খরোষ্ঠীলিপিতে রক্ত

খরোষ্ঠীলিপিতে রক্ত

 প্রস্তাবনা

ভদ্রলোক সোফায় বলেই তেতেমুখে বললেন,সবচেয়ে বাজে আর সাংঘাতিক হোক্স যদি কিছু থাকে, তা আছে আর্কিওলজিতে। মাটির তলায় একটা নাকভাঙা পুতুল বেরুলেই গুপ্তযুগ! একটুকরো মেটাল পাতে হিজিবিজি রেখা দেখলেই খরোষ্ঠী লিপি! ব্যাপারটা একটা ফাঁদের মতো। বাবা এই ফাঁদে পা দিয়ে এবার আমাদের ফ্যামিলিকে পথে বসাতে চলেছেন।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলাম ভদ্রলোককে। বয়স বেয়াল্লিশ হতে পারে, পঁয়তাল্লিশও হতে পারে। আবার পঞ্চাশ হলেও হতে পারে। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। রোদেপোড়া তামাটে গায়ের রঙ। চেহারায় মফস্বলের বনেদি আভিজাত্য স্পষ্ট। শক্ত হাড়ের কাঠামো। লম্বাটে গড়ন। পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি, তাঁতের ধুতি। হাতে একটা কালো শৌখিন ছড়ি। কাঁধের সুদৃশ্য ব্যাগটা গুছিয়ে পেটের কাছে রেখে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। এতক্ষণে আঙুলে গ্রহরত্ন বসানো কয়েকটা আংটিও চোখে পড়ল। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চুরুট কামড়ে ধরে তাকিয়ে ছিলেন। সাদাদাড়ি থেকে একটুকরো ছাই গড়িয়ে পড়ল। টাকে হাত বুলিয়ে বললেন,–আপনি সোমদেব রায়?

আজ্ঞে হ্যাঁ। এতক্ষণে ভদ্রলোক নমস্কার করলেন। একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ মহেন্দ্র বোস আমার বন্ধু। গতরাত্রে কথায় কথায় উনি আপনার কথা বলেছিলেন।

কর্নেল ওঁর কথার ওপর বললেন–আপনি কি আপনার বাবাকে সাইকিক পেশ্যান্ট ভেবেছিলেন?

-ভাবি, আর না-ভাবি, বলুন? সোমদেব সিগারেট ধরিয়ে, বিরক্তমুখে বললেন–বছর দশেক আগে স্কুল থেকে রিটায়ার করেছেন। স্কুলে থাকার সময় এসব বাতিক একটু-আধটু ছিল। সেটা এখন বাড়তে বাড়তে একেবারে পাগলামিতে পৌঁছেছে। আজকাল পঞ্চায়েত থেকে রাস্তা তৈরি, পুকুর সংস্কার এ সব কাজ আমাদের এলাকায় লেগেই আছে। বাবার বয়স পঁচাত্তর বছর। এই বয়সে কোথাও খোঁড়াখুঁড়ির খবর পেলেই সেখানে হাজির হবেন। আর রাজ্যের জঞ্জাল কুড়িয়ে এনেমিউজিয়াম! বুঝলেন? ওয়েস্টে চিঠি লেখালেখি করে সায়েব-মেমদের ডেকে আনা, তার ওপর বই লেখার বাতিক, পয়সা খরচ করে সেই বই ছাপানো–সংসার ফতুর হতে বসেছে।

–আপনার বাবার মিউজিয়াম থেকে কী হারিয়েছে বলেছিলেন?

সোমদেব সোজা হয়ে বসলেন।বাবা বলছেন হারিয়েছে। সেই নিয়ে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আবোল-তাবোল বকছেন। সামলানো যাচ্ছে না। চূড়ান্ত পাগলামি!

–জিনিসটা কী?

বলছেন নাকি ব্রোঞ্জের একটা সিল। খরোষ্ঠীলিপিতে কী সব লেখা ছিল। প্রায় নাকি ডিসাইফার করে ফেলেছিলেন। একটু বাকি ছিল।

কর্নেল একটু হাসলেন। –ডিসাইফার কথাটা ঠিক হল না। যতদূর জানি খরোষ্ঠীলিপি আলফাবেটিক রাইটিং সিস্টেম অর্থাৎ বর্ণমালাভিত্তিক লিপি। এখন এ লিপি পড়া হয়। ডিসাইফার করা হয় বলা চলে না।

সোমদেব গম্ভীর মুখে বললেন–কে জানে! বাবা তা-ই বলছেন। যাই হোক, প্রশ্ন হল, বাবার ও-ঘরে পারতপক্ষে আমরা কেউ ঢুকি না। ঢুকলে উনি বিরক্ত হন। তা ছাড়া সব সময় দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকে। বাবা যখন বেরোন, তালা এঁটেই বেরোন। তালা কেউ ভাঙেনি। বাবার দৃষ্টিশক্তিও এ বয়সে খুব তীক্ষ্ণ। কাজেই আমরা ভেবে পাচ্ছি না কীভাবে ওটা চুরি যেতে পারে। সোমদেব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশিয়ে ফের বললেন, কিছুদিন থেকে আমার ধারণা হয়েছে, বাবা ইমাজিনস থিংস। যা নেই, তা আছে বা ছিল বলে কল্পনা করেন। পরে অনেকসময় অবশ্য ভুলটা স্বীকার করেন। এনিওয়ে, ডঃ বোস বললেন–

-হ্যাঁ! একটু আগে উনি আমাকে ফোন করেছিলেন। কর্নেল হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন–কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এ ব্যাপারে আমি কী করতে পারি! ব্রোঞ্জের সিল হারানোর কথা আপনার বাবা কি থানায় জানিয়েছেন?

জানিয়েছেন। তবে লোকাল পুলিশ বাবার ব্যাপার-স্যাপার ভালই জানে।

ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি রেখে গেল। কর্নেল চোখ খুলে বললেন,–কফি খান।

 সোমদেব কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে আমার দিকে তাকালেন।

–এঁকে তো চিনতে পারলাম না। ইনি কি আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট? শুনেছি। প্রাইভেট ডিটেকটিভদের অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকে।

কর্নেল, দ্রুত বললেন–একটু ভুল হয়েছে সোমদেববাবু! আমি ডিটেকটিভ নই।

সোমদেব একটু অবাক হয়ে বললেন–কিন্তু ডঃ বোস বললেন–

–আমি ডিটেকটিভ?

সোমদেব বিব্রতভাবে বললেন না। মানে ঠিক এই কথাটা বলেননি। তবে মিসটিরিয়াস কিছু ঘটলে আপনি নাকি সম্ভ করতে পারেন।

কর্নেল তার স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসিটি হেসে বললেন–আসলে আমি একজন নেচারিস্ট, সোমদেববাবু। প্রকৃতিতে অসীম রহস্য। তা-ই নিয়ে আমি নিজের পদ্ধতিতে মাথা ঘামাই। না–আমি বিজ্ঞানী নই। তবে মানুষও তো প্রকৃতির একটা অংশ। তাই কোথাও মানুষের জীবনে রহস্যময় কিছু দৈবাৎ ঘটে গেলে আমি নাক গলাই। কর্নেল আমার দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বললেন–জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার স্পেশাল রিপোর্টার।

আমরা সৌজন্যমূলক নমস্কার বিনিময় করলাম। তারপর বললাম–আপনি কি হারানো ব্রোঞ্জের সিল উদ্ধার করতে কর্নেলের কাছে এসেছেন?

সোমদেব একটু ইতস্তত করে বললেন তার চেয়েও ব্যাপারটা সিরিয়াস। বাবার অবস্থা এখন হাফ-ম্যাড। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। বিড়বিড় করে কী সব বলছেন বোঝা যাচ্ছে না–’পালপুকুর’….’ধর্মপাল’…..’পালগড়’ এই সব কথা। কিন্তু বারবার পারু মানে আমাদের ছোটবোন পারমিতাকে ডাকছেন। পারু ইজ ডেড! অথচ বলছেন, পারুকে ডাকো সে সব জানে!

কর্নেল আস্তে বললেন, আপনার বোন মারা গেছে?

–একটা মিস হ্যাপ। ব্যাপারটা খুলে বলি। আমরা তিনভাই এক বোন। আমি, রন্তিদেব, শান্তিদেব আর পারমিতা। মা বেঁচে নেই। আমরা একান্নবর্তী ফ্যামিলিতে থাকি। গতবছর বাবা আমাদের অমতে ওঁর এক প্রাক্তন ছাত্র কমলেশের সঙ্গে পারুর বিয়ে দেন। মাস তিনেক আগে পারু সুইসাইড করেছে। একটা সুইসাইডাল নোট ওর ঘরে পাওয়া গিয়েছিল। আমরা জমিদার বংশ। বংশের প্রথা হল বাড়ির মেয়ে শ্বশুরঘর করত যাবে না। আমার ছোটবেলায় জমিদারিপ্রথা উচ্ছেদ হয়েছে। কিন্তু বাবা ট্রাডিশন ছাড়তে চাননি। কাজেই কমলেশ ঘরজামাই ছিল।

কমলেশবাবু এখন কোথায়?

–বাবা ওকে যেতে দেননি। বাবার আর্কিওলজিতে বাতিক। আর কমলেশ ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট!

সোমদেবের মুখে বিকৃতি ফুটে উঠল। কর্নেল ফের বললেন কমলেশবাবু এখন কোথায়?

–বাবার মিউজিয়ামের পাশের ঘরে থাকে। বাবার দেখাশোনা সে-ই করছে। আসলে বাবা আমাদের কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না। কিন্তু ওকে ঢুকতে অ্যালাউ করছেন।

কমলেশবাবুর বাড়ি ঢুকাথায় ছিল?

পাশের গ্রাম পালগড়ে। ছন্নছাড়া প্রকৃতির যাকে বলে। তিনকুলে কেউ নেই।

–কোনও চাকরি-বাকরি করেন উনি?

–আমাদের কোদালিয়া গ্রামের স্কুলের মাস্টারি করে। জেলার সবচেয়ে পুরনো স্কুল আমার ঠাকুর্দার করা। এখন গভর্নমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-বোর্ড বসিয়ে দিয়েছেন। আমার জ্যাঠামশাই ছিলেন সেক্রেটারি। তিনি মারা গেছেন। বাবা ছিলেন হেডমাস্টার।

আপনার জ্যাঠামশাইয়ের ফ্যামিলি কোথায় থাকেন?

 উনি চিরকুমার ছিলেন।

কর্নেল কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে বললেন– আপনি কী করেন?

সোমদেব হাসবার চেষ্টা করে বললেন–কিছু না। থিয়েটার নিয়ে থাকি। টাকি। খুলে বলা উচিত, আমি বাবার প্রিয়পাত্র ছিলাম না কোনওদিন। টেনেটুনে বি এ পাশ করেছিলাম। মেজ রন্তু রন্তিদেব অবশ্য ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। বাবা তাকে ওয়েস্টে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছিলেন। সে এখন আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে এশিয়ান স্টাডিজ ডিপার্টে পড়ায়। ছোট শান্তিদেব ইঞ্জিনিয়ার। দুর্গাপুরে ছিল। চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে চাষবাস নিয়ে মেতে আছে। বাই দ্য বাই, আমি জ্যাঠামশাইয়ের মতো ব্যাচেলর।

–শান্তিদেববাবু–

–বিবাহিত। একটি মেয়ের বাবা। মেয়ের বয়স বছর সাতেক। স্কুলে প্রাইমারি সেকশনে পড়ে।

কর্নেল আবার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজেছিলেন। সেই অবস্থায় বললেন–সম্প্রতি আপনার বাবার কাছে কোনও বিদেশী এসেছিলেন কি?

সোমদেব একটু চমকে উঠে বললেন–হ্যাঁ। মাসখানেক আগে রন্তু এক সায়েবকে পাঠিয়েছিল চিঠি দিয়ে। কী একটা খটমটে নাম–হ্যাঁ, গ্যান্সলার। সাম গ্যান্সলার। আশ্চর্য! বাপারটা আপনি বলায় এতক্ষণে কথাটি মাথায় এল। গ্যান্সলারসায়েবই সিলটা হাতাননি তো?

–আপনার বোন সুইসাইড করেছিল কীভাবে?

অতর্কিত প্রশ্ন করা কর্নেলের স্বভাব। সোমদেব হকচকিয়ে বললেন বাড়ির পেছনের বাগানে একটা গাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল। তবে পারু খুব জেদি আর হিস্টেরিক টাইপ ছিল। তা ছাড়া আমরা জানতাম, বিয়েটা সে মেনে নেয়নি। বাবা জোর করেই আমাদের অমতে বিয়ে দিয়েছিলেন। তো গ্যান্সলার সায়েব–

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন–আমি তা বলিনি। ওটা জাস্ট একটা প্রশ্ন। আমি আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সোমদেবের মুখে স্বাভাবিকতা ফিরে এল–আপনার পায়ের ধুলো পড়লে রায়ভবন ধন্য হবে। ডাঃ ঘোষের মুখে আপনার অনেক কীর্তিকলাপ শুনলাম। ডাঃ ঘোষের ফ্যামিলি একসময় কোদালিয়ায় ছিল। সেইসূত্রে চেনাজানা। যাইহোক, আমার এবং শান্তুর প্রব্লেম হল বাবাকে নিয়ে। উনি পাগল হয়ে গেলে আমরা ভেসে যাব।

–কেন?

সোমদেব অন্যমনস্কভাবে বললেন–প্রব্লেমটা প্রপার্টিঘটিত। আপনি গেলে ঠাণ্ডা মাথায় সব আলোচনা করব। আমি তাহলে উঠি। আপনি কখন যাচ্ছেন জানতে পারলে স্টেশনে শান্তু জিপ নিয়ে যাবে।

সোমদেব উঠে দাঁড়ালে কর্নেল বললেন–ঠিক সময় দিতে পারছি না। তবে যাব, কোদালিয়া আমার চেনা জায়গা।

সোমদেব কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করলেন। কিন্তু বললেন না। নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল চোখে হেসে বললেন কী বুঝলে ডার্লিং?

বললাম–একটা গ্রাম্য বনেদি ফ্যামিলির ব্যাকগ্রাউন্ড পাওয়া গেল। টিপিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যান্ড দ্য সেইম ক্যারেক্টার। সেই আদর্শবাদী স্কুলটিচার এবং পুরাতত্ত্বের বাতিক। আমি লক্ষ করেছি গ্রামের লোকেরা নিজেদের এরিয়ায় সবসময় প্রাচীন ইতিহাস এবং বিখ্যাত রাজরাজড়াকে এনে বসাতে চায়। কাল্পনিক অতীত সমৃদ্ধির গৌরব নিয়ে জাবর কাটে। এই ভদ্রলোকসোমদেব রায় ইজ কারেক্ট। মাটির তলায় পুতুল বা একটা কিছু পেয়ে গেলেই সটান গুপ্তযুগ! কলোনিয়াল হ্যাংওভার, কর্নেল! সম্প্রতি একটা বইয়ে পড়েছিলাম কলোনিয়ালিজম ইজ দ্য ওরিয়েন্টালিজম। কিংবা ওরিয়েন্টালিজমই কলোনিয়ালিজম!

জয়ন্ত, তুমি উত্তেজিত!

না। দেখুন, এই কবরখোঁড়া ব্যাপারটা আমার অসহ্য লাগে। আমার কাছে অতীতের চেয়ে বর্তমান নিয়ে মাথা ঘামানোই বড় কাজ। কারণ ভবিষ্যৎ সৃষ্টি হয় এই বর্তমান থেকেই।

কর্নেল হাসলেন। কিন্তু ডার্লিং, প্রবলেম হল, অতীতের ভূত আমাদের পিছু ছাড়ে না। রবিঠাকুরের আর্যবাণী ভুলে যাচ্ছ। অতীত গোপনে-গোপনে ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে। এনিওয়ে, রায়ভবনের এপিসোডটি ইন্টারেস্টিং। হ্যাঁ– খরোষ্ঠী লিপির চেয়ে ইন্টারেস্টিং।

–খরোষ্ঠী লিপিটা কী?

–আদি বৌদ্ধযুগে উত্তর-পশ্চিম ভারত, উত্তর-পূর্ব ইরান, আফগানিস্তান থেকে মধ্যএশিয়া পর্যন্ত বৌদ্ধরা এই লিপি ব্যবহার করতেন। এটা আসলে সেমিটিক লিপি। ডানদিক থেকে পড়তে হয়। প্রাচীন অ্যারামাইক লিপির হরফ ছিল মাত্র বাইশটা। সেই লিপি অনুকরণ করে বৌদ্ধ অনুশাসন লেখা হত প্রাকৃত ভাষায়। দক্ষিণবঙ্গে এই লিপি আবিষ্কারের দাবি কেউ-কেউ করেন। যেমন সোমদেববাবুর বাবা জয়দেববাবু। আমি ওঁর লেখা পড়েছি। কিন্তু এটাই আশ্চর্য, কোথায় পাহাড়ি পশ্চিম-ভারত আর কোথায় পূর্ব-ভারতের সমতল নিম্নাঞ্চল! বৌদ্ধদের বড় ঘাঁটি ছিল মগধ কলিঙ্গ অঞ্চলে। সেখানে রাশি রাশি বৌদ্ধ পুরাদ্রব্য পাওয়া গেছে। অথচ কোনও খরোষ্ঠীলিপি মেলেনি। কাজেই প্রশ্নটা হল, পশ্চিম-পূর্ব যোগসূত্রটা কীভাবে মেলানো যাবে? অবশ্য মথুরায় খরোষ্ঠী লিপিরই একটা নিদর্শন পাওয়া গেছে। কিন্তু তার পাঠ নিয়ে বিতর্ক আছে।

উঠে দাঁড়িয়ে বললাম–ওঃ! মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, চলি।

–জয়ন্ত, অতীতের ভূত পিছু ছাড়ে না। সেই ভূতকে দেখতে হলে কোদালিয়া চলো। আই প্রমিজ ডার্লিং! তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা একটা অনবদ্য স্টোরি পাবে।

অবাক হয়ে বললাম–চুরি যাওয়া জিনিস উদ্ধারের কাজটা সরকার পুলিশকে দিয়েছে। আপনি পুলিশের রোলে নামবেন নাকি? ছ্যা ছা! প্রখ্যাত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে যে!

কর্নেল হাসলেন না। গম্ভীর হয়ে বললেন-ন্যায়শাস্ত্রে অবভাসতত্ত্ব বলে একটা টার্ম আছে। হোয়াট অ্যাপিয়ার্স, ইজ নট রিয়্যাল। ব্রোঞ্জের সিল এবং সেই সিল চুরি যাওয়া সম্ভবত একটা ঘটনার মুখোশ, জয়ন্ত! মুখোশের তলায় অন্য কেউ বা কিছু আছে।

কী করে বুঝলেন?

 কর্নেল উঠে গিয়ে বুকশেলফ থেকে একটা বই টেনে বের করে আপনমনে বললেন–সোমদেববাবুর বোনের আত্মহত্যা, তারপর ব্রোঞ্জের সিল চুরি, জয়দেববাবুর মধ্যে পাগলামির লক্ষণ। সম্পত্তি ঘটিত কী একটা প্রব্লেম… মামার কেন যেন বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। জাস্ট অ্যান আনক্যানিং ফিলিং।

কর্নেল তার ইজিচেয়ারে ফিরে বইটার পাতা খুলে বিড়বিড় করতে থাকলেন। কথাগুলো বুঝতে পারছিলাম না। বইটার কভারে লেখা আছে ‘দ্য ওরিজিন অ্যান্ড ডেভালপমেন্ট অব খরোষ্ঠীস্ক্রিপ্ট।…

.

০১.

পুজোর কয়েকটা দিন বড় বিশ্রী গেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি যখন-তখন। দশমীর দিন তো কলকাতা জুড়ে প্রায় বন্যার দুর্যোগ। তারপর থেকে আবহাওয়া চমৎকার প্রসন্ন। কথা ছিল, কর্নেলের সঙ্গে হিমালয়যাত্রা করব। ততদিনে বাঙালি পর্যটকদের ভিড় ঘরমুখী হবে। স্থান বাছাই না হলেও আমাদের লক্ষ্য ছিল উত্তরপ্রদেশ। কিন্তু হঠাৎ ত্রয়োদশীর দিন কোন কোদালিয়া থেকে এক সোমদেব রায় এসে গ্রোগ্রাম ভন্ডুল করে দিলেন।

সোমদেবের বাবার চেয়ে কর্নেল কোনও অংশে কম যান না। মাথায় একটা কিছু ঢুকলেই হল। তা-ই নিয়ে একেবারে মরণপণ লড়াইয়ে নেমে যাবেন। সমস্যা হল, সেই লড়াইয়ে আমাকেও জড়িয়ে জেরবার করবেন। গতবছর এমনি শরতে ওড়িশার জঙ্গলে একটা পাখির পেছনে নিজে ছোটাছুটি করে সারাদিন কাটিয়েছিলেন এবং আমার হয়েছিল সাপের ছুঁচো গেলা অবস্থা। সঙ্গ ছাড়লে জঙ্গলে বেঘোরে প্রাণটি খোয়াতে হত। কাজেই পেছনে-পেছনে খালি পেটে অকারণ ছোটাছুটি করে কাটাতে হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, জঙ্গল থেকে বেআইনি কাঠপাচারের সরেজমিন অভিজ্ঞতা থেকে একটা রেপোর্টাজ উপহার দিতে পেরেছিলাম আমার রুজির মালিক দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকাকে। তাই কথাটি তুলতেই কর্নেল আমাকে সেটা স্মরণ করিয়ে মুখ বন্ধ করে দেন।

পরদিন দুপুরঅব্দি কর্নেলের সাড়া নেই দেখে আশা করছিলাম, সম্ভবত হারানো সিল পুলিশ উদ্ধার করে দিয়েছে। তাই কর্নেল কোদালিয়া যাত্রার প্রোগ্রাম বাতিল করে দিয়েছেন।

কিন্তু হঠাৎ দুটোয় ওঁর টেলিফোন এল।–জয়ন্ত! তৈরি হয়ে এস। শেয়ালদায় তিনটে দশে ট্রেন।

–কোদালিয়া?

–কোদালিয়া। কুইক ডার্লিং, কুইক!

কিন্তু….

আবার একটা মিসহ্যাপ হয়েছে রায়ভবনে। সোমদেববাবুর লোক এসে খবর দিয়ে গেল।

–মিসহ্যাপ? কমলেশবাবু….

-নাহ্। নন্দ নামে ওদের বাড়ির একজন পুরানো সারভ্যান্ট গতরাতে খুন হয়েছে। বডি পাওয়া গেছে বাড়ির বাগানে আজ ভোরবেলায়। চলে এস।

লাইন কেটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা অতর্কিত ত্রাস আমার বুকের ভেতর ধাক্কা দিল। আজকাল দেশের আইন-শৃঙ্খলার যা অবস্থা, অজানা গ্রাম্য জায়গায় খুনোখুনির মধ্যে গিয়ে পড়া কি ঠিক হবে? একটু ইতস্তত করে আলমারির লকার থেকে সিক্সরাউন্ডার অটোমেটিক রিভলভার বের করলাম। ক’বছর আগে চিৎপুর রেলইয়ার্ডে স্মাগলিং র‍্যাকেটের খবর কাগজে ফাস করার পর আমার ওপর হামলা হয়েছিল। তারপর পুলিশ কমিশনার উদ্যোগী হয়ে আমাকে এই অস্ত্রটার লাইসেন্স পাইয়ে দেন। কর্নেলেরও অবশ্য রিভলভার আছে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারের পক্ষে লাইসেন্স পাওয়া সোজা। তবে কর্নেল বলেন,–বয়স হয়েছে। শারীরিক ক্ষমতার ওপর নির্ভরতা কমে যাচ্ছে। তবে ভেবে দেখ ডার্লিং! এই মরজগতে মৃত্যু অমোঘ। তবু বেঘোরে প্রাণের মতো দামি জিনিস খোয়ানোটা ভারি অসম্মানজনক। প্রাণ প্রকৃতির দান। প্রাণ নেওয়ার অধিকার শুধু প্রকৃতির আছে। অন্য কেউ এতে নাক গলাক, এটা আমি বরদাস্ত করতে পারি না।

বিশালদেহী কর্নেলের বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি হয়ে এল। অথচ মুখে উনি যা-ই বলুন, জানি এবং দেখেছিও বটে, এ বয়সেও অনেক শক্তিমান জোয়ানকে ঢিট করতে উনি পটু। সামরিক জীবনে হাতাহাতি লড়াইয়ের গেরিলা-কৌশল এখনও ভোলেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বর্মার জঙ্গলে মার্কিন সেনাদের গেরিলাযুদ্ধের তামিল দিয়েছেন। ছয়ের দশকেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর লাদাক ডিভিসনের গেরিলাগ্রুপকে পাহাড়ি অঞ্চলে যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে ছিলেন।

এইসব কথা ভাবলেই ওঁর সঙ্গী হওয়ার ঝুঁকি নিমেষে ঘুচে যায়। কর্নেলের ইলিয়টরোডের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে যখন পৌঁছলাম, তখন আড়াইটে বাজে। উনি তৈরি হয়ে আমার অপেক্ষা করছিলেন। সেই চিরপরিচিত বেশভূষা। মাথায় টাক ঢাকা টুপি, পরনে ফুলহাতা জ্যাকেট এবং ছাইরঙা আঁটো পাতলুন, পায়ে হান্টিং বুট। বুকে ঝুলন্ত বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা। পিঠে আঁটা প্ৰকাণ্ড কিটব্যাগ থেকে প্রজাপতিধরা নেট-স্টিক উঁকি মেরে আছে। মুখে সাদা দাড়ি ঝকমক করছে।

বড়রাস্তার মোড়ে ট্যাক্সি পাওয়া গেল। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে বললাম– কাল আপনি আনক্যানি ফিলিংয়ের কথা বলছিলেন। তারপর এই খুনখারাপি। বস! আমার ধারণা, আপনার মধ্যে সত্যিই কোনও অতীন্দ্রিয় শক্তি আছে।

কর্নেল একটু হাসলেন। নাহ্! ওসব বুজরুকি ব্যাপার। আসলে আমার মনে হয়েছিল, আবার কোনও একটা অঘটন ঘটবে।

–কেন মনে হয়েছিল বলতে আপত্তি আছে?

–জানি না। তবে সোমদেববাবুর বিবরণকে যদি নিখুঁত তথ্য, মানে ‘ডেটা ধরে নিই, তা হলে দেয়ার ওয়জ সামথিং অড সামহোয়্যার। কী একটা গোপন ঘটনা থেকে এই ‘ডেটা’ গড়ে উঠছে। মানুষের মগজ আসলে একটা জটিল কম্পিউটার, ডার্লিং।

উঃ! বড্ড হেঁয়ালি হয়ে গেল বস!

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–ও! তোমাকে বলা হয়নি। নন্দের ডেডবডি দেখে প্রথমে সবাই ভেবেছিল সুইসাইড। একই গাছ থেকে গলায় দড়ির ফাঁস আটকে ঝুলছিল। মর্গে সদ্য নতুন একজন ডাক্তার এসছেন। তার চোখে পড়ে, বডির পিঠের হার্টের উল্টোদিকে ইনজেকশনের চিহ্ন। রক্তে সাংঘাতিক নিকোটিন পয়জন পাওয়া গেছে।

চমকে উঠে বললাম–সর্বনাশ! তা হলে তো

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন–সেটাই প্রশ্ন। নন্দ রবিঠাকুরের কথায় পুরাতন ভৃত্য। সে কি কিছু জানত, যেজন্য তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হল?

–সিল চুরির ব্যাপারে?

–জানি না।

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে আস্তে কথাটা বললে। মৌলালিতে প্রচণ্ড জ্যাম। ট্যাক্সিড্রাইভার তেতেমুখে গজগজ করতে থাকল। তার বক্তব্য, শেয়ালদার মুখে ফ্লাইওভার করে হলটা কী? জ্যামটা সরিয়ে আনা হল শুধু। গোর্মিনলোক খালি উল্টাকে সিধা আউর সিধাকো উল্টা করতা। দেখিয়ে সাব, দেখিয়ে! মিনিবাস টেরামলাইনকা উপ্পর খাড়া হোকে পেসেঞ্জার উঠাতা! কৈ কানুন হ্যায়?

স্টেশনে পৌঁছতে তিনটে বেজে গেল। টিকিট কাউন্টারে লম্বা লাইন। তবে ব্যস্ততার কারণ ছিল না। ট্রেন ছাড়ল সাড়ে তিনটেয়। ভয়বহ ভিড়। স্টেশনের নাম কোদালিয়াঘাট রোড। কস্মিনকালে শুনিনি। কর্নেল উঁচুমানুষ হওয়ায় তার দিকে লক্ষ রেখেছিলাম। ঘণ্টাখানেক পরে ভিড় কমে গেল। জানলার ধারে বসার জায়গাও মিলল। কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি-টাখি দেখতে লাগলেন।

সাড়ে পাঁচটায় কোদালিয়াঘাট রোডে নেমে দেখি বেশ বড় স্টেশন। মেন গেট দিয়ে বেরুতেই বছর ত্রিশ-বত্রিশ বয়সের একজন শক্তসমর্থ গড়নের ভদ্রলোক কর্নেলের সামনে এসে নমস্কার করলেন

আপনি কি কর্নেল সরকার?

কর্নেল বললেন–শান্তিদেব রায়?

–আজ্ঞে। বড়দা আপনার চেহারার ডেসক্রিপশন দিয়েছিলেন। তোত আমরা আশা করেছিলাম, আপনি দুলালের সঙ্গে আসবেন।

স্টেশনে জিপ নিয়ে এসেছিলাম। আসুন!

 বলে শান্তিদেব আমাকে নমস্কার করলেন। আপনি সম্ভবত সাংবাদিক…

 নমস্কার করে বললাম–জয়ন্ত চৌধুরি।

স্টেশনবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শান্তিদেব বললেন–আপনাকে পেয়ে আমার একটা বড় লাভ হবে মিঃ চৌধুরি! ওসব খুনোখুনি নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। দাদা ওসব দেখুক। আমার ফার্মহাউসে আপনাকে নিয়ে যাব। বিনা সারে নানা জায়গায় মাটির মিশ্রণ ঘটিয়ে আমি অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। আই মাস্ট শো য়ু দ্য এক্সপেরিমেন্ট। নেচারের কাছে কত কৌশলে বেশি আদায় করা যায়–এদিকে প্লিজ! এখানে সাইকেলরিকশোর ভিড়ে গাড়ি পার্ক যায় না। জাস্ট একমিনিট হাঁটতে হবে।

বাজার ছাড়িয়ে গিয়ে রাস্তা একটা নদীর ব্রিজে পৌঁছেছে। নদীটা দেখেই তার প্রেমে পড়ে গেলাম। উত্রাইয়ের পর বাঁদিকে শুরু হয়েছে বসতি এলাকা। ব্রিজ থেকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম কোদালিয়াকে ঠিক গ্রাম বলা চলে না। মফস্বল শহরের আকৃতি প্রকৃতি।

জিপ বসতির শেষদিকটায় একটা পুরনো দোতলা বাড়ির ফটক দিয়ে ঢুকল। বনেদি জমিদারবাড়ি যেমন হয়। বিশাল চৌহদ্দি উঁচু জরাজীর্ণ পাঁচিলে ঘেরা। পেছনদিকে এলোমেলো উঁচু-নিচু গাছের জটলা দেখে বুঝলাম ওটাই সেই বাগান। অনুমান করলাম, বাগানের ওধারে কাছাকাছি নদীটা বয়ে গেছে। কিন্তু এ জায়গাটা যথেষ্ট উঁচু। ধাপবন্দি সিঁড়ি উঠে গেছে বাড়ির পোর্টিকো থেকে। প্রকাণ্ড দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সোমদেব রায়। পরনে এখন পাজামা পানজাবি, হাতে সেই ছড়ি।

গতকাল কর্নেলের ড্রয়িংরুমে বসে একেবারে অনুমান করতে পারিনি, এঁরা এমন একটা অভিজাত পরিবারের মানুষ। দোতলা বাড়িটার স্থাপত্যশৈলী প্রমাণ দিচ্ছে পুরনো ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির। এখন ক্ষয়াটে, নির্জীব, অপরিচ্ছন্ন দেখালেও উদ্ধত অতীত আভিজাত্যের লক্ষণ স্পষ্ট। স্থবির সিংহের মতো বাড়িটা ধূসর চোখে তাকিয়ে আছে। সোমদেব অভ্যর্থনা করে ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা একটা হলঘর। একটা ফায়ারপ্লেস পর্যন্ত আছে। দেয়ালে কয়েকটা মলিন পোর্ট্রেট। এককোণে পুরনো সেকেলে সোফা। কয়েকটা গদিছেঁড়া চেয়ার দেয়ালে দাঁড় করানো। মাঝখানে বেখাপ্পা একটা বিশাল ডিমালো সাদা পাথরের টেবিল।

শান্তিদেব ঘরে ঢোকেননি। বাইরে ওঁর জিপের শব্দ শুনে বুঝলাম, চলে গেলেন কোথাও। সোমদেবকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। গোঁফদাড়ি কামাননি আজ। ভেতরে একটা দরজার কাছে যেমন-তেমন প্যান্টশার্ট পরা বেঁটে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি কর্নেলকে নমস্কার করলেন। সোমদেব বললেন দুলাল! কর্নেলসায়েবদের গেস্টরুমে নিয়ে যাও। তারপর কর্নেলকে বললেন– একটু বিশ্রাম করুন। আমি আসছি।

দুলালবাবু একটা খালি ঘরের ভেতর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা কাঠের সিঁড়ির কাছে আমাদের নিয়ে গেলেন। বললেন–একটু কষ্ট করে ওপরে উঠতে হবে স্যার!

সিঁড়িটা মাত্র হাততিনেক চওড়া। ওঠার মুখে একটা দরজা খোলা ছিল। বাইরে খোলামেলা একটুকরো বারান্দা দেখতে পেলাম। বারান্দার নীচে দেশি বিদেশি ফুলগাছ আর গুল্মের বাগান। অযত্নে জঙ্গল হয়ে আছে। ঘোরালো সিঁড়ি বেয়ে মোটামুটি বড় একটা ঘরে পৌঁছলাম। কর্নেল জানালার কাছে গিয়ে বললেন, বাঃ!

নদী এবং ওপারের খাপচা-খাপচা ঝোঁপজঙ্গল আর ধানক্ষেত দেখা যাচ্ছিল। সূর্যাস্তের ফিকে রোদে নদীর জল ঝিলমিল করছিল। আমিও না বলে পারলাম না–বিউটিফুল!

দুলালবাবু বললেন–এটা সাবেকি আমলের গেস্টরুম স্যার! শুনেছি জমিদারি আমলে সায়েবরা এসে এ ঘরে থাকতেন। নদীর ওপারে তখন ঘন জঙ্গল ছিল। বাঘ মারতে আসতেন সায়েবরা। এখন সব ধানক্ষেত হয়ে গেছে। একটা শেয়ালও নেই।

কর্নেল ছোট্ট ব্যালকনিতে গিয়ে বাইনোকুলারে পাখি খুঁজতে থাকলেন। দুলালবাবু দুটো চেয়ার নিয়ে গেলেন ব্যালকনিতে। বললেন–আমি আসছি স্যার! আর একটা কথা। কোনও দরকার হলে ওই সুইচটা টিপবেন।

দুলালবাবু চলে গেলেন। চেয়ারে বসে বললাম–এই ভদ্রলোক কে?

কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখেই বললেন শান্তিদেবের ফার্মহাউসের কর্মচারী। বোঝা যাচ্ছে, নন্দ বেচারা মারা না পড়লে সেই আমাদের সেবা-টেবা করত। তার বদলে দুলালবাবুকে বহাল করা হয়েছে।

–একটা ব্যাপার আশ্চর্য লাগছে।

–কী?

–সেই কমলেশবাবুকে দেখলাম না।

 –তাকে দেখতে হলে থানায় চলে যাও।

 চমকে উঠে বললাম–তার মানে?

–পুলিশ ওঁকে অ্যারেস্ট করেছে।

নন্দকে খুনের চার্জে?

–হ্যাঁ।

 –কিন্তু উনি কেন নন্দকে খুন করবেন? মোটিভটা কী থাকতে পারে?

 কাঠের সিঁড়িতে শব্দ শোনা গেল। কর্নেল চেয়ার টেনে বসলেন। সোমদেববাবুকে দেখা গেল। উনি একটা মোড়া তুলে এনে দরজার কাছে বসলেন। ব্যালকনিতে তিনজনের ঠাই হবে না, এত স্বল্পায়ন! সোমদেব বললেন–সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে তালগোল পাকিয়ে গেছে। এবার মনে হচ্ছে আমিও পাগল হয়ে যাব। কারণ পারুর ব্যাপারটা আমাকে হন্ট করছে। মর্গের আগের ডাক্তার ছিলেন বয়স্ক মানুষ। দায়সারা কাজ করতেন। নতুন ডাক্তারবাবুর মতো অ্যালার্ট থাকলে নিশ্চয় ধরা পড়ত, একই ভাবে পারুকে

চোখে জল এসে গিয়েছিল সোমদেবের। রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। কর্নেল বললেন–আপনার বাবা জানেন নন্দ মারা গেছে?

নাহ্। ওঁকে আমরা বলিনি। বুঝতেই পারছেন, বাবা এখন আনপ্রেডিক্টেবল ম্যান হয়ে উঠেছেন। কী রিঅ্যাকশন হবে তা তো জানি না।

–আপনার বাবাকে দেখাশোনা করত কে?

উনি স্বাবলম্বী মানুষ। কারও সাহায্য নিতেন না। সিল চুরির পর কমলেশই ওঁকে দেখাশোনা করত। তা ছাড়া কেন জানি না, নন্দকে বাবা কিছুদিন থেকে বরদাস্ত করতে পারছিলেন না। ধারে-কাছে দেখলেই ধমক দিয়ে সরে যেতে বলতেন।

–এটা কোন সময় থেকে?

সোমদেব একটু ভেবে নিয়ে বললেন–পারুর মৃত্যুর পর থেকে।

এখন আপনার বাবার দেখাশোনা কে করছে?

–শান্তুর বউ। এগারোটা নাগাদ পুলিশ কমলেশকে বাজার থেকে অ্যারেস্ট করেছে। তারপর বাবা ওকে ডাকাডাকি করেছিলেন। শান্তুর বউকে বাবা মোটামুটি পছন্দ করেন। আমরা তাকে শিখিয়ে দিয়েছি। বাবা জিজ্ঞেস করলে যেন বলে, কমলেশ কলকাতা গেছে কী কাজে।

–শুনে উনি কী বলেছেন?

–কিছু বলেননি। শান্তুর বউকে আপনি বরং জিজ্ঞেস করবেন। ডিটেলস বলবে।

–কোন গাছে নন্দের বড়ি ঝুলছিল এখান থেকে দেখা যায়?

সোমদেব ছড়ি তুলে বললেন–ওই যে পাইনগাছটা দেখছেন, তার পেছনে আমগাছটা। ওদিকে একটা লম্বালম্বি ডাল আছে। সেই ডালে।

কর্নেল বাইনোকুলারে গাছটা দেখতে থাকলেন। আমি বললাম–আশ্চর্য তো! এই মাটিতে পাইনগাছ!

সোমদেব বললেন–শান্তুর যেমন এগ্রিকালচারে বাতিক, আমার ঠাকুরদার তেমনি প্ল্যান্টেশনের বাতিক ছিল। নর্থবেঙ্গলে ওর কয়েকটি চা বাগিচা ছিল। তরাইয়ের জঙ্গল থেকে অনেক ধরনের গাছ এনে পুঁতেছিলেন। সব গাছ বাঁচেনি। কিভাবে ওই পাইনটা।

কর্নেল বললেন–পাইন দীর্ঘজীবী গাছ। ক্যালিফরনিয়ায় তিন হাজার বছরের সিকুইয়া পাইন আছে। অবশ্য এটা হিমালয়ান পাইন।

বললাম–কিন্তু এটা তো পাহাড়ী এলাকার মাটি নয়। এখানে পাইন গাছের বেঁচে থাকাটা আশ্চর্য!

কর্নেল হাসলেন। আশ্চর্য হলেও তুমি গাছটা দেখতে পাচ্ছ!

সোমদেব বললেন–আসলে এই মাটিটা বাবার মতে প্রাচীন যুগের কোন ধ্বংসাবশেষ। বাবার ছোটবেলায় ঠাকুরদালানের ভিত খুঁড়তে নাকি পাথরের স্ল্যাব  পাওয়া গিয়েছিল। দুটো স্ল্যাব বাবার ঘরে রাখা আছে। এটা নাকি একটা মাউন্ড ছিল। নাইনটিন্থ সেঞ্চুরিতে তার ওপর এই বাড়িটা তৈরি। আমাদের বংশের কুলকারিকায় আছে সেভেনটিন্থ সেঞ্চুরিতে মোগল সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষ এই এলাকায় এসেছিলেন। তো–

সিঁড়িতে আবার শব্দ শোনা গেল। দুলালবাবু একটা ট্রেতে স্ন্যাক্স আর কফির প্লেট-পেয়ালা সাজিয়ে ঘরের টেবিলে রাখলেন। আমরা ঘরে গেলাম। দুলালবাবু চেয়ার দুটো নিয়ে এলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন–মানিক এসেছে। বললাম, বড়দা এখন ব্যস্ত। বলল, খুব জরুরী দরকার। কি বলব?

সোমদেব ব্যস্তভাবে বললেন বাবার ঘরে গিয়ে ঢোকেনি তো?

নাহ্। ছোটবউদি আছেন বাবুমশাইয়ের কাছে। মানিক হলঘরে বসে আছে।

জ্বালাতন! আসছি কর্নেলসাহেব।

 বলে সোমদেব বেরিয়ে গেলেন। দুলালবাবু কুণ্ঠিতভাবে বললেন–স্যার কফি ছাড়া কিছু খান না শুনে ছোটবউদি কফি আনিয়ে রেখেছিলেন। টেস্ট ঠিক আছে স্যার?

কর্নেল চুমুক লাগিয়ে বললেন–ফাইন! আপনার ছোটবউদিকে থ্যাংকস জানিয়ে দেবেন।

দুলালবাবু বললেন–লক্ষ্মীপ্রতিমা স্যার! উনিই এতবড় সংসারটাকে রেখেছেন। পারুদিদিমণি তো জামাইবাবুর চেয়ে এককাঠি সরেস ছিল। পরনের শাড়িটা পর্যন্ত গুছিয়ে পরতে জানত না। আর কথায় কথায় ভাঙচুর। ছোটবউদির হেনস্থা! তো ছোটবউদি মাটির মানুষ। ননদকে পেটের মেয়ের মতো সামলে রাখতেন। অথচ দেখুন, কলকাতার মেয়ে। অনার্স গ্র্যাজুয়েট। এদিকে পারুদিদিমণি হায়ার সেকেন্ডারি পাস। হেডমাস্টার বাবার মনের অবস্থা বুঝুন স্যার!

কর্নেল একটু হেসে বললেন-বড়ছেলে থিয়েটার করেন। এতে বাবার অমত ছিল না?

দুলালবাবু হাসলেন–অমত কী বলছেন স্যার! কতবার ত্যজ্যপুত্র করবেন বলে থ্রেটন করেছেন। তবে বড়দার থিয়েটার স্যার মাঝে মাঝে কলকাতায় গিয়ে প্রাইজ নিয়ে আসে। নিজেই নাটক লেখেন। ডাইরেকশন দেন। অ্যাকটিং করেন। একেবারে অন্যরকমের থিয়েটার স্যার! এবার পুজোয় হওয়ার কথা ছিল। পারুদিদির মিসহ্যাপের জন্য ডেট পিছিয়ে গিয়েছিল। আবার নন্দের মিসহ্যাপ। ওদিকে বাবুমশাইয়ের হঠাৎ মাথাখারাপ।

–সিলচুরি!

আজ্ঞে। আপনাকে তো বলেছি স্যার, বাবুমশাইয়ের ঘরে উঁকি মেরে অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু তেমন কোনও জিনিস দেখিইনি। জার্মান সাহেবএলেন ওমাসে। বড়দা মেজদাকে আমেরিকায় চিঠি লিখে ওর কাছে খোঁজ নিতে বলেছিলেন। সেদিন মেজদার চিঠি এল। সায়েব বলেছেন, না তাকে তেমন কিছু দেখাননি বাবুমশাই।

আমি কর্নেলের দিকে তাকালাম।–সোমদেববাবু তো কাল সকালে আপনার কথা শুনে

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন–লিপিটা খরোষ্ঠি না খরোক্তি এসব পণ্ডিতরা ভাল বোঝেন। পাকিস্তানি আর পার্সিয়ান পণ্ডিতদের দাবি, কথাটা খারপোস্তি। খার মানে গাধা পোস্ত মানে চামড়া। সংস্কৃতে খার মানে গাধা। গাধার কুঁড়ির চামড়ায় লেখা বলেই নাকি খারপোক্তি। যাই হোক, মহাযানী বৌদ্ধদের লেখা সংস্কৃতে বুদ্ধের জীবনী লিলিত-বিস্তর বইয়ে ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী নিয়ে ৬৪টা লিপির উল্লেখ আছে। বইটা রাজেন্দ্রলাল মিত্র গত শতকে ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। ব্যাপারটা বড় জটিল। বুঝলে জয়ন্ত।

আমি তো থ। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। দুলালবাবুও হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন কর্নেলের দিকে। বললেন–আজ্ঞে স্যার! ঠিক এইসব কথাবার্তা বলতে শুনেছি বাবুমশাইয়ের মুখে। কমলেশের সঙ্গে এই নিয়ে ডিসকাস। করতেন।

কর্নেল বললেন–কখন শুনেছেন?

কর্নেলের প্রশ্নের ঝকে একটু ভড়কে গিয়ে দুলালবাবু বললেন, আজ্ঞে রাত্রিবেলা। আমি তো সারাটা দিন ফার্মেই থেকেছি। সন্ধ্যার পর ছোটবাবুর সঙ্গে এসে চা-কফি খেয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতাম। ছোটবাবুর ড্রয়িংরুম থেকে বাবুমশাইয়ের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যায়।

ফার্মে কতবিঘে জমি আছে?

-পঁচিশ একর। তিনভাই একবোনের নামে বাবুমশাইয়ের বাবা উইল করে গিয়েছিলেন। বাবুমশাই তো মাস্টারি আর ওইসব ছাইপাঁশ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। বাবুমশাইকে দিয়ে গেছেন শুধু এই বাড়িটা। তাও ছোটবাবু চাকরি ছেড়ে না এসে পড়লে বাবুমশাই বাড়িটা মিউজিয়াম আর লাইব্রেরি করার জন্য গভর্নমেন্টকে দান করে ফেলতেন। বরাবরই স্যার এইরকম পাগলামি ছিল। একবার খেয়াল হল, গার্লস স্কুলের জন্য বাড়িটা দান করবেন। তখন–

আবার কাঠের সিঁড়িতে শব্দ। দুলালবাবু চুপ করে গেলেন। সোমদেব এসে বললেন-বউমা তোমাকে ডাকছে।

দুলালবাবু বললেন–যাই। এঁদের খাওয়া হলে ট্রেটা নিয়ে যাব ভেবে ওয়েট করছিলাম।

পরে নিয়ে যেও।

দুলালবাবু চলে গেলেন। সোমদেব মোড়ায় বলে বললেন–কমলেশের এক কলিগ এসেছিল। মানিক চ্যাটার্জি নাম। পলিটিক্যাল পার্টির মাতব্বর। দুপুরে একবার এসেছিল। এখন আবার এসে বলছে, কমলেশ একাজ করতেই পারে না। আমি বললাম, পুলিশ কেস। আমরা কেউই ওর নাম করিনি। পুলিশ সবাইকে জেরা করে গিয়ে ওকে অ্যারেস্ট করেছে। পুলিশকে গিয়ে বলো। মানিক বলছে, আমিও যেন ওর সঙ্গে যাই। তা কী করে হয়? আসল কথাটা এবার বলি। শান্তুর বউ মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হবে না? সে স্পষ্ট দেখেছে জ্যোৎস্না ছিল রাত্রে, কমলেশ আর নন্দ বাগানের দিকে যাচ্ছে। তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা কি এগারোটা হবে। শান্তু খবর পাঠায়নি রাত্রে, ফার্মহাউসে থাকবে। তাই বউমা–

কর্নেল চুরুট ধরাচ্ছিলেন। তাঁর কথার ওপর বললেন–ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সোমদেব গম্ভীর মুখে বললেন–আসবে। আমি বলে এলাম আসতে।…

.

০২.

সোমদেব থিয়েটার নিয়ে কথা বলছিলেন। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দিনশেষের নদী দেখছিলাম। কর্নেল বলেন, এই সময়টাতে নাকি প্রকৃতিতে একটা আশ্চর্য সন্ধিকাল! প্রকৃতি জুড়ে একটা সাড়া পড়ে যায়। আমি অবশ্য তেমনি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। পাখিগুলো কেন যেন খুব ঝগড়াঝাটি করছিল। নদীর বাঁকে এক জেলে তার নৌকো থেকে শেষবার জাল ফেলে গুটিয়ে নিল। নৌকোটা ক্রমশ কালো হয়ে উঠছিল। ওপারের গাছপালার ওপর নীলাভ কুয়াশার স্তর জমে উঠল। বাঁদিকে পের্টিকোর সামনে ঘাসের ওপর একটি ছোট্ট মেয়ে আপনমনে স্কিপিং করছিল। শান্তিদেবের মেয়েই হবে। মুখের পাশে একটা ঝকমকে উজ্জ্বলতা। বাবার গায়ের রঙ তো শ্যামবর্ণ। মায়ের রঙ পেয়েছে। হয়তো।

ঘরের ভেতর তখন স্যামুয়েল বেকেট, ইউনেস্কো, ইউজিন ও নিল ব্রেখট হুল্লোড় করছেন।… ব্রেখট ইজ অলরাইট। আমিও ককেসিয়ান চকসার্কেল, করেছিলাম ব্যুহ নাম দিয়ে মাই কনসেপসন ইজ কোয়াইট ডিফারেন্ট কর্নেলসায়েব! সমাজচেতনা বা সমাজবদলানোর হাতিয়ার-টাতিয়ার, ওসবে আমি বিশ্বাস করি না। ফোকড্রামা লোকশিক্ষার বাহন ছিল কখন? যখন কিনা ওরাল ট্রাডিশানের যুগ। এখন লোকের শেখার অসংখ্য সোর্স আছে। ফোকফর্ম আমি প্রয়োগ করি। কখনও প্রসিনিয়াম থিয়েটারের অ্যাপ্রোচও ভেঙে ফেলি। কিন্তু শেষ কথা রস। এনটারটেনমেন্ট! ওই যে গল্প আছে? যাত্রার আসরে রাম সেজে সীতার জন্য কান্নাকাটি করে-টরে বাড়ি ফিরে দরজা খুলতে দেরি হওয়ার জন্য বউকে হারামজাদি বলে এক লাথি!

এইসব কথাবার্তার পর সোমদেব উঠে আলো জ্বেলে দিলেন। কাঠের সিঁড়িতে একটু শব্দ শুনিনি। অথচ কেউ ঘরে ঢুকল। চোখ জ্বলে দেখে। রবিঠাকুরের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের সেই মহিলা একেবারে। টানা দুটি চোখে কী এক বিহ্বলতা। খোঁপা যেমন-তেমন করে বাঁধা। পরনে ফিকে নীল হাল্কা ডোরাকাটা শাড়ি। কর্নেলকে নমস্কার করলেন–নাকি করল বলব? মেয়েদের বয়স আমি কিছুতেই আঁচ করতে পারি না। তবে পঁচিশের বেশি হওয়া অসম্ভব।

কর্নেল বললেন বসুন।

–আমার নাম রমা। আপনি নাম ধরে ডাকবেন এবং তুমি বলবেন।

 সোমদেব হাসতে হাসতে বললেন–হ্যাঁ। আপনার মেয়ের বয়সী। আমি সময়মতো বিয়ে করলে আমার মেয়েও এই বয়সের হত। বউমা, তুমি বসে কথা বলো।

কর্নেল সোমদেবের দিকে তাকিয়ে আস্তে বললেন–যদি কিছু মনে না করেন, আমি একটু নিরিবিলি কথা বলতে চাই।

সোমদেব ব্যস্তভাবে বললেন–অবশ্যই।

রমা বললেন–দুলালদাকে আমি একটু বাইরে পাঠিয়েছি। আপনি টিংকুকে একটু বকে দিন তো গিয়ে। ডাকলাম। এল না। শিশিরে ঠাণ্ডা বাধিয়ে বসবে।

সোমবাবু ছড়ি হাতে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন –আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।

রমা একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন–জানি। আপনাদের দুজনই আমার পরিচিত।

কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন কী করে?

দুর্গাপুরে থাকার সময় আমি দৈনিক সত্যসেবক পড়তাম। এখানে এসে কাগজ পড়ার অভ্যাস চলে গেছে।

কর্নেল হাসলেন। জয়ন্ত, তোমার একজন পাঠিকার দর্শন পেলে! চলে এস এখানে। রমা একটু ইতস্তত করে বললেন–আমার কিছু কথা আছে। এক মিনিট। সিঁড়ির নীচের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি।

রমা বেরিয়ে তেমনই নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। কর্নেলের দিকে তাকালাম। দেখলাম বৃদ্ধ রহস্যভেদী টাকে হাত বুলোচ্ছেন। চোখ বন্ধ।

এ ঘরটার সঙ্গে দোতলার কোনও ঘরের সম্পর্ক নেই। দক্ষিণে ছোট্ট ব্যালকনি, পশ্চিমে দুটো বড়ো জানলার নীচে সেই জংলি ফুলবাগান, উত্তরে দরজার পর কাঠের সিঁড়ি এবং পুবদিকটায় নিরেট দেয়াল। সেদিকেই বাড়ির দরজা বা জানালা আছে কি না কে জানে।

রমা এসে উত্তরের দরজাটাও বন্ধ করে একটা চেয়ারে বসলেন। ঘরের দুধারে দুটো সিঙ্গল খাট। একটায় আমি বসলাম। কর্নেল চোখ খুলে বললেন– তুমি গত রাতে কমলেশ আর নন্দকে বাগানের দিকে যেতে দেখেছিলে?

রমা চাপাস্বরে বললেন–হ্যাঁ। তবে শুধু গতরাতে নয়, দশমীর রাতেও দেখেছিলাম।

–ওদের কাকেও জিজ্ঞেস করোনি সে সম্পর্কে?

-নন্দকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলেছিল, ‘জামাইবাবু নদীর ধারে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। আমিও গেলাম। ওদিকে একটা দরজা আছে। নদীর ধারে যাওয়া যায়। বাঁধানো একটা ঘাট আছে। রমা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন–গতরাতে টিংকুর বাবা বাড়ি ফিরল না। খবরও পাঠায়নি। তাই ঘর-বার করছিলাম। তো জানালা দিয়ে দেখি, দুজনে বাগানের দিকে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, খিড়কি দিয়ে নদীর ঘাটে বেড়াতে যাচ্ছে।

–তোমার শ্বশুরমশাইয়ের কোন সাড়া পাচ্ছিলে?

নাহ্। কদিন থেকে ওঁকে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দিই। উনি ঘুমিয়ে পড়েন।

কমলেশ তো ওঁর পাশের ঘরে শোয়।

হ্যাঁ। বাবামশাইয়ের ঘর থেকে ওর ঘরে যাওয়া যায়। আমার ননদ বেঁচে থাকার সময় ওরা দোতলায় থাকত। শেষের দিকে ঝগড়াঝাটিতে অতিষ্ঠ হয়ে জামাইবাবু নীচের ওই ঘরে এসে শুত।

–সেইসময় ব্রোঞ্জের সিল চুরি যায়?

-হ্যাঁ। বাবা বলছেন সিল চুরি যাওয়ার কথা। আমি ও-ঘরে তেমন কিছু দেখিনি।

–কিছু মনে কোরো না। তোমার এডুকেশন?

–পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে য়ুনিভার্সিটিতে পড়ছিলাম। হঠাৎ বাবা মারা গেলেন। তারপর একটার পর একটা বিপদ। মামাবাবু দুর্গাপুরে ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ে লাগিয়ে দিলেন।

–গতরাতে তুমি কমলেশ আর নন্দকে বাগানে যেতে দেখেছিলে। তখন কটা বাজে?

–ঘড়ি দেখিনি। তবে এগারোটা হবে। রমা গলার স্বর আরও নামিয়ে বললেন–পুলিশকে যেটা বলিনি, আপনাকে বলছি। আমার ঘুম আসছিল না। টিংকুর বাবা ফিরলে ফটকের ওদিকে হর্ন বাজাবে। তখন নন্দ যদি ঘুমিয়ে পড়ে, ফটক কে খুলবে ভেবে জেগে ছিলাম। তারপর লোডশেডিং হয়ে গেল। হেরিকেন জ্বেলে দম কমিয়ে জানলার কাছে গেলাম। বাইরে পরিষ্কার জ্যোৎস্না। হঠাৎ দেখি জামাইবাবু পালিয়ে আসার মতো ছুটে আসছে। তারপর ওঁর ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনলাম।

–গিয়ে খোঁজ নিলে না কেন?

রমা চুপচাপ কিছুক্ষণ আঙুল খুঁটে মুখ তুললেন। ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বললেন তখন জামাইবাবু যে পালিয়ে আসার মতো ছুটে আসছে সেটা কিন্তু তত মনে হয়নি। মানে, গুরুত্ব দিইনি। হয়তো তাড়াতাড়ি ফিরছেন। তবু একবার মনে হয়েছিল, বেশ জোরেই আসছেন–ব্যাপারটা যেন একটু অস্বাভাবিকও। কিন্তু ভোরে নন্দের সাড়া না পেয়ে ওর ঘরে গিয়ে দেখি, দরজা বাইরে থেকে আটকানো। ভেতরে সে নেই। খটিয়ায় বিছানা গুটোনো। তখন ভাবলাম বাথরুম করতে বেরিয়েছে। সাতটা বাজল। তখনও পাত্তা নেই ওর। টিংকুর জেঠুকে চা দিতে গিয়ে কথাটা বললাম। উনি গ্রাহ্য করলেন না। বাবামশাইকে চা দিয়ে এলাম। দেখলাম, আজ একটু যেন স্বাভাবিক হাবভাব। জামাইবাবুর দরজায় টোকা দিলাম। বাবামশাই বললেন–ঘুমোক। ওকে ডিসটার্ব কোরো না। সাড়ে সাতটায় টিংকুর বাবা এল। বলল, কী সব ধান-টান পেকেছে। চোরের উপদ্রব। আমার ধারণা–

রমা হঠাৎ চুপ করলে কর্নেল বললেন,–হুঁ বলো।

ড্রাংক হয়ে পড়েছিল। রমা একটু ফুঁসে উঠলেন। ওই দুলালদাকে দেখছেন, সে-ও একই দলের লোক। সেও গতরাতে বাড়ি ফেরেনি।

নন্দের বডি কখন দেখতে পেলে তোমরা?

লক্ষ্মী নামে একটা মেয়ে এসে সারাদিন কাজ করে। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি চলে যায়। ও আসে সকাল আটটা নাগাদ। আজ ফটকে ঢুকেই নাকি বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিল। আসলে ওর ব্যাপারটা বুঝি। আমার ননদ সুইসাইড করার পর থেকে ওর চোখ সবসময় বাগানের দিকে থাকে। সন্ধ্যার আগেই কেটে পড়ে। বুঝতেই পারছেন, প্রচণ্ড সুপারস্টিশন ওদের। কতদিন বানিয়ে বলেছে আমাকে, আমগাছটার তলায় নাকি দিনদুপুরে একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। আজও ওর কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু লক্ষ্মী কান্নাকাটি করে বলতে লাগল। টিংকুর জ্যাঠা বললেন, দেখাই যাক না অমন করে বলছে যখন। :

–সোমদেববাবু গিয়ে দেখতে পেলেন?

হ্যাঁ। টিংকুর বাবাও দৌড়ে গেল। আমি দূর থেকে একটু দেখেই চলে এলাম। ওঃ!

রমা শিউরে ওঠার ভঙ্গি করলেন। কর্নেল বললেন–তখন কমলেশ কোথায় ছিল?

–ঘরে ছিল না। আমরা অবশ্য কেউই লক্ষ্য করিনি। পুলিশ এসে বডি নিয়ে গেল। তখনও ওকে দেখিনি। দুলালদা এসে বলল, বাজারে একটা স্টেশনারি দোকানে বসে আছে। ঘণ্টা দুই পরে আবার পুলিশ এল। তখন শুনলাম, ডাক্তার পিঠে ইঞ্জেকশনের চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। পুলিশ হলঘরে প্রত্যেককে আলাদা ডেকে জেরা করল। আমি জামাইবাবুর সঙ্গে নন্দের যাওয়ার কথাটা শুধু বললাম। ওর পালিয়ে আসার ব্যাপারটা বললাম না। রমার চোখে জল এসে গেল। মুখ নামিয়ে বললেন–ওর জন্য আমার কষ্ট হত। এখনও হচ্ছে। আমার ধারণা, কমলেশ কখনও নন্দকে মার্ডার করেনি। তা ছাড়া ও রোগী মানুষ। নন্দকে গাছের ডালে ঝোলানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়।

আমি বললাম–সঙ্গে লোকজন থাকতে পারে!

রমা জোর দিয়ে বললেননন্দকে কেন মারবে জামাইবাবু তা ছাড়া আমি এখন সিওর, আমার ননদকেও একইভাবে কেউ মেরে গাছে ঝুলিয়েছিল। এ একই লোকের কাজ।

কর্নেল বললেন–সে কে হতে পারে?

–জানি না। আপনি খুঁজে বের করুন। আমি জানি, আপনি তা পারবেন

 –পারমিতার ডেডবডি কে প্রথম দেখতে পেয়েছিল?

–জামাইবাবু। ও মাঝেমাঝে বাগানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকত।

–নন্দকে কেন মারা হল বলে তোমার ধারণা?

 একটু চুপ করে থেকে রমা খুব আস্তে বললেন–নন্দ হয়তো টের পেয়েছিল কে টিংকুর পিসিকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে। তাই তার মুখ বন্ধ করা হল।

পারুকে কেন মারা হয়েছে? মানে, তোমার কী ধারণা?

–আমি কথাটা ভেবেছি। কোনও উত্তর খুঁজে পাইনি। তবে….

তবে?

জামাইবাবু হয়তো জানে। না জানলেও ওর একটা আইডিয়া থাকতে পারে। কারণ পারুর মৃত্যুর পর একদিন কথায় কথায় আমাকে বলেছিল, পারু আর যা-ই করুক, মরার ইচ্ছে ওর ছিল না। অথচ ওকে মরতে হল। এটাই কি নিয়তি বউদি? জামাইবাবু আমাকে বউদি বলে।

–তুমি কী বলেছিলে ওকে?

-কী বলব? আসলে তখন ওসব কথার আলাদা কোনও মানে খুঁজিনি। জাস্ট কথা। এখন মানে খুঁজে পাচ্ছি।

–পারুর মৃত্যুতে তোমার শ্বশুরমশাইয়ের কী রিঅ্যাকশন হয়েছিল?

 –প্রচণ্ড শক পেয়েছিলেন। চুপচাপ বসে থাকতেন। সেই প্রথম পাগলামির লক্ষণ শুরু হল। আমার ধারণা, সিল চুরি ওঁর ইমাজিনেশন। লোকাল ডাক্তার বলেছেন, শিজোফ্রেনিয়া। তাই টিংকুর জেঠু সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়েছিলেন।

কর্নেল এতক্ষণে চুরুটের কেস থেকে একটা চুরুট বের করে ধরালেন। তারপর বললেন–আমি এখনও বুঝতে পারছি না কেন সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ ঘোষ সোমদেববাবুকে আমার কাছে পাঠালেন। আচ্ছা, তুমি কি জানো ডঃ ঘোষ এখানকার লোক?

–শুনেছি।

কর্নেল চোখ বুজে বললেন–পারুর অমতে কমলেশের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। জানো কি?

–হুঁ।

–অমতের কোন বিশেষ কারণ ছিল?

রমা মুখ নামিয়ে আস্তে বললেন কাঞ্চন নামে একটা ছেলের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল। ছেলেটাকে আমি বার দু-তিন দেখেছি। মস্তানটাইপ বাজে ছেলে। হাফ এডুকেটেড। তবে ওর বাবার বড় বিজনেস আছে ট্রান্সপোর্টের। কলকাতার একটা মেয়েকে এলোপ করে এনেছিল। পুলিশকেস হয়েছিল। মিটে গেছে.. শুনেছি।

মেয়েটি?

–এখন ওর বউ। কাঞ্চনের বাবা মেনে নিয়েছেন।

-তোমার শ্বশুরমশাই সিল হারানোর ব্যাপারে নাকি বলেন, পারু সব জানে। তাকে ডাকো।

-হ্যাঁ। প্রায়ই বলেন। উনি বিশ্বাস করেন না পারু মারা গেছে।

আমি বললাম কিন্তু সোমদেববাবু বলেছিলেন, পারুর একটা নিজের হাতে লেখা সুইসাইডাল নোট পাওয়া গিয়েছিল?

রমা আমার দিকে তাকালেন। একটু পরে বললেন–সেই কথাটাই কর্নেলসায়েবকে গোপনে বলতে চাই। আমি পারুর হাতের লেখা চিনি। ও লেখা পারুর হাতে লেখার মতো। কিন্তু কিছুতেই পারুর নয়।

কর্নেল বললেন–নয় বলছ?

-নাহ্। লোকাল পুলিশের ব্যাপার তো জানেন। তাড়াহুড়ো করে সব হাশ আপ করতে চায়।

তুমি এ কথা কাকেও বলেছিলে?

টিংকুর বাবাকে বলেছিলাম। বিশ্বাস করেনি।

–আর কাকেও?

নাহ্। টিংকুর বাবা নিষেধ করেছিল। বাড়িতে অশান্তি শুরু হত।

–চিঠিটা কোথায় আছে জানো?

পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল।

–পুলিশ পারুর লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেনি ওটা?

–জানি না। রমা উঠে দাঁড়ালেন। –আপনি খুব কফির ভক্ত জানি। জয়ন্তবাবুর ফিচারে পড়েছি। কফি পাঠিয়ে দিই।

কর্নেল হাসলেন। –দিতে পারো। তো একটা কথা। এই যে তুমি নীচের দরজা বন্ধ করে আমার সঙ্গে কথা বললে, এত সতর্কতার কি বিশেষ কোনও কারণ আছে?

–দুলালদার খুব আড়িপাতার অভ্যাস আছে। তা ছাড়া আমি… একটু ইতস্তত করে রমা খুব আস্তে বললেন–টিংকুর জেঠু সম্পর্কে সিওর নই। মানে, ওঁর হাব ভাব চালচলন আমার কেমন অস্বাভাবিক লাগে। উনি থিয়েটারের লোক। কখন অভিনয় করছেন, কখন করছেন না। আমি বুঝতে পারি না।

–আর দুটোমাত্র প্রশ্ন করব তোমাকে।

করুন না!

–তোমার স্বামী কোন ডিপার্টে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন?

ইরিগেশন।

 –হঠাৎ চাকরি ছেড়ে এখানে এসে চাষবাসে মেতে উঠলেন কেন জানো?

বাবামশাই চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, টিংকুর জেঠু দুলালদাকে দিয়ে চাষ করাচ্ছেন। বর্গাদারের নাম বসানো ঠেকানো গেছে বটে; কিন্তু ওঁর সন্দেহ, ভেতরে-ভেতরে কিছু জমিও বেচে দিয়েছেন। এজমালি প্রপার্টি’ না কী বলে যেন। বণ্টন হওয়ার আগে এভাবে কোনও শরিক নাকি আইনত জমি বেচতে পারে না। তা ছাড়া মেজভাসুরেরও অংশ তো আছে। টিংকুর বাবার কাছে। শুনেছি, ওর ঠাকুরদার উইলে তিরিশ একর লেখা আছে। সেটা ঠেকেছে পঁচিশ একরে। তবে ভাইদের মধ্যে বনিবনা আছে। টিংকুর বাবার দাদার বিরুদ্ধে কিছু বলেনি।

–এই বাড়িটা তোমার শ্বশুরমশাইয়ের নামে দেওয়া আছে?

 রমা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন–যত গণ্ডগোল এই বাড়ি। বাবামশাই নাকি মাস তিনেক আগে আমার ননদ আর জামাইবাবুর নামে এই বাড়ি উইল করে দিয়েছেন। সত্যিমিথ্যা জানি না। টিংকুর বাবা কার কাছে শুনেছিল। তবে এনিয়ে প্রকাশ্যে কোনও অশান্তি হয়নি। বাবামশাইকে দুই ছেলেই এ নিয়ে চার্জ করেনি। করলে জানতে পারতাম। আপনি যেন দয়া করে ও ব্যাপারে আমার নাম করবেন না। তা হলে…

কর্নেল হাত তুলে ঋষিসুলভ বরাভয়ের ভঙ্গিতে বললেন, হুঁ কফি।

রমা চলে গেলেন। একটু পরে আমি বললাম–দ্য মিস্ট্রি ইজ সলভড বস্!

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন কী ভাবে?

সোজা হিসেব। এতবড় একটা বাড়ি। চারদিকে বিশাল জায়গা। নির্ঘাত কয়েক লাখ টাকার সম্পত্তি। আজকাল মানুষের যা ব্যাপার স্যাপার, ভাই-বোন রক্তের সম্পর্কের চেয়ে প্রপার্টির মূল্য অনেক বেশি। দুই ভাই মিলে চক্রান্ত করে বোনকে মেরে বোনের স্বামীকে ফাঁসানোর জন্য শেষে নন্দকে মেরেছে। নন্দ নিশ্চয়ই ব্যাপারটা জানত। তারপর এই ভদ্রমহিলাকে দিয়ে গত রাতের গল্পটা সাজিয়েছে। মেয়েরা জন্ম অভিনেত্রী। সোজা ব্যাপার।

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। সোজা ব্যাপার আর রইল না ডার্লিং! রহস্য আরও জটিল হল।

কাঠের সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছিল। তাই চুপ করে গেলাম। শান্তিদেব এলেন এবার।….

.

০৩.

শান্তিদেব বললেন–ফার্মে গিয়েছিলাম। আজকাল চোরের বড় উপদ্রব। এক। জাতের হাই-ইল্ডিং ভ্যারায়টির ধান বেমরশুমে ফলে। কাঁটাতারের বেড়া কেটে চোর ঢুকেছিল পরশু রাতে। বলছি বটে চোর, ব্যাপারটা ঈর্ষাজনিত শত্রুতা। যাইহোক, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো আপনাদের?

কর্নেল বললেন–একটুও না। আপনার স্ত্রী আমার ফ্যান। জানেন কি?

–জানি মানে? শান্তিদেব হাসলেন। বড়দা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাচ্ছে শুনে রমাই আমাকে আপনার কথা সাজেস্ট করল। সমস্ত ব্যাপারটা মিসটিরিয়াস– আই মিন, সিলচুরি এবং বাবার অদ্ভুত পাগলামি। তো দুজনে কনসাল্ট করে বড়দা রওনা হওয়ার আগেই আমি ডাঃ ঘোষকে ট্রাঙ্ককল করে অনুরোধ করলাম, বড়দা গেলে উনি যেন তাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেন। ফোনগাইডে নিশ্চয়ই আপনার ঠিকানা পাওয়া যাবে, সে-কথাও বললাম।

–আই সি।

আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে দেখুন, তারপর মিস্ট্রিটা সাংঘাতিক জটিল হয়েও গেল। আপনি আসছেন, এদিকে নন্দ মার্ডার হয়ে গেল। রমা ইজ ইনটেলিজেন্ট। মেয়েদের যে সত্যিই অন্য একরকম ইনটুইশন আছে, আই বিলিভ ইট।

–আপনার স্ত্রীর বিশ্বাস, তার ননদকেও কেউ একইভাবে খুন করে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল।

শান্তিদেব গোঁফ চুলকে একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন–এখন আমাদেরও তাই মনে হচ্ছে। কমলেশকে সন্দেহ করা ছাড়া কোনও উপায় থাকছে না।  আরও বড় কথা, কমলেশকে লোকাল পলিটিক্যাল পার্টির এক মাতব্বর মানিক চ্যাটার্জি ডিফেন্ড করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, কমলেশের পেছনে দলবল আছে। বডি গাছে ঝোলানোর মতো লোকের অভাব থাকছে না তা হলে। বলুন পয়েন্টটা কারেক্ট কি না?

কর্নেল আস্তে বললেন–হুঁ। দ্যাটস পসিবল।

শান্তিদেব জোর দিয়ে বললেন–রিলায়েবল সোর্সে জেনেছি, বাবা পারু এবং কমলেশের নামে এই বাড়ি সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি-সহ উইল করে রেখেছেন। শর্ত হল, বাড়িটা মিউজিয়াম হবে এবং একাংশে ওরা দুজনে বসবাস করতে পারবে। কমলেশ হবে মিউজিয়ামের কিউরেটর ইত্যাদি। এদিকে মানিক চ্যাটার্জিরাও এটা চাইছিল অনেকদিন থেকে। বাবাকে ওরাই তাতিয়েছে বরাবর। সো কমলেশের মোটিভ ইজ ক্লিয়ার।

–আপনার স্ত্রীর মতে, সুইসাইডাল নোটের লেখা আপনার বোনের নয়।

 শান্তিদেব নড়ে বসলেন। হ্যাঁ রমা আমাকে বলেছিল কথাটা। আমি পাত্তা দিইনি। কারণ পারু হিস্টেরিক টাইপ মেয়ে। ওর বিয়েটা বাবা জোর করে দিয়েছিলেন বলা যায়। বড়দা তো থিয়েটারপাগল মানুষ। ইন্টারফেয়ার করেনি। আমি তখন দুর্গাপুরে। এনিওয়ে, সুইসাইড করার আগে হাতের লেখা অন্তত পারুর মতো মেয়ের পক্ষে একটু অন্যরকম হতেই পারে। তাড়াহুড়ো করে লেখা আঁকাবাঁকা হরফ।

আমি বললাম–মর্গের ডাক্তারের কোনও সন্দেহ হয়নি, এটা অবাক লাগছে। শান্তিদেব একটু চুপ করে থেকে বললেন-মফস্বলের মর্গের অবস্থা আপনি জানেন না। ডোমই বডি কাটাছেঁড়া করে। ডাক্তার দায়সারাভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। সুইসাইড না সুইসাইড! তো নতুন ডাক্তার ভদ্রলোক ইয়ংম্যান। ভেরি পার্টিকুলার সব ব্যাপারে। আলাপ করে মনে হল, ডাক্তারিটা চাকরি হিসেবে নেননি এবং প্রফেশনের ব্যাপারে হি ইজ অ্যামবিশাস।

কর্নেল বললেন–আপনার দাদা বলছিলেন, বাবা পাগল হয়ে গেলে আপনারা নাকি ভেসে যাবেন। হোয়াটস দ্যাট?

শান্তিদেব গম্ভীর হয়ে বললেন–দাদা বলেছে আপনাকে?

–হ্যাঁ।

 শান্তিদেবকে বিস্মিত দেখাচ্ছিল। বললেন–কেন এ কথা দাদা বলেছে বুঝতে পারছি না। ঠাকুর্দা অতসব ধানী জমি আমাদের তিন ভাই-বোনকে দিয়ে গেছেন। রন্তুদা সম্ভবত আমেরিকায় থেকে যাবে। পারু বেঁচে নেই। কাজেই সব জমি দাদা আর আমার হাফ-হাফ শেয়ার। ভেসে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

আমি বললাম–তা হলে হয়তো এই বাড়ির ব্যাপারেই কথাটা বলেছেন আপনার দাদা।

শান্তিদেব আমার দিকে তাকালেন। বাবার উইলের ব্যাপারটা নিয়ে দাদার সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। বাবা পাগল হয়ে গেলে তো উইলের এগেনস্টে স্ট্রং লিগ্যাল অপজিশন দাঁড় করানো সহজ হবে। শান্তিদেব মাথা দোলালেন। –থিয়েটারের নেশা দাদার মাথাটা খেয়েছে। কী বলতে কী বলেন। জানেন? আমাদের বংশটাই বাতিকগ্রস্ত। কেউ ছিলেন গাছপাগলা। কেউ ধর্মপাগল। কেউ সর্বস্বান্ত হয়ে সমাজসেবী। এদিকে বাবা আর্কিওলজি-পাগল। দাদা থিয়েটারপাগল। আর আমি হলাম চাষপাগল।

শান্তিদেব হেসে ফেললেন। সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছিল। দুলালবাবু আরেকবার কফি নিয়ে এলেন। শান্তিদেব বললেন–তুমি এখনও ফার্মে যাওনি?

দুলালবাবু বললেন–যাচ্ছিলাম। বউদি বললেন স্যারদের কফি দিয়ে যেতে।

–শিগগির চলে যাও। দেরি কোরো না। রমা আমাকে বললেই পারত।

দুলালবাবু চলে গেলেন। কর্নেল বললেন–আপনি গতরাতে ফার্মে ছিলেন?

–হ্যাঁ। নিজে না থাকলে চলে না–আজকাল কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন। আজ রাত্রেও থাকার কথা ছিল। রমা নিষেধ করল। আপনারা এসেছেন। দাদা এইমাত্র থিয়েটারক্লাবে চলে গেল। বড্ড ইরেসপনসিবল টাইপ।

–আপনার বাবা এখন কী করছেন?

দরজা বন্ধ আছে দেখে এলাম। বাবার যা কাজ! মিউজিয়ামের জিনিসপত্র নাড়াঘাটা, কিংবা একটা ভাঙাচোরা পুতুল হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকা আর বিড়বিড় করে প্রলাপ বকা।

কমলেশবাবুকে খুঁজছেন না, খোঁজেননি আজ?

খুঁজছিলেন নাকি। রমা বলেছে, কলকাতা গেছে। বাবার সঙ্গে এখন দেখা। করবেন?

–কোনও অসুবিধে না হলে…।

রমা ক্যান ম্যানেজ ইট। কফি খেয়ে নিন। রমাকে বলছি।

শান্তিদেব চলে গেলেন। কফি খেতে ইচ্ছে করছিল না। আসলে এ কফি কর্নেলের বাড়ির পারকোলেটারে তৈরি নির্ভেজাল কফি নয়। বাজারচলতি গুঁড়ো কফি। কিন্তু কর্নেলের কাছে কফি’ নামটাই যথেষ্ট। তারিয়ে-তারিয়ে খেতে খেতে বললেন–খাসা।

বাইরের দিকে তাকিয়ে বললাম–তার চেয়ে খাসা জিনিস আপনার মাদারনেচার ঝুলিয়ে দিয়েছে আকাশে। একেবারে ঢাকাই পরোটা।

ডার্লিং! নদীর শিয়রে চাঁদ প্রকৃতির এক অলৌকিক উপহার। ঢাকাই পরোটা নিছক লৌকিক জিনিস। খেতেও আহামরি নয়। কর্নেল কফির জাগ হাতে ব্যালকনিতে গেলেন।

আমিও গেলাম। গিয়েই চোখ পড়ল বাগানের গাঢ় ছায়ার ভেতর টর্চের আলো। আলোটা যেন সাবধানী। নীচে কয়েকবার কয়েকটি ছোট্ট আলোর বৃত্ত গড়ে নিভে গেল। বললাম–ওখানে কে কী করছে এখন?

কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না।

–শান্তিদেববাবু নাকি?

কর্নেল তবুও চুপ করে রইলেন।

 একটু বিরক্ত হয়ে বললাম ব্যাপারটা মিসটিরিয়াস কিন্তু!

হুঁঃ!

কী আশ্চর্য! ওই ভুতুড়ে জঙ্গলে আলো দেখে আপনার কিছু মনে হচ্ছে না?

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন–যতদূর জানি, ভূতেরা টর্চ ব্যবহার করে না।

–আহা, আমি তা বলছি না।

এবার নীচে বাঁদিকে পোর্টিকোর তলা থেকে জোরালো টর্চের আলো দেখা গেল। বাড়ির বাইরে কোনও আলোর ব্যবস্থা নেই। ঘাসেভরা লনের ওপর জ্যোৎস্নায় এতক্ষণে একটা মূর্তি বেরিয়ে এল। আলো ফেলতে ফেলতে সে জঙ্গলে বাগানের দিকে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিল। লোকটাকে চিনতে পারলাম। শান্তিদেব!

একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটতে চলেছে ভেবে বললাম কর্নেল। আমাদের যাওয়া উচিত। শান্তিদেববাবু বিপদে পড়তে পারেন। নিশ্চয় কোনও আউটসাইডারকে তাড়া করতে গেলেন উনি।

কর্নেল ঘরে গেলেন। কফির পাত্র রেখে চুরুট ধরিয়ে চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসলেন। মুখে নির্বিকার ভাব।

ঘরে ঢুকে ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর দেখি, বৃদ্ধ রহস্যভেদী দাড়িতে হাত বুলোচ্ছেন। চোখদুটি বন্ধ। এমন অবস্থায় কী আর করা যাবে, হতাশভাবে বসে পড়লাম।

বেশ কিছুক্ষণ পরে দরজায় রমাকে দেখা গেল। আশ্চর্য ব্যাপার! ভদ্রমহিলা এমন নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারেন। পুরনো কাঠের সিঁড়িকেও ওঁর পা চুপ করিয়ে রাখে কী কৌশলে? তারপর ওঁর পায়ের দিকে চোখ পড়ল। খালি পায়ে হাঁটেন দেখছি। তাই এমন নিঃশব্দ চলাফেরা।

রমা আস্তে বললেন–বাবামশাইয়ের অদ্ভুত ব্যাপার। কখন বেরিয়ে বাগানে ঢুকেছিলেন লক্ষ্য করিনি। টিংকুর বাবা ধরে নিয়ে এল।

কর্নেল তাকালেন।

–আপনি কথা বলবেন বলেছেন। আসুন। একটু স্বাভাবিক মনে হচ্ছে এখন।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আমার কী পরিচয় দিয়েছেন ওঁকে?

রমা একটু আড়ষ্ট হেসে বললেন–আমি বললাম আরকিওলজিস্ট। কাগজে আপনার আবিষ্কারের খবর পড়ে আলাপ করতে এসেছেন। শুনে বাবমশাই বললেন, আর্কিওলজি ব্যাপারটাই গোড়ার দিকে মিলিটারি অফিসারদের একচেটিয়া ছিল। ওঁরাই সাইট এক্সক্যাভেশন, ফিল্ডরিসার্চ করতেন। ওঁকে নিয়ে এস।

সিঁড়িতে নামতে নামতে বললাম বাগানে উনি কী করতে গিয়েছিলেন?

হঠাৎ নাকি ওঁর ভয় হয়েছিল পারুর মতো কমলেশও সুইসাইড করছে। তাই তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। আমরা নাকি বানিয়ে বলেছি, কলকাতা গেছে। টিংকুর বাবা জোর করে নিয়ে এল বাগান থেকে। আসছিলেন না। তখন আপনার আসার কথা বলেছেন। অমনি উনি ইন্টারেস্টেড হয়ে উঠেছেন।

নীচের ঘরে নেমে কর্নেল হঠাৎ বললেন–তোমার ভাসুরমশাইয়ের হাতে সবসময় ছড়ি থাকে কেন জানো?

রমা যেন একটু চমকে উঠলেন। জানি না। তবে প্রায় মাসখানেক থেকে দেখছি ছড়িটা। খাওয়ার টেবিলেও সঙ্গে থাকে। হল ঘরে গিয়ে রমা অন্যমনস্কভাবে বললেন–এ বাড়ির যা অবস্থা, প্রায় সাপ বেরোয়। নন্দ একটা কেউটে মেরেছিল বর্ষার সময়। হয়তো সাপের ভয়েই উনি ছড়ি হাতের কাছে রাখেন। মানুষটা একটু ভীতুও।

হলঘরের ভেতরে একটা দরজা দিয়ে রমা আমাদের যেখানে নিয়ে এলেন, সেখানে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। পাশে সংকীর্ণ করিডর। ডানদিকের দরজায় পর্দা ঝুলছে। ভেতরে উজ্জ্বল আলো। রমা পর্দা ফাঁক করে বললেন– বাবামশাই! কর্নেলসায়েব এসেছেন।

রুগণ এবং ফাঁসফেঁসে গলায় সাড়া এল–স্বাগতম! সুস্বাগতম!

কর্নেল আগে ঢুকলেন। তার পেছনে আমি। ঘরটা বিশাল। প্রথমেই চোখে পড়ল এলোমেলো পাথর। আবর্জনার ভঁই। দেয়াল ঘেঁসে দাঁড় করানো সারিবন্দি আলমারিতে জরাজীর্ণ বই ঠাসা। আলামারিগুলোর মাথায় পাথর আর পোড়ামাটির ভাঙাচোরা অসংখ্য মূর্তি। বিবর্ণ তৈজসপত্র। এক কোনায় প্রকাণ্ড একটা সেকেলে খাট। খাটের পাশে একটা টেবিলের ওপর হাতখানেক উঁচুতে আলাদা একটা জ্বলন্ত শেড-ল্যাম্প ঝুলছে। টেবিল জুড়ে ভাঙাচোরা খেলনাপাতির মতো জিনিস। চশমার খাপ। একগাদা কলম। হোমিওপ্যাথির বাকসোর মত একটা বাকসো পর্যন্ত। খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন অবিকল সোমদেববাবুর বৃদ্ধ এক প্রতিমূর্তি। সন্ন্যাসীদের মত লম্বা চুল, পেল্লায় গোঁফ-সবই সাদা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়ে আছে মুখে। এক হাতে একটা আতসকাঁচ, অন্যহাতে একটা কালচে চাকতি। মনেমনে ভাবলাম, এ যে দেখছি কর্নেলেরই দোসর!

কর্নেল করজোড়ে নমস্কার করে কাছে গেলে জয়দেববাবু উঠে দাঁড়িয়ে ওঁর দুটো হাত চেপে ধরলেন। কর্নেলের মতোই মাথায় উঁচু। কিন্তু শীর্ণ আর একটু কুঁজো। বললেন–আমার এই মিউজিয়ামে বিশ্বের বড় বড় পণ্ডিতের পায়ের ধুলো পড়েছে। রন্তু! আমার মধ্যম পুত্র। আমেরিকায় থাকে। তার কাছে খোঁজ পেয়ে সব চলে আসেন। এই তো এক জার্মান সায়েব-মাথার চুল আঁকড়ে ধরে নামটা স্মরণের চেষ্টা করলেন।

কর্নেল বললেন–গ্যান্সলার?

–গ্যান্সলার! চেনেন আপনি?

 রমা বললেন বাবামশাই এঁদের বসতে বলুন।

 জয়দেব বললেন–আপনি কী যেন….

কর্নেল বললেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। এর নাম জয়ন্ত চৌধুরি। সাংবাদিক।

–কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য! হাসলেন জয়দেব। দাঁতগুলো বাঁধানো মনে হল। আমরা টেবিলের পাশে রাখা দুটো গদিআটা চেয়ারে বসলে ফের বললেন–ওরা সব বিরক্ত হয়। আমি বলি, মধু থাকলে মৌমাছি আসবেই। পালসাম্রাজ্যের স্মৃতিপিণ্ড! স্বচক্ষে দর্শন করুন। বাট আই হ্যাভ ডিসকভার্ড মোর দ্যান দ্যাট।

বলে লম্বা হাত ছড়িয়ে পাথুরে আবর্জনার দিকটা দেখলেন জয়দেব। কর্নেল বললেন–খরোষ্ঠীলিপির সিল?

–ইয়েস! আরও দেখাচ্ছি! জয়দেব এগিয়ে আলমারির পাশে রাখা একটা কালো কলসি নিয়ে এলেন–পালপুকুর খোঁড়ার সময় এটা পাওয়া গেছে। এই দেখুন, খরোষ্ঠীতে লেখা আছে বলে চোখে চশমা পরলেন। আমি পাঠোদ্ধার করেছি। ব্যপয় কোশা তার মানে সেচের পাত্র। কোটা মুছে গেছে। ওটা বোঝাই যায়। চলতি কথায় কোশা-কুশি বলি আমরা।

আমি না বলে পারলাম না–সেকালের লোকে কি জলের গ্লাসেও জলের গ্লাস লিখত?

–এনসিয়েন্ট ইন্ডয়ান আর্ট।

কর্নেল কী যেন ভাবছিলেন। আমি বললাম–এটা কত বছরের পুরনো?

জয়দেব বললেন–প্রায় দুহাজার বছরের। খরোষ্ঠীলিপির যুগ! মাইন্ড দ্যাট।

–পুকুরের তলায় পাওয়া গেছে?

–হ্যাঁ। জয়দেব সস্নেহে পাত্রটার গায়ে হাত বোলাতে লাগলেন।

–এটা মাটির তৈরি?

–হ্যাঁঃ।

— হাজার বছরের মাটির কলসি পুকুরের তলায় এমন আস্ত থেকে গেছে?

 জয়দেবের চোখদুটো জ্বলে উঠেছিল। দ্রুত কর্নেল বললেন–এটা সাংবাদিক সম্মেলন নয়, জয়ন্ত! তাছাড়া আর্কিওলজির ছাত্রও তুমি ছিলে না। ওই লিপিই প্রমাণ দিচ্ছে–এনিওয়ে! জয়দেববাবু, আপনি এর আগেও নিশ্চয় সাংবাদিকদের পাল্লায় পড়েছেন?

জয়দেব খিক খিক করে হাসলেন। পড়েছি। আই নো দেম ওয়েল। ইয়েস! আস্কস্ মি কোয়েশ্চনস!

–আপনার মিউজিয়াম থেকে খরোষ্ঠীলিপির একটা ব্রোঞ্জ সিল হারিয়েছে শুনলাম?

জয়দেব কলসিটা টেবিলে সাবধানে রেখে চোখ থেকে চশমা খুললেন। হঠাৎ তাঁকে অত্যন্ত দুঃখিত মানুষ মনে হল, ফিসফিস করে বললেননন্দ চোর! তেমনি ফিসফিস করে কথাটা উচ্চারণ করলেন জয়দেব–একের নম্বর চোর

-নন্দ কি এবাড়ির সারভ্যান্ট?

–পারু, আমার মেয়ে পারু সব জানে। ওকে ডাকি।

 জয়দেব ব্যস্তভাবে খাট থেকে উঠে দাঁড়ালে কর্নেল বললেন–আপনি বসুন। আমি আপনার মেয়ের কাছে জেনে নেব’খন।

জয়দেব বসলেন! হতাশভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন–তাকে পাচ্ছেন কোথায়? শি ইজ ডেড।

তাই বুঝি?

–ডেড। বাট শি স্পিকস টু মি। এই তো গতরাতে… নাহ্। আপনি কর্নেল?

–হ্যাঁ। রিটায়ার্ড।

জয়দেবের মুখে সামান্য পাগলামির লক্ষণ ফুটে উঠল। বিড় বিড় করে বললেন–সিলটাতে লেখা ছিল ‘য়েন্ন দাদভঃ’। প্রাকৃত ভাষা। সংস্কৃত করলে কথাটা হবে ‘যেন দাদভঃ’। বাকি লেটারগুলো পড়তে বাকি ছিল… পালরাজারা বৌদ্ধ। বৌদ্ধরাই খরোষ্ঠীলিপি ব্যবহার করত। আর্লি প্রাকৃত ওয়াজ পালি।

জয়দেববাবু!

 নন্দ সিল চুরি করবে কেন? ওটা নিয়ে কী করবে সে?

 জয়দেববাবু একটু চুপ করে থাকার পর স্বাভাবিক হলেন। ফিসফিস করে বললেন-সায়েবকে বেচেছে। সায়েব–কী যেন নাম?

–গ্যান্সলার।

–গ্যান্সলার বলেছিলেন মিউনিখ মিউজিয়াম পাকিস্তান থেকে একটা খরোষ্ঠী সিল কিনেছে ফর্টি থাউজ্যান্ড ডয়েটস মার্কে। স্মাগলিং র‍্যাকেটের গ্লু দিয়ে কিনেছে।

নন্দ আজ কোথায় আছে জানেন?

বউমা বলছিল, গতরাতে পালিয়ে গেছে। সোমুকে দিয়ে থানায় খবর দিয়েছে।

–আপনি ঘুম থেকে কখন ওঠেন?

সাড়ে সাতটা। আগে ছটায় উঠতাম। ইদানীং কেন যেন ঘুম ভাঙে না।

 –আজ সকালে বেরিয়েছিলেন?

–বেরিয়েছিলাম কি না জিজ্ঞেস করছেন? নাহ্। আর আমার বেরুনোর যো নেই। সব চুরি হয়ে যাবে। আর আমি কাউকে বিশ্বাস করি না বউমাকেও না। এই যে আপনারা বসে আছেন, আমি কিন্তু নজর রেখেছি।

জয়দেব ফিক ফিক করে হাসতে লাগলেন।

সারাটা দিন কী করলেন ঘরে বসে?

একটা বাঁধানো মস্ত খাতা দেখিয়ে জয়দেব বললেন–মিউজিয়ামের প্রত্যেকটা জিনিসের তালিকা করছি। আইটেম নাম্বার, ডেসক্রিপসন, আনুমানিক পিরিয়ড, প্লেস অব ডিসকভারি অ্যান্ড রিমার্কস! ফোর হানড্রেড থার্টি সেভেন পিসেস অব আর্কিওলজিক্যাল অবজেক্টস। মাইনাস ওয়ান–ওই ব্রোঞ্জ সিলটা।

–আপনার এই মিউজিয়ামের উত্তরাধিকারী কাকে ঠিক করেছেন?

কমলেশ। আ ব্রিলিয়ান্ট বয়। আমার হাতে গড়া ছাত্র। আপনি জানেন আমি সারাজীবন শিক্ষকতা করেছি?

–শুনেছি। আপনি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। কমলেশবাবু আপনার জামাই, তা-ও শুনলাম।

জয়দেববাবু ফিস ফিস করে বললেন–আমার মেয়ে-জামাইয়ের নামে মিউজিয়ামসুদ্ধ গোটা বাড়িটা উইল করে রেখেছি।

–আপনার মেয়ে তো বেঁচে নেই।

–আত্মা অমর। শি স্পিকস্ টু মি।

 জয়দেববাবু পাঞ্জাবির একটা আস্তিনের ভেতর বাঁহাত ঢুকিয়ে বাহু চুলকোতে থাকলেন।

কর্নেল বললেন–আপনি কি কোনও ডাক্তারকে দিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা করান?

জয়দেব বিকৃতসুরে বললেন–ওই যে নাড়ু ডাক্তার আছে। ইঞ্জেকশন দেয় মাসে একটা করে। চুলকোচ্ছে।

–অসুখটা কী?

–পালগড় মাউন্ড এক্সক্যাভেশন আমি নিজের খরচায় করিয়েছি, জানেন? কী কী করেছি শুনুন। জয়দেব বাঁধানো খাতাটার দিকে হাত বাড়ালেন।

কর্নেল ফের বললেন–আপনার অসুখটা কী?

এক্সক্যাভেশন সাইটে সুপারভাইজ করছিলাম। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম।

–এনি সর্ট অব নার্ভাস ব্রেকডাউন?

–আই অ্যাম দ্য ম্যান অব স্ট্রং নার্ভ। পঁচাত্তর পেরিয়ে ছিয়াত্তরে পড়েছি। এখনও দৌড়ুতে পারি।

–ডাক্তারবাবু কি স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দিচ্ছেন?

 ড্রয়ার থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ বের করে দিলেন জয়দেব।

নাডুগোপাল মিত্তিরের চিত্তির! স্কুলে আমার সহপাঠী ছিল। অঙ্কে আর সায়েন্সে গোল্লা পেত। কী করে যেন ডাক্তার হয়ে গেল!

প্রেসক্রিপশন দেখে কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। স্টেরয়েড। কিন্তু স্টেরয়েড বিপজ্জনক।

জয়দেব হাসলেন–আর নিই না ইঞ্জেকশন। নাড়ু এলেই দরজা আটকে দিই।

–আপনার বউমা ট্যাবলেট খাওয়ান রাত্রে?

–হ্যাঁ ট্যাবলেটটা ভাল। ইনসমনিয়া সেরে গেছে।

–ওটা খাবেন। কিন্তু ইঞ্জেকশন আর নেবেন না।

বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। জয়দেব বললেন–চলে যাচ্ছেন? দেখার মত জিনিস দেখে যান।

–আমি আছি। সকালে দেখব’খন।

জয়দেব আমার উদ্দেশে বললেন কাগজের লোক আপনি?

 বললাম–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–আপনি কোন কাগজের?

-দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা।

কী আশ্চর্য! এতক্ষণ বলবেন তো! আপনাদের কাগজই প্রথম আমার আবিষ্কারকে অনার দিয়েছিল। কাটিং দেখাচ্ছি।

রমা সম্ভবত বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘরে ঢুকে বললেন–সকালে দেখাবেন। ওঁরা টায়ার্ড। কলকাতা থেকে একটু আগে এসেছেন।

জয়দেব কর্নেলের দু’হাত জড়িয়ে ধরে বললেন–আমার সৌভগ্য! মেজর—

কর্নেল বললেন কর্নেল নীলাদ্রী সরকার।

-সরি! কর্নেলসায়েবকে ঠিক মতো যত্নআত্তি করো বউমা! রাতবিরেতে দরকার হলে পারু আছে। ডাকলেই সাড়া পাবেন। আত্মা অমর।…

হলঘরে গিয়ে রমা বললেন–আজ সকাল থেকে বাবামশাই একেবারে নর্মাল। অন্যদিন কী অবস্থা করেন, সামলানো যায় না।

কর্নেল বললেন–অদ্ভুত ডাক্তার তো! এই বয়সে ওঁকে স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দিয়েছেন। কতগুলো দিয়েছেন এ পর্যন্ত?

–তিনটে।

–ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পিউলগুলো দেখেছিলে তুমি?

না তো। ডাক্তারবাবু নিয়ে আসেন।

–অ্যাম্পিউল তো ফেলে দেবার কথা!

রমা অবাক হয়ে তাকাল। আমি লক্ষ্য করিনি। হয় তো জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছেন।

কর্নেল বললেন–ডাক্তারবাবু শেষ ইঞ্জেকশন কবে দিয়েছেন?

–মহালয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা।

–আগেও কি সন্ধ্যায় আসতেন ইঞ্জেকশন দিতে?

–হ্যাঁ। সারাদিন নাকি রোগীর ভিড়। তাই সন্ধ্যায় কল অ্যাটেন্ড করেন।

 –ঠিক আছে। তোমাকে আর আসতে হবে না।

–আপনাদের খাবার ওপরে পাঠাব বরং। অ্যাটাচড বাথ আছে। বেসিন আছে।

–ঠিক আছে। বলে কর্নেল পা বাড়ালেন। আমরা একটু বেরোচ্ছি এখন। সাড়ে নটার মধ্যে ফিরব। কোদালিয়া আমার চেনা জায়গা। আর শোন! হলঘরের দরজা বন্ধ করে দাও…

.

০৪.

কর্নেল পোর্টিকো থেকে বেরিয়ে বাড়ির পুবদিকে ঘুরে ফটকের দিকে হাঁটছিলেন। কোথায় যাচ্ছেন, জিজ্ঞেস করলাম না। ওই পাগলবুডোর এক দোসর। জিজ্ঞেস করলে কী জবাব পাব, সেটা অনিশ্চিত।

ঘরগুলোর মেঝে উঁচু। যেতে যেতে একটা জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, শান্তিদেব মেয়েকে নিয়ে পড়াতে বসেছেন। হঠাৎ মনে হল, এতটুকু মেয়ের এবাড়িতে দিন কাটে কী করে? একা স্কিপিং করে? এই নির্জন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’! আর মাত্র চারজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক এখন। নন্দ বেঘোরে মারা পড়েছে। কমলেশবাবু পুলিশ হাজতে। জামিন পেলেও কি আর এবাড়িতে আসবেন ভদ্রলোক? কোন মুখে আসবেন?

একটা সাইকেলরিকশা ডাকলেন কর্নেল। বললেন–থানা।

রিকশায় উঠে বললাম–পুলিশটুলিশের কাছে রাত্রিবেলায় যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে?

কর্নেল এত জোরে অট্টহাসি হাসলেন যে, রিকশোওয়ালা মুখ ঘোরাল।

বললাম–এতে হাসির কী আছে? রাতে পুলিশের মুড বদলে যায় দেখেছি। শিকারি বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। তাতে মফস্বলের পুলিশ।

কর্নেল চুপ করে থাকলেন। ঘিঞ্জি বাজার এলাকা ছাড়িয়ে একটা চওড়া রাস্তায় রিকশার গতি বাড়ল। রীতিমতো টাউনশিপ। কিছুদূর চলার পর একটা পাঁচিলঘেরা এলাকার গেটের কাছে রিকশো থামল। গেটের মাথায় বোগেনভিলিয়ার ঝাপি। চৌকো সাদা কাঁচের বোর্ডে নিয়ন আলোয় লেখা আছে, কোদালিয়া পি এস। গেটে সেন্ট্রি বেয়নেট হাতে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দোতলা বাড়ি। করিডরে সাদা পোশাকের এক পুলিশকে কর্নেল বললেন– সি আই সায়েব আছে?

সে নিঃশব্দে সিঁড়ির দিকে আঙুল দেখাল। দোতলায় উঠে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলে সে ঘরটা দেখিয়ে দিল। কর্নেল পর্দা তুলে বললেন–আসতে পারি?

হ্যাল্লো ওল্ড বস! ওয়েলকাম। ওয়েটিং ফর য়ু। আর দশ মিনিট দেখে চলে যেতাম।

সার্কেল ইন্সপেক্টর দীপক মুখার্জির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন কর্নেল।

আমার বয়সী লোক। স্মার্টনেস ঝকমক করছে চেহারায়। আমরা বসলে বোতাম টিপে একজনকে ডাকলেন।

বললেন–ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সায়েবকে বলো কর্নেলসায়েব এসেছেন। ও সি সায়েব আছেন না বেরিয়েছেন?

–একটু আগে বেরোলেন স্যার!

–ওকে!

সে চলে গেলে মুখার্জি বললেন–আপনার ট্রাঙ্ককল পেয়ে আমি সত্যি বলতে কী, খুব অস্বস্তি বোধ করছিলাম। দিব্যেশকে ডেকে বললাম, আপনি ওকে থাকতে বলেছেন। দিব্যেশ তো শুনে নার্ভাস হয়ে পড়ল। বিলিভ মি! আপনি এসেছিলেন মার্চের শেষাশেষি। তখন অবশ্য তো একটু পরে দিব্যেশই আমাকে মনে করিয়ে দিল রায়ভবনের মার্ডার কেসের কথা। আর য়ু ইন্টারেস্টেড?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–আমরা রায়ভবনে গেস্ট হয়ে এসেছি। এখন সেখান থেকেই আসছি।

–সো দ্যাটস দ্যাট! কফির ব্যবস্থা করি আগে? আমার কোয়ার্টার পাশেই।

–থাক। বেশিক্ষণ বসব না।

একজন টাকমাথা গোলগাল ভদ্রলোক–দেখতে একেবারে সাদাসিধে এবং অমায়িক, ঘরে ঢুকে হাত বাড়িয়ে কর্নেলের করমর্দন করলেন। তারপর অন্যপাশে একটা চেয়ারে বসে বললেন–মশা মারতে কামান দাগার আয়োজন করল কেডা?

–দিব্যেশ, তুমি আমাকে কামান বলছ?

 ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর হাসলেন–হঃ! ত কী কমু?

মুখার্জি বললেন–হঠাৎ আজ দুপুর থেকে দিব্যেশ মাতৃভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে। আমি জানি, এটা ওর নার্ভাসনেস!

গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–দৈনিক সত্যসেবক। খাইছেরে!

কর্নেল বললেন–বেশিক্ষণ বসব না। আসামী কী বলছে?

গোয়েন্দা অফিসার হাই তুলে বললেন–বিকেল চারটেয় নার্ভ ব্রেক করল। অ্যান্ড হি কনফেসড।

বলল নন্দকে মার্ডার করে গাছে ঝুলিয়েছে?

–হঃ!

-কেন?

-নন্দ রায়বাবুর মিউজিয়ামের দামী একটা সিল চুরি করে নাকি এক সায়েবকে বেচেছিল। সেজন্যই নাকি রায়বাবু, মানে ওনার শ্বশুরমশাই পাগল হয়ে গেছেন। শ্বশুর-প্রেমিক জামাই। নন্দকে নদীর ঘাটে বেড়াতে ডেকে নিয়ে গিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরেছে। তারপর বডি এনে গাছে ঝুলিয়েছে। সিরিঞ্জ নদীতে ফেলে দিয়েছে।

কী ভাবে ঝোলাল গাছে?

দিব্যেশবাবু পকেট থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ বের করে দিলেন কর্নেলকে। –আসামীর নিজের হাতে আঁকা পিকচার। শুনুন। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি, যে ভাবে আসামী বুঝিয়েছে আমাকে।

কর্নেল কাগজটা খুললে ঝুঁকে গেলাম দেখার জন্য। দিব্যেশবাবু বললেন– বডি এনে পয়েন্ট ই’-তে ফেলে রাখে। গলায় শক্ত নাইলনের দড়ির ফঁস আটকে দেয়। আমগাছটা ‘ডি’ পয়েন্ট। পয়েন্ট ‘বি’র ওপর দিয়ে দড়ির অন্যপ্রান্তে ছুঁড়ে দেয়। এবার পয়েন্ট ‘এ’–একটা অশোকগাছ। দড়িটা ধরে টান দিল এবং বডি উঠে পয়েন্ট ‘বি’ ঝুলতে লাগল। দড়ির ডগাটা বাঁধল পয়েন্ট ‘এ’-তে। এবার আমগাছে উঠে পয়েন্ট ‘বি’তে দড়ির ওপর দুই পা চাপ দিয়ে ব্লেড দিয়ে পয়েন্ট ‘সি’-তে দড়িটা কাটল। তারপরের কাজটা সোজা। পয়েন্ট ‘বি’তে কাটা দড়ির ডগা ফাঁস দিয়ে আটকাল। বডি একটু নেমে এল বটে, কিন্তু টাইট হয়ে গেল ফঁস। গাছ থেকে নেমে পয়েন্ট ‘এ’ থেকে দড়ির কাটা অংশ খুলে নদীতে ফেলে দিয়ে এল। সো ইজি! বাট টেরিবলি ইনটেলিজেন্ট।

মুখার্জি বললেন–হরিফাইং জিওমেট্রিক্যাল প্যাটার্ন! একটা ত্রিভুজ। লোকটা তো স্কুলটিচার। কী পড়াতো?

–অঙ্ক আর জ্যামিতি।

–আই সি।

 কর্নেল বললেন–দড়িটা পেল কোথায়, বলেছে?

গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর বললেন বাড়ির একটা ঘরে ছিল। ওই ঘরে সোমবাবুর থিয়েটারের স্টেজ সিনসিনারি থাকে। বাঁশ, তক্তা, দড়িও থাকে।

মুখার্জি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন–এদিকে প্রেসার আসছে হেভি। মানিক চ্যাটার্জি, ইউ নো। এস ডি পি ও ইজ অলসো ইন্টারেস্টেড। ও সিকে ফোন করেছিলেন। উনি এসে আমাকে বলছিলেন, দেখুন তো কী করি! আই পি সি থ্রি জিরো টু কেস। থানা থেকে জামিনের প্রশ্নই ওঠে না। কাল কোর্টে প্রডিউস করে তারপর–এনিওয়ে, কর্নেল বলুন, হোয়াট ইজ ইওর ওপিনিয়ন?

কর্নেল ছবিটা দেখছিলেন। ফেরত দিয়ে বললেন–আপনাদের আসামীর সঙ্গে দু’একটা কথা বলতে চাই। সম্ভব হবে?

দিব্যেশবাবু উঠে দাঁড়ালেন। –একটা অসুবিধা। অন্যান্য আসামীদের সঙ্গে রাখা হয়েছে ওকে। ফর হিজ সেফটি। কনফেস করা আসামীদের নিয়ে আমাদের দুর্ভাবনা থাকে।

মুখার্জি বললেন–হ্যান্ডকাফ দিয়ে এঘরে নিয়ে আসুন বরং।

–দেখছি। বলে গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর বেরিয়ে গেলেন।

মুখার্জি হাসলেন। কর্নেল সায়েব এখন হতের কার্ড শো করবেন না, আই নো দ্যাট ওয়েল। একেবারে অকুস্থলে এসে উঠলেন। আমার ধারণা, ইতিমধ্যে অনেকটা এগিয়েছেনও। আপনার থিওরির সঙ্গে মিলছে?

কর্নেল বললেন–নাহ্।

-মাই গড! আসামীর কনফেসন অ্যান্ড দ্যাট পিকচার।

–ছবিটা ঠিকই আছে। মোডাস অপারেন্ডি ইজ অলরাইট।

তা হলে কী ঠিক নেই?

–মোটিভ। দ্য মোটিভ ইজ উইক। বড্ড অস্পষ্ট। কিছুটা অ্যাবসার্ডও বটে।

ধরুন, আসামী নিজেই সিল চুরি করে বেচেছে। নন্দ সেটা জানত। নন্দ রায়বাবুকে জানালে জামাইকে তাড়িয়ে দিতেন। এমন কি রায়বাবু সম্পর্কে যতটা জানি, আর্কিওলজিতে প্রচণ্ড বাতিক। এদিকে মেয়ে বেঁচে নেই। কাজেই প্রাক্তন জামাই আউটসাইডার। এক্ষেত্রে ওকে পুলিশে দেওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কাজেই

কমলেশবাবু আর মেয়ের নামে বাড়ি ও মিউজিয়াম উইল করে রেখেছেন রায়বাবু।

–শুনেছি। সোমবাবু বলছিলেন। মুখার্জি জোর দিয়ে বললেন কাজেই কমলেশের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। অতবড় একটা প্রপার্টি থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি ছিল। রায়বাবু উইল বদলাতেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নন্দকে আর টাকা দিয়ে চুপ করানো যাচ্ছিল না। তাই তাকে মারল কমলেশ।

কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন–একটা ব্রোঞ্জের সিলের খরোষ্ঠী লিপি সম্পর্কে নন্দের কোনও ধারণা থাকা অসম্ভব, দীপক! ছোট্ট একটা সিল, যা পকেটে লুকোন যায়, তা গোপনে বেচাকেনাটা অন্তত নন্দের মতো লোকের কাছে ধরাপড়ার চান্স অত্যন্ত কম। গ্যান্সলার নামে এক জার্মান সায়েব এসেছিলেন। তারপর সিল হারিয়েছে। গ্যান্সলারকে কমলেশ সিল বেচলে সে এমন বোকা নয় যে, নন্দের চোখে পড়ার মত জায়গায় বেচবে। এগেন আই স্ট্রেস দ্য পয়েন্ট, নন্দের পক্ষে এমন ঘটনা জানার চান্স খুবই কম।

মুখার্জি টেবিলে ডান কনুই রেখে দুই ভুরুর মধ্যিখানটা খামচে ধরে বললেন–কোর্টে অবশ্যি এসব কনফেসনের লিগ্যাল ভ্যালু নেই। আসামী বললেই হল, পুলিশের চাপে পড়ে মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছে। সো উই নিড আদার এভিডেন্স। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শী নেই। অতএব সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের ওপর নির্ভর করতে হবে।

–অ্যান্ড দ্য সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স বেসিক্যালি নিডস অ্যা স্ট্রং মোটিভ অব দ মার্ডার।

–নিশ্চয়! যুক্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য মোটিভ।

কর্নেল চুপচাপ কিছুক্ষণ চুরুট টানার পর বললেন–সিল চুরির ডায়েরি করা হয়েছিল থানায়?

–শুনলাম হয়েছিল। ওইদিন ডিউটি অফিসার ছিলেন এস আই মাখনবাবু। তিনি বদলি হয়ে গেছেন। ডাইরি দেখবেন নাকি?

নাহ্।

এই সময় গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর ফিরে এলেন। তার পেছনে হ্যান্ডক্যাপ পরা একজন রোগা যুবক। কোটরগত উজ্জ্বল চোখ। মাথায় একরাশ ঝকড়া চুল। পরনে প্যান্টশার্ট। পায়ে জুতো নেই। তার পেছনে দু’জন তাগড়াই কনস্টেবল। তারা সিআই সায়েবকে সেলাম দিয়ে প্রস্তরীভূত দাঁড়াল। সি আই মুখার্জি বললেনবাহারমে যাও।

তারা বেরিয়ে গেল। কর্নেল বললেন বসুন কমলেশবাবু।

কমলেশ তার দিকে তাকিয়ে রইল। দিব্যেশবাবু মিষ্টি গলায় বললেন বসুন, বসুন। যা হবার হয়ে গেছে। “নিয়তি কেন বাধ্যতে?”

মুখার্জি বললেন–আলাপ করিয়ে দিই। কর্নেল নীলাদ্রী সরকার আর ইনি হলেন দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি।

কমলেশ শান্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল–যা বলার বলেছি। নিউজপেপারে স্টেটমেন্ট দিতে আমি বাধ্য নই।

দিব্যেশবাবু হাসলেন। কী যে কন! স্টেটম্যান্ট চায় কেডা? কর্নেলসায়েবের লগে আলাপ করেন। ইনিও আপনার শ্বশুরের লাইনের লোক। আর্কিওলজিস্ট।

মুখার্জিও হাসলেন–অ্যান্ড নেচারিস্ট।

কর্নেলের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি কমলেশকে চোখ নামাতে বাধ্য করল। অন্যপাশের খালি চেয়ারে সে বসল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, এই রোগাপটকা যুবকটি কী করে গাছের ডালে বডি ঝোলাল, পদ্ধতিটা কি সত্যিই ‘ইজি’?

কর্নেল বললেন–সিলটা সম্পর্কে আমি ইন্টারেস্টেড কমলেশবাবু! আমাকে পুলিশের লোক ভাববেন না। খুন-খারাপির মধ্যে আমি নেই। খরোষ্ঠী সিল দক্ষিণ বাংলায় পাওয়া একটা যুগান্তকারী ঘটনা। শুধু বাংলা কেন, সারা ভারতের ইতিহাস তাহলে নতুন করে লিখতে হবে। তাই না?

কমলেশ ঠাণ্ডা গলায় বলল–হ্যাঁ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না ওইসব লিপি খরোষ্ঠী। মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে তর্ক করা চলে না। তাই কিছু বলিনি এতদিন।

মাস্টারমশাই মানে আপনার শ্বশুর জয়দেব রায়?

 –আমি মাস্টারমশাই বলি।

হারানো সিলটা আপনি দেখেছিলেন?

–দেখেছি। হাজার হাজার বছর মাটির তলায় পড়ে থাকা অবজেক্টে ন্যাচারাল কেমিক্যাল কনট্যামিনেশন হয়। পুরনো লিপি পড়ার আগে অবজেক্ট ন্যাচারাল কেমিক্যাল প্রসেসে পরিষ্কার করে নিয়ে ফোটোকপিতে কয়েক গুণ বড় করে নিতে হয়। তারপর পাঠের প্রশ্ন। আজকাল টেকনোলজির সুবিধে আছে। কম্পিউটার প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থা আছে। তা না করে খালি চোখে–

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন–প্রিন্সেপ ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠীর পাঠোদ্ধার করেছিলেন।

জানি। কিন্তু তাঁকেও তখনকার টেকনোলজির সাহায্য নিতে হয়েছিল। মাস্টারমশাই একটা আনক্লিন এবং কনট্যামিনেটেড সিল আতস কাঁচে দেখেই খরোষ্ঠী বলছেন। আপনি ললিতবিস্তর পড়েছেন?

সংস্কৃত বই। বুদ্ধের জীবনী। তাতে ৬৪টি লিপির কথা আছে।

–তাহলে দেখুন, অসংখ্য লিপি হারিয়ে গেছে। তা ছাড়া মাস্টারমশাই একটু বেশি উৎসাহী। একটি মাটির কলসির গায়ে কী লিপি ছিল। উনি তার ওপর সাদা রঙ বুলিয়েছেন। আ সর্ট অব ম্যানিপুলেশন! উইশফুল ডিসাইফারিং। আমি দেখামাত্র বুঝতে পেরেছিলাম কুমোরের তৈরি নকসামাত্র। কলসির গলায় নকসা এখনও করা হয়।

–সিলটা নন্দ চুরি করেছিল, আপনি সিওর হলেন কী করে?

মাস্টারমশাই মিউজিয়ামের কোনায় বসে একটা পাথরের স্ল্যাব পরীক্ষা করছিলেন। আমি পাশের ঘরে থাকি। নন্দ গ্লাসে জল নিয়ে ঢুকছিল। খাটের পাশে একটা টেবিলে জল রেখে গেল। টেবিলেই সিলটা ছিল। আমি পর্দা তুলে ঢুকেছি, নন্দ তাড়াতাড়ি চলে গেল। দুদিন পরে মাস্টারমশাই হইচই শুরু করলেন। সিলটা নেই।

নন্দ জল দিতে আসার সময় জার্মান সায়েব ছিলেন রায়ভবনে?

–ছিলেন। হঠাৎ সেদিনই বিকেলের ট্রেনে কলকাতা ফিরে গেলেন। গ্যান্সলার সিলটা দেখেছিলেন। নন্দ গেস্টরুমে ওঁর দেখাশোনা করত। দুইয়ে দুইয়ে চার।

–স্কুলে আপনি কী পড়ান?

–পাটীগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি।

–আপনি জানেন দেশের পুরাদ্রব্যসংক্রান্ত আইনে ব্যক্তিগত সংগ্রহে পুরাদ্রব্য রাখা যায় না। কিন্তু একটা ট্রাস্টি বোর্ড থাকলে তবেই রাখা য়ায?

–জানি।

–জয়দেববাবুর উইলে আপনি এবং আপনার স্ত্রীকে রায়ভবনের সবকিছুর উত্তরাধিকারী করা হয়েছে। বাড়ির ব্যাপারে প্রব্লেম নেই। কিন্তু মিউজিয়ামে আপনাদের আইনত অধিকার থাকছে না জানেন কি? ওটা সরকার ইচ্ছে করলে যে কোনও সময় নিতে পারেন।

কমলেশের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা রেখা দেখলাম। সে বলল মাস্টারমশাই বোকা নন। ওঁর অ্যাটর্নি আইন জানেন। মানিকদা–আমার কলিগ মানিক চ্যাটার্জি কোদালিয়া মিউজিয়ামের প্রেসিডেন্ট। আমি সেক্রেটারি। এই মিউজিয়াম ‘কোদালিয়া প্রত্ন উদ্ধার সমিতি’ নামে অলরেডি রেজিস্টার্ড হয়ে আছে। মেম্বারদের মধ্যে লোকাল পঞ্চায়েত এবং স্কুল থেকে প্রতিনিধিরা আছেন।

–আপনি সিওর নন্দ সিল চুরি করে সায়েবকে বেচেছিল?

–সিওর। পরদিন নন্দ কলকাতা গিয়েছিল কী কাজে। ডলার বা মার্ক ভাঙাতেই গিয়েছিল। টাকা কোথায় লুকিয়ে রেখে গেছে। গতরাতে ওকে জেরা করে কবুল করানো গেল না। তখন–আই কিলড দ্য বাস্টার্ড।

-নিকোটিন অ্যাম্পিউল কোথায় পেলেন?

পাওয়া যায়। পৃথিবীতে সবই পাওয়া যায়।

 –কোদালিয়ায়?

পাওয়া অসম্ভব নয়। কোদালিয়া এখন শহর। বর্ডার বেশি দূরে নয়। পুলিশ অফিসারদের জিজ্ঞেস করুন, এটা ফরেন গুডসের কতবড় স্মাগলিং সেন্টার।

–আপনার শ্বশুরকে স্টেরয়েড ইঞ্জেশন দেওয়া হত জানেন?

–হুঁউ, জানি। কিন্তু বাধা দিইনি। ওঁর ছেলেরা আছে। তবে..

বলুন!

–মাস্টারমশাই ক’মাস আগে একটা এক্সক্যাভেশন সাইটে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে ভীষণ দুর্বল বোধ করতেন। চলাফেরা করতে কষ্ট হত। তাই আমি স্টেরয়েড নিতে বাধা দিইনি। আই ফিল ফর হিম। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছি। পিসিমা মানুষ করছিলেন। মারা গেলেন। তখন মাস্টারমশাই আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। উনি ছাড়া এ পৃথিবীতে আমার কে আছে? ওঁর মনে কেউ আঘাত দিলে তাকে আমি ক্ষমা করতে পারি?

–আপনার স্ত্রী সুইসাইড করেছিলেন?

 কমলেশ তাকাল। একটু পরে বলল–শি ওয়জ আ সাইকিক পেশ্যান্ট। সবাই জানে।

–একই গাছের একই ডালে গলায় ফাঁস দিয়েছিলেন?

-হ্যাঁ। ওই থেকে আমার মাথায় নন্দকে একইভাবে ঝোলানোর প্ল্যান এসেছিল।

আপনার স্ত্রীও কি নাইলনের দড়ির ফাঁসে…

হ্যাঁ। বড়দার থিয়েটার রুমে অনেক দড়ি আছে।

–আমি যদি বলি, আপনি আপনার স্ত্রীকেও একইভাবে মেরে একই পদ্ধতিতে ঝুলিয়েছিলেন?

কমলেশ হাসল। মাস্টারমশাইয়ের শিক্ষা, সমাজের হিতের জন্য কোনও কাজে পাপ নেই।

–আই সি!

আমার স্ত্রীকে মেরে সমাজের হিতসাধন হত না। অন্য দেশে পুরাদ্রব্য পাচারকারীদের গুলি করে মারা হয়। এদেশে সেই সভ্য আইন নেই। তাই আমি নিজে সভ্য দেশের আইন প্রয়োগ করেছি।

নন্দকে মেরে?

–নন্দকে মেরে।

–কিন্তু আপনার স্ত্রীকে হত্যার প্রত্যক্ষ মোটিভ তো ছিল?

–হত্যা! এবং মোটিভ?

–হ্যাঁ। কাঞ্চন নামে একজনের সঙ্গে আপনার স্ত্রীর পূর্বপ্রণয় ছিল।

কমলেশ ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর হিসহিস করে বলল–হু আর য়ু? ডিটেকটিভ অফিসার, নাকি সি বি আই অফিসার?

–প্লিজ এক্সপ্লেন দিস পয়েন্ট!

–স্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না। শুধু মাস্টারমশাইয়ের কথা অমান্য করতে পারিনি বলেই-নাহ্ স্যার! যার সঙ্গে এতটুকু ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট ছিল না, তার জন্য প্রতিহিংসার প্রশ্নই ওঠে না।

–কিন্তু আপনারা একই ঘরে রাত্রিবাস করতেন?

না। পারু আমাকে পাশের ঘরে শুতে বলত। তা-ই শুতাম। পরে মাস্টারমশাইয়ের কানে গেলে উনি নিজের ঘরের পাশের ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।

–আপনি স্ত্রীর মৃত্যুর পর শান্তিবাবুর স্ত্রীকে বলেছিলেন ‘এটাই কি নিয়তি বউদি’? এক্সপ্লেন ইট।

বউদি বলেছে আপনাকে?

 হ্যাঁ।

–বলে থাকতে পারি। মনে নেই। আত্মহত্যাও তো নিয়তি।

 স্ত্রীর ডেডবডি আপনিই আবিষ্কার করেছিলেন?

হ্যাঁ। ভোরবেলা নদীর ধারে বেড়ানো আমার অভ্যাস। বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

–ওই ঘটনায় নন্দর রিঅ্যাকশন কী হয়েছিল, মনে পড়ে?

-কান্নাকাটি করেছিল। পারু–মানে আমার স্ত্রীকে নাকি সেই মানুষ করেছিল।

নন্দের কোনও বিশেষ উক্তি–মানে স্মরণে রাখার মতো…

কমলেশ হাতকড়া পরা হাত দুটো টেবিলে রেখে দ্রুত বললনন্দের বিশেষ উক্তি..হুঁ, ‘ওরা পাগল বংশ–সবাই মাথা খারাপ’…তবে এটা লোকাল লোকেরা সবাই বলে। মাস্টারমশাই বলতেন, তাঁর কোন জমিদার পূর্বপুরুষ নিরীহ প্রজাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুযন্ত্রণা এনজয় করতেন।

–মেয়ের মৃত্যুর পরই কি জয়দেববাবুর মধ্যে পাগলামির লক্ষণ প্রথম দেখা যায়?

–হ্যাঁ। ভীষণ শক। তবে মাস্টারমশাই তার আগেও কোনও কোনও ব্যাপারে যা সব করতেন, সুস্থ মানুষ করে না।

–ফর একজাম্পল?

–এত মনে নেই। বড্ড উইশফুল থিংকিং ছিল–যেমন এই খরোষ্ঠীলিপি। সামটাইমস হি ইমাজিনড থিংস।

আমি বলে উঠলাম–সোমদেববাবুও…কিন্তু কর্নেল চোখ কটমটিয়ে তাকাতেই চুপ করে গেলাম।

কমলেশ বলল—র‍্যাদার আ শিজোফ্রেনিক টাইপই বলব। রিয়্যাল আনরিয়্যালের পার্থক্য হারিয়ে ফেলতেন মাঝে মাঝে। কী করতে কী করছেন টের পেতেন না। মিউজিয়ামে কিছু প্রাচীন অস্ত্র আছে। একদিন দেখি, একটা তলোয়ার দিয়ে নিজের হাত কাটার জন্য ঘষছেন। ভাগ্যিস মরচে ধরা ভোতা তলোয়ার। বাধা দিলাম। তখন বললেন, ‘এতে একটা স্ক্রিপ্ট আছে। ডিসাইফার করছি। দিজ সর্ট অব থিংস্।

মুখার্জি বললেন–শিজোফ্রেনিয়া এবং প্যারানোইয়া প্রায় একই টাইপের অসুখ।

কমলেশ নিষ্পলক চোখে গোয়েন্দা ইনসপেক্টারের দিকে তাকাল। আপনারা এবার আমাকেও এই অসুখ ধরাবেন। হোয়াই এনি মোর কোয়েশ্চনস? পরিষ্কার লিখে দিয়েছি তো, আমি নন্দকে মেরেছি।

দিব্যেশবাবু বললেন–আপনার সত্য বলার সাহস আছে। আই প্রেইজ য়ু। আর একটা কথা। আপনার শ্বশুরমশাইয়ের কোনও প্ররোচনা ছিল না তো? ওই যে ওনার মেসেজ কইলেন, সমাজের হিতের জন্য কিছু করনে পাপ নাই!

নাহ্। প্রায় গর্জন করল কমলেশ। তারপর উঠে দাঁড়াল। অন্য দেশ হলে জয়দেব রায়কে মাথায় তুলে রাখত। জীবদ্দশায় স্ট্যাচু বানিয়ে সম্মান জানাত। নিজের পয়সায় এক্সক্যাভেশন করেছেন। সরকার নিজে তো একটা পয়সা দেনইনি, উপরন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জ যে সাহায্য করতে চেয়েছিল, তা-ও আটকে দিয়েছেন। ইউনেস্কোর টিমকে পর্যন্ত ভিজিটের পারমিশন দেওয়া হয়নি। এই দেশে সুস্থ মানুষের বেঁচে থাকতে আছে? আমার ফাঁসি হলে সুখে মরতে পারব।

কমলেশ পা বাড়ালে বাইরে থেকে সেই কনস্টেবলরা এসে ওর সামনে দাঁড়াল। দিব্যেশবাবু উঠে পড়লেন। কর্নেলকে বললেন–আর কিছু জিগাইবেন নাকি?

কর্নেল মাথা নাড়লেন। আসামীকে নিয়ে চলে গেলেন দিব্যেশবাবু।

 মুখার্জি বললেন–পাগলবংশের পাল্লায় পড়ে এ-ও দেখছি এক পাগল।

কর্নেল বললেন–উঠি।

কী বুঝলেন বলে যান।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–জানেন তো স্বদেশীযুগে ক্ষুদিরাম ফাঁসির মঞ্চে উঠে বলেছিলেন, দড়িতে মোম দেওয়া হয়েছে কেন? উই আর প্রাউড অব আওয়ার কান্ট্রি–ক্ষুদিরামস আর স্টিল বর্ন অ্যান্ড ডাই।

মুখার্জি শুকনো অট্টহাসি হাসলেন। বুঝি না মানুষ মেরে সমাজের কী হিত হয়! চলুন, আমিও বেরোই। কোয়ার্টারে গেলে শ্রাবণী খুশি হত। ওকে বলেছি, আপনি আসছেন।

–আগামী কাল যাব এবং কফি খাব।

 –টাইম দিন।

–দশটা নাগাদ।

থ্যাংকস!…

 সাইকেল রিকশোয় রায়ভবনের ফটকে পৌঁছলাম। দেখি, শান্তিদেব টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন–দেরি দেখে রমা তাগিদ দিল। কোথায় বেরিয়েছিলেন?

কর্নেল বললেন–থানায় গিয়েছিলাম।

শান্তিদেব আলো ফেলে হাঁটতে হাঁটতে ব্যস্তভাবে বললেন কমলেশকে মিট করলেন?

-হ্যাঁ। কমলেশ স্বীকার করেছে।

বলেন কী!

–নন্দ সিল চুরি করে সায়েবকে বেচেছে, সে জানতে পেরেছিল।

 –সে জন্য নন্দকে সে মারল? অদ্ভুত তো!

–সিল হারিয়ে তার মাস্টারমশাই পাগল হয়েছেন। তাই…

–অবিশ্বাস্য! অন্য কোনও গোপন ব্যাপার আছে। বাবার মিউজিয়াম থেকে জিনিসপত্র চুরি করত দুজনে। বখরা নিয়ে গণ্ডগোল। এখানে স্মাগলার্স গ্যাং আছে জানেন তো? তাদের সাহায্য নিয়ে মেরেছে নন্দকে।

কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। হলঘরের দরজায় রমা দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে ভাবছিলাম।

শান্তিদেব বললেন–জানো? কমলেশ কবুল করেছে।

 রমা কানে নিলেন না কথাটা। বললেন–তুমি এস। ওপরে খাবারটা পৌঁছে দেবে।

আমরা গেস্টরুমে গিয়ে পোশাক বদলে পালাক্রমে বাথরুম সেরে নিলাম। একটু পরে শান্তিদেব ট্রেতে রাতের খাবার এনে দিলেন। লুচি, আলুরদম, মাছভাজা, মুর্গির মাংস, সন্দেশ এবং একপট কফি।

যতক্ষণ খেলাম, শান্তিদেব কমলেশের কথা বলতে থাকলেন। তার পুরো জীবনী এবং কার্যকলাপ। শান্তিদেবের মতে মানিক চ্যাটার্জি ওর মুরুব্ধি। কাজেই পুলিশ চার্জশিট উইক করে দেবে। মামলা কেঁচে যাবে।

কর্নেল বললেন–আপনার দাদা ফিরেছেন?

এখন কী? রাত এগারোটা বাজুক। চুটিয়ে রিহার্সাল দিচ্ছেন। পাগল! পাগল!…

.

০৫.

নতুন জায়গায় গেলে আমার ঘুম আসতে চায় না। কর্নেলের কথায় সিঁড়ির নীচের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এ ঘরের দরজাও বন্ধ। তবু কী অস্বস্তি আমাকে পেয়ে বসেছিল। বাইরে ঝলমলে জ্যোৎস্না। মশারির ভেতর থেকে বারবার ব্যালকনির দিকে তাকাচ্ছিলাম। জয়দেববাবুর ‘আত্মা অমর’ এবং পারু স্পিকস টু মি’ কথাদুটো ক্রমশ আমার চেতনায় ঝাঁপিয়ে আসছিল। এমন একটা পুরনো ক্ষুধিত পাষাণ-টাইপ বাড়ি এবং একটা আত্মহত্যা, একটা সদ্য খুনখারাপি! ভূতে বিশ্বাস না করলেও ভূতের ভয় আমার আছে। রিভলভার আর টর্চ বালিশের পাশে রেখেছি! শিলিং ফ্যানের হাওয়ায় মশারি দুলছে। ঝুলন্ত ব্যালকনির দিকের দরজাটা কর্নেল বন্ধ করতে দেননি। হঠাৎ-হঠাৎ সেখানে যেন একটা আবছায়া দেখছি। মশারি থেকে মুখ বেরও করছি মাঝে মাঝে। এ এক অস্বস্তিকর রাত্রি।

কর্নেল নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। বিশ্বাস করা চলে জিম করবেটের মতো ওঁর গাছের ডালে ঘুমুনোর গল্প। আজীবন প্রকৃতিচর এবং সামরিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত লোকদের পক্ষে হয়তো এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধের ফ্রন্টে পরিখায় সৈনিকেরাও নাকি দিব্যি ঘুমিয়ে নেয়।

নীচের হলঘরে গ্র্যান্ডফাদার ঘড়ির অস্পষ্ট ঘণ্টার শব্দ শুনলাম একবার। একবার আমাকে চমকে দিয়ে কী একটা পাখি ক্রাক্রা করে চেরা গলায় ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। সম্ভবত পেঁচা। বহুদূরে ট্রেন বা মালগাড়ির শব্দ কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ নীচে কোথাও একটা শব্দ শুনতে পেলাম। কে যেন সিঁড়ির নীচের দরজাটা ঠেলছে। আস্তে ডাকলামকর্নেল! কর্নেল!

কর্নেলের নাকডাকা থেমে গেল।

কর্নেল! নীচের দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে।

ভূত।

কী আশ্চর্য! ওই শুনুন?

আবার কর্নেলের নাক ডাকতে থাকল। শব্দটাও থেমে গেল। আবার স্তব্ধতা। কতক্ষণ পরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে! স্বপ্নে দেখছিলাম, দৈনিক সত্যসেবকের চিফ অব দা নিউজবুরো সুনীলদা সবুজরঙের নাইলনের দড়িতে ফাস বানিয়ে নিষ্ঠুর হেসে বলছেন–তুমি আজ কাগজকে ফাঁসিয়েছ। তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবো। সারা নিউজরুম জুড়ে সহকর্মীরা আমাকে তাড়া করে আসছেন। চাঁচাতে চেষ্টা করছি কর্নেল! কর্নেল! বেয়ারা হরিবন্ধু বলছে–জয়ন্তবাবু পাগল! জয়ন্তবাবু…

বাবু! বাবু!

তাকিয়ে দেখ, দিব্যি মশারির ভেতর শুয়ে আছি। ঘরে দিনের উজ্জ্বল আলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটি মধ্যবয়সী গ্রাম্য মেয়ে ডাকছে বাবু! বাবু কোফি এনিচি। উঠুন!

মশারি থেকে বেরিয়ে এলাম। মেয়েটি টেবিলে ট্রে রেখে চলে গেল। এই তাহলে কাজের মেয়ে লক্ষ্মী। কর্নেলের বিছানা খালি। মশারি গুটোনো। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন বোঝা গেল। বাথরুম সেরে এসে বিস্কুট দিয়ে কফি খেলাম।

ব্যালকনিতে গিয়ে চোখে পড়ল সেই নদী আর নির্জন প্রকৃতি। তারপর মনে পড়ল, গতরাতে নীচের দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছিল। সোমদেববাবু কি ক্লাব থেকে ফিরে গল্প করতে আসছিলেন? কিন্তু তখন রাত প্রায় বারোটা বা একটা। তাছাড়া উনি যদি বিশেষ জরুরি কারণে এসেই থাকতেন, নিশ্চয় ডাকতেন।

দিনের উজ্জ্বল আলোয় ভূত ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা রহস্যজনক তো বটেই।

সাওয়া আটটা বাজে। কর্নেল কখন ফিরবেন, সেটা ওঁর মর্জি। রাতের পোশাক বদলে প্যান্ট শার্ট পরে নিলাম। চুপচাপ ঘরে বসে থাকার মানে হয় না। সতর্কতার দরুন রিভলভারটা ঘরে রেখে যাওয়া ঠিক মনে করলাম না। পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের অস্ত্রটা প্যান্টের পকেটে দিব্যি ঢুকে যায়। রুমালে জড়িয়ে পকেটে ঢোকালাম। অস্ত্রটা অটোমেটিক। কিন্তু ট্রিগারের পিঠের ওপর ইঞ্চিটাক লম্বা ক্লিপটা টেনে নামিয়ে রাখলে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ওটার সঙ্গে ভেতরে স্ট্রাইকিং হ্যাঁমারের যোগ আছে। একটা গুলি ছুঁড়লে দ্বিতীয়টা ঘুরে এসে হ্যাঁমারের সামনে বসে যায়। এই প্রক্রিয়াটাই অটোমেটিক।

পোর্টিকো নির্জন। জঙ্গলে লন পেরিয়ে বাগানে ঢুকলাম। সরু একফালি পায়ে চলা পথ চোখে পড়ল। পাইনগাছের ওপাশে আমগাছটা যেন ভয়াল জৈব চোখে আগন্তুককে দেখছে। একমিনিট দাঁড়িয়ে লম্বা ছড়ানো ডালটা এবং বাঁদিকে লম্বাটে অশোকগাছের গোড়াটা লক্ষ্য করলাম। আমগাছের ডালে কোনও চিহ্ন নেই। কিন্তু অশোকগাছের গোড়ায় হাতখানেক উঁচুতে ঘষা দাগ স্পষ্ট। ছাল ঘষা খেয়েছে দড়ির বাঁধনে।

পায়ে চলা পথটা শেষ হয়েছে একটা ফুট সাতেক উঁচু এবং ফুট চারেক চওড়া জরাজীর্ণ দরজায়। ধূসর হয়ে গেছে কপাট। তার ওপর মাকড়শা হয়তো গতরাতেই জাল ছড়িয়েছে। উঁচু পাচিলের ধারে ফার্নের জঙ্গল। কপাটের মাঝামাঝি জায়গায় একটা লম্বা কাঠের হুড়কো বসানো। দরজা খুলেই দেখি দুধারে লাইমকংক্রিটের চাবড়া, গুল্মলতা, তার শেষে পাথরের স্ল্যাব বসানো ঘাট। ধাপের ফাটলে কাশ এবং আগাছা গজিয়ে আছে। শ্যাওলায় সবুজ হয়ে আছে ধাপগুলো। ডাইনে একটা ন্যাড়া লাইমকংক্রিটের প্রকাণ্ড চাই। দেখে মনে হল, ওখানেই সম্ভবত কমলেশ এসে বসে থাকত।

রোদ্দুরে ওখানে বসার মানে হয় না। মন্থর নদীটাকে মাদালসা ইত্যাদি উপমায় কাব্য করার অভ্যাস আমার নেই। তবে বারবার কর্নেলের সঙ্গে নিসর্গভ্রমণে গিয়ে বুঝেছি, মানুষ ছাড়া প্রকৃতি-ট্রকৃতি অর্থহীন জড়পদার্থ মাত্র। এই নির্জন প্রকৃতিকে মানুষই অর্থপূর্ণ আর উদ্দেশ্যপূর্ণ করে তুলতে পারে।

কিন্তু আমি প্রকৃতিতে সবসময় নিজেকে আউটসাইডার আবিষ্কার করি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করে নদীতে ছুঁড়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। তারপর পা বাড়িয়েই চোখে পড়ল, লাইমকংক্রিটের চাইঢাকা আগাছার ভেতর কোনাকুনি এসে পড়া রোদের মধ্যে কী একটা জিনিস চকচক করছে।

কাছে গিয়ে দেখি, একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ সুচসুদ্ধ!

এটাই কি মার্ডার উইপন?

কর্নেলের সঙ্গগুণে জানি ওতে খুনির আঙুলের ছাপ থাকা সম্ভব। তাই রিভলভার জড়ানো রুমালটা সাবধানে বের করলাম। তারপর ঝোপে হাত ঢুকিয়ে রুমাল দিয়ে ওটা তুলে নিলাম।

এই সময় পেছনে একটা শব্দ হল। চমকে উঠে ঘুরে দেখি জয়দেববাবু। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। ফাঁসফেঁসে গলায় বললেন–ব্রোঞ্জের সিল? খরোষ্ঠী স্ক্রিপ্ট?

বললাম–আজ্ঞে না। একটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ!

–দেখি, দেখি!

ওঁর সামনে হাতের তালুতে রুমালে রাখা সিরিঞ্জটা এগিয়ে দিলাম। অমনি উনি খপ করে সিরিঞ্জটা তুলে নিয়ে জোরে নদীতে ছুঁড়ে ফেললেন। উত্তেজিতভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন–নাডুর ইঞ্জেকশন আর আমি নিচ্ছি না। আমাকে পাগল করার চক্রান্ত? আমি পুলিশ কেস করব। সোমু, রন্তু, শান্তু, পারু, বউমা সব্বাইকে আসামি করব। ওরা আমাকে পাগল সাব্যস্ত করে আমার উইল কেঁচিয়ে দেবে। হুঁ হুঁ বাবা, আমি সব বুঝি। লেট কমলেশ রায় ব্যাক ফ্রম ক্যালকাটা।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বললাম কিন্তু সিরিঞ্জটা যে…

চু-উ-প! আঙুল তুলে গর্জন করলেন জয়দেব রায়। –আর ইউ টু ইন্টারফিয়ার ইন মাই পার্সোনাল অ্যাফেয়ার? কে আপনি? এখানে ট্রেসপাস করেছেন কেন? বলে দরজার দিকে ঘুরে চিড়-খাওয়া গলায় হাঁকলেন নন্দ! নন্দ!

বাগানের ভেতর দিয়ে রমাকে হন্তদন্ত আসতে দেখলাম। এসেই শ্বশুরের হাত ধরে টেনে ভেতরে ঢোকালেন। জয়দেববাবু রুষ্ট চোখে বারবার ঘুরে আমাকে দেখছিলে। রমা বললেন–ঘরে চলুন তো!

–এই লোকটা আমার মিউজিয়ামে চুরি করতে এসেছে। ঘাপটি পেতে দাঁড়িয়ে আছে। চোর!

–আহ্! কাকে কী বলছেন! গতরাতে আলাপ হল না ওঁর সঙ্গে? কর্নেলসায়েবের সঙ্গে এসেছেন উনি। নিউজপেপারের লোক।

জয়দেববাবু ঘুরলেন। এবার মুখে হাসির ছাপ। সরি জেন্টলম্যান। আজকাল লোক চেনা দায় বুঝলেন তো? আসুন, আসুন! আমি একটা স্টেটমেন্ট দেব। হেডিং দেবেন ফ্রম হিন্দুকুশ টু লোয়ার বেঙ্গল। আমি প্রাচীন গ্রিকদের দেখা সেই ‘গঙ্গারিডি’ সাম্রাজ্য আবিষ্কার করেছি। পালযুগ পর্যন্ত সেই সাম্রাজ্য টিকে ছিল। হখমনশীয় পারস্যসাম্রাজ্যের কথা শুনেছেন? ফাইভ হান্ড্রেড ফিফটি এইট বিসি টু থ্রি হান্ড্রেড থার্টি বিসি। দারিয়ুসের রাজত্ব ছিল নীল নদ থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত। তখন অলরেডি বৌদ্ধযুগ চলেছে। হখমনিশীয়দের সাম্রাজ্য প্রচলিত আরামাইক ভাষা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। কাজেই অশোক আরামাইকে অনুশাসন চালু করলেন। কান্দাহার ইডিক্টস, ইউ নো! হিন্দুকুশ এরিয়ার বৌদ্ধরা আরামাইক স্ক্রিপ্ট থেকে খরোষ্ঠী ইডিক্টস অন সিলভার লিফ।…

কথা বলতে বলতে হাঁটছিলেন জয়দেব। রমা শ্বশুরের একটা বাহু ধরে আছেন। একবার ঘুরে চোখের ইশারায় আমাকে কেটে পড়তে বললেন। সুন্দরী। পরস্ত্রীর এই ভঙ্গি বুকের ভেতর সেতারের ঝংকার তুলেই থেমে গেল। ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটা এ মুহূর্তে আমার মাথায় বিপজ্জনকভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে।

রমা শ্বশুরকে পূর্বদিকে খোলা বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢোকালেন। দক্ষিণের কোণে গেস্টরুমের ব্যালকনিতে আমার চোখে পড়ল। কর্নেল চুরুট কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে বাইনোকুলার। ফিরেছেন তা হলে!

ওপরে গেস্টরুমে ঢুকেই বললাম–মার্ডার উইপন!

 কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখেই বলেন–হুঁ!

–শুনুন! মার্ডার উইপন সেই ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জটা নদীর ঘাটে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। ঝোঁপের ভেতর পড়ে ছিল। কিন্তু হঠাৎ জয়দেববাবু গিয়ে খপ করে কেড়ে নিয়ে নদীতে ছুঁড়ে ফেললেন।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে ঘরে এলেন। বললেননদীতে ছুঁড়ে ফেললেন?

–হ্যাঁ। বললেন, নাড়ু ডাক্তার এই ইঞ্জেকশন দিয়ে ওঁকে পাগল করে দিচ্ছে। উনি পাগল সাব্যস্ত হলে ওঁর উইল নাকি বেঁচে যাবে। অসম্বন্ধ প্রলাপ। তারপর আমাকে চার্জ–হু আর ইউ টু ইন্টারফিয়ার ইন মাই পার্সোনাল অ্যাফেয়ার? নন্দকে ডাকতে থাকলেন। ভাগ্যিস রমাদেবী গিয়ে বাঁচালেন।

–লক্ষ্য করেছি। তো সিরিঞ্জটাতে নিডল ফিট করা ছিল?

 –ছিল। বোঝা যাচ্ছে কমলেশ তাড়াহুড়ো করে ছুঁড়ে ফেলেছিল। জলে পড়েনি।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–দশটায় মুখার্জির কোয়ার্টারে কফির নেমন্তন্ন। কিন্তু যাওয়া হচ্ছে না। ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরুব।

কাল রাত্রে সিঁড়ির নীচের দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছিল। আপনাকে ডাকলাম—

কর্নেল একটু হাসলেন।সব পুরনো অভিজাত বাড়িতে রাতবিরেতে পুরনো মানুষদের আত্মারা চলাফেরা করে। জয়দেববাবু বলছিলেন, আত্মা অমর। হি ইজ রাইট। তাছাড়া আমিও রবিঠাকুর কোট করে বলেছিলাম, অতীত বর্তমানের মধ্যে কাজ করে।

বিরক্ত হয়ে বললাম–বাজে কথা। কেউ ঢোকার চেষ্টা করছিল। কোনও জ্যান্ত মানুষ।

–ডার্লিং! শেষপর্যন্ত যা ঘটেনি, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।

–সোমদেববাবুর পাত্তা নেই। ভারি অদ্ভুত লোক তো!

–শুনলাম উনি দায়ে না ঠেকলে নটা-সাড়ে নটার আগে বিছানা থেকে ওঠেন না।

দরজায় রমা দেখা দিলেন। কঁচুমাচু মুখে বললেন-জয়ন্তবাবু রাগ করেননি তো?

বললাম–না, না। আমি তো জানি ওঁর অবস্থা। তবে ইঞ্জেকশনের…

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–ওঁর ঘরের বাইরে জানালার নীচে কোনও ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পিউল খুঁজে পাইনি। রামা কি পেয়েছ?

রমা বললেন নাহ্। আমি খুঁজছিলাম। সেইসময় বাবা মশাইয়ের ডাকাডাকি শুনতে পেয়ে দৌড়ে গেলাম। আপনি এখন কফি খাবেন?

নাহ্।

কোনো অসুবিধে নেই। রেডি আছে। পাঠিয়ে দিচ্ছি। একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে রমা ফের বললেন–লক্ষ্মীকে দিয়ে পাঠাচ্ছি। বাবামশাইয়ের দিকে আমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ঘরে ফিরেই পাগলামি শুরু করেছেন। টিংকুর বাবা ফার্মে গেল। টিংকুর জেঠু এখনও ঘুমোচ্ছেন।

বলে রমা চলে গেলেন। কর্নেল পোশাক বদলাতে গেলেন বাথরুমে। তারপর বেসিনের জলে হাত ধুলেন। ফিরে এলে বললাম–ভদ্রমহিলা খালি পায়ে কেন চলাফেরা করেন? অবাক লাগছে।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–মেয়েরা নাকি প্রকৃতির অংশ। একটা বইয়ে পড়েছি, মধ্যযুগে ইউরোপের লোকেরা বিশ্বাস করত উইমেন স্পিক টু দা। নেচার অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য ল্যাংগুয়েজ অব দা নেচার। পায়ে জুতো থাকলে নেচারের সঙ্গে যোগসূত্র ছিঁড়ে যায়। খালি পায়ে হেঁটে দেখো। ইউ মে ফিল দা রিদম অব নেচার। অবশ্য তুমি পুরুষ। মেয়েদের যে সব সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় আছে, তোমার নেই।

হাসতে হাসতে বললাম–বোগাস! ভদ্রমহিলা হয়তো কোনও ব্রত পালন করছেন।

–মেয়েদের ব্রত ব্যাপারটাও কিন্তু টু কমিউনিকেট উই দা নেচার থু সাম মিডিয়াম। সেগুলোই রিচুয়ালস।

–আপনি জয়দেববাবুর দোসর। উনি আমাকে ইতিহাস শোনাচ্ছিলেন। কাগজে স্টেটমেন্ট দেবেন। হেডিং দিতে হবে, ফ্রম হিন্দুকুশ টু লোয়ার বেঙ্গল। আপনারটাও হেডিং হওয়া উচিত; উইমেন অ্যান্ড নেচার।

–সুসান গ্রিফিনের ওই নামেরই একটা বই আছে। তোমাকে দেব। গ্রিফিন উইমেনস লিবের দুর্ধর্ষ প্রবক্তা। এই মার্কিন মহিলার কলমের জোর আছে বটে। উওমেন-নেচার সম্পর্কটা যে পুরুষদেরই বানানো চক্রান্ত, সেটা প্রমাণ করে ছেড়েছেন।

লক্ষ্মী ট্রে নিয়ে এল। প্রচুর টোস্ট, এগপোচ, কলা, আপেল, সন্দেশ। কফির পট।…

ফটক দিয়ে আমরা বেরিয়েই সাইকেল রিকশো পেলাম। কর্নেল রিকশোওয়ালাকে বললেন–ইন্দ্রপুরী আবাসন।

অনেক গলিখুঁজি ঘুরে চওড়া রাস্তা। সেখান থেকে নদী দেখা গেল বাঁদিকে। ডানদিকে ছোট রাস্তায় মোড় নিল রিকশো। দুধারে একতলা সব নতুন বাড়ি। রিকশো একবার দাঁড় করিয়ে কর্নেল এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলেন–সি থ্রি থ্রি কোনদিকটায় পড়বে বলতে পারেন?

বাঁয়ে ঘুরে পার্ক দেখতে পাবেন। পার্কের নর্থে সি ব্লক।

বাড়িটা পাওয়া গেল। সামনে একটুকরো ফুলবাগিচা। বারান্দায় গ্রিল। আমরা গেটের কাছে রিকশো থেকে নামলে একটি কিশোরী দৌড়ে এল। এসেই কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়াল। সম্ভবত পাদ্রিসায়েব ভাবল।

কর্নেল বললেন–বেণীমাধববাবুকে খবর দাও। বলো কর্নেল সরকার এসেছেন।

–দাদু আমাকে বলেছে। আসুন!

আমরা বসার ঘরে ঢুকলাম। সাম্প্রতিক মফস্বলের সচ্ছল মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের বাড়ি। বসার ঘরে সোফাটোফা। বুক শেলফ। একটা টিভি। কোনার টুলে ঝালরকাটা ঢাকনার ওপর টেলিফোন।

এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, রোগা, ফ্যাকাসে চেহারা, হাতে ছড়ি নিয়ে ঢুকলেন। নমস্কার! নমস্কার! বলে কর্নেলের মুখোমুখি বসলেন। আমাদের এই রিটায়ার্ড ফিজিশিয়ানদের আমৃত্যু কতকগুলো লায়েবিলিটি থেকে যায়। তাই থানা থেকে ফোন করল যখন, আমি বুঝলাম, আই মাস্ট বিয়ার দা লায়াবিলিটি, হোয়াটেভার দ্যাট ইজ। তো আপনি কর্নেল সায়েব। ইনি আপনার জুনিয়র অফিসার, আই থিংক।

কর্নেল সে-কথার জবাব দিলেন না। বললেন কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করেই চলে যাব।

কয়েকটা কেন? ইউ আস্ক মি হান্ড্রেড কোয়েশ্চেনস। আই উইল আনসার।

–আপনি হাসপাতালে সার্জারি ওয়ার্ডের হেড ছিলেন?

–ছিলাম। ডাঃ বেণীমাধব হাসলেন। শেষ পর্যন্ত মর্গের চার্জে ঠেলল। বুঝলেন তো? আজকাল সবখানেই কেলোর কীর্তি চলেছে। তবে আই ওয়াজ অলওয়েজ স্যাটিসফায়েড উইদ মাই জব।

জয়দেব রায়ের মেয়ে পারমিতার বডি—

 ডাক্তার দ্রুত বললেন–আই সি। কিন্তু সে নিয়ে তো কোনও কেস হয়নি।

–পারমিতার মৃত্যুর কারণ কি শ্বাসরোধ?

–তা-ই। আপনি রিপোর্ট চেক করেছেন কি? ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, এক্সকিউজ মি কর্নেলসায়েব, দা মেডিক্যাল টার্মস ইউ ননা!

বডির এক্সটার্নাল চেক করেছিলেন কি?

 –সিওর। যেহেতু হ্যাংগিং কনডিশনে পাওয়া গেছে, সেটা প্রাথমিক কাজ।

বডির কোথাও ইঞ্জেকশনের চিহ্ন লক্ষ করেননি?

 ডাক্তার ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন রিপোর্টে সব ডিটেলস আছে। হোয়াই আস্ক মি?

–প্লিজ! আপনার তেমন কিছু চোখে পড়েছিল কি না মনে আছে? একটু ভেবে বলুন।

ডাক্তার স্মরণ করার চেষ্টা করে বললেন–পিঠে একইঞ্চি ক্ষত ছিল। ছড়ে যাওয়া চিহ্ন। দ্যাট ওয়জ এক্সপ্লেন্ড। গাছ থেকে বডি নামাবার সময় নাকি হাত ফস্কে পড়ে যায়। মাটিতে ইটের টুকরো ছিল।

–তা হলে পিঠে ছড়ে যাওয়া চিহ্ন ছিল?

 ছিল। আমি সেটা মেনশন করেছি রিপোর্টে।

–একটু ভেবে বলুন। চিহ্নটা হার্টের উল্টোদিকে ছিল?

–পসিবলি। রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখুন। নতুন নতুন সব ছোকরা ডাক্তার– এসেছে। উই আর ওল্ড হ্যাগার্ডস। রিপোর্টটা তাদের দেখান।

কর্নেল উঠলেন। থ্যাংকস। এই যথেষ্ট।

–গৃহস্থবাড়ি এসেছেন। একটু চা অন্তত—

নাহ্। থ্যাংকস।

ভদ্রলোক প্রায় হতবাক হয়ে বসে রইলেন। কর্নেল হন্তদন্ত হাঁটছিলেন। বাইরে গিয়ে দেখলাম, বারান্দায় বাড়ির মেয়েদের একটা ভিড়। পুতুলের মতো দেখাচ্ছে তাদের।

রাস্তার মোড়ে পার্কের কাছে গিয়ে বললেন–কী বুঝলে?

মর্গে ঠেলে দেওয়ায় উনি খুশি ছিলেন না।

কারেক্ট।

কাজেই দায়সারা কাজ করতেন।

 –একজ্যাক্টলি।

–পারমিতাকেও নন্দের মতো বিষাক্ত ইঞ্জেকশানে খুন করে বডি ঝোলানো হয়েছিল।

–ফাইন! তোমার মাথা খুলেছে।

–অ্যান্ড আই ডিসকভার্ড দা মার্ডার উইপন।

হুঁঃ।

পার্ক পেরিয়ে গিয়ে খালি সাইকেল রিকশো পাওয়া গেল। কর্নেল রিকশোওয়ালাকে বললেন–নিউমার্কেট।

বলে কর্নেল হাসলেন। বেতলা ফরেস্টে রাস্তার ধারে একবার পার্ক হোটেলে খেয়েছিলাম। টালির চালাঘর। নড়বড়ে কাঠের টেবিল-চেয়ার। তবে উঁড়সের তরকারিটা ছিল অপূর্ব। আসলে ব্যাপারটা হল, জয়দেববাবুর থিওরি অনুসারেই দেশটা চলছে। উনি এখানে গ্রিকদের জানা গঙ্গারাইড রাজ্যে বাস, করছেন। ক্রমশ ভাষায় ইংরেজি যে হারে ঢোকাচ্ছি, আমিও ব্যতিক্রম নই এবং তুমিও নও–তাতে বছর পঞ্চাশ পরে পিজিন ইংলিশ ‘বাংরেজি’ হবে বাংলার লিঙ্গুয়া গ্রাংকা। কলকাতায় একবার ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, সুরেন ব্যানার্জি রোডে যাব। সে বলে, কোথায় সেটা? বলেই গিয়ার টামল–ও! এস এন ব্যানার্জি রোড! যাই হোক, বেতলার জঙ্গণে পার্ক হোটেল থাকলে কোদালিয়ায় নিউ মার্কেটে আপত্তি কী? দুটোতেই যুক্তি আছে। বেতলা ন্যাশনাল পার্ক থেকে পার্ক কথাটা আসতেই পারে। কোদালিয়ায় নতুন সাজানো গোছানো একেলে রীতির বাজার নিউ মার্কেট হবেই।

বকবকানিতে কান ঝালাপালা হলেও সময় কেটে গেল। একটা বাসস্টেশন চোখে পড়ল। অসংখ্য বাসের ভিড়। মানুষজন। ট্রাক-টেম্পো-সাইকেলরিকশা গিজগিজ। তারপর দোতালা নতুন বিশাল বাড়ির মাথায় নিউমার্কেট সাইনবোর্ড। ভেতরে করিডরের দুধারে দোকানপাট। থরেথরে উজ্জ্বল ভোগ্যপণ্য সাজানো। মফস্বল বাংলা প্রচণ্ড বদলে গেছে বটে!

রিকশা থেকে কর্নেল দুধারে তাকাচ্ছিলেন। একটু পরে ডাকলেন–এস!

উল্টোদিকে একটা ডাক্তারখানায় ঢুকলাম আমরা। নেমপ্লেটে লেখা ডাঃ এন জি চক্রবর্তী এবং একসার ইংরেজি হরফ। ভেতরে কাঠের পার্টিশন। সামনে ওষুধের আলমারি। এক যুবক ঝিমোচ্ছিল কাউন্টারের সামনে। কর্নেল বললেন– ডাক্তারবাবু আছেন?

সে আমাদের দিকে না তাকিয়েই বুড়ো আঙুল দিয়ে পার্টিশনের দিকটা দেখাল। আমরা সটান গিয়ে ঢুকলাম। ইনিও প্রবীণ মানুষ। কিন্তু চেহারায় গ্রাম্য ছাপ। কর্নেলকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন–গুড মর্নিং! হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?

কর্নেলকে বোধ করি সায়েব ভেবেছিলেন ডাঃ নাড়ুগোপাল চক্রবর্তী। কর্নেল বসেই বিনা ভূমিকায় বললেন–আপনি রায়ভবনের জয়দেব রায়কে কি স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন, নাকি অন্য কিছু?

ডাক্তারবাবু গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে বললেন–আপনার পরিচয়?

কর্নেল পকেট থেকে তার নেমকার্ড বের করে দিলেন। ডাক্তারবাবু খুঁটিয়ে পড়ে বললেন বুঝলাম না। আপনি কি আই বি অফিসার ইন ডিসগাইস?

আমার দাড়ি টেনে দেখতে পারেন।

 রসিকতায় ডাক্তারবাবু একটুও হাসলেন না। বললেননন্দের মার্ডারকেসের তদন্তে এসেছেন? এইমাত্র শুনলাম কমলেশ কবুল করেছে। তো এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?

আপনি জয়দেববাবুকে কী ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন?

–ডেকাডিউরেবলিন।

না ডাঃ চক্রবর্তী! আপনি দিয়েছিলেন নার্কোটিক ড্রাগ।

–ব্লান্ট লাই। কে বলেছে?

ইঞ্জেকশনের কয়েকটা অ্যাম্পিউল বলেছে। বলে কর্নেল পকেট থেকে তিনটে অ্যাম্পিউল রে করলেন। ফের বললেন–জয়দেব রায়ের জানালার বাইরে পড়েছিল।

ডাক্তারবাবু গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে বললেন-ওটা নার্ভের ওষুধ। অন্যায় করিনি।

–আপনি তো এম বি বি এস নন?

 –আই অ্যাম আ রেজিস্টার্ড মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার।

–আপনি হাজারিবাগ গভর্নমেন্ট হসপিটালে ডিসপেন্সিং কেমিস্ট ছিলেন। কোদালিয়ায় ফিরে মেডিক্যাল প্র্যাকটিস শুরু করেন?

ডাক্তারবাবুর মুখ সাদা হয়ে গেল। গলা ঝেড়ে বললেন–এ কেসের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? রুণ মানুষের চিকিৎসা করা অন্যায় নয়। মফস্বলে ডাক্তারের অভাব। আমি অভিজ্ঞ ডাক্তার। এলাকায় আমার পপুলারিটি আছে।

–আপনি তো সোমদেববাবুর থিয়েটার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট?

–থিয়েটারে আমার আজীবন নেশা। কিন্তু নন্দের মার্ডার কেসের সঙ্গে…

নাহ্। এ কেসের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নেই।

–তা হলে হঠাৎ ওসব প্রশ্ন কেন?

–আপনি সত্যিই নার্ভের ওষুধ ইনজেক্ট করেছিলেন জয়দেববাবুর শরীরে। তবে তার সঙ্গে মর্ফিয়া গ্রুপের যে ওষুধ ছিল, তার ক্রিয়া বিপজ্জনক। সেটা নার্কোটিকস্ ছাড়া কিছু নয়। সুস্থ মস্তিষ্কের স্নায়ু ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। হ্যালুসিনেশন রোগ দেখা দেয়। ক্রমশ রোগী শিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়। রিয়্যাল-আনরিয়্যালের তফাত বুঝতে পারে না। সে অবসেসনের মধ্যে থাকে। বিশেষ করে রাতের দিকে এ রোগের লক্ষণ বেড়ে যায়। আপনি এই বিখ্যাত গল্পটি নিশ্চয় জানেন, এক ভদ্রলোক রাত্রে নিজের পোশাক বাগানে পুঁতে রেখে আসতেন। দিনে সেই পোশাক খুঁজে না পেয়ে চাকরকে বকাবকি করতেন। আপনি নিশ্চয় মালোর্পতির ‘দা ফেনোমেনোলজি অব পার্সেপশন’ বইটা পড়েননি। ওতে এক রোগিণীর কথা আছে। তিনি দিনদুপুরেই চিৎকার করতেন, জানালার নীচে একটা লোক! জানালার নীচে একটা লোক! অথচ কোনও লোককে দেখা যেত না। কিন্তু রোগিণী তার চেহারা ও পোশাকের ডিটেলস বর্ণনা দিতেন। এইসব রোগীর ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ব্যাপার হল, এঁরা দীর্ঘকাল কোনও উপেক্ষা-তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভোগ করলে এঁদের একটা সাংঘাতিক অবসেসন তৈরি হয়। অবচেতনায় পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর অভিমান কোনও এক মুহূর্তে বার্স্ট করে। তখন তারা এক অন্ধ শক্তির হাতের পুতুল মাত্র। তারা জানেন না কী করছেন।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। ডাক্তারবাবু তেমনি গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে আছে– পলকহীন। কোনও কথা বললেন না।

কর্নেল বেরিয়ে গিয়ে হনহন করে হাঁটতে থাকলেন। নিউমার্কেট এলাকা ছাড়িয়ে গিয়ে নির্জন রাস্তায় তিনি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বাইনোকুলারে আকাশদর্শনে ব্যস্ত হলেন। বললাম–পাখি?

–আভাঁ গার্দ।

তার মানে?

–ডার্লিং! এই প্রখ্যাত টার্মটি তোমার জানার কথা।

কি আশ্চর্য! ওটা তো সমাজতত্ত্বের টার্ম। চিন্তার ক্ষেত্রে যারা এগিয়ে থাকে। অ্যাডভান্স গার্ডের ফরাসি বয়ান। আকাশে তারা থাকে না। তারা মাটির বাসিন্দা।

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে একটু হেসে বললেন–হিমালয় পেরিয়ে আসা সাইবেরীয় হাঁসের একটা আগাম ঝক মালঞ্চীর বিলে যাচ্ছে। একমাস পরে ওরা আলিপুর চিড়িয়াখানার জলায় যাবে। যাই হোক, উত্তেজনার পর চমৎকার একটা রিলিফ পাওয়া গেল।

বলে আবার হাঁটতে থাকলেন। বললাম–আপনি সত্যিই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। ওই গ্রাম্য কোয়াক ডাক্তারবাবুকে অত সব হেভি তত্ত্ব বোঝানোর কি কোনও দরকার ছিল?

–ছিল। তবে গ্রাম্য কোয়াকদের এত ছোট করে দেখো না জয়ন্ত। জন্মগত প্রতিভা এঁদের কারও কারও থাকে। অশিক্ষিত পটুত্ব বলে একটা কথা আছে। তার জোরে এঁদের কেউ-কেউ তথাকথিত পশ্চিমফেরত বড়বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারদেরও কান কাটতে পারেন।

–হয় তো পারেন। কিন্তু বুঝতে পারছি না নাডুডাক্তার কোন স্বার্থে জয়দেব রায়কে পাগল করতে যাবেন।

–তুমি বড্ড অমনোযোগী, জয়ন্ত! উনি সোমদেবের থিয়েটার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। সোমদেবের প্ররোচনায় এ কাজটা করা ওঁর পক্ষে স্বাভাবিক। আর জয়দেববাবু পাগল হয়ে গেলে আর উইল অকেজো হয়ে যাবে। পূর্বপুরুষের অমন একটা বাড়ি…

দ্রুত বললাম–আই সি!

কর্নেল গলার স্বর নামিয়ে বললেন শান্তিদেব বলছিলেন কেন তার বড়দা আমাকে বলেছেন, বাবা পাগল হলে আমরা ভেসে যাব, এটা শান্তিদেব বুঝতে পারছেন না। মনে পড়ছে?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ। কথাটা তা হলে চালাকি?

–পঁচাত্তর বছর বয়সী বুড়ো বাবা। বোঝা যাচ্ছে। একবার মাইনর স্ট্রোক হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনা যে-কোনও মুহূর্তে। কাজেই তাকে পাগল করে ফেললে যদি সম্পত্তিটা বাঁচানোর শক্ত চান্স পাওয়া যায়, ছাড়তে চাননি সোমদেববাবু। তাঁর মৃত্যুর পর কোর্টে উইল পোবেট করাতে হবে। তখন সোমদেব আপত্তি তুলে বলতে পারবেন, বাবা পাগল অবস্থায় উইল করেছিলেন। কাজেই উইলের বৈধতা নেই।

একটু হেসে বললাম–তাহলে সোমদেব আপনার কাছে গিয়ে ভুল করেছেন।

–নিজের ইচ্ছায় যাননি। কিছু তলিয়ে ভেবেও যাননি। রমার কৌশলে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার ঘোষের নির্দেশেই আমার কাছে গিয়েছিলেন। ভুলে যেও না।

হ্যাঁ। দ্যাটস রাইট। কিন্তু ডঃ ঘোষের কাছেই বা কেন গেলেন সোহবে?

বাবা যে সত্যি মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত, তার সার্টিফিকেট সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। ওঁর নার্সিংহোমে কিছুদিন রাখা হত। কিন্তু জয়দেববাবুর মানসিক বৈকল্য সারানোর আর কোনও উপায়ই নেই সম্ভবত। এ বয়সের শিথিল আর বিকল নার্ভকে সুস্থ করার মতো ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।

একটু পরে দেখলাম, আমরা থানার সামনে এসে গেছি। বললাম–আবার থানায়?

–এস তো! বলে কর্নেল আমার হাত ধরে টানলেন। যেন আসামী ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।

দোতলায় এবার অফিসার-ইন-চার্জের ঘরে গেলাম আমরা। উর্দিপরা অফিসার সম্ভাষণ করে বসতে বললেন। কর্নেল আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন জয়ন্ত চৌধুরী। সাংবাদিক। জয়ন্ত, ইনি অশোক মজুমদার।

ওসি হাসলেন। এখানকার লোকে বলে বড়বাবু। সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে আর কী!

–দীপক নিশ্চয় আমার মুণ্ডুপাত করে গেছে?

–সি আই সায়েব একটু আগে বেরুলেন। গ্রামের দিকে একটা এনকোয়ারিতে–যাগে, ছোকরাকে এনে বসিয়ে রেখেছি দিব্যেশদার ঘরে। এখনই ওর একদঙ্গল লোক এসে ঝামেলা করছিল। দিব্যেশদাকে তো জানেন! বাঙাল বুলিতে তাদের সঙ্গে অনেক জোক-টোক করে সামাল দিয়েছে।

–তা হলে ওর ঘরেই যাই?

ওসি ব্যস্তভাবে বললেন, না। কত ভাগ্যে আপনার দর্শন পেয়েছি। মর্নিংয়ে এলেন, তখন তো এক কাপ চা-ও খেলেন না। সরি! আপনি তো কফি ছাড়া কিছু খান না।…

একটু পরে দিব্যেশবাবু এক কেতাদুরস্ত চেহারার যুবকের কাঁধে হাত রেখে এঘরে ঢুকলেন। একেবারে ফিল্মের হিরো। কিন্তু মুখটা গম্ভীর। মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। দিব্যেশবাবু সহাস্যে বললেন–মুখার্জি কইয়া গেল, কর্নেল সায়েবরে অ্যারেস্ট করবা। আমি ব্যাক না করা পর্যন্ত বওয়াইয়া রাখবা। সি দা অডাসিটি। আমি কইলাম, ফোর্ট উইলিয়াম খবর পাইলে কমান্ডো আইয়া পড়ব।

বলেই কাঞ্চনের দিকে ঘুরলেন। ইনি ক্রিসমাসের সান্তাক্লজ নন ভাইটি! মিলিটারির কর্নেলসায়েব। না, না! ভয় পাইবা না। নামেই কর্নেল। ওই দেখ, গলায় কী ঝুলতাছে। পাখি দেখা যন্তর। পাখি ছাড়া কিছু দ্যাখেন না। মানুষজন ব্যাবাক। বও ভাইটি বও!

কর্নেল বললেন–বসো, কাঞ্চন!

এমন ভঙ্গিতে বললেন যেন কতকালের চেনা। কাঞ্চন কুণ্ঠিতভাবে বসল।

কর্নেল বিনা ভূমিকায় বললেন রমা আমাকে বলছিল, পারুর সঙ্গে তোমার বিয়ে হলে পারু সুখী হত। কিন্তু পারুর বাবা একে মাস্টারমশাই, তাতে পাগল। রমার কাছেই শুনলাম, বিয়ের পরও পারুর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছিল। রমা এ ও বলল, তোমাদের গোপনে দেখাসাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিত সে।

কর্নেল নিশ্চয় এতগুলো চমৎকার মিথ্যা আওড়ে গেলেন। কাঞ্চন মুখ নামিয়ে বসে রইল।

–পারু গলায় দড়ি দিয়ে মরত না, যদি সে-রাতে তুমি ওর কথামতো যেতে। রমা তোমাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করত। পারু তৈরি ছিল। তুমি গেলে না। কেন যাওনি কাঞ্চন? তুমি গেলে মেয়েটা সুইসাইড করত না।

কাঞ্চন মুখ তুলে আস্তে আস্তে বলল–গিয়েছিলাম।

পারু কথামতো বাগানে অপেক্ষা করছিল?

–হ্যাঁ। কিন্তু হঠাৎ আমাদের ওপর টর্চের আলো পড়ল। আমি নদীর দিকের দরজা খুলে পালিয়ে গেলাম।

টর্চের আলো পড়েছিল?

–হ্যাঁ।

কর্নেল বললেন–এই যথেষ্ট। দিব্যেশ! কাঞ্চনকে ছুটি দাও…

.

০৬.

 আমরা সাইকেল রিকশোয় চেপে রায়ভবনে ফিরছিলাম। পথে যেতে যেতে বললামরমা দেবীর নামে আপনি একরাশ মিথ্যা আওড়ে গেলেন দেখে অবাক লাগছিল।

কর্নেল একটু হাসলেন। কোনও জিনিস সত্য কি না সেটা মিথ্যা দিয়েই বাজিয়ে নিতে হয়। নৈলে সত্য-মিথ্যার তফাত বোঝা যায় না। আমার থিওরি সত্য কি না, যাচাই করতে মিথ্যার দরকার ছিল।

কী আপনার থিওরি?

মাঝেমাঝে পারুর এই রাতের অভিসার খুনী টের পেয়েছিল। তাই সে সে রাতে তৈরি ছিল। কাঞ্চন পালিয়ে যাওয়ার পর খুনী গিয়ে পড়ে পারুর মুখোমুখি। পারু সম্ভবত চলে আসার জন্য ঘুরে পা বাড়াতেই খুনী তার পিঠে মারাত্মক ইঞ্জেকশনের নিডল ঢুকিয়ে দেয়। পারু মারা পড়ে। তুমি লক্ষ্য করেছ। কি নন্দের ঘর দক্ষিণপূর্ব কোণে? পারু নিশ্চয় অন্তিম আর্তনাদ করেছিল। নন্দ ছুটে গিয়ে খুনী ও পারুর সামনে পড়ে। এ অবস্থায় যে কি না বাড়ির বংশগত পুরাতন ভৃত্য, সেই নন্দ কী করতে পারে? খুনী বাড়িরই লোক। তাকে তো সে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারে না। এ একটা পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয় কি? অতএব নন্দ বাড়িরই অন্য কোনও লোকের সাহায্যে গলায় দড়ি বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে সাজায়। হাকমলেশ যে ছবি এঁকে ব্যাপারটা দেখিয়েছে, সেই পদ্ধতিতেই কাজটা করা হয়। বাড়ির সাহায্যকারী লোকটি এবং নন্দ দুজনেরই স্বাভাবিক সন্দেহ হতে পারে, পারুকে কী ভাবে মারা হল? দেহে ক্ষতচিহ্ন নেই, অথচ মৃত!

–তাহলে ধরে নিচ্ছি বডিতে আঘাতের চিহ্ন খুঁজতে গিয়েই পিঠে ইঞ্জেকশনের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিল ওরা।

কিন্তু সেই চিহ্ন তো সূক্ষ্ম!

–জয়ন্ত! এভাবে অতর্কিতে দেহে ইঞ্জেকশনের নিল ঢোকালে রক্তচিহ্ন থাকা স্বাভাবিক। কাজেই পিঠে কোনও ভেঁতা জিনিস ঘষে ছড়ে যাওয়ার ক্ষত তৈরি করে দুজনে।

সাহায্যকারী নিশ্চয় সোমদেব? নাকি শান্তিদেব?

কর্নেল চুপ করে রইলেন। একটু পরে বাইনোকুলারে আকাশ দেখতে থাকলেন। রায়ভবনের ফটকে রিকশো থেকে নেমে দেখলাম, রমা এদিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে ঢুকলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বললেন বাবামশাইয়ের আবার পাগলামি বেড়ে গেছে। ওঁর ঘরে একটা মরচেধরা তলোয়ার আছে। সেটা দিয়ে আঙুল কেটে রক্তারক্তি করেছেন। টিংকুর জেঠুকে ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছি দুঘণ্টা আগে। এখনও ফিরছেন না। এখনই এটিএস দেওয়া দরকার। টিটেনাস হয়ে যেতে পারে। ডেটল দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে অবশ্য।

আমরা জয়দেববাবুর ঘরে গেলাম। দেখলাম, ডানহাতের বুড়োআঙুল আর তর্জনীতে পট্টিবাঁধা। খাটে বসে ছোট্ট ব্রাশ দিয়ে একটা কালচে চাকতি সাফ করছেন। আমরা ঢোকামাত্র ফুঁসে উঠলেন–ট্রেসপাসারুস্ উইল বি প্রসিকিউটেড। গেট আউট! গেট আউট ফ্রম মাই মিউজিয়াম!

রমা দ্রুত বললেন বাবামশাই! ইনি কর্নেলসায়েব আর ইনি কাগজের রিপোর্টার। এঁদের সঙ্গে আপনার তো আলাপ হয়েছে।

জয়দেব রায় একটা ছোট্ট শিশিতে ব্রাশ চুবিয়ে চাকতিতে ঘষতে ঘষতে ফের বললেন—ট্রেসপাসারস উইল বি প্রসিকিউটেড।

কর্নেল বললেন-জয়দেববাবু, শুধু নিকোটোমাইন সলিউশন দিয়ে চাকতিটা সাফ হবে না। খানিকটা প্যারাফিন অয়েল মিশিয়ে নেবেন। নইলে হিতে বিপরীত হবে। সব সাইন মুছে যাবে।

জয়দেব রুষ্ট চোখে তাকিয়ে গর্জন করলেন–ডোন্ট ডিসটার্ব মি। গেট আউট! তারপর সেই ‘পালযুগ বা গুপ্তযুগের’ তলোয়ার তুলে উঠে দাঁড়ালেন।

আমরা বেরিয়ে এলাম। জয়দেব এসে দরজা জোরে বন্ধ করে দিলেন ভেতর থেকে। রমা কেঁদে ফেললেন। কর্নেল বললেন–কেঁদে কী হবে রমা? আমার সঙ্গে এস।

আমরা গেস্ট হাউসে উঠে এলাম। কর্নেল বসে একটা চুরুট ধরিয়ে রমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। রমা দ্বিধার সঙ্গে বসে বললেন–টিংকুর জেঠুর এত দেরি হচ্ছে কেন, বুঝতে পারছি না। নাড়বাবুকে বললেই তো ছুটে আসবেন।

নাড়ুবাবু আর এবাড়ির ছায়া মাড়াবেন না।

 রমা চমকে উঠে বললেন–সেকি! কেন?

উনি এ বাড়িরই একজনের চক্রান্তে তোমার শ্বশুরকে পাগল সাব্যস্ত করার জন্য নার্কোটিক ড্রাগ ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন। ওঁর মৃত্যুর পর কোদালিয়ার প্রত্ন-সংরক্ষণ সমিতি উইলের ভিত্তিতে বাড়ির দখল নিতে এলে আদালতে উইল চ্যালেঞ্জ করা যাবে যে, তোমার শ্বশুর উন্মাদ অবস্থায় উইল করে গেছেন।

রমা তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে ফুঁপিয়ে উঠে মাথা নাড়লেন। না। না। কে এমন চক্রান্ত করবে?

–তোমার ভাসুর এই কাজটি করেছেন। যাইহোক, তোমার শ্বশুরকে যত শিগগির পারো ডঃ ঘোষের সাহায্য নিয়ে যে নার্সিং হোমে বা হাসপাতালে নার্কোটিক ড্রাগে আসক্ত রোগীদের চিকিৎসা হয়, সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। তোমার স্বামীকে বলো। তবে তোমার ভাসুর এই চক্রান্ত করেছিলেন, এ কথা যেন ভুলেও বোলো না। পারিবারিক অশান্তি বাড়বে।

রমা চোখ মুছে বললে–এ বাড়িতে আমার একটুও থাকতে ইচ্ছে করে না। টিংকুর বাবারও না। ফার্মহাউসে বাড়ি করা আছে। আমরা বরং সেখানেই চলে যাব।

তাই যেও। সোমদেবের শাস্তি পাওয়া দরকার। আমি নিরুপায়। আইন নিজের পথে চলবে। সোমদেব এবং নাড়ুবাবু তার ফল ভুগবেন। আর শোনো, আমরা খেয়ে নিয়েই কলকাতা ফিরব।

রমা উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। তারপর বললেন–কিন্তু কমলেশ পারু বা নন্দকে মেরেছে, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। সে এত ভাল…

কান্না সামলাতে না পেরে রমা বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল গোছগাছ শুরু করলেন। বললেন–স্নান করছি না। তুমিও কোরো না। সাড়ে বারোটায় একটা ট্রেন আছে। ওই ট্রেনটা ধরতেই হবে। কলকাতা ফিরে ট্রাঙ্ককলে দিব্যেশকে যা জানাবার জানাব। সোমদেব অ্যান্ড দ্যাট কোয়াক ডক্টর মাস্ট বি পানিশড।

কিন্তু কমলেশ কি সত্যিই পারু এবং নন্দকে…

কর্নেল হঠাৎ চটে গেলেন। –ইউ ফুল! জয়দেববাবুর ঘরে নিকোটোমাইন সলিউশন দেখে এখনও বুঝতে পারছ না কী ঘটেছে? বুঝতে পারছ না তোমার হাত থেকে ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ কেড়ে কেন ছুঁড়ে ফেলতে হল জয়দেববাবুকে?

মাই গুডনেস! তা হলে জয়দেববাবু নিজের মেয়ে খুন করেছিলেন?

–দ্য সাইকিক কিলার’স ভায়োলেন্ট রিঅ্যাকশন। নন্দ সেই খুনের সাক্ষী। নন্দ পাগলা মনিবকে বাঁচাতে কমলেশের সাহায্য নিয়েছিল। জয়দেববাবুর উইলে তার প্রিয় ছাত্র কমলেশ উত্তরাধিকারী। কাজেই তার বিরুদ্ধে অবসেসনে জয়দেবের কোনও ঘৃণা নেই, বরং আছে প্রগাঢ় স্নেহ।

কিন্তু নন্দ খুনের সাক্ষী হয়ে রইল। তা ছাড়া কল্পিত সিল চুরির অবসেসনে আক্রান্ত জয়দেব। তাই নন্দকে মরতে হল। শ্বশুরকে বাঁচাতে কমলেশ আগের পদ্ধতিতে নন্দের বডি ঝোলাল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না মর্গের নতুন ডাক্তারের সতর্কতায়। তখন কমলেশ সমস্ত দায় নিজের কাঁধে নিল। তোমার মনে পড়ছে গতরাতে দীপক মুখার্জিকে বলছিলাম, ক্ষুদিরামস্ আর স্টিল বর্ন অ্যান্ড ডাই।

–কিন্তু রমা বলছেন, সে রাতে কমলেশ ও নন্দ বাগানে যায়। পরে কমলেশ পালিয়ে আসে।

–সরল ব্যাখ্যা সম্ভব। দুজনে নদীর ঘাটে জ্যোৎস্না রাতে বেড়াতে যেত– রমাই বলেছে। জয়দেব ঘাটে ওত পেতে ছিলেন। নন্দের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইঞ্জেকশনের নিডল ঢুকিয়ে দেন। হতবুদ্ধি কমলেশ পালিয়ে আসে। পরে বুদ্ধি করে সোমদেবের থিয়েটারের আসবাবের ঘর থেকে দড়ি নিয়ে গিয়ে নন্দের বডি একই পদ্ধতিতে ঝোলায়।

উত্তেজনায় একটা সিগারেট ধরাতে হল। আজকাল সিগারেট কদাচিৎ টানি। বললাম–কিন্তু কমলেশ নির্দোষ। তাকে বাঁচাবেন না?

কমলেশ বেঁচে যাবে। মানিক চ্যাটার্জিরা আছে। তুমি শুনেছ, ইতিমধ্যে পলিটিক্যাল প্রেসার এসেছে। এস ডি পি ও প্রেসারের মুখে পড়েছেন। এটা আইনের দিক থেকে অন্যায়। কিন্তু মানুষের জন্য আইন, না আইনের জন্য মানুষ, ডার্লিং? একজন নির্দোষ সৎ বিবেকবান যুবককে বাঁচাতে আইনকে কেউ যদি লাথি মারে–পলিটিক্যাল প্রেসার তো দূরের কথা, আই ওয়েলকাম এনি সর্ট অব ড্যাম থিং।

একটু হেসে বললাম-খুনের রহস্যটা চাপা থেকে যাবে?

–আই কোট জয়দেব রায়। সমাজের হিতসাধনের জন্য সবকিছু করা চলে। রহস্য তুমি-আমি জানলাম। দ্যাটস এনাফ। রহস্য চাপা থেকে বরং এই বাড়িটা একটা মিউজিয়াম হোক। এখানে একটা প্রত্ন-গবেষণাকেন্দ্র হোক। দেশবিদেশের পণ্ডিতরা আসুন। সেই মহৎ উদ্দেশ্যের স্বার্থে একটা কেন, একশো রহস্য চাপা রাখতে আমার আপত্তি নেই।

বলে কর্নেল ব্যালকনিতে গেলেন। সেখান থেকে ফের বললেন–হতভাগিনী পারু আর হতভাগ্য নন্দের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে ডার্লিং! কিন্তু তাদের মৃত্যুর শোধ নিতে একজন বৃদ্ধ সাইকিক কিলারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে লাভ কী? এর জন্য প্রকৃত দোষী তো সোমদেব এবং নাড়ডাক্তার। তাদেরই শাস্তি হওয়া দরকার। জয়দেববাবু যদি চিকিৎসায় সেরে ওঠেন এবং স্মৃতি ফিরে পান, তাহলে অজ্ঞানে অবচেতন হিংসায় যে সাংঘাতিক অপরাধ করে ফেলেছেন, তার প্রায়শ্চিত্ত নিজেই করবেন। লেট আস ওয়েট অ্যান্ড সি।…

.

কলকাতায় ফেরার পরদিন বিকেলে অফিস থেকে কর্নেলকে ফোন করলাম। আমার সাড়া পেয়েই বৃদ্ধ রহস্যভেদী বললেন–এবার দৈনিক সত্যসেবককে খরোষ্ঠীলিপিরহস্য উপহার দিতে পারো ডার্লিং! সোমদেব রায় এবং ডাঃ নাড়ুগোপাল চক্রবর্তীকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। জয়দেব রায় কলকাতায় সাইকিয়াট্রিক ডাক্তারের চিকিৎসাধীনে আছেন।

বললাম–শুধু দুটো পয়েন্ট ব্যাখ্যা করুন। সে রাতে জয়দেববাবু টর্চ জেলে বাগানে কেন গিয়েছিলেন?

ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ খুঁজতে।

 –গেস্টরুমের সিঁড়ির নীচের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল কে?

–আবার কে? জয়দেব রায়। সারারাত অবসেসনের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে উনি জ্যান্ত প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াতেন। তোমাকে বলেছিলাম, শিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর কাছে বাস্তব-অবাস্তব একাকার হয়ে যায়। সে কী করছে। নিজেই জানে না। পরে যখন জানতে পারে কী করেছে, যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে। প্রত্ন-তলোয়ার দিয়ে জয়দেবের হাতের আঙুল কাটার চেষ্টা সেই প্রতিক্রিয়া। সেই রোগী চেতনা-অবচেতনার মধ্যে সবসময় ছোটাছুটি করে বেড়ায়। আর একটা কথা। সোমদেব হাতে ছড়ি রাখেন। ওটা ওঁর আত্মরক্ষার অস্ত্র।

-থ্যাংকস। বুঝেছি।

টেলিফোন ছেড়ে কাগজের জন্য ‘স্টোরি’ লিখতে প্যাড টেনে নিলাম।…