প্রেমিক – ৩৫

৩৫

চেম্বারেও কম ভিড় ছিল না। নাসিম আগে থেকে বলে রেখেছিল বলে বেশিক্ষণ সময় লাগল না।

লক্ষণ দেখে ডাক্তার বরাট ওষুধ লিখে দিলেন।

ওষুধ কিনে বাড়ি ফেরার সময় তনয়া দেখলেন নাসিম দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আর ডাকলেন না। কষ্ট হচ্ছিল ছেলেটার জন্য।

রাত্রি বাড়ি এসে শুয়ে পড়ল। কিছু খাইয়ে জ্বরের ওষুধ খাওয়াতে বলেছিলেন ডাক্তার। তনয়া অনেক মিনতি করে খুব সামান্য কিছু খাওয়াতে পারলেন।

প্রণয় বাড়ির ভেতরে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝেই থার্মাল গান নিজের মাথায় তাক করে টেম্পারেচার দেখছেন।

তনয়াকে বললেন, “কী বলল ডাক্তার? করোনা হয়েছে?”

তনয়া বললেন, “নিজে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসতে পারতে। এখন আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?”

প্রণয় বললেন, “আমি গুরুজীকে বলেছি বুঝলে। উনি বললেন খুব ভোরে উঠে কোন কামধনুর পিওর গো মূত্র যদি খাওয়ানো যায়, তাহলে করোনা হবে না। আমি তো ভাবছি কাল নিজেই খেয়ে আসব। রাত্রির জন্যও নিয়ে আসব”।

তনয়া অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললেন, “একদম না। তুমি নিজেও খাবে না। মেয়েকেও এসব আমি খাওয়াতে দেব না। আর দেখো, অনেক যন্ত্রণা দিয়েছো, আর বেশি যন্ত্রণা দিলে তোমার ওই ফোনটা আমি একদম আগুনে পুড়িয়ে দেব। যদি না করেছি তাহলে তোমার একদিন কি আমারই একদিন”।

প্রণয় বললেন, “বশীকরণ করেছে তোমায় ওই মোল্লা ফ্যামিলিটা। তোমাকেও করেছে। রাত্রিকেও করেছে। কিছু খাইয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই ভাতের সঙ্গে। ওদের মধ্যেও অনেক গুণীন আছে। তুমি জানো না”।

তনয়া বললেন, “তুমি এগুলোও বিশ্বাস করা শুরু করেছো? দিন দিন তো তোমার খুব উন্নতি হচ্ছে! শেষে তোমার জন্য আমাকে এসবও বিশ্বাস করতে হবে নাকি?”

প্রণয় বললেন, “গুরুজী বললেন তো, ত্রিকালদর্শী উনি। একসঙ্গে সব কাল দেখতে পারেন”।

তনয়া বললেন, “সব ভণ্ড। এদের কাজ হল মানুষে মানুষে দাঙ্গা লাগানো। শোন, তোমার এই গুরুজী, বাবাজী বা যা যা আছে, হ্যাঁ, ওই গোমূত্র, গোবর ধরেই বলছি, এই সব কিছু আমার মেয়ের সুস্থ হওয়া অবধি যেন এ বাড়িতে না ঢোকে। যদি ঢোকে, তাহলে আমি সব জ্বালিয়ে দেব। তোমার এসব অনেক সহ্য করেছি। আজ তো ওই ছেলেটার সঙ্গেও দেখা হল। ওই ডাক্তার বরাটের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিল। অত্যন্ত ভদ্র ছেলে”।

প্রণয় হতভম্ব হয়ে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি ওই ছেলের সঙ্গে কথা বলেছো? তোমার এত সাহস? আমার বাড়িতে থেকে তুমি ওই মোল্লাদের সঙ্গে কথা বললে?”

তনয়া বললেন, “তোমার বাড়ি? উদয়াস্ত পরিশ্রম করে রান্না করে ঘর সাজিয়ে সব আমি করব, আর তোমার বাড়ি হয়ে গেল? তোমাকে বললাম তো, এই নিয়ে তোমার সঙ্গে আমি কোন কথা বলব না। শুধু জেনে রেখো, আমার কাছে সবার আগে আমার মেয়ে। তারপরে তুমি”।

প্রণয় বললেন, “ওই ছেলে যদি এ বাড়ির ধারে কাছে আসে, মনে রাখবে আমি গুণ্ডা দিয়ে ওর হাত পা ভেঙে দেব”।

তনয়া বললেন, “নাসিমের বয়েই গেছে এ বাড়িতে আসতে। ও না থাকলে লাইনটা কে দিত শুনি? নিজে তো বাড়িতে বসে নাটক করে যাচ্ছো। স্বার্থপর অপদার্থ একটা লোক”।

প্রণয় লাফাতে শুরু করলেন, “মোল্লা বশ করেছে তোমায়। আমি এবার গুরুজীর সঙ্গে কথা বলবই”।

প্রণয় ফোন নিতে গেলেন।

তনয়া এবার প্রণয়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সজোরে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারলেন। ফোনের স্ক্রিণটা ভেঙে গেল।

প্রণয় তনয়ার দিকে একবার তাকিয়ে আর ভেঙে যাওয়া ফোনের দিকে তাকিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে যাচ্ছিলেন।

বাড়ির বাইরে কতগুলো ছেলে আড্ডা মারছিল। তনয়া তাদের বলল, “এই ছেলেরা, আমাদের বাড়িতে করোনা হয়েছে। তোমাদের কাকু দেখো করোনা নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোতে যাচ্ছে”।

ছেলেগুলো হৈ হৈ করে উঠল।

প্রণয় তনয়ার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললেন, “এটা তুমি কী করলে? পাড়ার লোক এবার আমাদের একঘরে করবে”।

তনয়া বললেন, “বেশ করবে। তোমার মত উন্মাদ লোকের ওষুধ এটাই”।

৩৬

নাসিম স্নান করে ঘরে ঢুকে চুপ করে বসে ছিল।

নীপা নাসিমের ঘরে ঢুকে বলল, “কী রে দাদা? তুই এত চুপ করে গেলি কেন? মুড ঠিক আছে তোর?”

নাসিম বলল, “হ্যাঁ ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই”।

নীপা বলল, “রাত্রিদির সঙ্গে কথা হয়েছে?”

নাসিম বলল, “না না, কথা হবে কী! ওর জ্বর হয়েছে। কোভিড টেস্ট করালো”।

নীপা চমকে উঠে বলল, “সেকী রে! এসব কখন হল? কালকেই তো এখান থেকে গেল”।

নাসিম বলল, “জানি না। কাল এখান থেকে গিয়ে জ্বরে পড়েছে বোধ হয়। শুনলাম, খুব মাথা ধরে আছে”।

নীপা বলল, “এত তাড়াতাড়ি কি কোভিড হয় নাকি? এখান থেকে যাওয়ার সময় অবধি তো ঠিকই ছিল”।

নাসিম বলল, “এখান থেকে যাবার পর কী কী ফেস করতে হয়েছে ওকে, সেসব তো জানি না। আর কোভিড হয়েছে নাকি সেটা তো কনফার্ম না, জাস্ট সন্দেহ। তবে আজকাল যা অবস্থা, ওই টেস্ট করতে গেলেও মানুষের সংক্রমণ হয়ে যাচ্ছে। আমি ওর হয়ে লাইন দিয়ে এলাম। আমার থেকে দূরেই থাক এখন”।

নীপা বলল, “তুই লাইন দিলি? বলিস কী? ওর বাবা কিছু বলল না?”

নাসিম বলল, “ওর বাবা ছিল না। থাকলে বলত নিশ্চয়ই”।

নীপা বলল, “ওর বাবাটা কেমন যেন বল?”

নাসিম বলল, “সবাই কেমন যেন? সিস্টেমটাই কেমন যেন। ওসব নিয়ে ভাবিস না তুই। ঘরে যা”।

নীপা বলল, “তোর কোন অস্বস্তি হচ্ছে না তো? চা করে দেব?”

নাসিম বলল, “সে দে। আমি ক’টা দিন বাইরের ঘরে থাকি”।

নীপা বলল, “থাক। আর শোন, এমনি জ্বরও হতে পারে। এখন সাধারণ জ্বরকেও লোকে কোভিড ভেবে নিচ্ছে”।

নাসিম বলল, “এখন সাধারণ জ্বর হলে লোকের ইমিউনিটি কমে যাচ্ছে। কিন্তু কোন গ্যাদারিং থেকে জিনিসটা শরীরে এসে যাচ্ছে”।

নীপা বলল, “হতেই পারে। কাল ওর বাবা যাদের নিয়ে এসেছিল, লোকগুলো কেমন যেন। একজনেরও মাস্ক ছিল না”।

নাসিম বলল, “সব কিছু থেকেই রোগটা হবার চান্স আছে। যাক গে, তুই চা করলে দিস। আমি শুই কিছুক্ষণ”।

নীপা রান্নাঘরে গেল। শায়লা রান্না করছিলেন।

নীপাকে দেখে বললেন, “কী হল? দাদা কী বলছে?”

নীপা বলল, “রাত্রিদির শরীর ভাল না”।

শায়লা বললেন, “নাসিম কী করে জানল?”

নীপা বলল, “কোভিড টেস্ট করাতে গেছিল রাত্রিদি। ওখানে দেখা হয়েছে”।

শায়লা বললেন, “আমার আর ভাল লাগে না। পারলে তোদের সবক’টাকে ছেড়ে যদি কোথাও চলে যাওয়া যেত, আমি যেতাম। তুই কালকে দেখলি ওর বাবা কী করল এখানে এসে, এখন নাসিম হ্যাংলার মত আবার চলে গেল?”

নীপা বলল, “ওর বাবা ছিল না। আর দাদা তো রেড ভলান্টিয়ার। কারো কোন সমস্যা হলে যাবে না কেন?”

শায়লা বললেন, “যাবার দরকার নেই। কোথাও যেতে হবে না। এই রেড ভলান্টিয়ারগিরিও করতে হবে না। ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়াবে, তারপর লোকে জিরো জিরো বলে খ্যাপাবে। সব লোক ধান্দাবাজ। নিজের ছাড়া কেউ কিচ্ছু বোঝে না। আমাদের যখন বিপদ হবে, দেখবি কেউ আসবে না। ওই পার্টির লোকও আসবে না”।

নীপা বলল, “বিপদ মানে? কী বিপদের কথা বলছ?”

শায়লা দাঁড়িয়ে পড়লেন, “কী বিপদ? কী বিপদ হতে পারে তোর কোন ধারণা আছে? চেনা জানা মানুষেরাই কীভাবে পাল্টাতে পারে তুই জানিস? গুজরাটে কী হয়েছিল? একজন গর্ভবতী মেয়ের পেটে ওরা তলোয়ার চালিয়ে দিয়েছিল”।

শায়লা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

নীপা বলল, “খামোখা চিন্তা করছ মা। এসব কিছু হবে না এখানে”।

শায়লা বললেন, “পৃথিবীর কোন জায়গাই কোন বাবা মায়ের কাছে তার সন্তানের জন্য আর নিরাপদ না। সেটা এ দেশ হল বা ইউরোপ আমেরিকা হোক। আমি তোদের বার বার বলেছি, আমি চাই না, নাসিম এটায় জড়িয়ে পড়ুক। আসলে কিন্তু ও পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে। তোর বাবাকে তো বুঝিয়ে উঠতে পারি না, উনি যতই পড়াশুনা করুন, অন্য লোকেদের কাছে মুসলমান মানেই টেরোরিস্ট”।

নীপা বলল, “আহ। তুমি ভীষণ স্যাডিস্ট”।

শায়লা বললেন, “বাধ্য হয়ে হয়েছি। দেখছি তো চারপাশটা। যাক গে, রাত্রি মেয়েটার জন্যও তো খারাপ লাগছে। তাও সেটাতেও ভয় লাগে। শুনছিলি তো ওর বাবা কী বলছিল?”

নীপা বলল, “বলুক না। তাতে কী হয় মা? তোমার খারাপ লাগছে সেটা শুনে বরং আমার ভাল লাগল”।

শায়লা বললেন, “চুপ কর। পাকা মেয়ে কোথাকার”।

নীপা হেসে ফেলল।

৩৭

“বউ কথা না শুনলে বা বেয়াদবি না করলে তালিবানরা কী করে জানো? মাথায় গুলি করে দাও। তোমার কপাল ভাল তুমি হিন্দু ঘরে বিয়ে করেছো”।

রাত্রিকে সবে ঘরে শুইয়ে দিয়ে এসে তনয়া বসার ঘরে এসে কথাগুলো শুনলেন।

থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, “এক কালে বর মরলে হিন্দুরা বউকে চিতায় চড়িয়ে দিত। সেটা বন্ধ হয়েছে। তা বলে কি সেটাকে ভাল বলব? কোন ধর্ম এগিয়েছে, কোন ধর্মের একটা অংশ এগোয় নি। তা বলে কিছু না জেনে, না বুঝে তোমার মত অসভ্যতা করতে হবে?”

প্রণয় বললেন, “তুমি আমার ফোন ভেঙে দিলে। আমি গুরুজীর সঙ্গে যোগাযোগ করব কীভাবে?”

তনয়া বললেন, “বেশ করেছি তোমার ফোন ভেঙে দিয়েছি। চেষ্টা কর এবার স্বাভাবিক হবার। নিজে বুঝতে পারছো না তুমি কী করছো?”

প্রণয় বললেন, “তুমি বুঝতে পারছো না তুমি কী করছো। একটা মোল্লা ছেলের সঙ্গে মেয়ের যোগাযোগ থাকা মানে কী ভয়ানক তুমি বোঝো? যদি ছেলেটা টেরোরিস্ট হয়?”

তনয়া বললেন, “টেরোরিস্টই বটে। লোকের বাড়ির লোক ফেলে রেখে যাচ্ছে, আর ছেলেগুলো নাওয়া খাওয়া ভুলে অক্সিজেন নিয়ে দৌড়চ্ছে। টেরোরিস্টই। ঠিকই তো। লোকগুলো মরলে দেশের জনসংখ্যা কমে যেত। তাহলেই ভাল হত”।

প্রণয় বললেন, “ধান্দায় করছে। সব ধান্দায়”।

তনয়া বললেন, “ভাল তো। ধান্দাতেই করুক না। কতজন ধান্দায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় বল তো? ভোটে হেরে যাবার পর তো ঘরে বসে যেতে পারত। করে নি। করে যাচ্ছে তো”।

প্রণয় বললেন, “তুমি থামো। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকো। মেয়েছেলে, তুমি কী বুঝবে?”

তনয়া হেসে ফেললেন, “দেখলে তো? সেই মেয়েছেলে বলে কোণঠাসা করেই দিলে! তোমার আর একজন মুসলিম মৌলবাদীর মধ্যে কী পার্থক্য আছে? দুজনেই তো মেয়েদের মানুষ বলেই মনে কর না”।

প্রণয় বললেন, “আমি অনেক ভাল। ওরা হলে এতক্ষণে গুলি করে দিত”।

তনয়া বললেন, “তোমার কাছে এখন বন্দুক থাকলে তুমি গুলি করতে না বলছো? আমার মনে হচ্ছে না। ওরা ব্রেইনওয়াশড ক্রিমিনাল। তুমিও কোথাকার সব হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে থেকে ব্রেইন ওয়াশড হয়ে গেছো। তোমার গুরুজী যদি তোমাকে হাতে একটা বন্দুক ধরিয়ে দিয়ে বলে নে বউ মেয়েকে গুলি করে মেরে দে, তুমিও তাই করবে। তোমরা হিন্দু হও বা মুসলমানই হও, তোমরা তো নিজেদের বুদ্ধিতে চলবে না। চলবে পরের বুদ্ধিতে। কেউ চলবে ইমামের কথায়, আর কেউ কোন গুরুজী ধরবে। পড়াশুনা করেছো তো, ভালমন্দের বিচার নিজেই তো করতে পারো। অন্য লোক কেন ঠিক করে দেবে তুমি কী করবে? তোমার মেয়ে কার সঙ্গে মিশবে বাকিরা কেন ঠিক করবে?”

প্রণয় কিছু বলতে গিয়ে কাশতে শুরু করলেন। কেশে নিয়ে বললেন, “তুমি ওই ছেলেটার ধান্দাটা বুঝতে পারছো না। ওরা এভাবেই এখন হিন্দু বাড়ির মেয়েকে ফুসলিয়ে বিয়ে করবে। তারপরে মুসলিম বানিয়ে দেবে”।

তনয়া বললেন, “মানুষ কি তুমি শুধু একা চেনো? আমি চিনি না?”

প্রণয় থার্মাল গান আবার নিজের মাথায় দিলেন। বললেন, “ও বাবা। একশো জ্বর উঠে গেল তো। এবার আমি কী করব?”

তনয়া বললেন, “কাল সকালে টেস্ট করাও। বাধিয়েছো আর কী! আমিও অপেক্ষা করে থাকি। আমারও নিশ্চয়ই হবে। তুমি এক কাজ কর না, যারা এসেছিল তাদের নাম্বার জোগাড় কর। তোমার পক্ষে খুব কঠিন হবে না। তাদের বল তোমার কোভিড হয়েছে। টেস্ট করাতে হবে। দেখো তো, আসে নাকি। ধর্ম রক্ষা করতে তো ঝাঁক বেঁধে চলে এসেছিল। এখন দেখি আসে কি না”।

প্রণয় বললেন, “আসবে তো। কেন আসবে না?”

তনয়া বললেন, “কর তবে”।

প্রণয় বললেন, “তোমার ফোন দাও”।

তনয়া তার ফোন এনে দিলেন। প্রণয় বললেন, “গুগলেই নাম্বার থাকবে। দেখছি”।

মিনিট খানেকের মধ্যেই নাম্বার জোগাড় হল।

কিছুক্ষণ পর ফোনে যোগাযোগ করা গেল।

কথা হলে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওরা কাল থাকবে না। দুটো দিন পরে এসে নিয়ে যাবে। দেখলে, কেমন কথা শুনল?”

তনয়া বললেন, “এই দুটো দিনে যদি তোমার কিছু হয়ে যায়? কাল টেস্ট করা দরকার আর দুটো দিন পরে আসবে? সত্যিই আসবে নাকি দেখার জন্য আমি রইলাম তো। দেখব”।

প্রণয় বললেন, “আসবে না কেন? ঠিক আসবে”।

তনয়া হাসলেন, “আসবে না। দাঙ্গা করার লোক মানুষ বাঁচাতে আসে না। দেখে নিও”।

প্রণয় থমথমে মুখে বসে রইলেন।

৩৮

রাকিব ক্লাসের জন্য নোটস তৈরী করছিলেন।

নীপা দরজায় নক করল, “বাবা, আসব?”

রাকিব বললেন, “আয়”।

নীপা ঘরে ঢুকে বলল, “রাত্রিদির শরীর খারাপ। কোভিড টেস্ট করিয়েছে। দাদা গেছিল”।

রাকিব চমকে বললেন, “সেকী! কেমন শরীর খারাপ?”

নীপা বলল, “দাদা বলল, জ্বর আছে। দাদা টেস্ট করানোর ওখানে লাইন দিয়েছিল বলল তো”।

রাকিব চিন্তিত হলেন। বললেন, “কী পরিস্থিতিতে মেয়েটা আছে কে জানে। এবার চিন্তা হচ্ছে”।

নীপা বলল, “সেই তো। এখানেই ভাল ছিল। কেন গেল বল তো”!

রাকিব বললেন, “ওর বাবা যাতে আমাদের বেশি আর অপমান করতে না পারেন, তাই চলে গেল। মেয়েটা ভীষণ সেন্সিটিভ”।

নীপা বলল, “ভাল লাগছে না শোনার পর থেকে। আমরা কি কিছুই করতে পারি না”?

রাকিব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “বিভেদের অবক্ষয় এত বেশি হয়ে যাবে কোনদিন, ভাবতে পারি নি। সামনের দিনগুলো এরকমই আসবে হয়তো”।

নীপা বলল, “মা খুব ভয় পায় বাবা। মাকে বোঝাতে পারো না, এত ভয়ের তো কিছু নেই”।

রাকিব বললেন, “তোর মা প্র্যাক্টিকাল মানুষ। হয়ত ভয়ের কারণ আছে বলেই ভয় পায়। আমি যখন মসজিদে যেতাম না, তখন আমার উপরেও কম চাপ আসে নি। অনেক মুরুব্বিরা এসে বুঝিয়েছে। আমার বাবাকেও বোঝাতেন ওরা। বছরের পর বছর মানুষের মনে জমে থাকা অন্ধবিশ্বাসকে হারানো খুব কঠিন কাজ। তোর মা যখন বলেছিল নাসিম মসজিদে যাক, আমি বাধা দিই নি। দেখতে চেয়েছি নাসিম কী চায়। ও নিষ্ঠার সঙ্গেই করে। করুক। যেদিন মনে হবে করবে না, আমি চাই, সেদিন কোন বাইরের লোক এসে যেন ওকে বোঝাতে না যায় ও যা করছে, সেটা ঠিক না। এটুকু স্বাধীনতা প্রতিটা মানুষের থাকা উচিত। তোর মাকে কী করে বোঝাই বল তো ভয়ের কিছু নেই? তোর ভয় লাগে না?”

নীপা বলল, “আমার ভয় লাগে না। কেন ভয় লাগবে? আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। কে না কে কী বলে যাবে, সব কিছু শুনবই বা কেন এত?”

রাকিব হাসলেন, “তুই আমার মত হয়েছিস। যুক্তিবোধ আর মুক্তমন এতটাই প্রবল হোক, কোন অন্ধবিশ্বাস যেন তাকে হারাতে না পারে। মানুষের বিবর্তনের পথে ধর্ম এসেছে। সময়ের সঙ্গে অনেক ধর্মই নিজেকে পাল্টাতে পেরেছে। যারা পাল্টাতে পেরেছে, তারা উন্নতি করেছে। যারা পারে নি, তারা সমস্যায় পড়েছে। অনেকটা উইন্ডোজ নাইন্টি এইটে এখনকার কোন গেম খেলার মত। বুঝতে পারছিস? সময়টা এগিয়েছে, মানসিকতা এদের মধ্যযুগে পড়ে আছে। মেয়েরা বেরোবে না, তোমরা এখানে যাবে না, সেখানে যাবে না, অন্য ধর্মে বিয়ে করা তো দূর, নিজের পছন্দেই বিয়ে করতে পারবে না, এ সবই সময়ের সঙ্গে নিজেকে আপডেট করতে না পারার সমস্যা। হিন্দু ধর্মেও তো সমস্যাগুলো ছিল, গোঁড়ামি ছিল। নবজাগরণ এসেছিল। রাজা রামমোহন রায় কিংবা বিদ্যাসাগরের মত মানুষেরা ছিলেন যারা গোটা সমাজের বিরুদ্ধে যেতে পেরেছিলেন। আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা হল, এক শ্রেণীর মানুষের বিপথে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে যে ধর্মটা তৈরী করা হল, সে ধর্মটার সেভাবে আপডেট হল না। মধ্যযুগেই পড়ে রইল বেশিরভাগ মানুষ। সময় পাল্টাচ্ছে, পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে সব কিছু পালটানো অবশ্যই দরকার। মেয়েরা শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র নয়, তাদের কথা বলতে দিতে হবে, প্রয়োজনে অত বছর আগে যা বলা হয়েছে, তা পাল্টাতে হবে। নইলে জাত হিসেবে কিছুতেই এগনো সম্ভব হবে না। সর্বক্ষণ শুধু এটা কোর না, ওটা কোর না, এর সঙ্গে মিশো না, তার সঙ্গে মিশো না না বলে বলুক না সবাই মিলে পৃথিবীটাকে ঠিক করি! এত ক্ষত তৈরী হচ্ছে, কীভাবে সারবে কে জানে”।

রাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

নীপা বলল, “আমাদের বাড়ির ব্যাপারটা নিয়ে দাঙ্গা লাগতে পারতো, বল বাবা?”

রাকিব বললেন, “কেন লাগবে? দাঙ্গা কি এতই সহজ নাকি? মেয়েটার খোঁজটা নেওয়া বড্ড দরকার। কাল সকালে যাব ভাবছি একবার”।

নীপা চমকে উঠে বলল, “যেও না বাবা। অপমান করে যদি”।

রাকিব বললেন, “খোঁজটা তো নিতে হবে। ঠিক আছে, নাসিমকে বলছি, খোঁজটা নিক”।

নীপা বলল, “তাই ঠিক হবে”।

রাকিব বললেন, “একবার নাসিমকে পাঠিয়ে দিস তো”।

নীপা মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে”।

৩৯

বমি ভাব প্রবল হবার জন্য রাতে রাত্রি সেভাবে খেতেই পারল না। যতটা সম্ভব খাইয়ে তনয়া দেখলেন প্রণয় পাংশু মুখে বসে আছেন। বললেন, “জ্বর এসেছে। কী করব?”

তনয়া বললেন, “খেয়ে ঘুমাও। আর কী করবে? কাল ডাক্তার দেখিও”।

প্রণয় বললেন, “লাস্ট কবে প্রেশার সুগার মাপিয়েছি ভুলে গেছি”।

তনয়া বললেন, “সেটাই তো স্বাভাবিক। সারাক্ষণ বাংলাদেশের হিন্দুরা কী করছে, ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা কী করছে হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ পড়ে যাচ্ছো, নিজে কেমন আছো সেটাই দেখো নি। দেখো এবার”।

প্রণয় বললেন, “রাত্রিকে কী ওষুধ দিয়েছে আমাকেও দাও। আমিও খেতে শুরু করি”।

তনয়া বললেন, “সেটা তো খাওয়া ঠিক হবে না, আপাতত জ্বরের ওষুধ খাও খেয়ে নিয়ে। তারপর দেখা যাবে”।

প্রণয় বললেন, “ঠিক আছে। আর কাল সকালে কি একবার খাটালের দিকে যাব? যদি গোমূত্র পাওয়া যায়? মানে গুরুজী বলছিলেন…”

তনয়া রাগী চোখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “একদম খেয়ে ঘুমাবে। একটা বাজে কথা বললে তোমার কপালে দুঃখ আছে”।

প্রণয়ের তেজ কমেছে। তিনি বেশি কথা না বলে খেতে বসে গেলেন। তার চোখে মুখে একটা ভীত ভাব দেখতে পেলেন তনয়া। খেয়ে নিয়ে জ্বরের ওষুধ খেয়ে প্রণয় শুলেন।

তনয়া খেয়ে হাতের কাজ সেরে বললেন, “আমি অন্য ঘরে শুচ্ছি। কোন দরকার পড়লে ডাকবে”।

প্রণয় বললেন, “ঠিক আছে”।

তনয়া ঠাকুরঘরের ছোট খাটে গিয়ে শুলেন।

ঘুম আসছিল না। বেশ কয়েকদিন ধরে একে এই করোনার বাড় বাড়ন্ত প্রকোপ, তারপর পরিবর্তিত প্রণয় তাকে ঘুমাতে দিচ্ছিল না। মানুষের মনে কী করে যে এত ঘৃণা ছড়াতে পারছে মানুষ, হাজার ভেবেও কূল কিনারা পাচ্ছিলেন না তিনি। প্রণয় তো এরকম ছিলেন না। বিয়ের পরে কত রোম্যান্টিক ছিলেন। রাত্রি হবার পরেও ভাল ভাল বই পড়তেন। হঠাৎ করে এরকম হয়ে গেলেন।

মানুষের মনে ভালোবাসা ছড়ানোর থেকে অনেক সহজ বোধহয় ঘেন্না ছড়ানো। অবদমিত হতাশা, দিনের পর দিন ঘরে বসে থেকে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য মোবাইলে পড়ে পড়ে আজকে এই জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছেন।

ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে এসেছিল তনয়ার, ঘুম ভাঙল প্রণয়ের ডাকে, “শোন না। আমার বুকটা কেমন করছে”।

তনয়া উঠে বসলেন। প্রণয় দরদর করে ঘামছেন।

তনয়া হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। কী করবেন মাথায় কিছুই এল না। প্রণয়কে তাড়াতাড়ি বসিয়ে জল খাওয়ালেন। প্রণয় বললেন, “বুকে হঠাৎ করে ব্যথা হচ্ছে। হার্ট অ্যাটাক হল নাকি বল তো”।

তনয়া কোন কিছু না ভেবে নাসিমকে ফোন করলেন।

দুবার রিং হতেই নাসিম ধরল, “হ্যাঁ, বলুন কাকীমা”।

তনয়া বললেন, “রাত্রির বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বুকে ব্যথা। কিছু করা যাবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না”।

নাসিম বলল, “আমি যাচ্ছি। চিন্তা করবেন না। কুড়ি মিনিট মত সময় দিন”।

তনয়া বললেন, “ঠিক আছে”।

ফোন রাখলেন তনয়া।

প্রণয় হাঁফাচ্ছিলেন। বললেন, “কাকে ফোন করলে?”

তনয়া বললেন “নাসিমকে”।

প্রণয় বললেন, “কেন ডাকতে গেলে? আর কিছু ছিল না? পাড়ার লোকদের ডাকো”।

তনয়া বললেন, “কোন পাড়ার লোক করোনা সাসপেক্টের বাড়িতে এখন আসবে? আর কাকে চিনবো আমি? তুমি সোফায় শুয়ে পড়। দেখছি আমি”।

তনয়া তৈরী হয়ে নিলেন। রাত্রিকে আর ডাকলেন না।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে নাসিম আর ঋপণ চলে এল। রাত সাড়ে বারোটা বাজে। তনয়া দরজা খুলে দিলেন।

নাসিম বলল, “ঋপণদা গিয়ে কাকুকে নিয়ে আসুক। আমি বরং বাইরে দাঁড়াচ্ছি”।

তনয়া বুঝলেন নাসিম কেন আসতে চাইছে না। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “তুমি এসো। আমি বলছি, এসো”।

নাসিম ঋপণকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঋপণ বলল, “আমি তপনদার সঙ্গে কথা বলেছি। একবার দেখিয়ে আনছি। উনি বললেন হসপিটালাইজড করে দিচ্ছি। চলুন”।

নাসিম আর ঋপণ প্রণয়কে তুলল।

প্রণয়ের চোখ বন্ধ। দুজনের ঘাড়ে ভর দিয়ে কাতর স্বরে তনয়াকে বললেন, “তুমি যাবে না?”

তনয়া বললেন, “যাচ্ছি তো। চল”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *