2 of 2

৫৩. আস্তে আস্তে ভিড় কমে আসছে হাসপাতালে

আস্তে আস্তে ভিড় কমে আসছে হাসপাতালে। ফুল, চিঠি এইসবেরই স্রোত চৈত্র মাসের পাহাড়ি নালার জলের মতোই শুকিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।

অবশ্য সমবেদনা বা করুণা সে চায়নি কোনওদিনও কারো কাছ থেকে।

যা পৃথু করেছিল, সেই পুরো ব্যাপারটাই এখন হিন্দি সিনেমার কোনও ঘটনা বলেই মনে হয়।

মগনলালকে তো ও প্রথম দর্শনেই মারতে পারত, বিজ্‌লীর ঘরের দরজা যেই সে খুলেছিল অমনিই, সঙ্গে সঙ্গে।

তবে?

মারল না কেন?

কে জানে কেন! হয়তো একজন মানুষের পক্ষে পরিচয়-জানা অথচ অপরিচিত অন্য মানুষকে মুখখামুখি দাঁড়িয়ে হঠাৎই মারতে হৃদয়ের তীব্র কাঠিন্য লাগে। অথবা হয়তো পৃথুর মধ্যে একজন হিন্দি সিনেমার নায়কই ছিল। অবচেতন মনে। বাহাদুরি-প্রবণতা অনেক মানুষেরই রক্তের মধ্যে নুনের মতোই মিশে থাকে। পৃথুরও ছিল। সময়মতই বাইরে এসেছিল তা। বাহাদুরি করে, হাততালি পেয়ে, তারপরই অনুশোচনা আর আপশোসে নিমজ্জিত হতে হয় সেইসব মানুষদের। এই ক্রমশ-ক্ষীণ-হতে-থাকা দর্শনার্থী ও হিতার্থীদের দলকে লক্ষ্য করে পৃথুর এখন মনে হয় যে, যা কিছুই নিজেরই জন্যে খুশি মনে একজন মানুষ করে, তাইই শুধু থাকে জীবনে। শুধু সেইটুকু আনন্দ এবং গর্বই বুকের মধ্যে বেঁচে থাকে। আর যা-কিছুই করা হয় নিজের বাহাদুরি প্রবণতাকে খুশি করার জন্যে বা অন্যের হাততালি পাবার জন্যে, তার কিছুমাত্রই থাকে না।

দোষ বা মুর্খামি বা এই হাস্যকরভাবে অন্যর মামলায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলার ভুলের মাশুল বাকি জীবন গুণতেই হবে পৃথুকে। উপায় নেই কোনও।

তবে সত্যিই কি শুধুমাত্র বাহাদুরি-প্রবণতার জন্যেই পৃথু করেছিল? এই সবই? নিজের নিস্তরঙ্গ পানা-পুকুরের ঘটনাবিহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবনে হঠাৎই ডাকু মগনলালকে প্রতিপক্ষ পেয়ে ও নিজে কি উল্লসিতও হয়ে ওঠেনি? দৈনন্দিনতার ক্লান্তিতে ন্যুজ, একঘেয়েমির জাঁতাকলে পিষ্ট প্রত্যেক আধুনিক মানুষই বোধহয় লড়াই করার জন্যে সর্বদাই তৈরি হয়ে থাকে। নিজের সঙ্গে, নিজের অনুষঙ্গর সঙ্গে ছায়ার লড়াই লড়ে লড়ে তারা ক্লান্ত। তাইই কোনও শত্রু যখন শরীর ধরে চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়, তখন সেই শত্রু তার ব্যক্তিস্বরূপ ছাড়িয়ে গিয়ে এক শ্রেণীরূপ নেয়; বিবদমান ব্যক্তির সমস্ত শত্রুরই সে তখন প্রতিভূ হয়ে ওঠে। তাকে হারিয়ে দিলে, এমনকি হারাতে না পারলেও, তার সঙ্গে লড়তে পারলেও মনে হয়; ক্লান্তি অপনোদিত হবে, শান্তি পাবে সে।

তবে দুঃখিত নয় পৃথু। জীবনে যা কিছুই নিজেরই কৃতকর্মের ফল, সেইসব ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতির জন্যে বিন্দুমাত্রও দুঃখিত হয়নি ও। পৃথুর বাবা বলতেন, ‘নেভার লুক ব্যাক ইন লাইফ’। কত সুখ, কত দুঃখই তো পেছনে ফেলে এসেছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে খুবই হয় যে, ফাল্গুনের বনমর্মরের মধ্যে কোনও গাছতলায় বসে পেছনের বছরগুলোর সালতামামি করে। কিন্তু নাঃ, এখন আর তাও করতে ইচ্ছে করে না।

সিস্টার লাওয়ান্ডে একটু ঠাট্টা করেই বললেন পৃথুকে, সকালে তো একজনও এলেন না আপনাকে দেখতে, মিঃ ঘোষ?

তাইই তো দেখছি!

পৃথু বলল, সিস্টারের বিদ্রুপকে উড়িয়ে দিয়ে।

মন খারাপ লাগছে?

সিস্টার আবার বললেন।

নাঃ। ভালই লাগছে বরং। কথা বলতে হল না। কথা বলতে ইচ্ছে করে না।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ও ভাবছিল কত মানুষকেই তো দেখে, দেখল। দেখাশোনা তো। দিনভরই চলে, জীবনভর; জন্ম থেকে মৃত্যু, কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যে মনের মানুষ থাকে কজন? চোখ তো কতই দেখে! সকলকেই কি মনে ধরে? সারাজীবনে হয়তো একজন কি দুজনকেই তেমন করে চায় মানুষ! আর যাকে বা যাদের সে চোখের চাওয়া নয়, মনের চাওয়া চায়; তারাই তো হচ্ছে মনের মানুষ!

সিস্টার বললেন, কফি খাবেন নাকি এক কাপ? কর্নেল সিং বলেছেন আর দিন কুড়ি বাদেই আপনাকে ডিসচার্জ করে দেবেন। আপনার রিকভারি, একেবারে মিরাকুলাসলি স্পিডি। স্টিচ তো খুলে দেবেন এই শনিবারই। তারপর এখানেই সকাল বিকেল হাঁটবেন নিজের ঘরে। আর্টিফিসিয়াল লিম্বস থাকতে, আজকাল কেউই ক্রাচ নেন না। আপনি মানুষটা বড় জেদি। বড় বোকা-বোকা জেদ আপনার।

জানি, পৃথু বলল।

তারপর বলল, সিস্টার পিঠের দিকটা উঁচু করে দিন তো। বাইরেটা দেখব একটু ভাল করে। অশ্বখগাছটা। শীত চলে গিয়ে বসন্ত আসছে, বুঝতে পারছেন না? এই জবলপুর শহরেও সারা রাত পিউ কাঁহা আর কোকিল ডাকে। কৃষ্ণপক্ষের শেষ রাতের আবছা, জল-মেশানো দুধের মতো আলোয় কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে এই ঘুমন্ত পৃথিবী। উৎসাহর সঙ্গে উৎকৰ্ণ, উন্মুখ হয়ে দিনের সঙ্গে মিলিত হবে বলে ছটফট করে শীতশেষের রাত, আর পাগলের মতো পাখি ডাকে তখন।

আপনি বড় বেশি রোম্যান্টিক মিঃ ঘোষ। আপনি কবি-টবি হলেন না কেন? এঞ্জিনিয়র না-হয়ে?

পৃথু কথা না বলে চেয়ে রইল সিস্টারের চোখের দিকে।

মনে মনে বলল, আমি তো কবিই! ছন্দ মিলিয়ে অথবা গায়ের জোরেই ছন্দ না-মিলিয়ে যাঁরাই কবিতা লেখেন, পত্র-পত্রিকায় যাঁদের কবিতা ছাপাও হয়; কবি কি শুধু তাঁরাই? জীবনানন্দই বলেছিলেন না, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি?

বাঃ।

পৃথু বলল, বেশ লাগছে এবার। রোদের মধ্যে শীত-যাই-যাই ভাব, সত্যিই বসন্ত আসছে। দেখতে পাচ্ছেন? বসন্ত আপনার ভাল লাগে না সিস্টার? স্প্রিং-টাইম?

একেবারেই না। সিস্টার বললেন।

কেন?

বড় খাটনি বাড়ে। পন্সের কেস আসে হাসপাতালে অনেক। আর পক্সের রুগিরা বড় বায়নাক্কা করে।

ও।

বলল, পৃথু। থ হয়ে। নানারকম মানুষ আছে বলেই এত ইন্টারেস্টিং এখনও এই ধূসর পৃথিবী।

তাহলে আনি কফি?

আনুন। সময় আর কাটে না। কফিই খাই।

সিস্টার চলে যেতেই ওয়ার্ডবয় এল। একটা চিঠি দিল। বেশ মোটা খামটা। ভারীও। পৃথুর নামে, কিন্তু রুষার এবং শ ওয়ালেসের গেস্ট হাউসের প্রযত্নে লেখা। কুর্চির চিঠি। কে জানে, ও হয়তো শুনেছে যে, রুষা জবলপুরেই আছে যতদিন না সুস্থ হয়ে উঠছে পৃথু।

কে দিল?

শ’ ওয়ালেস কোম্পানির তোক হাসপাতালের রিসেপশানে দিয়ে গেছে।

ও।

পিঠটাকে আরও একটু ঠেলে দিল পেছনের দিকে। আরও সোজা হয়ে বসল উঁচু করা বিছানাতে বালিশে হেলান দিয়ে। তারপর খামটা না-খুলে, হাতে নিয়ে জানালা দিয়ে পাতা ঝিলমিল অশ্বখগাছটার দিকে চেয়ে রইল। হঠাৎই বিধুর হয়ে গেল ওর চোখের দৃষ্টি। ট্রাকের হর্ন, দূরের অর্ডন্যান্স, কারখানার ট্রেনের শব্দ, সাইকেল-রিকশার পক্ পঁ আর ক্রিরিং ক্রিরিং শব্দের সঙ্গে পানের দোকানের সামনে থেকে ভ্যাগাবণ্ড আর আড্ডাবাজ, কাজ ফাঁকি দেওয়া কিছু মানুষের মিশ্র শোরগোল ভেসে আসছে।

চিঠিটা এখন খুলবে না ও। কফিটা খেয়েই নেবে আগে। তারপর সিস্টারকে ঘর থেকে একটু বাইরে যেতে বলবে। চিঠি, লেখা বা পড়ার সময় মনে মনে ও নিরাবরণ হয়ে যায়। ঘরে কেউ থাকলে লজ্জা করে। অস্বস্তি লাগে।

সিস্টার কফি নিয়ে এলেন। কফিটা তারিয়ে তারিয়ে খেল পৃথু, চিঠিটাকে কোলের উপর রেখে। আর কোল! কোল মানে তো দুই উরু আর তলপেট। উরুই যার নেই তার আবার কোল কী!

রাগ এবং অভিমানও কম জমেনি এতদিনে কুর্চির ওপর পৃথুর। বিজ্‌লী পর্যন্ত দেখে গেল তাকে। আর যে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, অপারেশানের পর অজ্ঞানাবস্থা থেকে প্রথম জ্ঞানে ফেরার সময় যে মানুষের নামটি সে অবচেতনের গভীর থেকে মন্ত্রোচ্চারণের মতো করে অসহায় উচ্চারণ করেছে বারবার; সেই মানুষটিরই সময় হল না একটিবারের জন্যেও তাকে দেখতে আসার?

কফি খাওয়া শেষ হলে পৃথু সিস্টার লাওয়ান্ডেকে বলল, আপনি অন্য ওয়ার্ড থেকে একটু ঘুরে-টুরে আসতে পারেন। লাঞ্চের আগে তো আর কোনও ওষুধ বা ইনজেকশান দেওয়ার নেই, শুধু শুধু ঘরে আটকে থাকবেন কেন?

সিস্টার বললেন, গাইনি ওয়ার্ডেই যাই। আমাদের, কোলিগ সিস্টার খান্নার নাতি হয়েছে। প্রথম নাতি। পাঁচ কিলো ওজন। একেবারে রোম্যান ফিচারস। অথচ মা বাবা দুজনেই খারাপ দেখতে। যাই, গল্প করে আসি গিয়ে ওদের সঙ্গে।

আসুন।

পৃথু বলল।

এই সময়ে মিসেস খান্নার নাতির জিন অথবা মেয়ের চরিত্র নিয়ে ভাবিত হতে চায় না পৃথু আদৌ। সিস্টার চলে যেতেই, খামটা খুলল। বড় খাম একটা। বেশ ভারী। নিউজপ্রিন্টের মতো খসখসে কাগজে লিখেছে কুর্চি, গোটাগোটা অক্ষরে। কোনও তারিখ দেয়নি।

পৃথুদা,

আপনি আমাকে কী ভাবছেন তা আমি অনুমান করতে পারি। কিন্তু আমার কথা শুনলে আমাকে ক্ষমা করতে বাধ্য হবেন।

এই নতুন জায়গাতে এসে কোনওমতে একটি ডেরা জোগাড় করে একেবারে নতুন করে জীবন আরম্ভ করার চেষ্টা করছিলাম। এরই মধ্যে আবারও বিপদ এল। বিপদ নাকি কখনও একা আসে না, শুনেছিলাম। এখন জানলাম, কথাটা সত্যিই। দিন দশেক আগে আমার বাড়ি থেকে আমার সর্বস্ব চুরি হয়ে গেছে। সর্বস্ব মানে, জাগতিক সম্পত্তি বলতে যা-কিছু। মনের ধন যা-কিছু ছিল তা তো চুরি গেছে অনেক দিন আগেই।

গয়না, যাইই আমার বিধবা মা আমায় দিয়েছিলেন; শাড়ি, জামা এমনকি আমাকে লেখা আপনার চিঠিগুলো পর্যন্ত। আর সবকিছুই রেখে দিয়ে, যদি চিঠিগুলোকেও ফেরত দিত। এই ক্ষতিই আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতি। তবু বাঁচোয়া, চোর বাঙালি নয়। মানে, আশা করছি যে; বাঙালি নয়।

সুখের কথা এরই মধ্যে এইটুকুই যে, ভারী পা-মেশিনটা রেখে গেছে। এই সেলাইকলটা এখন আমার জীবিকা অর্জনের একমাত্র সহায়। কুড়ি গজ ছিট কাপড় কিনেছিলাম, ব্লাউজ বানাব বলে। আমার ব্লাউজ নয়। বিক্রির জন্যে। সেগুলোও নিয়ে গেছে। রঙিন কাপড়ের ঘাগ্রা বানানো ছিল ছটি। সেগুলোও।

এইখানে হাট বসে রবিবারে। আর এখান থেকে তিন মাইল দূরেই অন্য একটি জায়গাতেও হাট। বসে প্রতি শুক্রবারে। দুটি হাটই বেশ বড়। স্থানীয় লোক তো বটেই, বহু দূর দূর থেকে আদিবাসীরা সব আসে এই দুই হাটে। রঙের আর গন্ধের আর শব্দেরই মেলা বসে যেন। এইসবই। আদিবাসী অঞ্চল। বেশিই গোন্দ, বাইগা, পানকা, কুমি। কিছু মারিয়াও অবশ্য আছে। তারা স্থানীয় বাসিন্দা নয়। বাস্তার থেকে এসেছে। কাছাকাছি কারখানাও আছে দুটি। সেখানেই ওদের বেশিরভাগ কাজ করে। কাঠের ব্যবসা তো এখন ফরেস্ট করপোরেশান হবার পর বন্ধই হয়ে গেছে। তবে করপোরেশানের কাঠের ডিপোতে এবং অন্যান্য কাজে অনেকে লেগেও গেছে। ট্রাকের কুলি। ছুট-ছাট কাজের কামিন। বিড়িপাতা, লাক্ষা, বাঁশ এইসবের সঙ্গেও জড়িত আছে। অনেকেরই জীবিকা। এদের বউ-মেয়েদের কাছেই হাতে তৈরি নতুন নতুন ডিজাইনের ব্লাউজ, ঘাগ্রা এসব বানিয়ে বিক্রি করি। শায়া-ব্লাউজ, বড় বড় ব্যবসাদাররা পাইকারি হারে বানায় এবং অনেক সস্তাতে দেয়; আমার মতো সামান্য জনের ওদের সঙ্গে প্রতিযোগিতাতে পেরে ওঠার উপায় নেই। তাইই, মাথা খাটিয়ে নতুন ডিজাইন বের করি, নানা রঙা কাপড় জুড়ে-টুড়ে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করি। মোটামুটি গুছিয়েও এনেছিলাম। ভাবছিলাম। আরও দুটি মেশিন কিনব আগামী সপ্তাহে এবং দুটি মেয়েকে রাখব সেলাইয়ের কাজে সাহায্য করার জন্যে। ওদের শিখিয়ে-পড়িয়েও নিচ্ছিলাম। এমন সময় এই বিপত্তি। .একটা পেট, চলে যাচ্ছিল কোনওরকমে; সম্মানের সঙ্গেই। তবে এই হঠাৎ ক্ষতিটা বেশ কিছুদিনের জন্যে আমাকে পেছিয়ে দিয়ে গেল।

গয়না পরেছি খুব কমই; তবু বাক্সের কোণে যে আছে;.এই জানাটাই মনে বড় ভরসা জাগাত। ভাঁটু চলে গেছে, আমার পৃথুদার সঙ্গে আর রোধহয় দেখা হবে না, এখন গয়নাগুলোও গেল। সিকিওরিটি বলতে আমার আর কিছুমাত্রও রইল না। সিকিওরিটি বোধহয় একধরনের মানসিক ব্যাপার, যতখানি না জাগতিক তা। চলে যাওয়ায়, এখন বুঝি।

আপনাকে এতক্ষণ শুধু আমার কথাই শুনিয়ে গেলাম। আপনি ভাবছেন, কী স্বার্থপর এবং আমি-ময় আমি। আপনি কেমন আছেন সে কথাটাই একবারও জিগ্যেস করলাম না এতক্ষণে। আপনি ভাল আছেন এবং খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠছেন একথা আমি তো জানিই। জানার উপায় আছে বলেই জানি। আপনার দ্রুত সুস্থতায় যতই আনন্দিত হচ্ছি, আবার ততখানি ভীতও হয়ে উঠছি। ভীত হচ্ছি এই কারণে যে, আমি জানি আপনি সুস্থ হয়ে উঠলেই আমার খোঁজে বেরিয়ে পড়বেন হয়তো। কী বলব, আমি আপনাকে এড়াতে এবং আমার সম্মান বাঁচাতেই এত দূরে এসেছি যদিও তবু মনে মনে সব সময় ভাবি আপনি এসে দরজাতে দাঁড়িয়েছেন। নিজের সঙ্গে কেন যে অমন লুকোচুরি খেলা খেলি তা আমি নিজেই বুঝি না। ধরা যখন ইচ্ছে করলেই দেওয়া যায়, তখনই ইচ্ছে করে অন্য পক্ষ খুঁজে মরুক। যে লুকোচুরি খেলায় চোর ইচ্ছে করে ধরা দেয়, তাতে আর যাই থাক; মজা থাকে না একটুও। সত্যিই জানি না, অঙ্গহৃত বেচারি আপনি যদি আমার পর্ণকুটিরের দুয়ারে এসে দাঁড়ানই, ডাক দেন আমাকে, কুর্চি বলে; তখন আমি আমার জীবনে, আমার শরীরে আর বোধহয় আপনাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। সেই ভয়েই মরে থাকি অনুক্ষণ। চাইতে চাইতে চাওয়ার রঙ জ্বলে যায়, জেল্লা নিবে যায় এবং বোধহয় কোনও চাওয়াকে পাওয়াতে যদি পর্যবসিত করতেই হয় আদৌ তাহলে তা বিবর্ণ হওয়ার আগেই হয়তো করা ভাল।

কোনও চাওয়ারই নিজের তো কিছুমাত্রও মূল্য নেই, যদি না তা একদিন পাওয়াতে এসে লীন হয়। বড়ই ভয়ে ভয়ে আছি আমি পৃথুদা। কাঙালেরই মতো আপনি আমাকে চেয়েছেন, কত না ছোট করেছেন নিজেকে আমার কাছে! আর আমি দিনের পর দিন নিজেরই চোখের জলে-ভেজা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আপনাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। যাকে মন তীব্রভাবে চায়, সে যখন এসে ভিখিরির মতো এই সামান্য শরীরটাকেই ভিক্ষা চায় তখন ‘না’ বলতে বুক ভেঙে যায়। সত্যিই যে ভেঙে যায়, তা এদেশে আমার মতো লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত, স্বল্পশিক্ষিত, অত্যাধুনিক হয়ে উঠতে না পেরে ওঠা মেয়ে মাত্রই জানে।

আমাদের কথা, আপনারা কোনওদিনই বুঝবেন না।

ভগবানের কাছে তাইই প্রার্থনা করি, আপনি যেন আমাকে খুঁজে না পান এ জীবনে আর কোনওদিনও। না পেলেই আপনি আমারই থাকবেন চিরদিনের মতো, আমিও থাকব আপনার। আপনি যা চান তা পেয়ে গেলে আমাকে আর চাইবেনই না হয়তো। ভালও বাসবেন না। ভালবাসায় শরীর এসে পড়লে, ভালবাসা মরে যায় পৃথুদা। এ আমার গভীর বিশ্বাস। মায়ার খেলার সেই গানটির মতো সত্যি আর কিছু নেই, “আশ মেটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে”। অমন দুর্দৈব যেন আমার জীবনে না ঘটে কোনওদিনও।

আপনাকে আরও একটা কথা বলে ফেলি এইবেলা। যদিও একথা বোধহয় না বললেই ভাল হত। না বলেও পারছি না যে! ভাঁটুকে, ও দূরের জেলে চলে যাবার আগে, দেখতে গেছিলাম। ওকে জিগগেস করেছিলাম, ও এমন করল কেন? জীবিকার জন্যে ও যা করছিল, যতটুকুই রোজগার ছিল ওর; আমি তো তা নিয়েই সুখী ছিলাম। ও হঠাৎ বড়লোক হবার জন্যে, আমাকে সুখে মুড়েদেবার ইচ্ছেয় গাঁজার চোরাচালানের ব্যবসা কেন করতে গেল?

ও কী বলল জানেন, উত্তরে? বলল, তোমার পৃথুদারই জন্যে।

অবাক হয়ে আমি জিগগেস করলাম, পৃথুদারই জন্যে? কেন?

ও বলল, রাইনাতে আসার পর থেকে পৃথু ঘোষের সঙ্গে নতুন করে দেখা হওয়ার পর থেকেই তুমি বদলে গেছিলে কুর্চি। দেখা হলে তো বটেই, এমনকী তার নাম উচ্চারণ করলেই তোমার, মুখচোখের ভাব বদলে যেত। লেখাপড়া তো আমি শিখিনি। আমি যা, আমি তাইই। আমি তোমাকে কোনওরকম মিথ্যাচার করেও বিয়ে করিনি। তোমার মা আমার সঙ্গে তোমার বিয়েটা সম্বন্ধ করেই দিয়েছিলেন। আমি কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, তোমার সঙ্গে। অন্য কোনও মেয়ের দিকে তাকাইনি। তুমি ছাড়া অন্য কোনও সুখের কথা ভাবিনি। শুধু তোমাকে খুশি রাখতে আমার যতটুকু সাধ্য সবই আমি করেছিলাম। সাধ্য হয়তো আমার বেশি ছিল না; কিন্তু আন্তরিকতার অভাব হয়নি কোনওদিনও, তা তুমি জানো। পৃথু ঘোষ বিলেতে লেখাপড়া করেছেন, তিনি বিরাট কোম্পানির বিরাট অফিসার। তার বাড়ি, গাড়ি, ক্লাব, তার বড়লোক সব বন্ধুবান্ধব। আমি কোনওদিক দিয়েই তাঁকে এঁটে উঠতে পারিনি। আমাকে তো কোনও ক্লাবই মেম্বার করত না। আমার পরিচয় কী! মোটর-সাইকেল ভটভটিয়ে যাওয়া-আসা করা একজন জঙ্গলের ঠিকাদার ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় তো ছিল না আমার। অর্ডার-সাপ্লায়ার। পুরুষের জগতে আমি নিতান্তই অকুলীন। অথচ কুলীন বলে কখনও দাবিও করিনি আমি নিজেকে। তোমার কাছে তো নয়ই।

পৃথু ঘোষের সঙ্গে নতুন করে দেখা হওয়ার পরই তুমি আমার কাছ থেকে দ্রুত সরে যেতে থাকলে। তোমাকে যখন আদর করতাম, তখন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারতাম যে; চোখ বুজে তুমি আলো-নিবোনো ঘরে পৃথু ঘোষকেই কল্পনা করছ। আমাকে নেহাত আদরের যন্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করছ। আমি কি বুঝতে পারতাম না ভেবেছ? তখন আমার মনে হত, বোধহয় কোনও মৃতদেহকেই . আদর করছি। তারপর ভেবে দেখলাম, আমারও একটা গাড়ি কিনতেই হবে, বাড়ি করতেই হবে; ওই হাটচান্দ্রাতেই। এবং সে গাড়ি, সে বাড়ি, সেই বসবার ঘর, বাবুর্চি-বেয়ারা-চাকরবাকর সবাই পৃথু ঘোষের যা আছে তার চেয়ে অনেকই ভাল আমার চাই। পৃথু ঘোেষকে স্বক্ষেত্রে হারাতে না পারলে, তোমাকে ফিরে পাবার কোনওই উপায় ছিল না আমার। অত টাকা চোরাচালানের দলে না ভিড়লে আমি কী করে পেতাম বলো কুর্চি? কে আমাকে অত তাড়াতাড়ি অত টাকা দিত? এই পৃথিবী আজকাল এমনই হয়ে গেছে যে, যেন-তেন-প্রকারেণ কিছু টাকার মালিক হয়ে যেতে পারলেই সকলেই সেই মানুষের অতীত সহজে ভুলে যায়। যে এইভাবে বড়লোক হয়, বা সমাজের একজন হয়ে ওঠে; সে নিজেও বোধহয় ভুলে যায় তার অতীতকে সবচেয়ে আগে। নিজেকে বোঝাতে থাকে যে, চিরদিনই সে এমনই ছিল। টাকাটা এসে গেলেই, সে যেমন করেই আসুক না কেন; টাকাওয়ালা মানুষ তখন রেসপেক্টেবল হয়ে ওঠে। তার বাড়িতে তখন বড় বড় লোকের আনাগোনা। ক্লাবে গিয়ে সে যদি অনেক সই করে, তাহলে সে, সব ক্লাবেরই একজন মান্যগণ্য মেম্বার। তাইই তাড়াতাড়ি অনেক টাকা রোজগার করার জন্যেই ওই পথ বেছে নিয়েছিলাম আমি, এই পরিচয়হীন গুণহীন ভাঁটু। তোমাকে আবার আমার করে ফিরে পাব এই আশাতেই পৃথু ঘোষকে আমাদের জীবন থেকে তুলে নিয়ে পিত্তি-গলে-যাওয়া পাড়হে মাছেরই মতো ছুঁড়ে দূরে ফেলে দিতে পারব বলে।

ভাঁটু আরও কী বলল জানেন পৃথুদা? তা শোনা অবধি আমি ভয়ে আধমরাই হয়ে আছি। শুনলে, আপনিও হয়তো তাইই হবেন। ভাঁটু বলল, জেলে এত বছর কাটানোর পর কী আর বাকি থাকবে আমার জীবনের? চোর, বদমাস, ডাকাত, খুনী, বলাকারকরা সব মানুষদের সঙ্গে ওঠাবসা করে আমি তো ওদেরই মতো হয়ে যাব। কী ব্যবস্থা বলো এই দেশে! অপরাধীদের কোনওই শ্রেণীবিচার নেই। ভাল লোকও জেলে ঢুকলে অপরাধী হয়েই বেরিয়ে আসে; নেহাত সঙ্গদোষেই। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যেদিন তোমার কাছে গিয়ে পৌঁছব, সেদিন তুমি আমাকে হয়তো চিনতেই পারবে না, চিনতে পারলেও তুমি হয়তো অস্বীকার করবে আমাকে। এ যে অনেকই লম্বা সময়! তুমি যত লম্বা ভাবছ কুর্চি, তার চেয়েও অনেকই বেশি লম্বা। এবং জেল থেকে বেরিয়ে আসার মুহূর্ত থেকেই আমি, আবার জেলে যাবার জন্যে অথবা ফাঁসিতে ঝুলবার জন্যেই তৈরি হতে . থাকব হয়তো।

পৃথুদা, আমি অবাক হয়ে ভাঁটুকে বললাম, কেন?-তা কেন?

ও বলেছিল, খুন করব আমি, তোমার পৃথুদাকে। জেল থেকে বেরিয়েই আমি খুন করব তাকে, যে আমার জীবনের শনি, যে আমার আজকের এই অবস্থার জন্যে দায়ী, সে কি ভাবত, আমি এতই বোকা যে, কিছুই বুঝতাম না?

আমি ভাঁটুকে বললাম, পৃথুদার কী দোষ? দোষ তো আমারই! তুমি না হয় তার চেয়ে আমাকেই খুন কোবরা। ভালবাসা কি মানুষ ইচ্ছে করে, চেষ্টা করে বাসতে পারে? ভালবাসা হয়ে যায়; ঘটে যায়। যখন তা ঘটে, তখন দোষ-গুণের প্রশ্ন থাকে না ভাঁটু। যা অবধারিত, তাইই ঘটতে থাকে। দোষ তো আমারই বেশি। আমাকেই শাস্তি দিও তুমি।

ভাঁটু জ্বালা-ধরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে; একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, দরকার হলে তোমাকেও খুন করব আমি। যার সবই হারিয়ে গেছে তার হারানোর ভয় তো আর থাকে না। মান-সম্মান, তুমি; সবকিছুই তো হারিয়ে গেছে আমার। পাঁচ বছর পর জেল থেকে যে-মানুষটা ছাড়া পাবে সে তো এই ভাঁটু নয়। সে যে কী করবে আর করবে না, তা একমাত্র সেই ভাঁটুই জানে।

কী করব এখন আমি পৃথুদা? কী হবে আমার? আমার জীবনে, এত অসহায়, একা-একা, কষ্টর জীবনের নিত্যসঙ্গী এখন শুধুই ভয়। অনেক রকম ভয়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আপনি যদি আমাকে খুঁজে বের করেন, সেই ভয়। জেলখানা থেকে বেরিয়ে ভাঁটু এসে যদি আপনাকে সত্যিই খুন করে; সেই ভয়।

আপনার জন্যে বড় কষ্ট হয় পৃথুদা। ভাঁটু যেমন মনে করে, তার জীবনের সমস্ত অসুখের মূলে আপনি; আপনিও কি তেমনই মনে করেন যে, আপনার জীবনের সমস্ত অসুখের মূলেও আমিই? রুষাবৌদিও কি মনে করেন যে, আপনাদের দুজনের জীবনের সব অসুখের জন্যে আমিই দায়ী?

এসব ভাবতে গেলেই সব গোলমাল হয়ে যায়। আপনি বড়ই একা হয়ে গেছেন পৃথুদা। বড় একা। একা একা এমন করে একজন মানুষ কি বাঁচতে পারে? আপনার জন্যে সত্যিই বড় কষ্ট হয় আমার। কিন্তু আমি নিরুপায়। যদি পারেন, তাহলে আমার এই লজ্জাময় অপারগতা ক্ষমা করে দেবেন। নিজগুণে।

জানবেন যে, আপনার কথা আমার সব সময়ই মনে পড়ে। দিনে রাতে প্রতিটি মুহূর্ত। আমার এই পর্ণকুটিরের পেছনেই একটি পাহাড়ী নালা আছে। আর সামনেই মাথা উঁচু করা গহন জঙ্গলে মোড়া সাতপুরা পর্বতশ্রেণীর পাহাড়ের পর পাহাড়। শীত চলে যাচ্ছে। বসন্তর পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। আমার বাড়ির ঠিক পেছনের জঙ্গলেই, নালার পাশে একটি পাগলা কোকিল থাকে। বসন্ত কবে আসবে তার ঠিক নেই, তার দোসরও নেই, তবু সারা রাত সারা দিন সে গলার শিরা ফুলিয়ে কেবলই পুলকভরে ডাকে কুউ-উ-উ, কু-উ-উ-উ। মাঝে মাঝে আবার একসঙ্গে ঘন ঘন ডাকে বার বার কু-কু-কু-কু-উ-উ…। আর সারা রাত ধরে ডাকে পিউ কাঁহা পাখি। মনটা হু হু করে। সাহেবরা ঠিক নামই রেখেছিল এই পাখির। ব্রেইন-ফিভার। মস্তিষ্কের জ্বরই বটে!

প্রহরে প্রহরে পেছনের নদীর খোলে শেয়াল আর শেয়ালনি হুক্কা-হুয়া হুক্কা-হুয়া করে তাদের সহজ শরীরী আনন্দ দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়ে রাত কত হল তা ঘোষণা করে।

শেয়াল-কুকুর হয়ে জন্মালেও বেশ হত! তাই না পৃথুদা? মানুষ হয়ে জন্মানো বড়ই কষ্টের।

—ইতি আপনার কুর্চি।

চিঠিটা পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ উদাস চোখে অশ্বত্থগাছটার দিকে চেয়ে রইল পৃথু। চিঠিটা খোলা রইল তার বুকের উপরে।

বেচারি কুর্চি! বেচারি রুষা! বেচারি বিল্লী! বেচারি ভাঁটু! অন্য সব মানুষের দুঃখের কাছে নিজের দুঃখটাকে দুঃখ বলেই মনে হয় না আর। ভাগ্যিস অন্যর দুঃখে দুঃখী হওয়ার ক্ষমতা হারায়নি এখনও।

একা কে নয়? কোন মানুষ একা নয় এই সংসারে কুর্চি? যে-মানুষ ভাবে যে, সে নয়; তার ভাবনা বোধ হয় এখনও পুরোপুরি জমাট বাঁধেনি। আসলে, সকলেই একা। একা আসা, একা ভাসা; একা চলে যাওয়া। আসা, আর যাওয়া। এই দুই মেরুর মধ্যে যা কিছু ঘটনা ঘটে, সান্নিধ্য, উষ্ণতা, পুতুলের সংসারের লীলাখেলা; সেই সবই আধিক্য। মেরুমিলনের চিহ্ন আদৌ নয়। কুমেরু এবং সুমেরু চিরদিনই একা, তাদের মাঝের পৃথিবীতে যত কলরোলই থাকুক না কেন!

পৃথু ভাবছিল, কার যে কার কাছে কখন হেরে যেতে হয় অসহায়ের মতো; তা যদি আগে জানা যেত! দুর্ধর্ষ ডাকু মগনলাল হেরে গেল কবিতা-লেখা বাঙালি পৃথুর কাছে। পৃথু হেরে গেল একটা অশিক্ষিত, কুদর্শন, সামান্য, মোটা দাগের মানুষ ভাঁটুর কাছে।

ভাঁটু তাকে সত্যিই কি হারিয়ে দিল?

একটা শালিক উড়ে এসে বসল জানালার তাকে। তারপর, ঘর নিস্তব্ধ দেখে, পর্দার ফাঁক দিয়ে সাহস করে রোদ যেখানে লাফিয়ে নেমেছিল ঘরের মেঝেতে, সেই রোদের হলুদ কাঁথার উপরে লাফিয়ে নামল সেও। ডাকল একবার কিচির করে।

একা-শালিক দেখলেই টুসু বলে, ওয়ান্ ফর সরো।

কমলা রঙা রোদ ও খয়েরি রঙা শালিকের দিকে চেয়ে-থাকা পৃথু চোখ দুটি বন্ধ করে, মাথাটা বালিশে হেলিয়ে দিল।

টুসু ছেলেমানুষ, তাই জানে না যে শুধু শালিক নয়, ওয়ান ইজ ওলওয়েজ ফর সরো। অ্যান্ড টু; ওলমোস্ট ওলওয়েজ ফর জয়।

ওলমোস্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *