উপন্যাস
গল্প

নরোত্তম রোবটের প্রথম কেস

নরোত্তম রোবটের প্রথম কেস

শার্লক হোমস কলেজের চত্বরে ফার্ন গাছের নীচে বসে নরোত্তম অবাক হয়ে দেখছিল, সামনের পাহাড়ের গায়ে একজোড়া রামধনু উঠেছে। রামধনু ওঠার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সে জানে। কিন্তু একজোড়া রামধনু ওঠার কথা কখনও শোনেনি।

নরোত্তমের পুরো নাম নরোত্তম পহেলা। শার্লক হোমস কলেজের সে-ই হবে প্রথম পাস-করা গোয়েন্দা। মানে, যদি ফাইনাল পরীক্ষায় এবার এক চান্সে পাস করতে পারে। চার বছর আগে এই কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ে প্রথম ছাত্র হিসেবে সে যোগ দেয়। দার্জিলিঙের টয় ট্রেন কি বোটানিক্যাল গার্ডেনের মতোই নামডাক গোয়েন্দাগিরি শিক্ষাদানের এই কলেজের। ছাত্রসংখ্যা তেইশ।

আজকের বিচারে সংখ্যাটা হাস্যকর নিশ্চয়। কিন্তু আমাদের কাহিনি আরম্ভ হচ্ছে সেই যখন ইট আর সিমেন্টের যাবতীয় বাড়ি দার্জিলিং থেকে নির্মূল করার কাজ শুরু হয়েছে। ইতিহাসের কথাই উঠল যখন, এটাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, শার্লক হোমস কলেজই পৃথিবীর প্রথম রোবট-গোয়েন্দা তৈরির শিক্ষায়তন। রোবট মানে কিন্তু সেই খটমটে নাটবোল্ট আঁটা ব্যাপার নয়। রক্তমজ্জাবিশিষ্ট অ্যান্ড্রয়েড।

পায়ের ওপর কী একটা যেন খসে পড়ল। চমকে উঠল নরোত্তম। তাকিয়ে দেখে জ্যাকি জিব বের করে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে আর ল্যাজ নাড়ছে। আর নরোত্তমের পায়ের ওপর পড়ে রয়েছে আগাথা ক্রিস্টির লেখা মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস। বদমাশটা মুখে করে টেনে এনেছে বইটা। নরোত্তম বিরক্তিভরে পা ঝাঁকিয়ে বইটাকে পাঁচ ছ-মিটার দূরে ছিটকে দিল। কলেজের লাইব্রেরি থেকে বাধ্য হয়ে যে কটা সেকেলে বই তাকে ইশ্য করতে হয়েছে, তার মধ্যে এটা একটা। নরোত্তম শুধু শুধু সময় নষ্ট করতে ভালোবাসে না। আজকের দুনিয়ায় এসব পুরোপুরি অচল। এমনকী, ভাবলে তার হাসি পায়। যে, শার্লক হোমসেরও মানুষ আর খরগোশের রক্তের তফাত ধরতে এত দেরি হয়েছিল যে, তার ফাঁকে কোনান ডয়েল একটা গল্প লিখে ফেলেন। কিন্তু এসব যুক্তি কলেজ অধ্যক্ষের কাছে গ্রহণীয় নয়। ভাইভা-ভভাসিতে ক্লাসিক গোয়েন্দা কাহিনি থেকে প্রশ্ন আসবেই।

ক্রিস্টির পেপারব্যাক মুখে নিয়ে জ্যাকি আবার তার পায়ে অর্পণ করতে নরোত্তম বলল, তুই যেন কোয়েশ্চন পেপার দেখে এসেছিস মনে হচ্ছে?

মুখে যা-ই বলুক, বইটা নরোত্তম তুলে নিয়েছে। অ্যান্ড্রয়েডের কুকুর পোষা বিরল ঘটনা। রাস্তা থেকেই কুড়িয়ে এনেছিল জ্যাকিকে। জন্মের পর থেকেই গলায় ইনফেকশন ছিল। মায়ের দুধ অবধি খেতে পারছিল না। জ্যাকির মায়ের কিছুই করার ছিল না। সে দিন চাঁদনি রাতে হস্টেলের নিয়ম ভেঙেই নরোত্তম পায়চারি করছিল। পথের ধারে জ্যাকির ম্রিয়মাণ কান্নাকে অবহেলা করতে পারেনি। নরোত্তম আঙুলের ডগা দিয়ে পেট টিপে নির্ভুল জেনে নিয়েছিল, ক্যালোরি জল, প্রোটিন বা অ-প্রোটিন, ঠিক কোনটা ও কতটা তার প্রয়োজন। মানুষের হাতে পড়লে জ্যাকি বাঁচত না।

.

পরীক্ষার রেজাল্ট জেনে গেছে নরোত্তম, কিন্তু মার্কশিট পায়নি। এখনও প্র্যাকটিক্যালের ডেট পড়েনি। সেই জন্য ফলও প্রকাশ হচ্ছে না। দেরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অভিযোগ করার কোনও মানে হয় না।

এটাকে প্র্যাকটিক্যাল টেস্ট না বলে নরোত্তমের প্রথম কেসও বলা যেতে পারে। বানানো কেস নয়। ফলে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।

নরোত্তমের চিন্তা অন্য কারণে। দু-মাসের মধ্যে পৃথিবীতে বা মহাকাশের উপনিবেশের কোথাও যদি একটিও অপরাধ না ঘটে থাকে, তাহলে তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার। না জুটবে চাকরি, না জমবে স্বাধীন পেশা।

জ্যাকি কোত্থেকে ছুটে এসে ডাকাডাকি শুরু করে দিল। নরোত্তম প্রথমে কানও দেয়নি। জ্যাকি প্যান্ট ধরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে এল তাকে প্রিন্সিপালের ঘরে।

প্রফেসার প্রধান একটা কম্পিউটার প্রিন্ট-আউট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, গাড়ি রেডি। পনেরো মিনিটের মধ্যে না বেরোলে বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট মিস করবে। তোমার প্রথম মামলার ডাক এসেছে চাঁদের দেশ থেকে।

এরকম আচমকা তলবের জন্য নরোত্তম তৈরি ছিল। জ্যাকিকে ভরে নিয়েছে একটা রাসায়নিক কিট-বক্সে। রকেটে চড়ে পাড়ি দেওয়ার সময় জ্যাকিকে নিতে পারবে না, কিন্তু আপাতত ডোমেস্টিক ফ্লাইটে কোনও অসুবিধে হবে না।

বাগডোগরা থেকে দিল্লির ফ্লাইটটা ধরার পরে নিশ্চিন্ত বোধ করল নরোত্তম। পকেট থেকে টেনে নিল প্রফেসার প্রধানের নির্দেশ। তার প্রথম কেসের সংক্ষিপ্ত পশ্চাৎপট।

চাঁদের পিঠে একটি পর্যবেক্ষণকেন্দ্র তিন বছর ধরে কাজ করছে। চারজন বিজ্ঞানী বাস করে সেখানে। তিন দিন আগে, ৭ অক্টোবর একটি বিশাল উল্কা এসে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে তাদের ক্যাম্প। জীবিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন কোনওক্রমে পাঠিয়েছে। বিপদবার্তা। তারপরেই সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন।

নরোত্তমের মনে পড়ে যায়, শার্লক হোমস কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল পৃথিবীর বাইরে মহাকাশের বিভিন্ন মানব-বসতির প্রয়োজন মেটাবার ইচ্ছে। একটা ছোট্ট হিসেব সেরে নেয় সে। যতই চেষ্টা করা যাক, নরোত্তম চাঁদের মাটিতে পা দেওয়ার আগেই ওই ভয়ংকর দুর্ঘটনার পর এগারোটা দিন পেরিয়ে যাবে। জীবিত কাউকে পাবে কি নরোত্তম?

চান্দ্র উপনিবেশে তিন বিজ্ঞানীকে জীবিত দেখবে, এটা ভাবতেও পারেনি। কোপার্নিকাস পর্বতমালার ধারে তাদের পল্লির চেহারা প্রথম চোখে পড়ার পর সে ভেবেছিল, এখন শুধু চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। চার বিজ্ঞানীর চারটি কটেজের মধ্যে তিনটি পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আর এই কটেজেরই একেবারে পাশে বেশ কয়েকটি ছোটখাটো ঘরবাড়ি–গবেষণাকেন্দ্রও ধ্বংসস্তূপে পরিণত।

এয়ার-লক খুলে রকেটের সিঁড়ি বেয়ে চাঁদের মাটিতে পা রাখামাত্রই ওয়্যারলেস বার্তা কানে এল, ওয়েলকাম। ওয়েলকাম। ডক্টর বরদলই ও চ্যাটার্জির তরফ থেকে আমি ডক্টর সরকার আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা সবাই রয়েছি চার নম্বর কটেজে। প্লিজ, হেল্প আস!

নরোত্তম স্পেশ্যাল ফুডপ্যাক হাতে নিয়ে চার নম্বর কটেজে ঢুকল। একজন শোয়ার মতো খাটে দু-জন। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আর মেঝের ওপর পড়ে রয়েছে আর-একজন–স্লিপিং ব্যাগ খুলে–তার মুখের কাছে একটা মাইক্রোফোন। ডক্টর সরকার মাথাটা তুলে নরোত্তমের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করেই আবার শুয়ে পড়েছে।

প্রথম কাজই হচ্ছে মেডিক্যাল চেক আপ। অ্যান্ড্রয়েডদের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই নরোত্তম বুঝল, তেমন ভয়ের কিছু নেই। খাদ্যের অভাব হয়েছে। ঠিকই, কিন্তু সম্ভবত জল নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি।

ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়ে দিল নরোত্তম, স্ট্রেচার নিয়ে গাড়ি পাঠাবার দরকার নেই। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সবাই হেঁটেই পৌঁছে যাবে রকেটের চন্দ্রযানে।

সবাইকে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। এখন হাতে ঘণ্টাখানেক সময়। কটেজের মধ্যে চোখ বুলিয়ে দেখল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কোনও স্পর্শ পড়েনি। বায়ুনিরোধক ও অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা অচল হয়ে গেলে এরা কেউ বাঁচত না। ঘরের কোণে দুটো জলের ট্যাংক দেখে একটু খটকা লাগল। দুটো কেন?

ট্যাংক দুটোর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে নরোত্তম দেখল, এখনও একটার তলায় কিছুটা জল রয়েছে। খুব সতর্কভাবে র‍্যাশন করে জল খেয়েছে তিনজনে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, একটা ট্যাংক খুব সম্প্রতি এখানে টেনে আনা হয়েছে। অ্যান্ড্রয়েডের আঙুল লিনোলিয়াম চাদরের ওপর থেকে তার প্রমাণ সংগ্রহ করেছে।

ডক্টর সরকারের গলা কানে এল, এই ট্যাংকটা আমরা এক নম্বর কটেজ থেকে উদ্ধার করতে পেরেছি বলেই এ যাত্রা বোধহয় রক্ষা পাওয়া গেছে মিস্টার…

নরোত্তম।

ডক্টর সরকার নরোত্তমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। নরোত্তম বলল, চলুন, বাইরেটা একবার দেখে আসি।

অক্সিজেন মাস্ক পরে সরকার বেরিয়ে এল। রাস্তার দু-ধারে দুটি করে কটেজ। ওরা বেরিয়ে এসেছে চার নম্বর থেকে, ঠিক সামনেই রয়েছে বিধ্বস্ত এক নম্বর। চার নম্বরের পাশে দুই, আর এক নম্বরের পাশে তিন নম্বর কটেজেরও একই অবস্থা। নরোত্তম লক্ষ করল, কটেজগুলো বিধ্বস্ত হলেও তাদের নম্বর-লেখা ফলকগুলো দাঁড়িয়ে আছে।

সরকার বলল, আমরা তিনজন পর্যবেক্ষণে বেরিয়েছিলাম বলে বেঁচে গেছি। ডক্টর নাইডুর স্টমাক আপসেট হয়েছিল বলে বেরোননি, আর সেইটাই হল…

নাইডুর কটেজ কোনটা?

এক নম্বর। কিন্তু আমরা ওকে ওখান থেকে বের করে এনেছি। আগুন রোধ করার পোশাক পরে নিয়েছিল, তাই পুড়ে যায়নি, কিন্তু কটেজেরই কোনও অংশ ভেঙে মাথার হেলমেট সমেত…

জলের একটা পাত্র ছাড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে আর কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি, তা-ই না? নরোত্তম প্রশ্নটা করেই তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সরকারের দিকে। একই সঙ্গে মনোভাব বিশ্লেষক রেকর্ডারটাকেও চালু করে দিয়েছে বেল্টের সঙ্গে যুক্ত সুইচ টিপে।

সরকার হেসে বলল, ঠিক ধরেছেন। ওটা না পেলে আমাদের বাঁচার কোনও উপায়ই থাকত না।

চাক্ষুষ কোনও বিকার ধরা পড়েনি, কিন্তু নরোত্তমের ইলেকট্রনিক মগজ সংগ্রহ করে নিয়েছে যে, সরকার রীতিমতো বিব্রত। তার পাস রেট ও রক্তের চাপের বৃদ্ধি দূর নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র রেকর্ড করেছে ও জানিয়ে দিয়েছে।

নরোত্তম জিজ্ঞেস করল, নাইডুকে কি আপনারা কবর দিয়েছেন?

 নিশ্চয়। সেইটাই ছিল প্রথম কাজ। বিশেষত নাইডু যখন ক্রিশ্চান।

কোথায়?

দু-শো মিটার দূরে, চাঁদের রুক্ষ অসমতল প্রান্তরের মধ্যেই একফালি জায়গাকে কিছুটা মসৃণ করে নাইডুকে ওরা শুইয়ে দিয়েছে। একটা ফলকও লাগিয়েছে। যদিও সেটা ঠিক ক্রস চিহ্নের মতো দেখাচ্ছে না।

নরোত্তম ঘড়ির দিকে তাকাল। আরও আধ ঘণ্টা সময় আছে। বলল, ধন্যবাদ। ডক্টর সরকার, আপনি বরং কটেজে ফিরে যান। মনে হয় আপনার সহকর্মীরা অনেকটা রিকভার করেছেন এতক্ষণে। ঠিক আধ ঘণ্টা বাদেই আমরা রওনা হব পৃথিবীর দিকে।

শবব্যবচ্ছেদ করবেন? সরকারের প্রশ্নটা নিরীহ কৌতূহল কি না, ঠিক বুঝতে পারল না নরোত্তম। এই মুহূর্তে তার অনুভূতি বিশ্লেষক যন্ত্রটা চালু ছিল না।

শবব্যবচ্ছেদ তো নিশ্চয়। কিন্তু নরোত্তম চায় না যে, সরকার দেখুক, কী পদ্ধতিতে কাজটা সে সারবে। সরকারকে দেখিয়ে দেখিয়ে সে মাটি সরাতে শুরু করেছিল। সরকার অদৃশ্য হতেই পকেট থেকে বের করে নিল আলট্রাসনিক ড্রিল। ছ-ভোল্টের ব্যাটারিচালিত ড্রিল দু-মিলিমিটার ব্যাসের গর্ত খুঁড়েছে। তার মধ্যে দিয়ে নরোত্তম নামিয়ে দিয়েছে প্রোব।

মস্তিষ্কের আঘাতজনিত মৃত্যু।

কিন্তু পাকস্থলীতে এমন কিছু পাওয়া যায়নি, যা সামান্যতম অস্বস্তিরও কারণ হতে পারে।

শার্লক হোমস কলেজের কমিটি রুম। লম্বা টেবিলের একধারে শুধু নরোত্তম। আর প্রিন্সিপালকে মাঝখানে রেখে দশজন বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞ ওত পেতে বসেছেন। তার মুখোমুখি।

নাইডুর স্টমাক ট্রাল হয়নি, বুঝলাম। এটাও আমরা শুনেছি যে, তিনজন বিজ্ঞানীই এ ব্যাপারে মিথ্যে কথা বলেছে। কিন্তু কেন? একজন অধ্যাপক প্রশ্ন করলেন।

কারণ খুব সোজা। নাইডু মোটেই দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। তাকে খুন করা হয়েছে। খুব ভেবেচিন্তে। নরোত্তম চেয়ারের ডগায় এগিয়ে বসেছে। পরীক্ষকরা রীতিমতো বিস্মিত।

হ্যাঁ স্যার। ঠিক তা-ই। এই দেখুন নরোত্তম একটা নীল কাগজের নকশা বের করে টেবিলের ওপর পেতেছে, এটা আমি ফিরে এসে মহাকাশ বিজ্ঞান সংস্থার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। এই ছিল মূল কটেজগুলোর নম্বর। এর মধ্যে এক নম্বর কটেজে থাকতেন নাইডু। কিন্তু আমি আপনাদের আগেই বলেছি যে, ওখানে গিয়ে আমি দুই আর চার নম্বর কটেজকে এক সারিতে দেখি। তার মানে ওরা দুর্ঘটনার পর কটেজের নম্বর-লেখা ফলকগুলো বদলে দেয়। এককে চার ও চারকে এক করে। সত্যি বলতে, কটেজের নম্বরগুলোর মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলাই প্রথম আমাকে অবাক করেছিল। হয় সংখ্যাগুলো থাকবে ক্লক বা অ্যান্টিক্লকওয়াইজ, না হয় ১-৩ ও ২-৪ জাতীয় জোড়-বিজোড় সমাহারে। তা কিন্তু ছিল না।

এই প্রশ্নটার উত্তর কিন্তু ওখানে বসে তুমি পাওনি, তা-ই না? প্রিন্সিপাল বললেন।

 ইউ আর রাইট স্যার। কিন্তু ওখানেই দ্বিতীয় যে জিনিসটা চোখে পড়েছিল, সেটা হচ্ছে জল। ওদের কারও জলকষ্ট হয়নি। কারণ ঘরে দুটো ড্রাম ছিল এবং তাতে জল যা ছিল, সে জলে ওরা আরও দিন চারেক বাঁচতে পারত। রকেটে চড়ে ফেরার পথে আমি প্রত্যেককে আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কত দিনের মধ্যে রিলিফ আশা করছিল তারা? দশ থেকে পনেরো দিন। মোটামুটি এই উত্তর। অর্থাৎ, পনেরো দিনের কথা ভেবেই ওরা র‍্যাশন করেছিল। এবার ভেবে দেখুন, তিনজনের জায়গায় যদি চারজন থাকত, তাহলে কিন্তু…

নরোত্তমকে সংক্ষেপে কথা বলার শিক্ষা দেওয়া দরকার, তাই বাধা দিলেন বোর্ডের চেয়ারম্যান, কে খুন করেছে নাইডুকে?

উত্তর দেওয়ার সুযোগ পায়নি নরোত্তম। পশ্চিমের খোলা জানলা টপকে একবার সাড়া দিয়েই জ্যাকি সোজা তার কোলের ওপর লাফিয়ে উঠেছে।

নরোত্তম তাকাল। সকলেরই ভুরুতে বিরক্তি, মুখ থমথম করছে। শার্লক হোমস কলেজের ডিসিপ্লিন ও পবিত্রতা নষ্ট করেছে নরোত্তম বা তার প্রশ্রয়।

মরিয়া হয়ে নরোত্তম বলল, সরি! কিন্তু আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে, এই হত্যা রহস্য সমাধানের মূলসূত্রের জন্য আমি জ্যাকির কাছে কৃতজ্ঞ। ও-ই আমাকে জোর করে পড়িয়েছিল মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস৷ যেখানে ট্রেনের সব যাত্রী একসঙ্গে ষড়যন্ত্র করে একজনকে হত্যা করেছিল। এখানেও তা-ই ঘটেছে। সবাই মিলে, প্রাণে বাঁচার জন্য…।

কিন্তু নাইডু কেন?

কারণ, নাইডুর কটেজটাই বেঁচে গিয়েছিল এবং সম্ভবত নাইডু, তার নিজের জলের পাত্রটি হাতছাড়া করতে চায়নি। নিজের সম্পত্তি হিসেবে একা সুবিধে ভোগ করতে চেয়েছিল। এমনও হতে পারে, বাকি তিনজনকে হয়তো সে তার কটেজে ঢুকতে দিচ্ছিল না।

জ্যাকি স্পষ্ট বলল, ঘেউঘেউ!

[আনন্দমেলা, ৮ জুলাই ১৯৯২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *