উপন্যাস
গল্প

ছুটির দিনে চাঁদে

ছুটির দিনে চাঁদে

টেকো!

সাড়া নেই।

 টেকো!

তবু সাড়া নেই।

 টে-এ-কো-ও-ও!

এবার নির্দেশমতো দুলিয়ে দুলিয়ে বলেছি কথাগুলো, কিন্তু সাড়া তো দুরের কথা, টেকোর বুকপকেটের অসিলোস্কোপের সবুজ হিজিবিজি অবধি চোখে পড়ছে না।

নিশ্চয় শুনতে পাচ্ছে না। কানের বৈদ্যুতিন বর্তনীতে কোথাও গোলমাল হয়েছে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই। টেকোর একটা কান কালা বলেই না অত সস্তায় ভাড়া পেয়েছি। অবশ্য রোনুষ ইলেকট্রনিক্সের সেলসম্যান বোঝাতে চেয়েছিল, ওর মাথার চুল নেই বলেই এতদিন পড়ে ছিল। রোবট রূপবান হলে আরও বেশি কদর পায়। বিশেষ করে ঘরের কাজ করার জন্যে যাকে নিয়োগ করা, সারাক্ষণ তো সে চোখের সামনেই ঘুরঘুর করবে।

আসলে রোবটমানুষ উৎপাদনকারী সংস্থা হিসেবে রোনুষ একচেটিয়া কারবার আরম্ভ করার পর থেকেই তাদের পণ্যের মান নিম্নমুখী। আমরা যতই চ্যাঁচামেচি করি, এরা মুখ টিপে হাসে, ভালো করেই জানে যে, আজকের দিনে প্রত্যেক ঘরে একটি করে রোনুষ না থাকা মানেই জীবনযাত্রা পঙ্গু। সেই সুযোগটাই নিচ্ছে। টেকো বিকল হল কেন বলে কমপ্লেন করলেই মুখের ওপর জবাব দিয়ে দেবে–সেকেন্ড হ্যান্ড সস্তা জিনিস ভাড়া নিলে এরকম হবেই। আমাদের থার্টি-সিক্সথ জেনারেশন রোনুষ নিয়ে দেখুন। নো ট্রাবুল। সে তো খুবই সত্যি। কিন্তু তখন মাসে মাসে যে টাকা গুনতে হবে, তাতে আর আমার পক্ষে এ ঘরে থাকা সম্ভব হবে না। ঘরটা ছাড়ার ইচ্ছে নেই বলেই না…

এমনিতেই তো বছরে একবার মাত্র দেখা হয় বাবা, মা ও ছোট্ট বোনটার সঙ্গে। আরও দূরে, কম ভাড়ার ঘরে যেতে হলে দু-বছরেও একবার যাবার সময় পাব কি না সন্দেহ। আমায় লোকে যতই সেকেলে বলুক, টিভি-ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবির সঙ্গে কথা বলেও মন ভরে না। তার চেয়ে মিনিট পনেরোর মুখোমুখি দেখা–সুনন্দার চুলের ঝুঁটি ধরে টান দেওয়া, সেটা তো আর এভাবে হওয়ার নয়।

কিন্তু ঘরের দেওয়ালগুলো এখনও জ্বলে উঠল না কেন? সাতটা কি বাজেনি? তিন বছর হয়ে গেল এখানে, তবু মাঝে মাঝে এমন ভয় পাই! মনে পড়ে যায়, ঘরটা সাতান্নতলার ওপরে এবং আমার ঘরের ওপরে আছে আরও তিয়াত্তরতলা। ছ-কোনা ঘরের ছ-দিকের দেওয়ালের পেছনে আছে আরও শয়ে শয়ে এরকম ছ-কোনা ঘর। এক ফোঁটা হাওয়া নেই, আলো নেই–মানে প্রাকৃতিক আলো-হাওয়া প্রবেশের কোনও ব্যবস্থাই নেই। কেন্দ্রীয় কৃত্রিম আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ঘণ্টাখানেকের জন্যে যদি বিগড়ে যায়… নাঃ বড় আবোল-তাবোল ভাবছি। এসব আশঙ্কার কোনও মানে হয় না। গত কুড়ি বছরের মধ্যে কোনও দুর্ঘটনা তো ঘটেনি। কিন্তু সত্যিই কি সে কথা জোর দিয়ে বলা যায়? একমাত্র সংবাদ-প্রচারক সংস্থাটি যখন সরকারি নিয়ন্ত্রণে, কোনও খবর চেপে দিলে… অবশ্য যা-ই ঘটুক, লাইহোল তো আছেই। শুয়ে, বসে, গড়িয়ে বা লাফিয়ে কোনওরকমে লাল সবুজের ডোরাকাটা সিন্থেটিক ঢাকনার ওপর এসে পড়তে পারলেই এয়ার টিউব দিয়ে সাঁ করে নেমে যাব নীচে। সটান হাজির হব সূর্যের বা চাঁদের আলোয়, নীল কালো আকাশের নীচে, খোলা হাওয়ায়। কতক্ষণ আর, এক সেকেন্ডের মামলা। প্রতিদিন কারণে অকারণে কতবার ব্যবহার করি পথটা। কলকাতার সস্তা ভাড়ার বহুতল মৌচাকগৃহের নির্মাতাদের আমি শুধু এই একটি কারণে প্রশংসা করি। অযুত অযুত ঘর থেকে নেমে গেছে একটি করে নিজস্ব পথ। বড় রাস্তা অবধি। উচ্চচাপসম্পন্ন বায়ুপথে সিঁড়ি ভাঙতে হয়। না, লিফটে চড়তে হয় না। যেন ভাসতে ভাসতে নামা। উঠতে অবশ্য একটু বেশি সময় লাগে। তার জন্য ভিন্ন পথ। পঞ্চাশটা ঘরপিছু একটা করে।

সুপ্রভাত! সুপ্রভাত!–ইন্টারকম বেজে উঠল, আট হাজার সাতশো নিরানব্বই বলছি। আপনার প্রতিবেশী। মনে করিয়ে দিই, আজ থেকে আমরা তিন দিনের জন্যে পুরোনো পৃথিবীতে ফিরে গেছি। ছুটির এই তিন দিন দেওয়ালগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না। আলো জ্বালার ব্যবস্থা করুন। আপনার প্রতিবেশীদের খবরটা পৌঁছে দিন। নমস্কার।

প্রতিবেশী পাঁচটি ঘরে খবরটা রিলে করার পর এখন আমার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। এরকম ভুল আমার কখনও হয়নি। আসলে কালকে ভিডিয়ো-কেতাবে ব্যোমকেশকে ভরে মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। এখন কী করা? প্রত্যেক বছর তিন দিন এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। প্রায় সব আধুনিক ব্যবস্থাই বন্ধ থাকে। দু-শো বছর আগেকার সেই বাস-ট্রাম-ট্রেন ধরে যাতায়াত। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকেও ভিডিয়ো-ফোনে বাজার করার উপায় নেই। একমাত্র রোবট সার্ভিস আর গ্রহান্তরের রকেট পরিবহন চালু আছে। বছরে তিন দিন পৃথিবীটাকে একেবারে আদ্যিকালের জ্যান্ত মিউজিয়াম বানিয়ে ফেলা–নিশ্চয় কোনও খিটখিটে ইতিহাসের অধ্যাপকের মাথায় এই পরিকল্পনা জন্ম নিয়েছিল।

আর টেকোরও বাহাদুরি কম নয়। কী অসীম প্রভুভক্তি! দেখে-শুনে ঠিক আজকেই উনি কালা হলেন। হাঁটু গেড়ে বসে খুঁজে পেতে আলোর সুইচটা টিপলাম। না, বাড়ির ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এটা তো আর আমার করার কথা নয়। আড়াই ফুট রোনুষদের সুবিধার জন্যই এই ব্যবস্থা। আলো জ্বললে কী হবে, বিদ্যুতের আলো টিমটিম করছে। আঁকাবাঁকা, রোগা-মোটা, ঘন ফিকে–কত বাহারি সব ছায়া! ফ্লুরোসেন্ট দেওয়ালে অভ্যস্ত হবার পর এই আলোয় একমাত্র শুয়ে শুয়ে মানুষ-পিশাচ এর মতো গল্প পড়া যায়। ফি-বছর দু-চারটে ভূতের গল্প এখনও যা লেখা হয়, সবই এই তিন দিনের মধ্যে। আজকের খোরাক হিসেবে ব্রাম স্টোকার ও অ্যাম্ব্রোস বিয়ার্স-এর ভিডিয়ো-কেতাব দুটো অবশ্য আছে, কিন্তু খাওয়াদাওয়ার কী হবে! টেকোকে নিজে হাতে সারাবার জন্য ক্যাসেট-নির্দেশ আছে, কিন্তু কতক্ষণ সময় লাগবে, কে বলতে পারে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, সারাতেও পারলাম না, ওদিকে সময়টাও গেল। আর যা-ই করি, প্রচুর মেহনতের পর কতকগুলো স্বহস্তে প্রস্তুত অখাদ্য গিলতে রাজি নই। আঙুল নেড়ে টেকোকে ডাকলাম।

তিন পা এগিয়ে এল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছে।

যাক, কালা হলেও দৃষ্টিটা আছে। তার মানে শুধু শ্রবণ-বর্তনীতেই গড়বড়।

নির্ধারিত ছ-সেকেন্ড পেরোতেই টেকো মুখ তুলে বলল, ফরমাইয়ে।

ধুত্তোর! ফরমাশটা দেব যে, তুই তো শুনতেই পাবি না। কিন্তু রাগ করে লাভ নেই। যতক্ষণ না পরবর্তী নির্দেশ পাচ্ছে, নামতা আওড়াবার মতো সাতবার ফরমাইয়ে, ফরমাইয়ে করে চলবে। ইঙ্গিতের ভাষায় ওকে নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দিলাম। একটা গৃহিণীর অভিধান থাকলে পাতা খুলে, ম্যাগনেটিক কালি দিয়ে প্রয়োজনমতো লাইনগুলোর নীচে দাগ দিয়ে টেকোর ইলেকট্রনিক মগজের স্মৃতিপ্রকোষ্ঠে ভরে দিলেই খাওয়াদাওয়ার হাঙ্গামাটা মেটানো যেত।

একটু ভাবা যাক। সিগারেট-চেয়ারে বসে সুইচ দিলাম। ইশ! সিগারেট অবধি খতম। আইনস্টাইনের দিব্যি–এমন প্যাঁচে কখনও পড়িনি। গত চার-পাঁচ দিন এত সিগারেট টেনেছি যে নিকোটিন লেভেল একেবারে তুঙ্গে। নিদেনপক্ষে পাঁচ দিন সিগারেট-চেয়ার আর সিগারেট ছাড়বে না। অবশ্য অটোমেটিক সিস্টেম বন্ধ করে কয়েকটা যে ম্যানেজ করতে পারি না তা নয়, কিন্তু তার জন্যে শেষ পর্যন্ত এমন খেসারত দিতে হবে–কোনও দরকার নেই। বেরিয়ে পড়া যাক।

ছাতাটা অবধি আনতে ভুলে গেছি। অবস্থা শোচনীয়। স্বয়ংক্রিয় ফুটপাথগুলো বিশ্রাম নিচ্ছে, সূর্যের তাত থেকে বাঁচানোর জন্যে স্বচ্ছ অদৃশ্য পর্দাটাও নেই মাথার ওপর। সারাদিন রেস্টোরেন্টে বসে বসে সময় কাটাতে গেলে পকেট হালকা হয়ে যাবে। বাবাকে দেখতে যাবার ইচ্ছে বাসের ভিড় দেখেই উঠে গেছে। নড়বড় করতে করতে যে ধোঁয়া আর গর্জন ছাড়ছে, তাতে একটা বাস যতক্ষণে এলাহাবাদ পৌঁছোবে, ততক্ষণে মনোরেলে চড়ে পৃথিবীকে চারবার প্রদক্ষিণ করে আসা যায়। কিন্তু মনোরেলের লিনিয়ার মোটর তো আর আজ চালু হওয়ার কোনও উপায় নেই।

মনোরেল চালু না হোক, রকেট কিন্তু চালুই আছে। ইচ্ছে করলে চাঁদে পাড়ি দেওয়া যায়। সেটা সম্ভব। গ্রহান্তরের কার্যকলাপে কোনও বিরাম নেই।

শুনলেও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে, এ অবধি আমি একবারও চাঁদে যাইনি। একদিনের জন্যেও নয়। পৃথিবীর যে-কোনও শহরে দোকানপাটবহুল এলাকায় মিনিটকয়েক হাঁটলেই একটা-না-একটা সাইনস্ক্রিনে দেখা যাবে, শব্দ ভেসে যাচ্ছে–চাঁদে যেতে চান? কনডাক্টেড ট্যুরের ব্যবস্থা আছে–এক, দুই বা তিন দিনের জন্যে চাঁদে চলুন। অ্যাটমিক রকেটের আবির্ভাবের পর এত ট্যুরিস্ট কোম্পানি গজিয়েছে যে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যে টিকিটের দাম দিন দিন কমছে। আমার বিশ্বাস, আরও কমবে। সেই জন্যেই এত দিন টিকিট কাটিনি। এমনকী বাবা-মা আর ন-বছরের সুনন্দা অবধি ঘরে এসেছে। অবশ্য সরকারি অফিসের কর্মী হলে এত দিনে নিশ্চয় পিএলটিসি (প্ল্যানেটারি লিভ ট্রাভেল কনসেশন) নিয়ে চলে যেতাম। দু-বছর অন্তর ওরা একবার করে ছুটিতে গ্রহান্তরে ভ্রমণের জন্য খরচখরচা বাবদ অফিস থেকেই টাকা পায়। এত দিন ধরে এই নিয়ে অনেক দরবারের পর আমাদের প্রাইভেট কোম্পানির বড়সাহেবকেও রাজি করানো গেছে। তবু দু-বছর অন্তর নয়, তিন বছর। এই সুযোগ, হাতে কাজও তেমন নেই, আর সবচেয়ে বড় কথা, দিনকয়েকের জন্য খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করার হাঙ্গামা থেকে তো মুক্তি! পুরোনো দিনের পৃথিবীকে উপভোগ করার যন্ত্রণার জন্যেই দেখছি, চাঁদে পাড়ি দিতে হবে আজ। জানি না, আমার মতো কুনো গরিব মানুষদের পৃথিবীর বাইরে ঠেলে পাঠানোর জন্যেই এইভাবে প্রতি বছর তিন দিনের জন্যে সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধাকে ছুটি দেওয়ার রেওয়াজটা চালু করা হয়েছে কি না।

রাস্তা পেরোতে গিয়েই গাড়ির হর্নে আঁতকে উঠেছিলাম। বাঁদিক-ডানদিক দেখে পেরোবার কথা ভুলে মেরে দিয়েছি। গাড়ি চলাচলের পাট কবে মিটে গেছে। আজ সবই হ য-ব-র-ল। হুড-খোলা চৌকো বাক্সের মতো গাড়িতে চড়ে, সা-রে-গা-মা হর্ন বাজিয়ে, আদ্যিকালের শাড়ি আর ধুতি-পরা লোকগুলো টা-টা করে চলে গেল। অমূল্য পেট্রোল পোড়াবার আর হর্ন দেওয়ার অপরাধে ওদের মনে মনে ছ-মাসের নির্বাসন দিলাম দু হাজার আলোকবর্ষের ওপারে ল্যামডা নক্ষত্রের সাত নম্বর গ্রহ-কারাগারে। ভাবছি, কতশত টন ব্ল্যাক রেডিয়োঅ্যাকটিভ থাকলে তবে লোকে এরকম গাড়ি হাঁকাবার বিলাসিতা করতে পারে। আসলে ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর জেগে ঘুমোনোয় বিশ্বাসী। যন্ত্রগণক ইন্সপেক্টররা নাকি চতুর্দিকে অতন্দ্র পাহারা দিচ্ছে। সব ধাপ্পা। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া আটকানোর জন্যে আরও কম্পিউটার বসানোর প্রয়োজন নেই–প্রয়োজন সদিচ্ছা। কিছু না, শুধু এই তিনটে দিন পুরোনো পৃথিবীর অনুকরণে জীবনযাপনের এই কটা দিনের ওপর কড়া নজর রাখলে, কে কীভাবে টাকা ওড়াচ্ছে, খোঁজ নিতে পারলেই অর্ধেক কাজ হাসিল হতে পারে।

শ্বাসপ্রশ্বাসে বেশ কষ্ট হচ্ছে। এমনিতে কৃত্রিম আবহাওয়ার দৌলতে অক্সিজেনের ঘাটতির কথা খেয়াল করা যায় না। এক মিনিটের দাম ধরে পাঁচ টাকার একটা কয়েন স্লট মেশিনে গলিয়ে অক্সিজেনের নলের মধ্যে নাক-মুখ গুঁজে দিলাম।

বেশি দূর হাঁটার ইচ্ছে নেই, প্রথমেই যে ট্যুরিস্ট কোম্পানি চোখে পড়বে…

ক্রিং ক্রিং

একসঙ্গে পাঁচটা সাইকেলের ঘণ্টী। দল বেঁধে বেড়াতে বেরিয়েছে।

ক্রিং ক্রিং

আরে! বারবার বেল… ওহ্ হো! আমাদের তাজ্জব! তাই বলি।

–চললে কোথায়, তাজ্জব?

–হীরক-বন্দরে। যাবে নাকি?

–পাগল হয়েছ! দু-পা হাঁটতেই অক্সিজেনের অভাবে হাঁসফাঁস। তোমার মতো ক্ষমতা নেই।

–দিনরাত বন্ধ ঘরে বসে যোগ-বিয়োগ করলে এই হয়।

–কী আর করি বলো। চাকরি না করলে খাব কী!

–তা তুমি কোথায় যাচ্ছ?

–ভাবছি, কনডাক্টেড ট্যুরে চাঁদ থেকে ঘুরে আসি।

 –বেশ বেশ। টিকিট কেটে ফেলেছ?

–না।

–তাহলে আর কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে যাও চিপ ট্রিপ ট্যুরিস্ট ব্যুরোয়। এই তো মিনিট তিনেকের পথ। গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য সরণিতে ঢুকেই বাঁ হাতের দ্বিতীয় গলি–মোড়ের ওপরেই স্ক্রিন ডিসপ্লেতে নাম দেখতে পাবে। চার হাজার টাকায় হয়ে যাবে।

-যাঃ, ঠাট্টা কোরো না। তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজারের কমে…

–আইনস্টাইনের দিব্যি, বিশ্বাস না-হয় নিজে গিয়ে দেখো।

–কী বলছ তুমি! এ তো অবিশ্বাস্য!

–যা বলছি, শোনো। নইলে পরে আপশোশ করবে। চলি তাহলে–ফিরে এসে জানিয়ে কেমন লাগল।

হাসতে হাসতে তাজ্জব আমায় তাজ্জব করেই চলে গেল। ওর হাসিটাও যেন কেমন অদ্ভুত লাগল। ব্যাপারটা কী? বোকা বানাবার চেষ্টা করছে নাকি? কিন্তু কেন?

চিপ ট্রিপের কাউন্টারের সামনে বসে আছে ঘোষ-বাগচী। অর্থাৎ হয় ঘোষ নয় বাগচি। কেননা দুটো চেয়ারের মধ্যে একটা খালি আর টেবিলের ওপর ফাইবার গ্লাসের গুচ্ছের ডগায় ডগায় চিকমিক করছে ঘোষ-বাগচি–ঘোষ-বাগচি। লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি, কিন্তু মনে পড়ছে না।

–বলুন, কীভাবে সাহায্য করতে পারি।

কথাটা শোনামাত্র লোকটাকে অপছন্দ করে ফেলেছি। বস্তুটি একটি ভেজালমার্কা অ্যালয় বলেই মনে হচ্ছে। এর চেয়ে বিশুদ্ধ বিনয় বা ঔদ্ধত্য ঢের ভালো। অডিটরের কাজ করি, মানুষ তো কম দেখিনি। স্বার্থপর, মুনাফাখোরকেও সহ্য করতে রাজি, কিন্তু তার সঙ্গে যদি আবার সাংস্কৃতিক ভণিতা যোগ হয়…।

-আজ কোনও ট্রিপ আছে চাঁদে? কনডাক্টেড টুর?

–জাস্ট হাফ এ সেকেন্ড।

 ঘোষ-বাগচি কৃত্রিমভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ক্রোনোমিটারটা নিজে দেখল, না আমাকে দেখাতে গিয়ে দেখতে হল, বোঝা মুশকিল। তারপরে মাইক্রোপ্রসেসরের চাবি টেপাটেপি। উত্তরটা হয়তো ওর জানা ছিল না, কিন্তু আমি জানতাম। ট্রিপ না থাকলে আর তাতে সিট ফাঁকা না থাকলে, আজকে অন্তত ও এখানে বসে হাঁসফাঁস করত না।

–ঠিক সময়ে এসে পড়েছেন। আপনার ভাগ্য ভালো বলতে হবে।

 –ভাগ্য নয়, কোইনসিডেন্স। কোথা থেকে ধরতে হবে?

–নিউ গিনি পর্বতমালার কাছে আমাদের রকেট-প্যাড আছে। বিষুবরেখার কিছুটা দক্ষিণে। জায়গাটা সমুদ্র-লেভেলের তিন মাইল অ্যাবাভে এবং পৃথিবীর…

–পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘণ্টাপিছু হাজার মাইল পাক খাওয়াটাকে কাজে লাগিয়ে রকেটের জ্বালানি কিছুটা বাঁচানো হয়। জানি। কিন্তু পৌঁছোব কীভাবে?

–কোনও অসুবিধে নেই। আমরাই নিয়ে যাব মিনি রকেটে। এই বাড়ির ওপর থেকেই আমাদের শাটল সার্ভিস।

–ঠিক আছে, একটা আইডেনটিকিট দিন।

–দিচ্ছি, ততক্ষণ আপনি নিউমেটিকে বসে আরাম করুন। তারপর বলে উঠল, না, চালু ঠিক নয়। তবে আপনাদের জন্যে এটুকু করতে না পারলে…

তাপ-সংবেদী টিকিটের ওপর ছ-ভোল্টের কলম দিয়ে একটা সই করে সেটা পোলারয়েড ক্যামেরায় ভরে নিল। আমার রঙিন ফোটো সমেত চিপ-ট্রিপ কোম্পানির দু দিনের চন্দ্রভ্রমণের রসিদ তথা আইডেনটিকিট বেরিয়ে এল। হাতে নিয়ে দেখি, কোথায় চার হাজার টাকা–পঁয়ত্রিশ হাজারের ধাক্কা। গুলটা ভালোই ঝেড়েছে তাজ্জব। তবে, পঁয়ত্রিশ হাজার টাকাই স্ট্যান্ডার্ড রেট।

চল্লিশ হাজারের একটা নোট বাড়িয়ে ধরলাম।

-খুচরো নেই?

 খটকা লাগল। পাঁচ হাজার খুচরো ফেরত দিতে পারবে না, এ কেমন কথা।

–কত টাকা কনসেশন দিচ্ছেন?

–আজ্ঞে, কনসেশন কিছু নেই। পুরো চার হাজারই লাগবে।

কোনওরকমে সামলেছি নিজেকে। তাজ্জবের সঙ্গে দেখা না হলে ভাবতাম, আমিও বোধহয় টেকোর মতো কালা হয়ে গেছি।

-কিন্তু আপনি তো দেখছি, ভুল করে পঁয়ত্রিশ হাজারের টিকিট দিয়েছেন। চার হাজারের টিকিট দিন।

টিকিটটা ঘোষ-বাগচির দিকে বাড়িয়ে ধরেছি। এতক্ষণে একটা টোকা পড়েছে ওর কৃত্রিমতার খোলসে। চোখ-মুখের অবস্থা দেখে হাসি পায়। কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না।

–চার হাজারের টিকিট… মানে… তার কী দরকার! এই টিকিটেই তো আপনার কাজ হয়ে যাবে…। আমতা আমতা করে বলল, আর কিন্তু হাতে সময় নেই। শাটলটা অপেক্ষা…

পকেট থেকে একটা পাঁচ হাজারের নোট বার করে দিলাম। তাজ্জব তো তাহলে ভুল খবর দেয়নি। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? মনের প্রশ্নটা আন্দাজ করেই ঘোষ-বাগচি যেন। উত্তর দিল, এরকম সার্ভিস আর কেউ দিতে পারবে না। আমাদের রিসার্চ-উইং একটা যোগ-রকেট তৈরি করেছে। অ্যাটমিক পাওয়ারে প্রথম চারশো মাইল, তারপর আয়ন রকেটে কিছুটা, কিছুটা ফোটন-রকেটে।

ফোর-সিটার শাটল রকেটে উঠে কোনও সহযাত্রী পাব ভাবিনি। কিন্তু অনুমানের সঙ্গে কিছুই আজ মিলছে না। সব কটা সিটই ভরতি। সত্যিই যদি চার হাজারে চাঁদে যাওয়া যায়, কেনই বা যাবে না। ব্যাপারটা নিশ্চয় এখনও জানাজানি হয়নি, তাহলে লম্বা লাইন পড়ে যেত। এরা যে কেন ভালোভাবে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে না, সেটাও বোধগম্য হচ্ছে না।

ভেবেছিলাম, দু-চারটে কথাবার্তা বলব। কিন্তু সহযাত্রীরা মোটেই মিশুকে নয়। নিজেদের নিয়েই মশগুল। অন্য কোনওদিকে মন নেই।

প্রেশার সুইচটা নাড়িয়ে-চাড়িয়ে নিউমেটিকে শরীর ভাসিয়ে দিয়ে আরাম করে পা ছড়িয়ে বসলাম। এতক্ষণ পরে এয়ারকন্ডিশন আরামে চোখের পাতা বুজে আসছে। তার ওপর ঠোঁটের কাছে যন্ত্রের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। তিন-চারটে টান দিতেই…

চোখ খুলেই দেখি, নিখিলের বুকে তারা হয়ে ভাসছি। এ কী! লাইফ কর্ডটা কোথায়? স্পেসস্যুটের কোমরের সঙ্গেই তো অক্সিজেনের নলটা থাকার কথা। কিন্তু নেই তা! তাহলে? এখানে আমি এলাম কোত্থেকে? আমার হাতে আবার ওয়েল্ডিং গান। মহাকাশের মিস্ত্রি! কিন্তু… চিপ ট্রিপ! চিপ ট্রিপ ট্যুরিস্ট ব্যুরো তার মানে চাঁদে নিয়ে যাবার নাম করে আমাদের এইভাবে… তার মানে, এরা মিস্ত্রি সংগ্রহের আড়কাঠি… কিন্তু সব জেনে-বুঝে, তাজ্জব তুমি কেন…

আহ!

দু-হাতে মাথা চেপে ধরেছি। এক ঝটকায় কে যেন ছিটকে দিয়েছে নিউমেটিকের আশ্রয় থেকে।

–সেফটি বেল্ট বাঁধেননি কেন! রেট্রো-রকেট ফায়ার করেছে। আমরা নিউ গিনিতে পৌঁছে গেছি।

কয়েকবার চোখ পিটপিট করার পরে দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে বর্তমানে ফিরে এসেছি। একজন যাত্রী হাত বাড়িয়ে সাহায্য করল উঠে বসতে।

জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, নীচের পাহাড়-ঘেরা অরণ্য ক্রমেই ঢালু হয়ে পড়ছে শাটল রকেটের দিপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। সবুজের সমুদ্রে একফালি লালচে দ্বীপ চোখে পড়ছে। চিপ ট্রিপের রকেট উৎক্ষেপণকেন্দ্র।

এখনও কিন্তু মন থেকে চারহাজারি চন্দ্রভ্রমণের অবাস্তবতা কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছি না।

মাটিতে আর পা দিতে হয়নি। শাটল রকেটের ঢাকনা তুলে এয়ার-ক্রু মারফত সোজা এসে ঢুকেছি মুন-বাসে৷ এয়ারলক পেরিয়ে লুনার মডিউলে পা দিয়েই আবার চমক। চিপ ট্রিপের রকেটের নাম মুন-বাস শুনে মনে মনে হেসেছিলাম। বাস তো সামান্য–একে ডবল-ডেকার বাস বললেই ভালো হত। এত বড় যাত্রীবাহী রকেট তৈরি হয়েছে বলে তো গিনেস বুক অব রেকর্ডস-এও পড়িনি। দেখে মনে হচ্ছে, শ-দুয়েক লোকের বসার জায়গা রয়েছে এবং শুধু জায়গা নয়, জায়গাগুলো ভরতি। প্রত্যেকের সিটের সঙ্গে লাগোয়া একটা করে ভিউয়িং উইন্ডো। জানলা। এখন অবশ্য শাটার টানা রয়েছে।

সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে, কারও মুখেই কিন্তু দুশ্চিন্তার রেশমাত্র নেই। খোশমেজাজে গল্প করছে। চার হাজারের টিকিটে চাঁদে যাবার নাম করে শেষ পর্যন্ত কি এক্সপেরিমেন্ট করবে। আমাদের ওপর… নাঃ, এদের দেখে মনে হচ্ছে, অজ্ঞানতার মতো আশীর্বাদ আর কিছু হয় না।

সিটের মধ্যে সুপ্ত মাইক্রোফোন সরব হয়ে বেল্ট বেঁধে নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। কমান্ড মডিউলের দিকের স্ক্রিনে কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। টেন… নাইন… এইট…।

থরথর করে কাঁপছে রকেট। ইঞ্জিনের গর্জন অনুভব করছি। ব্লাস্ট-অফের অগ্নিদৃশ্যটা দেখানোর জন্যে শাটারটা তো ভোলা উচিত। আগুন আর ধোঁয়ার স্তম্ভের মাথায় চড়ে রকেটের ঊর্ধ্বগতির সূচনা।

তুমুল কাণ্ড চলেছে ইঞ্জিনে। পৃথিবীর টানের সঙ্গে অ্যাটমিক শক্তির পাঞ্জা। এখনও জানলার শাটার খোলেনি। মনে হচ্ছে, বেশ কিছুটা ওপরে উঠে এসেছি। রকেটের ভাইব্রেশন কমতির দিকে। কিন্তু এ কী ব্যাপার! ওজন বাড়ার কোনও অনুভূতি তো… তা কী করে হতে পারে! রকেটে যতক্ষণ ত্বরণ হবে, যে অনুপাতে হবে, ততই বাড়বে ওজন। এই তো, দিব্যি আমি হাতটা তুলছি–একটু ভারী ঠেকছে না। মাথা বাড়িয়ে সামনের সিটের ভদ্রলোকের কাঁধে হাত ঠেকিয়ে অভদ্রের মতোই ডাকলাম।

নমস্কার! নমস্কার! আমাদের পঁয়ত্রিশ ঘণ্টাব্যাপী চন্দ্রভ্রমণের শুভসূচনা হয়েছে। আপনাদের এই ট্রিপের পাইলট রাকেশ আপনাদের নমস্কার জানাচ্ছে।…

সিটের লাগোয়া মাইক্রোফোনের ঘোষণা কানে এল। সবাই নিশ্চয় একই কথা শুনছে, শুভযাত্রা শুভযাত্রা বলে হাসির হররা সারা কেবিনে।

..আমাদের রকেটের উন্নততর করণ-কৌশলের জন্য চাঁদে পৌঁছোনোর সময়টাই যে শুধু কমে গেছে তা-ই নয়, অভিকর্ষজ বলের হাত থেকেও আপনারা মুক্ত। রকেট ছাড়ার সময় আপনাদের ওজন সামান্যতম বৃদ্ধি পায়নি। আবার কিছুক্ষণ পরে যখন জ্বালানি বাঁচানোর জন্যে রকেট বন্ধ করে দেওয়া হবে, আমরা অসীম শূন্যে ভাসতে থাকব, কিংবা বলতে পারেন, খসে পড়তে থাকব মহাকাশে, তখনও আপনারা ভারশূন্য অবস্থার কথা টের পাবেন না। কোনও অসুবিধা হবে না। আর দু-চার মিনিটের মধ্যেই খুলে যাবে আপনাদের ভিউয়িং উইন্ডো।

সামনের সিটের ভদ্রলোক বোধহয় আমাকে পাগল ভাবল। ডেকেও কথা বললাম না। কিন্তু বলবটা কী? যা প্রশ্ন ছিল, উত্তর তো পেয়েই গেছি। যাত্রীদের কারও মধ্যে এতটুকু সন্দেহের ভাব দেখলে তো প্রসঙ্গটা তুলব!

ভিউয়িং উইন্ডোয় প্রশান্ত মহাসাগর এখন ঝলমলে বিশাল এক টুকরো ঘন নীল মণি। দিগন্তরেখায় চোখ পড়লে পৃথিবীর গোলাকৃতি বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। এখান থেকে পৃথিবীটা মূলত নীল আর সাদার খেলা। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল সাদা কুণ্ডলীগুলো বুঝি সমুদ্র। কিন্তু তা নয়, ওগুলো মেঘ। মাইক্রোফোনের নির্দেশমতো খুঁটিয়ে দেখতেই চোখে পড়ল নিউ জিল্যান্ডের ভূসীমানা। হাওয়াই দ্বীপটাকেও চেনা যাচ্ছে। নীল সমুদ্রের একটা অংশ সবুজমতো লাগছিল। ওখানে সামুদ্রিক খাদ্য উৎপাদনের খামার। বিভিন্ন দ্বীপের কোরাল-রিফগুলোও নজরে পড়ছে।

এ দৃশ্য যে একেবারে অচেনা তা নয়। রকেটে চড়ে চাঁদে না যাই, টিভি স্ক্রিনে আগেও এ ছবি দেখেছি। তবে ঘরে বসে দেখা আর প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ পাওয়া নিশ্চয় এক জিনিস নয়। সত্যি বলতে, টিকিটের চার হাজার টাকা এখনই উশুল হয়ে গেছে। চিপ ট্রিপের ওপর আর সন্দেহ পোষণ করার কোনও মানে হয় না। কেউ যদি লোকসান দিয়ে ব্যাবসা চালায়, তাতে তো ক্রেতার অখুশি হওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু ক্ষতি করার ইচ্ছে নিয়ে কে ব্যাবসা ফাঁদে, কী উদ্দেশ্যে?

মাঝে মাঝে রকেটের ইঞ্জিন গর্জে উঠে দিবদল করছে যাত্রীদের মহাকাশ-দর্শনের সুযোগ দিতে। কখনও কালো আলো আকাশের নিষ্কম্প তারা, কখনও সূর্যের পরিচিত উজ্জ্বলতা, কখনও ক্রমশ ছোট-হয়ে-আসা পৃথিবী দেখছি। ক্রমেই অগ্রসর হচ্ছি চাঁদের দিকে।

প্রথম বিস্ময়ের পর্ব কাটতেই একঘেয়েমি পেয়ে বসেছে। যারা দলবল মিলে এসেছে, গল্পগুজব করে সময় কাটাচ্ছে। আমি কিন্তু এখনও সহজ হতে পারিনি। আলোচনায় যোগ দিতে ইচ্ছে করছে না।

মাইক্রোফোনের শব্দে নড়েচড়ে বসলাম। টিউব ফুড সাঁটিয়ে আরেক দফা ঘুম মেরেছি এর মধ্যে। তাকিয়ে দেখি, চাঁদের কলঙ্ক আর সমুদগুলো মরুভূমি আর মৃত আগ্নেয়গিরির গহ্বর হয়ে উঠছে। আর বেশিক্ষণের ব্যাপার নয়।

ভিউয়িং উইন্ডোর ওপর শাটার নেমে এসেছে। মূল রকেটযান এবার চন্দ্র প্রদক্ষিণ শুরু করবে আর তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নেমে আসবে লুনার মডিউল চাঁদের পিঠে। চাঁদে নামার আগে এখন কিছুক্ষণ কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, জিওলভস্কি প্রমুখের কথা চোখ বুজে ভাবার সময়।

লুনার মডিউল চাঁদে নেমেছে। সার্ভিস মডিউল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মুহূর্তটা টের পাওয়া যায়নি৷ চাঁদের স্পর্শলাভের ক্ষণটিও অনুভবে ধরা দেয়নি। লুনার মডিউলের হাইড্রোলিক পা মাকড়সার মতো আলতোভাবে চাঁদের বালুকাময় প্রান্তর ছুঁয়েছে। মাইক্রোফোন জানাল, এবার মডিউলের সামনের দরজা দিয়ে আমরা এয়ারলক পেরিয়ে সোজা দিয়ে উঠব মনোরেলে। চাঁদের পিঠে হাজার তিনেক কিলোমিটার পাক খেয়ে আবার ফিরে আসব নিজেদের যানে।

মনোরেলেও প্রত্যেক যাত্রীর জন্যে নির্দিষ্ট একটি করে ঘুলঘুলি। ইঞ্চি ছয়েক মাত্র ব্যাস। চোখ ঠেকিয়ে রাখতে হচ্ছে। জানালাগুলো বড় করার অসুবিধে তো আছেই। চাঁদের বায়ুমণ্ডলহীন পিঠের ওপর মনোরেলের কামরাগুলো প্রেশারাইড। না হলে পৃথিবীর ধড়াচূড়া চাপিয়েই এভাবে কি আর এখানে বসে থাকা যেত!

অপূর্ব দৃশ্য। চাঁদের আকাশে পৃথিবীটা নীল-সবুজ গোলকের মতো ঝুলছে। যেন চীনা লণ্ঠন। অর্ধেকটার মতো দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীর আকাশে চাঁদ অস্ত যায়, কিন্তু চাঁদের আকাশে পৃথিবীর অংশবিশেষ সর্বদাই চোখে পড়ে। আমরা যেখানে এসে নেমেছি, চাঁদের সেই পিঠটা পৃথিবীর ওপর থেকে দেখা যায়। হঠাৎ একবার চাঁদের দিগন্তের কাছে আরেকটা চলমান গোলক দেখা দিয়েছিল। মাইক্রোফোনের বিবরণী জানিয়ে দিল, ওটা আমাদের মুনবাসেরই সার্ভিস-কাম-কমান্ড মডিউল। চাঁদকে প্রদক্ষিণ করতে করতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পৃথিবীতে ফেরার পথে লুনার মডিউল আবার ওটার সঙ্গে গিয়ে মিলবে–যাকে বলে ডকিং হবে। একটু আড়াআড়ি তাকালে দেখা যাচ্ছে, মনোরেলের লাইনটা দীর্ঘ ব্যবধানে স্থাপিত স্তম্ভের ওপর ভর রেখে চাঁদের রুক্ষ বুকের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে দৃষ্টির সীমানার বাইরে, অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।

সুদীর্ঘ চান্দ্ররাত্রির সূচনামুখে যাত্রা আরম্ভ হয়েছে আমাদের। প্রায় সাড়ে চোদ্দো দিন আবার এই জায়গায় সূর্যোদয় হবে। সূর্য ডুবে গেলেও পৃথিবীর শীতল আলোয় চাঁদের প্রান্তরে বন্যা। পৃথিবীর সমুদ্র আর মেঘগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছে অদ্ভুত নীলচে-সবুজ আলো, যাতে তাপের কণামাত্র নেই। চাঁদের পিঠে বসেও পৃথিবীর তুষারাবৃত মেরুর দিকে তাকালেই চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। মনোরেলের পথ পাহাড়ের ছায়ার মধ্যে প্রবেশ না করলে আকাশের তারারা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। চাঁদের মাটিতে যে শিশুরা জন্মাবে, তারা কখনওই তারাদের নিয়ে টুইঙ্কল-টুইঙ্কল ছড়া কাটবে না।

মাইক্রোফোনের ঘোষণা : আমরা চাঁদের নির্জলা কেন্দ্রীয় উপসাগরে অবতরণ করেছিলাম। এখন ছুটে চলেছি সূর্যকে ধরতে পুবদিকে। হ্যাঁ, চাঁদের ওপর পুবদিকেই অস্ত যায় সূর্য। জানলা দিয়ে লক্ষ রাখুন।

হঠাৎ জানলার সামনে যেন লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বিশাল পর্বতশ্রেণি। এবড়োখেবড়ো চোখা চোখা পাথরের কানা ধারালো ছুরির মতো। আর তার চেয়েও অদ্ভুত, পাহাড়গুলো যেন চাঁদের আকাশে জ্বলন্ত পিরামিডের আকারের মেঘের মতো নিশ্চল ভাসছে। ভূমির সঙ্গে কোনও সংযোগ নেই। ছায়ায় হারিয়ে গেছে তাদের তলদেশ আর মাথার ওপর এসে পড়েছে পৃথিবীর আলো।

মাইক্রোফোনের ঘোষণা : আপনারা এখন অ্যাপেনাইন পর্বতমালা দেখছেন। এর শৃঙ্গবিশেষের উচ্চতা কুড়ি হাজার ফুট। এই পর্বতমালা যতই উঁচু হোক, এরই ওপর দিয়ে আমাদের মনোরেলগাড়ি চলে যাবে। মনে রাখবেন, চাঁদের পিঠে কুড়ি হাজার ফুট চড়াই পেরোনো, পৃথিবীর হিসেবে চার হাজারেরও কম। এই পর্বতমালার ওপারে মেয়ার ইমব্রিয়াম, অর্থাৎ বৃষ্টির সাগর অভিমুখে আমরা এখন…

মাইক্রোফোন আর কী বলেছে, শুনিনি। আমি সেফটি-বেল্ট খুলতে শুরু করেছি। এতক্ষণ ধরে মনের মধ্যে যে সন্দেহ পুষে চলেছি, তার সত্যি-মিথ্যে যাচাই করার এ সুযোগ ছাড়া চলবে না। সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দেখি, কামরার ছাতে প্রায় মাথা ঠেকে যাচ্ছে। তাতেও অসুবিধে নেই। সিটের সারির পাশে মানুষ চলাচলের জায়গায় পা রেখে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছি। এবার একটা ছোট্ট লাফ–তাহলেই দমাস করে মাথাটা ঠুকবে ছাতে। ঠোকাই উচিত।

কিছুই হল না। মাথা ঠোকা দূরের কথা, ব্যাঙের মতো লাফ মেরেছি প্রাণপণ শক্তিতে। আরেকবার দেখি। নাঃ, চিৎকার করে উঠলাম : ধাপ্পা ধাপ্পা! সমস্ত ধাপ্পা!

হইচই শুরু হয়ে গেছে। ব্যাপার কী? ব্যাপার কী? মাথাটাথা খারাপ নাকি! হেড অফিসে গড়বড়!

-মাথা শুধু আমার একার নয়, সবাইকার বিগড়েছে। বুঝলেন? এই–এই—

আবার লাফ মারলাম।

–দেখছেন? দেখছেন তো ব্যাপারটা। চাঁদের পিঠে যেখানে অভিকর্ষের টান পৃথিবীর মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ, একটু লাফ মারলে কোথায় উঠে যাবার কথা! আমাদের পুরো ধাপ্পা দেওয়া হয়েছে! মোটেই চাঁদে নিয়ে আসা হয়নি আমাদের।

-ওটা অভিকর্ষের টান নয়, মহাকর্ষ! পরিভাষাটা বোধহয়…

দাদু যে দারুণ আবিষ্কার করেছেন!

চারধারে তুমুল হাসিঠাট্টার ঝড়ে আমার রাগ-উত্তেজনা মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গেল। মানুষ কি নির্বোধ হবার চর্চা করছে আজকাল! এত বড় একটা বুজরুকির কথা জানার পরেও নাকি এরা আমার কথা বুঝতে পারেনি। কিন্তু না-বোঝার আছেটা কী!

গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, আমি নিঃসন্দেহ যে আমরা এখন চাঁদের ওপর নেই।

মহা জ্বালাতন তো! নিঃসন্দেহ হয়েছেন তো, এবার নিশ্চিত হয়ে বসে পড়ন। অনেক বিদ্যে ফলিয়েছেন, এবার চেপে যান।

–কোনও মানে হয় এমন চেঁচামেচির!

বহুমুখী আক্রমণের মধ্যেই এক মধ্যবয়স্ক লোক একটু শালীন ভঙ্গিতে আমাকে হাত ধরে সিটের কাছে টেনে নিয়ে এলেন।

–আপনি এত উত্তেজিত হয়ে পড়লেন কেন?

–হব না! কী বলছেন আপনি! এরপরেও…

–এরপরেও মানে? কত টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছেন?

–চার হাজার।

–চার হাজারে কি চাঁদে পাড়ি দেওয়া যায়?

–যায় না বলেই তো…

–তাহলে জেনে-বুঝে টিকিট কিনে এখন হল্লা বাধাচ্ছেন…

–আহা, ব্যাপারটা অসম্ভব বলে সন্দেহ হয়েছিল বলেই তো যাচাই করার জন্যে…

–যাচাই করার আর আছেটা কী! আমরা তো সবাই জানি এটা একটা অ্যানিমেশন ট্রিপ!

তার মানে?

তার মানে, প্রথম থেকেই আপনি জানলার সঙ্গে লাগানো টিভির পর্দায় চলচ্চিত্র দেখছেন। পৃথিবী ছেড়ে এক ইঞ্চি নড়িনি আমরা।

কিন্তু কই, একবারও তো সে কথা জানানো হয়নি টিকিট বিক্রি করার সময়! এরকম একটা ধাপ্পা….

-থামুন তো মশাই! কথায় কথায় খালি ধাপ্পা-ধাপ্পা বলবেন না। ভারী একেবারে নীতিবাগীশ দেখছি। তা অতই যদি সততা তো চার হাজার টাকা দিয়ে পঁয়ত্রিশ হাজারের টিকিটটি পকেটে ভরলেন কী করে শুনি? তার বেলায় বলে টনটনে জ্ঞান। কালই অফিসে গিয়ে পিএলটিসি বাবদ ফলস বিল করবেন পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার। চাঁদ থেকে ঘুরে এসেছি বলে।

সামনের সিটের ভদ্রলোক মাথা ফিরিয়ে বললেন, যাক গে মশাই, ছেড়ে দিন। মনে হচ্ছে উনি বোধহয় আমাদের মতো সরকারি চাকুরে নয়। চিপ ট্রিপের ব্যাপারটা তাই এখনও কানে যায়নি…

চোখ বুজে এলিয়ে পড়লাম। কানে এসে কে যেন সান্ত্বনা দিচ্ছে, দুঃখ করছেন কেন! চাঁদে পা না দিন, যা যা দেখলেন ও দেখবেন, সে তো সবটাই সত্যি। একটা চন্দ্র অভিযানের আগাগোড়া ফিল্ম তুলে তার থেকে সযত্নে তৈরি এই অ্যানিমেশন সফর। শুধু শুধু পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে সত্যিকার চাঁদে গিয়েও তো এর বেশি কিছুই দেখতে পাবেন না। তা ছাড়া চিপ ট্রিপ কোম্পানির এত সুনাম, বিল সাবমিট করলেই পাস হয়ে যায়।

[সিদ্ধার্থ ঘোষ সম্পাদিত তৃতীয় নয়ন, বাংলা সায়েন্স ফিকশন গল্পের নির্বাচিত সংকলন, ১৯৮৬, গ্রন্থালয়।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *