শান্তিপর্ব

শান্তিপর্ব

মহাভারতের কাহিনি শেষ হল ‘স্ত্রীপর্ব’-এ। যেখানে ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জোড়া লাগাতে বসেছিল শত পুত্রবধূ। এই রকম এক ব্যাপক বিনষ্টির চিত্র এ মহাকাব্যের যথার্থ উপসংহার। পরবর্তী বৃহত্তম পর্ব— শান্তিপর্বের শুরুতে দেখি, শরশয্যায় শয়ান পিতামহ ভীষ্ম এবং পাণ্ডবপক্ষের জ্ঞানপিপাসু মহারথীরা তাঁর কাছে নানা প্রশ্ন নিয়ে আসছেন। এ ছাড়াও এ পর্বে অন্যান্য মুনিঋষিরা এমনকী পশুপক্ষীরাও প্রশ্ন করেছেন বা উত্তর দিচ্ছেন।

বিষয়ও বহু ও বিচিত্র। রাজধর্ম, যেটা সেদিনকার নতুন রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে নিতান্ত প্রাসঙ্গিক সেটা নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা আছে। এই দীর্ঘতম পর্বটিতে আরও নানা বিষয়ের মধ্যে ব্যক্তিগত নৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি নানা বিষয়ের আলোচনা সংলাপ আকারে পাওয়া যায়। এতে বহু পরস্পর-বিরুদ্ধ উক্তিও আছে। তার কারণ বক্তা, প্রসঙ্গ ও প্রশ্নোত্তরও ভিন্ন।

মহাভারতের যুদ্ধ শেষে মহাকাব্যটির ঘটনাগত একটি সমাপ্তি ঘটার পর এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়, গভীর, গম্ভীর ও চিন্তার উপাদানে পূর্ণ একটি রত্নকোষ হয়ে ওঠে। এই সময়ে ভৃগুবংশীয় কিছু মুনিঋষি এতে যে সব প্রক্ষেপ তাঁদের কাছে বিশেষ প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল, তাই প্রক্ষিপ্ত ভাবে এর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করে দেন। ভার্গব প্রক্ষেপের পরিমাণ খুব বেশি; এর প্রয়োজন নিয়ে পরে বলছি। এই প্রক্ষেপ যেহেতু বহু বিষয় অবলম্বন করে ও বহু বিস্তৃত অংশ জুড়ে, তাই এর গুরুত্বও খুব বেশি, যেটা প্রথমে একটা ধাক্কা দিয়ে আমাদের এর গুরুত্ব ও গভীরত্ব সম্বন্ধে অবহিত করে। প্রথমেই সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন: যে যুদ্ধে অস্ত্র, বন্ধু বা সহায় কোনও সাহায্য করতে পারে না, যেখানে নিজেকেই যুদ্ধটা জিততে হয় একক চেষ্টায়; মহারাজ, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অবসানে আজ আপনার সামনে সেই যুদ্ধ উপস্থিত। এখানে আপনার অন্তরাত্মার সঙ্গে আপনার বিবেকের একক সংগ্রাম। আজ সেই যুদ্ধ আপনার সামনে সমুপস্থিত, এই যুদ্ধ করে জয়লাভ করুন।

পণ্ডিতেরা বলেন, মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক। দীর্ঘ সাত-আট শতাব্দী ধরে, সমাজের যা অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি ও লব্ধ জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছে। প্রথম প্রয়োজন হস্তিনাপুরের সিংহাসনে সমূলে উৎপাটিত কুরুবংশের পরিবর্তে পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠির রাজা হবেন। তিনি রাজধর্মে অদীক্ষিত, কাজেই রাজত্ব শুরু করার পূর্বে তাঁকে রাজা হিসোেব তাঁর ইতিকর্তব্য বুঝে নিতে হবে।

এ বার কতকটা নতুন রাজত্ব আরম্ভ হবে, এ ধারার প্রথম রাজা যুধিষ্ঠির মানুষ হিসেবে তিনি বহুকাল ধরেই সম্মানিত। এ বার রাজা হিসেবে তাঁকে সম্মানের আসন জয় করতে হবে। তাই বলা হল: ধর্মে তিষ্ঠন্তি ভূতানি ধর্মো রাজনি তিষ্ঠতি। (৯১:৫) এই সময়ে, বিশেষত কুষাণ রাজবংশের সময় থেকে রাজার আসন দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হতে লাগল। প্রজারা রাজতন্ত্রে বাস করত, তাই বলা হচ্ছে, রাজার মধ্যেই ধর্ম বাস করে অর্থাৎ রাজা ধর্মের প্রতীক। এর সঙ্গেই রাজাকে ধর্মস্বরূপ বলা শেষ করে বলেছেন, রাজা কালের কারণ। রাজা তাঁর রাজত্বের প্রকৃতি পরিবর্তন করে স্বয়ং কালস্বরূপ হয়ে উঠলেন: কালো বা কারণং রাজ্ঞো রাজা বা কালকারণম্। (৭০:৬) ভার্গব প্রক্ষেপে রাজাকে রাজ্যের মুখ্য শক্তি বলে ঘোষণা করার একটি উপায় হল, রাজাকে ধর্মস্বরূপ বলা। এরই সঙ্গে বলা আছে, ধর্মের প্রধান লক্ষণ। ধর্ম হল মানুষের অন্তরের বস্তু, বাইরে তা বোঝা যাবে কী দিয়ে? উত্তরে বলা হয়, ‘আচারমেব মন্যন্তে গরীয়ো ধর্মলক্ষণম্’। (১৩৫:১৪) আচারই সবচেয়ে বড় ধর্মের লক্ষণ। ‘যে ধার্মিক তার ধর্মসংগত আচারই প্রমাণ করে তার ধার্মিকতা; বাইরে থেকে তার ধর্মপ্রাণতা বুঝায় কিসে? তার ধর্মসম্মত আচার দেখে। এই সময়ের থেকে শুরু করে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে আচারের নানা জটিল প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত, অন্য জাতিগোষ্ঠীর থেকে গৃহীত হতে থাকল। ধর্মসূত্র থেকে নানা পুরাণ ও সন্দর্ভে এক জটিলতা ক্রমেই বেড়ে এক আচার-নিবন্ধ সমাজের সৃষ্টি হতে থাকল। দেশে কালে অঞ্চলে যুগে যুগে এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। বেদের ধর্মসূত্রে একটা যুগ শেষ হল, বিদেশি আগন্তুকদের আচার এই আচারনিষ্ঠাকে বহুগণিত করে তুলেছে, তুলে চলেছে। ব্রাহ্মণধর্মের পরবর্তী যে হিন্দুধর্ম ধীরে ধীরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হল, তা অনেকাংশেই আচারসর্বস্ব: এই যুগেই তার সূত্রপাত। এ ছাড়া বহু বিদেশি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব দেবতা ও ধর্মাচরণ নিয়ে এসে এর জটিলতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে। অন্য একটা বৈদিক ব্রাহ্মণ্য নয়, পরবর্তী কালে যা হিন্দুধর্ম বলে চিহ্নিত হল, তাকেই সমবেত প্রচেষ্টায় নির্মাণ করল যা আজও শাখায়-প্রশাখায় সমৃদ্ধ হয়ে অগণ্য ছোট বড় সংযোজনের দ্বারা ক্রমে ক্রমে আজকের এই হিন্দুসমাজ সৃষ্টি করেছে।

বহু ঘটনা, অনাশাঙ্কিত পরিস্থিতি ও জটিল পরিস্থিতিতে কী কর্তব্য তা বুঝিয়ে দিলেন পিতামহ ভীষ্ম। শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম। যিনি নিজে একদিনও রাজত্ব করেননি কিন্তু প্রজ্ঞাবলে যিনি সমস্ত কিছু অনুমান করে সমাধান করেন। প্রকাণ্ড জনক্ষয়ী যুদ্ধের পরে চিন্তাক্লিষ্ট বিষণ্ণ যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্ম বলেন, ন জনপদিকং দুঃখমেকঃ শোচিতুমহর্ষি: সমস্ত জনপদের যে দুঃখ একলা তা বহন করতে পারো না। ভীষ্ম আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শোকের স্থান সহস্র, আনন্দের স্থান শত শত, এ সবে মূঢ় মানুষই আবিষ্ট হয়, পণ্ডিতেরা হন না। ভীষ্ম আরও বলেন, সুখই হোক দুঃখই হোক এ সব অনুভূতিতে হৃদয় যেন বিচলিত না হয়। যেন এ সবে তা অপরাজিত থাকে।

দীর্ঘ আলোচনা প্রকৃতপক্ষে ভীষ্মের কথিত বিবরণ এবং তার নির্যাস, যে সব তত্ত্ব তা দিয়ে বহু অংশ রচিত। আঠারোখানি গীতা মহাভারতে আছে। এগুলির মধ্যে শ্রীমদ্ভগবদগীতার মতো কোনওটিই নয়— না বিষয়ে না আঙ্গিকে। এ সব গীতা বৈশিষ্ট্য বর্জিত। মানুষের জীবনের নানা ধরনের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, প্রশ্ন, তার সমাধান শান্তিপর্বের একটি বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে। যেমন নারীকে অগ্নি, বিষ, সর্পের মতো (প্রাণঘাতিনী) বলা হয়েছে, আবার নারী, বিশেষত ভার্যার মাধুর্য, কোমলতা, আনুগত্য ইত্যাদি গুণে অনন্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ বহু মানুষের অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য এখানে আছে। ভাবতে কৌতুক বোধ করি, যখন মনে পড়ে, নারীর দাম্পত্যজীন সম্বন্ধে ফতোয়া দেবার সুরে যে-ভীষ্ম কথা বলছেন, তিনি ছিলেন চিরকুমার। ভাগ্যের সঙ্গে পুরুষকারের দ্বন্দ্ব দু’দিক থেকেই বলা হয়েছে— কখনও দেবকে প্রাধান্য দিয়ে কখনও বা দৈবকে।

অর্থাৎ ভীষ্মের স্বরে ওই আটশো বছরের উত্তর ভারতের কোটি কোটি মানুষের অভিজ্ঞতা বলা হয়েছে, এর মধ্যে পরস্পরবিরোধী কথা থাকারই কথা। কোনও বিষয়ে উচ্ছ্বসিত উক্তি করে, আবার অন্যত্র ঠিক তার বিরুদ্ধ কথা বলা হয়েছে; দুটোই সমান গুরুত্ব ও দৃঢ়তার সঙ্গে। এর একটা কারণ, বিভিন্ন দলের অভিজ্ঞতায় এই দৃঢ় উপলব্ধি ঘটেছে এবং সেটা তারা দৃঢ়তার সঙ্গেই ব্যক্ত করেছে। ‘পরের মর্ম না বুঝে, দারুণ (=ক্রূর) কর্ম না করে, জেলেদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা না করে (কেউ) পরম ঐশ্বর্য লাভ করতে পারে না।’ আর দয়া, মৈত্রী, করুণারও গুণগান করা আছে অন্যত্র। এগুলিকে পরস্পরবিরুদ্ধ উক্তি বলে বিচার করা ঠিক হবে না, কারণ, বিভিন্ন কালে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা বলে স্বতন্ত্র, সমানমূল্যের গৌরব দিয়ে দেখাই বোধহয় সমীচীন হবে।

বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান এগুলি সর্বদাই খুব সম্মানিত ছিল সমাজে এবং এগুলির চর্চাও ছিল সম্মানের। নিয়তির সার্বভৌমত্ব স্বীকার করলে স্বাভাবিক নিয়মে কাল যা করে, তাকে অস্বীকার করা হয়, তাই একটি শ্লোকে পড়ি: যদি কালের প্রভাব কিছু সিদ্ধ হয়, তা হলে ঔষধের কী প্রয়োজন? (যদি কালেন পচ্যন্তে ভেষজৈঃ কিং প্রয়োজনম্। (১৮৫:১৯) ধীরে ধীরে নিয়তিবাদের বিকাশ হচ্ছে। মানুষের চেষ্টা সব সময়ে সফল হয় না, তখন বিশ্বাস চলে যায় নিয়তির ওপরে, এর সূত্রপাত মহাকাব্য দু’টিতে, বিশেষত মহাভারতে, পরিণতি পুরাণগুলিতে)।

বহু আখ্যানের মধ্যে জীবনে চলবার পাথেয় নানা ভাবে বর্ণিত হয়েছে, কখনও তা ইতিবাচক, কখনও বা নেতিবাচক। অর্থাৎ কখনও পুরুষকারকে প্রকৃষ্ট বলা হয়েছে, কখনও বা নিয়তিকে— যেমন মানুষ তার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখে। তাই পরস্পরবিরুদ্ধ উক্তির এত ছড়াছড়ি। অতএব দীর্ঘকালের বিস্তৃত এক অঞ্চলের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সমাহার এই শান্তিপর্বে। ভীষ্মই বলুন বা অন্য কোনও ঋষিই বলুন, কোনও জীবজন্তুই বলুন বা দেবতা বা উপদেবতাই বলুন— কোনও একটি নির্দিষ্ট তথ্য বা তত্ত্ব প্রকাশিত হয়নি এখানে, বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার বিবরণ আছে, যার মধ্যে নানা প্রকৃতির মানুষ তাদের উপলব্ধির প্রকাশ দেখতে পেরেছে।

শান্তিপর্বের একটি বৈশিষ্ট্য এই বৈচিত্র্যে। পড়তে পড়তে কোনও ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব বা লক্ষ্যে এসে মানুষ পৌঁছয় না, বরং বুঝতে পারে, এত বড় পৃথিবীর এত বৈচিত্র্য, ইতিহাসে নানা জটিল ও সরল অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে এর সৃষ্টি। শান্তিপর্বে শান্তির কথা নেই, যুদ্ধের কথাও নেই, আছে মানুষের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন পরিবেশ, বহুবিধ সমস্যা ও তার বিচিত্র সমাধান। সব, কোনও একটি তত্ত্ব বা সিদ্ধান্তে পৌঁছয়নি, যদিও সংলাপে আখ্যানে বিবরণে এটি এমন এক গ্রন্থ (এই শান্তিপর্ব) যা নিতান্তই বিরল। খণ্ডগুলির মধ্যে বিস্ময় আছে, নীতির চমক আছে, কিন্তু সমস্তটা মিলে কোনও সংহতি নেই যা অন্য সতেরোটি অধ্যায়ে আছে।

তথাপি একটি শ্লোকে শান্তিপর্ব কালজয়ী অমরত্ব অর্জন করে, যা সমস্ত ভারতবাসীর গর্বের বস্তু। জিজ্ঞাসু যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্ম একবার বললেন, ‘একটা গুহ্য ব্রহ্ম যা তোমাকে বলছি (যুধিষ্ঠির): মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ জগতে আর কিছুই নেই।’’গুহ্যং ব্রহ্ম যদিদং তে ব্রবীমি। ন মানুষাৎশ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ।’ এ বাণী উচ্চারিত হল ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের ধ্যানধারণাকে একটা প্রকাণ্ড ধাক্কা দিয়ে। সেদিনের ভারতবর্ষে, বহু প্রাচীন, সমকালীন ও ভবিষ্যতের অনাগত অসংখ্য দেবতার আরাধনার দেশে, এর কিছু-বা ছিল বৈদিক যুগের উত্তরাধিকার, অন্য বহুদেবতা এখানকার আদিম অধিবাসীর দ্বারা দীর্ঘকাল ধরে পূজিত, আরও বহু-দেবতা বন্যাবেগে আশপাশের বহু দেশ থেকে ধাপে ধাপে এখানে এসে পৌঁছনো দেবতা। মহাভারত যখন রচিত হচ্ছে তখনই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কালী, সরস্বতী, দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, ইত্যাদি অসংখ্য দেবতা বহু নামে এখানে নানা স্থানে পূজিত হচ্ছেন। এর মধ্যে সূচিত হচ্ছে পুরাণের বহুসংখ্যক দেবতা ও উপদেবতার।

এই পরিবেশের মধ্যে এত অসংখ্য দেবতার ভিড়কে দু’-হাতে পাশে ঠেলে ভীষ্ম বললেন, ‘গুহ্যং ব্রহ্ম যদিদং তে ব্রবীমি। ন মানুষাৎশ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ।’ অর্থাৎ গোপন যে কথাটি তোমাকে বলছি (যুধিষ্ঠির) তা হল, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ নেই, কিছু নেই। বহু যুগ পরেও ভারত এ কথা নানা কণ্ঠে নানা পরিবেশে উচ্চারণ করেছে, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই, অথবা ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর।’ কবি চণ্ডীদাসের কণ্ঠেও শুনি, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ ভীষ্ম ও চণ্ডীদাস এবং অন্য বহু সাধকের উপলব্ধির মধ্যে যে কথাটি মর্মভেদী কঠোর সত্যের অনুরণন আনে তা হল: ‘তাহার উপরে নাই। মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব— দেবে-দানবে এই মানুষই পরাৎপর শীর্ষবিন্দু। এ কথা এমন করে আর কেউ কোথাও বলেছে কি না জানি না (হয়তো ইসলামে এর প্রতিধ্বনি আছে) কিন্তু ভারতবর্ষে এর উচ্চারণ আসমুদ্রহিমাচলকে শিহরিত করে রেখেছে। এমনই আরও কত শ্লোকে বা শ্লোকার্ধে বলা হয়েছে, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। এর তত্ত্বটির সরলার্থ হল, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও আরও অগণ্য দেবদেবীর দ্বারা অনুরণিত আকাশ-বাতাস হঠাৎ যেন দেবলোক গন্ধর্ব/অসুর, কি নরলোকে মিলিয়ে গিয়ে ধর্মীয় আবহাওয়াটা অনেক স্বচ্ছ হয়ে উঠল। মাথা উঁচু করে দাঁড়াল মানুষ। কোন সে মানুষ? যে নিজের স্বার্থকে গৌণ করে আশপাশের সাধারণ মানুষের স্বার্থকে বড় করে দেখে, প্রয়োজন হলে নিজেকে বলিদান দিয়েও সব মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে।

ভীষ্মের ভাষায় মানুষ দেবতার ওপরে স্থান পেল, তার গৌরবসমুজ্জ্বল মনুষ্যত্ব দিয়ে। এই উচ্চারণ অনুরণিত হচ্ছে আকাশে-বাতাসে, এত সাহসী বাণী, ও এত সত্য বাণী আর কে কবে উচ্চারণ করেছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শান্তিপর্ব

শান্তিপর্ব

শান্তিপর্ব

মহাভারতের কাহিনি শেষ হল ‘স্ত্রীপর্ব’-এ। যেখানে ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জোড়া লাগাতে বসেছিল শত পুত্রবধূ। এইরকম এক ব্যাপক বিনষ্টির চিত্র এ মহাকাব্যের যথার্থ উপসংহার। পরবর্তী বৃহত্তম পর্ব শান্তিপর্বের শুরুতে দেখি শরশয্যায় শয়ান পিতামহ ভীষ্ম। এবং পাণ্ডবপক্ষের জ্ঞানপিপাসু মহারথীরা তাঁর কাছে নানা প্রশ্ন নিয়ে আসছেন। এ ছাড়াও এ পর্বে অন্যান্য মুনিঋষিরা এমনকী পশুপক্ষীরাও প্রশ্ন করেছেন বা উত্তর দিচ্ছেন।

বিষয়ও বহু ও বিচিত্র। রাজধর্ম, যেটা সেদিনকার নতুন রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে নিতান্ত প্রাসঙ্গিক সেটা নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা আছে। এই দীর্ঘতম পর্বটিতে আরো নানা বিষয়ের মধ্যে ব্যক্তিগত নৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি নানা বিষয়ের আলোচনা সংলাপ আকারে পাওয়া যায়। এতে বহু পরস্পর-বিরুদ্ধ উক্তিও আছে। তার কারণ বক্তা, প্রসঙ্গ ও প্রশ্নোত্তরও ভিন্ন।

মহাভারতের যুদ্ধ শেষে মহাকাব্যটির ঘটনাগত একটি সমাপ্তি ঘটার পর এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়, গভীর, গম্ভীর ও চিন্তার উপাদানে পূর্ণ একটি রত্নকোষ হয়ে ওঠে। এইসময়ে ভৃগুবংশীয় কিছু মুনিঋষি এতে যেসব প্রক্ষেপ তাঁদের কাছে বিশেষ প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল তাই প্রক্ষিপ্তভাবে এর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করে দেন। ভার্গব প্রক্ষেপের পরিমাণ খুব বেশি; এর প্রয়োজন। নিয়ে পরে বলছি। এই প্রক্ষেপ যেহেতু বহু বিষয়ে অবলম্বন করে ও বহু বিস্তৃত অংশ জুড়ে তাই এর গুরুত্বও খুব বেশি, যেটা প্রথমে একটা ধাক্কা দিয়ে আমাদের এর গুরুত্ব ও গভীরত্ব সম্বন্ধে অবহিত করে। প্রথমেই সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন: যে যুদ্ধে অস্ত্র, বন্ধু বা সহায় কোনো সাহায্য। করতে পারে না, যেখানে নিজেকেই যুদ্ধটা জিততে হয় একক চেষ্টায়; মহারাজ, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অবসানে আজ আপনার সামনে সেই যুদ্ধ উপস্থিত। এখানে আপনার অন্তরাত্মার সঙ্গে আপনার বিবেকের একক সংগ্রাম। আজ সেই যুদ্ধ আপনার সামনে সমুপস্থিত, এই যুদ্ধ করে জয়লাভ করুন।

পণ্ডিতেরা বলেন মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক। দীর্ঘ সাত আট শতাব্দী ধরে, সমাজের যা অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি ও লব্ধ জ্ঞান সঞ্চিত হয়েছে। প্রথম প্রয়োজন হস্তিনাপুরের সিংহাসনে সমূলে উৎপাটিত কুরুবংশের পরিবর্তে পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠির রাজা হবেন। তিনি রাজধর্মে অদীক্ষিত, কাজেই রাজত্ব শুরু করার পূর্বে তাঁকে রাজা হিসাবে তাঁর ইতিকর্তব্য বুঝে নিতে হবে।

এবার কতকটা নতুন রাজত্ব আরম্ভ হবে, এ ধারার প্রথম রাজা যুধিষ্ঠির মানুষ হিসেবে তিনি বহুকাল ধরেই সম্মানিত। এবার রাজা হিসেবে তাঁকে সম্মানের আসন জয় করতে হবে। তাই বলা হল: ধর্মে তিষ্ঠন্তি ভূতানি ধর্মো রাজনি তিষ্ঠতি (৯১৫)। এই সময়ে, বিশেষত কুষাণ রাজবংশের সময় থেকে রাজার আসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হতে লাগল। প্রজারা রাজতন্ত্রে বাস করত তাই বলা হচ্ছে রাজার মধ্যেই ধর্ম বাস করে অর্থাৎ রাজা ধর্মের প্রতীক। এর সঙ্গেই রাজাকে ধর্মস্বরূপ বলা শেষ করে বলেছেন রাজা কালের কারণ। রাজা তাঁর রাজত্বের প্রকৃতি পরিবর্তন করে স্বয়ং কালস্বরূপ হয়ে উঠলেন: কালো বা কারণং রাজ্ঞো রাজা বা কালকারণম (৭০। ৬)। ভার্গব প্রক্ষেপে রাজাকে রাজ্যের মুখ্য শক্তি বলে ঘোষণা করার একটি উপায় হল রাজাকে ধর্মস্বরূপ বলা। এরই সঙ্গে বলা আছে ধর্মের প্রধান লক্ষণ। ধর্ম হল মানুষের অন্তরের বস্তু, বাইরে তা বোঝা যাবে কী দিয়ে? উত্তরে বলা হয় ‘আচারমেব মন্যন্তে গরীয়ো ধৰ্মলক্ষণম’ (১৩৫। ১৪)। আচারই সবচেয়ে বড়ো ধর্মের লক্ষণ। ’যে ধার্মিক তার ধর্মসংগত আচারই প্রমাণ করে তার ধার্মিকতা; বাইরে থেকে তার ধর্মপ্রাণতা বুঝায় কিসে? তার ধর্মসম্মত আচার দেখে। এই সময়ের থেকে শুরু করে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে আচারের নানা জটিল প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত, অন্য জাতিগোষ্ঠীর থেকে গৃহীত হতে থাকল। ধর্মসূত্র থেকে নানা পুরাণ ও সন্দর্ভে এক জটিলতা ক্রমেই বেড়ে এক আচার নিবন্ধ সমাজের সৃষ্টি হতে থাকল। দেশে কালে অঞ্চলে যুগেযুগে এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। বেদের ধর্মসূত্রে একটা যুগ শেষ হল, বিদেশি আগন্তুকদের আচার এই আচারনিষ্ঠাকে বহুগুণিত করে তুলেছে, তুলে চলেছে। ব্রাহ্মণধর্মের পরবর্তী যে হিন্দু-ধর্ম ধীরে ধীরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হল তা অনেকাংশেই আচার সর্বস্ব: এই যুগেই তার সূত্রপাত। এ ছাড়া বহু বিদেশি গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব দেবতা ও ধর্মাচরণ নিয়ে এসে এর জটিলতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে অন্য একটা বৈদিক ব্রাহ্মণ্য নয়, পরবর্তী কালে যা হিন্দুধর্ম বলে চিহ্নিত হল তাকেই সমবেত প্রচেষ্টায় নির্মাণ করল, এবং বংশ, গোষ্ঠী ও তাদের শাখাপ্রশাখায় মিলে একটি বহুশাখ সমাজতরু নির্মাণ করল যা আজও শাখায় প্রশাখায় সমৃদ্ধ হয়ে অগণ্য ছোটো বড়ো সংযোজনের দ্বারা ক্রমে ক্রমে আজকের এই হিন্দুসমাজ সৃষ্টি করেছে।

বহু ঘটনা, অনাশঙ্কিত পরিস্থিতি ও জটিল পরিস্থিতিতে কী কর্তব্য তা বুঝিয়ে দিলেন পিতামহ ভীষ্ম। শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম। যিনি নিজে একদিনও রাজত্ব করেননি কিন্তু প্রজ্ঞাবলে যিনি সমস্ত কিছু অনুমান করে সমাধান করেন। প্রকাণ্ড জনক্ষয়ী যুদ্ধের পরে চিন্তাক্লিষ্ট বিষণ্ণ যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্ম বলেন, ন জনপদিকং দুঃখমেকঃ শোচিতুমহর্ষি: সমস্ত জনপদের যে দুঃখ একলা তা বহন করতে পারো না। ভীষ্ম আরো মনে করিয়ে দিচ্ছেন শোকের স্থান সম্র, আনন্দের স্থান শতশত এসবে মূঢ় মানুষই আবিষ্ট হয়, পণ্ডিতেরা হন না। ভীষ্ম আরো বলেন সুখই হোক দুঃখই হোক এসব অনুভূতিতে হৃদয় যেন বিচলিত না হয়। যেন এসবে তা অপরাজিত থাকে।

দীর্ঘ আলোচনার প্রকৃতপক্ষে ভীষ্মের কথিত বিবরণ এবং তার নির্যাস, যে সব তত্ব তা দিয়ে বহু অংশ রচিত। আঠারোখানি গীতা মহাভারতে আছে। এগুলির মধ্যে শ্রীমদভগবদগীতার মতো কোনোটিই না— না বিষয়ে না আঙ্গিকে। এসব গীতা বৈশিষ্ট্য বর্জিত। মানুষের জীবনের নানা ধরনের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, প্রশ্ন, তার সমাধান শান্তিপর্বের একটি বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে। যেমন নারীকে অগ্নি, বিষ, সর্পের মতো (প্রাণঘাতিনী) বলা হয়েছে, আবার নারী, বিশেষত ভার্যার মাধুর্য, কোমলতা, আনুগত্য ইত্যাদি গুণে অনন্যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ বহু মানুষের অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য এখানে আছে। ভাবতে কৌতুক বোধ করি যখন মনে পড়ে নারীর দাম্পত্যজীবন সম্বন্ধে ফতোয়া দেবার সুরে যে-ভীষ্ম কথা বলছেন তিনি ছিলেন চিরকুমার। ভাগ্যের সঙ্গে পুরুষকারের দ্বন্দ্ব দুদিক থেকেই বলা হয়েছে—কখনো দেবকে প্রাধান্য দিয়ে কখনো বা দৈবকে।

অর্থাৎ ভীষ্মের স্বরে ওই আটশো বছরের উত্তর ভারতের কোটি কোটি মানুষের অভিজ্ঞতা বলা হয়েছে, এর মধ্যে পরস্পরবিরোধী কথা থাকারই কথা। কোনো বিষয়ে উচ্ছ্বসিত উক্তি করে, আবার অন্যত্র ঠিক তার বিরুদ্ধ কথা বলা হয়েছে; দুটোই সমান গুরুত্ব ও দৃঢ়তার সঙ্গে। এর একটা কারণ বিভিন্ন দলের অভিজ্ঞতায় এই দৃঢ় উপলব্ধি ঘটেছে এবং সেটা তারা দৃঢ়তার সঙ্গেই। ব্যক্ত করেছে। ’পরের মর্ম না বুঝে, দারুণ (=কুর) কর্ম না করে, জেলেদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা না করে কেউ) পরম ঐশ্বর্য লাভ করতে পারে না।’ আর দয়া মৈত্রী, করুণারও গুণগান করা আছে। অন্যত্র। এগুলিকে পরস্পর বিরুদ্ধ উক্তি বলে বিচার করা ঠিক হবে না, কারণ বিভিন্ন কালে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা বলে স্বতন্ত্র, সমানমূল্যের গৌরব দিয়ে দেখাই বোধহয় সমীচীন। হবে।

বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান এগুলি সর্বদাই খুব সম্মানিত ছিল সমাজে এবং এগুলির চর্চাও ছিল সম্মানের। নিয়তির সার্বভৌমত্ব স্বীকার করলে স্বাভাবিক নিয়মে কাল যা করে তাকে অস্বীকার করা হয় তাই একটি শ্লোকে পড়ি: যদি কালের প্রভাব কিছু সিদ্ধ হয় তা হলে ঔষধের কী প্রয়োজন? (যদি কালেন পচ্যন্তে ভেষজৈঃ কিং প্রয়োজনম (১৮৫১৯)। ধীরে ধীরে নিয়তিবাদের বিকাশ হচ্ছে। মানুষের চেষ্টা সব সময়ে সফল হয় না, তখন বিশ্বাস চলে যায় নিয়তির ওপরে, এর সূত্রপাত মহাকাব্য দুটিতে, বিশেষত মহাভারতে, পরিণতি পুরাণগুলিতে)।

বহু আখ্যানের মধ্যে জীবনে চলবার পাথেয় নানাভাবে বর্ণিত হয়েছে কখনো তা ইতিবাচক কখনো বা নেতিবাচক। অর্থাৎ কখনো পুরুষকারকে প্রকৃষ্ট বলা হয়েছে কখনো বা নিয়তিকে— যেমন মানুষ তার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখে। তাই পরস্পর-বিরুদ্ধ উক্তির এত ছড়াছড়ি। অতএব দীর্ঘকালের বিস্তৃত এক অঞ্চলের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সমাহার এই শান্তিপর্বে। ভীষ্মই বলুন বা অন্য কোনো ঋষিই বলুন, কোনো জীবজন্তুই বলুক বা দেবতা বা উপদেবতাই বলুন— কোনো একটি নির্দিষ্ট তথ্য বা তত্ব প্রকাশিত হয়নি এখানে, বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার বিবরণ আছে, যার মধ্যে নানা বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষ তাদের উপলব্ধির প্রকাশ দেখতে পেরেছে।

শান্তিপর্বের একটি বৈশিষ্ট্য এই বৈচিত্র্যে। পড়তে পড়তে কোনো ঐক্যবদ্ধ তত্ব বা লক্ষ্যে এসে মানুষ পৌছোয় না, বরং বুঝতে পারে, এত বড়ো পৃথিবীর এত বৈচিত্র ইতিহাসে নানা জটিল ও সরল অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে এর সৃষ্টি। শান্তিপর্বে শান্তির কথা নেই, যুদ্ধের কথাও নেই, আছে মানুষের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন পরিবেশ, বহুবিধ সমস্যা ও তার বিচিত্র সমাধান। সব, কোনো একটি তত্ব বা সিদ্ধান্তে পৌঁছোয়নি, যদিও সংলাপে, আখ্যানে বিবরণে এটি এমন এক গ্রন্থ (এই শান্তিপর্ব) যা নিতান্তই বিরল। খণ্ডগুলির মধ্যে বিস্ময় আছে, নীতির চমক আছে, কিন্তু সমস্তটা মিলে কোনো সংহতি নেই যা অন্য সতেরোটি অধ্যায়ে আছে।

তথাপি একটি শ্লোকে শান্তিপর্ব কালজয়ী অমরত্ব অর্জন করে, যা সমস্ত ভারতবাসীর গর্বের বস্তু। জিজ্ঞাসু যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্ম একবার বললেন, ‘একটা গুহ্য ব্রহ্ম যা তোমাকে বলছি (যুধিষ্ঠির): মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ জগতে আর কিছুই নেই।’ “গুহ্যং ব্রহ্ম যদিদং তে ব্রবীমি। ন মানুষৎশ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ। ” এ বাণী উচ্চারিত হল ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের ধ্যানধারণাকে একটা প্রকাণ্ড ধাক্কা দিয়ে। সেদিনের ভারতবর্ষে, বহু প্রাচীন, সমকালীন ও ভবিষ্যতের অনাগত অসংখ্য দেবতার আরাধনার দেশে, এর কিছু-বা ছিল বৈদিক যুগের উত্তরাধিকার, অন্য বহু দেবতা এখানকার আদিম অধিবাসীর দ্বারা দীর্ঘকাল ধরে পুজিত, আরো বহু-দেবতা বন্যাবেগে আশপাশের বহু দেশ থেকে ধাপে ধাপে এখানে এসে পৌঁছানো দেবতা। মহাভারত যখন রচিত হচ্ছে তখনই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কালী, সরস্বতী দূর্গা, কার্তিক গণেশ, লক্ষ্মী, ইত্যাদি অসংখ্য দেবতা বহু নামে এখানে নানাস্থানে পূজিত হচ্ছেন। এর মধ্যে সূচিত হচ্ছে পুরাণের বহুসংখ্যক দেবতা ও উপদেবতার।

এই পরিবেশের মধ্যে এত অসংখ্য দেবতার ভিড়কে দু-হাতে পাশে ঠেলে ভীষ্ম বললেন: “গুহ্যং ব্রহ্ম যদিদং তে ব্রবীমি। ন মানুষৎশ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ। ” অর্থাৎ ভীষ্ম অর্থাৎ যে-গোপন যে কথাটি তোমাকে বলছি (যুধিষ্ঠির) তা হল মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ নেই, কিছু নেই। বহু যুগ পরেও ভারত একথা নানা কণ্ঠে নানা পরিবেশে উচ্চারণ করেছে, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই, অথবা ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর।’ কবি চণ্ডীদাসের। কণ্ঠেও শুনি, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ ভীষ্ম ও চণ্ডীদাস এবং অন্য বহু সাধকের উপলব্ধির মধ্যে যে কথাটি মর্মভেদী কঠোর সত্যের অনুরণন আনে তা হল: ‘তাহার উপরে নাই। মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব দেবে দানবে এই মানুষই পরাৎপর শীর্ষবিন্দু। একথা এমন। করে আর কেউ কোথাও বলেছে কিনা জানি না (হয়তো ইসলামে এর প্রতিধ্বনি আছে কিন্তু ভারতবর্ষে এর উচ্চারণ আসমুদ্রহিমাচলকে শিহরিত করে রেখেছে। এমনই আরো কত শ্লোকে বা শ্লোকার্ধে বলা হয়েছে, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। এর তত্বটির সরলার্থ হল, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও আরো অগণ্য দেবদেবীর দ্বারা অনুরণিত আকাশ-বাতাস হঠাৎ যেন দেবলোক গন্ধর্ব/অসুর, কি নরলোকে মিলিয়ে গিয়ে ধর্মীয় আবহাওয়াটা অনেক স্বচ্ছ হয়ে উঠল। মাথা উঁচু করে দাঁড়াল মানুষ। কোন সে মানুষ? যে নিজের স্বার্থকে গৌণ করে আশপাশের সাধারণ মানুষের স্বার্থকে বড়ো করে দেখে, প্রয়োজন হলে নিজেকে বলিদান দিয়েও সব মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে।

ভীষ্মের ভাষায় মানুষ দেবতার ওপরে স্থান পেল তার গৌরবসমুজ্জ্বল মনুষ্যত্ব দিয়ে। এই উচ্চারণ অনুরণিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে, এত সাহসী বাণী, ও এত সত্য বাণী আর কে কবে উচ্চারণ করেছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *