প্রেমিক – ৪০

৪০

হাসপাতালের এমারজেন্সীতে ডাক্তারবাবু প্রণয়কে দেখছিলেন। তনয়া তার সঙ্গে আছেন।

একটু দূরে নাসিম দাঁড়িয়ে ঋপনের সঙ্গে।

ঋপণ বলল, “যেন সব ঠিক ঠাক থাকে। যা শুনলাম হাসপাতালে একটাও সিট নেই”।

নাসিম বলল, “ঠিক না থাকা মানে কী হতে পারে?”

ঋপণ বলল, “কিছু না। তুই চিন্তা করিস না। আমি আছি তো”।

নাসিম বলল, “শান্তদাকে বললে হেল্প করবে না?”

ঋপণ বলল, “পার্টির উপরমহলের সঙ্গে কথা বলে নেব দরকার হলে। বললাম তো ভাবিস না। আচ্ছা, যদি কলকাতা যেতে হয়, তাহলে কি ওই রাত্রি মেয়েটা কী করবে?”

নাসিম বলল, “জানি না, ওর মা কী বলেন দেখি”।

তনয়া প্রণয়কে বসিয়ে রেখে তাদের দিকে এগিয়ে এসে নাসিমকে বললেন, “ডাক্তারবাবু বলছেন অবজারভেশনে রাখতে হবে। কয়েকটা টেস্ট দিয়েছেন। ওষুধ দিয়েছেন। ইসিজি করানো যাবে এখন?”

নাসিম ঋপনের দিকে তাকিয়ে বলল, “পালিতদাকে বলবে একবার?”

ঋপণ বলল, “দেখছি”।

ঋপণ ফোন করল। খানিকক্ষণ কথা বলে বলল, “চলুন। বাড়িতেই আছে। ইসিজি করিয়ে নি”।

প্রণয়কে নিয়ে তনয়া এম্বুলেন্সে উঠলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পালিতবাবুর বাড়িতে পৌঁছল তারা।

ইসিজি করা হল। পালিতবাবু রিপোর্ট দেখে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে তনয়াকে বললেন, “রিপোর্ট ঠিক আছে। তাও কাল বাকি টেস্টগুলো করিয়ে নেবেন। গ্যাস ফর্ম করেই হয়েছে সম্ভবত”। তনয়া হাঁফ ছাড়লেন।

প্রণয় গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন। তাদের এম্বুলেন্সে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হল।

তনয়া নাসিম আর ঋপণকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলেন। নাসিম বলল, “যে কোন দরকারে আমাকে ফোন করবেন। কোন দ্বিধা করবেন না”।

তনয়া বললেন, “দ্বিধা আসে নি বলেই তো তোমাকে ফোন করেছিলাম”।

নাসিম বলল, “কাল সকালে টেস্টে করার ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রিপোর্ট এলে আরেকবার ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন”।

তনয়া বললেন, “ঠিক আছে। ভিতরে এসো তোমরা। চা খাও। এত রাতে এভাবে দৌড়ঝাঁপ করছ, ভাবা যায় না”।

নাসিম প্রণয়ের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, “না না, আমরা এখন আসি। ফোন করবেন”।

ঋপণকে প্রায় জোর করেই নাসিম প্রণয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

তনয়া ওদের চলে যাওয়াটা দেখে শ্বাস ছাড়লেন। বুঝলেন প্রণয়ের দুর্ব্যবহারের ভয়ে নাসিম আর ঢুকল না।

প্রণয় সোফায় চুপ করে বসে ছিলেন।

তনয়া বললেন, “ছেলেগুলো ঘরে এলে ভালো লাগত”।

প্রণয় বললেন, “গঙ্গাজল থাকলে ঘরের বাইরেটা গঙ্গাজল দিয়ে ছিটিয়ে দাও”।

তনয়া প্রণয়ের দিকে বিস্মিতভাবে তাকিয়ে বললেন, “এটা তুমি বলতে পারলে? এত কিছুর পরেও?”

প্রণয় বললেন, “এগুলো ওদের পলিটিকাল প্রোপাগান্ডা। এসব করে ভাবছে ভোট পাবে। আর মোল্লাটা কেন এসব করছে তুমি বুঝতে পারছ না? হিন্দু মেয়ে বিয়ে করবে, তাই আমাকে হাতে রাখতে চাইছে এভাবে”।

তনয়া বললেন, “বিয়ে করতে চাইলে তোমার মত ফালতু লোককে হাতে রাখার দিকে যাবেই বা কেন? আমার মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক, ওরা চাইলে বিয়ে করতেই পারে, তাতে তোমাকে হাতে রাখার তো কিছু নেই”।

প্রণয় মাথা নাড়লেন, “তুমি বুঝবে না। হাতে এখনো রাখতে হবে। আমি যে ওদের বাড়িতে অত লোক নিয়ে গেলাম, ওরা বুঝে গেছে যে আমার পিছনে লোক আছে। ভয় পাচ্ছে বুঝছ না?”

তনয়া বললেন, “আমি সব বুঝতে পারছি। শুধু এটা বুঝতে পারছি না তোমার চোখে যে মোটা একটা নোংরা চশমা লেগে আছে, সেটা ঠিক কবে নামবে।”

প্রণয় তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে কী করতে বলছ? ওই মোল্লাছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেব? তাই তো?”

তনয়া বললেন, “তোমার মেয়ের যদি সত্যিই করোনা হয়ে থাকে, তাহলে বিয়ে, মোল্লা, হিন্দু, জাত পাত, এসব পরে আসবে। সবার আগে মেয়েটাকে বাঁচতে হবে, তাই না?”

প্রণয় বললেন, “আর মোল্লাটার সঙ্গে বিয়ে হলে আমি বাঁচবো না”।

তনয়া বললেন, “আমি তোমার সঙ্গে এসব ব্যাপারে যত কম কথা বলব, ততো ভাল। তুমি গিয়ে শোও। যাও”। প্রণয় বললেন, “তুমি যাবে না?”

তনয়া বললেন, “আমাকে শান্তিতে ঘুমোতে দিচ্ছো তুমি? একটা না একটা ঝামেলা করেই যাচ্ছো। তুমি যাও। আমি পরে যাচ্ছি, একবার মেয়েকে দেখে আসি”।

প্রণয় বললেন, “আমি আমার পরিচিতদের খবর দিচ্ছি। কাল ওরা আসুক। এই রেড ভলান্টিয়ার আর মোল্লারা কাল যেন এখানে না আসে”।

তনয়া রেগে গিয়ে বললেন, “যাকে খুশি ডাকো, আমি কিছু জানি না”।

৪১

নাসিম স্নান সেরে ঘরে ঢুকে দেখল রাকিব জেগে আছেন। তাকে দেখে বললেন, “ঠিক আছিস তো?”

নাসিম অবাক হল, “হ্যাঁ। কেন বল তো?”

রাকিব বললেন, “সময়টা এত খারাপ হয়ে গেছে, আজ সন্ধ্যেতেই দেখলাম কোথায় এক রেড ভলান্টিয়ারকে সাহায্যের নামে ডেকে নিয়ে গিয়ে মারধোর করেছে”।

নাসিম হাসল, “না না, সেসব কিছু না। করবে হয়ত মারধোর, কাজ ফুরোলেই পাজি হয়ে যায় মানুষ। এটা তো দেখতেই পাচ্ছি। রাত্রির বাবার বুকে ব্যথা উঠেছিল। ওখানে গেছিলাম”।

রাকিব থমকে গিয়ে বললেন, “ভাল করেছিস। কিছু বলে নি তো?”

নাসিম বলল, “বলে নি। সেরে গেলে বলবেন নিশ্চয়ই”।

রাকিব নাসিমের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “নেতাদের ডিগ্রেডেশন তখনই শুরু হয়, যখন থেকে মানুষের ডিগ্রেডেশন হয়। লাইক পিপল, লাইক গভর্নমেন্ট। ঘৃণার চাষ হচ্ছে, এত কিছুর পরে ডিজে, গিমিক জিতছে, দেখা ছাড়া তো উপায় নেই আমাদের”।

নাসিম বলল, “কী হয়েছে বাবা? তুমি আজ এসব বলছো?”

রাকিব বললেন, “কিছু না, তুই ঘুমো গিয়ে। সারাদিন যা দৌড় ঝাঁপ চলছে, অসুস্থ হয়ে পড়বি”।

নাসিম বলল, “আমি কোয়ারান্টাইনে থাকব ভাবছি। রোজই তো কোন না কোন কোভিড পেশেন্টের কাছে যাই। তোমাদের হয়ে গেলে বিপদ”।

রাকিব বললেন, “হলে হবে। যা হবে দেখা যাবে। অত ভাবিস না। রোগের থেকেও রোগের ভয় বড় হয়ে গেলে বিপদ। মন শক্ত থাকলে মানুষ ক্যান্সারকে হারাতে পারে, কোভিড কোন ছার। আর শোন, যাই হোক, মার কাছে গিয়ে মাঝে মাঝে বসিস। তোর মা তোকে নিয়ে ভয়ে থাকে বুঝতে পারি। রেগে যায়, বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছিস। ভিতরে ভিতরে গর্বিত হয় বুঝতে পারি। ঘরে নিরাপদ আশ্রয়ে না থেকে মানুষের জন্য এভাবে কতজন কাজ করতে পারে? এ সবার কম্মো নয়। জানিস তো, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবকে অনেকেই মন থেকে সমর্থন করতেন। রবীন্দ্রনাথও করতেন। ভাল ভাল বাড়ির ছেলেগুলো মোস্ট ওয়ান্টেড হয়ে গেল। দেশের মানুষের জন্যই তো। সময় পাল্টাচ্ছে, মানুষ উপকার পাবার পর পাল্টে যেতেই পারে, কাজটা থাকুক। কাজটা থাকার বড্ড দরকার আছে। রাত্রির বাবা এত কিছু করার পরও তুই ওদের বাড়ি গেছিস, মনের ভিতর রাগকে ঘর বাঁধতে দিস নি, এটা যে কত বড় পরিণতিবোধ, সেটা তুই নিজেও কল্পনা করতে পারবি না। আরো বেশি করে পড়াশোনা কর। মার্ক্স পড়, কেন শ্রমিক শ্রেণী, কৃষক শ্রেণীর কথা বেশি করে ভাবা দরকার বুঝতে চেষ্টা কর। এই দেখ, এত বড় লকডাউন করে দিল, একবারও দেশের নেতারা ভাবল না গরীব মানুষের কী হবে। বিকল্প কী। তারা কী খাবে। পরিযায়ী শ্রমিকরা কী করবে। এটা কেন করতে পারল? বামপন্থীরা শক্তিশালী নেই বলে। বামপন্থা শক্তিশালী না হলে এটা হবেই। ভারতবর্ষের বামপন্থাকে দরকার ছিল”।

রাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “অনেক বাজে লেকচার দিয়ে ফেললাম। তুই ঘুমো”।

নাসিম বলল, “না না। বল। তুমি তো বেশি বল না কারেন্ট এফেয়ারস নিয়ে। শুনতে ভাল লাগছিল”।

রাকিব বললেন, “একটা কথা মনে রাখিস, পার্টি থাকুক বা না থাকুক, মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার চেষ্টা করিস। ঠিক সময়ে মানুষকে জাগতেই হবে একদিন। ক্যাপিটালিজমের সমস্ত জারিজুরি এই ধরণের প্যান্ডেমিকে শেষ হয়ে যাবে। মানুষের পাশে সেই মানুষকেই দাঁড়াতে হবে। সমাজ পাল্টাবে, মানুষের মূল্যবোধ বদলে যাবে, কিছু বেসিক ব্যাপার কোন দিন পাল্টাবে না। যে লোকটাকে তার নিজের বাড়ির লোক একঘরে করে দিত কোভিড হয়েছে বলে, অ্যাম্বুলেন্স চালক গাড়িতে তুলতে পর্যন্ত অস্বীকার করত, রেড ভলান্টিয়াররা আসার পরে সে দৃশ্যের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। হ্যাঁ। তুই নিশ্চিন্ত থাক, যাদের জন্য করেছিস, তারা তোদের নিশ্চয়ই ভুলে যাবে। তা বলে তোদের ভুললে চলবে না। পার্টির বেসিকটা ওখানেই। আবার যদি মানুষের দরকার পড়ে, আবার যাবি। বারবার যাবি। যত প্রতিকূলতাই আসুক”।

নাসিম বলল, “যাব। নিশ্চয়ই যাব”।

রাকিব বললেন, “রাত্রি কেমন আছে?”

নাসিম যন্ত্রণাক্লিষ্ট চোখে বাবার দিকে তাকাল।

৪২

সারারাত ছটফট করে শেষ রাতের দিকে ঘুমোতে পেরেছিলেন তনয়া। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলেন।

সকাল সাতটা হওয়া মাত্র উঠে রাত্রির ঘরে গেলেন। ডাক্তারবাবু মাস্ক পরে থাকতে বলেছেন।

একটা না। দুটো মাস্ক।

তনয়া দুটো মাস্ক পরে রাত্রির ঘরে গিয়ে দেখলেন রাত্রি কাশছে। বললেন, “কখন উঠেছিস?”

রাত্রি বলল, “সেই ভোর পাঁচটা থেকে উঠে বসে আছি। খুকখুকে কাশি হচ্ছে শুধু”।

তনয়া বললেন, “তোর বাবার তো বুকে ব্যথা ট্যাথা উঠে একাকার। সেই নাসিমকেই ডাকতে হল। ওরা এসে হাসপাতালে নিয়ে গেল”।

রাত্রি বলল, “বাবার কি তাতে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয়েছে?”

তনয়া হাসলেন, “নাহ। বলছে ওগুলো ইচ্ছা করে করছে। ইমপ্রেস করার জন্য করছে”।

রাত্রি জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, নাসিম ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন”?

তনয়া জানলার বাইরে নাসিমকে দেখে চমকে উঠে বললেন, “দাঁড়া। কথা বলি। চিন্তা করছে ছেলেটা। সারারাত জেগেছিল। কী ভাল ছেলেরে”।

রাত্রি কিছু বলল না।

তনয়া বাইরে গিয়ে নাসিমকে ডাকলেন।

নাসিম বলল, “কাকুর টেস্ট করাতে আসতে বলেছি ল্যাবের লোককে। একটু পরে আসবে”।

তনয়া বুঝলেন নাসিম আসলে রাত্রির খবর জানতে চাইছে। বললেন, “রাত্রির কাশি আছে। শরীর ঠিক নেই। রেজাল্ট তাও কখন আসবে?”

নাসিম বলল, “কোন ঠিক নেই। এত এত টেস্ট হচ্ছে, রেজাল্ট আসতে আসতে আজ রাত বা কাল সকাল। কখনো চার পাঁচ দিনও লেগে যাচ্ছে”।

তনয়া বললেন “গোমূত্র খাইয়েছে। কোত্থেকে কতগুলো লোক এসে এসব করে দিল। তোমরা পিটিয়ে দিতে পারলে না?”

নাসিম ম্লান হাসল, “সেটা কী করে হয় কাকীমা? আমরা না বহিরাগত? ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে যায় তো তাহলে”।

তনয়া বললেন, “মারা উচিত ছিল। তোমরা বহিরাগত নও। ওরা বহিরাগত। অহিংসা কখনোই সব কিছুর সমাধান হয় না”।

প্রণয় বাইরে এসে নাসিমকে দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

নাসিম বলল, “আমি আসি তাহলে কাকীমা। কোন দরকার হলে বলবেন”।

তনয়া বুঝলেন প্রণয়কে দেখে নাসিম সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তিনি প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি সুস্থ হয়েছো? তাহলে নাসিমকে চলে যেতে বলব। অসুস্থ হলে তো ওকে দরকার পড়বে। হয়েছো সুস্থ?”

প্রণয় হাঁ করে তনয়ার দিকে তাকালেন।

নাসিম বলল, “আমি আসি কাকীমা”।

তনয়া বললেন, “তুমি কি অক্সিমিটার নিয়ে এসেছো? রাত্রির অক্সিজেনটা দেখা দরকার ছিল”।

নাসিম প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন তো আনি নি। নিয়ে আসব পরে”।

তনয়া মাথা নাড়লেন, “ঠিক আছে”।

নাসিম যেতেই প্রণয় গম্ভীর মুখে ঘরের ভিতর গিয়ে বসলেন।

তনয়া ঘরে ঢুকতে প্রণয় বললেন, “ছেলেটা সকাল সকাল চলে এসেছে? বাহ বাহ। বেশ”।

প্রণয়ের গলায় শ্লেষের ছোঁয়া।

তনয়া বললেন, “তোমার ওই হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের লোকজনকে তো দেখলাম না। বিপদে ছেলেটাই এল। আমি কী করব বল? বলে গেল তোমার টেস্ট করার লোক ঠিক করেছে। আসবে কিছুক্ষণ বাদে। সে হিন্দুই”।

প্রণয় গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।

তনয়া বললেন, “কী হল? এবার কী হয়েছে?”

প্রণয় বললেন, “ছেলেটার সঙ্গে কী শলা করছিলে? মেয়েটাকে কীভাবে মুসলমান করবে?”

তনয়া প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার মেয়েটা অসুস্থ। এখনো তোমার মাথায় এগুলো কাজ করে চলেছে? তুমি ধন্য”।

প্রণয় বললেন, “বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারগুলো তোমায় ক্ষমা করবে না”।

তনয়া বললেন, “না করলে না করবে। আমার মেয়ের জন্য কে ভাল সেটা অন্য লোকে ঠিক করে দেবে কেন? আর আমি এসব কথা শুনবই না এখন। কত কত মানুষ মারা যাচ্ছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, অক্সিজেন নেই, এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমি তোমার লেকচার শুনতে পারব না”।

প্রণয় কাশতে শুরু করলেন।

তনয়া বললেন, “তোমারও কাশি হচ্ছে? আজকেই কোভিড টেস্ট করাতে হবে। নাসিমকে বলি”।

প্রণয় বললেন, “আমি একবার চেষ্টা করি। আমাদের গুরুজীকে ফোন করব। তোমার ফোনটা দাও। আজকে আসতে পারেন। বলেছিলেন”।

তনয়া ফোন এনে দিলেন। প্রণয় ফোন করলেন। তিনি কোভিড সাসপেক্ট জানালেন।

কয়েক সেকেন্ড কথা বলে ফোন রেখে বললেন, “উনি জানালেন এই উইকে বিজি আছেন। নেক্সট উইকে দেখছেন”।

তনয়া বললেন “নাসিমকে বলছি। ব্লাড স্যাম্পেল দিয়ে টেস্ট করিয়ে এসো। ও থাকলে অসুবিধা হবে না। দয়া করে টেস্টটা করাও তেজ না দেখিয়ে”।

প্রণয় বললেন, “দরকার নেই। আমি একাই যাব”।

বলে আবার কাশতে শুরু করলেন।

তনয়া বললেন, “যেমন তোমার ইচ্ছা”।

#

সকাল দশটা নাগাদ দেখা গেল প্রণয়কে নিয়ে নাসিম টেস্ট করাতে লাইন দিয়েছে।

৪৩

“তুমি নামাজ পড়?”

প্রণয় নাসিমের বাইকে ওঠার আগে প্রশ্ন করলেন। খানিকক্ষণ আগে তার স্যাম্পেল নেওয়া হয়েছে।

নাসিম বলল, “হ্যাঁ”।

প্রণয় গম্ভীর মুখে বললেন, “বীফ খাও?”

নাসিম বলল, “হ্যাঁ। খাই”।

প্রণয় নাক মুখ কুঁচকে বললেন, “আজ যদি গুরুজী লোক পাঠাতেন, আমি কিছুতেই তোমার সঙ্গে যেতাম না”।

নাসিম বলল, “টোটো ডেকে দেব?”

প্রণয় বললেন, “থাক। ডাকতে হবে না। তোমার কী মনে হয়? আমার হার্টে প্রবলেম আছে?”

নাসিম বলল, “না বোধ হয়। ডাক্তারবাবু বলছিলেন অবেলায় খাওয়া দাওয়ার জন্য গ্যাস হয়েছিল, আর অ্যাংজাইটি তো আছে”।

প্রণয় বললেন, “তোমাকে দেখে তো শিক্ষিত বলে মনে হয়। রেড ভলান্টিয়ার হলে কেন?”

নাসিম বলল, “ওই জন্যই তো হয়েছি”।

প্রণয় বললেন, “যত্তসব। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। চল আমাকে নামিয়ে দিয়ে এসো”।

নাসিম বাইকে বসল। প্রণয় তার পিছনে।

কিছুক্ষণ পরে প্রণয়ের বাড়ির সামনে দাঁড়াল নাসিমের বাইক। প্রণয় বললেন, “যদিও তুমি পিপিই পরে আছো, তবু গিয়ে স্নান কোর”।

নাসিম বলল, “রোজই করি”।

প্রণয় বললেন, “অক্সিমিটার এনেছো? রাত্রি আর আমার অক্সিজেনটাও দেখে যাও”।

নাসিম বলল, “ঠিক আছে”।

তনয়া এসেছিলেন। প্রণয়কে শান্ত মুখে ঘরের ভিতর ঢুকতে দেখে অবাক হলেন।

রাত্রি ঘরে শুয়েছিল।

নাসিম রাত্রির অক্সিজেন মেপে বলল, “আটানব্বই। ঠিক আছে। জ্বরের ওষুধ ডাক্তারবাবুর কথা শুনে খেয়ে যেতে হবে”।

রাত্রি নাসিমের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে বাবা ঘরে ঢুকতে দিল?”

তনয়া বললেন, “তোর বাবাকে নিয়ে টেস্ট করিয়ে এসেছে ছোকরা”।

রাত্রি অবাক হয়ে তনয়ার দিকে তাকাল।

তনয়া বললেন, “অবাক হচ্ছিস? আমি অবাক হই নি। কেউ আসে নি কোভিড সাসপেক্ট শুনে। আর তোর বাবার ওই বিষ ফোনটা আমি ভেঙে দিয়েছি। কাজেই মগজ ধোলাইটা বন্ধ আছে এখন”।

রাত্রি হেসে ফেলল। নাসিমও।

নাসিম বলল, “আমি আসি তাহলে। দরকার হলে ফোন করবেন”।

তনয়া বললেন, “দরকার ছাড়াও ফোন করব”।

নাসিম হাসল, “নিশ্চয়ই”।

তনয়া বললেন, “এই পিপিই পরে থাকাটা বড় কষ্টকর। তোমাকে আটকে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না”।

নাসিম বলল, “না না, ঠিক আছি”।

রাত্রি বলল, “নীপা ঠিক আছে?”

নাসিম বলল, “হ্যাঁ। সবাই ঠিক। আমি আসি”।

রাত্রি বলল, “সাবধানে যেও”।

নাসিম বলল, “সেরে ওঠো’।

রাত্রি বলল, “দেখা যাক”।

নাসিম ঘরের বাইরে বেরোল। ড্রইং রুমে প্রণয় বসে আছেন চুপ করে। তাকে দেখে বললেন, “রাত বিরেতে এদিক সেদিক যেতে হয়, সাবধানে বাইক চালাবে”।

তনয়া অবাক হয়ে প্রণয়ের দিকে তাকালেন। তিনি ভাবতেই পারেন নি প্রণয় এই কথাটা বলবেন।

প্রণয় সেটা বুঝে বললেন, “কাজ করছে, সাবধান হওয়া উচিত”।

তনয়া বললেন, “তা হোক না। মোল্লা তো। ওকে নিয়ে ভাবছো কেন?”

অনেকদিন পরে তনয়া প্রণয়ের মুখে লজ্জা দেখতে পেলেন। প্রণয় বললেন, “কিছু না। সাবধানে যায় যেন। বলে দাও”।

নাসিম বেরোল।

তনয়া প্রণয়ের সামনে বসে বললেন, “তোমার মাথা থেকে একটা ভূত নেমেছে মনে হচ্ছে। মাথাটা হালকা লাগছে?”

প্রণয় বললেন, “কীসের ভূত? কিচ্ছু না। সব ঠিক আছে”।

তনয়া বললেন, “তাহলে এত ভাল ভাল কথা বলছ মোল্লাটাকে নিয়ে?”

প্রণয় তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাজে বোকো না তো। আমি কোথায় ভাল ভাল কথা বলছি? নর্মাল কথা বলছি”।

তনয়া হাসলেন, “ও। ঠিক আছে”।

প্রণয় রেগে গিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলেন।

তনয়া রাত্রির কাছে গিয়ে বসলেন।

রাত্রি বলল, “বাবার কী হয়েছে মা? আমি তো ভাবতেই পারছি না নাসিম এখানে এসেছিল”।

তনয়া বললেন, “আমিও না। এত এত ঝাল ঝাল মেসেজ, এত মোল্লাবিরোধী লোক, বাপরে, আজ আবার কী হল কে জানে”।

রাত্রি হাসল, “অসুখটা সারছে বোধহয়”।

তনয়া বললেন, “কোভিড? সেরে গেছে তোর?”

রাত্রি মাথা নাড়ল, “না মা। কোভিডের থেকেও ভয়ংকর যে অসুখ, সেটা। কোভিড তো কোন অসুখই না। তার থেকে অনেক কঠিন অসুখে ভুগছে অনেকে বাবার মত। সে অসুখটা সারা বেশি জরুরি”।

তনয়া বললেন, “আমার বাচ্চাটা বড় হয়ে গেছে”।

রাত্রি হাসল।

৪৪

নাসিম স্নান করতে গিয়ে বুঝতে পারল তার জ্বর আসছে।

গলার কাছে কিছু একটা ঘোরাফেরা করছে।

নীপা বলল, “এই দাদা, রাত্রিদির কী খবর রে?”

নাসিম বলল, “তুই ঘরে যা। আমার জ্বর আসছে মনে হচ্ছে। ধারে কাছে থাকিস না”।

নীপা বলল, “কথা তো বলতে পারি। যথেষ্ট দূরত্ব আছে”।

নাসিম বলল, “খবর ঠিক আছে। অক্সিজেন তো ঠিকই দেখলাম”।

নীপা বলল, “তোর জ্বর আসছে কেন মনে হচ্ছে?”

নাসিম বলল, “গা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে”।

নীপা বলল, “মা শুনলে রণক্ষেত্র করবে। তুই ছবি হয়ে যাবি। বলবে বার বার বলেছিলাম, কেন যাস?”

নাসিমের স্নান হয়ে গেছিল। গামছা দিয়ে মাথা মুছছিল।

নীপা বলল, “এ কী রে দাদা, তোর চোখও তো লাল মনে হচ্ছে”।

নাসিম বলল, “আমি বাইরের ঘরে থাকছি। তুই থার্মোমিটারটা দিয়ে যা”।

নীপা বলল, “ঠিক আছে। আমি তোর জামা কাপড় দিয়ে যাচ্ছি”।

নাসিম বাইরের ঘরের খাটে গিয়ে শুল।

নীপা থার্মোমিটার দিল টুলের উপর।

নাসিম টেম্পারেচার নিয়ে বলল, “শুরুতেই সেঞ্চুরি করে দিয়েছি। ফাটাফাটি”।

নীপা ফ্যাকাসে মুখে বলল, “এবার কী হবে?”

নাসিম বলল, “ও কিছু হবে না। চিন্তা করিস না। তুই এখানে থাকিস না। দূরে থাক। আর স্যানিটাইজ কর বাইরেটা। যা”।

নীপা ছটফট করতে করতে ঘরের ভিতরে গিয়ে শায়লাকে খবর দিল।

শায়লা সঙ্গে সঙ্গে এলেন। বললেন, “বার বার বলেছিলাম। কেন যাস? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আর ভাল লাগে না আমার”।

নাসিম হেসে ফেলল, “জাস্ট এই কথাগুলোই নীপা বলছিল, তুমি এগুলো বলবে বলে”।

শায়লা বললেন, “এটা হাসির সময়? এবার কী হবে?”

নাসিম বলল, “ঠিক হয়ে যাবে। ভেবো না। রেস্ট নিতে হবে। ঋপণদাকে ডেকে ডাক্তার দেখিয়ে আসব। কোন চাপ নেই”।

শায়লা বললেন, “আমার ঠিক এই ভয়টাই হচ্ছিল”।

শায়লাকে অস্থির হতে দেখে নাসিম বলল, “তুমি অত ভেবো না মা। তুমি এখানে থেকো না। দূরে থাকো। এই রোগে আর কিচ্ছু ম্যাটার করে না। ক’দিন কোয়ারান্টাইনে থাকব, ওষুধ খাব, সব ঠিক হয়ে যাবে”।

শায়লা রেগে গেলেন, “বিরাট বড় বোদ্ধা হয়ে গেছিস তুই, তাই না? সব জেনে গেছিস? যারা সকাল বিকাল গালাগাল দিচ্ছে, খ্যাপাচ্ছে, তাদের জন্য প্রাণ কেঁদে উঠল একবারে। নে এবার কী করবি”।

নাসিম চুপ করে গেল।

শায়লা গজগজ করতে করতে ঘরে চলে গেলেন।

#

সন্ধ্যের দিকে নাসিমের একশো দুইয়ের বেশি জ্বর চলে এল। গায়ে হাত পায়ে প্রবল ব্যথা।

তার ফোন বাজছিল।

নাসিম কোন মতে ফোন ধরল, রাত্রির গলা ভেসে এল, “কী খবর?”

নাসিম হাসার চেষ্টা করল, “এই তো। বাড়িতে। তুমি কেমন আছো?”

রাত্রি বলল, “জ্বর কম কম লাগছে। এ যাত্রায় বেঁচে যাবো মনে হচ্ছে। তুমি তো যাতা কাণ্ড করে দিয়েছো। একবারে বাবার ডিফেন্স ভেদ করে দিয়েছো। বাবার সেই অ্যাগ্রেসিভ ভাবটাই সকাল থেকে গায়েব দেখতে পারছি”।

নাসিম বলল, “খুব ভাল”।

রাত্রি বলল, “বিকেলের দিকে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম জানো। ভাবছিলাম তুমি আসবে বোধ হয়। এলে না কেন? কোথাও গেছিলে?”

নাসিম বলল, “হ্যাঁ, ব্যস্ত ছিলাম আর কী”।

রাত্রি বলল, “তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না? একটু সুস্থ হয়েই তোমাকে ফোন করলাম, আর এরকম করে কথা বলছো কেন? কী হয়েছে?”

নাসিম বলল, “কোই, কিছু না তো”!

রাত্রি বলল, “হু। নীপা ঠিক আছে? কাকু, কাকীমা?”

নাসিম বলল, “হ্যাঁ। ঠিক আছে”।

রাত্রি বলল, “নীপার নাম্বারটা দেবে? কথা বলব”।

নাসিম বলল, “ঠিক আছে পাঠাচ্ছি”।

ফোন রেখে রাত্রিকে নীপার নাম্বার পাঠাল নাসিম।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তার ফোন বেজে উঠল, রাত্রি থমথমে গলায় বলল, “তুমি আমাকে বলবে না, তোমার জ্বর এসেছে?”

নাসিম বলল, “বলতাম। ভুলে গেছি বলতে। ভেবো না। ঠিক আছি”।

রাত্রি বলল, “এবার কী করবে? তোমাদের ভলান্টিয়ারদের বলবে? অক্সিজেন দেখেছো?”

নাসিম বলল, “দেখছি। ভেবো না”।

রাত্রি বক বক করে যেতে লাগল।

নাসিমের হঠাৎ বমি পেল।

সে ফোন রেখে বাইরের বাথরুমে গিয়ে বমি করে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *