বসু-বাড়ি – ১

আমার জীবনের প্রথম স্মৃতি, যেটা আজ কেবল আবছা-আবছা মনে পড়ে, সেটা কিন্তু এখন খুবই মজার বলে মনে হয়। যদিও যখন সেটা ঘটেছিল তখন সেটাই আমার জীবনের সমাপ্তি হতে পারত। বয়স তখন আমার বছর চারেক হবে, কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়ে শ্রীনগরের হাউসবোট থেকে ঝেলাম নদীতে পড়ে গিয়ে তলিয়ে গেলাম। বাবা ও মা, শরৎচন্দ্র ও বিভাবতী বেরিয়েছেন। আমার দাদাভাই ও মাজননী আছেন পাশের অন্য এক হাউসবোটে। এইখানে বলে রাখি যে, আমরা আমাদের পিতামহ জানকীনাথকে দাদাভাই ও পিতামহী প্রভাবতীকে মাজননী বলে ডাকতুম। 

আমার দিদি ও এক দাদা অবাক হয়ে দেখছে আমি নদীর জলে ডুবছি আর উঠছি। কিছু একটা ঘটেছে আন্দাজ করে একটি লোক ছুটে এল, নাম তার কালু সিং। আমার পোশাকের অংশ জলের ওপর দেখতে পেয়ে সে জলে ঝাঁপ দিয়ে আমাকে টেনে তুলল। কালু সিং পাহাড়ি লোক, সাঁতার জানে না, তাও জলে ঝাঁপ দিল। আমাদের বাড়ির কথা বলতে গেলে কালু সিংকে বাদ দেওয়া যায় না। তার সম্বন্ধে পরে কিছু বলব। 

কাশ্মীরে বাবা-মা আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে বেড়াতে গেছেন। সঙ্গে নিয়ে গেছেন দাদাভাই ও মাজননীকে। আর সঙ্গে আছেন রাঙাদাদাবাবু বীরেন্দ্রনাথ দত্ত—মাজননীর এক ভাই—যিনি কলকাতায় আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। আর ছিলেন আমাদের পরিবারের এক বিশেষ বন্ধু ব্যারিস্টার প্রভাসচন্দ্র বসু। বাবা তখনই কলকাতা হাইকোর্টের বড় ব্যারিস্টারদের মধ্যে একজন। সেকালে হাইকোর্টের একটাই বড় ছুটি হত। পুজোর কিছুকাল আগে থেকে শুরু করে। ছুটিতে সাহেব জজ-ব্যারিস্টাররা হোম লীভে বিলেত যেতেন। বাবার শখ ছিল বড় ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া। সেই সূত্রে ছেলেবেলায় আমরা বেশ কয়েকটা পাহাড়ি জায়গা দেখবার সুযোগ পেয়েছি। কয়েকবার বাবা দাদাভাই ও মাজননীকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। ১৯২২-২৩’এ কার্শিয়াংয়ে বাবা বাড়ি করবার পর অবশ্য সেখানেই যাওয়া হত বেশি। 

আমার দাদাভাই জানকীনাথ বসু সত্যিই অসাধারণ লোক ছিলেন, যদিও তাঁর সম্বন্ধে যথেষ্ট লেখা হয়নি। আমি যখন ফার্স্ট ক্লাস বা স্কুলের শেষ বছরে ঢুকব, সেই সময় তিনি মারা যান। শৈশবে বা কৈশোরে তাঁকে কেমন মনে হত, শুধু সেটুকুই আমি বলতে পারি। 

তিনি, বেশির ভাগ সময় কটকে থাকতেন এবং আমরা থাকতুম কলকাতায়। তিনি পুজোর সময় মাজননী প্রভাবতীকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় আসতেন। অসুখ করলে চিকিৎসার জন্য আসতেন, কিংবা বাবা-মায়ের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে যাবেন বলে আসতেন। দাদাভাই ও মাজননীর পুজোর সময় কলকাতা আসাটা আমাদের বাড়ির একটা বিশেষ ঘটনা ছিল। সেই সময় বাড়ির অন্য অনেকে—কাকা-জ্যাঠারা—যাঁরা কাজে কলকাতার বাইরে থাকতেন, তাঁদের অনেকেও কলকাতায় জড়ো হতেন। ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়ি সরগরম হয়ে উঠত। 

দাদাভাই ও মাজননী কলকাতা পৌঁছবার দিন এলগিন রোডের বাড়িতে সকলে মিলে সারি দিয়ে ঠাকুর-প্রণামের মতো একটা ব্যাপার করত। তাঁরা দু’জনে তাঁদের ঘরে পাশাপাশি বসতেন। আর আমরা একে একে প্রণাম করতুম। দাদাভাই প্রত্যেককে আলাদা করে আদর করতেন এবং কাছে টেনে নিয়ে প্রত্যেককে বিশেষ কিছু আলাদা করে বলতেন। আমরা যেন প্রত্যেকেই বিশেষ কোনো গুণের অধিকারী। আমরা সকলেই গভীরভাবে অনুভব করতুম তাঁর অফুরন্ত স্নেহের স্পর্শ। মাজননী প্রায় একইভাবে আমাদের কাছে টেনে নিতেন এবং নানা রকম প্রশ্ন বা মন্তব্য করতেন, যার ধরন ছিল একটু আলাদা। যেমন, কার রঙ আগের চেয়ে কালো হয়ে গেছে, কে যেন গায়ে মোটেই সারছে না, কিংবা আর কেউ বড়ই মোটা হয়ে পড়ছে, ইত্যাদি। তিনি তাঁর মন্তব্যগুলি সাধারণত আমাদের মায়েদের উদ্দেশে ছুঁড়তেন, যাঁরা কাছেই মাথায় কাপড় টেনে সলজ্জ ও সশ্রদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দুজনেরই আমাদের উপর প্রভাব ছিল বিরাট, কিন্তু কোথায় যেন একটু তফাত ছিল। দাদাভাইয়ের প্রতি আমাদের ভালবাসা ছিল ভালবাসাই, মাজননীর ক্ষেত্রে ভালবাসার সঙ্গে মেশানো ছিল খানিকটা ভয়। 

পুজো হত আমাদের গ্রাম কোদালিয়ায়, কলকাতা থেকে মাইল চোদ্দ হবে। দাদাভাই ও মাজননীর উপস্থিতিতে পুজো হলে ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াত গ্রামের সব স্তরের মানুষের একটা বিরাট মিলন-যজ্ঞ। আমরা ছোটরা তার মধ্যে প্রায় হারিয়ে যেতাম বলা চলে। একদিকে দাদাভাই তাঁর চিরসঙ্গী ছাতাটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সকলকে হাসিমুখে সম্ভাষণ করছেন, অন্যদিকে মাজননী বিরাট এক কর্মযজ্ঞের কর্ত্রী, বাড়ির আর সকলেই সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। 

বিজয়ার দিন দেশের পুজো সেরে দাদাভাই ও মাজননী কলকাতার বাড়িতে ফেরার পরে যে ব্যাপারটা হত, সেটাকে বসুবাড়ির কংগ্রেস বলা চলে। আত্মীয়স্বজন যে যেখানে আছেন সবাই ৩৮/২ এলগিন রোডে ভেঙে পড়তেন। মঞ্চে কিন্তু একজন সভাশ্রেষ্ঠর বদলে দুজন থাকতেন—দাদাভাই ও মাজননী। 

অত বড় বাড়িতেও জায়গা কুলোয় না। তার উপর প্রণাম, আলিঙ্গন ও সম্ভাষণের ঠেলায় শেষ পর্যন্ত সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। শেষে জলযোগ ও উপাদেয় শরবতে অধিবেশন শেষ হত। আমরা ছোটরাও তার ভাগ পেতাম। 

বাড়ির ছোটরা দাদাভাইকে একান্তভাবে পেতাম, যখন তিনি আমাদের সঙ্গে করে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। তাঁর যখন বছর চল্লিশেক বয়স, তখন তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর থেকে তিনি শরীরের দিক থেকে ডাক্তারের পরামর্শমতো কড়া নিয়ম মেনে চলতেন। 

নিয়মের মধ্যে প্রধান দুটি ছিল সকালে হেঁটে বেড়ানো এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সংযম। দাদাভাই জীবনের তিরিশ বছর নুন না খেয়ে চালিয়ে গেছেন। কী দিয়ে রান্না হবে, কী কী খাওয়া চলবে বা চলবে না, মাজননী পাশে বসে তদারক করতেন, এবং প্রায়ই “লোভ”-এর কুফলের কথা দাদাভাইকে মনে করিয়ে দিতেন। মাঝে-মাঝে বলতেন, 

তোমার তো খালি লোভ!” কথাটা শুনে আমাদের কেমন-কেমন লাগত। কারণ দাদাভাইয়ের লোভ কিছু ছিল বলে তো কখনও মনে হয়নি। 

আমার মা রান্নাবান্নায় বেশি আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু দাদাভাইয়ের জন্য মাজননীর নির্দেশমতো ইক্‌মিক কুকারে রান্না চাপাতেন। উডবার্ন পার্কের বাড়ির দোতলার দক্ষিণের বারান্দায় দাদাভাই মাটিতে আসন পেতে খেতে বসেছেন, এই দৃশ্য বেশ মনে পড়ে। পাশেই টেবিল-চেয়ার, কিন্তু তিনি মাটিতে বসেই খেতেন। নিয়মমাফিক তাঁকে কইমাছ ঘিয়ে ভেজে খেতে হত। 

ডাক্তারি দুরমকই চলত—অ্যালোপ্যাথি ও কবিরাজি। আমাদের নতুনকাকাবাবু সুনীলচন্দ্র নিজেই বড় ডাক্তার ছিলেন। বাড়ির কবিরাজ ছিলেন শ্যামাদাস বাচস্পতি। তাঁর স্নিগ্ধ সৌম্য চেহারা বেশ মনে পড়ে। আমাদের ডাক্তার-কাকা আর-একজনকে পরামর্শের জন্য প্রায়ই ডাকতেন, তিনি হলেন স্যার নীলরতন সরকার। যাঁরা একবার দুবার স্যার নীলরতনকে দেখেছেন, তাঁরা তাঁকে ভুলবেন না। চেহারায় অপূর্ব দীপ্তি, আচরণে সে কী মাধুর্য। তাঁর স্মিত হাসিটি দেখলেই রোগীর অসুখ অনেকটা সেরে যেত। 

দাদাভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি কলকাতার ইডেন গার্ডেনে, শিলংয়ের লেকে এবং পুরীর সমুদ্রের ধারে। আমার মা বিভাবতীকে দাদাভাই ‘মাজননী’ বলে ডাকতেন। দাদাভাইয়ের ইচ্ছামতো প্রত্যেকবার বেড়াতে বেরোবার আগে মা’র অনুমতি নিয়ে আসতে হত। অনেকবার এমন হয়েছে, দাদাভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, দাদাভাই জিজ্ঞেস করলেন, মাজননীকে বলে এসেছি কিনা। না হলে ফিরে গিয়ে মার অনুমতি নিয়ে আসতে হত। মা অপ্রস্তুত হতেন। বলতেন দাদাভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে যাবে, আমাকে জিজ্ঞেস করবার কী আছে! দাদাভাইয়ের বেড়ানোর ধরন ছিল ছাতা মাথায় সহজ, ধীর মাপা গতি। কতটা বেড়ানো হবে তাও ঠিক করা আছে। বাবা বা রাঙাকাকাবাবুর (সুভাষচন্দ্ৰ ) সঙ্গে বেড়ানো একেবারে ভিন্ন ব্যাপার। বাবার গতি মাঝামাঝি হলেও ঢিলেমি চলবে না—সমান তালে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে হাঁটা তো একটা লড়াই, সে কথা পরে বলব। 

আগেই তো বলেছি, দাদাভাইয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ছিল পুরোপুরি স্নেহের, শাসনের কোনও লেশমাত্র নেই। সেকালে তো বাড়িতে অনেক চাকরবাকর থাকত, তারাও কিন্তু তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল না। 

একবার অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য দাদাভাই মাজননীকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে রয়েছেন। খুব পুরনো দুই ভৃত্য শেখ কালু ও মাগুনি দাদাভাইয়ের খুব সেবা করত, তাছাড়া বামুন-ঠাকুর তো আছেই! বিদায়ের সময় এলে দেখেছি তাদের হাত ধরে দাদাভাইয়ের কৃতজ্ঞতার কান্না। শেখ আমেদ আমাদের পুরনো ড্রাইভার, সে খুবই অস্বস্তি বোধ করত, যখন দাদাভাই তার কাঁধে হাত দিয়ে বন্ধুর মতো সম্ভাষণ করতেন, “আচ্ছা, আমেদ ভাই, কেমন আছ বলো তো!” 

তোমরা যদি সুভাষচন্দ্রের আত্মজীবনী ‘ভারতপথিক’ পড়ো, তাহলে দেখবে যে, তাঁরাও যখন ছোট ছিলেন, বাড়ির চাকরবাকরদের তখন পরিবারভুক্ত মানুষ বলেই গণ্য করা হত। 

১৯৩৩ সালে পুরীতে গিয়েছি মাকে সঙ্গে নিয়ে। সেকালে মেয়েরা একলা ঘোরাফেরা করতেন না, ট্রেনে যাত্রা তো নয়ই। আমি তখন নেহাতই বালক। আমাকে মা সঙ্গে নিলেন বোধহয় নিয়মরক্ষার জন্য। কারণ আমার চেয়ে বয়সে বড় কোনো পুরুষ বাড়িতে ছিলেন না। বাবা জেলে, দাদারা কেউ হাতের কাছে নেই। দাদাভাই তাঁর কথাবার্তায় আমাকে মা’র ছোট্ট অভিভাবকের মর্যাদা দিতে লাগলেন এবং এমন সব আলোচনা করতে লাগলেন যেন আমি বেশ বড় হয়ে গিয়েছি। তিনি জেনেছিলেন আমি সংস্কৃত পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছি। মুখস্থ বিদ্যা আর কী! তিনি ধরে নিলেন যে, আমি অনেক সংস্কৃত শিখে ফেলেছি। বললেন, আমি যেন গীতা পড়তে আরম্ভ করি। 

মাজননী তো মোড়ায় বসে আমাকে খাওয়াতে বসতেন। নানারকম রান্না, বিশেষ করে মাছের ভিন্ন ভিন্ন পদ। আমি তখনও স্বল্পাহারী আর পেটরোগা। তাঁর নিজের ছেলেরা আমাদের বয়সে কত এবং কী কী খেত, মাজননী তার একটা ফর্দ আমাকে রোজই শোনাতেন। আমি লজ্জার খাতিরে যতটা পারতাম খেতাম এবং পরে ভুগতাম। খাওয়া ব্যাপারে, বিশেষ করে মাছ খাওয়ার ব্যাপারে, আমাদের এক আত্মীয় সম্বন্ধে একটা মজার গল্প সেইসময় শুনেছিলাম। সম্পর্কে তিনি আমাদের জ্যাঠামশাই। 

গল্প শুনেছি, প্রকাণ্ড একটা মাছ কিনে এনে তিনি নিজে তদারক করে কাটিয়ে কটা টুকরো হল গুনে আমার এক পিসিমাকে ভাজতে দিতেন। গুনে গুনে মাছ ভাজা খেয়ে এক কুঁজো জল খেয়ে, যাবার সময় বলতেন, “কই, মাছের তেলটা দে!” 

আমি যখন খুবই ছোট, তখন দাদাভাই আমাকে একটা নাম দিয়েছিলেন জংবাহাদুর। আমার মতো এক লাজুক নির্বিরোধী ছেলেকে এরকম দুর্ধর্ষ নাম কেন দিয়ে ফেললেন, আমি জানি না। বোধহয় দার্জিলিং কার্শিয়াং আমাদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে নেপালি নামটি তাঁর মনে ধরেছিল। বহুদিন পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাঞ্জাবে রাজবন্দী থাকার সময় এই নামটি আমি ব্যবহার করেছিলাম, পুলিসের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য। আমি লায়ালপুরের জেল থেকে ১৯৪৫-এ আমার মা’কে নানা খবর দিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিসের চোখ এড়িয়ে একটি গোপন চিঠি পাঠিয়েছিলাম। সেই চিঠিতে নিজেকে আমি জংবাহাদুর বলে উল্লেখ করেছিলাম। পুলিস তো এ-নামটি জানে না।—সুতরাং চিঠিটা ধরা পড়লেও কোনো বিপদ নেই। 

বসুবাড়িতে মাজননীর কর্তৃত্ব ছিল সর্বব্যাপী। মানুষটি ছিলেন ধবধবে ফর্সা, ছোটখাটো—কিন্তু মনের জোর ছিল অপরিসীম। যুদ্ধের সময় আমরা অনেক রকমের যুদ্ধ-জাহাজের নাম শুনতাম। আমি মনে মনে মাজননীকে তুলনা করতাম। একটি জার্মান পকেট ব্যাটলশিপের সঙ্গে। 

সংসারটি ছিল বিরাট। নিজেরই আট ছেলে ছয় মেয়ে। তাছাড়া মাজননীর নিজের ভাইদের মধ্যে চার-পাঁচ জন ছিলেন কমবয়সী। তাঁরা দিদির কাছে কটকে থেকে ভাগ্নেদের সঙ্গে পড়াশুনো করতেন। তার উপর মেয়েদের মধ্যে জন দুয়েক কম বয়সে বিধবা হওয়ায় তাঁদের সংসারের ভারও দাদাভাই ও মাজননীর ওপর পড়েছিল। চাকর-বাকরও অনেক, জন্তু-জানোয়ারের সংখ্যাও বাড়িতে কম নয়। সব মিলে এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী ছিলেন মাজননী। আজকাল তো দেখি, দু-চারজনের সংসার নিয়ে অনেক গৃহকর্ত্রীই হিমসিম খান। মাজননী সবদিক নজর রেখে অতি পরিপাটি করে সংসার চালাতেন। 

কোনো ব্যাপারে ফাঁকি দিয়ে মাজননীর কাছে পার পাওয়ার উপায় ছিল না। কটকের বাড়িতে পড়ার ঘরে ছেলেরা ও নিজের ছোট ভাইয়েরা যখন পড়তে বসতেন, তখনও তিনি পাশের ঘর থেকে নজর রাখতেন। তিনি প্রথম প্রথম ইংরেজি বিশেষ কিছুই জানতেন না। ওঁর এক ভাই তার সুযোগ নিয়ে তিনি পাশের ঘরে এলেই একই পাঠ বারবার জোর গলায় পড়ে তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন যে, পড়াশুনা খুব চলছে। কিন্তু মাজননী ধরে ফেলতেন। পরে ডেকে তাঁকে বললেন যে, ইংরেজি না জানলেওঁ মন দিয়ে শুনে তিনি বুঝেছেন যে, একই পাঠ বারবার পড়ে তিনি তাঁকে ধোঁকা দিচ্ছেন। পরে অবশ্য এক মেমসাহেব রেখে মাজননী খানিকটা ইংরেজি শিখেছিলেন। 

হাতের লেখা ছিল তাঁর মুক্তোর মতো। আমাদের মায়েরা আমাদের হাতের লেখা অভ্যাস করাবার সময় মাজননীর হাতের লেখা দেখে লিখতে বলতেন। সব ব্যাপারে নিখুঁত হবার চেষ্টায় কিন্তু একটা বড়ই অসুবিধার সৃষ্টি করতেন তিনি। সব কাজেই তাঁর সময় একটু বেশি লাগত। স্নান, খাওয়া, নিজের হাতে খাবার তৈরি করা, ট্রেন ধরবার সময়, সব ব্যাপারে তিনি এতই দেরি করতেন যে, বাড়ির সকলেই ছটফট করতেন। কলকাতা যাওয়া হবে। শুনেছি কটক স্টেশনের দিকে পুলের উপর রেলগাড়ির শব্দ পেলে তবেই তিনি ধীরেসুস্থে বাড়ি থেকে যাত্রা করতেন। 

একটা ব্যাপারে মাজননীর বিশেষ দুর্বলতার কথা আমাদের বাড়িতে এখনও অনেকেই বলেন। সেটা হল গায়ের রঙ। অনেকেরই ধারণা, ফর্সা রঙের প্রতি তাঁর একটা অস্বাভাবিক টান ছিল। ছেলেদের বৌ পছন্দ করার ব্যাপারে মাজননীর কথাই ছিল শেষ কথা এবং রঙ ময়লা হলে তাঁর হাতে পাস করা খুবই কঠিন ছিল। তিনি ভাবী কুটুম্বদের বাড়ির সামনে জুড়িগাড়িতে বসে থাকতেন। যাঁদের সঙ্গে কুটুম্বিতা হয়নি, তাঁদের বাড়িতে প্রবেশ করতে তাঁর সংস্কারে বাধত! 

মেয়েকে গাড়ির ভিতরে আনিয়ে তিনি পরীক্ষা নিতেন। তার মধ্যে একটা ছিল ক্রীম পাউডারের প্রলেপ অতি উত্তমরূপে মুছে নিয়ে ভাল করে দেখা যে, মেয়ের গায়ের রঙ আসলে কী রকম! নাতি-নাতনিদের বেলায়ও এই নীতি একটা চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি করত। আমাদের মধ্যে অনেকের মনে হত মাজননী হয়তো গায়ের রঙের জন্য পক্ষপাতিত্ব করেন। কেবল গায়ের রঙ কেন, রান্নার রঙ নিয়েও তিনি টিপ্পনী কাটতেন। ঝোলের রঙ যদি কালো হত, বামুন ঠাকুরকে তিনি বলতেন, “কী, নিজের গায়ের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে রান্না করেছ নাকি?” 

মাজননী ছিলেন অনেক দিক দিয়ে খুবই উদার, আবার অন্য ব্যাপারে সেকালকার নানা সংস্কারের সাক্ষী। তোমরা হয়তো শুনে অবাক হবে যে, তাঁদের সময় স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বেড়াতে বেরনো ছিল একটা অভিনব ব্যাপার। লোকে নানা কথা বলত, বলত এ আবার কেমন সাহেবিয়ানা। মাজননী কিন্তু দাদাভাইয়ের সঙ্গে জুড়ি-গাড়ি চেপে খোলাখুলিভাবে কটকে সন্ধ্যাবেলা নদীর ধারে বেড়াতে যেতেন। অন্য দিকে আবার মুরগি ও ম্লেচ্ছ খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তিনি এমন সব মতামত দিতেন, যা আমাদের কানে বাজত। আমার বাবা ছিলেন বেশ ভোজনবিলাসী, আর মা ছিলেন চিররুগ্‌ণা। সেজন্য আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে দেশী-বিদেশী নানা রকমের রান্না হত। দাদাভাই ও মাজননী উডবার্ন পার্কের বাড়িতে থাকলে আলাদা রান্নাঘরের ব্যবস্থা করতে হত। এলগিন রোডের বাড়িতে তো আমিষ ও নিরামিষ রান্নার আলাদা ব্যবস্থা সব সময়েই দেখেছি। ডাক্তারের পরামর্শে আমার মাকে নিয়মিত মুরগি খেতে দেওয়া হত। মাজননী বলতেন, স্বাস্থ্যের জন্য মুরগি খেতে তাঁর আপত্তি নেই, তিনিও নাকি কখনও কখনও ডাক্তারি মতে অসুখে-বিসুখে মুরগির সুপ খেয়েছেন। কিন্তু মুরগি খাওয়া শেষ হলেই তিনি নাকি কাপড়-চোপড় বদলে ফেলতেন! আমরা বিস্ময়ে ভাবতাম, পেটে তো মুরগি রইলই, কাপড়টা বদলে লাভ কী! 

তাঁর হাতের সব কাজই ছিল নিখুঁত। হাতের লেখার কথা তো আগেই বলেছি। সেলাইয়ের কাজও তাই। যাকে ইংরেজিতে বলে পারফেকশনিস্ট। তাঁর হাতের তৈরি চন্দ্রপুলি খাবার জন্য আমরা লাইন দিতেও প্রস্তুত ছিলাম বলা চলে। কেনাকাটার ব্যাপারে তাঁর চোখে ধুলো দেওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল। এলগিন রোডের বাড়িতে মাজননীর আম কেনা ছিল দেখবার মতো ব্যাপার। সেকালে আমওয়ালারা কিলো হিসাবে নয়, শ’য়ে শ’য়ে বিক্রি করত বাড়িতে এসে। দাদরিতে আমওয়ালারা মাজননীর কাছে তো হার মানতই, একশো আম বিক্রি করেও একটাও নিকৃষ্ট বা পচা বা কাঁচা ফল চালাতে পারত না। 

একটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলে আজকের মতো শেষ করি। ছেলেবেলা থেকে রাঙাকাকাবাবু সুভাষচন্দ্র তো তাঁর মা-বাবার অনেক চিন্তার কারণ হয়েছেন, তাঁর অনেক পাগলামি তাঁদের সহ্য করতে হয়েছে। ১৯২১ সাল। ছেলে তো ঠিক করে বসে আছেন যে, আই সি এস ছেড়ে দেবেন। দেশের কাজে ঝাঁপ দেবেন। বাবা জানকীনাথ বোঝাবার চেষ্টা করছেন, দেশে ফিরে ভেবেচিন্তে ঠিক করলেই তো হয়। মা প্রভাবতী মন্তব্য করলেন, তিনি মহাত্মা গান্ধীর ত্যাগের মন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তোমরা বোধ করি জানো, মহাত্মা গান্ধী তখন সবেমাত্র দেশকে অসহযোগের পথে ডাক দিয়েছেন। 

আমার অন্নপ্রাশন হয়নি, শরীর খারাপ ছিল বলে। মা পরে আমাকে একথা জানিয়ে বলেছিলেন, পুরুত মশাই বিধান দিয়ে দিলেন, ঠিক আছে, অন্নপ্রাশন বিয়ের সময় হবে। পদে-পদে পুরুতমশাইদের বিধান মেনে আমাদের চলতে হত। আর এক সমস্যা হল ইস্কুলে যাবার সময়, তখনও পর্যন্ত একটা ভাল নাম রাখা হয়নি। যেদিন ইস্কুলে ভর্তি হতে যাব, ভোরে বাবা-মা তাঁদের ঘরে ডাকলেন। শীতের সকালে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ভিজে মাঠের দিকে চেয়ে নাম দিয়ে ফেললেন—শিশিরকুমার। নিজের নাম বোধ করি অনেকেরই পছন্দ হয় না। পরে আমারও মনে হয়েছে নামটা অন্যরকম হলেও তো হত। তবে একটা কথা ভেবে আমার খুব ভাল লাগে। সেটা এই যে, আমার নাম রেখেছিলেন আমার বাবা-মা। অন্য কেউ নয়। 

বাড়ির ছেলেমেয়েদের নাম রাখা নিয়ে প্রায়ই সমস্যা দেখা দিত। বাড়িতে লোক তো অনেক, নানা মত। আমার মা এ-বিষয়ে রাঙাকাকাবাবুর পরামর্শ নিতেন। রাঙাকাকাবাবু যে-সব নাম দিতেন, অনেকেরই সেগুলো পছন্দ হত না। তাছাড়া তিনি প্রায়ই একসঙ্গে অনেকগুলি নাম তুলতেন। সমস্যা সমাধানের জন্য ঠাট্টা করে বলতেন, “যতগুলি নাম এসেছে সবগুলোই রেখে দেওয়া যাক; যার নাম সে বড় হয়ে একটা বেছে নেবে। 

সেকালে, বিশেষ করে আমাদের আগের জেনারেশনে, ছেলেমেয়েদের নাম মিলিয়ে রাখার একটা রেওয়াজ ছিল। দাদাভাই মাজননী সেই ধারা অনুসরণ করে তাঁদের আট ছেলের নাম ‘শ’ বা ‘স’ দিয়ে রেখেছিলেন এবং সকলেরই নামের শেষ ‘চন্দ্ৰ’। নামগুলো বলি—সতীশচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, সুরেশচন্দ্র, সুধীরচন্দ্র, সুনীলচন্দ্র, সুভাষচন্দ্র, শৈলেশচন্দ্র ও সন্তোষচন্দ্র। ফলে সকলেই ইংরেজিতে এস্ সি বোস। বুঝতেই পারছ, এত বড় পরিবার, সব ছেলের নাম যদি এক ধরনের হয় গোলমালের সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। ধরো, এস্ সি বোসের নামে চিঠি এল। পাবে কে? একান্নবর্তী পরিবার, শ’য়ে শ’য়ে কাপড়জামা, চাদর, ওয়াড় ইত্যাদি ধোপার বাড়ি যায়, কী করে সামলানো যায়! প্রত্যেকটি কাপড়-জামায় সুন্দর করে সেলাই করে নম্বর দেওয়া থাকত। যেমন, আমরা মেজ ছেলের পরিবার। আমাদের ছিল দু’নম্বর। দু’নম্বর মার্কা কাপড় মেজ ছেলের ঘরে যেত। 

কত নম্বরের বৌ, এ-সমস্যাও কখনও-কখনও দেখা দিত। মাজননীর ভাইদের মধ্যে কেউ কেউ বসু-বাড়িতেই থাকতেন, অন্যরাও প্রায়ই যাওয়া-আসা করতেন। সেকালে বাড়ির বৌয়েরা শ্বশুরকুলের বড়দের সামনে (শ্বশুর, ভাশুর ইত্যাদি) বেরোতেন না, কথাও বলতেন না। সামনে পড়ে গেলে লম্বা ঘোমটা টেনে ঘুরে দাঁড়াতেন। ধরো, এক মামাশ্বশুর কিছু বলবেন। তিনি জানবেন কী করে কত নম্বরের বৌ? বৌকে ইশারায় আঙুল গুনে দেখিয়ে দিতে হত কত নম্বর! 

আমার তখন বছর চারেক বয়স, রাঙাকাকাবাবু, বাবা, মা ও আমরা পাঁচ ভাইবোন (বসুবাড়ির দু’নম্বর ও ছ’নম্বর) সাবেক বাড়ি ৩৮/২ এলগিন রোড থেকে পাশের বাড়ি ৩৮/১ এলগিন রোডে উঠে গেলাম। এর দুটো ফল হল। এক, বাবা-মা সাংসারিক দিক থেকে খানিকটা স্বাধীন হলেন; দুই, রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমাদের একটা বিশেষ সম্পর্কের শুরু হল। 

শুনেছি বাবা মেজ ছেলে হলেও ব্যক্তিত্বের জোরে ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে তাঁর বেশ প্রাধান্য ছিল। ছেলেবেলায় বাবা ও তাঁর বড় ভাই আমাদের জ্যাঠাবাবু সতীশচন্দ্র খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। দুজনেরই সাহিত্যে খুব অনুরাগ ছিল—ইংরেজি সাহিত্যে। অনেক নাম-করা লেখা, নাটক, কবিতা, বক্তৃতা ইত্যাদি তাঁদের কণ্ঠস্থ ছিল। সন্ধ্যায় কটকে নদীর ধারে বেড়াতে গিয়ে তাঁরা আবৃত্তি করতেন, জোর গলায় বক্তৃতা অভ্যাস করতেন। দেখতেন কার গলা কতদূর যায়। দুজনেই পরে ব্যারিস্টার হন। ব্যারিস্টার হিসাবে বাবার নামডাক বেশি হলেও বাবা প্রায়ই আইন বিষয়ে তাঁর দাদার গভীর জ্ঞানের কথা বলতেন। রাঙাকাকাবাবু যে এক অতি অসাধারণ মানুষ, ছেলেবেলা থেকেই বাবা তা কী করে বুঝলেন বলা শক্ত। বিশেষ করে যখন অন্য অনেকেই ভাবতেন যে, সুভাষ ছেলেটি বদ্ধ পাগল। জীবনে ওর কিছুই হবে না। ছেলেবেলায় রাঙাকাকাবাবু যে-সব চিঠি লিখেছিলেন, সেগুলি বাবা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন। আই সি এস থেকে পদত্যাগ করার সময়ও রাঙাকাকাবাবু যে লম্বা-লম্বা চিঠি বাবাকে লিখেছিলেন, সেগুলিও রয়েছে। 

বসু-বাড়িতে বাবাই প্রথম বিলেত যান। এ হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগের কথা। বিলেতের জীবনযাত্রা তো অন্যরকম—পোশাক-আশাক; খাওয়া-দাওয়া, সাংস্কৃতিক জীবন ইত্যাদি। বাবা খুব খোলা মনে বিলেতের যা-কিছু ভাল এবং গ্রহণযোগ্য তার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। ভাল সাহেবি পোশাক ও ভাল বিলিতি খাবার তিনি ভালবাসতেন। আসল কথা হল সব কিছু উঁচু মানের হওয়া চাই—সেটা দেশী হোক বা বিদেশীই হোক। শরৎ বোস সাহেবের উৎকৃষ্ট চুরুট খাওয়ার কথা তো অনেকেই জানেন। কিন্তু তিনি জীবনে কোনদিন কোনো মাদক পানীয় বা নিষিদ্ধ মাংস স্পর্শ করেননি। 

এ-ব্যাপারে এক মজার গল্প প্রায়ই বাবা বলতেন। ব্যারিস্টারি পড়বার সময় নিয়মমাফিক বেশ কয়েকটি আনুষ্ঠানিক ডিনার খেতে হত। বাবা যে টেবিলে বসবেন, সেই টেবিলে জায়গা পাবার জন্য যাঁরা মাদক পানীয়তে আসক্ত তাঁদের মধ্যে এক ভাগ বেশি পাবার আশায় কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। 

এদিকে বিলেত যাবার অনেক আগে থেকেই বাবা দেশের মুক্তি-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি সঙ্গীদের নিয়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রাস্তায় রাস্তায় দেশাত্মবোধক গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। আঠারো বছর বয়স থেকেই তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সভ্য ছিলেন। বিলেতে থাকার সময় এক বন্ধুর সঙ্গে বাবা প্যারিসে বেড়াতে যান। প্যারিসে তখন আয়াল্যাণ্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মহীয়সী বিপ্লবী নেত্রী মাদাম্ গন্ ম্যাকব্রাইড নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর মাদাম্ গন তাঁর বন্ধুকে বলেছিলেন, দেখে নিও, এই যুবকটি একদিন ভারতের শ্রেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে একজন হবে। 

আমাদের বংশে বাবাই প্রথম বিলেত যান। বিলেত যাওয়া মানে তো কালাপানি পার হওয়া। সুতরাং শাস্ত্রে অশুদ্ধ! দেশে ফেরার পর সামাজিক সংস্কার রক্ষা করতে বাবাকে বেশ ঘটা করে আনুষ্ঠানিক প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল। 

আমি জন্মাবার আগেই বাবা পেশাগত ভাবে অনেক উপরে উঠে গেছেন। আইন-ব্যবসায় কৃতী হতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, বাবাকেও সারাদিন কোর্ট করার পরও রোজ অনেক রাত পর্যন্ত খাটতে হত। ভোর থেকেই আবার কাজ শুরু। সুতরাং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা হত কম। মা’র কাছে শুনেছি বহুদিন ধরে বাবা ছেলেমেয়েদের রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে আসতেন। বাবার সঙ্গ আমরা ভাল করে পেতাম কোর্টের ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে। সেখানে কিন্তু খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো সবই সকলকে নিয়ে। গল্পগুজব, হাসি-ঠাট্টা পুরোদমে চলত। বেশ কিছুদিন আমি বাড়ির ছোট ছেলে ছিলাম। সেজন্য আমার প্রতি বাবার খানিকটা পক্ষপাতিত্ব জন্মে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। আমার পরের বোন গীতার ক্ষেত্রেও বোধহয় একই কথা বলা যায়। 

১৯২৪ সালের শেষের দিকে রাঙাকাকাবাবু গ্রেফতার হন। আমরা তখন বাবা-মা’র সঙ্গে কাশ্মীর থেকে ফিরছি। কিছুদিন পরেই ইংরেজ সরকার রাঙাকাকাবাবুকে বর্মায় পাঠিয়ে দেয়। বর্মায় নির্বাসিত হবার আগে রাঙাকাকাবাবুর কথা আমার বিশেষ মনে নেই; কারণ তখন আমি নেহাতই ছোট। কিন্তু ১৯২৪ সালে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে বাড়ি-বদলের সময় থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত বাবা-মা ও আমাদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্কে কোনোদিন কোনো ছেদ পড়েনি। তিনি জেলেই থাকুন বা দূর বিদেশেই থাকুন, রাঙাকাকাবাবু কোনো-না-কোনোভাবে যেন সব সময়েই আমাদের মধ্যে উপস্থিত। অবশ্য এর মূলে ছিল আমার বাবা-মা’র সঙ্গে তাঁর এক আশ্চর্য ও বিশেষ সম্পর্ক। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *