৩. বাঙালীর সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই বাঙালীর ইতিহাস

প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
তৃতীয় পরিচ্ছেদ । বাঙালীর সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই বাঙালীর ইতিহাস

বস্তুত, সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই প্রকৃত জনসাধারণের ইতিহাস। প্রাচীন বাঙলার সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই এই গ্রন্থের মুখ্য আলোচ্য বলিয়াও ইহার নামকরণ করিয়াছি ‘বাঙালীর ইতিহাস’। রাজা ও রাষ্ট্র এই সমাজবিন্যাসে যতটুকু স্থান অধিকার করে ততটুকুই আমি ইহাদের আলোচনা করিয়াছি। এই সমাজবিন্যাসের বস্তুগত ভিত্তি, সমাজের বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণী, সমাজে ও রাষ্ট্রে তাহদের স্থান, তাহাদের দায় ও অধিকার, বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর ও রাষ্ট্রের সম্বন্ধ, রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্বন্ধ, সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপ ও প্রকৃতি ইত্যাদি সমস্তই প্রাচীন বাঙলার সমাজবিন্যাসের, তথা জনসাধারণের ইতিহাসের আলোচনার বিষয়। এই সমাজবিন্যাসের ইতিহাস-রচনার কতকটা পরিচয় পাওয়া যায় জার্মান পণ্ডিত ফিক্‌ (Fick)- রচিত বুদ্ধদেবের সমসাময়িক উত্তর-পূর্ব ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’- গ্রন্থে (Die Sociale Gielderung in Nordostlichen zu Buddhas Zeit)। অবশ্য, জাতকের অসংখ্য গল্পে এবং প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে তদানীন্তন সমাজবিন্যাসের যে চিত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, প্রাচীন বাঙলার সামাজিক ইতিহাসের উপাদানে সে স্পষ্টতা বা সম্পূর্ণতা একেবারেই নাই। তবু, সমাজতাত্ত্বিক রীতিপদ্ধতি অনুযায়ী প্রাচীন বাঙলার ঐতিহাসিক উপাদান সযত্বে বিশ্লেষণ করিলে আজ মোটামুটি একটা কাঠামো গড়িয়া তোলা একেবারে অসম্ভব হয়তো নয়। বর্তমান গ্রন্থে তাহার চেয়ে বেশি কিছু করা হইতেছে না, বোধ হয় সম্ভবও নয়। বাঙলাদেশে ঐতিহাসিক উপাদান আবিষ্কারের চেষ্টা খুব ভালো করিয়া হয় নাই। এক পাহাড়পুর নানাদিক দিয়া প্রাচীন বাঙলার জনসাধারণের ইতিহাসে অভিনব আলোকপাত করিয়াছে; কিন্তু, তেমন উদ্যম অন্যত্র এখনও দেখা যাইতেছে না। বেশির ভাগ উপাদানের আবিষ্কার আকস্মিক এবং পরোক্ষ। তবু, ক্রমশ নূতন উপাদান সংগৃহীত হইতেছে, এবং আজ যাহা কাঠামো মাত্র, ক্রমশ আবিষ্কৃত উপাদানের সাহায্যে হয়তো এই কাঠামোকে একদিন রক্তে-মাংসে ভরিয়া সমগ্র একটা রূপ দেওয়া সম্ভব হইবে।

 

উপাদান সম্বন্ধে সাধারণ দুই-একটি কথা

সমাজবিন্যাসের অথবা বৃহত্তর অর্থে সামাজিক ইতিহাস রচনার একটা সুবিধাও আছে, রাষ্ট্রীয় ইতিহাস রচনায় যাহা নাই। রাষ্ট্রীয়, বিশেষভাবে রাজবংশের, ইতিহাসে সন-তারিখ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য। কোন রাজার পরে কোন রাজা, কে কাহার পুত্র অথবা দৌহিত্র, কোন যুদ্ধ কবে হইয়াছিল ইত্যাদির চুলচেরা বিচার অপরিহার্য। সন-তারিখ লইয়া সেইজন্য প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস আলোচনায় এত বিতর্ক। এই ইতিহাসে ঘটনার মূল্যই সকলের চেয়ে বেশি এবং সেই ঘটনার কালপরম্পরার উপরই ইতিহাসের নির্ভর। সামাজিক ইতিহাস-রচনায় এই জাতীয় ঘটনার মূল্য অপেক্ষাকৃত অনেক কম; সন-তারিখের মোটামুটি কাঠামোটা ঠিক হইলেই হইল, যদি না। কিছু রাষ্ট্রীয় অথবা সামাজিক বিপ্লব-উপপ্লব সমাজের চেহারাটাই ইতিমধ্যে একেবারে বদলাইয়া দেয়। তাহার কারণ সহজেই অনুমেয়। সামাজিক বর্ণবিভাগ, শ্রেণীবিভাগ, ধনোৎপাদন ও বণ্টন-প্রণালী, জাতীয় উপাদান, ভূমিব্যবস্থা, বাণিজ্যপথ ইত্যাদি, এক কথায় সমাজবিন্যাস রাজা বা রাজবংশের হঠাৎ পরিবর্তনে রাতারাতি কিছু বদলাইয়া যায় নাই; অন্তত প্রাচীন বাঙলায় বা ভারতবর্ষে তাহা হয় নাই। প্রাচীন পৃথিবীতে সর্বত্রই এইরূপ। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৃহৎ কিছু একটা বিপ্লব-উপপ্লব সংঘটিত হইলে সমাজবিন্যাসও হয়তো বদলাইয়া যায়; কিন্তু তাহাও একদিনে, দুই-দশ বৎসরে হয় না। বহুদিন ধরিয়া ধীরে ধীরে এই বিবর্তন চলিতে থাকে, সমাজপ্রকৃতির নিয়মে। অবশ্য, বর্তমান যুগে ভৌতিক বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে এই বিবর্তন অত্যন্ত দ্রুত সংঘটিত হইয়া থাকে। কিন্তু এই সব আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত তাহ ধীরে ধীরেই হইত। আর্যদের ভারতাগমন প্রাচীন কালের একটি বৃহৎ সামাজিক উপপ্লবের দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যাইতে পারে। অনার্য অথবা আর্যপূর্ব সমাজবিন্যাস ছিল একরকম, তারপর আর্যেরা যখন তাহদের নিজেদের সমাজবিন্যাস লইয়া আসিলেন, তখন দুই আদর্শে একটা প্রচণ্ড সংঘাত নিশ্চয়ই লাগিয়াছিল। সেই সংঘাত ভারতবর্ষে চলিয়ছিল হাজার বৎসর ধরিয়া, এবং ধীরে ধীরে তাহার ফলে যে নূতন ভারতীয় সমাজবিন্যাস গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহাই পরবর্তী হিন্দুসমাজ। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যখন লৌহধাতুর আবিষ্কার হইয়াছিল, তখনও এইরকমই একটা সামাজিক বিপ্লবের সূচনা হয়তো হইয়াছিল, কারণ এই আবিষ্কারের ফলে ধন-উৎপাদনের প্রণালী বদলাইয়া যাইবার কথা, এবং তাহার ফলে সমাজবিন্যাসও। কিন্তু এই পরিবর্তনও একদিনে হয় না। প্রাচীন বাঙলায় ঐতিহাসিক কালে— প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা আমি বলিব না, তাহার কারণ সে সম্বন্ধে স্পষ্ট করিয়া আমরা এখনও কিছুই জানি না— এমন কোনও সামাজিক উপপ্লব দেখা দেয় নাই। যুদ্ধবিগ্রহ যথেষ্ট হইয়াছে, ভিন্নদেশাগত রাজা ও রাজবংশ বহুদিন ধরিয়া বাঙলাদেশে রাজত্বও করিয়াছেন, মুষ্টিমেয় সৈন্য ও সাধারণ প্রাকৃতজন নানা বৃত্তি অবলম্বন করিয়া এদেশে নিজেদের রক্ত মিশাইয়া দিয়া বাঙালীর সঙ্গে এক হইয়াও গিয়াছেন, কিন্তু এইসব ঐতিহাসিক পরিবর্তন বিপ্লবের আকার ধারণ করিয়া সমাজের মূল ধরিয়া টানিয়া সমাজবিন্যাসের চেহারাটাকে একেবারে বদলাইয়া দিতে পারে নাই। অদল-বদল যে একেবারে হয় নাই তাহা নয়, কিন্তু যাহা হইয়াছে, তাহা খুব ধীরে ধীরে হইয়াছে, এখানে-সেখানে কোন কোন সমাজ-অঙ্গের রং ও রূপ একটু-আধটু বদলাইয়াছে, কোনও নুতন অঙ্গের যোজনা হইয়াছে, কিন্তু মোটামুটি কাঠামোটা একই থাকিয়া গিয়াছে। অদল-বদল যাহা হইয়াছে তাহা প্রাকৃতিক ও সমাজবিজ্ঞানের নিয়মের বশেই হইয়াছে। কাজেই, রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের অজ্ঞাত যুগ সামাজিক ইতিহাসের দিক হইতে একেবারে অজ্ঞাত নাও হইতে পারে। পূর্বের এবং পরের সমাজবিন্যাসের ইতিহাস যদি জানা থাকে তাহা হইলে মাঝখানের ফাকটা কল্পনা ও অনুমান দিয়া ভরাট করিয়া লওয়া যাইতে পারে, এবং তাহা ঐতিহাসিক সত্যের পরিপন্থী না হওয়াই স্বাভাবিক | প্রাচীন বাঙলার সমাজবিন্যাসের ইতিহাসেও একথা প্রযোজ্য।

কিন্তু সুবিধার কথা যদি বলিলাম, অসুবিধার কথাও বলি। আগেই বলিয়াছি জনসাধারণের ইতিহাস-রচনার যে সব উপাদান আমাদের আছে, তাহার অধিকাংশ রাজসভা বা ধর্মগোষ্ঠীর আশ্রয়ে রচিত। রাজসভা বা ধর্মগোষ্ঠী সম্বন্ধে যাহা জ্ঞাতব্য তাহার অনেকাংশ এইসব উপাদানের মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর যে অগণিত জনসাধারণ তাহদের বা তাহাদের আশ্রয়ে রচিত কোনও উপাদানই আমরা পাই না কেন? যে বণিক-সম্প্রদায় দেশে-বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাইতেন তাহারা মূখ বা নিরক্ষর ছিলেন না, এমন অনুমান সহজই করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের সমৃদ্ধি যতদিন ছিল ততদিন সমাজে তাহদের স্থান বেশ উপরেই ছিল, রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালনায় তাহদের প্রভুত্বও কম ছিল না; একথা অনুমান-সাপেক্ষ নয়, তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে; তথাপি তাহদের কথা বিশেষভাবে কেহ বলে নাই। শিল্পী ও ক্ষেত্রকর-সম্প্রদায় সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। আর, চণ্ডাল পর্যন্ত যে অকীর্তিত জনসাধারণ তাহদের কথা না-ই বলিলাম। ইহারা তো নিরক্ষরই ছিলেন; সমাজে ইঁহাদের আধিপত্য বা অধিকার বলিয়া কিছু ছিল, এমন প্রমাণও নাই। কাজেই, ইঁহাদের সম্বন্ধে যে বিশেষ কিছু জানি না তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। কিন্তু কি শিল্পী-মানপ-ব্যাপার-বণিক, কি ক্ষেত্রকর, কি নিম্নতম সম্প্রদায়, ইহার রাজসভা বা ধর্মগোষ্ঠী দ্বারা কীর্তিত কিংবা কীর্তনযোগ্য বিবেচিত না হইলেও, ইঁহাদের সকলের দৈনন্দিন সুখদুঃখের, জীবনসমস্যার, নিজের বৃত্তি-সম্পৃক্ত নানা প্রশ্নের, এবং সাফল্য-অসাফল্যের প্রকাশ ও পরিচয় তদানীন্তন বাঙালী সমাজের মধ্যে কোথাও না কোথাও ছিলই। হয়তো সকল শ্রেণীর প্রকাশ ও পরিচয় সমভাবে একত্র কোথাও হইত না; হয়তো বিশেষ শ্রেণীর জীবনধারার প্রকাশ ও পরিচয় শ্রেণীর জনসাধারণের মধ্যেই আবদ্ধ থাকিত। কিন্তু যেভাবেই তাহা হউক, তাহা কোথাও লিপিবদ্ধ হইয়া থাকে নাই; সভাকবি, রাজপণ্ডিত, অভিজাতসমাজপুষ্ট কবি ও লেখক, বা ধর্মগোষ্ঠীর নেতাদের কাছে এইসব প্রকাশ ও পরিচয় লিপিযোগ্য বা গ্রন্থনযোগ্য মর্যাদা লাভ করিতে পারে নাই। স্মৃতি-ব্যবহার-পুরাণ গ্রন্থাদিতে পরোক্ষভাবে কিছু কিছু সংবাদ লিপিবদ্ধ হইয়াছে মাত্র, ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চতর বর্ণসমাজের সঙ্গে ইঁহাদের সম্বন্ধ নির্ণয়ের প্রসঙ্গে। তাহা ছাড়া, রাজসভা ও ধর্মগোষ্ঠী উভয়েরই লেখ্য ভাষা ছিল সংস্কৃত; অথচ, এই দেবভাষা যে প্রাকৃতজনের ভাষা ছিল তাহা তো সর্বজনস্বীকৃত; বাঙলার লিপিমালায়ও তাহার প্রমাণ বিক্ষিপ্ত। প্রাচীন বাঙলার প্রাকৃতজনের এই ভাষার বিশেষ কিছু পরিচয় আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই। স্বৰ্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়-কর্তৃক আবিষ্কৃত এবং অধুনা সুপরিচিত চর্যাগীতিগুলির ভাষা হয়তো দশম-দ্বাদশ শতকের এই প্রাকৃত ভাষা, কিন্তু সন্ধ্যাভাষায় রচিত এই দোহা ও গানগুলিকে ঐতিহাসিক উপাদানরূপে পুরোপুরি গ্রহণ করা সর্বত্র সম্ভব নয়। ধর্মের ইতিহাসে অবশ্য এই পদগুলির বিশেষ মূল্য আছে। ডাক ও খনার বচনগুলিতেও কিছু কিছু ইতিহাসের উপাদান আছে। পণ্ডিতেরা স্বীকার করেন যে, এই বচনগুলিতে সমাজের যে পরিচয় টুকরা টুকরা ভাবে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাহা নিঃসংশয়ে খ্ৰীষ্টীয় দশম অথবা একাদশ শতকের, কিন্তু ঐতিহাসিকের বিপদ এই যে, এই বচনগুলি বর্তমানে আমরা যে রূপে পাই, যে ভাষায় বর্তমানে ইহারা আমাদের হাতে আসিয়াছে, সে রূপ ও সে ভাষা এত প্রাচীন নয়। কাজেই মুখে মুখে প্রচলিত বচনগুলি পরবর্তী কালে ক্রমশ যখন লিপিবদ্ধ হইয়াছে, তখন যে সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক যুগের সমাজের পরিচয় কিছু কিছু তাহার মধ্যে ঢুকিয়া পড়ে নাই তাহার নিশ্চয়তা কি? শূন্যপুরাণ’, ‘গোপীচাদের গীত’, ‘সেখ শুভোদয়া, আদ্যের গম্ভীরা’, ‘মুর্শিদ্যা গান’, প্রাচীন রূপকথা ইত্যাদি সম্বন্ধেও এই সন্দেহ প্রযোজ্য, যদিও ইঁহাদের বিষয়বস্তু প্রাচীনতর কাল সম্পর্কিত। মধ্যযুগের আরো দুই-চারটি বাঙলা বই সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। আসল কথা হইতেছে, জনসাধারণ প্রাকৃতজনসুলভ ভাব ও ভাষায় তাহাদের দৈনন্দিন জীবনের যে-সব সুখ-দুঃখ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ জীবন-সমস্যা ইত্যাদি প্রকাশ করিত গানে-গল্পে-বচনে-গাথায়-রূপকথায়, তাহ কেহ লিখিয়া রাখে নাই; লোকের মুখে মুখেই তাহা গীত ও প্রচারিত হইয়াছে এবং বহুদিন পরে তাহ হয়তো লিপিবদ্ধ হইয়াছে যখন প্রাকৃতজনের ভাষা লেখা-মর্যাদা লাভ করিয়াছে। কিন্তু মুশকিল হইতেছে, এইসব প্রমাণ স্বসম্পূর্ণ স্বয়ংসিদ্ধ প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করিবার উপায় নাই, যতক্ষণ পর্যন্ত সমসাময়িক প্রমাণদ্বারা তাহা সমর্থিত না হয়।

পূর্বেই বলিয়াছি প্রাচীন লিপিমালা এবং কিছু কিছু ধর্ম ও সাহিত্য গ্রন্থই বাঙালীর ইতিহাসের উপাদান এবং ইঁহাদের সাক্ষ্যই প্রামাণিক। এই লিপিগুলি সমস্তই সমসাময়িক; স্মৃতি, পুরাণ, ব্যবহার এবং কাব্য-গ্রন্থগুলিও প্রায় তাহাই। কোথাও কোথাও কিছু কিছু পরবর্তী অথবা পূর্ববর্তী প্রামাণিক লিপি ও গ্রন্থের সহায়তা আমি গ্রহণ করিয়াছি, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সমসাময়িক প্রামাণিক সাক্ষ্যদ্বারা তাহা সমর্থিত না হইয়াছে ততক্ষণ আমার বক্তব্যের পক্ষে অনুমানের অধিক মূল্য কখনও আমি দাবি করি নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি বাঙলাদেশের সাক্ষ্যপ্রমাণই গ্রহণ করিয়াছি, তবে মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও কোনো সাক্ষ্য বা উক্তি সুস্পষ্ট করিবার জন্য প্রতিবেশী কামরূপ অথবা বিহার অথবা ওড়িশার সাক্ষ্য-প্রমাণও উল্লেখ করিয়াছি। সেগুলি প্রমাণ বলিয়া স্বীকৃত না হইলেও একথা অনুমান করিতে বাধা নাই যে, বাঙলাদেশেও হয়তো অনুরূপ রীতি প্রচলিত ছিল।

বাঙলাদেশের লিপিগুলি কালানুযায়ী সাজাইলে খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক দ্বিতীয় শতক হইতে আরম্ভ করিয়া তুর্কী বিজয়েরও প্রায় শতবর্ষ কাল পর পর্যন্ত বিস্তৃত করা যায়। তবে খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতক হইতে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্তই ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়, এবং এই সাত-আট শত বৎসরের সামাজিক ইতিহাসের রূপই কতকটা স্পষ্ট হইয়া চোখের সম্মুখে ধরা দেয়। পঞ্চম শতকের আগে আমাদের জ্ঞান প্রায় অস্পষ্ট এবং অনেকটা অনুমানসিদ্ধ। লিপিগুলির সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যবহারের আর-একটু বিপদও আছে। খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শতকে উৎকীর্ণ দামোদরপুরে (পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি) প্রাপ্ত কোনও তাম্রপট্টে ভূমিব্যবস্থা অথবা রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্বন্ধে যে খবর পাওয়া যায় তাহা যে দশম অথবা একাদশ শতকে সমতলমণ্ডল অথবা খাড়িমণ্ডল, কিংবা পুণ্ডবর্ধনভূক্তির অন্য কোনও মণ্ডল বা বিষয় সম্বন্ধে সত্য হইবে, এমন মনে করিবার কোনও কারণ নাই। এমন-কি, সেই শতকেরই বাঙলার অন্য কোনও ভুক্তি অথবা বিষয় সম্বন্ধে সত্য হইবে, তাহাও বলা যায় না। কাজেই যে-কোনও লিপিবর্ণিত যে-কোনও অবস্থা সমগ্রভাবে বাঙলাদেশ সম্বন্ধে অথবা সমগ্র প্রাচীনকাল সম্বন্ধে প্রযোজ্য না-ও হইতে পারে। বস্তুত, দেখা যায়, একই সময়ে বাঙলার বিভিন্ন স্থানে একই বিষয়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা, রীতি ও পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এইজন্যই সাক্ষ্যপ্রমাণ উল্লেখ করিবার সময় ইচ্ছা করিয়াই আমি লিপিবর্ণিত স্থান ও কালের উল্লেখ সর্বত্রই করিয়াছি; এবং সেই স্থান ও কালেই বর্ণিত বিষয় প্রযোজ্য, এইরূপ ইঙ্গিত করিয়াছি। তারপর বিশেষ কোনও নিয়ম বা পদ্ধতি কতটুকু অন্য কাল ও অন্য স্থান সম্বন্ধে প্রযোজ্য, কী পরিমাণে সমগ্র বাঙলাদেশ সম্বন্ধে প্রযোজ্য তাহা লইয়া পাঠক অনুমান যদি করিতে চান তাহাতে ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কিছু নাই।