অ্যান্টি-ড্রাগ ফরমুলা রহস্য – কর্নেল সমগ্র ৮ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
(কর্নেলের জার্নাল থেকে)
হোটেল দা শার্কের দোতলার ব্যালকনিতে বসে চুরুট টানছিলাম। তখন রাত প্রায় নটা! সমনে একটা বালিয়াড়ির ওধারে সমুদ্র। ডানদিকে টানা ঝাউবন চলে গেছে প্রায় আধ কিলোমিটার। সমুদ্রের শব্দের সঙ্গে ঝাউবনের শব্দ মিলেমিশে এক রহস্যময় অপার্থিব অর্কেস্ট্রা শোনা যায়। যত রাত বাড়ে, অর্কেস্ট্রা আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে। তন্ময় হয়ে শুনছিলাম।
হটাৎ ঝাউবনের ভেতর টর্চের আলোর ঝলকানি।
গত রাতেও এই আলোর ঝলকানি দেখেছি। ভেবেছিলাম কেউ বা কারা রাতের সমুদ্র দেখার জন্য বিচে বসেছিল। এতক্ষণে ফিরে আসছে। কোনও দম্পতি, কিংবা কোনও প্রেমিক-প্রেমিকা, অথবা কোন নিঃসঙ্গ মানুষ।
একটু পরে অবাক হলাম। আলোটা গত রাতে তিনবার জ্বলে উঠতে দেখেছি। আজও তেমনি তিনবার জ্বলল তারপর আর কোনও আলো জ্বলল না। ওদিকটা ঘন অন্ধকার। ঝাউবনটা এই হোটেলের সামনা-সামনি ডানদিকে যেখানে শুরু হয়েছে, সেখানে খোলামেলা বালিয়াড়ি। হোটেলের আলোয় জায়গাটা মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যায়! ঝাউবন থেকে কেউ এলেই চোখে পড়ার কথা। কিন্তু কাল রাতের মতো আজও কাকেও দেখতে পেলাম না।
দিনে দেখেছি, ঝাউবন থেকে সোজা নেমে আসার কোনও পথ নেই। নিচে ঘন কেয়াবন আর গুল্মজাতীয় জঙ্গল। সাপের উৎপাত থাকা সম্ভব। সোজাসুজি জঙ্গল ভেঙে সমুদ্রের সমান্তরাল পিচ রাস্তায় ওঠা যায়। কিন্তু ভ্রমণবিলাসীদের পক্ষে সেটা রীতিমতো একটা অ্যাডভেঞ্চারের শামিল।
ধরা যাক, কেউ বা কারা অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ নিতে জঙ্গল ভেঙে রাস্তায় উঠল। কিন্তু হাতে যখন টর্চ আছে, তখন আলো সে জ্বালবেই।
অথচ আর আলোর পাত্তা নেই। দ্বিতীয়ত, আলোটা তিনবার জ্বলতে দেখলাম পর পর দুটো রাত।
কোনও গোপন সংকেত নাকি?
চন্দনপুর-অন-সিতে অ্যান্টি-ড্রাগ সেমিনারে যোগ দিতে এসেছি। উদ্বোধন করে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেমিনার ব্যাপারটা আমি মোটেও পছন্দ করি না কিন্তু আমার এক বন্ধু ডঃ শক্তিপদ ব্রহ্মের অনুরোধ (তার মাদক বিরোধী সমিতিই এর উদ্যোক্তা) ঠেলতে পারিনি। এ ছাড়া আরও একটা কারণ ছিল। চন্দনপুর অন-সিতে সমুদ্রের বন্যতা আমাকে আকর্ষণ করে। কয়েকবারই নানা সুযোগে এখানে তাই এসেছি। এলাকাটা আমার নখদর্পণে।
আলোর ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামানো নিরর্থক! সমুদ্রের ক্রুদ্ধ গর্জন ঝাউবনে এসে যেন শোকের হাহাকারে পরিণত হচ্ছে, এর চেয়ে আকর্ষণীয় আর কি হতে পারে?
একটু পরে দরজায় কেউ নক করল। বিরক্ত হয়ে উঠে গেলাম। দরজা খুলে দেখি ডঃ ব্রহ্ম। বললেন, “শুয়ে পড়েছিলেন নাকি?”
বললাম, “নাহ্। আসুন।”
ডঃ ব্রহ্ম চাপা গলায় বললেন, “একটা জরুরি দরকারে আসতে হলো।” দরজা এঁটে ওঁকে ব্যালকনিতে নিয়ে এলাম। বললাম, “আপনাকে একটু উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। শরীর খারাপ নয় তো?”
ডঃ ব্রহ্ম আস্তে বললেন, “না। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করছি দুদিন থেকে।”
“ঝাউবনে টর্চের আলো?”
“আলো? ঝাউবনে?” ডঃ ব্রহ্ম একটু থামলেন। “নাহ। আলোটালো নয়। ডঃ মৈত্রের সঙ্গে যে মহিলা এসেছে, সম্ভবত উনি তাঁর স্ত্রী নন।”
একটু অবাক হয়ে বললাম, “আপনি অধ্যাপিকা মহিলার কথা বলছেন কি?”
“হ্যাঁ। প্রথমত, মহিলার পদবি দাশগুপ্তা। দ্বিতীয়ত, আমাকে ক্ষমা করবেন, অমিতা দাশগুপ্তাকে আমি এক যুবকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছি। দে ওয়ার কিসিং ইচ আদার। পার্ভাটেড মহিলা।” ডঃ ব্রহ্মের কথার ঘৃণার ছাপ।
“যুবকটি কে?”
“ডঃ মৈত্রের সঙ্গে এসেছে। পঁচিশের মধ্যে বয়স। এদিকে ডঃ মৈত্র আমার বয়সী। পঞ্চাশোর্ধ্ব। স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছেন অধ্যাপিকা দাশগুপ্তার। তার বয়স তিরিশের বেশি নয়।”
হাসতে হাসতে বললাম, “তাতে কী? শুনুন ডঃ ব্রহ্ম, ওঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলিয়ে অকারণ–”
আমাকে থামিয়ে ডঃ ব্রহ্ম বললেন, “আমি একজন মর্যালিস্ট, কর্নেল সরকার। তাছাড়া এই অ্যান্টি-ড্রাগ ক্যাম্পেনে মর্যালিটির ওপর আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। এখন কথা হলো, সর্ষের মধ্যে ভূত থাকা কি বাঞ্ছনীয়? যুবকটিকে দেখে আমার সন্দেহ হয়, সে ড্রাগ-অ্যাডিক্ট। ওর চেহারা লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন।”
চুরুটে জোরালো টান দিয়ে বললাম, “আমিও কতকটা ড্রাগঅ্যাডিক্ট নই কি ডঃ ব্রহ্ম? এই চুরুট এবং প্রচুর কফি আমার এই বয়সে ভীষণ ক্ষতিকর। তবু দেখুন, এ দুটো ছাড়লে আমার জীবন যেন অনুর্বর হয়ে যাবে। চিন্তাভাবনা থেমে যাবে মনে হয় কি না যে কোনও নেশার ক্ষেত্রে একটা মানসিকতা।”
ডঃ ব্রহ্ম হাসলেন। “নাহ কর্নেল সরকার! চুরুট বা কফি নার্কোটিকসের আওতায় পড়ে না।”
বললাম, “যুবকটির নাম কী জানেন?”
“কৌশলে ডঃ মৈত্রের কাছে জেনে নিয়েছি। আশিস সেন। সে নাকি ডঃ মৈত্রের ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট। আপনি তো সেমিনারে ডঃ মৈত্রের মুখে শুনেছেন, উনি অ্যান্টিড্রাগ প্রবণতা সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা করছেন। মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা।”
“হ্যাঁ। একটা ওষুধ আবিষ্কার করতে চান। যা ইঞ্জেক্ট করলে নাকি ড্রাগ অ্যাডিক্ট নেশা ছেড়ে দেবে এবং তার স্বাভাবিক দেহমন ফিরে পাবে।”
ডঃ ব্রহ্ম আস্তে বললেন, “যার অ্যাসিস্ট্যান্ট মাদকাসক্ত, তিনি কী করে অমন বড়-বড় কথা বলেন?”
“ডঃ ব্রহ্ম! এমন তো হত পারে উনি ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্টের ওপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন?”
ডঃ ব্রহ্ম একটু চুপ করে থেকে বললেন, “মে বি। বাট আই কান্ট টলারেট দ্যাট পার্ভাটেড লেডি-অধ্যাপিকা অমিতা দাশগুপ্তা! সেমিনার কাল শেষ হচ্ছে। কলকাতায় ফিরে মহিলার মেম্বারশিপ ক্যান্সেলের জন্য মিটিং ডাকব।”
বলেই ডঃ ব্রহ্ম “গুডনাইট” জানিয়ে চলে গেলেন। জানি প্রচণ্ড নীতিবাগীশ মানুষ উনি। ডঃ মৈত্র আমার সঙ্গে কথা না বললেও কিংবা কেউ পরিচয় করিয়ে না দিলেও আশিসকে আমি লক্ষ্য করেছি। শান্ত উদাসীন প্রকৃতির যুবক। সম্ভবত কবিতা লেখে। কারণ ওর হাতে কবিতার বই দেখেছি। আজকাল শুধু কবিরাই কবিতা পড়ে।
কিন্তু তার চেহারায় মাদকাসক্তের ছাপ তো লক্ষ্য করিনি।
ডঃ ব্রহ্ম তাকে এবং মিসেস দাসগুপ্তকে চুমু খেতে দেখেছেন! সত্যিই দেখেছেন, নাকি-
দরজায় আবার কেউ নক করল।
খুলে দেখি, ডঃ সুদর্শন মৈত্র। নমস্কার করে বললেন, অসময়ে একটু বিরক্ত করতে এলাম।”
“না, না। আমি এগারোটার আগে শুই না। আসুন।”
ব্যালকনিতে বসে ডঃ মৈত্র একটু হেসে বললেন, “দেশবিদেশে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার রহস্যভেদী হিসেবে সুপরিচিত। এ হেন মানুষের কাছে যদি একটা রহস্যভেদের জন্য অনুরোধ জানাই, আশা করি বিমুখ করবেন না।”
একটু গম্ভীর হয়ে বললাম, “দেখুন ডঃ মৈত্র, আমার বয়স হয়েছে। দাড়ি এবং টাকের অবস্থা লক্ষ্য করুন।”
ডঃ মৈত্র প্রায় অট্টহাসি হাসলেন এবার। “আমি জানি, এ বয়সেও আপনি সিংহের চেয়ে শক্তিমান! এনিওয়ে, আমার রহস্যটা সামান্য।”
অগত্যা বললাম, “বলুন ডঃ মৈত্র।”
ডঃ মৈত্র চাপা স্বরে বললেন, “এই সেমিনারটা হোক্স বলে মনে হচ্ছে আমার। এই উদ্যোক্তা মাদকবিরোধী সমিতি। তার চেয়ারম্যান ডঃ শক্তিপদ ব্রহ্ম গত রাতে এবং আজ কিছুক্ষণ আগে চুপিচুপি কোথায় বেরিয়েছিলেন? উনি বেরিয়ে যাওয়ার পরই বা, ওই ঝাউবনে তিনবার আলোর সিগন্যাল দেখা যায় কেন?”
চমকে উঠলাম। কিন্তু উত্তেজনা চেপে বললাম, “আপনি কি ওঁর প্রতি লক্ষ্য রাখেন?”
“রাখি বলতে পারেন।”
“বিশেষ কোনও কারণ আছে?”
“আছে। এখানে গত পরশু আমি সস্ত্রীক পৌঁছেছি”
জাস্ট আ কোয়েশ্চন, প্লিজ আনসার ইট। আপনার স্ত্রী আপনার পদবি নেননি, এর কারণ কি নেহাত অফিসিয়্যাল অর টেকনিক্যাল?”
“দ্যাটস রাইট কর্নেল সরকার। আমরা একটু দেরিতে বিয়ে করেছি। সদ্য দুমাস আগে। এবার গিয়ে নোটারি পাবলিকের গ্লু দিয়ে কোর্টে অমিতা এফিডেবিট দিয়ে পদবি বদলাবে।”
“হু, বলুন!”
“গত পরশু পৌঁছে ক্যান্টিনে খেতে গিছলাম। আমরা উঠেছি স্যুট নাম্বার ফোরে। নিচের তলায়। তো খেয়ে ফিরে দেখি, আমার ব্রিফকেস খোলা। ওতে আমার সেমিনার পেপারের দশটা কপি ছিল। একটা নেই। কাকেও বলিনি। সামান্য ব্যাপার। ভাবলাম আমারও ভুল হতে পারে। যাই হোক, গতকাল বিকেলে দেখি ডঃ ব্রহ্মের ঘরের পেছনে সেই পেপার–মোট ছটা জেরক্স করা পাতা কুচিকুচি হয়ে পড়ে আছে। আজ মর্নিং সেসনে ডঃ ব্রহ্ম আমার থিম নিয়েই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। হাউ ইট ইজ পসিবিল? ওঁর সাবজেক্ট তো সম্পূর্ণ আলাদা।”
“আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টকে সঙ্গে এনেছেন দেখেছি!”
“হ্যাঁ। আশিস অত্যন্ত বিশ্বাসী ছেলে।”
একটু ভেবে নিয়ে বললাম, “আমি কী করতে পারি, বলুন ডঃ মৈত্র?”
ডঃ মৈত্র ফিসফিস করে বললেন, “ডঃ ব্রহ্ম সম্ভবত এখান সেমিনারের ছলে ড্রাগপাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এসেছেন! আপনি ওঁর দিকে লক্ষ্য রাখুন!”
ডঃ মৈত্র তখনই চলে গেলেন।…
.
কলকাতা ছেড়ে বাইরে গেলেই মর্নিংওয়াক না করে পারি না। সঙ্গে থাকে প্রজাপতিধরা নেট এবং স্টিক। স্টিকটি ছড়ির মতো ব্যবহার করা যায়। বাইনোকুলার এবং ক্যামেরাও গলা থেকে ঝোলে। ভোর ছটায় উঠে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পিচরাস্তা ধরে এক কিলোমিটার হেঁটে বাঁদিকে গুল্মঝোঁপ ভেঙে বালিয়াড়িতে উঠলাম। আধ কিলোমিটার হাঁটার পর ঝাউবনের ভেতর দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখলাম। সমুদ্র থেকে হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড লাল চাকা এক লাফে আকাশে উঠল। আদিগন্ত সমুদ্র লাল হয়ে গেল। এ এক অলৌকিক দৃশ্য!
ক্যামেরায় ছবি তুলে ঝাউবনের ভেতর দিকে হাঁটতে থাকলাম। ঝাউবনের মাটিতে অজস্র পায়ের ছাপ। অনেকখানি হাঁটার পর বাঁদিকের নিচে কেয়াঝোপে একপাটি স্লিপার চোখে পড়ল। লাল দু’ফিতের মেয়েদের স্লিপার।
স্লিপারটা ছেঁড়া নয়। তাই নেমে গিয়ে ওটা কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখলাম। তারপর হঠাৎ মাথায় একটা অদ্ভুত খেয়াল চাপল। ওটা কুড়িয়ে নিয়ে বালিতে পুঁতে একটা শুকনো ডাল ফেলে রাখলাম, যাতে পরে জায়গাটা চিনতে পারি।
জানি না কেন এটা করলাম।
আবার ঝাউবনে উঠে কয়েক পা হাঁটার পর চোখে পড়ল বাঁদিকে, নিচে একটা কাটাঝোপে কী একটা জিনিস আটকে আছে। সূর্যের প্রথম আলোয় ইঞ্চি দুই লম্বা জিনিসটা ঝিকমিক করছে। নেমে গিয়ে দেখি, নীল শাড়ির একটু অংশ।
কিন্তু ওই অংশটুকু কোনও পুরনো শাড়ির নয়। তুলে নিয়ে টেনে দেখলাম, আমার ধারণা ঠিক। ফাইবারগুলো শক্ত এবং সিন্থেটিক ফাইবার।
তারপরই মনে পড়ে গেল, অধ্যাপিকা অমিতা দাশগুপ্তার পরনে গতকাল বিকেলে নীল শাড়ি দেখেছিলাম।
ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা দরকার। কাপড়টুকু পকেটস্থ করলাম। তারপর আবার ঝাউবনে উঠে কিছুটা এগিয়ে ডাইনে সমুদ্রের বিচে নেমে গেলাম।
বিচে ভিড় জমে গেছে। প্রথম সকালের টাটকা সমুদ্র দেখার নেশা মানুষজনকে পেয়ে বসেছে। নুলিয়ারা কাঠের ভেলা ভাসিয়ে ব্রেকওয়াটার পেরিয়ে মধ্যসমুদ্রে পৌঁছুনোর জন্য লড়াই করছে। সমুদ্র ওদের ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু ওরা সমুদ্রে যাবেই যাবে। না গেলে সারাদিন উপোস।
ভিড় থেকে দূরে একলা দাঁড়িয়ে আছেন ডঃ শক্তিপদ ব্রহ্ম। কাছে গেলে আমাকে দেখে সম্ভাষণ করলেন, “গুড মর্নিং!”
“মর্নিং ডঃ ব্রহ্ম!”
ডঃ ব্রহ্ম বাঁকা হেসে আমাকে ইশারায় দেখালেন, ডঃ মৈত্র এবং আশিস পুরনো লাইটহাউসের দিকে এগিয়ে চলেছেন। লাইটহাউসটা পূর্বে এবং এখান থেকে বড় জোর শ’পাঁচেক মিটার দূরে। বাইনোকুলারে ওঁদের দেখে একটু উদ্বিগ্ন হলাম। দুজনের মুখের একটা পাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লেন্স অ্যাডজাস্ট করলে মুখের অংশ আরও স্পষ্ট হলো। দুটি মুখেই কী এক বিহ্বলতার ছাপ। দুজনে লাইটহাউসের ওধারে অদৃশ্য হলেন।
ডঃ ব্রহ্ম আস্তে বললেন, “কী বুঝলেন বলুন কর্নেল সরকার?”
বাইনোকুলার নামিয়ে রেখে বললাম, “কিছু বুঝলাম না।”
“আপনি বাইনোকুলারে দেখেও কিছু বুঝলেন না?” হাসলেন ডঃ ব্রহ্ম। “আমি কিন্তু বুঝেছি।”
“কী বুঝেছেন?”
“মান-অভিমানের পালা চলেছে। শ্রীমতী সম্ভবত রাগ করে ওখানে কোথাও বসে আছেন!”
“দেখেছেন যেতে?”
মাথা নাড়লেন ডঃ ব্রহ্ম। নাহ্। ওইরকমভাবে দুই পুরুষের যাওয়া দেখে তা-ই মনে হচ্ছিল।”
একটু ভেবে নিয়ে বললাম, “আচ্ছা ডঃ ব্রহ্ম, শুনেছি ডঃ মৈত্র যে গবেষণাটা করছেন, সেটা নাকি বৈপ্লবিক ব্যাপার ঘটাবে?”
“বোগাস। আমার ধারণা, ভদ্রলোক বিদেশ থেকে কারও থিসিস চুরি করে এনেছেন।”
হাসতে হাসতে বললাম, “আপনি ওঁর ওপর কেন যেন রুষ্ট!”
“হব না রুষ্ট?” ডঃ ব্রহ্ম প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন। “একে-ওকে বলে বেড়াচ্ছেন আমি ওঁর সেমিনার পেপারের কপি চুরি করে সেটা নষ্ট করেছি।”
‘কীভাবে নষ্ট করেছেন?”
ডঃ ব্রহ্ম অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাসলেন। “ছিড়ে কুচিকুচি করেছি নাকি। আমার ধারণ, ওই ছোকরাকে দিয়ে একটা কপি ছিঁড়ে ডঃ মৈত্র আমার ঘরের জানালার পেছনে ফেলতে বলেছিলেন।”
“কুচিগুলো পড়েছিল তাহলে?”
“ছিল। এটাই আশ্চর্য! কেন আমি ওসব ট্রাপে হাত দিতে যাব বলুন। আমার সাবজেক্ট তো আলাদা।”
“ডঃ ব্রহ্ম, ওঁর সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?”
“মুখোমুখি আলাপ এখানে এসে। ওঁর নাম রেকমেন্ড করেছিলেন আমাদের সমিতির একজন মেম্বার। আমি ভুল করে ফেলেছি।”
“অধ্যপিকা দাশগুপ্তার সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ কতদিন আগে?”
“মাস তিনেক। উনি কাগজে সমিতির বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেছিলেন।”
“তখন উনি অবিবাহিতা ছিলেন কি?”
“হ্যা” বলে ডঃ ব্রহ্ম পা বাড়ালেন। “আসি কর্নেল সরকার! সকাল ন’টায় সভা বসবে। প্রিপারেশন দরকার। আপনি এই সেশনে অবশ্য থাকবেন যেন।”
ডঃ ব্রহ্ম চলে গেলেন। বাইনোকুলারে আবার লাইটহাউসের দিকটা দেখছিলাম। ডঃ মৈত্র ফিরে আসছেন। পেছনে আশিস সেন। দুটি মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। উদ্বেগের ছাপ গাঢ়। মনে মনে চাইছিলাম, এই সুন্দর সকালে যেন কোনও দুঃসংবাদ শুনতে না হয়।
একটু পরে ওঁরা মোড় নিয়ে বালিয়াড়িতে উঠলেন। তখন ওঁদের অনুসরণ করলাম। হোটেল দা শার্কের কাছাকাছি গিয়ে ওঁদের নাগাল পেলাম। বললাম, “গুড মর্নিং ডঃ মৈত্র!”
ডঃ মৈত্র আস্তে বললেন, “মর্নিং?”
“আপনারা লাইটহাউস দেখতে গিয়েছিলেন!”
আশিস কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিল। ডঃ মৈত্র তাকে ইশারায় চলে যেতে বললেন। সে চলে গেল। পিচরাস্তার মোড়ে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেপ্টেম্বরের ঝলমলে সূর্য হঠাৎ মেঘে চাপা পড়ল। ডঃ মৈত্র আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে বললেন, “একটা গণ্ডগোলে পড়েছি কর্নেল সরকার!”
“আপনার স্ত্রী”
আমার কথার ওপর ডঃ মৈত্র বললেন, “ঘুম থেকে উঠে তাঁকে খুঁজে পাচ্ছি। না। হোটেলের কেউ তাকে বেরিয়ে যেতে দেখেনি। অবশ্য আমার স্যুটের পেছনে বাউন্ডারি ওয়ালের খানিকটা অংশ ভাঙা। একজন মানুষ অনায়াসে গলে যেতে পারে।
“রাত্রে কি আপনাদের মধ্যে–সরি! আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো অনুচিত!”
ডঃ মৈত্র আস্তে গম্ভীর মুখ বললেন, “আপনি প্রশ্নটা তুলতেই পারেন। কারণ আপনি একজন রহস্যভেদী। গত রাতে আপনার ঘর থেকে ফেরার পর অমিতার সঙ্গে আমার একটু তর্কাতর্কি বেধেছিল। কী নিয়ে, তা-ও বলা দরকার। অমিতা আমার পেপারস হাতড়ে কিছু খুঁজছিল। আশিস ইশারায় সেটা বুঝিয়ে না দিলে জানতে পারতাম না। এই ছেলেটা আমার প্রহরী বলতে পারেন। সে পাশের সিঙ্গলরুমে থাকে।”
“আশিস” একটু অবাক হয়ে বললাম, “আশিস কি বোবা কালা?”
“ঠিক ধরেছেন। কিন্তু সে মূক-বধির স্কুলে পড়াশুনা করেছে। সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলতে পারে। ওই সাইন-ল্যাংগুয়েজ আমিও জানি।”
“হু, আশিস কীভাবে জানল, মিসেস অমিতা আপনার পেপার হাতড়ে কিছু খুঁজছিলেন?”
“আশিস তখন আমাদের স্যুটে ছিল। বোবাকালা বলে অমিতা তাকে গ্রাহ্য করেনি।” ডঃ মৈত্র পা বাড়ালেন হোটেলের দিকে। “আমি অবশ্য অমিতাকে সেজন্য তত কিছু বলিনি। শুধু বলেছিলাম, কোনও পেপার দরকার হলে আমাকে বললেই তো হয়। তার কাছে আমার গোপনীয় কিছু থাকতে পারে না। অমিতা কেন কে জানে, ভীষণ চটে গেল।”
“আপনারা লাইটহাউসের দিকে ওঁকে খুঁজতে গেলেন কেন?”
ডঃ মৈত্র নীচের দিকে দৃষ্টি রেখে হাঁটছিলেন। বললেন, “কাল বিকেলে আশিসকে নিয়েই অমিতা ওখানে গিয়েছিল। তাই ভাবলাম যাই হোক, মর্নিং সেশনে যাচ্ছেন তো?”
“নাহ্! আমি এ বেলা প্রজাপতির ছবি তুলতে বেরুব। কেয়াবনের দিকটায় অনেক প্রজাপতি দেখেছি।”
“কখন বেরুবেন?”
“ব্রেকফাস্ট করার পর।”
“আমি মর্নিং সেশন মিস করব না। আর মিনিট পনের দেরি। আপনি কাইন্ডলি দেখবেন, যদি অমিতা ওদিকে গিয়ে থাকে।”
ওঁর কথার ওপর বললাম, “অবশ্যই।…
.
ব্রেকফাস্ট করে সাড়ে আটটায় বেরোলাম। সেই জুতো পড়ে থাকা জায়গাটা তন্নতন্ন খুঁজে আর কিছু দেখতে পেলাম না। ঝাউবনে উঠে কিছুটা চলার পর হঠাৎ কী একটা চকচকে জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। জিনিসটা একটা ঝাউগাছের গোড়ায় পড়ে আছে। রোদে চকচক করছে। কাছে গিয়ে দেখি, একটা ঘড়ি। চেন খুলে পড়ে গেছে কারও হাত থেকে। ঘড়িটা জাপানি এবং বেশ দামী। পুরুষদের মতো ঘড়ি মেয়েরাও অনেকে আজকাল পরেন।
পকেটে চালান করে চারপাশটা খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলাম। টের পেলাম আমি উত্তেজিত। প্রায় আধঘণ্টার বেশি প্রাণীর চোখে খোঁজাখুঁজি করে হাল ছেড়ে দিলাম। এতক্ষণে প্রশ্নটা তীব্র হয়ে বিঁধছিল–অধ্যাপিকা অমিতা দাশগুপ্তাকে কি খুন করা হয়েছে গতরাতে?
দু কিলোমিটার দূরে একটা নদী এসে সমুদ্রে মিশেছে। সেখানে বার্ডস স্যাংচুয়ারি। অনেকক্ষণ পাখি দেখে এবং ফিল্মের একটা রোল প্রায় শেষ করে ছবি তুলে পিচ রাস্তা ধরে ফিরছিলাম হোটেলের দিকে। এক কিমি আসার পর ডাইনে বালিয়াড়ি ও ঝাউবনের মিলনস্থলে দেখি, কয়েকটা শকুন বসে আছে। থমকে দাঁড়ালাম। আকাশে আরও এক ঝক শকুন। ডানার শব্দ করে একে একে এসে বসছে। ব্যাপারটা দেখতে হয়।
এখানে কয়েকটা কাঠবাদামের গাছ আছে। শকুনগুলো সেইসব গাছে বসে আছে। গুল্মঝোঁপের ভেতর অতি কষ্টে এগিয়ে গেলাম। খানিকটা জায়গা। বালিতে ভর্তি। কোনও গাছ বা এক চিলতে ঘাসও গজায়নি। একদঙ্গল কুকুর বালি আঁচড়াচ্ছে। প্রজাপতি ধরা নেটের স্টিক দিয়ে কুকুরগুলোকে তাড়ালাম। তারপর থমকে দাঁড়ালাম।
একরাশ কালো চুল বেরিয়ে পড়েছে। দেখে আমার মাথার ভেতর ঠাণ্ডা হিম ঢিল-গড়িয়ে গেল। পিঠের কিটব্যাগ থেকে ভাঁজ করা ছুরি বের করলাম। অনেক কাঁটাঝোঁপ কেটে ভালো করে পুঁতে দিলাম চারদিকে।
হোটেলে ফিরেই ফোন করলাম পুলিসকে। তখন সেমিনার পুরোদমে চলেছে। সরকারি মেরিন হাউসের হলঘরে। সাড়ে এগারোটা বাজে। পুলিশ অফিসার পি আর দাস আমার পরিচিত। ব্যাপারটা আমার কাছে জেনে নিয়ে জিপ ছুটিয়ে অকুস্থলে গেলেন। আমি গেলাম না। বোবাকালা যুবকটিকে খুঁজছিলাম। একটু পরে বাইনোকুলারে দেখালম সে সি-বিচে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে চলে গেলাম।
বোবা কালাদের দু’হাতের আঙুলের সাহায্যে সাইন-ল্যাংগুয়েজ শেখানো হয়। আমার সব বিষয়ে একটু বাতিক বা নেশা আছে। দেখা যাক, ওর সঙ্গে চিহ্ন-ভাষায় কথা বলতে পারি কি না। আমার নিজের প্রতিভায় নিজেই অবাক হলাম। সে চমৎকার সাড়া দিল। সেই চিহ্ন-ভাষায় আলাপটা এরকম :
“তোমার নাম কি আশিস?”
“হ্যাঁ। আপনি কে?”
“কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।” নামটা বোঝাতে অনেক কসরত করতে বললো। মিলিটারি ব্যাপারটা সে ভালোই বুঝল। তবে অসবরপ্রাপ্ত জেনে একটু হতাশ হলো।
সে আমার সম্পর্কে আরও জানতে চাইছিল। তাকে সরাসরি অধ্যাপিকার কথা বললাম। সে বলল, “উনি হয়তো রাগ করে চলে গেছেন।”
কিটব্যাগ থেকে একপাটি স্লিপার, শাড়ির টুকরো এবং ঘড়িটা দেখালাম। অমনি ও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সাইন-ল্যাংগুয়েজ ছেড়ে গলার ভেতর অদ্ভুত শব্দ করতে থাকল। তারপর দৌড়ে চলে গেল। পিচ রাস্তায় গিয়ে সে সেমিনার হলের দিকে ছুটল। আমি হতাশ হয়ে নিজের স্যুটে ফিরে এলাম।…
সারা চন্দনপুর-অন-সি ভেঙে পড়েছিল। সবখানে ভিড়, জটলা, জল্পনাকল্পনা। ডঃ মৈত্রের অভিযোগে পুলিশ ডঃ ব্রহ্মকে গ্রেফতার করল। গ্রেফতারের অবশ্য ভিত্তি ছিল। ডঃ ব্রহ্মের ঘরে ডঃ মৈত্রের হারিয়ে যাওয়া একটা অ্যান্টি-ড্রাগ মানসিকতা তৈরির ওষুধের ফরমুলা পাওয়া গেছে। ডঃ ব্রহ্ম তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলছিলেন, “ডঃ মৈত্র ওটা আশিস বা ওঁর স্ত্রীকে দিয়ে পাচার করেছেন।”
কিন্তু আশিস বোবাকালা। সে সাইন-ল্যাংগুয়েজে জানাল, কাজটা সে করেনি। আর মৃতা অমিতার মুখ থেকে জানার কোনও উপায় নেই। তবে। আরও সাংঘাতিক প্রামাণ হলো, ঘড়িটা ডঃ ব্রহ্মেরই। ডঃ মৈত্র আমাকে সাক্ষী মেনে রাতের ঝাউবনে আলোর সংকেতের কথাও পুলিশকে জানিয়েছিলেন।
বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে দেখি, ডঃ মৈত্র এবং আশিস লাইটহাউসের দিকে চলেছেন। অনেকটা ঘুরে বালিয়াড়ির আড়ালে ওদের অনুসরণ করলাম।
লাইটহাউসের নিচেই সমুদ্র। অনেক পাথর পড়ে আছে। তাই ওখানে ব্রেকওয়াটারের গর্জন এবং আস্ফালন প্রচণ্ড। হঠাৎ দেখলাম, আশিস ডঃ মৈত্রকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। ডঃ মৈত্র টাল খেয়ে একপাশে পড়লেন। তারপর দৌড়ে পালিয়ে এলেন।
আশিস চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে? ডঃ মৈত্র চলে আসার পর আমি আশিসের কাছে গেলাম। আমাকে দেখে সে সাইন-ল্যাংগুয়েজে বলল, “ডঃ মৈত্র আমাকে একটু হলেই নিচে ফেলে দিতেন।”
অবাক হয়ে বললাম, “কিন্তু আমি তো দেখছিলাম তুমিই ওঁকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলার চেষ্টা করছিলে!”
“আপনি ভুল দেখেছেন। উনি আমাকে ফেলে দিচ্ছিলেন। আমি বাধা দিয়েছি।”
“আশিস! তুমি কি অমিতাকে ভালোবাসতে?”
আশিস হকচকিয়ে গেল এই আকস্মিক প্রশ্নে। একটু পরে তার চোখে জল দেখলাম। সে বলল, “হ্যাঁ।”
“উনি তো তোমার চেয়ে বয়সে বড়।”
“না। আমরা প্রায় সমবয়সী।” সে বয়সও বুঝিয়ে দিল। তার বয়স আঠাশ বছর। অমিতাকে একটু বয়স্ক দেখালেও তার বয়স সাতাশ বছর ন-দশ মাসের বেশি নয়। আশিস আরও বলল, “তার সঙ্গে অমিতার বিয়ের কথা ছিল। অমিতার ইচ্ছা সেটা। কিন্তু অমিতার মা বোবাকালার সঙ্গে সুশিক্ষিতা মেয়ের বিয়েতে আপত্তি তোলেন। আত্মহত্যার ভয় দেখান। তাই আমিই অমিতাকে নিবৃত্ত করেছিলাম। দু’মাস আগে ডঃ মৈত্রের সঙ্গে অমিতার আলাপ-পরিচয় হয়। আমিই অমিতাকে বলি, ওঁকে বিয়ে করো। তোমার বিদেশে গিয়ে রিসার্চের সুযোগ হবে। তারপর অমিতার কথায় আমাকে ডঃ মৈত্র ল্যাবরেটারি অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নেন।”
“আশিস! রাতে ঝাউবনে কোনও আলো দেখেছ? গত রাত এবং আগের রাতে?”
“না।”
“ডঃ ব্রহ্মের সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?”
“নাক-গলানে লোক। খুব নীতিবাগীশ।”
“অমিতাকে কি তিনি খুন করতে পারেন?”
একটু চুপ করে থেকে আশিস জানাল, তেমন কোনও কারণ সে খুঁজে পাচ্ছে না।
“তোমাদের উনি গোপনে পরস্পরকে চুমু খেতে দেখেছেন।”
“তাতে কী? বেশ করেছি।”
“ডঃ মৈত্র ঈর্ষাবশে অমিতাকে খুন করতে পারেন কি?”
“জানি না। তবে ডঃ মৈত্র ভীতু লোক। অমিতাকে ভয় করে চলতেন।”
একটা চুরুট ধরিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। প্রচণ্ড বাতাস। লাইটহাউসের আড়ালে গেলাম। সেই সময় আশিস হনহন করে চলে গেল।
ডঃ ব্রহ্ম কি উগ্রনীতিবাগীশ বলেই অমিতাকে সহ্য করতে পারছিলেন না? নাহ্, এই তুচ্ছ কারণে কেউ নরহত্যা করতে পারে না। দ্বিতীয় এবং খাঁটি কারণ হলো, অ্যান্টি-ড্রাগ ওষুধ তৈরির ফরমুলা ডঃ মৈত্রের ঘর থেকে চুরি করার সময় সম্ভবত অমিতা দেখে ফেলেছিলেন ডঃ ব্রহ্মকে?…
সেমিনার বন্ধ হয়ে গেছে। পণ্ডিতজনেরা সবাই লাঞ্চের পর বাসে বা নিজের গাড়িতে ফিরে গেছেন। ডঃ মৈত্রকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, আশিসকে খুঁজে পাচ্ছেন না এবং তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন। পুলিশকে জানাবেন ভাবছেন।
লাঞ্চের পর একটু জিরিয়ে নিয়ে থানায় গেলাম। পুলিশ অফিসার মিঃ দাস আমাকে সম্ভাষণ করে বললেন, “হাই ওল্ড বস! আপনিই যেখানেই যান, সেখানেই ডেডবডি পড়ে বলে পুলিশমহলে কিংবদন্তি চালু আছে। আশা করি, খুনখারাপির গন্ধ পেয়ে চন্দপুর-অন-সিতে হাজির হননি?”
“নাহ্। সেমিনারে আমাকে যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন ডঃ ব্রহ্ম।”
“কর্নেল! প্লিজ, একটু ঝেড়ে কাসুন।”
“কিছু বুঝতে পারছি না মিঃ দাস। আমি ডঃ ব্রহ্মের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।”
“এখনই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ওঁকে এখন জেরা করা হচ্ছে।”
কিছুক্ষণ পরে হাজতে ঢুকলাম। ডঃ ব্রহ্ম গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে হাউমাউ করে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ফেললেন।
বললাম, “ডঃ ব্রহ্ম আপনি একজন পণ্ডিত মানুষ। ভেঙে পড়া আপনার শোভা পায় না! আমার প্রশ্নের জবাব দিন। প্লিজ, যা বলবেন, সত্য বলবেন।”
“বলুন, কী জানতে চান।” ডঃ ব্রহ্ম চোখ মুছে বললেন, “আমি মিথ্যাবাদী নই।”
“আপনার ঘড়ি ওখানে গেল কী করে?”
“ঘড়িটা গতরাতে আপনার ঘরে যাওয়ার সময় টেবিলে খুলে রেখেছিলাম। ফিরে এসে পাইনি। কিন্তু এ নিয়ে হইচই করিনি। শুধু ম্যানেজারকে বলেছিলাম কথাটা। ম্যানেজার বলেছিলেন, এমন অভিযোগ এই প্রথম পেলাম। আমাদের কর্মচারীরা বিশ্বস্ত। তবে জিজ্ঞেস করে দেখব।”
“ঝাউবনে রাতে কোনও আলো দেখেননি বলছিলেন আমাকে।”
“হ্যাঁ কোনও আলো দেখিনি।”
“কিন্তু ডঃ মৈত্র দেখেছিলেন।”
“দেখতে পারেন।”
“ওঁর ওষুধের ফরমুলা আপনার ঘরে গেল কী করে?”
“বলেছি। আশিস বা অমিতা দাশগুপ্তা” বলে চুপ করলেন ডঃ ব্রহ্ম। একটু পরে বললেন, “মনে পড়ছে। গতকাল ইভনিংয়ে অমিতা এসেছিলেন আমার সঙ্গে আজ সকালের সেশন নিয়ে আলোচনা করতে। তখনই রেখে যেতে পারেন স্বামীর হুকুমে।”
“কে অমিতাকে খুন করে পুঁতে রেখে আসতে পারে বলে আপনার ধারণা?
“ডঃ মৈত্র।”
“কেন?”
“স্ত্রী ব্যভিচারিণী। এটাই কি যথেষ্ট কারণ নয়?”
“থ্যাংকস ডঃ ব্রহ্ম! চলি?”….
বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গেলাম, যেখানে অমিতার লাশ পুঁতে রাখা হয়েছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হয়তো ইনটুইশন, হঠাৎ মনে হলো, কেউ আমাকে দেখছে। তখনই বাইনোকুলারে চারদিক খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম। সামনে কিছু দূরে বাঁদিকে কেয়াঝোঁপের আড়ালে কেউ বসে আছে। সে আমার দিকে ঘুরলে দেখি, আশিস। তার হাতে একটা ভোজালি। চমকে উঠলাম।
একটা ঘন ঝোঁপের আড়ালে হুমড়ি খেয়ে বসে পড়লাম।
একটু পরে দেখি হনহন করে ডঃ মৈত্র এগিয়ে আসছেন ঝাউবনের দিক থেকে। তার হাতে রিভলভার। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাকে খুঁজছেন যেন। খুঁজতে খুঁজতে নিচের জঙ্গলে নামলেন। তারপর যেখানে অমিতার লাশ পোঁতা ছিল, তার একটু তফাতে গুঁড়ি মেরে বসে জুতোয় ডগা দিয়ে বালি সরাতে থাকলেন। একটা ব্রিফকেস বেরুল। ব্রিফকেসটা বাঁ হাতে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, আশিস ভোজালি হাতে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এল। ডঃ মৈত্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, “ডঃ মৈত্র।”
দুজনেই ঘুরলেন আমার দিকে। আশিস আমাকে দেখে পালাতে যাচ্ছিল। ডঃ মৈত্র তার দিকে রিভলভার তাক করলে আবার বললাম, “ডঃ মৈত্র!”
আশিস পালিয়ে গেল। ডঃ মৈত্র বললেন, “দেখুন! দেখুন শয়তানটার কীর্তি! আমাকে খুন করার জন্য এখানে ওত পেতে বসেছিল। কারণ ও জানত, অমিতার হারানো ব্রিফকেস খুঁজতে আমি এখানে আসব! তবে আমিও তৈরি হয়ে এসেছিলাম।”
“রিভলভারটা আমাকে দিন ডঃ মৈত্র। নইলে আপনার রিভলভার ধরা হাতে অমি গুলি করব।”
আমার হাতে রিভলভার দেখে ডঃ মৈত্র তার রিভলভার ফেলে দিলেন। এগিয়ে গিয়ে সেটা কুড়িয়ে কিটব্যাগে ঢোকালাম। তারপর ডঃ মৈত্রের শার্টের কলার খামচে ধরলাম আচমকা। ডঃ মৈত্র বললেন, “এ কী!”
“ডঃ মৈত্র! স্ত্রী হত্যার অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হবে। চুপচাপ আমার সঙ্গে চলুন।”
“আশ্চর্য! কী বলছেন আপনি।”
“ঝাউবনে আলোর সিগন্যাল দিয়ে আপনি আমাকে বোকা বানাতে চেয়েছিলেন। অমিতার অ্যান্টি-ড্রাগ ওষুধের ফরমুলা চুরির জন্য আপনি তাকে বিয়ে করেছিলেন। জানতেন, আপনার স্ত্রী আশিসের প্রতি আসক্ত। তবু আপনার মনে বিকার, ঘটেনি। গত রাতে ঝাউবনে আলো জ্বেলে তারপর আপনি আমার কাছে গিয়েছিলেন। তারপর অমিতাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ইঞ্জেকশন করে মেরে তার বডি পেছনের বাউন্ডারি ওয়ালের ভাঙা জায়গা দিয়ে বাইরে ফেলেন। সেখানে কিছু চিহ্ন আছে।”
মিঃ দাসকে আভাস দিয়ে এসেছিলাম। তাই কথা বলে সময় কাটাচ্ছিলাম। পুলিশের জিপ এসে রাস্তায় থামল। সদলবলে ছুটে এলেন মিঃ দাস। ডঃ মৈত্রের হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দিলেন।
বললাম, “ব্রিফকেসটা এখানে পুঁতে রেখে আরও ধোঁকা দিতে চেয়েছিলেন মৈত্র মশাই। তার ইচ্ছা ছিল, পুলিশ এটা আবিষ্কার করুক। তা হলে ডঃ ব্রহ্মের ঘাড়ে দেষটা পড়বে। আসলে ডঃ ব্রহ্মের ঘরে পাওয়া ফরমুলাটা বোগাস। এই ব্রিফকেসেই অমিতার আসল ফরমুলা আছে। এটা অমিতারই ব্রিফকেস।”
এতক্ষণে আশিস এল। হাতে ভোজালি নেই। একপাটি স্লিপার। চোখে জল।…
Leave a Reply