বসু-বাড়ি – ৪০

৪০

ডিসেম্বর মাসটা যতই এগোতে লাগল, মনে হল রাঙাকাকাবাবু ক্রমেই অস্থির হয়ে পড়ছেন। প্রথমে আমাকে বলেছিলেন যে বড়দিনের ছুটি নাগাদ বেরিয়ে পড়তে চান। কিন্তু মিঞা আকবর শাহের দিক থেকে সিগন্যাল পেতে দেরি হচ্ছিল। 

এরই মধ্যে বোম্বাই থেকে দুই অতিথি এসে পড়লেন—বসুবাড়ির বিশেষ বন্ধু নাথালাল পারেখ ও তাঁর স্ত্রী। নাথালালের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর তিরিশের দশকে ইউরোপে আলাপ হয়। প্রবাসে পারেখ-পরিবারের আতিথেয়তায় রাঙাকাকাবাবু মুগ্ধ হন। দেশে ফেরার পর নাথালাল আরও অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠেন। ১৯৩৮-এ কংগ্রেস সভাপতি হবার পর থেকে ১৯৪১-এ দেশত্যাগ করা পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবু যতবারই বোম্বাই গিয়েছেন নাথালালের মেরিন ড্রাইভের বাড়িতে থেকেছেন। বাবা-মার সঙ্গে আমরাও নাথালালের বাড়িতে থেকেছি। ১৯৩৯-এর পুজোর ছুটিটা বাবা-মা ও আমরা সকলে নাথালাল ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে মহারাষ্ট্রের মহাবালেশ্বর পাহাড়ে খুব আনন্দে কাটিয়েছিলাম। ত্রিপুরী কংগ্রেসে পারেখ-দম্পতি রাঙাকাকাবাবুর পাশে পাশে ছিলেন এবং যথাসাধ্য সেবা করেছিলেন। 

এবার রাঙাকাকাবাবু নাথালাল ও তাঁর স্ত্রীর থাকবার ব্যবস্থা উডবার্ন পার্কের বাড়িতে করতে বললেন। বাড়ি তো তখন খালি, কেবল আমি আছি। সেজন্য তাঁদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা এলগিন রোডের বাড়িতেই ছিল। বোম্বাই ফেরবার আগে ডিসেম্বরের শেষে তাঁরা শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গেলেন। সেখান থেকে ফিরে তাঁরা নতুন বছরের প্রথমেই বোম্বাই ফিরে যাবেন। 

প্রথম প্রথম আমার মনে হয়েছিল যে, আমাকে রাঙাকাকাবাবু সম্ভবত বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছে দিতে বলবেন, কারণ তিনি ফেরবার পথে বিষড়ার বাড়িতে রাত কাটাবার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে মনে হল তিনি আরও অনেক লম্বা পাড়ির কথা ভাবছেন। কারণ আমাকে তিনি পরে বললেন যে, তাঁকে আসানসোল বা তার কাছাকাছি কোনো স্টেশনে পৌঁছে দিতে হবে। প্ল্যানটা হবে এই রকম—আমি ভোর রাত্তিরে তাঁকে পথের কোনো-একটা ডাকবাংলোয় নামিয়ে দেব। তিনি দিনটা সেখানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকবেন। আর আমি চলে যাব ধানবাদের কাছে আমার দাদার বারারির বাড়িতে। পরের দিন সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকবাংলো থেকে তুলে তিনি যে স্টেশনে ট্রেন ধরতে চান আমি পৌঁছে দেব। দাদা-বৌদির কাছে আমার বারারি যাওয়ার একটা অজুহাত বের করা তো খুবই সহজ। এমনিতেই জানুয়ারির প্রথমে আমার বারারি যাবার কথা ছিল। তার উপর রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ও ঐ এলাকাটা আমার একবার ভাল করে দেখে এলে ভাল হয়। মা ও ছোটদের বারারি থেকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি এই অজুহাত দেখিয়ে আমি নাথালালদের সঙ্গে বোম্বাই মেলে চাপলাম। মাঝরাতে ধানবাদে নেমে গেলাম। সেখান থেকে বারারি বেশি দূর নয়। 

ঠিক যেমন রাঙাকাকাবাবু বলে দিয়েছিলেন, বারারি ছাড়বার আগে আমি দাদাকে বললাম, দিনকতক পরে রাঙাকাকাবাবুর কোনো কাজে আমি ঐ অঞ্চলে আসব, সেই সময় আমি আবার বারারিতে আসব। 

গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে ধানবাদ যাবার রাস্তা ও ধানবাদ থেকে বারারি পর্যন্ত পথঘাট আমি ভাল করে দেখে নেবার চেষ্টা করলাম। ধানবাদ থেকে বারারি পথটা একটু গোলমেলে ঠেকেছিল। পথের কতকগুলো বাড়িঘর, ছোটখাটো ব্রিজ, কটা বাঁক আছে, ইত্যাদি মনে ধরে রাখবার চেষ্টা করলাম। তবে দাদার বাড়ির পেছনেই বড় বড় চিমনিওয়ালা কারখানাটা বেশ একটা বড় দিক্‌চিহ্ন ছিল। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের উপর, ধানবাদের দিকে মোড় নেওয়ার আগে গোবিন্দপুর বলে একটা জায়গায় বাঁশের বেড়া নামিয়ে গাড়ি থামিয়ে নম্বরটা লিখে নিল নজর করলাম। 

কলকাতা ফেরার পথে স্টুডিবেকার গাড়িটা আসানসোল ও বর্ধমানের মাঝে বেশ একটা গণ্ডগোল করে বসল। এমন একটা যন্ত্র ভেঙে গেল যে সেখানে সারানো সম্ভব হল না। একটা গ্যারাজে গাড়িটা রেখে মামাবাবুর সঙ্গে আমরা একটা নড়বড়ে ট্যাক্সি চেপে কলকাতায় ফিরলাম। ব্যাপারটাতে আমি তো শঙ্কিত হলাম। রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে যদি ওয়াণ্ডারার গাড়ি এ-রকম ব্যবহার করে তাহলে কী উপায় হবে! 

কলকাতায় ফিরেই রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে নিয়মমতো জল্পনা-কল্পনা শুরু হল। বাবাও কালিম্পঙ থেকে ফিরলেন। রাঙাকাকাবাবু আমাকে বলেছিলেন, “মাকে বলে রেখো, যেদিনই তোমার বাবা কলকাতায় পৌঁছবেন সেদিনই সন্ধ্যায় যেন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন।” তাই হল।সেদিন সারা সন্ধ্যাটাই বাবা ও রাঙাকাকাবাবু নিভৃতে কথা বললেন। আমি বাইরেই রইলাম। পরের দিন সন্ধ্যায় মা একটু হেসে আমাকে বললেন, “উনি বলছিলেন, তোমার ছেলে কি আমাদের না জানিয়েই এই সব কাণ্ড করতে যাচ্ছিল নাকি যাই হোক, বাবা-মার দিকটা এইভাবে সমাধান হয়ে যাওয়াতে আমি বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। বাবা কিন্তু ১৬ই জানুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত এ-বিষয়ে আমার সঙ্গে কোনো কথাই বললেন না। মা কেবলই বলতে লাগলেন, একটু আগে জানতে পারলে আরও বেশি দেখাসাক্ষাৎ করে নিতে পারতাম, অনেক কথাবার্তা হতে পারত। 

প্রথমের দিকেই বাবার সম্বন্ধে কথা তুলে রাঙাকাকাবাবু বলেছিলেন যে, বাবার সেই সময়কার শরীরের অবস্থা দেখে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন। তাঁর মনে হয়েছিল, বাবার স্নায়বিক অবস্থা অন্তত সাময়িকভাবে বেশ খারাপ। আরও বলেছিলেন যে, তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি সঙ্কট-মুহূর্তে তিনি বাবার পরামর্শ ও সমর্থন চেয়েছেন, পেয়েছেনও। তাঁর ভয় হয়েছিল, যদি বাবা মন শক্ত করতে না পারেন এবং রাঙাকাকাবাবুকে এত বড় বিপদের ঝুঁকি নিতে বারণ করেন তাহলে তিনি মহা মুশকিলে পড়ে যাবেন। যাই হোক, পরের দিন রাঙাকাকাবাবুর কাছ থেকে যা শুনলাম তাতে তো মনে হল না যে বাবা কোনোরকম আপত্তি তুলেছেন। বরং মনে হল পুরো পরিকল্পনাটা তাঁরা দুজনে খুঁটিয়ে বিচার করেছেন এবং বাবা বেশ কতকগুলি ব্যাপারে অদলবদল করতে পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন, এলগিন রোডের বাড়িতে একমাত্র ইলার উপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না বলে বাবা মনে করেছিলেন। কারণ সেক্ষেত্রে পুলিশের সব জুলুম বাড়ির ঐ মেয়েটির উপর পড়বে। এই সূত্রে রাঙাকাকাবাবু আমার সঙ্গে আমার জ্যাঠতুত ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথের সম্ভাব্য ভূমিকা সম্বন্ধে কথা বলেছিলেন। 

বাড়ি থেকে উধাও হবার পর ব্যাপারটা কী উপায়ে গোপন রাখা যাবে তার পরিকল্পনা ধীরে-সুস্থে রাঙাকাকাবাবু একদিন আমাকে বললেন। আমি তো শুনে অবাক। লোকে বিশ্বাস করবে তো! বললেন, তিনি যথাসময়ে বাড়ির লোকেদের জানিয়ে দেবেন যে, তিনি একটা ব্রত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কিছুদিন সম্পূর্ণ নির্জনবাস করবেন। সকলে জানবে যে তিনি নিজের শোবার ঘর থেকে মোটেই বের হন না, কারুর সঙ্গে দেখা করেন না বা টেলিফোনেও কারুর সঙ্গে কথা বলেন না। এ-ব্যাপারে বড় রকমের কোনো প্রচার হবে না, খবরের কাগজেও কোনো ঘোষণা করা হবে না। বাইরের কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে বা টেলিফোন করলে জানিয়ে দেওয়া হবে যে, দিনকয়েকের জন্য তিনি নির্জনবাস করছেন। আস্তে আস্তে খবরটা ছড়াবে। মাজননীর ঠাকুর তাঁর খাবার পর্দার আড়াল থেকে রেখে দিয়ে যাবে। যাতে সকলে বিশ্বাস করে যে, সত্যিই তিনি ঘরে আছেন, তার জন্য সব ব্যবস্থা মনে-মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন। খাবারগুলো খাওয়া এবং ঘর ব্যবহার করার ভার ভো দিয়ে যাবেন। তাছাড়া অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন রকমের শ্লিপ নিজের হাতে লিখে দিয়ে যাবেন যেগুলো বুঝেসুঝে আগন্তুকদের দেওয়া হবে। কোনোটায় লেখা থাকবে, এ-ব্যাপারে কংগ্রেস অফিসে আশরাফউদ্দীন-সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, এ-বিষয়ে করপোরেশনের অমুক কাউন্সিলারের সঙ্গে কথা বলুন, ইত্যাদি। তাছাড়া কতকগুলো চিঠি লিখে দিয়ে যাবেন যেগুলো তাঁর অন্তর্ধানের পর ভিন্ন-ভিন্ন তারিখে ছাড়া হবে। চিঠি লিখবেন বিশেষ করে জেলে বন্দী তাঁর সহকর্মীদের নামে, যাতে সেগুলি পুলিশ বিভাগের নজরে পড়ে এবং তারা মনে করে যে সুভাষবাবু তাঁর কলকাতার বাড়ি থেকে চিঠি লিখছেন। 

ক্রমেই আমার মনে হতে লাগল, যে-কোনোদিন যাত্রার সঙ্কেত এসে পড়তে পারে। শেষের কয়েকদিন দেখা হলেই প্রথমেই রাঙাকাকাবাবু জিজ্ঞাসা করতেন—প্রস্তুত তো? সুতরাং আমি গাড়ির দিকে নজর দিলাম। বাবাকে বলে একটা নতুন টায়ার ও ব্যাটারির ব্যবস্থা করলাম। যাত্রার ঠিক আগেই যাতে গাড়িটা ভাল করে সার্ভিসিং করিয়ে নেওয়া যায় সেজন্যে আমাদের সেই সময়কার বাঁধা গ্যারাজ ইন্টারন্যাশনাল টায়ারস অ্যাণ্ড মোটরস্-এ কথাবার্তা বলে এলাম। সমস্যা হল ওয়াণ্ডারার গাড়ির ড্রাইভারকে নিয়ে। কিন্তু চট করে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। ড্রাইভার বাবুর বাড়ি থেকে টেলিগ্রাম এল, তার মার খুব অসুখ, তক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে। রাঙাকাকাবাবুকে সন্ধ্যায় যখন বললাম ভাল খবর আছে, তিনি প্রথমটায় গম্ভীর হবার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত হেসে ফেললেন। 

৪১

যাত্রার কয়েকদিন আগে রাঙাকাকাবাবু আমাকে বললেন, সন্ধ্যায় গাড়ি চালিয়ে ইলাকে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরে নিয়ে যেতে হবে। প্রশ্ন করার কোনো অবকাশ নেই। তবে বুঝলাম, একটা বিরাট দুঃসাহসিক অভিযানের পূর্বে তাঁর নিজের প্রস্তুতির সঙ্গে এর সম্বন্ধ আছে। রাঙাকাকাবাবুর ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়। এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তাঁর জীবনে প্রমাণ করেছিলেন যে, সেই বিশ্বাসই সত্য, যা মানুষকে অফুরন্ত শক্তি দেয়, ত্যাগের জন্য প্রস্তুত করে, নিরহঙ্কার ও নিঃস্বার্থ করে। কুসংস্কার রা অর্থহীন আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে এই ধর্মবিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই। পারিবারিক ও সামাজিক সব রকম প্রশ্নেও রাঙাকাকাবাবু ছিলেন উদার ও প্রগতিবাদী। সেজন্য, অন্ধ বা লোক-দেখানো ভক্তি, কুসংস্কার ও আচার-অনুষ্ঠানের আতিশয্য, যা বসুবাড়ির অনেকের মধ্যেই দেখেছি, রাঙাকাকাবাবুর মধ্যে দেখিনি। অবশ্য বিশেষ কোনো-কোনো অবস্থায় রাঙাকাকাবাবুকে অন্যদের সঙ্গে কিছু-কিছু আচার-অনুষ্ঠান মানতে দেখেছি। দুটি কারণে তিনি এটা করতেন। প্রথমত, পারিবারিক ব্যাপারে অযথা গণ্ডগোলের সৃষ্টি না করা। দ্বিতীয়ত, যে কথাটা তাঁর নিজের মুখে শুনেছি, নিজের বিশ্বাস যাই হোক না কেন, অন্যের বিশ্বাসে অযথা আঘাত না করা। 

যাই হোক, জ্যোৎস্নায় ভরা এক সুন্দর সন্ধ্যায় আমি ওয়াণ্ডারার গাড়িতে করে ইলাকে দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে গেলাম। আমি মন্দিরের সিঁড়িতে অপেক্ষা করলাম, ইলা ছোট একটি তামার পাত্র নিয়ে ভিতরে গেল। কিছুক্ষণ পরে কিছু ফুল ও পাত্রটি নিয়ে ফিরে এল। রাঙাকাকাবাবু তাকে কী করতে বলেছিলেন—জিজ্ঞেস করলাম না। 

.

এই সূত্রে দুটি কথা মনে পড়ে গেল। প্রেসিডেন্সি জেলে তিনি অনশন আরম্ভ করেন কালীপূজোর দিন। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সিঙ্গাপুর থেকে আমি তাঁর এক গোপন বার্তা পাই। তাঁর নিজের হাতে লেখা বার্তাটির ওপরে লেখা ছিল “শ্রীশ্রী কালীপূজা, ২৯শে অক্টোবর ১৯৪৩”। দেশের দশের কাজে আরাধ্য দেবীর কাছে নীরবে ও নিভৃতে আত্মনিবেদনের নিশ্চয়ই খুব গভীর তাৎপর্য আছে। এর ব্যাখ্যা করবার যোগ্যতা আমার নেই। এই অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার যুগে আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয়তো ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারে। 

বাড়ি থেকে বেরোবার সময় যাতে কোনো বাধা না পড়ে সেজন্য নানা দিক দিয়ে আঁটঘাট বেঁধে নিতে হল। আত্মীয়-স্বজনদের কার কীরকম অভ্যাস সে তো জানাই আছে। মোটামুটি বড়রা সকলেই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েন বা তিনতলায় নিজের-নিজের ঘরে চলে যান। চাকর-বাকরদের ঘুম বেশ গাঢ় লক্ষ করা গেল। বাড়ির প্রধান কাঠের সিঁড়ির একতলার দরজা রাঙাকাকাবাবুর বেয়ারা রমণী বন্ধ করে শোয়। যথাসময়ে দরজা বন্ধ করে তাকে শুতে যেতে বললেই হবে। রাঙাকাকাবাবু আগে থেকেই ঠিক করেছিলেন রান্নাবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে বেরোবেন। ঐ সিঁড়ির নীচের তলায় কোনো দরজাই নেই। বাড়ির সামনের গেটে তালা পড়ে না, ঠিক সময়ে খুলে নিলেই হবে। 

নতুনকাকাবাবু ডাঃ সুনীলচন্দ্রের তেজী অ্যালসেশিয়ান কুকুর ‘সানি বয়’ সমস্যায় ফেলল। রাত্রে লোকের আনাগোনা দেখলে নির্ঘাত ঝাঁপিয়ে পড়বে। একদিন বেশি রাতে সত্যবাবু—সত্যরঞ্জন বক্সী, রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে কথা বলে বাড়ি ফিরছেন, ‘সানি বয়’ তো ওই ছোট্ট মানুষটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওই ঘটনার সুযোগ নিয়ে রাঙাকাকাবাবু ইলাকে নতুনকাকাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে বললেন। তাঁকে বলা হল, যে ক’দিন রাঙাকাকাবাবু জেলের বাইরে আছেন, অনেকেই তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন এবং বেশি রাতে বাড়ি ফিরবেন। ‘সানি বয়’কে যদি সন্ধ্যার পর দিনকতক বেঁধে রাখা যায় তো ভাল হয়। নতুনকাকাবাবু রাজি হয়ে গেলেন। 

একদিন গিয়ে দেখি রাঙাকাকাবাবুকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে, যেন ভাল কোনো খবর দেবেন। বললেন, আগের দিন রাত্রে তাঁর পুরো ছদ্মবেশ পরে ঘরের বড় আয়নায় নিজেকে দেখেছেন, খুব ভাল হয়েছে, কেউ চিনতে পারবে না। আমি সন্দেহ প্রকাশ করে বললাম, “ওই চেহারা ঢেকে রাখা খুবই শক্ত, যতই ছদ্মবেশ ধারণ করুন না কেন।” আমার মন্তব্য তাঁর পছন্দ হল বলে মনে হল না। 

শেষের দিকটায় আমি একটু ঘন ঘন—এ বেলা ওবেলা এলগিন রোডের বাড়িতে যেতে লাগলাম, যদি কোনো খবর থাকে! ১৪ জানুয়ারি দুপুরে আমাকে রাঙাকাকাবাবু জানালেন, সিগন্যাল এসে গেছে, ১৬ জানুয়ারি রাত্রে যাত্রা করতে হবে। মনে মনে আমি খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দৌড়ে গাড়িটা সার্ভিসিংয়ের ব্যবস্থা করতে গেলাম। ষোলো তারিখের আগে বুকিং পেলাম না। তবে গ্যারাজ থেকে আশ্বাস দিল, কাজ সম্পূর্ণ করে সন্ধ্যার আগে গাড়ি ফেরত দেবে। 

শেষের দিকে রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, হোল্ড-অল্টা তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিতে, শেষ মুহূর্তে জিনিসপত্র নিতে সুবিধা হবে। আবার একবার কাপড়-জামা বাছাবাছি করার অজুহাতে অন্য কাপড়-জামার সঙ্গে চাদরে মুড়ে হোল্‌ড্-অল্টা রাঙাকাকাবাবুর কাছে রমণীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। 

যাত্রার আগের দিন সন্ধ্যায় আমি ঘর বন্ধ করে রাঙাকাকাবাবুর বাক্স গোছাতে লাগলাম। স্যুটকেসটা গোছাবার সময় হঠাৎ একটা খটকা লাগল। ওয়াণ্ডারার গাড়ির মাল রাখবার জায়গাটায় জিনিস ঢোকাতে হত গাড়ির ভেতর থেকে, সীটের পেছনটা নামিয়ে। ফাঁকটা খুব বড় ছিল না। আমার সন্দেহ হল, স্যুটকেসটা ঢুকবে তো! ফিতে দিয়ে স্যুটকেসের উচ্চতা মেপে লোকের চোখ এড়িয়ে গ্যারাজে গিয়ে ফাঁকটা মাপলাম। বুঝলাম, স্যুটকেসটা ঢুকবে না। কখন আবার একটা স্যুটকেস কিনব, নাম লেখাব? রাঙাকাকাবাবুই বা কী মনে করবেন? আমার ঘরের পাশের বারান্দায় বাড়ির সব বাক্স-প্যাঁটরা জমা করা থাকত। সেখান থেকে S. C. B. মার্কা ঠিক মাপের বাবার একটা স্যুটকেস বের করলাম। বাক্সবদল করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। দৌড়ে এক বোতল চাইনিজ ইঙ্ক, স্পিরিট ইত্যাদি যোগাড় করলাম। বাবার স্যুটকেসের ডালার উপর থেকে S. C. B. অক্ষরগুলো অনেক কষ্টে ঘষে তুলে ফেললাম, আর যতটা পারি বড় অক্ষরে M. Z. লিখলাম। যে স্যুটকেসটা রাঙাকাকাবাবুর জন্য কিনেছিলাম, একই ভাবে তার ওপর থেকে M. Z. তুলে S. C. B. লিখে অন্যান্য স্যুটকেসের সঙ্গে রেখে দিলাম। রাঙাকাকাবাবুর জন্য যে-সব জিনিসপত্র কিনেছিলাম স্যুটকেসে ও অ্যাটাচিকেসে গোছালাম। দু’কপি কোরান অ্যাটাচিকেসে নেবার জন্য দিয়েছিলেন। ইলা দু-রকম কবিরাজি ওষুধ ছোট শিশিতে ভরে লেবেল দিয়ে নিজের হাতে নাম লিখে পাঠিয়েছিল। লেবেলগুলো তুলে ফেললাম। 

.

দেখতে-দেখতে দুটো রাত কেটে গেল। ১৬ জানুয়ারি এসে পড়ল। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। কলেজে একবার চেহারাটা দেখানো ভাল হবে মনে করে কিছুক্ষণের জন্য 

ঘুরে এলাম। অদ্ভুত রকমের মনের ভাব হয়েছিল আমার। দেখছি সকলেই যার-যার নিত্যনৈমিত্তিক ও গতানুগতিক কাজ করে যাচ্ছে। আমি মনে মনে যেন অন্য জগতে বাস করছি। মনে হল যেন ওই গতানুগতিক জীবনযাত্রা পেছনে ফেলে আমি অনেক দিনের জন্য দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি। কলেজে একটা লেকচারও শুনলাম, কিন্তু মাথায় ঢুকল না কিছুই। সেই সময় অ্যানাটমি শিখবার জন্য মৃতদেহ কাটাকাটির কাজে নিযুক্ত ছিলাম। দু’জন-দুজন করে ছাত্রকে এক সঙ্গে শরীরের এক-একটা ভাগ ডিসেকশন্ করতে দেওয়া হত। আমার পার্টনার প্রভাতকুমার বসু ছিল খুবই সরল প্রাণখোলা লোক, যা বলব তাই মেনে নেবে। আমাদের ডেমনস্ট্রেটর ছিলেন ডাক্তার সুবোধ সুররায়। শিক্ষক হিসাবে যেমন তাঁর নাম, চারদিকে তেমনই তাঁর চোখ। তাঁর কাছ থেকে ছুটি নিলাম না। প্রভাতকে কেবল. বলে এলাম, বাড়িতে একটু কাজ পড়ে গেছে, দিন দুয়েক নাও আসতে পারি। 

বিকেলের দিকে রাঙাকাকাবাবুর ঘরে উঁকি মারলাম। অন্য লোক ছিল, কথাবার্তা বিশেষ হল না। পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। দুজনেই যেন বলতে চাইলাম, সব ঠিক আছে। আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন, রাত ন’টার মধ্যে গাড়ি নিয়ে হাজির হতে, যত শীঘ্র সম্ভব রওনা হয়ে যেতে চান। 

৪২

শীতের দিন। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়। সেই সকালে গাড়িটা সার্ভিসিংয়ে দিয়েছি। অন্ধকার হয়ে আসছে, কিন্তু গাড়ি গ্যারাজ থেকে ফেরত দিচ্ছে না। বাবার বড় গাড়ির ড্রাইভার সামসুদ্দিনকে অনেকক্ষণ পাঠিয়েছি। আমি আমার তিনতলার ঘর থেকে বারে বারে রাস্তার দিকে দেখছি আর ছটফট করছি। যদি গ্যারাজ থেকে বলে, আজ কাজ শেষ হবে না, গাড়ি কাল দেব, তাহলেই তো গেছি। এই সব নানা দুশ্চিন্তা। যাই হোক, সব চিন্তা দূর করে দেরি হলেও গাড়ি ফিরল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ততক্ষণে রাঙাকাকাবাবুর বাক্স গোছানো আমি সেরে ফেলেছি। 

মাঝে মাঝে দোতলায় গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিলাম। বাবা কোর্ট থেকে ফিরে স্নান সেরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আশেপাশে বাড়ির লোকজন ঘোরাফেরা করছে। বাবার সঙ্গে দেখা করার ও কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছিলাম। সুবিধে না পেয়ে তিনতলায় ফিরে এসে কীভাবে কী করা যায় চিন্তা করতে লাগলাম। খানিকটা পরে বাবার পায়ের আওয়াজ পেলাম। এগিয়ে দেখি বাবা ধীরভাবে ওপরে উঠে আসছেন। ছাদের আলোটা জ্বেলে দিতে বলে আমাকে নিয়ে ছাদে বেরিয়ে গেলেন। বাবার সঙ্গে এত ভাবগম্ভীর পরিবেশে কথাবার্তা এর আগে আমার আর কখনও হয়নি। 

বাবাকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। তাহলেও একটু মৃদু হেসে বললেন, “কী, ঠিক পারবে তো?” প্রথমত, এতটা গাড়ি চালাতে আমার কোনও অসুবিধা হবে কী না, গাড়ির কোনও গোলমাল হওয়ার আশঙ্কা আছে কী না ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। আমি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, “গাড়ি চালানোর দিক থেকে আমার কোনও অসুবিধা নেই, ওয়াণ্ডারার গাড়িটার ওপরও বেশ ভরসা করা যায়।” 

বাবা মনে মনে যেন সারা পথটা একবার দেখে নিলেন, কোথায়-কোথায় বাধা পাবার বা ধরা পড়ার আশঙ্কা আছে, চিন্তা করতে লাগলেন। তারপর বললেন, রাঙাকাকাবাবু যতটা নিরুদ্বিগ্ন তিনি ততটা নন। যুদ্ধের সময়, পথে অনেক কড়া পাহারা পেরিয়ে আমাদের যেতে হবে। বিশেষ করে চন্দননগর পার হবার সময় আমাদের অসুবিধেয় পড়তে হবে বলে বাবার আশঙ্কা ছিল। চন্দননগর ছিল বিরাট ব্রিটিশ রাজত্বের মধ্যে একটি ফরাসি উপনিবেশ। একটা ছোট্ট মাপের অন্য রাজ্য বলা চলে। সেখানকার ফরাসি পুলিস নানা জিনিসের, বিশেষ করে মাদক দ্রব্যের চোরাচালান ধরবার জন্য শুনেছি গাড়িঘোড়া আটক করত। 

বাবা বললেন, এত রাত্রে একটা প্রাইভেট মোটরগাড়ি চন্দননগর দিয়ে কেন যাচ্ছে প্রহরীদের এ-রকম মনে হওয়া স্বাভাবিক। সে জন্য তিনি ওই এলাকা অতিক্রম করার সময় খুব সাবধান হতে বললেন। 

বাবা আরও জানালেন যে, আমার হঠাৎ বারারি যাওয়ার একটা অজুহাত তৈরি রাখার ব্যাপারে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। দরকার হলে বলা হবে যে, আমার বৌদিদির অসুখের খবর পেয়ে বাবা আমাকে নিজের চোখে তাঁকে দেখে আসার জন্য পাঠিয়েছেন। আরও ঠিক হয়েছে যে, আমি বারারি পৌঁছে একটা টেলিগ্রাম পাঠাব। জানাব যে, বৌদিদি আগের চেয়ে ভাল আছেন। চিন্তার কোনও কারণ নেই। ছাদের আলোয় বাবা আমার সঙ্গে অল্প কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। বললেন, এই ধরনের গোপন কথাবার্তা খোলা আলোকিত জায়গায় হওয়াই ভাল, যাকে বলে ‘কনস্পিরেসি আণ্ডার দি ল্যাম্পপোস্ট’। তাতে লোকের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় না। তারপর আমার দিকে চেয়ে আবার একটু মৃদু হেসে ‘আচ্ছা’ বলে ধীরভাবে নীচে নেমে গেলেন। বুঝলাম, বাবাকে খুব চিন্তায় ফেলেছি। 

পরে মা আমাকে বলেছিলেন যে, সেদিন বাবা রাত দুটো পর্যন্ত জেগে ছিলেন, এবং সামনে দিয়ে ওয়াণ্ডারার গাড়ি চলে যাওয়ার আওয়াজ শোনার জন্য কান পেতে ছিলেন এবং মাঝে মাঝেই ঘরের পশ্চিমের ছোট বারান্দায় আনাগোনা করছিলেন। ভেবেছিলেন যে, উডবার্ন রোড দিয়েই সম্ভবত আমরা উত্তরে যাব। 

ঘড়ির কাঁটাটা বেশ দ্রুত চলতে আরম্ভ করল। গাড়িতে মাল তুলব কী করে? কেউ যদি দেখে ফেলে কী বলব? প্রথমে নীচে নেমে গাড়িটা পরীক্ষা করতে লাগলাম, যেন সার্ভিসিং কেমন হয়েছে দেখছি। গাড়িটা সামসুদ্দিন গ্যারেজে তুলে রেখেছিল। বের করে একতলার খাবার ঘরের সংলগ্ন প্যাট্রির বা ছোট-রান্নাঘরের দরজার কাছাকাছি রাখলাম। সদর দরজা দিয়ে মাল নেওয়া যাবে না, লোক বসে আছে। তিনতলা থেকে তিন পর্যায়ে বাক্সস-দুটি নামালাম। প্রথমত, এদিক-ওদিক দেখে চট করে সেগুলি দোতলার ড্রয়িংরুম বা বসবার ঘরে এনে রাখলাম। 

ঘরটা অন্ধকার ছিল। দোতলায় চাকরবাকর তো আছেই। তাছাড়া, বিশেষ করে আমার বোন গীতার চোখ এড়িয়ে কাজটা করা চাই। পিঠোপিঠি ভাইবোনেদের সম্পর্কে একটা বিশেষত্ব আছে। যত ভাব, তত ঝগড়া। একজন অন্যের কাছে কিছু লুকোলে বা একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজন কিছু করলে, অভিমানের পালা শুরু হয়। কথা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া, বাড়ির সব ব্যাপারে গীতার দৃষ্টিও ছিল খুব সতর্ক। দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখে এলাম দোতলা থেকে একতলার পথ ফাঁকা কি না। চট করে বাক্স দুটো একতলার খাবার ঘরে নিয়ে গেলাম। সৌভাগ্যক্রমে সেখানেও কেউ ছিল না, ঘরটাও ছিল অন্ধকার। শেষ পর্যায়ে গাড়ি-বারান্দা থেকে গ্যারাজের সামনে পর্যন্ত টহল দিলাম। সুবিধে বুঝে গাড়ির পেছনের একটা দরজা নিঃশব্দে খুলে রাখলাম। সময়মত বাক্স-দুটি সীটের পিছনের জায়গায় ঢুকিয়ে ফেললাম। 

কেউ তো কিছু দেখল না, কিন্তু আমার মনে হল, কোণে দাঁড়িয়ে বাবার গ্রাণ্ড ফাদার ক্লকটা যেন সব দেখল। 

খাওয়াদাওয়াটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়। আমাদের বহুদিনের পুরনো ঠাকুর সত্যবাদীর শরণাপন্ন হলাম। বললাম, বড়ই ক্লান্ত লাগছে, তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে চাই। সত্যবাদী পাণ্ডা বহুদিনের লোক, এককালে মাজননীর ঠাকুর ছিল। প্রায়ই সে আমাদের সঙ্গে অভিভাবকের মতো ব্যবহার করত। তখন ছোটরাও কেউ খায়নি, সত্যবাদী বলতে পারত, না এখন হবে না, যাও। যাই হোক। মা কাছাকাছি থাকাতে কিছু বলল না। খাওয়ার সময় মা এসে পাশে বসে রইলেন। 

বাবার ড্রাইভার সামসুদ্দিন ছিল বেশ বুদ্ধিমান ও কেতাদুরস্ত। সে বাড়িতেই থাকত, কিন্তু খেত বাইরে। ওয়াণ্ডারারের ড্রাইভার তো অসুস্থ মাকে দেখতে আগেই দেশে চলে গিয়েছে। কিন্তু সামসুদ্দিনকে সরানো দরকার। মাকে বললাম সামুদ্দিনকে খেয়ে আসতে বলতে। এই ভাবে একটা-একটা করে পথের কাঁটা সরাতে হল। 

নিজের খাওয়া সেরে মায়ের ঘরে গেলাম। পথের খরচের জন্য কিছু টাকা চাইলাম। আলমারি খুলে টাকা বের করতে করতে মা বললেন, “জানি না বাবা, তোমরা কী সব করতে যাচ্ছ!” 

আমার নিজের পোশাকের কোনওরকম পরিবর্তন করতে রাঙাকাকাবাবু মানা করেছিলেন—আমাকে তো দুই বাড়ির অনেকেই সেই সন্ধ্যায় দেখবে। ধুতি, শার্ট, গরম কোট, কাবলি জুতো। তবে নিজের জামাকাপড়ের ভেতর থেকে বের করে রাঙাকাকাবাবু নিজের একটা কাশ্মীরি টুপি আমাকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দিনের আলোতে গাড়ি চালাবার সময় টুপি পরে নিতে, যাতে চেহারাটা অন্যরকম দেখায়, অবাঙালি মনে হয়। ওই টুপিটা পরে রাঙাকাকাবাবুর ইউরোপে তোলা অনেক ছবি আছে। সঙ্গে নিজের জন্য জিনিসপত্র বিশেষ কিছুই নিইনি। ছোট্ট একটা ব্যাগই যথেষ্ট ছিল। 

আটটা বেজে গিয়েছে। প্রস্তুত হয়ে ধীরে-সুস্থে নীচে নামলাম। গাড়িবারান্দায় একতলার বেয়ারা ধনু বসে ছিল। তাকে বললাম, আমি একটু রিষড়ার দিকে যাচ্ছি। যদি দেরি হয়ে যায় রাতটা ওখানেই থেকে যাব। এগারটা পর্যন্ত দেখে তোমরা দরজা বন্ধ করে দিও। 

উলটো দিক দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। উডবার্ন পার্ক থেকে বেরিয়ে ডান দিকে চলে গেলাম। লোয়ার সার্কুলার রোড আর লী রোডের মোড়ের পেট্রল পাম্পে ঢুকলাম। ট্যাঙ্ক ভর্তি করে নিলাম, টিনে দু গ্যালন পেট্রল আলাদা করে নিলাম। টায়ারের চাপ ঠিক আছে কি না দেখে নিলাম। তারপর চৌরঙ্গি হয়ে পশ্চিম দিক থেকে এলগিন রোডে ঢুকলাম। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই গাড়ি চালিয়ে ৩৮/২ এলগিন রোডে ঢুকে গেলাম। বাড়ির শেষ প্রান্তে গাড়িটা ঘুরিয়ে রান্নাবাড়ির সিঁড়ির কাছে রাখলাম। 

রাঙাকাকাবাবুর ঘরে গিয়ে দেখি তিনি সিল্কের ধুতি-চাদর পরে উত্তরের জানালার কাছে মেজেতে পাতা আসনে বসতে যাচ্ছেন। সামনে থালায় খাবার দেওয়া রয়েছে। মাজননী, বাড়ির দুই বৌ আর ছেলেমেয়েরা কয়েকজন রয়েছেন। বোঝাই গেল, নির্জনবাস ও ব্রত-টত করার যে সঙ্কল্প রাঙাকাকাবাবু প্রচার করেছিলেন, এই লোক-দেখানো অনুষ্ঠানটি ছিল তারই শুরু। ব্যাপারটা আমি দাদাভাইয়ের খাটে বসে নিশ্চল হয়ে দেখলাম। মাঝে মাঝে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দৃষ্টি-বিনিময়ও হল। 

৪৩

রাঙাকাকাবাবুর আনুষ্ঠানিক আহারের পর বাড়ির বড়রা একে একে যে যার ঘরে চলে গেলেন। মাজননীও নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। মাজননী ও রাঙাকাকাবাবুর ঘরের মধ্যের দরজায় সেই যে খিল দেওয়া হল, ২৬শে জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত আর খোলা হয়নি। পাশের যে ঘরে ইলা থাকত আমি সেখানে সরে গেলাম এবং জ্যাঠাবাবুর বড় ছেলে আমাদের মেজদার সঙ্গে জমিয়ে গল্প জুড়ে দিলাম। রাঙাকাকাবাবুর রেডিওটা ঐ ঘরে রাখা হয়েছিল। খবর-টবর শুনতে শুনতে মেজদার সঙ্গে নানারকম কথাবার্তা চলতে লাগল। মেজদা—ধীরেন্দ্রনাথ—গণেশ বলেই বেশি পরিচিত ছিলেন। খুব প্রাণখোলা হাসিখুশি লোক ছিলেন তিনি। তাঁর সরলতার সুযোগ নিয়ে আমরা সকলেই তাঁকে নানাভাবে খ্যাপাতাম। 

বড়রা প্রস্থান করবার পরেই রাঙাকাকাবাবুর ঘর সাজানো শুরু হল। দেখলাম অরবিন্দকেও রাঙাকাকাবাবু দলে টেনে নিয়েছেন। বিছানার বড় বড় চাদর টাঙিয়ে ঘরটাকে তিন ভাগে ভাগ করা হল। উত্তর দিকে ঘরের অর্ধেকটা আলাদা রইল। দক্ষিণের বেশির ভাগটাই দাদাভাইয়ের প্রকাণ্ড খাটটা ঘিরে রইল। আর-একটা ছোট এলাকা করা হল বাইরে যাবার দরজাটার কাছে। সকলকে বলা হয়েছিল, ঐ এলাকা পেরিয়ে কেউ যেতে পারবে না। মাজননীর ঠাকুর সর্বেশ্বরকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, সে ঐ এলাকা থেকে পরদা একটু সরিয়ে খাবারের থালা একটি নিচু ছোট টেবিলে সময়মতো রেখে যাবে। আবার সময়মতো খালি থালা সরিয়ে নিয়ে যাবে। 

ইলা ও অরবিন্দ তারপর রাঙাকাকাবাবুর বালিশের ওয়াড়, বিছানার চাদর ও গেঞ্জি থেকে সেলাই করা ‘৬’ নম্বর চিহ্নগুলি কেটে ফেলে দিল। সেগুলি হোল্ড-অলে ঢুকিয়ে সেটি বেঁধে রাখা হল। 

সর্বেশ্বর ঠাকুর নিজের অজান্তে অন্তর্ধানের পরিকল্পনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল দশদিন পরে কিছুই না জেনে সে ২৬শে জানুয়ারি ‘আবিষ্কার’ করল যে, খাবার আগের দিন রাত্রে খাওয়া হয়নি, যেমন দেওয়া হয়েছিল তেমনই পড়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই সে সোরগোল তুলল, নিশ্চয়ই রাঙাকাকাবাবুর কিছু হয়েছে, যাই হোক, সে পরের কথা। সর্বেশ্বর রাঁধতও ভাল, লোকও ছিল চমৎকার। সে ছিল এক সুদর্শন পুরুষ, শরীরের গঠন ছিমছাম। সে হাত-পা দুলিয়ে নাচিয়ের ভঙ্গিতে চলাফেরা করত। সেজন্য বাড়ির সকলেই তাকে উদয়শঙ্করের চেলা বলে ঠাট্টা করতেন। 

.

রাঙাকাকাবাবু বলেছিলেন যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পড়তে চান। কারণ আলো হবার আগেই ধানবাদ পৌঁছে যাওয়া ভাল। কিন্তু পথ খালি পাবার জন্য আমাদের ঘণ্টা-চারেক অপেক্ষা করতে হল। রাঙাকাকাবাবু তো ক্রমে ক্রমে বেশ অস্থির হয়ে পড়ছিলেন। মেজদার তাড়াতাড়িই ঘুম পেত। বেশ খানিকক্ষণ রেডিও শোনা ও কথাবার্তার পর তিনি হাই তুলতে লাগলেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে হাই তুলতে লাগলাম। মেজদা শুতে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, আমিও বললাম—বাড়ি ফিরতে চাই। এরই মধ্যে দ্বিজুদা বা দ্বিজেন আমাকে বলে গেল, রাঙাকাকাবাবু আমাকে জানাতে বলেছেন যে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি যেন ডান দিকে মোড় নিয়ে এলেনরি রোড ধরে দক্ষিণে চলে যাই। মেজদা তো হাই তুলতে তুলতে উপরে চলে গেলেন। কিন্তু মুশকিল হল সেজদাকে নিয়ে-সেজকাকাবাবুর বড় ছেলে রঞ্জিত বা কার্তিক। আমার স্থির বিশ্বাস তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অস্বাভাবিক কিছু-একটা ঘটতে যাচ্ছে। তিনি এটাও জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এত রাত পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে আমি কেন ও-বাড়িতে রয়েছি। সেজদা ক্রমাগতই দোতলার লম্বা বারান্দায় আর গাড়িবারান্দার ছাদে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। একবার তিনি তিনতলার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছেন দেখে আমিও জোরগলায় ‘এবার বাড়ি যাওয়া যাক’ বলে বেশ আওয়াজ করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলাম। একটু পরে পা টিপে টিপে উপরে উঠে আসছি। দেখি সেজদাও তিনতলা থেকে নেমে আসছেন। ধরা পড়ে যাওয়াতে কী-একটা যেন ফেলে গেছি এ-রকম কিছু বলে সরে গেলাম। রমণীকে বলে দেওয়া হল, সে নীচের সদর দরজা বন্ধ করে শুতে যেতে পারে। সে তাই করল। দেখে নেওয়া হল যে, বাড়ির অন্য চাকর-বাকররা যে যার আস্তানায় চলে গেছে। কিন্তু সেজদা কিছুতেই ভোলবার নয়। 

যখন রাত একটা বেজে গেল, রাঙাকাকাবাবু দ্বিজুদাকে বললেন সেজদাকে সঙ্গে করে নিয়ে তিনতলায় শুতে যেতে। আর যদি সেজদা কোনো সন্দেহ প্রকাশ করে, তাকে বলতে যে সন্দেহ করলে তো রাঙাকাকাবাবুর মন্দ বই ভাল হবে না। সুতরাং সন্দেহ চেপে রেখে শুয়ে পড়াই ভাল। দ্বিজুদাকে আরও বলে দেওয়া হল যে, উপর থেকে রাস্তার দিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে এবং সেজদাকে ধরে রেখে ঠিক সময়ে বেশ জোরে গলা ঝাড়া দিতে। তার গলার আওয়াজ পেলে আমরা যাত্রা আরম্ভ করব। 

চারিদিক নিস্তব্ধ। রাঙাকাকাবাবুর ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা সেকেণ্ড ঠুকে ঠুকে এগিয়ে চলেছে। আমিও যেন আমার হার্টের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। সেই সন্ধ্যার দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ পনেরো মিনিট যে কীভাবে কাটল ভগবানই জানেন। দেড়টার সময় দ্বিজুদার গলা খাঁকারি শোনা গেল। রাঙাকাকাবাবু দরজার কাছের ঘেরা এলাকায় বেরিয়ে এলেন। সেই মুহূর্তে ছদ্মবেশে তাঁকে দেখে বেশ চমকেই গিয়েছিলাম। উত্তর ভারতের মুসলমান মৌলভির বেশে সুভাষচন্দ্র বসুর এক অবিস্মরণীয় প্রকাশ। ঐ প্রকাশ কজনই বা দেখেছে! ইলার কপালে স্নেহচুম্বন দিয়ে ‘গড় ব্লেস ইউ’ বলে আমাদের যাত্রা শুরু করতে বললেন। অরবিন্দ হোল্ড-অলটা তুলে নিয়ে আগে আগে চলল, তার পেছনে রাঙাকাকাবাবু, শেষে আমি। ততক্ষণে চাঁদ বেশ উঠেছে। রাঙাকাকাবাবু আগেই বলে দিয়েছিলেন দেওয়াল ঘেঁষে চলতে, যাতে ছায়া না পড়ে। পা টিপে টিপে চলতে হল। আগেই দেখেছিলাম, রাঙাকাকাবাবু কাবলি জুতোটা পরেননি, পরেছিলেন ইউরোপের মজবুত মোটা হীল-ওয়ালা ব্রাউন রঙের ফিতে-বাঁধা জুতো। শেষকালে তিনি বলেছিলেন, তাঁকে অনেক হাঁটতে হবে, কাবলি পরা তাঁর অভ্যাস নেই। ওটা পরে অত হাঁটতে পারবেন না। যে চশমা তিনি ব্যবহার করতেন সেটা রেখে গেলেন। সঙ্গে নিলেন বহুকালের পুরনো রোল্ড গোল্ডের ফ্রেমের চশমা, যেটা তিনি ছাত্রাবস্থায় ইংল্যাণ্ডে ও দেশে ফিরে ত্রিশ দশকের প্রথমে পরতেন। বললেন, প্রয়োজনমতো হাঁটবার সময় চশমা পরবেন, অন্য সময় খালি চোখেই থাকবেন। 

আমরা লম্বা বারান্দা পেরিয়ে রান্নাবাড়ির মাঝখানের বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির মুখে পৌঁছলাম। কেউ কোথাও নেই, কোনো শব্দ নেই, শুরুটা বেশ নির্বিঘ্নে হবে বলে মনে হল। 

রাঙাকাকাবাবু আগেই বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি পেছনে বসবেন। ব্যবস্থাটা ছিল যে, কোথাও যদি কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ করে বা প্রশ্ন করে, আমি চুপচাপ গম্ভীর হয়ে বসে থাকব—যেন মনিব। রাঙাকাকাবাবু আমার ‘শোফার’-এর পার্ট করবেন। প্রয়োজন হলে তিনি চট করে বেরিয়ে এসে সেলাম ঠুকে কথাবার্তা শুরু করে দেবেন। আমি অবশ্য তাঁকে বলেছিলাম, চেহারা দেখে কি কেউ বিশ্বাস করবে যে আমি মনিব আর আপনি আমার ‘শোফার’? রাঙাকাকাবাবু উত্তরে আমাকে বলেছিলেন, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। চুপচাপ বসে থাকবে, আমি ঠিক অ্যাকটিং ক’রে যাব! 

পা টিপে টিপে তিনজনে রান্নাবাড়ির সিঁড়ির নীচে পৌঁছলাম। গাড়ি তো সামনেই রয়েছে। অরবিন্দ হোল্ড-অলটা সামনের বাঁ দিকের সীটে রেখে দিয়ে গেটের দিকে চলে গেল। আমি নিঃশব্দে গাড়ির পেছনের বাঁ দিকের দরজাটা খুলে দিলাম। সম্পূর্ণ নিঃশব্দে রাঙাকাকাবাবু গাড়িতে উঠে বসলেন। এক মুহূর্ত পরেই আমি ইচ্ছা করে পায়ের বেশ আওয়াজ করে ড্রাইভারের জায়গায় বসলাম এবং সশব্দে দরজা বন্ধ করলাম। পেছনের নিমগাছের ঘুমন্ত কাকগুলো চমকে কা-কা করে উঠল। সামনে চেয়ে দেখলাম গেটটা খুলে গেল। স্টার্ট নিতেও বেশ আওয়াজ হল। ওয়াণ্ডারার বেশ তেজের সঙ্গে যাত্রা শুরু করল। কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গাড়ি চালিয়ে দিলাম। গেট পার হয়ে ডান দিকে ঘুরলাম, খানিকটা এগিয়ে আবার ডান দিকে মোড় নিয়ে এলেনবি রোডে ঢুকে পড়লাম। ততক্ষণ রাঙাকাকাবাবু তাঁর পাশের দরজাটা ধরে বসে ছিলেন, যাতে দরজা বন্ধ করার দুটো আওয়াজ না হয়। দরজাটা তিনি বন্ধ করলেন, এক দুর্গম যাত্রা শুরু হল। 

যাত্রা করার ব্যাপারে এক অদ্ভুত রকমের অনুভূতি আমার মধ্যে অনেকদিন কাজ করত। আমার মনে হত ঐ গোপন যাত্রার দুই নীরব সাক্ষী থেকে গেল—উডবার্ন পার্কের নীচের বারান্দার প্রহরী বাবার গ্র্যাণ্ড ফাদার ঘড়িটা আর এলগিন রোডের বাড়ির নিমগাছটা। দুই সাক্ষী যেন এখনও আমাকে বলে, আমরা কিন্তু জানি। 

৪৪

এলেনবি রোড থেকে বাঁ দিকে ঘুরে জাস্টিস চন্দ্রমাধব রোড ধরে ল্যান্সডাউন রোডে পড়লাম। দক্ষিণে যাবার উদ্দেশ্যটা ছিল বেশ পরিষ্কার—যদি পুলিশের কোনো চর গাড়ি বেরুতে দেখে থাকে, সে মনে করবে, হয়তো বা কাউকে বাড়ি পৌঁছতে গাড়ি দক্ষিণে গেল, পুলিশের দফতরেও রিপোর্ট হবে সেই রকম। 

রওনা হবার পর বেশ কিছুক্ষণ আমি বারবার পেছনের দিকে দেখছিলাম। রাঙাকাকাবাবু আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন আমি গাড়ি চালাতে চালাতে পেছনে ফিরে ফিরে দেখছি। আমি দেখছিলাম কেউ ফলো করছে কি না। ল্যান্সডাউন রোডে আমাদের একটু পেছনে একটা গাড়ির আলো দেখেছিলাম। গাড়িটা অন্য দিকে মোড় নেওয়ায় আমি নিশ্চিন্ত হলাম। 

প্রথমেই যাত্রার শুরুতে দেরি হওয়ার কথা উঠল। আমাদের হিসাবমতো অন্তত তিন ঘণ্টা দেরি হয়েছিল। রাঙাকাকাবাবু বললেন, শেষ পর্যন্ত পথ পরিষ্কার করতে না পারলে তিনি সে রাত্রে রওনা হবার প্ল্যান ‘গিভ আপ’ করতেন। আমি তো শুনে আঁতকে উঠলাম। তিনি বললেন, এই ধরনের গোপন কাজে উপায় না থাকলে অনেক সময় সন্দিহান আত্মীয়স্বজন বা নিকট-বন্ধুদের খানিকটা দলে টেনে নিতে হয়। মুখ বন্ধ করার এ একটা উপায়। গোপন বৈপ্লবিক কাজে যত কম লোককে জড়ানো হয় ততই ভাল। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন এটা নয়। যাই হোক, যাত্রা মোটামুটি শুভ হয়েছে বলেই তো আমার মনে হল। 

একেবারে শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় চূড়ান্ত কথাবার্তার সময় রাঙাকাকাবাবু একটা কথা আমাকে বলেছিলেন। বলেছিলেন যে, আমি যে তাঁকে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে গেছি সেটা খুব বেশি দিন গোপন থাকবে না, ‘লিক’ হয়ে যাবে। কারণ, এলগিন রোডের বাড়ি এত বড় এবং এত রকমের লোকজন সেখানে যাওয়া-আসা করে যে, ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যাবে। বললেন, তাতে আর কী হয়েছে, যতদিন যুদ্ধ চলবে ততদিন জেলে থাকবে, দেশের কত লোকই তো জেলে রয়েছে। তবে নিজের সম্বন্ধে তিনি আশাবাদী ছিলেন। বলেছিলেন, তোমরা যদি দিন-চারেক কোনোরকম করে ব্যাপারটা চেপে রাখতে পারো, তাহলে আমি ‘পগার পার হয়ে যাব।’ 

১৯৪২ সালের শেষের দিকে আমি যখন বন্দী অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছি তখন বাবা দক্ষিণ ভারতের জেল থেকে এক গোপন বার্তায় জানিয়েছিলেন যে, তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছেন রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানে আমার ভূমিকার কথা ভারত সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ জানে। অবশ্য খবরটা বেরিয়ে যাবার সূত্রটা তিনি বলেননি। 

ল্যান্সডাউন রোড থেকে সার্কুলার রোড ধরে শেয়ালদার দিকে এগোলাম। এখান-সেখানে দু-একটা ঠেলা বা ঘোড়ারগাড়ি চোখে পড়ল। রাস্তায় লোকজন ছিল না বললেই হয়। শেয়ালদার কাছাকাছি রাস্তায় বেশ কিছু ফিটন গাড়ি ঘোরাফেরা করছিল। গাড়ির গতি কমিয়ে নিতে হল। আমার মাথায় দুটি প্রশ্ন ঘুরছে, প্রথম কেউ আমাদের অনুসরণ করছে কি না, দ্বিতীয়, সময় নষ্ট হচ্ছে কিনা। গাড়ির ড্যাশ বোর্ডের ঘড়িটায় আলো জ্বলছিল না। সেজন্য আমি বারবার বাঁ হাতে টর্চের আলো ফেলে সময় দেখছিলাম। চারদিকে লোকজন, গাড়িঘোড়া। রাঙাকাকাবাবু আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, টর্চের আলো রিফলেক্ট করে তাঁর মুখে পড়ছে, আমি যেন টর্চ না জ্বালাই। 

হ্যারিসন রোড ধরে যখন বড়বাজার পার হলাম কী রকম যেন অদ্ভুত লাগল। কলকাতার ওই এলাকা যে অত নির্জন হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। হাওড়া ব্রিজের মুখে দু-একটা ট্যাক্সি দেখা গেল। কেবলই মনে হচ্ছিল গাড়ির চাকার আওয়াজটা বড়ই বেশি হচ্ছে, পাথরে বাঁধানো রাস্তা তো। যখন হাওড়া ব্রিজে উঠলাম, আওয়াজটা যেন আরও বেড়ে গেল। কেন যে মোটর গাড়ি পা টিপে টিপে চলতে পারে না! সকলে জেগে যাবে যে! জলের ওপর জাহাজ ও নৌকাগুলো ঘুমিয়েই রইল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এই ব্রিজ দিয়ে হরিপুরা কংগ্রেস থেকে ফেরার সময়, এক বিরাট শোভাযাত্রা করে রাঙাকাকাবাবুকে নিয়ে আসা হয়েছিল। কী অদ্ভুত পট-পরিবর্তন। হাওড়ার সবকিছুই নীরব। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে পড়ে মনে হল, মুক্তি পেয়েছি। জোর কদমে এগিয়ে যাওয়া যাবে এবার। ততক্ষণে চাঁদও বেশ উঠেছে, যেন পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে। 

একটু পরেই রাঙাকাকাবাবু ভবিষ্যতের পরিকল্পনাটা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, যদিও বাবার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে যে, আমি বারারি পৌঁছে একটা টেলিগ্রাম পাঠাব, তাঁর মনে হয় কাজটা ঠিক হবে না। কেন মিছিমিছি সরকারি দফতরে আমার কলকাতার বাইরে যাওয়ার একটা রেকর্ড থেকে যাবে। রওনা হবার আগেই অবশ্য তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি কোনো ডাকবাংলোয় আশ্রয় না নিয়ে দাদার বাড়িতেই ছদ্মবেশে দিনটা কাটাবেন। নীতিটা হল, অপরিচিত লোকের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার চেয়ে আত্মীয়স্বজনের কাছে ধরা দেওয়া ভাল। তাছাড়া তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, তিনি বারারির জন্য যে অভিনয়ের প্ল্যান করেছিলেন, সেটা বেশ উতরে যাবে। 

রিষড়া পার হবার সময় আমাদের বাগানবাড়িটা রাস্তার ধার থেকে রাঙাকাকাবাবুকে দেখিয়ে দিলাম। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর শিল্পাঞ্চল পেছনে ফেলে বেশ স্পীড়েই বেরিয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে বন্দুকধারী পুলিশ দেখা গেল। মনে হল তারা যেন অবাক হয়েই আমাদের দেখছে, কিন্তু কেউই আমাদের পথ আগলাবার চেষ্টা করল না। এ সময়েই রাঙাকাকাবাবু ডি ভ্যালেরার জেল থেকে পালাবার কথা পাড়লেন। 

.

পথের হিসেব রাখার জন্য আমি ঘন ঘন টর্চের আলো ফেলে বাস্তার মাইলস্টোনগুলি দেখছিলাম। গাড়ির স্পীড মাঝারি কিন্তু সমান রেখেছিলাম। বেশি জোরে চালিয়ে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। বর্ধমানের কাছাকাছি একটা রেলের লেভেল-ক্রসিংয়ে প্রথম আটকালাম। ইলা সঙ্গে ফ্লাস্কে কফি দিয়েছিল। ভাবলাম একটু কফি খেয়ে নিই। রাঙাকাকাবাবু তৎক্ষণাৎ বললেন, “আমি মাঝে মাঝে তোমাকে কফি ঢেলে দিই, তুমি গাড়ি চালাও আর খাও।” এমনভাবে কথাটা বললেন যে আমিই কোনো বড় কাজে বেরিয়েছি, তিনি আমাকে সাহায্য করবার জন্য রয়েছেন। আর এমন স্নেহের সুরে কথাটা বললেন যে, আমি তো অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। তাঁর কথাই রইল। 

আমি ফিরে বললাম, “আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন না।” 

তিনি উত্তর দিলেন, “না, গাড়ির একমাত্র যাত্রীর ঘুমোনো উচিত নয়, ড্রাইভারের নিঃসঙ্গতা বাড়ে, ঘুমও পেয়ে যেতে পারে।” তিনি দেশের নানা জায়গায় ট্যুর করবার সময় বহুবার মোটরগাড়িতে রাত জেগেছেন। তাঁর কিছু অসুবিধা হবে না। 

ট্রেন তো চলে গেল কিন্তু লেভেল-ক্রসিংয়ের প্রহরীটি ঘুমিয়ে পড়েছে। গেট আর খোলে না। এঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ি থেকে নেমে আমাকে হাঁকাহাকি করতে হল। গেট তো খুলল, কিন্তু গাড়ি আর স্টার্ট নিতে চায় না। দেখে রাঙাকাকাবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। বুঝলাম, হঠাৎ থামবার জন্য তেল বেশি এসে গিয়েছে। রাঙাকাকাবাবুকে আশ্বস্ত করলাম। একটু পরে ওয়াণ্ডারার সজোরে স্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল। বর্ধমান যখন পার হলাম তখন প্রায় সাড়ে চারটে হবে। ওই সময়টায় সকলে ঘুমোয় বেশি, সুতরাং কোনো সমস্যা ছিল না। আসানসোলের দিকে এগিয়ে চললাম। হাওড়া থেকে বর্ধমান পর্যন্ত রাস্তাটা ছিল আঁকা-বাঁকা। বর্ধমান থেকে আসানসোল, ধানবাদ মোটামুটি সিধে রাস্তা, তবে উঁচু-নিচু। মাঝে পড়বে দুর্গাপুর। দুর্গাপুরের চেহারা ছিল তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। দুর্গাপুরের জঙ্গলে প্রায়ই ডাকাতি-টাকাতি হয় বলে শোনা যেত। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লালমাটির রাস্তা চলে গেছে। বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ ওই সময়টাতে পেয়েছিলাম। ডাকাত অবশ্য পড়েনি। কিন্তু হঠাৎ অন্ধকারের মধ্য থেকে একপাল মোষ রাস্তার ওপরে এসে পড়ায় বেশ কিছুটা অসুবিধায় পড়েছিলাম। বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল, গাড়ি থামিয়ে ফেললাম। তবে মোষগুলো গাড়ির আশেপাশে ধাক্কাধাক্কি করে রাস্তার অন্য পারে চলে গেল। দেখলাম, অত রাতেও দু-চার জন লোক লাঠি চালিয়ে মোষগুলো তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

আসানসোলের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি তখন আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। এটাই আমরা চাইনি, কিন্তু উপায় কী? আমার আবার মাথায় চাপল যে, পেট্রল নেব। রাঙাকাকাবাবুর মত ছিল না, বললেন, “না নিলে হয় না? দু গ্যালনের টিনটা তো সঙ্গেই ছিল। কিন্তু আমি বললাম, “কোনো চান্স নিতে চাই না।” 

.

আসানসোল শহরে ঢোকার আগেই একটা পেট্রল পাম্পে গাড়ি দাঁড় করালাম। যতটা পারি এগিয়ে রাখলাম যাতে পাম্পের লোকটি রাঙাকাকাবাবুকে সোজাসুজি দেখতে না পায়। তাঁরই দেওয়া কাশ্মীরি টুপিটি মাথায় দিয়ে নামলাম। গাড়ির বেশ খানিকটা পেছনে দাঁড়িয়ে দাম মেটালাম। লোকটি দোকানঘরের দিকে রওনা দেবার পরে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। এবার স্পীডও বাড়ালাম। আসানসোল থেকে ধানবাদের পথে দু-চারটে গাড়ির সঙ্গে মোলাকাত হল। যখনই লোকজনের জটলা বা গাড়ি দেখি, গতিটা বাড়িয়ে দিই। সেই চেনা গোবিন্দপুরের কাছাকাছি এসে খানিকটা দূর থেকেই দেখতে পেলাম একটা লম্বা বাঁশের বেড়া রাস্তার ওপর নেমে আসছে। একটি লোক রাস্তার পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির নম্বর টুকে নিল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই বেড়াটা উঠে গেল। আরও খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে ধানবাদের রাস্তা ধরলাম। রাঙাকাকাবাবু বার দুয়েক জিজ্ঞাসা করলেন, “ঠিক দেখেছ যে গাড়ির নম্বর নিয়েছে?” 

আমি বললাম, “হ্যাঁ।” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *