সংস্কার ও কুসংস্কার সৃষ্টি
প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের সহায়তায় যে মানবেতিহাস প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাতে জানা যায় যে, মানুষের জাতিগত জীবনের শৈশবে মানুষ ও ইতর জীবের আহার-বিহার ও মনোবৃত্তির বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না। সভ্যতার উষালোকপ্রাপ্তির সাথে সাথে পার্থক্যটি প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। তখনকার দিনে যেমনই চলিয়াছিল পশুবৃত্তি দূরীকরণ অভিযান, অর্থাৎ মানুষের সমাজ সংস্কার, আবার তেমনই উহার সহগামী হইয়া চলিয়াছিল শত শত কুসংস্কার। সেইদিনের মানুষের নিছক কল্পিত বিষয় বা কাহিনীগুলি পরবর্তী মানুষের মনে এমনই গভীরভাবে দাগ কাটিয়াছে যে, হাজার হাজার বৎসর পরেও কতক মানুষ ঐগুলিকে ধ্রুব সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া আসিতেছে।
মানব সভ্যতার মধ্যযুগে গ্রীস, মিশর, ব্যাবিলন, চীন ও ভারতাদি অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশসমূহে চলিয়াছিল মানুষের কল্পনাপ্রসূত নানাবিধ জপ, তপ, হোম, বলি ও নানাবিধ ক্রিয়ানুষ্ঠানাদি কুসংস্কারের প্রবল বন্যা এবং উহাই ছিল সেইদিনের মানুষের ধর্ম। ধর্ম তখনও স্বতন্ত্র রূপ লইয়া মানব সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই। বলা বাহুল্য যে, সেইদিনের কোনো। ক্রিয়ানুষ্ঠানাদিতে অবশ্যকরণীয় বলিয়া কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। মানুষ তাহার স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই প্রকৃতির নানারূপ শক্তির স্তব-স্তুতি করিত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া স্বাধীনভাবে। এইটা কর, ওইটা করিতে হইবে’ –এই বলিয়া কোনো চাপ ছিল না কোনো ব্যক্তির উপরে।
কালক্রমে যখন অঞ্চলবিশেষের সমাজপতিগণ কতক পূর্বপ্রচলিত ও কতক স্বকল্পিত ক্রিয়ানুষ্ঠানাদিকে অবশ্যকরণীয় বলিয়া প্রচার করিলেন, তখন হইতে তৈয়ারী হইল নিত্য নৈমিত্তিক কর্মতালিকা বনাম ‘ধর্ম’ নামের সূচনা।
ধর্মবেত্তারা সকলেই যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন কুসংস্কার বর্জন করিতে। তাই দেখা যাইতেছে যে, যে ধর্ম অপেক্ষাকৃত আধুনিক, সেই ধর্ম কুসংস্কারমুক্ত এবং যে ধর্ম পুরাতন, সেই ধর্ম কুসংস্কারে ভরপুর।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, আমরা বাস করিতেছি বিরাট এক বায়ুচাপের মধ্যে, যে চাপে পাথরাদি গুড়া হইয়া যাইতে পারে। কথাটি সত্য। কিন্তু আমরা তাহা টের পাইতেছি না। কেননা আমাদের শরীরের বাহিরে যেমন বায়ু আছে, ভিতরেও তেমন বায়ু আছে; ভিতর ও বাহিরের বায়ুর চাপে ঐ চাপ কাটাকাটি হইয়া যায়। বিশেষত জন্মাবধি বায়ুচাপে বাস করিয়া ঐ চাপ হইয়াছে আমাদের। অভ্যাসাগত। কাজেই আমরা অনুভব করিতে পারতেছি না যে, বায়ুর চাপ আছে।
বায়ুচাপের মতোই মানুষের অভ্যাসাগত কুসংস্কার। দূর অতীতের ধর্মবেত্তারা ছিলেন নানাবিধ কুসংস্কারপূর্ণ সমাজের বাঁশিন্দা। তাহাদের ভিতর ও বাহিরে ছিল কুসংস্কার এবং জন্মাবধি কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে বাস করিয়া কিছু হইয়াছিল গা-সহা অভ্যাস। তাই অনেক ধর্মবেত্তাই কু সংস্কার কি ও কোনটি, তাহা অনুধাবন করিতেই পারেন নাই। কাজেই কুসংস্কার বর্জনের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কতক ধর্মবেত্তা বহুক্ষেত্রে ঝোঁপ কাটিয়া জঙ্গল রোপণ করিয়া গিয়াছেন। বলা বাহুল্য যে, কোনো কুসংস্কারই কুসংস্কার বলিয়া সর্বস্তরের লোকের কাছে স্বীকৃতি লাভ করে না।
কুসংস্কার কি, অল্প কথায় ইহার উত্তর হইল, যুক্তিহীন বিশ্বাস বা অসার যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত মতবাদে বিশ্বাস; এক কথায় –অন্ধবিশ্বাস। যেখানে কোনো বিষয় বা ঘটনা সত্য কি মিথ্যা, তাহা যাচাই করিবার মতো জ্ঞানের অভাব, সেখানেই কুসংস্কারের বাসা। অসভ্য, অর্ধসভ্য, অশিক্ষিত ও শিশু মনেই কুসংস্কারের প্রভাব বেশি। কিন্তু কুসংস্কার এত ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া আছে যে, সম্পূর্ণ কুসংস্কারমুক্ত মানুষ অল্পই পাওয়া যায়। যাহারা নিজেদের কুসংস্কারমুক্ত বলিয়া গর্ববোধ করেন, হয়তো কোনো না কোনো রূপে তাহাদের ভিতরেও কিছু না কিছু কুসংস্কার লুকাইয়া থাকিতে পারে বা আছে।
শিশুমনে কুসংস্কারের বীজ ছড়ায় তাহাদের মাতা-পিতা ও গুরুজন, নানারূপ দেও, পরী ও ভূতের গল্প বলিয়া। যদিও বাস্তব জগতে ঐগুলির কোনো অস্তিত্ব নাই, তথাপি একদল মানুষ উহা বিশ্বাস করে ও তাহাদের সন্তান-সন্ততি বা শিষ্যাদির মধ্যে উহার বীজ ছড়ায়। কেননা ঐ সকল অলীক কাহিনী শিশুমনেই দাগ কাটে বেশি।
এমন একটি যুগ ছিল, যখন মানুষ ছিল তাহার জাতিগত জীবনে শিশু। সেই মানব সভ্যতার শিশুকালে তৎকালীন মোড়ল বা সমাজপতিগণ যাহা বলিতেন, জনসাধারণ তাহা অভ্রান্ত বলিয়া বিশ্বাস ও মান্য করিত; তা বাক্যটি যতই অদ্ভুত হউক না কেন। বর্তমান কালেও কোনো কোনো মহলে দেখা যায়– সত্য-মিথ্যার বিচার নাই, গুরুবাক্য শিরোধার্য। এইখানে আমরা ঐরূপ কতিপয় গুরুবাক্যের অবতারণা করিব, ইহার কোটি সংস্কার এবং কোটি কুসংস্কার, তাহা যাচাই করিবেন সুধী পাঠকবৃন্দ।
.
# দেবতা
হয়তো কোন দেশের কোনো সমাজপতি কল্পনা করিলেন যে, সূর্যের বদৌলতে আমরা তাপ পাই, আলো পাই, বাগান বা ক্ষেতের ফসল পাই এবং উহার দ্বারা আরো কত রকমে উপকৃত হই, সুতরাং উহাকে তুষ্ট না রাখিলে চলে না। তিনি শুরু করিলেন সূর্যের স্তব-স্তুতি, আর জনসাধারণ উহা মানিয়া লইল এবং আরম্ভ হইল সূর্যপূজা। মেক্সিকোর আদিম অধিবাসীরা তো সূর্যের নামে নরবলি প্রথারই প্রচলন করিয়াছিল এবং হাজার হাজার বৎসরে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নষ্ট হইয়াছে উহাদের সূর্যদেবকে তুষ্ট করার জন্য। দেব-দেবী বা ঈশ্বরের নামে নরবলির বদলে পশুবলির প্রথা প্রায় সব দেশেই আজও প্রচলিত আছে।
শুধু মেক্সিকোতেই নহে, অন্যান্য দেশেও নরবলি প্রথার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইহুদিদিগের মধ্যে জাভে-এর তৃপ্তির জন্য নরবলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। জজদের যুগে দেখা যায় নবী শামুয়েল বন্দী রাজা আগাগকে প্রভুর নামে স্বহস্তে বলি দিয়াছিলেন (Samuel 15), জেফত তাহার কন্যাকে বলি দিয়া যজ্ঞে আহুতিদান করিয়াছিলেন (Judges II) এবং হজরত ইব্রাহিম তাঁহার পুত্রকে কোরবানি দিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। ভারতেও এক সময়ে নরবলির প্রথা ছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ গ্রন্থের কাঁপালিক চরিত্রে।
কোনো দেশের কোনো মুরুব্বি ব্যক্তি হয়তো কল্পনা করিলেন যে, সূর্যের কাছে আমরা অশেষ উপকার প্রাপ্ত হই বটে; কিন্তু উহাকে তো আর হাতের কাছে পাই না! সূর্যের প্রায় সকল গুণই পাওয়া যায় অগ্নির মধ্যে, বস্তুত অগ্নি সূর্যেরই প্রতিরূপ। সুতরাং অগ্নিদেবের তুষ্টার্থে তাঁহার জপ-তপ করাই কর্তব্য। আর তাহার ঐ মত মানিয়া জনসাধারণ আরম্ভ করিল অগ্নিপূজা। হিন্দু ও পারসিকদের মতে, অগ্নি অতীব পবিত্র এবং পরম দেবতা।
আদিম মানব সহজ ও সরল মনেই প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির উপাসনা শুরু করিয়াছিল। তাহাদের ঐ সকল উপাসনার মূলে ছিল বাঁচিয়া থাকার কামনা, স্বর্গপ্রাপ্তি নহে। অনুকূল শক্তিসমূহের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও প্রতিকূল শক্তিকে বশ করিবার প্রচেষ্টাই ছিল আদিম মানবদের প্রকৃতিপূজার মূল উদ্দেশ্য। আবার বিরাট ও বিশাল কিছু দেখিলেই তাহার কাছে তাহারা মস্তক অবনত করিত। বিশেষত প্রত্যেক শক্তিকেই কল্পনা করা হইত ব্যক্তিরূপে। উহারা যেন সকলেই মানুষের মতো আকৃতি-প্রকৃতি বিশিষ্ট এবং ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। উহারা ইচ্ছা করিলে যেন মানুষের উপকার বা অপকার দুইই করিতে পারে। এইরূপ বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়া আদি মানব শুধু সূর্য ও অগ্নিকেই দেবত্ব দেয় নাই, দেবত্ব দিয়াছিল জল, বায়ু, সাপ, কুমির, বাঘ, নদী, সাগর, পাহাড়, নক্ষত্র, মেঘ, বৃষ্টি, ঝঞ্ঝা, বস্ত্র, বটবৃক্ষ এবং কোনো কোনো পশু পাখিকেও।
ঐসব পার্থিব দেবতা ভিন্ন কতগুলি অপার্থিব দেবতারও কল্পনা হইয়াছিল। যেমন– ক্রোধের দেবতা রুদ্র, সাম্যের দেবতা বিষ্ণু, সম্পদের দেবী লক্ষ্মী, বিদ্যাদেবী সরস্বতী ইত্যাদি। আবার কোনো কোনো দেশে মানুষকেও দেবাসনে বসানো হইয়াছে, কোথায়ও মহামানব বা কোথায়ও দেব-অবতাররূপে। যেমন –শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ, নমরুদ, ফেরাউন ইত্যাদি (ফেরাউন কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নহে, উহা রাষ্ট্রীয় উপাধি মাত্র)।
আদিম মানবদের ঈশ্বরকল্পনা ছিল না, কল্পনা ছিল দেবতার। যে তাপ ও আলো দান করে, সে একজন দেবতা; যে খাদ্য দান করে, সে একজন দেবতা; যে বৃষ্টি দান করে, সে একজন দেবতা; এইরূপ– ঝঞ্ঝার দেবতা, বজ্রের দেবতা, মৃত্যুর দেবতা ইত্যাদি অজস্র দেবতা। মনে করা হইত যে, দেবতারা সকলেই এক একটি কার্য নির্বাহ করিয়া থাকেন স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে। কাজেই উহারা প্রত্যেকেই এক একটি বিষয়ের মালিক। অর্থাৎ বিভাগীয় ঈশ্বর (Departmental God) পরবর্তী কালের মানুষ কল্পনা করিল যে, ঐ সকল ভিন্ন ভিন্ন শক্তির মূলে একটি মহাশক্তি আছে, তখন তাহার নাম রাখা হইল বিশ্ব অধিপতি বা পরম ঈশ্বর। কিন্তু দেখা গেল যে, পরম ঈশ্বর তো স্বহস্তে কিছুই করেন না, তবে প্রকৃতির যাবতীয় ঘটনা ঘটে কি রকম? তখন কল্পনা করা হইল যে, যাবতীয় কার্য নির্বাহ ঐ সকল দেবতারাই করিয়া থাকেন বটে, কিন্তু পরমেশ্বরের হুকুমমতে। দেবতারা সকলেই পরমেশ্বরের নির্দেশমতে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করিয়া থাকেন মাত্র। তবে আগের পরিকল্পনাটি একটু পরিবর্তন করা হইল। দেবতারা ছিলেন ৩০-৪০ কোটি বা নির্দিষ্ট সংখ্যক, কিন্তু স্বর্গীয় দূতেরা অসংখ্য। পরমেশ্বর বা একেশ্বর কল্পনার পূর্বে যাহারা ছিলেন। দেবতা, একেশ্বর কল্পনার পরে তাহারাই বনিয়াছেন স্বর্গীয় দূত। প্রাচীন মানবের এই স্বর্গদূত পরিকল্পনাটি পরে স্থান পাইয়াছে কতগুলি ধর্মে।
কোনো কোনো অঞ্চলে কল্পনা করা হইল প্রত্যেকটি রোগের কারণ ও বাহনরূপে এক একটি অপদেবতার। জ্বর, কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি যত প্রকার রোগ আছে, তাহার প্রত্যেকটির পরিবাহক এক একটি অপদেবতাও আছে এবং ঐ সকল রোগের প্রতিকারার্থে নানাবিধ তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড় ফুঁকেরও প্রচলন হইয়াছিল সেই আদি কালেই, যাহা স্থানবিশেষে এখনও প্রচলিত আছে।
.
# জন্মান্তর
জন্মান্তর কল্পনাটি অতি প্রাচীন। ইহার দুইটি রকমভেদ আছে। যথা –পুনর্জন্ম এবং পুনর্জীবন। হিন্দু ও বৌদ্ধগণ পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। ইহাদের মতে, দেহ নশ্বর, কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর। অর্থাৎ জীবের মুত্যুর পরে তাহার এই পার্থিব দেহ লয়প্রাপ্ত হয়, কিন্তু আত্মা লয়প্রাপ্ত হয় না। এই জন্মের ভালো বা মন্দ কর্মানুসারে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট জীবরূপে আত্মা আবার জন্ম লয়। অর্থাৎ মৃত্যুর পর আত্মা নূতন জনমে রাজা বা ভিখারী, চোর বা সাধু অথবা শিয়াল-কুকুর, কীট-পতঙ্গও হইতে পারে। কিন্তু আদিম মানবদের মনে (পরকালে) পাপ-পুণ্যের ফলভোগ-এর কল্পনা ছিল না, ছিল শুধু পুনর্জীবনের আশা। ইহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন মিশরীয়দের সমাধিগুলিতে রক্ষিত আসবাবপত্র ও জাঁকজমক দেখিয়া।
ইহুদি ও খ্রীস্টানাদি সেমিটিক জাতিরা জন্মান্তরে বিশ্বাসী নহেন, তাহারা বিশ্বাসী পুনর্জীবনে। তাহাদের মতে, মানুষ মৃত্যুর পর তাহার পূর্বদেহেই কোনো এক সময়ে আবার জীবন ফিরিয়া পাইবে এবং তখন সে তাহার ন্যায় বা অন্যায় কাজের ফল ভোগ করিবে।
পুনর্জীবনের কল্পনাটি বোধ হয় প্রথম জাগিয়াছিল প্রাচীন মিশরীয়দের মনে। কল্পনাটির মূল উৎস ছিল দুইটি –সূর্য ও নীলনদ। মিশর দেশটি সাহারা মরুর অংশবিশেষ। প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানক্রমে ঐখানে সূর্যের যতখানি প্রতাপ, পৃথিবীর অন্য আর কোথায়ও তত নহে। কাজেই সূর্য মিশরবাসীদের মনকে আকর্ষণ করিয়াছিল বেশি এবং সূর্যকে লইয়া উহারা জল্পনা-কল্পনাও করিয়াছিল বেশি। তাহারা দেখিয়াছিল যে, এমন প্রচণ্ড প্রতাপশালী সূর্য ভোরে জন্মলাভ করিয়া শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্যে পৌঁছিয়া সন্ধ্যায় অস্তাচলে গমন করে, অর্থাৎ উহার মৃত্যু হয়। পরের দিন ভোরে আবার পুনর্জীবন লাভ করিয়া পূর্ববৎ উদিত হয়। ঐরূপ মানুষের জীবনও এই দেহে ফিরিয়া আসিবে– এইরূপ আশা প্রাচীন মিশরীয়দের মনে উঁকি মারিতেছিল।
মিশরীয়দের মনে আর একটি আকর্ষণীয় বিষয় ছিল নীলনদ। মরুময় মিশর দেশকে শস্যশ্যামল করিয়া মিশরবাসীগণকে বাঁচাইয়া রাখে নীলনদ। তাহারা দেখিত যে, বৎসরের একটি নির্দিষ্ট দিনে নীলনদে বান ডাকিয়া জল আসে। শুরুতে জল আসে অল্প অল্প এবং ক্রমে জল বৃদ্ধি পাইয়া প্রবল আকার ধারণ করে, নীলনদের যৌবনজোয়ার মিশর দেশকে ডুবাইয়া দেয়। আবার ক্রমে ক্রমে উহা ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া জলশূন্য হইয়া যায়। তখন হয় নীলনদের মৃত্যু। কিন্তু বৎসরান্তে আবার জল আসে, দেশ ভাসে, নীলনদ পুনর্জীবন পায়। নীলনদের এই বার্ষিক জন্ম-মৃত্যুর ঘটনাটি সূর্যের দৈনিক জন্ম-মৃত্যুর ঘটনাটির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ সন্দেহ নাই। কাজেই প্রাচীন মিশরীয়দের মনে ভালোভাবেই বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, মৃত্যুর পরে ঐরূপ মানুষও পুনর্জীবন লাভ করিবে।
তাই প্রাচীন মিশরীয়রা শবকে নষ্ট হইতে দিত না, সযত্নে কবর দিত এবং মৃতের আহারের। জন্য খাদ্য-পানীয়, ব্যবহারের জন্য নানাবিধ পাত্র, আত্মরক্ষার জন্য হাতিয়ার ও সুখ-সুবিধার অন্যান্য দ্রব্য কবরে দিত। রাজরাজড়াদের কবরে নাকি দাস-দাসী, পরিজন, পাত্র-মিত্রগণও স্থান লাভ করিত এবং উহার অভাবে ঐসবের মূর্তি বা চিত্র কবরে রাখা হইত। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মিশরে খননকার্যের দ্বারা বহু কবরে ঐসকল প্রাপ্ত হইয়াছেন।
পুনর্জীবনে বিশ্বাসবশত মানবদেহকে অক্ষত রাখার চরম প্রচেষ্টারই ফল মিশরের পিরামিড। গিজার বড় পিরামিডটির মধ্যে যে সকল জিনিসপত্র পাওয়া গিয়াছে, দুই-এক পৃষ্ঠা কাগজে তাহার তালিকা ধরে না। সোনাদানার নানা রকম জিনিস হইতে আরম্ভ করিয়া চেয়ার, টেবিল, খাট-পালক, বাসনকোসন, এমনকি নখ পালিশ করিবার সুন্দর ছোট যন্ত্রপাতি পর্যন্ত ঐ সকল পিরামিডে পাওয়া গিয়াছে। আর পাওয়া গিয়াছে জীবদ্দশায় রাজার যে সমস্ত পাত্র-মিত্র, সভাসদ এবং দাস-দাসী ছিল, তাহাদের মূর্তি। অর্থাৎ জীবদ্দশায় যাহারা রাজার সাঙ্গপাঙ্গ ছিল, তাহাদের অভাবে রাজার যাহাতে কষ্ট না হয়, সেই জন্য জীবন্তের প্রতীক হিসাবে এই মূর্তিগুলি রাজার আশেপাশে রাখা হইত। পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, আদিতে ইহাদের জীবন্ত অবস্থাতেই সমাধিস্থ করা হইত।[৩৪]
পণ্ডিতগণের অনুমান যে সত্য, তাহার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে প্রাচীন সুমের ও ব্যাবিলোনিয়ার কয়েকটি সমাধিগর্ভে। সাধারণ নাগরিকেরা গর্ত খুঁড়িয়া মৃতকে কবর দিত, তাহার আভরণ, শখের বস্তু, ছোরা, সিলমোহর, ধাতু বা পাথর নির্মিত পাত্র ইত্যাদি সমেত। কিন্তু রাজরাজড়ার সমাধি এক বিরাট কাণ্ড। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে উর নগরের খননকার্যের ফলে রাজ্ঞী সুব-আদ ও তাঁহার স্বামীর দুইটি সমাধি আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তাহার বিশেষ বিবরণ দিয়াছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার লিওনার্ড উলি। বিবরণটি নিম্নরূপ —
“মাটির নিচে প্রস্তুত করা হইয়াছে একটি ইষ্টকনির্মিত সৌধ, সেটি সমাধিগৃহ। তাহার মধ্যে চারিটি কক্ষ। রাজা ও রাণীকে দুইটি কক্ষে সমাধি দান করা হইয়াছে, আর বাহিরের দুইটি কক্ষে এবং প্রবেশপথে পড়িয়া আছে অনেকগুলি নর-নারীর কঙ্কাল, সারিবদ্ধভাবে শায়িত। এক জায়গায় দশটি নারীদেহ রহিয়াছে দুই সারিতে। তাহাদের মাথায় ও কণ্ঠে সোনার ও পাথরের অলঙ্কার। একটি সোনার মুকুট পরা মেয়ের হাতে রহিয়াছে একটি বীণা। সমাধিকক্ষে প্রবেশ করার জুলি পথে একটি রথ, আর রথের উভয় পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছে স্বর্ণনির্মিত সিংহমূর্তি, নানা। রকমের কাজ করা। সোনা-রূপার সিংহ ও বৃষের মূর্তিতে রথের চূড়াদেশ সজ্জিত। সম্মুখেই দুইটি গর্দভের ও সিংহের কঙ্কাল আর দূতক্রীড়ার ছক, নানাবিধ অস্ত্র, স্বর্ণ ও তাম্র পাত্র এবং পাথরবাটি। প্রস্তরনির্মিত কক্ষটির প্রান্তদেশে নয়টি নারী, সকলেরই মাথায় রত্নভূষণ, কানে সোনার দুল ও মাকড়ি। মোট ৬৮টি নারীর কঙ্কাল ছিল সমাধিগর্ভে, তাহার মধ্যে ২৮টির মাথায় স্বর্ণালঙ্কার পুরানো।
“রাজা-রাণীর সমাধিগৃহে রত্নভূষণে সজ্জিত স্ত্রীলোক, পুরুষ মানুষ, রথ ইত্যাদি প্রোথিত হইয়াছিল কেন? ইহার অত্যন্ত সহজ উত্তর এই যে, রাজা-রাণীর সঙ্গে তাহাদের পরিচারক পরিচারিকাদেরও সমাধি দেওয়া হইত, যেমন প্রোথিত করা হইত তাহাদের শখের জিনিস, আবশ্যকীয় দ্রব্য। জিনিসের প্রয়োজন হইত ব্যবহারের জন্য, আর দাস-দাসীর প্রয়োজন হইত পরলোকের সেবার জন্য।”[৩৫]
.
# তালমুদিক শিক্ষা
প্রাচীন হিব্রু জাতির মধ্যে কতগুলি রূপকথা-উপকথা বা কাহিনী প্রচলিত ছিল। সেই সব কাহিনীর ব্যক্তি বা স্বর্গদূতগণের নাম হয়তো বাইবেলে আছে, কিন্তু সেই নামের সূত্র ধরিয়া (উপন্যাসের আকারে) কতগুলি পার্থিব ও অপার্থিব প্রাণীদের কল্পিত কাহিনী দীর্ঘকাল ধরিয়া হিব্রুদের মুখে মুখে চলিয়া আসিতেছিল। কালক্রমে ইহুদি পুরোহিত বা ‘রাবিব’গণ ঐ কাহিনীগুলিকে সংকলন করিয়া বিরাট দুইখানা পুস্তক লেখেন। গ্রন্থদ্বয়ের নাম তালমুদ ও মিদ্রাস। ঐ গ্রন্থ দুইখানি রূপকথা-উপকথার অফুরন্ত ভাণ্ডার এবং কুসংস্কারের পাহাড়। বর্তমান জগতে যত রকম কুসংস্কার প্রচলিত আছে, বোধ হয় যে, ঐ গ্রন্থ দুইখানিই তাহার কেন্দ্র। মুশকিল হইল ঐ জায়গায় যে, তালমুদে বর্ণিত কাহিনীগুলির মূল সূত্র অর্থাৎ ব্যক্তি বা স্বর্গদূতগণের নাম বাইবেলে লিখিত থাকায় কেহ কেহ ঐসব কম্পিত কাহিনী গ্রহণ করিতেছে ধর্মীয় কাহিনী হিসাবে, অর্থাৎ সত্য বলিয়া। তালমুদ গ্রন্থে বর্ণিত তিনটি উপকথার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিতেছি।
লিলিথের উপকথা
লিলিথ মানুষের মতোই মাটির তৈয়ারী একজন স্ত্রীলোক। সে প্রথমে শয়তানকে বিবাহ করে ও তাহাকে ত্যাগ করিয়া বিবাহ করে আদমকে। আদমের সহিত তাহার বনিবনা না হওয়ায় সে পলাইয়া যায় এবং আদম ঈশ্বরের কাছে নালিশ করে। ঈশ্বর তিনজন স্বর্গদূত পাঠায় লিলিথকে ধরিয়া আনিবার জন্য। কিন্তু তাহারা তাহা পারে না (সম্ভবত এই সময়ে হাওয়ার সহিত আদমের বিবাহ হয়)। আদম এদন উদ্যান হইতে বিতাড়িত হইয়া হাওয়া হইতে বিচ্ছিন্ন হইবার পর লিলিথ আদমের সাথে পুনঃ মিলিত হয় এবং ৩০ বৎসর আদমের ঘর-সংসার করে। এই সময়ে লিলিথের গর্ভে যে সকল সন্তান জন্মে, তাহারা হইল ‘শেদিম’ (Shedim) বা দানব।
স্বর্গদূত প্রতিষ্ঠান
ইহুদিদের মতে স্বর্গদূত তিন শ্রেণীর –সিরাফিম, চিরাবিম ও ওনাকিম। অগ্নি উপাদানে উহাদের দেহ গঠিত। উহাদের নিঃশ্বাসে মনুষ্য দগ্ধ হয় ও কণ্ঠস্বরে মানুষের কর্ণপটাহ বিদীর্ণ হয়। আধা আগুন ও আধা বরফের তৈয়ারী এঞ্জেলও আছে। এই দলের নাম ইসিম। মৃত্যুর এঞ্জেলের চক্ষুদ্বয় আগুনের তৈয়ারী। তাহার দিকে চাহিলেই মানুষ ধরাশায়ী হয়। এঞ্জেল অসংখ্য। চিনিবার জন্য প্রত্যেকের বক্ষে একটি করিয়া চাকতি লাগানো থাকে এবং তাহাতে ঈশ্বরের নামের সাথে লেখা থাকে এঞ্জেলের নাম। এঞ্জেলদের প্রত্যেকের কর্তব্য ঠিক করিয়া দিয়াছেন ঈশ্বর (আদিতে যাহারা ছিল দেবতা, তাহারাই তালমুদে বনিয়াছে স্বর্গদূত)। যথা —
১. আফাত্রিয়েল ইনি মানুষের চিন্তা ও বাক্য স্বর্গে বহন করেন।
২. গালিজুর ঈশ্বরের বাণী পৃথিবীর গোচরে আনেন।
৩. বেননেজ নিয়ন্ত্রণ করেন ঝঙ্কাকে।
৪. বারাকিয়েল নিয়ন্ত্রণ করেন বিদ্যুতকে।
৫. লাইলাহেম নিয়ন্ত্রণ করেন রাত্রিকে।
৬. জোরকামি নিয়ন্ত্রণ করেন শিলাবৃষ্টিকে।
৭. রাশিয়েল নিয়ন্ত্রণ করেন ভূমিকম্পকে।
৮. সালগিয়েল। নিয়ন্ত্রণ করেন তুষারপাতকে।
৯. রাহাব নিয়ন্ত্রণ করেন সমুদ্রকে।
১০. সানডেল ফোন ইনি পৃথিবীর উপরে দাঁড়াইয়া আছেন। ইঁহার মাথা স্বর্গ স্পর্শ করে, ইনি সৃষ্টিকর্তার মহিমার রশ্মিকিরিটী বয়ন করেন (বোধ হয়, ইনি সূর্য)।
১১. রেডিয়াও ইনি বৃষ্টির এঞ্জেল। ইনি স্বর্গের ও পৃথিবীর জলরাশি নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁহার জলদমন্দ্র কণ্ঠস্বর পৃথিবীময় ধ্বনিত হয় (বোধ হয় মেঘগর্জন)।
১২. মেটাট্রোন ইনি পৃথিবী পরিদর্শনের কার্য করেন। ধর্ম ও শাস্ত্রসমূহের সংরক্ষণের ভার হঁহার উপরে। বনি ইস্রায়েলদের মিশর হইতে স্বদেশে ফিরাইয়া লইয়া যাইবার কাজ ইহাকে অর্পণ করা হইয়াছিল।
ঐ সকল এঞ্জেলদের উপরে বিরাজ করেন কয়েকজন আর্কেঞ্জেল, অর্থাৎ প্রধান এঞ্জেল। যেমন –মাইকেল, র্যাফেল, গ্যাব্রিয়েল, উরিয়েল ইত্যাদি। ইহারা ঈশ্বরের আদেশে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করিয়া থাকেন।
শয়তান ও পতিত দূতগণ
শয়তান ছিল সিরাফিম গোষ্ঠীর একজন আর্কেঞ্জেল। তাহার ইহুদি নাম সামমায়েল। তাহার বারোটি পাখা ছিল। ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করায় শয়তান ও তাহার অনুচরদের প্রতি দণ্ডাদেশ হইল নির্বাসনের। সেই আদেশ তাহারা প্রত্যাখ্যান করিল। তখন ঈশ্বরের দূতগণের সঙ্গে তাহাদের যুদ্ধ আরম্ভ হইল (ইহা পারসিকদের অহুরমজদা ও আহরিমান-এর আখ্যানের অনুরূপ)। স্বর্গদূত বাহিনীর নেতা ছিলেন আর্কেঞ্জেল মাইকেল। শয়তানের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তিনিই প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। শেষমেশ শয়তান ও তাহার অনুচরদের পরাজয় হইল এবং উহাদের পতন হইল স্বর্গ হইতে নরকে (পৃথিবীতে)। সেই সময় হইতে মানুষের অহিতসাধন ও ঈশ্বরবিরোধী করিয়া তাহাদের বিপথে চালাইয়া লওয়াই হইল শয়তানের একমাত্র ব্রত।
স্বর্গীয় এঞ্জেলদের মতো নরকে (পৃথিবীতে) শয়তানের অনুচর দানবগণও সংঘবদ্ধভাবে একটি প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিয়াছিল। দানবগণ ছদ্মআকারে মর্তমানবকে আশ্রয় করিয়া নানা আধি-ব্যাধি সৃষ্টি করে, বিশেষ ক্ষেত্রে মানুষের বশ্যতাও স্বীকার করে এবং আলাউদ্দীনের প্রদীপের দানবের মতো মানুষের কাজেও লাগে। এই দানবগোষ্ঠী চারি শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা –শেদিম, রউখিল, মাজিকিল ও লেলিন। মানুষ ও স্বর্গদূত, এই উভয় জাতির গুণ বিদ্যমান আছে এই দানবদের মধ্যে। মানুষের মতো তাহারা আহার-বিহার ও বংশবৃদ্ধি করে, মানুষের মতোই তাহাদের মৃত্যু হয়, অথচ এঞ্জেলদের মতো তাহাদের পাখা আছে। গগনে বিহার করিতে পারে (ইহা দেও-পরীর কল্পনার উৎস)। দিব্যদৃষ্টিতে ভবিষ্যতকে দেখিতে পায়। ইচ্ছামতো মানুষ বা অন্য প্রাণীর রূপ ধারণ করিতে পারে এবং নিজে অদৃশ্য থাকিয়া অন্যকে দেখিতে পারে। পৃথিবীতে তাহাদের বাসস্থান মরু-কান্তার, জলাভূমি, শ্মশান ইত্যাদি। বাঁধা বস্তু বা সিলমোহর দেওয়া কোনো জিনিসের উপর তাহাদের প্রভাব নাই। ঈশ্বরের নাম উচ্চারণমাত্র উহারা সেখান হইতে পলাইয়া যায় ইত্যাদি।[৩৬]
বলা বাহুল্য যে, তালমুদীয় আবহাওয়া হইতে কোনো দেশ বা কোনো জাতিই সম্পূর্ণ মুক্ত নহে।
.
# ভূত
মধ্যযুগে পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদি ধর্ম হইয়াছিল ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব ও ডাকিনী-যোগিনীর বাসা। ইহুদিদের মধ্যে ভূতে পাওয়ার বিশ্বাস বিশেষভাবে প্রসার লাভ করিয়াছিল। ঐ সকল ভূত বা দানবদের বলা হইত দিল্লুক (Dibbuk)। উহারা নাকি মানুষের দেহকে আশ্রয় করিত এবং যাহার উপর চাপিত, তাহার ব্যক্তিত্ব একেবারেই লোপ পাইত। নানাবিধ তন্ত্র-মন্ত্র, তাবিজ-কবচ এবং ওঝার ঝাড়-ফুঁক উদ্ভাবন ও প্রচলন করিয়াছিল সেই কালের ইহুদিরা। ঐগুলি এখনও প্রচলিত রহিয়াছে অনুন্নত দেশগুলিতে।
খ্রীস্টান জগতে ভূতে পাওয়া সম্বন্ধে ধারণা ছিল আরও অদ্ভুত। তাহারা ভূতে পাওয়া রোগী দুনিয়ায়ই রাখিত না, মারিয়া ফেলিত। তবে এখন আর মারে না।
ভূত-প্রেত বা গন্ধর্ব মানুষকে আশ্রয় করে, এই বিশ্বাস ভারতীয় বৈদিক যুগেও ছিল। তাহার নিদর্শন পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে। বৃহদারণ্যক উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় ব্রাহ্মণে দেখা যায়, পাতঞ্জল কাপ্যের এক কন্যা গন্ধর্বগৃহীতা (আবিষ্টা) হইয়াছিল।
ঘটনা সাধারণত দুই জাতীয়– লৌকিক এবং অলৌকিক। আবার অলৌকিক ঘটনার কতগুলিকে বলা হয় ঐশ্বরিক এবং কতগুলিকে ভৌতিক। যে সমস্ত ঘটনার কারণসমূহ সাধারণত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, তাহাকে বলা হয় লৌকিক এবং যাহা ইদ্রিয়গ্রাহ্য নহে, তাহাকে বলা হয় ঐশ্বরিক বা ভৌতিক।
রোগও দুই জাতীয় –শারীরিক ও মানসিক। কলেরা, বসন্ত ও জ্বরাদি রোগসমূহ শারীরিক; ইহা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। উন্মাদাদি রোগসমূহ মানসিক। ইহার কারণাবলী ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা সহজবোধ্য নহে। তাই এক শ্রেণীর মানুষ উহাকে বলে ভৌতিক অর্থাৎ ভূতের আশ্রয়।
ভূতে পাওয়া রোগীরা কখনও হাসে, কখনও কাঁদে, কখনও নাচে বা গান গায়; কেহ আবোলতাবোল বকে, কেহবা গুম হইয়া বসিয়া থাকে ইত্যাদি।
ভূতে পাওয়া রোগ– ১. শিক্ষিত অপেক্ষা অশিক্ষিতের মধ্যে বেশি, ২. শহর অপেক্ষা গ্রামাঞ্চলে বেশি, ৩. পুরুষ অপেক্ষা নারীর বেশি এবং ৪. শিশু ও বৃদ্ধ অপেক্ষা যুবক-যুবতী বা মধ্যবয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
রোগের কারণ– ১. সুশিক্ষিত ব্যক্তিরা কুসংস্কারমুক্ত এবং অশিক্ষিতরাই নানাবিধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। উহারা যে কোনো রোগ বিশেষত মানসিক রোগের দায় কথায় কথায় দেও, পরী বা ভূতের মাথায় চাপাইয়া থাকে। ২. সাধারণত শহর হইতে পল্লী অঞ্চলে অশিক্ষিতের সংখ্যা বেশি। উহারা যে কোনো মানসিক বিকৃতিকে ‘ভূতের দৃষ্টি’ বলিয়া, এমনকি কলেরা-বসন্তকেও ‘ওলা’ এবং শীতলা’র উৎপাত বলিয়া মনে করে। ৩. মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের মতে উন্মাদ রোগ অধিকাংশই প্রণয় বা কাম ঘটিত। উহার মূল কারণ হইল যৌনমিলনে বিফলকাম হওয়া। উহার ডাক্তারী নাম নিম্ফম্যানিয়া বা কামোন্মাদ। কামঘটিত ব্যাপারে পুরুষদের অপেক্ষা নারীরাই বিফলকাম হয় বেশি, তাই উহাদের কামোন্মাদ রোগ বনাম ভূতের দৃষ্টিও বেশি, বিশেষত যৌবনে। ৪. অনেক চিকিৎসকের মতে রমণীদের মাসিক ঋতুর বা প্রসবান্তে জরায়ুর গোলমালের জন্য অনেক ক্ষেত্রে উন্মাদ রোগ জন্সিয়া থাকে। রমণীদের শৈশব ও বার্ধক্যে উহার কোনোটিই থাকেনা, থাকে যৌবনে। কাজেই মধ্যম বয়সী রমণীদের উন্মাদনা বা ভূতের আশ্রয়ও বেশি। এতদ্ভিন্ন নানাবিধ কারণে মানুষের মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটিয়া থাকে। পল্লী অঞ্চলে ঐগুলির দায়ও ভূতের মাথায় চাপানো হয়। বস্তুত দেও, পরী, ভূত ইত্যাদি নামের কোনো জানোয়ার দুনিয়ায় নাই।
.
# শপথ
মহাপ্রবরদের যুগে একটি প্রথা ছিল এই যে, যদি কোনো ব্যক্তির শপথ করিবার আবশ্যক হইত, তবে যাহার কাছে শপথ করা হইত, শপথকারী তাহার লিঙ্গ স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞাপূর্বক শপথ করিত। (জেনেসিস ২৪; ৯, ৪৭ )
ঐরূপ কোনো কিছু স্পর্শ করিয়া শপথ করিবার রেওয়াজ এখনও আছে। শপথ করিতে হইলে এইদেশের হিন্দুরা স্পর্শ করেন তামা ও তুলসী, মুসলমানে পবিত্র কোরান এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে স্পর্শ করেন পুত্রের মাথা।
.
# জাদু
আদিম মানুষদের মধ্যে শত্ৰুনিপাতের উপায় হিসাবে কতগুলি প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস ছিল, উহাকে বলা হয় জাদু। জাদু কথাটিকে ইংরাজিতে বলে ম্যাজিক। কিন্তু আলোচ্য জাদু কথাটির ইংরাজি একটু অন্য রকম। জাদুবিশ্বাস দুই রকম। উহার ইংরাজি নাম –কটেজিয়াস ম্যাজিক ও ইমিটেটিভ ম্যাজিক।
মনে করা যাক, কোনো শত্রুকে জাদু দ্বারা বধ করিতে হইবে। এখন উহার ব্যবস্থা হইল– শত্রুর চুল, নখ বা কাপড়ের খুঁট কাটিয়া আনিয়া উহা আগুনে পোড়াইয়া ফেলা। ইহাতে শত্রু জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিবে। এইরূপ বিশ্বাসকে বলা হয় কনটেজিয়াস ম্যাজিক।
আবার শত্রুর একটি মূর্তি তৈয়ার করিয়া উহার গায়ে একটি তীর বিদ্ধ করা হইল এবং মনে করা হইল যে, ইহাতে শত্ৰুটির দেহ ধীরে ধীরে ক্ষয় পাইয়া শেষে সে মারা যাইবে। এইরূপ বিশ্বাসকে বলা হয় ইমিটেটিভ ম্যাজিক।
উক্ত দুই প্রকার ম্যাজিক বা জাদুর প্রচলন হাল আমলেও এইদেশের গ্রামাঞ্চলে কিছু কিছু আছে। উহার গ্রাম্য নাম বাণ বা টোনা।
.
# ইন্দ্রজাল
পুরাকালে এক রকম বিদ্যা ছিল ইন্দ্রজাল। উহাতে ছিল নানারূপ ভূত-প্রেত ও ডাকিনী-যোগিনীর কল্পনা, যথা –উগ্রচণ্ডী, ভৈরবী, বাসুকি ইত্যাদি; নানারূপ বিদঘুঁটে পদার্থ, যথা –চিতার কয়লা, দাঁতের ময়লা, মরা মানুষের মাথার খুলি ইত্যাদি এবং নানাবিধ তন্ত্র-মন্ত্র। মারণ, স্তম্ভন, উচাটন ও সম্মোহন ইত্যাদি কাজের জন্য দরকার হইত ভিন্ন ভিন্ন সময়ের, যথা –কালীসন্ধ্যা বা অন্ধকার গভীর রজনী, শনি বা মঙ্গল বার, অমাবস্যা তিথি ইত্যাদি; ভিন্ন ভিন্ন স্থান, যথা –তেপথা, চিতাখোলা, বিজন বন ইত্যাদি এবং ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্র ও আসন। সাধক যথাবিহিত আসনে উপবেশনপূর্বক যথারীতি অনুষ্ঠান পালন করিলেই ঈপিত ফললাভ হইয়া থাকে। এই সবে বিশ্বাসের আমেজ এখনও কিছু কিছু আছে।
হাজার হাজার বৎসর পূর্বে, ধাতুযুগের প্রারম্ভে আসিরিয়া দেশে একটি অদ্ভুত আচার প্রচলিত ছিল। এখন আমরা ধাতুদ্রবণকে মনে করি যে, উহা একটি বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা বা রাসায়নিক ক্রিয়া। কিন্তু সেই যুগের আসিরিয়াবাসীদের ধারণা ছিল অন্য রকম। তাহারা যখন দেখিত যে, দুইটি ধাতুপদার্থ একত্রে গলাইলে একটি অভিনব পদার্থের সৃষ্টি হয় এবং পাথরাদি হইতে লৌহাদির উৎপত্তি হয়, তখন তাহারা উহাকে মনে করিত ইন্দ্রজাল বলিয়া। এই বিদ্যার অধিকারী সকলে নহে, শুধু একশ্রেণীর কারিগর। যেমন আমাদের দেশের কামার, কুমার ইত্যাদি শিল্পীরা। এইটি ছিল একটি গুপ্তবিদ্যা। কতগুলি রহস্যাত্মক ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে এই বিদ্যাটি জড়িত ছিল। আসিরিয়ার কয়েকটি শিলালিপিতে এই অনুষ্ঠানগুলির বিবরণ পাওয়া যায়। অত্যন্ত বীভৎস রকমের অনুষ্ঠান। কার্য আরম্ভের পূর্বে নবগভিনী রমণীর ও তাহার গর্ভস্থ সূণের রক্ত দিয়া অনুষ্ঠান সম্পন্ন হইত। বর্তমানে অনেক আদিম জাতির কারিগরেরা ঐন্দ্রজালিক এক্রিয়াব পর কার্য আরম্ভ করে। এখন আমাদের দেশের কারিগরেরা করেন বিশ্বকর্মা পূজা এবং রক্তের বদলে ব্যবহার করেন সিন্দুর।[৩৭]
.
# শুভাশুভ লগ্ন ও খনার বচন
যাত্রা বা কোন কার্যারম্ভে শুভাশুভ কাল নির্ণয়ের ঝোঁক এই দেশে কম নহে। স্বদেশে, বিদেশে, এমনকি কোনো উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘরের বাহিরে যাইতে হইলেই শুভাশুভ কাল নির্ণয়ের চেষ্টা অনেকে করিয়া থাকেন। এই বিষয়ে দেশীয় পঞ্জিকাগুলিই প্রধান শিক্ষক। তিথি, বার, নক্ষত্র এবং অমৃত, মাহেন্দ্র ও শূলযোগের দোষ-গুণ বিচার না করিয়া কোথায়ও যাত্রার বা কোনো কাজে হাত বাড়াইবার নিয়ম নাই। বিবাহ, দ্বিরাগমন, সাধভক্ষণ ও অন্নপ্রাশন হইতে আরম্ভ করিয়া শিক্ষা দীক্ষা, হল প্রবাহ ও বীজবপনাদি কোনো কাজেই পঞ্জিকার লিখিত তারিখ ও সময় ভিন্ন এক মিনিট এদিক ওদিক করা একেবারেই নিষেধ। সুখের বিষয় এই যে, রেল, স্টিমার, কোর্ট-কাঁচারি বা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এখন আর ঐ বিষয়ে আমল দেওয়া হয় না।
“দিকশূল” কথাটি নাকি খুব ভয়ানক। শুক্র এবং রবিবারে পশ্চিমে দিকশুল। ঐরূপ মঙ্গল ও বুধবারে উত্তরে, শনি ও সোমবারে পূর্বে এবং বৃহস্পতিবারে দক্ষিণে দিকশূল। দিকশূলে যাত্রা করিলে যাত্রীর নাকি মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ঐসব মানিয়া চলিলে ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি।
বার বা মাস মাহাত্মের প্রচারণাও এই দেশে কম নহে। ভিন্ন ভিন্ন বার বা মাসের গুণাগুণ নাকি ভিন্ন ভিন্ন। কোনো কোনো বার বা মাস নাকি অতি উৎকৃষ্ট, আবার কোনো কোনো বার বা মাস নাকি অতি নিকৃষ্ট (শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা বা ফসল উৎপাদনের জন্য নহে)। কেহ কেহ বলেন, জন্মমাস বা জন্মবার-এ বিবাহ নিষিদ্ধ। কেহ কেহ এই কথাও বলিয়া থাকেন যে, ভালো বার বা ভালো মাসে জন্সিতে বা মরিতে পারিলেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
এইদেশে খনার বচন’ বলিয়া কতক শ্লোক প্রচলিত আছে এবং উহার অনেকগুলিতে আছে শুভাশুভ কাল নির্ণয়ের নির্দেশ। এইখানে উহার একটি নমুনা দেওয়া গেল।
“শূন্য কলসি, শুকনা না’, শুকনা ডালে ডাকে কা’,
যদি দেখ মাকুন্দ চোপা, এক পা না বাড়াও বাপা,
খনা বলে একেও ঠেলি, যদি সামনে না দেখি তেলি।”
অর্থাৎ জলহীন কলসি, আরোহী বা মালহীন নৌকা, মাকুন্দ অর্থাৎ দাড়ি-গোফ গজায় না এরূপ ব্যক্তি (মতান্তরে ধোপা) দৃষ্টিপথে পতিত হইলে এক পদও অগ্রসর হওয়া নিষেধ। যদি কোনো কারণে ইহার অন্যথা করাও হয়, তথাপি কলুর মুখ দেখিলে নিশ্চয়ই সেই যাত্রা ত্যাগ করিবে। বর্তমানে অয়েল মিলের মালিকেরাও কলু নামের আওতায় পড়ে, কিন্তু তাহাদের নিয়া যাত্রাভঙ্গের প্রশ্ন উঠে না।
খনার মতে, হাঁচি ও টিকটিকির শব্দ হইলে উহা কোন্ দিকে হইল এবং সাপ, শিয়াল, নেউল (বেজি) ইত্যাদি পথ ডিগাইলে, উহা কোন পার্শ্ব হইতে কোন পার্শ্বে গেল, তাহাও যাত্রার শুভাশুভ নির্দেশ করে। ডান বা বাম নাকে শ্বাস-নিঃশ্বাস চলাচলের তারতম্যও নাকি যাত্রাকালীন শুভাশুভ নির্দেশক।
.
# ভাগ্য
ফলিত জ্যোতিষ (Astrology)-এর সিদ্ধান্তমতে, প্রতিটি মানুষ জন্মিবার কালেই নক্ষত্রাদির সমাবেশে এক একটি রাশি প্রাপ্ত হয়। ইহাকে বলা হয় জন্মরাশি। মেষ, বৃষ, মিথুনাদি রাশির সংখ্যা বারোটি। মানুষ জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত যে রোগ, শোক, দুঃখ, পুত্র, কন্যা, বিত্ত-সম্পদ ও মান-অপমান ইত্যাদির অধিকারী হইয়া থাকে ইহার নিয়ামক তাহার রাশি। আবার কেহ কেহ বলেন যে, উহা রাশি নহে, ভাগ্য।
কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের যাবতীয় ঘটনাই নির্ধারিত হয় তাহার জন্মিবার বহু আগে ও তাহা লেখা থাকে তাহার ভাগ্যলিপিতে। বাঁচা, মরা, খাওয়া-দাওয়া এবং আয়-ব্যয়ের উপর মানুষের কোনো হাত নাই, উহা সমস্তই ভাগ্যলিপির ফল।
সুখের বিষয় এই যে, আজকাল প্রায় সকল মানুষই অদৃষ্টবাদ বনাম কুঁড়েমিবাদ পরিত্যাগ করিয়া কর্মবাদ গ্রহণ করিতেছেন এবং পৃথিবী হইয়া উঠিতেছে কর্মমুখর।
.
# সতীদাহ
প্রাচীন ভারতের একটি বিশেষ প্রথা অধুনালুপ্ত সতীদাহ। রমণী মরণান্তে অনন্তকাল স্বামীসহ স্বর্গবাস করিবে– এই বিশ্বাসের ফলেই সতীদাহ প্রথার প্রচলন হইয়াছিল।
সতীদাহ দুই রকম –সহমরণ ও অনুমরণ। পতির দেহের সহিত একত্রে দগ্ধ হওয়া সহমরণ এবং দূরদেশস্থ পতির মৃত্যু হইলে দেহের অভাবে পতির ব্যবহার্য কোনো দ্রব্য লইয়া চিতানলে দগ্ধ হওয়া অনুমরণ। গর্ভবতী রমণীর সহমরণে যাইবার অধিকার ছিল না। কিন্তু সন্তান প্রসবের পর অনুমরণের বিধান ছিল। পতির মৃত্যুর পর সহমরণাভিলাষিনী রমণী একটি আম্রপল্লব হস্তে ধারণ করিত। নববিধবা আম্রপল্লব ধারণ করিলেই ‘সহমরণে কৃতসংকল্পা’ বলিয়া লোকে বুঝিতে পারিত। মৃত ব্যক্তির একাধিক স্ত্রী থাকিলে বিষম গোলযোগ উপস্থিত হইত। কেননা একাধিক রমণীর সহমরণে অধিকার ছিল না। শাস্ত্রজ্ঞ গুরু-পুরোহিত বা আত্মীয়-স্বজনগণ গোলযোগ নিষ্পত্তি করিয়া একজনকেই নির্বাচন করিতেন। সহমরণোদ্ধতা রমণী রক্তবস্ত্র পরিধান করিয়া এবং সিন্দুর ও অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া পতির শবের অনুগমন করিত। অগ্রে শবদেহ বাহিত হইত। সতী শবের পশ্চাতে চলিত এবং তাহার পশ্চাতে আত্মীয়বর্গ ও কতিপয় ব্যক্তি ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গাদি বাদ্য করিতে করিতে হরিধ্বনি করিয়া শ্মশানে উপস্থিত হইত। তথায় দুই হাত প্রশস্ত, তিন হাত দীর্ঘ এবং তিন হাত উচ্চ চিতা সজ্জিত হইত। সতী পতিকে আলিঙ্গনপাশে আবদ্ধ করিয়া চিতার উপর শয়ন করিত। তখন চিতায় অগ্নিসংযোগ করা হইত। সতী সহাস্যবদনে প্রজ্জ্বলিত চিতামধ্যে থাকিয়া পতিসহ ভস্মীভূত হইত। কোনো রমণী যদি চিতা দেখিয়া ভয়। পাইত, তবে তাহাকে গৃহে ফিরাইয়া আনা হইত। কিন্তু চিতায় আরোহণ করিয়া ভয় পাইলে বা : প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করিলে তাহাকে বলপূর্বক দাহ করা হইত।
এই বিষয়ে ‘পদ্মপুরাণ’-এ একটি উপাখ্যান দৃষ্ট হয়। উপাখ্যানটি এইরূপ –
দেবরাজ ইন্দ্র একদা শিবলোকে এক ভয়কর পুরুষকে দেখিয়া তাহার পরিচয় জানিতে চাহিলে, সে তাহার কোনো উত্তর না দেওয়ায় ইন্দ্র কুদ্ধ হইয়া তাহাকে বজু দ্বারা আঘাত করেন। ইহাতে আগন্তুক পুরুষের ললাট হইতে অগ্নি নির্গত হইয়া ইন্দ্রকে জ্বালাইতে থাকে। তখন। আগন্তুক পুরুষকে রুদ্র বলিয়া চিনিতে পারিয়া ইন্দ্র তাহার স্তব-স্তুতি আরম্ভ করেন। স্তবে তুষ্ট হইয়া রুদ্র তাহার ললাটের অগ্নি সাগর সঙ্গমে নিক্ষেপ করিলে তৎক্ষণাৎ উহা হইতে এক বালক উৎপন্ন হইয়া রোদন করিতে থাকে। সাগর ঐ বালকের জাতকর্মাদি নির্বাহের জন্য ব্রহ্মাকে অনুরোধ করে। ব্রহ্মা বালককে ক্রোড়ে লইবামাত্র সে তাহার দাড়ি ধরিয়া টান দিলে ব্রহ্মার চক্ষু হইতে জলধারা নির্গত হওয়ায় ঐ শিশুর নাম রাখিলেন জলন্ধর। অধিকন্তু ঐ শিশুকে বর দান করিলেন যে, সে অসুররাজ্যের রাজা হইবে এবং শিব ভিন্ন অপর কাহারও হস্তে তাহার মৃত্যু হইবে না।
বয়স্ক হইয়া জলন্ধর কালনেমির কন্যা বৃন্দার পাণি গ্রহণ করে এবং অসুররাজ্যের রাজা হয়। ক্রমে অত্যন্ত পরাক্রমশালী হইয়া দেবরাজ ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া স্বর্গরাজ্য দখল করে। ইহাতে দেবতারা শিবের শরণাপন্ন হইলে শিব জলন্ধরকে বধ করার জন্য তাহার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন। ঐদিকে জলন্ধরের সহধর্মিনী বৃন্দা স্বামীর জীবনরক্ষার্থে বিষ্ণুর স্তব করিতে থাকে এবং বিষ্ণুর অনুকম্পায় জলন্ধর শিবেরও অবধ্য হইয়া উঠে। এই ঘটনা জানিতে পারিয়া দেবতারা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। তখন বিষ্ণু জলন্ধরের রূপ ধারণ করিয়া বৃন্দার নিকট উপস্থিত হইলে বৃন্দা বিষ্ণুর স্তব ত্যাগ করিয়া স্বামীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে এবং সেই অবসরে শিব জলন্ধরকে বধ করেন।
বিষ্ণুর ছল-চাতুরি ও স্বামীর মৃত্যুসংবাদ অবগত হইয়া বৃন্দা হতাশ হৃদয়ে বিষ্ণুকে অভিশাপ দিতে উদ্যতা হইলে বিষ্ণু তাহাকে সান্ত্বনা দিয়া বলিলেন, “তুমি তোমার পতির অনুমৃতা হও, তোমার ভস্মে যে বৃক্ষ জন্মিবে, তাহা আমার স্বরূপ হইবে। ঐ বৃক্ষকে পূজা করিলে আমার তুষ্টি জন্মিবে।”
অতঃপর বৃন্দা বিষ্ণুর উপদেশমতো কার্য করিলে বৃন্দার ভস্ম হইতে তুলসী, ধানী (আমলকি), পলাশ ও অশ্বথ বৃক্ষ উৎপন্ন হইল। হিন্দুগণ এই বৃক্ষচতুষ্টয়কে আজিও দেবতাজ্ঞানে ভক্তি ও পূজা করিয়া থাকেন।
পদ্মপুরাণের লেখক এই কাল্পনিক উপাখ্যানটির মাধ্যমে বিষ্ণুর মুখ দিয়া বৃন্দাকে আer অনুমরণের যে প্রেরণা দিয়া গিয়াছেন, তাহাতে উদ্বুদ্ধা হইয়া যে কত হিন্দু রমণী অকালে প্রাণ বিসর্জন দিয়াছে, কে তাহার সংখ্যা করিবে?
মোগল সম্রাট মহামতি আকবর ইহার নিষেধাজ্ঞা প্রচার করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি ইহা একেবারে রহিত করিতে পারেন নাই। অবশেষে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ কতিপয় দেশীয় লোকের সহযোগিতায় ১৮২৯ অব্দের ৪ ডিসেম্বর এক আইন করিয়া এই প্রথা রহিত করিয়া দেন। উক্ত আইনের মর্ম এই যে, অতঃপর যে কেহ সতীদাহে সহায়তা করিবে, সে ‘অপরাধযুক্ত নরহত্যা’ অপরাধে অপরাধী হইয়া দণ্ডনীয় হইবে। তদবধি হিন্দুদের সতীদাহ প্রথা স্থগিত আছে।
সতীদাহ প্রথা রহিতকরণে বেন্টিক সাহেবের সপক্ষে ছিলেন মাত্র গুটিকয়েক হিন্দু, গোড়ারা ছিলেন বিপক্ষে এবং অধিকাংশই ছিলেন মনোক্ষুণ্ণ। তখন হিন্দু ভারত স্বাধীন থাকিলে ঐ প্রথাটি বোধ হয় আজও প্রচলিত থাকিত। ভারত এখন স্বাধীন দেশ, কে জানে ভারত সরকার উহা পুনঃ প্রবর্তন করিবেন কি না!
.
# ভবিষ্যত গণনা
মানুষের ভবিষ্যত জানিবার কৌতূহল খুবই পুরাতন ও ব্যাপক এবং উহার জন্য নানা দেশে নানাবিধ নিয়ম প্রচলিত আছে। ভবিষ্যত জানিবার জন্য কয়েকটি অদ্ভুত প্রথা ছিল প্রাচীন ব্যাবিলোনিয়ায়। কোনো ব্যক্তির কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যের ভবিষ্যত শুভাশুভ জানিতে হইলে সে। একটি পশু বলিদান করিত এবং সেই পশুর যকৃতের উপরিস্থ রেখা বা দাগ দেখিয়া জানিয়া লওয়া হইত যে, বলিদাতার উদ্দেশ্যটির ভবিষ্যত শুভ কি অশুভ। ব্যাবিলোনিয়ার কোনো রাজাই নাকি উক্ত প্রথায় ফলাফল না জানিয়া যুদ্ধে যাইতেন না। এইরূপ প্রথা রোমানদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল।
ঐ দেশে আর একটি প্রথা ছিল তৈল দ্বারা ভবিষ্যত জানা। কতগুলি পশু-পাখি বা পদার্থকে মনে করা হইত ভালো এবং কতগুলিকে মন্দ; আমরা যেমন ময়না, টিয়া পাখি ও জলপূর্ণ কলসি ভালো জানি, কিন্তু কাক, পেঁচক ও শূন্য কলসি ভালো জানি না। কোনো একটি জলপূর্ণ পাত্রে এক ফোঁটা তৈল ফেলিয়া লক্ষ্য করা হইত যে, উহা কি রকম আকৃতি ধারণ করে এবং সেই আকৃতি দেখিয়াই জানিয়া লওয়া হইত উদ্দেশ্যটির ভবিষ্যত শুভ কি অশুভ।[৩৮] এই ধরণের প্রথা কোনো কোনো অঞ্চলে প্রকারান্তরে এখনও প্রচলিত আছে।
এই দেশেও ভবিষ্যত জানার জন্য কয়েক রকম চেষ্টা প্রচলিত আছে। আগামী অমাবস্যা, পূর্ণিমা, চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ, ধুমকেতুর উদয় ইত্যাদির বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে গণিত জ্যোতিষ (Astronomy) এবং যান্ত্রিক উপায়ে পাইয়া থাকি আবহাওয়ার পূর্বাভাস। আবার কেহ কেহ হাত বা কররেখা দেখিয়া কোনো ব্যক্তির জীবনের ভূত-ভবিষ্যত ও বর্তমানের সমস্ত ঘটনাই আগাম বলিয়া দেন। কাক, পেঁচক ও হুতুম পাখির ডাকও নাকি মানুষের ভবিষ্যত শুভাশুভের ইঙ্গিত করে এবং চক্ষুস্পন্দন, গাত্রচর্মের শিহরণও নাকি মানুষের ভবিষ্যত শুভাশুভের সংবাদ বহন করে।
এই দেশে প্রচলিত অনেক খনার বচন-এ ভবিষ্যত জানার উপায় বর্ণিত আছে। উহার একটি নমুনা–
(গর্ভস্থ সন্তান গণনা )
গ্রাম গর্ভিনী ফলে যুথা, তিন দিয়ে হর পুতা;
একে সুত, দুয়ে সুতা, শূন্য হলে গর্ভ মিথ্যা।
এ কথা যদি মিথ্যা হয়, সে ছেলে তার বাপের নয়।
অর্থাৎ যে গ্রামে গর্ভিনী বাস করে, সেই গ্রামের ও গর্ভিনীর নামের অক্ষরসংখ্যা এবং প্রশ্নকর্তা একটি ফলের নাম বলিবে, সেই ফলের নামের অক্ষরসংখ্যা একত্র করিয়া যোগফলকে তিন দ্বারা ভাগ করিতে হইবে। ভাগশেষ এক থাকিলে পুত্র, দুই থাকিলে কন্যা এবং শূন্য থাকিলে বুঝিবে যে, সেই গর্ভে সন্তান নাই। যদি কখনও এই গণনার ব্যতিক্রম হয়, তবে সেই সন্তানটি তাহার পিতার নহে, অর্থাৎ জারজ।
.
# ঠুকনো
প্রাচীনকালের ইহুদি পুরোহিতগণ তাহাদের শিষ্যদের এমন কতগুলি বিষয় শিক্ষা দিতেন, যাহা একান্তই তাহাদের অলীক কল্পনা। অথচ শিষ্যরা তাহা মনে প্রাণে বিশ্বাস ও প্রতিপালন করিত। পুরোহিতদের সেই সকল শিক্ষার কতগুলি বিষয় স্থান পাইয়াছে উহাদের তালমুদ গ্রন্থের ‘গেমারা’ অংশে। কালক্রমে উহা ভাষান্তরে (হয়তো বা রূপান্তরেও) বিস্তার লাভ করিয়াছে অন্যান্য জাতির মধ্যে। তালমুদীয় শিক্ষাগুলি এইরূপ —
১. বাড়িতে ভোজদ্রেব্য ঝুলাইয়া রাখিলে দারিদ্র দেখা দেয়।
২. বাড়িতে খুদ-কুঁড়া রাখিলে অভাব দেখা দেয়।
৩. বদনার মুখে ময়লা থাকিলে অভাব দেখা দেয়।
৪. প্লেট হইতে জল পান করিলে চক্ষে ছানি পড়ে।
৫. হাত না ধুইয়া রক্ত মোক্ষণ করিলে ৭ দিন বিভীষিকাদর্শন হয়।
৬. নাসারন্ধে হাত দিবার ফল বিভীষিকাদর্শন।
৭. কপালে হাত রাখিবার ফল নিদ্রা।
৮. খাদ্যদ্রব্য লৌহপাত্রে ঢাকা দিয়া রাখিলে উহা দানবের আশ্রয়স্থল হয়। ইত্যাদি।
এই দেশেও ঐ ধরণের কতগুলি প্রথা আছে, যাহা গ্রামাঞ্চলে বেশ প্রচলিত। যেমন—
১. লাউ, কুমড়া বা সীমের মাচায় কালো পাতিল রাখা। উহাতে নাকি লোকের কুদৃষ্টি এড়ানো যায় এবং গাছ সতেজ হয়।
২. শিশুর গলায় রুদ্রাক্ষ, ঝাটার শলা, তাবিজ-কবচ দেওয়া এবং কপালে তিলক কাটা। উহাতে নাকি ভূতপ্রেত বা দেও-দানবের আছর ও রোগের প্রকোপ এড়ানো যায়।
৩. মেয়েলোকের যমজ ফল না খাওয়া। খাইলে নাকি যমজ সন্তান হয়।
৪. সাধু-সজ্জন ও দেবতার নামে ছেলে-মেয়েদের নাম রাখা। ইহাতে নাকি দেশে চোর, বদমায়েশ ও অসৎ লোক কমিয়া থাকে।
৫. নানাবিধ রোগারোগ্য ও অভীষ্টসিদ্ধির জন্য মানত করা। ইত্যাদি।
————
৩৪. প্রাচীন মিশর, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৪৬।
৩৫. প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ ১১৩-১১৫।
৩৬. প্রাচীন প্যালেস্টাইন, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ২১৩-২১৮।
৩৭. প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৮, ৯।
৩৮. প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১০৪।