৩০
“দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের কিছু করার থাকে না। প্রতিটা দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা এই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষগুলোর মতই। বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের হিন্দুরা যেমন। তাদের এক সঙ্গে থাকতে হয়। বাংলাদেশে আমার পরিচিত এক হিন্দু পরিবারে আমি দেখেছি, তারা সব সময় আতঙ্কে থাকে। তাদের আপোষ করে চলতে হয় স্থানীয় মুসলমান হোমরা চোমড়াদের সামনে। বাড়ির মেয়েদের অত্যন্ত সাবধানে রাখতে হয়। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে এই ভাবনাও কাজ করে, যেন তেন প্রকারেণ যদি ভারতে চলে যাওয়া যায়, তাহলে বেঁচে যাওয়া যায়। গোষ্ঠীর একজনও যদি চলে যায়, তারা ভীষণ মুষড়ে পড়ে।
সীমানার এপ্রান্তে আমাদের অবস্থা তুলনামূলক ভাবে তাদের থেকে ভাল। তবে এখানেও সংখ্যালঘুদের মধ্যে জোটবদ্ধ হয়ে থাকার প্রবণতা দেখা যায়। ধর্ম পালন না করলে বাংলাদেশে যেভাবে এক ঘরে করে দেওয়ার চল আছে, এখানে সেটা নেই, এটুকুই যা বাঁচোয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমি ধর্ম পালনে আগ্রহী ছিলাম না কোন কালেই। আমার বাবা অনেকবার বলেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন। আমি উৎসাহ পাই নি। বিয়ের পর শায়লাও আমাকে জোর করেছে। আমি করি নি। শায়লা নাসিমকে জোর করে। জানি না, নাসিম এসব মন থেকে পালন করে নাকি। তবে ওকে ওর মার জন্য করতে হয়। নীপা খানিকটা আমার মতই। ধর্মগুরুদের মূল বিরোধিতা কখনোই আরেকটা ধর্মের সঙ্গে হয় না। এদের মূল বিরোধিতা হয় মুক্ত চিন্তার বিরুদ্ধে। পড়াশুনা এবং বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে। গণশত্রু সিনেমায় সত্যজিৎ রায় যেমন দেখিয়েছেন, মন্দিরের জল থেকে জন্ডিস হবে জেনেও ধর্মের পৃষ্ঠপোষকেরা সে তথ্য ধামাচাপা দিতে কতখানি আগ্রহী ছিলেন। একইভাবে সব ধর্মের কাজই হল বিজ্ঞানের ব্যখ্যাকে অস্বীকার করে সেটা ঈশ্বরের লীলা খেলা বলে প্রকাশ করতে চাওয়া। বিজ্ঞানকে যত ছোট দেখানো যাবে, ধর্মান্ধতা তত বাড়তে থাকবে। মানুষ প্রশ্ন করলে মানুষকে বিদ্রোহী না ভেবে আমাদের পরমতসহিষ্ণু হওয়ার প্রয়োজন আছে। এ দেশের শাসক থেকে বিরোধী থেকে সাধারণ মানুষ, আমরা কেউ বিরোধী মত শুনতে আগ্রহী নই। নিজের মতটাই যেন তেন প্রকারেণ অপরের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিতে আগ্রহী হয়ে পড়ি। পরমত না শুনলে, পরের যুক্তি না শুনলে জাতি হিসেবে কিছুতেই মানুষের উন্নতি হবে না। সত্তরের দশকে মানুষের আশা ছিল, জাতি হিসেবে আমরা নতুন নতুন গ্রহ আবিষ্কার করব। মহাশূন্যে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব হবে, চিকিৎসাশাস্ত্রে আমাদের উন্নতি হবে। পরিবর্তে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি তালিবান পুনরুত্থান, চিকিৎসার নামে মানুষের সর্বস্ব হরণ, বিজ্ঞানের অগ্রগতির নামে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য আহরণের প্রাণান্তকর চেষ্টা।
হিন্দুত্ববাদ বা মুসলমানত্ববাদ এখন এমন পরিমাণে বেড়ে চলেছে, যা রীতিমতো ভীতিপ্রদ। মানুষ কেন অপরকে রক্ত দেওয়ার আগে দেখতে যাবে সে হিন্দু না মুসলমান? এই সময়ে এসে যখন পৃথিবীর আরো অনেক বেশি যুক্তিবাদী হবার প্রয়োজন ছিল, আদতে দেখা গেল, পৃথিবী আরো কঠিন অসুখের মুখে পতিত হচ্ছে। সামনের দিনের বিপদ কি আমরা বুঝতে পারছি না? এভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে কী লাভ হচ্ছে মানুষের? চারদিকে কেবল ঘৃণা আর ঘৃণা…”
রাকিব এতটা লিখে চুপ করে বসলেন। অস্থির লাগছে।
লেখাটা বড় নেগেটিভ হয়ে যাচ্ছি। কেন পজিটিভ কিছু থাকবে না?
দরজায় নক হল।
রাকিব বললেন, “কে?”
নাসিম দরজা খুলে বলল, “আমি”।
রাকিব বললেন, “আয়”।
নাসিম ঘরে ঢুকে বসল।
রাকিব বললেন, “কোথায় গেছিলি?”
নাসিম বলল, “একজন পেশেন্ট ছিল, জ্বর কমছে না। টেস্ট করে জানা গেছে রিপোর্ট নেগেটিভ। ডাক্তারবাবুরাও ধরতে পারছেন না”।
রাকিব চিন্তিত মুখে বললেন, “তারপরে?”
নাসিম বলল, “কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। অন্য কিছুও থাকতে পারে”।
রাকিব বললেন, “এখন তো এটাই সমস্যা হয়েছে। কোভিডের যন্ত্রণায় সাধারণ মানুষের সাধারণ রোগগুলোর চিকিৎসা সিকেয় উঠে গেছে। রাত্রির খবর কী?”
নাসিম মাথা নিচু করল, “জানি না”।
রাকিব বললেন, “তুই কি ভয় পেয়ে যাচ্ছিস?”
নাসিম অবাক হয়ে রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, “মানে?”
রাকিব বললেন, “মানে তোর কি ভয় হচ্ছে? আচ্ছা বাদ দে। অন্য কথায় আসি, তুই মুসলমান, আর রাত্রি হিন্দু বলে কি তোর মনে কোন অপরাধবোধ কাজ করছে?”
নাসিম বলল, “বুঝতে পারছি না ঠিক”।
রাকিব বললেন, “অপরাধবোধ কাজ করলে বুঝতে হবে তোর নিজের ভেতরেও ভাল মন্দের বিচারবোধটা এখনো তৈরী হয় নি”।
নাসিম বলল, “বুঝলাম না ঠিক”।
রাকিব বললেন, “বুঝতে হবে না। আচ্ছা আমাকে বল, তুই বাংলাদেশে থাকলি, তুই হিন্দু পরিবারের লোক, তোর বোনকে কোন মুসলমান সংখ্যাগুরু ছেলে বিয়ে করতে চাইল, তুই কী করতিস?”
নাসিম বলল, “জানি না। এসব নিয়ে ভাবি নি বাবা”।
রাকিব খুশি হলেন, “গুড। এটা হলেও চলবে। এত হিন্দু মুসলিম কচকচানি মাথার মধ্যে না আসাই ভাল। যা তুই, আমি প্রবন্ধটা লিখে শেষ করি”।
নাসিম গেল না। চুপ করে বসে রইল।
রাকিব বললেন, “কিছু বলবি?”
নাসিম বলল, “আমার মনে হয়, রাত্রির খোঁজ নেওয়া উচিত। এভাবে ওকে জোর করে নিয়ে গেল ওকে”।
রাকিব বললেন, “বেশ তো, খোঁজ নে। কী করবি? লোকাল পার্টিকে জানা, ওরা খোঁজ নিয়ে তোকে বলুক”।
নাসিম বলল, “আমি যদি ওদের বাড়ি যাই?”
রাকিব চিন্তিত মুখে বললেন, “বাড়ি যাবি? যেতেই পারিস। অসুবিধা নেই। আচ্ছা তুই গেলে যা। আমি লিখি বরং”।
নাসিম বুঝল বাবা এখন লেখা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তাকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। সে ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
৩১
রাত হয়েছে।
একটা ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন বিজন আর রুমা।
প্রণয় বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে যাচ্ছেন। কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই বলে দিচ্ছে বাড়ি গিয়ে আরটি পিসি আর করা সম্ভব না।
মেয়ের ঘরে খানিকটা দূরে বসে আছেন তনয়া। রাত্রি চোখ বুজে আছে।
তনয়া বললেন, “মাথা ধরে আছে তোর?”
রাত্রি বলল, “ভীষণ”।
তনয়া বললেন, “ঘুম আসছে না?”
রাত্রি বলল, “ঘুমিয়েছি তো। এখন আর ঘুম আসবে না মনে হয়। তুমি মাস্ক পর মা”।
তনয়া বললেন, “ওই লোকগুলোর থেকেই হয়েছে। একটাকেও তো মাস্ক পরতে দেখি নি। ছি ছি। কী লজ্জার ব্যাপার”।
রাত্রি বলল, “লজ্জার ব্যাপার তো নাসিমদের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে করা হল মা। ওরা এত যত্ন করলেন, আর বাবা কী করল বল তো?”
তনয়া বললেন, “ওরা ভাল? আচ্ছা ওরা কি খাটে বসে খায়? সারাক্ষণ লুঙ্গি পরেই থাকে?”
রাত্রি হেসে ফেলল, “ওরা আমাদের মতই মা। আমরা যেভাবে থাকি, ওরাও সেভাবেই থাকে। আর নাসিমের বোন নীপার যে কী পড়াশুনা তুমি ভাবতে পারবে না। কত বই ওদের বাড়িতে”।
তনয়া বললেন, “তুই যদি একবার তোর বাবাকে আটকাতে পারতিস!”
রাত্রি বলল, “আটকে কিছু হয় না। আমি…”
রাত্রি কাশতে শুরু করল।
তনয়া বললেন, “থাক এখন কথা বলতে হবে না। চা এনে দি। আদা দিয়ে চা খেলে ভাল লাগবে হয়ত”।
রাত্রি বলল, “তাই দাও”।
তনয়া রান্নাঘরে গেলেন। রুমা বিজনের উপর তার রাগ হচ্ছিল। মজা দেখতে এসেছিলেন ওরা। এখন আতঙ্কিত হয়ে তাদের সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। লকডাউন এবং বিধিনিষেধের সময় অতিরিক্ত দুজনের রান্না করাটাও ঝামেলার ব্যাপার। বাজারও করতে হবে। তনয়া বেশি বলা ছেড়ে দিয়েছেন। এদের কিছু বললেও কেউই তার কথা শুনবেন না। আপাতত মেয়েটা সুস্থ হোক।
চা নিয়ে রাত্রির ঘরে গিয়ে দেখলেন রাত্রি খাটের উপর উঠে বসে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। তনয়া বললেন, “কী দেখছিস?”
রাত্রি বলল, “কিছু না”।
তনয়া বললেন, “চা নে। দেখ ভাল লাগবে খানিকটা”।
রাত্রি বলল, “আমার হাতে দিও না। খাটের উপর রাখো। আমি নিচ্ছি”।
প্রণয় ঝড়ের মত ঘরের দরজায় এসে বললেন, “আমি কাউকে পাচ্ছি না। একজন বলল হাসপাতালে গিয়ে লাইন দিলে টেস্ট করা যাচ্ছে। তুই পারবি লাইন দিতে?”
তনয়া বললেন, “তোমার ধর্ম রক্ষার্থে যে সব লোকগুলো সকালে এসেছিল, ওদের ডাকছো না কেন? এই যে মেয়েটা অসুস্থ হয়েছে, এতেও তো ধর্ম বিপন্ন হচ্ছে, তাই না? ওদের ফোন কর”।
প্রণয় রাগী গলায় বললেন, “সব বিষয় নিয়ে বাজে কথা ভাল লাগে না”।
তনয়া বললেন, “বাজে কথা কেন হবে? ওর জ্বর, শরীর দুর্বল। এর মধ্যে মেয়েটা গিয়ে লাইন দিয়ে টেস্ট করাতে যাবে? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? তুমি যখন ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছো, তখন তোমার দায়িত্ব ঠিক ঠাকভাবে মেয়েটার টেস্ট করানো। যাকে পারো, যেখান থেকে পারো গাড়ি ঠিক করে এসে নিয়ে যাবে”।
প্রণয় বললেন, “আশ্চর্য! করোনা সাসপেক্টেড হলে কেন কোন গাড়ির ড্রাইভার এ বাড়িতে আসবে? তুমি বুঝতে পারছো না কেন?”
তনয়া বললেন, “সকালে যে লোকগুলোকে নিয়ে এসেছিলে, তাদের কারো মুখে মাস্ক ছিল না কেন? তাদের থেকেই তো মেয়েটার রোগ হয়েছে। তুমিও ওদের সঙ্গে মিশেছো। তোমারও হবে”।
প্রণয় কটমট করে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমায় অভিশাপ দিচ্ছো তুমি?”
তনয়া বললেন, “অভিশাপ তো কাজ করে না। করলেও দিতাম না। তোমার উপর করুণাও হচ্ছে না। ধর্ম ধর্ম করে মাথা খারাপ করে দিলে। আর মেয়েটাকে গোবর খাওয়ালে কেন?”
প্রণয় বললেন, “মোল্লা বাড়িতে ছিল। গরু টরু খাইয়েছে নাকি আমি কী করে জানব?”
তনয়া বললেন, “গরু খেলে গোবর খেলেই প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায় বুঝি? খুব মজার ব্যাপার তো! কোত্থেকে পাও বল তো এত বুদ্ধি?”
প্রণয় বললেন, “ওই মোল্লাদের বাড়ি থেকেই মেয়েটার জ্বর এসেছে”।
রাত্রি বলল, “না বাবা। ওদের বাড়িতে সবাই অত্যন্ত সুস্থ। অসুস্থ তুমি। মানসিকভাবে তো বটেই”।
প্রণয় বললেন, “খুব বুলি ফুটেছে না? একটা চড় মারব তোকে”।
তনয়া বললেন, “মেয়েটাকে অসুস্থ করে এখন শাসন করতে এসেছো? তুমি এখনই এখান থেকে বেরোও”।
প্রণয় রাগী চোখে রাত্রি আর তনয়ার দিকে তাকিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
৩২
রাত দেড়টা।
তনয়ার ঘুম আসছিল না। ছটফট করছিলেন রাত্রির কথা ভেবে। অদ্ভুত এক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে।
ভালোবাসাবাসি তো তেমন তৈরী হয় নি।
যেটা তৈরী হয়েছে সেটা ভাললাগা। ব্যাপারটা এত দূর গড়াতোই না যদি প্রণয় এত কিছু না করতেন।
সদ্য টিনেজ পেরনো ছেলেমেয়েদের মনে জেদ থাকে বেশি। তাদের কোন কিছু না করতে বললে সেটাই তারা বেশি করে করবে। রাত্রির বেলাতেও তাই হয়েছে। প্রণয় যদি মেয়ের কথায় এত বেশি প্রতিক্রিয়া না দিতেন, তাহলে কিছুই হত না। কয়েক বছর আগেও তো ধর্ম নিয়ে এত কিছু হত না। ইদানীং মানুষের অসহিষ্ণুতা যেন বড্ড বেড়ে যাচ্ছে। এমনটা তো হবার কথা ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত হাওয়া আরো বেশি করে বইবার কথা ছিল।
প্রণয় ঘুমের ঘোরে কাশতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পর উঠে বসে বললেন, “দেখো তো, আমার কপালে হাত দিয়ে। জ্বর এসছে মনে হচ্ছে”।
তনয়া প্রণয়ের কপালে হাত দিলেন। বললেন, “হ্যাঁ। খুব হালকা জ্বর আছে। আসবে মনে হচ্ছে”।
প্রণয় বললেন, “জল গরম কর দাও। ভেপার নি, গার্গল করি”।
তনয়া বললেন, “নিজে করে নাও। কোত্থেকে না কোত্থেকে কতগুলো লোক জুটিয়ে এনে রোগ বাঁধালে, এবার তুমি বোঝো কী করবে”।
প্রণয় বললেন, “তুমি এরকম করছো কেন?”
তনয়া চোখ বুজলেন। উত্তর দিলেন না।
প্রণয় এ পাশ ও পাশ করে সত্যি সত্যিই উঠে গিয়ে রান্নাঘরে গেলেন।
ওখানেও কাশতে শুরু করলেন।
তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভয়াবহ রোগটা তার মানে তাদের বাড়িতেও চলে এল। বাড়ি বাড়ি জ্বর, কারো কারো শ্বাসকষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এত কিছুর মধ্যে লোকটা এমন সব কান্ড করে বসল, যে এখন তাদের বাড়িতেও রোগটা হানা দিল। তনয়া দেখলেন তার ফোন বাজছে। রুমা ফোন করছেন।
এই করছেন রুমা সন্ধ্যে থেকে। ঘর থেকে বেরোচ্ছেন না। শুধু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে ফোন করছেন।
তনয়া ধরলেন, “বল”।
রুমা ভীত গলায় বললেন, “কী রে, তোর বর কাশছে কেন?”
তনয়া বললেন, “নিশ্চয়ই বাধিয়েছে, আর কেন কাশবে?”
রুমা বললেন, “ওরে বাবা, আমারও কেমন জ্বর জ্বর লাগছে রে। আমারও এল নাকি?”
তনয়া বললেন, “তুই কাল সকালেই বাড়ি চলে যা। এখানে থাকলে তোর করোনা হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না”।
রুমা বললেন, “বাড়ি গেলে কী করে হবে? রোগ যদি হবার থাকে তাহলে তো অলরেডি হয়েই গেছে”।
তনয়া বললেন, “তাহলে আমি কী করতে পারি বল? তোকে তো আমি নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসি নি! তুই মজা দেখতে চলে এসেছিলি যে আমার মেয়ে মুসলমানের সঙ্গে পালিয়ে গেছে, বাড়িতে থাকলে বোর হচ্ছিলি, কী করবি, চলে এসেছিস”।
রুমা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “এটা তুই কী বলছিস?”
তনয়া বললেন, “হ্যাঁ ঠিকই বলছি। আমি একটা ভয়ংকর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তোরা এসে সেই সময়টাকে আরো কঠিন করে দিলি। চিরকাল তোরা যা করে এসেছিস, আমি কিচ্ছু বলি নি। কিন্তু এবারে আর চুপ থাকতে পারলাম না। কিছু মনে করিস না। আজ যে গাড়িটায় করে এসেছিলি, কাল সে গাড়িটা করে চলে যাস। আর হ্যাঁ, তোরা এসেছিস বলে আমার অসুবিধা হচ্ছে। আমার ঘরের এই অবস্থা। তোদের সার্কাস আমি আর নিতে পারছি না”।
রুমা বললেন, “আমি ভাবতে পারি নি তুই এত বড় কথা আমাকে বলে দিলি। সম্ভব হলে আমি এখনই চলে যেতাম”!
তনয়া বললেন, “বিশ্বাস কর, যদি আমি পারতাম, আমিও তোদের গাড়ি ঠিক করে এখনই পাঠিয়ে দিতাম”।
ফোন কেটে দিলেন তনয়া।
প্রণয় শব্দ করে গার্গল করে টরে ঘরে এসে আলমারি খুলে বললেন, “আমাকে অত বোকা ভেবো না, আমি আগের থেকেই বিপদের আন্দাজ পেয়ে জিনিস নিয়ে এসেছি”।
আলমারি থেকে ওষুধের বাক্স বের করে প্রণয় বললেন, “এই যে, পালস অক্সিমিটার, থার্মাল গান সব আছে। এই দেখো”।
থার্মাল গানটা নিজের কপালে দিয়ে রিডিং দেখলেন প্রণয়, “আহ। জ্বর নেই। চিন্তা কোর না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা আমাদের ভাবিজি পাঁপড় আছে?”
তনয়া বিরক্ত মুখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
৩৩
এক একটা রাত অসহ্য হয়ে ওঠে।
আগে তো ক্লান্তিতেই ঘুম চলে আসত।
এবারে ঘুমোলেও নাসিম ছটফট করছিল।
রাত তিনটে নাগাদ উঠে জল খেল। ঠিক করল ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখবে।
ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল রাকিবের লাইব্রেরীর ঘরের আলো জ্বলছে।
নাসিম লাইব্রেরীর দরজা ঠেলে ঢুকে দেখল রাকিব মন দিয়ে লিখে যাচ্ছেন। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় বাবাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! নাসিমের চোখে জল এল। বাবাকে কি সে কষ্ট দিয়েছে? লোকগুলো কীভাবে অসভ্যতা করে গেল।
ওদের কথা খুব পরিষ্কার। এটা তো তাদের দেশ না। তাদের উচিত ছিল দেশভাগের সময়েই এই দেশ থেকে চলে যাওয়া।
রাকিব তার দিকে তাকালেন, “ঘুম হচ্ছে না?”
নাসিম বলল, “তুমি লেখো বাবা। বিরক্ত করব না”।
রাকিব বললেন, “বস। বিরক্ত করার কিছু নেই”।
নাসিম বসল।
রাকিব বললেন, “কী ভাবছিস?”
নাসিম বলল, “এই দেশটা আমাদের না, বল বাবা? আমাদের কোন অধিকার নেই এই দেশে”।
রাকিব বললেন, “কথাটা রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট। অত ভাবিস না এটা নিয়ে”।
নাসিম বলল, “ভাবব না? সারাক্ষণ তো এখন এগুলোই শুনছি। না ভাবলে কী করে হবে?”
রাকিব বললেন, “শোন, একটা সময় ছিল, যখন নিচু জাতের মানুষদের উঁচু জাতের মানুষেরা এত জ্বালাতন করেছে, তখন নিচু জাতের মানুষদের আর কিছু করার উপায় ছিল না। তারা ধর্মান্তরিত হতে শুরু করে। আবার বাইরে থেকে মুসলমান শাসকেরা যখন এদেশে আসতে শুরু করে, তাদের প্রভাবেও অনেকে মুসলমান হয়। তাদের বংশধর থাকতে পারে, জোর করে করা ধর্মান্তর হতে পারে, কিন্তু এভাবেই দেশে মুসলমান বাড়তে থাকে। সৌরজগতের একটা গ্রহ পৃথিবী, কত গ্রহ আছে, সেখানে প্রাণ নেই, শুধুমাত্র এই গ্রহে প্রাণ আছে। মানুষ আছে। মানুষ কী করল? এই ভূ খণ্ড দখল করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করল। একটার পর একটা ধর্ম তৈরী হল। কাজের কাজ কিছুই হল না, শুধু এরা নিজেদের মেরে যেতে লাগল। দেশ আবার কী রে? দেশ, জাত, ধর্ম… এই সব কিছু পলিটিকাল টার্ম। কোনটাই ডিফাইন করে দেবে না কোনটা কাদের দেশ। হীনমন্যতায় ভুগবি না। কমিউনিস্ট পার্টি করিস, মাথা উঁচু করে বাঁচবি”।
নাসিম বলল, “লাভ হয় না বাবা। কমিউনিস্ট পার্টিতেও আমরা ওরা শুনেছি আমি”।
রাকিব বললেন, “স্বাভাবিক। কমিউনিজমের কনসেপ্ট তো অত সোজা না যে সব রাম শ্যাম যদু মধু এত সহজে এটাকে চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে পারবে। কেউ দল করেছে ধান্দায়, কেউ ভালোবেসে, কারো বা কৃতজ্ঞতা আছে দলের প্রতি। আদতে ভেতর থেকে কমিউনিজমের আদর্শটাকে মন থেকে মেনে নিয়ে খুব কম লোক পার্টি করে। জন্মগতভাবে তুই মুসলমান, তুই সংখ্যালঘু, এটা দেগে দিয়েছে সবাই। তা বলে তুই সে জন্য মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকবি না। একজন সু নাগরিক হবার চেষ্টা করবি। পাকিস্তান আর ভারতবর্ষের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। পাকিস্তান মুসলমানদের জন্যই তৈরী হয়েছিল। ভারতবর্ষ সব ধর্মের জন্য। রাজনীতিকরা অনেক কিছু খারাপ কাজ করেছে সে সময়ে। কিন্তু এই যে একটা দেশকে সব ধর্মের মিলনক্ষেত্র বলে দেখানো হয়েছে, এটা একটা এশিয়ার দেশ হয়েও ভারতবর্ষকে এক অসাধারণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। মৌলবাদীরা চেষ্টা করে যাচ্ছে সব সময়ে, সে হিন্দু মৌলবাদী হোক কিংবা মুসলিম মৌলবাদী, তবু এত কিছুর পরেও ওরা জিততে পারবে না। শেষমেশ মনুষ্যত্বই জিতবে। তুই তোর মায়ের সঙ্গে থেকে আল্লাহকে মানিস, আল্লাহর কাছে ধন্যবাদ দে, তুই ভাগ্যবান, তুই বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে জন্মাস নি। যে দেশগুলোতে থেকে শুধু বিদ্বেষের চাষ করতে হয়,জোর করে ধর্মাচরণ করতে হয়, এরকম কোন দেশে তোকে জন্ম নিতে হয় নি। এ দেশ মহান। বিদ্বেষ যারা ছড়িয়ে যাচ্ছে, শুধু ঘেন্না শিখিয়ে যাচ্ছে, একদিন ওরা ক্লান্ত হয়ে যাবে”।
নাসিম বলল, “তাই হোক”।
রাকিব বললেন, “ঘুমের চেষ্টা কর। ঘুমটা জরুরি। শরীর খারাপ করিস না”।
নাসিম বলল, “ঠিক আছে”।
রাকিব বললেন, “রেড ভলান্টিয়ারের কাজটা কর। মানুষের পাশে থাক। মানুষ ভুলে যাবে, ইতিহাস তোদের ভুলবে না। তোদের কাজটা ঠিক থেকে যাবে”।
নাসিম উঠল। বাবার সঙ্গে কথা বললে মনটা ঠান্ডা হয়ে যায়। এবার অন্তত ঘুমটা আসুক!
৩৪
ঘুম থেকে উঠে প্রণয় খাটে বসে নিজের কপালে হাত দিয়ে বললেন, “জ্বর এসছে মনে হচ্ছে। দেখো তো”।
তনয়া পাত্তা না দিয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখলেন রুমা বিজনকে নিয়ে বেরোচ্ছেন। তাকে দেখে কাঁদো কাঁদো চোখে রুমা বললেন, “আমরা চলে যাচ্ছি”।
তনয়া রুমাকেও পাত্তা দিলেন না।
রুমা ভেবেছিলেন তনয়া তাকে সাধবেন। সেটা করলেন না দেখে মুখে আঁচল দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
তনয়া রাত্রির ঘরে গিয়ে মেয়ের কপালে হাত দিলেন।
বেশ ভাল জ্বর আছে।
তনয়া টেলিমিডিসিনের খবরটা দেখেছিলেন। সেখানে ফোন করলেন। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর কথা বলে জানতে পারলেন যত তাড়াতাড়ি টেস্ট করে ওষুধ শুরু করা যায়, তত ভাল।
তিনি নিজের ঘরে গিয়ে প্রণয়কে বললেন, “মেয়েকে নিয়ে টেস্ট করিয়ে আনো”।
প্রণয় বললেন, “আমি কী যাব? আমার নিজেরই অসুস্থ লাগছে। তুমি যাও”।
তনয়া বললেন, “তাই যাবো”।
কথা না বাড়িয়ে রাত্রিকে ঘুম থেকে তুললেন। রাত্রির চোখ ঘোলাটে। গায়ে বেশ জ্বর এসেছে।
তনয়া জানেন পাড়ার লোক করোনা বললেই তাদের এক ঘরে করে দেবে। এক টোটোওয়ালার নাম্বার ছিল। তাকে ডাকলেন। রাত্রিকে তৈরী করতে কিছু সময় লাগল। প্রণয় নিজের তাপমাত্রাই মেপে যাচ্ছেন।
তনয়া ঘাঁটালেন না।
রাত্রিকে নিয়ে টেস্ট সেন্টারের কাছে এসে দেখলেন লম্বা লাইন। মাথার উপরে চড়া রোদ।
রাত্রি বলল, “মা, টেস্ট করাতে হবে না। বাড়ি যাই চল। এখানে লাইনে দাঁড়ালে আমি মরে যাব শিওর”।
তনয়া হাল ছাড়লেন না। রাত্রিকে টোটোতেই বসিয়ে রেখে নিজে লাইনে দাঁড়ালেন।
লাইনে কেউ কাশছে, কাউকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রবল অসুস্থ। কেউ লাইনের আগে চলে যাচ্ছিল বলে প্রবল গালিগালাজ শুরু করে দিল লোকে কাশতে কাশতেই। মর্ত্যে যেন নরক নেমে এসেছে।
রাত্রির মাথা ধরাটা অসহ্য বেড়ে গেছে। সে মাথা টিপে ধরে বসে আছে। একটা বাইক এসে দাঁড়াল। চেনা কন্ঠস্বর পেল সে, “এখানে?”
রাত্রি দেখল নাসিম। সে হাসল, “মনে হচ্ছে হয়েছে”।
নাসিম বলল, “টেস্ট করাবে?”
রাত্রি বলল, “মা লাইন দিয়েছে। কখন হবে জানি না”।
নাসিম বলল, “কোথায় তোমার মা?”
রাত্রি বলল, “ওই তো লাইনে”।
নাসিম তনয়ার কাছে গিয়ে বলল, “আপনি রাত্রির কাছে গিয়ে বসুন। আমি লাইনে দাঁড়াচ্ছি”।
তনয়া নাসিমের দিকে তাকালেন। ছেলেটার চোখে কেমন একটা ছটফটানি। রাত্রি কষ্ট পাচ্ছে দেখে ছেলেটাও কষ্ট পাচ্ছে। ভালবাসে তার মেয়েকে। ভীষণ ভালবাসে। চোখ দুটোই সব বলে দিচ্ছে। তিনি বললেন, “তোমার কষ্ট হবে না?”
নাসিম মাথা নাড়ল, “না না। কোন কষ্ট হবে না। আপনি টোটোতে গিয়েই বসুন”।
তনয়া বললেন, “ঠিক আছে। তুমি ডেকো তবে”।
নাসিম বলল, “ঠিক আছে”।
তনয়া রাত্রির কাছে গিয়ে বসলেন।
দেড় ঘন্টা পর রাত্রির স্যাম্পেল নেওয়া গেল।
তনয়া মেয়েকে টোটোতে তুলে বসালেন। টোটোর ছেলেটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছিল না। তনয়া ছেলেটার হাত পাঁচশো টাকা দিলে ছেলেটা আর কিছু বলল না।
নাসিম চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। রাত্রিকে টোটোতে বসিয়ে তনয়া নাসিমের কাছে গিয়ে বললেন, “রাত্রির বাবা তোমাদের খুব অপমান করেছে। আমি খুব লজ্জিত। আমি ওর হয়ে তোমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি”।
নাসিম হাসল, “না না কাকীমা। ভাববেন না। আগে সবাই ঠিক থাকুন। ডাক্তার বরাট বসেন পঞ্চানন মোড়ে। এখনই চলে যান। আমি নাম লিখিয়ে রেখেছি লাইনে থাকা অবস্থাতেই। ওকে ওর কাছে দেখিয়ে ওষুধ শুরু করে দিন। বাড়িতে অক্সিমিটার আছে তো?”
তনয়া বললেন, “আছে”।
নাসিম বলল, “অক্সিজেন লেভেলটা মণিটরিং করবেন। আমার নাম্বারটা রাখুন, কোন রকম দরকার হলে ফোন করবেন”।
তনয়ার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। এই ছেলেটার পরিবারের সঙ্গে প্রণয় দুর্ব্যবহার করে এলেন?
নাসিমের নাম্বার নিয়ে তিনি টোটোয় উঠলেন।
রাত্রি বলল, “কী বলল ও”?
তনয়া বললেন, “ডাক্তারবাবুকে দেখিয়ে ওষুধ শুরু করতে বলল। ঠাকুর করে তোর করোনা না হোক”।
রাত্রি বলল, “খুব মাথা ধরেছে মা। এটুকু কমলে অন্তত শান্তি পাব”।
তনয়া দেখলেন একটু দূরত্বে থেকে নাসিম আসছে। তিনি আশ্বস্ত হলেন। এই বিপদের দিনে নাসিমকে তার পরম আত্মীয় বলে মনে হল।