প্রেমিক – ৪৫

৪৫

রাত্রি ছটফট করছিল।

তনয়া বললেন, “এরকম করিস না মা। তোর কি কিছু হয়েছে? নাসিমেরও কিছু হবে না। সবাই ঠিক হয়ে যাবে”।

রাত্রি বলল, “তুমি দেখো, দিন নেই, রাত নেই, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন ঠিক আছে এর? কী হবে কে জানে”।

তনয়া বললেন, “ঠিক হয়ে যাবে। তুই টেনশন করিস না”।

রাত্রি বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে রইল।

তনয়া বাইরের ঘরে এসে দেখলেন প্রণয় টিভি দেখছেন। তাকে দেখে বললেন, “কাটার বাচ্চাটার জ্বর হয়েছে না? গরু খায় তো, ঠিক সেরে যাবে”।

প্রণয় কথাটা তীক্ষ্ণভাবে বলতে চাইলেও তনয়া বুঝলেন কথাটা বলেও প্রণয়ের গলা কেঁপে গেছে। বললেন, “সারলেই ভাল”।

প্রণয় বললেন, “কোন মানে হয় বল তো? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। গাধা কোথাকার! পড়াশুনা কর, ব্যবসা কর, নইলে দেশ ছেড়ে গিয়ে আইসিস জয়েন কর, তোদের তো এটাই করার কথা, মোল্লা কোথাকার! তোরা কেন মানুষের কাজ করতে যাবি?”

তনয়ার চোখ ভিজে উঠল। বললেন, “এত কিছু বললে, এত কিছু করলে, তাও দেখো, আমি ফোন করা মাত্র চলে এসেছিল। যেন এটাই ওদের কাজ। কোন চাওয়া পাওয়ার ব্যাপার নেই, হাসিমুখে দিন রাত এক করে কাজ করে যাচ্ছে”।

তনয়ার ফোনে মেসেজ টোন এল।

তনয়া ফোন দেখে বললেন, “উফ… শান্তি। মেয়ের কোভিড নেগেটিভ। উফ…”

প্রণয় বললেন, “যাক। এবার ছেলেটা সুস্থ হলেই…”

তনয়া প্রণয়ের দিকে তাকালেন।

বললেন, “ডাক্তারবাবুকে ফোন করতে হবে। জিজ্ঞেস করে নিই একই ওষুধ চলবে নাকি”।

প্রণয় বললেন, “হ্যাঁ। আমিই বরং যাই বুঝলে? টোটোওয়ালার নাম্বার আছে না? ওকে ফোন কর, আমি জিজ্ঞেস করে আসি ডাক্তারবাবুকে। তুমি আমাকে প্রেসক্রিপশন দাও”।

তনয়া রাত্রির ঘরে গিয়ে রাত্রির গালে আদর করে বললেন, “তোর কোভিড হয় নি। ওই গোমূত্র খাওয়া টাওয়ার জন্য শক নিতে না পেরে জ্বর এসে গেছিল। বাবা যাচ্ছে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে। যাক বাবা। শান্তি”।

রাত্রি বলল, “নাসিম ঠিক হয়ে যাবে তো মা?”

তনয়া বললেন, “নিশ্চয়ই হবে। ভাবিস না”।

তিনি প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে প্রণয়কে দিলেন।

#

আধঘন্টা পরের কথা।

রাকিব বাড়ির বাইরে পায়চারি করছিলেন।

একটা টোটো এসে দাঁড়াল।

প্রণয় টোটো থেকে নেমে বললেন, “নাসিম কেমন আছে?”

রাকিব বিস্মিত চোখে প্রণয়ের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, “জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। ওদের ছেলেরা আসবে। সম্ভবত হসপিটালাইজ করতে হবে”।

প্রণয় বললেন, “আমি দেখতে পারি একবার?”

রাকিব বললেন, “না না, আপনি দূরে থাকুন। এগুলো ছড়িয়ে পড়ার চান্স খুব বেশি। রাত্রি ভাল আছে তো?”

প্রণয় বললেন, “হ্যাঁ। ওর কোভিড নেগেটিভ এসেছে”।

রাকিব বললেন, “যাক। শান্তি”।

প্রণয় বললেন, “কীসের শান্তি মশাই? আর আপনিই বা কেমন বাবা মা? ছেলেটার নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, যখন তখন যেখানে সেখানে চলে যাচ্ছে, বকতে পারেন না? বারণ করতে পারেন না? কী দরকার ছিল এসবের?”

রাকিব প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে আপনাকে দেখছি। আপনার এই পরিবর্তনটা দেখছি। এইটুকুরই দরকার ছিল। ছেলেটা একটু হলেও তো আপনাকে ভাবাচ্ছে। আপনাদের ভাবাচ্ছে। এটুকুই দরকার ছিল। আপনি বাড়ি যান। আপনার নিজেরও তো শরীর খুব একটা ভাল না। আমি খবর দেব”।

প্রণয় পকেট থেকে দশ হাজার টাকা বের করে রাকিবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এই টাকাটা রাখুন। কোন দরকার হলে খরচ করবেন। না করবেন না, পরে দিয়ে দেবেন। এখন ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে। কোথায় ওদের ভলেন্টিয়াররা? কখন আসবে বলুন তো?”

রাকিব বললেন, “আপনি অস্থির হবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। রোগটাকে সময় দিতে হয় তো”।

প্রণয় রেগে গেলেন, “আজব বাবা তো আপনি! আপনার চিন্তা হয় না?”

রাকিব বললেন, “হয় তো। কিন্তু এই কঠিন সময়ে শান্ত থাকতে হবে। মাথা ঠান্ডা করুন”।

প্রণয় বললেন, “জ্বরে বেহুঁশ হওয়া ভাল ব্যাপার না। অক্সিজেন দেখতে হবে। আপনারা এই গ্রামে ফেলে রাখবেন না। দরকার হলে কলকাতা পাঠাবেন। বুঝলেন?”

রাকিব বললেন, “ঠিক আছে, তাই করব”।

প্রণয় অস্থির হয়ে বললেন, “অদ্ভুত সব ছেলেপিলে। কোথায় ধান্দাবাজ হবে, অফিস করবে, ব্যবসা করবে, নিজেদের ঘর সামলাবে, তা না, এদের ভলান্টিয়ার হতে হবে! হুহ। মানুষের কাজ করবে! যত্তসব! নে, এবার উল্টে পড়ে থাক! কী দরকার ছিল? সবাই আছে তো। তোদের কোন দরকার ছিল না”।

ঋপণরা দুটো বাইকে করে এল। একজন ডাক্তারবাবুকে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রণয় উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বাইরে।

রাকিব বললেন, “দেখুন তো, কী অবাক কাণ্ড! আমরা হিন্দু না মুসলমান করে মরলাম, আর রোগটা এসব কিছুই দেখল না। মানুষের রোগই মনে হয় সব থেকে বড় সেকুলার জিনিস, তাই না?”

প্রণয় কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন।

৪৬

জ্বর বাড়ছে। কেমন দম আটকে আসছে। সঙ্গে কাশিও।

নাসিম চোখ খুলল।

দরজার বাইরে থেকে প্রণয়ের গলা শোনা যাচ্ছে, “কীসের রেড ভলান্টিয়ার তোমরা? এত বছর ক্ষমতায় ছিলে, একটা বেড জোগাড় করতে পারছো না এখন?”

ঋপণ প্রণয়কে বোঝানোর চেষ্টা করতে করতে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

শায়লা আর নীপা ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, রাকিব আটকালেন, “যেও না। ওরা দেখছে”।

শায়লা কাঁদছিলেন।

অক্সিজেন বিরানব্বই।

ঋপণ সিলিন্ডার নিয়ে এসেছিল। দেওয়া হল।

রাকিবকে বলল, “কাকাবাবু, সরকারি হাসপাতালে বেড পাওয়া অসম্ভব। বেসরকারি হাসপাতালের একটায় পাওয়া গেছে। কী করব?”

রাকিব কিছু বলার আগে প্রণয় বললেন, “টাকা নিয়ে ভেবো না। নিয়ে চল”।

রাকিব বললেন, “হ্যাঁ। নিয়ে চল”।

অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হল। ঋপণ আর একজন ভলান্টিয়ার নাসিমকে নিয়ে চলে গেল।

প্রণয় যেতে চেয়েছিলেন। রাকিব বহু কষ্টে আটকালেন।

অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে গেলে প্রণয় একটা চেয়ার টেনে বসে বললেন, “আমি দায়ী সব কিছুর জন্য। ও আমার টেস্ট করাতে নিয়ে গেল। ওখান থেকেই হয়েছে”।

রাকিব বললেন, “নাহ। কেউ দায়ী নয়। এটা তো একটা ঝড়। একদিন ঠিক থেমে যাবে। ভাববেন না”।

শায়লা কাঁদছিলেন।

নীপা তার ঘরে চলে গেছে।

প্রণয় বললেন, “এই ছোট ছোট ছেলেগুলোকে এভাবে কেউ সামনে ঠেলে দেয়? ছি ছি। লিডারগুলো সব ঘরে বসে আছে, আর বাচ্চাগুলো মরছে”।

রাকিব বললেন, “ওভাবে না ভেবে অন্যভাবেও ভাবতে পারেন। নতুন প্রজন্ম ব্যাটন হাতে নিয়েছে। তারা এগিয়ে আসছে”।

প্রণয় বললেন, “এগিয়ে এসে কী হল? এখন নাসিমের যদি কিছু হয়? রাত নেই, দিন নেই, সকাল নেই, বিকেল নেই, যখন পারছে চলে যাচ্ছে। এদের কিছু হলে এরপরের বারে কী হবে? আবার যখন কোন প্যান্ডেমিক আসবে?”

রাকিব বললেন, “কঠিন সময়েই তো মানুষের আসল রূপটা বেরিয়ে আসে, তাই না? ভালটাই জিতবে। আজ এই প্যান্ডেমিকটা হয়েছিল বলেই তো কতগুলো ছেলে, যাদের আমরা ভাবতাম শুধু ঝান্ডা ধরে ঝামেলা করতে পারে, তাদের নতুন করে চিনতে পারলাম। আপনি বুঝলেন, হিন্দু মুসলিমের থেকেও মনুষ্যত্ব অনেক উপরে থাকে। এটা কি কম পাওনা বলুন তো?”

প্রণয় বললেন, “আমি জানি না। ওই ঋপণ ছেলেটাকে বলবেন নাসিমের খোঁজ রাখে যেন। দিদি, আমাকে একটু জল দেবেন?”

শায়লা গ্লাসে করে প্রণয়ের জন্য জল নিয়ে এলেন।

রাকিব হাসলেন, “আমাদের ঘরে জল খাবেন তো”?

প্রণয় গ্লাসটা খালি করে দিয়ে বললেন, “আর লজ্জা দেবেন না। ছেলেটা ভাল হয়ে ফিরুক, তাহলেই হবে। দেশের ঘরে ঘরে নাসিমরা জন্মাক। আমাদের মত লোকগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিক, ধর্মের থেকেও অনেক বড় কিছু আছে জীবনে। ছি, ছি, ছি, আমি কী হয়ে গেছিলাম”।

রাকিব বললেন, “রাত্রিও তাই বলেছিল। বারবার আমাদের বলত ওর বাবা এরকম নন”।

প্রণয়ের চোখে জল এসে গেল। বললেন, “কী হয়ে যাই আমরা? এরকম কেন হয়ে যাই? কত কিছু করে ফেললাম?”

রাকিব বললেন, “সমস্যাটা আপনার একার না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলে গেছিলেন, আমাদের সমস্যা হল, দীর্ঘদিন কাছাকাছি থেকেও আমরা কোনদিন এক হতে পারলাম না। বাইরের লোকের আর দোষ কী বলুন? দেশটাই ভাগ হয়ে গেল। যাক গে, আপনাকে ঠিক সুস্থ লাগছে না। আমার ঘরে একটু রেস্ট নিয়ে যান”।

প্রণয় বললেন, “ঠিক আছে। তাই করি। কোনটা আপনার ঘর”?

রাকিব বললেন, “আসুন”।

রাকিব দেখিয়ে দিলেন। প্রণয় রাকিবের খাটে বসলেন। আলমারিভর্তি বই। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। প্রণয় সব কিছু দেখে নিজের মনেই বলে চললেন, “আমি কী করছিলাম, ছিঃ”।

রাকিব বললেন, “আপনি কি চা খাবেন?”

প্রণয় বললেন, “না না। কিছু করতে হবে না। আর আপনি এত শান্ত থাকছেন কী করে বলুন তো? আমারই তো কেমন অস্থির লাগছে। আপনি না বাবা?”

রাকিব বললেন, “বাড়ির মাথাও তো। আমি শান্ত না থাকলে সবাই অস্থির হয়ে পড়বে যে। আপনি বসুন। আমি বেশ ভাল চা করতে পারি। খেয়ে দেখুন”।

প্রণয় অবাক চোখে রাকিবের দিকে তাকালেন।

৪৭

রাত্রি চুপ করে সোফার নিচে বসেছিল।

তনয়া সোফায় বসে মেয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন। বললেন, “ট্রমা থেকে এরকম জ্বর আগেও অনেকের আসত। সমস্যা হল এখন চারদিকে এমনভাবে কোভিড কোভিড করছে সবাই, সবাই ভেবে নিচ্ছে কোভিডই হয়েছে। নাসিমের যেন কোভিড না হয় ঠাকুর”।

রাত্রির অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখছিল। এ ক’টা দিন ঝড়ের মত গেল। বাবা এসব না করলে হয়ত এত কিছু হতই না। আর এখন সব থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে নাসিমের জন্য।

প্রণয় এলেন কিছুক্ষণ পরে। রাত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাসিমকে কলকাতা নিয়ে গেছে। বলছে অক্সিজেন ফল করে গেছে। কী ভয়ংকর রোগ ভাবো, ভিতরে ভিতরে রোগটা থাকলেও কেউ বুঝতে পারে না তার হয়ে গেছে। কারো কারো হলেও তাড়াতাড়ি সেরে যাচ্ছে, আর যারা একদম ফ্রন্টলাইনে আছে, তাদের শরীরে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে”।

তনয়া বললেন, “গরম জল করে রেখেছি। ভাল করে হাত পা ধুয়ে এসো”।

প্রণয় বাথরুম থেকে বেরিয়ে চেঞ্জ করে এসে চুপ করে বসে রইলেন।

তনয়া বললেন, “তুমি ওদের বাড়ি গিয়ে ঠিক কী কী করলে?”

প্রণয় বললেন, “চা খেলাম, নাসিমের বাবা খুব ভাল চা করেন। আদা দিয়ে আমাকে চা করে দিলেন। প্রচুর পড়াশুনা ওর, কত বই পড়েন সারাদিন। ওর মধ্যেও আমাকে মুড়ি মাখা খাওয়ালো”।

তনয়া প্রণয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “তুমি খেলে সে মুড়ি? বমি পেল না?”

প্রণয় বিরক্ত গলায় বললেন, “বমি পাবে কেন খামোখা? কত ভাল ফ্যামিলি! রাকিব আমারই বয়সী হবেন, অথচ কী শান্ত একজন মানুষ! অনেক কিছু শেখার আছে। এমন বাড়ির ছেলে খারাপ হতেই পারে না”।

তনয়া বললেন, “আর কী করছিলে তুমি বল?”

প্রণয় বললেন, “যা হয়েছে হয়েছে। ছাড়ো। আমার ব্যাংকের পাশবইটা দাও দেখি”।

তনয়া বললেন, “কেন? কী হয়েছে?”

প্রণয় বললেন, “রাকিবদের কাছে কত টাকা আছে জানি না। আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব করব”।

তনয়া বললেন, “অনেক খরচ হবে, বল?”

প্রণয় বললেন, “বেসরকারি মানেই তো মাথায় বাঁশ। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। সরকার থেকে তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো পাবলিকদের জন্য আলাদা কোটা করবে না। বাড়িতে বাড়িতে রোগ। সব বেড ভর্তি হয়ে গেছে। একটা মাত্র বেড পেয়েছে বলল। তাও জানি না কলকাতায় গিয়ে কী হবে। অক্সিজেন কমে যাচ্ছে নাকি। এই টুকু ছেলে, তার যদি অক্সিজেন কমে যায়…” প্রণয় থেমে গেলেন রাত্রির থমথমে মুখ দেখে।

রাত্রি উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে খাটে বসল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক ছুটে গিয়ে দেখে আসে ছেলেটাকে। ওই জানলা দিয়েই তো দেখা যেত, কেমন ক্যাবলারামের মত হাসত। কী করবে সে? কিচ্ছু করার নেই।

তনয়া কিছুক্ষণ পর এসে দরজায় নক করলেন।

রাত্রি দরজা খুলল।

তনয়া মেয়েকে দেখে বললেন, “তোর বাবাকে দেখেছিস কেমন পাগল লোক? যখন মাথায় ভূত ঢুকেছিল, তখন একরকম পাগলামি শুরু করেছিল, এখন যেই ভূত বেরিয়েছে, ঠিক উলটো পাগলামি শুরু করেছে”।

রাত্রি মার হাত ধরে বলল, “করোনায় অনেক লোক মারা যাচ্ছে বল মা?”

তনয়া বললেন, “তুই ভাবিস না। যতজন মারা যাচ্ছে, তার অনেক বেশি মানুষ সেরেও উঠছে”।

রাত্রি বলল, “অক্সিজেন কমে যাবে কেন বল তো? এ আবার কী? কী হয় অক্সিজেন কমে গেলে?”

তনয়া বললেন, “কিছু হবে না। তুই শো। তোর শরীর ঠিক হয় নি। তুই শো, আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আয়”।

রাত্রি কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পড়ল।

তনয়া অনেক চেষ্টা করেও রাত্রিকে কিছু খাওয়াতে পারলেন না।

ভোরের দিকে প্রণয়ের ফোনে রাকিবের ফোন এল।

যে নার্সিং হোমের ভরসায় ওরা কলকাতা গিয়েছিল, গিয়ে দেখেছে সিট ভর্তি হয়ে গেছে।

সারারাত এক নার্সিং হোম থেকে অন্য নার্সিং হোম ঘুরে বেরিয়েছে ঋপণরা।

এক নার্সিং হোমে অনেক জায়গা থেকে ফোন করে জায়গার ব্যবস্থা করে নাসিমকে নিতে গিয়ে ঋপণরা দেখল নাসিম নিথর হয়ে পড়ে আছে…

৪৮

“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।

 তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,

 বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥

 তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,

 কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।

নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ–

 সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে”॥

“জীবনের মূল্য… কথাটা বড় আপেক্ষিক। প্রথম বিশ্বের দেশ আর তত নিচের বিশ্বের দেশে প্রাণের মূল্য এক নয়। এই সৌরজগতের পৃথিবী নামের গ্রহটাতেই এখন অবধি মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে শুধু মানুষ নয়, মানুষের সঙ্গে অনেক প্রাণীই আছে। মানুষ তার মেধাশক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তির জোরে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু তাতে সে সন্তুষ্ট হল না। বিষয়টা অনেকটা মেগা সিরিয়ালের মত কিংবা আমরা তুলনা করতে পারি চুইং গামের মত। ক্রিম পার্টটা শেষ হয়ে যাবার পর যেটা শুরু হয়, সেটা শুধুই চিবিয়ে যাওয়া।

সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে মানুষ লড়াই করে বাঁচল বটে, কিন্তু তারপরে তারা ঠিক করে নিল তারা নিজেরাই নিজেদের শত্রু। তারা ভূ খণ্ড ভাগ করা শুরু করল। ধর্ম তৈরী হল। এক একটা ধর্ম এসেছিল মানুষের নিজের প্রয়োজনে, কিন্তু মানুষ সে ধর্মকে নিজের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলল। ক্রুসেড হল, ধর্মে ধর্মে লড়াই শুরু হল, বছরের পর বছর ধরে সভ্যতার নামে চলল মানুষেরই তাণ্ডবলীলা। এল হিরোশিমা নাগাসাকি… মানুষের ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়, এল ওসামা বিন লাদেনের মত সন্ত্রাসবাদী, একটার পর একটা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। মানুষ পাল্টাল না।

পৃথিবী মানুষের থেকে অনেক কিছুই আশা করেছিল। পৃথিবী ছিল সেই স্নেহশীল বাবা মায়ের মত, যারা সন্তানকে সবটুকু উজার করে দিয়েছিল। পরিবর্তে সেই সন্তান কী করল? তার মাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিল। পৃথিবীর তো রাগ হয়, তাই না?

সে প্যান্ডেমিক দিল। মানুষকে বুঝিয়ে দিল, সে কত ক্ষুদ্র। কত নীচু। প্রতিটা ক্ষেত্রে কোথাও অক্সিজেন নেই, কোথাও ওষুধ নেই, কোথাও অ্যাম্বুলেন্স যাবে না… আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বেই শুধু নয়, প্রথম বিশ্বকেও নাস্তানাবুদ করে দিল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পৃথিবী দেখতে চেয়েছিল, মানুষ কি সত্যিই পারবে? যাদের কথা ছিল হাতে হাত ধরে নিজেদের পাশে দাঁড়ানো, তারা কি কঠিন সময়ে পারবে ফিরে আসতে? লড়াই করতে?

আজ, এই সময়ে দাঁড়িয়ে, দ্বিতীয় ওয়েভ যখন কমতে শুরু করেছে, তখন আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, আমরা কিছুটা হলেও পেরেছি। আমরা পেরেছি সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আমাদের মত দেশে, আমরা রাজনীতি দেখি নি, ধর্ম দেখি নি, মানুষ দেখেছি।

আমরা দেখেছি তাদের, যারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে থেকেও সেফ হোম বানিয়েছে। রাত বিরেতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমার ছেলে নাসিম তাদের মধ্যে ছিল। নাসিমকে আমরা কখনও আটকাই নি। ওর মা চিন্তা করেছে, কান্নাকাটি করেছে। আমার কাছেও নালিশ করেছে, কেন ছেলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। একটা শূন্য পাওয়া দলের না হওয়া পার্টি মেম্বার, যার নেতারা বাড়িতে বসে শুধু বুলি কপচিয়ে যাচ্ছে, সেই দলের ব্যানারে নাসিম কাজ করেছে।

নাসিম প্রেমিক ছিল, বাকি ভলান্টিয়াররাও তাই। তারা সেই বিরল প্রজাতির প্রেমিক, যারা কিছু পাওয়ার আশায় প্রেম করে নি। সমাজকে পাল্টানোর বিরাট কোন আশা তাদের মধ্যে ছিল না। রেজাল্ট বেরনোর দিন মার্কশিটে শূন্য দেখেও যারা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পিপিই পরে অক্সিজেন নিয়ে ছুটেছিল।

নাসিম বিশ্বাস পারিবারিক সূত্রে মুসলমান। তার মৃতদেহের পৃথিবীর মাটি পাওয়ার কথা ছিল না হয়ত। হয়ত ধাপার মাঠে তার মৃতদেহ দাহ করা হত। অন্য কোন রাজ্যে থাকলে নদীর তীরে কাপড়ে জড়ানো অবস্থায় তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যেত। তার বন্ধুরা সেটা হতে দেয় নি। নাসিমের দেহকে পরম যত্নে তারা কবর দিতে পেরেছে। আমি আমার পরিবারকে বলে গেছি, আমার মৃত্যুর পর আমার দেহ যেন কলকাতা মেডিকাল কলেজে দিয়ে যাওয়া হয়।

আমরা এটুকুই পারি। আমি এবং আমার স্ত্রী তাদের প্রিয়তম ছেলেকে হারিয়েছি। আমার মেয়ে তার প্রিয় দাদাকে। তবু আমি বলব, আমরা পেরেছি। দিনের শেষে আমি গর্বিত আমার ছেলের জন্য। নাসিমদের মতন প্রেমিক তৈরী হোক এই বাংলার ঘরে ঘরে, যারা বিন্দুমাত্র কিছু পাওয়ার আশা না করে যে কোন সময়ে মানুষের জন্য এগিয়ে যাবে।

মানুষ নইলে কোনদিন জিততে পারবে না। মানুষকে যদি জিততে হয়, তাদের এভাবেই জিততে হবে।

সংখ্যালঘু হোক হিংসাশ্রয়ীরা, নিশ্চিহ্ন হোক তারা। মনুষ্যত্ব জিতুক।

নাসিম, তোকে লাল সেলাম জানাই। আমার শ্রদ্ধা নিস তুই”।

রাকিব থামলেন।

পরিবারের তরফে একটা ছোট স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল। চারপাশের এলাকার প্রচুর মানুষ এসেছেন, দল মত নির্বিশেষে। রাকিবের বক্তব্যে হাততালি পড়ল না। সবাই নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন।

রাত্রি নীপার পাশে চুপ করে বসে ছিল। শায়লাকে সামলাচ্ছেন তনয়া।

প্রণয় প্রস্তুত হলেন।

তাকেও বলতে হবে। অনেক কথা বলতে হবে।

ছেলেটা সব কিছুকে কেমন অবলীলায় মিলিয়ে দিয়ে চলে গেল…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *