প্রেমিক – ১

বাড়ির সামনে ছেলেটা ঘুরছে।

রাত্রির ভাল লাগে না ছেলেটাকে। আজকাল ছেলেটার যাওয়া আসার ফ্রিকোয়েন্সি অনেক বেড়ে গেছে।

তার দোকান যাবার পথে ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক কিছু বলার চেষ্টা থাকে।

রাত্রি বিরক্ত হয়। যদি তাকেই বলার থাকে, বললেই পারে। এভাবে চোখেই সব কথা বলে দেয় কেন?

একদিন সে দাঁড়িয়ে গেল।

ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “নাম কী তোমার?”

ছেলেটা ঘাবড়ে গেল। তার দিকে না তাকিয়ে মাটির দিকে তাকাল, “নাসিম”।

রাত্রি বলল, “মুসলিম?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল।

রাত্রি বলল, “তুমি এ পাড়ায় কেন যাতায়াত কর?”

নাসিম বলল, “ভাল লাগে”।

রাত্রি বলল, “কাকে? হিন্দু মেয়েদের?”

নাসিম মাথা নাড়ল, “ওভাবে দেখি নি কাউকে”।

রাত্রি বলল, “পাড়ার ছেলেরা ঠ্যাঙ খোঁড়া করে দেবে মনে রেখো। এ পাড়ায় অনেকেই এখন তোমাদের বিরুদ্ধে কথা বলে”।

নাসিম সিঁটিয়ে গেল। ওর যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না।

#

প্রেমের সমস্যা হল, কেউ বার বার এলে বিরক্ত লাগে। আবার না এলেও একই সমস্যা হয়। সেদিনের পর নাসিম সত্যি সত্যিই আসা বন্ধ করে দিল।

রাত্রির বাবা প্রণয় ইদানীং হোয়াটস অ্যাপ করছেন। সেদিন হঠাৎ করেই বললেন, “আজকাল একটা জিনিস চালু হয়েছে। লাভ জিহাদ। মুসলিম ছেলেরা হিন্দু মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জানিস তো এদেশের মত না। এখানে যেমন সবাই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়, ওখানে ঠিক এর উলটো। হিন্দু মেয়েদের টার্গেট করে এরা। এখানেও শুরু করেছে। একবারে কোন মুসলিম ছেলের পাল্লায় পড়বি না”।

রাত্রি রেগে যায়, “আমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই?”

বলে উঠে চলে যায়। বাবার উপর ভীষণ রাগ হয়।

ক’দিন পর নাসিমকে আবার দেখতে পায়। নাসিম একটা নতুন বাইক কিনেছে।

রাত্রি দোতলার ব্যালকনিতে ছিল। নাসিমকে দেখামাত্র ঘরে চলে এল। ঘুম ইচ্ছে করছিল গিয়ে জিজ্ঞেস করে, এতদিন কোথায় ছিল। প্রেম ট্রেম না, নিছক কৌতূহলবশতই হয়ত। নাকি অন্যকিছুও হতে পারে?

রাত্রি বুঝতে পারে না।

কলেজ বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। এলাকাতেও বিধিনিষেধ চলছে।

ছেলেটা মাস্ক পরে। কেউ দেখে বুঝবে না ও মুসলিম।

রাত্রি প্রবল দোটানায় থাকে। সে একদিকে শিখেছে হিন্দু মুসলমান এক দেশের দুটো হৃদপিণ্ড। এটাও বাবাই বলেছিল এক কালে।

এখন অন্য প্রসঙ্গ উঠে আসছে।

কোনটা যে ঠিক আর কোনটা ভুল, রাত্রি বুঝতে পারে না।

অনলাইন ক্লাস করার সময় বাইকের শব্দ পেলে পর্দা সরিয়ে উৎসুক চোখে দেখতে ইচ্ছা হয়।

কেমন একটা নেশা তৈরী হচ্ছে।

লকডাউনের আগে সেভাবে কাউকে ভালবাসে নি সে। ফেসবুক দেখে বন্ধুদের থেকে “ক্রাশ” ইত্যাদি শুনেছে। তার বন্ধুদের অনেকে প্রেম করে।

তার করা হয় নি। বা হয়ে ওঠে নি।

তার জন্য একটা ছেলে আসছে, ব্যাপারটা তাকে ভাবাতে শুরু করল। ভাবতে ভাবতে গুগল সার্চ করে ফেলল বেশ কয়েকবার। “মুসলিম রিচুয়ালস”, “লাভ জিহাদ”, “মুসলিম ম্যারেজ”।

বিভিন্ন রকম মুসলিম সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে শুরু করল।

বিধি নিষেধ অনেকটাই হালকা হতে শুরু করেছে। মা একদিন বলল পাড়ার দোকান থেকে ডিম আনতে। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে দেখল নাসিম দাঁড়িয়ে আছে। সে নাসিমের কাছে গিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ দেখছে নাকি। তারপর বলল, “তুমি নামাজ পড়?”

নাসিম বলল, “পড়ি তো”।

রাত্রি বলল, “রোজা কর?”

নাসিম মাথা নাড়ল।

রাত্রি বলল, “যে জিনিসটা হওয়া সম্ভব না, সেটা কেন হওয়াতে চাইছো? আমাদের মত বাড়ির মেয়েরা তোমাদের পছন্দ করে না। ইনফ্যাক্ট আমার বাবা মুসলিমদের ঘেন্না করে। আমরা বাঙাল। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি বাংলাদেশে আমাদের কোন কাকীমাকে মুসলিমরা তুলে নিয়ে গেছিল। তুমি আর এসো না। নিজের ধর্মে বিয়ে কর”।

নাসিমের মুখটা ছোট হয়ে গেল।

রাত্রি বলল, “এসো না। বোঝার চেষ্টা কর। এটা হয় না”।

নাসিম কিছুক্ষণ শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।

“ওরা বোরখা পরতে বাধ্য করবে। হিজাব পরাবে। ওদের নারী স্বাধীনতা বলে কিছু নেই”।

বাবা আবার কোত্থেকে একটা হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ পেয়েছে। পড়ে যাচ্ছে। মা বাবাকে বলল, “তোমার কী হয়েছে বল তো? সারাদিন ধরে এসব করে যাচ্ছো? আগে তো এরকম ছিলে না। কমিউনিস্ট পার্টি করতে, হিন্দু মুসলমান নিয়ে কোন দিন কথা বলতে দেখি নি তোমায়”।

প্রণয় গম্ভীর গলায় বললেন, “ভুল করেছি। ভুল দল করেছি, ভুল আদর্শ নিয়ে চলেছি। ঠিক করি নি। ধর্মটাকে নেগলেক্ট করে গেছি চিরকাল। এটা অপরাধ। কোন দিন দেখেছো কোন মুসলিম ছেলে ধর্ম বিসর্জন দিয়ে পার্টি করেছে? দেখবে না। এরা ঠিক তলে তলে সব ঠিক রেখে দেয়। মক্কাও যায়। আর হিন্দুরা পার্টি করে ধর্ম পালন করলেই দোষ”।

রাত্রির মা বিরক্ত হয়ে বলেন, “তাহলে আমাকে বিয়ে করাও তোমার ঠিক হয় নি। আমার বাপের বাড়ি সবাই লাল। তারা ভেবেছিল তুমি কমিউনিস্ট। এখন এসব ভিমরতি হয়েছে তোমার। এখন নতুন বউ দেখে নাও তুমি”।

প্রণয় চুপ করে যান। হোয়াটস অ্যাপের মেসেজ বাকি বন্ধুদের ফরোয়ার্ড করতে শুরু করেন।

ঘৃণা যখন আসে তখন একা আসে না। বরাবর তার সঙ্গী হিংসা। আচমকা বাবার মধ্যে এই পরিবর্তন রাত্রিকে আঘাত করল। মা মাঝে মাঝে মন খারাপ করে বসে থাকে। তাকে বলে “কোনমতে তোর বাবার ফোনটা লুকিয়ে ফেল। ওটা যত নষ্টের মূল”।

রাত্রি একদিন বাবার ফোন হাতে নিয়ে দেখল। কীসব গ্রুপে জয়েন করেছে বাবা। হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে সহ কত কত গ্রুপ। মাকে এসব নিয়ে কিছু বলল না। তবে এই সব কিছু তার মধ্যে একটা অদ্ভুত বিকর্ষণ তৈরী করল এ সমস্ত রকম ধর্ম কালচারের প্রতি।

নাসিরকে পাড়ায় দেখামাত্র সে বাড়ি থেকে বেরোল। অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করার পরে ছেলেটা এসেছে। খানিকটা ঘোরের মাথায় নাসিরের কাছে দাঁড়িয়ে সে বলল, “তুমি আবার এসেছো?”

নাসির বলল, “আমি এ পাড়ায় ওষুধ নিতে এসেছি। রেড ভলান্টিয়ারের কাজ করছি। কোথাও কিছু পাওয়া যায় নি। এখানে এলাম”।

রাত্রি বিদ্রুপের গলায় বলল, “ওহ তুমি রেড ভলান্টিয়ার, মানে কমিউনিস্ট তাই তো? এদিকে নামাজ পড়। তাহলে তুমি সিউডো কমিউনিস্ট”।

নাসির অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হঠাৎ এই কথা? আমি অত ভেবে তো কিছু করি নি কোন কালে। নামাজ ছোটবেলা থেকে পড়ি, রোজাটাও অভ্যাস হয়ে গেছে। এই নিয়ে কোন দিন আলাদা করে চর্চাও করি নি”।

রাত্রি বলল, “তুমি বাঙালি?”

নাসির বলল, “কেন নয়? বাঙালি হবার জন্য ঠিক কী কী প্রমাণ দিতে হয়?”

রাত্রি বলল, “একটা কবিতা বল দেখি রবীন্দ্রনাথের”।

নাসির বলল, “আমাদের ছোটনদী বলব?”

রাত্রি বলল, “এটা তো ছোটবেলার কবিতা”।

নাসির বলল, “তুমি পারবে এই ছোটবেলার কবিতাটা পুরোটা ঠিক ঠাক বলতে?”

রাত্রি বলল, “ইন্ডিয়া পাকিস্তান ম্যাচে তুমি কাদের সাপোর্ট কর?”

নাসির হেসে ফেলল। বলল, “এই যে মানুষ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছিল, আমি সিলিন্ডার কাঁধে নিয়ে একেক জনের বাড়িতে গেছি, কেউ কেউ বিদ্রুপ করে আমাদের এন জি ও বলেছে, এগুলো তো এই দেশেই হয়েছে বল? পাকিস্তানীদের জন্য তো অক্সিজেন নিয়ে যাই নি। তাহলে ইন্ডিয়া পাকিস্তান ম্যাচে কেন পাকিস্তানকে সাপোর্ট করব?”

রাত্রি রেগে গেল, “যদি বলি এগুলোই তোমাদের ট্র্যাপ? এভাবেই তোমরা এ দেশের ছেলেদের মধ্যে মিশে যাচ্ছো, আদতে তোমরা পাকিস্তানকেই সাপোর্ট কর?”

নাসির বলল, “তোমার প্রশ্নবিচিত্রাটা বেশ ভালই হয়েছে, তবে কী জানো তো, আমি এত সব কিছু কোন কালে ভাবি নি। ভাবানো হচ্ছে। যাই হোক, তুমি যা ভেবেছো ঠিকই ভেবেছো, কোন ভুল নেই তাতে। আমিও ভেবে দেখেছি এভাবে অন্য ধর্মের মধ্যে ভালোবাসা উচিত না। বাইক নিয়ে যাতায়াত করতাম খানিকটা ঝোঁকের বশেই। এখন বরং ক্ষমা চেয়ে নি তোমার কাছে। আমি আর আসব না। কেমন?”

রাত্রি ঠোঁট কামড়াল। বাবা তাকে দেখছে দূর থেকে।

“ছেলেটা কে?”

রাত্রি বাড়ি ফিরতেই বাবার প্রশ্নের মুখে পড়ল। প্রশ্নটা প্রত্যাশিত ছিল।

রাত্রি বলল, “কলেজের বন্ধু”।

প্রণয় বললেন, “কলেজের বন্ধুর সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার কী আছে? বাড়িতে আসতে বললি না কেন?”

রাত্রি বলল, “দেখা হয়ে গেল বলে কথা বললাম। ও কোথাও একটা যাচ্ছিল। তাছাড়া এই সময় বাড়িতে কীভাবে আসতে বলি? যত কম লোক বাড়িতে আসে ততো ভাল”।

প্রণয় বললেন, “হু। বন্ধুই তো?”

রাত্রি বলল, “হ্যাঁ”।

প্রণয় বললেন, “কী নাম”?

রাত্রি একটু থমকে বলল, “নাসিম”।

প্রণয় বললেন, “মুসলমান বন্ধু আছে তোর?”

রাত্রি বলল, “থাকতেই পারে। কী সমস্যা?”

প্রণয় বললেন, “থাকতে পারে মানে? অ্যাভয়েড করা যায় না? এরপর তো দুদিন পরে গরু খেয়ে এসে বলবি খেতেই পারি। নিজের ধর্মকে অপমান করাটাই তো তোদের ফ্যাশন হয়ে গেছে”।

রাত্রি মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে বাবার সামনে বসে বলল, “ধর্ম জিনিসটা কি মাংসে আটকে থাকে বাবা? গরু খেলেই ধর্ম চলে যায়?”

প্রণয় সোজা হয়ে বসলেন, “বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানে যেত। যে সব হিন্দুরা এদেশে ঢুকতে পারে নি, তাদের ওরা অনেকেই ছলে বলে কৌশলে মুসলমান বানিয়ে দিত”।

রাত্রি বলল, “ধরে নিলাম মুসলমান বানিয়ে দিল। তাতে কী হল? সেই তো মানুষই হল, নাকি?”

প্রণয় বললেন, “মানুষ হল? মুসলমান হওয়া মানে মানুষ হওয়া বোঝায়? তুই কোরাণ পড়িসনি? জানিস না, ওরা মেয়েদের কী হিসেবে দেখে? বাদ দে, তোকে এগুলো বোঝানোই বৃথা”।

রাত্রি বলল, “আমার বোঝার দরকার নেই। দু হাজার একুশে এসে কে কী খাবে, কে কোন ধর্মে থাকবে সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। উলটে আমার মনে হয়েছে মুসলমান ধর্মের মধ্যেও অনেক মানুষ আছে যারা যথেষ্ট শিক্ষিত এবং তোমার সঙ্গে তাদের কোন পার্থক্য নেই”।

প্রণয় বললেন, “ঠিক আছে। বুঝতে পারছি। ওদের ডিফেন্ড করার চেষ্টা করছিস। প্যারিসে কার্টুন আঁকার জন্য যেভাবে কার্টুনিস্টদের খুন করা হচ্ছে সেটাকেও সাপোর্ট করছিস নিশ্চয়ই? তুই জানিস না আসলে মুসলমান মানে কী ভয়ংকর একটা এন্টিটি। পারলে কোন দিন প্যালেস্তাইন আর ইজরায়েলের কনফ্লিক্ট নিয়ে পড়াশুনা করিস। যেটা ইহুদীরা করেছিল, সেটা হিন্দুরা পারে নি। শুধু এ কারণে ইজরায়েল দেখবি কোথায় চলে যাবে আর আমাদের আবার একদিন মুসলমানরা দখল করে নেবে। বাই দ্য ওয়ে, এবার সত্যি করে বল তো, ওই ছেলেটা সত্যিই তোর বন্ধু, নাকি বেশি কিছু?”

রাত্রি রেগে গিয়ে বলল, “তোমাকে বোঝানো বৃথা। তুমি একবারে এক্সট্রিমিস্ট হয়ে যাচ্ছো”।

সে ঘরে যেতে যেতে শুনল প্রণয় বলছেন, “নিজের ঘর বাঁচানোর দায়ে এক্সট্রিমিস্ট হওয়াটাই প্রয়োজন। কোন বাংলাদেশী হিন্দু সংখ্যালঘু পরিবারের কাহিনী শুনলে বুঝতে পারবি। কে বোঝাবে আর, কত ভাল ভাল মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যায়”।

রাত্রি ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। অসহ্য লাগছে। বাবা হঠাৎ করে পাল্টে গেছে। কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে তার জানা নেই। সম্ভবত এই সব হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ থেকে মাথায় রোজ নতুন নতুন বিদ্বেষ ঢুকছে।

নাসিমের কথা বাবার মাথায় ঢুকেছে মানে এটা নিয়েও চিন্তা করবে। তার কাছে নাসিমের ফোন নাম্বার নেই। থাকলে সাবধান করে দিত। যে ছেলের সঙ্গে কোন দিন সম্পর্কই হল না কোন, তাকে নিয়েও বাবা চিন্তা করতে শুরু করবে। পাড়ায় বেশ কয়েকজন আছেও বাবার মানসিকতার। হঠাৎ করে তারা দেশপ্রেমিক হয়ে গেল। উইচ হান্টিং এর মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে “দেশদ্রোহী”দের কান ধরে উঠবোস করিয়েছিল তারা। স্বাধীনদেশে মানুষের স্বাধীন মতামত রাখার অধিকার হারিয়ে যাওয়ার জোগাড়।

রাত্রির অস্থির লাগছিল। একে বাড়িতে বসে বসে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কলেজ যাওয়ার নাম নেই, ক্লাস যা হচ্ছে অনলাইনে, তার উপরে নাসিমের মুখটা যেন তার পিছু ছাড়ছে না। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে মুসলমান হয়েছে তো কী হয়েছে, আবার পরে মনে হচ্ছে কালচারাল ডিফারেন্স হলে সে আদৌ নিতে পারবে তো?

সব ভুলে রাত্রি গান চালিয়ে দিল জোরে জোরে।

বাবা খিটখিট করুক। ওটাই ভাল হবে।

ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় রাত্রির একটা ছেলেকে ভাললাগত। তাদেরই ক্লাসের। অরিত্রি শুনে বলেছিল, “ধুস, সেম এজে বিয়ে করিস না। অন্তত চার পাঁচ বছর বড় হলে ভাল”।

রাত্রি হেসে ফেলেছিল, “বিয়ে করছি কোথায়? মনে হল ঠিক ঠাক”।

অরিত্রি অনেক জ্ঞান দিয়েছিল। বয়সের ডিফারেন্স থাকা উচিত, মেয়েদের অনেক বুঝে শুনে এসব করা উচিত। সেম এজের ছেলেদের এসট্যাব্লিশড হতে সময় লাগে।

রাত্রি বলেছিল ছেলেদেরই কেন এস্টাব্লিশড হতে হবে? সেটা শুনে অরিত্রি বলেছিল তোর মধ্যে বিপ্লবী ভাব প্রবল। বিপ্লবী হওয়া ভাল, তবে নিজের লাইফে অ্যাপ্লাই করার ক্ষেত্রেই সমস্যাটা বোঝা যায়।

এই কথাটা রাত্রির মনে ছিল। তার খারাপ লাগছিল। তার বরাবরই একটু বেশি দূর বাড়িয়ে ভেবে নেওয়া কাজ। এর আগেও সে ভেবেছে। নাসিম ঝাড়ি মারতে এসেছিল। সে বিয়ে অবধি ভেবে নিয়েছে। ক্লাসের ছেলেটার ক্ষেত্রে যদিও এতটা ভাবে নি। অরিত্রি ভাবিয়েছিল।

নাসিমের সম্পর্কে রাত্রির আরো জানতে ইচ্ছে করছিল। রেড হোক, গ্রীন বা যে ভলান্টিয়ারও হোক, ঠিক কোন অনুপ্রেরণা থেকে এরা এটা করছে? তাদের পাশের বাড়ির জ্যেঠুর করোনার সময় এই ভলান্টিয়াররা এসে প্রায় সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ভোট অবশ্যই সব না। ভোটের থেকেও বড় কোন তাগিদ থেকে এরা এই কাজটা করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। দিন নেই, রাত নেই ছুটে যাচ্ছে।

নাসিম রেড ভলান্টিয়ার মানে অবশ্যই কমিউনিস্ট। বলল ধর্ম নিয়ে অতটা ভাবে নি কোন কালেই। রাত্রির মনে হল কেন ভাববে না? কমিউনিস্ট মানে অবশ্যই বিজ্ঞানকে আগে জায়গা দিতে হবে। বার বার সব কিছুতে প্রশ্ন তুলতে হবে। প্রশ্ন তোলাটা জরুরি। সব কিছু মাথা নিচু করে মেনে নেওয়া কমিউনিজম হতে পারে না। রাজনীতির পচা, গলা, ধান্দাবাজি জায়গাগুলোতে এই ভলান্টিয়াররা সামান্য হলেও ঝড় তুলেছে।

সে ছটফট করছিল। মুসলমানদের মধ্যে রামমোহন ছিলেন না, বিদ্যাসাগরও না, এক দেশে পাশা পাশি থেকেও যেন অন্য গোলার্ধে থাকে তারা। জানতে ইচ্ছে করছিল তার ভীষণভাবে। ইচ্ছে করছিল নাসিমের বাড়ি চলে যায়। ওদের সবার সঙ্গে আলাপ করে। নিজের কাকা, জ্যাঠা, মামার মেয়েদের সঙ্গেও নাকি ওদের বিয়ে হয়। ওরা খাটে বসে খায়। ওরা গরু খায়। ওরা ভারতে থেকেও নাকি পাকিস্তানীদের সমর্থন করে।

রাত্রির মাথায় জট লেগে যাচ্ছিল। সে এরকমই। কোন জিনিস মাথায় ঢুকলে সহজে বেরোতে চায় না।

একটা খাতায় সব ক’টা প্রশ্নের পয়েন্ট এক এক করে লিখছিল সে। ঠিক কোন কোন জায়গায় তারা আলাদা। ফেসবুকের গ্রুপে দেখেছে গরু শুয়োর নিয়ে কীভাবে বাগবিতণ্ডা লেগে যায়।

ধার্মিক নাস্তিক বলে তো কিছু হয় না। নাসিম কি নিজেকে সেরকম কিছু প্রতিপন্ন করতে চাইছে?

ভাবনা ধাক্কা খেল দরজায় ধাক্কার শব্দে। রাত্রি দরজা খুলে দেখল মা দাঁড়িয়ে আছে চিন্তাগ্রস্থ মুখে। তাকে বলল, “তুই নাকি কোন মুসলিম ছেলের সঙ্গে জড়িয়েছিস? তোর বাবার তো প্রেশার সুগার সব বেড়ে যাবে এবার!”

রাত্রি আবার মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল, “আমার বন্ধু। কলেজের। বাবাকে এটুকুই বলেছি। এতে কীভাবে প্রমাণ হল আমি জড়িয়েছি?”

মা বলল, “ঠিক আছে। বাবাকে সেটাই বুঝিয়ে বল। কোথায় বেরিয়ে গেল এই করোনার সময়ে কে জানে”!

রাত্রি বলল, “কী বুঝিয়ে বলব? দিন দিন হিন্দু তালিবান হয়ে যাচ্ছে। আমারই ভুল ছিল এসব স্মার্ট ফোন ইউজ করা শেখানো। এমন সব কথা বলে যাচ্ছে যেগুলো শুনলেই কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে”।

মা বলল, “তোরই বা গায়ে লাগছে কেন? সত্যিই কি কোন ফিলিংস আছে ছেলেটার জন্য?”

রাত্রি বলল, “ধরে নাও আছে। তাতে কী হবে? কী কী সমস্যা হয় তাতে?”

মা মাথায় হাত দিয়ে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “তোর বাবার হার্টফেল হয়। সেটাই কি সব থেকে বড় ব্যাপার হতে পারে না?”

রাত্রি বলল, “তাহলে বাবা মৌলবাদী হয়ে যাবে আর আমাকে সেটা দেখতে হবে বলছো?”

মা বলল, “আমি জানি না। তুই যা পারিস কর। আমার অশান্তি ভাল লাগে না একদম”।

রাত্রি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *