2 of 2

৬৬. দিসাওয়াল সাহেবের বিড়িপাতার কাজ

দিসাওয়াল সাহেবের বিড়িপাতার কাজ শুরু হয়েছে সবে।

অন্য অঞ্চলের জঙ্গল হলে কাজ এতদিনে এগিয়ে যেত অনেক কিন্তু এই অঞ্চলে গরম দেরি করে পড়ায় একটু দেরিতেই শুরু হয়েছে।

জঙ্গলের মধ্যে কুলিদের ক্যাম্প এবং পাতা কালেকশনের ডেরা সবে ঠিক-ঠাক করা হচ্ছে। গত বর্ষার বৃষ্টিতে ঝুপড়িগুলোর চাল পচে, খসে, ঝড়ে উড়ে গেছে। খুঁটিও নড়ে গেছে অনেক। কিছু তো পড়ে গেছে। এই সব মেরামত করার কাজ সবে শেষ হয়েছে। পুরনো কুলিসর্দার গাণ্ডেরী সিং মারা গেছিল শীতের গোড়ায় তিনদিনের জ্বরে। নতুন সর্দার হুকমত হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে লেবারদের নিয়ে। বয়সে গাণ্ডেরী তরুণ এবং অনভিজ্ঞ। সে কারণেই পৃথুকে দিসাওয়াল সাহেবের অনুরোধ পুরো ব্যাপারটা তত্ত্বাবধান করে মসৃণভাবে যাতে কাজ চালু হয় এবং থাকে তাই পৃথু এখানে এসেছে। দিন সাতেক থাকতে হবে। দিসাওয়াল সাহেবের ধারণা পৃথু নাকি ওঁর চেয়েও ভালভাবে এ বছরের পাতার ফলন, গুণগত মানের রকম এবং কবে নাগাদ সব পাতা জঙ্গল থেকে সীওনীতে নিয়ে এসে পাইকারদের দিয়ে দেওয়া যাবে সে সম্বন্ধে ধারণা করতে পারবে।

কেঁদ গাছের পাতাই বিড়িপাতা। কিন্তু সময় মতো পেড়ে, সময়ে, মানে বৃষ্টিনামার আগে আগেই চালান না করতে পারলে সবই মাটি। নরকি-কিল্লার কাছে রাস্তাটার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে আছে। গত বছরে ফরেস্ট করপোরেশনের ঠিকাদার বোধহয় পুরো টাকাটাই খেয়ে নিয়েছে, নইলে এক বর্ষায়। পথের হাল এমন হত না। এখন নিজেদের পয়সাতেই মেরামত করতে হবে, নইলে ট্রাক যাবে না। দুটো নদীও পেরোতে হয় আসতে হলে সান্দুর-এ। নদীতে নামার ও ওঠার জায়গাগুলোরও ভাল মেরামতি দরকার। কাজ যখন পুরোদমে শুরু হবে তখন একেবারে দক্ষযজ্ঞ।

বিড়িপাতার দাম এক এক বছরে এক একরকম থাকে, অন্যান্য সমস্ত জাংগল-প্রস-এরই মতো। আশে পাশের অন্যান্য জঙ্গলের ফলনও দামের উপর প্রভাব ফেলে।

সাত দিনের ট্রিপ-এ আসার আগে কুর্চি বলেছিল আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন পৃথুদা? যদিও জংগল পাহাড়ের পরিবেশে কাটিয়েছি অনেকই দিন তবু একেবারে জঙ্গলের বুকের মধ্যে সাতদিন কুঁড়ে ঘরে থাকার অভিজ্ঞতা কখনওই হয়নি আমার। তা ছাড়া, আপনার সঙ্গে জঙ্গলে থাকাও তো একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। ভাবব, এইই আমাদের না-বিয়ে-হওয়া কৃষ্ণপক্ষর হানিমুন। মনে মধু থাকলেই হল, চাঁদে নাইই বা থাকল।

হেসে বলেছিল পৃথু। বেশ তো। চলো। তবে, তোমার মনে আমার সম্বন্ধে যা আছে তা মনেই রেখো। অন্যে শুনলে ভাবতে পারে নিজের সম্বন্ধে আমি অরণ্যদেবের মতো কোনও ইমেজ গড়ে তুলেছি তোমার মনে। জঙ্গলের কতটুকুই বা জানি। ভালবাসি, এই পর্যন্ত।

যতটুকু জানেন, তাইই আমার কাছে অনেকখানি। ভালই হল। আমাদের দুজনের মনের উপর দিয়েই যা বয়ে গেছে তাতে একটা ছুটির দরকার ছিল দুজনেরই।

পৃথু বলেছিল, আমার তো নিরন্তরই ছুটি। কাজ আর করলাম কোথায় জীবনে? যা করেছি সবই প্রায় অকাজ।

ঈসস ভাবতেই ভাল লাগছে। গভীর বনের মধ্যে পর্ণকুটিরে থাকব আপনার সঙ্গে। জায়গাটার কী নাম?

সান্দুর। জীপে যেতে এখান থেকে ঘণ্টাখানেক লাগবে। পথ বেশি নয় তবে খারাপ। তাইই সময় লাগে।

এখানে আসার পর থেকে কুর্চি বন-মুগ্ধ হয়ে রয়েছে। প্রকৃতির তো সত্যিই কোনও বিকল্প নেই। চাঁদে পা-দেওয়া মানুষ, কম্পিউটার-নির্ভর মানুষ, হাইড্রোজেন বোমা বানানো মানুষ সকলেরই প্রকৃত মুক্তি নিহিত আছে এই প্রকৃতিরই মধ্যে। প্রকৃতি থেকে যতই আধুনিক মানুষ বিযুক্ত হয়ে পড়ছে, ততই সে অমানুষ হয়ে উঠছে।

আজকে পঞ্চম দিন। আজ সকালে ঘুম ভেঙেই পৃথুর কোমর জড়িয়ে শুয়ে কুর্চি বলেছিল, সারা জীবন এখানে থাকতে পারি না আমরা?

পৃথু হেসেছিল। বলেছিল, তোমার মতো অনেক বন-বিলাসীই এক বছর একটানা এই রকম জায়গায় থাকলে আর কখনও জঙ্গলের মুখই দেখতে চাইবে না। শহুরেদের পক্ষে, প্রকৃতি খুব সুন্দর, ফর আ চেঞ্জ। জঙ্গলের ভালটাতে মুগ্ধ হওয়া সোজা, খারাপ যেটুকু আছে তা সকলের সয় না।

একটি পাহাড়ি ঝোরা সোজা বয়ে গেছে ডেরার ঠিক পিছন দিয়ে। এখানে নদীটা খরস্রোতা। নদীর নামও সান্দুর। নদীর নামেই জায়গার নাম। এক কোমর জল আছে এখানে এবং গ্রীষ্ম যখন তুঙ্গে তখনও এক হাঁটু জল নাকি থাকবে, হুকমত সিং বলছিল। এই জলই ডেরায় এবং কুলি ঝুপড়ির সকলের পানীয় জলের উৎস। চান করা, কাপড়-চোপড় কাচা এবং অন্যান্য প্রয়োজনও মেটাতে হয় ওই জলেই। সব সময় ঝরঝরানি শব্দ। রাত যত গভীর হতে থাকে এই শব্দও তত জোর হতে থাকে। ঝরনা এক আশ্চর্য ফুলেরই মতো ঝরে যাচ্ছে ফুটে থেকেই। নিশিদিন। দিনের বেলা মনে হয় তার স্বর যেন বি-ফ্ল্যাটে বাঁধা। আর গভীর রাতে সি-শার্প-এ। যে-কেউই গলা মিলিয়ে তার সঙ্গে গাইতে পারে গান, ইচ্ছে যদি হয়।

কুর্চি শালকাঠের তক্তার মাচার বিছানাতে উঠে বসে পাল্লাহীন জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে বলেছিল, সত্যি পৃথুদা, ঠাট্টা নয়। পারি না থাকতে সারা জীবন? এই রকম জীবনের স্বপ্নই দেখেছিলাম ছোটবেলা থেকে।

পৃথু বলল, যাবে না কেন? তবে জঙ্গলে থাকলে জংলীদের মতোই থাকতে হবে। সারা জীবন তো লোকে থাকেই। কাছেই সান্দুর বস্তি। সেখানের মানুষরা তো এখানেই থাকে। তবে, তোমার সঙ্গে বোধহয় এইই ভাল। একমাত্র মহিলা তুমি এই ক্যাম্পে। এতজন পুরুষের লুব্ধ চোখের সামনে তুমি একা। ভাল লাগে না?

পুরুষের চোখ মাত্রই তো লুব্ধ। সে এখানে আর ওখানে কি? এইটা ভেবেই খারাপ লাগে। সুন্দর করে যারা তাকাতে পর্যন্ত পারে না তাদেরই চাওয়ার শেষ নেই।

বেশি সুন্দর করে তাকালে বোধহয় তোমরা বুঝতে পর্যন্ত পারো না যে তোমাদের চাইছে তারা।

হেসে ফেলল, কুর্চি। বলল, কথায় পারব না।

সান্দুরের জঙ্গলে এসে কুর্চিও যেন সত্যিই জংলী হয়ে উঠেছে। এই কুর্চিকে ভয় পেতে শুরু করেছে পৃথু। সব মেয়েই কি কুর্চিরই মতো? কে জানে? হাতে হাত রাখলে, পাখির পালকের মতো মসৃণ একটি চুমু খেতে চাইলে লজ্জায়, ভয়ে মরে যেত যে মেয়ে, তারই এই রূপ দেখে অবাক তো হতেই হয়। ‘সেক্স’ ব্যাপারটাতে ওদের ভীষণই ভীতি এবং অপরাধবোধ। কিন্তু সেটা কেটে গেলে একেবারেই অন্যরকম হয়ে ওঠে বোধহয়। কে জানত যে, তার কুর্চির মধ্যেও এমন একজন মেয়ে বাস করত?

আসলে, পৃথু একটি ফারস্ট-রেট ইডিয়ট। না বুঝতে পারল রুষাকে, না কুর্চিকে। মেয়েরা কি আসলে একেবারেই রোম্যান্টিক নয়? পৃথুদের চেয়ে ইদুরকারদের দামই তাই বেশি ওদের কাছে? অথচ পুরুষের সব রোম্যান্টিকতা ওদেরই ঘিরে। মেয়েরা যতখানি শরীর-সর্ব, শরীর-নির্ভর, ততখানি পুরুষরাও নয়। অবশ্য দুজনকে দেখেই সব মেয়েদের সম্বন্ধে ধারণা করা অনুচিত। এই বিষয়ে পৃথুর অভিজ্ঞতা অতি সীমিত।

কাজ যতটুকু, তা ভোর বেলা উঠে শুরু করে দিত পৃথু। একবার ফিরে এসে নাস্তা করত। আবার বেরিয়ে যেত। দুপুরে ফিরে খেতে খেতে দেড়টা দুটো হত। তারপর আর কোনও কাজ থাকত না। কুর্চিকে নিয়ে, জঙ্গলে বেড়িয়ে বেড়াত। কখনও জীপ নিয়ে যেত, ড্রাইভারকে নিয়ে। কখনও হেঁটে। রাস্তার একজন লোক অবশ্য আছে এই ক্যাম্পের মেস-এ। কিন্তু পৃথুর রান্না কুর্চিই করত। দুজনের মতো। কাল দুপুরে এঁচোড়ের তরকারি বেঁধেছিল। পরশু বিকেলে জংগলে বেড়াতে গিয়ে জংলী কাঁঠালের গাছ থেকে পেড়ে এনেছিল দুজনে মিলে। তেঁতুল দিয়ে এঁচোড়ের টকও বেঁধেছিল। মোটা চালের সোঁদাগন্ধ ভাত, অড়হরের ডাল, জম্পেস করে ঘি ঢেলে তাতে কাঁচালঙ্কা আর হিং দিয়ে বেঁধেছিল কুর্চি। রান্নার গুণে এঁচোড়টা তো মাংস বলেই মনে হচ্ছিল। কেউ যত্ন করে নিজে হাতে বেঁধে সামনে বসে এমন আদর করে খাওয়ালে নিজের কাছে নিজের দামই বেড়ে যায় যেন। শব্দহীন অথচ তীব্রভাবে সোচ্চার হয়ে থাকা দীর্ঘদিনের সমস্ত ইনডিগনিটিজ এবং মিসডিমেনুরের দুঃখ ভুলেই যেতে ইচ্ছে করে চিরদিনের মতো।

রুষা তাকে যা দিত, তা পেলে হয়তো অন্য কোনও পুরুষ বর্তে যেতেন, কিন্তু সেই আড়ম্বর ও বাহুল্যে ও বিদিশিপনাতে পৃথুর প্রয়োজন ছিল না কোনওই। কুর্চি যেন পৃথুরই জন্যে জন্মেছিল এবং পৃথু কুর্চির জন্যে, শরীরে মনে। সিগারেট কোম্পানি খোঁজ পেলে, তাঁদের মেড ফর ইচ আদারের প্রাইজটা নির্ঘাৎ দিয়ে দিতেন ওদের দুজনকে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। পার্টি-ড্রেসে সেজেগুজে যাওয়া দম্পতিদেরই এঁরা এই পুরস্কার দেন। বাহ্যিক মিল দেখে। আসলে হয়তো দেওয়া উচিত ছিল পৃথু ও কুর্চিরই মতো দম্পতিকে, যাঁরা আত্মিক মিলে একে অন্যের পরিপূরক।

কুর্চি রাতের বেলাতেও বেরতে চায় হেঁটে। পৃথু, আজকাল ‘ক্রাচ-নির্ভর’ হওয়ায় অন্ধকার রাতে আর আগের মতো অনায়াস নয়। তা ছাড়া কৃষ্ণপক্ষর রাত। তার উপর সান্দুর জায়গাটা সীওনী থেকে অনেকই নীচে। গরমের দিনে সাপ ও বিছে আছে নানারকম। তবে, একরাতে জীপ ও ড্রাইভার নিয়ে কুর্চিকে রাতের বন দেখিয়ে এনেছিল দুর্গম প্রায় দুরতিগম্য সব রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে। নাইটজার পাখিরা তাদের লাল লাল চোখ জ্বেলে কী করে বনপথ আঁকড়ে বসে থেকে একেবারে শেষ মুহূর্তে সোজা উপরে ওঠে, ওড়ে, তা দেখিয়েছে পৃথু কুর্চিকে। মনে হয়, যেন জীপের বনেট ফুঁড়েই উঠল পাখিরা। জীপ যত জোরেই যাক না কেন, কখনও বন-পথে বসে-থাকা নাইটজার পাখি নীচে চাপা পড়েছে বলে জানা নেই ওর তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায়।

চিতল হরিণের চোখ রাতে কী ভাবে জ্বলে আলো পড়ে, দুই জ্বলন্ত চোখের উচ্চতা ব্যবধান এবং চোখ ঘোরানোর ভঙ্গি দেখে এবং সেই চোখের আলোর রঙ দেখেই সেই জানোয়ার নিরামিষাশী না মাংসাশী তা বোঝা যায়। এই দুই শ্রেণীর মধ্যে সেই জ্বলজ্বলে চোখের মালিক যে কোন বিশেষ জানোয়ার তাও কী করে বুঝতে হয় পৃথুর কাছ থেকে কুর্চি এই সব খুঁটিনাটিও জেনে নিতে লাগল। জেনে নিতে পারে সহজেই কেউ। কিন্তু জঙ্গলের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হতে অনেকই বছর লেগে যায়। কখনও কখনও সারা জীবন। কনডেনসড কোর্স নেই এখানে। থিওরির সঙ্গে প্র্যাকটিস অঙ্গাঙ্গীভাবে মিলে আছে।

কুর্চি সখেদে বলল, এতগুলো বছর চলে গেল, মিছিমিছি পৃথুদা এইবারে…

কালো কালো পাথরছড়ানো একটি এলাকায় একদল বুনো শুয়োর দেখা গেল। আলোতে পাথরের মধ্যে তাদের প্রথমে অনড় পাথর বলেই মনে হওয়ায় কুর্চি বলল ওদের চোখ জ্বলছে না যে?

পৃথু বলল, শুয়োরদের চোখ খুদে খুদে। প্রায় জ্বলেই না বলতে গেলে।

একটি চিতা চকিত কিন্তু বিনা আয়াসে লাফ মেরে পথের ডানদিক থেকে বাঁদিকে যাওয়ায় কুর্চি বলল, এত বড় লাফ মারল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই? অনেকখানি দৌড়ে এসেও তো অতখানি লং-জাম্প দিতে পারত না কোনও মানুষ।

লং-জাম্প বোলো না, বলো লংকাম-হাই জাম্প। কত উঁচু দিয়ে গিয়ে কত দূরে পড়ল দেখলে? ওদের দৌড়তেও হয় না। বাঘও চিতার মতোই বড় লাফ দিতে পারে। ওদের শরীরের পেশীগুলো সব দড়িরই মত পাকানো পাকানো থাকে। মেদ যা আছে, তা সামান্য, পেটের কাছে। কোনওদিনও যদি মৃত, চামড়াছাড়ানো বাঘকে দেখতে তাহলে অনুমান করতে পারতে কী শক্তি ধরে সুন্দর, ডোরাকাটা মসৃণ চকচকে চামড়া ঘেরা এই বড় বিড়ালেরা।

সেদিন বিকেলে, বেলা থাকতেই কুর্চি চা বানাল ওদের জন্যে। তারপর দুজনে বেরিয়ে পড়ল। জীপের ড্রাইভার বসির ওদের এগিয়ে দিল যতখানি জীপ যেতে পারে ততখানি। তারপর পায়ে হেঁটে এগোল ওরা। বসিরকে বলে দিল পৃথু যেন সন্ধের আগে এখানেই এসে অপেক্ষা করে। কুলিরা সকালবেলা গিয়ে একটি ‘হাইড’ বা ‘আড় বানিয়ে এসেছিল ডালপালা আর পাতা দিয়ে সান্দুর ঝোরার অনেক উজানে, যেখানে অনেকগুলো গেম-ট্র্যাক এসে মিশেছে। জানোয়াররা জল খেতে আসে। সেখানে পৌঁছে যখন ওরা দুজন লুকিয়ে বসল নদীর দিকে মুখ করে একটা মস্ত বহেড়া গাছকে পেছনে রেখে। তখন পাঁচটা বেজে গেছে। সূর্য ড়ুববে অবশ্য ঘণ্টা দেড়েক বাদে।

বড় জানোয়ারেরা জল খায় মূল নদীরে। কিন্তু চকচক করে তাদের জল খাওয়ার চেয়েও বেশি ভাল লাগে ছোট ছোট নানা জানোয়ার ও পাখির জল খাওয়া দেখতে। মূল নদীর পাশে অনেকখানি গেরুয়া রঙা বালি ভিজে রয়েছে। তারই একপাশ দিয়ে পায়ের পাতাও ভেজে না এমন জল চলেছে। শব্দ না করে, বালির উপর বুকে হেঁটে।

বেলা পড়ে আসতেই পাখিরা এল একে একে। শীণা গায়িকার গলার শিরা যেমন গান গাইবার সময় তিরতির করে কাঁপে তেমন তাদের গলার শিরাও কাঁপছিল তৃষ্ণায়। সরু সরু ঠোঁটে জল শুষে নিচ্ছিল ওরা। বনমুরগি, তিতির, বটের, আসকল, কালি-তিতির, ময়ুর, মুনিয়া, নানা রকম ফ্লাইক্যাচার পাখি, বাদামি কালো বড় ক্রোফেজেন্ট, পৃথুর ওড়িয়া বন্ধু চন্দ্রকান্তদের দেশে যে পাখিকে বলে “কুস্তাটুয়া”, মৌটুসী, ঘুঘু, নীলচে রঙা বক্-পিজিয়ন। তাবৎ বিশ্বকে দ্যা ছ্যা ছ্যা করা বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতাদের মতো বাচাল ছাতারে পাখিরা সদলবলে এল তাদের পাটকিলে-খয়েরি রঙে নদীর পাড়ের ধুলোবালির রঙের সঙ্গে মিশে গিয়ে।

সাপেরাও এল। সুন্দর দেখতে ঢোঁড়া, গা-ঘিনঘিন করা চিতি, গোখরো এবং একটি মস্ত শঙ্খচূড়। ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল কুর্চি। পৃথুও অনড় হয়ে রইল। ওদের উপর ভরসা কম। রুষারই মতো বদমেজাজি সাপ এ। বিনা কারণেই ভীত, পলায়মান মানুষের পেছন পেছন গিয়ে দৌড়ে গিয়েও লেজের উপর সোজা দাঁড়িয়ে উঠে বুকে মুখে বা মাথায়ও ছোবল মারে এরা। আর শঙ্খচূড়ের ছোবল মানেই মৃত্যুর চুমু।

চলে গেল তারা এঁকেবেঁকে ভিজে বালিতে তাদের সর্পিল ছাপ এঁকে দিয়ে।

প্রজাপতিরাও এসেছিল, পাখিদেরও আগে। ভিজে বালিতে ওদের মুখ ছোঁওয়ায় আর উড়ে যায় আবার ছোঁওয়ায় আবারও ওড়ে। এমনি করেই জল খায় ওরা। শেষের দিকে দুটি খরগোস এবং একটি শজারু এল। একটি বনবেড়ালও। বেজি দেখতে পেল না একটিও। বেজি কম বলেই হয়তো সাপেরা এমন নিশ্চিন্ত এখানে। তবে ময়ুর আছে। নানা ধরনের ঈগল আছে। ওদের ভয় পাওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে।

মূল নদীতে চিতল, শম্বর, বারাশিঙা, বাইসন, কোটরা এরা সবাই জল খেয়ে গেল। চৌশিঙ্গাও এসেছিল একজোড়া। একদল কৃষ্ণসার।

চারধার দেখে নিয়ে সাবধানে উঠল পৃথু কুর্চিকে নিয়ে। সন্ধের আগে বড় রাস্তায় গিয়ে পৌঁছতে হবে। সঙ্গে টর্চও আনেনি।

গ্রীষ্ম সন্ধ্যার বনে বনে তীব্র মধ্যাহ্নর রিরংসার ঝাঁঝ মরে গিয়ে তার অদৃশ্য শাড়ির প্রান্ত দিয়ে শুকনো পাতা-ঝেটিয়ে-নেওয়া উদাস হাওয়াটা বনমর্মরের সঙ্গে আশ্চর্য মিশ্র বনজ গন্ধ উড়িয়ে এক বিষণ্ণ বিবাগী ভাব এনে দেয়। বিধুর করে তোলে মনকে, যাদের মন আছে। উষ্ণ পাথরের খাঁজ-খখাঁজের শিলাজুত, ছায়া-খোঁজা পাখির বুকের আঁশটে-গন্ধ-উষ্ণতা সবই উবে গিয়ে পশ্চিমাকাশের স্নিগ্ধ নীল সন্ধ্যাতারারই মতো স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে বন পাহাড়। সেই মুহূর্তে, ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে সবাইকেই। ভালবাসতেও ইচ্ছে করে, যদি তেমন জন কেউ থাকে। পৃথুকে চিরদিনই অবাক করেছে প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর, দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ের এক ভাববদলের ভরন্ত ঋতি। কুর্চির মনেও এই সাংঘাতিক নেশা ধীরে ধীরে সংক্রামিত হচ্ছে। এ নেশায় যাকে একবার পেয়েছে, তার আর রক্ষা নেই। তীব্র-আনন্দ চকচক করা কুর্চির চোখ দুটিও উত্তেজনায় ফুলে ওঠা নাকের পাটার দিকে চেয়ে ভারী ভাল লাগতে থাকে পৃথুর। কুর্চি হয়তো প্রকৃতিকে, প্রকৃতির এই ঋতিকে বোঝে বলেই পৃথুকেও বোঝে।

অন্ধকার হয়ে আসছিল। ওরা একটু এসেছে নদীর কোল ছেড়ে অমনি ওদের দেখে চমকে গিয়ে একটা ভাল্লুকের গুবলু-গাবলু বাচ্চা স্প্রিং-দেওয়া মস্ত কালো কুমড়োর মতো লাফাতে লাফাতে গড়াতে গড়াতে শুকনো পাতা আর কুটোকাঁটা ভেঙে ওরা যেদিকে যাবে তার বাঁদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

পৃথু বলল, তাড়াতাড়ি পা চালাও কুর্চি। ওর মাও ধারে কাছে থাকতে পারে। থাকলে, ঝামেলা বাধাবে। টর্চও আনিনি সঙ্গে।

পিস্তল?

সেটা আছে। কিন্তু…

কিন্তু কী? পিস্তল দিয়ে মানুষ মারাই সহজ। মানুষই তো হচ্ছে সবচেয়ে কমজোরী, নাজুক প্রাণী। জঙ্গলের জানোয়ারের মোকাবিলা করতে রাইফেল বন্দুকই ভাল।

ভয় পেয়ে কুর্চি পৃথুর পেছনে গিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরল। যদি সত্যিই ভাল্লুকী আক্রমণ করে তাহলে অসুবিধায় পড়বে, কুর্চি তার কোমর জড়িয়ে থাকলে। কিন্তু কিছু বলল না পৃথু। খুব ভাল লাগতে লাগল ওর। কেউই ওর উপর এমন করে নির্ভর করেনি আগে। ও যে আদৌ নির্ভরযোগ্য এ কথাও কেউ ওকে বুঝতেও দেয়নি। অন্যে নির্ভর করলে, বোধহয় মানুষ তার নিজের সব ক্ষমতা ছাপিয়ে গিয়ে অতিমানুষও হয়ে উঠতে চায়।

কুর্চির গরম নিঃশ্বাস পড়ছিল ওর পিঠে। দৃঢ় অথচ নরম বুকের ছোঁয়াও অনুভব করছিল। গা সিরসির করছিল, ভাল লাগায়। আওয়াজটা কাছে এসে গেছে। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এবার। আস্তে করে পিস্তলটাকে হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখল পৃথু। কিছুক্ষণ আগে থেকেই আওয়াজের রকমটা দেখেই ও বুঝেছিল যে কোনও মানুষ আসছে। ভাল্লুক নয়। মা-ভাল্লুকী এলে এমন গদাইলস্করি চালে আসত না। ঝড়েরই মতো উড়ে আসত। এবং সে যে ভালমানুষের ঝি-এরই মতো জানোয়ার-চলা পথটি ধরেই আক্রমণ করত এমনও নয়।

জেনেও, কুর্চিকে বলেনি কিছু। কুর্চির এই সমর্পণকে উপভোগ করছিল এতক্ষণ। যে নির্ভর করে, তাকে ভীত দেখে এক ধরনের আনন্দও পাওয়া যায় বোধহয়। এখন দেখা যাক, মানুষটি কে? কোনও আদিবাসী চোরাশিকারি? ডেরার কোনও লোক কি?

বাবা!

কে যেন ডেকে উঠল পিটাস ঝোপের আড়াল থেকে।

টুসু আবার বলল, বাবা।

হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল পৃথুর। গরমের সন্ধের মুখে, এমন গভীর জঙ্গলের মধ্যে জলের পাশে টুসুকে একা কে এমন বে-আক্কেলের মতো পাঠাল? ভাল্লুকের বাচ্চা যখন আছে ভাল্লুক মায়েরও কাছাকাছি থাকা একটুও বিচিত্র নয়। এই জঙ্গলে প্রায় সবরকম জানোয়ারই আছে। এক গণ্ডার আর হাতি ছাড়া।

টুসু এবার বলল, বাবা! তুমি কোথায়? আমি এসেছি।

কুর্চির হাতের বাঁধন, বুকের চাপ আলগা হয়ে এল তার পিঠ থেকে। অনুভব করল পৃথু। টুসু এগিয়ে আসতে লাগল যত, কুর্চি ততই সরে যেতে লাগল।

পৃথু বলল, টুসু।

বলেই এগিয়ে গেল।

টুসু বলল, বাবা।

বাবা এবং ছেলের মিলনের মিলিত ডাক প্রায়ান্ধকার বনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে গেল। ঝোরার স্রোত সেই ডাককে কুড়িয়ে নিয়ে মুখে করে উৎসারে ছুটে গেল উপত্যকার প্রপাতের মাথায় তাকে টুকরো করে ভেঙে নীচের ফেনিল দহে ছড়িয়ে দেবে বলে।

টুসু, পৃথুর একখানি পা, আর কোমর জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। টুসুর মুখটা পৃথুর কোমরের কাছে। পৃথুর মধ্যে পূর্বমুহূর্তে কুর্চির সান্নিধ্যজনিত যে উষ্ণ আনন্দটুকু কাঁপছিল তা মুছে গিয়ে টুসুর প্রতি ওর বুকের মধ্যে দীর্ঘ অদর্শনের দিনগুলিতে জমিয়ে রাখা পাথরের মতো শক্ত জমাট এক বোধ গলিত উষ্ণ লাভার মতো ছিটকে বাইরে এল। পৃথু বোকার মতো অনুভব করল যে, তার দু চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে।

কুর্চি পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিল।

কুর্চির মুখের ভাব স্পষ্ট দেখা গেল না। তার মুখের অন্ধকার বনের অন্ধকারে মিশে গেল। একটা টিটি পাখি ওদের মাথার উপর পা দুলোতে দুলোতে ঘুরে ঘুরে বার বার ডাকতে লাগল : ডিড উ্য ড়ু ইট? ভিড উ্য ড়ু ইট? ডি উ্য?

এই পাখিগুলোর ইংরিজি নামই এই। ডিড উ্য ড়ু ইট।

কুর্চির ইচ্ছে হচ্ছিল পাখিটাকে ঢিল ছুঁড়ে মেরে চেঁচিয়ে বলে : আমি না। আমি না। আমি কিছু করিনি।

কিন্তু পাখি তো মানুষের মনের ভাষা, এমনকী মুখের ভাষাও বোঝে না। তাইই সে ডাকতেই লাগল ঘুরে ঘুরে চক্রাকারে :

পৃথু, কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, এই যে। টুসুকে তুমি চেনো? টুসু তুই কি কুর্চিকে চিনিস?

কুর্চি পাশে দাঁড়িয়ে হাসল।

মনে হল যে হাসল। প্রায়ান্ধকারে ভাল বোঝা গেল না।

টুসু বলল, হাই আন্টি!

হাই বলা অভ্যেস নেই কুর্চির। অপ্রস্তুত হয়ে গেল অমন সম্ভাষণে।

টুসুকে বলল, এসো। আমার হাত ধরো। তোমার বাবা পড়ে যাবেন তুমি ওঁকে অমন করে জড়িয়ে রাখলে।

রাখব না জড়িয়ে আমি, বাবাকে।

বলেই, টুসু যেন অনিচ্ছাতেই ওর বাবাকে ছেড়ে দিল।

কুর্চি আবার বলল, আমার হাত ধরো।

লাগবে না কারও হাত। টুসু বলল। আমি বড় হয়ে গেছি।

মনে মনে বলল কুর্চি, ছেলেটা বাপকো বেটা।

এবারে ওরা সকলে মিলে এগোল সামনে। পৃথু বলল, ভুচুটা কী রকম বে-আক্কেলে লোক যে তোকে এই সন্ধের সময় গরমের দিনে জলের কাছে পাঠাল? কত বিপদ হতে পারত? এক্ষুনি তো একটা ভাল্লুকের বাচ্চা। তাছাড়া সাপ…

জানো বাবা। আমিও।

কী?

একটা মস্ত ভাল্লুক দেখলাম। পেছন উপুড় করে মহুয়া গাছে উঠছিল। কেন বাবা? মহুয়া তো আর নেই।

কোথায় দেখলি?

আরে। ওই দ্যাখো। ওই তো। নেমে পড়ল গাছ থেকে।

আতঙ্কিত কুর্চি আর পৃথু দেখল সত্যিই একটা প্রকাণ্ড ভালুকী মহুয়াতলি থেকে তাদের দিকে তেড়ে আসছে। আর বাচ্চাটা তার কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে বিনা টিকিটে মজা দেখছে।

টুসু আর কুর্চিকে পেছনে ঠেলে পিস্তলের দিকে হাত বাড়ানোর আগেই গুলির আওয়াজ হল একটা। শর্ট-ব্যারেলড পিস্তলে আওয়াজ জোর হয়। ভাল্লুকীর কাছাকাছিই এসে পড়ল গুলিটা। ধুলো উড়ে গেল। পাথরের একটি চিলতে কটাং করে উড়ে গেল গুলি খেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে উক উক ঊক আওয়াজ করে ঘুরে গেল ভাল্লুকী। তারপর বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ল ঝোপঝাড় দাবড়ে। প্রকাণ্ড বড় শ্লথ-বেয়ার।

পৃথু বুঝেছিল গুলিটা গায়ে লাগানোর জন্যে করেনি ভুচু, ভয় পাওয়ানোর জন্যেই করেছিল। গায়ে গুলি লাগলে বিপদ ছিল সকলেরই। গুলির শব্দ করাও বারণ এখানে। কিন্তু না করেও উপায় ছিল না। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়েই দেখল ওদের থেকে কিছুটা দূরে সঁড়ি পথের বাঁকের মুখে একটা উঁচু কালো পাথরের উপরে ঘোড়ায় চড়ার মতো করে দুদিকে দু পা ঝুলিয়ে বসে আছেন ভুচু বাবু।

এক লাফে নেমে পড়েই পৃথুর জন্যে শালপাতার দোনায় মোড়া পানের প্যাকেট বের করে দিল।

টুসু বলল, ভুচু আংকল? তুমি কি হনুমান? কী করে লাফিয়ে নামলে।

ভুচু বলল, হুপ! হুপ! হুপ! দেখলে তো ভালুক বাবাজিকে?

কুর্চি বলল, ভাল আছেন?

ভুচু বলল, এই আপনারা সকলে যেমন রেখেছেন।

কথাটাতে খোঁচা ছিল, বুঝল কুর্চি।

ভুচুও ওদের সঙ্গে সঙ্গে এগোতে লাগল। জিনের শার্টের নীচে বেল্টের সঙ্গে লাগানো হোলস্টারে পিস্তলটা গুঁজে রাখতে রাখতে। তোমার এই খামকা হরকৎ ভাল লাগে না ভুচু। যদি সত্যিই চার্জ করত ওটা?

করলে করত? আমরা দুজনে ছিলাম! পটাপট মেরে শুইয়ে দিতাম।

এরকম রসিকতার কোনও মানে হয়? সঙ্গে বাচ্চা এবং মেয়েদের নিয়ে?

লেহ্ লটকা।

লাড্ডুর মতো করে বলল ভুচু। যেন ভাল্লুকটার সঙ্গে কনসাল্ট করে তোমাদের ইনসাল্ট করেছি। আমি কি জানতাম? তোমাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যেই টুসুকে পাঠিয়েছিলাম আগে আগে।

কাজটা ভাল করনি।

আমি ওকে কভার করে ছিলাম তো। নইলে আর ওই উঁচু পাথরের উপর চড়তে যাব কেন? আমার নিজের বউ-ছেলে নেই বলে কি আমি এতই দায়িত্বজ্ঞানহীন? কী ভাবো তুমি বলো তো আমাকে পৃথুদা?

আহত গলায় বলল ভুচু।

তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে কুর্চি বলল, লাড্ডুবাবুর খবর কী?

খুব খারাপ।

কেন?

ওর বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেছে।

ওমাঃ। সেটাকে খারাপ খবর বলছেন?

খারাপ নয়? বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার মতো খারাপ খবর একজন অসাধারণ পুরুষের জীবনে আর কীইই বা থাকতে পারে?

পুরুষরা তো সবাইই অসাধারণ! মেয়েরাই শুধু সাধারণ।

তা কেন? আপনি অসাধারণ। রুষা বৌদিও অসাধারণ।

পৃথু ওদের এই তর্কে যোগ না দিয়ে বলল, তোর খবর বল টুসু। তোর ইদুরকার আংক তোর সঙ্গে কি খারাপ ব্যবহার করেছিল রে? তোকে মেরেছিল? বকেছিল?

নাঃ

তবে?

কিছুই করেনি।

তবে?

কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি তো?

না। কিন্তু আমার সঙ্গে কথাই বলত না।

কুর্চি চকিতে একবার তাকাল টুসুর দিকে। পৃথুরই ছেলে বটে। কুর্চিরও দরকার এমন একটি ছেলের। এমন কেন? টুসুর চেয়েও ভাল।

আমার কাছে থাকবি তুই টুসু?

থাকব বলেই তো এলাম।

তোর স্কুল?

আমি আর পড়বো না বাবা। স্কুলের পড়া আমার ভাল লাগে না। হিন্দি, ইংরিজি, ম্যাথস। তুমি আমাকে জঙ্গল, পাখি, ফুল, প্রজাপতি এসব চেনাবে? বাবা?

এসব চিনতেও তো পড়াশুনো করতে হয় টুসু।

সে তো আমি জানি। ইংরিজিতে আমি পড়তে লিখতে জানিই। তুমি আমাকে ভাল ভাল বই এনে দেবে। তুমি আমাকে পড়াবে। আমি বাড়িতেই পড়ব বাবা।

তারপর? বড় হলে, ডিগ্রি না থাকলে যে চাকরি পাবি না। আমি কি চিরদিন বাঁচব? তাও তো ল্যাংড়াই হয়ে গেছি এখন।

চাকরি করব না আমি।

খাব কী?

কেন ভুচু-আংকলও তো চাকরি করে না। ভুচু আংকলও তো কলেজে যায়নি, স্কুলের ডিগ্রি নেই…

বোঝো এখন।

বলে, হেসে উঠল ভুচু।

বলল, রুষা বৌদি এই জন্যেই বলতেন যে, আমার মতো ছোটলোক মোটর মেকানিকদের সঙ্গে মেলামেশা না করতে। তুমি তো নষ্ট হলেই, আমার দ্বারা, নেক্সট জেনারেশানেরও দফারফা! নাঃ। মিসেস রায়, আমার জন্যে এখানেই একটু জায়গা দেখে দিন তো। আমি চলেই আসব। হাটচান্দ্রা থেকে।

তুমি কি ভুচু-আংকল-এর মতো গাড়ির গারাজ করবে? গাড়ি-টাড়ি সারাবে?

না। আমি ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার হব।

ও, এখনও মাথায় আছে সেটা।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক জানালেও আর্টিকেল লিখব। জঙ্গলের মধ্যে একা একা থেকে ডাইরি লিখব। কত কীই তো এখনও আমরা জানি না, না বাবা?

হুঁ। পৃথু বলল, অন্যমনস্কর মতো।

তারপর বলল, মা কেমন আছে রে টুসু? আর দিদি?

ভাল নেই। জানো বাবা, আংকল ইদুরকার না, মাকে চড় মেরেছিল।

মা কিছু বলেননি, আমাকে বলবার জন্যে?

না। শুধু তোমার চোখের মলমটা দিয়ে দিয়েছে। বললেন, লাগাতে ভুলে যেয়ো না। তুমি খুব ভুলো মনের লোক। না-লাগালে চোখ আবার খারাপ হবে। এই কথাই বলতে বলেছেন শুধু।

অন্যমনস্কর মতো পৃথু বলল, হু! তাইই বলেছে?

হ্যাঁ।

ডেরাতে পৌঁছেই কুর্চি ভুচুর জন্যে চা এবং টুসুর জন্যে খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে গেল।

ভুচু বলল, পাগল হয়েছেন মিসেস রায়। সান-ডাউনের পর চা খেয়ে লিভার নষ্ট করতে রাজি নই আমি। টুসুকেও অনেক খাইয়ে দিয়েছে ঠুঠা আর বিগু। এই জংগলে আর ফর্মালিটি করবেন না। আপনি বরং রাতের জন্যে কিছু বন্দোবস্ত করুন। কাউকে বলুন, আমাদের একটু জল আর দুটো গ্লাস দেবে। রাম আমি সঙ্গেই এনেছি। সামনের এই বহেরা গাছটার নীচে চৌপায়া পেতে আমি আর পৃথুদা একটু সুখ-দুঃখের গল্প করি। কাল তো ফিরেই যাব।

পৃথু বলল, টুসু, তুমি আন্টির সঙ্গে গল্প করো। কাল থেকে তো আমি আর তুমি। আমাদের সব কথা হবে তখন।

পৃথু আসলে, কুর্চির সামনে ইদুরকারের রুষাকে চড় মারার কথা টুসু বলে ফেলায় অস্বস্তি বোধ করছিল। কেন যে এমন হয়? রুষার অপমানে তো পৃথুর খুশিই হবার কথা ছিল। কেন যে দুঃখ পায় কে জানে? নিজেকে একেবারেই বোঝে না ও।

টুসু ভিতরে গেলে, পৃথু বলল, ভুচু চিঠিতে তুমি যা করবে বলে লিখেছিলে তা পড়ে খুবই চিন্তা হয়েছিল আমার। কিছু করোনি তো? আমার চিঠি পেয়েছিলে?

তুমি ইদুরকারের কথা বলছ পৃথুদা?

হ্যাঁ। তুমি লিখেছিলে না, শিক্ষা দেবে ওকে।

না পৃথুদা। দেব ভেবেও কিছুই করিনি। এ কথা শুনে তুমি হয়তো অবাক হবে। কিন্তু কী জানি, বয়স হচ্ছে বলেই হয়তো, বদলে যাচ্ছি। আগে মনে করতাম, আমারই দু হাতে পৃথিবীর সব জোর। যা-কিছু অন্যায়, অবিচার সবকিছুর প্রতিকার যেন আমাকেই করতে হবে। তোমার চেলাগিরি করেও এই ভুল ধারণাটা জোরদার হয়েছিল। সকলকেই ‘শিখলিয়ে “টাইট” করে দিতে গিয়ে নিজে যা শিখলাম তা অন্য কথা। কেউই বোধহয় কাউকে কিছু শেখাতে পারে না পৃথুদা।

কুর্চির নির্দেশে মেট মইউদ্দিনের ছেলে আসলাম একটি অ্যালুমিনিয়ামের জাগে করে জল আর দুটি গ্লাস নিয়ে এল।

ভুচু উঠে গিয়ে জীপের থেকে রাম-এর বোতলটা নিয়ে এল। তারপর বোতলটা খুলতে খুলতে বলল, তোমার রয়্যাল কাস্ক পেলাম না। টুয়েভ ইয়ার্স ওল্ড মংক।

হলেই হল। বলল, পৃথু। একা তো খাই না। হাটচান্দ্রা ছেড়ে এসে লাভ এইটুকুই হয়েছে যে মদ্যপান প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। তারপরই বলল, রুষা আর কিছু বলেছিল? সেদিনের পর?

হ্যাঁ। রুষা বৌদি মাঝেও এসেছিলেন একদিন। অনেকক্ষণ ছিলেন আমার গারাজে। ওমলেট আর চা বানিয়ে দিলাম। খুব প্রশংসা করলেন ওমলেটের। মানুষটি কিন্তু ভারী ভাল। ভাল করে মিশে দেখলাম সেদিন। ভুল সকলেরই হয়, হতে পারে পৃথুদা। তোমারও যে ভুল তুমি কি…কী বলতে চাইছ তুমি?

পৃথু রাম-এ চুমুক দিয়ে বলল।

পৃথুর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে, ভুচু মাঝপথে থেমে গেল।

দুর থেকে চিঠিতে এই পৃথু ঘোষ মানুষটাকে যা লেখা যায়, সামনাসামনি বলতে ভয় করে। এমনিতে মনে হয় মানুষটা মাটির মানুষ, সকলের সঙ্গেই কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলে কিন্তু হঠাৎ যখন ভিতরের মানুষটা বাইরের খোলা ভেঙে বেরিয়ে আসে তখন তাকে কিছু বলার মতো সাহস ভুচুরও হয় না।

প্রসঙ্গ বদলে ভুচু বলল, বেশ ভাল জানোয়ার আছে কিন্তু এই সান্দুরের জঙ্গলে।

থাকবেই তো! ভ্যালী তো। চারদিকে পাহাড় ঘেরা তাছাড়া, এই সব জঙ্গলের সঙ্গেই তো ন্যাশনাল পার্ক-এর যোগাযোগ আছে। বিড়িপাতার কাজের জন্যে বছরের এ সময়টাতে যা একটু গোলমাল হয়, বাকি সারা বছরই জঙ্গল আনডিসটার্বড় থাকে।

ভুচুর গ্লাসে চুমুক দিয়ে ভুচু বলল, রুষা বৌদি তোমাকে চিঠি দিয়েছে একটা পৃথুদা।

কোথায়?

হিপ পকেট থেকে একটা খাম বের করল ভুচু।

পৃথু, চৌপাইয়ে শুইয়ে রাখা ক্রাচ দুটি তুলে নিয়ে বলল, আমি একটু আসছি ভুচু।

তারপর আসলামকে ডেকে বলল, একটি হ্যারিকেন দিতে। হারিকেন নিয়ে এলে, পৃথু গিয়ে মেট মইউদ্দিনের ঘরের বারান্দার শাল কাঠের তক্তার উপরে বসে খুলল চিঠিটা। ইংরিজিতে লিখেছে।

পৃথু।

আমি ঠিক করেছি, ভুচু ফিরলেই আমাদের বাড়িতে ফিরে আসব। ভুচুর একটু সাহায্যর দরকার হবে আমার।

গিরিশদার এবং শামীমের সঙ্গেও একদিন পথে হঠাৎ দেখা হয়েছিল। ভেবেছিলাম, চিনবেন। কিন্তু দুজনেই ভাল ব্যবহার করলেন। একটু অবাকই হয়েছিলাম।

একটা কথা স্বীকার করতেই হয় যে, তুমি যাদের সঙ্গে উঠতে বসতে তাদের সকলের ফম্যাল এড়ুকেশান বা সামাজিক পদমর্যাদা তেমন না থাকলেও মানুষ তারা কেউই খারাপ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, তোমাকে তারা প্রত্যেকে সত্যিই খুবই ভালবাসে। আমার ক্লাবের বন্ধুবান্ধব, স্কুলের সহকর্মীরা, মহিলাসমিতির মহিলাদের মধ্যে আমার বন্ধু যে একজনও নেই তা আমি এখন বুঝি। তাছাড়া, তারা সবাইই খোপের পায়রা। তোমাকে ছেড়ে যেতেই তারা আমাকে ত্যাগ শুধু করেছে যে তাইই নয়; অপমান ও অসম্মানও কম করেনি।

ভিনোদকে আমি সত্যিই ভালবেসেছিলাম। যদিও সেই ভালবাসার অনেকখানিই ছিল শরীর-নির্ভর। এর জন্যে তুমি আমাকে পুরোপুরি দোষী করলে হয়তো অন্যায় করবে। তোমার কাছে আমার দাম ছিল না কোনওই। তোমার কাছে তোমার কারখানা, ভুচু, দিগা পাঁড়ে, সাবীর সাহেব, শামীম, গিরিশদারাই সব কিছু ছিল ও ছিলেন।

মানুষের জীবনের প্রকৃতিও হয়তো হাওয়ারই মতো, জলেরই মতো সীমানা মধ্যবর্তী কোনও এলাকায় শূন্যতার সৃষ্টি হলে স্বাভাবিক নিয়মে পারিপার্শ্ব থেকে সেই শূন্যতা পূরণ করতে ছুটে আসে। আশেপাশের চেনাজানা মানুষও তেমনই আসে ছুটে। আমার শুন্যতা পূর্ণ করতে যেমন এসেছিল ভিনোদ, তোমার শূন্যতা পূর্ণ করতে কুর্চি।

বড়লোক! কিন্তু অত্যন্ত খারাপ চরিত্রর মানুষ এই ভিনোদ। একরাতে মিলির দিকেও হাত বাড়িয়েছিল। মিলি তো খুবই সুন্দরী হয়ে উঠেছে। বড় তো হয়েইছে। যা আমাকে খুবই চিন্তিত করেছে তা হচ্ছে মিলির মধ্যে ভিনোদের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা। এখন ভাবি, কী জানি, ভিনোদ হয়তো মিলির জন্যেই আমার সঙ্গে অভিনয় করেছিল। মিলির চরিত্রের এই দিকটা হয়তো সে আমার কাছ থেকেই পেয়েছে। সে জন্যে আমি লজ্জিত।

ভিনোদ জোর করছে যে অন্তত বছর দুই যেন তাকে আমি সুযোগ দিই। বলছে, সে মানুষটা খারাপ নয়, একটু বদরাগী, ওইই নাকি ওর দোষ। আমাকে চড় মেরে তারপর আমার পায়ে পড়ে অনেক ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু আমার মন বলছে ওর মনে অন্য কোনও মতলব আছে। যে মানুষ তার স্ত্রীকে খুন করতে পারে টাকার জন্যে তাকে বিশ্বাস করি কী করে? ভুচুকে আমি কিন্তু এই চড় মারার কথা জানাইনি। ও নিজেই বুঝতে পেরেছিল। ছেলেটির খুব সেনসিটিভ একটি মন আছে।

আমি যে চলে যাব এ কথা ঘুণাক্ষরেও জানাইনি ভিনোদকে। হঠাৎই ব্যাপারটা ঘটাতে হবে। তার জন্যে ভুচু এবং গিরিশদাদের সাহায্যর দরকার হতে পারে যে, এ কথা আগেই বলেছি।

তুমি ভাবতে পারো, তোমাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে গিয়ে এখন বিপদে পড়ে এত কথা তোমাকেই বা জানাচ্ছি কেন?

ভয় নেই তোমার কোনও। তোমার ও কুর্চির জীবনে আমি কোনওরম বাধাই হবে না। আমরা দুজনেই জুয়া খেলেছিলাম জীবন নিয়ে। তুমি জিতেছ। আমি হেরে গেছি। তুমি হয়তো মানুষটাও আমার চেয়ে ভাল বলেই জিতেছে। সে যাইই হোক, আমিও এমন চরিত্রর মানুষ নই যে, জুয়াতে হেরে গিয়ে যা বাজি ধরেছিলাম তা ফিরে চাইব। তোমার জীবনে আমার আর কোনও দাবিই থাকবে না। তবে, একসময়ের সাথী হিসেবে, আমার ছেলেমেয়ের বাবা হিসেবে এক ধরনের সম্পর্ক থাকবেই বাকি জীবন। তাকে ঠিক “সম্পর্ক” বলা যায় কি না জানি না। কিন্তু সম্পর্ক তো বটেই! যত দিলেই হোক না কেন তার বাধঁন! প্রেমের সম্পর্ক তোমার সঙ্গে হয়তো আর হবে না এত কিছু ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। তবু, যেখানে প্রেমের সম্পর্ক থাকে না সেখানেও যে শুধুমাত্র বৈরিতার সম্পর্কই রাখতে হবে, এইই বা কেমন কথা? প্রেম আর বৈরিতার মাঝেও তো সম্পর্কের আরও নানা স্তর আছে! আমার ও তোমার সম্পর্ক সেই রকমই কোনও স্তরে এসে থেমে থাকবে। অন্তঃসলিলা নদীরই মতো, বাইরে থেকে হয়তো বোঝাও যাবে না যে কোনওরকম সম্পর্ক আছে কিন্তু নিভৃতে দুজনের চারহাতে বালি খুঁড়লে দেখা যাবে হয়তো আপাত উত্তপ্ততার গভীরে তখনও অনেকই আর্দ্রতা আছে।

যাকগে এসব কথা। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতই জানে।

পৃথু, আমার খুব ভয় করছে। যতদিন না ও বাড়িতে ফিরে যেতে পারছি ততদিন প্রতি মুহূর্ত ভয়ে ভয়ে থাকি আমি।

এসব কথা তোমার দয়া চাওয়ার জন্যে লিখছি না। দয়া, আমি কারও কাছেই চাই না। মিলি টুসুর বাবা তুমি, তাইই সব কথা তোমাকে জানানো আমার কর্তব্য। আমার যা কিছুই হোক না কেন, তার জন্যে আমিই দায়ী। আমার অপরাধে ওদের শাস্তি কেন হবে? শাস্তি হলে, আমি তোমার কাছেই বা মুখ দেখাব কেমন করে?

আজ এখানেই শেষ করি। কুর্চির সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে, শুনেছি ভুচুর কাছে। জানি না, তোমাদের সম্পর্কটা কেমন। যেমনই হোক, তা নিয়ে আজ আমার কোনও অনুযোগ বা অভিযোগের কারণ আর নেই। আমার আত্মসম্মানের কারণেও তোমাদের সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে আমি আদৌ উদগ্রীব নই। এইই প্রার্থনা করি যে, তুমি সুখী হও। আমাকে নিয়ে হতে পারলে না, তবু জীবনের বাকি এখনও তো অনেকই আছে! বাকি জীবন তোমার নিজের মতো করে সুখী হও। একটাই জীবন। সকবেই নিজের নিজের মতো করে সুখী হওয়ার অধিকার আছে। যে না হতে পারল, সে অভাগা।

আমিও সুখী হব। সব মেয়েরাই ভাবে, তাদের সুখের জন্যে একজন পুরুষের সঙ্গে ঘরবাঁধাটা ভীষণই জরুরি। এ সব গত প্রজন্মর কথা। আগামী প্রজন্মর মেয়েরা গিরিশদার মতো, ভুচুর মতো, একা এবং স্বাবলম্বী হয়েই তাদের একক জীবনে চমৎকার সুখী হবে। শরীরের এবং অর্থর প্রয়োজন মেটাতে সারাটা জীবন পছন্দ না হলেও, বনিবনা না হলেও একই পুরুষের পদবীর বোঝা কাঁধে নিয়ে ভারবাহী পশুর মতো জীবন তারা আর কাটাবে না। তাছাড়া, শারীরিক সুখকে তো দেখলামই! নানারকম ভাবেই। একজন মানুষের পক্ষে সুখী হতে হলে হয়তো মনের সুখটা যতখানি দরকার শরীরের সুখ তার ছিটেফোঁটাও দরকার নয়। মনের সুখের সঙ্গে শরীরের সুখ মিললেই ভাল। নইলে, শরীরের সুখের দামই বা কী? বিদেশে তো এই ন্যূনতম সুখের জন্যে নানারকম যন্ত্রই পাওয়া যায়। হয়তো এদেশেও যাবে, ভবিষ্যতে। মন ছাড়া তো মানুষ হয় না। মন না মিললে মিলন ব্যাপারটাই একটা মিসনমার। অথবা জানি না, আমি এখনও সঠিক কিছু বুঝি বলে এসব ব্যাপারের। শরীর সর্বস্ব ভিনোদকে এবং মন-সর্বস্ব তোমাকে দেখে আমি টোটালি কনফিউজড হয়ে আছি এই মুহূর্তে।

চিঠিটা অনেকই বড় হয়ে গেল। কথাগুলোও বড় এলোমেলোভাবে আগে পরে মনে আসে আজকাল। চিঠিটা লেখা দরকার ছিল আমার বিপদের কথা জানানোর প্রয়োজন ছাড়াও অন্য একটা কথা বলতে! কুর্চি যদি তোমাকে সুখী করতে পারে কোনওদিন তাহলে আমি সুখীই হব। সত্যিই বলছি। আমি তো হেরে গেছিই। যে হারে, সে হারেই। প্রতিপক্ষ কত ভাল অথবা কত খারাপ, হেরে যাবার পর তা নিয়ে আলোচনা করা আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন কোনও মানুষকে একেবারেই মানায় না। নাথিং ফেইলস লাইক ফেইলিওর!

ভাল থেকো। বেশি মদ খেয়ে না। আমি একদমই ছেড়ে দিয়েছি। প্রায় অ্যালকহলিকই হয়ে গেছিলাম। যে সব মানুষ দুঃখ ভোলার দোহাই দিয়ে মদ খায় তারা মানুষই নয়। মানুষ হিসেবে তুমি আমার চেনাজানা অনেক মানুষের চেযেই বড়। দেরি করে বুঝলেও, তা বুঝি। এবার লেখালেখি শুরু করো! জীবনে যা হতে চেয়েছিলে তাইই হও। এখনও বাকি আছে অনেকই সময়। নতুনভাবে তোমার নতুন রুষা-হীন, বাধাবন্ধহীন জীবন আরম্ভ করার সময় এসেছে। আমার সমস্ত শুভেচ্ছা রইল তোমার প্রতি।

ইয়োরস রুষা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *