2 of 2

৬৩. ভুচুর চিঠি এল আজ বিকেলে

ভুচুর চিঠি এল আজ বিকেলে। পোস্ট করেছিল পরশু। তাহলে খুব একটা দেরি হয় না চিঠি আসতে যেতে। রুষাকে এবং মিলি টুসুকে ও যদিও লিখেছিল, রুষার কোনও চিঠিই আসেনি আজ অবধি। মাস খানেক হতে চলল ও ছেড়ে এসেছে হাটচান্দ্রা। বেশ তাড়াতাড়িই ছিঁড়ে ফেলল তো সম্পর্কটা রুষা। বাসী ফুলের মালার মতো।

ভুচুর মতো প্রাণবন্ত উদার ছেলে কাছে এলে বা তার চিঠি এলেও কিছুক্ষণের জন্যে মন ভারী চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বৈশাখের ভোরের হাওয়ায় যেমন হয়। সব মানুষেরই কমবেশি দুঃখ কষ্ট থাকেই। কিন্তু তাদের রকমটা আলাদা আলাদা। সেই দুঃখকষ্টকে দেখার বা গ্রহণ করার দৃষ্টিকোণ এবং ক্ষমতাও একেকজন মানুষের একেকরকম। ভুচুর সঙ্গে পামেলার বিয়ে যে হতে পারে না, পামেলার যে বিয়ে হয়ে গেছে শুধু তাইই নয়, সে মা হতে চলেছে এই খবরটা পৃথুকে হাসিমুখে দিয়ে ভুচু তার “মোটর-মিস্ত্রির বুলিতে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিল : “তুমিই একমাত্র শক-অ্যাবজবার নও দাদা। আমরাও আছি।” যখন বলেছিল, তখন যেন ব্যাপারটার তাৎপর্যটা, শূন্যতাটা পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গমই করা যায়নি। এখন যাচ্ছে। এতদূরে বসে, নিজের হৃদয়ের অনেক ফাঁক-ফোকর খাঁজ-খোঁজ, আলোর মধ্যে কুৎসিত ক্ষতরই মতো যেমন ফুটে ওঠে, যা আগে প্রকট হয়নি; বা দেখার বা বোঝার সময়ই হয়নি কখনও, তেমনই; ভুচুর দুঃখর স্বরূপটাও।

প্রতিদিন আলো ফোটার আগে উঠে সব দরজা-জানালা খুলে দেয় পৃথু। পূবের অন্ধকার পর্বতমালার রোমশ গায়ের একটি ফোকরের উপরে আকাশে ধীরে ধীরে কে যেন একটি জবালাল চাঁদোয়া টাঙিয়ে দিতে থাকে। তার ক্ষীণ রঙ ক্রমশ গাঢ় হতে থাকে। আর সেই লালিমার অস্পষ্টতা যেমনই স্পষ্ট হতে থাকে তেমনই দূরের মসজিদের ভোরের আজান ক্ষীণ থেকে তীব্র হয়ে ভেসে আসতে থাকে। দু কান, মস্তিষ্কর সব কোষ ভরে যায় আস্তে আস্তে সেই প্রতিধ্বনিত আওয়াজে।

প্রতি ভোরে এই ভোরের আজান শুনতে শুনতে বারান্দায় বসা পৃথুর মনে হয়, যুগযুগান্ত ধরে কত দূর দেশ থেকে কত মুসাফির, কত ব্যবসায়ী কত গিরিসংকট পেরিয়ে এসেছে তাদের উট বা ঘোড়া বা অশ্বেতরদের পায়ে পায়ে ধুলো উড়িয়ে এই ভোরের আজান শুনতে শুনতে। বুখারা, সমরখন্দ, কাবুল, কান্দাহার, শিশুকালের কত সব গা-ছমছম স্মৃতি-ভরা নামের জায়গা থেকে, অজানা, বিজাতীয় গন্ধ; অচেনা দ্রুতগতি ঘুম-ভাঙানো সব ভাষা তাদের রোদে-পোড়া রুক্ষ মুখে করে।

ওই সব মানুষদের কারওই কি ঘর ছিল না কোনও? রুষা ছিলও না? মিলি, খুকু? পামেলা? প্রেমিকা?

কুর্চির মতো কেউ?

তাদের মত হওয়ার সাধ্য নেই সামান্য পৃথুর। সেই সব পুরুষই মানুষের ইতিহাসকে বেগবান করেছে চিরদিন। সাধ ছিল, কিন্তু পারল না পৃথু। সহজ সুখে সুখী হয়ে ও বাঁচা বলতে ও যা বুঝেছে তেমন করে বাঁচা হল না। অথচ পৃথু ঘোষ একজন মানুষের মতো মানুষই হতে চেয়েছিল। যে-কোনও মানুষ হতে চায়নি সে কোনওদিনও।

ভুচুর চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ হালকা লেগেছিল মন। ভুচু লিখেছিল :

দাদা, আমরা সদলবলে পৌঁছে যাচ্ছি আগামী রবিবারে। “ফাইভ হাংগ্রী মেন কামিং। কীপ দ্যা ব্ৰথ্‌ বয়েলিং।”

পাঁচজন কে কে? তাহলে কি সাবীর মিঞা ভালই হয়ে গেলেন এ যাত্রা? তবে তো খুদাতাল্লার অসীম দায়ই বলতে হবে!

ভুচু লিখেছিল, আমিও আজকাল তোমাকে আর মণি চাকলাদারকে দেখে কবিতা লিখতে শুরু করেছি। গিরিশদা বলছিলেন, কবিতা হচ্ছে হজমি-গুলির মতোই। খিদে হওয়ার জন্যে যেমন খানার আগেই ইস্তেমাল করতে হয়, কবিতাও নাকি তাইই। অর্থাৎ, বিয়ে যাদের হয়নি তারাই ফটাফট-মেশিনের মতোই কবিতা লিখে যায়। বিয়ে হলেই ব্যস। ঘি পড়ে গেল বিরিয়ানিতে। তুলবে আর কী করে? সে তো আলু, জাফরান, বাদাম, পিস্তা, আর গোস্ত-এর সঙ্গে মাখামাখি হয়ে গেছে ততক্ষণে।

তা আমিও ছাড়বার পাত্র নই। বললাম, কিন্তু গিরিশদা, আপনারও তো বিয়ে হয়নি। কবিতা থামল কেন?

গিরিশদা বললেন, কেরানিগিরির মতো কবিগিরিরও সুপার-অনুয়েশানের একটা সময় থাকে। থাকা উচিত অন্তত। এটা অনেক কবিই বোঝেন না। এখন আমি রিটায়ার্ড। চুনী গোস্বামীর মতো অতুল্য ঘোষের মতো জীবনের সব ক্ষেত্রেই চুড়োয় থাকতে থাকতে, উপত্যকার দিকে স্বাভাবিক নিয়মে গড়িয়ে যাওয়ার আগেই রিটায়ার করায় বিশ্বাসী আমি। কারণ, চুড়ো-মাত্রই পিচ্ছিল। সে মাউন্ট এভারেস্টই হোক, কী কাব্য-যশের চুড়োই হোক। সেখানে বুদ্ধিমান মানুষ পৌঁছে গিয়ে পতাকা তুলেই তরতর করে নেমে আসে। আমিও তাই করেছি। অবশ্য, আমার এভারেস্ট হচ্ছে। হাটচান্দ্রার কবিতার কাগজ।

ভুচু লিখেছে, জীপেই যাব। বিরিয়ানি আমরা বেঁধেই নিয়ে যাব। বিরিয়ানির হাণ্ডিকে বিমারী-আদমির মতো কম্বলে ভাল করে মুড়ে-টুড়ে নেব। ঠাণ্ডা লাগার ভয় নেই। তুমি রাইতা আর আনুষঙ্গিক সব কিছু বানিয়ে রেখো। ওখানকার কিমতি জিনিস যদি কিছু থাকে তো আনিয়ে রেখো। বীয়ার খাব কিন্তু এতখানি পথ জীপ চালিয়ে যাওয়ার পর। গরমও পড়ে গেছে। স্টক যথেষ্টই রেখো। গিরিশদা বলেছেন, গোঁড়া লেবু, (সে যতই টক হোক না কেন) শুকনো তেঁতুল আর কাঁচা লংকাও মজুত রেখো। বীয়ারের সঙ্গে মিশিয়ে উনি কী সব করবেন। এক এক চুমুক দেবে আর রকি মার্সিয়ানোর আপার কাট। চ্যাক-ট্যাক্-চ্যাক।

ব্যাটা লাড়ু যেতে গররাজি ছিল। ওর নাকি জোর বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। কোন মেয়ে যে ওর সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে ঘি-এর গন্ধে ভিরমি খেয়ে মরবে তা সে ওইই জানে। ওকে বিয়ে করার চেয়ে ওর গানের সঙ্গে প্রেমে পড়া অনেক সোজা। কিন্তু গায়কের সঙ্গে? আমি যদি কোনও সামান্যা মেয়েও হতাম, তবুও উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবকে বিয়ে করতে রাজি হতাম না। তাঁর বাদী হয়ে থাকতাম, সেও ভি আচ্ছা! বিয়েটা একটা প্রচণ্ড গোপন, ব্যক্তিগত ব্যাপার। কী বল? না করেও বুঝেছি। যাকে তাকে কি বিয়ে করা যায়, বলো? সে জন্যেই বোধহয় আমার বিয়েটা করাই হয়ে উঠবে না। কাবাবমে হাড্ডি হয়ে থাকার চেয়ে শুধু হাড্ডি হয়ে স্বাধীনতা বজায় রাখা ভাল।

আরেকটা কথা! অসম্ভব না হলে অন্তত একজন মহিলাকে আনিয়ে রেখো। নুরজেহান যাচ্ছে নিকাহর আগে তোমাকে প্রণাম করতে। আমাদের মতো অসুরদের সঙ্গে ও বেচারি কী করে সময় কাটাবে? হুদার খুব ইচ্ছে ছিল সঙ্গে আসার। আমিই কাটিয়ে দিয়েছি। কদিন পরে তো হুরীকে নিয়ে একা ঘরে শোবেই। এত অধৈর্যপনা কিসের? আসলে, হয়তো আমার উপোসী মন আজকাল অন্যকে দুঃখ দিয়ে একটু আনন্দও পাচ্ছে। সুস্থ জীবন, স্বাভাবিক জীবনযাপন না করতে পারলেই বোধহয় বড় এবং ভাল মানুষরাও এমন টেটিয়া, খচ্চর হয়ে ওঠে আস্তে আস্তে। শেষে, স্যাডিস্ট?

যাই হোক, রাতটা আমরা থেকে, পরদিনই ফিরব। রাতের খানা কী হবে না হবে, সেসব সকলে মিলে যুক্তি করে ঠিক করব। ডাকু ভিনোদ সিং-এর প্রেজেন্ট করা স্কচ-এর বোতলটাও নিয়ে যাব। তার মোগাগুলো আমার পেটে আছে। মাঝে মাঝে বলে ওঠে, বেশরম কাঁহাকা! আশাকরি, তুমি রাগ করবে না। একটা মেয়েকে, মানে পামেলাকেই সামান্য কটা দিন সামলে রাখতে পারলাম না। আমি। তার মুরগি! সবার দ্বারা সব হয় না গো। আমার ভালবাসাও এখন “মুসলমানের মুরগি পোষার মতো হয়ে গেছে।

লাড্ডুর জন্যে ম্যায়ফিল বসিও রাতে। ওখানের কোনও পুরুষ বা মহিলা গাইয়ে থাকলেও বলে রেখো। যাঁদের নেমন্তন্ন করবে তাঁদেরও বলে রেখো। গাইয়ে আর কেউই না থাকলে, তুমি তো আছেই। হাতের পাঁচ। তোমার বাড়িতে আবার কাক-ফাক নেই তো?

গিরিশদার পণ্ডিত মরে গেছে। এখন সিরিয়াসলি কথাবার্তা চালাচ্ছেন ধোবি বস্তির লোকদের সঙ্গে। এবার একটা গাধা পুষবেন। নাম দেবেন ‘মূখ।

ঠুঠা বাইগা কেমন আছে? মানুষটাকে নাঙ্গা বাইগীনই খেল। ওর যা দরকার, তা একটা শক্ত-সমর্থ মেয়েছেলের। বেঁধে বেড়ে খাওয়াবে, রাতে “ঘুঘুর-সই! ঘুঘুর-সই!” খেলবে। তোমার মতো পুরুষ কি অন্য একজন জংলি পুরুষের শরীর মনের সব শূন্যতা পূর্ণ করতে পারে পৃথুদা? সংসারের এই পৃথিবীর, কতগুলো স্বাভাবিক নিয়ম আছে। খাদ্য এবং জলেরই মতো আরও কিছুর প্রয়োজন প্রত্যেক নারী ও পুরুষেরই বেঁচে থাকার জন্যে। তোমাকে আমি আর কী শেখাব বলে? তবে, শেখাতে ইচ্ছে যে করে না একেবারে তাও নয়। বেশি জেনেই তো এই হল তোমার। তোমার ওখানে যাওয়ার অন্য উদ্দেশ্যও আছে। দেখি, তোমার ইস্কুলের টিচারদের ইন্টার নিয়ে। “মোটর-মেকানিককে বিয়ে করে তাঁরা কি কেউ “জাতিচ্যুত” হতে রাজি আছেন? সম্ভব হলে জিজ্ঞেস করে রেখো। আমার যদি পছন্দ হয় কাউকে তাহলে…

তবে, যা ভাবছ তা নয়। তাহলে, তোমার সঙ্গেই ঝুলিয়ে দেব। তুমি স্বীকার করো আর নাইই করো, একা থাকার মানুষ তুমি নও। আমি যা পারি, গিরিশদা যা পেরেছেন, তুমি তা পারবে না। সবাই সব পারে না। তুমি ব্যক্তিগত জীবনে একজন কাছাখোলা, কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে না-খেতে-পারা বড়লোকের লালু ছেলে! তাও আবার একটা পা কমে গেছে, একজন সঙ্গিনী, সাথী নিতান্তই প্রাণে বেঁচে থাকার জন্যেও তোমার প্রয়োজন। বিলাস নয়, প্রয়োজন। বেশিদিন একা থাকলে তোমার অবস্থাও ঠুঠারই মতো হবে। ম্যাড হয়ে যাবে; ম্যাড। তোমার সেই জ্যাঠার মতন। সেটা কি ভাল হবে পৃথুদা? তাছাড়া চোরের উপর রাগ করে যে মাটিতে ভাত খায়, সে তো ইডিয়ট। তুমি তো ইডিয়ট নও।

আচ্ছা পৃথুদা, তোমার সেই কুর্চির খোঁজ কি পেলে?

আজকে সাহস করে বলতে পারি, ভদ্রমহিলা কিন্তু তোমাকে খুবই ভালবাসতেন। আর তুমি? তুমিও তো লুকোতে পারেনি আমার কাছে। ভালবাসায় তো কোনো পাপ নেই পৃথুদা। ভালবেসে, তা অস্বীকার করাতেই পাপ। ভালবেসে, ভালবাসার লোককে খুশি না করাই পাপ। নিজেও খুশি -হওয়া পাপ। একজন মানুষের সঙ্গে অন্যজনের একসময় বিয়ে হয়েছিল বলে কি বাকি জীবনের মতো তার সমস্ত শরীর মনের দরজা বন্ধ করেই রাখতে হবে? রুষা বৌদিকে তো তোমার মহৎ হাত তুলে ‘টা টা করে চলে যেতে দিলে, আর অন্যকে ‘প্লীজ ড়ু কাম’ বলে ভিতরে ডাকতেই যত অপরাধ বোধ?

জানি না, তার খোঁজ পেয়েছ কি না। পেলে, আমার মতো খুশি আর কেউই হয় না। সে শালা ভাঁটু না ডাঁটুকে মারো গোলি। স্মাগলিং করলে, জেল হয়ই। ও যাইই করুক না কেন ওই মহিলার যোগ্য স্বামী সে কোনওদিনও হত না। কুর্চি যদি আমার বৌদি হয় কোনওদিন, তখন আমি লক্ষ্মণের মতো দেওর হয়ে তার পিছনে পিছনে ঘুরব। নাটক জমে যাবে একেবারে। তোমাকে এত ভালবাসলাম, আমাকে তুমি কিছুই দিলে না। এমন একটা বৌদি অন্তত দাও। কিছু তো দেবে!

শেষ করলাম।

আমরা অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে একেবারে টিকিয়া-উড়ানে চালিয়ে লাঞ্চ-এর সময় পৌঁছে যাব। বিয়ার যেন যথেষ্টই ঠাণ্ডা থাকে। ফ্রিজ না থাকলে, বরফ এনে গামলাতে রেখো। তাও না। পারলে, পাহাড়ি নদীর ভিজে বালি দেড়হাতা মতো খুঁড়ে নিয়ে তার নীচে লাইন লাগিয়ে রেখে দিও। ওইখানেই না হয় পিকনিক হবে।

চিয়ার্স! পৃথুদা।

ভালো থেকো।

তুমি আছ বলেই আমি আছি।

—এভার ইওরস, ভুচু।

চিঠিটা অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে রইল পৃথু। চোখ দুটো একবার জ্বালা করে উঠল। স্বাভাবিক নিয়ম বলে এদেশে যা বোঝায়, এ দেশের বেশির ভাগ স্বাভাবিক নিয়মই তো অস্বাভাবিক; তাতে, ভুচুর মতো মোটর মেকানিকের সঙ্গে পৃথুর মতো একজন মানুষের সখ্যতার কথা ভাবাই যায় না। অথচ এত নিছক বন্ধুত্বই নয়। জঙ্গলের বন্ধুত্বর রকমই আলাদা। দিনে রাতে বন্দুক হাতে বিপদের মুখমুখি হওয়াতে এক দারুণ কমরেডশিপ জন্মায়। যার তুলনা হয়তো একমাত্র সৈন্যদের বন্ধুত্বের সঙ্গেই হতে পারে। কিন্তু সে তো শামীম, সাবীর মিঞা, গিরিশদা এঁদের সঙ্গেও আছে। কিন্তু পৃথুর জীবনে ঠুঠা বাইগা আর ভুচু এক বিশেষ আসনে আসীন। বন্ধুত্ব, উষ্ণতা, হৃদয়ের মাপ, ত্যাগ এই সবের পরীক্ষাতেই পৃথু যে কতবার হেরে গেছে এই দুজন মানুষের কাছে তার হিসেব রাখাও সম্ভব হয়নি। তবু, সান্ত্বনা এইই যে, কিছু কিছু হারের ব্যাপার প্রত্যেক মানুষের জীবনেই থাকে, ছেলের কাছে বাবার হেরে যাওয়ার মতো, যা দুঃখের নয়; গভীর আনন্দেরই।

বড় কষ্ট পায় পৃথু, ওদের হৃদয়ের উষ্ণতার কণামাত্রও ফিরিয়ে দিতে পারে না বলে ওদের। এই অপারগতার কষ্টর পিছনেও হয়তো কারও হাত কাজ করে। সে যে কে, কেমন সে দেখতে, আদৌ সে আছে কি নেই, এসব প্রশ্নর উত্তরও পৃথুর নিজের কাছে নেই। দিগা পাঁড়ে যত সহজে বিশ্বাস করতে পারে, পৃথুর ইংরিজি-শিক্ষা, বিজ্ঞানী-মন অতসহজে তা বিশ্বাস করতে দেয় না। অথচ সহজ বিশ্বাসের মতো সহজিয়া ব্যাপার আর কীই বা আছে! “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদুর।”

এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল পৃথুর। খুব সম্ভব কিশলয় ঠাকুরের চমৎকার লেখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী, পথের কবি’তে পড়েছিল। কলকাতার সেনেট হল-এ বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট ডেভিস মীড এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে, নীহারিকাপুঞ্জ সম্বন্ধে। জেমস জিনস সভাপতি। বিভূতিবাবু তাঁর লেখার এক অনুরাগিণীকে নিয়ে গেছিলেন সেই বক্তৃতা শুনতে।

মীড বলেছিলেন, “আলটিমেট রিয়ালিটিজ অফ দ্যা উনিভার্স আর অ্যাট প্রেজেন্ট কোয়াইট বীয় দ্যা রীচ অফ সায়ান্স অ্যান্ড প্রোব্যাবলী আর ফর এভার বীয় দ্যা কমপ্রিহেনশন অফ দ্যা হিউম্যান মাইণ্ড।”

বিভূতিভূষণ বললেন, “শোনো সুপ্রভা, বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে পরম সত্যকে অস্বীকার করতে চায় বাতুলেরা। ওদের বলতে চাই কথাটা। আমিও বোঝাতে পারি না, ওরাও বুঝতে চায় না। এলে, আজ শুনতে পেত ওরা।”

ওরা, মানে ওঁর সাহিত্যিক বন্ধুরা।

আজকের সায়ান্সের “রীচের সঙ্গে সেদিনের সায়ান্সের “রীচ”-এর তুলনা হয় না কোনও। বিজ্ঞান যেন ‘অজানা কথাটাকেই অভিধান থেকে মুছে দিতে চাইছে। হিউম্যান মাইণ্ডের কমপ্রিহেনশানের বাইরে যে কিছুমাত্র থাকতে পারে না, এমনই এক গভীর বিশ্বাস জন্মে গেছে প্রত্যেক আধুনিক মানুষেরই মনে।

তবু, পৃথুর নিজের মনে সংশয় আছে এখনও। বিজ্ঞান যাকে ‘উদ্ভাবন’ বলে থাকে, তা আসলে হয়তো নিছক আবিষ্কারই। নতুন কিছুর উদ্ভব হয়নি আসলে। সবই আবিষ্কার। এবং যা মানুষের আজকের উদ্ভাবনের গর্ব, তা হওয়া উচিত ছিল আবিষ্কারের মুগ্ধতা! হয়তো সে মুখ বলে, হয়তো সে প্রাকৃত বলে, হয়তো সে বিজ্ঞানই শেষ কথা নয় বলে এখনও বিশ্বাস করে বলে। মানসিকতায়, পৃথু এই বিংশ শতাব্দীর শেষেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলেই। ও জানে যে, তাদের দল সংখ্যালঘু।

তবু…।

সকাল থেকেই মনটা ভাল নেই পৃথুর।

বাসের কনডাকটর কাল সন্ধের পর চিঠি দিয়ে গেছিল অফিসের দারোয়ানের হাতে। দারোয়ান পৌঁছে দিয়েছিল। গিরিশদার চিঠি।

সাবীর সাহেব পরশু দুপুরে চলে গেলেন। শেষের কদিন পৃথুর কথা নাকি অনেকবার বলেছিলেন। একবার দেখতেও চেয়েছিলেন।

গিরিশদা লিখেছিলেন যে, ওঁকে কবর দিয়ে এসেই পৃথুকে ওই চিঠি লিখতে বসেছেন উনি।

এক একজন মানুষ থাকেন, যাঁরা নিছক ব্যক্তিমাত্রই নন। বড় বা বিখ্যাত মানুষদের কথা বলছে না পৃথু। নিজেদেরই গণ্ডীর অখ্যাত চেনা-পরিচিতদেরই মধ্যে এমন মানুষ কেউ কেউ থাকেন যাঁরা এক একটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ। বড় গাছেরই মতো। যাঁদের ঘিরে অনেক ছায়া, অনেক পাখির ডাক, অনেক ঝড় বাদলের রাতের শুকনো আশ্রয়। যাঁরা ভূপতিত হলে, অনেকেরই বড় ক্ষয়। এবং ক্ষতি। কত হাসি, কবিতা, গান; কত খাওয়া-দাওয়া, কত শিকার আর শিকারের গল্প, আতর, গুলাব, কত রাত-কিরাণী। সত্যিই! সাবীর মিঞার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠানই যেন শেষ হয়ে গেল। পৃথুদের প্রজন্মর কেউই ইচ্ছে করলেও অমন প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারবে না। কোনওদিনও। গিরিশদারা যদিও আছেন এখনও। হাটচান্দ্রা থেকে যেদিন গিরিশদা এবং ভুচুও সরে যাবেন, উপরে কিংবা পাশে; সেদিন ওই জায়গাটি শুধুমাত্র একটি নামই হয়ে যাবে পৃথুর কাছে। মরা-নাম। ফাঁকা-নাম। যদি না, মিলি-টুসু আবার বাবা বলে তাকে কাছে ডাকে।

খুব ভোরে উঠে সাবীর সাহেবের বড় ছেলে ওয়াজ্জ মহম্মদকে চিঠি লিখতে বসেছিল ও। অনেকই বড় হয়ে গেল চিঠিটা। কত কথাই যে মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওয়াঙ্কুর কাছে এ চিঠির কোনও দাম আছে কি নেই তা জানে না ও। নিজেকে হালকা করার জন্যেই দরকার ছিল লেখার।

অফিস থেকে আজ ফিরতে সন্ধেই হয়ে গেল। বারান্দায় বসে ছিল পৃথু অন্ধকারে। পরিবেশে মহুয়ার আর প্রথম গ্রীষ্মের বন-পাহাড়ের গন্ধ থম মেরে আছে। একটু পরই হাওয়া চলতে শুরু করবে একটা। শুকনো পাতা আর গন্ধ নিয়ে চালাচালি করবে তখন। রিলে-রেস-এর মতো সুগন্ধর রুমাল এক হাওয়া পৌঁছে দেবে অন্য হাওয়ার হাতে।

 

এখন, প্রকৃতি মৌন। দিগা পাঁড়ের মতো ধ্যানে বসেছে যেন। দিসাওয়াল সাহেব গাড়িতে সফর করতে করতে একদিন একটি নোটবুকে, যখনি যা মনে হয়েছে, ওর সঙ্গে আলোচনার যোগা সবই পরপর নাম্বার দিয়ে টুকে রেখেছিলেন। সেই সবকটি ব্যাপার নিয়েই এতক্ষণ আলোচনা করে এল পৃথু।

মানুষটির ভারী সুন্দর একটি মানবিক মন আছে। টাকা-পয়সা, লাভ-লোকসানের মধ্যে ড়ুবে থেকেও নিজের জীবনকে জীবিকা থেকে পুরোপুরি আলাদা করে রাখতে পারা বড় সোজা ব্যাপার নয়। খুব কম মানুষই তা পারেন। দিসাওয়াল সাহেব সেই মুষ্টিমেয়দেরই একজন। ওর স্কুল সম্বন্ধে আলোচনার মধ্যে পৃথু বলেছিল, আপনার মতো এমন উদার মনের ব্যবসাদার খুবই কম দেখা যায়।

বিদায়ী সূর্যর চৈতি আলো; শিরিষগাছের ঝিলমিল করা পাতার ফাঁক দিয়ে এসে খোঁচা-খোঁচা পাকা-দাড়িময় তাঁর রুক্ষ মুখে এবং উস্কোখুস্কো কাঁচা-পাকা চুলে এসে পড়েছিল। উনি বলেছিলেন, দেখুন ঘোষসাহেব, এই পৃথিবীতে ভগবান কিছু কিছু মানুষকে বেছে বেছে চওড়া কাঁধ দিয়েই পাঠান। তাঁদের ভাগ্যবান করে পাঠান, অন্যদেরই জন্যে। যাঁরা “ভাগ্য” ব্যাপারটার মানে আদৌ বোঝেন না, তাঁরাই এমন লোকদের বোকা ভাবেন। আমাকে যদি ভগবান অনেকই দিয়ে থাকেন তবে তা আমার একার ভোগের জন্যে কখনওই দেননি। আমার চারপাশের সকলের বোঝা লাঘব করার জন্যেই তা দিয়েছেন।

ভগবান কোথায় দিলেন? আপনি তো সব নিজের হাতেই গড়েছেন। ভাগ্য তো আপনার নিজেরই গড়া।

পৃথু বলেছিল।

একেবারেই ভুল কথা। এসব সত্যিই সব মুখ দাম্ভিকের কথা। শুধুমাত্র পুরুষকারেই কিছুমাত্র পেতে পারে না কেউই, ভাগ্য যদি সহায় না হন! যেসব সফল মানুষ ভাগ্যকে অস্বীকার করেন, তাঁরা মানুষ বোধহয় ভাল নয়। তাঁদের চেয়ে অনেকই বেশি যোগ্য মানুষ এই মুহূর্তেই ভাগ্যর হাতে মার। খেয়ে ডানা ভেঙে পড়ে আছেন চারপাশে, তা কি তাঁরা দেখতে পান না?

তাছাড়া অন্যের জন্যে যে করে, সে মহৎ নয়। নিজের বোেঝা তো একজন ভিখিরিও বয়ে নেয়, কঁকিয়ে-কেঁদে হলেও, পরের বোঝা যে বয়, সেইই তো মানুষ! না, কী বলেন?

এক দারুণ দীপ্তিতে ওঁর মুখ দীপ্ত হয়ে উঠল। বললেন, ঘোষ সাহেব, অনেকদিন আগে আমাকে একজন বাঙালি ভদ্রলোক বলেছিলেন জাবালপুরে যে, বাংলা ভাষাতে আপনাদের একটি প্রবাদ আছে : “পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব হাসে অন্তর্যামী”। বড় ভাল প্রবাদটা। আমারও এখন সেই কথাই মনে হচ্ছে, আপনার মন বুঝে। আমি নিজেকে জানি। জানি যে, আমি কেউই নই।

পৃথু চমকে উঠল, তারপর হেসে বলল, ওটা প্রবাদ এখন হয়ে গেছে যদিও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই কথা আসলে।

কোন ঠাকুর? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ওঃ, তাইই! তা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী? ছেলে, না মেয়ে? কোথায়, মন্দির আছে ওঁর? আপনাদের কলকাতার কালীঘাটেই কি? নাকি বৈদ্যনাথধামে?

পৃথু হেসে ফেলল। বলল, না, না, ঠাকুর, মানে দেবতা নন। আমাদের গ্রেটেস্ট পোয়েট হচ্ছেন উনি। পদবি ওটা।

কভি? বাবাঃ তাইই তো! তা, কভি ছাড়া এমন কথাই বা কার মনে আসছে? সব দেওতাই তো আসলে কভিই। কবিতাই তো পথ বেঁধে দেয় দেবতার দেউলের।

আমিও কি বোঝা আপনার? পৃথু বলল, মুখ নামিয়ে।

চেয়ার ছেড়ে এসে, পৃথুর কাঁধে হাত দিয়ে দিসাওয়াল সাহেব বললেন, “বোব!” কথাটা আমি বলেছিলাম অন্য অর্থে, তা নিয়ে অন্য কোনও সময়ে আলোচনা করব। আজ ভারী ক্লান্ত আছি। আপাতত এইটুকুই জেনে রাখুন যে,আপনি আমার বোঝা নন আদৌ। আমার নিজের বোঝার ভার সোজা করতেই ভগবান আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন ঘোষ সাহেব। আপনি ফ্রাচ-এ ভর করে কষ্ট করে যেই মুহূর্তে আমার কাছে এসে পৌঁছেছেন সেই মুহূর্তেই আপনাকে আমার ভীষণ দরকার ছিল। এসবই আসলে প্রিকণ্ডিশানড। ঘটবে বলে লেখা ছিল। আমি বিশ্বাস করি তাইই। নইলে এত বছর পরে, এমন ভাবে এমন সময় আপনি এসে পৌঁছবেনই বা কেন?

তার নিজের আধুনিকতাবোধ বা বিজ্ঞান-বিশ্বাস যাইই বলুক না কেন, গিী পাঁড়ে, বা দিসওয়াল সাহেব বা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লিখিত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট ডেভিস মীডের মৃত মানুষেরা মাঝে মাঝেই যে তার আধুনিকতাকে চকিত-টুসকি মরে চলে যান না, তার বিজ্ঞান-বিশ্বাসকে অদৃশ্য বিছের মতো অন্ধকার নিস্তব্ধ মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে কামড়ে দিয়ে পালিয়ে যান না এমন কথা হলফনামায় বলতে পারে না ও। তাছাড়া, দ্বিধাহীন ঋজু বিশ্বাস, প্রকৃতার্থে শিক্ষিত মানুষদের পক্ষেই একমাত্র থাকা সম্ভব। সে মানুষ ‘অ্যানস্টিক-ই হন আর নাইই হন! পৃথু ঘোষের মতো অশিক্ষিত, বানান-না-জানা মানুষের সঙ্গে দিগা পাঁড়েদের তফাত তো খুব বেশি নেই! বেশি থোক; তা চায়ও না ও।

ওঠবার সময় দিসাওয়াল সাহেব বললেন, আজকে আরও একটা কথা বলছি আপনাকে। পাছে, এ নিয়েও ভুল বোঝাবুঝি হয় পরে।

কী কথা?

যে বাঙালি মেয়েটির সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব, তা নিয়ে এখানে ইতিমধ্যেই অনেকই কথা হচ্ছে। আপনারা দুজনে যে কিবুরু বাংলোতে রাত কাটিয়ে এসেছেন সে কথাও আজ এখানে আসামাত্রই আমার কানে ভোলা হয়েছে। বন্ধুর সংখ্যার শেষ নেই আমাদের। এই বন্ধুরাই জীবনের পথ সবচেয়ে বেশি বন্ধুর করে তোলে।

পৃথু, উঠে পড়েছিল। দু ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দিসাওয়াল সাহেবের মুখের দিকে চাইল। ভাবল, বলেই দেয় যে, আমাকে ছেড়ে দিন। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে…চাকরি আমার দরকার নেই। চলে যাব অন্য কোথাও।

কিন্তু ও কিছু বলার আগেই দিসাওয়াল সাহেব বললেন, লোকে তো বলবেই। এই নিষ্কর্মাদের দেশে, সেক্স-স্টার্ভড় দেশে যে-কোনও পুরুষ-আর নারীর একটু সুখ দেখলেই সকলে বুনো কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। আপনি এ নিয়ে ভাববেন না। তবে আমি বলব, লুকিয়ে পালিয়ে কেন? আপনারা এখানেই থাকবেন স্বামী-স্ত্রীর মতো। আমি আপনার পেছনে আছি। জানবেন, এও কিন্তু প্রিকণ্ডিশনড। জীবনে যা কিছুই ঘটে, সব কিছুর পেছনেই মানে থাকে, তাৎপর্য থাকে। আমরা অন্ধ, তাইই দেখতে পাই না।

আপনি? আমার পেছনে আছেন কথাটার মানে ঠিক বুঝলাম না।

সন্ধিগ্ধ-চোখে তাকিয়েছিল পৃথু, পয়সাওয়ালা, জঙ্গলে-থাকা, জংলি অকৃতদার মানুষ দিসাওয়াল সাহেবের মুখে।

আপনার কী ইন্টারেস্ট?

পৃথু বলল।

আমার?

বলেই, আবার সেই দীপ্ত হাসি হাসলেন দিসাওয়াল সাহেব।

একটু থেমে বললেন, তাছাড়া আপনার দ্বিধাটা কিসের? আররে! আপনি তো আর পরের বউ ভাগিয়ে আনেননি; ঘর ভাঙেননি কারও। সে বিচারিও একা, আপনিও তো একাই হয়ে গেছেন। বললাম না, সব প্রি-কণ্ডিশানড।

বাইরে বেরিয়ে বললেন, গাড়িতেই আসুন, নামিয়ে দিয়ে যাব।

পৃথু বলল, না। একটু একসারসাইজের দরকার।

বাংলোর দিকে আসতে-আসতে দিসাওয়াল সাহেবের কথাটা ভাবছিল; “আপনি তো আর ঘর ভাঙেননি কারও?”

ভাঙেনি কি?

বিগু চা নিয়ে এল। হ্যারিকেন রেখে গেল বারান্দায়। তারপর ট্রেতে বসিয়ে চা, হালুয়া, এবং সেঁকা পাঁপড় নিয়ে এসে রাখল। দেখল, চায়ের ট্রের এক কোণে রাখা আছে একটি চিঠি।

ট্রেটা নামিয়ে বিগু বলল, ঠুঠাচাচা নিয়ে এসেছিল। বিকেলের বাসে এসেছে চিঠি।

সে কোথায়? ঠুঠা বাইগা? তাকে যে দেখাই যায় না আজকাল।

চরাবরা করতে গেছে।

বিগুর কথার ধরনে হাসি পেল পৃথুর, কিন্তু হাসি চেপে বলল, এ কীরকম কথা রে? ঠুঠা বাইগা আমার বিশেষ সম্মানের মানুষ, জানবি। কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে আমাকে। এমন করে কথা বলবি না।

তা কী করব? মানুষ যে আদৌ তাইই বা বুঝব কী করে? সারা দিনে তো একটিও কথা বলে না। গরু ছাগল হলেও বোঁওও অথবা ব্যাঁ-এ-এ করত দিনে একবার দুবার অন্তত। এ শুধু চেয়েই থাকে আর বিড়বিড় করে। আমার ভয় হয় সাহাব, কোনদিন আমাকে কেটে না ফেলে দেয় ঠুঠা চাচা। যা রাগি!

রাগি? রাগ কোথায় দেখলি তুই?

বাবাঃ। রাগ নেই? সবসময়ই তো ফুঁসছে রাগে।

কার উপর?

সেইই তো হচ্ছে কথা! কার উপর নয়? আকাশ, বাতাস, বন, পাহাড়, সকলের উপর। কখনও আপনার উপর, কখনও আমার উপর, কখনও কুর্চি মেমসাবের উপর। তবে বেশি সময়ই, নিজের উপর।

কুর্চি মেমসাহেবের উপর কেন? কথাটা মনে ভাবল। মুখে বলল না। বলল, নিজেরই উপর?

কী করে বুঝলি?

না বোঝার কী আছে। বারান্দার মুখ-ধোওয়া বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মুখ ভাঙায়। নিজেই, নিজেকে লাথি মারে।

সে কী রে? নিজেকে নিজে লাথি মারা যায়?

অবাক হয়ে শুধোল পৃথু।

হ্যাঁ। কেন যাবে না? আপনার এক পায়ে আপনি পারবেন না। এই দেখুন! বলেই, দিব্যি নিজের পেছনে নিজে এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পায়ে লাথি মেরে দেখিয়ে দিল। পৃথু ভাবল, অন্য পা হারিয়ে সত্যিই ওর বড় হেনস্থা। নিজের পেছনে নিজে লাথি মারার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত হারিয়েছে ও।

বিগু বলল, চলি। রাজমা-তড়কা ডাল বসিয়ে এসেছি উনুনে। পুড়ে যাবে। আরও চা লাগলে, ঘণ্টা বাজাবেন সাহাব।

গরুর গলায় বাঁধার একটা পেতলের ঘন্টা, গরু বাঁধা দড়ি দিয়ে বেঁধে, বিগু বারান্দায় ঝুলিয়ে রেখেছে। বাংলোটাতে ক্যাকটাই, আর অর্কিড আর ব্রমেলিয়াডস্ আর বহু রকম হাউস-প্ল্যান্টস যা সফিসটিকেশন এনেছিল, যা রুচির ছাপ, তার সবই এই একটা গরু-ঘণ্টা কড়মড়িয়ে চিবিয়ে দিয়েছে। তবুও বিগুকে কিছু বলেনি পৃথু। এইটে বাজালেই, হয় বিগু নয় ঠুঠা আসে। ওই ঘণ্টাটা বাজলে ওর মাথার মধ্যেও ঘণ্টা বাজে, ডং-ডডং-ডং। চেঁচামেচি কোনওদিনই পছন্দ নয় ওর। তাতে শান্তি ভঙ্গ হয়। ওই ঘণ্টাটা বাজলে ওর মধ্যেও ঘণ্টা বাজে, ডং-ডডং-ডং।

“ফর হুম্ দ্যা বেল টোলস? দ্যা বেল টোলস্ ফর দী?”

হোক। হোক। উল্টোপাল্টা হোক কিছু কিছু। রুচিশীলতা, পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্যজ্ঞানে ঘাটতি পড়ক কিছু। এলোমেলো, বিস্রস্ত, অবিন্যস্ত হয়ে যাক অনেকই দিন ধরে অভ্যস্ত, রুষার সংসারের বড়-বেশি বিধিবদ্ধ জীবন। ঘণ্টা বাজুক এলোমেলো। ডাকুক পাগলা কোকিলের মতো ফুলে ফুলে, দুলে দুলে। ফ্রেমিং খারাপ হয়ে যাক। যাক। আউট-অফ ফোকাস হয়ে যাক জীবন! শটু এলোমেলো হোক। ডিটেইলস-এর অভাব ঘটুক; কিন্তু পরিপূর্ণ নিবিড় ভালবাসার বেনিয়মের গভীর স্বাদে স্বাদু-সুগন্ধি হোক পৃথুর কর্তিত এই নতুন জীবন। অনেকগুলি অসম্ভব ভাল, কিন্তু অসংলগ্ন, পয়েন্টলেস শটস-এর চাইতে পুরো ফিল্মটি প্রাণবন্ত, অর্থবাহী, বাত্ময় হয়ে উঠুক। জীবনের স্টুডিওতে অনেকই ইংরিজি বুকনি, আঁতেলপনা, করোসাওয়া, আন্তোনিওনি, ফেলিনি, বার্জমান হয়েছে এতদিন। ফাটা বাঁশিতে সজোরে কিন্তু ফাঁকা ফু-এরই মতো। বাকি জীবনের ফ্লোরে দিশি শাঁখের আওয়াজ, গাছ-কোমর-করে শাড়ি পরা কুর্চি, আলুপোস্ত, সজনের-চচ্চরি, সোজাসুজি বাংলা কথা, বাংলা গান এবং সাদা-মাটা একটি প্রেমের গল্পর শুটিং হোক। এই স্ক্রিপ্টে কোনও ভিলেইন থাকবে না। না।

গরুর গলার ঘণ্টাই বাজুক ঘন ঘন।

চা খেতে খেতে পৃথু চিঠিটা তুলে নিল। রুষার চিঠি। থাক। হালুয়া এবং সেঁকা-পাঁপড় শেষ করে তারপর হাত ধুয়ে এসেই খুলবে চিঠিটা। বেশ ভারীও আছে। খুব বড় চিঠি লিখেছে রুষা। কেন, কে জানে?

বেশি বলার মতো বাকি কি আছে কিছু?

বেসিনে হাত ধুতে ধুতে রিকের কবিতার লাইন উঠে এল যেন ফার্নগাছের পাতাদের গা থেকে। রুষার চিঠিরই পরিপ্রেক্ষিতে।

“জাস্ট ওয়া/
এভরীথিং, ওনলী ফর ওয়ান্স, ওয়ান্স এন্ড নো মোর/ এন্ড উই ট্যু/
ওয়ান্স এন্ড নেভার এগেইন/ বাট দিস/
হ্যাভিং বীন ওয়ান্স, দো ওলী ওগান্স,
হ্যাভিং বীন ওয়ান্স অন আর্থ–ক্যান ইট
এভার বী ক্যানসেলড?”

কী করা যাবে রুষা?

কারও দোষগুনের কথা এখানে আসছে না। তোমার আমার একবার মাত্রর একটি জীবন এবারের মতো ক্যানসেলডই হয়ে গেছে।

তবে জীবনের মধ্যেই অন্য জীবন সুপ্ত থাকে, যেমন ফুলের মধ্যে থাকে রেণু, শুকনো কুদৃশ্য ফলের বুকে থাকে বীজ। পাখির ঠোঁটে, হাওয়ার হাসিতে অথবা নদীর উহ্লাসে ভেসে গিয়ে কোন দূর দূরান্তের প্রান্তরে সেই সুপ্ততা থেকে প্রকাশিত হয় কত নতুন সব কচি কলাপাতারঙ জীবন, তা কী। কেউ আগে থেকে বলতে পারে?

সেদিন রাতে কিবুরু বাংলোর বারান্দায় বসে কুর্চির গান শুনতে শুনতে পৃথুর মনে হয়েছিল যে, গানের মধ্যে দিয়ে বিশ্বভুবনের সঙ্গে সঙ্গে যেন সে তার অন্তলোকের ভুবনকেও নতুন করে আবিষ্কার করছে। এই গানের জীবনকেও।

“ফর সঙ, অ্যাজ টট ই উ্য ইজ নট ডিজায়ার,
নট উয়িং অফ সামথিং ফাইনালী অ্যাটেইড স ইজ এগজিস্টেন্স ফর দ্যা গড
আস্ট্রেইনড,
বাট হোয়েন শ্যাল উই এগজিস্ট?
বাট হোয়েন শ্যাল উই এগজিস্ট?”

বারান্দায় ফিরে এসে লণ্ঠনের ফিতেটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে টেবলের উপর বাঁ-পাটি তুলে দিয়ে চিঠিটি খুলল। ডান পায়ের অবশিষ্টাংশটি আজকাল স্মৃতিচিহ্নর মতো চেয়ারেই পড়ে থাকে। তাকে পারা যায় ওঠাতে, না নামাতে। তবু সে নিজেই থরথরিয়ে উঠে তার কল্পনাতে নড়াচড়া করে।

মাই ডিয়ার পৃথু,

এই চিঠি জবাবদিহি করার জন্য লিখছি না। জবাবদিহি, কারও কাছেই করা আমার স্বভাবও নয়। একে হয়তো চিঠিও ঠিক বলা যায় না। তোমার আমার জীবনের, একসঙ্গে কাটানো দিনগুলির দিকে পিছনে ফিরে, তোমার আমার নতুন জীবনের দিকে প্রত্যাশার সঙ্গে তাকানোর ভাল মন্দরই আলোচনা হয়তো।

তোমাকে একটা কথা পরিষ্কার করে বলা আমার দরকার। তোমার বিরুদ্ধে আমার অনেকই অনুযোগ অভিযোগ ছিল, সুখী-দম্পতির মধ্যেই এইসব অনুযোগ অভিযোগ থাকেই, ছাইচাপা আগুনেরই মতো। কিন্তু তার জন্যে বিবাহিত জীবন থেমে থাকে না। রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠা, চা খাওয়া, ব্রেকফাস্টের তদারকি করা, ছেলেমেয়েকে স্কুলের জন্যে তৈরি করা, স্বামীর অফিসের প্রস্তুতিতে সাহায্য করা এই সবের মধ্যে আমার মতোই বেশির ভাগ স্ত্রী কোন মুহূর্তে যে নিজের সব নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে এক অবশ বিধিবদ্ধ একঘেয়েমির শিকার হয়ে পড়ে তা বোঝার মতো মনটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না আর।

ইদুরকার তোমার থেকে কোনও দিক দিয়েই ভাল নয়। তবু, সে অন্য একজন মানুষ।

তোমার আমার জীবনের একঘেয়েমির অবসান হল তারই জন্যে। হয়ত কুর্চিরও জন্যে। ওই সাধারণ, অশিক্ষিত, ইনসিপিড একটি মেয়ের মধ্যে তুমি যেমন করে নিজের জীবনের একঘেয়েমির অবসানের সূত্র খুঁজেছিলে আমিও হয়তো তেমন, ইদুরকারের মধ্যে।

পরিবর্তন, সবসময়ই যে বেশি সুখের তা নয়। কিন্তু পরিবর্তনের একটি নিজস্ব মূল্য আছে। পুরনোকে সে নতুন করে তোলে।

কিন্তু সত্যি বলতে কি এই কদিনেই আমি হাঁফিয়ে উঠেছি। প্রথম প্রথম বেশ লাগত। নতুন জীবন, নতুন আদর, নতুন নিয়ম, অপরিসীম সচ্ছলতা, কিন্তু এখনই আমার একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে। জানি না, হয়তো ভুলই করলাম। কিন্তু ভুল করি আর যাইই করি, তোমার বুকে কেঁদে পড়ব গিয়ে, এমন মেয়ে আমি নই।

রেলগাড়ির কামরায় বারো ঘণ্টা কোনও সহযাত্রী বা সহ্যাত্ৰিনীর সঙ্গে সফর করলেও, নিজের স্টেশনে ট্রেন এসে থামলে ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার সময়, “চলি, আবার দেখা হবে” বলবার সময় বুকের মধ্যে একটু মোচড় দিয়ে ওঠেই! যদিও জানা কথা যে, সে শুধু কথারই কথা। রেলগাড়ির কামরার নৈকট্য, উষ্ণতা, একই টিফিন ক্যারিয়ার থেকে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়ার সহৃদয়তা ওই কামরাতেই ধুলোর মধ্যে পড়ে থাকে। নামার সময় খালি বুকেই নামতে হয়, সেই কামরার সম্পর্ককে, ধীরে ধীরে আউটার সিগন্যালের সবুজ আলো পেরিয়ে খয়েরি রঙা দীর্ঘ সাপের মতো ট্রেন তার বুকের কোরকে করে অজানা গন্তব্যর দিকে রিকি-ঝিকি-ঝিকিরিকি করে বয়ে নিয়ে যায়, নতুন স্টেশনের নতুন যাত্রীদের হাতে তুলে দেবে বলে। সেই সব সহযাত্রীদের সঙ্গে এই ছোট্ট জীবনে দেখা হয়ই না আর। তবু, ভালোগা থাকে, কিছুদিন; ভাল পারফুমারের গন্ধরই মতো। আলতো হয়ে লেগে থাকে, শার্টে, ব্লাউজে, মনে। পৃথু, তোমার স্মৃতিও তেমনই জড়িয়ে আছে আমায়। সেই গন্ধ এখনও উবে যায়নি।

তুমি বলবে, মিলি টুসুর কথা আমার কি ভাবার দরকার ছিল না? আমি বলব নিশ্চয়ই ছিল। এবং তাদের কথা ভেবেছি। তুমি মানবে কি না জানি না, আমাদের ছেলেমেয়েরা আমারই হাতে বড় হয়ে উঠেছে, তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছি বলেই বলছি, তাদের প্রতি অবিচার কিছুমাত্রও করিনি।

আমরা যে প্রজন্মের মানুষ, সেই প্রজন্মকে সমাজ শাঁখের করাতের মতো দু ধারে কেটে গেছে সর্বদা। অগ্রজদের প্রতি শ্রদ্ধা, কর্তব্য আমাদের মনে অটুট আছে। অনুজদেরও প্রতিও স্নেহ এবং কর্তব্য। কিন্তু এর পরের প্রজন্মর ছেলে মেয়েরা আমাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। এটা ওদের দোষ নয়। ওদের প্রজন্মর পক্ষে এইটাই নিয়ম। ব্যতিক্রম যদি কখনও ঘটেও তবে তা সেই নিয়মকেই দৃঢ়তর করে প্রতিষ্ঠিত করবে। পৃথু, এ কথা আমার চেয়ে ভাল তুমি জানো না। ওদের জন্যে জীবনের সবচেয়ে ভাল সময়টুকুই নিংড়ে দিলাম। অন্য বাবারাও দেয় মায়েদের সঙ্গে, তুমি যদিও দাওনি। তাই-ই আমার মতো করে ওদের বোঝা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আমরা যাকে জীবন বলে জেনেছি সে তো প্রায়শই একটা অভ্যেসই মাত্র। অতি স্বাচ্ছল্য অথবা দারিদ্র্য, দুজনের মধ্যে অমিল অথবা ঘঘারতর মিল সবই শেষে একঘেয়েমিতেই গিয়ে মেশে। আমার কেবলি মনে হয়, আধুনিক মানুষের জীবনে একঘেয়েমির চেয়ে বড় বিপদ আর কিছুই নেই। একঘেয়েমির চেয়ে একাকিত্বের দুঃখ অনেক ভাল। কারণ তাকে বোঝা যায়, তা পীড়িত করে আর একঘেয়েমি, হাঙ্গরের দাঁতের মতো কারণ যে, জীবনের শরীর থেকে সমস্ত কটি সুন্দর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দৈনন্দিনতার জলের নীচে কেটে দিয়ে যায়, তা সেই জলের উপরে জীবনকে টেনে না তোলা পর্যন্ত বোঝা পর্যন্ত যায় না।

সমাজ তৈরি হয়েছিল নিছকই প্রয়োজনে। একদল চাষ করত, অন্যদল যুদ্ধ করত, আরেকদল সকলের সুখ সুবিধে দেখত, আইনকানুন বানিয়ে শৃঙ্খলা আনত। তখন শৃঙ্খলার দরকারও ছিল। কিন্তু আমরা এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছি এখন যে, আমার মনে হয় সামাজিক জীবনের শৃঙ্খলা এখন একটা বন্ধন আর কিছুই নয়। আজকের সমাজ তোমার সুখে ঈর্ষা বোধ করে, তোমার ভাল হলে দুঃখিত হয়, তোমার খারাপ হলে সুখী হয়, তোমার ব্যক্তিগত সমস্ত আনন্দর চৌকাঠে যমের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এই সমাজকে আর দরকার নেই আমাদের।

তুমি তো রিচার্ড বাখ-এর ‘ইলসনস’ বইটা পড়েছ। তোমারও কি মনে হয় না যে,

“ইওর ওনলী।
অবলিগেশন ইন এনী লাইফটাইম
ইজ টু বী টু টু ইওরসেল্ফ।
বীইং টু টু এনীওয়ান এলস অর
এনীথিং এলস ইজ নট ওনলী
ইমপসিবল, বাট দ্যা
মার্ক অফ আ ফেক
মেহসারা।
দ্যা সিমপ্লেস্ট কোয়েশ্চেনস
আর দ্যা মোস্ট প্রোফাউন্ড।
হোয়্যার ওয়্যার উ্য বর্ন? হোয়্যার ইজ ইওর হোম?
হোয়্যার আর উ্য গোয়িং?
হোয়াট আর উ্য ড়ুয়িং?
থিংক অ্যাবাউট
দীজ ওয়ান্স ইন আ হোয়াইল, এন্ড
ওয়াচ ইওর আনসারস
চেঞ্জ

দা বন্ড
দ্যাট লিংকস ইওর ট্র ফ্যামিলি
ইজ নট ওয়ান অফ ব্লাড, বাট
অফ রেসপেক্ট অ্যান্ড জয় ইন
ইচ আদারস লাইফ
রেয়ারলি ড়ু মেম্বারস
অফ ওয়ান ফ্যামিলি গ্রো আপ
আন্ডার দ্যা সেম
রুফ।

মিলি ও টুসুও আলাদা আলাদা মানুষ। যেমন আমি ও তুমি। এই ‘ইলশানস’ বইটি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। “আই ওয়ান্টেড টু স্যে, ফর দ্যা লাভ অফ গড, ইফ উ্য ওয়ান্ট ফ্রীডম অ্যান্ড জয় সো মাচ, কান্ট উ্য সী ইটস নট এনিহোয়ার আউটসাইড অফ উ্য? স্যে, উ হ্যাভইট অ্যান্ড ট্য হ্যাভ ইট! অ্যাক্ট অ্যাজ ইফ ইটস ইওরস, অ্যান্ড ইট ইজ! রিচার্ড, হোয়াট ইজ সো ড্যামড় অ্যাবাউট দ্যাট?”

আমি নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছি পৃথু। তোমাকে ভাসিয়ে দিয়েছি, তুমি যাকে পেলে সত্যিই খুশি হও তারই দিকে। মিলি টুসু আমার তোমার সাহায্য ছাড়াই ভেসে যাবে নিজের নিজের গভীর গন্তব্যর দিকে, নিজের নিজের প্রকৃত সুখের দিকে, ভান ভণ্ডামি, লোকভয় সব ছিঁড়ে ফেলবে ওরা। ওরা বাঁচবে। আমাদের মতো প্রশ্বাস নেওয়া আর নিঃশ্বাস ফেলাকে ওরা বাঁচা বলে ভুল করবে না কখনও। তুমি দেখো।

মিলি টুসু সম্বন্ধে তোমার গভীর দুঃখ আছে। আমি জানি। মিলির চিঠি পড়ে তুমি হয়তো আঘাত পেয়েছ। কিন্তু ভেবে দ্যাখো তো, তুমি তোমার বাবাকে অমন চিঠি কি লিখতে পারতে? তোমার বাবা না হয় অন্যরকম ছিলেন, কিন্তু তুমি কি বলতে চাও আমাদের প্রজন্মর সব ছেলে-মেয়েই বাবা মাকে নিয়ে সুখী ছিল। কিন্তু যেহেতু বাবা-মায়েরা খেতে পরতে দিতেন, দেখাশোনা করতেন, আমরা বোবার মতো তাঁদের সবকিছুকেই মেনে নিতাম। আমরা ভীরু ছিলাম, অসৎ ছিলাম।

মিলির শ্রদ্ধা বা আমার সঙ্গ ছাড়াও তোমার দিব্যি চলে যাবে পৃথু। দেখো তুমি। তুমি আমি এবং প্রত্যেকটি মানুষই যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজের মধ্যের এবং শুধুমাত্র নিজেরই আনন্দর খোঁজে এবারে বেরিয়ে পড়ো। বুঝতে পারবে, দুঃখ যা পাবার তা আমরা নিজেরাই নিজেদের দিই, অন্যকে দায়ী করি মিছিমিছি; নিজেরা ভীরু এবং অসৎ বলে। ভণ্ড বলে।

মিলির জন্য আমার তো গর্বই হয়। তোমারও হওয়া উচিত। তুমি ভাব যে, ওরা তোমার সম্পত্তি। তা তো নয়। ওরা যে আলাদা আলাদা মানুষ।

কাহলিল গিব্রান তো তোমার এত প্রিয় কবি! বাংলা আমি কিছুই পড়িনি, পড়তে পারি না তা মানি। কিন্তু ইংরিজি তে পড়ি। পড়লেই হল! গিব্রান ওর “দ্যা প্রফেট” বইতে ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে কি বলা হয়েছে তা বুঝি মনোযোগ দিয়ে পড়োনি?

“ইওর চিল্ডরেন আর নট ইওর চিল্ডরেন
দে আর দ্যা সানস অ্যান্ড ডটারস অফ লাইফস লংগিং ফর ইটসেফ
দে কাম থু উ্য, বাট নট ফ্রম উ্য
এন্ড দে দে আর উইথ উ্য ইয়েট দে বীলঙ নট টু উ্য।
উ্য মে গিভ দেম ইওর লাভ বাট নট উওর থটস,
ফর দে হ্যাভ দেয়ার ওন থটস
উ্য মে হ্যাভ দেয়ার বডীজ বাট নট দেয়ার সোওলস,
ফর দেয়ার সোওলস স্যুয়েল ইন দ্যা হাউস অফ টুমবো,
হুইচ উ্য ক্যানট ভিজিট, নট ইভিন ইন ইওর ড্রীমস
উ্য মে স্ট্রাইভ টু বী লাইক দেম, বাট সীক নট টু মেক দেম লাইক উ্য
ফর লাইফ ‘গো’জ নট ব্যাকওয়ার্ড নর টারিজ উইথ ইয়েস্টারডে”

পৃথু, আমি আমার নতুন জীবনের নতুনত্ব নিয়েই অভিভূত আছি। এ ভাল কি মন্দ তার বিচার করার সময় এখনও আসেনি। আমাদের বিয়ের পরদিন থেকেই আমরা অসুখী। আমিও তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি, তুমিও চাওনি আমাকে। অথচ আমাদের কারওই সাহস ছিল না যে, গুরুজনদের বিরুদ্ধে যাই। আমরা জেনেশুনেই এই জীবনে শুধু প্রবেশ করেছিলাম তাইই নয়, এক রকম ঘোরের মধ্যেই এই অসীম ক্লান্তিকর অভ্যেসের মধ্যে জাবনার সামনে দাঁড়ানো গরুর মতো এতগুলো বছর না-বেঁচেও বেঁচে এলাম। মিলি টুসুকে আমাদের আনা অন্যায় হয়েছিল, কিন্তু ওরা তো “সানস অ্যান্ড ডটারস অফ লাইফস লংগিং ফর ইটসেল্ফ।” আমাদের মধ্যে দিয়ে এসেছে ওরা শুধু কিন্তু ওরা আমাদের কেউই নয়। যা ভুল হয়েছে; হয়েছে। বাকি জীবনের আর অমন ভুল হবে না। আমি যা করলাম তাকে তুমি এবং হয়তো অন্য সবাইই বলবে “স্বার্থপরতার চরম”। কিন্তু নিজের স্বার্থ নিজে লেখার মধ্যে লজ্জা, আমি অন্তত দেখি না। পরার্থেই বেঁচে থাকে বলে যারা বলে, সে নিজের সংসার স্বামী বা ছেলেমেয়ে যাদের জন্যেই হোক না কেন, তারা হয় ভণ্ড নয় বাঁচা কাকে যে বলে তা জানতে পর্যন্ত ভয় পায়, পাছে তারা যে বেঁচে নেই এই নগ্ন সত্যটা প্রকাশ হয়ে পড়ে।

এই দেশে বেশির ভাগ দম্পতিই অভ্যেসেরই আলোয় “ঘর” করে, জীবনের আলোয় নয়। জীবনের শেষে এসে পরনির্ভর হয়ে, জরাগ্রস্ত হয়ে তখন হা-হুতাশ করে মরার চেয়ে সময় থাকতে থাকতেই নোঙর ঘেঁড়াকে ভাল বলে মনে করেছি আমি।

ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতই জানে। আমি চাই যে, তুমিও সুখী হও। সত্যিকারের সুখী। তোমার প্রেমিকার খোঁজ পাও। তার সঙ্গে নতুন করে ঘর পাতে। তোমার পা হারিয়েছে বলেই ছেলেমেয়ের দায়িত্বও আমি আমার কাঁধেই নিয়েছি। তুমি তো ঝাড়া হাতপা। সুখী হতে তোমার বাধা কোথায়?

তবে, ভাবলে খারাপ লাগে এই জন্যে যে, তুমি চিরদিনই বড় কনফিউজড। নইলে, তোমার মতো মানুষের কুর্চির মতো সাধারণ মেয়েকে ভাল লাগত না। তবু, কুর্চির কাছে আমি কৃতজ্ঞ, কারণ নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার পথে বাধা যেটুকু ছিল তা কুর্চিই এসে দূর করেছিল।

তোমরা পুরুষরা কোনওদিনই এক নারী নিয়ে খুশি নও। ইতিহাস তাইই বলে। লুকিয়ে চুরিয়ে পরকীয়া করে অথবা খারাপ মেয়েদের কাছে গিয়ে নতুনত্ব খোঁজো তোমরা আর চাও তোমাদের স্ত্রীরা সতী-সাধ্বী হয়ে বাড়িতে সংসার পালন করুক। সেই স্ত্রী যদি তোমাদের সমানও আয় করে, শিক্ষিত হয়, তবুও। কারণ, তোমরা পুরুষ। কিন্তু মেল শভিনিজম-এর দিন এদেশেও অতি দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। তোমরা নতুনত্ব চাইলে আমাদেরও বা চাইতে দোষ কি? আমরা পারি, পেরেছি বলেই কি চিরদিনই একই ভাবে পেরে আসব? তোমাদের পা-ধুইয়ে দেব? সহমরণে যাব? বোরখা না পরেও বোরখা পবে থাকর চিরদিন?

না। তা আর হবে না। আমরা সমানে সমানে বাঁচব। এই “বাঁচার” কথা বুঝতে এদেশের সব মেয়েদের আরও কিছু সময় লাগবে। তাছাড়া, খুবই অল্পে সন্তুষ্ট বলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পুরোপুরি নেই বলে, এবং আমরা জন্ম-ভীতু বলেই সুখ না থাকলেও আমরা সুখকে কল্পনা করে নিয়ে বেঁচে থাকতে ভালবেসে এসেছি এত বছর, পাছে, অসুখের সত্যি মুখটি চোখের সামনে এসে আমাদের ঘোর ভাঙায়! তবু, একজন মনোমতে, বুঝদার, কনসিডারেট স্বামী পেলে আজও কোনও বুদ্ধিমতী মেয়ে ঘর ভাঙতে চায় না। আবার এও সত্যি যে, এই মুহূর্তে আমার চেয়েও অনেকেই বেশি অখুশি অনেক স্ত্রী এই ছোট্ট জায়গা হাটচান্দ্রাতেই আছে। তারা সত্নানের মা ডাক শুনে চমকে ওঠে। যে ছেলেমেয়েরা তাদের ভবিষ্যতের সাথী নয়, কেউই নয়, তাদেরই জন্যে এবং তাদের ভণ্ড, মিথ্যাচারী, অত্যাচারী স্বামীদেরও জন্যে এই একটামাত্র জীবন মিছিমিছি নষ্ট করে চলে যায়।

যাক। যত লম্বা হচ্ছে চিঠি, ততই গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। হয়তো পুনরাবৃত্তিও হয়ে যাচ্ছে বক্তব্যর। তুমি খুশি হও। ভাল থাকো, আনন্দে থাকো তাইই আমি চাই। আমার নতুনত্বে কাঁটা বিঁধবে, যদি না তুমিও নতুন হও।

মিলি ও টুসুকে চিঠি দিও। বাবাগিরি ফলিও না’। জ্ঞান দিও না। কারণ ওদের জ্ঞান আমার তোমার চেয়ে একটুও কম নয়। ওদের দুঃখবোধ আনন্দবোধ সবই পুরোপুরি অন্যরকম। ওরা হয়তো ভবিষ্যতে কোনও কৃত্রিম উপগ্রহে বাস করবে। নয়তো সমুদ্রের তলায় কোথায় বাস করবে তা তো অজানা। পৃথিবী তো আর থেমে নেই। আগের পৃথিবীই নেই, তাই তার পুরনো মানসিকতাই বা থাকবে কী করে? ওরা ওরা, আমরা আমরা। বন্ধুর মতো যদি দেখো ওদের! বন্ধুত্ব পাবে। তুমি নিছক “বাবা” বলেই যে ওদের ভালবাসা পাবে তা আদৌ ভেবো না। সমস্ত সম্পর্কর উষ্ণতাই ভালবাসার প্রদীপ জ্বেলে পেতে হয়। দেবে না, বদলে শুধু পেয়েই যাবে তা আর হবার নয়। তা সে স্ত্রীই হোক, কি ছেলেমেয়েই হোক।

কুর্চির দেখা পেলে কি না জানিও। কে রাঁধছে? কী খাচ্ছ? কেমন আছ? জানিয়ো। চোখের মলমটা বোধ হয় শেষ হয়ে গেছে। আরেক শিশি কি পাঠিয়ে দেব? আসলে, তোমার কোনও স্ত্রীই দরকার ছিল না। একজন মা থাকলেই চলত তোমার। ইডিপাস কমপ্লেক্স-এর এমন কেশ, তোমার মতো, আমি আর দেখিনি।

তোমার জন্যে সত্যিই চিন্তা হয়!

তোমার ঠুঠা কি সঙ্গে আছে? তাও একজন পুরনো চেনা লোক আছে জেনে ভাল লাগে।

–ইতি
তোমার এক সময়ের স্ত্রী রুষা।

ঠুঠা বারান্দার এক কোণে একটা থামে হেলান দিয়ে ওর নস্যিরঙা মোটা আলোয়ান জড়িয়ে অন্ধকারে অন্ধকারেরই মতো বসে ছিল। হঠাৎই অমানুষিক আওয়াজ করল একটা মুখ দিয়ে। কিন্তু চাপা, নিচুস্বরের আওয়াজ।

পৃথু চমকে তাকাল সেদিকে। কৃষ্ণপক্ষের প্রথম এক ফালি ছোট্ট চাঁদ উঠবে, তাও অনেক পরে। অন্ধকারে ঠুঠার চুট্টার লাল আগুনটা তীব্র হচ্ছে মাঝে মাঝে যখন টান মারছে তাতে।

পৃথু বলল, কী হল? এলে কখন? গেছিলেই বা কোথায়?

ঠুঠা জবাব দিল না কোনও। আবার ওইরকম আওয়াজ করল একটা।

পৃথুর মনে হল পৃথু যেন সত্যিসত্যিই লা-মাঞ্চার ডন কীয়োটে, আর ঠুঠা বাইগা তার স্যাঙ্কো। বোবা স্যাঙ্কো। এতদিন অনেক উইন্ডমিলের সঙ্গে যুদ্ধ করে, অনেক পথ পরিক্রমার শেষে যেন ফিরে এসেছে ওরা দুজনে রণক্লান্ত হয়ে। তফাৎ এইটুকুই যে, ডন কীয়োটে বলে এক আশ্চর্য চরিত্র তৈরি করেছিলেন মিগুয়েল দ্য সারভান্তে, আর পৃথুর মনোজগতের সব লড়াইই মিছিমিছিই ফেলা গেল। ডনকীয়োটে অমর হয়ে রয়েছেন, সাহিত্যে, পৃথু ঘোষ মুছে যাবে তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই।

পৃথু ভাবছিল, মিলি ও টুসুকে কি সত্যিই ওরা দুজনে মিলে তৈরি করেনি? অপত্য-সম্পর্ক বলে কি কোনও সম্পর্ক ভবিষ্যতে থাকবেই না? রুষা যেমন বলছে, মানুষ কি সত্যিই তেমনই হয়ে যাবে? আলাদা, আলাদা, ছেড়া ছেড়া, সুখকে ছোট ছোট ললিপপ-এর মতো ভাগ করে নিয়ে তাইই একা একা বড়জোর দোকা দোকা চুষে চুষে খাবে?

কে জানে! হয়তো হবে। ভবিষ্যতে হবে। মিলি-টুসুরা পৃথুকে কী দেবে কী দেবে না তা ওদেরই ব্যাপার। তাছাড়া এ তো টিবড়েওয়াল-এর অ্যাকাউন্ট্যাসি নয়। জীবনের সব ক্ষেত্রেই কি একটি ডেবিটের বদলে একটি ক্রেডিট হয়ই? দেখাই যাবে। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যই জানবে। তবে যতদিন মিলি টুসু “বাবা” বলে ডাকলে তার বুকের মধ্যের গাছ পাথর সব গলে গলে যাবে, যেমন যায়, ততদিন সে ওদের বাবাই থাকবে। খারাপ বাবা, বাজে বা অপদার্থ বাবা।

তবু, বাবা তো।

লণ্ঠনটা দপদপ করছিল। তেল ফুরিয়ে এসেছে। ঠুঠা খসখসে পায়ে হেঁটে এগিয়ে এসে লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে বাংলোর ভিতরে চলে গেল। নৌকোড়ুবি হলে জল যেমন নৌকোকে গিলে ফেলে, জলের মধ্যে ভাঙা কাঁচের মতো ঝকঝকে রূপোলি জল চারদিকে ছিটিয়ে দিয়ে, এখন নিকষ অন্ধকার তেমনই করে কয়লার গুঁড়োর মতো অন্ধকারের স্তুপের মধ্যে টেনে নিল পৃথুকে।

ঠুঠা বাইগা লণ্ঠন হাতে ফিরে এল। টেবলের উপর বসাল সেটাকে।

পৃথু বলল, বোসো না ঠুঠা।

ঠুঠা চেয়ারে না বসে পৃথুর সামনে মাটিতে বসল। জোড়াসন করে।

সংস্কার!

কথা বলো না কেন? আজকাল? কী হল তোমার?

পৃথু বলল।

শব্দ না করে হাসল ঠুঠা। যেন, পৃথুর প্রশ্নর মধ্যে হাস্যকর কিছু ছিল।

কথা না বললে, তুমি পাগল হয়ে যাবে। কথা না বলে বাঁচতে পারে কোনও মানুষ?

ঠুঠা আবারও হাসল। শব্দ না করে। এক দারুণ দীপ্তি ছড়িয়ে গেল ওর কুৎসিত মুখে।

কী অসুবিধে তোমার? ঠুঠা? সব সময় এত গম্ভীর হয়ে কী ভাবো তুমি? কিসের চিন্তা করো?

এবারে ডান হাত দিয়ে হঠাৎ একটি অতি দ্রুত ঢেউ-তোলা ভঙ্গি করে ও আবারও হাসল। বোঝাতে চাইল যে, বালকসুলভ প্রশ্নর জবাব দেওয়ার মতো সময় অথবা প্রয়োজনও তার একেবারেই নেই।

পৃথু বলল, আজ কুর্চির বাড়ি যাবে না? কুন্তী কি আছে।

কুন্তীর নাম শুনেই ঠুঠা বাইগার মুখ হঠাৎ গম্ভীর, নিষ্ঠুর হয়ে গেল। সে উঠে পড়ে আবার গিয়ে বারান্দার থামে হেলান দিয়ে নস্যি-রঙা আলোয়ানের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

পশ্চিমাকাশে, পাহাড়ের মাথার ঠিক উপরে সন্ধ্যাতারাটা স্নিগ্ধ সবুজাভ দ্যুতিতে অন্ধকারের জ্বরগ্রস্ত কপালে ওডিকোলন-ভিজোনো রুমালের মত স্নিগ্ধতা ঢেলে দিচ্ছিল। সেই চিতাটা করাত-চেরা আওয়াজে ভরে দিল অন্ধকার রাতের সব রোমকূপ। পাহাড়তলির ঘনান্ধকার থেকে শম্বরের দলের দৌড়ে যাওয়ার আওয়াজ ধেয়ে এল। রাতের বাতাস, শুকনো পাতাদের পাথরের আর পাথুরে-মাটির উপর দিয়ে সড়সড় আওয়াজ তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। করৌঞ্জ আর মহুয়ার গন্ধ ছুটছে আগে আগে। পাইলট সার্জেন্টেদের মতো।

হাটচান্দ্রায় যখন ছিল তখন একা থাকতে খুবই ভাল লাগত পৃথুর। এখন একেবারেই একা হয়ে গিয়ে বুঝতে পারছে যে, একা একা বেঁচে থাকা বড় সোজা নয়।

পূর্ণেন্দু পত্রীর একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি যেন জঙ্গল থেকেই উঠে এসে ওর মাথার মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে থাকল। প্রত্যেকটি শব্দ একটি একটি করে :

“একা হলেই নিজের কাছে নতজানু মানুষ
বরফের মতো, ঘাসের মতো
মোমের মতো গলতে গলতে বলে
—ক্ষমা কর!
আমি পারিনি
খুচরো পয়সার মতো এলোমেলো হয়ে গেছি
গাছ থেকে ঝরে পড়েছি
খাদে,
ফাঁদে,
জঙ্গলে। দরজা খুঁজে পাইনি রাজবাড়ির
সিঁড়ি খুঁজে পাইনি মন্দিরের
ক্ষমা কর।
আমি পারিনি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *