প্রেমিক – অভীক দত্ত
প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর, ২০২১
প্রতিটি চরিত্র, স্থান, কাল, পাত্র, নামোল্লেখ-
কাল্পনিক
…
Imagine there’s no countries
It isn’t hard to do
Nothing to kill or die for
And no religion, too
Imagine all the people
Livin’ life in peace
…”
প্রেমিক
১
বাড়ির সামনে ছেলেটা ঘুরছে।
রাত্রির ভাল লাগে না ছেলেটাকে। আজকাল ছেলেটার যাওয়া আসার ফ্রিকোয়েন্সি অনেক বেড়ে গেছে।
তার দোকান যাবার পথে ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক কিছু বলার চেষ্টা থাকে।
রাত্রি বিরক্ত হয়। যদি তাকেই বলার থাকে, বললেই পারে। এভাবে চোখেই সব কথা বলে দেয় কেন?
একদিন সে দাঁড়িয়ে গেল।
ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “নাম কী তোমার?”
ছেলেটা ঘাবড়ে গেল। তার দিকে না তাকিয়ে মাটির দিকে তাকাল, “নাসিম”।
রাত্রি বলল, “মুসলিম?”
ছেলেটা মাথা নাড়ল।
রাত্রি বলল, “তুমি এ পাড়ায় কেন যাতায়াত কর?”
নাসিম বলল, “ভাল লাগে”।
রাত্রি বলল, “কাকে? হিন্দু মেয়েদের?”
নাসিম মাথা নাড়ল, “ওভাবে দেখি নি কাউকে”।
রাত্রি বলল, “পাড়ার ছেলেরা ঠ্যাঙ খোঁড়া করে দেবে মনে রেখো। এ পাড়ায় অনেকেই এখন তোমাদের বিরুদ্ধে কথা বলে”।
নাসিম সিঁটিয়ে গেল। ওর যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না।
#
প্রেমের সমস্যা হল, কেউ বার বার এলে বিরক্ত লাগে। আবার না এলেও একই সমস্যা হয়। সেদিনের পর নাসিম সত্যি সত্যিই আসা বন্ধ করে দিল।
রাত্রির বাবা প্রণয় ইদানীং হোয়াটস অ্যাপ করছেন। সেদিন হঠাৎ করেই বললেন, “আজকাল একটা জিনিস চালু হয়েছে। লাভ জিহাদ। মুসলিম ছেলেরা হিন্দু মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জানিস তো এদেশের মত না। এখানে যেমন সবাই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়, ওখানে ঠিক এর উলটো। হিন্দু মেয়েদের টার্গেট করে এরা। এখানেও শুরু করেছে। একবারে কোন মুসলিম ছেলের পাল্লায় পড়বি না”।
রাত্রি রেগে যায়, “আমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই?”
বলে উঠে চলে যায়। বাবার উপর ভীষণ রাগ হয়।
ক’দিন পর নাসিমকে আবার দেখতে পায়। নাসিম একটা নতুন বাইক কিনেছে।
রাত্রি দোতলার ব্যালকনিতে ছিল। নাসিমকে দেখামাত্র ঘরে চলে এল। ঘুম ইচ্ছে করছিল গিয়ে জিজ্ঞেস করে, এতদিন কোথায় ছিল। প্রেম ট্রেম না, নিছক কৌতূহলবশতই হয়ত। নাকি অন্যকিছুও হতে পারে?
রাত্রি বুঝতে পারে না।
কলেজ বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। এলাকাতেও বিধিনিষেধ চলছে।
ছেলেটা মাস্ক পরে। কেউ দেখে বুঝবে না ও মুসলিম।
রাত্রি প্রবল দোটানায় থাকে। সে একদিকে শিখেছে হিন্দু মুসলমান এক দেশের দুটো হৃদপিণ্ড। এটাও বাবাই বলেছিল এক কালে।
এখন অন্য প্রসঙ্গ উঠে আসছে।
কোনটা যে ঠিক আর কোনটা ভুল, রাত্রি বুঝতে পারে না।
অনলাইন ক্লাস করার সময় বাইকের শব্দ পেলে পর্দা সরিয়ে উৎসুক চোখে দেখতে ইচ্ছা হয়।
কেমন একটা নেশা তৈরী হচ্ছে।
লকডাউনের আগে সেভাবে কাউকে ভালবাসে নি সে। ফেসবুক দেখে বন্ধুদের থেকে “ক্রাশ” ইত্যাদি শুনেছে। তার বন্ধুদের অনেকে প্রেম করে।
তার করা হয় নি। বা হয়ে ওঠে নি।
তার জন্য একটা ছেলে আসছে, ব্যাপারটা তাকে ভাবাতে শুরু করল। ভাবতে ভাবতে গুগল সার্চ করে ফেলল বেশ কয়েকবার। “মুসলিম রিচুয়ালস”, “লাভ জিহাদ”, “মুসলিম ম্যারেজ”।
বিভিন্ন রকম মুসলিম সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে শুরু করল।
বিধি নিষেধ অনেকটাই হালকা হতে শুরু করেছে। মা একদিন বলল পাড়ার দোকান থেকে ডিম আনতে। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে দেখল নাসিম দাঁড়িয়ে আছে। সে নাসিমের কাছে গিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ দেখছে নাকি। তারপর বলল, “তুমি নামাজ পড়?”
নাসিম বলল, “পড়ি তো”।
রাত্রি বলল, “রোজা কর?”
নাসিম মাথা নাড়ল।
রাত্রি বলল, “যে জিনিসটা হওয়া সম্ভব না, সেটা কেন হওয়াতে চাইছো? আমাদের মত বাড়ির মেয়েরা তোমাদের পছন্দ করে না। ইনফ্যাক্ট আমার বাবা মুসলিমদের ঘেন্না করে। আমরা বাঙাল। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি বাংলাদেশে আমাদের কোন কাকীমাকে মুসলিমরা তুলে নিয়ে গেছিল। তুমি আর এসো না। নিজের ধর্মে বিয়ে কর”।
নাসিমের মুখটা ছোট হয়ে গেল।
রাত্রি বলল, “এসো না। বোঝার চেষ্টা কর। এটা হয় না”।
নাসিম কিছুক্ষণ শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
২
“ওরা বোরখা পরতে বাধ্য করবে। হিজাব পরাবে। ওদের নারী স্বাধীনতা বলে কিছু নেই”।
বাবা আবার কোত্থেকে একটা হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ পেয়েছে। পড়ে যাচ্ছে। মা বাবাকে বলল, “তোমার কী হয়েছে বল তো? সারাদিন ধরে এসব করে যাচ্ছো? আগে তো এরকম ছিলে না। কমিউনিস্ট পার্টি করতে, হিন্দু মুসলমান নিয়ে কোন দিন কথা বলতে দেখি নি তোমায়”।
প্রণয় গম্ভীর গলায় বললেন, “ভুল করেছি। ভুল দল করেছি, ভুল আদর্শ নিয়ে চলেছি। ঠিক করি নি। ধর্মটাকে নেগলেক্ট করে গেছি চিরকাল। এটা অপরাধ। কোন দিন দেখেছো কোন মুসলিম ছেলে ধর্ম বিসর্জন দিয়ে পার্টি করেছে? দেখবে না। এরা ঠিক তলে তলে সব ঠিক রেখে দেয়। মক্কাও যায়। আর হিন্দুরা পার্টি করে ধর্ম পালন করলেই দোষ”।
রাত্রির মা বিরক্ত হয়ে বলেন, “তাহলে আমাকে বিয়ে করাও তোমার ঠিক হয় নি। আমার বাপের বাড়ি সবাই লাল। তারা ভেবেছিল তুমি কমিউনিস্ট। এখন এসব ভিমরতি হয়েছে তোমার। এখন নতুন বউ দেখে নাও তুমি”।
প্রণয় চুপ করে যান। হোয়াটস অ্যাপের মেসেজ বাকি বন্ধুদের ফরোয়ার্ড করতে শুরু করেন।
ঘৃণা যখন আসে তখন একা আসে না। বরাবর তার সঙ্গী হিংসা। আচমকা বাবার মধ্যে এই পরিবর্তন রাত্রিকে আঘাত করল। মা মাঝে মাঝে মন খারাপ করে বসে থাকে। তাকে বলে “কোনমতে তোর বাবার ফোনটা লুকিয়ে ফেল। ওটা যত নষ্টের মূল”।
রাত্রি একদিন বাবার ফোন হাতে নিয়ে দেখল। কীসব গ্রুপে জয়েন করেছে বাবা। হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে সহ কত কত গ্রুপ। মাকে এসব নিয়ে কিছু বলল না। তবে এই সব কিছু তার মধ্যে একটা অদ্ভুত বিকর্ষণ তৈরী করল এ সমস্ত রকম ধর্ম কালচারের প্রতি।
নাসিরকে পাড়ায় দেখামাত্র সে বাড়ি থেকে বেরোল। অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করার পরে ছেলেটা এসেছে। খানিকটা ঘোরের মাথায় নাসিরের কাছে দাঁড়িয়ে সে বলল, “তুমি আবার এসেছো?”
নাসির বলল, “আমি এ পাড়ায় ওষুধ নিতে এসেছি। রেড ভলান্টিয়ারের কাজ করছি। কোথাও কিছু পাওয়া যায় নি। এখানে এলাম”।
রাত্রি বিদ্রুপের গলায় বলল, “ওহ তুমি রেড ভলান্টিয়ার, মানে কমিউনিস্ট তাই তো? এদিকে নামাজ পড়। তাহলে তুমি সিউডো কমিউনিস্ট”।
নাসির অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হঠাৎ এই কথা? আমি অত ভেবে তো কিছু করি নি কোন কালে। নামাজ ছোটবেলা থেকে পড়ি, রোজাটাও অভ্যাস হয়ে গেছে। এই নিয়ে কোন দিন আলাদা করে চর্চাও করি নি”।
রাত্রি বলল, “তুমি বাঙালি?”
নাসির বলল, “কেন নয়? বাঙালি হবার জন্য ঠিক কী কী প্রমাণ দিতে হয়?”
রাত্রি বলল, “একটা কবিতা বল দেখি রবীন্দ্রনাথের”।
নাসির বলল, “আমাদের ছোটনদী বলব?”
রাত্রি বলল, “এটা তো ছোটবেলার কবিতা”।
নাসির বলল, “তুমি পারবে এই ছোটবেলার কবিতাটা পুরোটা ঠিক ঠাক বলতে?”
রাত্রি বলল, “ইন্ডিয়া পাকিস্তান ম্যাচে তুমি কাদের সাপোর্ট কর?”
নাসির হেসে ফেলল। বলল, “এই যে মানুষ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছিল, আমি সিলিন্ডার কাঁধে নিয়ে একেক জনের বাড়িতে গেছি, কেউ কেউ বিদ্রুপ করে আমাদের এন জি ও বলেছে, এগুলো তো এই দেশেই হয়েছে বল? পাকিস্তানীদের জন্য তো অক্সিজেন নিয়ে যাই নি। তাহলে ইন্ডিয়া পাকিস্তান ম্যাচে কেন পাকিস্তানকে সাপোর্ট করব?”
রাত্রি রেগে গেল, “যদি বলি এগুলোই তোমাদের ট্র্যাপ? এভাবেই তোমরা এ দেশের ছেলেদের মধ্যে মিশে যাচ্ছো, আদতে তোমরা পাকিস্তানকেই সাপোর্ট কর?”
নাসির বলল, “তোমার প্রশ্নবিচিত্রাটা বেশ ভালই হয়েছে, তবে কী জানো তো, আমি এত সব কিছু কোন কালে ভাবি নি। ভাবানো হচ্ছে। যাই হোক, তুমি যা ভেবেছো ঠিকই ভেবেছো, কোন ভুল নেই তাতে। আমিও ভেবে দেখেছি এভাবে অন্য ধর্মের মধ্যে ভালোবাসা উচিত না। বাইক নিয়ে যাতায়াত করতাম খানিকটা ঝোঁকের বশেই। এখন বরং ক্ষমা চেয়ে নি তোমার কাছে। আমি আর আসব না। কেমন?”
রাত্রি ঠোঁট কামড়াল। বাবা তাকে দেখছে দূর থেকে।
৩
“ছেলেটা কে?”
রাত্রি বাড়ি ফিরতেই বাবার প্রশ্নের মুখে পড়ল। প্রশ্নটা প্রত্যাশিত ছিল।
রাত্রি বলল, “কলেজের বন্ধু”।
প্রণয় বললেন, “কলেজের বন্ধুর সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার কী আছে? বাড়িতে আসতে বললি না কেন?”
রাত্রি বলল, “দেখা হয়ে গেল বলে কথা বললাম। ও কোথাও একটা যাচ্ছিল। তাছাড়া এই সময় বাড়িতে কীভাবে আসতে বলি? যত কম লোক বাড়িতে আসে ততো ভাল”।
প্রণয় বললেন, “হু। বন্ধুই তো?”
রাত্রি বলল, “হ্যাঁ”।
প্রণয় বললেন, “কী নাম”?
রাত্রি একটু থমকে বলল, “নাসিম”।
প্রণয় বললেন, “মুসলমান বন্ধু আছে তোর?”
রাত্রি বলল, “থাকতেই পারে। কী সমস্যা?”
প্রণয় বললেন, “থাকতে পারে মানে? অ্যাভয়েড করা যায় না? এরপর তো দুদিন পরে গরু খেয়ে এসে বলবি খেতেই পারি। নিজের ধর্মকে অপমান করাটাই তো তোদের ফ্যাশন হয়ে গেছে”।
রাত্রি মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে বাবার সামনে বসে বলল, “ধর্ম জিনিসটা কি মাংসে আটকে থাকে বাবা? গরু খেলেই ধর্ম চলে যায়?”
প্রণয় সোজা হয়ে বসলেন, “বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানে যেত। যে সব হিন্দুরা এদেশে ঢুকতে পারে নি, তাদের ওরা অনেকেই ছলে বলে কৌশলে মুসলমান বানিয়ে দিত”।
রাত্রি বলল, “ধরে নিলাম মুসলমান বানিয়ে দিল। তাতে কী হল? সেই তো মানুষই হল, নাকি?”
প্রণয় বললেন, “মানুষ হল? মুসলমান হওয়া মানে মানুষ হওয়া বোঝায়? তুই কোরাণ পড়িসনি? জানিস না, ওরা মেয়েদের কী হিসেবে দেখে? বাদ দে, তোকে এগুলো বোঝানোই বৃথা”।
রাত্রি বলল, “আমার বোঝার দরকার নেই। দু হাজার একুশে এসে কে কী খাবে, কে কোন ধর্মে থাকবে সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। উলটে আমার মনে হয়েছে মুসলমান ধর্মের মধ্যেও অনেক মানুষ আছে যারা যথেষ্ট শিক্ষিত এবং তোমার সঙ্গে তাদের কোন পার্থক্য নেই”।
প্রণয় বললেন, “ঠিক আছে। বুঝতে পারছি। ওদের ডিফেন্ড করার চেষ্টা করছিস। প্যারিসে কার্টুন আঁকার জন্য যেভাবে কার্টুনিস্টদের খুন করা হচ্ছে সেটাকেও সাপোর্ট করছিস নিশ্চয়ই? তুই জানিস না আসলে মুসলমান মানে কী ভয়ংকর একটা এন্টিটি। পারলে কোন দিন প্যালেস্তাইন আর ইজরায়েলের কনফ্লিক্ট নিয়ে পড়াশুনা করিস। যেটা ইহুদীরা করেছিল, সেটা হিন্দুরা পারে নি। শুধু এ কারণে ইজরায়েল দেখবি কোথায় চলে যাবে আর আমাদের আবার একদিন মুসলমানরা দখল করে নেবে। বাই দ্য ওয়ে, এবার সত্যি করে বল তো, ওই ছেলেটা সত্যিই তোর বন্ধু, নাকি বেশি কিছু?”
রাত্রি রেগে গিয়ে বলল, “তোমাকে বোঝানো বৃথা। তুমি একবারে এক্সট্রিমিস্ট হয়ে যাচ্ছো”।
সে ঘরে যেতে যেতে শুনল প্রণয় বলছেন, “নিজের ঘর বাঁচানোর দায়ে এক্সট্রিমিস্ট হওয়াটাই প্রয়োজন। কোন বাংলাদেশী হিন্দু সংখ্যালঘু পরিবারের কাহিনী শুনলে বুঝতে পারবি। কে বোঝাবে আর, কত ভাল ভাল মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যায়”।
রাত্রি ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। অসহ্য লাগছে। বাবা হঠাৎ করে পাল্টে গেছে। কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে তার জানা নেই। সম্ভবত এই সব হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ থেকে মাথায় রোজ নতুন নতুন বিদ্বেষ ঢুকছে।
নাসিমের কথা বাবার মাথায় ঢুকেছে মানে এটা নিয়েও চিন্তা করবে। তার কাছে নাসিমের ফোন নাম্বার নেই। থাকলে সাবধান করে দিত। যে ছেলের সঙ্গে কোন দিন সম্পর্কই হল না কোন, তাকে নিয়েও বাবা চিন্তা করতে শুরু করবে। পাড়ায় বেশ কয়েকজন আছেও বাবার মানসিকতার। হঠাৎ করে তারা দেশপ্রেমিক হয়ে গেল। উইচ হান্টিং এর মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে “দেশদ্রোহী”দের কান ধরে উঠবোস করিয়েছিল তারা। স্বাধীনদেশে মানুষের স্বাধীন মতামত রাখার অধিকার হারিয়ে যাওয়ার জোগাড়।
রাত্রির অস্থির লাগছিল। একে বাড়িতে বসে বসে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কলেজ যাওয়ার নাম নেই, ক্লাস যা হচ্ছে অনলাইনে, তার উপরে নাসিমের মুখটা যেন তার পিছু ছাড়ছে না। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে মুসলমান হয়েছে তো কী হয়েছে, আবার পরে মনে হচ্ছে কালচারাল ডিফারেন্স হলে সে আদৌ নিতে পারবে তো?
সব ভুলে রাত্রি গান চালিয়ে দিল জোরে জোরে।
বাবা খিটখিট করুক। ওটাই ভাল হবে।
৪
ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় রাত্রির একটা ছেলেকে ভাললাগত। তাদেরই ক্লাসের। অরিত্রি শুনে বলেছিল, “ধুস, সেম এজে বিয়ে করিস না। অন্তত চার পাঁচ বছর বড় হলে ভাল”।
রাত্রি হেসে ফেলেছিল, “বিয়ে করছি কোথায়? মনে হল ঠিক ঠাক”।
অরিত্রি অনেক জ্ঞান দিয়েছিল। বয়সের ডিফারেন্স থাকা উচিত, মেয়েদের অনেক বুঝে শুনে এসব করা উচিত। সেম এজের ছেলেদের এসট্যাব্লিশড হতে সময় লাগে।
রাত্রি বলেছিল ছেলেদেরই কেন এস্টাব্লিশড হতে হবে? সেটা শুনে অরিত্রি বলেছিল তোর মধ্যে বিপ্লবী ভাব প্রবল। বিপ্লবী হওয়া ভাল, তবে নিজের লাইফে অ্যাপ্লাই করার ক্ষেত্রেই সমস্যাটা বোঝা যায়।
এই কথাটা রাত্রির মনে ছিল। তার খারাপ লাগছিল। তার বরাবরই একটু বেশি দূর বাড়িয়ে ভেবে নেওয়া কাজ। এর আগেও সে ভেবেছে। নাসিম ঝাড়ি মারতে এসেছিল। সে বিয়ে অবধি ভেবে নিয়েছে। ক্লাসের ছেলেটার ক্ষেত্রে যদিও এতটা ভাবে নি। অরিত্রি ভাবিয়েছিল।
নাসিমের সম্পর্কে রাত্রির আরো জানতে ইচ্ছে করছিল। রেড হোক, গ্রীন বা যে ভলান্টিয়ারও হোক, ঠিক কোন অনুপ্রেরণা থেকে এরা এটা করছে? তাদের পাশের বাড়ির জ্যেঠুর করোনার সময় এই ভলান্টিয়াররা এসে প্রায় সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ভোট অবশ্যই সব না। ভোটের থেকেও বড় কোন তাগিদ থেকে এরা এই কাজটা করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। দিন নেই, রাত নেই ছুটে যাচ্ছে।
নাসিম রেড ভলান্টিয়ার মানে অবশ্যই কমিউনিস্ট। বলল ধর্ম নিয়ে অতটা ভাবে নি কোন কালেই। রাত্রির মনে হল কেন ভাববে না? কমিউনিস্ট মানে অবশ্যই বিজ্ঞানকে আগে জায়গা দিতে হবে। বার বার সব কিছুতে প্রশ্ন তুলতে হবে। প্রশ্ন তোলাটা জরুরি। সব কিছু মাথা নিচু করে মেনে নেওয়া কমিউনিজম হতে পারে না। রাজনীতির পচা, গলা, ধান্দাবাজি জায়গাগুলোতে এই ভলান্টিয়াররা সামান্য হলেও ঝড় তুলেছে।
সে ছটফট করছিল। মুসলমানদের মধ্যে রামমোহন ছিলেন না, বিদ্যাসাগরও না, এক দেশে পাশা পাশি থেকেও যেন অন্য গোলার্ধে থাকে তারা। জানতে ইচ্ছে করছিল তার ভীষণভাবে। ইচ্ছে করছিল নাসিমের বাড়ি চলে যায়। ওদের সবার সঙ্গে আলাপ করে। নিজের কাকা, জ্যাঠা, মামার মেয়েদের সঙ্গেও নাকি ওদের বিয়ে হয়। ওরা খাটে বসে খায়। ওরা গরু খায়। ওরা ভারতে থেকেও নাকি পাকিস্তানীদের সমর্থন করে।
রাত্রির মাথায় জট লেগে যাচ্ছিল। সে এরকমই। কোন জিনিস মাথায় ঢুকলে সহজে বেরোতে চায় না।
একটা খাতায় সব ক’টা প্রশ্নের পয়েন্ট এক এক করে লিখছিল সে। ঠিক কোন কোন জায়গায় তারা আলাদা। ফেসবুকের গ্রুপে দেখেছে গরু শুয়োর নিয়ে কীভাবে বাগবিতণ্ডা লেগে যায়।
ধার্মিক নাস্তিক বলে তো কিছু হয় না। নাসিম কি নিজেকে সেরকম কিছু প্রতিপন্ন করতে চাইছে?
ভাবনা ধাক্কা খেল দরজায় ধাক্কার শব্দে। রাত্রি দরজা খুলে দেখল মা দাঁড়িয়ে আছে চিন্তাগ্রস্থ মুখে। তাকে বলল, “তুই নাকি কোন মুসলিম ছেলের সঙ্গে জড়িয়েছিস? তোর বাবার তো প্রেশার সুগার সব বেড়ে যাবে এবার!”
রাত্রি আবার মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল, “আমার বন্ধু। কলেজের। বাবাকে এটুকুই বলেছি। এতে কীভাবে প্রমাণ হল আমি জড়িয়েছি?”
মা বলল, “ঠিক আছে। বাবাকে সেটাই বুঝিয়ে বল। কোথায় বেরিয়ে গেল এই করোনার সময়ে কে জানে”!
রাত্রি বলল, “কী বুঝিয়ে বলব? দিন দিন হিন্দু তালিবান হয়ে যাচ্ছে। আমারই ভুল ছিল এসব স্মার্ট ফোন ইউজ করা শেখানো। এমন সব কথা বলে যাচ্ছে যেগুলো শুনলেই কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে”।
মা বলল, “তোরই বা গায়ে লাগছে কেন? সত্যিই কি কোন ফিলিংস আছে ছেলেটার জন্য?”
রাত্রি বলল, “ধরে নাও আছে। তাতে কী হবে? কী কী সমস্যা হয় তাতে?”
মা মাথায় হাত দিয়ে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “তোর বাবার হার্টফেল হয়। সেটাই কি সব থেকে বড় ব্যাপার হতে পারে না?”
রাত্রি বলল, “তাহলে বাবা মৌলবাদী হয়ে যাবে আর আমাকে সেটা দেখতে হবে বলছো?”
মা বলল, “আমি জানি না। তুই যা পারিস কর। আমার অশান্তি ভাল লাগে না একদম”।
রাত্রি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
৫
প্রণয় রাত করে বাড়ি ফিরলেন।
ঘরে ঢুকে রাত্রির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোর ফোনটা আমি কিনে দিয়েছি। আমার কেনা ফোন দিয়ে আমি এসব করা বরদাস্ত করব না”।
রাত্রি শুয়েছিল। সোজা হয়ে বসে বলল, “কী বরদাস্ত করবে না তুমি?”
প্রণয় বললেন, “এই মুসলমানের সঙ্গে কোন রকম সম্পর্কে থাকলে আমি কিছুতেই মেনে নেব না”।
রাত্রি বলল, “তোমার কী হয়েছে বাবা? এরকম পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছো কেন তুমি? এই সময়ে দাঁড়িয়ে কী করে হিন্দু মুসলমান মাথায় আসছে তোমার?”
প্রণয় কয়েক সেকেন্ড গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি তোর বিয়ে দিয়ে দেব। চল্লিশ পঞ্চাশ জন নিমন্ত্রিত থাকবে। এর মধ্যেই বিয়ে হোক। দরকার নেই এসব মেয়ে বাড়িতে রাখার। বিয়ে আমার ইচ্ছায় হবে। মানলে এই বাড়িতে থাকবি, না মানলে বেরিয়ে যা, যেখানে ইচ্ছে যে কোন মোল্লার বাড়ি গিয়ে থাক, আমি কিছু বলব না। তুই যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিস, কিন্তু কোন মোল্লার সঙ্গে বিয়ে করলে আমি তোকে নিজের মেয়ে বলেই কোন দিন স্বীকৃতি দেবো না, এটা জেনে রাখ”।
রাত্রি বলল, “কার সঙ্গে বিয়ে দেবে?”
প্রণয় বললেন, “দেখছি। কাল সকালের মধ্যে জেনে যাবি”।
রাত্রি বলল, “বিয়ের পর যদি কোন মুসলমানের সঙ্গে এক্সট্রা ম্যারিটাল করি?”
প্রণয় বললেন “ওই বাড়ি থেকে তো তোকে বের করে দেবে। আমিও আর ঢুকতে দেবো না। কিছুতেই ঢুকতে দেব না। মোল্লাদের কাজ কী? হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে শুয়ে তাদের শরীরে মুসলমান বানানো। এটাই ওদের কাজ”।
রাত্রির কান মাথা ব্যথা করছিল। এই বাবাকে সে চেনে না। ইনি একজন মৌলবাদীতে পরিণত হয়েছেন। যে মৌলবাদী প্যারিসে নাস্তিক কার্টুনিস্টদের খুন করে, তার সঙ্গে তার বাবার বিন্দুমাত্র কোন তফাৎ নেই শুধু ধর্মটা ছাড়া। একটা ধর্ম বিদ্বেষের জন্য মানুষ তার নিজের মেয়েকে পর্যন্ত এত বড় কথা বলে ফেলছে! সে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে বলল, “ঠিক আছে। আমি তাহলে বাড়ি ছাড়ছি। তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। আর কোন দিন বাড়িতে ফিরবো না তো? বেশ, তাই হবে”।
প্রণয় চিৎকার শুরু করলেন। রাত্রির মা ছুটে এল। রাত্রি দরজা বন্ধ করে চেঞ্জ করে নিল। কয়েক মিনিট পরে ঘর থেকে বেরোল। মা তাকে আটকাতে গেলেন। রাত্রি মাকে জোর করে ছাড়িয়ে দিল। প্রণয় চিৎকার করলেন, “হবেই তো, মোল্লাদের সঙ্গে মিশে ও মেয়ে এখন মোল্লা হয়ে গেছে। বেরিয়ে যাক। দরকার নেই এই কুলাঙ্গার মেয়ে আমার”।
রাত্রি বাড়ি থেকে বেরোল। তার সঙ্গে সঙ্গে তার মা বেরোতে যাচ্ছিলেন। প্রণয় আটকালেন। দরজা বন্ধ করে দিলেন।
রাত্রি সোজা তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্থানীয় পার্টি অফিসে গিয়ে ঢুকল। চার পাঁচজন বয়স্ক মানুষ মিটিং করছেন।
রাত্রির মাথা কাজ করছিল না। সে কোন মতে বলল, “আপনাদের একজন রেড ভলান্টিয়ার আছে। নাসিম নাম। তার ফোন নাম্বার দিতে পারবেন?”
বাকিরা খানিকটা অবাক হলেন। রাত্রি বলল, “ভীষণ দরকার। একটা ব্যক্তিগত সমস্যায় পড়েছি। দেওয়া যাবে?”
কিছুক্ষণের মধ্যে পার্টি অফিস থেকে একজন নাসিমকে ফোন করে রাত্রিকে তার ফোনটা দিলেন। রাত্রি ফোন ধরে বলল, “আমি এই অঞ্চলের পার্টি অফিসে আছি। তুমি আসতে পারবে?”
নাসিম একটুও না ভেবে বলল, “আসছি”।
ফোন রেখে রাত্রি পার্টি অফিসের বাইরে গেল। প্রবল কান্না আসছিল। সামান্য একটা সন্দেহ থেকে কত বড় কিছু হয়ে গেল বাড়িতে? একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বললেন, “নাসিম গ্রামের ছেলে। কোন সমস্যা হলে আমাদের বলতে পারো”।
রাত্রি মাথা নাড়ল, “না না। ব্যক্তিগত ব্যাপার কাকু। সেরকম কিছু না”।
ভদ্রলোক আর কথা না বাড়িয়ে পার্টি অফিসে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে নাসিম এল। তাকে দেখে অবাক চোখে বলল, “কী হয়েছে?”
রাত্রি বলল, “কোন প্রশ্ন না করে আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে”?
নাসিম অবাক হয়ে রাত্রির দিকে তাকিয়ে রইল।
৬
অনেকদিন পর রাকিব রবীন্দ্রনাথ পড়ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পড়ার জন্য একটা আলাদা পরিবেশ তৈরী করেন রাকিব। বাড়িতে সবাইকে বলে দেওয়া হয়, কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করেন। এই দিন তিনি তার লাইব্রেরী থেকে সন্ধ্যের পর থেকে আর বেরোন না। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রাকিবকে মুগ্ধ করে ঠিকই, তবে তিনি মনে করেন কবিতাগুলো আরো বেশি মনোযোগ দাবী করে।
একটা পদ্য থেকে, একটা শব্দও এদিক ওদিক করা সম্ভব না। রবীন্দ্রনাথ তাকে মুগ্ধ করে। বেঁচে থাকতে শেখায়।
রাত হয়েছিল। রাকিব গীতাঞ্জলী পড়তে শুরু করেছিলেন, হঠাৎ লাইব্রেরীর দরজায় কেউ নক করল।
রাকিব বিরক্ত হলেন। এটা তো হবার কথা নয়। বাড়িতে সবাইকে বলা থাকে এই সময় কেউ যেন বিরক্ত না করে। তবু এইভাবে নক করছে!
উঠে বইটা টেবিলের উপর রাখলেন। রাকিব তার প্রতিটা বইয়ের প্রতিটা পাতা যত্ন করে রাখেন। কেউ বই ধার নিলে বিরক্ত হন। দিতে চান না। ভদ্রতাবশত দিতে হলে সে বই ফিরে এলে যদি দেখেন পাতা মুড়ে রেখেছে, ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়েন। নিজের মনেই বলে, এর থেকে খুন করে যেতে পারত।
রাকিব দরজা খুললেন। নীপা দাঁড়িয়ে আছে চিন্তিত মুখে। নীপা রাকিবের ছোট মেয়ে। নাসিমের বোন। নীপা কখনো চিন্তিত হয় না। সব সময় হাসিমুখে থাকে। নীপা চিন্তিত থাকা মানে বাড়িতে সত্যি কোন সমস্যা হয়েছে। রাকিব সেটা বুঝে বললেন, “কী হয়েছে?”
নীপা বলল, “তুমি একটু মাথা ঠান্ডা কর বাবা”।
রাকিব বললেন, “মাথা ঠান্ডাই আছে। কী বলবি বল”।
নীপা বলল, “বাইরের ঘরে এসো”।
রাকিব বললেন, “এখন? এখন আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ছি তো”।
নীপা বলল, “এসো একটু”।
রাকিব বিরক্ত হয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখলেন নাসিম দাঁড়িয়ে আছে। একটা মেয়ে সোফায় বসে আছে। তিনি নাসিমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল? নীপা ডেকে নিয়ে এল! কী ব্যাপার?”
নাসিম বলল, “বাবা ওর নাম রাত্রি। ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে”।
রাকিব রাত্রির দিকে তাকালেন। মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে আছে। কাঁদছে সম্ভবত তবে কান্না দেখা যাচ্ছে না। তিনি বললেন, “বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কেন তোমাকে?”
রাত্রি বলল, “বাবার ধারণা আমি নাসিমকে ভালবাসি। বাবা মুসলমানদের ঘেন্না করে”।
রাকিব বললেন, “ওহ। তাহলে তুমি নাসিমকে ভালোবাসো না?”
নীপা এবার হেসে ফেলল, “বাবা, তুমি এই সময় এই প্রশ্নটা কী করে করলে?”
নাসিম বলল, “আমি বাইরে থেকে আসছি”।
রাকিব বললেন, “দাঁড়া দাঁড়া। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুই তো রেড ভলান্টিয়ার হলি। এ বাড়ি সে বাড়ি অক্সিজেন দিয়ে আসতিস। হঠাৎ করে এসব কবে শুরু করলি?”
নাসিম বলল, “শুরু করি নি। ওদের পাড়ায় গেছিলাম…”
নাসিম চুপ করে গেল।
রাকিব বললেন, “বুঝেছি। রাত্রি, তুমি আমাকে বল দেখি তুমি কী চাও?”
রাত্রি কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলল, “আমি নিজেও জানি না আমি কী চাই। বাবা হঠাৎ করে এমন হয়ে গেল কেন তাও জানি না”।
রাকিব নীপার দিকে তাকালেন, “ওকে জল দে। তোর ঘরে নিয়ে যা। সুস্থির হোক। তোর মা ফিরেছে?”
নীপা বলল, “ফিরবে খানিকক্ষণ পরে”।
রাকিব নাসিমকে বললেন, “প্রেম ট্রেম না, তাই তো?”
নাসিম জোরে জোরে মাথা নাড়াল, “একবারেই না। কী যে বল!!”
রাকিব বললেন, “রাত্রির থেকে ওর বাড়ির নাম্বার নে। আমি ওর বাবাকে ফোন করছি”।
রাত্রি বলল, “আমি ও বাড়ি যাবো না”।
রাকিব বললেন, “ওরকম বলে না মা। বাবা মা চিন্তা করবেন। ভেবো না। আমি কথা বলছি। তুমি নীপার ঘরে গিয়ে রেস্ট কর। আমি গিয়ে তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবো”।
নীপা রাত্রির হাত ধরল, “চল, আমার ঘরে”।
রাত্রি উঠে নীপার ঘরে গেল।
রাকিব নাসিমকে বললেন, “তুই মেয়েটাকে কত দিন ধরে চিনিস?”
নাসিম বলল, “এই ক’দিন হল”।
রাকিব বললেন, “নাম্বারটা নে। ফোন করছি। ওর বাবা কী বলেন দেখি। আমরা গিয়ে ওকে দিয়ে আসব। কী যে করিস তোরা, কী সুন্দর রবীন্দ্রনাথ পড়ছিলাম!”
নাসিম হাসল।
বাবা এবং রবীন্দ্রনাথের মাঝে এখনো কিছু এলে আগের মতই রেগে যান…
৭
রাত্রিকে খাটে বসিয়ে নীপা এক গ্লাস জল এনে দিল। রাত্রি জল খেয়ে নীপার ঘরটা দেখছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। খাটের পাশে বেশ কয়েকটা পুতুল, গল্পের বই। দেওয়াল আলমারিতে বই সাজানো। নীপা বলল, “তোমার কি একটু ভাল লাগছে?”
রাত্রি বলল, “হ্যাঁ”।
নীপা বলল, “তুমি কি সত্যি দাদার সঙ্গে…”
রাত্রি নীপার দিকে তাকাল। কী মিষ্টি মেয়েটা। ঠোঁটের কোণে সব সময় একটা হাসি লেগে আছে। সে বলল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
নীপা বলল, “টুয়েলভ। উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার কথা ছিল। সব ভেস্তে গেল। কবে কী হবে জানি না। জানো আমার এক বন্ধু আছে, ও পরীক্ষা হবে না শুনে এমন লাফ দিয়েছিল যে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে গেছে”।
কথাটা বলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল নীপা। রাত্রিও হাসল। মেয়েটা খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিতে পারে। সে একইসঙ্গে অবাকও হচ্ছিল। তার ধারণা ছিল নাসিমদের বাড়িটা পুরো ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙের হবে। ঘরে ঘরে শুধু মক্কা মদিনার ছবি থাকবে। ওরা খাটে পা তুলে খাওয়া দাওয়া করবে। ঘরে ঘরে বাচ্চা কিলবিল করবে। সেরকম কিছুই নেই। একবারে তাদের মতই বাড়ি। নাসিমের বাবার মধ্যেও কী অসাধারণ প্রজ্ঞা!
এতদিন কি সে ভুল জানত? রোজ খেতে বসলেই খাবার টেবিলে বাবা মুসলমানদের নামে কত কিছু বলে যায়। এরা জন্ম থেকেই জিহাদ করতে যায়, এদের মনের ভিতর নাকি সবসময় বিদ্বেষ থাকে, কোথায়? নীপাকে তো নিজের বোনের মতই মনে হচ্ছে। মজা করতে ভালবাসে, কথা বেশি বলে, কথা বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে ফেলে… তারই মত তো মানুষ! হোয়াটস অ্যাপে বর্ণিত ভয়াবহ প্রাণীদের মত তো মনে হচ্ছে না কাউকেই।
নীপা বলল, “এই দিদি, তুমি বললে না তো, আমার গাধা দাদাটার সঙ্গে তুমি কি সত্যি প্রেম কর?”
রাত্রি হেসে ফেলল, “নাসিমকে গাধা বললে?”
নীপা বলল, “হু? খারাপ লাগল বুঝি? বাপরে! সরি সরি”।
আবার হেসে গড়িয়ে পড়ল নীপা।
রাত্রি নীপাকে সবটা বলল।
নীপা গালে হাত দিয়ে বলল, “বাপরে, ইনি তোমার বাবা না অমরেশ পুরী? এমন কেন ভদ্রলোক?”
রাত্রি বলল, “হোয়াটস অ্যাপ! আবার কী?”
নীপা বলল, “সে তো বুঝতেই পারছি। তবে ভেবো না শুধু তোমার বাবাই এরকম। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে আগে আমি খুব যেতাম। করোনার প্রথম লকডাউনের কয়েক মাস আগে আমাকে সে বন্ধু স্পষ্টই বলে দিয়েছিল ওদের বাড়ি না যেতে। আমাদের এগুলো অভ্যাস হয়ে গেছে। বাবাকে বললে বাবা অবশ্য বলে কেউ বন্ধু না থাকলে বইকে বন্ধু করে নিতে। জানো, আমার বাবা আমাকে একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করল, খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করল। মা, তুই কি স্মার্ট ফোন নিবি? তুই চাইলে আমি কিনে দেব। তবে আমার মতে যতদিন এই যন্ত্রটা ছাড়া থাকবি, ততদিন ভাল থাকবি। আমি বললাম, থাক বাবা। আমাকে কী প্যাড ওয়ালা ফোনই দাও। ওটা নেই বলেই হয়ত এখনো পড়াশুনো করতে পারছি”।
রাত্রি অবাক হল, “তোমার স্মার্ট ফোন নেই? ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট?”
নীপা মাথা নাড়ল, “না। আমিও বই পড়ি। এখন কী পড়ছি জানো? পরশুরামের মহাভারত। একসময় উপেন্দ্রকিশোরের ছোটদের মহাভারত পড়ে পড়ে বইটাকে পাপড়ভাজা করে দিয়েছিলাম। ইলেভেনে উঠলে বাবা আমাকে একটা পরশুরামের মহাভারত দিল। বাপরে, কী চাপের! মহাভারতের ছোটবড় হয়!”
রাত্রি ইতস্তত করে বলল, “তুমি কোরাণ পড় না?”
নীপা বড় করে মাথা নাড়ল, “তাও পড়েছি। কোরাণ পড়েছি, বাইবেল পড়েছি। কিন্তু মহাভারত আলাদা ব্যাপার। আর আমার বাবার কাছে মহাভারতের থেকেও আলাদা ব্যাপার রবীন্দ্রনাথের কবিতা। আমার বাবার সব কাব্যগ্রন্থের সব ক’টা কবিতা মুখস্ত। তবু পড়বে। বলে প্রতিদিন নতুন নতুন করে মানে বেরোয় নাকি! আমার কিন্তু কবিতা ভাল লাগে না। আমার গদ্য। তাও কার বল তো? সুনীলের”।
রাত্রি বলল, “আর তোমার দাদার কী পছন্দ?”
নীপা বলল, “দাদা হল সাইলেন্ট লাভার মানুষ। ওই তোমাকে যেমন ঝাড়ি মারত, তুমি না এগোলে জীবনেও আর কথা বলত না। তার ওই সাইলেন্ট প্রেমের লেখা ভাল লাগে”।
রাত্রি মজা পেল, বলল, “যেমন?”
নীপা চোখ নাচাল, “সেটা দাদাকেই জিজ্ঞেস করবে। আমি কেন বলব? তোমার মনে হয় বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। ঈশ, তুমি এখানে থাকলে ভারি মজা হত। আমরা সারারাত আড্ডা মারতাম। আচ্ছা, তুমি সত্যিই দাদাকে একটুও ভালবাসো না? ফাইভ পারসেন্টও না? এই এট্টুসখানি?”
নীপা কেমন বাচ্চাদের মত প্রশ্ন করল।
রাত্রি হি হি করে হেসে ফেলল। শেষ কবে সে এত মজা পেয়েছে, নিজেই মনে করতে পারছিল না।
৮
রাত্রি চলে যাওয়ার পর প্রণয় নিজেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিলেন। রাত্রির মা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন।
রাতের দিকে বাড়ি ফিরে প্রণয় থম মেরে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। স্ত্রী তখনো কাঁদছিলেন। প্রণয় বিরক্ত গলায় বললেন, “একদম কোন যোগাযোগ রাখবে না। তোমার মেয়ে লাভ জিহাদের শিকার হয়েছে। তুমি বুঝতে পারছো না এটা কত বড় ষড়যন্ত্র। ওরা হিন্দু মেয়েদের টেনে নিয়ে গিয়ে কনভার্ট করে দেয়। এতক্ষণে তোমার মেয়ে মোল্লা হয়ে গেছে”।
রাত্রির মা তনয়া বললেন, “তা বলে এভাবে মেয়েকে পর করে দেবে তুমি? আটকানো যেত না?”
প্রণয় বললেন, “তুমি জানো না, আটকে কোন লাভ নেই। তারপরে ঠিক একদিন পালিয়ে যাবে। দেখো না, এই হোয়াটস অ্যাপ মেসেজটা দেখো…”
প্রণয় ফোনটা তনয়ার দিকে এগিয়ে দিলেন। একটা মেসেজ। কীভাবে হিন্দু মেয়েদের বাড়ি থেকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে মুসলমানেরা ধর্মান্তরিত করছে, কীভাবে এর প্রতিরোধ করা উচিত, তা নিয়ে অনেক বড় লেখা। খানিকটা পড়ে তনয়া কেঁদে ফেললেন, “আমার কিছু ভাল লাগছে না। একটা মাত্র মেয়ে, সারাদিন ঘরে কাটাচ্ছে। এর মধ্যে কখন এসব হয়ে গেল?”
প্রণয় বললেন, “ওটাই তো। এখন সাইবার ক্রাইমের যুগ। ওরা সব পারে। হয়ে গেল বুঝলে, এই দিনটাই দেখার ছিল আমার। আমি ঠিক ব্যবস্থা নেব দাঁড়াও। আমারও লোক আছে। যে বাড়িতে বিয়ে করেছে, সে বাড়ির সবাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারব। ছাড়ব না”।
তনয়া শিউরে উঠে বললেন, “একী বলছো তুমি? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
প্রণয় বললেন, “পাকিস্তানের চাল এগুলো, বুঝতে পারছো? সৌদি আরব থেকে পেট্রো ডলার আসছে, পাকিস্তানের টাকা ঢুকছে, সব হিন্দু মেয়েগুলোকে ওরা মোল্লা করে ওদের গর্ভে নিজেদের সন্তান…”
কলিং বেল বেজে উঠল।
প্রণয় বললেন, “দেখো কে এসেছে”।
তনয়া ছুটে দরজা খুললেন। একজন সৌম্য ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।
তনয়া বললেন, “বলুন”।
ভদ্রলোক বললেন, “প্রণয়বাবু আছেন?”
তনয়া চোখের জল লুকিয়ে বললেন, “আসুন”।
ভদ্রলোক ঘরের ভিতরে প্রবেশ না করে বললেন, “আমি ভিতরে গেলে আপনাদের অসুবিধে হতে পারে। প্রণয়বাবুকে ডাকুন”।
তনয়া বুঝলেন না। অবাক হয়ে বললেন, “কেন অসুবিধা হবে বলুন তো?”
ভদ্রলোক বললেন, “আমার নাম আব্দুর রাকিব বিশ্বাস। আপনাদের মেয়ে এখন আমাদের বাড়িতে আছে। আমি সে ব্যাপারে প্রণয়বাবুর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি”।
তনয়া বিহ্বল চোখে রাকিবের দিকে তাকিয়ে রইলেন, বললেন, “ও ঠিক আছে তো?”
রাকিব হাসলেন, “নিশ্চয়ই ঠিক আছে। তবে বাবাকে খুব ভয় পায় তো। তাই…”
তনয়া বললেন, “ঠিক আছে। আমি ডাকছি ওর বাবাকে”।
তনয়া ঘরের ভিতরে গিয়ে বললেন, “তোমাকে ডাকছেন একজন”।
প্রণয় বাইরে বেরিয়ে বললেন, “বলুন। ভিতরে আসেন নি কেন?”
রাকিব বললেন, “আমি মুসলমান। আপনাদের অসুবিধা করতে চাই না এত রাতে”।
প্রণয় অবাক হয়ে রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি মুসলমান? টুপি কোথায়? দাড়ি কোথায়? লুঙ্গি? আপনাকে তো বাঙালিদের মতই লাগছে!”
রাকিব হাসলেন, “আমি অবশ্যই বাঙালি। ভয় পাবেন না। আমি কোন টাইম বোমা নিয়ে আপনাদের বাড়ি আসি নি। আপনার মেয়ে আমাদের বাড়িতে আছে। আমার ছেলের সঙ্গে ওর কোন রকম কোন সম্পর্ক হয় নি। ও আপনার সঙ্গে প্রবল তর্ক করেছে। তারপরে রাগের মাথায় বেরিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে গেছে। রাত্রি এখন টোটোতে বসে আছে বাইরে। আপনি অনুমতি দিলে আমি ওকে আপনাদের কাছে রেখে বাড়ি ফিরব”।
প্রণয় থতমত খেয়ে গেলেন, “ভালবাসে না?”
রাকিব বললেন, “না বোধহয়”।
প্রণয় বললেন, “এখনো মুসলমান করেন নি আপনারা ওকে?”
রাকিব বললেন, “না। নিজেরা আগে ভাল মানুষ হই, তারপরে না হয় হিন্দু মুসলমান হওয়া যাবে! মেয়েকে ডাকব?”
প্রণয় রাকিবকে দেখে কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিলেন না। একটু ভেবে বললেন, “আমি পড়েছি বটে, মুসলমানেরা হিন্দুদের মত ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়। আপনি সেরকম নন তো?”
রাকিব বললেন, “আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে একদিন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে, যদি আপনি অনুমতি দেন তবে। আপাতত নিজের মেয়েকে ডেকে নিন। বেচারি ভারি ভয় পেয়ে আছে”।
প্রণয় তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নিয়ে এসো। ঘরের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখো। আগুন ছুঁয়ে ঘরে ঢুকিও”।
রাকিব বললেন, “অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি আসি। অনেক উপকার করলেন আমার। সবে গীতাঞ্জলী শুরু করেছিলাম সন্ধ্যেয়”।
প্রণয় বললেন, “গীতাঞ্জলী মানে? সেটা কী?”
রাকিব হাসলেন, “যার সৃষ্টি ভুলে গিয়ে আজ বাঙালির এই দুর্দশা হচ্ছে। তার লেখা। ভদ্রলোক এককালে নোবেল পেয়েছিলেন। এখন বিস্মৃতপ্রায় মনে হয়… যাই হোক, ভাল থাকুন”।
রাকিব হাত জোড় করলেন।
৯
রাকিব দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঠিক করেছিলেন রাত্রি ঘরে ঢোকার পরে বেরোবেন। রাত্রি গেটের কাছে আসতেই প্রণয়বাবু হাঁ হাঁ করে তেড়ে উঠলেন, “স্নান করে ঘরে ঢোক। তুই ওখানেই দাঁড়া। মা বালতিতে জল দিচ্ছে। সে জলে স্নান কর। মোল্লাদের বাড়ি থেকে এ বাড়িতে এভাবে ঢুকবি না”।
বাবার কথাটা কানে যেতে রাত্রি সিঁটিয়ে গেল।
রাকিব বললেন, “এত রাতে স্নান করবে বাড়ির বাইরে?”
প্রণয় রাকিবের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, “আপনি আসতে পারেন। এটা আমাদের বাড়ির ভিতরের ব্যাপার। বাইরের লোকের মতামত নেওয়ার কোন রকম প্রয়োজন বোধ করি না”।
রাকিব স্থির চোখে প্রণয়ের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রাত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি ভুল করেছিলাম। আমি বুঝতে পারি নি এই ভয়াবহ বিদ্বেষের পরিবেশে তোমাকে থাকতে হচ্ছে মা। তুমি চাইলে আমাদের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারো। কী করবে জানাও। আমি টোটোতে গিয়ে বসছি”।
রাত্রি বলল, “আমি এ বাড়িতে থাকব না কাকু”।
প্রণয়বাবু চিৎকার শুরু করলেন। রাকিব কোন কথা না বলে টোটোতে গিয়ে বসলেন। রাত্রি তার সামনে বসল।
প্রণয় বললেন, “আমি থানায় ফোন করছি”।
রাকিব টোটোচালককে বললেন, “চল”।
তনয়া নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। রাত হয়েছিল বলে পাড়ার লোক জড়ো হতে হতে টোটো চলে গেছিল।
পাড়ার তিন চারজন এল। একজন বলল, “কী হয়েছে?”
প্রণয় বললেন, “আমার মেয়েকে এক মোল্লা ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে। আমি ছাড়ব না। শেষ দেখে ছাড়ব”।
তনয়া বললেন, “বাজে কথা। কেউ ফুসলায়নি। মেয়ে নিজের ইচ্ছেয় গেছে”।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এই দ্বিমত দেখে পাড়ার লোকজনের মধ্যে ফিসফাস শুরু হল।
তনয়া কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করছিলেন, “মেয়েটাকে ঘরের মধ্যে এক ঘরে করে রেখে দিয়েছে। সারাক্ষণ পাগলের মত মোবাইলে উলটো পালটা পড়ে যাচ্ছে। আমার আর ভাল লাগে না কিছু। কাল সকাল হোক, আমিও বাপের বাড়ি চলে যাব”।
প্রণয় কড়া গলায় বললেন, “তুমি ঘরের ভিতরে যাও। আপনারাও যান। আমার বাড়ির ব্যাপার। আমি বুঝব”।
পাড়াতে এমনিতেই প্রণয়ের খুব একটা সুনাম নেই বলে ভিড় হালকা হয়ে গেল।
প্রণয় ঘরের ভিতর গুম হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তনয়া সোফায় কাঁদছিলেন।
প্রণয় বললেন, “আমি আগেই বলেছিলাম আমার মেয়ে মরে গেছে। অকারণ ন্যাকামিটা হল। যাই হোক, তুমি বাপের বাড়ি যাবে তো? চলে যেও। কোন অসুবিধা নেই। তবে তোমার কোন ভাই তোমায় খাওয়াবে, সেটা আমার খুব দেখার ইচ্ছা আছে”।
তনয়া উত্তর দিলেন না।
প্রণয় ফোন নিয়ে তার হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে লিখলেন নাসিম কীভাবে তার মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে। গ্রুপে হাহাকার পড়ে গেল।
কেন একজন হিন্দুর মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে মুসলিম, এই নিয়ে গ্রুপে কমেন্টের ঝড় উঠতে শুরু করল।
মিনিট দশেক বাদে ফেসবুকে পোস্ট পড়ল। শেয়ার হতে শুরু করল।
প্রণয়ের মাথায় আগুন লেগে গেছিল। তিনি বাথরুমে জামা কাপড় পরা অবস্থাতেই মাথায় জল দিলেন। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের বাইরে ভেজা গায়ে হাঁটাহাঁটি করতে শুরু করলেন। রাত একটার দিকে তার ফোন বাজতে শুরু করল। বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসতে শুরু করল কীভাবে নাসিম তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে।
কয়েকটা ফোন অ্যাটেন্ড করে প্রণয় ফোন অফ করে সোফায় বসে রইলেন। কোন মতে রাত কাটতে সকাল সাতটাতেই প্রণয় থানায় গেলেন। ওসি প্রসেনজিত বর্মণ অফিসেই ছিলেন। প্রণয় গিয়ে বললেন, “আমার মেয়েকে মোল্লারা তুলে নিয়ে গেছে। লাভ জিহাদ করছে”।
প্রসেনজিত চা খাচ্ছিলেন। বললেন, “আপনার মেয়ে অ্যাডাল্ট?”
প্রণয় বললেন, “অ্যাডাল্ট তো কী হয়েছে? আমি জানি আপনি এই প্রশ্ন করবেন। অ্যাডাল্ট হলেই বা কী? কী করে একটা হিন্দু কান্ট্রিতে একটা মোল্লা এভাবে হিন্দু মেয়ে তুলে নিয়ে যেতে পারে?”
প্রসেনজিত বললেন, “হিন্দু কান্ট্রি কোনটা?”
প্রণয় বললেন, “আপনিও সেকু নাকি? আমি এদেশের কথা বলছি, এদেশে সব হিন্দু। আপনি আমাকে হেল্প করুন, ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব”।
প্রসেনজিত বিরক্ত মুখে প্রণয়ের দিকে তাকালেন, “আপনি ডাক্তার দেখান”।
প্রণয় লাফ ঝাঁপ দিতে শুরু করলেন, “আমি বুঝে নেব। ফেসবুকে পোস্ট ভাইরাল হয়ে গেছে। কেউ ছেড়ে দেবে না”।
প্রসেনজিত প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন প্রণয় ঠিক অবস্থায় নেই। তিনি চুপ করে বসে প্রণয়ের লাফ ঝাঁপ দেখতে লাগলেন।
১০
নাসিম তার ঘরে মোবাইল ঘাঁটছিল।
নীপা নাসিমের ঘরে ঢুকে বলল, “এই দাদা। মন খারাপ নাকি?”
নাসিম নীপার দিকে না তাকিয়ে বলল, “মন খারাপ কেন হতে যাবে?”
নীপা বলল, “না মানে বউদি এসেও চলে গেল। তাই আর কী”।
নাসিম বলল, “তুই কিন্তু চড় খাবি। তোর চড় খাওয়ার সময় এসে গেছে, বুঝতে পারছিস?”
নীপা বলল, “তুই ঝাড়ি মারছিলি? ঈস, তুই আবার কবে থেকে ঝাড়ি মারিস?”
নাসিম এবার ফোন রেখে নীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “পুরোটাই ঝোঁকের মাথায় হয়েছে। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি এত দূর চলে যাবে বুঝি নি। বাবা তো মেয়েটাকে দিয়েই আসবে। এই সব নিয়ে আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিস না। হিন্দু মুসলমান এখন বিরাট ইস্যু হয়ে গেছে। কিছু হলেই দাঙ্গা লাগবে। মিটে যাক ব্যাপারটা”।
নীপা বুঝল দাদার হৃদয় বেদনাহত। সে ফিক করে হেসে টিভি দেখতে গেল।
কলিং বেল বাজল। নীপা দরজা খুলে দেখল তার মা এসেছেন। নীপা বলল, “এত রাত অবধি খালার বাড়িতে ছিলে? এদিকে তো বিরাট কান্ড হয়ে গেল”।
শায়েলা অবাক হলেন, “কী হয়েছে?”
নীপা বলল, “ঘরে এসো বলছি”।
শায়েলা ঘরে ঢুকতে নীপা গড়গড় করে সব বলে ফেলল।
শায়েলা গালে হাত দিয়ে বললেন, “হায় আল্লা। নাসিম এসব করেছে?”
নীপা হাসল, “তার উপর বাবার আজকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ডেট ছিল”।
শায়েলা বললেন, “ঐ রবীন্দ্রনাথ শুনেই আমি সাজিয়ার বাড়ি গেলাম। যাতে আমি কথা বলতে গেলে তোর বাবা রেগে না যায়। আজ নাসিমের খবর আছে। দাঁড়া, আমি হাত মুখ ধুয়ে নি”।
শায়েলা বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাসিমের ঘরে গেলেন।
নাসিম মাকে দেখে বলল, “নিশ্চয়ই আমাদের সি এন এন নিউজ তোমাকে সব খবর দিয়ে দিয়েছে?”
শায়েলা বসলেন, “আমি তোকে রুহানার কথা বলায় এই জন্য তুই এড়িয়ে যাচ্ছিলি? তোর হিন্দু মেয়ে পছন্দ?”
নাসিম চোয়াল শক্ত করল, “আমি হিন্দু মুসলিম দেখে যাই নি। তাছাড়া নিজের খালা ফুপুর মেয়েকে বিয়ে করায় আমার আপত্তি আছে। এককালে নিয়ম ছিল, এখন মনে হয় যাদের সঙ্গে বড় হলাম, বোনের মত দেখলাম, তাকে বিয়ে করলে ভাল দেখাবে? আমাদের নিয়ে সবাই মজা করে মা”।
শায়েলা বললেন, “মজা করে, আমাদের এই দেশের নাগরিক বলেই অনেকে ভাবে না। তাতে কী হয়? আমরা আমাদের মত। তা বলে এমন কোন মেয়েকে পছন্দ করতে হবে যাকে বিয়ে করলে অশান্তি হতে পারে?”
নাসিম বলল, “জানি তো। আমরা সংখ্যালঘু। আমরা নাকি টেরোরিস্ট। রোজই তো শুনি মা। যাই হোক, চিন্তা কোর না। ও মেয়ে তো আর আসবে না। তবে এটুকু জেনো, নিজের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে আমি…”
কলিং বেল বেজে উঠল। শায়েলা বললেন, “তোর বাবা এল বোধ হয়। আমি দেখছি। তুই জেদ করে থাক, আমি কিছু বলব না। কিন্তু ভাল মেয়ে না পাওয়া গেলে আমার ভোট রুহানার দিকেই থাকবে, এ কথা মনে রাখবি”।
শায়েলা নাসিমের ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন নীপা দরজা খুলেছে। রাকিব একটি মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। তাকে দেখে বললেন, “শায়েলা, ও রাত্রি। আজ থেকে এ বাড়িতেই থাকবে”।
নীপা আনন্দে রাত্রিকে জড়িয়ে ধরল। রাত্রি কাঁদছিল। শায়েলা বললেন, “কী হয়েছে আমি কি জানতে পারি?”
রাকিব বললেন, “তোমার আরেকটা মেয়ে হয়েছে আজ। আর কিছু না। তুমি খাবার দাও। রাত্রিও খাবে আমাদের সঙ্গে”।
শায়েলা রাত্রির দিকে তাকালেন। ভারি মিষ্টি মুখটা। তবু মায়ের মন। তার বুকটা ধড়ফড় করছিল। নীপাকে বললেন রাত্রিকে তার ঘরে নিয়ে যেতে। ওরা বেরোলে তিনি রাকিবকে বললেন, “তুমি মেয়েটাকে দিতে গেছিলে। এখন আবার কী হল?”
রাকিব সবটা বললেন।
শায়েলা সোফায় চিন্তিত মুখে বসে বললেন, “এটা নিয়ে খুব ঝামেলা হবে। সব দিকের লোকজন জল ঘোলা করবে। কী হবে?”
রাকিব বললেন, “খাও। খেয়ে দেয়ে ঘুমাও। যা হবে কাল দেখা যাবে”।
শায়েলা উঠলেন না। তার মাথা দপদপ করতে শুরু করল।
মাইগ্রেনের ব্যথাটা আসছে আবার ঝড়ের মত…
১১
রাকিব লাইব্রেরীতে আবার ঢুকে গেছেন। লাইব্রেরী রুমে একটা তক্তপোষ আছে। তিনি সেখানেই ঘুমিয়ে পড়বেন বই পড়তে পড়তে। রাত্রি নীপার সঙ্গে শুয়েছে।
শায়লার ঘুম আসছিল না। মাথা ব্যথা বাড়লে তার ঘুম আসে না।
প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর উঠে তিনি নাসিমের ঘরে গেলেন।
নাসিম শুয়ে ফোন ঘাঁটছিল।
তাকে দেখে বলল, “ঘুমাওনি?”
শায়লা বসলেন, “এটা কী হল বল তো? তোরা যেটা করলি সেটা ভাল করলি?”
নাসিম অবাক হল, “কী করলাম? আর তোরা মানে কাদের কথা বলছো?”
শায়লা বললেন, “তুই আর মেয়েটা! কত বড় বিপদ তুই বাড়ি বয়ে এনেছিস বুঝতে পারছিস? কতদিন ধরে এসব করছিস তুই?”
নাসিম বলল, “শোন মা, আমি কিছুই করি নি। ব্যাপারটা কিছু করার আগেই এত দূর গড়িয়ে গেছে”।
শায়লা বললেন, “কীভাবে গড়াল? এটা সম্ভব? বিশ্বাসযোগ্য? তোদের মধ্যে কোন বোঝাপড়া নেই বলছিস?”
নাসিম বলল, “সত্যি কোন বোঝাপড়া নেই। আমি তো ভাবতেই পারি নি এত কিছু হয়ে যাবে বিকেলের পর থেকে”।
শায়লা মাথা নাড়লেন, “আমি জানি না তুই কী করতে চাইছিস। এখন এ দেশের অবস্থা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তোর? এই কিছুদিন আগেও ভোটের সময় আমাদের এন আর সি করে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি শুনতে হয়েছে। এত ভাল একজন শিক্ষক তোর বাবা, তাকেও রাস্তাঘাটে বেরোলে লোকে দুধেল গাই বলে ডাকে। কেন ডাকে বুঝতে পারিস না? সব কিছু তো আগের মত নেই। কোভিডের জন্য হয়ত কমিউনাল টেনশনটা কমেছে, একটু থিতু হলেই দেখবি আবার শুরু হয়ে গেছে। তোর বাবা না হয় সারাক্ষণ ভাবের ঘোরে থাকে, তুই তো সেটা থাকিস না। এদিক সেদিক যাস, তোদের পার্টিতেও কি সবাই মুসলমানদের সমানভাবে দেখে?”
নাসিম বলল, “দেখে। কেন, তোমায় কে কী বলেছে?”
শায়লা চিন্তিত গলায় বললেন, “জানি না, আমার আজকাল সবকিছুতেই সন্দেহ হয়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। তার মধ্যে তুই যে এটা কী করলি…”
নাসিম বলল, “আমি কিছু করি নি মা। বাবা সব ম্যানেজ করে দেবে দেখবে। কালকের মধ্যে মেয়েটাকে ওদের বাড়িতে দিয়ে আসবে”।
শায়লা বললেন, “ব্যাপারটা এত সোজা বলে তোর মনে হচ্ছে? তুইও দেখছি তোর বাবার মত কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছিস আজকাল। যদি ওর বাড়িতে ওকে অ্যাক্সেপ্ট করত, তাহলে আজকেই করত। এবার এটা নিয়ে জল ঘোলা হতে শুরু করবে। সব পক্ষ জড়াবে, পলিটিসাইজ করবে। উফ”।
শায়লা কপালে হাত রাখলেন।
নাসিম বলল, “তুমি ঘুমিয়ে পড় মা। চিন্তা কোর না। যা হবে দেখা যাবে”।
শায়লা বললেন, “তুই আমাকে কথা দে, তুই ওই মেয়েকে বিয়ে করবি না। সত্যি করে বল তো, কিছু নেই তো তোদের মধ্যে?”
নাসিম বলল, “না না। কিচ্ছু নেই। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও। চিন্তা কোর না”।
শায়লা বললেন, “আমি পারি না বিশ্বাস কর। সব সময়, সব জায়গায় মোল্লা মোল্লা শুনে মাথা খারাপ হয়ে যায়। কমনরুমে উত্তমদা, পারমিতারা আমাকে নিয়ে কথা বলে আমি বুঝতে পারি। আমি ঢুকলেই ওদের কথা বন্ধ হয়ে যায়।সারজিকাল স্ট্রাইকের দিন হঠাৎ করে অহনাদি আমাকে বলে বসল খারাপ লাগছে তোমার? যেন আমি পাকিস্তানী। এ দেশটা আমার না! এবার থেকে শুনতে হবে আমার ছেলে লাভ জিহাদ করেছে”।
শায়লা ভেঙে পড়লেন। নাসিম মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, “তুমি ঘুমোও গিয়ে। আমার কাছে ঘুমোবে মা? মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই তোমায়”।
শায়লা বললেন, “আমার মাঝে মাঝে তোর বাবাকে একবারে সহ্য হয় না। বিড়াল পার করতে গিয়ে কেউ এভাবে বিড়াল বাড়ি নিয়ে আসে বল? মেয়েটার বাড়িতে অশান্তি হত, ঠিকও হয়ে যেত। এবার ঝামেলা বাড়তে থাকবে”।
নাসিম চুপ করে বসে রইল।
রাত্রি কি তাকে ভালবাসে? সবটাই কি ঝোঁকের বশে করল?
১২
ঘুমনোর আগে নীপা একটা বই নিয়ে বসল।
রাত্রি বলল, “তুমি বই পড়তে পড়তে ঘুমোও?”
নীপা হাসল, “বাবা এই অভ্যাস তৈরী করেছিল। এখন এটাই ঘুমের ওষুধ। বই না পড়লে ঘুমই আসবে না। বই পড়ারও আমার এক একটা ফেজ আসে। এই যে, এখন যেমন পড়ছি নীললোহিত। পড়েছো?”
রাত্রি বলল, “বেশি না। কয়েকটা পড়েছি। বাবা একদিন হঠাৎ বলে বসল সুনীল সেকুদের লেখক। সে মাকু। আর কিনে দিল না”।
নীপা অবাক হল, “মাকু আর সেকু মানে?”
রাত্রি বলল, “মার্ক্সিস্ট আর সেকুলার। মার্ক্সিস্টরা ধর্ম মানে না। সুনীলও মানতেন না। সেটা নিয়ে সুনীলের লেখা নিয়ে হিন্দুত্বপন্থীরা এখন খুব রাগ করে”।
নীপা বলল, “ওহ মার্ক্সিস্ট। তাদের উপর সবারই কম বেশি রাগ আছে। আবার তুমি যদি তার বাইরে গিয়ে ভাবো, বাংলাদেশে অভিজিৎ রায় বলে একজন ব্লগার ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে ব্লগ লিখতেন। বাংলাদেশ বইমেলায় যখন এসেছিলেন, তখন ইসলামিক এক্সট্রিমিস্টরা তাকে খুন করে দিয়েছিল। যে কোন লেখক যখন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তার মত ব্যক্ত করবে, তখন তার উপরে সবার রাগ হবে। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ একসঙ্গে সবাইকে খুশি করতে পারে না”।
রাত্রি বলল, “তোমার সুনীল ভাল লাগে?”
নীপা বলল, “আমার সবার লেখা ভাল লাগে। তসলিমা নাসরিনেরও। তসলিমা তার লেখায় একটা মত ব্যক্ত করেছেন। তার জন্য তাকে দেশ ছাড়া কেন হতে হবে? এই রাজ্যেও তো কমিউনিস্ট শাসন ছিল। তাদের আমলেও তসলিমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। আমরা আসলে কেউই নিজেদের স্বার্থ বাদ দিয়ে তোমার ঐ মাকু বা সেকু হতে পারি নি”।
রাত্রি চমৎকৃত হল। এইটুকু মেয়ে, অথচ কী গভীর কথা! সে বলল, “তুমি খুব পড়তে ভালবাসো বল? আচ্ছা তোমার যদি কোন কনজারভেটিভ পরিবারে বিয়ে হয়, তারা বই পড়তে না দেয়, তখন কী করবে?”
নীপা বলল, “বাবা আমাকে পড়াবে। আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে যাবো কেন খামোখা? আমার অনেক পড়ার ইচ্ছে”।
দরজায় ঠক ঠক হল।
নীপা উঠে দরজা খুলে দেখল নাসিম দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ পাকাল, “কী রে, এত রাতে?”
নাসিম বলল, “সব ঠিক আছে তো?”
রাত্রি উঠে বসেছে দেখে নীপা বলল, “আয়”।
নাসিম বলল, “না না ঠিক আছে”।
নীপা বললে, “আয়, আয়। বুঝেছি তোর চাপ হয়ে যাচ্ছে”।
নাসিম ঘরে ঢুকে বলল, “চাপ না ঠিক। মা চিন্তা করছে একটু”।
রাত্রি বলল, “খুব অসুবিধা করে দিলাম আমি এসে?”
নীপা বলল, “ধ্যাত। চুপ কর তো। বাবা আছে তো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে”।
নাসিম বলল, “ঠিক আছে, আমি যাই?”
নীপা বলল, “যাবি? তোর কি রাত্রিদিকে কিছু বলার আছে?”
নাসিম বলল, “না, ঠিক আছে। আমি আর কী বলব? আমার কিছু বলার নেই”।
রাত্রি হঠাৎ করে বলল, “আচ্ছা নাসিম তোমার নীললোহিত ভাল লাগে?”
নাসিম থতমত খেয়ে বলল, “হ্যাঁ, তবে বেশি পড়ি নি। কাকাবাবু আর সেই সময় পড়েছি। প্রথম আলো পড়ব পড়ব করেও পড়া হয় নি”।
নীপা বলল, “কী করে হবে, এখন সারাদিন পার্টি লিটারেচার পড়ে। বাপরে, আমি বুঝতেই পারি না অর্ধেক। কীসব ভাষা, পুঁজিবাদী সমাজ, প্রলেতারিয়েত, উফফ!”
নাসিম রেগে গেল, “গাট্টা খাবি। তোকে বলেছি না বুঝলে বুঝিয়ে দেব, বাজে বকবি না”।
নীপা ফিক করে হেসে বলল, “এই তুই তার মানে মাকু। তোকে আমি মার্ক্সীয় সাহিত্য না কী সব পড়তে দেখেছি”।
নাসিম বলল, “এটা আবার কে শেখালো?”
নীপা বলল, “এই তো রাত্রিদি বলছিল। ওর বাবা সুনীলকে সেকু মাকু বলেছেন”।
নাসিম বলল, “এটা ওদের দেশ। এখন ওরাই যা বলবে তাই হবে”।
রাত্রি বলল, “কেন? সেটা কে ঠিক করল? সংবিধান কি পাল্টে গেছে?”
নাসিম বলল, “পাল্টে দেবে। তোমার বাবার মত শিক্ষিত মানুষদের যারা ঘৃণার নামে পাল্টে দিতে পারছে, সংবিধান পাল্টাতে আর কতদিন লাগবে?”
রাত্রি মন মরা হল, “আমার বাবা হঠাৎ করে পাল্টে গেল। এরকম ছিল না। হোয়াটস অ্যাপ ফেসবুক যেদিন থেকে শুরু করল, সেদিন থেকেই। কী বাজে রোগ। মোবাইলের স্ক্রিণে যা থাকবে, তাই বিশ্বাস করবে”।
নাসিম বলল, “মোবাইলটা শুধু একপক্ষকে আঘাত করে নি। আরেকপক্ষকেও সমান ভাবে করছে। শুধু তুমি অপরপক্ষটা দেখতে পাচ্ছো না, এই আর কী”!
রাত্রি বলল, “মানে?”
নাসিম বলল, “আমার অনেক চেনা জানা মুসলমানও এখন অকারণ হিন্দুবিরোধী আক্রোশে ভুগছে এই মোবাইলের কল্যাণে। এক পক্ষের ঘৃণা, অপর পক্ষের ঘৃণাকেও জাগাতে সাহায্য করছে”।
নীপা বলল, “দাদা, তুই কেমন জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তির মত কথা বলছিস, এটা কি রাত্রি এফেক্ট?”
নাসিম এবার রেগে মেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নীপা হাসতে হাসতে বলল, “লজ্জা পেয়ে গেছে”।
১৩
রবীন্দ্রনাথে মজে ছিলেন অনেক রাত অবধি। রাকিবের ঘুম ভাঙল সকাল ন’টার দিকে।
উঠে দেখলেন নাসিম লাইব্রেরীতে ঢুকে চুপ করে বসে আছে।
রাকিব বললেন, “কী ব্যাপার?”
নাসিম বলল, “সকালে বেরিয়েছিলাম। গ্রামে অনেকেই ব্যাপারটা জেনেছে। হানিফ চাচা একগাদা কথা বলল। আমরা মসজিদে যাই না, ধর্মাচরণ মন দিয়ে করি না এসব তো বললই, তারপরে আরো একগাদা কথা বলল। আসবে বলল দশটার দিকে”।
রাকিব চুপচাপ শুনে বললেন, “বেশ তো। আসুক। তোর কী সমস্যা?”
নাসিম বলল, “মাও খুব চিন্তায় আছে। কাল রাতে বলছিল ব্যাপারটায় ঝামেলা হতে পারে”।
রাকিব বললেন, “ঠিক আছে। আমায় অনলাইন ক্লাস নিতে হবে এগারোটার দিকে। মুখ টুখ ধুই, তারপর দেখছি”।
নাসিম চুপ চাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রাকিব হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম সেরে ড্রইংরুমে বসতেই হানিফ এলেন। হানিফ স্থানীয় পঞ্চায়েতের কোন এক পদে আছেন। রাকিব বললেন, “তুমি নাকি নাসিমকে কীসব বলেছো?”
হানিফ বসে বললেন, “আমি কী বলব? যা বলার তাই বলেছি। মেয়েটা যখন যেচে তোমাদের বাড়িতে এসেছে, তখন বিয়ে দিয়ে দাও। কাজি বিয়ে পড়িয়ে দিক। আর বাকিটা…”
রাকিব গালে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে হানিফের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ধর্ম বাদ দিয়ে বাকি পৃথিবীটা দেখেছো কখনো? অনেক কিছু আছে, দেখেছো?”
হানিফ জিভ কাটলেন, “তওবা তওবা, তুমি কি নাস্তিক হলে নাকি? এসব কী বলছ? ধর্ম বাদ দিয়ে কিছু হয় নাকি?”
রাকিব বললেন, “হয়, আবার হয়ও না। আমার হাতে সময় কম আছে। এখনই তর্ক করতে পারবো না, তবে এই মেয়েকে কনভার্ট করার কোন প্ল্যান আমার নেই। মেয়েটির বাবা তোমাদের মতই একজন ধর্মোন্মাদ মানুষ, আপাতত তাকে বুঝিয়ে মেয়েটিকে তার বাড়িতে ফেরানোই আমার লক্ষ্য”।
হানিফ রাগী গলায় বললেন, “দুটো বই পড়ে বেশি জ্ঞানী হয়ে যাওয়া ভাল না। আল্লাহকে ভয় কর রাকিব মিয়াঁ। উনি চেয়েছেন বলেই মেয়েটা এ বাড়িতে এসেছে”।
রাকিব বললেন, “তুমি এখন এসো। আমার অনেক কাজ আছে। ক্লাস করানো আছে, অনেক কাজও আছে। এসব নিয়ে আমরা পরে কথা বলব, কেমন?”
হানিফ বললেন, “গেরুয়া পার্টি এলে কে বাঁচাবে তোমায় দেখব”।
রাকিব হাসলেন, “তুমি এসো। পরে কথা হবে। বললাম তো”।
হানিফ রেগে মেগে বেরিয়ে গেলেন।
রাকিব ল্যাপটপে ক্লাসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, শায়লা এসে বসলেন। রাকিব বললেন, “বল, তোমার কিছু বলার আছে?”
শায়লা বললেন, “আমরা এখন ঠিক কী করব?”
রাকিব বললেন, “আমার কলেজের ক্লাস করানো আছে। তুমি কী করবে বল?”
শায়লা বিরক্ত মুখে বললেন, “আমি সেটা বলি নি। তুমি নিজেও জানো আমি কী ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি”।
রাকিব বললেন, “রাত্রির ব্যাপারে বলবে তাই তো? মিটে যাবে। চিন্তা কোর না”।
শায়লা বললেন, “কীভাবে মিটবে?”
রাকিব বললেন, “আমি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলব। ভদ্রলোক একটু ঠান্ডা হোন। কথা বললে আশা করি বুঝবেন উনি”।
শায়লা বললেন, “তুমি নিশ্চিত জানো ওদের দুজনের পরস্পরের প্রতি কোন ফিলিংস নেই? যদি থাকে, তাহলে রাত্রিকে ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেও কিন্তু ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরী হতে পারে”।
রাকিব এবার চিন্তায় পড়লেন, “এটা তো ভেবে দেখি নি! এরকম হতে পারে? তাই তো! তখন কী করবে?”
শায়লা রেগে গেলেন, “তুমি ভেবে দেখো দয়া করে। এই জন্য তোমাকে আমার মাঝে মাঝে অসহ্য মনে হয়”।
রাকিব উঠলেন। ডাইনিং টেবিলে রাত্রি আর নীপা গল্প করছে। আরেকটু দূরে খাটের উপর বসে নাসিম মোবাইল ঘাঁটছে। রাকিব বললেন, “আমার রাত্রি আর নাসিমের কাছে একটা প্রশ্ন আছে। বাই এনি চান্স, তোমরা কি দুজন দুজনকে সত্যিই ভালবাসো? বিয়ে করতে চাও?”
নাসিমের হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল।
রাত্রি কাশতে শুরু করল।
শায়লা রাকিবের পিছনেই ছিলেন। তিনি চিৎকার করলেন, “এই, তুমি ক্লাস করাও গিয়ে। যাও। তোমাকে কোন সমস্যার সমাধান করতে হবে না”।
রাকিব শায়লার দিকে তাকালেন, “ভুল কিছু বলে ফেলেছি?”
শায়লা রাগে কাঁপছিলেন, বললেন, “তুমি নিজের কাজ কর দয়া করে। যাও”।
রাকিব বললেন, “তাই ভাল। আজ আবার আলোর গতিপথ পড়াতে হবে। কঠিন সাবজেক্ট। তুমি তাহলে দেখো ওরা কী চায়”।
রাকিব আর দেরী না করে লাইব্রেরীতে ঢুকে গেলেন।
১৪
‘স্বদেশীযুগে আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরে আত্মীয় বলিয়া, ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম। সেই স্নেহের ডাকে যখন তারা অশ্রু গদগদ কন্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারী রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই, আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না…। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সাথে সাথে এক হয় নাই তাহার কারণ তাদের সাথে আমরা কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীপা রাত্রিকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, “বাবার কথায় কিছু মনে কর নি তো? বাবা এমনিতে খুব যুক্তিবাদী মানুষ, কিন্তু এসব ব্যাপারে ছড়িয়ে লাট করে ফেলে”।
বলে নীপা হেসে ফেলল।
রাত্রি বলল, “কিন্তু কাকুর অ্যাপ্রোচটাকে আমার অনেস্ট মনে হয়েছে। যে সব মানুষ বেশি রাখ ঢাক করে কথা বলে, তাদের আমার অত ভাল লাগে না। কাজে এক আর মুখে আরেক করলেই বরং বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যা দেখা যায়। ঠিকই তো, আমি নাসিমকে ভালবাসি নাকি বা নাসিম আমাকে, সেটা না জানলে অনেক প্রশ্নের উত্তরই তো পাওয়া যাবে না”।
নীপা চোখ নাচাল, “তুমি দাদাকে ভালবাসো বুঝি? সত্যি?”
রাত্রি হেসে ফেলল, “ব্যাপারটা অত দূর কোন কালেই যায় নি। তবে আমি যেদিন থেকে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি, আমার ভাল লেগেছে। সেভাবে কোন ছেলে তো আমার জন্য প্যান্ডেমিকের সময় এরকম বাইক নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝাড়ি মারার ব্যর্থ চেষ্টা করে নি! অবশ্য প্যান্ডেমিকই বা হল কোথায়?”
নীপা বলল, “জানো তো, আমার মনে হয় প্যান্ডেমিকটা হয়ে একদিকে ভাল হয়েছে”।
রাত্রি অবাক হল, “এত লোক মারা গেল, তুমি ভাল বলছ কেন?”
নীপা বলল, “আমরা খুব ভয় পাচ্ছিলাম। শুধু এ দিক সেদিক থেকে কমিউনাল টেনশনের কথা শুনতে পারছিলাম। এ ভয়টা যে ঠিক কতটা ভয়, সেটা তুমি বুঝবে না”।
রাত্রি বলল, “অনেকটা বুঝব না হয়ত, তবে কিছুটা বুঝব। সারাক্ষণ ঘেন্নার চাষ হতে হতে মানুষের মধ্যে একটা চাপা রাগ তৈরী হয়। মানুষের কাজ নেই, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, রাজনীতিকরা আর কী করবে? এসবের উস্কানিতে মেরুকরণ হয়, ভোটের সমীকরণটাই পাল্টে যায়। আমরা যেটা বুঝতে পারি, দুঃখের ব্যাপার হল বড়রা অনেকেই বুঝতে পারে না। আমার হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটিওয়ালা ফোনটা থাকার আগের বাবা আর পরের বাবার মধ্যে অনেক তফাৎ। সারাক্ষণ শুধু আমরা ওরা করে চলেছে। এখন এসব করে কি সত্যিই কোন লাভ আছে”?
নীপা বলল, “ভয় না থাকুক, তবে আমাদের ওরা ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছে। আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি। যখনই পক্ষ তৈরী হয়ে যাচ্ছে, আমাদেরও আতঙ্ক শুরু হয়ে যাচ্ছে”।
কলিং বেল বাজল। শায়লা গিয়ে দরজা খুললেন। দেখলেন পুলিশের গাড়ি এসেছে। একজন ইন্সপেক্টর তার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করলেন, “নমস্কার, আমি থানা থেকে আসছি। এ বাড়িতে…”
শায়লা বললেন, “ভিতরে এসে বসুন”।
প্রসেনজিতকে ড্রইং রুমে বসিয়ে শায়লা রাকিবের লাইব্রেরীতে ঢুকে বললেন, “পুলিশ এসেছে। এবার তুমি সামলাও”।
রাকিব ক্লাস করাচ্ছিলেন।
শায়লার কথা শুনে বললেন, “ওহ। ঠিক আছে। যাও। আমি আসছি”।
শায়লা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। ঠিক যে যে দুঃস্বপ্নগুলো তিনি দেখেন, সেগুলোই যেন এক এক করে শুরু হয়ে গেল।
ছাত্রদের পরে ক্লাস নেবেন বলে ক্লাস শেষ করে রাকিব ড্রইং রুমে গেলেন। প্রসেনজিতকে দেখে বললেন, “রাত্রির জন্য এসেছেন?”
প্রসেনজিত বললেন, “হ্যাঁ। মেয়েটির বাবা মিসিং ডায়েরী করেছে। আমি খানিকটা মধ্যস্থতা করার জন্যই এসেছি। ভদ্রলোক থানায় গিয়ে এমন শুরু করেছেন যে না আসা ছাড়া উপায় ছিল না”।
রাকিব হেসে ফেললেন, “সেসব না করে কাল যখন ওর মেয়েকে দিয়ে আসতে গেছিলাম, তখন বেশি ঝামেলা না করে নিয়ে নিলেই পারতেন”।
প্রসেনজিত অবাক হলেন, “সেকী?”
রাকিব গোটা ব্যাপারটা বললেন। প্রসেনজিত বললেন, “অদ্ভুত তো, ভদ্রলোক কী চান? বাই দ্য ওয়ে, আপনার ছেলের সঙ্গে কি মেয়েটার সম্পর্ক আছে?”
রাকিব বললেন, “আমি এ ব্যাপারে একবারেই অন্ধকারে অফিসার। নিজেও জানি না ঠিক কী অবস্থায় আছে ব্যাপারটা। আপনি কি মেয়েটাকে নিয়ে যেতে এসেছেন?”
প্রসেনজিত বললেন, “মেয়েটি যেতে চাইলে আমি নিয়ে যেতে পারি। কোন অসুবিধা নেই”।
রাকিব নীপার ঘরে গিয়ে রাত্রিকে ডেকে আনলেন। রাত্রি বাইরে বেরিয়ে পুলিশ দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেল।
রাকিব বললেন, “তোমার বাবা থানায় গিয়েছিলেন। তুমি চাইলে ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরতে পারো। উনি মধ্যস্থতা করছেন”।
রাত্রি প্রসেনজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি একটু ভেবে নি? পরে জানাই?”
প্রসেনজিত বললেন, “নিশ্চয়ই। আমার নাম্বার রেখে যাচ্ছি। কোন অসুবিধা হলে জানাবেন”।
রাত্রি ঘাড় নাড়ল, “আচ্ছা”।
বাড়ির বাইরে ভিড় জমে গেছে।
প্রসেনজিত রাকিবকে বললেন, “আপনার সঙ্গে আলাদা করে একটু কথা বলব স্যার”।
রাকিব বললেন, “নিশ্চয়ই”।
রাকিব প্রসেনজিতকে লাইব্রেরীতে নিয়ে গেলেন।
প্রসেনজিত বসে বললেন, “মেয়েটির বাবা একটু বেশিই সক্রিয়। কমিউনাল টেনশন হতে পারে। আমি ব্যাপারটা দেখছি, তবে রাজনীতি ঢুকলে ব্যাপারটা কিন্তু জটিল হতে পারে। একটু সাবধানে থাকবেন”।
১৫
স্থানীয় নেতার বাড়িতে এই প্যান্ডেমিকের সময়েও বেশ ভিড়। প্রণয়কে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল। নেতাদের চামচ, হাতা, অনেক লোক থাকে। নেতা অনুপম প্রামাণিকের সামনে যখন বলার সুযোগ পেলেন, তখন ঘর ভর্তি লোক তার দিকে তাকিয়ে।
প্রণয় বললেন, “একটু প্রাইভেসী পাওয়া যাবে?”
অনুপম মুখে একটা পান ভরে বললেন, “পৃথিবীতে সবাই সবার জন্য দাদা। প্রাইভেসী বলে সত্যিই কি কিছু আছে? পায়খানা আর সেক্স বাদ দিয়ে কোন কিছুর প্রাইভেসী লাগে না। বলুন সবার সামনেই বলুন। আমরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ব আপনার জন্য। সেবার জন্যই তো আমরা বসে আছি দাদা”।
প্রণয় বললেন, “আমার মেয়েকে মুসলিম ছেলে প্রেম করেছে। লাভ জিহাদ। আমার বিচার চাই”।
অনুপম বললেন, “আপনার মেয়ের অমতে?”
প্রণয় বিরক্ত হয়ে বললেন, “আজব তো! অমতে কেন? ফুসলিয়ে বিয়ে করলে কি অমতে হয় নাকি? ফুসলানো মানে হচ্ছে ওকে ভুল বুঝিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। আর দেখুন, আপনারা পারলে বলুন, নইলে আমি গেরুয়া পার্টির কাছে যাব”।
অনুপম বললেন, “আপনার মেয়ের বয়স আঠেরো পেরিয়েছে?”
প্রণয় বললেন, “হু”।
অনুপম বললেন, “তাহলে আপনি গেরুয়া পার্টির কাছেই যান”।
প্রণয় বললেন, “কেন? আপনারা দুধেল গাইদের কিছু বলবেন না?”
অনুপম পানের পিক ফেলে ফেসে বললেন, “আপনি যদি তাই মনে করেন, তবে তাই। তবে গেরুয়া পার্টি হোক, আর যে পার্টিই হোক, আপনার মেয়ে যদি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে থাকে, তাহলে মোদিবাবু এসেও কিছু করতে পারবেন না”।
প্রণয় বললেন, “কেন পারবে না? এই মোল্লাদের জ্বালায় আমাদের একটা দেশ থেকে চলে আসতে হল। এখন এপারে এসেও এদের অত্যাচার সহ্য করতে হবে কেন?”
ঘরে বসে থাকা একজন বলল, “ও দাদা, আমিও মুসলমান। কী অত্যাচার করেছি আপনাকে? যা নয় তাই বলে গেলেই হল নাকি?”
অনুপম বললেন, “আপনি আসুন দাদা। এখানে উলটো পালটা বকলে ঝামেলা বাড়বে। তবে আমি একটা কথা আপনাকে খুব সিরিয়াসলি বলি, আগেও বলেছি, আরেকবার বলছি, আপনার মেয়ে যদি স্বেচ্ছায় কাউকে ভালবেসে থাকে, তবে আমাদের কিছু করার নেই, হ্যাঁ, আপনি বলুন”।
অনুপম পরের জনের দিকে তাকালেন।
প্রণয় রেগে মেগে অনুপমের অফিস থেকে বেরিয়ে স্থানীয় গেরুয়া পার্টির অফিসে গেলেন। পুরনো লোক বেশি কেউ নেই, সব বর্তমান শাসকদলের বিক্ষুব্ধ, নয়ত লাল পার্টির প্রাক্তন। ভোটে হেরে বিমর্ষ মুখে মুড়ি খাচ্ছিল। প্রণয়কে দেখে একজন বলল, “বলুন”।
প্রণয় বললেন, “আমার মেয়েকে মোল্লারা ফুসলিয়ে বিয়ে করেছে। লাভ জিহাদ। কিছু ব্যবস্থা করুন”।
সবাই সোজা হয়ে বসল। একজন বলল, “পাকিস্তানে পাচার করে দিয়েছে?”
প্রণয় বললেন, “না না। এখানেই আছে। আপনারা ব্যবস্থা করুন”।
একজন বলল, “আপনি ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়ে যান। জানেনই তো, এ রাজ্যে এদেরই দৌরাত্ম্য বেশি এখন। উত্তরপ্রদেশ কিংবা গুজরাট হলে আপনার মেয়েকে তুলে নিয়ে চলে আসতাম”।
প্রণয় বললেন, “আমি একজন দেশপ্রেমী। পি এম থালা বাজাতে বলেছিলেন বলে আমি থালা নিয়ে গোটা পাড়ায় ঘুরেছিলাম। নোট বাতিল হবার সঙ্গে সঙ্গে বাতিল নোট নিয়ে পাল্টাতে ছুটেছিলাম। ডিজেল পেট্রোল রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ে, আমি হাসিমুখে সে দাম দিয়ে সব কিনি। কারণ দাদানে কিয়া হোগা তো আচ্ছা হি হোগা। যে কোন সময় ডাকলে আমি বর্ডারে গিয়ে দশটা পাকিস্তানী মেরে আসতে পারি। আপনারা আমার মেয়েকে নিয়ে আসুন, আপনাদের কেনা গোলাম হয়ে থাকব”।
একজন হাঁ করে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কি ঠাট্টা করছেন না সত্যি বলছেন?”
প্রণয় বললেন, “সত্যি বলছি। আপনাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপেও আছি। যা যা আসে, সব ফরোয়ার্ড করি আমার বন্ধুদের”।
একজন বয়স্ক লোক বলল, “আমি এ অঞ্চলের দলীয় সভাপতি। আমার তো মনে হচ্ছে আমার থেকে আপনি বেশ ভালবাসেন দলটাকে। আনন্দে আমার চোখে জল এসে গেল। আপনি বাড়ি যান। আমরা দেখছি কী করতে পারি। তবে মোল্লারা খুব ডেঞ্জার জানেন তো, সব সময় অস্ত্র নিয়ে ঘোরে। নিরাপত্তার ব্যাপারটাও তো দেখতে হবে বলুন”।
প্রণয় বললেন, “যা পারেন করুন, আমার বিচার চাই”।
১৬
পার্টি অফিসে অক্সিজেন সিলিন্ডার এসেছে। ভলান্টিয়াররা একে একে জড়ো হয়েছে।
ঋপণ কাজ দেখছিল।
নাসিমকে ঢুকতে দেখে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলল, “কী রে, তুই নাকি কিসব কেচ্ছা করেছিস?”
নাসিম সবটা বলল। ঋপণ বলল, “মরেছে। তুই এসব কবে করলি?”
নাসিম হতাশ গলায় বলল, “আরে তুমিও দেখি বাবা মার মত শুরু করলে! আমি কেন করতে যাব? ব্যাপারটা পুরোটাই কাকতালীয়ভাবে হয়ে চলেছে”।
ঋপণ বলল, “তোর বাবা যখন আছেন, অতটা চিন্তা করছি না যদিও। তবে সাবধানে থাকিস। দিনকাল ভাল না। আমরা এখন শূন্য, পাওয়ারে নেই। লোকজন এন জি ও বলে ডাকছে, একটা জিনিস বুঝে নে ভাই, আমরা যতই যাই করি, লোকে আমাদের থেকে হেল্প নেওয়ার পরে দেখবি ঠিক মুখ মুছে ফেলবে। এদের ধর্মই এটা। যখন তুই জিতবি, তখন তোর সব ঠিক, যা ডিসিশন নিবি, সেটাই মাস্টারস্ট্রোক, আর যখন তুই হারবি, ঠিক কাজ করলেও সেটাই দেখবি ভুল করেছিলি। ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেল। তাছাড়া এত কম বয়েসে নিশ্চয়ই বিয়ে টিয়ের কথা ভাবছিস না?”
নাসিম লাজুক হাসল, “ধুস! কী যে বল!”
ঋপণ বলল, “ঠিক আছে। বাদ দে। তুই আমার সঙ্গে চল তো। পূর্ব পল্লীতে এক বাড়িতে এক বয়স্ক লোকের কোভিড হয়েছে। বাড়ির লোকেরা নাকি খেতেও দিচ্ছে না। অক্সিজেন মেপে কেসটা দেখে আসি চল। তুই পিপিই পরে নে”।
নাসিম বলল, “পিপিই পরার কী দরকার? আমি গ্লাভস আর মাস্ক পরে নিচ্ছি”।
ঋপণ ঘাড় নাড়ল, “একবারেই না। পরে নে। কোন রকম রিস্ক নিবি না। দুজন রেড ভলান্টিয়ার এর মধ্যেই মারা গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যা করছি ভুল করছি। কী দরকার ছিল, মানুষ তো ছুঁড়ে ফেলেই দিয়েছে। তার পর মনে হয় এভাবে পড়ে থাকবে মানুষ আর আমরা দেখে যাব তাও তো হয় না”।
ঋপণকে হতাশ দেখাচ্ছিল।
দুজনে পূর্ব পল্লী যখন পৌঁছল তখন দুপুর একটা বাজে। বাড়ির কলিং বেল বাজানোর পর একজন ভদ্রমহিলা দরজা খুলে তাদের দেখে বললেন, “পিছনের দরজা দিয়ে যাও ভাই। ওই ঘরে আছেন উনি”।
ঋপণ নাসিমকে বলল, “তাই চল”।
দুজনে পিছনের দরজা দিয়ে বাড়িটায় ঢুকল। ভদ্রলোক শুয়ে আছেন। চোখ মুখ বসে গেছে। ঋপণ থার্মাল গান দিয়ে ভদ্রলোকের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ে নাসিমকে বলল, “একশো দুই। অক্সিমিটারটা দে”।
নাসিম পকেট থেকে বের করে অক্সিমিটার দিল।
ঋপণ অক্সিমিটার দিয়ে ভদ্রলোকের অক্সিজেন মেপে বলল, “বিরাশি। কাকীমা, ও কাকীমা”।
ভদ্রমহিলা বাইরে থেকে সাড়া দিলেন, “বল”।
ঋপণ বলল, “কাকুকে হাসপাতালে দিতে হবে। অক্সিজেনের অবস্থা ভাল না। আপনারা কেউই কি কাছে আসছেন না?”
ভদ্রমহিলা কাঁদতে শুরু করলেন।
স্থানীয় হাসপাতালে একটাও বেড ছিল না। সব ব্যবস্থা করে কুড়ি কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে ভদ্রলোককে ভর্তি করে ঋপণ আর নাসিমের বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।
নাসিম বাড়ি ফিরে বাইরের টিউবওয়েলে স্নান করল। নীপা বারান্দা থেকে তাকে দেখে বলল, “রাজপুত্তুরের এত দেরী হল যে? রাজকন্যা তো চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে”।
নাসিম বালতি থেকে মগের জল মাথায় ঢালতে ঢালতে বলল, “এই ব্যাপারটা নিয়ে একদম ইয়ার্কি করিস না। ব্যাপারটা এত সোজা না”।
নীপা বলল, “কঠিনও তো না”।
নাসিম বলল, “কিছুই না। জল অনেক দূর গড়াবে। মেয়েটার বাবা এত সহজে ছেড়ে দেবে না”।
নীপা বলল, “সে তো প্রথম থেকেই বলে এলি। অথচ ঝাড়িও মেরেছিস”।
রাত্রি নীপার পিছন পিছন চলে এসেছিল।
নাসিমকে খালি গায়ে স্নান করতে দেখে সে পালিয়ে গেল।
নাসিম লজ্জা পেল, “তুই দরজাটা বন্ধ করবি না গাধা?”
রাত্রি হি হি করে হাসতে হাসতে ঘরের ভিতর চলে গেল।
স্নান করে জামা কাপড় পাল্টে বসার ঘরে গিয়ে নাসিম দেখল রাত্রি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সে বলল, “হাসির কিছু নেই। তোমার বাবা খুব ঝামেলা করছে। শুনলাম অনেক দূর যাবেন”।
রাত্রি বলল, “আমার খুব মজা লাগছে। সিরিয়াসলি। আর তুমি এক কথা বার বার বলছ কেন? বাবা কত দূর যাবে? মিয়াঁ বিবি রাজি তো ক্যা করেগা কাজি?”
নাসিম বলল, “মজা লাগার কিছু নেই। তুমি ফিরে যাও বরং। অনেক ঝামেলা বাড়বে নইলে। আর মিয়াঁ বিবি রাজি মানে কী? আমি রাজি টাজি না”।
রাত্রি বলল, “তাহলে বল তুমি আমায় ঝাড়ি মারতে দাঁড়াতে কেন?”
নাসিম গম্ভীর হয়ে বলল, “বাড়িতে অন্যরা আছে। এসব বোল না। বাবা মা শুনলে খারাপ ভাববে”।
রাত্রি বলল, “ওরা দুজনেই তো কোথায় বেরোলেন। নীপাও অন্য ঘরে। আচ্ছা শোন, একটা গান মনে পড়ে গেল”।
নাসিম বলল, “কী?”
রাত্রি বলল, “এই, তুমি কি আমায় ভালবাসো? যদি না বাসো, তবে পরোয়া করি না”।
নাসিম বলল, “পরোয়া কর না? আচ্ছা তুমি কি পাগল? কী ঘটনা, কতদূর চলে গেল বল তো?”
রাত্রি বলল, “আমার ভাল লাগছে। চল আমরা বিয়ে করে নি”।
নাসিম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
১৭
রাকিব এবং শায়লা ফিরলেন কিছুক্ষণ পরে। ওষুধ আনতে গেছিলেন দুজনে।
শায়লা তার ঘরে গিয়ে নীপাকে ডেকে পাঠালেন।
নীপা মার খাটে বসে বলল, “বল মা। কী হল?”
শায়লা বললেন, “তোর দাদার সঙ্গে কি সত্যি মেয়েটার কিছু আছে?”
নীপা বলল, “কেন বল তো মা? কী হয়েছে?”
শায়লা বললেন, “বাড়ির বাইরে থেকে শুনছিলাম তোরা খুব হাসাহাসি করছিলি। আমাকে সত্যি করে বল নীপা, তোরা কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছিস?”
নীপা ফিক করে হেসে বলল, “লুকোতে পারলেই ভাল হত। রাত্রিদি খুব ভাল বৌদি হবে”।
শায়লা বললেন, “আমাকে স্পষ্ট করে বল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সত্যিই কি কিছু আছে বুঝতে পারছিস?”
নীপা বলল, “আগে ছিল না। এখন হতেই পারে। হলে বাধা দিও না মা”।
শায়লা বললেন, “তুই থাম। তুইও হয়েছিস তোর বাবার মতন। বাস্তব বোধের বড্ড অভাব”।
নীপা বলল, “কোন কিছুর অভাব নেই মা। রাত্রিদি যদি ওর ধর্ম পালন করতে চায় করবে, আমরা আমাদের মত করে চলব। তাতে অসুবিধার কী আছে?”
শায়লা মাথা নাড়লেন, “তোদের কাউকেই বুঝিয়ে উঠতে পারছি না”।
নীপা বলল, “বুঝতে পারছিও না”।
বাড়ির বাইরে বাইকের হর্ন বাজার শব্দ হল। নীপা পর্দা সরিয়ে দেখল ঋপণ দাঁড়িয়ে আছে। শায়লা রাগী গলায় বললেন, “ওই দেখ, কৃষ্ণের বাঁশি বেজে উঠল। তার মানে তোর নাসিম এখন দৌড়বে। ক’টা বাজে দেখ”।
নীপা দেখল রাত ন’টা বাজে। বলল, “এই তো ফিরল”।
শায়লা বললেন, “ভোটের নামে দেখা নেই, এখন এক এই নতুন নাটক শুরু হয়েছে। সরকার কী করছে? যাদের ভোট দিয়েছে তারা কি কিছু করছে না? কোন দরকার ছিল না এসব করার। ছেলেটার যদি এখন কোভিড হয়, এরা দায়িত্ব নেবে? বুড়ো বুড়ো নেতাগুলো নিজেরা উপর মহলে আপোষ করে চলবে, আর ছোট ছেলেগুলো মার খেয়ে মরবে। আমি এর পরে নাসিমকে আর বেরোতে দেবো না। দেখ”।
নীপা বলল, “দাদাকে এসব বোল না মা। বাস্তবটা তুমি বুঝতে পারো হয়ত, কিন্তু দাদার মধ্যে যে ডেডিকেশনটা আছে, সেটা ভীষণ অনেস্ট। সেটাকে আঘাত কোর না”।
শায়লা ক্লান্ত গলায় বললেন, “আমার আর ভাল লাগে না কিছু”।
রাত্রি দরজায় নক করল।
নীপা বলল, “এসো এসো। খিদে পেয়েছে?”
রাত্রি শায়লার ঘরে ঢুকল।
নীপা রাত্রির হাত ধরে তাকে খাটে বসাল। নীপা বলল, “বললে না, খিদে পেয়েছে?”
রাত্রি বলল, “না না, ঠিক আছে”।
শায়লা বললেন, “নাসিম বেরিয়ে গেল?”
রাত্রি বলল, “হ্যাঁ, চলে গেল দেখলাম”।
শায়লা নীপাকে বললেন, “কখন ফিরবে দেখ। রাতে ফিরলে গরম জল করে দিস। হিন্দু বাড়িগুলো এখন মুসলমান ছেলেদের ঢুকতে দিচ্ছে রে? নাসিম মুসলমান জানলে যদি রেগে যায়?”
নীপা বলল, “আহ মা। এসব কী বলছো?”
রাত্রি বলল, “আমার বাবা জানলে বলত করোনায় মরে যাব তাও ভাল, মুসলমান যেন না ছোঁয়”।
বলে রাত্রি ফিক করে হেসে ফেলল। নীপাও হেসে উঠল।
শায়লা বললেন, “তোমার বাবা বুঝি মুসলমানদের দেখতে পারেন না?”
রাত্রি বলল, “আগে ছিল না। এখন হয়েছে। তবে বাবা যেমন কট্টর হিন্দু, এরকম কট্টর মুসলিমও আছে নাকি শুনেছি”।
শায়লা বললেন, “তা আছে। সব দিকেই কট্টর লোক আছে। তোমার মাও কি তোমার বাবার মতই?”
রাত্রি মাথা নাড়ল, “একবারেই না। আমার মা ওসব নিয়ে অতো ভাবে না”।
শায়লা বললেন, “কী আশ্চর্য না, একই দেশে এত বছর ধরে দুটো ধর্মের মানুষ আছে, অথচ এখনো পরস্পরকে কত অবিশ্বাস, এখনো কত আমরা ওরা”!
নীপা বলল, “এই রাত্রিদি, মা জানতে চাইছিল তোমাদের মধ্যে সত্যিই কিছু আছে নাকি?”
শায়লা রেগে গেলেন, “এই বাঁদর মেয়ে”।
নীপা হাসতে হাসতে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।
রাত্রি হঠাৎ লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে নীপার পিছন পিছন চলে গেল।
শায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই মেয়ে নাসিমকে ভালবাসে। চোখ কখনো মিথ্যা হতে পারে না।
আরো চিন্তায় পড়লেন তিনি।
১৮
রাত সাড়ে এগারোটা। নাসিম ফেরে নি।
শায়লা খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে শুয়েছেন। রাকিব লাইব্রেরীতে পড়তে বসেছেন।
নীপা আর রাত্রিও শুয়েছে।
নীপা বই পড়ছে। “কাউন্ট অফ মন্টিক্রিষ্টো”। আগে পড়া। তবু বার বার পড়তে ভাল লাগে।
রাত্রি চোখ খুলে ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল। তার খারাপ লাগার কথা। খারাপ লাগছে না। দিব্যি লাগছে। বাড়িতে বাবা সারাক্ষণ বিদ্বেষের কথা বলে যায়। একটা অদ্ভুত জগতে চলে গেছে বাবা। লকডাউনের ফলে বাড়িতে থেকে থেকে তার চিন্তাভাবনা আটকে গেছিল যেন। বই যে একটা অনেক বড় জানলা হতে পারে, সে ভুলতে বসেছিল। ঠিকই তো, ফোন কেন লাগবে? ওয়েব সিরিজ কেন লাগবে? বইয়ের থেকে বড় বন্ধু আর কে আছে? অথচ এই ব্যাপারটাই তো সে ভুলে গিয়েছিল!
নীপা তাকে একটা বই দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের “আজ আমি কোথাও যাব না”। দুপুরে পড়ে ফেলেছে বইটা। কেমন মায়াবী লেখা। পড়তে পড়তে কান্না চলে এসেছিল। বাবাকে বললে হয়ত বলত মোল্লাদের লেখা। দেখ প্রোপাগান্ডা লেখা। কে যে কখন কোন প্রোপাগান্ডায় জড়িয়ে পড়েছে, মানুষ নিজেই বুঝতে পারছে না আর।
সে বলল, “নীপা”।
নীপা বলল, “হু”।
রাত্রি বলল, “তোমার দাদা কখন ফিরবে?”
নীপা বলল, “কে জানে। নাও ফিরতে পারে”।
রাত্রি বলল, “তোমার বাবা কিছু বলেন না?”
নীপা বলল, “বাবা তো ইন্সপায়ার করে দাদাকে। সেটা দেখে মা আরো রেগে যায়। বাবা বলে, এখন আমাদের পরীক্ষা দেওয়ার সময় আমরা মানুষ তো? পৃথিবীতে অনেক জীব জন্তু এসেছিল, সময়ের সঙ্গে তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরকম কোন রোগেই হয়ত। মানুষ যদি মানুষের পাশে না দাঁড়াবে তো কে দাঁড়াবে? আমারও ইচ্ছা করে যেতে। বাবা বাধা দিত না। তবে মা এমন কড়া চোখে তাকাল, আমি আর যাই নি”। হেসে ফেলল নীপা।
রাত্রি বলল, “আচ্ছা”।
নীপা বলল, “জানো তো, দাদাকে আমিও অনেক খেপিয়েছি। তোরা শূন্য, কেন এসব করছিস। পাবলিক তোদের আর পাত্তাই দেয় না। দাদা বলে দলটা তো একটা মাধ্যম। কাজটা তো করা দরকার। কত মানুষের স্টিগমা ছিল গত বছর। কত মানুষের বাড়ির লোকই খেতে দেয় নি। এক ঘরে করে রেখে দিয়েছিল। এরা সেই সব কিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। দাদাকে যে নিতে এসেছিল, ঋপণদা, ও কিন্তু ছাত্র হিসেবে খুবই ভাল। ওর মাথাতেও একই পোকা। পাগলের মত এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। ওদের আবার একটা হেল্পলাইন খুলেছে। কে কোথায় খেতে পাচ্ছে না, কার অক্সিজেন দরকার, কাকে হাসপাতালে নিতে হবে, এক ফোনে ছুটে যাচ্ছে। হেরে গেছে তো কী হয়েছে বল, মানুষগুলো তো আমাদের দেশেরই। কেন যাবে না?”
রাত্রি বলল, “এরকম মহান ভাবনা ভাবা মানুষের আমায় ঝাড়ি মারতে দাঁড়াতে হল কেন তাই বুঝছি না”।
নীপা হেসে বলল, “আমি ছেলে হলে আমিও দাঁড়াতাম। তুমি ভারি মিষ্টি মেয়ে। পাগলীও আছো। কেমন নিশ্চিন্ত আছো, কান্নাকাটিও করছো না! আমি হলে তো দুঃখে পাগল হয়ে যেতাম!”
রাত্রি বলল, “তোমাদের বাড়ির পরিবেশটাই এমন, যে কেউ ঘরকুনো হয়ে যাবে। আচ্ছা, কাকীমার আমাকে পছন্দ না, তাই না?”
নীপা বলল, “মা চিন্তা বেশি করে। সব সময় মানুষের থেকে মুসলমান বলে হ্যাটাটা মেনে নিতে পারে না। কতবার আমাদের শুনতে হয়েছে ওহ, তোমরা মুসলমান? কথা শুনে তো বাঙালি বলে মনে হয়! ভাবখানা এমন, যে এখনই বোম টোম নিয়ে মানুষ মারতে বেরিয়ে যাব। লোকসভা ভোটের আগে যখন পুলওয়ামা কান্ড হল, আমাদের বাড়ির সামনে একটা দল এসে কী কুৎসিত কথা বার্তা শুরু করেছিল। তার উপর আমার দাদা লাল পার্টি করে। আমাদের চিনের দালাল, পাকিস্তানী, কত কিছু বলে গেল। দাদা মন খারাপ করেছিল। বাবা শুধু একটা কথাই বলেছিল। এরা যারা এই অসভ্যতাটা করে গেল, আমরা তাদের থেকে অনেক বেশি ভারতীয়”।
বাইকের শব্দ পাওয়া গেল। নীপা বলল, “দাদা এসছে বোধ হয়। চল দেখি। গরম জল করে দি। স্নান করবে এখন”।
রাত্রি সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল।
১৯
নাসিম স্নান করছে।
নীপা গরম জল দিয়েছে।
রাত্রি বারান্দায় যেতেই নাসিম নীপাকে বলল, “ওকে ঘরে যেতে বল”।
নীপা বলল, “থাক না। কী হয়েছে?”
নাসিম খিচিয়ে উঠল, “কী হয়েছে বুঝিস না? যেতে বল”।
নীপা বলল, “রাত্রিদি, দাদা তোমাকে ঘরে যেতে বলছে”।
রাত্রি বলল, “যাবো তো। তোমার দাদা কোথায় গেছিল জিজ্ঞেস করলে?”
নাসিম বলল, “কালকে বলব। এখন এই অবস্থায় বলা যাবে না”।
রাত্রি হাসতে হাসতে ঘরে চলে গেল।
নীপা বলল, “দাদা, রাত্রিদি তোর উপর পুরো লাট্টুরে। পুরো প্রেম কাহিনী হবে মনে হচ্ছে”।
নাসিম গা মুছতে মুছতে বলল, “তুই পড়াশুনা না করে এখন এসব শুরু করেছিস তো? আমি মাকে বলছি দাঁড়া”।
নীপা ঘাবড়ে গিয়ে তার ঘরে চলে গেল।
রাত্রি খাটে বসে পা দোলাচ্ছিল। নীপাকে দেখে বলল, “তোমার দাদা পুরো দেশোদ্ধার করে ফিরছে দেখছি”।
নীপা বলল, “হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করলেই দেখবে কত ফিরিস্তি দিয়ে দেবে”।
রাত্রি বলল, “সময় ভাল না। মাস্ক আর স্যানিটাইজার ঠিক ঠাক ইউজ করতে বোল। যখন কিছু হবে তখন কেউ দেখবে না। সবাই বলবে কেন গেছিল। মানুষ উপকার নিতে জানে, তার পরিবর্তে নিন্দা ছাড়া কিছু করতে জানে না”।
নীপা বলল, “খুব চিন্তা হচ্ছে বল তোমার দাদার জন্য?”
রাত্রি হাসল, “তা হচ্ছে। সব ভলান্টিয়ারদের জন্যই হচ্ছে। সত্যি ওরা অসাধ্যসাধন করছে। ওরা না থাকলে যে কী হত, কে জানে!”
নাসিম দরজা নক করল।
নীপা বলল, “আয় দাদা”।
নাসিম ঘরে ঢুকল।
রাত্রি বলল, “এলাকাতেই ছিলে না দূরে?”
নাসিম বলল, “এক পেশেন্টকে হাসপাতালে ভর্তি নিচ্ছিল না। সেফ হোমে ছিল এতদিন। হঠাৎ করে অক্সিজেন ফল করতে শুরু করেছে। বাড়ির লোক কান্নাকাটি করছিল। হাসপাতালে একটা ব্যবস্থা করা গেছে। অ্যাম্বুলেন্সে করে পৌঁছে দিয়ে এলাম”।
রাত্রি বলল, “মানুষ কখনো তোমার সামনে মারা গেছে?”
নাসিম বলল, “দুজন। কলকাতা নিয়ে যেতে গিয়ে তার মধ্যে একজন। তার বাড়ির লোক ছিল না গাড়িতে। শ্বাস কষ্ট হতে হতে গাড়িতেই মারা গেলেন”।
রাত্রি বলল, “হিন্দু না মুসলমান?”
নাসিম ম্লান হাসল, “হিন্দু। আর যে মানুষ অন্য সময়ে অচ্ছুৎ থাকে, রুগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় সেই অচ্ছুৎরাই নিয়ে যায়। এই দেখো না, আমি মুসলমান জানলে কত বাড়িতে ঢুকতেই দিত না, সেসব বাড়িতেও রুগীকে অক্সিজেন দিয়ে এসেছি। তখন আর অচ্ছুৎ থাকি নি”।
নীপা বলল, “বেশ করেছে। অচ্ছুৎ করে রাখাই ভাল তোকে। কোন কাজে আসিস না। একটা ঠিক করে প্রেমও করতে পারলি না এদ্দিনে”।
নাসিম চোখ পাকাল।
রাত্রি নাসিমকে বলল, “ওহ, তুমি এতদিনে একটাও প্রেম করতে পারো নি?”
নাসিম বলল, “নীপা ছোট। ওর সামনে এসব কথা বলবে না”।
নীপা বলল, “বেশ তো, আমি অন্য ঘরে চলে যাচ্ছি। তোরা কথা বল”।
নাসিম বলল, “কোন দরকার নেই। তোর সময় ঘনিয়েছে। খুব মার খাবি তুই”।
রাত্রি নীপার হাত ধরে বলল, “কেন, ও মার খাবে কেন? তুমি ওকে মারো নাকি?”
নীপা বলল, “ধুস, ও মারতে পারে নাকি? ও খালি ভয় দেখায়। আর মাঝে মাঝে চকলেট খাওয়ায়”।
রাত্রি বলল, “চকলেট খাওয়ায়? কোই, আমায় খাওয়ালো না তো?”
নীপা বলল, “কী রে দাদা, তোর তো উচিত ছিল রাত্রিদির জন্য চকলেট আনা। আনিস নি কেন?”
নাসিম বলল, “মাঝরাতে তোর রাত্রিদির জন্য তো সব দোকান খুলে রেখেছে। এমন সব কথা বলিস না!”
শায়লা ঘরে ঢুকলেন। নীপা সঙ্গে সঙ্গে খাটে শুয়ে পড়ল। শায়লা নাসিমকে বললেন, “এত রাতে এসে হাসি ঠাট্টা করছিস কেন? গিয়ে ঘুমিয়ে পড়”।
নাসিম বলল, “হ্যাঁ যাচ্ছি”।
শায়লা রাত্রির দিকে তাকালেন, “তুমি ঘুমিয়ে পড়। এত রাতে জাগতে নেই”।
রাত্রি ঘাড় নাড়ল, “আচ্ছা”।
শায়লা নাসিমের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
২০
প্রণয়কে তনয়া ঠিক চিনতে পারেন না আজকাল। অন্ধ মুসলিম বিদ্বেষী কথাবার্তা বলা শুরু করেছিলেন বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। কিন্তু রাত্রি চলে যাওয়ার পর থেকে কেমন পাগলের মত করছেন। এক জায়গা থেকে ঘামতে ঘামতে এসে আরেক জায়গায় ছুটছেন।
তনয়ার দিদি রুমা খবর পেয়ে ফোন করেছিলেন, “কী হয়েছে বল তো আমায়”?
তনয়া সবটা বললেন।
রুমা বললেন, “সে কী? এত কিছু হয়ে গেছে, অথচ তুই আমায় এখন জানাচ্ছিস?”
তনয়া ধরা গলায় বললেন, “কী জানাবো বল তো? এটা জানানোর ব্যাপার? তার উপরে ওর বাবা যা শুরু করেছে, আমি আরো পাগল হয়ে যাবো”।
রুমা বললেন, “ছেলেটার সঙ্গে রাত্রির প্রেম আছে? রাত্রি তো সারাদিন ঘরেই থাকে দেখেছি। এটা সেটা রান্না করছে, ফেসবুকে ছবি দিচ্ছে, সে এসব করে ফেলল? অথচ আজকালকার দিনের ছেলে মেয়েরা কখন কী করছে, কিছুই বোঝা সম্ভব না, তবু আমার কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না রাত্রি জড়িয়ে পড়ল কী করে। তোদের ওদিকে মুসলমান আছে নাকি?”
তনয়া বললেন, “আমি কিছু জানি না”।
রুমা বললেন, “বিয়ে হয়ে গেছে?”
তনয়া বললেন, “জানি না”।
রুমা বিরক্ত হয়ে বললেন, “জানি না বললে কী করে হবে? মেয়েটা তোর। তোর অনেক আগে জানানো উচিত ছিল। নাকি সারাদিন কেঁদেই মরছিস?”
তনয়া বললেন, “তুই যদি প্রণয়কে দেখতিস, তাহলে বুঝতিস আমি কেন কাউকে কিছু বলছি না। একাই যা শুরু করেছে…”
রুমা বললেন, “তা তো করারই কথা। মেয়ে পালিয়ে গেলে বাবা মা করবে না?”
তনয়া বললেন, “টেকনিকালি পালিয়ে গেছে বলা যাবে না হয়ত। ওর বাবা যা শুরু করেছে, মেয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। ওরা তো দিতেও এসেছিল রাত্রিকে। ওর বাবা আবার ভ্যানতাড়া শুরু করল”।
রুমা বললেন, “আমি এখন উত্তরপাড়া থেকে কী করে যাই বল তো? ট্রেন বাস সব বন্ধ”।
তনয়া বললেন, “ফোনে খবর দেবো। আসার দরকার নেই। যা সর্বনাশ হবার, আমার মনে হয় হয়েই গেছে”।
রুমা বললেন, “রাত্রি ফোন করে নি? কান্না কাটি করে না তোর জন্য? বলে না, মেয়ে কখনো আপন হয় না?”
তনয়া থমকে গিয়ে বললেন, “রাখছি এখন। পরে কথা বলব”।
ফোন কেটে দিলেন তনয়া। বাইরের ঘরে প্রণয় কাকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ফোন করছেন।
কিছুক্ষণ পর তার ঘরে এসে বললেন, “এবার বুঝবে। আমি অনেক উপর মহলে খবর দিয়েছি। এরা পাতি বাঙালি না। একদম অবাঙালি ভেজ খাওয়া হিন্দু। মোল্লাদের দাপট বের করে দেবে দেখবে। কাল ভোরেই আসবে সব”।
তনয়া বললেন, “অবাঙালি ভেজ খাওয়া হিন্দু গুন্ডা?”
প্রণয় বললেন, “একদম গুণ্ডা বলবে না। গুণ্ডা আবার কী? ধর্ম রক্ষা করছে। এরকম লোকেদেরই তো দরকার ছিল। ছ্যা ছ্যা, লোকাল যারা আছে, তারা একবারে অপদার্থ। আমি বললাম আপনাদের এত এত লোক সাপোর্টার আছে, চলুন, তাদের নিয়ে গিয়ে একবারে শিক্ষা দিয়ে আসি। আমায় বলে কী না, ওদের এক হাজার সাপোর্টার হলে ন’শো নাকি ফেক প্রোফাইল। একটা লোক ন’টা প্রোফাইল চালায়। আর বেশিরভাগই কেউ বাংলাদেশে থাকে, কেউ বা বিদেশে। এভাবে এরা ধর্ম রক্ষা করতে নেমেছে। ছি। তারপরে অনেক কিছু ঘেঁটে এক্কেবারে হেড অফিসে ফোন করলাম। এবার ব্যাটারা বুঝবে কত ধানে কত চাল। হু! লাভ জিহাদ করবে! আমার মেয়েকে ফুসলিয়ে বিয়ে করে নিয়ে যাবে! দেখিয়ে দিচ্ছি”।
তনয়া ভয় পেলেন, “তুমি কি গুণ্ডা ভাড়া করেছো?”
প্রণয় বললেন, “তুমি দেখে নিও কী ভাড়া করেছি”।
তনয়া আর কিছু বললেন। রাতে খেলেন না। মেয়ে যাবার পরে খাওয়া ত্যাগ করেছেন। তবে প্রণয় সেটা বোঝেন নি। তিনি সারাক্ষণ লাফ ঝাঁপ দিয়ে যাচ্ছেন।
রাতটা দুঃস্বপ্ন দেখে কাটল তনয়ার।
সকাল আটটা নাগাদ দেখলেন বাড়ির সামনে একটা টাটা সুমো দাঁড়াল।
সে গাড়ি থেকে সাত আটজন তিলক কাটা লোক তাদের বাড়িতে এসে কলিং বেল বাজালো।
প্রণয় লাফাতে লাফাতে দরজা খুলতে ছুটলেন।
২১
রাত্রির ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল।
হঠাৎ করে বাবা মার জন্য মন কেমন করছে তার। নীপা শুয়েছিল।
ডাকল না। সে চুপ করে শুয়ে থাকল।
বাবা যেমনই হোক, তারই তো বাবা। চোখের সামনে লোকটা পাল্টে গেল। ছোট থাকতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কিছু চাইলে বাবা কখনো না করতে পারতো না। রাত্রির ইচ্ছে হচ্ছিল এক ছুটে বাড়িতে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে।
এভাবে তাকে পর করে দিতে পারবে না নিশ্চয়ই।
আর তার মা কী করছে এখন? নিশ্চয়ই ঘুমোয় নি!
রাত্রির মাকে ফোন করতে ইচ্ছা করছিল।
ঠিক করল দশটার দিকে ফোন করে নেবে।
অজান্তেই তার দু চোখ কখন অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল বুঝতে পারে নি সে।
আবার চোখ বুজতে ঘুম চলে এল।
ভাঙল প্রবল চিৎকারে।
ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল ঘরে কেউ নেই।
জানলার পর্দা সরিয়ে দেখল বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবার চিৎকার ভেসে আসছে।
রাত্রি বেরোল।
দেখল বেশ কয়েকজন লোক এসে জড়ো হয়েছে। প্রণয় চিৎকার করছেন, “আমি বুঝে নেব। সব ক’টাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেব। বুঝে নেব”।
রাকিব চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। শায়লা ফ্যাকাসে মুখে একটা চেয়ারে বসে আছেন। তার হাত পা কাঁপছে। নীপা এক কোণে দাঁড়িয়ে প্রবল ভাবে হাসি চাপার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সিরিয়াস সময়ে হাসি পাওয়ার রোগ তার বরাবরের। পাড়ার লোক জড়ো হচ্ছে। এ পাড়া মুসলমান প্রধান। প্রণয়ের সঙ্গে গাড়িতে আসা লোকগুলোর হাব ভাব রাত্রির মোটেও সুবিধার লাগল না। বাবার আচরণে সে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল।
সে তাড়াতাড়ি প্রণয়ের কাছে গিয়ে বলল, “বাবা! তুমি বাড়ি যাও”।
প্রণয় থমকে গেলেন। তার দিকে থতমত হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
রাত্রি বলল, “এরা কারা? কাদের নিয়ে এসেছো?”
প্রণয় বললেন, “তোকে ওরা জিন দিয়ে বশ করেছে। তুই জানিস না। মোল্লারা জিন পোষে”।
রাত্রি বলল, “তোমার মাস্ক কোথায় বাবা?”
প্রণয় বললেন, “তুই গাড়িতে ওঠ। তোকে গঙ্গা স্নান করিয়ে ঘরে তুলব। তোর শুদ্ধিকরণ হবে। এখনো কিছু শেষ হয়ে যায় নি”।
একজন টাক মাথা গেরুয়াধারী বলল, “সব হো জায়েগা। ও কোই বাত নেহী। চলো বেটি”।
রাত্রি বলল, “আমি কোথাও যাব না। তুমি ঠিক না হলে আমি আর বাড়িও ফিরব না বাবা। কে জানে কাদের নিয়ে এসেছো, এদের গাড়ি চড়ে এসেছো তুমি? কারো ভিতরে যদি ভাইরাস থাকে?”
দশ বারো জন লোক ভিড় ঠেলে এসে বলল, “কী হচ্ছে এখানে? এ পাড়ায় গুন্ডামি করতে এলে ঠ্যাঙ ভেঙে দেব”।
রাকিব বললেন, “এটা আমার ব্যাপার। পাড়ার লোক আসবেন না কেউ দয়া করে”।
রাত্রি বলল, “তুমি যাও বাবা। এখানে থেকো না। যাদের নিয়ে এসেছো তাদের নিয়ে চলে যাও”।
রাকিবের বারণ সত্ত্বেও পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠল। গাড়ির থেকে লাঠিসোটা বেরোতে শুরু করল।
প্রণয় রাকিবের দিকে ছুটে গেলেন, “কী করেছিস আমার মেয়েকে তোরা? কী খাইয়েছিস? মোল্লা কাটার বাচ্চা, তোদের পাকিস্তানে না পাঠানো পর্যন্ত শান্তি নেই আমার”।
রাত্রি বুঝল প্রণয় যা শুরু করেছেন, তাতে সে যতক্ষণ না গাড়িতে উঠবে, এলাকা তত উত্তপ্ত হতে শুরু করবে। নাসিমদের পরিবারের উপরে তত চাপ বাড়তে থাকবে।
রাত্রি বাবার হাত ধরল, “কী চাও তুমি? আমি বাড়ি গেলেই হবে তো? চল”।
প্রণয় বললেন, “গাড়িতে ওঠ”।
রাত্রি রাকিবের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল।
প্রণয় আরো এক দফা চিৎকার করে গাড়িতে উঠলেন।
গাড়ি স্টার্ট দিতেই গাড়িতে বসারা বাকিরা চিৎকার করে স্লোগান দিতে শুরু করল।
রাত্রি দেখল রাকিব নিশ্চুপ হয়ে তাদের চলে যাওয়াটা দেখছেন।
একজন ড্রাইভারকে হিন্দিতে বলল গ্রাম পেরিয়ে কোন ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াতে। শুদ্ধিকরণ করতে হবে রাত্রির।
রাত্রি কিছু বলল না। তার চোখ ফেটে জল আসছিল।
২২
মফস্বল আর গ্রামের মধ্যে একটা বড় মাঠের ব্যবধান। মাঠের কোণে একটা বড় পুকুর।
পুকুরের পাড়ে গাড়ি দাঁড় করানো হল।
প্রণয় রাত্রিকে বললেন, “যা, স্নান করে আয়। পূজারীজি পুজোর আয়োজন করছেন। তোকে শুদ্ধ করে ঘরে তোলা হবে”।
রাত্রি পাথর হয়ে বসে থাকল। প্রণয় বললেন, “কী হল? কানে যাচ্ছে না কথা? যা বলছি কর”।
রাত্রি বলল, “আমাকে বাড়ি নিয়ে গেলে চল। রাস্তাঘাটে কোন রকম নাটক আমি করতে পারবো না”।
প্রণয় গম্ভীর গলায় বললেন, “নাটক না। যা করতে বলছি কর”।
রাত্রি বলল, “পারব না”।
একজন গাড়ির বাইরে থেকে হিন্দিতে বলল, “বাইরে এসো বেটি। স্নান করে গো মূত্র আর গোময় দিয়ে তোমাকে শোধন করে দেব আমরা”।
রাত্রি বলল, “মরে গেলেও আমি গোবর খেতে পারব না”।
প্রণয় বললেন, “খেতে পারবি না মানে কী? মোল্লাদের বাড়ির ভাত যখন খেতে পেরেছিস, গো মূত্রও খেতে পারবি। তুই কি জানিস গো মূত্র কত পবিত্র?”
রাত্রি ঘেন্নায় নাক মুখ কুঁচকে বসে রইল।
প্রণয় বললেন, “তুই যদি এখন এখানে বসে থাকিস, তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না”।
রাত্রি বলল, “তোমার থেকে খারাপ আমি আর কাউকে দেখছিও না বাবা। এমন কি এই যাদের নিয়ে এসেছো, তাদেরও তোমার থেকে ভাল লাগছে। কী করবে তুমি? মেরে ফেলবে? মেরে ফেললে মেরে ফেলো”।
প্রণয় ভুল হিন্দীতে বাকিদের বলল, “আমার মেয়েকো তুকতাক করা হ্যায়। জিন উঠা বসা হ্যায় মেরে মেয়েকা আন্দর। ইসে বাচাও”।
একজন পুকুর থেকে জল নিয়ে এসে রাত্রির গায়ে ছুঁড়ে মারল।
রাত্রি গাড়ি থেকে নামতে গেলে সবাই জোর করে গাড়ির দরজা ধরে দাঁড়াল। প্রণয় রাত্রির দু হাত শক্ত করে ধরলে একজন চামচ করে গোবর আর গোমূত্র খাইয়ে দিল রাত্রিকে।
রাত্রি গন্ধের চোটে বমি করে ফেলল।
একজন মন্ত্র পড়ে প্রণয়কে বলল মেয়ের শুদ্ধিকরণ হয়ে গেছে।
প্রণয় ভারি খুশি হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর তাদের বাড়ির সামনে রাত্রি যখন নামল, পাড়ার লোকেরা দেখল জামায় বমি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাত্রি বাড়ির ভিতরে ঢুকল।
যে সব লোকজনেরা এসেছিল, তাদের প্রণয় একপ্রকার জোর করে টাকা দিলেন। তারা স্লোগান দিতে দিতে গাড়ি নিয়ে বিদায় নিল।
তনয়া চুপ করে বসার ঘরে বসে ছিলেন এতক্ষণ। রাত্রির অবস্থা থেকে শিউরে উঠলেন। দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে ধরলেন।
রাত্রি মরা মাছের চোখ নিয়ে মাকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল।
তনয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “বাথরুমে যা”।
রাত্রি ধীর পায়ে বাথরুমে গেল।
তনয়া প্রণয়কে বললেন, “এটা কী করেছো তুমি?”
প্রণয় আলেকজান্ডারের মত হাব ভাব করে বললেন, “কী করলাম বুঝলে না? বিধর্মীদের হাত থেকে নিজের মেয়েকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলাম। এ যে কত বড় কাজ করলাম, তা তুমি কী করে বুঝবে? আমি দেখি নি, মেয়েটাকে কী শিখিয়েছো কে জানে? মোল্লাদের বাড়ি থাকতে চলে গেছে নাকি! ছি ছি ছি! লজ্জার ব্যাপার!”
রাত্রি বাথরুমে শাওয়ার ছেড়ে বসে রইল।
গা ঘিন ঘিন করছে। যত বার তার মনে পড়তে লাগল সে গো মূত্র আর গোবর খেয়েছে, তার বমি হতে লাগল। বার বার বমি করতে শুরু করতে করতে সে অজ্ঞান হয়ে গেল।
তনয়া সাত তাড়াতাড়ি মেয়ের জন্য রান্না বসিয়েছিলেন। মেয়ে বাথরুম থেকে বেরোচ্ছে না দেখে তনয়া দরজা ধাক্কালেন।
দরজা খুলল না। রাত্রির সাড়াও পাওয়া গেল না। তনয়া একটুও অপেক্ষা না করে পাড়ার লোকজনকে ডেকে বাথরুমের দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করলেন।
রাত্রিকে যখন তুলে ঘরে নিয়ে আসা হল, ততক্ষণে রাত্রির তুমুল জ্বর এসে গেছে।
“ও বাবা, আমাকে ওসব খাইও না বাবা, আমি গোবর খাব না”, রাত্রি ক্রমাগত এই কথাটাই বলে যেতে থাকল। প্রণয় ছাদে উঠে বিভিন্ন জায়গায় হোয়াটস অ্যাপ করে তার বিজয় সংবাদ দিচ্ছিলেন। ছাদ থেকে নেমে যখন দেখলেন পাড়ার অনেক লোক তার বাড়িতে এসেছে, তখন তার টনক নড়ল। ঘরে এসে রাত্রিকে শুয়ে থাকতে দেখে তনয়াকে বললেন, “কী হচ্ছে বল তো?”
তনয়া বললেন, “বুঝতে পারছো না কী হয়েছে? নিজের মেয়েকে বুঝতে পারছো না? ওকে না, তুমি বরং নিজেকে জিজ্ঞেস কর, তোমার কী হয়েছে?”
তনয়া ভীষণ চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করায় প্রণয় বেগতিক বুঝে বাড়ি থেকে পালালেন।
পাড়ার কয়েকজন মহিলা থেকে গেলেন তনয়ার সঙ্গে। জলের ঝাপটা দিয়ে অনেক কষ্টে রাত্রিকে সামলানো গেল। একজন বমির ওষুধ খাইয়ে দিলেন।
রাত্রি কাঠের মত খাটে শুয়ে থাকল। তার সমস্ত প্রাণশক্তি কে যেন শুষে নিয়ে গেছে…
২৩
নাসিমকে ভোর বেলায় ডেকে নিয়ে গেছিল ঋপণ। পর পর তিনটে বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার কাজ ছিল। পিপিই পরে অক্সিজেন সিলিন্ডার বয়ে নেওয়া খুব পরিশ্রমের কাজ। মাস্ক খুলতে একবারে বারণ করে দিয়েছেন ডাক্তারবাবুরা। তারা জানিয়েছেন, এই ভাইরাসের আগ্রাসন এতটাই ভয়ংকর, মাস্ক খোলার সঙ্গে সঙ্গে এটা শরীরে প্রবেশ করে ফেলবে। ফোন অফ করে পকেটে রাখা ছিল।
শেষ বাড়িটায় অক্সিজেন দিয়ে এসে পার্টি অফিসে এসে পিপিই খুলে হাত মুখ ধুল সে। ঋপণ বলল, “চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি। আবার ডাকলে তুলে নেবো। কাল রাতেও তো সেভাবে ঘুমোতে পারিস নি”।
নাসিম বলল, “হ্যাঁ। দিয়ে এসো”।
সে খানিকটা উতলাও হয়ে যাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে রাত্রিকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। ভাল লাগা তৈরী হয়ে গেলে সেটা ডালপালা মেলতে বেশি সময় নেয় না। শত কাজের মধ্যেও রাত্রির মুখটা সঞ্জীবনীর মত কাজ করছিল।
ঋপণ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল, “তোর লাভ স্টোরি কত দূর?”
নাসিম হাসল, “ধুস, কী যে বল। লাভ স্টোরির কিছু নেই”।
ঋপণ বলল, “শোন ভাই, কমিউনিস্ট হয়েছিস, বুক বাজিয়ে বলবি, হ্যাঁ ভালবাসি। কিছু ভুল ভাল পাবলিক কমিউনিজম শেখানোর নামে মামণিদের ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে একবারে বদনাম করে ছেড়ে দিল মাইরি। একটা মেয়েকে ঠিক করে প্রপোজও করতে পারলাম না এই ভয়ে। কে কখন কী বলে দেবে”।
নাসিম বলল, “ফাঁকা ফ্ল্যাটে লেনিন। হা হা”।
দুজনে হাসতে লাগল। ঋপণ বলল, “সব থেকে মজার ব্যাপার হল, লোকের ধারণা লাল পতাকা থাকলেই আমাদের পার্টি। অসংখ্য পাবলিক আছে, আর কিছু আঁতেল অতিবিপ্লবী অতি বামপন্থীও আছে যারা মাঝে মাঝেই অ্যান্টি ইন্ডিয়ান কথা বলে। সমস্যা হল, এইগুলোর বিল আমাদের নামেই কাটা হয়”।
নাসিম বলল, “আর প্রতি বছর দেখবে মরিচঝাপির মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। হোক, শূন্য হয়েছে। ভোটও শূন্য হোক। আমরা একবারে শুরু থেকে শুরু করি। সেটাই দরকার”।
ঋপণ বলল, “হ্যাঁ। অনেক খেটেছি ভোটে ভাই। ভোটের পরেও দেখছি। পাবলিক আমাদের ওই এন জি ওই ভাবছে। কেউ কেউ বলছে যা যা পাপ করেছে তোদের সিনিয়ররা, এখন মানুষের কাজ করে সেগুলোর প্রায়শ্চিত্ত কর। মাইরি, কী মজা লাগে। চোর চিটিংবাজদের মাথায় তুলে নাচবে, রেপিস্টদের হিরো বানাবে, আর সব দোষ নাকি আমাদের ছিল। আসলে কী হয়েছিল বল তো, ক্ষমতায় থাকার সময় পার্টি থেকে অসংখ্য অযোগ্য লোককে চাকরি দিয়েছিল। এরা সব সুবিধা নিয়ে নিয়েছে। এখন দেখছি এক জায়গা থেকে তো সব পেয়ে গেছি, এবার পাল্টি মেরে দেখি অন্য জায়গা থেকে কী কী পাওয়া যায়। দিন সবার ফুরোয় একদিন”।
নাসিম বলল, “ধুস, তুমি ফ্রাস্ট্রু হয়ে যাচ্ছো। এক কাজ কর তাহলে। ভলান্টিয়ারগিরিটাই বন্ধ করে দাও। কেন করছো?”
ঋপণ হাসল, “কেন করছি? অ্যায়সে হি, সেক্সি লাগ রহা হে। শহরের মানুষ বুঝবে না, আমাদের গ্রামগুলোতে রেড ভলান্টিয়াররা না থাকলে কত সমস্যা তৈরী হত। আমার বাবাকেই দেখ, বাড়ি গেলেই গজগজ শুরু করে, কেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছি। নিজে এদিকে পার্টির দয়ায় চাকরি পেয়েছিল। সবাই কি আর রাকিবকাকুর মত হয়? এই সব মিটলে রাকিবকাকাকে বলব আমাদের ক্লাস নিতে। শিক্ষাটা ভীষণ দরকার। আগে নাকি ক্লাস হত, রীতিমত সব ধরণের লিটারেচার পড়তে হত। কেন এখনো সাম্যের কথা বলা উচিত, মানুষকে না বোঝালে মানুষ কেন বুঝতে যাবে? একটা ছোট ছোট শহরে এখন কোন বড় রিটেল কোম্পানি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুললে দেখবি লোকে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাইন দিচ্ছে। ছোট ছোট দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোভিডের ফলে অসংখ্য মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে। এক সময় তো এই মানুষগুলোর কথা কমিউনিস্ট পার্টিই বলতো। এখন কেন বলছে না? শুধু ইলেকশনের সময় জোট করে লাফঝাপ করলেই হবে?”
নাসিমদের বাড়ির সামনে ঋপণ বাইক নিয়ে দাঁড়াল। বাড়ির সামনে পাড়ার লোকজন ভর্তি। ঋপণ বলল, “কী হল আবার?”
নাসিম দেখল রাকিব পাড়ার মানুষদের কিছু বোঝাচ্ছেন। সে নীপাকে দেখে বলল, “কী হয়েছে রে?”
নীপা বলল, “রাত্রিদিকে ওর বাবা এসে নিয়ে গেছে। গাড়ি ভর্তি করে লোকজন নিয়ে এসেছিল”।
নাসিমের মন খারাপ হয়ে গেল।
২৪
“বিয়ে হয়ে গেছে নাকি দিদি?”
পাশের বাড়ির এক মহিলা তনয়াকে জিজ্ঞেস করলেন। রাত্রিকে শুইয়ে দিয়ে বাইরের ঘরে এসে বসেছেন তনয়া। পাড়ার মহিলারা ছেঁকে ধরেছেন তাকে। করোনার জন্য এতদিন বাইরে বেরনো হয় নি। এখন একটা মশলাদার কেচ্ছা পাওয়া গেছে। স্থির জলে ঢিল পড়ার মত সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
তনয়া মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “না”।
পেছন থেকে কে ফিসফিস করে বলল, “ওরকম তো এখন বলতেই হবে। এবার চেনা জানার মধ্যে বিয়ে দিলে চলবে না। বাইরের ছেলে খুঁজতে হবে। জানলেই তো চিত্তির”।
তনয়া ক্লান্ত গলায় বললেন, “তোমরা বরং এখন যাও। আমার কাজ আছে”।
ফিসফিস করতে গিয়ে সবাই বেরোল।
তনয়া বাইরের দরজা বন্ধ করে এসে মেয়ের কাছে গিয়ে বসলেন।
কপালে হাত দিলেন। জ্বর এসেছে। আলতো স্বরে ডাকলেন, “মা। ভাল লাগছে এখন?”
রাত্রি কেঁপে উঠল একবার।
তনয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর রাত্রি ঘুমিয়ে পড়ল।
তনয়া ভাত বসালেন। মেয়েটাকে খাওয়াতে হবে। খালি পেটে থাকলে সমস্যা আরো বাড়বে।
বাড়ির বাইরে লোক নেই দেখে প্রণয় ঢুকলেন কিছুক্ষণ পরে। তনয়া দরজা খুললে তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় সে?”
তনয়া উত্তর না দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন।
প্রণয় রান্নাঘরের দরজার বাইরে ঘুর ঘুর করতে করতে বললেন, “ঠিক হয়েছে এখন?”
তনয়া উত্তর দিলেন না।
প্রণয় কিছুক্ষণ নিজের মনে বিড়বিড় করে টিভি চালিয়ে বসলেন।
তনয়া রান্না করে রাত্রির কাছে নিয়ে গেলেন।
ভাল জ্বর এসে গেছে রাত্রির। তনয়া রাত্রিকে কোন মতে তুলে খাওয়াতে গেলেন। খানিকটা খেয়ে হড় হড় করে বমি করে দিল রাত্রি।
তনয়া রাত্রির বমিটা থালায় নিয়ে এসে ড্রইং রুমের টেবিলে রেখে প্রণয়কে বললেন, “এ নাও। মেয়ে বমি করছে। জ্বর এসেছে। কী করবে কর”।
প্রণয় বললেন, “কী করব মানে? আমি কী করব? ডাক্তার ডাকছি, এসে দেখে যাক”।
তনয়া বললেন, “তুমি ওকে গোমূত্র আর গোবর খাইয়েছো? এটা করলে সব দোষ চলে যাবে? কে শিখিয়েছে তোমায়? কে বলে দিয়েছে এগুলো করলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে?”
প্রণয় কোন দিন তনয়াকে এভাবে কথা বলতে দেখেন নি। খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েও সামলালেন নিজেকে, “কে বলেছে মানেটা কী? শুদ্ধিকরণ করতে হয় না? মোল্লাদের বাড়িতে থেকেছে, খেয়েছে, একবারে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে ঘরে ঢুকিয়েছি। এবার আর কেউ কিছু বলতে পারবে না”।
তনয়া বললেন, “কেউ কিছু মানে? কেউটা কে? আমার তো মনে হয় এই কেউ সব থেকে বেশি তুমি! পাগলের মত কাজ করে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তাড়ালে। তারপর কতগুলো গুণ্ডা জড়ো করে মেয়েটাকে নিয়ে চলে এলে। এবার মেয়ের যদি কিছু হয়, আমি তোমাকে ছাড়ব না”।
প্রণয় বললেন, “গুণ্ডা কাদের বললে? ওরা ধর্ম রক্ষা করতে এসেছে। ওরা ধর্ম যোদ্ধা”।
তনয়া বললেন, “উফ! ধর্ম, ধর্ম ধর্ম করে মাথা খারাপ করে দিলে। তোমার ধর্ম তোমার কাছে রাখো। মেয়েটা তোমার না? এত যন্ত্রণা দিলে কেন? যাও এবার ওকে সুস্থ কর। ও যদি সুস্থ না হয়, এ বাড়িতে আমি একটা অন্নও মুখে তুলব না”।
প্রণয় উঠলেন, “ঠিক আছে, আমি দেখছি। বিরাট বড় কাজ করেছি, ক’দিন পরে তুমি নিজেই বলবে এটা দারুণ কাজ করেছি”।
তনয়া কিছু বললেন না।
প্রণয় রাত্রির কাছে গিয়ে ডাকলেন, “কী রে? কী হয়েছে?”
রাত্রি বলল, “আমাকে নাসিমদের বাড়িতে রেখে এসো। আমি এখানে থাকব না”।
প্রণয় বললেন, “আজে বাজে কথা বলিস না মা। তোকে কত কষ্ট করে নিয়ে এলাম”।
রাত্রি বলল, “আমি এখানে থাকব না। কিছুতেই থাকব না”।
প্রণয় ঘর থেকে বেরিয়ে তনয়াকে বললেন, “পান পোড়া দাও। আমি খোঁজ নিচ্ছি। ওরা জাদু টোনা করেছে। দরকার হলে ওঝা ডেকে এনে ছাড়াতে হবে। বুঝলে?”
তনয়া রাগী চোখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
২৫
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
আনকোরা যত নন্ভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন্ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!
-কাজী নজরুল ইসলাম
নাসিম স্নান করে তার ঘরে গিয়ে বসল। শায়লা ঘরে ঢুকে বললেন, “ভাল হয়েছে যা হয়েছে। দীর্ঘকালীন অপমানের থেকে এরকম হওয়াই ভাল। তুই মন খারাপ করিস না। আজ বিরিয়ানি করব। খাবি তো?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ কর”।
শায়লা নাসিমের পাশে বসে বললেন, “তেলে জলে মিশ খায় না। ভালবাসিস বা না বাসিস, সেটা বড় কথা না। একটা দেশে সংখ্যালঘু হয়ে থাকার অনেক জ্বালা। যে সে সংখ্যালঘু না, মুসলিম সংখ্যালঘু। তোর বাবা যতই পড়াশুনা করে থাকুক, ওর বাস্তববোধের অভাব আছে। যেখানে মেয়ের বাবা এতটা অ্যাক্টিভ হয়ে পড়েছে, মেয়ে নিজেও জানে না আদৌ তোকে ভালবাসে কি না, সেখানে দাঁড়িয়ে আমি বলব, যেটা হয়েছে, ঠিক হয়েছে। তোর সামনে গোটা ভবিষ্যৎ পড়ে আছে বাবু, এসব মাথায় নিস না”।
নাসিম বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছো। চিন্তা কোর না, আমি ঠিক আছি”।
শায়লা কয়েক সেকেন্ড নাসিমের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন।
নীপা এল। নাসিমের পাশে বসে বলল, “দাদা, রাত্রিদিকে ফোন কর না। কী বলছে দেখ”।
নাসিম বলল, “আমার কাছে ওর নাম্বার নেই”।
নীপা বলল, “সত্যি?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ। তাছাড়া যা হয়েছে ভালর জন্যই হয়েছে। মা ঠিক বলেছে। তেলে জলে কখনো মিল হয় না”।
নীপা বলল, “তেলে জলের কী আছে? রিলেশনশিপে রিলিজিয়ন কবে দেখা হয় রে? কমিউনিস্ট পার্টি করছিস কেন তাহলে?”
নাসিম বলল, “কমিউনিস্ট পার্টি করে তো ঈদ পালন করি। ঋপণদাও পুজো করে। শনি মন্দিরের সামনে মাথা নোয়ায়। আমরা ঠিক কমিউনিস্ট না। ধর্মকে অস্বীকার করতে পেরেছি কোথায়? আমরা কিচ্ছু পারি নি। ফেল করে গেছি বুঝলি”?
নীপা বলল, “কিচ্ছু ফেল করিস নি। ফেলটা তখন করবি, যদি রাত্রিদিকে সত্যি ভালবেসেও শুধু ধর্ম আলাদা হবার জন্য বলতে না পারিস। ধর্ম কেন বাধা হবে দুজনের মধ্যে? রাত্রিদি তো কখনো ধর্মকে মাঝখানে আনে নি। ও হিন্দু বাড়ির মেয়ে হয়েও দিব্যি আমাদের সাথে মিশে গেছিল। তোর কী সমস্যা?”
নাসিম বলল, “তুই বক্তৃতা না দিয়ে পড়তে যা। তোকে কিছু বলতে হবে না”।
নীপা বলল, “কেন বলতে হবে না? তুইই বলিস না, মার্ক্স প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন? আমি প্রশ্ন করছি তোকে, কেন হবে না তোদের রিলেশনটা? যদি না হয়, তাহলে তুই এই সব করা ছেড়ে দে। মানুষের জন্য কাজ করবি না। ঘরে বসে থাক, পড়াশুনা কর, চাকরি কর। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হবে না তোকে”।
নাসিম বলল, “তুই যা। আমাকে একটু শুয়ে থাকতে দে। রাতে ঘুমাতে পারি নি। আবার সকালেও দৌড়লাম। ভাল্লাগছে না। যা তুই”।
নীপা রেগে মেগে শব্দ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নাসিম চুপ করে শুয়ে রইল।
রাত্রি যখন ছিল, একটা ভাললাগা ছিল। এখন নেই, কষ্ট হচ্ছে শুধু। তার অনুভূতি প্রথমে আসে না। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রাত্রিকে সে ভালবাসে বলে আগে অতটা ভাবে নি। এখন যে কষ্ট হচ্ছে, সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে রাত্রিকে ভালবাসে। দেশভাগের পরও দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা বড় দেওয়াল রয়ে গেছে। এই দেওয়াল একদিনে তৈরী হয় নি। বছরের পর বছর ধরে এই দেওয়াল তৈরী হয়েছে। এর দায় দুটো সম্প্রদায়েরই।
ঘরে অসহ্য লাগছে। নাসিম উঠে বসল।
ঘুরে আসা যাক বাইক নিয়ে।
সে বেরোল।
রাকিব ডাইনিং টেবিলে বসে ছিলেন।
তাকে দেখে বললেন, “কোথায় যাচ্ছিস? রাত্রিদের বাড়ি?”
শায়লা সেটা শুনে চলে এলেন, “তুমি ছেলেকে তাতাচ্ছো কেন? তুমি চাও ও যাক?”
নাসিম মার দিকে তাকাল, “না না, আমি যাচ্ছি না। পার্টি অফিসে যাব”।
রাকিব বললেন, “নীপাকে কী বলেছিস? রেগে গেছে মনে হল?”
নাসিম বলল, “কিছু না”।
শায়লা বললেন, “তুই ঘুরে আয়। আমার মাথা ধরার ওষুধটা শেষ হয়ে গেছে। নিয়ে আসিস এক পাতা”।
নাসিম বলল, “ঠিক আছে”।
রাকিব বললেন, “মেয়েটাকে ওর বাড়ির লোক অত্যাচার করতে পারে। আমার চিন্তা হচ্ছে”।
শায়লা বললেন, “যা খুশি করুক। তুমি ভেবো না”।
রাকিব নাসিমের দিকে তাকালেন।
নাসিমের চোখ মুখ থম থম করছে।
২৬
রাত্রিকে কোনমতে ঘুম পাড়াতে পেরেছেন তনয়া।
বিজয়োল্লাসে ঘরের মধ্যে বসে চারদিকে জয়ের খবর হোয়াটস অ্যাপ করছেন প্রণয়।
তনয়া রাত্রির ঘর থেকে বেরোতে প্রণয় বললেন, “একটা সুখবর আছে”।
তনয়া ক্লান্ত গলায় বসলেন, “বলে ফেলো”।
প্রণয় বললেন, “রাত্রি কুমারী। এটা ওর কথা শুনে যারা এসেছিল তারা বুঝেছে। ওরা হেড অফিসে জানিয়েছে। রাত্রির জন্য এবার একজন হিন্দু সুপাত্র দেখেছে ওরা”।
তনয়া বললেন, “বাঙালি না অবাঙালি?”
প্রণয় বললেন, “অবাঙালি। তাতে কী হয়েছে? বিহারে বাড়ি। কোন বাঙালি তোমার মেয়ের সব পাস্ট জেনে বিয়ে করবে হে?”
তনয়ার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। একটু থমকে বললেন, “এখন কম্প্যাটিবিলিটি ফ্যাক্টর কাজ করবে না? বাঙালি বিহারীতে বিয়ে হতে পারে, আর হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হলেই সমস্যা?”
প্রণয় বললেন, “তুমি কি চাও, ওই জেহাদীদের বাড়ি আমি মেয়ের বিয়ে দিই?”
তনয়া বললেন, “মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে এটা কোথায় লেখা আছে? মেয়েটা বিয়ে ছাড়াও তো ভাল থাকতে পারে, তাই না? না জেনে শুনে কোথাকার কোন ছেলের গলায় মেয়েকে ঝোলাতে যাবোই বা কেন? আমাদের মেয়ে কি বোঝা?”
প্রণয় বললেন, “তোমাকে অত বোঝাতে পারবো না। আমার গ্রুপের যারা আছে, তারা সবাই বলছে রাত্রির এখন হিন্দু সুপাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই মঙ্গল। নইলে ওই ছেলে আবার চলে আসবে”।
তনয়া বললেন, “যদি জোর করে কিছু কর, তখন ওই বিহারীর সঙ্গে বিয়ের পর তোমার মেয়ে যদি মুসলমান ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়, তখন তোমার মুখ রক্ষা হবে তো?”
প্রণয় বললেন, “এসব কথা তোমার মাথায় কে ঢুকিয়েছে? রাত্রি বলেছে ওই কাটার বাচ্চা মোল্লার সঙ্গে ও পালাবে?”
তনয়া বললেন, “যদি নাও বা পালাত, তুমি যেমন যাত্রা দলের রাবণের মত শুরু করেছো, তাতে আমার মনে হচ্ছে ও সত্যি সত্যিই পালিয়ে যাবে”।
প্রণয় চিৎকার করতে যাচ্ছিলেন। তনয়া ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন, “একদম কথা বলবে না। চিৎকার করবে না। তুমি যদি বাড়িতে সীন ক্রিয়েট কর, আমি মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। দরকার হলে রাস্তায় থাকব, কিন্তু এ বাড়িতে ফিরব না। মেয়েটা সবে ঘুমিয়েছে। যদি জেগে যায়, তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন”।
প্রণয় গুম হয়ে বসে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর বললেন, “খিদে পেয়েছে”।
তনয়া বললেন, “নিজে ভাত বসিয়ে খাও। খুব বুকনি মারছিলে না মোল্লারা মেয়েদের স্বাধীনতা দেয় না বলে। তুমি এক কাজ কর, আজ থেকে আমায় স্বাধীন করে দাও। নিজে রান্না করবে, নিজে খাবে। বাথরুম পরিষ্কার করবে, ঘর ঝাঁট দেবে, বাসন মাজবে, কাপড় কাচবে, ঘর মুছবে, সব নিজে নিজে করবে”।
প্রণয় বললেন, “খুব রাগ মনে হচ্ছে তোমার মেয়েটাকে কাটা বাড়িতে বিয়ে দিই নি বলে?”
তনয়া বললেন, “আমার রাগ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি নিজে রেঁধে খাও। আমাকে বলতে আসবে না”।
প্রণয় উঠে রান্নাঘরে গেলেন। ভাতের হাঁড়ি দেখলেন। সামান্য ভাত পড়ে আছে।
আবার বসার ঘরে এসে বললেন, “তুমি আমার ভাত কর নি?”
তনয়া বললেন, “না। করি নি। আজ থেকে করব না। ওই মোবাইলটা যতদিন তোমার হাতে থাকবে, আমি তোমার কোন ফাইফরমাশ খাটব না। মোবাইলটা ফেলে দাও, তারপরে দেখছি”।
প্রণয় বললেন, “তাহলে আমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে?”
তনয়া বললেন, “করবে না। যেখান থেকে ক্রমাগত বিষ আসছে, সেটা বন্ধ হয়ে গেলে ভাল হবে। কারো কোন ক্ষতি হবে না। তুমিও সুস্থ হবে”।
প্রণয় রেগে গেলেন, “আমি অসুস্থ?”
তনয়া বললেন, “নিজেকে আয়নায় দেখো। বুঝে যাবে তুমি ঠিক কী? আজ থেকে পাঁচ বছর আগে কী ছিলে, আর এখন কী অবস্থা হয়েছে তোমার? সারাক্ষণ ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছো”।
বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। তনয়া দেখলেন তার দিদি, জামাইবাবু সব গাড়ি থেকে নামছেন।
তনয়া বললেন, “হয়ে গেল। যাও বাজার নিয়ে এসো। বাড়িতে এবার সার্কাস শুরু হবে। খবর পেয়ে এই লকডাউনের মধ্যে গাড়ি ভাড়া করে চলে এসেছে। পারেও বটে!”
২৭
শায়লা রান্না বসিয়েছেন।
রাকিব ক্লাস করাচ্ছেন। নীপা তার ঘরে গিয়ে বইতে মুখ গুঁজেছে।
নাসিম বেরোল। এ পাড়া সে পাড়া বাইক নিয়ে ঘুরে দেখল আরো অসহ্য লাগছে। মায়ের ওষুধ নিয়ে এসে নিজের ঘরে চুপ করে শুয়ে পড়ল।
ঋপণের বাইকের হর্ন শুনেও উঠল না।
নীপা তার ঘরে এসে বলল, “ঋপণদা এসেছে। যাবি না?”
নাসিম বলল, “ভাল লাগছে না”।
নীপা বাড়ির বাইরে গেল। ঋপণদাকে তার ভারি ভাল লাগে। বলতে পারে নি। একে দাদার কমরেড। তার উপরে ভীষণ গম্ভীর মানুষ। তাকে দেখলে কেমন দাদাগিরি করতে শুরু করে। অথচ ভাল করে সেটা করতে পারে না। নীপার হাসি পেয়ে যায়।
নীপাকে দেখে ঋপণ বলল, “কোথায় গেল নাসিম? ডাক। এখনই বেরোতে হবে”।
নীপা বলল, “দাদা শুয়ে আছে। আসবে না মনে হয়”।
ঋপণ বলল, “কেন রে? মেয়েটা চলে গেছে বলে”?
নীপা বলল, “তা হবে”।
ঋপণ বলল, “মহা জ্বালা হল তো। আমি একা অক্সিজেন সিলিন্ডার বইব না বাইক চালাবো?”
নীপা বলল, “তুমি গিয়ে বল। দেখো যদি যায়”।
ঋপণ বাইক স্ট্যান্ড করে বলল, “অগত্যা…”
নাসিম শুয়েই ছিল। ঋপণ বলল, “কী রে? এরকম নেতিয়ে গেলি কেন?”
নাসিম বলল, “আজকের দিনটা ম্যানেজ দাও প্লিজ। ভাল লাগছে না”।
ঋপণ বলল, “সেটা তো খুব ভাল করে বুঝেছি। কিন্তু এভাবে শুয়ে থাকলে কি খারাপ লাগাটা কমবে? কী মনে হয় তোর?”
নীপা উঁকি মারল, “চা খাবে ঋপণদা?”
ঋপণ বলল, “না রে। রুগী মরণাপন্ন। সেফ হাউজে নিয়ে যেতে হবে। তোর দাদা এভাবে শুয়ে থাকলে কী হবে কে জানে”।
নাসিম উঠে জামা পরে বলল, “চল”।
ঋপণ খুশি হল, “এই তো। সোনা ছেলে। চল চল”।
নাসিম বেরোল।
ঋপণ বাইকের কাছে এসে বাইক স্টার্ট দিল।
নাসিম ঋপণের পিছনে বসল।
খানিকটা রাস্তা যাওয়ার পর ঋপণ বাইক থামিয়ে বলল, “তুই মেয়েটাকে ভালবাসিস। এটা বুঝে গেছিস। কোন কনফিউশন নেই আর। এবার মেয়েটাকে বলে দে”।
নাসিম মাথা নাড়ল, “ধুস। অনেক অশান্তি। মা ভয় পাচ্ছে। গেরুয়া পার্টি ইনভলভ হয়ে গেছে। গ্রামের কয়েকজন আবার বলছে ওকে কনভার্ট করাতে হবে। সব মিলিয়ে ঘেঁটে যাবে ব্যাপারটা। ছেড়ে দাও”।
ঋপণ বলল, “মামাবাড়ি আর কী! এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে? তোরা যদি ঠিক থাকিস, কোন হনু কিছু করতে পারে নি। দেশটা এখনো গুজরাট বা আফগানিস্তান হয়ে যায় নি”।
নাসিম ঋপণের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল, “এই জন্যই আমরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি বুঝলে? তুমি বোঝো না এখনো? মানুষ অনেক পাল্টে গেছে। এরা আমাদের থেকে সাহায্য নেবে ঠিকই। তবে এরা আমাদের নয়। অনেক কিছুই পাল্টে গেছে কমরেড। চিনি না, জানি না, এমন লোকেদের নিয়ে ওর বাবা আমাদের বাড়ি চলে এল। তারা বাঙালিও নয়। কোথাকার লোক কে জানে। যাক গে, চল। যাই”।
ঋপণ বলল, “জনবিচ্ছিন্ন হয়েছি নাকি জানি না। তবে আমার আজকাল মনে হয় আমাদের পার্টি দিন দিন মরে যাচ্ছে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব আনতে হলে কী দরকার জানিস? মার দরকার। পার্টি এখন সেই লাইনে চলে না। সারাক্ষণ শুধু সম্মেলন আর শান্তির জল ছিটিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে দিই। কিন্তু কোথায় যাব? মানতে পারি না কোন কিছুই। শাসকের আস্ফালন একদিকে, অন্যদিকে জাতের নামে বজ্জাতি। এই কোভিডের সময় পেরিয়ে গেলে আমরা কী করব? যারা এখন ঘরে চুপ করে বসে আছে, তারা পিল পিল করে বেরিয়ে নেতাগিরি শুরু করে দেবে, আর আমরা তখনও কিছু করব না। আর কারো সঙ্গেই তো মেলে না আমাদের, যাদের সঙ্গে মেলে, তারাও যদি এরকম ভুল ভাল কাজ করতে শুরু করে, আমরা কোথায় যাই বল?
নাসিম বলল, “মানুষ আমাদের আর ভোট দেবে না বল?”
ঋপণ বাইক স্টার্ট দিল, “না দিলেই বা কী? চল। দেরী হয়ে গেল”।
২৮
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খানিকক্ষণ আগেই রোদ ছিল।
পাড়ার কৌতূহলী মহিলারা ঠেক বসিয়েছিল। তনয়া স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন। ভাগ্যিস বৃষ্টি হল। নিশ্চয়ই রাত্রিকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। অনেক দিন পরে একটা ভাল বিষয় পেয়েছে পাড়ার মানুষ। এই কোভিডের সময়েও সবাই জড়ো হয়ে গেছিল।
রসালো আলোচনা করবে।
রুমা বার বার রাত্রির ঘরে যাবার চেষ্টা করেছেন। তনয়া অত্যন্ত কড়া হাতে নিজের দিদিকে সামলাচ্ছেন। ঠিকই করেছেন রাত্রির ঘুম কিছুতেই ভাঙাতে দেবেন না।
জামাইবাবু বিজন এসে প্রণয়ের সঙ্গে উত্তেজিত কথা বার্তা বলছেন। মাংস ভাত হবার প্ল্যান পর্যন্ত হয়ে গেছে।
এত বড় জয় পাওয়া গেছে। কম কথা না।
সন্ধ্যা নামলে রাত্রির ঘরে ঢুকে তনয়া দেখলেন রাত্রি সিঁটিয়ে শুয়ে আছে।
আলো জ্বালিয়ে রাত্রিকে ডাকলেন।
রাত্রি চোখ খুলল।
তনয়া বললেন, “এখন একটু ভাল লাগছে? মাসী মেসো সব এসেছে। পারবি বাইরের ঘরে যেতে?”
রাত্রি ভাঙা গলায় বলল, “কেন এসেছে?”
তনয়া বললেন, “তোকে দেখতে”।
রাত্রি বলল, “আমি বাইরে যাবো না। ভাল লাগছে না”।
তনয়া বললেন, “ঠিক আছে। তুই শুয়ে থাক”।
রাত্রি বলল, “মাথা ধরেছে খুব। কোন ওষুধ থাকলে দিও”।
তনয়া রাত্রির কপালে হাত দিলেন। জ্বর আছে। বললেন, “আর সব ঠিক আছে তো?”
রাত্রি বলল, “ভীষণ গায়ে হাত পায়ে ব্যথা করছে”।
তনয়া চিন্তিত মুখে বললেন, “তুই শো। আমি দেখছি”।
ড্রইং রুমে প্রণয় আর বিজন গল্প করছিলেন।
তনয়া বললেন, “মেয়ের জ্বর এসেছে। মাথা ব্যথা। গা হাত পাও ব্যথা। কী করবে, ঠিক কর। বাইরের কতগুলো অচেনা অজানা লোকের সঙ্গে গাড়িতে উঠেছো। দেখো এবার কী হুয়”।
তনয়ার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বিজন উঠে দাঁড়ালেন, “সে কী? জ্বর এসেছে মানে? আমি তো গাড়িও ছেড়ে দিলাম”।
তনয়া হাসলেন, “আমি তো আপনাকে নেমন্তন্ন করে আনি নি জামাইবাবু। এই মহামারীর সময়ে আপনি এসেছেন, কিন্তু যদি আমার মেয়ের থেকে আপনাদের কিছু হয়, আমাকে দোষ দিতে পারবেন না”।
প্রণয় বললেন, “অজানা লোকের গাড়ি আবার কী? ও মোল্লা বাড়িতে গেছিল। ওদের কোন মানা মানি আছে নাকি? ওখান থেকেই নির্ঘাত রোগ বাঁধিয়েছে”।
তনয়া ঠান্ডা গলায় বললেন, “তোমার মেয়ে। তুমি নিজে লোক জন জড়ো করে নিয়ে এসেছো। এবার কিছু হোক না হোক, টেস্ট করাও। ডাক্তার দেখাও”।
প্রণয় হতবুদ্ধি হয়ে মোবাইল নিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলেন।
বিজন বিড় বিড় করতে শুরু করলেন, “মহা জ্বালা হল তো! আমার সুগার আছে। এবার কী হবে? রুমা আমাকে নিয়ে এল”।
পকেট থেকে একটা ছোট স্যানিটাইজারের বোতল বের করে বিজন হাতে গাদা গুচ্ছের স্যানিটাইজার বের করে মেখে ফেললেন। রুমাকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলেন।
রুমা ছুটে এলেন, “কী হল?”
বিজন বললেন, “তুমি জোর করে নিয়ে এলে। মেয়ের এখন নাকি জ্বর। মাথা ব্যথা। সবই তো কোভিডের সিম্পটম। এবার কী হবে?”
রুমা চোখ বড় বড় করে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই আমাকে বলবি না? তোর জামাইবাবুর যদি কিছু হয়?”
তনয়া মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলেন না আর। বললেন, “কী বলতে হবে তোকে? আর কী বলার আছে বল তো? আমাকে জিজ্ঞেস করে এসেছিস তোরা? আর আমি কি জানতাম প্রণয় ওই বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে চলে আসবে?”
রুমা কাঁদো কাঁদো চোখে বিজনের দিকে তাকালেন।
প্রণয় ঘরে ঢুকে বললেন, “কাল সকালে লোকাল হাসপাতালে লাইন দিতে হবে। আগে সোয়াব টেস্ট করুক। ডাক্তার দেখানোই ভাল। রতনদাকে ফোন করেছিলাম। উনি বললেন একটু অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু টেস্ট করে দেবে। দুদিন পরে রেজাল্ট পাওয়া যাবে। এটা ওই মোল্লা বাড়ি থেকে এসেছে। আমার মেয়ের কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়ব না। সবাইকে এক এক করে দেখে নেব”।
লাফাতে শুরু করলেন প্রণয়। তনয়া দেখলেন বিজন আবার স্যানিটাইজার বের করে কনুইতে মাখছেন।
২৯
রাকিব বই পড়ছিলেন।
ক্লাস নেই।
শায়লা এলেন।
রাকিব শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাসিম কি বেরিয়েছে?”
শায়লা চেয়ার টেনে বসে বললেন, “হ্যাঁ। ঋপণ এসে নিয়ে গেল। তুমি এবার নাসিমকে বোঝাও। ও অহেতুক মন খারাপ করছে”।
রাকিব বইটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “কী বোঝাবো?”
শায়লা বললেন, “তেলে জলে মিশ খায় না, সেটা বোঝাও। আবার কী বোঝাবে? এটাও তোমাকে খুলে বলতে হবে?”
রাকিব বললেন, “আমি তো সেটা বোঝাবো না”।
শায়লা অবাক হলেন, “মানে?”
রাকিব বললেন, “আমি বোঝাবো, যদি ওরা দুজন দুজনকে সত্যিই ভালবাসে, তাহলে বাকি সব কিছু ভুলে যাওয়াই ভাল”।
শায়লা রেগে গেলেন, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
রাকিব বললেন, “না। একবারেই মাথা খারাপ হয় নি। তবে যেখানে কোন পাপ নেই, সেখানে আমার ছেলেকে অহেতুক দোষী ভাবতে আমার সমস্যা আছে। সংখ্যাগুরুর আস্ফালন এখানে বসে সহ্য করবই বা কেন? তুমি তোমার ধর্ম পালন করেছো, সব কিছু মেনে চলেছো, আমি কিছু বলি নি। আমাকে ইমাম থেকে শুরু করে সবাই বার বার বলেও জোর করে ধর্ম পালন করাতে পারে নি। আমি আমার মত চলেছি। সেই আমি কি করে আমার ছেলেকে ভুল শিক্ষা দিতে যাব? কী আনন্দে?”
শায়লা বললেন, “তোমাকে কিছু বলাটাই ভুল হয়েছে আমার”।
রাকিব বললেন, “ঠিক আর ভুল যতক্ষণ না আমরা আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারবো, ততদিন এটাই হয়ে চলবে। কাউকে ভালবাসতে হলে যদি মানুষকে তার জাত, পাত, ধর্ম, সব আলাদা করে ভেবে তারপর ভালবাসতে হয়, তবে সেটা ভালোবাসা হয় কী করে?”
শায়লা বললেন, “ভালবাসতে হবে না। দরকার নেই ভালবাসার। যে ভালবাসায় আমাদের বাড়িতে যে কোন সময় অচেনা অজানা লোকেরা এসে হামলা করতে পারে, সেরকম ভালবাসায় দরকার নেই। তুমি জানো সকালে আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। কেন, তুমি ভয় পাও নি?”
রাকিব বললেন, “কেন ভয় পাবো? আমরা চুরি করেছি না ডাকাতি করেছি?”
শায়লা বললেন, “তা না। আমাদের বাড়ির ব্যাপারটা নিয়ে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। ওরা তো এসে আমাকে বলেও গেলে, প্রয়োজনে রাত্রির বাড়ি গিয়ে রাত্রিকে তুলে নিয়ে আসবে। অনেক কষ্টে আটকাতে পেরেছি সেটা”।
রাকিব বললেন, “সেটা তুমি ঠিকই করেছো। কিন্তু নাসিমের কোন দোষ নেই। তাই ওকে বোঝানোরও ব্যাপার নেই”।
শায়লা বললেন, “আমি তোমাদের জ্বালায় একদিন পাগল হয়ে যাবো, জানো তো? এতদিন শুনে এসেছি তোমার বর নামাজ পড়ে না কেন, রোজা রাখে না কেন, এখন শুনতে হবে হিন্দু বাড়ির মেয়েকে আমার ছেলে তুলে নিয়ে এসেছে”।
রাকিব হেসে ফেললেন, “তুমি ওভার থিংক করছো। স্টপ ওভার থিংকিং। বেশি ভাবলে কাজের কাজ কিছু হয় না। সময় দাও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। ফেসবুকে দেখছিলাম কয়েকটা প্রোফাইল থেকে ক্রমাগত হিন্দু মুসলিম করে যায়। ওরা আমরা। কী সব বিষমাখা তীর একে অপরের দিকে মেরে যাচ্ছে সারাক্ষণ ধরে। এই ফাঁদে যেন নাসিম না পড়ে সেটা দেখো। এ রাজ্যের কমিউনিস্ট পার্টির অনেক দোষ আছে। গুণটা হল এরা ধর্ম সম্পর্কে মানুষকে উদাসীন বানিয়ে রাখতে পেরেছিল। এ রাজ্যে কখনো ভাবতে হয়নি দিল্লি থেকে নেতা এসে দলিতের বাড়িতে ভাত খাবে। আমরা দলিত ব্যাপারটা নিয়েও তো ভাবতাম না কোন কালে। রাজনীতিতে যখন ধর্ম মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন বুঝতে হয় রাজনীতিকদের ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে। তারা আসলে রাজ্যের ভাল চায় না। ধর্মের বিষ ছড়িয়ে ভোট পাওয়ার ধান্দা করছে। ব্রিটিশরা শুধু ধর্মে ধর্মে আগুন লাগিয়ে এত বছর ক্ষমতায় থেকে গেল”।
শায়লা বললেন, “উফ, এত জ্ঞান না দিয়ে তুমি আমাকে বল তো আমি কী করব?”
রাকিব বললেন, “কিচ্ছু করবে না। চুপ করে দেখে যাও আমাদের ছেলে কী করে। বুঝলে?”
শায়লা মুখ কালো করে বললেন, “আমার তোমার কাছে আসাটাই ভুল হয়েছে। একটা ঠিক ঠাক বুদ্ধি যদি দিতে পারো তুমি”।
৩০
“দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের কিছু করার থাকে না। প্রতিটা দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা এই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষগুলোর মতই। বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের হিন্দুরা যেমন। তাদের এক সঙ্গে থাকতে হয়। বাংলাদেশে আমার পরিচিত এক হিন্দু পরিবারে আমি দেখেছি, তারা সব সময় আতঙ্কে থাকে। তাদের আপোষ করে চলতে হয় স্থানীয় মুসলমান হোমরা চোমড়াদের সামনে। বাড়ির মেয়েদের অত্যন্ত সাবধানে রাখতে হয়। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে এই ভাবনাও কাজ করে, যেন তেন প্রকারেণ যদি ভারতে চলে যাওয়া যায়, তাহলে বেঁচে যাওয়া যায়। গোষ্ঠীর একজনও যদি চলে যায়, তারা ভীষণ মুষড়ে পড়ে।
সীমানার এপ্রান্তে আমাদের অবস্থা তুলনামূলক ভাবে তাদের থেকে ভাল। তবে এখানেও সংখ্যালঘুদের মধ্যে জোটবদ্ধ হয়ে থাকার প্রবণতা দেখা যায়। ধর্ম পালন না করলে বাংলাদেশে যেভাবে এক ঘরে করে দেওয়ার চল আছে, এখানে সেটা নেই, এটুকুই যা বাঁচোয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমি ধর্ম পালনে আগ্রহী ছিলাম না কোন কালেই। আমার বাবা অনেকবার বলেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন। আমি উৎসাহ পাই নি। বিয়ের পর শায়লাও আমাকে জোর করেছে। আমি করি নি। শায়লা নাসিমকে জোর করে। জানি না, নাসিম এসব মন থেকে পালন করে নাকি। তবে ওকে ওর মার জন্য করতে হয়। নীপা খানিকটা আমার মতই। ধর্মগুরুদের মূল বিরোধিতা কখনোই আরেকটা ধর্মের সঙ্গে হয় না। এদের মূল বিরোধিতা হয় মুক্ত চিন্তার বিরুদ্ধে। পড়াশুনা এবং বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে। গণশত্রু সিনেমায় সত্যজিৎ রায় যেমন দেখিয়েছেন, মন্দিরের জল থেকে জন্ডিস হবে জেনেও ধর্মের পৃষ্ঠপোষকেরা সে তথ্য ধামাচাপা দিতে কতখানি আগ্রহী ছিলেন। একইভাবে সব ধর্মের কাজই হল বিজ্ঞানের ব্যখ্যাকে অস্বীকার করে সেটা ঈশ্বরের লীলা খেলা বলে প্রকাশ করতে চাওয়া। বিজ্ঞানকে যত ছোট দেখানো যাবে, ধর্মান্ধতা তত বাড়তে থাকবে। মানুষ প্রশ্ন করলে মানুষকে বিদ্রোহী না ভেবে আমাদের পরমতসহিষ্ণু হওয়ার প্রয়োজন আছে। এ দেশের শাসক থেকে বিরোধী থেকে সাধারণ মানুষ, আমরা কেউ বিরোধী মত শুনতে আগ্রহী নই। নিজের মতটাই যেন তেন প্রকারেণ অপরের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিতে আগ্রহী হয়ে পড়ি। পরমত না শুনলে, পরের যুক্তি না শুনলে জাতি হিসেবে কিছুতেই মানুষের উন্নতি হবে না। সত্তরের দশকে মানুষের আশা ছিল, জাতি হিসেবে আমরা নতুন নতুন গ্রহ আবিষ্কার করব। মহাশূন্যে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব হবে, চিকিৎসাশাস্ত্রে আমাদের উন্নতি হবে। পরিবর্তে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি তালিবান পুনরুত্থান, চিকিৎসার নামে মানুষের সর্বস্ব হরণ, বিজ্ঞানের অগ্রগতির নামে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য আহরণের প্রাণান্তকর চেষ্টা।
হিন্দুত্ববাদ বা মুসলমানত্ববাদ এখন এমন পরিমাণে বেড়ে চলেছে, যা রীতিমতো ভীতিপ্রদ। মানুষ কেন অপরকে রক্ত দেওয়ার আগে দেখতে যাবে সে হিন্দু না মুসলমান? এই সময়ে এসে যখন পৃথিবীর আরো অনেক বেশি যুক্তিবাদী হবার প্রয়োজন ছিল, আদতে দেখা গেল, পৃথিবী আরো কঠিন অসুখের মুখে পতিত হচ্ছে। সামনের দিনের বিপদ কি আমরা বুঝতে পারছি না? এভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে কী লাভ হচ্ছে মানুষের? চারদিকে কেবল ঘৃণা আর ঘৃণা…”
রাকিব এতটা লিখে চুপ করে বসলেন। অস্থির লাগছে।
লেখাটা বড় নেগেটিভ হয়ে যাচ্ছি। কেন পজিটিভ কিছু থাকবে না?
দরজায় নক হল।
রাকিব বললেন, “কে?”
নাসিম দরজা খুলে বলল, “আমি”।
রাকিব বললেন, “আয়”।
নাসিম ঘরে ঢুকে বসল।
রাকিব বললেন, “কোথায় গেছিলি?”
নাসিম বলল, “একজন পেশেন্ট ছিল, জ্বর কমছে না। টেস্ট করে জানা গেছে রিপোর্ট নেগেটিভ। ডাক্তারবাবুরাও ধরতে পারছেন না”।
রাকিব চিন্তিত মুখে বললেন, “তারপরে?”
নাসিম বলল, “কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। অন্য কিছুও থাকতে পারে”।
রাকিব বললেন, “এখন তো এটাই সমস্যা হয়েছে। কোভিডের যন্ত্রণায় সাধারণ মানুষের সাধারণ রোগগুলোর চিকিৎসা সিকেয় উঠে গেছে। রাত্রির খবর কী?”
নাসিম মাথা নিচু করল, “জানি না”।
রাকিব বললেন, “তুই কি ভয় পেয়ে যাচ্ছিস?”
নাসিম অবাক হয়ে রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, “মানে?”
রাকিব বললেন, “মানে তোর কি ভয় হচ্ছে? আচ্ছা বাদ দে। অন্য কথায় আসি, তুই মুসলমান, আর রাত্রি হিন্দু বলে কি তোর মনে কোন অপরাধবোধ কাজ করছে?”
নাসিম বলল, “বুঝতে পারছি না ঠিক”।
রাকিব বললেন, “অপরাধবোধ কাজ করলে বুঝতে হবে তোর নিজের ভেতরেও ভাল মন্দের বিচারবোধটা এখনো তৈরী হয় নি”।
নাসিম বলল, “বুঝলাম না ঠিক”।
রাকিব বললেন, “বুঝতে হবে না। আচ্ছা আমাকে বল, তুই বাংলাদেশে থাকলি, তুই হিন্দু পরিবারের লোক, তোর বোনকে কোন মুসলমান সংখ্যাগুরু ছেলে বিয়ে করতে চাইল, তুই কী করতিস?”
নাসিম বলল, “জানি না। এসব নিয়ে ভাবি নি বাবা”।
রাকিব খুশি হলেন, “গুড। এটা হলেও চলবে। এত হিন্দু মুসলিম কচকচানি মাথার মধ্যে না আসাই ভাল। যা তুই, আমি প্রবন্ধটা লিখে শেষ করি”।
নাসিম গেল না। চুপ করে বসে রইল।
রাকিব বললেন, “কিছু বলবি?”
নাসিম বলল, “আমার মনে হয়, রাত্রির খোঁজ নেওয়া উচিত। এভাবে ওকে জোর করে নিয়ে গেল ওকে”।
রাকিব বললেন, “বেশ তো, খোঁজ নে। কী করবি? লোকাল পার্টিকে জানা, ওরা খোঁজ নিয়ে তোকে বলুক”।
নাসিম বলল, “আমি যদি ওদের বাড়ি যাই?”
রাকিব চিন্তিত মুখে বললেন, “বাড়ি যাবি? যেতেই পারিস। অসুবিধা নেই। আচ্ছা তুই গেলে যা। আমি লিখি বরং”।
নাসিম বুঝল বাবা এখন লেখা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তাকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। সে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
৩১
রাত হয়েছে।
একটা ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন বিজন আর রুমা।
প্রণয় বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে যাচ্ছেন। কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই বলে দিচ্ছে বাড়ি গিয়ে আরটি পিসি আর করা সম্ভব না।
মেয়ের ঘরে খানিকটা দূরে বসে আছেন তনয়া। রাত্রি চোখ বুজে আছে।
তনয়া বললেন, “মাথা ধরে আছে তোর?”
রাত্রি বলল, “ভীষণ”।
তনয়া বললেন, “ঘুম আসছে না?”
রাত্রি বলল, “ঘুমিয়েছি তো। এখন আর ঘুম আসবে না মনে হয়। তুমি মাস্ক পর মা”।
তনয়া বললেন, “ওই লোকগুলোর থেকেই হয়েছে। একটাকেও তো মাস্ক পরতে দেখি নি। ছি ছি। কী লজ্জার ব্যাপার”।
রাত্রি বলল, “লজ্জার ব্যাপার তো নাসিমদের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে করা হল মা। ওরা এত যত্ন করলেন, আর বাবা কী করল বল তো?”
তনয়া বললেন, “ওরা ভাল? আচ্ছা ওরা কি খাটে বসে খায়? সারাক্ষণ লুঙ্গি পরেই থাকে?”
রাত্রি হেসে ফেলল, “ওরা আমাদের মতই মা। আমরা যেভাবে থাকি, ওরাও সেভাবেই থাকে। আর নাসিমের বোন নীপার যে কী পড়াশুনা তুমি ভাবতে পারবে না। কত বই ওদের বাড়িতে”।
তনয়া বললেন, “তুই যদি একবার তোর বাবাকে আটকাতে পারতিস!”
রাত্রি বলল, “আটকে কিছু হয় না। আমি…”
রাত্রি কাশতে শুরু করল।
তনয়া বললেন, “থাক এখন কথা বলতে হবে না। চা এনে দি। আদা দিয়ে চা খেলে ভাল লাগবে হয়ত”।
রাত্রি বলল, “তাই দাও”।
তনয়া রান্নাঘরে গেলেন। রুমা বিজনের উপর তার রাগ হচ্ছিল। মজা দেখতে এসেছিলেন ওরা। এখন আতঙ্কিত হয়ে তাদের সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। লকডাউন এবং বিধিনিষেধের সময় অতিরিক্ত দুজনের রান্না করাটাও ঝামেলার ব্যাপার। বাজারও করতে হবে। তনয়া বেশি বলা ছেড়ে দিয়েছেন। এদের কিছু বললেও কেউই তার কথা শুনবেন না। আপাতত মেয়েটা সুস্থ হোক।
চা নিয়ে রাত্রির ঘরে গিয়ে দেখলেন রাত্রি খাটের উপর উঠে বসে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। তনয়া বললেন, “কী দেখছিস?”
রাত্রি বলল, “কিছু না”।
তনয়া বললেন, “চা নে। দেখ ভাল লাগবে খানিকটা”।
রাত্রি বলল, “আমার হাতে দিও না। খাটের উপর রাখো। আমি নিচ্ছি”।
প্রণয় ঝড়ের মত ঘরের দরজায় এসে বললেন, “আমি কাউকে পাচ্ছি না। একজন বলল হাসপাতালে গিয়ে লাইন দিলে টেস্ট করা যাচ্ছে। তুই পারবি লাইন দিতে?”
তনয়া বললেন, “তোমার ধর্ম রক্ষার্থে যে সব লোকগুলো সকালে এসেছিল, ওদের ডাকছো না কেন? এই যে মেয়েটা অসুস্থ হয়েছে, এতেও তো ধর্ম বিপন্ন হচ্ছে, তাই না? ওদের ফোন কর”।
প্রণয় রাগী গলায় বললেন, “সব বিষয় নিয়ে বাজে কথা ভাল লাগে না”।
তনয়া বললেন, “বাজে কথা কেন হবে? ওর জ্বর, শরীর দুর্বল। এর মধ্যে মেয়েটা গিয়ে লাইন দিয়ে টেস্ট করাতে যাবে? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? তুমি যখন ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছো, তখন তোমার দায়িত্ব ঠিক ঠাকভাবে মেয়েটার টেস্ট করানো। যাকে পারো, যেখান থেকে পারো গাড়ি ঠিক করে এসে নিয়ে যাবে”।
প্রণয় বললেন, “আশ্চর্য! করোনা সাসপেক্টেড হলে কেন কোন গাড়ির ড্রাইভার এ বাড়িতে আসবে? তুমি বুঝতে পারছো না কেন?”
তনয়া বললেন, “সকালে যে লোকগুলোকে নিয়ে এসেছিলে, তাদের কারো মুখে মাস্ক ছিল না কেন? তাদের থেকেই তো মেয়েটার রোগ হয়েছে। তুমিও ওদের সঙ্গে মিশেছো। তোমারও হবে”।
প্রণয় কটমট করে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমায় অভিশাপ দিচ্ছো তুমি?”
তনয়া বললেন, “অভিশাপ তো কাজ করে না। করলেও দিতাম না। তোমার উপর করুণাও হচ্ছে না। ধর্ম ধর্ম করে মাথা খারাপ করে দিলে। আর মেয়েটাকে গোবর খাওয়ালে কেন?”
প্রণয় বললেন, “মোল্লা বাড়িতে ছিল। গরু টরু খাইয়েছে নাকি আমি কী করে জানব?”
তনয়া বললেন, “গরু খেলে গোবর খেলেই প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায় বুঝি? খুব মজার ব্যাপার তো! কোত্থেকে পাও বল তো এত বুদ্ধি?”
প্রণয় বললেন, “ওই মোল্লাদের বাড়ি থেকেই মেয়েটার জ্বর এসেছে”।
রাত্রি বলল, “না বাবা। ওদের বাড়িতে সবাই অত্যন্ত সুস্থ। অসুস্থ তুমি। মানসিকভাবে তো বটেই”।
প্রণয় বললেন, “খুব বুলি ফুটেছে না? একটা চড় মারব তোকে”।
তনয়া বললেন, “মেয়েটাকে অসুস্থ করে এখন শাসন করতে এসেছো? তুমি এখনই এখান থেকে বেরোও”।
প্রণয় রাগী চোখে রাত্রি আর তনয়ার দিকে তাকিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
৩২
রাত দেড়টা।
তনয়ার ঘুম আসছিল না। ছটফট করছিলেন রাত্রির কথা ভেবে। অদ্ভুত এক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে।
ভালোবাসাবাসি তো তেমন তৈরী হয় নি।
যেটা তৈরী হয়েছে সেটা ভাললাগা। ব্যাপারটা এত দূর গড়াতোই না যদি প্রণয় এত কিছু না করতেন।
সদ্য টিনেজ পেরনো ছেলেমেয়েদের মনে জেদ থাকে বেশি। তাদের কোন কিছু না করতে বললে সেটাই তারা বেশি করে করবে। রাত্রির বেলাতেও তাই হয়েছে। প্রণয় যদি মেয়ের কথায় এত বেশি প্রতিক্রিয়া না দিতেন, তাহলে কিছুই হত না। কয়েক বছর আগেও তো ধর্ম নিয়ে এত কিছু হত না। ইদানীং মানুষের অসহিষ্ণুতা যেন বড্ড বেড়ে যাচ্ছে। এমনটা তো হবার কথা ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত হাওয়া আরো বেশি করে বইবার কথা ছিল।
প্রণয় ঘুমের ঘোরে কাশতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর উঠে বসে বললেন, “দেখো তো, আমার কপালে হাত দিয়ে। জ্বর এসছে মনে হচ্ছে”।
তনয়া প্রণয়ের কপালে হাত দিলেন। বললেন, “হ্যাঁ। খুব হালকা জ্বর আছে। আসবে মনে হচ্ছে”।
প্রণয় বললেন, “জল গরম কর দাও। ভেপার নি, গার্গল করি”।
তনয়া বললেন, “নিজে করে নাও। কোত্থেকে না কোত্থেকে কতগুলো লোক জুটিয়ে এনে রোগ বাঁধালে, এবার তুমি বোঝো কী করবে”।
প্রণয় বললেন, “তুমি এরকম করছো কেন?”
তনয়া চোখ বুজলেন। উত্তর দিলেন না।
প্রণয় এ পাশ ও পাশ করে সত্যি সত্যিই উঠে গিয়ে রান্নাঘরে গেলেন।
ওখানেও কাশতে শুরু করলেন।
তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভয়াবহ রোগটা তার মানে তাদের বাড়িতেও চলে এল। বাড়ি বাড়ি জ্বর, কারো কারো শ্বাসকষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এত কিছুর মধ্যে লোকটা এমন সব কান্ড করে বসল, যে এখন তাদের বাড়িতেও রোগটা হানা দিল। তনয়া দেখলেন তার ফোন বাজছে। রুমা ফোন করছেন।
এই করছেন রুমা সন্ধ্যে থেকে। ঘর থেকে বেরোচ্ছেন না। শুধু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে ফোন করছেন।
তনয়া ধরলেন, “বল”।
রুমা ভীত গলায় বললেন, “কী রে, তোর বর কাশছে কেন?”
তনয়া বললেন, “নিশ্চয়ই বাধিয়েছে, আর কেন কাশবে?”
রুমা বললেন, “ওরে বাবা, আমারও কেমন জ্বর জ্বর লাগছে রে। আমারও এল নাকি?”
তনয়া বললেন, “তুই কাল সকালেই বাড়ি চলে যা। এখানে থাকলে তোর করোনা হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না”।
রুমা বললেন, “বাড়ি গেলে কী করে হবে? রোগ যদি হবার থাকে তাহলে তো অলরেডি হয়েই গেছে”।
তনয়া বললেন, “তাহলে আমি কী করতে পারি বল? তোকে তো আমি নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসি নি! তুই মজা দেখতে চলে এসেছিলি যে আমার মেয়ে মুসলমানের সঙ্গে পালিয়ে গেছে, বাড়িতে থাকলে বোর হচ্ছিলি, কী করবি, চলে এসেছিস”।
রুমা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “এটা তুই কী বলছিস?”
তনয়া বললেন, “হ্যাঁ ঠিকই বলছি। আমি একটা ভয়ংকর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তোরা এসে সেই সময়টাকে আরো কঠিন করে দিলি। চিরকাল তোরা যা করে এসেছিস, আমি কিচ্ছু বলি নি। কিন্তু এবারে আর চুপ থাকতে পারলাম না। কিছু মনে করিস না। আজ যে গাড়িটায় করে এসেছিলি, কাল সে গাড়িটা করে চলে যাস। আর হ্যাঁ, তোরা এসেছিস বলে আমার অসুবিধা হচ্ছে। আমার ঘরের এই অবস্থা। তোদের সার্কাস আমি আর নিতে পারছি না”।
রুমা বললেন, “আমি ভাবতে পারি নি তুই এত বড় কথা আমাকে বলে দিলি। সম্ভব হলে আমি এখনই চলে যেতাম”!
তনয়া বললেন, “বিশ্বাস কর, যদি আমি পারতাম, আমিও তোদের গাড়ি ঠিক করে এখনই পাঠিয়ে দিতাম”।
ফোন কেটে দিলেন তনয়া।
প্রণয় শব্দ করে গার্গল করে টরে ঘরে এসে আলমারি খুলে বললেন, “আমাকে অত বোকা ভেবো না, আমি আগের থেকেই বিপদের আন্দাজ পেয়ে জিনিস নিয়ে এসেছি”।
আলমারি থেকে ওষুধের বাক্স বের করে প্রণয় বললেন, “এই যে, পালস অক্সিমিটার, থার্মাল গান সব আছে। এই দেখো”।
থার্মাল গানটা নিজের কপালে দিয়ে রিডিং দেখলেন প্রণয়, “আহ। জ্বর নেই। চিন্তা কোর না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা আমাদের ভাবিজি পাঁপড় আছে?”
তনয়া বিরক্ত মুখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
৩৩
এক একটা রাত অসহ্য হয়ে ওঠে।
আগে তো ক্লান্তিতেই ঘুম চলে আসত।
এবারে ঘুমোলেও নাসিম ছটফট করছিল।
রাত তিনটে নাগাদ উঠে জল খেল। ঠিক করল ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখবে।
ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল রাকিবের লাইব্রেরীর ঘরের আলো জ্বলছে।
নাসিম লাইব্রেরীর দরজা ঠেলে ঢুকে দেখল রাকিব মন দিয়ে লিখে যাচ্ছেন। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় বাবাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! নাসিমের চোখে জল এল। বাবাকে কি সে কষ্ট দিয়েছে? লোকগুলো কীভাবে অসভ্যতা করে গেল।
ওদের কথা খুব পরিষ্কার। এটা তো তাদের দেশ না। তাদের উচিত ছিল দেশভাগের সময়েই এই দেশ থেকে চলে যাওয়া।
রাকিব তার দিকে তাকালেন, “ঘুম হচ্ছে না?”
নাসিম বলল, “তুমি লেখো বাবা। বিরক্ত করব না”।
রাকিব বললেন, “বস। বিরক্ত করার কিছু নেই”।
নাসিম বসল।
রাকিব বললেন, “কী ভাবছিস?”
নাসিম বলল, “এই দেশটা আমাদের না, বল বাবা? আমাদের কোন অধিকার নেই এই দেশে”।
রাকিব বললেন, “কথাটা রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট। অত ভাবিস না এটা নিয়ে”।
নাসিম বলল, “ভাবব না? সারাক্ষণ তো এখন এগুলোই শুনছি। না ভাবলে কী করে হবে?”
রাকিব বললেন, “শোন, একটা সময় ছিল, যখন নিচু জাতের মানুষদের উঁচু জাতের মানুষেরা এত জ্বালাতন করেছে, তখন নিচু জাতের মানুষদের আর কিছু করার উপায় ছিল না। তারা ধর্মান্তরিত হতে শুরু করে। আবার বাইরে থেকে মুসলমান শাসকেরা যখন এদেশে আসতে শুরু করে, তাদের প্রভাবেও অনেকে মুসলমান হয়। তাদের বংশধর থাকতে পারে, জোর করে করা ধর্মান্তর হতে পারে, কিন্তু এভাবেই দেশে মুসলমান বাড়তে থাকে। সৌরজগতের একটা গ্রহ পৃথিবী, কত গ্রহ আছে, সেখানে প্রাণ নেই, শুধুমাত্র এই গ্রহে প্রাণ আছে। মানুষ আছে। মানুষ কী করল? এই ভূ খণ্ড দখল করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করল। একটার পর একটা ধর্ম তৈরী হল। কাজের কাজ কিছুই হল না, শুধু এরা নিজেদের মেরে যেতে লাগল। দেশ আবার কী রে? দেশ, জাত, ধর্ম… এই সব কিছু পলিটিকাল টার্ম। কোনটাই ডিফাইন করে দেবে না কোনটা কাদের দেশ। হীনমন্যতায় ভুগবি না। কমিউনিস্ট পার্টি করিস, মাথা উঁচু করে বাঁচবি”।
নাসিম বলল, “লাভ হয় না বাবা। কমিউনিস্ট পার্টিতেও আমরা ওরা শুনেছি আমি”।
রাকিব বললেন, “স্বাভাবিক। কমিউনিজমের কনসেপ্ট তো অত সোজা না যে সব রাম শ্যাম যদু মধু এত সহজে এটাকে চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে পারবে। কেউ দল করেছে ধান্দায়, কেউ ভালোবেসে, কারো বা কৃতজ্ঞতা আছে দলের প্রতি। আদতে ভেতর থেকে কমিউনিজমের আদর্শটাকে মন থেকে মেনে নিয়ে খুব কম লোক পার্টি করে। জন্মগতভাবে তুই মুসলমান, তুই সংখ্যালঘু, এটা দেগে দিয়েছে সবাই। তা বলে তুই সে জন্য মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকবি না। একজন সু নাগরিক হবার চেষ্টা করবি। পাকিস্তান আর ভারতবর্ষের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। পাকিস্তান মুসলমানদের জন্যই তৈরী হয়েছিল। ভারতবর্ষ সব ধর্মের জন্য। রাজনীতিকরা অনেক কিছু খারাপ কাজ করেছে সে সময়ে। কিন্তু এই যে একটা দেশকে সব ধর্মের মিলনক্ষেত্র বলে দেখানো হয়েছে, এটা একটা এশিয়ার দেশ হয়েও ভারতবর্ষকে এক অসাধারণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। মৌলবাদীরা চেষ্টা করে যাচ্ছে সব সময়ে, সে হিন্দু মৌলবাদী হোক কিংবা মুসলিম মৌলবাদী, তবু এত কিছুর পরেও ওরা জিততে পারবে না। শেষমেশ মনুষ্যত্বই জিতবে। তুই তোর মায়ের সঙ্গে থেকে আল্লাহকে মানিস, আল্লাহর কাছে ধন্যবাদ দে, তুই ভাগ্যবান, তুই বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে জন্মাস নি। যে দেশগুলোতে থেকে শুধু বিদ্বেষের চাষ করতে হয়,জোর করে ধর্মাচরণ করতে হয়, এরকম কোন দেশে তোকে জন্ম নিতে হয় নি। এ দেশ মহান। বিদ্বেষ যারা ছড়িয়ে যাচ্ছে, শুধু ঘেন্না শিখিয়ে যাচ্ছে, একদিন ওরা ক্লান্ত হয়ে যাবে”।
নাসিম বলল, “তাই হোক”।
রাকিব বললেন, “ঘুমের চেষ্টা কর। ঘুমটা জরুরি। শরীর খারাপ করিস না”।
নাসিম বলল, “ঠিক আছে”।
রাকিব বললেন, “রেড ভলান্টিয়ারের কাজটা কর। মানুষের পাশে থাক। মানুষ ভুলে যাবে, ইতিহাস তোদের ভুলবে না। তোদের কাজটা ঠিক থেকে যাবে”।
নাসিম উঠল। বাবার সঙ্গে কথা বললে মনটা ঠান্ডা হয়ে যায়। এবার অন্তত ঘুমটা আসুক!
৩৪
ঘুম থেকে উঠে প্রণয় খাটে বসে নিজের কপালে হাত দিয়ে বললেন, “জ্বর এসছে মনে হচ্ছে। দেখো তো”।
তনয়া পাত্তা না দিয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখলেন রুমা বিজনকে নিয়ে বেরোচ্ছেন। তাকে দেখে কাঁদো কাঁদো চোখে রুমা বললেন, “আমরা চলে যাচ্ছি”।
তনয়া রুমাকেও পাত্তা দিলেন না।
রুমা ভেবেছিলেন তনয়া তাকে সাধবেন। সেটা করলেন না দেখে মুখে আঁচল দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
তনয়া রাত্রির ঘরে গিয়ে মেয়ের কপালে হাত দিলেন।
বেশ ভাল জ্বর আছে।
তনয়া টেলিমিডিসিনের খবরটা দেখেছিলেন। সেখানে ফোন করলেন। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর কথা বলে জানতে পারলেন যত তাড়াতাড়ি টেস্ট করে ওষুধ শুরু করা যায়, তত ভাল।
তিনি নিজের ঘরে গিয়ে প্রণয়কে বললেন, “মেয়েকে নিয়ে টেস্ট করিয়ে আনো”।
প্রণয় বললেন, “আমি কী যাব? আমার নিজেরই অসুস্থ লাগছে। তুমি যাও”।
তনয়া বললেন, “তাই যাবো”।
কথা না বাড়িয়ে রাত্রিকে ঘুম থেকে তুললেন। রাত্রির চোখ ঘোলাটে। গায়ে বেশ জ্বর এসেছে।
তনয়া জানেন পাড়ার লোক করোনা বললেই তাদের এক ঘরে করে দেবে। এক টোটোওয়ালার নাম্বার ছিল। তাকে ডাকলেন। রাত্রিকে তৈরী করতে কিছু সময় লাগল। প্রণয় নিজের তাপমাত্রাই মেপে যাচ্ছেন।
তনয়া ঘাঁটালেন না।
রাত্রিকে নিয়ে টেস্ট সেন্টারের কাছে এসে দেখলেন লম্বা লাইন। মাথার উপরে চড়া রোদ।
রাত্রি বলল, “মা, টেস্ট করাতে হবে না। বাড়ি যাই চল। এখানে লাইনে দাঁড়ালে আমি মরে যাব শিওর”।
তনয়া হাল ছাড়লেন না। রাত্রিকে টোটোতেই বসিয়ে রেখে নিজে লাইনে দাঁড়ালেন।
লাইনে কেউ কাশছে, কাউকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রবল অসুস্থ। কেউ লাইনের আগে চলে যাচ্ছিল বলে প্রবল গালিগালাজ শুরু করে দিল লোকে কাশতে কাশতেই। মর্ত্যে যেন নরক নেমে এসেছে।
রাত্রির মাথা ধরাটা অসহ্য বেড়ে গেছে। সে মাথা টিপে ধরে বসে আছে। একটা বাইক এসে দাঁড়াল। চেনা কন্ঠস্বর পেল সে, “এখানে?”
রাত্রি দেখল নাসিম। সে হাসল, “মনে হচ্ছে হয়েছে”।
নাসিম বলল, “টেস্ট করাবে?”
রাত্রি বলল, “মা লাইন দিয়েছে। কখন হবে জানি না”।
নাসিম বলল, “কোথায় তোমার মা?”
রাত্রি বলল, “ওই তো লাইনে”।
নাসিম তনয়ার কাছে গিয়ে বলল, “আপনি রাত্রির কাছে গিয়ে বসুন। আমি লাইনে দাঁড়াচ্ছি”।
তনয়া নাসিমের দিকে তাকালেন। ছেলেটার চোখে কেমন একটা ছটফটানি। রাত্রি কষ্ট পাচ্ছে দেখে ছেলেটাও কষ্ট পাচ্ছে। ভালবাসে তার মেয়েকে। ভীষণ ভালবাসে। চোখ দুটোই সব বলে দিচ্ছে। তিনি বললেন, “তোমার কষ্ট হবে না?”
নাসিম মাথা নাড়ল, “না না। কোন কষ্ট হবে না। আপনি টোটোতে গিয়েই বসুন”।
তনয়া বললেন, “ঠিক আছে। তুমি ডেকো তবে”।
নাসিম বলল, “ঠিক আছে”।
তনয়া রাত্রির কাছে গিয়ে বসলেন।
দেড় ঘন্টা পর রাত্রির স্যাম্পেল নেওয়া গেল।
তনয়া মেয়েকে টোটোতে তুলে বসালেন। টোটোর ছেলেটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছিল না। তনয়া ছেলেটার হাত পাঁচশো টাকা দিলে ছেলেটা আর কিছু বলল না।
নাসিম চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। রাত্রিকে টোটোতে বসিয়ে তনয়া নাসিমের কাছে গিয়ে বললেন, “রাত্রির বাবা তোমাদের খুব অপমান করেছে। আমি খুব লজ্জিত। আমি ওর হয়ে তোমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি”।
নাসিম হাসল, “না না কাকীমা। ভাববেন না। আগে সবাই ঠিক থাকুন। ডাক্তার বরাট বসেন পঞ্চানন মোড়ে। এখনই চলে যান। আমি নাম লিখিয়ে রেখেছি লাইনে থাকা অবস্থাতেই। ওকে ওর কাছে দেখিয়ে ওষুধ শুরু করে দিন। বাড়িতে অক্সিমিটার আছে তো?”
তনয়া বললেন, “আছে”।
নাসিম বলল, “অক্সিজেন লেভেলটা মণিটরিং করবেন। আমার নাম্বারটা রাখুন, কোন রকম দরকার হলে ফোন করবেন”।
তনয়ার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। এই ছেলেটার পরিবারের সঙ্গে প্রণয় দুর্ব্যবহার করে এলেন?
নাসিমের নাম্বার নিয়ে তিনি টোটোয় উঠলেন।
রাত্রি বলল, “কী বলল ও”?
তনয়া বললেন, “ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে ওষুধ শুরু করতে বলল। ঠাকুর করে তোর করোনা না হোক”।
রাত্রি বলল, “খুব মাথা ধরেছে মা। এটুকু কমলে অন্তত শান্তি পাব”।
তনয়া দেখলেন একটু দূরত্বে থেকে নাসিম আসছে। তিনি আশ্বস্ত হলেন। এই বিপদের দিনে নাসিমকে তার পরম আত্মীয় বলে মনে হল।
৩৫
চেম্বারেও কম ভিড় ছিল না। নাসিম আগে থেকে বলে রেখেছিল বলে বেশিক্ষণ সময় লাগল না।
লক্ষণ দেখে ডাক্তার বরাট ওষুধ লিখে দিলেন।
ওষুধ কিনে বাড়ি ফেরার সময় তনয়া দেখলেন নাসিম দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আর ডাকলেন না। কষ্ট হচ্ছিল ছেলেটার জন্য।
রাত্রি বাড়ি এসে শুয়ে পড়ল। কিছু খাইয়ে জ্বরের ওষুধ খাওয়াতে বলেছিলেন ডাক্তার। তনয়া অনেক মিনতি করে খুব সামান্য কিছু খাওয়াতে পারলেন।
প্রণয় বাড়ির ভেতরে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝেই থার্মাল গান নিজের মাথায় তাক করে টেম্পারেচার দেখছেন।
তনয়াকে বললেন, “কী বলল ডাক্তার? করোনা হয়েছে?”
তনয়া বললেন, “নিজে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসতে পারতে। এখন আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?”
প্রণয় বললেন, “আমি গুরুজীকে বলেছি বুঝলে। উনি বললেন খুব ভোরে উঠে কোন কামধনুর পিওর গো মূত্র যদি খাওয়ানো যায়, তাহলে করোনা হবে না। আমি তো ভাবছি কাল নিজেই খেয়ে আসব। রাত্রির জন্যও নিয়ে আসব”।
তনয়া অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললেন, “একদম না। তুমি নিজেও খাবে না। মেয়েকেও এসব আমি খাওয়াতে দেব না। আর দেখো, অনেক যন্ত্রণা দিয়েছো, আর বেশি যন্ত্রণা দিলে তোমার ওই ফোনটা আমি একদম আগুনে পুড়িয়ে দেব। যদি না করেছি তাহলে তোমার একদিন কি আমারই একদিন”।
প্রণয় বললেন, “বশীকরণ করেছে তোমায় ওই মোল্লা ফ্যামিলিটা। তোমাকেও করেছে। রাত্রিকেও করেছে। কিছু খাইয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই ভাতের সঙ্গে। ওদের মধ্যেও অনেক গুণীন আছে। তুমি জানো না”।
তনয়া বললেন, “তুমি এগুলোও বিশ্বাস করা শুরু করেছো? দিন দিন তো তোমার খুব উন্নতি হচ্ছে! শেষে তোমার জন্য আমাকে এসবও বিশ্বাস করতে হবে নাকি?”
প্রণয় বললেন, “গুরুজী বললেন তো, ত্রিকালদর্শী উনি। একসঙ্গে সব কাল দেখতে পারেন”।
তনয়া বললেন, “সব ভণ্ড। এদের কাজ হল মানুষে মানুষে দাঙ্গা লাগানো। শোন, তোমার এই গুরুজী, বাবাজী বা যা যা আছে, হ্যাঁ, ওই গোমূত্র, গোবর ধরেই বলছি, এই সব কিছু আমার মেয়ের সুস্থ হওয়া অবধি যেন এ বাড়িতে না ঢোকে। যদি ঢোকে, তাহলে আমি সব জ্বালিয়ে দেব। তোমার এসব অনেক সহ্য করেছি। আজ তো ওই ছেলেটার সঙ্গেও দেখা হল। ওই ডাক্তার বরাটের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিল। অত্যন্ত ভদ্র ছেলে”।
প্রণয় হতভম্ব হয়ে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি ওই ছেলের সঙ্গে কথা বলেছো? তোমার এত সাহস? আমার বাড়িতে থেকে তুমি ওই মোল্লাদের সঙ্গে কথা বললে?”
তনয়া বললেন, “তোমার বাড়ি? উদয়াস্ত পরিশ্রম করে রান্না করে ঘর সাজিয়ে সব আমি করব, আর তোমার বাড়ি হয়ে গেল? তোমাকে বললাম তো, এই নিয়ে তোমার সঙ্গে আমি কোন কথা বলব না। শুধু জেনে রেখো, আমার কাছে সবার আগে আমার মেয়ে। তারপরে তুমি”।
প্রণয় বললেন, “ওই ছেলে যদি এ বাড়ির ধারে কাছে আসে, মনে রাখবে আমি গুণ্ডা দিয়ে ওর হাত পা ভেঙে দেব”।
তনয়া বললেন, “নাসিমের বয়েই গেছে এ বাড়িতে আসতে। ও না থাকলে লাইনটা কে দিত শুনি? নিজে তো বাড়িতে বসে নাটক করে যাচ্ছো। স্বার্থপর অপদার্থ একটা লোক”।
প্রণয় লাফাতে শুরু করলেন, “মোল্লা বশ করেছে তোমায়। আমি এবার গুরুজীর সঙ্গে কথা বলবই”।
প্রণয় ফোন নিতে গেলেন।
তনয়া এবার প্রণয়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সজোরে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারলেন। ফোনের স্ক্রিণটা ভেঙে গেল।
প্রণয় তনয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আর ভেঙে যাওয়া ফোনের দিকে তাকিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে যাচ্ছিলেন।
বাড়ির বাইরে কতগুলো ছেলে আড্ডা মারছিল। তনয়া তাদের বলল, “এই ছেলেরা, আমাদের বাড়িতে করোনা হয়েছে। তোমাদের কাকু দেখো করোনা নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোতে যাচ্ছে”।
ছেলেগুলো হৈ হৈ করে উঠল।
প্রণয় তনয়ার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললেন, “এটা তুমি কী করলে? পাড়ার লোক এবার আমাদের একঘরে করবে”।
তনয়া বললেন, “বেশ করবে। তোমার মত উন্মাদ লোকের ওষুধ এটাই”।
৩৬
নাসিম স্নান করে ঘরে ঢুকে চুপ করে বসে ছিল।
নীপা নাসিমের ঘরে ঢুকে বলল, “কী রে দাদা? তুই এত চুপ করে গেলি কেন? মুড ঠিক আছে তোর?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই”।
নীপা বলল, “রাত্রিদির সঙ্গে কথা হয়েছে?”
নাসিম বলল, “না না, কথা হবে কী! ওর জ্বর হয়েছে। কোভিড টেস্ট করালো”।
নীপা চমকে উঠে বলল, “সেকী রে! এসব কখন হল? কালকেই তো এখান থেকে গেল”।
নাসিম বলল, “জানি না। কাল এখান থেকে গিয়ে জ্বরে পড়েছে বোধ হয়। শুনলাম, খুব মাথা ধরে আছে”।
নীপা বলল, “এত তাড়াতাড়ি কি কোভিড হয় নাকি? এখান থেকে যাওয়ার সময় অবধি তো ঠিকই ছিল”।
নাসিম বলল, “এখান থেকে যাবার পর কী কী ফেস করতে হয়েছে ওকে, সেসব তো জানি না। আর কোভিড হয়েছে নাকি সেটা তো কনফার্ম না, জাস্ট সন্দেহ। তবে আজকাল যা অবস্থা, ওই টেস্ট করতে গেলেও মানুষের সংক্রমণ হয়ে যাচ্ছে। আমি ওর হয়ে লাইন দিয়ে এলাম। আমার থেকে দূরেই থাক এখন”।
নীপা বলল, “তুই লাইন দিলি? বলিস কী? ওর বাবা কিছু বলল না?”
নাসিম বলল, “ওর বাবা ছিল না। থাকলে বলত নিশ্চয়ই”।
নীপা বলল, “ওর বাবাটা কেমন যেন বল?”
নাসিম বলল, “সবাই কেমন যেন? সিস্টেমটাই কেমন যেন। ওসব নিয়ে ভাবিস না তুই। ঘরে যা”।
নীপা বলল, “তোর কোন অস্বস্তি হচ্ছে না তো? চা করে দেব?”
নাসিম বলল, “সে দে। আমি ক’টা দিন বাইরের ঘরে থাকি”।
নীপা বলল, “থাক। আর শোন, এমনি জ্বরও হতে পারে। এখন সাধারণ জ্বরকেও লোকে কোভিড ভেবে নিচ্ছে”।
নাসিম বলল, “এখন সাধারণ জ্বর হলে লোকের ইমিউনিটি কমে যাচ্ছে। কিন্তু কোন গ্যাদারিং থেকে জিনিসটা শরীরে এসে যাচ্ছে”।
নীপা বলল, “হতেই পারে। কাল ওর বাবা যাদের নিয়ে এসেছিল, লোকগুলো কেমন যেন। একজনেরও মাস্ক ছিল না”।
নাসিম বলল, “সব কিছু থেকেই রোগটা হবার চান্স আছে। যাক গে, তুই চা করলে দিস। আমি শুই কিছুক্ষণ”।
নীপা রান্নাঘরে গেল। শায়লা রান্না করছিলেন।
নীপাকে দেখে বললেন, “কী হল? দাদা কী বলছে?”
নীপা বলল, “রাত্রিদির শরীর ভাল না”।
শায়লা বললেন, “নাসিম কী করে জানল?”
নীপা বলল, “কোভিড টেস্ট করাতে গেছিল রাত্রিদি। ওখানে দেখা হয়েছে”।
শায়লা বললেন, “আমার আর ভাল লাগে না। পারলে তোদের সবক’টাকে ছেড়ে যদি কোথাও চলে যাওয়া যেত, আমি যেতাম। তুই কালকে দেখলি ওর বাবা কী করল এখানে এসে, এখন নাসিম হ্যাংলার মত আবার চলে গেল?”
নীপা বলল, “ওর বাবা ছিল না। আর দাদা তো রেড ভলান্টিয়ার। কারো কোন সমস্যা হলে যাবে না কেন?”
শায়লা বললেন, “যাবার দরকার নেই। কোথাও যেতে হবে না। এই রেড ভলান্টিয়ারগিরিও করতে হবে না। ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়াবে, তারপর লোকে জিরো জিরো বলে খ্যাপাবে। সব লোক ধান্দাবাজ। নিজের ছাড়া কেউ কিচ্ছু বোঝে না। আমাদের যখন বিপদ হবে, দেখবি কেউ আসবে না। ওই পার্টির লোকও আসবে না”।
নীপা বলল, “বিপদ মানে? কী বিপদের কথা বলছ?”
শায়লা দাঁড়িয়ে পড়লেন, “কী বিপদ? কী বিপদ হতে পারে তোর কোন ধারণা আছে? চেনা জানা মানুষেরাই কীভাবে পাল্টাতে পারে তুই জানিস? গুজরাটে কী হয়েছিল? একজন গর্ভবতী মেয়ের পেটে ওরা তলোয়ার চালিয়ে দিয়েছিল”।
শায়লা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
নীপা বলল, “খামোখা চিন্তা করছ মা। এসব কিছু হবে না এখানে”।
শায়লা বললেন, “পৃথিবীর কোন জায়গাই কোন বাবা মায়ের কাছে তার সন্তানের জন্য আর নিরাপদ না। সেটা এ দেশ হল বা ইউরোপ আমেরিকা হোক। আমি তোদের বার বার বলেছি, আমি চাই না, নাসিম এটায় জড়িয়ে পড়ুক। আসলে কিন্তু ও পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে। তোর বাবাকে তো বুঝিয়ে উঠতে পারি না, উনি যতই পড়াশুনা করুন, অন্য লোকেদের কাছে মুসলমান মানেই টেরোরিস্ট”।
নীপা বলল, “আহ। তুমি ভীষণ স্যাডিস্ট”।
শায়লা বললেন, “বাধ্য হয়ে হয়েছি। দেখছি তো চারপাশটা। যাক গে, রাত্রি মেয়েটার জন্যও তো খারাপ লাগছে। তাও সেটাতেও ভয় লাগে। শুনছিলি তো ওর বাবা কী বলছিল?”
নীপা বলল, “বলুক না। তাতে কী হয় মা? তোমার খারাপ লাগছে সেটা শুনে বরং আমার ভাল লাগল”।
শায়লা বললেন, “চুপ কর। পাকা মেয়ে কোথাকার”।
নীপা হেসে ফেলল।
৩৭
“বউ কথা না শুনলে বা বেয়াদবি না করলে তালিবানরা কী করে জানো? মাথায় গুলি করে দাও। তোমার কপাল ভাল তুমি হিন্দু ঘরে বিয়ে করেছো”।
রাত্রিকে সবে ঘরে শুইয়ে দিয়ে এসে তনয়া বসার ঘরে এসে কথাগুলো শুনলেন।
থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, “এক কালে বর মরলে হিন্দুরা বউকে চিতায় চড়িয়ে দিত। সেটা বন্ধ হয়েছে। তা বলে কি সেটাকে ভাল বলব? কোন ধর্ম এগিয়েছে, কোন ধর্মের একটা অংশ এগোয় নি। তা বলে কিছু না জেনে, না বুঝে তোমার মত অসভ্যতা করতে হবে?”
প্রণয় বললেন, “তুমি আমার ফোন ভেঙে দিলে। আমি গুরুজীর সঙ্গে যোগাযোগ করব কীভাবে?”
তনয়া বললেন, “বেশ করেছি তোমার ফোন ভেঙে দিয়েছি। চেষ্টা কর এবার স্বাভাবিক হবার। নিজে বুঝতে পারছো না তুমি কী করছো?”
প্রণয় বললেন, “তুমি বুঝতে পারছো না তুমি কী করছো। একটা মোল্লা ছেলের সঙ্গে মেয়ের যোগাযোগ থাকা মানে কী ভয়ানক তুমি বোঝো? যদি ছেলেটা টেরোরিস্ট হয়?”
তনয়া বললেন, “টেরোরিস্টই বটে। লোকের বাড়ির লোক ফেলে রেখে যাচ্ছে, আর ছেলেগুলো নাওয়া খাওয়া ভুলে অক্সিজেন নিয়ে দৌড়চ্ছে। টেরোরিস্টই। ঠিকই তো। লোকগুলো মরলে দেশের জনসংখ্যা কমে যেত। তাহলেই ভাল হত”।
প্রণয় বললেন, “ধান্দায় করছে। সব ধান্দায়”।
তনয়া বললেন, “ভাল তো। ধান্দাতেই করুক না। কতজন ধান্দায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় বল তো? ভোটে হেরে যাবার পর তো ঘরে বসে যেতে পারত। করে নি। করে যাচ্ছে তো”।
প্রণয় বললেন, “তুমি থামো। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকো। মেয়েছেলে, তুমি কী বুঝবে?”
তনয়া হেসে ফেললেন, “দেখলে তো? সেই মেয়েছেলে বলে কোণঠাসা করেই দিলে! তোমার আর একজন মুসলিম মৌলবাদীর মধ্যে কী পার্থক্য আছে? দুজনেই তো মেয়েদের মানুষ বলেই মনে কর না”।
প্রণয় বললেন, “আমি অনেক ভাল। ওরা হলে এতক্ষণে গুলি করে দিত”।
তনয়া বললেন, “তোমার কাছে এখন বন্দুক থাকলে তুমি গুলি করতে না বলছো? আমার মনে হচ্ছে না। ওরা ব্রেইনওয়াশড ক্রিমিনাল। তুমিও কোথাকার সব হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে থেকে ব্রেইন ওয়াশড হয়ে গেছো। তোমার গুরুজী যদি তোমাকে হাতে একটা বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে বলে নে বউ মেয়েকে গুলি করে মেরে দে, তুমিও তাই করবে। তোমরা হিন্দু হও বা মুসলমানই হও, তোমরা তো নিজেদের বুদ্ধিতে চলবে না। চলবে পরের বুদ্ধিতে। কেউ চলবে ইমামের কথায়, আর কেউ কোন গুরুজী ধরবে। পড়াশুনা করেছো তো, ভালমন্দের বিচার নিজেই তো করতে পারো। অন্য লোক কেন ঠিক করে দেবে তুমি কী করবে? তোমার মেয়ে কার সঙ্গে মিশবে বাকিরা কেন ঠিক করবে?”
প্রণয় কিছু বলতে গিয়ে কাশতে শুরু করলেন। কেশে নিয়ে বললেন, “তুমি ওই ছেলেটার ধান্দাটা বুঝতে পারছো না। ওরা এভাবেই এখন হিন্দু বাড়ির মেয়েকে ফুসলিয়ে বিয়ে করবে। তারপরে মুসলিম বানিয়ে দেবে”।
তনয়া বললেন, “মানুষ কি তুমি শুধু একা চেনো? আমি চিনি না?”
প্রণয় থার্মাল গান আবার নিজের মাথায় দিলেন। বললেন, “ও বাবা। একশো জ্বর উঠে গেল তো। এবার আমি কী করব?”
তনয়া বললেন, “কাল সকালে টেস্ট করাও। বাধিয়েছো আর কী! আমিও অপেক্ষা করে থাকি। আমারও নিশ্চয়ই হবে। তুমি এক কাজ কর না, যারা এসেছিল তাদের নাম্বার জোগাড় কর। তোমার পক্ষে খুব কঠিন হবে না। তাদের বল তোমার কোভিড হয়েছে। টেস্ট করাতে হবে। দেখো তো, আসে নাকি। ধর্ম রক্ষা করতে তো ঝাঁক বেঁধে চলে এসেছিল। এখন দেখি আসে কি না”।
প্রণয় বললেন, “আসবে তো। কেন আসবে না?”
তনয়া বললেন, “কর তবে”।
প্রণয় বললেন, “তোমার ফোন দাও”।
তনয়া তার ফোন এনে দিলেন। প্রণয় বললেন, “গুগলেই নাম্বার থাকবে। দেখছি”।
মিনিট খানেকের মধ্যেই নাম্বার জোগাড় হল।
কিছুক্ষণ পর ফোনে যোগাযোগ করা গেল।
কথা হলে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওরা কাল থাকবে না। দুটো দিন পরে এসে নিয়ে যাবে। দেখলে, কেমন কথা শুনল?”
তনয়া বললেন, “এই দুটো দিনে যদি তোমার কিছু হয়ে যায়? কাল টেস্ট করা দরকার আর দুটো দিন পরে আসবে? সত্যিই আসবে নাকি দেখার জন্য আমি রইলাম তো। দেখব”।
প্রণয় বললেন, “আসবে না কেন? ঠিক আসবে”।
তনয়া হাসলেন, “আসবে না। দাঙ্গা করার লোক মানুষ বাঁচাতে আসে না। দেখে নিও”।
প্রণয় থমথমে মুখে বসে রইলেন।
৩৮
রাকিব ক্লাসের জন্য নোটস তৈরী করছিলেন।
নীপা দরজায় নক করল, “বাবা, আসব?”
রাকিব বললেন, “আয়”।
নীপা ঘরে ঢুকে বলল, “রাত্রিদির শরীর খারাপ। কোভিড টেস্ট করিয়েছে। দাদা গেছিল”।
রাকিব চমকে বললেন, “সেকী! কেমন শরীর খারাপ?”
নীপা বলল, “দাদা বলল, জ্বর আছে। দাদা টেস্ট করানোর ওখানে লাইন দিয়েছিল বলল তো”।
রাকিব চিন্তিত হলেন। বললেন, “কী পরিস্থিতিতে মেয়েটা আছে কে জানে। এবার চিন্তা হচ্ছে”।
নীপা বলল, “সেই তো। এখানেই ভাল ছিল। কেন গেল বল তো”!
রাকিব বললেন, “ওর বাবা যাতে আমাদের বেশি আর অপমান করতে না পারেন, তাই চলে গেল। মেয়েটা ভীষণ সেন্সিটিভ”।
নীপা বলল, “ভাল লাগছে না শোনার পর থেকে। আমরা কি কিছুই করতে পারি না”?
রাকিব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “বিভেদের অবক্ষয় এত বেশি হয়ে যাবে কোনদিন, ভাবতে পারি নি। সামনের দিনগুলো এরকমই আসবে হয়তো”।
নীপা বলল, “মা খুব ভয় পায় বাবা। মাকে বোঝাতে পারো না, এত ভয়ের তো কিছু নেই”।
রাকিব বললেন, “তোর মা প্র্যাক্টিকাল মানুষ। হয়ত ভয়ের কারণ আছে বলেই ভয় পায়। আমি যখন মসজিদে যেতাম না, তখন আমার উপরেও কম চাপ আসে নি। অনেক মুরুব্বিরা এসে বুঝিয়েছে। আমার বাবাকেও বোঝাতেন ওরা। বছরের পর বছর মানুষের মনে জমে থাকা অন্ধবিশ্বাসকে হারানো খুব কঠিন কাজ। তোর মা যখন বলেছিল নাসিম মসজিদে যাক, আমি বাধা দিই নি। দেখতে চেয়েছি নাসিম কী চায়। ও নিষ্ঠার সঙ্গেই করে। করুক। যেদিন মনে হবে করবে না, আমি চাই, সেদিন কোন বাইরের লোক এসে যেন ওকে বোঝাতে না যায় ও যা করছে, সেটা ঠিক না। এটুকু স্বাধীনতা প্রতিটা মানুষের থাকা উচিত। তোর মাকে কী করে বোঝাই বল তো ভয়ের কিছু নেই? তোর ভয় লাগে না?”
নীপা বলল, “আমার ভয় লাগে না। কেন ভয় লাগবে? আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। কে না কে কী বলে যাবে, সব কিছু শুনবই বা কেন এত?”
রাকিব হাসলেন, “তুই আমার মত হয়েছিস। যুক্তিবোধ আর মুক্তমন এতটাই প্রবল হোক, কোন অন্ধবিশ্বাস যেন তাকে হারাতে না পারে। মানুষের বিবর্তনের পথে ধর্ম এসেছে। সময়ের সঙ্গে অনেক ধর্মই নিজেকে পাল্টাতে পেরেছে। যারা পাল্টাতে পেরেছে, তারা উন্নতি করেছে। যারা পারে নি, তারা সমস্যায় পড়েছে। অনেকটা উইন্ডোজ নাইন্টি এইটে এখনকার কোন গেম খেলার মত। বুঝতে পারছিস? সময়টা এগিয়েছে, মানসিকতা এদের মধ্যযুগে পড়ে আছে। মেয়েরা বেরোবে না, তোমরা এখানে যাবে না, সেখানে যাবে না, অন্য ধর্মে বিয়ে করা তো দূর, নিজের পছন্দেই বিয়ে করতে পারবে না, এ সবই সময়ের সঙ্গে নিজেকে আপডেট করতে না পারার সমস্যা। হিন্দু ধর্মেও তো সমস্যাগুলো ছিল, গোঁড়ামি ছিল। নবজাগরণ এসেছিল। রাজা রামমোহন রায় কিংবা বিদ্যাসাগরের মত মানুষেরা ছিলেন যারা গোটা সমাজের বিরুদ্ধে যেতে পেরেছিলেন। আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা হল, এক শ্রেণীর মানুষের বিপথে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে যে ধর্মটা তৈরী করা হল, সে ধর্মটার সেভাবে আপডেট হল না। মধ্যযুগেই পড়ে রইল বেশিরভাগ মানুষ। সময় পাল্টাচ্ছে, পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে সব কিছু পালটানো অবশ্যই দরকার। মেয়েরা শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র নয়, তাদের কথা বলতে দিতে হবে, প্রয়োজনে অত বছর আগে যা বলা হয়েছে, তা পাল্টাতে হবে। নইলে জাত হিসেবে কিছুতেই এগনো সম্ভব হবে না। সর্বক্ষণ শুধু এটা কোর না, ওটা কোর না, এর সঙ্গে মিশো না, তার সঙ্গে মিশো না না বলে বলুক না সবাই মিলে পৃথিবীটাকে ঠিক করি! এত ক্ষত তৈরী হচ্ছে, কীভাবে সারবে কে জানে”।
রাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
নীপা বলল, “আমাদের বাড়ির ব্যাপারটা নিয়ে দাঙ্গা লাগতে পারতো, বল বাবা?”
রাকিব বললেন, “কেন লাগবে? দাঙ্গা কি এতই সহজ নাকি? মেয়েটার খোঁজটা নেওয়া বড্ড দরকার। কাল সকালে যাব ভাবছি একবার”।
নীপা চমকে উঠে বলল, “যেও না বাবা। অপমান করে যদি”।
রাকিব বললেন, “খোঁজটা তো নিতে হবে। ঠিক আছে, নাসিমকে বলছি, খোঁজটা নিক”।
নীপা বলল, “তাই ঠিক হবে”।
রাকিব বললেন, “একবার নাসিমকে পাঠিয়ে দিস তো”।
নীপা মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে”।
৩৯
বমি ভাব প্রবল হবার জন্য রাতে রাত্রি সেভাবে খেতেই পারল না। যতটা সম্ভব খাইয়ে তনয়া দেখলেন প্রণয় পাংশু মুখে বসে আছেন। বললেন, “জ্বর এসেছে। কী করব?”
তনয়া বললেন, “খেয়ে ঘুমাও। আর কী করবে? কাল ডাক্তার দেখিও”।
প্রণয় বললেন, “লাস্ট কবে প্রেশার সুগার মাপিয়েছি ভুলে গেছি”।
তনয়া বললেন, “সেটাই তো স্বাভাবিক। সারাক্ষণ বাংলাদেশের হিন্দুরা কী করছে, ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা কী করছে হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ পড়ে যাচ্ছো, নিজে কেমন আছো সেটাই দেখো নি। দেখো এবার”।
প্রণয় বললেন, “রাত্রিকে কী ওষুধ দিয়েছে আমাকেও দাও। আমিও খেতে শুরু করি”।
তনয়া বললেন, “সেটা তো খাওয়া ঠিক হবে না, আপাতত জ্বরের ওষুধ খাও খেয়ে নিয়ে। তারপর দেখা যাবে”।
প্রণয় বললেন, “ঠিক আছে। আর কাল সকালে কি একবার খাটালের দিকে যাব? যদি গোমূত্র পাওয়া যায়? মানে গুরুজী বলছিলেন…”
তনয়া রাগী চোখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “একদম খেয়ে ঘুমাবে। একটা বাজে কথা বললে তোমার কপালে দুঃখ আছে”।
প্রণয়ের তেজ কমেছে। তিনি বেশি কথা না বলে খেতে বসে গেলেন। তার চোখে মুখে একটা ভীত ভাব দেখতে পেলেন তনয়া। খেয়ে নিয়ে জ্বরের ওষুধ খেয়ে প্রণয় শুলেন।
তনয়া খেয়ে হাতের কাজ সেরে বললেন, “আমি অন্য ঘরে শুচ্ছি। কোন দরকার পড়লে ডাকবে”।
প্রণয় বললেন, “ঠিক আছে”।
তনয়া ঠাকুরঘরের ছোট খাটে গিয়ে শুলেন।
ঘুম আসছিল না। বেশ কয়েকদিন ধরে একে এই করোনার বাড় বাড়ন্ত প্রকোপ, তারপর পরিবর্তিত প্রণয় তাকে ঘুমাতে দিচ্ছিল না। মানুষের মনে কী করে যে এত ঘৃণা ছড়াতে পারছে মানুষ, হাজার ভেবেও কূল কিনারা পাচ্ছিলেন না তিনি। প্রণয় তো এরকম ছিলেন না। বিয়ের পরে কত রোম্যান্টিক ছিলেন। রাত্রি হবার পরেও ভাল ভাল বই পড়তেন। হঠাৎ করে এরকম হয়ে গেলেন।
মানুষের মনে ভালোবাসা ছড়ানোর থেকে অনেক সহজ বোধহয় ঘেন্না ছড়ানো। অবদমিত হতাশা, দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য মোবাইলে পড়ে পড়ে আজকে এই জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছেন।
ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে এসেছিল তনয়ার, ঘুম ভাঙল প্রণয়ের ডাকে, “শোন না। আমার বুকটা কেমন করছে”।
তনয়া উঠে বসলেন। প্রণয় দরদর করে ঘামছেন।
তনয়া হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। কী করবেন মাথায় কিছুই এল না। প্রণয়কে তাড়াতাড়ি বসিয়ে জল খাওয়ালেন। প্রণয় বললেন, “বুকে হঠাৎ করে ব্যথা হচ্ছে। হার্ট অ্যাটাক হল নাকি বল তো”।
তনয়া কোন কিছু না ভেবে নাসিমকে ফোন করলেন।
দুবার রিং হতেই নাসিম ধরল, “হ্যাঁ, বলুন কাকীমা”।
তনয়া বললেন, “রাত্রির বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বুকে ব্যথা। কিছু করা যাবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না”।
নাসিম বলল, “আমি যাচ্ছি। চিন্তা করবেন না। কুড়ি মিনিট মত সময় দিন”।
তনয়া বললেন, “ঠিক আছে”।
ফোন রাখলেন তনয়া।
প্রণয় হাঁফাচ্ছিলেন। বললেন, “কাকে ফোন করলে?”
তনয়া বললেন “নাসিমকে”।
প্রণয় বললেন, “কেন ডাকতে গেলে? আর কিছু ছিল না? পাড়ার লোকদের ডাকো”।
তনয়া বললেন, “কোন পাড়ার লোক করোনা সাসপেক্টের বাড়িতে এখন আসবে? আর কাকে চিনবো আমি? তুমি সোফায় শুয়ে পড়। দেখছি আমি”।
তনয়া তৈরী হয়ে নিলেন। রাত্রিকে আর ডাকলেন না।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে নাসিম আর ঋপণ চলে এল। রাত সাড়ে বারোটা বাজে। তনয়া দরজা খুলে দিলেন।
নাসিম বলল, “ঋপণদা গিয়ে কাকুকে নিয়ে আসুক। আমি বরং বাইরে দাঁড়াচ্ছি”।
তনয়া বুঝলেন নাসিম কেন আসতে চাইছে না। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “তুমি এসো। আমি বলছি, এসো”।
নাসিম ঋপণকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঋপণ বলল, “আমি তপনদার সঙ্গে কথা বলেছি। একবার দেখিয়ে আনছি। উনি বললেন হসপিটালাইজড করে দিচ্ছি। চলুন”।
নাসিম আর ঋপণ প্রণয়কে তুলল।
প্রণয়ের চোখ বন্ধ। দুজনের ঘাড়ে ভর দিয়ে কাতর স্বরে তনয়াকে বললেন, “তুমি যাবে না?”
তনয়া বললেন, “যাচ্ছি তো। চল”।
৪০
হাসপাতালের এমারজেন্সীতে ডাক্তারবাবু প্রণয়কে দেখছিলেন। তনয়া তার সঙ্গে আছেন।
একটু দূরে নাসিম দাঁড়িয়ে ঋপনের সঙ্গে।
ঋপণ বলল, “যেন সব ঠিক ঠাক থাকে। যা শুনলাম হাসপাতালে একটাও সিট নেই”।
নাসিম বলল, “ঠিক না থাকা মানে কী হতে পারে?”
ঋপণ বলল, “কিছু না। তুই চিন্তা করিস না। আমি আছি তো”।
নাসিম বলল, “শান্তদাকে বললে হেল্প করবে না?”
ঋপণ বলল, “পার্টির উপরমহলের সঙ্গে কথা বলে নেব দরকার হলে। বললাম তো ভাবিস না। আচ্ছা, যদি কলকাতা যেতে হয়, তাহলে কি ওই রাত্রি মেয়েটা কী করবে?”
নাসিম বলল, “জানি না, ওর মা কী বলেন দেখি”।
তনয়া প্রণয়কে বসিয়ে রেখে তাদের দিকে এগিয়ে এসে নাসিমকে বললেন, “ডাক্তারবাবু বলছেন অবজারভেশনে রাখতে হবে। কয়েকটা টেস্ট দিয়েছেন। ওষুধ দিয়েছেন। ইসিজি করানো যাবে এখন?”
নাসিম ঋপনের দিকে তাকিয়ে বলল, “পালিতদাকে বলবে একবার?”
ঋপণ বলল, “দেখছি”।
ঋপণ ফোন করল। খানিকক্ষণ কথা বলে বলল, “চলুন। বাড়িতেই আছে। ইসিজি করিয়ে নি”।
প্রণয়কে নিয়ে তনয়া এম্বুলেন্সে উঠলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পালিতবাবুর বাড়িতে পৌঁছল তারা।
ইসিজি করা হল। পালিতবাবু রিপোর্ট দেখে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে তনয়াকে বললেন, “রিপোর্ট ঠিক আছে। তাও কাল বাকি টেস্টগুলো করিয়ে নেবেন। গ্যাস ফর্ম করেই হয়েছে সম্ভবত”। তনয়া হাঁফ ছাড়লেন।
প্রণয় গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন। তাদের এম্বুলেন্সে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হল।
তনয়া নাসিম আর ঋপণকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলেন। নাসিম বলল, “যে কোন দরকারে আমাকে ফোন করবেন। কোন দ্বিধা করবেন না”।
তনয়া বললেন, “দ্বিধা আসে নি বলেই তো তোমাকে ফোন করেছিলাম”।
নাসিম বলল, “কাল সকালে টেস্টে করার ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রিপোর্ট এলে আরেকবার ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন”।
তনয়া বললেন, “ঠিক আছে। ভিতরে এসো তোমরা। চা খাও। এত রাতে এভাবে দৌড়ঝাঁপ করছ, ভাবা যায় না”।
নাসিম প্রণয়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, “না না, আমরা এখন আসি। ফোন করবেন”।
ঋপণকে প্রায় জোর করেই নাসিম প্রণয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
তনয়া ওদের চলে যাওয়াটা দেখে শ্বাস ছাড়লেন। বুঝলেন প্রণয়ের দুর্ব্যবহারের ভয়ে নাসিম আর ঢুকল না।
প্রণয় সোফায় চুপ করে বসে ছিলেন।
তনয়া বললেন, “ছেলেগুলো ঘরে এলে ভালো লাগত”।
প্রণয় বললেন, “গঙ্গাজল থাকলে ঘরের বাইরেটা গঙ্গাজল দিয়ে ছিটিয়ে দাও”।
তনয়া প্রণয়ের দিকে বিস্মিতভাবে তাকিয়ে বললেন, “এটা তুমি বলতে পারলে? এত কিছুর পরেও?”
প্রণয় বললেন, “এগুলো ওদের পলিটিকাল প্রোপাগান্ডা। এসব করে ভাবছে ভোট পাবে। আর মোল্লাটা কেন এসব করছে তুমি বুঝতে পারছ না? হিন্দু মেয়ে বিয়ে করবে, তাই আমাকে হাতে রাখতে চাইছে এভাবে”।
তনয়া বললেন, “বিয়ে করতে চাইলে তোমার মত ফালতু লোককে হাতে রাখার দিকে যাবেই বা কেন? আমার মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক, ওরা চাইলে বিয়ে করতেই পারে, তাতে তোমাকে হাতে রাখার তো কিছু নেই”।
প্রণয় মাথা নাড়লেন, “তুমি বুঝবে না। হাতে এখনো রাখতে হবে। আমি যে ওদের বাড়িতে অত লোক নিয়ে গেলাম, ওরা বুঝে গেছে যে আমার পিছনে লোক আছে। ভয় পাচ্ছে বুঝছ না?”
তনয়া বললেন, “আমি সব বুঝতে পারছি। শুধু এটা বুঝতে পারছি না তোমার চোখে যে মোটা একটা নোংরা চশমা লেগে আছে, সেটা ঠিক কবে নামবে।”
প্রণয় তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে কী করতে বলছ? ওই মোল্লাছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেব? তাই তো?”
তনয়া বললেন, “তোমার মেয়ের যদি সত্যিই করোনা হয়ে থাকে, তাহলে বিয়ে, মোল্লা, হিন্দু, জাত পাত, এসব পরে আসবে। সবার আগে মেয়েটাকে বাঁচতে হবে, তাই না?”
প্রণয় বললেন, “আর মোল্লাটার সঙ্গে বিয়ে হলে আমি বাঁচবো না”।
তনয়া বললেন, “আমি তোমার সঙ্গে এসব ব্যাপারে যত কম কথা বলব, ততো ভাল। তুমি গিয়ে শোও। যাও”। প্রণয় বললেন, “তুমি যাবে না?”
তনয়া বললেন, “আমাকে শান্তিতে ঘুমোতে দিচ্ছো তুমি? একটা না একটা ঝামেলা করেই যাচ্ছো। তুমি যাও। আমি পরে যাচ্ছি, একবার মেয়েকে দেখে আসি”।
প্রণয় বললেন, “আমি আমার পরিচিতদের খবর দিচ্ছি। কাল ওরা আসুক। এই রেড ভলান্টিয়ার আর মোল্লারা কাল যেন এখানে না আসে”।
তনয়া রেগে গিয়ে বললেন, “যাকে খুশি ডাকো, আমি কিছু জানি না”।
৪১
নাসিম স্নান সেরে ঘরে ঢুকে দেখল রাকিব জেগে আছেন। তাকে দেখে বললেন, “ঠিক আছিস তো?”
নাসিম অবাক হল, “হ্যাঁ। কেন বল তো?”
রাকিব বললেন, “সময়টা এত খারাপ হয়ে গেছে, আজ সন্ধ্যেতেই দেখলাম কোথায় এক রেড ভলান্টিয়ারকে সাহায্যের নামে ডেকে নিয়ে গিয়ে মারধোর করেছে”।
নাসিম হাসল, “না না, সেসব কিছু না। করবে হয়ত মারধোর, কাজ ফুরোলেই পাজি হয়ে যায় মানুষ। এটা তো দেখতেই পাচ্ছি। রাত্রির বাবার বুকে ব্যথা উঠেছিল। ওখানে গেছিলাম”।
রাকিব থমকে গিয়ে বললেন, “ভাল করেছিস। কিছু বলে নি তো?”
নাসিম বলল, “বলে নি। সেরে গেলে বলবেন নিশ্চয়ই”।
রাকিব নাসিমের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “নেতাদের ডিগ্রেডেশন তখনই শুরু হয়, যখন থেকে মানুষের ডিগ্রেডেশন হয়। লাইক পিপল, লাইক গভর্নমেন্ট। ঘৃণার চাষ হচ্ছে, এত কিছুর পরে ডিজে, গিমিক জিতছে, দেখা ছাড়া তো উপায় নেই আমাদের”।
নাসিম বলল, “কী হয়েছে বাবা? তুমি আজ এসব বলছো?”
রাকিব বললেন, “কিছু না, তুই ঘুমো গিয়ে। সারাদিন যা দৌড় ঝাঁপ চলছে, অসুস্থ হয়ে পড়বি”।
নাসিম বলল, “আমি কোয়ারান্টাইনে থাকব ভাবছি। রোজই তো কোন না কোন কোভিড পেশেন্টের কাছে যাই। তোমাদের হয়ে গেলে বিপদ”।
রাকিব বললেন, “হলে হবে। যা হবে দেখা যাবে। অত ভাবিস না। রোগের থেকেও রোগের ভয় বড় হয়ে গেলে বিপদ। মন শক্ত থাকলে মানুষ ক্যান্সারকে হারাতে পারে, কোভিড কোন ছার। আর শোন, যাই হোক, মার কাছে গিয়ে মাঝে মাঝে বসিস। তোর মা তোকে নিয়ে ভয়ে থাকে বুঝতে পারি। রেগে যায়, বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছিস। ভিতরে ভিতরে গর্বিত হয় বুঝতে পারি। ঘরে নিরাপদ আশ্রয়ে না থেকে মানুষের জন্য এভাবে কতজন কাজ করতে পারে? এ সবার কম্মো নয়। জানিস তো, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবকে অনেকেই মন থেকে সমর্থন করতেন। রবীন্দ্রনাথও করতেন। ভাল ভাল বাড়ির ছেলেগুলো মোস্ট ওয়ান্টেড হয়ে গেল। দেশের মানুষের জন্যই তো। সময় পাল্টাচ্ছে, মানুষ উপকার পাবার পর পাল্টে যেতেই পারে, কাজটা থাকুক। কাজটা থাকার বড্ড দরকার আছে। রাত্রির বাবা এত কিছু করার পরও তুই ওদের বাড়ি গেছিস, মনের ভিতর রাগকে ঘর বাঁধতে দিস নি, এটা যে কত বড় পরিণতিবোধ, সেটা তুই নিজেও কল্পনা করতে পারবি না। আরো বেশি করে পড়াশোনা কর। মার্ক্স পড়, কেন শ্রমিক শ্রেণী, কৃষক শ্রেণীর কথা বেশি করে ভাবা দরকার বুঝতে চেষ্টা কর। এই দেখ, এত বড় লকডাউন করে দিল, একবারও দেশের নেতারা ভাবল না গরীব মানুষের কী হবে। বিকল্প কী। তারা কী খাবে। পরিযায়ী শ্রমিকরা কী করবে। এটা কেন করতে পারল? বামপন্থীরা শক্তিশালী নেই বলে। বামপন্থা শক্তিশালী না হলে এটা হবেই। ভারতবর্ষের বামপন্থাকে দরকার ছিল”।
রাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “অনেক বাজে লেকচার দিয়ে ফেললাম। তুই ঘুমো”।
নাসিম বলল, “না না। বল। তুমি তো বেশি বল না কারেন্ট এফেয়ারস নিয়ে। শুনতে ভাল লাগছিল”।
রাকিব বললেন, “একটা কথা মনে রাখিস, পার্টি থাকুক বা না থাকুক, মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার চেষ্টা করিস। ঠিক সময়ে মানুষকে জাগতেই হবে একদিন। ক্যাপিটালিজমের সমস্ত জারিজুরি এই ধরণের প্যান্ডেমিকে শেষ হয়ে যাবে। মানুষের পাশে সেই মানুষকেই দাঁড়াতে হবে। সমাজ পাল্টাবে, মানুষের মূল্যবোধ বদলে যাবে, কিছু বেসিক ব্যাপার কোন দিন পাল্টাবে না। যে লোকটাকে তার নিজের বাড়ির লোক একঘরে করে দিত কোভিড হয়েছে বলে, অ্যাম্বুলেন্স চালক গাড়িতে তুলতে পর্যন্ত অস্বীকার করত, রেড ভলান্টিয়াররা আসার পরে সে দৃশ্যের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। হ্যাঁ। তুই নিশ্চিন্ত থাক, যাদের জন্য করেছিস, তারা তোদের নিশ্চয়ই ভুলে যাবে। তা বলে তোদের ভুললে চলবে না। পার্টির বেসিকটা ওখানেই। আবার যদি মানুষের দরকার পড়ে, আবার যাবি। বারবার যাবি। যত প্রতিকূলতাই আসুক”।
নাসিম বলল, “যাব। নিশ্চয়ই যাব”।
রাকিব বললেন, “রাত্রি কেমন আছে?”
নাসিম যন্ত্রণাক্লিষ্ট চোখে বাবার দিকে তাকাল।
৪২
সারারাত ছটফট করে শেষ রাতের দিকে ঘুমোতে পেরেছিলেন তনয়া। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন।
সকাল সাতটা হওয়া মাত্র উঠে রাত্রির ঘরে গেলেন। ডাক্তারবাবু মাস্ক পরে থাকতে বলেছেন।
একটা না। দুটো মাস্ক।
তনয়া দুটো মাস্ক পরে রাত্রির ঘরে গিয়ে দেখলেন রাত্রি কাশছে। বললেন, “কখন উঠেছিস?”
রাত্রি বলল, “সেই ভোর পাঁচটা থেকে উঠে বসে আছি। খুকখুকে কাশি হচ্ছে শুধু”।
তনয়া বললেন, “তোর বাবার তো বুকে ব্যথা ট্যাথা উঠে একাকার। সেই নাসিমকেই ডাকতে হল। ওরা এসে হাসপাতালে নিয়ে গেল”।
রাত্রি বলল, “বাবার কি তাতে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয়েছে?”
তনয়া হাসলেন, “নাহ। বলছে ওগুলো ইচ্ছা করে করছে। ইমপ্রেস করার জন্য করছে”।
রাত্রি জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, নাসিম ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন”?
তনয়া জানলার বাইরে নাসিমকে দেখে চমকে উঠে বললেন, “দাঁড়া। কথা বলি। চিন্তা করছে ছেলেটা। সারারাত জেগেছিল। কী ভাল ছেলেরে”।
রাত্রি কিছু বলল না।
তনয়া বাইরে গিয়ে নাসিমকে ডাকলেন।
নাসিম বলল, “কাকুর টেস্ট করাতে আসতে বলেছি ল্যাবের লোককে। একটু পরে আসবে”।
তনয়া বুঝলেন নাসিম আসলে রাত্রির খবর জানতে চাইছে। বললেন, “রাত্রির কাশি আছে। শরীর ঠিক নেই। রেজাল্ট তাও কখন আসবে?”
নাসিম বলল, “কোন ঠিক নেই। এত এত টেস্ট হচ্ছে, রেজাল্ট আসতে আসতে আজ রাত বা কাল সকাল। কখনো চার পাঁচ দিনও লেগে যাচ্ছে”।
তনয়া বললেন “গোমূত্র খাইয়েছে। কোত্থেকে কতগুলো লোক এসে এসব করে দিল। তোমরা পিটিয়ে দিতে পারলে না?”
নাসিম ম্লান হাসল, “সেটা কী করে হয় কাকীমা? আমরা না বহিরাগত? ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে যায় তো তাহলে”।
তনয়া বললেন, “মারা উচিত ছিল। তোমরা বহিরাগত নও। ওরা বহিরাগত। অহিংসা কখনোই সব কিছুর সমাধান হয় না”।
প্রণয় বাইরে এসে নাসিমকে দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন।
নাসিম বলল, “আমি আসি তাহলে কাকীমা। কোন দরকার হলে বলবেন”।
তনয়া বুঝলেন প্রণয়কে দেখে নাসিম সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তিনি প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি সুস্থ হয়েছো? তাহলে নাসিমকে চলে যেতে বলব। অসুস্থ হলে তো ওকে দরকার পড়বে। হয়েছো সুস্থ?”
প্রণয় হাঁ করে তনয়ার দিকে তাকালেন।
নাসিম বলল, “আমি আসি কাকীমা”।
তনয়া বললেন, “তুমি কি অক্সিমিটার নিয়ে এসেছো? রাত্রির অক্সিজেনটা দেখা দরকার ছিল”।
নাসিম প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন তো আনি নি। নিয়ে আসব পরে”।
তনয়া মাথা নাড়লেন, “ঠিক আছে”।
নাসিম যেতেই প্রণয় গম্ভীর মুখে ঘরের ভিতর গিয়ে বসলেন।
তনয়া ঘরে ঢুকতে প্রণয় বললেন, “ছেলেটা সকাল সকাল চলে এসেছে? বাহ বাহ। বেশ”।
প্রণয়ের গলায় শ্লেষের ছোঁয়া।
তনয়া বললেন, “তোমার ওই হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের লোকজনকে তো দেখলাম না। বিপদে ছেলেটাই এল। আমি কী করব বল? বলে গেল তোমার টেস্ট করার লোক ঠিক করেছে। আসবে কিছুক্ষণ বাদে। সে হিন্দুই”।
প্রণয় গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।
তনয়া বললেন, “কী হল? এবার কী হয়েছে?”
প্রণয় বললেন, “ছেলেটার সঙ্গে কী শলা করছিলে? মেয়েটাকে কীভাবে মুসলমান করবে?”
তনয়া প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার মেয়েটা অসুস্থ। এখনো তোমার মাথায় এগুলো কাজ করে চলেছে? তুমি ধন্য”।
প্রণয় বললেন, “বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারগুলো তোমায় ক্ষমা করবে না”।
তনয়া বললেন, “না করলে না করবে। আমার মেয়ের জন্য কে ভাল সেটা অন্য লোকে ঠিক করে দেবে কেন? আর আমি এসব কথা শুনবই না এখন। কত কত মানুষ মারা যাচ্ছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, অক্সিজেন নেই, এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমি তোমার লেকচার শুনতে পারব না”।
প্রণয় কাশতে শুরু করলেন।
তনয়া বললেন, “তোমারও কাশি হচ্ছে? আজকেই কোভিড টেস্ট করাতে হবে। নাসিমকে বলি”।
প্রণয় বললেন, “আমি একবার চেষ্টা করি। আমাদের গুরুজীকে ফোন করব। তোমার ফোনটা দাও। আজকে আসতে পারেন। বলেছিলেন”।
তনয়া ফোন এনে দিলেন। প্রণয় ফোন করলেন। তিনি কোভিড সাসপেক্ট জানালেন।
কয়েক সেকেন্ড কথা বলে ফোন রেখে বললেন, “উনি জানালেন এই উইকে বিজি আছেন। নেক্সট উইকে দেখছেন”।
তনয়া বললেন “নাসিমকে বলছি। ব্লাড স্যাম্পেল দিয়ে টেস্ট করিয়ে এসো। ও থাকলে অসুবিধা হবে না। দয়া করে টেস্টটা করাও তেজ না দেখিয়ে”।
প্রণয় বললেন, “দরকার নেই। আমি একাই যাব”।
বলে আবার কাশতে শুরু করলেন।
তনয়া বললেন, “যেমন তোমার ইচ্ছা”।
#
সকাল দশটা নাগাদ দেখা গেল প্রণয়কে নিয়ে নাসিম টেস্ট করাতে লাইন দিয়েছে।
৪৩
“তুমি নামাজ পড়?”
প্রণয় নাসিমের বাইকে ওঠার আগে প্রশ্ন করলেন। খানিকক্ষণ আগে তার স্যাম্পেল নেওয়া হয়েছে।
নাসিম বলল, “হ্যাঁ”।
প্রণয় গম্ভীর মুখে বললেন, “বীফ খাও?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ। খাই”।
প্রণয় নাক মুখ কুঁচকে বললেন, “আজ যদি গুরুজী লোক পাঠাতেন, আমি কিছুতেই তোমার সঙ্গে যেতাম না”।
নাসিম বলল, “টোটো ডেকে দেব?”
প্রণয় বললেন, “থাক। ডাকতে হবে না। তোমার কী মনে হয়? আমার হার্টে প্রবলেম আছে?”
নাসিম বলল, “না বোধ হয়। ডাক্তারবাবু বলছিলেন অবেলায় খাওয়া দাওয়ার জন্য গ্যাস হয়েছিল, আর অ্যাংজাইটি তো আছে”।
প্রণয় বললেন, “তোমাকে দেখে তো শিক্ষিত বলে মনে হয়। রেড ভলান্টিয়ার হলে কেন?”
নাসিম বলল, “ওই জন্যই তো হয়েছি”।
প্রণয় বললেন, “যত্তসব। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। চল আমাকে নামিয়ে দিয়ে এসো”।
নাসিম বাইকে বসল। প্রণয় তার পিছনে।
কিছুক্ষণ পরে প্রণয়ের বাড়ির সামনে দাঁড়াল নাসিমের বাইক। প্রণয় বললেন, “যদিও তুমি পিপিই পরে আছো, তবু গিয়ে স্নান কোর”।
নাসিম বলল, “রোজই করি”।
প্রণয় বললেন, “অক্সিমিটার এনেছো? রাত্রি আর আমার অক্সিজেনটাও দেখে যাও”।
নাসিম বলল, “ঠিক আছে”।
তনয়া এসেছিলেন। প্রণয়কে শান্ত মুখে ঘরের ভিতর ঢুকতে দেখে অবাক হলেন।
রাত্রি ঘরে শুয়েছিল।
নাসিম রাত্রির অক্সিজেন মেপে বলল, “আটানব্বই। ঠিক আছে। জ্বরের ওষুধ ডাক্তারবাবুর কথা শুনে খেয়ে যেতে হবে”।
রাত্রি নাসিমের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে বাবা ঘরে ঢুকতে দিল?”
তনয়া বললেন, “তোর বাবাকে নিয়ে টেস্ট করিয়ে এসেছে ছোকরা”।
রাত্রি অবাক হয়ে তনয়ার দিকে তাকাল।
তনয়া বললেন, “অবাক হচ্ছিস? আমি অবাক হই নি। কেউ আসে নি কোভিড সাসপেক্ট শুনে। আর তোর বাবার ওই বিষ ফোনটা আমি ভেঙে দিয়েছি। কাজেই মগজ ধোলাইটা বন্ধ আছে এখন”।
রাত্রি হেসে ফেলল। নাসিমও।
নাসিম বলল, “আমি আসি তাহলে। দরকার হলে ফোন করবেন”।
তনয়া বললেন, “দরকার ছাড়াও ফোন করব”।
নাসিম হাসল, “নিশ্চয়ই”।
তনয়া বললেন, “এই পিপিই পরে থাকাটা বড় কষ্টকর। তোমাকে আটকে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না”।
নাসিম বলল, “না না, ঠিক আছি”।
রাত্রি বলল, “নীপা ঠিক আছে?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ। সবাই ঠিক। আমি আসি”।
রাত্রি বলল, “সাবধানে যেও”।
নাসিম বলল, “সেরে ওঠো’।
রাত্রি বলল, “দেখা যাক”।
নাসিম ঘরের বাইরে বেরোল। ড্রইং রুমে প্রণয় বসে আছেন চুপ করে। তাকে দেখে বললেন, “রাত বিরেতে এদিক সেদিক যেতে হয়, সাবধানে বাইক চালাবে”।
তনয়া অবাক হয়ে প্রণয়ের দিকে তাকালেন। তিনি ভাবতেই পারেন নি প্রণয় এই কথাটা বলবেন।
প্রণয় সেটা বুঝে বললেন, “কাজ করছে, সাবধান হওয়া উচিত”।
তনয়া বললেন, “তা হোক না। মোল্লা তো। ওকে নিয়ে ভাবছো কেন?”
অনেকদিন পরে তনয়া প্রণয়ের মুখে লজ্জা দেখতে পেলেন। প্রণয় বললেন, “কিছু না। সাবধানে যায় যেন। বলে দাও”।
নাসিম বেরোল।
তনয়া প্রণয়ের সামনে বসে বললেন, “তোমার মাথা থেকে একটা ভূত নেমেছে মনে হচ্ছে। মাথাটা হালকা লাগছে?”
প্রণয় বললেন, “কীসের ভূত? কিচ্ছু না। সব ঠিক আছে”।
তনয়া বললেন, “তাহলে এত ভাল ভাল কথা বলছ মোল্লাটাকে নিয়ে?”
প্রণয় তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাজে বোকো না তো। আমি কোথায় ভাল ভাল কথা বলছি? নর্মাল কথা বলছি”।
তনয়া হাসলেন, “ও। ঠিক আছে”।
প্রণয় রেগে গিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলেন।
তনয়া রাত্রির কাছে গিয়ে বসলেন।
রাত্রি বলল, “বাবার কী হয়েছে মা? আমি তো ভাবতেই পারছি না নাসিম এখানে এসেছিল”।
তনয়া বললেন, “আমিও না। এত এত ঝাল ঝাল মেসেজ, এত মোল্লাবিরোধী লোক, বাপরে, আজ আবার কী হল কে জানে”।
রাত্রি হাসল, “অসুখটা সারছে বোধহয়”।
তনয়া বললেন, “কোভিড? সেরে গেছে তোর?”
রাত্রি মাথা নাড়ল, “না মা। কোভিডের থেকেও ভয়ংকর যে অসুখ, সেটা। কোভিড তো কোন অসুখই না। তার থেকে অনেক কঠিন অসুখে ভুগছে অনেকে বাবার মত। সে অসুখটা সারা বেশি জরুরি”।
তনয়া বললেন, “আমার বাচ্চাটা বড় হয়ে গেছে”।
রাত্রি হাসল।
৪৪
নাসিম স্নান করতে গিয়ে বুঝতে পারল তার জ্বর আসছে।
গলার কাছে কিছু একটা ঘোরাফেরা করছে।
নীপা বলল, “এই দাদা, রাত্রিদির কী খবর রে?”
নাসিম বলল, “তুই ঘরে যা। আমার জ্বর আসছে মনে হচ্ছে। ধারে কাছে থাকিস না”।
নীপা বলল, “কথা তো বলতে পারি। যথেষ্ট দূরত্ব আছে”।
নাসিম বলল, “খবর ঠিক আছে। অক্সিজেন তো ঠিকই দেখলাম”।
নীপা বলল, “তোর জ্বর আসছে কেন মনে হচ্ছে?”
নাসিম বলল, “গা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে”।
নীপা বলল, “মা শুনলে রণক্ষেত্র করবে। তুই ছবি হয়ে যাবি। বলবে বার বার বলেছিলাম, কেন যাস?”
নাসিমের স্নান হয়ে গেছিল। গামছা দিয়ে মাথা মুছছিল।
নীপা বলল, “এ কী রে দাদা, তোর চোখও তো লাল মনে হচ্ছে”।
নাসিম বলল, “আমি বাইরের ঘরে থাকছি। তুই থার্মোমিটারটা দিয়ে যা”।
নীপা বলল, “ঠিক আছে। আমি তোর জামা কাপড় দিয়ে যাচ্ছি”।
নাসিম বাইরের ঘরের খাটে গিয়ে শুল।
নীপা থার্মোমিটার দিল টুলের উপর।
নাসিম টেম্পারেচার নিয়ে বলল, “শুরুতেই সেঞ্চুরি করে দিয়েছি। ফাটাফাটি”।
নীপা ফ্যাকাসে মুখে বলল, “এবার কী হবে?”
নাসিম বলল, “ও কিছু হবে না। চিন্তা করিস না। তুই এখানে থাকিস না। দূরে থাক। আর স্যানিটাইজ কর বাইরেটা। যা”।
নীপা ছটফট করতে করতে ঘরের ভিতরে গিয়ে শায়লাকে খবর দিল।
শায়লা সঙ্গে সঙ্গে এলেন। বললেন, “বার বার বলেছিলাম। কেন যাস? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আর ভাল লাগে না আমার”।
নাসিম হেসে ফেলল, “জাস্ট এই কথাগুলোই নীপা বলছিল, তুমি এগুলো বলবে বলে”।
শায়লা বললেন, “এটা হাসির সময়? এবার কী হবে?”
নাসিম বলল, “ঠিক হয়ে যাবে। ভেবো না। রেস্ট নিতে হবে। ঋপণদাকে ডেকে ডাক্তার দেখিয়ে আসব। কোন চাপ নেই”।
শায়লা বললেন, “আমার ঠিক এই ভয়টাই হচ্ছিল”।
শায়লাকে অস্থির হতে দেখে নাসিম বলল, “তুমি অত ভেবো না মা। তুমি এখানে থেকো না। দূরে থাকো। এই রোগে আর কিচ্ছু ম্যাটার করে না। ক’দিন কোয়ারান্টাইনে থাকব, ওষুধ খাব, সব ঠিক হয়ে যাবে”।
শায়লা রেগে গেলেন, “বিরাট বড় বোদ্ধা হয়ে গেছিস তুই, তাই না? সব জেনে গেছিস? যারা সকাল বিকাল গালাগাল দিচ্ছে, খ্যাপাচ্ছে, তাদের জন্য প্রাণ কেঁদে উঠল একবারে। নে এবার কী করবি”।
নাসিম চুপ করে গেল।
শায়লা গজগজ করতে করতে ঘরে চলে গেলেন।
#
সন্ধ্যের দিকে নাসিমের একশো দুইয়ের বেশি জ্বর চলে এল। গায়ে হাত পায়ে প্রবল ব্যথা।
তার ফোন বাজছিল।
নাসিম কোন মতে ফোন ধরল, রাত্রির গলা ভেসে এল, “কী খবর?”
নাসিম হাসার চেষ্টা করল, “এই তো। বাড়িতে। তুমি কেমন আছো?”
রাত্রি বলল, “জ্বর কম কম লাগছে। এ যাত্রায় বেঁচে যাবো মনে হচ্ছে। তুমি তো যাতা কাণ্ড করে দিয়েছো। একবারে বাবার ডিফেন্স ভেদ করে দিয়েছো। বাবার সেই অ্যাগ্রেসিভ ভাবটাই সকাল থেকে গায়েব দেখতে পারছি”।
নাসিম বলল, “খুব ভাল”।
রাত্রি বলল, “বিকেলের দিকে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম জানো। ভাবছিলাম তুমি আসবে বোধ হয়। এলে না কেন? কোথাও গেছিলে?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ, ব্যস্ত ছিলাম আর কী”।
রাত্রি বলল, “তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না? একটু সুস্থ হয়েই তোমাকে ফোন করলাম, আর এরকম করে কথা বলছো কেন? কী হয়েছে?”
নাসিম বলল, “কোই, কিছু না তো”!
রাত্রি বলল, “হু। নীপা ঠিক আছে? কাকু, কাকীমা?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ। ঠিক আছে”।
রাত্রি বলল, “নীপার নাম্বারটা দেবে? কথা বলব”।
নাসিম বলল, “ঠিক আছে পাঠাচ্ছি”।
ফোন রেখে রাত্রিকে নীপার নাম্বার পাঠাল নাসিম।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তার ফোন বেজে উঠল, রাত্রি থমথমে গলায় বলল, “তুমি আমাকে বলবে না, তোমার জ্বর এসেছে?”
নাসিম বলল, “বলতাম। ভুলে গেছি বলতে। ভেবো না। ঠিক আছি”।
রাত্রি বলল, “এবার কী করবে? তোমাদের ভলান্টিয়ারদের বলবে? অক্সিজেন দেখেছো?”
নাসিম বলল, “দেখছি। ভেবো না”।
রাত্রি বক বক করে যেতে লাগল।
নাসিমের হঠাৎ বমি পেল।
সে ফোন রেখে বাইরের বাথরুমে গিয়ে বমি করে দিল।
৪৫
রাত্রি ছটফট করছিল।
তনয়া বললেন, “এরকম করিস না মা। তোর কি কিছু হয়েছে? নাসিমেরও কিছু হবে না। সবাই ঠিক হয়ে যাবে”।
রাত্রি বলল, “তুমি দেখো, দিন নেই, রাত নেই, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন ঠিক আছে এর? কী হবে কে জানে”।
তনয়া বললেন, “ঠিক হয়ে যাবে। তুই টেনশন করিস না”।
রাত্রি বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে রইল।
তনয়া বাইরের ঘরে এসে দেখলেন প্রণয় টিভি দেখছেন। তাকে দেখে বললেন, “কাটার বাচ্চাটার জ্বর হয়েছে না? গরু খায় তো, ঠিক সেরে যাবে”।
প্রণয় কথাটা তীক্ষ্ণভাবে বলতে চাইলেও তনয়া বুঝলেন কথাটা বলেও প্রণয়ের গলা কেঁপে গেছে। বললেন, “সারলেই ভাল”।
প্রণয় বললেন, “কোন মানে হয় বল তো? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। গাধা কোথাকার! পড়াশুনা কর, ব্যবসা কর, নইলে দেশ ছেড়ে গিয়ে আইসিস জয়েন কর, তোদের তো এটাই করার কথা, মোল্লা কোথাকার! তোরা কেন মানুষের কাজ করতে যাবি?”
তনয়ার চোখ ভিজে উঠল। বললেন, “এত কিছু বললে, এত কিছু করলে, তাও দেখো, আমি ফোন করা মাত্র চলে এসেছিল। যেন এটাই ওদের কাজ। কোন চাওয়া পাওয়ার ব্যাপার নেই, হাসিমুখে দিন রাত এক করে কাজ করে যাচ্ছে”।
তনয়ার ফোনে মেসেজ টোন এল।
তনয়া ফোন দেখে বললেন, “উফ… শান্তি। মেয়ের কোভিড নেগেটিভ। উফ…”
প্রণয় বললেন, “যাক। এবার ছেলেটা সুস্থ হলেই…”
তনয়া প্রণয়ের দিকে তাকালেন।
বললেন, “ডাক্তারবাবুকে ফোন করতে হবে। জিজ্ঞেস করে নিই একই ওষুধ চলবে নাকি”।
প্রণয় বললেন, “হ্যাঁ। আমিই বরং যাই বুঝলে? টোটোওয়ালার নাম্বার আছে না? ওকে ফোন কর, আমি জিজ্ঞেস করে আসি ডাক্তারবাবুকে। তুমি আমাকে প্রেসক্রিপশন দাও”।
তনয়া রাত্রির ঘরে গিয়ে রাত্রির গালে আদর করে বললেন, “তোর কোভিড হয় নি। ওই গোমূত্র খাওয়া টাওয়ার জন্য শক নিতে না পেরে জ্বর এসে গেছিল। বাবা যাচ্ছে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে। যাক বাবা। শান্তি”।
রাত্রি বলল, “নাসিম ঠিক হয়ে যাবে তো মা?”
তনয়া বললেন, “নিশ্চয়ই হবে। ভাবিস না”।
তিনি প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে প্রণয়কে দিলেন।
#
আধঘন্টা পরের কথা।
রাকিব বাড়ির বাইরে পায়চারি করছিলেন।
একটা টোটো এসে দাঁড়াল।
প্রণয় টোটো থেকে নেমে বললেন, “নাসিম কেমন আছে?”
রাকিব বিস্মিত চোখে প্রণয়ের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, “জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। ওদের ছেলেরা আসবে। সম্ভবত হসপিটালাইজ করতে হবে”।
প্রণয় বললেন, “আমি দেখতে পারি একবার?”
রাকিব বললেন, “না না, আপনি দূরে থাকুন। এগুলো ছড়িয়ে পড়ার চান্স খুব বেশি। রাত্রি ভাল আছে তো?”
প্রণয় বললেন, “হ্যাঁ। ওর কোভিড নেগেটিভ এসেছে”।
রাকিব বললেন, “যাক। শান্তি”।
প্রণয় বললেন, “কীসের শান্তি মশাই? আর আপনিই বা কেমন বাবা মা? ছেলেটার নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, যখন তখন যেখানে সেখানে চলে যাচ্ছে, বকতে পারেন না? বারণ করতে পারেন না? কী দরকার ছিল এসবের?”
রাকিব প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে আপনাকে দেখছি। আপনার এই পরিবর্তনটা দেখছি। এইটুকুরই দরকার ছিল। ছেলেটা একটু হলেও তো আপনাকে ভাবাচ্ছে। আপনাদের ভাবাচ্ছে। এটুকুই দরকার ছিল। আপনি বাড়ি যান। আপনার নিজেরও তো শরীর খুব একটা ভাল না। আমি খবর দেব”।
প্রণয় পকেট থেকে দশ হাজার টাকা বের করে রাকিবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এই টাকাটা রাখুন। কোন দরকার হলে খরচ করবেন। না করবেন না, পরে দিয়ে দেবেন। এখন ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে। কোথায় ওদের ভলেন্টিয়াররা? কখন আসবে বলুন তো?”
রাকিব বললেন, “আপনি অস্থির হবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। রোগটাকে সময় দিতে হয় তো”।
প্রণয় রেগে গেলেন, “আজব বাবা তো আপনি! আপনার চিন্তা হয় না?”
রাকিব বললেন, “হয় তো। কিন্তু এই কঠিন সময়ে শান্ত থাকতে হবে। মাথা ঠান্ডা করুন”।
প্রণয় বললেন, “জ্বরে বেহুঁশ হওয়া ভাল ব্যাপার না। অক্সিজেন দেখতে হবে। আপনারা এই গ্রামে ফেলে রাখবেন না। দরকার হলে কলকাতা পাঠাবেন। বুঝলেন?”
রাকিব বললেন, “ঠিক আছে, তাই করব”।
প্রণয় অস্থির হয়ে বললেন, “অদ্ভুত সব ছেলেপিলে। কোথায় ধান্দাবাজ হবে, অফিস করবে, ব্যবসা করবে, নিজেদের ঘর সামলাবে, তা না, এদের ভলান্টিয়ার হতে হবে! হুহ। মানুষের কাজ করবে! যত্তসব! নে, এবার উল্টে পড়ে থাক! কী দরকার ছিল? সবাই আছে তো। তোদের কোন দরকার ছিল না”।
ঋপণরা দুটো বাইকে করে এল। একজন ডাক্তারবাবুকে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রণয় উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বাইরে।
রাকিব বললেন, “দেখুন তো, কী অবাক কাণ্ড! আমরা হিন্দু না মুসলমান করে মরলাম, আর রোগটা এসব কিছুই দেখল না। মানুষের রোগই মনে হয় সব থেকে বড় সেকুলার জিনিস, তাই না?”
প্রণয় কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন।
৪৬
জ্বর বাড়ছে। কেমন দম আটকে আসছে। সঙ্গে কাশিও।
নাসিম চোখ খুলল।
দরজার বাইরে থেকে প্রণয়ের গলা শোনা যাচ্ছে, “কীসের রেড ভলান্টিয়ার তোমরা? এত বছর ক্ষমতায় ছিলে, একটা বেড জোগাড় করতে পারছো না এখন?”
ঋপণ প্রণয়কে বোঝানোর চেষ্টা করতে করতে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
শায়লা আর নীপা ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, রাকিব আটকালেন, “যেও না। ওরা দেখছে”।
শায়লা কাঁদছিলেন।
অক্সিজেন বিরানব্বই।
ঋপণ সিলিন্ডার নিয়ে এসেছিল। দেওয়া হল।
রাকিবকে বলল, “কাকাবাবু, সরকারি হাসপাতালে বেড পাওয়া অসম্ভব। বেসরকারি হাসপাতালের একটায় পাওয়া গেছে। কী করব?”
রাকিব কিছু বলার আগে প্রণয় বললেন, “টাকা নিয়ে ভেবো না। নিয়ে চল”।
রাকিব বললেন, “হ্যাঁ। নিয়ে চল”।
অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হল। ঋপণ আর একজন ভলান্টিয়ার নাসিমকে নিয়ে চলে গেল।
প্রণয় যেতে চেয়েছিলেন। রাকিব বহু কষ্টে আটকালেন।
অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে গেলে প্রণয় একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, “আমি দায়ী সব কিছুর জন্য। ও আমার টেস্ট করাতে নিয়ে গেল। ওখান থেকেই হয়েছে”।
রাকিব বললেন, “নাহ। কেউ দায়ী নয়। এটা তো একটা ঝড়। একদিন ঠিক থেমে যাবে। ভাববেন না”।
শায়লা কাঁদছিলেন।
নীপা তার ঘরে চলে গেছে।
প্রণয় বললেন, “এই ছোট ছোট ছেলেগুলোকে এভাবে কেউ সামনে ঠেলে দেয়? ছি ছি। লিডারগুলো সব ঘরে বসে আছে, আর বাচ্চাগুলো মরছে”।
রাকিব বললেন, “ওভাবে না ভেবে অন্যভাবেও ভাবতে পারেন। নতুন প্রজন্ম ব্যাটন হাতে নিয়েছে। তারা এগিয়ে আসছে”।
প্রণয় বললেন, “এগিয়ে এসে কী হল? এখন নাসিমের যদি কিছু হয়? রাত নেই, দিন নেই, সকাল নেই, বিকেল নেই, যখন পারছে চলে যাচ্ছে। এদের কিছু হলে এরপরের বারে কী হবে? আবার যখন কোন প্যান্ডেমিক আসবে?”
রাকিব বললেন, “কঠিন সময়েই তো মানুষের আসল রূপটা বেরিয়ে আসে, তাই না? ভালটাই জিতবে। আজ এই প্যান্ডেমিকটা হয়েছিল বলেই তো কতগুলো ছেলে, যাদের আমরা ভাবতাম শুধু ঝান্ডা ধরে ঝামেলা করতে পারে, তাদের নতুন করে চিনতে পারলাম। আপনি বুঝলেন, হিন্দু মুসলিমের থেকেও মনুষ্যত্ব অনেক উপরে থাকে। এটা কি কম পাওনা বলুন তো?”
প্রণয় বললেন, “আমি জানি না। ওই ঋপণ ছেলেটাকে বলবেন নাসিমের খোঁজ রাখে যেন। দিদি, আমাকে একটু জল দেবেন?”
শায়লা গ্লাসে করে প্রণয়ের জন্য জল নিয়ে এলেন।
রাকিব হাসলেন, “আমাদের ঘরে জল খাবেন তো”?
প্রণয় গ্লাসটা খালি করে দিয়ে বললেন, “আর লজ্জা দেবেন না। ছেলেটা ভাল হয়ে ফিরুক, তাহলেই হবে। দেশের ঘরে ঘরে নাসিমরা জন্মাক। আমাদের মত লোকগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিক, ধর্মের থেকেও অনেক বড় কিছু আছে জীবনে। ছি, ছি, ছি, আমি কী হয়ে গেছিলাম”।
রাকিব বললেন, “রাত্রিও তাই বলেছিল। বারবার আমাদের বলত ওর বাবা এরকম নন”।
প্রণয়ের চোখে জল এসে গেল। বললেন, “কী হয়ে যাই আমরা? এরকম কেন হয়ে যাই? কত কিছু করে ফেললাম?”
রাকিব বললেন, “সমস্যাটা আপনার একার না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলে গেছিলেন, আমাদের সমস্যা হল, দীর্ঘদিন কাছাকাছি থেকেও আমরা কোনদিন এক হতে পারলাম না। বাইরের লোকের আর দোষ কী বলুন? দেশটাই ভাগ হয়ে গেল। যাক গে, আপনাকে ঠিক সুস্থ লাগছে না। আমার ঘরে একটু রেস্ট নিয়ে যান”।
প্রণয় বললেন, “ঠিক আছে। তাই করি। কোনটা আপনার ঘর”?
রাকিব বললেন, “আসুন”।
রাকিব দেখিয়ে দিলেন। প্রণয় রাকিবের খাটে বসলেন। আলমারিভর্তি বই। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। প্রণয় সব কিছু দেখে নিজের মনেই বলে চললেন, “আমি কী করছিলাম, ছিঃ”।
রাকিব বললেন, “আপনি কি চা খাবেন?”
প্রণয় বললেন, “না না। কিছু করতে হবে না। আর আপনি এত শান্ত থাকছেন কী করে বলুন তো? আমারই তো কেমন অস্থির লাগছে। আপনি না বাবা?”
রাকিব বললেন, “বাড়ির মাথাও তো। আমি শান্ত না থাকলে সবাই অস্থির হয়ে পড়বে যে। আপনি বসুন। আমি বেশ ভাল চা করতে পারি। খেয়ে দেখুন”।
প্রণয় অবাক চোখে রাকিবের দিকে তাকালেন।
৪৭
রাত্রি চুপ করে সোফার নিচে বসেছিল।
তনয়া সোফায় বসে মেয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন। বললেন, “ট্রমা থেকে এরকম জ্বর আগেও অনেকের আসত। সমস্যা হল এখন চারদিকে এমনভাবে কোভিড কোভিড করছে সবাই, সবাই ভেবে নিচ্ছে কোভিডই হয়েছে। নাসিমের যেন কোভিড না হয় ঠাকুর”।
রাত্রির অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখছিল। এ ক’টা দিন ঝড়ের মত গেল। বাবা এসব না করলে হয়ত এত কিছু হতই না। আর এখন সব থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে নাসিমের জন্য।
প্রণয় এলেন কিছুক্ষণ পরে। রাত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাসিমকে কলকাতা নিয়ে গেছে। বলছে অক্সিজেন ফল করে গেছে। কী ভয়ংকর রোগ ভাবো, ভিতরে ভিতরে রোগটা থাকলেও কেউ বুঝতে পারে না তার হয়ে গেছে। কারো কারো হলেও তাড়াতাড়ি সেরে যাচ্ছে, আর যারা একদম ফ্রন্টলাইনে আছে, তাদের শরীরে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে”।
তনয়া বললেন, “গরম জল করে রেখেছি। ভাল করে হাত পা ধুয়ে এসো”।
প্রণয় বাথরুম থেকে বেরিয়ে চেঞ্জ করে এসে চুপ করে বসে রইলেন।
তনয়া বললেন, “তুমি ওদের বাড়ি গিয়ে ঠিক কী কী করলে?”
প্রণয় বললেন, “চা খেলাম, নাসিমের বাবা খুব ভাল চা করেন। আদা দিয়ে আমাকে চা করে দিলেন। প্রচুর পড়াশুনা ওর, কত বই পড়েন সারাদিন। ওর মধ্যেও আমাকে মুড়ি মাখা খাওয়ালো”।
তনয়া প্রণয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “তুমি খেলে সে মুড়ি? বমি পেল না?”
প্রণয় বিরক্ত গলায় বললেন, “বমি পাবে কেন খামোখা? কত ভাল ফ্যামিলি! রাকিব আমারই বয়সী হবেন, অথচ কী শান্ত একজন মানুষ! অনেক কিছু শেখার আছে। এমন বাড়ির ছেলে খারাপ হতেই পারে না”।
তনয়া বললেন, “আর কী করছিলে তুমি বল?”
প্রণয় বললেন, “যা হয়েছে হয়েছে। ছাড়ো। আমার ব্যাংকের পাশবইটা দাও দেখি”।
তনয়া বললেন, “কেন? কী হয়েছে?”
প্রণয় বললেন, “রাকিবদের কাছে কত টাকা আছে জানি না। আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব করব”।
তনয়া বললেন, “অনেক খরচ হবে, বল?”
প্রণয় বললেন, “বেসরকারি মানেই তো মাথায় বাঁশ। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। সরকার থেকে তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো পাবলিকদের জন্য আলাদা কোটা করবে না। বাড়িতে বাড়িতে রোগ। সব বেড ভর্তি হয়ে গেছে। একটা মাত্র বেড পেয়েছে বলল। তাও জানি না কলকাতায় গিয়ে কী হবে। অক্সিজেন কমে যাচ্ছে নাকি। এই টুকু ছেলে, তার যদি অক্সিজেন কমে যায়…” প্রণয় থেমে গেলেন রাত্রির থমথমে মুখ দেখে।
রাত্রি উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে খাটে বসল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক ছুটে গিয়ে দেখে আসে ছেলেটাকে। ওই জানলা দিয়েই তো দেখা যেত, কেমন ক্যাবলারামের মত হাসত। কী করবে সে? কিচ্ছু করার নেই।
তনয়া কিছুক্ষণ পর এসে দরজায় নক করলেন।
রাত্রি দরজা খুলল।
তনয়া মেয়েকে দেখে বললেন, “তোর বাবাকে দেখেছিস কেমন পাগল লোক? যখন মাথায় ভূত ঢুকেছিল, তখন একরকম পাগলামি শুরু করেছিল, এখন যেই ভূত বেরিয়েছে, ঠিক উলটো পাগলামি শুরু করেছে”।
রাত্রি মার হাত ধরে বলল, “করোনায় অনেক লোক মারা যাচ্ছে বল মা?”
তনয়া বললেন, “তুই ভাবিস না। যতজন মারা যাচ্ছে, তার অনেক বেশি মানুষ সেরেও উঠছে”।
রাত্রি বলল, “অক্সিজেন কমে যাবে কেন বল তো? এ আবার কী? কী হয় অক্সিজেন কমে গেলে?”
তনয়া বললেন, “কিছু হবে না। তুই শো। তোর শরীর ঠিক হয় নি। তুই শো, আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আয়”।
রাত্রি কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পড়ল।
তনয়া অনেক চেষ্টা করেও রাত্রিকে কিছু খাওয়াতে পারলেন না।
ভোরের দিকে প্রণয়ের ফোনে রাকিবের ফোন এল।
যে নার্সিং হোমের ভরসায় ওরা কলকাতা গিয়েছিল, গিয়ে দেখেছে সিট ভর্তি হয়ে গেছে।
সারারাত এক নার্সিং হোম থেকে অন্য নার্সিং হোম ঘুরে বেরিয়েছে ঋপণরা।
এক নার্সিং হোমে অনেক জায়গা থেকে ফোন করে জায়গার ব্যবস্থা করে নাসিমকে নিতে গিয়ে ঋপণরা দেখল নাসিম নিথর হয়ে পড়ে আছে…
৪৮
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ–
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে”॥
“জীবনের মূল্য… কথাটা বড় আপেক্ষিক। প্রথম বিশ্বের দেশ আর তত নিচের বিশ্বের দেশে প্রাণের মূল্য এক নয়। এই সৌরজগতের পৃথিবী নামের গ্রহটাতেই এখন অবধি মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে শুধু মানুষ নয়, মানুষের সঙ্গে অনেক প্রাণীই আছে। মানুষ তার মেধাশক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তির জোরে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু তাতে সে সন্তুষ্ট হল না। বিষয়টা অনেকটা মেগা সিরিয়ালের মত কিংবা আমরা তুলনা করতে পারি চুইং গামের মত। ক্রিম পার্টটা শেষ হয়ে যাবার পর যেটা শুরু হয়, সেটা শুধুই চিবিয়ে যাওয়া।
সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে মানুষ লড়াই করে বাঁচল বটে, কিন্তু তারপরে তারা ঠিক করে নিল তারা নিজেরাই নিজেদের শত্রু। তারা ভূ খণ্ড ভাগ করা শুরু করল। ধর্ম তৈরী হল। এক একটা ধর্ম এসেছিল মানুষের নিজের প্রয়োজনে, কিন্তু মানুষ সে ধর্মকে নিজের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলল। ক্রুসেড হল, ধর্মে ধর্মে লড়াই শুরু হল, বছরের পর বছর ধরে সভ্যতার নামে চলল মানুষেরই তাণ্ডবলীলা। এল হিরোশিমা নাগাসাকি… মানুষের ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়, এল ওসামা বিন লাদেনের মত সন্ত্রাসবাদী, একটার পর একটা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। মানুষ পাল্টাল না।
পৃথিবী মানুষের থেকে অনেক কিছুই আশা করেছিল। পৃথিবী ছিল সেই স্নেহশীল বাবা মায়ের মত, যারা সন্তানকে সবটুকু উজার করে দিয়েছিল। পরিবর্তে সেই সন্তান কী করল? তার মাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিল। পৃথিবীর তো রাগ হয়, তাই না?
সে প্যান্ডেমিক দিল। মানুষকে বুঝিয়ে দিল, সে কত ক্ষুদ্র। কত নীচু। প্রতিটা ক্ষেত্রে কোথাও অক্সিজেন নেই, কোথাও ওষুধ নেই, কোথাও অ্যাম্বুলেন্স যাবে না… আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বেই শুধু নয়, প্রথম বিশ্বকেও নাস্তানাবুদ করে দিল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পৃথিবী দেখতে চেয়েছিল, মানুষ কি সত্যিই পারবে? যাদের কথা ছিল হাতে হাত ধরে নিজেদের পাশে দাঁড়ানো, তারা কি কঠিন সময়ে পারবে ফিরে আসতে? লড়াই করতে?
আজ, এই সময়ে দাঁড়িয়ে, দ্বিতীয় ওয়েভ যখন কমতে শুরু করেছে, তখন আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, আমরা কিছুটা হলেও পেরেছি। আমরা পেরেছি সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আমাদের মত দেশে, আমরা রাজনীতি দেখি নি, ধর্ম দেখি নি, মানুষ দেখেছি।
আমরা দেখেছি তাদের, যারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে থেকেও সেফ হোম বানিয়েছে। রাত বিরেতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমার ছেলে নাসিম তাদের মধ্যে ছিল। নাসিমকে আমরা কখনও আটকাই নি। ওর মা চিন্তা করেছে, কান্নাকাটি করেছে। আমার কাছেও নালিশ করেছে, কেন ছেলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। একটা শূন্য পাওয়া দলের না হওয়া পার্টি মেম্বার, যার নেতারা বাড়িতে বসে শুধু বুলি কপচিয়ে যাচ্ছে, সেই দলের ব্যানারে নাসিম কাজ করেছে।
নাসিম প্রেমিক ছিল, বাকি ভলান্টিয়াররাও তাই। তারা সেই বিরল প্রজাতির প্রেমিক, যারা কিছু পাওয়ার আশায় প্রেম করে নি। সমাজকে পাল্টানোর বিরাট কোন আশা তাদের মধ্যে ছিল না। রেজাল্ট বেরনোর দিন মার্কশিটে শূন্য দেখেও যারা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পিপিই পরে অক্সিজেন নিয়ে ছুটেছিল।
নাসিম বিশ্বাস পারিবারিক সূত্রে মুসলমান। তার মৃতদেহের পৃথিবীর মাটি পাওয়ার কথা ছিল না হয়ত। হয়ত ধাপার মাঠে তার মৃতদেহ দাহ করা হত। অন্য কোন রাজ্যে থাকলে নদীর তীরে কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যেত। তার বন্ধুরা সেটা হতে দেয় নি। নাসিমের দেহকে পরম যত্নে তারা কবর দিতে পেরেছে। আমি আমার পরিবারকে বলে গেছি, আমার মৃত্যুর পর আমার দেহ যেন কলকাতা মেডিকাল কলেজে দিয়ে যাওয়া হয়।
আমরা এটুকুই পারি। আমি এবং আমার স্ত্রী তাদের প্রিয়তম ছেলেকে হারিয়েছি। আমার মেয়ে তার প্রিয় দাদাকে। তবু আমি বলব, আমরা পেরেছি। দিনের শেষে আমি গর্বিত আমার ছেলের জন্য। নাসিমদের মতন প্রেমিক তৈরী হোক এই বাংলার ঘরে ঘরে, যারা বিন্দুমাত্র কিছু পাওয়ার আশা না করে যে কোন সময়ে মানুষের জন্য এগিয়ে যাবে।
মানুষ নইলে কোনদিন জিততে পারবে না। মানুষকে যদি জিততে হয়, তাদের এভাবেই জিততে হবে।
সংখ্যালঘু হোক হিংসাশ্রয়ীরা, নিশ্চিহ্ন হোক তারা। মনুষ্যত্ব জিতুক।
নাসিম, তোকে লাল সেলাম জানাই। আমার শ্রদ্ধা নিস তুই”।
রাকিব থামলেন।
পরিবারের তরফে একটা ছোট স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল। চারপাশের এলাকার প্রচুর মানুষ এসেছেন, দল মত নির্বিশেষে। রাকিবের বক্তব্যে হাততালি পড়ল না। সবাই নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন।
রাত্রি নীপার পাশে চুপ করে বসে ছিল। শায়লাকে সামলাচ্ছেন তনয়া।
প্রণয় প্রস্তুত হলেন।
তাকেও বলতে হবে। অনেক কথা বলতে হবে।
ছেলেটা সব কিছুকে কেমন অবলীলায় মিলিয়ে দিয়ে চলে গেল…
Leave a Reply