উপসংহার
‘সৃষ্টি রহস্য’ শেষ হইয়াও পুরাপুরি শেষ হইল না। একটি বিষয় বাকি থাকিল এইজন্য যে, তাহা শুধু সম্ভাবনাময়, তবে বাস্তবমুখী। সেই বিষয়টি হইল পৃথিবীর বাহিরে জীবন বা জীবের অস্তিত্ব।
আকাশবিজ্ঞানীদের মতে আমাদের নক্ষত্রজগতের দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের মধ্যে একটি আমাদের সূর্য। এইখানে যে প্রক্রিয়ায় গ্রহাদি জন্মিতে পারিয়াছে, অনুরূপ প্রক্রিয়ায় অন্যান্য নক্ষত্রেও গ্রহ-উপগ্রহের জন্ম হওয়া অসম্ভব নহে এবং পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে যে পরিবেশে জীবন ও জীবের উদ্ভব হইয়াছে, তদনুরূপ পরিবেশে অন্যান্য নক্ষত্রের গ্রহসমূহেও জীবন ও জীবের উৎপত্তি হওয়া অসম্ভব নহে। হয়তো সেই সব গ্রহে মানুষের মতো বা তাহার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান প্রাণী থাকাও বিচিত্র নহে, হয়তোবা রূপান্তরে।
কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে, আমাদের নক্ষত্রজগতের প্রতি একশতটি নক্ষত্রের মধ্যে একটি আমাদের সূর্যের মতো গ্রহমণ্ডল সমন্বিত। এই হিসাব মোতাবেক আমাদের নক্ষত্রজগতের দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের মধ্যে একশত কোটি নক্ষত্রের গ্রহমণ্ডল আছে। বিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে, উহাদের মধ্যে কোটি কোটি নক্ষত্রের গ্রহের তাপমাত্রা ও আবহাওয়া আমাদের পৃথিবীর মতো হইতে পারে এবং উহার অনেকগুলিতেই প্রাণ ও প্রাণীর উদ্ভব হইয়া থাকিতে পারে। অনুরূপভাবে আমাদের নক্ষত্রজগত ছাড়া আরও যে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্ৰজগত (নীহারিকা) মহাকাশে আছে, তাহাতেও গ্রহমণ্ডল সমন্বিত শত কোটি নক্ষত্র থাকিতে পারে এবং তদন্তর্গত কোটি কোটি গ্রহে জীবন বা জীবের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করিবার কোনো কারণ নাই।
ভবিষ্যতে দূরবীনাদি পর্যবেক্ষণ যন্ত্রের আরও উন্নতি হইলে, হয়তো তখন গ্রহান্তরে জীবের বসবাসের সঠিক তথ্য জানা যাইবে এবং তখন তাহা সৃষ্টি রহস্য’-এর বিষয়সূচীর অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হইবে।
এই পুস্তকখানিতে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে মানবসমাজের কতিপয় মতবাদের কিছু কিছু আলোচনা করা হইল। ইহার মধ্যে আদিম মানবদের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে সমালোচ্য বিষয় কিছু আছে বলিয়া মনে হয় না। কেননা উহা মানব জাতির শৈশব ও বাল্যকালের কল্পনা প্রসূত। কাজেই বলা যায় যে, ঐসব শিশু ও বালসুলভ উক্তি। অবশিষ্ট মতবাদসমূহের আলোচনায় দেখা যায় যে, উহাদের মধ্যে সাধারণ মতবাদ দুইটি –ধর্মীয় মতবাদ ও বৈজ্ঞানিক মতবাদ।
বিজ্ঞানীদের বলা হয় বস্তুবাদী এবং বিজ্ঞানকে বলা হয় বস্তুবাদ। আবার বিজ্ঞানকে বলা যায় গণিতের সহোদর, কেননা উভয়ের চরিত্র অভিন্ন। উহাদের কাহারও মধ্যে দয়া, মায়া, ক্ষমা, হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি ভাবাবেগ নাই এবং উভয়েই সত্যের পূজারী, বস্তুজগতেই উভয়ের অস্তিত্ব। যেখানে কোনো বস্তু নাই, সেখানে গণিতের প্রক্রিয়া বন্ধ, বিজ্ঞানের গবেষণা অচল। কাজেই গাণিতিকগণও বস্তুবাদী।
বর্তমান যুগে মানব সমাজের এক বিরাট এলাকা অধিকার করিয়া আছে ধর্মীয় মতবাদ তথা ভাববাদ। কিন্তু উহার সংঘাত চলিতেছে বস্তুবাদের সাথে অহরহ। ধর্মীয় মতবাদ অপরিবর্তনীয়, চিরস্থির ও স্থবির। পক্ষান্তরে বস্তুবাদ পরিবর্তনশীল, চঞ্চল ও গতিশীল। তাই বস্তুবাদের চাঞ্চল্যের গায়ে পড়া আঘাতের ভয়ে ভাববাদ আত্মরক্ষায় উদ্বিগ্ন।
ভাববাদী তপস্বীগণ যোগাসনে বসিয়া মুদ্রিত নয়নে পরমাত্মার ধ্যানে মগ্ন থাকেন আত্মোৎকর্ষ বা আত্মতৃপ্তির জন্য। তাহারা যেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কোনো সমস্যা দেখিতে, শুনিতে বা অনুভব করিতেই পারেন না। আর বস্তুবাদী তপস্বী (বিজ্ঞানী)-গণ তাহাদের পরীক্ষাগারেই আবদ্ধ হইয়া থাকেন না, তাহারা ছুটিয়া চলেন আকাশে, পাতালে, দেশ-দেশান্তরে; পর্যবেক্ষণ করেন বিশ্বের বৃহত্তম নক্ষত্র-নীহারিকা হইতে ক্ষুদ্রতম অণু-পরমাণু পর্যন্ত, মানবকল্যাণের জন্য।
মানব জীবনে সমস্যার অন্ত নাই। খাদ্য, বস্ত্র, রোগ ইত্যাদি অজস্র সমস্যায় মানুষ জর্জরিত। “খাদ্য সমস্যার সমাধান কি?” –এইরূপ প্রশ্ন হইলে ভাববাদীগণ বলেন, “জীব দিয়াছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি।” কিন্তু উহার জন্য বস্তুবাদীরা চক্ষু মুদিয়া বসিয়া থাকিতে পারেন না। তাহারা চালাইয়া থাকেন অধিক খাদ্য ফলাও অভিযান, করেন বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানি, খোলেন অন্নসত্র। রোগাদি সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হইলে ভাববাদীগণ বলেন, “ঐসব ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা, উহার প্রতিকারের জন্য তাহার কাছে প্রার্থনা করাই উত্তম।” কিন্তু উহার জন্য বস্তুবাদীগণ করেন নানাবিধ ঔষধ আবিষ্কার, নির্মাণ করেন নানারূপ যন্ত্রপাতি, স্থাপন করেন নানাবিধ চিকিৎসালয়।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এমন কোনো বিষয় পাওয়া যায় না, যে বিষয়ে বস্তুবাদী (বিজ্ঞানী)-দের কোনোরূপ অবদান নাই। বিজ্ঞানীদের যাবতীয় সাধনার মৌলিক উদ্দেশ্য আত্মস্বার্থ বিসর্জনপূর্বক সত্যোঘাটন ও মানুষের কল্যাণ সাধন করা। তাই স্বভাবতই তাহারা ত্যাগী ও মানবপ্রেমিক। অধুনা বস্তুবাদের সহিত ত্যাগ ও প্রেম যোগে মানব জগতে গড়িয়া উঠিয়াছে এক নূতন মতবাদ, যাহার নাম মানবতাবাদ। ইহা বৈজ্ঞানিক সমাজে সমাদৃত, অনেকটা বাহিরেও। বিজ্ঞানের দুর্বার অগ্রগতি দেখিয়া মনে হয় যে, একদা মানবজগতের আন্তর্জাতিক ধর্মই হইবে মানবতাবাদ (HUMANISM)।