৫
প্রণয় রাত করে বাড়ি ফিরলেন।
ঘরে ঢুকে রাত্রির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোর ফোনটা আমি কিনে দিয়েছি। আমার কেনা ফোন দিয়ে আমি এসব করা বরদাস্ত করব না”।
রাত্রি শুয়েছিল। সোজা হয়ে বসে বলল, “কী বরদাস্ত করবে না তুমি?”
প্রণয় বললেন, “এই মুসলমানের সঙ্গে কোন রকম সম্পর্কে থাকলে আমি কিছুতেই মেনে নেব না”।
রাত্রি বলল, “তোমার কী হয়েছে বাবা? এরকম পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছো কেন তুমি? এই সময়ে দাঁড়িয়ে কী করে হিন্দু মুসলমান মাথায় আসছে তোমার?”
প্রণয় কয়েক সেকেন্ড গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি তোর বিয়ে দিয়ে দেব। চল্লিশ পঞ্চাশ জন নিমন্ত্রিত থাকবে। এর মধ্যেই বিয়ে হোক। দরকার নেই এসব মেয়ে বাড়িতে রাখার। বিয়ে আমার ইচ্ছায় হবে। মানলে এই বাড়িতে থাকবি, না মানলে বেরিয়ে যা, যেখানে ইচ্ছে যে কোন মোল্লার বাড়ি গিয়ে থাক, আমি কিছু বলব না। তুই যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিস, কিন্তু কোন মোল্লার সঙ্গে বিয়ে করলে আমি তোকে নিজের মেয়ে বলেই কোন দিন স্বীকৃতি দেবো না, এটা জেনে রাখ”।
রাত্রি বলল, “কার সঙ্গে বিয়ে দেবে?”
প্রণয় বললেন, “দেখছি। কাল সকালের মধ্যে জেনে যাবি”।
রাত্রি বলল, “বিয়ের পর যদি কোন মুসলমানের সঙ্গে এক্সট্রা ম্যারিটাল করি?”
প্রণয় বললেন “ওই বাড়ি থেকে তো তোকে বের করে দেবে। আমিও আর ঢুকতে দেবো না। কিছুতেই ঢুকতে দেব না। মোল্লাদের কাজ কী? হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে শুয়ে তাদের শরীরে মুসলমান বানানো। এটাই ওদের কাজ”।
রাত্রির কান মাথা ব্যথা করছিল। এই বাবাকে সে চেনে না। ইনি একজন মৌলবাদীতে পরিণত হয়েছেন। যে মৌলবাদী প্যারিসে নাস্তিক কার্টুনিস্টদের খুন করে, তার সঙ্গে তার বাবার বিন্দুমাত্র কোন তফাৎ নেই শুধু ধর্মটা ছাড়া। একটা ধর্ম বিদ্বেষের জন্য মানুষ তার নিজের মেয়েকে পর্যন্ত এত বড় কথা বলে ফেলছে! সে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে বলল, “ঠিক আছে। আমি তাহলে বাড়ি ছাড়ছি। তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। আর কোন দিন বাড়িতে ফিরবো না তো? বেশ, তাই হবে”।
প্রণয় চিৎকার শুরু করলেন। রাত্রির মা ছুটে এল। রাত্রি দরজা বন্ধ করে চেঞ্জ করে নিল। কয়েক মিনিট পরে ঘর থেকে বেরোল। মা তাকে আটকাতে গেলেন। রাত্রি মাকে জোর করে ছাড়িয়ে দিল। প্রণয় চিৎকার করলেন, “হবেই তো, মোল্লাদের সঙ্গে মিশে ও মেয়ে এখন মোল্লা হয়ে গেছে। বেরিয়ে যাক। দরকার নেই এই কুলাঙ্গার মেয়ে আমার”।
রাত্রি বাড়ি থেকে বেরোল। তার সঙ্গে সঙ্গে তার মা বেরোতে যাচ্ছিলেন। প্রণয় আটকালেন। দরজা বন্ধ করে দিলেন।
রাত্রি সোজা তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্থানীয় পার্টি অফিসে গিয়ে ঢুকল। চার পাঁচজন বয়স্ক মানুষ মিটিং করছেন।
রাত্রির মাথা কাজ করছিল না। সে কোন মতে বলল, “আপনাদের একজন রেড ভলান্টিয়ার আছে। নাসিম নাম। তার ফোন নাম্বার দিতে পারবেন?”
বাকিরা খানিকটা অবাক হলেন। রাত্রি বলল, “ভীষণ দরকার। একটা ব্যক্তিগত সমস্যায় পড়েছি। দেওয়া যাবে?”
কিছুক্ষণের মধ্যে পার্টি অফিস থেকে একজন নাসিমকে ফোন করে রাত্রিকে তার ফোনটা দিলেন। রাত্রি ফোন ধরে বলল, “আমি এই অঞ্চলের পার্টি অফিসে আছি। তুমি আসতে পারবে?”
নাসিম একটুও না ভেবে বলল, “আসছি”।
ফোন রেখে রাত্রি পার্টি অফিসের বাইরে গেল। প্রবল কান্না আসছিল। সামান্য একটা সন্দেহ থেকে কত বড় কিছু হয়ে গেল বাড়িতে? একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বললেন, “নাসিম গ্রামের ছেলে। কোন সমস্যা হলে আমাদের বলতে পারো”।
রাত্রি মাথা নাড়ল, “না না। ব্যক্তিগত ব্যাপার কাকু। সেরকম কিছু না”।
ভদ্রলোক আর কথা না বাড়িয়ে পার্টি অফিসে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে নাসিম এল। তাকে দেখে অবাক চোখে বলল, “কী হয়েছে?”
রাত্রি বলল, “কোন প্রশ্ন না করে আমাকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে”?
নাসিম অবাক হয়ে রাত্রির দিকে তাকিয়ে রইল।
৬
অনেকদিন পর রাকিব রবীন্দ্রনাথ পড়ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পড়ার জন্য একটা আলাদা পরিবেশ তৈরী করেন রাকিব। বাড়িতে সবাইকে বলে দেওয়া হয়, কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করেন। এই দিন তিনি তার লাইব্রেরী থেকে সন্ধ্যের পর থেকে আর বেরোন না। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রাকিবকে মুগ্ধ করে ঠিকই, তবে তিনি মনে করেন কবিতাগুলো আরো বেশি মনোযোগ দাবী করে।
একটা পদ্য থেকে, একটা শব্দও এদিক ওদিক করা সম্ভব না। রবীন্দ্রনাথ তাকে মুগ্ধ করে। বেঁচে থাকতে শেখায়।
রাত হয়েছিল। রাকিব গীতাঞ্জলী পড়তে শুরু করেছিলেন, হঠাৎ লাইব্রেরীর দরজায় কেউ নক করল।
রাকিব বিরক্ত হলেন। এটা তো হবার কথা নয়। বাড়িতে সবাইকে বলা থাকে এই সময় কেউ যেন বিরক্ত না করে। তবু এইভাবে নক করছে!
উঠে বইটা টেবিলের উপর রাখলেন। রাকিব তার প্রতিটা বইয়ের প্রতিটা পাতা যত্ন করে রাখেন। কেউ বই ধার নিলে বিরক্ত হন। দিতে চান না। ভদ্রতাবশত দিতে হলে সে বই ফিরে এলে যদি দেখেন পাতা মুড়ে রেখেছে, ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়েন। নিজের মনেই বলে, এর থেকে খুন করে যেতে পারত।
রাকিব দরজা খুললেন। নীপা দাঁড়িয়ে আছে চিন্তিত মুখে। নীপা রাকিবের ছোট মেয়ে। নাসিমের বোন। নীপা কখনো চিন্তিত হয় না। সব সময় হাসিমুখে থাকে। নীপা চিন্তিত থাকা মানে বাড়িতে সত্যি কোন সমস্যা হয়েছে। রাকিব সেটা বুঝে বললেন, “কী হয়েছে?”
নীপা বলল, “তুমি একটু মাথা ঠান্ডা কর বাবা”।
রাকিব বললেন, “মাথা ঠান্ডাই আছে। কী বলবি বল”।
নীপা বলল, “বাইরের ঘরে এসো”।
রাকিব বললেন, “এখন? এখন আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ছি তো”।
নীপা বলল, “এসো একটু”।
রাকিব বিরক্ত হয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখলেন নাসিম দাঁড়িয়ে আছে। একটা মেয়ে সোফায় বসে আছে। তিনি নাসিমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল? নীপা ডেকে নিয়ে এল! কী ব্যাপার?”
নাসিম বলল, “বাবা ওর নাম রাত্রি। ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে”।
রাকিব রাত্রির দিকে তাকালেন। মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে আছে। কাঁদছে সম্ভবত তবে কান্না দেখা যাচ্ছে না। তিনি বললেন, “বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কেন তোমাকে?”
রাত্রি বলল, “বাবার ধারণা আমি নাসিমকে ভালবাসি। বাবা মুসলমানদের ঘেন্না করে”।
রাকিব বললেন, “ওহ। তাহলে তুমি নাসিমকে ভালোবাসো না?”
নীপা এবার হেসে ফেলল, “বাবা, তুমি এই সময় এই প্রশ্নটা কী করে করলে?”
নাসিম বলল, “আমি বাইরে থেকে আসছি”।
রাকিব বললেন, “দাঁড়া দাঁড়া। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুই তো রেড ভলান্টিয়ার হলি। এ বাড়ি সে বাড়ি অক্সিজেন দিয়ে আসতিস। হঠাৎ করে এসব কবে শুরু করলি?”
নাসিম বলল, “শুরু করি নি। ওদের পাড়ায় গেছিলাম…”
নাসিম চুপ করে গেল।
রাকিব বললেন, “বুঝেছি। রাত্রি, তুমি আমাকে বল দেখি তুমি কী চাও?”
রাত্রি কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলল, “আমি নিজেও জানি না আমি কী চাই। বাবা হঠাৎ করে এমন হয়ে গেল কেন তাও জানি না”।
রাকিব নীপার দিকে তাকালেন, “ওকে জল দে। তোর ঘরে নিয়ে যা। সুস্থির হোক। তোর মা ফিরেছে?”
নীপা বলল, “ফিরবে খানিকক্ষণ পরে”।
রাকিব নাসিমকে বললেন, “প্রেম ট্রেম না, তাই তো?”
নাসিম জোরে জোরে মাথা নাড়াল, “একবারেই না। কী যে বল!!”
রাকিব বললেন, “রাত্রির থেকে ওর বাড়ির নাম্বার নে। আমি ওর বাবাকে ফোন করছি”।
রাত্রি বলল, “আমি ও বাড়ি যাবো না”।
রাকিব বললেন, “ওরকম বলে না মা। বাবা মা চিন্তা করবেন। ভেবো না। আমি কথা বলছি। তুমি নীপার ঘরে গিয়ে রেস্ট কর। আমি গিয়ে তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবো”।
নীপা রাত্রির হাত ধরল, “চল, আমার ঘরে”।
রাত্রি উঠে নীপার ঘরে গেল।
রাকিব নাসিমকে বললেন, “তুই মেয়েটাকে কত দিন ধরে চিনিস?”
নাসিম বলল, “এই ক’দিন হল”।
রাকিব বললেন, “নাম্বারটা নে। ফোন করছি। ওর বাবা কী বলেন দেখি। আমরা গিয়ে ওকে দিয়ে আসব। কী যে করিস তোরা, কী সুন্দর রবীন্দ্রনাথ পড়ছিলাম!”
নাসিম হাসল।
বাবা এবং রবীন্দ্রনাথের মাঝে এখনো কিছু এলে আগের মতই রেগে যান…
৭
রাত্রিকে খাটে বসিয়ে নীপা এক গ্লাস জল এনে দিল। রাত্রি জল খেয়ে নীপার ঘরটা দেখছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। খাটের পাশে বেশ কয়েকটা পুতুল, গল্পের বই। দেওয়াল আলমারিতে বই সাজানো। নীপা বলল, “তোমার কি একটু ভাল লাগছে?”
রাত্রি বলল, “হ্যাঁ”।
নীপা বলল, “তুমি কি সত্যি দাদার সঙ্গে…”
রাত্রি নীপার দিকে তাকাল। কী মিষ্টি মেয়েটা। ঠোঁটের কোণে সব সময় একটা হাসি লেগে আছে। সে বলল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
নীপা বলল, “টুয়েলভ। উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার কথা ছিল। সব ভেস্তে গেল। কবে কী হবে জানি না। জানো আমার এক বন্ধু আছে, ও পরীক্ষা হবে না শুনে এমন লাফ দিয়েছিল যে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে গেছে”।
কথাটা বলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল নীপা। রাত্রিও হাসল। মেয়েটা খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিতে পারে। সে একইসঙ্গে অবাকও হচ্ছিল। তার ধারণা ছিল নাসিমদের বাড়িটা পুরো ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙের হবে। ঘরে ঘরে শুধু মক্কা মদিনার ছবি থাকবে। ওরা খাটে পা তুলে খাওয়া দাওয়া করবে। ঘরে ঘরে বাচ্চা কিলবিল করবে। সেরকম কিছুই নেই। একবারে তাদের মতই বাড়ি। নাসিমের বাবার মধ্যেও কী অসাধারণ প্রজ্ঞা!
এতদিন কি সে ভুল জানত? রোজ খেতে বসলেই খাবার টেবিলে বাবা মুসলমানদের নামে কত কিছু বলে যায়। এরা জন্ম থেকেই জিহাদ করতে যায়, এদের মনের ভিতর নাকি সবসময় বিদ্বেষ থাকে, কোথায়? নীপাকে তো নিজের বোনের মতই মনে হচ্ছে। মজা করতে ভালবাসে, কথা বেশি বলে, কথা বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে ফেলে… তারই মত তো মানুষ! হোয়াটস অ্যাপে বর্ণিত ভয়াবহ প্রাণীদের মত তো মনে হচ্ছে না কাউকেই।
নীপা বলল, “এই দিদি, তুমি বললে না তো, আমার গাধা দাদাটার সঙ্গে তুমি কি সত্যি প্রেম কর?”
রাত্রি হেসে ফেলল, “নাসিমকে গাধা বললে?”
নীপা বলল, “হু? খারাপ লাগল বুঝি? বাপরে! সরি সরি”।
আবার হেসে গড়িয়ে পড়ল নীপা।
রাত্রি নীপাকে সবটা বলল।
নীপা গালে হাত দিয়ে বলল, “বাপরে, ইনি তোমার বাবা না অমরেশ পুরী? এমন কেন ভদ্রলোক?”
রাত্রি বলল, “হোয়াটস অ্যাপ! আবার কী?”
নীপা বলল, “সে তো বুঝতেই পারছি। তবে ভেবো না শুধু তোমার বাবাই এরকম। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে আগে আমি খুব যেতাম। করোনার প্রথম লকডাউনের কয়েক মাস আগে আমাকে সে বন্ধু স্পষ্টই বলে দিয়েছিল ওদের বাড়ি না যেতে। আমাদের এগুলো অভ্যাস হয়ে গেছে। বাবাকে বললে বাবা অবশ্য বলে কেউ বন্ধু না থাকলে বইকে বন্ধু করে নিতে। জানো, আমার বাবা আমাকে একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করল, খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করল। মা, তুই কি স্মার্ট ফোন নিবি? তুই চাইলে আমি কিনে দেব। তবে আমার মতে যতদিন এই যন্ত্রটা ছাড়া থাকবি, ততদিন ভাল থাকবি। আমি বললাম, থাক বাবা। আমাকে কী প্যাড ওয়ালা ফোনই দাও। ওটা নেই বলেই হয়ত এখনো পড়াশুনো করতে পারছি”।
রাত্রি অবাক হল, “তোমার স্মার্ট ফোন নেই? ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট?”
নীপা মাথা নাড়ল, “না। আমিও বই পড়ি। এখন কী পড়ছি জানো? পরশুরামের মহাভারত। একসময় উপেন্দ্রকিশোরের ছোটদের মহাভারত পড়ে পড়ে বইটাকে পাপড়ভাজা করে দিয়েছিলাম। ইলেভেনে উঠলে বাবা আমাকে একটা পরশুরামের মহাভারত দিল। বাপরে, কী চাপের! মহাভারতের ছোটবড় হয়!”
রাত্রি ইতস্তত করে বলল, “তুমি কোরাণ পড় না?”
নীপা বড় করে মাথা নাড়ল, “তাও পড়েছি। কোরাণ পড়েছি, বাইবেল পড়েছি। কিন্তু মহাভারত আলাদা ব্যাপার। আর আমার বাবার কাছে মহাভারতের থেকেও আলাদা ব্যাপার রবীন্দ্রনাথের কবিতা। আমার বাবার সব কাব্যগ্রন্থের সব ক’টা কবিতা মুখস্ত। তবু পড়বে। বলে প্রতিদিন নতুন নতুন করে মানে বেরোয় নাকি! আমার কিন্তু কবিতা ভাল লাগে না। আমার গদ্য। তাও কার বল তো? সুনীলের”।
রাত্রি বলল, “আর তোমার দাদার কী পছন্দ?”
নীপা বলল, “দাদা হল সাইলেন্ট লাভার মানুষ। ওই তোমাকে যেমন ঝাড়ি মারত, তুমি না এগোলে জীবনেও আর কথা বলত না। তার ওই সাইলেন্ট প্রেমের লেখা ভাল লাগে”।
রাত্রি মজা পেল, বলল, “যেমন?”
নীপা চোখ নাচাল, “সেটা দাদাকেই জিজ্ঞেস করবে। আমি কেন বলব? তোমার মনে হয় বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। ঈশ, তুমি এখানে থাকলে ভারি মজা হত। আমরা সারারাত আড্ডা মারতাম। আচ্ছা, তুমি সত্যিই দাদাকে একটুও ভালবাসো না? ফাইভ পারসেন্টও না? এই এট্টুসখানি?”
নীপা কেমন বাচ্চাদের মত প্রশ্ন করল।
রাত্রি হি হি করে হেসে ফেলল। শেষ কবে সে এত মজা পেয়েছে, নিজেই মনে করতে পারছিল না।
৮
রাত্রি চলে যাওয়ার পর প্রণয় নিজেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিলেন। রাত্রির মা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন।
রাতের দিকে বাড়ি ফিরে প্রণয় থম মেরে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। স্ত্রী তখনো কাঁদছিলেন। প্রণয় বিরক্ত গলায় বললেন, “একদম কোন যোগাযোগ রাখবে না। তোমার মেয়ে লাভ জিহাদের শিকার হয়েছে। তুমি বুঝতে পারছো না এটা কত বড় ষড়যন্ত্র। ওরা হিন্দু মেয়েদের টেনে নিয়ে গিয়ে কনভার্ট করে দেয়। এতক্ষণে তোমার মেয়ে মোল্লা হয়ে গেছে”।
রাত্রির মা তনয়া বললেন, “তা বলে এভাবে মেয়েকে পর করে দেবে তুমি? আটকানো যেত না?”
প্রণয় বললেন, “তুমি জানো না, আটকে কোন লাভ নেই। তারপরে ঠিক একদিন পালিয়ে যাবে। দেখো না, এই হোয়াটস অ্যাপ মেসেজটা দেখো…”
প্রণয় ফোনটা তনয়ার দিকে এগিয়ে দিলেন। একটা মেসেজ। কীভাবে হিন্দু মেয়েদের বাড়ি থেকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে মুসলমানেরা ধর্মান্তরিত করছে, কীভাবে এর প্রতিরোধ করা উচিত, তা নিয়ে অনেক বড় লেখা। খানিকটা পড়ে তনয়া কেঁদে ফেললেন, “আমার কিছু ভাল লাগছে না। একটা মাত্র মেয়ে, সারাদিন ঘরে কাটাচ্ছে। এর মধ্যে কখন এসব হয়ে গেল?”
প্রণয় বললেন, “ওটাই তো। এখন সাইবার ক্রাইমের যুগ। ওরা সব পারে। হয়ে গেল বুঝলে, এই দিনটাই দেখার ছিল আমার। আমি ঠিক ব্যবস্থা নেব দাঁড়াও। আমারও লোক আছে। যে বাড়িতে বিয়ে করেছে, সে বাড়ির সবাইকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারব। ছাড়ব না”।
তনয়া শিউরে উঠে বললেন, “একী বলছো তুমি? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
প্রণয় বললেন, “পাকিস্তানের চাল এগুলো, বুঝতে পারছো? সৌদি আরব থেকে পেট্রো ডলার আসছে, পাকিস্তানের টাকা ঢুকছে, সব হিন্দু মেয়েগুলোকে ওরা মোল্লা করে ওদের গর্ভে নিজেদের সন্তান…”
কলিং বেল বেজে উঠল।
প্রণয় বললেন, “দেখো কে এসেছে”।
তনয়া ছুটে দরজা খুললেন। একজন সৌম্য ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।
তনয়া বললেন, “বলুন”।
ভদ্রলোক বললেন, “প্রণয়বাবু আছেন?”
তনয়া চোখের জল লুকিয়ে বললেন, “আসুন”।
ভদ্রলোক ঘরের ভিতরে প্রবেশ না করে বললেন, “আমি ভিতরে গেলে আপনাদের অসুবিধে হতে পারে। প্রণয়বাবুকে ডাকুন”।
তনয়া বুঝলেন না। অবাক হয়ে বললেন, “কেন অসুবিধা হবে বলুন তো?”
ভদ্রলোক বললেন, “আমার নাম আব্দুর রাকিব বিশ্বাস। আপনাদের মেয়ে এখন আমাদের বাড়িতে আছে। আমি সে ব্যাপারে প্রণয়বাবুর সঙ্গে কথা বলতে এসেছি”।
তনয়া বিহ্বল চোখে রাকিবের দিকে তাকিয়ে রইলেন, বললেন, “ও ঠিক আছে তো?”
রাকিব হাসলেন, “নিশ্চয়ই ঠিক আছে। তবে বাবাকে খুব ভয় পায় তো। তাই…”
তনয়া বললেন, “ঠিক আছে। আমি ডাকছি ওর বাবাকে”।
তনয়া ঘরের ভিতরে গিয়ে বললেন, “তোমাকে ডাকছেন একজন”।
প্রণয় বাইরে বেরিয়ে বললেন, “বলুন। ভিতরে আসেন নি কেন?”
রাকিব বললেন, “আমি মুসলমান। আপনাদের অসুবিধা করতে চাই না এত রাতে”।
প্রণয় অবাক হয়ে রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি মুসলমান? টুপি কোথায়? দাড়ি কোথায়? লুঙ্গি? আপনাকে তো বাঙালিদের মতই লাগছে!”
রাকিব হাসলেন, “আমি অবশ্যই বাঙালি। ভয় পাবেন না। আমি কোন টাইম বোমা নিয়ে আপনাদের বাড়ি আসি নি। আপনার মেয়ে আমাদের বাড়িতে আছে। আমার ছেলের সঙ্গে ওর কোন রকম কোন সম্পর্ক হয় নি। ও আপনার সঙ্গে প্রবল তর্ক করেছে। তারপরে রাগের মাথায় বেরিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে গেছে। রাত্রি এখন টোটোতে বসে আছে বাইরে। আপনি অনুমতি দিলে আমি ওকে আপনাদের কাছে রেখে বাড়ি ফিরব”।
প্রণয় থতমত খেয়ে গেলেন, “ভালবাসে না?”
রাকিব বললেন, “না বোধহয়”।
প্রণয় বললেন, “এখনো মুসলমান করেন নি আপনারা ওকে?”
রাকিব বললেন, “না। নিজেরা আগে ভাল মানুষ হই, তারপরে না হয় হিন্দু মুসলমান হওয়া যাবে! মেয়েকে ডাকব?”
প্রণয় রাকিবকে দেখে কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিলেন না। একটু ভেবে বললেন, “আমি পড়েছি বটে, মুসলমানেরা হিন্দুদের মত ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়। আপনি সেরকম নন তো?”
রাকিব বললেন, “আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে একদিন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে, যদি আপনি অনুমতি দেন তবে। আপাতত নিজের মেয়েকে ডেকে নিন। বেচারি ভারি ভয় পেয়ে আছে”।
প্রণয় তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নিয়ে এসো। ঘরের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখো। আগুন ছুঁয়ে ঘরে ঢুকিও”।
রাকিব বললেন, “অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি আসি। অনেক উপকার করলেন আমার। সবে গীতাঞ্জলী শুরু করেছিলাম সন্ধ্যেয়”।
প্রণয় বললেন, “গীতাঞ্জলী মানে? সেটা কী?”
রাকিব হাসলেন, “যার সৃষ্টি ভুলে গিয়ে আজ বাঙালির এই দুর্দশা হচ্ছে। তার লেখা। ভদ্রলোক এককালে নোবেল পেয়েছিলেন। এখন বিস্মৃতপ্রায় মনে হয়… যাই হোক, ভাল থাকুন”।
রাকিব হাত জোড় করলেন।
৯
রাকিব দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঠিক করেছিলেন রাত্রি ঘরে ঢোকার পরে বেরোবেন। রাত্রি গেটের কাছে আসতেই প্রণয়বাবু হাঁ হাঁ করে তেড়ে উঠলেন, “স্নান করে ঘরে ঢোক। তুই ওখানেই দাঁড়া। মা বালতিতে জল দিচ্ছে। সে জলে স্নান কর। মোল্লাদের বাড়ি থেকে এ বাড়িতে এভাবে ঢুকবি না”।
বাবার কথাটা কানে যেতে রাত্রি সিঁটিয়ে গেল।
রাকিব বললেন, “এত রাতে স্নান করবে বাড়ির বাইরে?”
প্রণয় রাকিবের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, “আপনি আসতে পারেন। এটা আমাদের বাড়ির ভিতরের ব্যাপার। বাইরের লোকের মতামত নেওয়ার কোন রকম প্রয়োজন বোধ করি না”।
রাকিব স্থির চোখে প্রণয়ের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রাত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি ভুল করেছিলাম। আমি বুঝতে পারি নি এই ভয়াবহ বিদ্বেষের পরিবেশে তোমাকে থাকতে হচ্ছে মা। তুমি চাইলে আমাদের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারো। কী করবে জানাও। আমি টোটোতে গিয়ে বসছি”।
রাত্রি বলল, “আমি এ বাড়িতে থাকব না কাকু”।
প্রণয়বাবু চিৎকার শুরু করলেন। রাকিব কোন কথা না বলে টোটোতে গিয়ে বসলেন। রাত্রি তার সামনে বসল।
প্রণয় বললেন, “আমি থানায় ফোন করছি”।
রাকিব টোটোচালককে বললেন, “চল”।
তনয়া নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। রাত হয়েছিল বলে পাড়ার লোক জড়ো হতে হতে টোটো চলে গেছিল।
পাড়ার তিন চারজন এল। একজন বলল, “কী হয়েছে?”
প্রণয় বললেন, “আমার মেয়েকে এক মোল্লা ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে। আমি ছাড়ব না। শেষ দেখে ছাড়ব”।
তনয়া বললেন, “বাজে কথা। কেউ ফুসলায়নি। মেয়ে নিজের ইচ্ছেয় গেছে”।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এই দ্বিমত দেখে পাড়ার লোকজনের মধ্যে ফিসফাস শুরু হল।
তনয়া কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করছিলেন, “মেয়েটাকে ঘরের মধ্যে এক ঘরে করে রেখে দিয়েছে। সারাক্ষণ পাগলের মত মোবাইলে উলটো পালটা পড়ে যাচ্ছে। আমার আর ভাল লাগে না কিছু। কাল সকাল হোক, আমিও বাপের বাড়ি চলে যাব”।
প্রণয় কড়া গলায় বললেন, “তুমি ঘরের ভিতরে যাও। আপনারাও যান। আমার বাড়ির ব্যাপার। আমি বুঝব”।
পাড়াতে এমনিতেই প্রণয়ের খুব একটা সুনাম নেই বলে ভিড় হালকা হয়ে গেল।
প্রণয় ঘরের ভিতর গুম হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তনয়া সোফায় কাঁদছিলেন।
প্রণয় বললেন, “আমি আগেই বলেছিলাম আমার মেয়ে মরে গেছে। অকারণ ন্যাকামিটা হল। যাই হোক, তুমি বাপের বাড়ি যাবে তো? চলে যেও। কোন অসুবিধা নেই। তবে তোমার কোন ভাই তোমায় খাওয়াবে, সেটা আমার খুব দেখার ইচ্ছা আছে”।
তনয়া উত্তর দিলেন না।
প্রণয় ফোন নিয়ে তার হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে লিখলেন নাসিম কীভাবে তার মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে। গ্রুপে হাহাকার পড়ে গেল।
কেন একজন হিন্দুর মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে মুসলিম, এই নিয়ে গ্রুপে কমেন্টের ঝড় উঠতে শুরু করল।
মিনিট দশেক বাদে ফেসবুকে পোস্ট পড়ল। শেয়ার হতে শুরু করল।
প্রণয়ের মাথায় আগুন লেগে গেছিল। তিনি বাথরুমে জামা কাপড় পরা অবস্থাতেই মাথায় জল দিলেন। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের বাইরে ভেজা গায়ে হাঁটাহাঁটি করতে শুরু করলেন। রাত একটার দিকে তার ফোন বাজতে শুরু করল। বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসতে শুরু করল কীভাবে নাসিম তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে।
কয়েকটা ফোন অ্যাটেন্ড করে প্রণয় ফোন অফ করে সোফায় বসে রইলেন। কোন মতে রাত কাটতে সকাল সাতটাতেই প্রণয় থানায় গেলেন। ওসি প্রসেনজিত বর্মণ অফিসেই ছিলেন। প্রণয় গিয়ে বললেন, “আমার মেয়েকে মোল্লারা তুলে নিয়ে গেছে। লাভ জিহাদ করছে”।
প্রসেনজিত চা খাচ্ছিলেন। বললেন, “আপনার মেয়ে অ্যাডাল্ট?”
প্রণয় বললেন, “অ্যাডাল্ট তো কী হয়েছে? আমি জানি আপনি এই প্রশ্ন করবেন। অ্যাডাল্ট হলেই বা কী? কী করে একটা হিন্দু কান্ট্রিতে একটা মোল্লা এভাবে হিন্দু মেয়ে তুলে নিয়ে যেতে পারে?”
প্রসেনজিত বললেন, “হিন্দু কান্ট্রি কোনটা?”
প্রণয় বললেন, “আপনিও সেকু নাকি? আমি এদেশের কথা বলছি, এদেশে সব হিন্দু। আপনি আমাকে হেল্প করুন, ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব”।
প্রসেনজিত বিরক্ত মুখে প্রণয়ের দিকে তাকালেন, “আপনি ডাক্তার দেখান”।
প্রণয় লাফ ঝাঁপ দিতে শুরু করলেন, “আমি বুঝে নেব। ফেসবুকে পোস্ট ভাইরাল হয়ে গেছে। কেউ ছেড়ে দেবে না”।
প্রসেনজিত প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন প্রণয় ঠিক অবস্থায় নেই। তিনি চুপ করে বসে প্রণয়ের লাফ ঝাঁপ দেখতে লাগলেন।