2 of 2

৫৯. সীওনীতে বেশ থিতু হয়েই বসেছে পৃথু

সীওনীতে বেশ থিতু হয়েই বসেছে পৃথু সাতদিন হল।

যাঁর কাছ থেকে পৃথুর প্রত্যাশা ছিল, এবং হয়তো অন্যায্য কারণেও নয়, সেই মুঙ্গেশ শুক্ল, তাঁর ছেলেকে পাঠানো দূরে থাকুক, পৃথুর সঙ্গে একবার দেখাও পর্যন্ত করেননি। হাটচান্দ্রার অফিসঘরে যে চেয়ারটিতে পৃথু বসত, সেই চেয়ারটির দাম যে পৃথু ঘোষের নিজের দামের চেয়েও অনেকই বেশি তা এতদিন বুঝতে পারেনি। মানুষের চরিত্রের এক নতুন দিক উন্মোচিত হল ওর কাছে। অথচ, কান্তি দিসাওয়াল যে এতটা ভাল ব্যবহার করবেন তা স্বপ্নেও ভাবেনি।

পৃথুকে দেখামাত্রই “স্যার” “স্যার” করছিলেন ভদ্রলোক।

পৃথু বলেছিল, পৃথুবাবুই বলবেন। পৃথু যখন আর সাহেব নেই। থাকতে চায়ও না। উনি বললেন, একবার স্যার হলে অলোওয়েজ স্যার।

শুধু চমৎকার বাসস্থানই নয়, যথেষ্ট ভাল, আশাতীত একটা চাকরিও ভদ্রলোক পৃথুকে দিয়েছেন।

বলেছিলেন, ভগবানই আপনাকে পাঠিয়েছেন স্যার। আমার ম্যানেজার সাহেবের বাড়ি মাইহার-এ। নাজিমুদ্দিন সাহেব। তাঁর একমাত্র ছেলে হঠাৎ মারা যাওয়াতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি মাইহার চলে গেলেন গত শুক্রবারে। সত্যিই ভগবান পাঠিয়েছেন আপনাকে।

মাইহার মানে? উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র মাইহার?

হা। দেখুন, তাই-ই লোকে বলে স্বদেশে পূজ্যতে, রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে। শুধু পুজোই নয়, যে গুণী ব্যক্তিকে মাইহারের রাজারা আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁদেরই আমরা ভুলে গেছি। টাকা থাকে না, ক্ষমতা থাকে না দুনিয়াতে, থেকে যায় শুধুমাত্র গুণ।

তা সত্যি। কিন্তু আমি কোন কাজে লাগব আপনার? বিড়ি পাতার কাজ তো সীজনাল কাজ। গরমের সময় জঙ্গল থেকে বিড়িপাতা সংগ্ৰহর কাজ তো এখন শেষই হয়ে গেছে। বিড়ি তো আর বানান না আপনারা!

বিড়ি বানাই না, তবে আমার তো অন্য ব্যবসাও আছে। একটু আধটু সিভিল কনস্ট্রাকশানও করছি। নানা ধরনের অর্ডার সাপ্লাই। মায়ের নামে একটা স্কুলও করেছি এখানে। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্যে এতদিন যা করার তা তো ক্রীশ্চান মিশনারীরাই করল, আমরা তাদের নামে যাই-ই বলি না কেন। আমিও তাই বিনি-পয়সার স্কুল খুলেছি একটা। চারজন টিচারও আছেন। গ্রাজুয়েট।

আমাকে কোন কাজে লাগাবেন আপনি দিসাওয়াল সাহাব?

অনেকই কাজে লাগবেন। আপনি সবকিছুর, সব স্টাফের উপরে থাকবেন। জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আর অ্যাকাউন্টসটাও একটু দেখবেন। শুধু আপনার নামেই আমার অনেক কাজ হবে এমনিতেই। এইখানে আস্ত নামে, অন্যত্র নাম ভাঙিয়ে।

অ্যাকাউন্টস। ভাল লোককেই বলেছেন। ও সব আমি কিছুই বুঝি না।

বোঝেন। বোঝেন। অ্যাকাউন্টস বোঝেন না এমন মানুষই নেই। যে-কোনও শহরের চৌমাথার মোড়ে বসে থাকা জুতো-পালিশ করা ছোকরা থেকে টাটা-বিড়লা-মালীয়ারা সকলেই বোঝে। অ্যাকাউন্ট্যাসির চেয়ে বড় সত্য জীবনে আর কিছু আছে?

অবাক হয়ে পৃথু বলেছিল, তার মানে?

তার মানে, এভরী ডেবিট হ্যাজ আ ক্রেডিট। জীবনেও কি এই একই নিয়ম খাটে না স্যার? কিছু পেলে, কিছু দিতে তো হয়ই। কিছু দিলে; কিছু পাওয়াও যায় বদলে।

গম্ভীর হয়ে গেছিল পৃথু।

বলেছিল, প্রায় স্বগতোক্তিরই মতো, সব ক্ষেত্রেই কি এই নিয়ম খাটে?

কখনও কখনও খাটে না। না খাটলে, জীবনের ট্রায়াল বালান্সেও ডিফারেন্স হয়। তখন সেই ডিফারেন্সকে ডেবিট বা ক্রেডিট করে দিতে হয় প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ডে। মুনিববাবুরা একে “খাইয়ে দেওয়া” বলেন। এত কিছুই নয়, কত বড় বড় পাওনা টাকা পানিমে পানি হয়ে যায়, যখন তা পাওয়া যায়ই না, তখন তাকে “নাজাই’ খাতে লিখে দিয়ে ভুলে যাওয়া হয়। আপনার ও আমার অথবা অন্য সকলেরই জীবনে অত সহজে আমরা নাজাই খাতে লিখে দিয়ে ভুলে যেতে পারি কি অনাদায়ী পাওনাগুলো? পারি না। সারাজীবন আপসোস করি; অনুযোগ করি। অন্যর বঞ্চনার কারণে নিজেদের কুরে কুরে খাই। অ্যাকাউন্ট্যান্সি কারও মুখ চেয়েই বসে থাকে না স্যার। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেমন ব্যবসার বালান্স-শীট বানাতেই হয়, জীবনের বেলাতেও হয়তো তাই-ই হওয়া উচিত ছিল। জীবন-ভর তা ফেলে রাখা উচিত নয়। গরমিল যা, তা “যানে দো কনডাক্টর” বলে প্রফিট-অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্টে ডেবিট করেই এগিয়ে যেতে হয়। আকাউন্ট্যান্সির মতো এইরকম জীবনধর্মী, গতিমান, আধুনিকতম বিজ্ঞান আর নেই-ই বলতে গেলে। জীবনের সঙ্গে অ্যাকাউন্ট্যান্সির যতখানি মিল ততখানি মিল অন্য কোনও বিদ্যার সঙ্গেই নেই।

আমি যে জানি না কিছুই অ্যাকাউন্ট্যান্সির। সত্যিই কিছুই জানি না।

জানতে হবে না। আমার অ্যাকাউন্ট্যান্ট টিবরেওয়াল, মাড়েয়ারী, ঝানু এক নম্বরের। সব সেই-ই করে। কিন্তু আজকাল “গুরু গুড, চেলা চিনি” হয়ে উঠছে। আমার কাছেই কাজ শিখে, এখন আমাকেই টেক্কা মারার চেষ্টা। টাকার চেয়ে বড় ওর জীবনে চাইবার আর কিছুই নেই। ওদের সমাজে নাকি যার যত টাকা সে তো সম্মানের লোক। টাকার সঙ্গে টিবরেওয়াল সম্মান ব্যাপারটাকে গুলিয়ে ফেলেছে। এটা কি দুঃখের নয়? খ্যয়ের, ঘোৎ-ঘাৎ সব আমি দেখিয়ে দেব একদিনে। আমার সব এক নম্বরের ব্যাপার। দু নম্বরী তিন নম্বরী ধান্দা আমার নেই কোনও। স্যার, আপনার বুঝতে একটুও সময় লাগবে না। অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে হলে, এমন কিছু মাথা লাগে না। বরং, মাথাওয়ালা লোক বলেই আপনার প্রথম প্রথম বুঝতে একটু অসুবিধে হতে পারে।

পৃথু হাসল, বলল, কোনও অ্যাকাউন্ট্যান্ট এ কথা শুনলে রাগ করতে পারেন।

করলে করবেন। আররে ইদানীংই না সব ভাল ভাল ছেলেরা চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির লাইনে আসছেন। চার্টার্ড, কস্ট, ম্যানেজমেন্ট, কত রকম অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয় এখন। আগে মানে, তিরিশ চল্লিশ বছর আগে কি হত? যাদের প্রফেসর, ডাক্তার, এঞ্জিনীয়ার কিছুই হওয়া হল না তারাই ভিড় করত এ লাইনে। “কম্মী” ছিল বলেই না বলত আই-কম, বি-কম্।

সে সব অনেক দিন আগের কথা।

পৃথু বলল। এত কঠিন পরীক্ষা। কত ভাল ভাল ছেলেরা পাস করতে না পেরে লাইন ছেড়ে দেয়। তবে এটা ঠিক, পরীক্ষাটা যে পুরোপুরি মেধার পরীক্ষা তা হয়তো বলা যায় না। মেধার চেয়ে জেদ হয়তো বেশি লাগে আমাকে অবশ্য একজন অ্যাকাউন্ট্যান্টই বলেছিলেন।

আর রে, আমি কি আর তা জানি না? আমিও তো নাগপুরে আর্টিকেলড ক্লার্ক ছিলাম সিং কোম্পানীতে।

হেসে বললেন দিসাওয়াল সাহেব।

তারপর বললেন, বিয়েও ঠিক হয়ে গেছিল। নাগপুরের এক বড় ব্যবসায়ীর মেয়ের সঙ্গে। পরীক্ষাই পাস করতে পারলাম না। সেই শালা উডবী-ফাদার ইন-ল শেঠ বিয়েটাই কেঁচিয়ে দিল। তারপরই তো আমার এক মামার কাছ থেকে দু হাজার টাকা কর্জ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভাগ্যের খোঁজে। তখন থেকেই মনের জ্বালায় পুরো অ্যাকাউন্ট্যান্সি প্রফেশনের উপরই থুথু দিচ্ছি স্যার। এই জঙ্গলে এসে বিড়ি পাতার কাজে তো সেই সময়ই লাগলাম।

ভালই করেছেন। যে-কোনও প্রফেশনেই সম্মান যত আছে, টাকা ততটা নেই। ব্যবসা যারা করে তাদেরই তো সেবা করতে হয়। তারা স্যারই বলুক আর সাহেবই বলুক, আসলে তারাই তো মালিক। আপনি যেমন আমার।

তা যা বলেছেন। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। বলেই, বললেন, ছিঃ ছিঃ। বুঝতে পারিনি। এরকম বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না।

দিসাওয়াল মানুষটা একটু অদ্ভুত ধরনের। অবিবাহিত। কিন্তু এই সাতদিনে কোনও সূত্র থেকেই তার চরিত্রের কোনওরকম দোষের কথাই শোনেনি পৃথু। এমন কি চা-পান-সিগারেট পর্যন্ত খান না। নারীঘটিত কোনওরকম দোষের কথাই শোনেনি পৃথু। এখনও পৃথিবীতে এরকম দোষহীন নিপাট ভালমানুষ যে রয়ে গেছেন তা জেনেও ভাল লাগে।

দিসাওয়াল সাহেবের মুখ দেখে মনে হয়েছিল, কিছু কিছু মানুষ নিজেকে প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েই সবচেয়ে আনন্দ পান। উনিও হয়তো তাঁদেরই একজন।

ভালবাসার জন কেউ না থাকলে কি চলে? ছেলেমেয়েও তো নেই। কাকে দিয়ে যাবেন, আপনার এত সম্পত্তি।

পৃথু তবু বলেছিল। মেয়েরা যেমন করে পুরুষদের বলে।

দিসাওয়াল সাহেব হেসে, রঙ-চটা ছাইরঙা অ্যামবাসাডরের পেছনের বাঁদিকের দরজা খুলে উঠে বসতে বসতে বলেছিলেন, দেনেওয়ালা যদি খাঁটি হয় স্যার, তবে ভালবাসা লেনেওয়ালার অভাব ঘটে কোনওদিনও।

বলেই, দূরের পাথরের উপর চুনকামকরা স্কুল বাড়িটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ছিলেন।

উনি যে শুধু ছোট ছেলেমেয়েদের জন্যে বিনা পয়সায় লেখাপড়ার বন্দোবস্তই করেছেন তাই-ই নয়, তাদের জামাকাপড়, বই-পত্র এবং টিফিন এ সমস্তই বিনা পয়সায় দেওয়া হয়।

গাড়িটা চলে গেলে, অবাক হয়ে অপস্রিয়মান গাড়ির চাকায়-ওড়া লাল ধুলোর মেঘের দিকে চেয়ে থেকে ও ভেবেছিল সত্যিই হয়তো তাই-ই। ভালবাসা ব্যাপারটা, নিজেই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বোধ। কাকে তা দেওয়া হবে তার বাছবিচার বেশি না করলে হৃদয় নিংড়ে দিলেই হয়তো হৃদয় ভরে ওঠে। তবে, দিসাওয়াল সাহেবরা অন্য ধরনের মানুষ। দিগা পাঁড়েরই মতো এক বিশেষ মানসিক উচ্চতাতে পৌঁছে গেছেন উনি জাগতিক, জীবনের সাধারণ সব সম্পর্কজাত দুঃখবোধ বলে কোনও কথাই নেই। ওঁদের অভিধানে। এই পৃথিবীর কোনও নারী বা পুরুষই সেই সব মানুষকে কোনওরকম দুঃখ দেবার ক্ষমতা রাখেন না, অথচ আনন্দ তাঁরা আহরণ করতে পারেন ভোরের রোদ কি পাখির স্বর, কি অনাত্মীয়, স্বার্থসম্পৰ্কশুন্য আদিবাসী শিশুদের হাসি থেকে। এই সব মানুষের কাছে কোনও বিশেষ ব্যক্তির বিন্দুমাত্রও দাম নেই। সমস্ত মানুষই বোধহয় এক বিশেষ জাতি হিসেবে তাঁদের অশেষ স্নেহ প্রীতি এবং ভালবাসার পাত্র।

খুবই কৃতজ্ঞবোধ করে পৃথু। এমন এমন মানুষের কাছে এলেও মনটা প্রসন্নতায় ভরে ওঠে। দিগা পাঁড়ের কাছে গেলে যেমন হত। মন, যে-মানুষের ছোট; তাদের কাছাকাছি হলেই এক গভীর অস্বস্তি বোধ করে ও, বুকের মধ্যে এক ধরনের কষ্ট হতে থাকে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। তা সে-মানুষ যতই মহত্ত্বর ভান করুন না কেন। ফুলের গন্ধর মতোই ভাল মানুষের মনের গন্ধও আপনিই ছড়িয়ে যায় অন্য মানুষের মনে।

যে বাংলোটিতে আস্তানা গেড়েছে পৃথু সেটি নাজিমুদ্দিন সাহেবেরই বাংলো ছিল। কখনই পরিবার নিয়ে উনি থাকেননি নাকি এখানে। মাইহারেই থাকতেন তাঁরা। ছেলে কাটনিতে পড়ছিল। বেশি বয়সে বিয়ে এবং দেরি করে সন্তান হয় ওঁর। প্রত্যেক দু মাস অন্তর নাকি সাত দিন ছুটি নিয়ে চলে যেতেন মাইহারে।

ভদ্রলোকের সাকুলেন্ট এবং ক্যাকটাই এবং প্লান্টস-এর শখ ছিল প্রচণ্ড। ফুলেরও। বাংলোটিকে প্রথম দর্শনে দেখে পৃথুর মনে হয়েছিল কোনও হর্টিকালচারাল গার্ডেনই বুঝি! অর্কিডও করেছিলেন উনি অনেক রকম।

বাংলোটা সত্যিই ভারী পছন্দ হয়ে গেছিল পৃথুর। একটি ছেলে আছে তার নাম বিগু। সেই দেখাশোনা করত নাজিমুদ্দিন সাহেবের। অনেকদিন আগেই দিসাওয়াল সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে এখানে এসে মৌরসী পাট্টা গেড়ে প্রথম দিন থেকেই সীওনীতেই থাকতে পারত ও। এ রকম স্বপ্নের মতো জায়গা!

কাছেই দুগাবতী দুর্গ আছে। কাছে মানে, বত্রিশ-তেত্রিশ মাইলের মতো। আড়ি বলে একটি জায়গা হয়ে যেতে হয়। শর্টকাট অবশ্য একটা আছে, তাতে সময় কম পড়ে। তবে সে পথে গাড়ি যায় না। চার মাইল দূর দিয়ে ওয়াইনগঙ্গা নদী বয়ে গেছে। পাহাড়ী নদী। ওপর দিয়ে চলে গেছে কজওয়ে-পিপারদাহি, চৌরাহি, চাঁদ, অমরওয়াড়া এসব জায়গায়। আরও এগিয়ে গেলে পড়ে পেঞ্চ নদী। তার ওপরেও কজওয়ে। মানে, সামার্সিবল ব্রিজ আর কী! পেঞ্চ নদী পেরুনোর পরই ঝিলমিলি। সেখান থেকে আরও এগিয়ে গেলে মাইল পনেরো যোলো, চিন্দোয়াড়া।

পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্ক-এর মধ্যে সুন্দর সুন্দর সব ফরেস্ট বাংলোও আছে। একটা বাংলোয় দেখল সোলার এনার্জিতে আলো জ্বলে আর একটি বাংলোতে ফ্রিজও আছে। গত শনি রবিবার পারিহার সাহেব নিজে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন পৃথুকে.। যাকে বলে ফ্যামিলিয়ারইজেশন টাওর। তবে সব দেখতে এখনও অনেকই বাকি। পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্ক-এর গড় উচ্চতা হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার ফুট-এর মতো। সাতপুরা পর্বতশ্রেণীর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পেঞ্চ। দক্ষিণবাহিনী। পোআনির চেক-পোস্ট দিয়ে ঢুকে গেলে সিলারি, সুরেরা (কোলিথমারা), রানীদেহ তোদোহ আর ঘাটপেনটারি পড়ে। অন্য একটি পথ দিয়েও ঢোকা যায়। সেদিক দিয়ে ঢুকলে, নাগপুরের মাইল পনেরো উত্তরে সাত নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে হয়ে খাপা আর সালাইঘাটে যাওয়া যায়। ওদিকটাতে যাওয়া হয়নি এখনও এবারে এসে। ছেলেবেলায় যখন বাবার সঙ্গে আসত শিকারে, তখন ঘাটপেণ্টারিতে ছিল একবার। নামটা তাই-ই মনে আছে।

আজকে রবিবার।

পৃথু নাজিমুদ্দিন সাহেবের বাংলোর বারান্দায় বসে ছিল। বেতের টেবলের ওপর খাতা কাগজ বই কলম নিয়ে।

সমস্ত বাংলোটার এমন বাগানের মতো পরিবেশ যে, তার জীবনে যে এত বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল সে কথা নিয়ে ভাববার ইচ্ছেও যেন হয় না এমন স্বর্গীয় পরিবেশে বসে। বারান্দা এবং সিঁড়ির ধাপগুলো শুধু ফার্ন-এই ভর্তি। কত রকমের ফার্ন! এই বাংলোতে যদি রুষার সঙ্গে থাকতে পারত ও, তাহলে তাদের জীবনে হয়তো কোনও ছেদই ঘটত না। এমন একটি ফুল-ফলন্ত বাগানওয়ালা বাড়ি দাম্পত্য সম্পর্কের জীবনবীমা, অকৃতদারের স্ত্রী, মৃতদারের সান্ত্বনা। রুষা এই সব পৃথুর চেয়ে বেশি ভালবাসে। পৃথু তো জংলী লোক। জঙ্গলের উলঝি-সুলঝি অযত্নবর্ধিত খামখেয়ালি গাছগাছালির রূপই তার মন কেড়েছে চিরদিন। যা-কিছু সযত্নলালিত, মানুষের চেষ্টাকৃত, নিয়মবদ্ধ সেই সব কিছুর প্রতিই ওর গভীর অনীহাই শুধু নয়, অসুয়াও আছে। সেই কারণেই হয়তো পৃথুর চরিত্রটাও সুন্দর লাল রঙ-করা কাঠের টবের মধ্যের নিয়মিত সেবা এবং পরিমিত আলো হাওয়া এবং অবশ্যই পরিমিত ছায়াতেও প্রস্ফুটিত, প্রীতিবদ্ধ, সুন্দর, প্রাইজ-পাওয়ার মতো হল না কোনওদিনও। রুষার চরিত্রর মানসিকতার এবং সৌন্দর্যর মতোই যেন এই বাংলোয় সবকিছু মেমসাহেবী ছিমছাম। খুঁতহীন। এসে অবধি, রুষার কথা অন্যান্য নানা কারণের সঙ্গে এই কারণেও খুবই মনে পড়ে।

বারান্দাতে এবং সিঁড়ির ধাপে ধাপে কোন ফার্ন যে নেই, তাই-ই কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হবে। টেবল ফার্ন, বোস্টন ফার্ন, বার্ডসনেস্ট ফার্ন র্যাবিটস-ফুট ফার্ন, অ্যাসপারাগাস ফার্ন, মেইডেনহেয়ার ফার্ন, এমনকি স্ট্যাগহর্ন ফানও। পৃথুর চেনা ভ্যারাইটির মধ্যে দেখছে না কেবল অ্যাসপ্লেনিয়াম বুলবিফেরা। ওদের কমন নামটা যে কী, তা কিছুতেই মনে করতে পারছে না এই মুহূর্তে।

গেট থেকে ঢুকে বাংলোর বারান্দার দিকে আসতে দু পাশের খোলা জায়গা, বাংলোর পেছন্টা, ভিতরের উঠোন, বাউন্ডারি ওয়ালের আশ-পাশ দেখে মনে হয়, উটির বটানিকাল গার্ডেনেই যেন এসেছে বুঝি। কতরকম যে বাল্কস্, ব্ৰমেলিয়াডস্, আফ্রিকান ভায়োলেট, ক্যাক্টাই আর সাকুলেন্টস কত ভ্যারাইটির টেরারিয়ামস আর প্যাশিও প্লান্টস তা আর বলে শেষ করা যায় না। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে তা বোধহয় এই রকমই হওয়ার কথা ছিল।

ঠুঠা এই বাগান পেয়ে যেন ওর বান্‌জারী খুঁজে পাওয়ার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছে। সারাদিনই খুপরি আর জলের ঝারি হাতে এই সব প্লান্টস আর ফার্ন-এর তদারকি করে। মালকোঁচা মেরে ধুতি উপরে তুলে, খালি গায়ে। বিকেল হলেই অবশ্য ধুতি নেমে যায়; জামা ওঠে গায়। রাতের দিকে, এখনও বেশ ঠাণ্ডা এদিকে।

ঠুঠা বাইগা মানুষটা কিন্তু একেবারেই বদলে গেছে। জঙ্গলে ও নাকি নাঙ্গা বাইগার স্বপ্ন পেয়েছিল। প্রায় বোবারই মতো হয়ে গেছে। ওর অন্তবিহীন কথা যে জঙ্গলের কোন মারাই দেবী গিলে ফেললেন। সারা দিনে ও দু একটিই কথা বলে এখন। দশটা প্রশ্ন করলে, একটার উত্তর দেয়। মানুষের যে ছাতারে পাখির মতো কথা বলা উচিত নয় এতদিন পরে বুঝেছে ওরা। বেলা পড়ে এলেই বারান্দার সিঁড়িতে এসে বসে সামনের ঘন জঙ্গলাবৃত মাথা-উঁচু মেঘের মতো পর্বতশ্রেণীর দিকে চেয়ে থাকে ঠুঠা বাইগা। হাওয়ায় কর্কশ চাবুক মেরে টিয়ার ঝাঁক এক স্কোয়াড্রন মিগ ফাইটারের মতো বাড়ি ফেরে। কোনওদিন বিকেলে ছাড়া-ছাড়া জোড়াজোড়া ছোটকি ধনেশ, মানে লেসার ইন্ডিয়ান হর্নবিলস্, নিষ্কম্প ডানায় গ্লাইডিং করে গোলাপী আকাশের পটভূমিতে হঠাৎ-খুঁজে-পাওয়া ধূসর পাণ্ডুলিপির মতো দেখা দিয়েই আবার ঘনায়মান অন্ধকারের ধুলোরঙা পুবের পাহাড়ের দিকে শেষ সূর্যর পশ্চিমী আলোর অস্পষ্ট রেশের মধ্যে ভেসে যায়।

পাখিরা মুছে যায়।

তারারা ফুটে ওঠে।

পৃথুও মাঝে মাঝেই মানুষের হাতে বানানো এই সুন্দর স্বগোদ্যানের মধ্যে বসেও ঠুঠা বাইগারই মতো উদাস হয়ে যায় পৃথু।

বাংলোর পেছনেও পাহাড়। সারা রাত একটা কপারস্মিথ পাখি ডাকে আর তার দোসর সাড়া দেয় দূরের জঙ্গল থেকে। পাখিরা মানুষ নয়। অনেক সুখ ওদের। সহজ সুখ। দোসর জোটায়, নীড় বানায়, ডিম পাড়ে। সহজে! কোনও কষ্ট নেই ওদের। রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারে নানা সম্ভাবনার অশরীরী আভাস হাওয়ার ফিসফিসানির মধ্যে চমকে চলে, থমকে থেমে, আবারও চমকে চলে যায়। পৃথু, বোঝে ঠুঠা বাইগাকে। যারা একবার জঙ্গলের প্রেমে পড়েছে তাদের ইহকাল পরকাল সবই ঝরঝরে। স্বগোদ্যানেও তাদের মন বসে না।

ঠুঠা মুখ দিয়ে অমানুষিক একটা নিচু আওয়াজ করে, মুখটা উঁচু করে পৃথুর দিকে চেয়ে বলল, পা কেমন?

ওর প্রশ্নটা গোঙানির মতো শোনাল।

পৃথু বলল, ভাল।

পৃথুর উত্তরটাও বোধহয় সে রকমই শোনাল।

তুমি কেমন আছ এখন ঠুঠা?

ঠুঠা আবারও একটা অমানুষিক শব্দ করল, সজারুরা সঙ্গমের সময় যেমন করে।

কিছুই বোঝা গেল না। কিন্তু বোঝা গেল যে, ঠুঠা ভাল নেই। যদিও বলছে যে, ভাল আছে।

ঠুঠা আবার বলল, আজ হাটে যাওয়া দরকার ছিল তোমার। তোমার নিজের।

কেন এ কথা বলল ঠুঠা, কে জানে?

আর কোনও দরকার নেই পৃথুর। হাটবাজার সওদা—আনাজ-মুরগি এ সবে ওর কিছুই দরকার নেই। ঠুঠা ভাল মনে করলে যাবে, নইলে খিচুড়ি খেয়েই থাকবে। একজন মানুষের নিজের জন্যে কিছুরই প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন সব ভালবাসার জনেদেরই জন্যে। আর…

ঠুঠাকে দেখে আজকাল ন্যতরুদাম্-এর হাঞ্চব্যাকের কথা মনে হয় পৃথুর। কোয়াসিমোদোর কথা। প্রত্যেক পুরুষের জীবনেই এমারাল্ডা দরকার। ক্ষণিকের জন্যে হলেও। সে পুরুষ উঠার মতো প্রাকৃতই হোক অথবা পৃথুর মতো অত্যাধুনিকই। নারীরা, সুন্দর লাল রঙা কাঠের টবেরই মতো যাদের বুকের মধ্যে থাকলে স্ট্যাগহর্ন ফার্ন-এর শোভা খোলে।

পৃথুর বাবা যখন ছেলেবেলায় পৃথুকে প্রথম ফোটো তুলতে শিখিয়েছিলেন, তখন বলেছিলেন, যে, পটভূমিই হচ্ছে আসল। ব্যাকগ্রাউন্ড। বলেছিলেন, শুধু প্রকৃতিরই ছবি : যেমন সুন্দর, প্রান্তর, নদী, পাহাড় কখনও তুলবি না। সাবজেক্ট হিসেবে প্রকৃতি একা এক্কেবারেই “ডাল”। সব সময়ই মানুষ রাখবি ফ্রেমের মধ্যে। অথবা নিদেন পক্ষে অন্য প্রাণী। একটি বাচ্চা ছেলে মোষের পিঠে চড়ে চলে যাচ্ছে বাঁশি বাজাতে বাজাতে। তবেই না, জঙ্গলের চরিত্রটা ফুটে উঠবে। মনে কর জেলে তার জাল উড়িয়েছে আকাশে। একটি সামান্য মানুষ, তার ছোট্ট একটি জালে, ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটি মাছ ধরার ছোট্ট আশাটুকু ছড়িয়ে দিচ্ছে বিরাট, গুরুগর্জনে অনন্তকাল ধরে বয়ে যাওয়া নদীর পটভূমিতে। নীল আদিগন্ত আকাশের কাছে যেন ভিক্ষা চাইছে সেই উলা গায়ের কালো কোলো মানুষটি। পটভূমিতে তবে না নদী ফুটবে। নদী, কিবন, কি পাহাড় নিজেই নিজে ফোটে এমন সাধ্য কী তাদের?

জীবনও এক ধরনের ফোটোগ্রাফি। ঠুঠা বাইগা আর পৃথু ঘোষ জীবনের ডিফাইন্ডারের ফ্রেমে কোনও মানুষকে আঁটাতে পারেনি। নারীকে তো নয়ই। তাই-ই তাদের জীবনের ফোটোগুলিতে পটভূমি তেমন করে ফুটল না বোধহয় এই জন্মে।

বিগু বারান্দায় এসে দাঁড়াল বাংলোর ভিতর থেকে। চায়ের পট ট্রেতে বসিয়ে। দুধ ও চিনি আলাদা করে এনে ছোট ছোট পটে। প্লেটে চারখানি থিন-অ্যারারুট বিস্কিট। ওর খসখসে পায়ের পাতা বারান্দার মসৃণ মেঝেতে জানোয়ারের পায়ের আওয়াজেরই মতো খস খস আওয়াজ তুলল।

চা-এর ট্রেটা নামিয়ে রেখে বিগু বলল, ক্যা বানায়াগা খানা, ম্যানিজার সাহাব।

সন্ধে হয়ে এল। বাঁ পাশের টাঁড় থেকে তিতির আর হট্টিটিরা তারস্বরে চিৎকার করে জানিয়ে দিল যে, এইমাত্র দিনের মৃত্যু হল। দিনকে কালো কাফানে ঢেকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেঁচা আর পেঁচানি তাদের কিচি কিচির কিচি—কিচর-র, কিঁচি-কিচর চ্যাঁচানি শুরু করল।

পৃথু বারান্দার আলোর নীচে বসে বাইরের তুমুল অন্ধকারকে তার গায়ের মিশ্রগন্ধ দিয়ে চিনে নিতে চেষ্টা করতে করতে ভাবছিল, প্যাচাদের প্রেমও বোধ হয় এই রকমই হয়। অনবরত চেঁচিয়ে যাচ্ছে। তারা। হয়তো ওদের ঝগড়া ও ভালবাসার রকমে কোনও তফাত নেই।

কাহলিন গিব্রা-এর ‘প্রফেট’ বইতে আছে যে, বিয়ের উপরে কিছু কথা।

“লেট দেয়ার বী স্পেসেস ইন ইওর টুগেদারনেস্”।

ভেবেছিল, রুষাকে যখন চিঠি লিখবে, রুষাকেও বলবে এই কথা; শুধু পেঁচাদেরই নয়। আরও আছে:

“লাভ ওয়ান অ্যানাদার বাট মেক নট
আ বন্ড অফ লাভ :
লেট ইট রাদার বী আ মুভিং সী বীটউইন দ্যা শোরস্
অফ ইওর সোওল।”

পৃথুর যথেষ্ট পয়সা থাকলে প্রত্যেক দম্পতিকে কাহলিন গিব্রানের “প্রফেট” বইটি কিনে উপহার দিত। ভাল বই একা একা পড়লে বড় ছোট লাগে নিজেকে। ভাল বই কিনে যদি জনে জনে উপহার না দেওয়া যায় মন খারাপ হয়ে যায় বড়।

বিগু কী রাঁধবে তার উত্তর পৃথুর কাছে পেল না।

দুখী ও মেরীর এবং লছমার সিং-এর হাত থেকে বেঁচে এসে এবার এই ক্ষুন্নিবৃত্তির দায় সে ঠুঠার ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে। পুরোপুরিই।

ঠুঠা বড়ই বিব্রত বোধ করে এতে।

কিন্তু পৃথু নির্বিকার।

বিগু প্রায় রোজই বলে, সে বেহেতরীন “হাওয়াই পুটি বানাতে পারে।

বস্তুটি কী? জিজ্ঞেস করাতে জানতে পেরেছিল যে, এক ধরনের পুডিং।

মনে মনে বলেছিল, নো থ্যাঙ্ক ট্য। নো পুডিং; নো স্যুপ।

বিগু ছেলেটা খুবই হাসি খুশি। উজ্জয়িনীর কাছে বাড়ি ওর। সময় পেলেই, মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে ঠুঠার কাছে শিকারের গল্প শুনতে চায়। ঠুঠা রসিয়ে গল্প বলতে পারে না। প্রকৃতই যারা ভাল শিকারি, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই পারেন না। তাতে হতাশ হয়ে, বিগু নিজেরই গল্প বলে চলে, উৎসাহের সঙ্গে ঠুঠা বাইগাকে হাত পা নেড়ে। ঠুঠা বাইগা কোনও প্রাচীন গাছের মতো ঝিম ধরে বসে থাকে। মাঝে মাঝে পাতা একটু কাঁপে। বিগু বলে চলে ওর অমরকণ্টক বেড়ানোর গল্প।

পৃথু চুপ করে বসে অন্যদিকে চেয়ে বিগু আর ঠুঠা বাইগার কথাবার্তা শোনে সম্পূর্ণ অন্য কারণে। বিগুর গলার স্বরের সঙ্গে টুসুর গলার স্বরের আশ্চর্য মিল আছে। অথচ টুসুর চেয়ে বিগু কম পক্ষে পাঁচ বছরের বড়।

টুসুর কথা মনে পড়ে। হঠাৎই মন খারাপ হয়ে যায় পৃথুর। যন্ত্রণা বোধ করতে থাকে এক রকম। যে যন্ত্রণাটা, ওর পায়ের যন্ত্রণার চেয়েও অনেক অনেকই বেশি তীব্র।

“ইওর পেইন ইজ দ্যা ব্রেকিং অফ দ্যা
শ্যেল অফ ইয়োর আন্ডার স্ট্যান্ডিং…
মাচ অফ ইওর পেইন ইজ সেল্ফ চোজেন।”
কাহলিল গিব্রান

পৃথু মনে মনে বলল, মণি চাকলাদার, কবিতা নিজে না লিখে এ সব কবিতা পড়ন। আত্মশুদ্ধি হবে। এই জন্মে কবিতা কাকে বলে তা জেনে নিন; পরের জন্মেই না হয় লেখালেখি করবেন।

যদি পরজন্ম না থাকে? মণি চাকলাদার যেন তাঁর শেয়ালের মতো ধূর্ত চোখ দুটি তুলে বললেন।

ওয়েল! কডনট কেয়ারলেস। উ্য জাসট মিসড দ্যা বাস। সরী পোয়েট। আই মীন, অ্যান অ্যাপলজী ফর আ পোয়েট!

“সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি।”

হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। একটা লেপার্ডের করাতের আওয়াজের মতো শব্দ সামনের ঘোরান্ধকার পাহাড়টার কাঁধের কাছ থেকে ভেসে আসে।

একটা ব্যথা, করাতে কাটার মতোই ব্যথা অথচ আওয়াজহীন; পৃথুর বুকটাকে চিরে চিরে যায়।

একটা একলা টি টি পাখি পাহাড়তলির সব রাতচরা জানোয়ারদের সাবধান করে দিয়ে অন্ধকারে হোগল বাদায় শালটি বাওয়ার মতো করে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে উড়তে থাকে। ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে উড়তে উড়তে ডাকে সে; হট্টি-টি-টি হুট টি-টি-টি হুট।

মানুষদের জগতে কোনও বন্ধু টি-টি পাখি নেই। এই সব অব্যক্ত অস্ফুট তীব্র যন্ত্রণা আচমকা অবচেতনের অন্ধকার থেকে হিংস্র লেপার্ডেরই মতো লাফিয়ে পড়ে অসহায় অপ্রস্তুত চেতন মনকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায় তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে।

হঠাৎই।

টি টি পাখি ডেকে চলে; স্তব্ধ জমাটবাঁধা, সুগন্ধি চৈতি পাহাড়তলির অন্ধকারে; হট্টি-টি-টি-টি হুট, টি-টি-টি-হুট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *