উপন্যাস
গল্প

৩. ঘোড়ার খুরের মতো

০৩.

ঘোড়ার খুরের মতো বিশাল কনফারেন্স টেবিলটা ঘিরে একটা চেয়ারও খালি নেই। জরুরি মিটিং শুরু হবার আগেই কোলাহলের তাণ্ডব চলেছে। সুজনের শিথিল দেহটা চেয়ারে তলিয়ে রয়েছে। কিছু শুনছে না ও। শোনার কি প্রয়োজন আছে কিছু? এদের মধ্যেই আসল খুনি লুকিয়ে আছে, কিন্তু তাকে খুঁজে বার করা দুষ্কর।

কনভেনার ডক্টর গোস্বামীর স্পষ্ট গলা শোনা গেল এবার, রেসপেক্টেড ডেলিগেটস—

কথাটা শেষ করার আগে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, রেসপেক্টেড ডেলিগেটস অ্যান্ড এ বাঞ্চ অব ক্রিমিনালস–

ডক্টর গোস্বামী থামেন না, আমি আপনাদের অনুরোধ করছি প্লিজ–কুল ব্রেনে পুরো পরিস্থিতিটা একবার খুঁটিয়ে দেখুন। এভাবে পরস্পরকে দোষারোপ করে কোনও লাভ হবে না।

আমেরিকান ডেলিগেট উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, পরস্পরকে দোষী সাব্যস্ত করার ব্যাপার নয়, আমরা জানি, এ কাজ তারাই করতে পারে, যারা নিজেদের ছাড়া আর সব দেশকেই প্রতিক্রিয়াশীল বলে জঘন্যতম দোষারোপ করতে দ্বিধা করে না। যারা বলে, প্রতিক্রিয়াশীলরা নিজেরা পরমাণুশক্তি মজুত রেখে অন্যদের পারমাণবিক শক্তি হিসেবে বিকশিত হবার সুযোগ দিতে চায় না।

আমেরিকান ডেলিগেটের কথার খেই ধরে সঙ্গে সঙ্গে ডক্টর চ্যাং উঠে দাঁড়ালেন। বেঁটে মানুষ, চোখে চশমা। ধীরে ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করছেন আর দোভাষী তার অনুবাদ প্রচার করছে।

ইতিহাসই সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কারা নিজেদের শক্তি জাহির করে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে তাদের পদানত করে রাখতে চেয়ে লক্ষ-কোটি মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করেছে, সে কথা নিশ্চয় প্রমাণ করার দরকার নেই। ভুলে গিয়ে থাকলে আপনার ছেলেমেয়ের ইস্কুলের বই খুলে স্মৃতিটাকে ঝালিয়ে নিতে পারেন। ১৯৪৫-এ জাপানের…

ডক্টর গোস্বামীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠ মাইকে ব্লাস্টেড হয়ে খ্যান খ্যান করে। প্লিজ–এই আলোচনা কোনও সুফল দেবে না।

এখনও সুফল আশা করেন?

 নিশ্চয়। কারা অপরাধী জানতে পারলে পৃথিবীর সমস্ত দেশ তার বিরুদ্ধে।

কিন্তু অপরাধী তো নেই! অন্তত কেউই যে স্বীকার করবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

সুজন ভাবে, ডক্টর চ্যাং-এর এই বিদ্রূপ যদি মিথ্যের ওড়না হয়, তাহলে তাঁর মতো অভিনয়ক্ষমতা দুর্লভ বলতে হবে।

স্বীকার করতে বাধ্য হবে। ডক্টর গোস্বামীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সুজনের মনে। হয়, ডক্টর গোস্বামীর মাথায় কোনও পরিকল্পনা আছে।

তাহলে তো শার্লক হোমসকে এখুনি তলব করতে হয়। পিয়ের যে খাঁটি ফরাসি, সেটা তাঁর ব্যঙ্গের প্রয়োগেই প্রমাণিত।

হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। তবে আগে আমার প্রস্তাবটা শুনুন। সায়েন্স কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আমরা তিনজনের একটা দল তৈরি করেছি। এদের আমরা ফিল্ড ইনভেস্টিগেশনে পাঠাব।

তাতে লাভ?

সেখানকার মানুষদের কাছ থেকে নিশ্চয় কিছু-না-কিছু কু পাওয়া যাবেই। তা ছাড়া টিমে থাকছেন ডক্টর সেনশর্মার মতো বিজ্ঞানী। তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিশ্চয় বিস্ফোরণের ক্ষমতার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে এবং তার থেকে হয়তো…।

সুজনের অসীম ক্লান্তির আবরণটাকে আস্তে আস্তে খুলে নিচ্ছে ডক্টর গোস্বামীর কথাগুলো।

টিমে কে কে আছে? আমেরিকান প্রতিনিধি জানতে চাইলেন।

ডক্টর সেনশর্মা, সুজন দাশগুপ্ত আর মঁসিয়ে পিয়ের।

পিয়ের! হোয়াই পিয়ের? ফ্রান্সও পারমাণবিক শক্তি। অন্য কোনও পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশের প্রতিনিধি যদি… রুশ প্রতিনিধির তীব্র আপত্তি মার্কিন এবং জার্মান প্রতিনিধির সমর্থন পেল।

ডক্টর গোস্বামী বাধা দিলেন, মঁসিয়ে পিয়েরকে দলে নেবার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেছে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের গ্যাবন রাজ্যে। গ্যাবন বর্তমানে স্বাধীন হলেও দীর্ঘ দিন ফ্রান্সের অধীনে থাকায় এখনও অবধি ফরাসি সেখানকার প্রধান ভাষা। গ্যাবনে যেতে হলেও প্যারি হয়েই যেতে হবে। তা ছাড়া এই দলে পুরোপুরি নিরপেক্ষ আরও দু-জন থাকছেন, কাজেই আপনাদের উৎকণ্ঠার কোনও কারণ নেই।

ডক্টর গোস্বামীর কথা শেষ হতেই মার্কিন প্রতিনিধি উইলসন আবার উঠে দাঁড়ালেন, ও.কে. ডক্টর। এই প্রসঙ্গে মার্কিন গভর্নমেন্টের তরফ থেকে বলছি, আমরা আপনাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। যে-কোনও

মোটা রুশ কণ্ঠের ধাক্কায় কথা শেষ হল না। দোভাষী সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করে দিল, প্রতিশ্রুতির কথা অনেক হয়েছে। কাজের কথা হোক। আমরা জানি, গ্যাবনের মায়ান্ডায় কমিলগ কোম্পানি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ম্যাঙ্গানিজ খনি পরিচালনা করে। এই কোম্পানির ওপর আমেরিকান কন্ট্রোলই সবচেয়ে বেশি। নামকাওয়াস্তে ফরাসি আর গ্যাবন সরকার আছে বটে…।

উইলসন উঠে দাঁড়াল, আপনার ইতিহাসচর্চার প্রয়োজন নেই। কমিলগ কোম্পানি প্রয়োজনমতো কোঅপারেট করতে এতটুকু পেছপা হবে না। গ্যারান্টি দিচ্ছি।

ব্যাস–ব্যাস–তাহলেই হল। পিয়ের চেয়ারে বসেই ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বলে, একটা জবরদস্ত দেখে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে রাখবেন দয়া করে। ওখানে রাস্তাঘাটের অবস্থা যত দূর জানি খুবই খারাপ।

সুজনের মনে হল, ব্যাপারটা বড্ড বেশি ঘুলিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ বিশেষ দেশের বিভিন্ন সংস্থার সাহায্য নিশ্চয় প্রয়োজন হবে, কিন্তু তার পেছনে দয়াদাক্ষিণ্যের মনোভাবটা যাতে কাজ না করে, সেটাও দেখা দরকার। এতক্ষণের আলোচনায় এই প্রথম সে অংশ নিল। ডক্টর গোস্বামীর দিকে তাকিয়ে সুজন বলল, আমার মনে হয়, এই এক্সপিডিশনটার জন্য ইউনাইটেড নেশনস-এর এগিয়ে আসা উচিত সর্বপ্রথম। ওদেরই স্পনসর করা উচিত। অন্য কোনও দেশ বা সংস্থার সাহায্য যদি দরকার হয় তো তার ব্যবস্থা ইউএন-এর মাধ্যমেই হবে। সরাসরি কারও কাছে সাহায্য চাওয়াটা একটা হিউমিলিয়েশন। সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য সবাই দায়বদ্ধ থাকবে।

সুজনের বক্তব্য থার্ড ওয়ার্ল্ডের সম্পূর্ণ সমর্থন লাভ করল। ডক্টর গোস্বামী ইউএন-এর প্রতিনিধিকে বললেন, আমার মনে হয় আপনার ইমিডিয়েটলি হেড কোয়ার্টারে মেসেজ পাঠানো উচিত। এরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হতে পারে, ততই ভালো। জানিয়ে দেবেন, মিটিং-এ সর্বসম্মতিক্রমে এই রেজোলিউশন নেওয়া হয়েছে।

অভিযানের আয়োজনের ব্যাপারে খুঁটিনাটি আলোচনা শুরু হতে সুজন উঠে দাঁড়ায়। এসব অর্থনৈতিক আর ক্লারিক্যাল চিন্তাভাবনার মধ্যে তার অংশগ্রহণের ইচ্ছে নেই বিন্দুমাত্র। মঁসিয়ে পিয়েরের সঙ্গে করমর্দন সেরে নিঃশব্দে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে ভেবেছিল। ডক্টর সেনশর্মা দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এ কী ব্রাদার! বুড়ো মানুষটাকে এভাবে হাঙরদের মধ্যে ফেলে সরে পড়ছ একা একা? অন্তত এবারের মতো উদ্ধার করো।

সুজনের মুখে হাসি ফোটে। আলোচনা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ডক্টর সেনশর্মা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তারপর চা এলে ঘুম ভেঙে উঠে প্যাডের ওপর সমীকরণের আঁকিবুকি কাটতে শুরু করেছিলেন। কিছুই বোধহয় তাঁর কানে যায়নি। হোটেলে ফিরে গিয়ে সব কথা ওঁকে বলা দরকার।