প্রেমিক – ১০

১০

নাসিম তার ঘরে মোবাইল ঘাঁটছিল।

নীপা নাসিমের ঘরে ঢুকে বলল, “এই দাদা। মন খারাপ নাকি?”

নাসিম নীপার দিকে না তাকিয়ে বলল, “মন খারাপ কেন হতে যাবে?”

নীপা বলল, “না মানে বউদি এসেও চলে গেল। তাই আর কী”।

নাসিম বলল, “তুই কিন্তু চড় খাবি। তোর চড় খাওয়ার সময় এসে গেছে, বুঝতে পারছিস?”

নীপা বলল, “তুই ঝাড়ি মারছিলি? ঈস, তুই আবার কবে থেকে ঝাড়ি মারিস?”

নাসিম এবার ফোন রেখে নীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “পুরোটাই ঝোঁকের মাথায় হয়েছে। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি এত দূর চলে যাবে বুঝি নি। বাবা তো মেয়েটাকে দিয়েই আসবে। এই সব নিয়ে আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিস না। হিন্দু মুসলমান এখন বিরাট ইস্যু হয়ে গেছে। কিছু হলেই দাঙ্গা লাগবে। মিটে যাক ব্যাপারটা”।

নীপা বুঝল দাদার হৃদয় বেদনাহত। সে ফিক করে হেসে টিভি দেখতে গেল।

কলিং বেল বাজল। নীপা দরজা খুলে দেখল তার মা এসেছেন। নীপা বলল, “এত রাত অবধি খালার বাড়িতে ছিলে? এদিকে তো বিরাট কান্ড হয়ে গেল”।

শায়েলা অবাক হলেন, “কী হয়েছে?”

নীপা বলল, “ঘরে এসো বলছি”।

শায়েলা ঘরে ঢুকতে নীপা গড়গড় করে সব বলে ফেলল।

শায়েলা গালে হাত দিয়ে বললেন, “হায় আল্লা। নাসিম এসব করেছে?”

নীপা হাসল, “তার উপর বাবার আজকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ডেট ছিল”।

শায়েলা বললেন, “ঐ রবীন্দ্রনাথ শুনেই আমি সাজিয়ার বাড়ি গেলাম। যাতে আমি কথা বলতে গেলে তোর বাবা রেগে না যায়। আজ নাসিমের খবর আছে। দাঁড়া, আমি হাত মুখ ধুয়ে নি”।

শায়েলা বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাসিমের ঘরে গেলেন।

নাসিম মাকে দেখে বলল, “নিশ্চয়ই আমাদের সি এন এন নিউজ তোমাকে সব খবর দিয়ে দিয়েছে?”

শায়েলা বসলেন, “আমি তোকে রুহানার কথা বলায় এই জন্য তুই এড়িয়ে যাচ্ছিলি? তোর হিন্দু মেয়ে পছন্দ?”

নাসিম চোয়াল শক্ত করল, “আমি হিন্দু মুসলিম দেখে যাই নি। তাছাড়া নিজের খালা ফুপুর মেয়েকে বিয়ে করায় আমার আপত্তি আছে। এককালে নিয়ম ছিল, এখন মনে হয় যাদের সঙ্গে বড় হলাম, বোনের মত দেখলাম, তাকে বিয়ে করলে ভাল দেখাবে? আমাদের নিয়ে সবাই মজা করে মা”।

শায়েলা বললেন, “মজা করে, আমাদের এই দেশের নাগরিক বলেই অনেকে ভাবে না। তাতে কী হয়? আমরা আমাদের মত। তা বলে এমন কোন মেয়েকে পছন্দ করতে হবে যাকে বিয়ে করলে অশান্তি হতে পারে?”

নাসিম বলল, “জানি তো। আমরা সংখ্যালঘু। আমরা নাকি টেরোরিস্ট। রোজই তো শুনি মা। যাই হোক, চিন্তা কোর না। ও মেয়ে তো আর আসবে না। তবে এটুকু জেনো, নিজের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে আমি…”

কলিং বেল বেজে উঠল। শায়েলা বললেন, “তোর বাবা এল বোধ হয়। আমি দেখছি। তুই জেদ করে থাক, আমি কিছু বলব না। কিন্তু ভাল মেয়ে না পাওয়া গেলে আমার ভোট রুহানার দিকেই থাকবে, এ কথা মনে রাখবি”।

শায়েলা নাসিমের ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন নীপা দরজা খুলেছে। রাকিব একটি মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। তাকে দেখে বললেন, “শায়েলা, ও রাত্রি। আজ থেকে এ বাড়িতেই থাকবে”।

নীপা আনন্দে রাত্রিকে জড়িয়ে ধরল। রাত্রি কাঁদছিল। শায়েলা বললেন, “কী হয়েছে আমি কি জানতে পারি?”

রাকিব বললেন, “তোমার আরেকটা মেয়ে হয়েছে আজ। আর কিছু না। তুমি খাবার দাও। রাত্রিও খাবে আমাদের সঙ্গে”।

শায়েলা রাত্রির দিকে তাকালেন। ভারি মিষ্টি মুখটা। তবু মায়ের মন। তার বুকটা ধড়ফড় করছিল। নীপাকে বললেন রাত্রিকে তার ঘরে নিয়ে যেতে। ওরা বেরোলে তিনি রাকিবকে বললেন, “তুমি মেয়েটাকে দিতে গেছিলে। এখন আবার কী হল?”

রাকিব সবটা বললেন।

শায়েলা সোফায় চিন্তিত মুখে বসে বললেন, “এটা নিয়ে খুব ঝামেলা হবে। সব দিকের লোকজন জল ঘোলা করবে। কী হবে?”

রাকিব বললেন, “খাও। খেয়ে দেয়ে ঘুমাও। যা হবে কাল দেখা যাবে”।

শায়েলা উঠলেন না। তার মাথা দপদপ করতে শুরু করল।

মাইগ্রেনের ব্যথাটা আসছে আবার ঝড়ের মত…

১১

রাকিব লাইব্রেরীতে আবার ঢুকে গেছেন। লাইব্রেরী রুমে একটা তক্তপোষ আছে। তিনি সেখানেই ঘুমিয়ে পড়বেন বই পড়তে পড়তে। রাত্রি নীপার সঙ্গে শুয়েছে।

শায়লার ঘুম আসছিল না। মাথা ব্যথা বাড়লে তার ঘুম আসে না।

প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর উঠে তিনি নাসিমের ঘরে গেলেন।

নাসিম শুয়ে ফোন ঘাঁটছিল।

তাকে দেখে বলল, “ঘুমাওনি?”

শায়লা বসলেন, “এটা কী হল বল তো? তোরা যেটা করলি সেটা ভাল করলি?”

নাসিম অবাক হল, “কী করলাম? আর তোরা মানে কাদের কথা বলছো?”

শায়লা বললেন, “তুই আর মেয়েটা! কত বড় বিপদ তুই বাড়ি বয়ে এনেছিস বুঝতে পারছিস? কতদিন ধরে এসব করছিস তুই?”

নাসিম বলল, “শোন মা, আমি কিছুই করি নি। ব্যাপারটা কিছু করার আগেই এত দূর গড়িয়ে গেছে”।

শায়লা বললেন, “কীভাবে গড়াল? এটা সম্ভব? বিশ্বাসযোগ্য? তোদের মধ্যে কোন বোঝাপড়া নেই বলছিস?”

নাসিম বলল, “সত্যি কোন বোঝাপড়া নেই। আমি তো ভাবতেই পারি নি এত কিছু হয়ে যাবে বিকেলের পর থেকে”।

শায়লা মাথা নাড়লেন, “আমি জানি না তুই কী করতে চাইছিস। এখন এ দেশের অবস্থা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তোর? এই কিছুদিন আগেও ভোটের সময় আমাদের এন আর সি করে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি শুনতে হয়েছে। এত ভাল একজন শিক্ষক তোর বাবা, তাকেও রাস্তাঘাটে বেরোলে লোকে দুধেল গাই বলে ডাকে। কেন ডাকে বুঝতে পারিস না? সব কিছু তো আগের মত নেই। কোভিডের জন্য হয়ত কমিউনাল টেনশনটা কমেছে, একটু থিতু হলেই দেখবি আবার শুরু হয়ে গেছে। তোর বাবা না হয় সারাক্ষণ ভাবের ঘোরে থাকে, তুই তো সেটা থাকিস না। এদিক সেদিক যাস, তোদের পার্টিতেও কি সবাই মুসলমানদের সমানভাবে দেখে?”

নাসিম বলল, “দেখে। কেন, তোমায় কে কী বলেছে?”

শায়লা চিন্তিত গলায় বললেন, “জানি না, আমার আজকাল সবকিছুতেই সন্দেহ হয়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। তার মধ্যে তুই যে এটা কী করলি…”

নাসিম বলল, “আমি কিছু করি নি মা। বাবা সব ম্যানেজ করে দেবে দেখবে। কালকের মধ্যে মেয়েটাকে ওদের বাড়িতে দিয়ে আসবে”।

শায়লা বললেন, “ব্যাপারটা এত সোজা বলে তোর মনে হচ্ছে? তুইও দেখছি তোর বাবার মত কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছিস আজকাল। যদি ওর বাড়িতে ওকে অ্যাক্সেপ্ট করত, তাহলে আজকেই করত। এবার এটা নিয়ে জল ঘোলা হতে শুরু করবে। সব পক্ষ জড়াবে, পলিটিসাইজ করবে। উফ”।

শায়লা কপালে হাত রাখলেন।

নাসিম বলল, “তুমি ঘুমিয়ে পড় মা। চিন্তা কোর না। যা হবে দেখা যাবে”।

শায়লা বললেন, “তুই আমাকে কথা দে, তুই ওই মেয়েকে বিয়ে করবি না। সত্যি করে বল তো, কিছু নেই তো তোদের মধ্যে?”

নাসিম বলল, “না না। কিচ্ছু নেই। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও। চিন্তা কোর না”।

শায়লা বললেন, “আমি পারি না বিশ্বাস কর। সব সময়, সব জায়গায় মোল্লা মোল্লা শুনে মাথা খারাপ হয়ে যায়। কমনরুমে উত্তমদা, পারমিতারা আমাকে নিয়ে কথা বলে আমি বুঝতে পারি। আমি ঢুকলেই ওদের কথা বন্ধ হয়ে যায়।সারজিকাল স্ট্রাইকের দিন হঠাৎ করে অহনাদি আমাকে বলে বসল খারাপ লাগছে তোমার? যেন আমি পাকিস্তানী। এ দেশটা আমার না! এবার থেকে শুনতে হবে আমার ছেলে লাভ জিহাদ করেছে”।

শায়লা ভেঙে পড়লেন। নাসিম মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, “তুমি ঘুমোও গিয়ে। আমার কাছে ঘুমোবে মা? মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই তোমায়”।

শায়লা বললেন, “আমার মাঝে মাঝে তোর বাবাকে একবারে সহ্য হয় না। বিড়াল পার করতে গিয়ে কেউ এভাবে বিড়াল বাড়ি নিয়ে আসে বল? মেয়েটার বাড়িতে অশান্তি হত, ঠিকও হয়ে যেত। এবার ঝামেলা বাড়তে থাকবে”।

নাসিম চুপ করে বসে রইল।

রাত্রি কি তাকে ভালবাসে? সবটাই কি ঝোঁকের বশে করল?

১২

ঘুমনোর আগে নীপা একটা বই নিয়ে বসল।

রাত্রি বলল, “তুমি বই পড়তে পড়তে ঘুমোও?”

নীপা হাসল, “বাবা এই অভ্যাস তৈরী করেছিল। এখন এটাই ঘুমের ওষুধ। বই না পড়লে ঘুমই আসবে না। বই পড়ারও আমার এক একটা ফেজ আসে। এই যে, এখন যেমন পড়ছি নীললোহিত। পড়েছো?”

রাত্রি বলল, “বেশি না। কয়েকটা পড়েছি। বাবা একদিন হঠাৎ বলে বসল সুনীল সেকুদের লেখক। সে মাকু। আর কিনে দিল না”।

নীপা অবাক হল, “মাকু আর সেকু মানে?”

রাত্রি বলল, “মার্ক্সিস্ট আর সেকুলার। মার্ক্সিস্টরা ধর্ম মানে না। সুনীলও মানতেন না। সেটা নিয়ে সুনীলের লেখা নিয়ে হিন্দুত্বপন্থীরা এখন খুব রাগ করে”।

নীপা বলল, “ওহ মার্ক্সিস্ট। তাদের উপর সবারই কম বেশি রাগ আছে। আবার তুমি যদি তার বাইরে গিয়ে ভাবো, বাংলাদেশে অভিজিৎ রায় বলে একজন ব্লগার ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে ব্লগ লিখতেন। বাংলাদেশ বইমেলায় যখন এসেছিলেন, তখন ইসলামিক এক্সট্রিমিস্টরা তাকে খুন করে দিয়েছিল। যে কোন লেখক যখন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তার মত ব্যক্ত করবে, তখন তার উপরে সবার রাগ হবে। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ একসঙ্গে সবাইকে খুশি করতে পারে না”।

রাত্রি বলল, “তোমার সুনীল ভাল লাগে?”

নীপা বলল, “আমার সবার লেখা ভাল লাগে। তসলিমা নাসরিনেরও। তসলিমা তার লেখায় একটা মত ব্যক্ত করেছেন। তার জন্য তাকে দেশ ছাড়া কেন হতে হবে? এই রাজ্যেও তো কমিউনিস্ট শাসন ছিল। তাদের আমলেও তসলিমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। আমরা আসলে কেউই নিজেদের স্বার্থ বাদ দিয়ে তোমার ঐ মাকু বা সেকু হতে পারি নি”।

রাত্রি চমৎকৃত হল। এইটুকু মেয়ে, অথচ কী গভীর কথা! সে বলল, “তুমি খুব পড়তে ভালবাসো বল? আচ্ছা তোমার যদি কোন কনজারভেটিভ পরিবারে বিয়ে হয়, তারা বই পড়তে না দেয়, তখন কী করবে?”

নীপা বলল, “বাবা আমাকে পড়াবে। আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে যাবো কেন খামোখা? আমার অনেক পড়ার ইচ্ছে”।

দরজায় ঠক ঠক হল।

নীপা উঠে দরজা খুলে দেখল নাসিম দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ পাকাল, “কী রে, এত রাতে?”

নাসিম বলল, “সব ঠিক আছে তো?”

রাত্রি উঠে বসেছে দেখে নীপা বলল, “আয়”।

নাসিম বলল, “না না ঠিক আছে”।

নীপা বললে, “আয়, আয়। বুঝেছি তোর চাপ হয়ে যাচ্ছে”।

নাসিম ঘরে ঢুকে বলল, “চাপ না ঠিক। মা চিন্তা করছে একটু”।

রাত্রি বলল, “খুব অসুবিধা করে দিলাম আমি এসে?”

নীপা বলল, “ধ্যাত। চুপ কর তো। বাবা আছে তো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে”।

নাসিম বলল, “ঠিক আছে, আমি যাই?”

নীপা বলল, “যাবি? তোর কি রাত্রিদিকে কিছু বলার আছে?”

নাসিম বলল, “না, ঠিক আছে। আমি আর কী বলব? আমার কিছু বলার নেই”।

রাত্রি হঠাৎ করে বলল, “আচ্ছা নাসিম তোমার নীললোহিত ভাল লাগে?”

নাসিম থতমত খেয়ে বলল, “হ্যাঁ, তবে বেশি পড়ি নি। কাকাবাবু আর সেই সময় পড়েছি। প্রথম আলো পড়ব পড়ব করেও পড়া হয় নি”।

নীপা বলল, “কী করে হবে, এখন সারাদিন পার্টি লিটারেচার পড়ে। বাপরে, আমি বুঝতেই পারি না অর্ধেক। কীসব ভাষা, পুঁজিবাদী সমাজ, প্রলেতারিয়েত, উফফ!”

নাসিম রেগে গেল, “গাট্টা খাবি। তোকে বলেছি না বুঝলে বুঝিয়ে দেব, বাজে বকবি না”।

নীপা ফিক করে হেসে বলল, “এই তুই তার মানে মাকু। তোকে আমি মার্ক্সীয় সাহিত্য না কী সব পড়তে দেখেছি”।

নাসিম বলল, “এটা আবার কে শেখালো?”

নীপা বলল, “এই তো রাত্রিদি বলছিল। ওর বাবা সুনীলকে সেকু মাকু বলেছেন”।

নাসিম বলল, “এটা ওদের দেশ। এখন ওরাই যা বলবে তাই হবে”।

রাত্রি বলল, “কেন? সেটা কে ঠিক করল? সংবিধান কি পাল্টে গেছে?”

নাসিম বলল, “পাল্টে দেবে। তোমার বাবার মত শিক্ষিত মানুষদের যারা ঘৃণার নামে পাল্টে দিতে পারছে, সংবিধান পাল্টাতে আর কতদিন লাগবে?”

রাত্রি মন মরা হল, “আমার বাবা হঠাৎ করে পাল্টে গেল। এরকম ছিল না। হোয়াটস অ্যাপ ফেসবুক যেদিন থেকে শুরু করল, সেদিন থেকেই। কী বাজে রোগ। মোবাইলের স্ক্রিণে যা থাকবে, তাই বিশ্বাস করবে”।

নাসিম বলল, “মোবাইলটা শুধু একপক্ষকে আঘাত করে নি। আরেকপক্ষকেও সমান ভাবে করছে। শুধু তুমি অপরপক্ষটা দেখতে পাচ্ছো না, এই আর কী”!

রাত্রি বলল, “মানে?”

নাসিম বলল, “আমার অনেক চেনা জানা মুসলমানও এখন অকারণ হিন্দুবিরোধী আক্রোশে ভুগছে এই মোবাইলের কল্যাণে। এক পক্ষের ঘৃণা, অপর পক্ষের ঘৃণাকেও জাগাতে সাহায্য করছে”।

নীপা বলল, “দাদা, তুই কেমন জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তির মত কথা বলছিস, এটা কি রাত্রি এফেক্ট?”

নাসিম এবার রেগে মেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

নীপা হাসতে হাসতে বলল, “লজ্জা পেয়ে গেছে”।

১৩

রবীন্দ্রনাথে মজে ছিলেন অনেক রাত অবধি। রাকিবের ঘুম ভাঙল সকাল ন’টার দিকে।

উঠে দেখলেন নাসিম লাইব্রেরীতে ঢুকে চুপ করে বসে আছে।

রাকিব বললেন, “কী ব্যাপার?”

নাসিম বলল, “সকালে বেরিয়েছিলাম। গ্রামে অনেকেই ব্যাপারটা জেনেছে। হানিফ চাচা একগাদা কথা বলল। আমরা মসজিদে যাই না, ধর্মাচরণ মন দিয়ে করি না এসব তো বললই, তারপরে আরো একগাদা কথা বলল। আসবে বলল দশটার দিকে”।

রাকিব চুপচাপ শুনে বললেন, “বেশ তো। আসুক। তোর কী সমস্যা?”

নাসিম বলল, “মাও খুব চিন্তায় আছে। কাল রাতে বলছিল ব্যাপারটায় ঝামেলা হতে পারে”।

রাকিব বললেন, “ঠিক আছে। আমায় অনলাইন ক্লাস নিতে হবে এগারোটার দিকে। মুখ টুখ ধুই, তারপর দেখছি”।

নাসিম চুপ চাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাকিব হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম সেরে ড্রইংরুমে বসতেই হানিফ এলেন। হানিফ স্থানীয় পঞ্চায়েতের কোন এক পদে আছেন। রাকিব বললেন, “তুমি নাকি নাসিমকে কীসব বলেছো?”

হানিফ বসে বললেন, “আমি কী বলব? যা বলার তাই বলেছি। মেয়েটা যখন যেচে তোমাদের বাড়িতে এসেছে, তখন বিয়ে দিয়ে দাও। কাজি বিয়ে পড়িয়ে দিক। আর বাকিটা…”

রাকিব গালে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে হানিফের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ধর্ম বাদ দিয়ে বাকি পৃথিবীটা দেখেছো কখনো? অনেক কিছু আছে, দেখেছো?”

হানিফ জিভ কাটলেন, “তওবা তওবা, তুমি কি নাস্তিক হলে নাকি? এসব কী বলছ? ধর্ম বাদ দিয়ে কিছু হয় নাকি?”

রাকিব বললেন, “হয়, আবার হয়ও না। আমার হাতে সময় কম আছে। এখনই তর্ক করতে পারবো না, তবে এই মেয়েকে কনভার্ট করার কোন প্ল্যান আমার নেই। মেয়েটির বাবা তোমাদের মতই একজন ধর্মোন্মাদ মানুষ, আপাতত তাকে বুঝিয়ে মেয়েটিকে তার বাড়িতে ফেরানোই আমার লক্ষ্য”।

হানিফ রাগী গলায় বললেন, “দুটো বই পড়ে বেশি জ্ঞানী হয়ে যাওয়া ভাল না। আল্লাহকে ভয় কর রাকিব মিয়াঁ। উনি চেয়েছেন বলেই মেয়েটা এ বাড়িতে এসেছে”।

রাকিব বললেন, “তুমি এখন এসো। আমার অনেক কাজ আছে। ক্লাস করানো আছে, অনেক কাজও আছে। এসব নিয়ে আমরা পরে কথা বলব, কেমন?”

হানিফ বললেন, “গেরুয়া পার্টি এলে কে বাঁচাবে তোমায় দেখব”।

রাকিব হাসলেন, “তুমি এসো। পরে কথা হবে। বললাম তো”।

হানিফ রেগে মেগে বেরিয়ে গেলেন।

রাকিব ল্যাপটপে ক্লাসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, শায়লা এসে বসলেন। রাকিব বললেন, “বল, তোমার কিছু বলার আছে?”

শায়লা বললেন, “আমরা এখন ঠিক কী করব?”

রাকিব বললেন, “আমার কলেজের ক্লাস করানো আছে। তুমি কী করবে বল?”

শায়লা বিরক্ত মুখে বললেন, “আমি সেটা বলি নি। তুমি নিজেও জানো আমি কী ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি”।

রাকিব বললেন, “রাত্রির ব্যাপারে বলবে তাই তো? মিটে যাবে। চিন্তা কোর না”।

শায়লা বললেন, “কীভাবে মিটবে?”

রাকিব বললেন, “আমি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলব। ভদ্রলোক একটু ঠান্ডা হোন। কথা বললে আশা করি বুঝবেন উনি”।

শায়লা বললেন, “তুমি নিশ্চিত জানো ওদের দুজনের পরস্পরের প্রতি কোন ফিলিংস নেই? যদি থাকে, তাহলে রাত্রিকে ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেও কিন্তু ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরী হতে পারে”।

রাকিব এবার চিন্তায় পড়লেন, “এটা তো ভেবে দেখি নি! এরকম হতে পারে? তাই তো! তখন কী করবে?”

শায়লা রেগে গেলেন, “তুমি ভেবে দেখো দয়া করে। এই জন্য তোমাকে আমার মাঝে মাঝে অসহ্য মনে হয়”।

রাকিব উঠলেন। ডাইনিং টেবিলে রাত্রি আর নীপা গল্প করছে। আরেকটু দূরে খাটের উপর বসে নাসিম মোবাইল ঘাঁটছে। রাকিব বললেন, “আমার রাত্রি আর নাসিমের কাছে একটা প্রশ্ন আছে। বাই এনি চান্স, তোমরা কি দুজন দুজনকে সত্যিই ভালবাসো? বিয়ে করতে চাও?”

নাসিমের হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল।

রাত্রি কাশতে শুরু করল।

শায়লা রাকিবের পিছনেই ছিলেন। তিনি চিৎকার করলেন, “এই, তুমি ক্লাস করাও গিয়ে। যাও। তোমাকে কোন সমস্যার সমাধান করতে হবে না”।

রাকিব শায়লার দিকে তাকালেন, “ভুল কিছু বলে ফেলেছি?”

শায়লা রাগে কাঁপছিলেন, বললেন, “তুমি নিজের কাজ কর দয়া করে। যাও”।

রাকিব বললেন, “তাই ভাল। আজ আবার আলোর গতিপথ পড়াতে হবে। কঠিন সাবজেক্ট। তুমি তাহলে দেখো ওরা কী চায়”।

রাকিব আর দেরী না করে লাইব্রেরীতে ঢুকে গেলেন।

১৪

‘স্বদেশীযুগে আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরে আত্মীয় বলিয়া, ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম। সেই স্নেহের ডাকে যখন তারা অশ্রু গদগদ কন্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারী রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই, আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না…। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সাথে সাথে এক হয় নাই তাহার কারণ তাদের সাথে আমরা কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।’

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নীপা রাত্রিকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, “বাবার কথায় কিছু মনে কর নি তো? বাবা এমনিতে খুব যুক্তিবাদী মানুষ, কিন্তু এসব ব্যাপারে ছড়িয়ে লাট করে ফেলে”।

বলে নীপা হেসে ফেলল।

রাত্রি বলল, “কিন্তু কাকুর অ্যাপ্রোচটাকে আমার অনেস্ট মনে হয়েছে। যে সব মানুষ বেশি রাখ ঢাক করে কথা বলে, তাদের আমার অত ভাল লাগে না। কাজে এক আর মুখে আরেক করলেই বরং বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যা দেখা যায়। ঠিকই তো, আমি নাসিমকে ভালবাসি নাকি বা নাসিম আমাকে, সেটা না জানলে অনেক প্রশ্নের উত্তরই তো পাওয়া যাবে না”।

নীপা চোখ নাচাল, “তুমি দাদাকে ভালবাসো বুঝি? সত্যি?”

রাত্রি হেসে ফেলল, “ব্যাপারটা অত দূর কোন কালেই যায় নি। তবে আমি যেদিন থেকে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি, আমার ভাল লেগেছে। সেভাবে কোন ছেলে তো আমার জন্য প্যান্ডেমিকের সময় এরকম বাইক নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝাড়ি মারার ব্যর্থ চেষ্টা করে নি! অবশ্য প্যান্ডেমিকই বা হল কোথায়?”

নীপা বলল, “জানো তো, আমার মনে হয় প্যান্ডেমিকটা হয়ে একদিকে ভাল হয়েছে”।

রাত্রি অবাক হল, “এত লোক মারা গেল, তুমি ভাল বলছ কেন?”

নীপা বলল, “আমরা খুব ভয় পাচ্ছিলাম। শুধু এ দিক সেদিক থেকে কমিউনাল টেনশনের কথা শুনতে পারছিলাম। এ ভয়টা যে ঠিক কতটা ভয়, সেটা তুমি বুঝবে না”।

রাত্রি বলল, “অনেকটা বুঝব না হয়ত, তবে কিছুটা বুঝব। সারাক্ষণ ঘেন্নার চাষ হতে হতে মানুষের মধ্যে একটা চাপা রাগ তৈরী হয়। মানুষের কাজ নেই, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, রাজনীতিকরা আর কী করবে? এসবের উস্কানিতে মেরুকরণ হয়, ভোটের সমীকরণটাই পাল্টে যায়। আমরা যেটা বুঝতে পারি, দুঃখের ব্যাপার হল বড়রা অনেকেই বুঝতে পারে না। আমার হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটিওয়ালা ফোনটা থাকার আগের বাবা আর পরের বাবার মধ্যে অনেক তফাৎ। সারাক্ষণ শুধু আমরা ওরা করে চলেছে। এখন এসব করে কি সত্যিই কোন লাভ আছে”?

নীপা বলল, “ভয় না থাকুক, তবে আমাদের ওরা ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছে। আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি। যখনই পক্ষ তৈরী হয়ে যাচ্ছে, আমাদেরও আতঙ্ক শুরু হয়ে যাচ্ছে”।

কলিং বেল বাজল। শায়লা গিয়ে দরজা খুললেন। দেখলেন পুলিশের গাড়ি এসেছে। একজন ইন্সপেক্টর তার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করলেন, “নমস্কার, আমি থানা থেকে আসছি। এ বাড়িতে…”

শায়লা বললেন, “ভিতরে এসে বসুন”।

প্রসেনজিতকে ড্রইং রুমে বসিয়ে শায়লা রাকিবের লাইব্রেরীতে ঢুকে বললেন, “পুলিশ এসেছে। এবার তুমি সামলাও”।

রাকিব ক্লাস করাচ্ছিলেন।

শায়লার কথা শুনে বললেন, “ওহ। ঠিক আছে। যাও। আমি আসছি”।

শায়লা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। ঠিক যে যে দুঃস্বপ্নগুলো তিনি দেখেন, সেগুলোই যেন এক এক করে শুরু হয়ে গেল।

ছাত্রদের পরে ক্লাস নেবেন বলে ক্লাস শেষ করে রাকিব ড্রইং রুমে গেলেন। প্রসেনজিতকে দেখে বললেন, “রাত্রির জন্য এসেছেন?”

প্রসেনজিত বললেন, “হ্যাঁ। মেয়েটির বাবা মিসিং ডায়েরী করেছে। আমি খানিকটা মধ্যস্থতা করার জন্যই এসেছি। ভদ্রলোক থানায় গিয়ে এমন শুরু করেছেন যে না আসা ছাড়া উপায় ছিল না”।

রাকিব হেসে ফেললেন, “সেসব না করে কাল যখন ওর মেয়েকে দিয়ে আসতে গেছিলাম, তখন বেশি ঝামেলা না করে নিয়ে নিলেই পারতেন”।

প্রসেনজিত অবাক হলেন, “সেকী?”

রাকিব গোটা ব্যাপারটা বললেন। প্রসেনজিত বললেন, “অদ্ভুত তো, ভদ্রলোক কী চান? বাই দ্য ওয়ে, আপনার ছেলের সঙ্গে কি মেয়েটার সম্পর্ক আছে?”

রাকিব বললেন, “আমি এ ব্যাপারে একবারেই অন্ধকারে অফিসার। নিজেও জানি না ঠিক কী অবস্থায় আছে ব্যাপারটা। আপনি কি মেয়েটাকে নিয়ে যেতে এসেছেন?”

প্রসেনজিত বললেন, “মেয়েটি যেতে চাইলে আমি নিয়ে যেতে পারি। কোন অসুবিধা নেই”।

রাকিব নীপার ঘরে গিয়ে রাত্রিকে ডেকে আনলেন। রাত্রি বাইরে বেরিয়ে পুলিশ দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেল।

রাকিব বললেন, “তোমার বাবা থানায় গিয়েছিলেন। তুমি চাইলে ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরতে পারো। উনি মধ্যস্থতা করছেন”।

রাত্রি প্রসেনজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি একটু ভেবে নি? পরে জানাই?”

প্রসেনজিত বললেন, “নিশ্চয়ই। আমার নাম্বার রেখে যাচ্ছি। কোন অসুবিধা হলে জানাবেন”।

রাত্রি ঘাড় নাড়ল, “আচ্ছা”।

বাড়ির বাইরে ভিড় জমে গেছে।

প্রসেনজিত রাকিবকে বললেন, “আপনার সঙ্গে আলাদা করে একটু কথা বলব স্যার”।

রাকিব বললেন, “নিশ্চয়ই”।

রাকিব প্রসেনজিতকে লাইব্রেরীতে নিয়ে গেলেন।

প্রসেনজিত বসে বললেন, “মেয়েটির বাবা একটু বেশিই সক্রিয়। কমিউনাল টেনশন হতে পারে। আমি ব্যাপারটা দেখছি, তবে রাজনীতি ঢুকলে ব্যাপারটা কিন্তু জটিল হতে পারে। একটু সাবধানে থাকবেন”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *