রাহ্মণোত্তরান্‌ মহত্তরকুটম্বিপুরোগমেদান্‌ ধ্ৰুকচণ্ডালপয্যন্তান্‌। ভবদেব ভট্টের স্মৃতিশাসনে চণ্ডাল অন্তজ পর্যায়ের, চণ্ডাল ও অন্ত্যজ এই দুইই সমার্থক। মেদরাও ভবদেবের মতে অন্ত্যজ পর্যায়ের। মেদ ও চণ্ডালদের সঙ্গে অন্ধ্রদের উল্লেখ হইতে মনে হয়, ইঁহাদেরও স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছিল বাঙালী সমাজের নিম্নতম স্তরে। কিন্তু, কেন এইরূপ হইয়াছিল, বুঝা কঠিন। বেতনভূক সৈন্য হিসাবে মালব খস কুলিক, হূণ, কর্ণাট, লাট প্রভৃতি বিদেশী ও ভিনপ্রদেশী অনেক লোক পালবাষ্ট্রেব সৈন্যদলে ভর্তি হইয়াছিল; এই তালিকায় অন্ধ্রদের দেখা পাওয় যায় না। ইহারা স্বভাবতঃ জীবিকার্জনের জন্য নিজের দেশ ছাড়িয়া বাংলাদেশে আসিয়া এদেশের বাসিন্দা হইয়া গিয়াছিলেন, এবং সামাজিক দৃষ্টিতে হেয় বা নীচ এমন কোনও কাজ করিয়া জীবিকানির্বাহ করিতেন।

ইঁহাদের ছাড়া “চযাঁগীতি” বা “চযাঁচর্যবিনিশ্চয়” গ্রন্থে আরও কয়েকটি তথাকথিত নীচ জাতের খবর পাওয়া যাইতেছে, যথা ডোম বা ডোম্ব, চণ্ডাল, শবর ও কাপালি। ডোমপত্নী অর্থাং ডোমনী বা ডোম্বি ও কাপালি বা কাপালিক সম্বন্ধে কাহ্নুপাদের একটি পদের কিয়দংশ উদ্ধার করা যাইতে পারে। (১)

নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহেরি কুড়িআ (কুঁড়েঘর)।
ছোই ছোই জাহ সো বাহ্মণ নাড়িআা (নেড়ে ব্রাহ্মণ)।।
আলো (ওলো) ডোম্বি তোত্র সম করিব ম সঙ্গ।
নিঘিন (নিঘৃণ — ঘৃণা নাই যার) কাহ্ন কাপালি জোই (যোগী) লাংগ (উলঙ্গ)।।…
তান্তি (তাঁত) বিকণঅ ডোম্বি অরবনা চাংগেড়া (বাশের চাঙ্গাড়ি)।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়-পেড়া ॥

ডোমেরা যে সাধারণতঃ নগরের বাহিরে কুঁড়ে বাঁধিয়া বাস করিত, বাঁশের তাঁত ও চাঙাড়ি তৈরি করিয়া বিক্রয় করিত, এবং ব্রাহ্মণস্পর্শ যে তাহাদের নিষিদ্ধ ছিল, এই পদে তাহার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে! ডোম পুরুষ ও নারী নৃত্যগীতে সুপটু ছিল। কপালী বা কাপালি(ক)রাও নিম্নস্তরের লোক বলিয়া গণ্য হইত; এই পদে তাহার ও ইঙ্গিত বিদ্যমান। ভবদেব ভট্ট চণ্ডাল ও পুক্‌কশদের সঙ্গে কাপালিকদেরও অন্ত্যজ পর্যায়ভুক্ত করিয়াছেন। কাপালিকরা ছিল লজ্জাঘৃণাবিরহিত, গলায় পরিত হাড়ের মালা, দেহগাত্র থাকিত প্রায় উলঙ্গ। শবরেরা বাস করিত পাহাড়ে জঙ্গলে, ময়ূরের পাখ্‌ ছিল তাহাদের পরিধেয়, গলায় গুঞ্জা বীচির মালা, কর্ণে বজ্রকুণ্ডল। (২)

উঁচা উঁচা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী॥…
একেলী শবরী এ বন হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডলবজ্রধারী!
তিঅ ধাউ খাট পাড়িলা সবরো মহাসুখে সেজি ছাইলী।
সবোর ভূজঙ্গ নৈরামণি দাবী পেহ্মরাতি পোতাইলী।।

শবর-শবরীদের গানের একটা বিশিষ্ট ধরণ ছিল; সেই ধরণ শবরী রাগ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। কয়েকটি চযাঁগীতি যে এই শবরী রাগে গীত হইত সে-প্রমাণ এই গ্রন্থেই পাওয়া যাইতেছে। এই চৰ্যাগীতিটির মধ্যেই আমরা বজ্রযান বৌদ্ধদেবতা পর্ণশবরীর রূপাভাস পাইতেছি, এ-তথ্যের ইঙ্গিতও সুস্পষ্ট। একাধিক চযাঁগীতির ইঙ্গিতে মনে হয় ডোম্ব ও চণ্ডাল অভিন্ন (১৮ ও ৪৭ সংখ্যক পদ) কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ডোম ও চণ্ডাল উঠাই অন্ত্যজ অস্পৃশ্য পর্যায়ভুক্ত, কিন্তু পৃথক পৃথকভাবে উল্লিখিত। চযাঁপদের সাক্ষ্য হইতে এই ধারণা করা চলে যে সমাজের উচ্চতর শ্রেণী ও বর্ণের দৃষ্টিতে ইহাদের যৌনাদর্শ ও অভ্যাস শিথিল ছিল। পরবর্তী পর্বে দেখা যাইবে, এই শৈথিল্য উচ্চশ্রেণীর ধর্মকর্মকেও স্পর্শ করিয়াছিল। পাহাড়পুরের ধ্বংসস্তুপের পোড়ামাটির ফলকগুলিতে বাঙালীসমাজের নিম্নস্তরের এইসব গোষ্ঠী ও কোমদের দৈহিক গঠনাকুতি ও দৈনন্দিন আহারবিহার বসনব্যসনের কতকটা পরিচয় পাওয়া যায়। বৃক্ষপত্রের পরিধান, গলায় গুঞ্জাবীচির মালা, এবং পাতা ও ফুলের নানা অলঙ্কার দেখিলে শবরী মেযেদের চিনিয়া লইতে দেরী হয় না।

——————
(১) চযাঁপদ ১০ নং।
(২) চযাঁপদ ২৮ নং।

 

ব্রাহ্মণ

পাল-চন্দ্র-কম্বোজ পর্বের ব্রাহ্মণেতর অন্যান্য বর্ণ উপবর্ণ সম্বন্ধে যে-সব সংবাদ পাওয়া যায় তাহা একত্রে গাঁথিয়া মোটামুটি একটা চিত্র দাঁড় করাইবার চেষ্টা করা গেল। দেখা যাইতেছে এ-যুগের রাষ্ট্রদৃষ্টি বর্ণসমাজের নিম্নতম স্তর চণ্ডাল পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য বর্ণসমাজের মাপকাঠি ব্রাহ্মণ স্বয়ং এবং ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও ধর্ম। সমাজে ইঁহাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তির বিস্তার ও গভীরতার দিকে তাকাইলে  বর্ণসমাজের ছবি স্পষ্টতর ধরিতে পারা যায়। এক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার তারতম্য এবং বিশিষ্টতা অনেকাংশে কোন বিশেষ ধর্ম ও ধর্মগত সংস্কার ও সমাজব্যবস্থার প্রসারতার দ্যোতক।

পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতি প্রসার আগেই লক্ষ্য করা হইয়াছে। সমাজে ব্রাহ্মণ্য বর্ণব্যবস্থাও সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশঃ প্রসারিত হইতেছিল। যুয়ান্‌-চোয়াঙ, ও মঞ্জুশ্ৰীমূল-কল্পের গ্রন্থকার শশাঙ্ককে বলিয়াছেন বৌদ্ধবিদ্বেষী। সত্যই শশাঙ্ক তাহা ছিলেন কিনা সে-বিচার এখানে অবান্তর। এই দুই সাক্ষ্যের একটু ক্ষীণ প্রতিধ্বনি নদীয়া বঙ্গসমাজের কুলজী গ্রন্থেও আছে, এবং সেই সঙ্গে আছে শশাঙ্ক কর্তৃক সরযূনদীর তীর হইতে বারো জন ব্রাহ্মণ আনয়নের গল্প। শশাঙ্ক এক উৎকট ব্যাধিদ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিলেন; ব্যাধিমুক্তির উদ্দেশ্যে গৃহযজ্ঞ করিবার জন্যই এই ব্রাহ্মণদের আগমন। রাজানুরোধে এই ব্রাহ্মণেরা গৌড়ে বসবাস আরম্ভ করেন এবং গৃহবিপ্র নামে পরিচিত হন; পরে তাহাদের বংশধরেরা রাঢ়েবঙ্গে ও বিস্তৃত হইয়া পড়েন এবং নিজ নিজ গাঞী নামে পরিচিত হন। বাংলার বাহির হইতে ব্রাহ্মণ্যগমনের যে ঐতিহ্য কুলজী গ্রন্থে বিধৃত তাহার সূচনা দেখিতেছি শশাঙ্কের সঙ্গে জড়িত। কুলজীগ্রন্থের অন্য অনেক গল্পের মত এই গল্পও হয়তো বিশ্বাস্য নয়, কিন্তু এই ঐতিহ্য-ইঙ্গিত সৰ্বথা মিথ্যা না-ও হইতে পারে। মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার বলিতেছেন, শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ; ব্রাহ্মণের পক্ষে ব্রাহ্মণ্যপ্রীতি কিছু অস্বাভাবিক নয়, এবং বহুযুগস্মৃত শশাঙ্কের বৌদ্ধবিদ্বেষ কাহিনীর মূলে এতটুকু সত্যও নাই, এ-কথাই বা কি করিয়া বলা যায়। সমসাময়িক কাল যে প্রাগ্রসরমান ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম ও সংস্কৃতিরই কাল তাহা ত নানাদিক হইতে সুস্পষ্ট। আগেই তাহা উল্লেখ করিয়াছি। যুয়ান্‌ চোয়াঙ্‌, ইৎসিঙ্‌, সেংচি প্রভৃতি চীন ধৰ্ম পরিব্রাজকেরা যে সব বিবরণী রাখিয়া গিয়াছেন তাহা হইতে অনুমান করা চলে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থাও বেশ সমুদ্ধই ছিল, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ-তথ্য অনস্বীকার্য যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থা তাহার চেয়েও অনেক বেশী সমুদ্ধতর ছিল। বাংলার সর্বত্র ব্রাহ্মণ দেবপূজকের সংখ্যা সৌগতদের সংখ্যাপেক্ষ অনেক বেশি ছিল, এতথ্য যুয়ান্‌-চোয়াঙই রাখিয়া গিয়াছেন। পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারের তথা বৰ্ণব্যবস্থার প্রসার বাড়িয়াই চলিয়াছিল, এ সম্বন্ধে দেবদেবীর মূর্তি-প্রমাণই যথেষ্ট। জৈন ধর্ম ও সংস্কার তো ধীরে ধীরে বিলীন হইয়াই যাইতেছিল। আর, বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কারও ব্রাহ্মণ্য সমাজাদর্শকে ধীরে ধীরে স্বীকার করিয়া লইতে ছিল, পাল-চন্দ্র-কঙ্গোজ রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শের দিকে তাকাইলেই তাহা সুস্পষ্ট ধরা পড়ে। যুয়ান্‌-চোয়াঙ কামরূপ প্রসঙ্গে বলিতেছেন, কামরূপের অধিবাসিরা দেবপূজক ছিল, বৌদ্ধধর্মে তাঁহারা বিশ্বাস করিত না; দেবমন্দিব ছিল শত শত, এবং বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের লোকসংখ্যা ছিল অগণিত। মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি বৌদ্ধ ছিল তাঁহারা ধর্মানুষ্ঠান করিত গোপনে। এই ত সপ্তমশতক কামরূপের অবস্থা; বাংলা দেশেও তাহার স্পর্শ লাগে নাই, কে বলিবে? মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের গ্রন্থকার স্পষ্টই বলিতেছেন, মাৎস্যন্যায়ের পর গোপালের অভ্যুদয় কালে সমুদ্রতীর পর্যন্ত স্থান তীৰ্থিক (ব্রাহ্মণ?) দের দ্বারা অধ্যুষিত ছিল; বৌদ্ধমঠগুলি জীর্ণ হইয়া পড়িতেছিল, লোকে ইহাদেরই ইটকাঠ কুড়াইয়া লইয়া ঘরবাড়ী তৈয়ার করিতেছিল। ছোটবড় ভূস্বামীরাও তখন অনেকে ব্রাহ্মণ। গোপাল নিজেও ব্রাহ্মণানুরক্ত, এবং বৌদ্ধ গ্রন্থকার সেজন্য গোপালের উপর একটু কটাক্ষপাতও করিয়াছেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের ক্রমবর্দ্ধমান প্রসার ও প্রভাব সম্বন্ধে কোন ও সন্দেহই আর করা চলে না।

 

পালরাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ

পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগের সমসাময়িক অবস্থাটা দেখা যাইতে পারে। এ-তথ্য সুবিদিত যে পাল রাজার বৌদ্ধ ছিলেন—পরম সুগত। বৌদ্ধধর্মের তাহার পরম পৃষ্ঠপোষক, ওদন্তপুরী, সোমপুর এবং বিক্রমশীল মহাবিহারের তাঁহারা প্রতিষ্ঠাতা, নালন্দা মহাবিহারের তাঁহারা ধারক ও পোষক; বজ্রাসনের বিপুল করুণা পরিচালিত দলবল পাল রাষ্ট্রের রক্ষক। বাংলাদেশে যত বৌদ্ধ মূর্তি ও মন্দির আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহা প্রায় সমস্তই এই যুগের; যত অসংখ্য বিহারের উল্লেখ পাইতেছি নানা জায়গায় জগদ্দল বিক্রমপু্রী-ফুল্লহরি-পট্টিকেরক-দেবীকোটপণ্ডিত-ত্ৰৈকূটক-পণ্ডিতসন্নগর—এই সমস্ত বিহারও এই যুগের; দেশ-বিদেশ-প্রখ্যাত যে বৌদ্ধ পণ্ডিতাচার্যদের উল্লেখ পাইতেছি তাঁহারাও এই যুগের। চন্দ্রবংশও বৌদ্ধ; জিন (বুদ্ধ), ধর্ম ও সংঘের স্বস্তি উচ্চারণ করিয়া চন্দ্রবংশীয় লিপিগুলির সূচনা; ইহাদের রাজ্য হরিকেল তো বৌদ্ধতান্ত্রিক পীঠগুলির অন্যতম পীঠ। ভিন্ন-প্রদেশাগত কম্বোজ রাজবংশ ও বৌদ্ধ, পরমসুগত।

অথচ ইঁহাদের প্রত্যেকেরই সমাজাদর্শ একান্তই ব্রাহ্মণ্য সংস্কারানুসারী, ব্রাহ্মণ্যাদর্শানুযায়ী। এই যুগের লিপিগুলি ত প্রায় সবই ভূমিদান সম্পর্কিত; এবং প্রায় সর্বত্রই ভূমিদান লাভ করিতেছেন ব্রাহ্মণেরা, এবং সর্বাগ্রে ব্রাহ্মণদের সম্মাননা না করিয়া কোন দানকার্যই সম্পন্ন হইতেছে না। তাঁহাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি রাষ্ট্রের ও সমাজের সর্বত্র। “হরিচরিত” নামক গ্রন্থের লেখক চতুর্ভূজ বলিতেছেন, তাঁহার পূর্বপুরুষের বরেন্দ্রভূমির করঞ্জগ্রাম ধৰ্মপালের নিকট হইতে দানস্বরূপ লাভ করিয়া ছিলেন। এই গ্রামের ব্রাহ্মণেরা বেদবিদ্যাবিদ এবং স্মৃতিশাস্ত্রজ্ঞ ছিলে।(১) এই ধর্মপাল প্রসিদ্ধ পাল-নরপতি হওয়াই সম্ভব, যদিও কেহ কেহ মনে করেন ইনি রাজেন্দ্রচোল-পরাজিত ধৰ্মপাল। বৌদ্ধ নরপতি শূরপাল (প্রথম বিগ্রহপাল) মন্ত্রী কেদারমিশ্রের যজ্ঞস্থলে স্বয়ং উপস্থিত থাকিয়া অনেকবার শ্রদ্ধাসলিলাপ্লুতহৃদয়ে নতশিরে পবিত্র শান্তিবারি গ্রহণ করিয়াছিলেন। বাদল প্রস্তরলিপিতে শাণ্ডিল্যগোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ মন্ত্ৰীর শৈব প্রশস্তি উৎকীর্ণ আছে; এই বংশের তিনপুরুষ বংশপরম্পরায় পালবাষ্ট্রের মন্ত্রীত্ব করিয়াছিলেন। দর্ভপাণিপুত্র মন্ত্রী কেদারমিশ্র সঙ্গন্ধে এই লিপিতে আরও বলা তইয়াছে, “তাহার [হোমকুণ্ডোত্থিত] অবক্ৰভাবে বিরাজিত সুপুষ্ট হোমাগ্নিশিখাকে চুম্বন করিয়া দিকচক্রবাল যেন সন্নিহিত হইয়া পড়িত।” তাহা ছাড়া তিনি চতুৰ্বিদ্যা-পয়োনিপি পান করিয়াছিলেন (অর্থাৎ চারি বেদবিদ ছিলেন)। কেদারমিশ্রের পুত্র মন্ত্রী গুরবমিশ্রের “বাগ্‌বৈভবের কথা, আগমে ব্যুৎপত্তির কথা, নীতিতে পরম নিষ্ঠার কথা… জ্যোতিষে অধিকারের কথা এবং বেদার্থচিন্তাপরায়ণ অসীম তেজসম্পন্ন তদীয় বংশের কথা ধর্মাবতার ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন।” পরমসুগত প্রথম মহীপাল বিষুবসংক্রান্তির শুভতিথিতে গঙ্গাস্নান করিয়া এক ভট্ট ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। তৃতীয় বিগ্ৰহপালও আমগাছি লিপিদ্বারা এক ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন।

মদনপালেব মহনলি লিপিতে বলা হইয়াছে, শ্রীবটেশ্বর স্বামীশর্মা বেদব্যাসপ্রোক্ত মহাভারত পাঠ করায় মদনপালের পট্টমহাদেবী চিত্রমতিকা ভগবান বৃদ্ধভট্টারককে উদ্দেশ্য করিয়া অনুশাসন দ্বারা বটেশ্বরকে নিষ্কর গ্রাম দান করিয়াছেন। বৈদ্যদেবের কমৌলি লিপিতে দেখিতেছি, বরেন্দ্রীর অন্তর্গত ভাবগ্রামে ভরত নামক ব্রাহ্মণ প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন; “তাহার যুধিষ্ঠির নামক বিপ্র (কুল) তিলক পণ্ডিতাগ্রগণ্য পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি শাস্ত্রজ্ঞানপরিশুদ্ধবুদ্ধি এবং শ্রেত্রিয়ত্বের সমুজ্জ্বল যশোনিধি ছিলেন।” যুধিষ্ঠিরের পুত্র ছিলেন দ্বিজাধীশ-পূজ্য শ্রীধর। তীর্থভ্রমণে, বেদাধ্যয়নে, দানাধ্যাপনায়, যজ্ঞানুষ্ঠানে, ব্রতাচরণে, সবশ্রোত্রীয়শ্রেষ্ট শ্রীধর প্রাতঃ, নক্ত, অযাচিত এবং উপরসন (নামক বিবিধ কৃচ্ছ্রসাধন) করিয়া মহাদেবকে প্রসন্ন করিয়াছিলেন, এবং কর্মকাণ্ড জ্ঞানকাণ্ডবিং পণ্ডিতগণের অগ্রগণ্য, সর্বাকার-তপোনিধি এবং শ্রৌতস্মার্তশাস্ত্রের গুপ্তার্থবিৎ বাগীশ বলিয়া খ্যাতিলাভ করিধাছিলেন। পবিত্র ব্রাহ্মণবংশোদ্ভব কুমারপাল-মন্ত্রী বৈদ্যদেব বৈশাখে বিষুবসংক্রান্তি একাদশী তিথিতে ধর্মাধিকার পদাভিষিক্ত শ্ৰী গোনন্দন পণ্ডিতের অনুরোধে এই ব্রাহ্মণ শ্রীধরকে শাসনদ্বারা ভূমিদান করিয়াছিলেন। কিন্তু আর দৃষ্টান্ত উল্লেখের প্রয়োজন নাই; লিপিগুলিতে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী এবং মন্দির ইত্যাদির যে সব উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় তাহারও আর বিবরণ দিতেছি না। বস্তুত, পালযুগেব লিপিমালা পাঠ করিলেই এ-তথ্য সুস্পষ্ট হঠয়া উঠে যে এইসব লিপির রচনা আগাগোড়া ব্রাহ্মণ্য পুরাণ, রামায়ণ মহাভারতের গল্প, ভাবকল্পনা, এবং উপমালঙ্কার দ্বারা আচ্ছন্ন—ইহাদের ভাবাকাশ একান্তই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারের আকাশ। তাহা ছাড়া বৌদ্ধ পালরাষ্ট্র যে ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও বর্ণব্যবস্থা পুরোপুরি স্বীকার করিত তাহার অন্ততঃ দুটি উল্লেখ পাল-লিপিতেই আছে। দেবপালদেবের মুঙ্গের লিপিতে ধর্মপাল সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, ধর্মপাল “শাস্ত্রার্থের অতুবর্তী শাসনকৌশলে (শাস্ত্রশাসন হইতে) বিচলিত (ব্রাহ্মণ্যদি) বর্ণসমূহকে স্ব স্ব শাস্ত্রনিদিষ্ট ধর্মে প্রতিস্থাপিত করিয়াছিলেন”। এই শাস্ত্র যে ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র এই সম্বন্ধে তো কোন সন্দেহই থাকিতে পারে না। স্ব স্ব ধর্মে প্রতিস্থাপিত কবিবার অর্থও নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসে প্রত্যেক বর্ণের যথানিদিষ্ট স্থানে ও সীমায় বিন্যস্ত করা। মাৎস্যন্যায়ের পরে নূতন করিয়া শাস্ত্রশাসনানুযায়ী বিভিন্ন বর্ণগুলিকে সুবিন্যস্ত কবার প্রয়োজন বোধ হয় সমাজে দেখা দিয়াছিল ৷ আমগাছি লিপিতেও দেখিতেছি তৃতীয় বিগ্রহপালকে “চাতুবর্ণ্য-সমাশ্রয়” বর্ণাশ্রমের আশ্রয়স্থল বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে।

——————————————————–
(১) Sastri, H. P.–Cat of Mss. Nepal. 1, 134 p; হরপ্রসাদ সংবৰ্দ্ধন লেখমালা, ২য় খণ্ড, ২০৮ পৃ; যতীন্দ্র মোহন রায়—ঢাকার ইতিহাস, ২য় খণ্ড, ১০৭ পৃ।