২৫
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
আনকোরা যত নন্ভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন্ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!
-কাজী নজরুল ইসলাম
নাসিম স্নান করে তার ঘরে গিয়ে বসল। শায়লা ঘরে ঢুকে বললেন, “ভাল হয়েছে যা হয়েছে। দীর্ঘকালীন অপমানের থেকে এরকম হওয়াই ভাল। তুই মন খারাপ করিস না। আজ বিরিয়ানি করব। খাবি তো?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ কর”।
শায়লা নাসিমের পাশে বসে বললেন, “তেলে জলে মিশ খায় না। ভালবাসিস বা না বাসিস, সেটা বড় কথা না। একটা দেশে সংখ্যালঘু হয়ে থাকার অনেক জ্বালা। যে সে সংখ্যালঘু না, মুসলিম সংখ্যালঘু। তোর বাবা যতই পড়াশুনা করে থাকুক, ওর বাস্তববোধের অভাব আছে। যেখানে মেয়ের বাবা এতটা অ্যাক্টিভ হয়ে পড়েছে, মেয়ে নিজেও জানে না আদৌ তোকে ভালবাসে কি না, সেখানে দাঁড়িয়ে আমি বলব, যেটা হয়েছে, ঠিক হয়েছে। তোর সামনে গোটা ভবিষ্যৎ পড়ে আছে বাবু, এসব মাথায় নিস না”।
নাসিম বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছো। চিন্তা কোর না, আমি ঠিক আছি”।
শায়লা কয়েক সেকেন্ড নাসিমের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন।
নীপা এল। নাসিমের পাশে বসে বলল, “দাদা, রাত্রিদিকে ফোন কর না। কী বলছে দেখ”।
নাসিম বলল, “আমার কাছে ওর নাম্বার নেই”।
নীপা বলল, “সত্যি?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ। তাছাড়া যা হয়েছে ভালর জন্যই হয়েছে। মা ঠিক বলেছে। তেলে জলে কখনো মিল হয় না”।
নীপা বলল, “তেলে জলের কী আছে? রিলেশনশিপে রিলিজিয়ন কবে দেখা হয় রে? কমিউনিস্ট পার্টি করছিস কেন তাহলে?”
নাসিম বলল, “কমিউনিস্ট পার্টি করে তো ঈদ পালন করি। ঋপণদাও পুজো করে। শনি মন্দিরের সামনে মাথা নোয়ায়। আমরা ঠিক কমিউনিস্ট না। ধর্মকে অস্বীকার করতে পেরেছি কোথায়? আমরা কিচ্ছু পারি নি। ফেল করে গেছি বুঝলি”?
নীপা বলল, “কিচ্ছু ফেল করিস নি। ফেলটা তখন করবি, যদি রাত্রিদিকে সত্যি ভালবেসেও শুধু ধর্ম আলাদা হবার জন্য বলতে না পারিস। ধর্ম কেন বাধা হবে দুজনের মধ্যে? রাত্রিদি তো কখনো ধর্মকে মাঝখানে আনে নি। ও হিন্দু বাড়ির মেয়ে হয়েও দিব্যি আমাদের সাথে মিশে গেছিল। তোর কী সমস্যা?”
নাসিম বলল, “তুই বক্তৃতা না দিয়ে পড়তে যা। তোকে কিছু বলতে হবে না”।
নীপা বলল, “কেন বলতে হবে না? তুইই বলিস না, মার্ক্স প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন? আমি প্রশ্ন করছি তোকে, কেন হবে না তোদের রিলেশনটা? যদি না হয়, তাহলে তুই এই সব করা ছেড়ে দে। মানুষের জন্য কাজ করবি না। ঘরে বসে থাক, পড়াশুনা কর, চাকরি কর। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে হবে না তোকে”।
নাসিম বলল, “তুই যা। আমাকে একটু শুয়ে থাকতে দে। রাতে ঘুমাতে পারি নি। আবার সকালেও দৌড়লাম। ভাল্লাগছে না। যা তুই”।
নীপা রেগে মেগে শব্দ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নাসিম চুপ করে শুয়ে রইল।
রাত্রি যখন ছিল, একটা ভাললাগা ছিল। এখন নেই, কষ্ট হচ্ছে শুধু। তার অনুভূতি প্রথমে আসে না। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রাত্রিকে সে ভালবাসে বলে আগে অতটা ভাবে নি। এখন যে কষ্ট হচ্ছে, সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে রাত্রিকে ভালবাসে। দেশভাগের পরও দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা বড় দেওয়াল রয়ে গেছে। এই দেওয়াল একদিনে তৈরী হয় নি। বছরের পর বছর ধরে এই দেওয়াল তৈরী হয়েছে। এর দায় দুটো সম্প্রদায়েরই।
ঘরে অসহ্য লাগছে। নাসিম উঠে বসল।
ঘুরে আসা যাক বাইক নিয়ে।
সে বেরোল।
রাকিব ডাইনিং টেবিলে বসে ছিলেন।
তাকে দেখে বললেন, “কোথায় যাচ্ছিস? রাত্রিদের বাড়ি?”
শায়লা সেটা শুনে চলে এলেন, “তুমি ছেলেকে তাতাচ্ছো কেন? তুমি চাও ও যাক?”
নাসিম মার দিকে তাকাল, “না না, আমি যাচ্ছি না। পার্টি অফিসে যাব”।
রাকিব বললেন, “নীপাকে কী বলেছিস? রেগে গেছে মনে হল?”
নাসিম বলল, “কিছু না”।
শায়লা বললেন, “তুই ঘুরে আয়। আমার মাথা ধরার ওষুধটা শেষ হয়ে গেছে। নিয়ে আসিস এক পাতা”।
নাসিম বলল, “ঠিক আছে”।
রাকিব বললেন, “মেয়েটাকে ওর বাড়ির লোক অত্যাচার করতে পারে। আমার চিন্তা হচ্ছে”।
শায়লা বললেন, “যা খুশি করুক। তুমি ভেবো না”।
রাকিব নাসিমের দিকে তাকালেন।
নাসিমের চোখ মুখ থম থম করছে।
২৬
রাত্রিকে কোনমতে ঘুম পাড়াতে পেরেছেন তনয়া।
বিজয়োল্লাসে ঘরের মধ্যে বসে চারদিকে জয়ের খবর হোয়াটস অ্যাপ করছেন প্রণয়।
তনয়া রাত্রির ঘর থেকে বেরোতে প্রণয় বললেন, “একটা সুখবর আছে”।
তনয়া ক্লান্ত গলায় বসলেন, “বলে ফেলো”।
প্রণয় বললেন, “রাত্রি কুমারী। এটা ওর কথা শুনে যারা এসেছিল তারা বুঝেছে। ওরা হেড অফিসে জানিয়েছে। রাত্রির জন্য এবার একজন হিন্দু সুপাত্র দেখেছে ওরা”।
তনয়া বললেন, “বাঙালি না অবাঙালি?”
প্রণয় বললেন, “অবাঙালি। তাতে কী হয়েছে? বিহারে বাড়ি। কোন বাঙালি তোমার মেয়ের সব পাস্ট জেনে বিয়ে করবে হে?”
তনয়ার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। একটু থমকে বললেন, “এখন কম্প্যাটিবিলিটি ফ্যাক্টর কাজ করবে না? বাঙালি বিহারীতে বিয়ে হতে পারে, আর হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হলেই সমস্যা?”
প্রণয় বললেন, “তুমি কি চাও, ওই জেহাদীদের বাড়ি আমি মেয়ের বিয়ে দিই?”
তনয়া বললেন, “মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে এটা কোথায় লেখা আছে? মেয়েটা বিয়ে ছাড়াও তো ভাল থাকতে পারে, তাই না? না জেনে শুনে কোথাকার কোন ছেলের গলায় মেয়েকে ঝোলাতে যাবোই বা কেন? আমাদের মেয়ে কি বোঝা?”
প্রণয় বললেন, “তোমাকে অত বোঝাতে পারবো না। আমার গ্রুপের যারা আছে, তারা সবাই বলছে রাত্রির এখন হিন্দু সুপাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই মঙ্গল। নইলে ওই ছেলে আবার চলে আসবে”।
তনয়া বললেন, “যদি জোর করে কিছু কর, তখন ওই বিহারীর সঙ্গে বিয়ের পর তোমার মেয়ে যদি মুসলমান ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়, তখন তোমার মুখ রক্ষা হবে তো?”
প্রণয় বললেন, “এসব কথা তোমার মাথায় কে ঢুকিয়েছে? রাত্রি বলেছে ওই কাটার বাচ্চা মোল্লার সঙ্গে ও পালাবে?”
তনয়া বললেন, “যদি নাও বা পালাত, তুমি যেমন যাত্রা দলের রাবণের মত শুরু করেছো, তাতে আমার মনে হচ্ছে ও সত্যি সত্যিই পালিয়ে যাবে”।
প্রণয় চিৎকার করতে যাচ্ছিলেন। তনয়া ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন, “একদম কথা বলবে না। চিৎকার করবে না। তুমি যদি বাড়িতে সীন ক্রিয়েট কর, আমি মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। দরকার হলে রাস্তায় থাকব, কিন্তু এ বাড়িতে ফিরব না। মেয়েটা সবে ঘুমিয়েছে। যদি জেগে যায়, তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন”।
প্রণয় গুম হয়ে বসে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর বললেন, “খিদে পেয়েছে”।
তনয়া বললেন, “নিজে ভাত বসিয়ে খাও। খুব বুকনি মারছিলে না মোল্লারা মেয়েদের স্বাধীনতা দেয় না বলে। তুমি এক কাজ কর, আজ থেকে আমায় স্বাধীন করে দাও। নিজে রান্না করবে, নিজে খাবে। বাথরুম পরিষ্কার করবে, ঘর ঝাঁট দেবে, বাসন মাজবে, কাপড় কাচবে, ঘর মুছবে, সব নিজে নিজে করবে”।
প্রণয় বললেন, “খুব রাগ মনে হচ্ছে তোমার মেয়েটাকে কাটা বাড়িতে বিয়ে দিই নি বলে?”
তনয়া বললেন, “আমার রাগ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি নিজে রেঁধে খাও। আমাকে বলতে আসবে না”।
প্রণয় উঠে রান্নাঘরে গেলেন। ভাতের হাঁড়ি দেখলেন। সামান্য ভাত পড়ে আছে।
আবার বসার ঘরে এসে বললেন, “তুমি আমার ভাত কর নি?”
তনয়া বললেন, “না। করি নি। আজ থেকে করব না। ওই মোবাইলটা যতদিন তোমার হাতে থাকবে, আমি তোমার কোন ফাইফরমাশ খাটব না। মোবাইলটা ফেলে দাও, তারপরে দেখছি”।
প্রণয় বললেন, “তাহলে আমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে?”
তনয়া বললেন, “করবে না। যেখান থেকে ক্রমাগত বিষ আসছে, সেটা বন্ধ হয়ে গেলে ভাল হবে। কারো কোন ক্ষতি হবে না। তুমিও সুস্থ হবে”।
প্রণয় রেগে গেলেন, “আমি অসুস্থ?”
তনয়া বললেন, “নিজেকে আয়নায় দেখো। বুঝে যাবে তুমি ঠিক কী? আজ থেকে পাঁচ বছর আগে কী ছিলে, আর এখন কী অবস্থা হয়েছে তোমার? সারাক্ষণ ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছো”।
বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। তনয়া দেখলেন তার দিদি, জামাইবাবু সব গাড়ি থেকে নামছেন।
তনয়া বললেন, “হয়ে গেল। যাও বাজার নিয়ে এসো। বাড়িতে এবার সার্কাস শুরু হবে। খবর পেয়ে এই লকডাউনের মধ্যে গাড়ি ভাড়া করে চলে এসেছে। পারেও বটে!”
২৭
শায়লা রান্না বসিয়েছেন।
রাকিব ক্লাস করাচ্ছেন। নীপা তার ঘরে গিয়ে বইতে মুখ গুঁজেছে।
নাসিম বেরোল। এ পাড়া সে পাড়া বাইক নিয়ে ঘুরে দেখল আরো অসহ্য লাগছে। মায়ের ওষুধ নিয়ে এসে নিজের ঘরে চুপ করে শুয়ে পড়ল।
ঋপণের বাইকের হর্ন শুনেও উঠল না।
নীপা তার ঘরে এসে বলল, “ঋপণদা এসেছে। যাবি না?”
নাসিম বলল, “ভাল লাগছে না”।
নীপা বাড়ির বাইরে গেল। ঋপণদাকে তার ভারি ভাল লাগে। বলতে পারে নি। একে দাদার কমরেড। তার উপরে ভীষণ গম্ভীর মানুষ। তাকে দেখলে কেমন দাদাগিরি করতে শুরু করে। অথচ ভাল করে সেটা করতে পারে না। নীপার হাসি পেয়ে যায়।
নীপাকে দেখে ঋপণ বলল, “কোথায় গেল নাসিম? ডাক। এখনই বেরোতে হবে”।
নীপা বলল, “দাদা শুয়ে আছে। আসবে না মনে হয়”।
ঋপণ বলল, “কেন রে? মেয়েটা চলে গেছে বলে”?
নীপা বলল, “তা হবে”।
ঋপণ বলল, “মহা জ্বালা হল তো। আমি একা অক্সিজেন সিলিন্ডার বইব না বাইক চালাবো?”
নীপা বলল, “তুমি গিয়ে বল। দেখো যদি যায়”।
ঋপণ বাইক স্ট্যান্ড করে বলল, “অগত্যা…”
নাসিম শুয়েই ছিল। ঋপণ বলল, “কী রে? এরকম নেতিয়ে গেলি কেন?”
নাসিম বলল, “আজকের দিনটা ম্যানেজ দাও প্লিজ। ভাল লাগছে না”।
ঋপণ বলল, “সেটা তো খুব ভাল করে বুঝেছি। কিন্তু এভাবে শুয়ে থাকলে কি খারাপ লাগাটা কমবে? কী মনে হয় তোর?”
নীপা উঁকি মারল, “চা খাবে ঋপণদা?”
ঋপণ বলল, “না রে। রুগী মরণাপন্ন। সেফ হাউজে নিয়ে যেতে হবে। তোর দাদা এভাবে শুয়ে থাকলে কী হবে কে জানে”।
নাসিম উঠে জামা পরে বলল, “চল”।
ঋপণ খুশি হল, “এই তো। সোনা ছেলে। চল চল”।
নাসিম বেরোল।
ঋপণ বাইকের কাছে এসে বাইক স্টার্ট দিল।
নাসিম ঋপণের পিছনে বসল।
খানিকটা রাস্তা যাওয়ার পর ঋপণ বাইক থামিয়ে বলল, “তুই মেয়েটাকে ভালবাসিস। এটা বুঝে গেছিস। কোন কনফিউশন নেই আর। এবার মেয়েটাকে বলে দে”।
নাসিম মাথা নাড়ল, “ধুস। অনেক অশান্তি। মা ভয় পাচ্ছে। গেরুয়া পার্টি ইনভলভ হয়ে গেছে। গ্রামের কয়েকজন আবার বলছে ওকে কনভার্ট করাতে হবে। সব মিলিয়ে ঘেঁটে যাবে ব্যাপারটা। ছেড়ে দাও”।
ঋপণ বলল, “মামাবাড়ি আর কী! এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে? তোরা যদি ঠিক থাকিস, কোন হনু কিছু করতে পারে নি। দেশটা এখনো গুজরাট বা আফগানিস্তান হয়ে যায় নি”।
নাসিম ঋপণের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল, “এই জন্যই আমরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি বুঝলে? তুমি বোঝো না এখনো? মানুষ অনেক পাল্টে গেছে। এরা আমাদের থেকে সাহায্য নেবে ঠিকই। তবে এরা আমাদের নয়। অনেক কিছুই পাল্টে গেছে কমরেড। চিনি না, জানি না, এমন লোকেদের নিয়ে ওর বাবা আমাদের বাড়ি চলে এল। তারা বাঙালিও নয়। কোথাকার লোক কে জানে। যাক গে, চল। যাই”।
ঋপণ বলল, “জনবিচ্ছিন্ন হয়েছি নাকি জানি না। তবে আমার আজকাল মনে হয় আমাদের পার্টি দিন দিন মরে যাচ্ছে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব আনতে হলে কী দরকার জানিস? মার দরকার। পার্টি এখন সেই লাইনে চলে না। সারাক্ষণ শুধু সম্মেলন আর শান্তির জল ছিটিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে দিই। কিন্তু কোথায় যাব? মানতে পারি না কোন কিছুই। শাসকের আস্ফালন একদিকে, অন্যদিকে জাতের নামে বজ্জাতি। এই কোভিডের সময় পেরিয়ে গেলে আমরা কী করব? যারা এখন ঘরে চুপ করে বসে আছে, তারা পিল পিল করে বেরিয়ে নেতাগিরি শুরু করে দেবে, আর আমরা তখনও কিছু করব না। আর কারো সঙ্গেই তো মেলে না আমাদের, যাদের সঙ্গে মেলে, তারাও যদি এরকম ভুল ভাল কাজ করতে শুরু করে, আমরা কোথায় যাই বল?
নাসিম বলল, “মানুষ আমাদের আর ভোট দেবে না বল?”
ঋপণ বাইক স্টার্ট দিল, “না দিলেই বা কী? চল। দেরী হয়ে গেল”।
২৮
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খানিকক্ষণ আগেই রোদ ছিল।
পাড়ার কৌতূহলী মহিলারা ঠেক বসিয়েছিল। তনয়া স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন। ভাগ্যিস বৃষ্টি হল। নিশ্চয়ই রাত্রিকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। অনেক দিন পরে একটা ভাল বিষয় পেয়েছে পাড়ার মানুষ। এই কোভিডের সময়েও সবাই জড়ো হয়ে গেছিল।
রসালো আলোচনা করবে।
রুমা বার বার রাত্রির ঘরে যাবার চেষ্টা করেছেন। তনয়া অত্যন্ত কড়া হাতে নিজের দিদিকে সামলাচ্ছেন। ঠিকই করেছেন রাত্রির ঘুম কিছুতেই ভাঙাতে দেবেন না।
জামাইবাবু বিজন এসে প্রণয়ের সঙ্গে উত্তেজিত কথা বার্তা বলছেন। মাংস ভাত হবার প্ল্যান পর্যন্ত হয়ে গেছে।
এত বড় জয় পাওয়া গেছে। কম কথা না।
সন্ধ্যা নামলে রাত্রির ঘরে ঢুকে তনয়া দেখলেন রাত্রি সিঁটিয়ে শুয়ে আছে।
আলো জ্বালিয়ে রাত্রিকে ডাকলেন।
রাত্রি চোখ খুলল।
তনয়া বললেন, “এখন একটু ভাল লাগছে? মাসী মেসো সব এসেছে। পারবি বাইরের ঘরে যেতে?”
রাত্রি ভাঙা গলায় বলল, “কেন এসেছে?”
তনয়া বললেন, “তোকে দেখতে”।
রাত্রি বলল, “আমি বাইরে যাবো না। ভাল লাগছে না”।
তনয়া বললেন, “ঠিক আছে। তুই শুয়ে থাক”।
রাত্রি বলল, “মাথা ধরেছে খুব। কোন ওষুধ থাকলে দিও”।
তনয়া রাত্রির কপালে হাত দিলেন। জ্বর আছে। বললেন, “আর সব ঠিক আছে তো?”
রাত্রি বলল, “ভীষণ গায়ে হাত পায়ে ব্যথা করছে”।
তনয়া চিন্তিত মুখে বললেন, “তুই শো। আমি দেখছি”।
ড্রইং রুমে প্রণয় আর বিজন গল্প করছিলেন।
তনয়া বললেন, “মেয়ের জ্বর এসেছে। মাথা ব্যথা। গা হাত পাও ব্যথা। কী করবে, ঠিক কর। বাইরের কতগুলো অচেনা অজানা লোকের সঙ্গে গাড়িতে উঠেছো। দেখো এবার কী হুয়”।
তনয়ার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বিজন উঠে দাঁড়ালেন, “সে কী? জ্বর এসেছে মানে? আমি তো গাড়িও ছেড়ে দিলাম”।
তনয়া হাসলেন, “আমি তো আপনাকে নেমন্তন্ন করে আনি নি জামাইবাবু। এই মহামারীর সময়ে আপনি এসেছেন, কিন্তু যদি আমার মেয়ের থেকে আপনাদের কিছু হয়, আমাকে দোষ দিতে পারবেন না”।
প্রণয় বললেন, “অজানা লোকের গাড়ি আবার কী? ও মোল্লা বাড়িতে গেছিল। ওদের কোন মানা মানি আছে নাকি? ওখান থেকেই নির্ঘাত রোগ বাঁধিয়েছে”।
তনয়া ঠান্ডা গলায় বললেন, “তোমার মেয়ে। তুমি নিজে লোক জন জড়ো করে নিয়ে এসেছো। এবার কিছু হোক না হোক, টেস্ট করাও। ডাক্তার দেখাও”।
প্রণয় হতবুদ্ধি হয়ে মোবাইল নিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলেন।
বিজন বিড় বিড় করতে শুরু করলেন, “মহা জ্বালা হল তো! আমার সুগার আছে। এবার কী হবে? রুমা আমাকে নিয়ে এল”।
পকেট থেকে একটা ছোট স্যানিটাইজারের বোতল বের করে বিজন হাতে গাদা গুচ্ছের স্যানিটাইজার বের করে মেখে ফেললেন। রুমাকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলেন।
রুমা ছুটে এলেন, “কী হল?”
বিজন বললেন, “তুমি জোর করে নিয়ে এলে। মেয়ের এখন নাকি জ্বর। মাথা ব্যথা। সবই তো কোভিডের সিম্পটম। এবার কী হবে?”
রুমা চোখ বড় বড় করে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই আমাকে বলবি না? তোর জামাইবাবুর যদি কিছু হয়?”
তনয়া মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলেন না আর। বললেন, “কী বলতে হবে তোকে? আর কী বলার আছে বল তো? আমাকে জিজ্ঞেস করে এসেছিস তোরা? আর আমি কি জানতাম প্রণয় ওই বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে চলে আসবে?”
রুমা কাঁদো কাঁদো চোখে বিজনের দিকে তাকালেন।
প্রণয় ঘরে ঢুকে বললেন, “কাল সকালে লোকাল হাসপাতালে লাইন দিতে হবে। আগে সোয়াব টেস্ট করুক। ডাক্তার দেখানোই ভাল। রতনদাকে ফোন করেছিলাম। উনি বললেন একটু অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু টেস্ট করে দেবে। দুদিন পরে রেজাল্ট পাওয়া যাবে। এটা ওই মোল্লা বাড়ি থেকে এসেছে। আমার মেয়ের কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়ব না। সবাইকে এক এক করে দেখে নেব”।
লাফাতে শুরু করলেন প্রণয়। তনয়া দেখলেন বিজন আবার স্যানিটাইজার বের করে কনুইতে মাখছেন।
২৯
রাকিব বই পড়ছিলেন।
ক্লাস নেই।
শায়লা এলেন।
রাকিব শায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাসিম কি বেরিয়েছে?”
শায়লা চেয়ার টেনে বসে বললেন, “হ্যাঁ। ঋপণ এসে নিয়ে গেল। তুমি এবার নাসিমকে বোঝাও। ও অহেতুক মন খারাপ করছে”।
রাকিব বইটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “কী বোঝাবো?”
শায়লা বললেন, “তেলে জলে মিশ খায় না, সেটা বোঝাও। আবার কী বোঝাবে? এটাও তোমাকে খুলে বলতে হবে?”
রাকিব বললেন, “আমি তো সেটা বোঝাবো না”।
শায়লা অবাক হলেন, “মানে?”
রাকিব বললেন, “আমি বোঝাবো, যদি ওরা দুজন দুজনকে সত্যিই ভালবাসে, তাহলে বাকি সব কিছু ভুলে যাওয়াই ভাল”।
শায়লা রেগে গেলেন, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
রাকিব বললেন, “না। একবারেই মাথা খারাপ হয় নি। তবে যেখানে কোন পাপ নেই, সেখানে আমার ছেলেকে অহেতুক দোষী ভাবতে আমার সমস্যা আছে। সংখ্যাগুরুর আস্ফালন এখানে বসে সহ্য করবই বা কেন? তুমি তোমার ধর্ম পালন করেছো, সব কিছু মেনে চলেছো, আমি কিছু বলি নি। আমাকে ইমাম থেকে শুরু করে সবাই বার বার বলেও জোর করে ধর্ম পালন করাতে পারে নি। আমি আমার মত চলেছি। সেই আমি কি করে আমার ছেলেকে ভুল শিক্ষা দিতে যাব? কী আনন্দে?”
শায়লা বললেন, “তোমাকে কিছু বলাটাই ভুল হয়েছে আমার”।
রাকিব বললেন, “ঠিক আর ভুল যতক্ষণ না আমরা আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারবো, ততদিন এটাই হয়ে চলবে। কাউকে ভালবাসতে হলে যদি মানুষকে তার জাত, পাত, ধর্ম, সব আলাদা করে ভেবে তারপর ভালবাসতে হয়, তবে সেটা ভালোবাসা হয় কী করে?”
শায়লা বললেন, “ভালবাসতে হবে না। দরকার নেই ভালবাসার। যে ভালবাসায় আমাদের বাড়িতে যে কোন সময় অচেনা অজানা লোকেরা এসে হামলা করতে পারে, সেরকম ভালবাসায় দরকার নেই। তুমি জানো সকালে আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম। কেন, তুমি ভয় পাও নি?”
রাকিব বললেন, “কেন ভয় পাবো? আমরা চুরি করেছি না ডাকাতি করেছি?”
শায়লা বললেন, “তা না। আমাদের বাড়ির ব্যাপারটা নিয়ে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। ওরা তো এসে আমাকে বলেও গেলে, প্রয়োজনে রাত্রির বাড়ি গিয়ে রাত্রিকে তুলে নিয়ে আসবে। অনেক কষ্টে আটকাতে পেরেছি সেটা”।
রাকিব বললেন, “সেটা তুমি ঠিকই করেছো। কিন্তু নাসিমের কোন দোষ নেই। তাই ওকে বোঝানোরও ব্যাপার নেই”।
শায়লা বললেন, “আমি তোমাদের জ্বালায় একদিন পাগল হয়ে যাবো, জানো তো? এতদিন শুনে এসেছি তোমার বর নামাজ পড়ে না কেন, রোজা রাখে না কেন, এখন শুনতে হবে হিন্দু বাড়ির মেয়েকে আমার ছেলে তুলে নিয়ে এসেছে”।
রাকিব হেসে ফেললেন, “তুমি ওভার থিংক করছো। স্টপ ওভার থিংকিং। বেশি ভাবলে কাজের কাজ কিছু হয় না। সময় দাও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। ফেসবুকে দেখছিলাম কয়েকটা প্রোফাইল থেকে ক্রমাগত হিন্দু মুসলিম করে যায়। ওরা আমরা। কী সব বিষমাখা তীর একে অপরের দিকে মেরে যাচ্ছে সারাক্ষণ ধরে। এই ফাঁদে যেন নাসিম না পড়ে সেটা দেখো। এ রাজ্যের কমিউনিস্ট পার্টির অনেক দোষ আছে। গুণটা হল এরা ধর্ম সম্পর্কে মানুষকে উদাসীন বানিয়ে রাখতে পেরেছিল। এ রাজ্যে কখনো ভাবতে হয়নি দিল্লি থেকে নেতা এসে দলিতের বাড়িতে ভাত খাবে। আমরা দলিত ব্যাপারটা নিয়েও তো ভাবতাম না কোন কালে। রাজনীতিতে যখন ধর্ম মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন বুঝতে হয় রাজনীতিকদের ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে। তারা আসলে রাজ্যের ভাল চায় না। ধর্মের বিষ ছড়িয়ে ভোট পাওয়ার ধান্দা করছে। ব্রিটিশরা শুধু ধর্মে ধর্মে আগুন লাগিয়ে এত বছর ক্ষমতায় থেকে গেল”।
শায়লা বললেন, “উফ, এত জ্ঞান না দিয়ে তুমি আমাকে বল তো আমি কী করব?”
রাকিব বললেন, “কিচ্ছু করবে না। চুপ করে দেখে যাও আমাদের ছেলে কী করে। বুঝলে?”
শায়লা মুখ কালো করে বললেন, “আমার তোমার কাছে আসাটাই ভুল হয়েছে। একটা ঠিক ঠাক বুদ্ধি যদি দিতে পারো তুমি”।