প্রেমিক – ১৫

১৫

স্থানীয় নেতার বাড়িতে এই প্যান্ডেমিকের সময়েও বেশ ভিড়। প্রণয়কে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল। নেতাদের চামচ, হাতা, অনেক লোক থাকে। নেতা অনুপম প্রামাণিকের সামনে যখন বলার সুযোগ পেলেন, তখন ঘর ভর্তি লোক তার দিকে তাকিয়ে।

প্রণয় বললেন, “একটু প্রাইভেসী পাওয়া যাবে?”

অনুপম মুখে একটা পান ভরে বললেন, “পৃথিবীতে সবাই সবার জন্য দাদা। প্রাইভেসী বলে সত্যিই কি কিছু আছে? পায়খানা আর সেক্স বাদ দিয়ে কোন কিছুর প্রাইভেসী লাগে না। বলুন সবার সামনেই বলুন। আমরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ব আপনার জন্য। সেবার জন্যই তো আমরা বসে আছি দাদা”।

প্রণয় বললেন, “আমার মেয়েকে মুসলিম ছেলে প্রেম করেছে। লাভ জিহাদ। আমার বিচার চাই”।

অনুপম বললেন, “আপনার মেয়ের অমতে?”

প্রণয় বিরক্ত হয়ে বললেন, “আজব তো! অমতে কেন? ফুসলিয়ে বিয়ে করলে কি অমতে হয় নাকি? ফুসলানো মানে হচ্ছে ওকে ভুল বুঝিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। আর দেখুন, আপনারা পারলে বলুন, নইলে আমি গেরুয়া পার্টির কাছে যাব”।

অনুপম বললেন, “আপনার মেয়ের বয়স আঠেরো পেরিয়েছে?”

প্রণয় বললেন, “হু”।

অনুপম বললেন, “তাহলে আপনি গেরুয়া পার্টির কাছেই যান”।

প্রণয় বললেন, “কেন? আপনারা দুধেল গাইদের কিছু বলবেন না?”

অনুপম পানের পিক ফেলে ফেসে বললেন, “আপনি যদি তাই মনে করেন, তবে তাই। তবে গেরুয়া পার্টি হোক, আর যে পার্টিই হোক, আপনার মেয়ে যদি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে থাকে, তাহলে মোদিবাবু এসেও কিছু করতে পারবেন না”।

প্রণয় বললেন, “কেন পারবে না? এই মোল্লাদের জ্বালায় আমাদের একটা দেশ থেকে চলে আসতে হল। এখন এপারে এসেও এদের অত্যাচার সহ্য করতে হবে কেন?”

ঘরে বসে থাকা একজন বলল, “ও দাদা, আমিও মুসলমান। কী অত্যাচার করেছি আপনাকে? যা নয় তাই বলে গেলেই হল নাকি?”

অনুপম বললেন, “আপনি আসুন দাদা। এখানে উলটো পালটা বকলে ঝামেলা বাড়বে। তবে আমি একটা কথা আপনাকে খুব সিরিয়াসলি বলি, আগেও বলেছি, আরেকবার বলছি, আপনার মেয়ে যদি স্বেচ্ছায় কাউকে ভালবেসে থাকে, তবে আমাদের কিছু করার নেই, হ্যাঁ, আপনি বলুন”।

অনুপম পরের জনের দিকে তাকালেন।

প্রণয় রেগে মেগে অনুপমের অফিস থেকে বেরিয়ে স্থানীয় গেরুয়া পার্টির অফিসে গেলেন। পুরনো লোক বেশি কেউ নেই, সব বর্তমান শাসকদলের বিক্ষুব্ধ, নয়ত লাল পার্টির প্রাক্তন। ভোটে হেরে বিমর্ষ মুখে মুড়ি খাচ্ছিল। প্রণয়কে দেখে একজন বলল, “বলুন”।

প্রণয় বললেন, “আমার মেয়েকে মোল্লারা ফুসলিয়ে বিয়ে করেছে। লাভ জিহাদ। কিছু ব্যবস্থা করুন”।

সবাই সোজা হয়ে বসল। একজন বলল, “পাকিস্তানে পাচার করে দিয়েছে?”

প্রণয় বললেন, “না না। এখানেই আছে। আপনারা ব্যবস্থা করুন”।

একজন বলল, “আপনি ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়ে যান। জানেনই তো, এ রাজ্যে এদেরই দৌরাত্ম্য বেশি এখন। উত্তরপ্রদেশ কিংবা গুজরাট হলে আপনার মেয়েকে তুলে নিয়ে চলে আসতাম”।

প্রণয় বললেন, “আমি একজন দেশপ্রেমী। পি এম থালা বাজাতে বলেছিলেন বলে আমি থালা নিয়ে গোটা পাড়ায় ঘুরেছিলাম। নোট বাতিল হবার সঙ্গে সঙ্গে বাতিল নোট নিয়ে পাল্টাতে ছুটেছিলাম। ডিজেল পেট্রোল রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ে, আমি হাসিমুখে সে দাম দিয়ে সব কিনি। কারণ দাদানে কিয়া হোগা তো আচ্ছা হি হোগা। যে কোন সময় ডাকলে আমি বর্ডারে গিয়ে দশটা পাকিস্তানী মেরে আসতে পারি। আপনারা আমার মেয়েকে নিয়ে আসুন, আপনাদের কেনা গোলাম হয়ে থাকব”।

একজন হাঁ করে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কি ঠাট্টা করছেন না সত্যি বলছেন?”

প্রণয় বললেন, “সত্যি বলছি। আপনাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপেও আছি। যা যা আসে, সব ফরোয়ার্ড করি আমার বন্ধুদের”।

একজন বয়স্ক লোক বলল, “আমি এ অঞ্চলের দলীয় সভাপতি। আমার তো মনে হচ্ছে আমার থেকে আপনি বেশ ভালবাসেন দলটাকে। আনন্দে আমার চোখে জল এসে গেল। আপনি বাড়ি যান। আমরা দেখছি কী করতে পারি। তবে মোল্লারা খুব ডেঞ্জার জানেন তো, সব সময় অস্ত্র নিয়ে ঘোরে। নিরাপত্তার ব্যাপারটাও তো দেখতে হবে বলুন”।

প্রণয় বললেন, “যা পারেন করুন, আমার বিচার চাই”।

১৬

পার্টি অফিসে অক্সিজেন সিলিন্ডার এসেছে। ভলান্টিয়াররা একে একে জড়ো হয়েছে।

ঋপণ কাজ দেখছিল।

নাসিমকে ঢুকতে দেখে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলল, “কী রে, তুই নাকি কিসব কেচ্ছা করেছিস?”

নাসিম সবটা বলল। ঋপণ বলল, “মরেছে। তুই এসব কবে করলি?”

নাসিম হতাশ গলায় বলল, “আরে তুমিও দেখি বাবা মার মত শুরু করলে! আমি কেন করতে যাব? ব্যাপারটা পুরোটাই কাকতালীয়ভাবে হয়ে চলেছে”।

ঋপণ বলল, “তোর বাবা যখন আছেন, অতটা চিন্তা করছি না যদিও। তবে সাবধানে থাকিস। দিনকাল ভাল না। আমরা এখন শূন্য, পাওয়ারে নেই। লোকজন এন জি ও বলে ডাকছে, একটা জিনিস বুঝে নে ভাই, আমরা যতই যাই করি, লোকে আমাদের থেকে হেল্প নেওয়ার পরে দেখবি ঠিক মুখ মুছে ফেলবে। এদের ধর্মই এটা। যখন তুই জিতবি, তখন তোর সব ঠিক, যা ডিসিশন নিবি, সেটাই মাস্টারস্ট্রোক, আর যখন তুই হারবি, ঠিক কাজ করলেও সেটাই দেখবি ভুল করেছিলি। ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেল। তাছাড়া এত কম বয়েসে নিশ্চয়ই বিয়ে টিয়ের কথা ভাবছিস না?”

নাসিম লাজুক হাসল, “ধুস! কী যে বল!”

ঋপণ বলল, “ঠিক আছে। বাদ দে। তুই আমার সঙ্গে চল তো। পূর্ব পল্লীতে এক বাড়িতে এক বয়স্ক লোকের কোভিড হয়েছে। বাড়ির লোকেরা নাকি খেতেও দিচ্ছে না। অক্সিজেন মেপে কেসটা দেখে আসি চল। তুই পিপিই পরে নে”।

নাসিম বলল, “পিপিই পরার কী দরকার? আমি গ্লাভস আর মাস্ক পরে নিচ্ছি”।

ঋপণ ঘাড় নাড়ল, “একবারেই না। পরে নে। কোন রকম রিস্ক নিবি না। দুজন রেড ভলান্টিয়ার এর মধ্যেই মারা গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যা করছি ভুল করছি। কী দরকার ছিল, মানুষ তো ছুঁড়ে ফেলেই দিয়েছে। তার পর মনে হয় এভাবে পড়ে থাকবে মানুষ আর আমরা দেখে যাব তাও তো হয় না”।

ঋপণকে হতাশ দেখাচ্ছিল।

দুজনে পূর্ব পল্লী যখন পৌঁছল তখন দুপুর একটা বাজে। বাড়ির কলিং বেল বাজানোর পর একজন ভদ্রমহিলা দরজা খুলে তাদের দেখে বললেন, “পিছনের দরজা দিয়ে যাও ভাই। ওই ঘরে আছেন উনি”।

ঋপণ নাসিমকে বলল, “তাই চল”।

দুজনে পিছনের দরজা দিয়ে বাড়িটায় ঢুকল। ভদ্রলোক শুয়ে আছেন। চোখ মুখ বসে গেছে। ঋপণ থার্মাল গান দিয়ে ভদ্রলোকের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ে নাসিমকে বলল, “একশো দুই। অক্সিমিটারটা দে”।

নাসিম পকেট থেকে বের করে অক্সিমিটার দিল।

ঋপণ অক্সিমিটার দিয়ে ভদ্রলোকের অক্সিজেন মেপে বলল, “বিরাশি। কাকীমা, ও কাকীমা”।

ভদ্রমহিলা বাইরে থেকে সাড়া দিলেন, “বল”।

ঋপণ বলল, “কাকুকে হাসপাতালে দিতে হবে। অক্সিজেনের অবস্থা ভাল না। আপনারা কেউই কি কাছে আসছেন না?”

ভদ্রমহিলা কাঁদতে শুরু করলেন।

স্থানীয় হাসপাতালে একটাও বেড ছিল না। সব ব্যবস্থা করে কুড়ি কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে ভদ্রলোককে ভর্তি করে ঋপণ আর নাসিমের বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।

নাসিম বাড়ি ফিরে বাইরের টিউবওয়েলে স্নান করল। নীপা বারান্দা থেকে তাকে দেখে বলল, “রাজপুত্তুরের এত দেরী হল যে? রাজকন্যা তো চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে”।

নাসিম বালতি থেকে মগের জল মাথায় ঢালতে ঢালতে বলল, “এই ব্যাপারটা নিয়ে একদম ইয়ার্কি করিস না। ব্যাপারটা এত সোজা না”।

নীপা বলল, “কঠিনও তো না”।

নাসিম বলল, “কিছুই না। জল অনেক দূর গড়াবে। মেয়েটার বাবা এত সহজে ছেড়ে দেবে না”।

নীপা বলল, “সে তো প্রথম থেকেই বলে এলি। অথচ ঝাড়িও মেরেছিস”।

রাত্রি নীপার পিছন পিছন চলে এসেছিল।

নাসিমকে খালি গায়ে স্নান করতে দেখে সে পালিয়ে গেল।

নাসিম লজ্জা পেল, “তুই দরজাটা বন্ধ করবি না গাধা?”

রাত্রি হি হি করে হাসতে হাসতে ঘরের ভিতর চলে গেল।

স্নান করে জামা কাপড় পাল্টে বসার ঘরে গিয়ে নাসিম দেখল রাত্রি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সে বলল, “হাসির কিছু নেই। তোমার বাবা খুব ঝামেলা করছে। শুনলাম অনেক দূর যাবেন”।

রাত্রি বলল, “আমার খুব মজা লাগছে। সিরিয়াসলি। আর তুমি এক কথা বার বার বলছ কেন? বাবা কত দূর যাবে? মিয়াঁ বিবি রাজি তো ক্যা করেগা কাজি?”

নাসিম বলল, “মজা লাগার কিছু নেই। তুমি ফিরে যাও বরং। অনেক ঝামেলা বাড়বে নইলে। আর মিয়াঁ বিবি রাজি মানে কী? আমি রাজি টাজি না”।

রাত্রি বলল, “তাহলে বল তুমি আমায় ঝাড়ি মারতে দাঁড়াতে কেন?”

নাসিম গম্ভীর হয়ে বলল, “বাড়িতে অন্যরা আছে। এসব বোল না। বাবা মা শুনলে খারাপ ভাববে”।

রাত্রি বলল, “ওরা দুজনেই তো কোথায় বেরোলেন। নীপাও অন্য ঘরে। আচ্ছা শোন, একটা গান মনে পড়ে গেল”।

নাসিম বলল, “কী?”

রাত্রি বলল, “এই, তুমি কি আমায় ভালবাসো? যদি না বাসো, তবে পরোয়া করি না”।

নাসিম বলল, “পরোয়া কর না? আচ্ছা তুমি কি পাগল? কী ঘটনা, কতদূর চলে গেল বল তো?”

রাত্রি বলল, “আমার ভাল লাগছে। চল আমরা বিয়ে করে নি”।

নাসিম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

১৭

রাকিব এবং শায়লা ফিরলেন কিছুক্ষণ পরে। ওষুধ আনতে গেছিলেন দুজনে।

শায়লা তার ঘরে গিয়ে নীপাকে ডেকে পাঠালেন।

নীপা মার খাটে বসে বলল, “বল মা। কী হল?”

শায়লা বললেন, “তোর দাদার সঙ্গে কি সত্যি মেয়েটার কিছু আছে?”

নীপা বলল, “কেন বল তো মা? কী হয়েছে?”

শায়লা বললেন, “বাড়ির বাইরে থেকে শুনছিলাম তোরা খুব হাসাহাসি করছিলি। আমাকে সত্যি করে বল নীপা, তোরা কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছিস?”

নীপা ফিক করে হেসে বলল, “লুকোতে পারলেই ভাল হত। রাত্রিদি খুব ভাল বৌদি হবে”।

শায়লা বললেন, “আমাকে স্পষ্ট করে বল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সত্যিই কি কিছু আছে বুঝতে পারছিস?”

নীপা বলল, “আগে ছিল না। এখন হতেই পারে। হলে বাধা দিও না মা”।

শায়লা বললেন, “তুই থাম। তুইও হয়েছিস তোর বাবার মতন। বাস্তব বোধের বড্ড অভাব”।

নীপা বলল, “কোন কিছুর অভাব নেই মা। রাত্রিদি যদি ওর ধর্ম পালন করতে চায় করবে, আমরা আমাদের মত করে চলব। তাতে অসুবিধার কী আছে?”

শায়লা মাথা নাড়লেন, “তোদের কাউকেই বুঝিয়ে উঠতে পারছি না”।

নীপা বলল, “বুঝতে পারছিও না”।

বাড়ির বাইরে বাইকের হর্ন বাজার শব্দ হল। নীপা পর্দা সরিয়ে দেখল ঋপণ দাঁড়িয়ে আছে। শায়লা রাগী গলায় বললেন, “ওই দেখ, কৃষ্ণের বাঁশি বেজে উঠল। তার মানে তোর নাসিম এখন দৌড়বে। ক’টা বাজে দেখ”।

নীপা দেখল রাত ন’টা বাজে। বলল, “এই তো ফিরল”।

শায়লা বললেন, “ভোটের নামে দেখা নেই, এখন এক এই নতুন নাটক শুরু হয়েছে। সরকার কী করছে? যাদের ভোট দিয়েছে তারা কি কিছু করছে না? কোন দরকার ছিল না এসব করার। ছেলেটার যদি এখন কোভিড হয়, এরা দায়িত্ব নেবে? বুড়ো বুড়ো নেতাগুলো নিজেরা উপর মহলে আপোষ করে চলবে, আর ছোট ছেলেগুলো মার খেয়ে মরবে। আমি এর পরে নাসিমকে আর বেরোতে দেবো না। দেখ”।

নীপা বলল, “দাদাকে এসব বোল না মা। বাস্তবটা তুমি বুঝতে পারো হয়ত, কিন্তু দাদার মধ্যে যে ডেডিকেশনটা আছে, সেটা ভীষণ অনেস্ট। সেটাকে আঘাত কোর না”।

শায়লা ক্লান্ত গলায় বললেন, “আমার আর ভাল লাগে না কিছু”।

রাত্রি দরজায় নক করল।

নীপা বলল, “এসো এসো। খিদে পেয়েছে?”

রাত্রি শায়লার ঘরে ঢুকল।

নীপা রাত্রির হাত ধরে তাকে খাটে বসাল। নীপা বলল, “বললে না, খিদে পেয়েছে?”

রাত্রি বলল, “না না, ঠিক আছে”।

শায়লা বললেন, “নাসিম বেরিয়ে গেল?”

রাত্রি বলল, “হ্যাঁ, চলে গেল দেখলাম”।

শায়লা নীপাকে বললেন, “কখন ফিরবে দেখ। রাতে ফিরলে গরম জল করে দিস। হিন্দু বাড়িগুলো এখন মুসলমান ছেলেদের ঢুকতে দিচ্ছে রে? নাসিম মুসলমান জানলে যদি রেগে যায়?”

নীপা বলল, “আহ মা। এসব কী বলছো?”

রাত্রি বলল, “আমার বাবা জানলে বলত করোনায় মরে যাব তাও ভাল, মুসলমান যেন না ছোঁয়”।

বলে রাত্রি ফিক করে হেসে ফেলল। নীপাও হেসে উঠল।

শায়লা বললেন, “তোমার বাবা বুঝি মুসলমানদের দেখতে পারেন না?”

রাত্রি বলল, “আগে ছিল না। এখন হয়েছে। তবে বাবা যেমন কট্টর হিন্দু, এরকম কট্টর মুসলিমও আছে নাকি শুনেছি”।

শায়লা বললেন, “তা আছে। সব দিকেই কট্টর লোক আছে। তোমার মাও কি তোমার বাবার মতই?”

রাত্রি মাথা নাড়ল, “একবারেই না। আমার মা ওসব নিয়ে অতো ভাবে না”।

শায়লা বললেন, “কী আশ্চর্য না, একই দেশে এত বছর ধরে দুটো ধর্মের মানুষ আছে, অথচ এখনো পরস্পরকে কত অবিশ্বাস, এখনো কত আমরা ওরা”!

নীপা বলল, “এই রাত্রিদি, মা জানতে চাইছিল তোমাদের মধ্যে সত্যিই কিছু আছে নাকি?”

শায়লা রেগে গেলেন, “এই বাঁদর মেয়ে”।

নীপা হাসতে হাসতে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।

রাত্রি হঠাৎ লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে নীপার পিছন পিছন চলে গেল।

শায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই মেয়ে নাসিমকে ভালবাসে। চোখ কখনো মিথ্যা হতে পারে না।

আরো চিন্তায় পড়লেন তিনি।

১৮

রাত সাড়ে এগারোটা। নাসিম ফেরে নি।

শায়লা খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে শুয়েছেন। রাকিব লাইব্রেরীতে পড়তে বসেছেন।

নীপা আর রাত্রিও শুয়েছে।

নীপা বই পড়ছে। “কাউন্ট অফ মন্টিক্রিষ্টো”। আগে পড়া। তবু বার বার পড়তে ভাল লাগে।

রাত্রি চোখ খুলে ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল। তার খারাপ লাগার কথা। খারাপ লাগছে না। দিব্যি লাগছে। বাড়িতে বাবা সারাক্ষণ বিদ্বেষের কথা বলে যায়। একটা অদ্ভুত জগতে চলে গেছে বাবা। লকডাউনের ফলে বাড়িতে থেকে থেকে তার চিন্তাভাবনা আটকে গেছিল যেন। বই যে একটা অনেক বড় জানলা হতে পারে, সে ভুলতে বসেছিল। ঠিকই তো, ফোন কেন লাগবে? ওয়েব সিরিজ কেন লাগবে? বইয়ের থেকে বড় বন্ধু আর কে আছে? অথচ এই ব্যাপারটাই তো সে ভুলে গিয়েছিল!

নীপা তাকে একটা বই দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের “আজ আমি কোথাও যাব না”। দুপুরে পড়ে ফেলেছে বইটা। কেমন মায়াবী লেখা। পড়তে পড়তে কান্না চলে এসেছিল। বাবাকে বললে হয়ত বলত মোল্লাদের লেখা। দেখ প্রোপাগান্ডা লেখা। কে যে কখন কোন প্রোপাগান্ডায় জড়িয়ে পড়েছে, মানুষ নিজেই বুঝতে পারছে না আর।

সে বলল, “নীপা”।

নীপা বলল, “হু”।

রাত্রি বলল, “তোমার দাদা কখন ফিরবে?”

নীপা বলল, “কে জানে। নাও ফিরতে পারে”।

রাত্রি বলল, “তোমার বাবা কিছু বলেন না?”

নীপা বলল, “বাবা তো ইন্সপায়ার করে দাদাকে। সেটা দেখে মা আরো রেগে যায়। বাবা বলে, এখন আমাদের পরীক্ষা দেওয়ার সময় আমরা মানুষ তো? পৃথিবীতে অনেক জীব জন্তু এসেছিল, সময়ের সঙ্গে তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরকম কোন রোগেই হয়ত। মানুষ যদি মানুষের পাশে না দাঁড়াবে তো কে দাঁড়াবে? আমারও ইচ্ছা করে যেতে। বাবা বাধা দিত না। তবে মা এমন কড়া চোখে তাকাল, আমি আর যাই নি”। হেসে ফেলল নীপা।

রাত্রি বলল, “আচ্ছা”।

নীপা বলল, “জানো তো, দাদাকে আমিও অনেক খেপিয়েছি। তোরা শূন্য, কেন এসব করছিস। পাবলিক তোদের আর পাত্তাই দেয় না। দাদা বলে দলটা তো একটা মাধ্যম। কাজটা তো করা দরকার। কত মানুষের স্টিগমা ছিল গত বছর। কত মানুষের বাড়ির লোকই খেতে দেয় নি। এক ঘরে করে রেখে দিয়েছিল। এরা সেই সব কিছুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। দাদাকে যে নিতে এসেছিল, ঋপণদা, ও কিন্তু ছাত্র হিসেবে খুবই ভাল। ওর মাথাতেও একই পোকা। পাগলের মত এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। ওদের আবার একটা হেল্পলাইন খুলেছে। কে কোথায় খেতে পাচ্ছে না, কার অক্সিজেন দরকার, কাকে হাসপাতালে নিতে হবে, এক ফোনে ছুটে যাচ্ছে। হেরে গেছে তো কী হয়েছে বল, মানুষগুলো তো আমাদের দেশেরই। কেন যাবে না?”

রাত্রি বলল, “এরকম মহান ভাবনা ভাবা মানুষের আমায় ঝাড়ি মারতে দাঁড়াতে হল কেন তাই বুঝছি না”।

নীপা হেসে বলল, “আমি ছেলে হলে আমিও দাঁড়াতাম। তুমি ভারি মিষ্টি মেয়ে। পাগলীও আছো। কেমন নিশ্চিন্ত আছো, কান্নাকাটিও করছো না! আমি হলে তো দুঃখে পাগল হয়ে যেতাম!”

রাত্রি বলল, “তোমাদের বাড়ির পরিবেশটাই এমন, যে কেউ ঘরকুনো হয়ে যাবে। আচ্ছা, কাকীমার আমাকে পছন্দ না, তাই না?”

নীপা বলল, “মা চিন্তা বেশি করে। সব সময় মানুষের থেকে মুসলমান বলে হ্যাটাটা মেনে নিতে পারে না। কতবার আমাদের শুনতে হয়েছে ওহ, তোমরা মুসলমান? কথা শুনে তো বাঙালি বলে মনে হয়! ভাবখানা এমন, যে এখনই বোম টোম নিয়ে মানুষ মারতে বেরিয়ে যাব। লোকসভা ভোটের আগে যখন পুলওয়ামা কান্ড হল, আমাদের বাড়ির সামনে একটা দল এসে কী কুৎসিত কথা বার্তা শুরু করেছিল। তার উপর আমার দাদা লাল পার্টি করে। আমাদের চিনের দালাল, পাকিস্তানী, কত কিছু বলে গেল। দাদা মন খারাপ করেছিল। বাবা শুধু একটা কথাই বলেছিল। এরা যারা এই অসভ্যতাটা করে গেল, আমরা তাদের থেকে অনেক বেশি ভারতীয়”।

বাইকের শব্দ পাওয়া গেল। নীপা বলল, “দাদা এসছে বোধ হয়। চল দেখি। গরম জল করে দি। স্নান করবে এখন”।

রাত্রি সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল।

১৯

নাসিম স্নান করছে।

নীপা গরম জল দিয়েছে।

রাত্রি বারান্দায় যেতেই নাসিম নীপাকে বলল, “ওকে ঘরে যেতে বল”।

নীপা বলল, “থাক না। কী হয়েছে?”

নাসিম খিচিয়ে উঠল, “কী হয়েছে বুঝিস না? যেতে বল”।

নীপা বলল, “রাত্রিদি, দাদা তোমাকে ঘরে যেতে বলছে”।

রাত্রি বলল, “যাবো তো। তোমার দাদা কোথায় গেছিল জিজ্ঞেস করলে?”

নাসিম বলল, “কালকে বলব। এখন এই অবস্থায় বলা যাবে না”।

রাত্রি হাসতে হাসতে ঘরে চলে গেল।

নীপা বলল, “দাদা, রাত্রিদি তোর উপর পুরো লাট্টুরে। পুরো প্রেম কাহিনী হবে মনে হচ্ছে”।

নাসিম গা মুছতে মুছতে বলল, “তুই পড়াশুনা না করে এখন এসব শুরু করেছিস তো? আমি মাকে বলছি দাঁড়া”।

নীপা ঘাবড়ে গিয়ে তার ঘরে চলে গেল।

রাত্রি খাটে বসে পা দোলাচ্ছিল। নীপাকে দেখে বলল, “তোমার দাদা পুরো দেশোদ্ধার করে ফিরছে দেখছি”।

নীপা বলল, “হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করলেই দেখবে কত ফিরিস্তি দিয়ে দেবে”।

রাত্রি বলল, “সময় ভাল না। মাস্ক আর স্যানিটাইজার ঠিক ঠাক ইউজ করতে বোল। যখন কিছু হবে তখন কেউ দেখবে না। সবাই বলবে কেন গেছিল। মানুষ উপকার নিতে জানে, তার পরিবর্তে নিন্দা ছাড়া কিছু করতে জানে না”।

নীপা বলল, “খুব চিন্তা হচ্ছে বল তোমার দাদার জন্য?”

রাত্রি হাসল, “তা হচ্ছে। সব ভলান্টিয়ারদের জন্যই হচ্ছে। সত্যি ওরা অসাধ্যসাধন করছে। ওরা না থাকলে যে কী হত, কে জানে!”

নাসিম দরজা নক করল।

নীপা বলল, “আয় দাদা”।

নাসিম ঘরে ঢুকল।

রাত্রি বলল, “এলাকাতেই ছিলে না দূরে?”

নাসিম বলল, “এক পেশেন্টকে হাসপাতালে ভর্তি নিচ্ছিল না। সেফ হোমে ছিল এতদিন। হঠাৎ করে অক্সিজেন ফল করতে শুরু করেছে। বাড়ির লোক কান্নাকাটি করছিল। হাসপাতালে একটা ব্যবস্থা করা গেছে। অ্যাম্বুলেন্সে করে পৌঁছে দিয়ে এলাম”।

রাত্রি বলল, “মানুষ কখনো তোমার সামনে মারা গেছে?”

নাসিম বলল, “দুজন। কলকাতা নিয়ে যেতে গিয়ে তার মধ্যে একজন। তার বাড়ির লোক ছিল না গাড়িতে। শ্বাস কষ্ট হতে হতে গাড়িতেই মারা গেলেন”।

রাত্রি বলল, “হিন্দু না মুসলমান?”

নাসিম ম্লান হাসল, “হিন্দু। আর যে মানুষ অন্য সময়ে অচ্ছুৎ থাকে, রুগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় সেই অচ্ছুৎরাই নিয়ে যায়। এই দেখো না, আমি মুসলমান জানলে কত বাড়িতে ঢুকতেই দিত না, সেসব বাড়িতেও রুগীকে অক্সিজেন দিয়ে এসেছি। তখন আর অচ্ছুৎ থাকি নি”।

নীপা বলল, “বেশ করেছে। অচ্ছুৎ করে রাখাই ভাল তোকে। কোন কাজে আসিস না। একটা ঠিক করে প্রেমও করতে পারলি না এদ্দিনে”।

নাসিম চোখ পাকাল।

রাত্রি নাসিমকে বলল, “ওহ, তুমি এতদিনে একটাও প্রেম করতে পারো নি?”

নাসিম বলল, “নীপা ছোট। ওর সামনে এসব কথা বলবে না”।

নীপা বলল, “বেশ তো, আমি অন্য ঘরে চলে যাচ্ছি। তোরা কথা বল”।

নাসিম বলল, “কোন দরকার নেই। তোর সময় ঘনিয়েছে। খুব মার খাবি তুই”।

রাত্রি নীপার হাত ধরে বলল, “কেন, ও মার খাবে কেন? তুমি ওকে মারো নাকি?”

নীপা বলল, “ধুস, ও মারতে পারে নাকি? ও খালি ভয় দেখায়। আর মাঝে মাঝে চকলেট খাওয়ায়”।

রাত্রি বলল, “চকলেট খাওয়ায়? কোই, আমায় খাওয়ালো না তো?”

নীপা বলল, “কী রে দাদা, তোর তো উচিত ছিল রাত্রিদির জন্য চকলেট আনা। আনিস নি কেন?”

নাসিম বলল, “মাঝরাতে তোর রাত্রিদির জন্য তো সব দোকান খুলে রেখেছে। এমন সব কথা বলিস না!”

শায়লা ঘরে ঢুকলেন। নীপা সঙ্গে সঙ্গে খাটে শুয়ে পড়ল। শায়লা নাসিমকে বললেন, “এত রাতে এসে হাসি ঠাট্টা করছিস কেন? গিয়ে ঘুমিয়ে পড়”।

নাসিম বলল, “হ্যাঁ যাচ্ছি”।

শায়লা রাত্রির দিকে তাকালেন, “তুমি ঘুমিয়ে পড়। এত রাতে জাগতে নেই”।

রাত্রি ঘাড় নাড়ল, “আচ্ছা”।

শায়লা নাসিমের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *