উপন্যাস
গল্প

৫. গ্যাবনবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

০৫.

সন্ধ্যাবেলা গ্যাবনবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হলে হোটেলে ফিরছিল সুজন আর পিয়ের। রোজারও আসতে চেয়েছিল, কিন্তু ওরা তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। একরকম জোর করেই নিরস্ত করেছে। ডক্টর সেনশর্মা আগেই চলে এসেছেন। তাঁর শরীরটা ভালো লাগছিল না। ওদের কানে এখনও সারিবদ্ধ বান্টুদের হাততালির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছন্দে ছন্দে হেলাদোলা, ঘণ্টা ও ঢাকের আওয়াজ আর শিঙাধ্বনি ভেসে আসছে। আদিম মানুষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সরলতা ও সৌন্দর্য আজও মুগ্ধ করেছে সভ্যজগতের এই দুই প্রতিনিধিকে। তা ছাড়া অবিস্মরণীয় তাদের মুখোশ পরে পিতৃপুরুষদের পূজার অনুষ্ঠান। অদ্ভুত ধরনের সব মুখোশ। কোনওটা ভয়ংকর, কোনওটা রুগণ, কোনওটা আবার মানুষের মুখ বলেই চেনা শক্ত। অতিথিদের সুবিধের জন্য ওরা বুঝিয়েও দিয়েছে মুখোশের রহস্য। প্রত্যেকটা মানুষের নাকি দুটো করে মুখ। একটা হচ্ছে শরীরের মুখ, আটপৌরে মুখ, সবাই যেটা দেখতে পায়, যার আয়ু মানুষের বয়সের সমান। অন্য মুখটা দেখা যায় না, কিন্তু সেটা অবিনশ্বর। সূর্য, সমুদ্র আর পাহাড়ের মতোই তার কোনও ক্ষয় নেই। এইটাই মানুষের প্রকৃত মুখ। এই মুখোশগুলো মানুষের সেই আসল মুখের প্রতীক। পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানাবার সময় কি আশীর্বাদ প্রার্থনা করবার সময় মানুষের এই মুখটি প্রয়োজন হয়। জীবনমৃত্যু, ভালোবাসা ঘিরে কালো মানুষগুলোর দুঃখ ও আনন্দের বুনো আবেগগুলো কিন্তু একেবারে শুভ্র। সুজন ভাবছিল, বস্তুভিত্তিক সভ্যতার প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যদি তার আদিম সরলতাকে রক্ষা করতে পারত তাহলে হয়তো আজ আর তাদের এখানে আসার প্রয়োজনই পড়ত না। পিয়ের নিঃশব্দে গাড়ির সিটে ঠেস দিয়ে বসে আছে। আজকের সন্ধ্যাটা অদ্ভুতভাবে তাকে বিমর্ষ করেছে। সুজন অনুভব করতে পারে, তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার মানুষ হিসেবে একটা অপরাধবোধ সঞ্চারিত হয়েছে ওদের মধ্যে। ওরা একটা করে আবলুস কাঠের ভাস্কর্য উপহার পেয়েছে। সুজন শিল্পের বইয়ে গ্যাবনের কাঠ আর পাথরের ভাস্কর্য আর বিখ্যাত মুখোশের ছবি দেখেছে। কিন্তু আজ ওরা এক বিস্ময়কর ভাস্কর্য উপহার দিয়েছে। ভাস্কর্যটার একটা নামও আছে। বাংলায় অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায়–মৃত্যুর মুখ।

পিয়ের যেন সুজনের মনের কথাটার খেই ধরেই বলল, আচ্ছা সুজন, তোমার মনে হয়নি এই মুখখানা যেন হাজার হাজার বছরের অন্ধকার আর যন্ত্রণা? তুমি লক্ষ্য করেছ, কঠিন মুখখানার মধ্যে একমাত্র অভিব্যক্তি শুধু চোখে। চোখ দুটো যেন আকস্মিক আঘাত পেয়ে ভয়ংকর ঘৃণায় কুঁচকে গেছে।

সুজন প্রায় অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল, অন্ধকার আর যন্ত্রণার বিরুদ্ধেই বোধহয় ওই কঠিন মুখের প্রতিরোধ। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের জেহাদের প্রতিজ্ঞা। আর সভ্য দুনিয়ার আলোই বোধহয় অমঙ্গলের ছায়া ফেলেছে ওই চোখে। ভাস্কর শুধু প্রচলিত অর্থে মৃত্যুর মুখ খোদাই করেনি। এই মৃত্যু আরও ব্যাপক, আরও নিবিড় এক মৃত্যু। এই হয়তো সরলতার মৃত্যু।

গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের গাড়িবারান্দায় পা দিয়েই পিয়ের দেখল দোতলায় ওদের ঘরের সঙ্গে লাগানো বারান্দার রেলিং-এ কনুইয়ে ভর রেখে ডক্টর সেনশর্মা দাঁড়িয়ে। এখনও ঘুমোননি ডক্টর?

ডক্টর সেনশর্মা চেঁচিয়ে বললেন, ঘুমোব কী করে? ভূতের ভয় করছে। শিগগিরি ওপরে এসো। এখানেই খাবার দিতে বলছি।

তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এল দু-জনে। ঘরে ঢুকে দেখল, ডক্টর বারান্দার টেবিলটাকে বই আর কাগজপত্রের স্তূপ তৈরি করে ফেলেছেন।

ওঃ–এই আপনার শরীর খারাপ! পিয়ের জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল। তখন যদি চলে না আসতাম, নির্ঘাত শরীর খারাপ করত। ধরো, তোমার এক বন্ধু তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। বহু দিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। মনটা ছটফট করবে না? তবু সব জেনেও তুমি যদি আসতে না পারো, শরীর তো খারাপ হবেই। ডক্টর সেনশর্মা হাসতে হাসতে একটা খাতা টেনে নেন।

এইটি বুঝি আপনার সেই বন্ধু পিয়ের নোটবইটার দিকে আঙুল তোলে। সুজন বলে ওঠে, আচ্ছা, এ কী আশ্চর্যের ব্যাপার! এখানে কি সকাল-সন্ধ্যা-রাত্তির কখনওই তাপমাত্রা এতটুকু কমে না! দুপুর রোদেও যেমন গরম করছিল, এখনও তা-ই। এতটুকু হাওয়া অবধি…

সুজনের কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ পিয়ের যেন গুলিবিদ্ধের মতো সামনে ছিটকে গিয়ে ডক্টর সেনশর্মার বাঁ হাতের ওপর দমাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।

উফ! ঘটনার আকস্মিকতায় নোটবইটা মাটিতে পড়ে যায়।

 কী হল? সুজন ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসে।

 পিয়ের ডান হাতের চেটো থেকে একটা পোকার মতো বস্তু বাঁ হাতের দু-আঙুলে করে তুলে ধরে সুজনের চোখের কাছে। কী দেখছ?

 সাদা-কালো ডোরাকাটা একটা পোকা।

উঁহু, এটি পোকা নয়। মশা। এর নাম–স্টেগোমিয়া।

 মশা! অবাক হয় সুজন।

 হ্যাঁ–মশা। এনারাই সেই বিখ্যাত পীতজ্বরের নায়ক।

তা-ই নাকি!

কিন্তু তাতে ভয় পাবার কী হল! আমাদের তো ভ্যাকসিন নেওয়া আছে। ডক্টর সেনশর্মা বলেন।

না না, সাবধানের মার নেই। চলুন, ঘরে গিয়ে তাড়াতাফি খাওয়ার পাট চুকিয়ে মশারির মধ্যে সেঁধিয়ে পড়ি। তা ছাড়া কাল ভোরবেলাই তো রওনা হতে হবে।

ডক্টর সেনশর্মা খাটে উঠেই হাঁক লাগালেন, আচ্ছা পিয়ের, তুমি শেৎ-সি মাছির নাম শুনেছ?

শুনব না? স্লিপিং সিকনেস রোগ তো ভয়ংকর। এই মাছিগুলোই তো…

তুমি কি জানো পিয়ের, লোকে বলে, সাদা পোশাক পরলে এদের আক্রমণের হাত থেকে নাকি খানিকটা রক্ষা পাওয়া যায়।

কারেক্ট। কথাটা সত্যি। শেৎ-সি মাছিগুলো শুধু দিনের বেলাই আক্রমণ চালায়। শুধু সাদা পোশাকেই নয়, সাদা চামড়ার লোকেদের ওরা একটু ক্ষমাঘেন্নার চোখে দেখে। পিয়ের হাসতে লাগল।

বুঝেছি–সেই জন্যেই তুমি খুব নিশ্চিন্ত আছ। তোমার পাশে আমরা দু-জন কেলে লোক। শেৎ-সি মাছিদের ফিলটারের কাজ করব। সুজন ঠাট্টা করে।

যাঃ–ইয়ারকি মেরো না। কাল কিন্তু সত্যিই প্রত্যেকের সাদা জামা-প্যান্ট পরে বেরোনো উচিত। পিয়ের হাত বাড়িয়ে বেড সুইচটা টিপে দিল।

গুড নাইট!–গুড নাইট!–গুড নাইট!