২০
প্রণয়কে তনয়া ঠিক চিনতে পারেন না আজকাল। অন্ধ মুসলিম বিদ্বেষী কথাবার্তা বলা শুরু করেছিলেন বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। কিন্তু রাত্রি চলে যাওয়ার পর থেকে কেমন পাগলের মত করছেন। এক জায়গা থেকে ঘামতে ঘামতে এসে আরেক জায়গায় ছুটছেন।
তনয়ার দিদি রুমা খবর পেয়ে ফোন করেছিলেন, “কী হয়েছে বল তো আমায়”?
তনয়া সবটা বললেন।
রুমা বললেন, “সে কী? এত কিছু হয়ে গেছে, অথচ তুই আমায় এখন জানাচ্ছিস?”
তনয়া ধরা গলায় বললেন, “কী জানাবো বল তো? এটা জানানোর ব্যাপার? তার উপরে ওর বাবা যা শুরু করেছে, আমি আরো পাগল হয়ে যাবো”।
রুমা বললেন, “ছেলেটার সঙ্গে রাত্রির প্রেম আছে? রাত্রি তো সারাদিন ঘরেই থাকে দেখেছি। এটা সেটা রান্না করছে, ফেসবুকে ছবি দিচ্ছে, সে এসব করে ফেলল? অথচ আজকালকার দিনের ছেলে মেয়েরা কখন কী করছে, কিছুই বোঝা সম্ভব না, তবু আমার কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না রাত্রি জড়িয়ে পড়ল কী করে। তোদের ওদিকে মুসলমান আছে নাকি?”
তনয়া বললেন, “আমি কিছু জানি না”।
রুমা বললেন, “বিয়ে হয়ে গেছে?”
তনয়া বললেন, “জানি না”।
রুমা বিরক্ত হয়ে বললেন, “জানি না বললে কী করে হবে? মেয়েটা তোর। তোর অনেক আগে জানানো উচিত ছিল। নাকি সারাদিন কেঁদেই মরছিস?”
তনয়া বললেন, “তুই যদি প্রণয়কে দেখতিস, তাহলে বুঝতিস আমি কেন কাউকে কিছু বলছি না। একাই যা শুরু করেছে…”
রুমা বললেন, “তা তো করারই কথা। মেয়ে পালিয়ে গেলে বাবা মা করবে না?”
তনয়া বললেন, “টেকনিকালি পালিয়ে গেছে বলা যাবে না হয়ত। ওর বাবা যা শুরু করেছে, মেয়ে এক প্রকার বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। ওরা তো দিতেও এসেছিল রাত্রিকে। ওর বাবা আবার ভ্যানতাড়া শুরু করল”।
রুমা বললেন, “আমি এখন উত্তরপাড়া থেকে কী করে যাই বল তো? ট্রেন বাস সব বন্ধ”।
তনয়া বললেন, “ফোনে খবর দেবো। আসার দরকার নেই। যা সর্বনাশ হবার, আমার মনে হয় হয়েই গেছে”।
রুমা বললেন, “রাত্রি ফোন করে নি? কান্না কাটি করে না তোর জন্য? বলে না, মেয়ে কখনো আপন হয় না?”
তনয়া থমকে গিয়ে বললেন, “রাখছি এখন। পরে কথা বলব”।
ফোন কেটে দিলেন তনয়া। বাইরের ঘরে প্রণয় কাকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ফোন করছেন।
কিছুক্ষণ পর তার ঘরে এসে বললেন, “এবার বুঝবে। আমি অনেক উপর মহলে খবর দিয়েছি। এরা পাতি বাঙালি না। একদম অবাঙালি ভেজ খাওয়া হিন্দু। মোল্লাদের দাপট বের করে দেবে দেখবে। কাল ভোরেই আসবে সব”।
তনয়া বললেন, “অবাঙালি ভেজ খাওয়া হিন্দু গুন্ডা?”
প্রণয় বললেন, “একদম গুণ্ডা বলবে না। গুণ্ডা আবার কী? ধর্ম রক্ষা করছে। এরকম লোকেদেরই তো দরকার ছিল। ছ্যা ছ্যা, লোকাল যারা আছে, তারা একবারে অপদার্থ। আমি বললাম আপনাদের এত এত লোক সাপোর্টার আছে, চলুন, তাদের নিয়ে গিয়ে একবারে শিক্ষা দিয়ে আসি। আমায় বলে কী না, ওদের এক হাজার সাপোর্টার হলে ন’শো নাকি ফেক প্রোফাইল। একটা লোক ন’টা প্রোফাইল চালায়। আর বেশিরভাগই কেউ বাংলাদেশে থাকে, কেউ বা বিদেশে। এভাবে এরা ধর্ম রক্ষা করতে নেমেছে। ছি। তারপরে অনেক কিছু ঘেঁটে এক্কেবারে হেড অফিসে ফোন করলাম। এবার ব্যাটারা বুঝবে কত ধানে কত চাল। হু! লাভ জিহাদ করবে! আমার মেয়েকে ফুসলিয়ে বিয়ে করে নিয়ে যাবে! দেখিয়ে দিচ্ছি”।
তনয়া ভয় পেলেন, “তুমি কি গুণ্ডা ভাড়া করেছো?”
প্রণয় বললেন, “তুমি দেখে নিও কী ভাড়া করেছি”।
তনয়া আর কিছু বললেন। রাতে খেলেন না। মেয়ে যাবার পরে খাওয়া ত্যাগ করেছেন। তবে প্রণয় সেটা বোঝেন নি। তিনি সারাক্ষণ লাফ ঝাঁপ দিয়ে যাচ্ছেন।
রাতটা দুঃস্বপ্ন দেখে কাটল তনয়ার।
সকাল আটটা নাগাদ দেখলেন বাড়ির সামনে একটা টাটা সুমো দাঁড়াল।
সে গাড়ি থেকে সাত আটজন তিলক কাটা লোক তাদের বাড়িতে এসে কলিং বেল বাজালো।
প্রণয় লাফাতে লাফাতে দরজা খুলতে ছুটলেন।
২১
রাত্রির ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল।
হঠাৎ করে বাবা মার জন্য মন কেমন করছে তার। নীপা শুয়েছিল।
ডাকল না। সে চুপ করে শুয়ে থাকল।
বাবা যেমনই হোক, তারই তো বাবা। চোখের সামনে লোকটা পাল্টে গেল। ছোট থাকতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কিছু চাইলে বাবা কখনো না করতে পারতো না। রাত্রির ইচ্ছে হচ্ছিল এক ছুটে বাড়িতে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে।
এভাবে তাকে পর করে দিতে পারবে না নিশ্চয়ই।
আর তার মা কী করছে এখন? নিশ্চয়ই ঘুমোয় নি!
রাত্রির মাকে ফোন করতে ইচ্ছা করছিল।
ঠিক করল দশটার দিকে ফোন করে নেবে।
অজান্তেই তার দু চোখ কখন অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল বুঝতে পারে নি সে।
আবার চোখ বুজতে ঘুম চলে এল।
ভাঙল প্রবল চিৎকারে।
ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল ঘরে কেউ নেই।
জানলার পর্দা সরিয়ে দেখল বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবার চিৎকার ভেসে আসছে।
রাত্রি বেরোল।
দেখল বেশ কয়েকজন লোক এসে জড়ো হয়েছে। প্রণয় চিৎকার করছেন, “আমি বুঝে নেব। সব ক’টাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেব। বুঝে নেব”।
রাকিব চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। শায়লা ফ্যাকাসে মুখে একটা চেয়ারে বসে আছেন। তার হাত পা কাঁপছে। নীপা এক কোণে দাঁড়িয়ে প্রবল ভাবে হাসি চাপার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সিরিয়াস সময়ে হাসি পাওয়ার রোগ তার বরাবরের। পাড়ার লোক জড়ো হচ্ছে। এ পাড়া মুসলমান প্রধান। প্রণয়ের সঙ্গে গাড়িতে আসা লোকগুলোর হাব ভাব রাত্রির মোটেও সুবিধার লাগল না। বাবার আচরণে সে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিল।
সে তাড়াতাড়ি প্রণয়ের কাছে গিয়ে বলল, “বাবা! তুমি বাড়ি যাও”।
প্রণয় থমকে গেলেন। তার দিকে থতমত হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
রাত্রি বলল, “এরা কারা? কাদের নিয়ে এসেছো?”
প্রণয় বললেন, “তোকে ওরা জিন দিয়ে বশ করেছে। তুই জানিস না। মোল্লারা জিন পোষে”।
রাত্রি বলল, “তোমার মাস্ক কোথায় বাবা?”
প্রণয় বললেন, “তুই গাড়িতে ওঠ। তোকে গঙ্গা স্নান করিয়ে ঘরে তুলব। তোর শুদ্ধিকরণ হবে। এখনো কিছু শেষ হয়ে যায় নি”।
একজন টাক মাথা গেরুয়াধারী বলল, “সব হো জায়েগা। ও কোই বাত নেহী। চলো বেটি”।
রাত্রি বলল, “আমি কোথাও যাব না। তুমি ঠিক না হলে আমি আর বাড়িও ফিরব না বাবা। কে জানে কাদের নিয়ে এসেছো, এদের গাড়ি চড়ে এসেছো তুমি? কারো ভিতরে যদি ভাইরাস থাকে?”
দশ বারো জন লোক ভিড় ঠেলে এসে বলল, “কী হচ্ছে এখানে? এ পাড়ায় গুন্ডামি করতে এলে ঠ্যাঙ ভেঙে দেব”।
রাকিব বললেন, “এটা আমার ব্যাপার। পাড়ার লোক আসবেন না কেউ দয়া করে”।
রাত্রি বলল, “তুমি যাও বাবা। এখানে থেকো না। যাদের নিয়ে এসেছো তাদের নিয়ে চলে যাও”।
রাকিবের বারণ সত্ত্বেও পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠল। গাড়ির থেকে লাঠিসোটা বেরোতে শুরু করল।
প্রণয় রাকিবের দিকে ছুটে গেলেন, “কী করেছিস আমার মেয়েকে তোরা? কী খাইয়েছিস? মোল্লা কাটার বাচ্চা, তোদের পাকিস্তানে না পাঠানো পর্যন্ত শান্তি নেই আমার”।
রাত্রি বুঝল প্রণয় যা শুরু করেছেন, তাতে সে যতক্ষণ না গাড়িতে উঠবে, এলাকা তত উত্তপ্ত হতে শুরু করবে। নাসিমদের পরিবারের উপরে তত চাপ বাড়তে থাকবে।
রাত্রি বাবার হাত ধরল, “কী চাও তুমি? আমি বাড়ি গেলেই হবে তো? চল”।
প্রণয় বললেন, “গাড়িতে ওঠ”।
রাত্রি রাকিবের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল।
প্রণয় আরো এক দফা চিৎকার করে গাড়িতে উঠলেন।
গাড়ি স্টার্ট দিতেই গাড়িতে বসারা বাকিরা চিৎকার করে স্লোগান দিতে শুরু করল।
রাত্রি দেখল রাকিব নিশ্চুপ হয়ে তাদের চলে যাওয়াটা দেখছেন।
একজন ড্রাইভারকে হিন্দিতে বলল গ্রাম পেরিয়ে কোন ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াতে। শুদ্ধিকরণ করতে হবে রাত্রির।
রাত্রি কিছু বলল না। তার চোখ ফেটে জল আসছিল।
২২
মফস্বল আর গ্রামের মধ্যে একটা বড় মাঠের ব্যবধান। মাঠের কোণে একটা বড় পুকুর।
পুকুরের পাড়ে গাড়ি দাঁড় করানো হল।
প্রণয় রাত্রিকে বললেন, “যা, স্নান করে আয়। পূজারীজি পুজোর আয়োজন করছেন। তোকে শুদ্ধ করে ঘরে তোলা হবে”।
রাত্রি পাথর হয়ে বসে থাকল। প্রণয় বললেন, “কী হল? কানে যাচ্ছে না কথা? যা বলছি কর”।
রাত্রি বলল, “আমাকে বাড়ি নিয়ে গেলে চল। রাস্তাঘাটে কোন রকম নাটক আমি করতে পারবো না”।
প্রণয় গম্ভীর গলায় বললেন, “নাটক না। যা করতে বলছি কর”।
রাত্রি বলল, “পারব না”।
একজন গাড়ির বাইরে থেকে হিন্দিতে বলল, “বাইরে এসো বেটি। স্নান করে গো মূত্র আর গোময় দিয়ে তোমাকে শোধন করে দেব আমরা”।
রাত্রি বলল, “মরে গেলেও আমি গোবর খেতে পারব না”।
প্রণয় বললেন, “খেতে পারবি না মানে কী? মোল্লাদের বাড়ির ভাত যখন খেতে পেরেছিস, গো মূত্রও খেতে পারবি। তুই কি জানিস গো মূত্র কত পবিত্র?”
রাত্রি ঘেন্নায় নাক মুখ কুঁচকে বসে রইল।
প্রণয় বললেন, “তুই যদি এখন এখানে বসে থাকিস, তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না”।
রাত্রি বলল, “তোমার থেকে খারাপ আমি আর কাউকে দেখছিও না বাবা। এমন কি এই যাদের নিয়ে এসেছো, তাদেরও তোমার থেকে ভাল লাগছে। কী করবে তুমি? মেরে ফেলবে? মেরে ফেললে মেরে ফেলো”।
প্রণয় ভুল হিন্দীতে বাকিদের বলল, “আমার মেয়েকো তুকতাক করা হ্যায়। জিন উঠা বসা হ্যায় মেরে মেয়েকা আন্দর। ইসে বাচাও”।
একজন পুকুর থেকে জল নিয়ে এসে রাত্রির গায়ে ছুঁড়ে মারল।
রাত্রি গাড়ি থেকে নামতে গেলে সবাই জোর করে গাড়ির দরজা ধরে দাঁড়াল। প্রণয় রাত্রির দু হাত শক্ত করে ধরলে একজন চামচ করে গোবর আর গোমূত্র খাইয়ে দিল রাত্রিকে।
রাত্রি গন্ধের চোটে বমি করে ফেলল।
একজন মন্ত্র পড়ে প্রণয়কে বলল মেয়ের শুদ্ধিকরণ হয়ে গেছে।
প্রণয় ভারি খুশি হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর তাদের বাড়ির সামনে রাত্রি যখন নামল, পাড়ার লোকেরা দেখল জামায় বমি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাত্রি বাড়ির ভিতরে ঢুকল।
যে সব লোকজনেরা এসেছিল, তাদের প্রণয় একপ্রকার জোর করে টাকা দিলেন। তারা স্লোগান দিতে দিতে গাড়ি নিয়ে বিদায় নিল।
তনয়া চুপ করে বসার ঘরে বসে ছিলেন এতক্ষণ। রাত্রির অবস্থা থেকে শিউরে উঠলেন। দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে ধরলেন।
রাত্রি মরা মাছের চোখ নিয়ে মাকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল।
তনয়া মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “বাথরুমে যা”।
রাত্রি ধীর পায়ে বাথরুমে গেল।
তনয়া প্রণয়কে বললেন, “এটা কী করেছো তুমি?”
প্রণয় আলেকজান্ডারের মত হাব ভাব করে বললেন, “কী করলাম বুঝলে না? বিধর্মীদের হাত থেকে নিজের মেয়েকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলাম। এ যে কত বড় কাজ করলাম, তা তুমি কী করে বুঝবে? আমি দেখি নি, মেয়েটাকে কী শিখিয়েছো কে জানে? মোল্লাদের বাড়ি থাকতে চলে গেছে নাকি! ছি ছি ছি! লজ্জার ব্যাপার!”
রাত্রি বাথরুমে শাওয়ার ছেড়ে বসে রইল।
গা ঘিন ঘিন করছে। যত বার তার মনে পড়তে লাগল সে গো মূত্র আর গোবর খেয়েছে, তার বমি হতে লাগল। বার বার বমি করতে শুরু করতে করতে সে অজ্ঞান হয়ে গেল।
তনয়া সাত তাড়াতাড়ি মেয়ের জন্য রান্না বসিয়েছিলেন। মেয়ে বাথরুম থেকে বেরোচ্ছে না দেখে তনয়া দরজা ধাক্কালেন।
দরজা খুলল না। রাত্রির সাড়াও পাওয়া গেল না। তনয়া একটুও অপেক্ষা না করে পাড়ার লোকজনকে ডেকে বাথরুমের দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করলেন।
রাত্রিকে যখন তুলে ঘরে নিয়ে আসা হল, ততক্ষণে রাত্রির তুমুল জ্বর এসে গেছে।
“ও বাবা, আমাকে ওসব খাইও না বাবা, আমি গোবর খাব না”, রাত্রি ক্রমাগত এই কথাটাই বলে যেতে থাকল। প্রণয় ছাদে উঠে বিভিন্ন জায়গায় হোয়াটস অ্যাপ করে তার বিজয় সংবাদ দিচ্ছিলেন। ছাদ থেকে নেমে যখন দেখলেন পাড়ার অনেক লোক তার বাড়িতে এসেছে, তখন তার টনক নড়ল। ঘরে এসে রাত্রিকে শুয়ে থাকতে দেখে তনয়াকে বললেন, “কী হচ্ছে বল তো?”
তনয়া বললেন, “বুঝতে পারছো না কী হয়েছে? নিজের মেয়েকে বুঝতে পারছো না? ওকে না, তুমি বরং নিজেকে জিজ্ঞেস কর, তোমার কী হয়েছে?”
তনয়া ভীষণ চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করায় প্রণয় বেগতিক বুঝে বাড়ি থেকে পালালেন।
পাড়ার কয়েকজন মহিলা থেকে গেলেন তনয়ার সঙ্গে। জলের ঝাপটা দিয়ে অনেক কষ্টে রাত্রিকে সামলানো গেল। একজন বমির ওষুধ খাইয়ে দিলেন।
রাত্রি কাঠের মত খাটে শুয়ে থাকল। তার সমস্ত প্রাণশক্তি কে যেন শুষে নিয়ে গেছে…
২৩
নাসিমকে ভোর বেলায় ডেকে নিয়ে গেছিল ঋপণ। পর পর তিনটে বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার কাজ ছিল। পিপিই পরে অক্সিজেন সিলিন্ডার বয়ে নেওয়া খুব পরিশ্রমের কাজ। মাস্ক খুলতে একবারে বারণ করে দিয়েছেন ডাক্তারবাবুরা। তারা জানিয়েছেন, এই ভাইরাসের আগ্রাসন এতটাই ভয়ংকর, মাস্ক খোলার সঙ্গে সঙ্গে এটা শরীরে প্রবেশ করে ফেলবে। ফোন অফ করে পকেটে রাখা ছিল।
শেষ বাড়িটায় অক্সিজেন দিয়ে এসে পার্টি অফিসে এসে পিপিই খুলে হাত মুখ ধুল সে। ঋপণ বলল, “চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি। আবার ডাকলে তুলে নেবো। কাল রাতেও তো সেভাবে ঘুমোতে পারিস নি”।
নাসিম বলল, “হ্যাঁ। দিয়ে এসো”।
সে খানিকটা উতলাও হয়ে যাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে রাত্রিকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। ভাল লাগা তৈরী হয়ে গেলে সেটা ডালপালা মেলতে বেশি সময় নেয় না। শত কাজের মধ্যেও রাত্রির মুখটা সঞ্জীবনীর মত কাজ করছিল।
ঋপণ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল, “তোর লাভ স্টোরি কত দূর?”
নাসিম হাসল, “ধুস, কী যে বল। লাভ স্টোরির কিছু নেই”।
ঋপণ বলল, “শোন ভাই, কমিউনিস্ট হয়েছিস, বুক বাজিয়ে বলবি, হ্যাঁ ভালবাসি। কিছু ভুল ভাল পাবলিক কমিউনিজম শেখানোর নামে মামণিদের ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে একবারে বদনাম করে ছেড়ে দিল মাইরি। একটা মেয়েকে ঠিক করে প্রপোজও করতে পারলাম না এই ভয়ে। কে কখন কী বলে দেবে”।
নাসিম বলল, “ফাঁকা ফ্ল্যাটে লেনিন। হা হা”।
দুজনে হাসতে লাগল। ঋপণ বলল, “সব থেকে মজার ব্যাপার হল, লোকের ধারণা লাল পতাকা থাকলেই আমাদের পার্টি। অসংখ্য পাবলিক আছে, আর কিছু আঁতেল অতিবিপ্লবী অতি বামপন্থীও আছে যারা মাঝে মাঝেই অ্যান্টি ইন্ডিয়ান কথা বলে। সমস্যা হল, এইগুলোর বিল আমাদের নামেই কাটা হয়”।
নাসিম বলল, “আর প্রতি বছর দেখবে মরিচঝাপির মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। হোক, শূন্য হয়েছে। ভোটও শূন্য হোক। আমরা একবারে শুরু থেকে শুরু করি। সেটাই দরকার”।
ঋপণ বলল, “হ্যাঁ। অনেক খেটেছি ভোটে ভাই। ভোটের পরেও দেখছি। পাবলিক আমাদের ওই এন জি ওই ভাবছে। কেউ কেউ বলছে যা যা পাপ করেছে তোদের সিনিয়ররা, এখন মানুষের কাজ করে সেগুলোর প্রায়শ্চিত্ত কর। মাইরি, কী মজা লাগে। চোর চিটিংবাজদের মাথায় তুলে নাচবে, রেপিস্টদের হিরো বানাবে, আর সব দোষ নাকি আমাদের ছিল। আসলে কী হয়েছিল বল তো, ক্ষমতায় থাকার সময় পার্টি থেকে অসংখ্য অযোগ্য লোককে চাকরি দিয়েছিল। এরা সব সুবিধা নিয়ে নিয়েছে। এখন দেখছি এক জায়গা থেকে তো সব পেয়ে গেছি, এবার পাল্টি মেরে দেখি অন্য জায়গা থেকে কী কী পাওয়া যায়। দিন সবার ফুরোয় একদিন”।
নাসিম বলল, “ধুস, তুমি ফ্রাস্ট্রু হয়ে যাচ্ছো। এক কাজ কর তাহলে। ভলান্টিয়ারগিরিটাই বন্ধ করে দাও। কেন করছো?”
ঋপণ হাসল, “কেন করছি? অ্যায়সে হি, সেক্সি লাগ রহা হে। শহরের মানুষ বুঝবে না, আমাদের গ্রামগুলোতে রেড ভলান্টিয়াররা না থাকলে কত সমস্যা তৈরী হত। আমার বাবাকেই দেখ, বাড়ি গেলেই গজগজ শুরু করে, কেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছি। নিজে এদিকে পার্টির দয়ায় চাকরি পেয়েছিল। সবাই কি আর রাকিবকাকুর মত হয়? এই সব মিটলে রাকিবকাকাকে বলব আমাদের ক্লাস নিতে। শিক্ষাটা ভীষণ দরকার। আগে নাকি ক্লাস হত, রীতিমত সব ধরণের লিটারেচার পড়তে হত। কেন এখনো সাম্যের কথা বলা উচিত, মানুষকে না বোঝালে মানুষ কেন বুঝতে যাবে? একটা ছোট ছোট শহরে এখন কোন বড় রিটেল কোম্পানি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুললে দেখবি লোকে কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাইন দিচ্ছে। ছোট ছোট দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোভিডের ফলে অসংখ্য মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে। এক সময় তো এই মানুষগুলোর কথা কমিউনিস্ট পার্টিই বলতো। এখন কেন বলছে না? শুধু ইলেকশনের সময় জোট করে লাফঝাপ করলেই হবে?”
নাসিমদের বাড়ির সামনে ঋপণ বাইক নিয়ে দাঁড়াল। বাড়ির সামনে পাড়ার লোকজন ভর্তি। ঋপণ বলল, “কী হল আবার?”
নাসিম দেখল রাকিব পাড়ার মানুষদের কিছু বোঝাচ্ছেন। সে নীপাকে দেখে বলল, “কী হয়েছে রে?”
নীপা বলল, “রাত্রিদিকে ওর বাবা এসে নিয়ে গেছে। গাড়ি ভর্তি করে লোকজন নিয়ে এসেছিল”।
নাসিমের মন খারাপ হয়ে গেল।
২৪
“বিয়ে হয়ে গেছে নাকি দিদি?”
পাশের বাড়ির এক মহিলা তনয়াকে জিজ্ঞেস করলেন। রাত্রিকে শুইয়ে দিয়ে বাইরের ঘরে এসে বসেছেন তনয়া। পাড়ার মহিলারা ছেঁকে ধরেছেন তাকে। করোনার জন্য এতদিন বাইরে বেরনো হয় নি। এখন একটা মশলাদার কেচ্ছা পাওয়া গেছে। স্থির জলে ঢিল পড়ার মত সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
তনয়া মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “না”।
পেছন থেকে কে ফিসফিস করে বলল, “ওরকম তো এখন বলতেই হবে। এবার চেনা জানার মধ্যে বিয়ে দিলে চলবে না। বাইরের ছেলে খুঁজতে হবে। জানলেই তো চিত্তির”।
তনয়া ক্লান্ত গলায় বললেন, “তোমরা বরং এখন যাও। আমার কাজ আছে”।
ফিসফিস করতে গিয়ে সবাই বেরোল।
তনয়া বাইরের দরজা বন্ধ করে এসে মেয়ের কাছে গিয়ে বসলেন।
কপালে হাত দিলেন। জ্বর এসেছে। আলতো স্বরে ডাকলেন, “মা। ভাল লাগছে এখন?”
রাত্রি কেঁপে উঠল একবার।
তনয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর রাত্রি ঘুমিয়ে পড়ল।
তনয়া ভাত বসালেন। মেয়েটাকে খাওয়াতে হবে। খালি পেটে থাকলে সমস্যা আরো বাড়বে।
বাড়ির বাইরে লোক নেই দেখে প্রণয় ঢুকলেন কিছুক্ষণ পরে। তনয়া দরজা খুললে তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় সে?”
তনয়া উত্তর না দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন।
প্রণয় রান্নাঘরের দরজার বাইরে ঘুর ঘুর করতে করতে বললেন, “ঠিক হয়েছে এখন?”
তনয়া উত্তর দিলেন না।
প্রণয় কিছুক্ষণ নিজের মনে বিড়বিড় করে টিভি চালিয়ে বসলেন।
তনয়া রান্না করে রাত্রির কাছে নিয়ে গেলেন।
ভাল জ্বর এসে গেছে রাত্রির। তনয়া রাত্রিকে কোন মতে তুলে খাওয়াতে গেলেন। খানিকটা খেয়ে হড় হড় করে বমি করে দিল রাত্রি।
তনয়া রাত্রির বমিটা থালায় নিয়ে এসে ড্রইং রুমের টেবিলে রেখে প্রণয়কে বললেন, “এ নাও। মেয়ে বমি করছে। জ্বর এসেছে। কী করবে কর”।
প্রণয় বললেন, “কী করব মানে? আমি কী করব? ডাক্তার ডাকছি, এসে দেখে যাক”।
তনয়া বললেন, “তুমি ওকে গোমূত্র আর গোবর খাইয়েছো? এটা করলে সব দোষ চলে যাবে? কে শিখিয়েছে তোমায়? কে বলে দিয়েছে এগুলো করলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে?”
প্রণয় কোন দিন তনয়াকে এভাবে কথা বলতে দেখেন নি। খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েও সামলালেন নিজেকে, “কে বলেছে মানেটা কী? শুদ্ধিকরণ করতে হয় না? মোল্লাদের বাড়িতে থেকেছে, খেয়েছে, একবারে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে ঘরে ঢুকিয়েছি। এবার আর কেউ কিছু বলতে পারবে না”।
তনয়া বললেন, “কেউ কিছু মানে? কেউটা কে? আমার তো মনে হয় এই কেউ সব থেকে বেশি তুমি! পাগলের মত কাজ করে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তাড়ালে। তারপর কতগুলো গুণ্ডা জড়ো করে মেয়েটাকে নিয়ে চলে এলে। এবার মেয়ের যদি কিছু হয়, আমি তোমাকে ছাড়ব না”।
প্রণয় বললেন, “গুণ্ডা কাদের বললে? ওরা ধর্ম রক্ষা করতে এসেছে। ওরা ধর্ম যোদ্ধা”।
তনয়া বললেন, “উফ! ধর্ম, ধর্ম ধর্ম করে মাথা খারাপ করে দিলে। তোমার ধর্ম তোমার কাছে রাখো। মেয়েটা তোমার না? এত যন্ত্রণা দিলে কেন? যাও এবার ওকে সুস্থ কর। ও যদি সুস্থ না হয়, এ বাড়িতে আমি একটা অন্নও মুখে তুলব না”।
প্রণয় উঠলেন, “ঠিক আছে, আমি দেখছি। বিরাট বড় কাজ করেছি, ক’দিন পরে তুমি নিজেই বলবে এটা দারুণ কাজ করেছি”।
তনয়া কিছু বললেন না।
প্রণয় রাত্রির কাছে গিয়ে ডাকলেন, “কী রে? কী হয়েছে?”
রাত্রি বলল, “আমাকে নাসিমদের বাড়িতে রেখে এসো। আমি এখানে থাকব না”।
প্রণয় বললেন, “আজে বাজে কথা বলিস না মা। তোকে কত কষ্ট করে নিয়ে এলাম”।
রাত্রি বলল, “আমি এখানে থাকব না। কিছুতেই থাকব না”।
প্রণয় ঘর থেকে বেরিয়ে তনয়াকে বললেন, “পান পোড়া দাও। আমি খোঁজ নিচ্ছি। ওরা জাদু টোনা করেছে। দরকার হলে ওঝা ডেকে এনে ছাড়াতে হবে। বুঝলে?”
তনয়া রাগী চোখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।